পুরাতন কথার আলোচনা-শীর্ষক একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হইয়াছে। ইহাতে আমার সম্বন্ধে কিছু কিছু আলোচনা আছে, কিন্তু আছে বলিয়াই যে সে আলোচনায় আমিও যোগ দিই এ আমার স্বভাব নয়। তাহার প্রধান কারণ, আমি অত্যন্ত অলস লোক—সহজে লেখালিখির মধ্যে ঘেঁষি না; দ্বিতীয় কারণ, আমার বিগত জীবনের ইতিবৃত্ত সম্বন্ধে আমি অত্যন্ত উদাসীন। জানি, এ লইয়া বহুবিধ জল্পনা-কল্পনা ও নানাবিধ জনশ্রুতি সাধারণ্যে প্রচারিত আছে কিন্তু আমার নির্বিকার আলস্যকে তাহা বিন্দুমাত্র বিচলিত করিতেও পারে না। শুভার্থীরা মাঝে মাঝে উত্তেজিত হইয়া আসিয়া বলেন, এইসব মিথ্যের আপনি প্রতিকার করবেন না? আমি বলি, মিথ্যে যদি থাকে ত সে প্রচার আমি করিনি, সুতরাং প্রতিকার করার দায় আমার নয়—তাঁদের। তাঁদের করতে বলো গে। তাঁরা রাগিয়া জবাব দেন—লোকে যে আপনাকে অদ্ভুত ভাবে তার কি? আমি বলি, সে-দায়ও তাঁদের, কিন্তু এই সাতান্ন বছরেও যদি ক্ষতি না হয়ে থাকে ত আর কয়েকটা বছর ধৈর্য ধরে থাকো—আপনিই এর সমাপ্তি হবে। কোন চিন্তা নেই।
আজ…এই লেখাটা পড়িতে পড়িতে ভাবিতেছিলাম আমাদের ছেলেবেলার সেই অতি ক্ষুদ্র অকিঞ্চিৎকর সাহিত্য-সভায়…নেপথ্যে যোগদান করার—‘নেপথ্য’ শব্দটি কে একজন দিতে ভুলিয়াছেন বলিয়া…কি অস্থিরতা! একবারও ভাবিয়া দেখি নাই কতটুকুই ইহার মূল্য এবং জগৎ-সংসারে কেই-বা সে-কথা মনে রাখিবে। অবশ্যই ইহার জবাবও আছে।
সে যাই হোক, নিজের কথাটাই বলি। বলার একটু হেতু আছে,—কিন্তু সে আমার নিজের জন্য নয়—এ লেখার শেষ পর্যন্ত পড়িলে তাহা বুঝা যাইবে।
শ্রীযুক্ত সুরেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় আমার আত্মীয় ও আবাল্যবন্ধু। ‘কল্লোলে’ এবং ‘কালি-কলমে’ তিনি আমার বাল্যজীবনের প্রসঙ্গে কি-কি লিখিয়াছেন আমি পড়ি নাই—কোন্ কথা বলিয়াছিলেন তাহাও দেখি নাই। এ-ও আমার স্বভাব। কিন্তু আমি জানি, আমার প্রতি সুরেনের কি অপরিসীম স্নেহ, সুতরাং তাঁহার লেখায় অতিশয়োক্তি যে আছেই তাহা না পড়িয়াও হলফ করিতে পারি। কিন্তু না পড়িয়া হলফ করা এক কথা,—এবং না পড়িয়া প্রতিবাদ করা অন্য কথা। অতএব ইহা কাহারও লেখার প্রতিবাদ নয়,—শুধু যতটুকু আমার মনে পড়ে তাহাই বলা।
ভাগলপুরে আমাদের সাহিত্য-সভা যখন স্থাপিত হয় তখন আমাদের সঙ্গে শ্রীমান বিভূতিভূষণ ভট্ট বা তাঁর দাদাদের কিছুমাত্র পরিচয় ছিল না। বোধ হয় একটা কারণ এই যে, তাঁরা ছিলেন বিদেশী এবং বড়লোক।…স্বর্গীয় নফর ভট্ট ছিলেন সেখানকার সবজজ। তারপরে কি করিয়া এই পরিবারের সঙ্গে আমাদের ক্রমশঃ জানাশুনা এবং ঘনিষ্ঠতা হয় সে-সব কথা আমার ভালো মনে নাই। বোধ হয় এই জন্য যে, ধনী হইলেও ইঁহাদের ধনের উগ্রতা বা দাম্ভিকতা কিছুমাত্র ছিল না। এবং আমি আকৃষ্ট হইয়াছিলাম বোধ হয় এইজন্য বেশী যে, ইঁহাদের গৃহে দাবা-খেলার অতি পরিপাটি আয়োজন ছিল। দাবা-খেলার পরিপাটি আয়োজন অর্থে বুঝিতে হইবে—খেলোয়াড়, চা, পান ও মুহুর্মুহুঃ তামাক।
সম্ভবতঃ এই সময়েই…শ্রীমান বিভূতিভূষণ আমাদের সাহিত্য-সভায় সভ্যশ্রেণীভুক্ত হন। আমি ছিলাম সভাপতি, কিন্তু আমাদের সাহিত্য-সভায়…গুরুগিরি করিবার অবসর অথবা প্রয়োজন আমার কোনকালেই ঘটে নাই। সপ্তাহে একদিন করিয়া সভা বসিত এবং অভিভাবক গুরুজনদের চোখ এড়াইয়া কোন একটি নির্জন মাঠেই বসিত। জানা আবশ্যক যে, সে-সময়ে সে-দেশে সাহিত্যচর্চা একটা গুরুতর অপরাধের মধ্যেই গণ্য ছিল। এই সভায় মাঝে মাঝে…কবিতা পাঠ করা হইত। গিরীন পড়িতে পারিত সবচেয়ে ভালো, সুতরাং এ-ভার তাহার উপরেই ছিল, আমার ’পরে নয়। কবিতার দোষগুণ বিচার হইত এবং উপযুক্ত বিবেচিত হইলে সাহিত্য-সভার মাসিকপত্র ‘ছায়া’য় প্রকাশিত হইত। গিরীন ছিলেন একাধারে সাহিত্য-সভার সম্পাদক, ‘ছায়া’র সম্পাদক ও ‘অঙ্গুলি-যন্ত্রে’ অধিকাংশ লেখার মুদ্রাকর। এ-সম্বন্ধে এই আমার মোটামুটি মনে পড়ে।
সাহিত্য-সভার সভ্যগণের মধ্যে সবচেয়ে মেধাবী ছিলেন…বিভূতি। যেমন ছিল তাঁর পড়াশুনা বেশী, তেমনি ছিলেন তিনি ভদ্র এবং বন্ধুবৎসল। সমঝদার-সমালোচকও তেমনি।…
কিন্তু না বলিয়া জানা এবং না-বলিয়া প্রকাশ্যে প্রতিবাদ করাও ঠিক এক বস্তু নয়। তখন সঙ্কোচে বাধা দেয়, বয়োজ্যেষ্ঠ কাহাকেও অকারণে ক্ষুণ্ণ করার ক্ষোভে মন অশান্তি বোধ করে। অথচ সত্য-প্রতিষ্ঠা যখন করিতেই হয় তখন অপ্রিয় কর্তব্যের এই পুনঃপুনঃ দ্বিধা নিজের বক্তব্যকে পদে পদে অস্বচ্ছ করিয়া তোলে।
পুরাতন কথার আলোচনায়…বিপদ হইয়াছে এইখানে। অথচ প্রয়োজন ছিল না। এই সুদীর্ঘ বর্ষ পরে আমি হইলে বলিতাম, কত ভুলই ত সংসারে আছে, থাকিলই বা আর একটা। কি এমন ক্ষতি! কিন্তু আমার ও অপরের ক্ষতিবোধের হিসাব ত এক নয়।
…এখানে একটা গল্প মনে পড়িয়াছে। গল্পটা এই—
“কয়েক বৎসরের কথা, একবার হাবড়ায় ‘শরৎচন্দ্র’ সম্বন্ধীয় একটি সভার একজন বক্তা বোধ হয় সুরেন্দ্রনাথের ঐ লেখাটি পড়িয়াই (‘কল্লোল’ মাঘ, ১৩৩২) বক্তৃতায় বলিয়াছিলেন, টিলাকুঠির মাঠে (ভাগলপুর) এই সভা বসিত এবং সুরেন্দ্র, গিরীন্দ্র…বিভূতিভূষণ তাঁহার পদতলে বসিয়া সাহিত্য-সাধনা করিত। এই সভার একজন শ্রোতা (তাঁর নাম ৺বিনয়কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, শারীরিক বলের জন্য আদমপুর ক্লাবে এই বিনয়বাবুকে সকলেই জানিত। তিনি গৃহশিক্ষকরূপে ভাগলপুরে বহুদিন বাস করায়…সবই জানিতেন।) উত্তেজিত হইয়া আমাদের এ-খবর দেন এবং প্রতিবাদ করিতে বলেন। বিভূতিবাবু তাঁহাকে বহু কষ্টে প্রকৃতিস্থ করিয়া বুঝান যে…অপরের মুখের শোনা-কথা লেখায় প্রতিবাদ চলে না। আপনি মুখে যাহা বলিয়াছেন সেই পর্যন্তই ভাল।”
বিভূতিবাবু তাঁহার ভূতপূর্ব গৃহশিক্ষক বিনয়কুমারকে যদি সত্যই ‘প্রকৃতিস্থ’ করিতে সক্ষম হইয়া থাকেন ত একটা বিস্ময়কর ব্যাপার করিয়াছিলেন তাহা মানিবই। কারণ, চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে এক ঘণ্টাও তাঁহাকেও ‘প্রকৃতিস্থ’ করা সহজ বস্তু ছিল না। “পদতলে বসিয়া সাহিত্য-সাধনা করিত”, সভায় এই গ্লানিকর উক্তি শুনিয়া ভূতপূর্ব গৃহশিক্ষক বিনয়কুমার নিজে উত্তেজিত হইয়া প্রতিবাদ করিয়াছেন এবং অপরকে উত্তেজিত হইতে প্ররোচিত করিয়াছেন। কিন্তু ঘটনাটা আমার কাছে একেবারে নূতন। ১৩৩২ সনে আমি হাবড়াতেই ছিলাম অথচ আমার সম্বন্ধে এরূপ একটা সভা হওয়ার কথা আমি আদৌ বিদিত নই। সভা সত্যিই হইয়া থাকিলে এবং নিজে উপস্থিত থাকিলে এমন একটা কথা আমার নিজের পক্ষে যত বড় গৌরবের সামগ্রীই হোক অসত্য বলিয়া নিশ্চয়ই প্রতিবাদ করিতাম এবং বিনয়েরও উত্তেজিত হইয়া উঠার প্রয়োজন হইত না। তাহা নিঃসন্দেহে বলিতে পারি।
…মানুষ স্বভাবতঃ অনেকটা যে কল্পনাপ্রবণ তাহা সত্য এবং কল্পনারও যে উপযোগিতা আছে তাহাও সত্য, কিন্তু যথাস্থানে। ভূতপূর্ব গৃহশিক্ষক বিনয়কুমার পরবর্তীকালে ছিলেন Statesman কাগজের Reporter. বার বার ঘটনাস্থলে উপস্থিত না থাকিয়াও খরতর কল্পনার সাহায্যে report দাখিল করার জন্য তাঁহার চাকরি গিয়াছিল এবং কাগজের সম্পাদককেও লাঞ্ছিত হইতে হইয়াছিল।
আজ বিনয় পরলোকগত। মৃত ব্যক্তিকে লইয়া এই সকল কথা লিখিতে আমার ক্লেশবোধ হয়।…
কিন্তু ইহা বাহ্য। আসলে…উত্ত্যক্ত করিয়াছে কতকগুলি অতি কৌতূহলী লোকের অশিষ্ট…ও অমার্জনীয় জিজ্ঞাসাবাদ। তাহারা প্রশ্ন করিয়াছে, আমার কাছে…সাহিত্য-ব্যাপারে কে কতটা ঋণী। লোকেরা এ-প্রশ্ন আমাকেও যে না করিয়াছে তাহা নয়। কিন্তু যে-কেহ জিজ্ঞাসা করিয়াছে তাহাকেই অকপটে এই সত্য কথাটাই চিরদিন বলিয়াছি যে…আমার কাছে লেশমাত্র কেহ ঋণী নয়। একস্থানে এক সময়ে ছেলে-বয়েসে সাহিত্যচর্চা করিতে থাকিলে লোক পরস্পরকে উৎসাহ দিয়াই থাকে, ভালো লাগিলে ভালো বলিয়া বন্ধুজনেরা অভিনন্দিত করিয়াই থাকে, তাহাকে ঋণ বলিয়া অভিহিত করিতে গেলে মানুষের ঋণের কোথাও আর সীমা থাকে না। যেমন সুরেন, গিরীন, উপেন, তেমনি বিভূতি…প্রভৃতি। লেখা পড়িয়া ভালো লাগিলে ভালো বলিয়াছি—কোথাও তেমন ভালো না লাগিলে ছিঁড়িয়া ফেলিয়া আবার লিখিতে অনুরোধ করিয়াছি।…কোনদিন সংশোধন করি নাই।…এতকাল পরে এই সকল কথা ব্যক্ত করার উদ্দেশ্য আমার শুধু এই যে, এ সম্বন্ধে আমার বক্তব্য যেন লিপিবদ্ধ হইয়া থাকিতে পারে।…
এইবার আমার নিজের সম্বন্ধে দুই-একটা কথা বলিয়া এ-আলোচনা শেষ করিতে চাই। ছেলেবেলার লেখা কয়েকটা বই আমার নানা কারণে হারাইয়া গেছে। সবগুলার নাম আমার মনে নাই। শুধু…দু’খানা বইয়ের নষ্ট হওয়ার বিবরণ জানি। একখানা, ‘অভিমান’, মস্ত মোটা খাতায় স্পষ্ট করিয়া লেখা,—অনেক বন্ধুবান্ধবের হাতে হাতে ফিরিয়া অবশেষে গিয়া পড়িল বাল্যকালের সহপাঠী কেদার সিংহের হাতে। কেদার অনেকদিন ধরিয়া অনেক কথা বলিলেন, কিন্তু ফিরিয়া পাওয়া আর গেল না। এখন তিনি এক ঘোরতর তান্ত্রিক সাধুবাবা। বইখানা কি করলেন তিনিই জানেন—কিন্তু চাহিতে ভরসা হয় না—তাঁর সিঁদুর মাখানো মস্ত ত্রিশূলটার ভয় করি। এখন তিনি নাগালের বাহিরে—মহাপুরুষ—ঘোরতর তান্ত্রিক সাধুবাবা।
দ্বিতীয় বই ‘শুভদা’। প্রথম যুগের লেখা ওটা ছিল আমার শেষ বই, অর্থাৎ ‘বড়দিদি’, ‘চন্দ্রনাথ’, ‘দেবদাস’ প্রভৃতির পরে।