রাগে গজগজ করতে করতে ফোনটা খাটের উপর ছুড়ে ফেলে দিয়ে বেরিয়ে গেল নিবেদিতা। ওপাশের ফোনের লাইন টা তখন ও কেটে যায় নি।
“হ্যালো নিবু হ্যালো…শুনতে পাচ্ছো।
নিবু মানে নিবেদিতা তখন মাথায় ৪৪০ভোল্ট কারেন্ট নিয়ে বাথটাবে চোখ বন্ধ করে মেডিটেশন করছে।
এবার আসি আসল কথায়, যাকে নিয়ে আলোচনা তিনি হলেন নিবেদিতা ঘোষ গড়িয়া হাটে এক বড়লোক ব্যবসায়ীর একমাত্র কন্যা, মা মারা গিয়েছে অনেক ছোট বেলায়। কাজের মাসির কাছেই মানুষ। বাবা সারাদিন ব্যাবসা নিয়ে ব্যাস্ত, মেয়ের সময়ের চাহিদাকে কে দামীপন্য দিয়ে ভরিয়েছেন। যত দিন গেছে নিবেদিতা ঘোষ একটি আস্ত গেছো বাঁদরি তে পরিণত হয়েছে।
বর্তমানে নিবেদিতা বিবাহ সূত্রে বারাসাতের একটি বিলাস বহুল ফ্ল্যাটের একমাত্র অধিকারিণী। তার বেচারা স্বামীটি ভয়ে সর্বক্ষণ মুখে কুলুপ এটে থাকে। বড়লোকের আহ্লাদি মেয়ের সাথে প্রেম করার ফল হাতে নাতে ভুগছে সে।
কেন বলছি শুনুন হটাৎ করে বিয়ে ঠিক হবার দুদিন আগে তার মনে হলো বাড়িথেকে যেভাবে বিয়ের আয়োজন করেছে তাতে কোনো মজা নেই, অ্যডভেঞ্চার চাই লাইফে। প্রেমে অন্ধ আস্ত বলদটিকে নিয়ে তিনি হাজির হলেন কালীঘাটে। বিয়ের দুদিন আগে জিন্স টিশার্ট পড়ে বিয়ে করে ঘরে ফিরে এসে জানায় আমরা বিয়ে করে ফেললাম। ওইসব অনুষ্ঠান ফালতু ,সব ক্যান্সেল করো।
এই পাগলীর পাল্লায় পড়ে দুই বাড়ির জীবন ওষ্ঠাগত। বিয়ের দুদিন পরেই শাশুড়ি মা লোটা কম্বল নিয়ে দেশের বাড়ি পালিয়েছেন। আগে তিনি বছরের মধ্যে সাত আট মাস ছেলের কাছেই থাকতেন, কিন্তু গত ছয়মাসে একটি বারও তার ছেলের কাছে ফেরার প্রবৃত্তি হয় নি, মানে বলতে পারেন সাহসে কুলোয় নি।
এবার আসি মহারানীর মাথা গরমের আসল কারণে। নিবেদিতার স্বামী অভির দেশের বাড়ি সিংহীগঞ্জে, বর্ধমান স্টেশনে নেমে আরো তিরিশ কিলোমিটার দুরে ধাত্রীগ্রামের লাগোয়া একটি প্রত্যন্ত গ্রাম। অভির পরিবার সেখানেই আছে, অভির দিদুনের শরীর খারাপ, কোনো সময় খারাপ খবর আসতে পারে। অভির ইচ্ছে করেই এই পুজোয় সিংহীগঞ্জে যাবার প্ল্যান করেছে। সেই খবরের প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে বারাসতের ওই ফ্ল্যাটে।
-না না অভি এই পুজোর সময় ওই অজ পাড়াগাঁয়ে আমি যাবো না। কোনো প্রশ্নই ওঠে না। আমি বরং বাপির কাছে যাচ্ছি, তুমি একাই যাও। কথাগুলো বলে শোবার ঘরের দরজা দড়াম করে বন্ধ করে দিলো।
অভি ভাবলাকান্তের মত খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে বুঝলো আজ আর সিংহীর গুহায় প্রবেশ হবে না, রাতের খাবার খেয়ে অন্য ঘরে ঘুমাতে গেল।
পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে টেবিলের ওপর একখানা চিঠি, লিখেছেন
“শোনো অভি, আমি বাপির কাছে যাচ্ছি, তুমি তোমার বাড়ির লোকের সাথে পুজো কাটাও আমি ও আমার বন্ধুদের সাথে এনজয় করবো।”
বাড়িতে গিয়ে নিবেদিতা জানতে পারে বাপি দিন সাতেকের জন্য আমেদাবাদ গেছে, বাবলু কাকার ওপর দোকানের ভার দিয়ে। মাথাটা আবার গরম হয়ে গেছে,
” ইশ তাহলে এবার পুজোয় পুরো একা। ওদিকে নিশা, রিমঝিম, পুকাই সবাই নিজের বয়ফ্রেন্ডকে নিয়ে ঘুরবে তাহলে আমি কি করি? অগত্যা ফিরতেই হবে। দুদিন বাদে যাবো না হলে অভি আবার আমায় নিয়ে মজা করবে।”
আজ পঞ্চমী, সারাদিন ঘুমিয়ে রাতে গাড়ি নিয়ে নিবেদিতা চললে বারাসাত, বাড়ির ড্রাইভার খানিক ইচ্ছে করেই একডালিয়া, মহাম্মদ আলী পার্ক, একুশ পল্লী, যাদবপুর সর্বজনীন সব প্যান্ডেলে ঘুরিয়ে আদরের নিবু দিদিকে পৌঁছে দেয় বারাসাতে। আলোয় মোড়া গোটা শহরে, কোথাও সাবেকিয়ানা আবার কোথাও থিমের পুজো। বিভিন্ন মন্দিরের আদলে গড়ে উঠেছে প্যান্ডেল। নিবু খুব খুশি হয়েছে। বিয়ের পর এই প্রথম পুজো,তিলোত্তমা যেন নবরূপে সেজে উঠেছে। সেই ছোট্ট বেলা থেকে এই পুজো গুলোতে যায় তবুও এতটুকু টান কমেনি, বরং উত্তরোত্তর আকর্ষণ বেড়েছে।
রাত দুটো নিবু চাবি খুলে ঘরে ঢুকে দেখে অভি বসে আছে ড্রয়িং রুমে। নিবুকে দেখেই বলে
“চল বারাসাতের ঠাকুর গুলো দেখে ওই গাড়িতে করেই বেরিয়ে যাবো সিংহীগঞ্জে।”
নিবেদিতা বুঝলো যে সব প্ল্যান করা, ড্রাইভার কাকু মিচকি মিচকি হাসছে। আবার রাগ হচ্ছে নিবেদিতার।
“না এখন রাগ না আগে ঠাকুর গুলো দেখেনি তারপর দেখছি দুজন কে!!”
ঠাকুর দেখতে দেখতে ভোর হয়ে গেছে। বারাসাত থেকে বর্ধমান পৌঁছাতে সময় লাগলো ঘন্টা চারেক। বাবা বীরেশ্বরের মন্দির দর্শন করে সিংহীগঞ্জে পৌছালো তখন বেলা পড়ে এসেছে।
শরতের আকাশে পেঁজা পেঁজা তুলোর মতো মেঘেরা অবিশ্রান্ত ছুটে বেড়াচ্ছে সারা আকাশময়,বাতাসে বেশ একটা পুজো পুজো গন্ধ। নিবেদিতা কোনোদিন গ্রামের পুজো দেখিনি শুধু যে সর্বক্ষণ দেখাশুনা করতেন মলিনা মাসির কাছে ছোট্ট বেলায় গল্প শুনেছে। অভির গ্রামটা ছোট, চারিদিকে সবুজে সবুজ। অভি খেয়াল হলো নিবুর মুখে সেই কপট রাগের ছোঁয়া নেই, তার জায়গায় চোখেমুখে একটা শান্তির ছোঁয়া।
পৌঁছে পরিচয় পর্ব সাঙ্গ করে নিবেদিতা বাড়ি ঘুরে দেখছে, মনে মনে ভাবছে
” কত বড়ো বাড়ি মলিনা মাসি যেমন গল্প বলতো ঠিক তেমনি ঠাকুর দালান,বড়ো বড়ো
ঘর,উঠোন,পুকুর,বাগান সব আছে।”
অভির দিদার শরীর এখন অনেকটা ভালো, অল্প অল্প কথা বলছেন, খুব খুশি হয়েছেন তার নাথ বউ কে দেখে।
দিদুন খুব মিশুকে, গায়ে একটা অদ্ভুত গন্ধ আছে ঠিক যেন মা মা গন্ধ। নিবুর মনে খুব অল্প স্মৃতি আছে তার মাকে নিয়ে, কিন্তু তার আজ ও সেই গন্ধটা মনে আছে। সুগন্ধী তেল, ধুপকাঠি আর তরকারির গন্ধ মিলিয়ে একটা অপূর্ব সুন্দর মা মা গন্ধ যেটা আজ এত বছর পর আবার নিবু উপলব্ধি করলো।
“দিদুন আজকে আমি তোমার সাথে ঘুমাবো, গলা জড়িয়ে ধরে বলে”।
নিবুর পরিবর্তন দেখে শাশুড়ি সমেত অভি ভিরমি খাবার উপক্রম। নিজেদের খুব সামলে নিয়েছে, কেননা এই মা চন্ডীকে যদি উল্টে প্রশ্ন করা হয় হতে পারে এখানেই রামলীলা দেখিয়ে দিল। রাতে খাবার খেয়ে যে যার মত ঘুমিয়ে পড়েছে।
সকালবেলা উঠে অভি আর নিবু পুজো প্যান্ডেলে উপস্থিত, লাল সাদা জামদানিতে এত অপূর্ব লাগছে ঠিক যেন মা দুর্গা।ততক্ষনে ষষ্ঠীর পুজো শুরু হয়ে গেছে একটা বেলগাছে নতুন শাড়ি পড়িয়ে তার সামনে ঘট রেখে পুজো চলছে। ছটফটে নিবু চুপ করে বসে কি সুন্দর পুজোর কাজ দেখছে।
পুজো শেষে বাড়িতে ফিরে নিবু ছুটলো দিদুনের ঘরে। হাত মুখ ধুয়ে অভি ও উপস্থিত সেখানে। দিদুনের কোলে মাথা রেখে নিবু গল্প শুনছে। সিংহীগঞ্জ গ্রামের অনেকদিন আগের গল্প।
দিদুন কাঁপা কাঁপা স্বরে বলেন
” রাজা গোপাল চন্দ্র চৌধুরী ছিলেন এই অঞ্চলের জমিদার তার ভয়ে বাঘে গরুতে এক ঘাটে জল খেতো,তিনি প্রজাদের দুর্ভিক্ষের প্রকোপ থেকে বাঁচানোর জন্য এই পুজোর প্রচলন করেন সেই থেকে রীতি মেনে আজও এই পুজো হয়ে আসছে। এখন জমিদারি নেই বাড়ির আর সদস্যরাও সব বাইরে বাইরে তাও পুজোর সময় সবাই একসাথে মিলে মিশে পুজো করেন।”
সন্ধ্যেবেলায় পাশের গ্রামের ঠাকুর দেখতে যাবে, অভির শিউলি ফুল খুব পছন্দ, অভির মা ঘরে একটা কাঁচের পাত্রে জল দিয়ে তারওপর অনেকগুলো শিউলিফুল রেখে গেছেন। সারা ঘর গন্ধে ম ম করেছে। এক অনাবিল আনন্দে মনটা ভরে গেছে দুজনের। বিয়ের পর এই প্রথম চব্বিশ ঘন্টা কেটে গেছে তাও দুজনের ঝগড়া হয়নি একবারও।
আজ সপ্তমী। সকালবেলায় অভি নিবু কে নিয়ে আসে পুকুর ধারে, সেখানে কলাবউ স্নান শঙ্খধ্বনি,উলুধ্বনি,ঢাকের আওয়াজ সব মিলিয়ে একটা মনোরম পরিবেশের সৃষ্টি করেছে। একটা কলাগাছকে স্নান করিয়ে সিঁদুর পরিয়ে সুন্দর করে লালপাড় সাদা শাড়ি পরিয়ে গণেশের পাশে বসিয়ে পুজো হচ্ছে। পুজোর সব নিয়ম নিষ্ঠা এত কাছ থেকে নিবু আগে কোনদিন দেখেনি।
আজ নিবু শাশুড়ি মায়ের সাথে বসে বসে ঠাকুরদালানের কাছে আলপনা দিয়েছে। বেশ একটা গিন্নী গিন্নী ভাব সারা মুখে। যেন কত কাজ করছে। মায়ের কাছে হাত জোড় করে অভি বলে
“মা এই নিবুকেই যেন ফিরে গিয়ে দেখতে পাই। মা চন্ডী রূপ ধারণ যেন না করে।”
আজ অষ্টমী সকাল থেকে ধুপ ধুনোর গন্ধে পুজো মণ্ডপ মাতোয়ারা। সকালের এক প্রস্ত পুজো সাঙ্গ হয়েছে এখন চলছে সন্ধিপূজার আয়োজন নানাবিধ উপাচারে হয় এই সন্ধিপূজা। তারপর সন্ধেবেলা সন্ধারতির পর আর একবার অঞ্জলী । এই দিনগুলো নিবু শুধু পুজো মন্ডপ আর দিদুনের সাথেই কাটাচ্ছে। দুজন অসমবয়সী মানুষের যে এত অল্পদিনে এত নিবিড় বন্ধুত্ব হতে পারে তা এদের না দেখলে বোঝার উপায় নেই। খুব ভালো খবর হলো নিবু আসার পর দিদুন খুব তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠেছেন।
কাল নবমী, পুজো শেষ নিবু দিদুন কে নিয়ে মণ্ডপে যায়। শরীর দুর্বল কিন্তু নিবু নাছোড়বান্দা
“একবার তোমায় যেতেই হবে দিদুন, না হলে আর আসবো না”।
অবাধ্য বন্ধুর আবদার রাখতে হবে। সবাই মিলে যখন উপস্থিত হলো পুজো মণ্ডপে
তখন পাঁঠাবলি হচ্ছে,সাথে কামান দাগা । কলকাতা থেকে যাত্রা দলের লোক এসেছে। সারা গ্রামের লোক আজ উপস্থিত সেখানে। যাত্রা দেখে একটু রাত করেই বাড়ি ফেরে অভি আর নিবু।
সকালে ঘুম থেকে উঠতে দেরি হয়ে যায়। আজ আবার অপরাজিতা পুজো ,সকাল থেকেই সবাই ঠাকুর বরণ ঠাকুর বিসর্জনের কাজে ব্যাস্ত। সকালে উঠে দিদুনের ঘরে ঢুকে দেখে সবার মুখে কাঁদো কাঁদো, চোখে জল। কাল রাতে খুব শরীর খারাপ হয়েছে, প্রেসার একদম কম। ডাক্তার এসে কোনো আশার কথা বলেনি।
“কাল যদি জোর না করতাম তাহলে দিদুনের হয়তো শরীর খারাপ হতো না।” বলে ডুকরে কেঁদে ওঠে নিবেদিতা।
খুব মন খারাপ নিয়ে ঠাকুর বরণ করতে যায় নিবু। মায়ের মুখে মিষ্টি ছুঁয়ে একটাই প্রার্থনা করে
“মা দিদুন কে সুস্থ করে দাও। ”
চোখের কোণা চিকচিক করে ওঠে। হাত জোড় করে মায়ের কাছে আকুল আবেদন করে তখনই কেউ যেন কানের কাছে এসে বলে
“আজ রাতে আমি আসবো।”
পিছনে ফিরে দেখে কেউ কোথাও নেই।
সন্ধ্যে থেকেই দিদুনের জ্বরটা বেড়েছে। পাড়ার সবাই বিসর্জনে গেছে, অভির বন্ধুরা জোর করে অভিকে ও নিয়ে গেছে। অভির মা রান্নাঘরে রাতের রান্না করছে, নিবু বসে আছে দিদুনের মাথার কাছে। জলপট্টি দিচ্ছে। চুপচাপ বসে থাকতে থাকতে নিবু ঘুমিয়ে পড়ে।
হটাৎ একটা সুন্দর গন্ধ,সাথে সেই চুড়ির আওয়াজ শুনে নিবু চোখ খুলে দেখে এক গ্রাম্যবধূ ঘরের চারপাশে দন্ডী কাটছে। নিবু এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে, দন্ডী কাটা হলে চারিদিকে জল ছড়িয়ে নিবুর দিকে তাকিয়ে বলে
“যা আর কোনো ভয় নেই, এ গন্ডী অতিক্রম করার সাধ্য কারোর নেই।”
কথা গুলো বলতে বলতে হাওয়ায় মিলিয়ে যায় সেই গ্রাম্যবধূ। নিবু ভয়ে চিৎকার করতে গিয়ে ধড়ফড় করে উঠে দেখে সে স্বপ্ন দেখছিল, সামনের সপ্তাহে পূর্ণিমা, আকাশে চাঁদের আলো বেশ জোরালো। সেই আলোয় বাইরে গিয়ে দেখে সারা সীমানা বরাবর এক গোলাকার বৃত্ত আঁকা, আর পায়ের ছাপ মাটির ওপরে। ঠিক তখনই অভির মায়ের গলার স্বর শুনতে পায়।
“নিবু শিগগিরই আয় তোর দিদুনের জ্ঞান ফিরেছে।”