দুপাশে ধুধু করা মাঠ, তার মাঝখান দিয়ে রাস্তা। কোনও বাড়িঘর তো দেখাই যাচ্ছে না, মাঠে কোনওরকম ফসল নেই, গাছপালাও প্রায় নেই বলতে গেলে। অনেক দূরে দেখা যায় পাহাড়ের রেখা। এই অঞ্চলটাকে ঠিক মরুভূমি বলা যায় না, ভাল বাংলাতে এইরকম জায়গাকেই বলে ঊষর প্রান্তর।
রাস্তাটা অবশ্য বেশ সুন্দর, মসৃণ, কুচকুচে কালো যত্ন করে বাঁধানো। গাড়ি চলার কোনও ঝাঁকুনি নেই, রাস্তার দুপাশে কিছু দেখারও নেই, তাই সবারই ঘুম পেয়ে যাচ্ছে। কিন্তু গাড়ি যে চালাচ্ছে, তাকে তো চোখ মেলে থাকতেই হবে, রঞ্জন সেইজন্য নস্যি নিচ্ছে মাঝে-মাঝে। আকাশে একটুও মেঘের চিহ্ন নেই, মধ্য গগনে গনগন করছে সূর্য। মাঝে-মাঝে দু-একটা লরি ছাড়া এ রাস্তায় গাড়ি চলাচলও নেই তেমন।
সামনের সিটে বসে আছেন কাকাবাবু। চলন্ত গাড়িতেও তিনি বই পড়ছিলেন, একসময় হাত তুলে বললেন, খাবার জল আর আছে, না ফুরিয়ে গেছে?
পেছনের সিটের মাঝখানে বসেছে রঞ্জনের স্ত্রী রিঙ্কু, তার দুপাশে জোজো আর সন্তু। দুজনেই জানলার ধার চেয়েছিল, কিন্তু এখন ঘুমে ঢুলছে। রিঙ্কু সোজা হয়ে জেগে বসে আছে, তার কোলের ওপর একটা ম্যাপ ছড়ানো। রঞ্জন এর আগে দু-তিনবার ভুল করে অন্য রাস্তায় ঢুকে পড়তে যাচ্ছিল, রিঙ্কুই। প্রত্যেকবার তাকে গাড়ি ঘোরাতে বলেছে।
কাকাবাবুর কথা শুনে রিঙ্কু পায়ের কাছ থেকে ওয়াটার বলটা তুলে নেড়েচেড়ে বলল, শেষ হয়ে গেছে! আমাদের আরও দুটো-তিনটে জলের বোতল আনা উচিত ছিল।
ওরা বেরিয়েছে বাঙ্গালোর থেকে খুব ভোরে। সেখানকার আবহাওয়া খুব সুন্দর, ঠাণ্ডা-ঠাণ্ডা, পথে যে এত গরম পড়বে সেকথা তখন মনে আসেনি।
কাকাবাবু বললেন, একটা কোনও নদী-টদিও দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না এদিকে।
রঞ্জন বলল, এর পর যে পেট্রোল-পাম্প পড়বে, সেখানে আমরা জল খাব, গাড়িও জল-তেল খাবে।
কাকাবাবু বললেন, এ-তল্লাটে কোনও পেট্রোল-পাম্প আছে কি? শুধুই তো মাঠের পর মাঠ দেখছি!
রিঙ্কু বলল, ম্যাপে দেখা যাচ্ছে, আর ১৪ কি… না, না, দাঁড়ান, হিসেব করে বলছি, উ, ইয়ে, প্রায়, তিন ক্রোশ পরে একটা বড় জায়গা আসছে, এর নাম চিত্ৰদুগা! সেখানে গাড়ির পে.. মানে তেল আর খাবার-টাবার পাওয়া যাবে নিশ্চয়ই!
রঞ্জন অবহেলার সঙ্গে বলল, তিন ক্রোশ? কতক্ষণ লাগবে, পনেরো মিনিটে মেরে দেব! তোমরা সবাই এরই মধ্যে এত ঝিমিয়ে পড়ছ কেন, চিয়ার আপ!
সন্তু ঘুমজড়ানো গলায় বলল, রঞ্জনদা দুবার, কাকাবাবু এবার?
রঞ্জন বলল, এই রে, বিচ্ছুটা সব শুনছে? আমি ভেবেছিলুম ঘুমিয়ে পড়েছে বুঝি!
সন্তু পকেট থেকে একটা ছোট্ট নোটবই বার করে কী যেন লিখল, তারপর আবার চোখ বুজল।
রঞ্জন বলল, আরে, এ-ছেলে দুটো এত ঘুমোয় কেন? আমরা কত ভাল-ভাল জিনিস দেখছি।
সন্তু চোখ না খুলেই বলল, কিছু দেখার নেই।
রঞ্জন বলল, একটু আগে রাস্তা দিয়ে দুটো ছোট-ঘোট বাঘ চলে গেল। এখন যতি দেখতে পাচ্ছি, একটা, দুটো, তিনটে… কাকাবাবু, আপনি দেখতে পাচ্ছেন না?
কাকাবাবু বললেন, আরে, তাই তো রঞ্জন কি ম্যা… ইয়ে জাদুবিদ্যে জানে নাকি? সত্যিই তো হাতি?
কাকাবাবুর কথা শুনে সন্তু ধড়মড় করে উঠে বসল। কোনও সন্দেহ নেই, সোজা রাস্তাটার অনেক দূরে গোটাতিনেক হাতি দেখা যাচ্ছে। সন্তু ধাক্কা দিয়ে জাগাল জোজোকে।
জোজো সামনের দিকে চেয়েই বলল, ওয়াইন্ড এলিফ্যান্টস!
সন্তু পকেট থেকে ছোট খাতাটা বার করতে করতে বলল, জোজো এক!
রঞ্জন বলল, এই ধুধু-করা মাঠের মধ্যে বন্য হস্তী আসিবে, ইহা অতিশয় অলীক কল্পনা। আমার মনে হয়, এই হস্তীযুথ বিক্রয়ের জন্য হাটে লইয়া যাওয়া হইতেছে। সন্তু, একটা হাতি কিনবি নাকি?
গাড়িটা আরও কাছে আসবার পর দেখা গেল হাতিগুলোর সঙ্গে বেশ কিছু লোজনও আছে, কয়েকজন সানাই বাজাচ্ছে। মাঝখানের হাতিটায় একজন প্যান্ট-কোট পরা লোক বসে আছে, তার গলায় অনেকগুলো মালা, মাথায় সাদা রিবনো পাগড়ি।
রিকু বলল, ওমা, বর যাচ্ছে!
সন্তু জিজ্ঞেস করল, বউ কোথায়? প্যান্ট-কোট-পরা বর হয় নাকি?
রঞ্জন বলল, হ্যাঁ, হয়। এখানে এরা সুট পরে, পাগড়ি মাথায় দিয়ে বিয়ে করতে যায়। এই লোকটা বিয়ে করতে যাচ্ছে।
রিকু বলল, এদের দিনের বেলায় বিয়ে হয়। বাঙালিদের বিয়ের মতন আলোটালো জ্বালার খরচ নেই!
জোজো বলল, এরা হচ্ছে গোন্দ নামে একটা ট্রা… মানে, উপজাতি। এদের মধ্যে নিয়ম আছে, হতির বিয়ে দেওয়া খুব ধুমধাম করে। আজ হাতিগুলোরও বিয়ে হবে, তাই ওদের গলাতেও মালা পরানো হয়েছে, দেখেছিস সন্তু।
রঞ্জন ভুরু কপালে তুলে বলল, বাঃ, তোমার তো অনেক জ্ঞান দেখছি!
সন্তু বলল, ও আপনাকেও ছাড়িয়ে যাবে, রঞ্জনদা!
জোজো বলল, আমার মামাবাড়িতে দুটো হাতি ছিল কিনা! সেখানে মাহুতের মুখে শুনেছি। আমার এক মামা সেই মাহুতকে অসম থেকে নিয়ে এসেছিল।
রঞ্জন ঘ্যাঁচ করে গাড়িতে ব্রেক কষে বলল, তা হলে জিজ্ঞেস করা যাক, আজ ওই লোকটার বিয়ে, না হাতিগুলোর বিয়ে?
রিঙ্কু ধমক দিয়ে বলল, এই রঞ্জন, পাগলামি করবে না!
রঞ্জন গোঁফ-দাড়ির ফাঁক দিয়ে অনেকখানি হেসে বলল, আমার নতুন-নতুন জিনিস শিখতে খুব ভাল লাগে। হাতির বিয়ে!
বছরখানেক ধরে রঞ্জন দাড়ি রাখছে। শুধু রাখছে না, দাড়ি ইচ্ছেমতন বাড়তে দিচ্ছে, এখন তাকে প্রায় ইতিহাসের নানাসাহেবের মতন দেখায়। তার চেহারাটিও সেরকম বিরাট। কিন্তু তার হাসিতে এখনও একটা দুষ্টু ছেলের ভাব ফুটে ওঠে।
কিছু লোক হাতির পিঠে চেপেছে, কিছু লোক পায়ে হেঁটে যাচ্ছে। সানাইওয়ালারা গাড়ি দেখে যেন বেশি উৎসাহ পেয়ে জোরে-জোরে বাজাতে লাগল।
রঞ্জন তাল দিতে দিতে বলল, এদের সঙ্গে বরযাত্রী হয়ে চলে যাব? ভাল খাওয়াবে।
কাকাবাবু অনেকক্ষণ কোনও কথা বলেননি। এবার বললেন, রঞ্জন, গাড়ি থামলেই গরম বেশি লাগছে। আগে আমার একটু জল খাওয়া দরকার।
রঞ্জন সঙ্গে সঙ্গে গাড়িতে আবার স্টার্ট দিয়েই এই হাতির শোভাযাত্রাটাকে পাশ কাটিয়ে হুস করে বেরিয়ে গেল।
রিঙ্কু বলল, এই কী করছ? এত স্পিড দিও না!
সন্তু খাতা বার করে বলল, রিঙ্কুদি এক?
রিঙ্কু বলল, কেন? আমি কী বলেছি? ওঃ হো, স্পিড! না বাপু, আমি এই খেলা খেলতে পারব না!
কাকাবাবু হাসতে লাগলেন। রঞ্জন একটা স্বরচিত গান ধরে দিল, গতি! গতি! যার নাই কোনও গতি, সেই করে ওকালতি! কিংবা সে পথ ভোলে, ভুলুক না, তাহেকী বা ক্ষতি।
সামনেই একটা মোড় এল, ডান দিকে বাঁ দিকে দুটো রাস্তা বেরিয়ে গেছে। রিঙ্কু বলল, পথ ভুল করলে চলবে না! রঞ্জন, এবার লেফট টার্ন নাও, আমরা হাইওয়ে ছাড়ব না। ওইটা হাইওয়ে দেখতে পাচ্ছ না?
সন্তু বলল, রিঙ্কুদি দুই!
জোজো বলল, দুই না, তিন! হাইওয়ে দুবার বলেছে।
রিঙ্কু বলল, অ্যাই, হাইওয়ের বদলে কী বলব রে?
সন্তু বলল, রাজপথ। বাকিগুলো শাখাপথ।
কাকাবাবু বললেন, সামনে ওই যে পাহাড়ের ওপর মন্দির দেখা যাচ্ছে, ওইটাই খুব সম্ভবত চিত্রদুগা। অনেকদিন আগে এখানে একবার এসেছিলাম, ভাল মনে নেই। পাহাড়টার গায়ে একটা দুর্গ আছে। খুব সম্ভবত এই জায়গাটার আসল নাম চিত্ৰ-দুর্গ, ইংরেজি বানান দেখে-দেখে লোকে এখন বলে চিত্রদুর্গা। এসব দিকে দুর্গা মন্দির থাকা অস্বাভাবিক। ওপরের মন্দিরটা বোধহয় শিবমন্দির।
রঞ্জন বলল, আর বেশিদূর গিয়ে কী হবে? ওই পাহাড়টার তলায় যদি কোনও বাংলো-টাংলো পাওয়া যায়, তা হলে সেখানে থেকে গেলেই তো হয়।
রিঙ্কু বলল, মোটই না! রঞ্জন, আজ সন্ধের মধ্যেই আমরা হপি পৌঁছতে চাই।
জোজো বলল, মধ্যপ্রদেশে এরকম একটা পাহাড়ের মাথায় মন্দির দেখেছিলুম, সে-পাহাড়টা অবশ্য আরও অনেক উঁচু, সেখানে নরবলি হয়।
রিঙ্কু একটু চমকে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, তুমি দেখেছ মানে? তুমি সেই মন্দিরে নরবলি দিতে দেখেছ?
জোজো বলল আমি যেদিন সেই পাহাড়টার ওপরে উঠি সেদিন শুধু মোষবলি ছিল। তবে আমার মামা নিজের চোখে নরবলি দেখেছে?
রঞ্জন জিজ্ঞেস করল, এটা তোমার কোন্ মামা? যিনি অসম থেকে মাহুত আর হাতি এনেছিলেন?
জোজো বলল, না, সে অন্য মামা!
রঞ্জন আবার জিজ্ঞেস করল, তোমার কতজন মামা?
জোজো উত্তর দেবার আগেই সন্তু বলল, আমি এ-পর্যন্ত জোজোর এগারোজন মামা আর সতেরোজন পিসেমশাইয়ের হিসেব পেয়েছি।
রঞ্জন একটুও অবাক না হয়ে বলল, তা তো থাকতেই পারে। কারও কারও মামা-মামি, পিসে-পিসির ভাগ্য ভাল হয়। ভাবো তো, যার কোনও মামা নেই, মেসোমশাই কিংবা পিসেমশাই নেই, সে কত হতভাগ্য! আমি মামি, মাসি আর পিসিদের কথা বাদ দিচ্ছি।
রিঙ্কু বলল, কেন, তুমি মাসি-পিসিদের কথা বাদ দিচ্ছ কেন? মাসি-পিসি থাকাটাও তো দুর্ভাগ্য!
রঞ্জন বলল, এইজন্যই বলি রিঙ্কু, যে-কোনও কথা বলার আগে একটু বুদ্ধি খাটাবে! যে-লোকের মাসি নেই, তার কি মেলোমশাই থাকতে পারে? মনে করো, আমার বাবার কোনও বোন নেই, তা বলে কি আমি যার-তার সঙ্গে পিসেমশাই সম্পর্ক পাতাতে পারি। তঁা, একটা কথা তুমি বলতে পারে বটে যে, মামিমা না থাকলেও মামা থাকতে পারে! মামা-শ্রেণীর লোকেরা একটু স্বার্থপর হয়, মামিমাকে বাদ দিয়েও তাদের মধ্যে কেউ-কেউ মামা হিসেবে টিকে যায়। কিন্তু পিসিমা-ই নেই অথচ পিসেমশাই, এ যে সোনার পাথরবাটি!
কাকাবাবু এদের কথা শুনে মজা পেয়ে মিটিমিটি হাসছেন।
এখন রাস্তার ধারে দু-চারখানা বাড়িঘর দেখা যাচ্ছে। একটু দূরেই দাঁড়িয়ে আছে কয়েকটা বাস। তার কাছেই বাজার। রঞ্জন সেখানে গাড়ি না থামিয়ে, কয়েকবার বাঁক নিয়ে একেবারে পৌঁছে গেল পাহাড়ের গায়ে দুর্গের দরজায়।
দরজা মানে সিংহদরজা যাকে বলে, তিন-মানুষ উঁচু কাঠের পাল্লা, তার গায়ে লোহার বন্টু বসানো। দুপাশে দুটি পাথরের সিংহ। তার মধ্যে একটা সিংহের অবশ্য মুণ্ডু নেই।
কাছেই একটা বাড়ির গায়ে লেখা আছে, হোটেল।
রঞ্জন বলল, আগে এখানে ভাত-মাংস খেয়ে নেওয়া যাক। ওহো, মাংস তো এ তল্লাটে পাওয়া যায় না। এটা নিরামিষের দেশ!
কাকাবাবু ক্রাচ বগলে দিয়ে গাড়ি থেকে নামতে নামতে বললেন, আমার নিরামিষে আপত্তি নেই। তোমাদের কষ্ট হবে। দ্যাখো যদি ডিম পাওয়া যায়।
হোটেল মানে অবশ্য পুরনো একটা চায়ের দোকানের মতন। তবে ভেতরটা খুব পরিষ্কার। পেতলের থালা-গেলাসে খাবার দেওয়া হয়। সেগুলি ঝকমকে করে মাজা। কয়েকজন লোক খেয়ে বেরোচ্ছে, টেবিল সাফ করা হচ্ছে, তাই ওরা অপেক্ষা করতে লাগল বাইরে।
দোকানের বাইরে কয়েকটা ফুলের গাছ। তার মধ্যে একটা বড় গাছ থেকে লম্বা লম্বা লালচে ফুল ঝুলছে। সেদিকে আঙুল দেখিয়ে রিঙ্কু বলল, এগুলো কী ফুল জানিস সন্তু? বল তো?
সন্তু মুচকি হেসে দুদিকে ঘাড় নেড়ে বলল, জানি না। তুমি বলো।
বট্ল ব্রাশ। এগুলোকে বলে বট্ল ব্রাশ।
জানতুম। আমি নামটা জানতুম। তবু তোমাকে দিয়ে বললুম। তোমার আরও দুবার জরিমানা হল।
তার মানে? কেন জরিমানা হবে? বল ব্রাশ একটা ফুলের নাম। তার কোনও বাংলা নেই।
কে বলল নেই? বল-এর বাংলা বোতল আর ব্রাশ-এর বাংলা বুরুশ। এই ফুলটার নাম বোতলবুরুশ!
কাকাবাবু হোহো করে হেসে উঠলেন। রঞ্জন বলল, হ্যাঁ, সন্তু ঠিকই বলেছে, যেমন, টেল-এর বাংলা টেবিল আর গ্লাস-এর বাংলা গেলাস
সন্তু পকেট থেকে ছোট্ট খাতাটা বার করল।
সেই খাতার এক-একটা পাতায় এক-একজনের নাম লেখা আছে। কাল রাত্তিরেই ঠিক হয়েছিল যে, আজ সকাল থেকে বেড়াতে বেরোবার পর কেউ একটাও ইংরেজি শব্দ বলবে না। কেউ ভুল করে বলে ফেললেই একটা। ইংরেজি কথার জন্য দশ পয়সা জরিমানা। সন্তু খাতায় সেই হিসেব লিখে রাখছে। কাল সবাই এই খেলা খেলতে রাজি হয়েছিল।
রিঙ্কু বলল, না, আমি আর এই পচা খেলা খেলব না! আই কুইট!
রঞ্জন বলল, অ্যাই, এখন ওসব বললে চলবে না। আজ রাত্তিরে সব হিসেব হবে, জরিমানার টাকাটা দিয়ে তারপর ছুটি। রিঙ্কু, তোমার আরও দুবার
জরিমানা হল।
জোজো বলল, ভেতরটা খালি হয়ে গেছে। চলো গিয়ে বসি। এবার আর-একটা মজা হবে মনে হচ্ছে!
একটাই লম্বা টেবিল, সবাই মিলে কাছাকাছি বসল। একজন সাদা লুঙ্গি-পরা বেয়ারা সবাইকে জলের গেলাস দিয়ে অর্ডার নেবার জন্য দাঁড়াল।
রঞ্জন বলল, ভাই আমরা ক্ষুধার্ত। আমাদের কিছু খাদ্য দাও। ভাত, ডাল, মাংস, ডিম যা খুশি!
লোকটি কিছু বুঝতে না পেরে ভুরু কুঁচকে রঞ্জনের কাছে ঝুঁকে এসে কী যেন বলল।
রঞ্জন বলল, আমি ভাই তোমার সঙ্গে ইংরিজি বলে জরিমানা দিতে পারব বা। খাবারের দাম সবাই মিলে দেবে, আর জরিমানা আমাকে একলা দিতে হবে। তুমি আমার বাংলা কথা শুনে যা বোঝো তাই দাও।
লোকটি এবার ইংরেজিতে বলল, হোয়াট ডিড ইউ সে সার?
রঞ্জন সবেগে মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, উঁহু, তুমি যতই ইংরেজি বলল, আমি বাংলা ছাড়া কিছু বলব না। আমাদের খাদ্য দাও, খাদ্য!
রিঙ্কু বলল, এইরকম করলে আমাদের আর কিছু খাওয়াই হবে না! আমরা কেউ কন্নড় ভাষা জানি না, এরা কেউ হিন্দিও বোঝে না! বাংলা তো দূরের কথা।
কাকাবাবু উঠে গিয়ে একটা দেওয়ালের পাশে দাঁড়ালেন। সেখানে খাবারদাবারের নামলেখা একটা তালিকা ঝুলছে। কন্নড় আর ইংরেজি দু ভাষাতেই লেখা। কাকাবাবু বেয়ারাটির দিকে ইঙ্গিত করে কয়েকটা নামের ওপর আঙুল রাখলেন। তারপর হাত তুলে পাঁচটা আঙুল দেখিয়ে বোঝালেন যে পাঁচজনের খাবার চাই।
বেয়ারাটি অদ্ভুত মুখের ভার করে ভেতরে চলে গেল।
কাকাবাবু ফিরে এসে বললেন, এতে মোটামুটি কাজ চালানো গেল, কী। বলো? কিন্তু সন্তু তোর নিয়মটা একটু পালটাতে হবে। আমরা নিজেদের মধ্যে ইংরেজি বলব না, কিন্তু বাইরের লোকদের সঙ্গে বলতেই হবে! অন্য লোকরা
তো আমাদের সঙ্গে এ-খেলায় যোগ দেয়নি।
সন্তু বলল, ঠিক আছে। অন্যদের বেলায় অ্যা-অ্যা-অ্যা, মানে অন্যদের সঙ্গে বলা যাবে।
রিঙ্কু বলল, অন্যদের সঙ্গে অ্যালাউড? বাঁচা গেল!
তারপর কাউন্টারের ম্যানেজারের দিকে তাকিয়ে সে বলল, এক্সকিউজ মি, প্লিজ সেন্ড দা বেয়ারার এগেইন!
সন্তু বলল, রিদি, তুমি অ্যালাউডটা আমাদের বলেছ! তোমার আর একটা…
সবাই হেসে উঠল আবার।
এই দোকানে ইডলি-ধোসাবড়া ছাড়া আর কিছুই পাওয়া যায় না। মাংস তো দূরের কথা, ভাতও নেই। বেয়ারাটি খুব ভ্যাবাচাকা খেয়ে গেছে, একটু আগে তার ইংরেজি কথা শুনেও এরা উত্তর দিচ্ছিল না, এখন এদের মুখে ইংরেজির বন্যা বয়ে যাচ্ছে।
ওদের খাওয়ার মাঝখানে দোকানটির সামনে একটা বড় স্টেশন ওয়াগন থামল। তার থেকে নামল চারজন লোক, তাদের মধ্যে একজনের দিকেই বিশেষ করে চোখ পড়ে। এই গরমেও সেই লোকটি পরে আছে একটা চকচকে সুট, চেহারাটি ছোটখাটো একটি পাহাড়ের মতন, তার চোখে সান গ্লাস, মুখে লম্বা চুরুট।
দুপদাপ করে জুতোর শব্দ তুলে লোকগুলো ঢুকল ভেতরে। টেবিলে বসার আগেই একজন জিজ্ঞেস করল, কফি হায়? কফি মিলেগা?
কাকাবাবু খাওয়া বন্ধ করে এই আগন্তুকদের দিকে স্থিরভাবে তাকিয়ে রইলেন।
পাহাড়ের মতন লোকটি কাকাবাবুর দিকে চোখ ফেলেই মহা আশ্চর্যের ভান করে বলল, ওয়েল, ওয়েল, ওয়েল, আপ রাজা রায়চৌধুরী হ্যায় না? আপ ইধার?
বাংলা-অসম-ত্রিপুরা কিংবা বিহার-ওড়িশা বা দিল্লিতে কাকাবাবুকে অনেকে চিনতে পারে, কিন্তু এই কণাটকের একটা ছোট্ট জায়গাতেও যে কেউ তাকে। চিনতে পারবে, তা যেন তিনি আশা করেননি। তিনি লাজুকভাবে একটু হেসে বললেন, এই এদিকে একটু বেড়াতে এসেছি।
লোকটি এগিয়ে এসে বলল, বেড়াতে এসেছেন? এখানে?
কাকাবাবু বললেন, শুধু এখানে না। আশেপাশে কয়েকটা জায়গায়। সঙ্গে এই আমার ভাইপো, সন্তু। ওর কলেজের বন্ধু জোজো। আর ইনি রঞ্জন ঘোষাল আর ওঁর স্ত্রী রিঙ্কু ঘোষাল, আমার বিশেষ পরিচিত।
লোকটি সকলের দিকে হাত তুলে নমস্কার জানিয়ে বলল, আমার নাম মোহন সিং। আমাকে চিনেছেন তো? দিল্লিতে দেখা হয়েছিল একবার।
তারপর সে কাকাবাবুর কাঁধে একটা চাপড় মেরে বলল, মিঃ রাজা রায়চৌধুরী, সামুচ বলুন তো, আপনাকে এখানে কে পাঠিয়েছে?
কাকাবাবু ভুরু কুঁচকে বললেন, কেউ তো পাঠায়নি। আমরা নিজেরাই এসেছি।
মোহন সিং বলল, নিজেরা এসেছেন তো ঠিক আছে, আপনি কার হয়ে কাজ করছেন?
মোহন সিং কাকাবাবুর কাছ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে তখনও তাঁর কাঁধে হাত দিয়ে আছে।
কাকাবাবু এবার একটু কড়া গলায় বললেন, আপনি ওদিকে গিয়ে বসুন।
মোহন সিং তবু সরল না। চওড়া করে হেসে বলল, ঠিক আছে, আপনি অন্য কারও হয়ে কাজ না করেন তো খুব ভাল কথা। আমি আপনাকে একটা কাজ দেব। আপনার ফি কত?
কাকাবাবু বললেন, আমার গায়ে হাত দিয়ে কথা বলা আমি পছন্দ করি না। আপনার চুরুটের ধোঁয়ার গন্ধও আমার সহ্য হচ্ছে না। আপনি, প্লিজ, দূরে গিয়ে বসুন।
মোহন সিং-এর সঙ্গীরা তিনটে চেয়ার টেনে বসে এদিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। প্রত্যেকেরই বেশ গড়াপেটা চেহারা।
মোহন সিং কাকাবাবুর কাঁধ থেকে হাত তুলে নিল, কিন্তু সরে গেল না। চুরুটের ছাই ঝেড়ে বলল, আরে মশাই, আপনাকে আমি এমপ্লয় করছি, কম সে কম পঞ্চাশ হাজার খরচ করতে রাজি আছি। আপনাকে এত টাকা কেউ দেবে?
রঞ্জন বলল, শুনুন, মিঃ সিং, কাকাবাবু এখন রিটায়ার করেছেন। আমি ওঁর অ্যাসিস্টান্ট। ওঁকে কী কাজ দেবার কথা বলছেন, সেটা আমাকে দিন না! আমার কিছু টাকা-পয়সার দরকার এখন। তা হা, পঞ্চাশ হাজার পেলে মোটামুটি চলে যাবে।
মশামাছি তাড়াবার মতন বাঁ হাতের ভঙ্গি করে মোহন সিং বলল, আপ চুপ রহিয়ে। আমি মিঃ রায়চৌধুরীর সঙ্গে কথা বলছি। জরুরি কাজের কথা।
রঞ্জন উঠে দাঁড়িয়ে বলল, আপনি আমাকে ঠিক বিশ্বাস করতে পারছেন না। তাই না? আমি রিভলভার চালাতে জানি, দড়ির মই বেয়ে উঠতে পারি, গোপন ম্যাপ চিবিয়ে চিবিয়ে খেয়ে ফেলতে পারি, এমনকী আমি পিকক করতেও পারি। দেখবেন?
তারপর রঞ্জন সত্যিই মাটিতে দুটো হাত দিয়ে পা দুটো শূন্যে তুলে ফেলল। ঝনঝন করে তার পকেট থেকে খসে পড়ল অনেগুলো খুচরো পয়সা।
সেই অবস্থায় সে হাত দিয়ে হাঁটবার চেষ্টা করল। মোহন সিংয়ের তুলনায় রঞ্জনের চেহারাটাও নেহাত ছোট নয়। একটুখানি এগিয়েই তার পা শূন্যে টলমল করে উঠল, সে হুড়মুড় করে গিয়ে পড়ল মোহন সিংয়ের ওপর। মোহন সিংও এই ধাক্কা সামলাতে না পেরে চিত হয়ে পড়ে গেল মাটিতে।
তড়াক করে লাফিয়ে উঠে রঞ্জন খুবই কাচুমাচু গলায় বলল, আরে ছি ছি, কী কাণ্ড। আউট অব প্র্যাকটিস, বুঝলেন! আবার দু-একদিন প্র্যাকটিস করলেই ঠিক হয়ে যাবে। আপনার লাগেনি তো? আমি খুবই দুঃখিত!
রঞ্জন মোহন সিংয়ের হাত ধরে টেনে তোলার চেষ্টা করল। তার সঙ্গের লাোেও ছুটে এল দু-দিকে।
মোহন সিং নিজেই উঠে দাঁড়াল কোনওরকমে। রঞ্জন বলল, এক্সট্রিমলি সরি, আমায় মাপ করে দিন, এর পরের বার দেখবেন, কোনও ভুল হবে না!
মোহন সিং কটমট করে তাকিয়ে বলল, বেওকুফ!
তারপর কাকাবাবুর দিকে ফিরে অবজ্ঞার সুরে বলল, আপনি রিটায়ার করেছেন? একেবারে বুঢ়া বনে গেছেন! সে কথা আগে বললেই হত!
মোহন সিংয়ের চুরুটটা ছিটকে চলে গেছে অনেক দূরে। সেটা আর না কুড়িয়ে সে গিয়ে বসল একটা চেয়ারে। বেয়ারা এর মধ্যেই কফি দিয়ে গেছে। সে কফিতে চুমুক দিতে লাগল ঘনঘন।
রঞ্জনের কাণ্ড দেখে সন্তু আর জোজোর খুব হাসি পেয়ে গেলেও হাসতে পারছে না। সন্তু হাসি চাপবার জন্য নিজের উরুতে চিমটি কেটে আছে। রিঙ্কুর মুখখানাও লালচে হয়ে গেছে, সেও আসলে প্রাণপণে হাসি চাপছে। রঞ্জনকে সে আগে কোনওদিন পিকক করতে দ্যাখেনি।
মোহন সিং আর কোনও কথা বলল না। কফি শেষ করে দলবল নিয়ে উঠে দাঁড়াল। পয়সা মিটিয়ে দিয়ে দরজার কাছে চলে গিয়েও ফিরে দাঁড়াল হঠাৎ।
কাকাবাবুর দিকে আঙুল তুলে বলল, মিঃ রায়চৌধুরী, আপনাদের কি হামপির দিকে যাবার প্ল্যান আছে?
কাকাবাবু মাথা দুলিয়ে বললেন, হ্যা। মোহন সিং বলল, বেলুড় যান, হ্যালিবিড যান, শ্রবণবেলগোলা যান, এই কণার্টকে অনেক দেখবার জায়গা আছে। লেকিন, মপি যাবেন না এখন।
কাকাবাবু হেসে বললেন, আমি কোথায় যাব না যাব, তা নিয়ে আপনি মাথা ঘামাচ্ছেন কেন বলুন তো? আমি কিন্তু আপনাকে চিনতে পারিনি।
মোহন সিং তবু বলল, আর যেখানে খুশি যান, মপি যাবেন না। তা হলে আপনাদের অনেক অসুবিধেয় পড়তে হবে!
এর উত্তর না দিয়ে কাকাবাবু হাসিমুখে চেয়ে রইলেন। মোহন সিং পেছন ফিরে গটগট করে বেরিয়ে গেল!
জোজো দরজা পর্যন্ত ছুটে গিয়ে উঁকি মেরে দেখে এসে চোখ বড় বড় করে বলল, চম্বলের ডাকাত! মোহন সিং! এর নাম আমি অনেকবার আমার পিসেমশাইয়ের মুখে শুনেছি।
রিঙ্কু বলল, মোহন সিং তো কমন নাম। অনেকেরই হতে পারে। আমার মনে হল, সিনেমার ভিলেন! আমজাদ খানের মতন চেহারা।
সন্তু নিজের কাজ ভোলেনি। সে ছোট খাতাটা বার করে বলল, রিঙ্কুদি, বাইরের লোক চলে গেছে, তুমি দুটো ইংরেজি শব্দ বলেছ?
রিঙ্কু সেকথা অগ্রাহ্য করে বলল, রঞ্জন কী কাণ্ডটাই করল!
এবার সকলের চেপে রাখা হাসি বেরিয়ে এল একসঙ্গে। শুধু রঞ্জন হাসল না। সে নিজের দাড়িতে হাত বুলোতে বুলোতে বলল, ইশ, পঞ্চাশ হাজার টাকার কাজটা ফসকে গেল?
কাকাবাবু বললেন, কোথা থেকে লোকটা হঠাৎ এসে উদয় হল বলো তো? আমাকে চেনে কিন্তু আমি ওকে চিনি না। ও গায়ে পড়ে আমাদের মপি যেতে বারণ করলই বা কেন? তা হলে কী করবে, হামপি যাবে, না অন্য কোথাও যাবে?
রিঙ্কু বলল, আমরা হামপি দেখব বলে বেরিয়েছি, সেখানে তো যাবই। ওই লোকটা বারণ করেছে বলে আরও বেশি করে যাব। ও বারণ করবার কে?
বড় দরজাটা দিয়ে ঢোকার পর দেখা গেল, দুপাশে বিশাল উঁচু দেওয়াল, তার মাঝখান দিয়ে সিঁড়ি। পাহাড়টা কেটে-কেটে দুর্গ বানানো হয়েছে, কিন্তু দূর থেকে শুধু পাহাড় বলেই মনে হয়।
পাহাড়ের ওপরটা পর্যন্ত ঘুরে আসতে কতক্ষণ লাগবে? বড়জোর এক ঘন্টা।
জোজো বলল, চল সন্তু, যাবি?
সন্তু কাকাবাবুর দিকে তাকাল।
কাকাবাবু বললেন, সিঁড়ি আর পাহাড়, এই দুটোই আমাকে বড় জব্দ করে দেয়। আমি যাব না, তোরা ঘুরে আয় ওপর থেকে।
রঞ্জন বলল, আমারও পাহাড়ে চাপার শখ নেই, আমিও ওপরে যাব না। ততক্ষণ গাছের ছায়ায় একটু ঘুমিয়ে নেব।
রিঙ্কু বলল, তোমরা কিন্তু এক ঘন্টার মধ্যে ঠিক ফিরে আসবে। ঠিক তিনটের সময় আমরা স্টা…স্টা….স্টা…ইয়ে, যাত্রা শুরু করব।
আরও একটু ওপরে ওঠার পর একটা জায়গায় বড়বড় কয়েকটা গাছের তলায় চমৎকার সবুজ ঘাস। রঞ্জন সেখানে শুয়ে পড়েই চোখ বুজল।
রিঙ্কু বলল, মোহন সিং-এর গাড়িটা নীচে দেখা যাচ্ছে। ওরা এখনও যায়নি।
কাকাবাবু বললেন, ওরা ওপরের মন্দিরে পুজো দিতে গেছে। ওদের একজনের হাতে শালপাতায় মোড়া ফুলটুল দেখেছিলুম।
রিঙ্কু বলল, তা হলে তো সন্তুদের সঙ্গে দেখা হয়ে যাবে। ওই বিচ্ছিরি লোকটা যদি ওদের সঙ্গে গণ্ডগোল করে?
কাকাবাবু বললেন, সেজন্য চিন্তা নেই। সন্তু ওরকম লোক অনেক দেখেছে।
রঞ্জন চোখের ওপর থেকে হাত সরিয়ে বলল, ওই সন্তু বিচ্ছুটা চলে গেছে? তা হলে এখন একটু প্রাণ খুলে ইংরেজি বলা যাক। হা, কী ইংরেজি বলব? কিছু মনে পড়ছে না যে?
রিঙ্কু বলল, সত্যি, আমাদের এমন অভ্যেস হয়ে গেছে যে, ইংরেজি শব্দ বাদ দিয়ে কথাই বলতে পারি না। অন্য সময় খেয়ালই থাকে না।
রঞ্জন বলল, এখন তো তুমি দিব্যি বাংলা বলছ, রিঙ্কু। একটু আগে স্টার্ট বলে ফেলতে গিয়ে স্টাস্টাস্টা বলে এমন তোতলাতে শুরু করলে! তোমার অনেক ফাইন হয়ে গেছে এরই মধ্যে। রিঙ্কু বলল, তোমারও কম হয়নি। কাকাবাবু বললেন, সন্তু কিন্তু এ পর্যন্ত একটাও ইংরেজি বলেনি। রঞ্জন বলল, ফাইন দেবার ভয়ে সন্তু তো কথাই বলছে না প্রায়। আজ রাত্তিরে যেখানে থাকব সেখানে বসে হিসেবটিসেব কষে, প্রত্যেকের ফাইন চুকিয়ে দিয়ে এ-খেলাটা শেষ করে দিতে হবে।
রিঙ্কু বলল, আমরা আজ রাত্তিরে কোথায় থাকব? তুঙ্গভদ্রা ড্যামের গেস্ট হাউসে?
রঞ্জন বলল, গিয়ে দেখা যাক। সেখানে জায়গা না পাওয়া গেলে কোনও হোটেল-টোটেল খুঁজতে হবে। এই রে, হোটেল কথাটা আবার সন্তুর কাছে উচ্চারণ করা যাবে তো? হোটেলের বাংলা কী, সরাইখানা?
কাকাবাবু বললেন, হোটেল আর ট্যাক্সি, এই কথা দুটো এখন সারা পৃথিবীতে চলে। এর আর বাংলা করার দরকার নেই।
রিঙ্কু বলল, এই জায়গাটা কী শান্ত আর নির্জন লাগছে। এক সময় এখানে কত সৈন্য-সামন্ত যাতায়াত করত, এখানে কত যুদ্ধ হয়েছে, এখন কিছু বোঝাই যায় না।
রঞ্জন বলল, রি, তুমি যেখানে বসে আছ, ওইখানেই যুবরাজ বিক্রম মাণিক্য, ইয়ে, খুন হয়েছিল। হ্যাঁ, চারজন বিদ্রোহী তার দেহটাকে টুকরো-টুকরো করে ফেলে, তার মুণ্ডুটা এখানে পড়েছিল অনেকদিন?
রিঙ্কু একটু চমকে উঠে এদিক-ওদিক তাকাল। তারপর বলল, কাকাবাবু, রঞ্জন কিন্তু যখন-তখন এই রকম ইতিহাস বানায়। ওর কথা বিশ্বাস করবেন না।
রঞ্জন বলল, এই, আমি ক্লাস নাইন, মানে নবম শ্রেণীতে ইতিহাস পরীক্ষায় ফাস্ট, মানে প্রথম হয়েছিলুম না?
কাকাবাবু বললেন, এইসব দুর্গে ওরকম খুনোখুনি হওয়া অসম্ভব কিছু তো নয়। আমরা যেখানে যাচ্ছি…।
কাকাবাবুর কথা শেষ হবার আগেই পাহাড়ের ওপর দিয়ে প্রচণ্ড জোরে দুবার দুমদুম শব্দ হল। ঠিক যেন বোমা ফাটার আওয়াজ। অনেকগুলো কাক একসঙ্গে ডেকে উঠে ছড়িয়ে গেল আকাশে।
রিঙ্কু সঙ্গে-সঙ্গে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, কী হল? সন্তু আর জোজো গেছে ওদিকে। রঞ্জন, চলো আমরা গিয়ে দেখি!
কাকাবাবু বললেন, দাঁড়াও, দাঁড়াও, আওয়াজটা বেশি দূরে হয়নি। সন্তু আর জোজোর এর মধ্যে আরও উঠে যাবার কথা।
রঞ্জন বলল, খুব সম্ভবত ডিনামাইট দিয়ে পাথর ফাটাচ্ছে। নতুন রাস্তা-টাস্তা বানাবে।
রিঙ্কু বলল, আমি দেখে আসছি।
সঙ্গে সঙ্গে সে ছুট লাগাল। রঞ্জন কাকাবাবুর দিকে তাকিয়ে বলল, আপনি ভাবছেন তো যে, আমার বউ একা-একা গেল, আমারও ওর সঙ্গে যাওয়া উচিত ছিল? রিঙ্কুকে আপনি ভাল করে চেনেন না। ও একাই তিনশো!
পাহাড়ের সিঁড়িটা এঁকেবেঁকে উঠেছে, একটু দূরেই একটা বাঁক নিয়েছে বলে ওপরের দিকটা দেখা যায় না। রিঙ্কুও তরতর করে ছুটতে ছুটতে সেদিকে মিলিয়ে গেল।
কাকাবাবু পেছন ফিরে বললেন, মোহন সিংগাড়িটা বেরিয়ে যাচ্ছে। ওরা এর মধ্যেই নেমে এসেছে।
রঞ্জন বলল, গাড়িতে একটা বায়নোকুলার আছে, সেটা নিয়ে আসা উচিত ছিল। মোহন সিংরা নামল কোন্ দিক দিয়ে? দেখতে পেলাম না তো।
কাকাবাবু বললেন, নিশ্চয়ই আর একটা রাস্তা আছে অন্যদিক দিয়ে।
একটু পরেই দেখা গেল রিঙ্কু আর সন্তু-জোজো একসঙ্গে নেমে আসছে। সন্তুর হাতে একটা পাতাওয়ালা গাছের ডাল, তার ডগায় কয়েকটা হলুদ রঙের ফুল। ওরা গল্প করতে করতে নামছে আস্তে-আস্তে।
সেদিকে তাকিয়েই রঞ্জন বলল, কাকাবাবু, শিগগির নেমে চলুন।
কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, ওদের জন্য অপেক্ষা করবে না?
রঞ্জন বলল, ওদের দেখেই তো বুঝতে পারা যাচ্ছে যে, ওরা কোনও বিপদে পড়েনি। এবার ওরা একটু আমাদের খোঁজাখুঁজি করুক!
কাকাবাবু ক্রাচ বগলে নিয়ে যতদূর সম্ভব তাড়াতাড়ি নামতে লাগলেন। রঞ্জন দৌড়ে গিয়ে গাড়ির দরজা খুলল, তারপর কাকাবাবু এসে পৌঁছতেই তাঁকে তুলে নিয়ে স্টার্ট দিল।
বাজারের কাছে পেট্রোল-পাম্প। সেখানে মোহন সিংদের গাড়িটাও থেমে আছে। সামনের সিটে জানলার ধারে বসে আছে মোহন সিং, রঞ্জনকে দেখে সে ঘুরিয়ে নিল মুখখানা।
রঞ্জনই গাড়ি থেকে নেমে এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, কেয়া সিংজি, আপলোগও কি হামপি যাতা হ্যায়?
মোহন সিং রঞ্জনের দিকে কটমট করে তাকিয়ে রইল, কোনও কথা বলল না।
রঞ্জন আবার বলল, আরে আপ রাগ করতা হ্যায় কাঁহে? আমি তো ইচ্ছে করে আপনাকে ফেলে দিইনি, ব্যালান্স সামলাতে পারিনি। আপনি কী কাজ দেবার কথা বলছিলেন, আমাকে দিন না।
পেছন থেকে মোহন সিং-এর এক সঙ্গী রঞ্জনের কাঁধে একটা চাপড় মেরে বলল, আপনা কাম করো। ইধার ঝঞ্ঝাট মাত করো।
তারপর সে রঞ্জনকে আস্তে করে ঠেলে দেবার একটা ভাব দেখাল। লোকটার গায়ে অসম্ভব জোর, সেইটুকু ঠেলার চোটেই রঞ্জন হুমড়ি খেয়ে পড়ে যাচ্ছিল প্রায়, গাড়িটাকে ধরে সামলে নিল। লোকটি হেসে উঠে বলল, মোহন সিংজির সঙ্গে এবার থেকে সমঝে কথা বলবে।
রঞ্জন একটুও রাগ না করে বলল, উঃ, আপনার তো খুব গায়ের জোর! রোজ ব্যায়াম করেন বুঝি? আপনার নাম কী?
লোকটি বলল, বিরজু সিং। রঞ্জন বলল, আপনারা দুজনেই সিং। বাঃ বাঃ! তা হলে হামপিতে আবার আপনাদের সঙ্গে দেখা হচ্ছে?
মোহন সিং পিচ করে মাটিতে থুতু ফেলল। তাই দেখাদেখি বিরজু আরও থুতু ফেলে অবজ্ঞার সঙ্গে বলল, হুঁ।
ওদের গাড়িতে তেল ভরা হয়ে গিয়েছিল, ওরা, বেরিয়ে গেল আগে। রঞ্জন। নিজের গাড়ির চাবি পাম্পের লোকের হাতে দিয়ে কাকাবাবুর কাছে এসে বলল, হামপিতে গিয়ে বেশ মজা হবে মনে হচ্ছে। ঠিক যেন একটা গল্পের মতন শুরু।
কাকাবাবু বললেন, এবার শুধু বেড়াতে বেরিয়েছি। এবার আর কোনও গল্প-টল্পর দরকার নেই। জলের বোতলটা ভরে নাও।
পেট্রোল নিয়ে বেরিয়ে রঞ্জন কিছু কলা আর পেয়ারাও কিনে ফেলল। তখনই দেখা গেল রিঙ্কুরা জোরে হেঁটে আসছে এদিকে। গাড়িটা নজরে পড়তেই ওরা থেমে গিয়ে কী যেন বলাবলি করতে লাগল।
রঞ্জন বলল, আমাদের দেখতে না পেয়ে ওরা অনেক দৌড়োদৌড়ি করেছে, কিন্তু সেকথা স্বীকার করবে না, বুঝলেন তো! আসলে কিন্তু বেশ ঘাবড়ে গিয়েছিল।
কাকাবাবু বললেন, রিঙ্কুর বুদ্ধির ওপর আমার আস্থা আছে। সে তো এত সহজে ঘাবড়াবার মেয়ে নয়।
রিঙ্কুরা কাছে এসে গাড়িতে উঠে পড়ে বলল, আমরা এক ঘন্টার বেশি সময় নিইনি। এবার চলো।
রঞ্জন বলল, তোমরা আমাদের খুঁজতে কোথায়-কোথায় গিয়েছিলে?
রিঙ্কু খুব অবাক হয়ে বলল, খুঁজব কেন? তোমরা গাড়ির তেল নেবে, এ তো জানা কথাই! আমরা ভাল মিষ্টি কিনে আনলুম এই ফাঁকে। নিজেরা কয়েকটা খেয়েও এসেছি।
রঞ্জন জিজ্ঞেস করল, পাহাড়ের ওপর আওয়াজটা হয়েছিল কিসের?
রিঙ্কু পালটা প্রশ্ন করল, বলো তো কিসের? আন্দাজ করো!
রঞ্জন বলল, আমি তো কাকাবাবুকে আগেই বলে রেখেছি। ডিনা.. এই সন্তু, আমি কিন্তু ডিনামাইটের বাংলা বলতে পারব না। ডিনামাইট দিয়ে পাথর ফাটাচ্ছিল।
রিঙ্কু বলল, মোটেই না।
রঞ্জন বলল, তবে কি কেউ সত্যিকারের বোমা ছুঁড়েছিল? সন্তু, বোমা কথাটা কিন্তু বাংলা! আমি তো বম্ব বলিনি!
রিঙ্কু বলল, না, এবারও হল না। ওখানে একটা চলচ্চিত্রের চিত্রগ্রহণ হচ্ছিল।
কী হচ্ছিল? চলচ্চিত্রের চিত্রগ্রহণ! তার মানে? সিনেমার শুটিং!
সন্তু আর জোজো দুজনেই হাততালি দিয়ে উঠল। রিঙ্কু হাসতে হাসতে বলল, আমরা ঠিক জানতুম, রঞ্জন ইংরেজি করে বলবেই।
রঞ্জন একটু বিরক্ত হয়ে বলল, আসল ব্যাপারটা কী হয়েছে, তাই বলে না!
সন্তু বলল, ওখানে একটা চলচ্চিত্র তোলা হচ্ছে। দুদলের ডাকাতের মারামারির দৃশ্যে বন্দুকের গুলির শব্দ হল। ওখানে প্রচুর লোকের ভিড়।
জোজো বলল, ওখানে মোহন সিংকেও দেখলুম। সে ডাকাতের সদার হয়েছে। আমি যে ওকে চম্বলের ডাকাত বলেছিলুম, সেটা খুব ভুল ছিল না!
রিঙ্কু বলল, আমি আগেই ওকে চলচ্চিত্রের খলনায়ক বলেছিলুম।
কাকাবাবু বললেন, কিন্তু মোহন সিংকে যে একটু আগে এখানে দেখা গেল? এর মধ্যেই সে নেমে এল কী করে?
সন্তু বলল, আর একটা লোককে মোহন সিং-এর মতন সাজিয়েছে। তারও প্রায় ওইরকম চেহারা। আসল মারামারির দৃশ্যগুলো ওই নকল মোহন সিং করবে।
জোজো বলল, ওদের বলে স্টান.. স্টান… থাকগে, ওর বাংলা করা যাবে না।
গাড়িটা আবার ছুটতে লাগল বড় রাস্তা দিয়ে। রঞ্জন বলল, এখন কিন্তু কেউ ঘুমোবে না, তা হলে আমারও ঘুম পেয়ে যাবে।
সে এক টিপ নস্যি নিল নাকে।
রিঙ্কু ম্যাপটা বিছিয়ে বলল, রঞ্জন, হামপির আগে হস্পট বলে একটা জায়গা দেখতে পাচ্ছি। মনে হচ্ছে এটা একটা বড় জায়গা।
কাকাবাবু বললেন, ওই হসপেটেই আমাদের থাকতে হবে। হামপিতে কোনও থাকার জায়গা নেই।
সন্তু বলল, আমরা যে তুঙ্গভদ্রা নদীর ধারে অতিথিশালায় থাকব ঠিক ছিল? তুঙ্গভদ্রা নামটা কী সুন্দর।
কাকাবাবু বললেন, ওখানে বড় জোর রাতটা থাকা যাবে। ওখান থেকে হামপি বেশ দূর হবে, যাওয়া-আসা করা যাবে না।
জোজো হঠাৎ জিজ্ঞেস করল, আমরা যে হামপি দেখতে যাচ্ছি, সেখানে কী আছে?
সন্তু বলল, হামপিতে হামপি আছে। জোজো বলল, ও!
রঞ্জন জিজ্ঞেস করল, তুই যে গম্ভীরভাবে ও বললি, হামপি মানে তুই কী বুঝলি রে, জোজো? পাহাড়, জঙ্গল, না সমুদ্রের মধ্যে একটা দ্বীপ?
জোজো বলল, আমি একবার আমার ছোটমামার সঙ্গে কোকোডিমা বলে একটা দ্বীপে গেসলুম। সেই দ্বীপটা কোথায় তোমরা বলতে পারো?
জোজোর কথা ঘোরাবার ক্ষমতা দেখে কাকাবাবু পর্যন্ত একটু হেসে উঠলেন।
গল্প করতে করতে অনেকটা রাস্তা চলে আসা গেল। বিকেল হয়ে এল আস্তে। এখনও গরম কমবার নাম নেই! শ্চিমের আকাশটা লাল হয়ে উঠেছে।
একটা চৌরাস্তার মোড়ে এসে রঞ্জন গাড়িটা থামাল। এরপর কোনদিকে যেতে হবে, রিঙ্কু ঠিক বুঝতে পারছে না ম্যাপ দেখে।
রঞ্জন বলল, নেমে তা হলে জিজ্ঞেস করা যাক। কয়েকটা চায়ের দোকানও রয়েছে। ইচ্ছে করলে এখানে চা খাওয়া যেতে পারে।
সবাই গাড়ি থেকে নেমে পড়ল। পাশাপাশি তিনটে চায়ের দোকান। লম্বা-লম্বা বেঞ্চ আর খাটিয়া পাতা আছে বাইরে। কাছেই দাঁড়িয়ে আছে কয়েকটি লরি আর একটি সাদা রঙের গাড়ি।
একটি খাটিয়ার ওপর শুয়ে আছেন একজন বৃদ্ধ, তাঁর মাথার চুল, মুখের দাড়ি সব ধপধপে সাদা। বৃদ্ধটি বেশ অসুস্থ মনে হয়। তাঁর মাথার কাছে বসে একটি খুব সুন্দরী মেয়ে হাওয়া করছে পাখা দিয়ে। একজন মাঝবয়েসী লোক বৃদ্ধটিকে খাইয়ে দিচ্ছে চা।
কাকাবাবু অন্য একটি দোকানে বসলেন। বৃদ্ধটিকে একবার দেখে তাঁর ভুরু একটু কুঁচকে গেল। তার চেনা কোনও একজন মানুষের সঙ্গে ওই বৃদ্ধটির মুখের মিল আছে, কিন্তু কার সঙ্গে যে মিল তা কিছুতেই মনে করতে পারলেন না। তবে তা নিয়ে তিনি আর মাথা ঘামালেন না।
একটু পরে সেই বৃদ্ধটিকে ধরাধরি করে তোলা হল সাদা গাড়িটিতে। সেখানেও তিনি বসতে পারলেন না, শুয়ে পড়লেন মেয়েটির কোলে মাথা দিয়ে।
রঞ্জন কয়েকজনকে জিজ্ঞেস-টিজ্ঞেস করে এসে বলল, কাকাবাবু, রাস্তা পেয়ে গেছি, আর বেশি দূর নেই, বড়জোর এক ঘন্টা। তবে তুঙ্গভদ্রা গেস্ট হাউসে নাকি এখন অনেক লোক। ওই যে থুরথুরে বুড়ো লোকটিকে দেখছেন, উনিও দলবল নিয়ে সেখানেই যাচ্ছেন শুনলুম।
রিঙ্কু বলল, অত বুড়োলোকের বেড়াবার শখ কেন? দেখে তো মনে হয় যখন-তখন মরে যাবে! আমাদের তো টেলিফোন করা আছে, আমরা তুঙ্গভদ্রা গেস্ট হাউসেই থাকব।
সন্তু পকেট থেকে খাতা বার করল। রিঙ্কু বলল, এই, এই, টেলিফোন বলব না তো কী বলব রে।
সন্তু বলল, শুধু বাংলা বলতে চাইলে এইভাবে বলা যায়। আমাদের তো দূরভাষে বলা আছে, আমরা তুঙ্গভদ্রা অতিথি নিবাসে থাকব?
রিঙ্কু বলল, ধ্যাত, এইরকমভাবে কেউ কথা বলে? আমাদের বাড়ির একজন পুরুতঠাকুর এইভাবে কথা বলতেন।
সন্তু বলল, মোটে তো একদিন। কাল থেকে আবার যে-যার নিজের মতন কথা বলবে। রঞ্জনদা, তোমারও একটা ফাইন হয়েছে।
রঞ্জন প্রায় লাফিয়ে উঠে বলল, অ্যাই, অ্যাই, পেয়েছি! সন্তু ফাইন বলেছে! সন্তুরও এবার জরিমানা। তুই নিজেরটা লেখ সন্তু!
জোজো বলল, আচ্ছা সন্তু, আমি যদি পুরো ফরাসি ভাষায় কথা বলি, তাতে ৩৮৮
তো কোনও আপত্তি নেই? আজ তো শুধু ইংরিজি বলা চলবে না!
রঞ্জন জিজ্ঞেস করল, তুই ফরাসি জানিস বুঝি?
জোজো বলল, খুব ভাল জানি। আমি যখন বাবার সঙ্গে চার মাস প্যারিসে ছিলুম, তখন গড়গড় করে ফ্রেঞ্চ বলতে শিখেছি। চোখ বুজে বলতে পারি।
শুনবে?
রঞ্জন বলল, শুনি, শুনি?
জোজো সত্যি চোখ বুজে বলল, উই, উই, পারদোঁ ম্যাসিও, ম্যার্সি বকু, জ্য ন পার্ল পা ফ্রাঁসে!
রঞ্জন বলল, হুঁ, ফ্রেঞ্চ ভাষা চোখ বুজেই বলতে হয়।
কাকাবাবু বললেন, চমৎকার বলেছে! কিন্তু জোজো, তোমার এই ভাষা যে আমরা কেউ বুঝতে পারব না!
রিঙ্কু বলল, আর দেরি করে কী হবে, এইবার চলো। চা খাওয়া তো হয়ে গেছে। চা-টা একেবারে অখাদ্য।
এদিকটায় ছোট ছোট পাহাড়ের গা দিয়ে রাস্তা। তুঙ্গভদ্রার বাঁধ অনেকটা উঁচুতে। সেই বাঁধের গায়ে বেশ বড় আর পুরনো আমলের দোতলা অতিথিশালা। সামনে আরও তিনখানা গাড়ি দাঁড়ানো। তার মধ্যে সেই সাদা গাড়িটাও রয়েছে। একতলা-দোতলায় অনেক লোকজনের ব্যস্ততা।
একজন কেয়ারটেকারকে খুঁজে বার করা গেল। সে রঞ্জনের কোনও কথায় পাত্তাই দিতে চায় না। প্রথম থেকেই বলতে লাগল, জায়গা নেই, জায়গা নেই! রঞ্জন বারবার জানাবার চেষ্টা করতে লাগল যে, বাঙ্গালোর থেকে টেলিফোন করা হয়েছে ঘর রাখবার জন্য, তবু লোকটি গ্রাহ্য করল না।
রঞ্জন বলল, আপনি বলতে চান এত বড় ডাকবাংলোতে একটা ঘরও খালি নেই? এখন আমাদের হোটেল খুঁজতে যেতে হবে?
লোকটি বলল, একটাই মাত্র রুম রাখা আছে। সেটা রাজা রায়চৌধুরী নামে একজন ভি আই পির জন্য।
রঞ্জন বলল, উফ, আপনাদের নিয়ে আর পারা যায় না, মশাই! নিন, খুলুন, খুলুন। এতক্ষণ আমার নাম জিজ্ঞেস করেছেন? আমিই তো রাজা রায়চৌধুরী।
লোকটি সঙ্গে-সঙ্গে জিভ কেটে বলল, আরে ছি ছি, সে কথা বলেননি কেন? আপনাদের জন্য দোতলায় ভাল ঘর রাখা আছে। তিনখানা খাট। আসুন, আসুন! আমি চাবি আনছি!
রঞ্জন সন্তুকে বলল, এখানকার লোকগুলো কী রকম সৎ দেখলি? কাউকে অবিশ্বাস করে না। যে-কেউ এসে নিজের নাম রাজা রায়চৌধুরী বললেই ঘর খুলে দিত।
কাকাবাবু গাড়ি থেকে নেমে বললেন, আমাদের পূর্ব পরিচিত একজন বন্ধুও এখানে রয়েছে দেখছি।
কাকাবাবুর কথা শুনে সবাই ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল। দোতলার বারান্দায় একজন তোক রেলিং-এ ঝুকে দাঁড়িয়ে আছে। ভাল করে মুখটা দেখা না গেলেও কোনও সন্দেহ নেই, সে মোহন সিং।
কাকাবাবু বললেন, ভালই হল, ওর সঙ্গে এবার ভাল করে আলাপ করা যাবে।
ডাকবাংলোর দুজন আদালি এসে মালপত্র ওপরে নিয়ে গেল। কেয়ারটেকার ঘরের চাবি খুলে দিয়ে বলল, আপনারা রাত্তিরে খাবেন তো? খাবার অর্ডার এখনই দিয়ে দেবেন?
রিঙ্কু জিজ্ঞেস করল, কী কী পাওয়া যাবে?
লোকটি বলল, ভাত-রুটি, মুরগি, সবজি, ডাল, ডিমের কারি।
রঞ্জন বলল, কফি আছে আপনাদের?
লোকটি বলল, হ্যাঁ, কফি পাবেন।
রঞ্জন বলল, এখন আমাদের কফি আর ডিমের ওমলেট দিতে বলুন। রাত্তিরে আমরা মাংস-ভাত খাব।
রিঙ্কুর দিকে ফিরে সে বলল, আমরা তো ওবেলা নিরামিষ খেয়েছি, তাই আগে ডিম খেয়ে সেটা মেক-আপ করে নেওয়া যাক, তারপর মাংস হবে। ঠিক আছে?
রিঙ্কু বলল, সন্তু তুই লিখেনে, রঞ্জন আমাকে শুধু-শুধু মেক-আপ বলেছে।
রঞ্জন বলল, তাই তো! মুখ দিয়ে অটোমেটি…না, না, বলিনি, বলিনি, পুরোটা বলিনি, মুখ দিয়ে ফস করে এক-একটা ইংরেজি কথা বেরিয়ে আসে। ওর বদলে আমার কী বলা উচিত ছিল?
রিঙ্কু বলল, মিটিয়ে। মিটিয়ে বলা যেত।
রঞ্জন বলল, ডিম খেয়ে মিটিয়ে? যাঃ, এটা কীরকম যেন শুনতে লাগে!
জোজো বলল, ইয়ে বলতে পারতে, রঞ্জনদা! বাংলায় এই একটা চমৎকার শব্দ আছে, ইয়ে, এই ইয়ে দিয়ে সব কিছু বোঝানো যায়। এভরিথিং?
সন্তু বলল, হুঁ! এভরিথিং শব্দটা কি ফরাসি?
লম্বা বারান্দাটা এখন খালি, মোহন সিংকে ঘরটায় আর দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। পাশের ঘরটির দরজা ভেতর থেকে বন্ধ, একদম কোণের ঘরটায় অনেক লোকজনের গলার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। একটি নোক সে-ঘর থেকে হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে এদিকে আসতে আসতে সন্তুদের ঘরের সামনে থমকে দাঁড়াল!
রঞ্জন সঙ্গে সঙ্গে বলল, আসুন, আসুন, ভেতরে আসুন!
রঞ্জন এমনভাবে লোকটিকে ডাকল যেন অনেক দিনের চেনা।
লোকটি ঘরের মধ্যে না ঢুকে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে হিন্দিতে জিজ্ঞেস করল, একটা কথা জানতে চাই, আপনাদের মধ্যে কি কেউ ডাক্তার আছে?
রঞ্জন বলল, না, পাশ করা ডাক্তার কেউ নেই, তবে আমার স্ত্রী আমার ওপরে প্রায়ই নানারকম ডাক্তারি করেন।
লোকটি বলল, আপনাদের কাছে থার্মোমিটার আছে?
রঞ্জন বলল, ইশ, খুব দুঃখিত। বেড়াতে বেরোবার সময় থার্মোমিটার আনার কথা আমাদের মনেই পড়েনি। আনা উচিত ছিল নিশ্চয়ই?
লোকটি বেশ নিরাশ হয়ে বলল, আমাদের সঙ্গের একজন খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। মনে হচ্ছে একশো পাঁচ ডিগ্রি টেম্পারেচার উঠে গেছে। ইনি খুব নামকরা, সম্মানিত লোক।
রঞ্জন জিজ্ঞেস করল, কী নাম?
লোকটি বলল, ভগবতীপ্রসাদ শর্মা।
রঞ্জন বলল, আমি আবার এত মুখ্যু যে, অনেক বিখ্যাত লোকদেরই নাম শুনিনি।
কাকাবাবু ঘরের জানলার পর্দা সরিয়ে অন্ধকারের মধ্যে নদী দেখবার চেষ্টা। করছিলেন, হঠাৎ চমকে পেছন ফিরে জিজ্ঞেস করলেন, কী নাম বললেন? ভগবতীপ্রসাদ শর্মা? মানে, হিস্টোরিয়ান?
লোকটি বলল, হ্যাঁ, হ্যাঁ, খুব বড় হিস্টোরিয়ান। আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ার ডিরেক্টর জেনারেল ছিলেন। আমি তাঁর ভাইয়ের ছেলে, আমি চাচাকে প্রায় জোর করে নিয়ে এসেছি, এখন যদি কিছু একটা বিপদ হয়ে যায়…
কাকাবাবু বললেন, ভগবতীপ্রসাদ শর্মার তো অনেক বয়েস! প্রায় পঁচাশি-ছিয়াশি হবেই। আমি একবার তাঁকে দেখতে যেতে পারি?
সেই লোকটি বলল, হ্যাঁ, হ, যান না। আমি দেখি, নীচে কেয়ারটেকারের কাছে খোঁজ করে কোনও ডাক্তার পাওয়া যায় কি না?
লোকটি চলে যেতেই কাকাবাবু নিজের হাতব্যাগটা খুলে রিভলভার বার করলেন। স্টোর চেম্বার খুলে দেখে নিলেন ভেতরে গুলি আছে কি না! তারপর সেটার ডগায় কয়েকবার ফুঁ দিয়ে পকেটে ভরলেন।
রঞ্জন আর জোজো অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। কাকাবাবু হেসে ওদের বললেন, ও ঘরে খুব সম্ভবত মোহন সিং আছে। লোকটা রেগে আছে আমাদের ওপর। তোমরা একটু সাবধানে থেকো।
ক্রাচ খটখট করে কাকাবাবু বারান্দা পেরিয়ে এলেন কোণের ঘরটার কাছে। দরজা ভেজানো। তিনি আস্তে ঠেলে দরজাটা খুললেন।
অতি বৃদ্ধ ভগবতীপ্রসাদ একটা খাটে শুয়ে বিড়বিড় করে কী যেন বলছেন। তাঁর মাথায় জলপট্টি। তিন-চারজন লোক ঝুঁকে দাঁড়িয়ে আছে খাটের দুপাশে। তাদের মধ্যে একজন মোহন সিং, তার হাতে একটা টেপ রেকর্ডার, সেটা সে ধরে আছে অসুস্থ বুড়ো লোকটির একেবারে মুখের কাছে।
কাকাবাবুকে ঢুকতে দেখেই মোহন সিং কুটিলভাবে ভুরু কুঁচকে তাকাল।
কাকাবাবু সেদিকে গ্রাহ্য না করে এগিয়ে এলেন।
মোহন সিং জিজ্ঞেস করল, আপ ডাগদার হ্যায়? আপকো ইধার কেয়া চাইয়ে?
কাকাবাবু সে কথার উত্তর না দিয়ে ক্রাচ দুটো খাটের পাশে দাঁড় করিয়ে বৃদ্ধলোকটির একটি হাত ধরলেন! তারপর মোহন সিং-দের দিকে তাকিয়ে ধমকের সুরে বললেন, আপনারা এঁর কথা রেকর্ড করছেন, অথচ ইনি কী বলছেন, তা বুঝতে পারছেন না?
মোহন সিং-এর পাশের লোকটি বলল, ইনি পণ্ডিত লোক, জ্বরের ঘোরে ইনি যে-সব কথা বলছেন, সব রেকর্ড করে রাখছি। পরে ভাল করে শুনব। এখন বোঝা যাচ্ছে না?
কাকাবাবু বললেন, ইনি ওষুধ চাইছেন! সরবিট্রেট!
লোকটি বলল, এখানে আমরা কোথায় ওষুধ পাব? সেইজন্যই তো ডাক্তার ডাকতে গেছে একজন।
কাকাবাবু বললেন, এঁর ব্যাগ কোথায়? সেটা খুব ভাল করে দেখুন। এঁর এত বয়েস হয়েছে, নিশ্চয়ই সঙ্গে কিছু ওষুধ রাখেন।
ওরা দু-তিনজনে মিলে একসঙ্গে ব্যাগ ঘাঁটাঘাঁটি করতে লাগল। তারপর প্রায় চার-পাঁচরকম ওষুধ বার করে আনল। কাকাবাবু তার মধ্য থেকে একটা শিশি নিয়ে খুব ছোট্ট একটা ট্যাবলেট বার করলেন, সেটাকে আবার ভেঙে আদ্ধেক করলেন। তারপর খুব যত্ন করে সেই টুকরোটা ঢুকিয়ে দিলেন বৃদ্ধের জিভের তলায়।
তারপর মুখ তুলে কাকাবাবু বললেন, আপনারা মাথার কাছ থেকে সরে যান। জানলা খুলে হাওয়া আসতে দিন।
বৃদ্ধের বিড়বিড় করা বন্ধ হয়ে গেল, এক মিনিট পরেই তিনি চোখ মেলে তাকালেন। প্রথমেই কাকাবাবুকে দেখতে পেয়ে তিনি ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলেন, তুম কৌন?
কাকাবাবু বললেন, শর্মাজি, আমার নাম রাজা রায়চৌধুরী। অনেকদিন আগে আপনার সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল দেরাদুনে। আপনি আমাকে চিঠিও লিখেছেন কয়েকটা।
ভগবতীপ্রসাদ শর্মা কয়েক মুহূর্ত অপলকভাবে তাকিয়ে রইলেন কাকাবাবুর মুখের দিকে।
তারপর আস্তে-আস্তে বললেন, তুমি…তুমি রাজা রায়চৌধুরী? তুমি মহারাজ কণিষ্কের মুণ্ডু খুঁজে পেয়েছিলে, তাই না?
একে এত বৃদ্ধ, তার ওপর এমন অসুস্থ, তবু তাঁর এরকম স্মৃতিশক্তি দেখে কাকাবাবু একেবারে স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। ৩৯২
বৃদ্ধের চোখ দুটি হঠাৎ যেন জ্বলজ্বল করে উঠল। তিনি ঘরের অন্য সকলের দিকে তাকালেন, মোহন সিংকে জিজ্ঞেস করলেন, শিবপ্রসাদ কোথায়?
মোহন সিং বলল, তিনি ডাক্তার ডাকতে গেছেন। আপনি কেমন আছেন, একটু ভাল বোধ করছেন কি?
বৃদ্ধ চুপ করে রইলেন।
কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, শর্মাজি, আপনি এই বয়েসে এতদূর এসেছেন কেন? আপনার বাড়িতে এখন বিশ্রাম নেওয়াই উচিত।
মোহন সিং বলল, আমরা ওনাকে নিয়ে এসেছি। আমরা ওঁর দেখভাল করব। এখনই ডাক্তার এসে যাবে। আপনি ওনাকে বেশি কথা বলবেন না।
বৃদ্ধ নিজের কম্পিত হাত তুলে কাকাবাবুর একটা হাত চেপে ধরে অন্যদের বললেন, তোমরা সবাই ঘরের বাইরে যাও! রাজা রায়চৌধুরী, শুধু তুমি থাকো!
মোহন সিং বলল, চাচাজি, আমরা আপনার সেবা করব। এখন আপনি বেশি কথা বলবেন না।
বৃদ্ধ আবার বললেন, তোমরা সবাই বাইরে যাও। রাজার সঙ্গে আমার একটা কথা আছে।
খুব অনিচ্ছের সঙ্গে মোহন সিং আর তার দলবল বাইরে চলে গেল। বৃদ্ধ কাকাবাবুকে ইঙ্গিত করলেন, দরজাটা বন্ধ করে দেবার জন্য।
মোহন সিং টেপ রেকর্ডারটা চালু করে বিছানার ওপর রেখে গেছে। বৃদ্ধ নিজেই এবার উঠে বসে সেটা বন্ধ করে দিলেন। কাকাবাবুকে খুব কাছে ডেকে বললেন, একটা বিশেষ কাজে এসেছি এখানে, রাজা। এই শরীর নিয়ে আমার এখানে আসা উচিত ছিল না। কিন্তু এটাই হবে আমার শেষ আবিষ্কার। যদি আমি হঠাৎ মরে যাই, তবে তোমাকে সে দায়িত্ব নিতে হবে। তুমি ঠিক পারবে।
কাকাবাবু বললেন, আপনি উঠছেন কেন, শুয়ে থাকুন। আর কোনও ওষুধ খাবেন?
বৃদ্ধ বললেন, না, এখন একটু ভাল বোধ করছি। শোনো, আগে কাজের কথা বলি। তুমি তোমার কানটা আমার মুখের কাছে নিয়ে এসো, যেন আর কেউ শুনতে না পায়! তোমার কানে কানে বলব।
কাকাবাবু মাথাটা ঝুকিয়ে আনলেন।
সেই বৃদ্ধ চোখের নিমেষে বালিশের তলা থেকে একটা রিভলভার বার করে কাকাবাবুর কপালে ঠেকিয়ে বললেন, সাবধান! একটু নড়লেই তোমার জীবন শেষ! এইবার বলো তো, রাজা রায়চৌধুরী, তুমি আমাকে ফলো করে এখানে এসেছ কেন? তোমার কী মতলব?
কাকাবাবু মাথা সরালেন না। কিন্তু সেই অবস্থাতেই হেসে বললেন, এ তো ভারী মজার ব্যাপার দেখছি! আমি আপনাকে ফলো করব কেন? আপনি একটা দলবলের সঙ্গে এখানে এসেছেন, আর আমিও কয়েকজনকে নিয়ে এখানে বেড়াতে এসেছি। আমরা আলাদা আলাদাভাবে আসতে পারি না?
বৃদ্ধ বললেন, তুমি সত্যি বেড়াতে এসেছ, না অন্য কোনও উদ্দেশ্য নিয়ে এসেছ? তুমি তো এমনি-এমনি কোথাও যাও না!
কাকাবাবু বললেন, আমি এমনি কোথাও যাই না! আমি কি ইচ্ছেমতন বেড়াতে পারব না? আমি আজকাল আর অন্য লোকের কাজ নিই না। বেড়াতেই ভালবাসি।
সত্যি কথাটা বলো। নইলে, আমি ঠিক গুলি করব।
গুলি করুন! আমি মরে গেলেও বিশ্বাস করতে পারব না যে প্রোফেসর ভগবতীপ্রসাদ শর্মা মানুষ খুন করতে পারেন।
সত্যি দেখতে চাও গুলি করতে পারি কি না? আমি বলব, তুমি আমার গলা টিপে ধরতে এসেছিলে, তাই আমি সেলফ ডিফেন্সে গুলি করেছি।
আমি আপনার গলা টিপে ধরতে যাব কেন? একটা কিছু মোটিভ তো। থাকা দরকার। আপনাকে আমি শ্রদ্ধা করি, আপনার গায়ে হাত তোলার কথা আমি চিন্তাই করি না। আপনার হাত থেকে রিভলভারটা কেড়ে নেওয়া কি আমার পক্ষে খুব শক্ত হত?
বৃদ্ধ ফিসফিস করে বললেন, রাজা রায়চৌধুরী, তোমাকে আমি ভাল করেই চিনি, দরজার আড়াল থেকে মোহন সিংরা দেখছে, তাই আমি এই অভিনয় করছি। মোহন সিং-এর দল তোমাকে দেখে চিন্তায় পড়ে গেছে। আমি এখন তোমাকে যে কয়েকটা কথা বলছি, তা খুব মন দিয়ে শোনো। আর কেউ যেন জানতে না পারে। আমি হঠাৎ মরে গেলে তুমি আমার কাজটা সম্পূর্ণ করবে।
এরপর বৃদ্ধ আরও আস্তে-আস্তে কয়েকটা কথা বললেন, শুনতে-শুনতে কাকাবাবুর কপাল কুঁচকে গেল।
তারপর আবার গলা চড়িয়ে বৃদ্ধ বললেন, এবার তোমায় ছেড়ে দিলাম। যদি প্রাণের মায়া থাকে, তা হলে খবদার আমার সামনে তুমি আর আসবে না।
এই সময় দরজায় দুম দুম করে ধাক্কা পড়ল। একজন কেউ চেঁচিয়ে বলল, ডাক্তার আ গয়া। খোলিয়ে, খখালিয়ে!
বৃদ্ধ চোখ টিপে বললেন, মনে রেখো, আমার কথাগুলো।
কাকাবাবু এগিয়ে গিয়ে দরজাটা খুলে দিলেন।
শর্মাজির ভাইপো কোথা থেকে একজন ডাক্তার জোগাড় করে এনেছে।
সবাই বৃদ্ধের খাটের দিকে এগিয়ে গেল। শুধু মোহন সিং কাকাবাবুর কাঁধটা খামচে ধরে বলল, রায়চৌধুরী, প্রোফেসর-সাহেব তোমাকে কী কথা বললেন? সাফ খুলে বলো!
কাকাবাবু বললেন, বলছি, তুমি বারান্দার ওই কোণে চলল। খুব জরুরি কথা।
মোহন সিং কাকাবাবুর কাঁধটা ছাড়ল না, প্রায় টানতে টানতে নিয়ে চলল। একটা ক্রাচ পিছলে গিয়ে কাকাবাবু প্রায় হুমড়ি খেয়ে পড়ে যাচ্ছিলেন একবার। তবু রিভলভারটা বার করলেন না। তাঁর ক্রাচ দুটো খসে পড়ে গেল মাটিতে।
বারান্দার এই কোণটা বেশ অন্ধকার মতন। দিনের বেলা এখান থেকে তুঙ্গভদ্রা নদীর বাঁধ দেখতে পাওয়া যায়, কিন্তু এখন সবকিছুই ঝাপসা।
কাকাবাবু শান্ত গলায় বললেন, তোমাদের প্রোফেসর সাহেবের সঙ্গে আমার অনেক দিনের চেনা। তিনি আমার কানে কানে বললেন, তুমি ওই মোহন সিংকে একটু ভদ্রতা শিখিয়ে দিও তো! ও সবসময় নিজেকে সিনেমার ভিলেইন মনে করে।
মোহন সিং ধমক দিয়ে বলল, তুমি আমার সঙ্গে মজা মারছ, ঠিক করে বলো।
কাকাবাবু বললেন, ভদ্রলোকের কাঁধে হাত দিয়ে কথা বলতে নেই, জানো? হাত সরাও!
মোহন সিং আরও কিছু বলতে গেল, তার আগেই হঠাৎ কাকাবাবু একটু নিচু হয়ে তার ডান চোখে খুব দ্রুত একটা ঘুসি চালালেন। মোহন সিং একটা আর্ত চিৎকার করে কাকাবাবুর কাঁধ ছেড়ে দিয়ে দু হাতে চোখ চাপা দিল।
কাকাবাবু এবার মোহন সিং-এর কাঁধটা ধরে এক ঝটকায় তার শরীরটা উলটে দিলেন। মোহন সিং বারান্দার রেলিং-এর ওপারে শূন্যে ঝুলতে লাগল। এতই ভয় পেয়ে গেছে সে যে, মুখ দিয়ে শুধু আঁ-আঁ শব্দ করছে, আর কোনও কথা বলতে পারছে না। তার অত বড় শরীরটা যে কাকাবাবু অবলীলাক্রমে তুলে ফেলতে পারবেন, তা যেন এখনও বিশ্বাস করতে পারছে না সে।
কাকাবাবু বললেন, এবার আমি তোমাকে নীচে ফেলে দিতে পারি। কিন্তু ভদ্রলোকেরা মানুষকে চট করে এত কঠিন শাস্তি দেয় না। আর কখনও নিজের বন্ধুবান্ধব ছাড়া অন্য কারও কাঁধে হাত দিয়ে কথা বোলো না। আর দু নম্বর হল, ইন্ডিয়া ইজ আ ফ্রি কান্ট্রি, যার যেখানে খুশি যেতে পারে। আমি হামপি-তে যাব কি যাব না, তা নিয়ে তুমি মাথা ঘামাচ্ছ কেন?
মোহন সিং দু হাত দিয়ে রেলিংটা ধরার চেষ্টা করছে। কাকাবাবুর মুঠি একটু আলগা হয়ে গেলেই সে পড়ে যাবে। এর মধ্যেই সে একবার চেঁচিয়ে উঠল, বিরজু, বিরজু!
কাকাবাবু বললেন, তোমার ওই বিরজু লোকটা পেট্রোল পাম্পে আমাদের রঞ্জনকে অকারণে একটা ধাক্কা দিয়েছিল। তাকেও বলে দিও যেন যখন তখন সে গায়ের জোর না দেখায়।
খুব জোরে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে তিনি মোহন সিংকে ফিরিয়ে আনলেন বারান্দায়। সেখানে তাকে ঠেসে ধরে কাকাবাবু আবার বললেন, ভগবতীপ্রসাদ শর্মা আমার গুরুর মতন। উনি হুকুম করলে আমি ওঁর পা-ধোওয়া জলও খেতে পারি। উনি বুঝেছেন যে, আমরা শুধু ছুটিতে বেড়াতে এসেছি, আমাদের অন্য কোনও উদ্দেশ্য নেই। আমরা তোমাদের কোনও ব্যাপারে ডিসটার্ব করব না। তোমরাও আমাদের ডিসটার্ব কোরো না।
মোহন সিংকে ছেড়ে দিয়ে কাকাবাবু ক্রাচ দুটো তুলে নিলেন। তারপর হাঁটতে শুরু করলেন পেছন ফিরে।
মোহন সিং ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। সে যেন এখনও বিশ্বাস করতে পারছে না যে, কাকাবাবুর হাতে এত জোর। তার বুকের মধ্যে ঢিপঢিপ শব্দ হচ্ছে।
সন্তু চোখ মেলে দেখল, তার পাশে জোজো গভীরভাবে ঘুমিয়ে আছে। আলোয় ভরে গেছে ঘর। এখন কটা বাজে কে জানে? রোদুরের রং দেখে মনে হয়, বেশ বেলা হয়েছে। রঞ্জন আগের রাত্রেই বলে রেখেছিল, আজ সে অনেক দেরি করে উঠবে। কোনও তাড়া তো নেই।
জোজোকে না ডেকে সন্তু বাইরে বেরিয়ে এল।
দোতলায় আর কোনও মানুষজনের চিহ্ননেই। পাশের ঘরগুলো খালি। মোহন সিং-এর দলবল, সেই বৃদ্ধ ভদ্রলোক, সবাই উধাও।
হাওয়ায় একটু শীত শীত ভাব। সন্তু পরে আছে শুধু পাজামা আর গেঞ্জি, সেই অবস্থাতে সে চলে এল বারান্দার একধারে। এখান থেকে তুঙ্গভদ্রা নদী ভাল করে দেখা যায় না, বাঁধটা অনেকটা উঁচু, তাতে খানিকটা ঢাকা পড়ে গেছে।
সন্তু উঁকি দিয়ে দেখল, নীচের বাগানে একটা লোহার বেঞ্চে বসে আছেন কাকাবাবু। গায়ে একটা চাদর। অন্যমনস্কভাবে আঙুল বোলাচ্ছেন গোঁফে।
সন্তু নেমে এল বাগানে। কাকাবাবুর পায়ের কাছে একটা চায়ের ট্রে, তাতে দুটি কাপ, দুটি কাপেই চা ঢালা হয়েছিল। কিন্তু কাকাবাবু ছাড়া বাগানে আর কোনও লোককে দেখতে পাওয়া গেল না।
কাকাবাবু প্রথমটায় সন্তুকে দেখতে পেলেন না। কাকাবাবু কিছু একটা নিয়ে চিন্তা করছেন, সন্তু তাই কোনও কথা না বলে এগিয়ে গেল বাঁধের দিকে। এখানে নদী বেশ চওড়া, সকালের আলোয় রুপোর মতন ঝকঝক করছে। নদী দেখতে সন্তুর সব সময়ই ভাল লাগে। কোনও নদীই একরকম নয়। কতদিন আগে থেকে বইছে এই নদী, এর দুপারে কত মানুষ থেকে গেছে, কত গ্রাম-নগর ধ্বংস হয়েছে, তবু নদী ঠিক একইরকমভাবে বয়ে চলেছে।
সন্তুর ইচ্ছে হল—এই নদীতে নেমে একবার সাঁতার কাটবে। জোজোকে ডাকা দরকার। জোজো অবশ্য সাঁতার জানে না, জলকে ভয় পায়, তবু জোজোকে পারে দাঁড় করিয়ে রাখা যাবে। একদম একলা-একলা জলে নামতে ভাল লাগে না। এখানে আর কেউ স্নান করছেও না, দু-একটা মাছধরা নৌকো দেখা যাচ্ছে শুধু।
সন্তু বাঁধ থেকে নেমে আসতেই কাকাবাবু তাকে দেখতে পেয়ে বললেন, সবাই এখনও ঘুমোচ্ছে? এবার ডাকো, ব্রেকফাস্ট খেয়ে বেরিয়ে পড়া যাক।
সন্তু জিজ্ঞেস করল, আমরা কি একদম চান-টান করে বেরোব, না দুপুরে আবার ফিরে আসব?
কাকাবাবু বললেন, এখনও গরম পড়েনি, বেশ ঠাণ্ডা-ঠাণ্ডা আছে। তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়াই ভাল, হামপি দেখতে অনেকক্ষণ লাগবে। সবাই মিলে চান করতে গেলে দেরি হয়ে যাবে না?
এই সময় দেখা গেল রঞ্জন আর রিঙ্কু নেমে আসছে বাগানের দিকে। রঞ্জনের চুল উসকোখুসকো, চোখে এখনও ঘুম লেগে আছে মনে হয়। রিঙ্কু কিন্তু এরই মধ্যে বেশ ফিটফাট হয়ে গিয়েছে।
রঞ্জন একটু দূর থেকেই বলল, সুপ্রভাত কাকাবাবু, আপনার কাছে ঘড়ি আছে? এই রিঙ্কু শুধু-শুধু আমাকে ধাক্কা মেরে-মেরে বিছানা থেকে তুলল। আমি যত বলছি, এখন সাড়ে ছটার বেশি হতেই পারে না। এখনও ভোর রয়েছে।
কাকাবাবু হাসতে হাসতে বললেন, আমার হাতে ঘড়ি নেই, কিন্তু আকাশে তো মস্ত বড় একটা ঘড়ি রয়েছে। সেটার দিকেই তাকিয়ে বলা যায়, এখন অন্তত সাড়ে আটটা বেজে গেছে।
রঞ্জন বলল, তা হলে তো ঠিকই আছে। দক্ষিণ দেশে নটার পর সকাল হয়, তার আগেকার সময়টাকে এরা বলে ভোর।
রিঙ্কু বলল, রঞ্জনকে না ডাকলে ও সারাদিন ঘুমোতে পারে, জানেন!
রঞ্জন বলল, তাতেই বোঝা যায়, আমার হেল…হেল.. মানে স্বাস্থ্য কত ভাল। আবার দরকার হলে আমি সারারাত জেগে থাকতে পারি। এখন একখানা বেশ ভাল করে অবগাহন স্নান করতে হবে, কী বলো শ্রীমান সন্তু? আমার সঙ্গে সন্তরণ প্রতিযোগিতা হবে নাকি? শুনেছি তুমি ভাল সাঁতার জানো। তুঙ্গভদ্রা নদী এপার-ওপার করার চ্যা…চ্যা… বাজি ফেলবে?
হঠাৎ রঞ্জন অন্যদের দিকে তাকিয়ে বলল, আরে, বাংলা খেলা তো কাল রাত্তিরেই শেষ হয়ে গেছে। আমি এত কষ্ট করে বাংলা বলছি কেন? গুড মর্নিং-এর দলে সুপ্রভাত বলে ফেললুম! আজ সারাদিন প্রাণ ভরে ইংরেজি বলব!
রিঙ্কু বলল, শুধু-শুধু ইংরেজি বলার দরকারই বা কী? গুডমর্নিং-এর বদলে সুপ্রভাত শুনতে তো বেশ ভালই লাগে!
রঞ্জন বলল, তুমি বাজে কথা বোলো না। তোমার কাল সবচেয়ে বেশি ফাইন হয়েছে। টাকাটা তুমি আজই সন্তুর কাছে জমা করে দাও, মেরে দেবার চেষ্টা কোরো না।
কাল রাত্তিরে খাওয়াদাওয়ার পর হিসেব করা হয়েছিল, কে কতগুলো ইংরেজি বলে ফেলেছে। রিঙ্কু আর রঞ্জন প্রায় সমান-সমান, রিঙ্কু আঠাশ টাকা আর রঞ্জনের সাতাশ।
রঞ্জন আবার সন্তুকে বলল, কী, আমার সঙ্গে সুইমিং কমপিটিশানে নামতে রাজি আছ? তুঙ্গভদ্রা এপার-ওপার, একশো টাকা বাজি। চ্যালেঞ্জ!
রিঙ্কু বলল, রাজি হয়ে যা, সন্তু! একশো টাকা পেয়ে যাবি। রঞ্জন সাঁতারই। জানে না?
রঞ্জন আকাশ থেকে পড়ার মতন অবাক হয়ে বলল, আমি সাঁতার জানি না? আমি একটা জেনুইন বাঙাল, আমাদের সাতপুরুষ পূর্ববাংলার নদী-নালার দেশে…তুমি জানো, ওখানে চার বছরের বাচ্চারাও পুকুরে ড়ুব-সাঁতার দিতে। শিখে যায়।
রিঙ্কু বলল, তুমি তো আর কোনওদিন পূর্ববাংলায় ছিলে না! তোমায় আমি কোনওদিন সাঁতার কাটতে দেখিনি।
রঞ্জন বলল, দেখোনি, আজ দেখিয়ে দিচ্ছি! আমি কলকাতার গঙ্গা কতবার এপার-ওপার করেছি! ও হ্যাঁ, জোজো কোথায়? সে নিশ্চয়ই আমার থেকেও বড় চ্যাম্পিয়ান? জোজো খুব সম্ভব কোনও সমুদ্র এপার-ওপার করেছে।
সন্তু বলল, জোজো এখনও জাগেনি।
কাকাবাবু বললেন, তোমাদের সাঁতারের কেরামতি এখন দেখতে গেলে অনেক দেরি হয়ে যাবে। তোমরা যদি স্নান করেই বেরোতে চাও তো বাথরুমেই স্নান করে নাও। আমার মনে হয়, মপি দেখতে হলে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়াই ভাল।
রঞ্জন বলল, কাকাবাবু, আপনার আর সন্তুর চা খাওয়া হয়ে গেছে দেখছি। আমরাও এই বাগানে বসেই বেড-টি খাব! অ্যাই সন্তু, একটু চায়ের কথা বলে দে না ভাইটি!
সবাই এক সঙ্গে হেসে উঠল।
কাকাবাবু বললেন, সন্তু চা খায়নি আমার সঙ্গে। অন্য একজন ভদ্রলোকের সঙ্গে আলাপ হল। তিনি চা খেতে-খেতে গল্প করছিলেন আমার সঙ্গে।
গেস্ট হাউসের একজন বেয়ারা এদিকেই আসছিল কাপগুলো নিতে, তাকেই বলে দেওয়া হল চায়ের কথা। দোতলার বারান্দায় দেখা গেল জোজোকে। সন্তু তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকল।
রঞ্জন জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা কাকাবাবু, আমরা যে হামপি দেখতে যাচ্ছি, সেখানে আসলে কী দেখার আছে একটু বুঝিয়ে বলুন তো!
কাকাবাবু বললেন, হামপি এখানকার একটি গ্রামের নাম। এককালে ওইখানেই ছিল বিজয়নগর রাজ্যের রাজধানী। বিজয়নগরের কথা ইতিহাসে পড়েছ নিশ্চয়ই।
রঞ্জন বলল, আমি অঙ্কে খুব ভাল তো, সেইজন্য ইতিহাস আর ভূগোলে খুব কাঁচা। তা ছাড়া ইস্কুল ছাড়বার পর তো আর ইতিহাস পড়িনি! বিজয়নগর নামে একটা রাজ্য ছিল বুঝি?
রিঙ্কু ধমক দিয়ে বলল, অ্যাই রঞ্জন, তুমি বিজয়নগরের কথা জানো না! বিজয়নগর আর বাহমনি, এই দুটো রাজ্যের মধ্যে সবসময় লড়াই হত!
সন্তু বলল, হরিহর আর বুক নামে দুই ভাই বিজয়নগর রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করেছিল দক্ষিণ ভারতে। দিল্লিতে তখন পাগলা রাজা মহম্মদ বিন তুঘলকের আমল। সেটা ফোরটিনথ সেঞ্চুরির মাঝামাঝি।
রঞ্জন সন্তুর কাঁধে হাত দিয়ে বলল, বাহ্, তোর তো বেশ ইতিহাসে মাথা। সেঞ্চুরি পর্যন্ত মনে আছে। হ্যাঁ বুঝলাম, বিজয়নগর নামে একটি রাজ্য ছিল, তার রাজারা সবসময় মারপিট করত। তারপর?
কাকাবাবু বললেন, হামপিতে সেই এককালের বিরাট শহর বিজয়নগরের রুইনস আছে। সেইগুলোই দেখতে যাচ্ছি।
রঞ্জন অবহেলার সঙ্গে বলল, ওঃ, হিস্টোরিক্যাল রুইনস? তার মানে তো দু-চারটে ভাঙা দেওয়াল আর আধখানা মন্দির, আর-একটা লম্বা ধ্যাড়েঙ্গা গেট। যে-জায়গাটায় হাতি থাকত সেই জায়গাটাই দেখিয়ে গাইডরা বলবে, এটাই ছিল মহারানির প্রাসাদ। এই তো? এ-আর দেখতে কতক্ষণ লাগবে? বড়জোর একঘন্টা! এই হিস্টোরিক্যাল রুইনস-টুইনসগুলো সাধারণত খুব বোরিং হয়।
রিঙ্কু বলল, মোটেই না! আমার এসবগুলো দেখতে খুব ভাল লাগে।
রঞ্জন বলল, ঠিক আছে, আমি গাছতলায় শুয়ে থাকব। তোমরা যত খুশি পেট ভরে দেখো দুঘন্টা, তিনঘন্টা, তার বেশি তো লাগবে না! লাঞ্চের আগেই শেষ হয়ে যাবে। আমি বলি কী, এই গেস্ট হাউস ছাড়ার দরকার নেই, আমরা এখানেই ফিরে আসব আবার। রাত্তিরটা জমিয়ে আড্ডা দেওয়া যাবে।
জোজো বাগানে এসে সন্তুর পাশে দাঁড়িয়েছে। সে জিজ্ঞেস করল, হামপিতে যদি ভাঙাচোরা জিনিস ছাড়া আর কিছুই দেখবার না থাকে, তা হলে ওই মোহন সিং সেখানে যেতে আমাদের বারণ করল কেন? কাকাবাবুকে শাসালই বা কেন?
রঞ্জন বলল, দ্যাট ইজ আ মিলিয়ন ডলার কোয়েশ্চেন। আমিও ঠিক সেই কথাই ভাবছিলুম। আমরা হামপি বেড়াতে গেলে ওর অসুবিধের কী আছে? তা ছাড়া ওই গণ্ডারটা কাকাবাবুকে পঞ্চাশ হাজার টাকার একটা কাজ দিতে চেয়েছিল।
কাকাবাবু বললেন, এখন একটু-একটু মনে পড়ছে, ওই মোহন সিং-এর ভাই। সুরয সিংকে আমি একবার জব্দ করেছিলুম। সুরয সিং এখন জেল খাটছে। সেইজন্যেই আমার ওপর মোহন সিং-এর রাগ থাকতে পারে। পঞ্চাশ হাজার টাকার লোভটা কেন দেখিয়েছিল বুঝতে পারছি না। আমাকে কোনও ফাঁদে ফেলতে চেয়েছিল বোধহয়।
রিঙ্কু বলল, ওর কথায় আমরা ভয় পাব নাকি! আমরা হমপি দেখতে এসেছি, সেখানে যাবই। কাকাবাবুর সঙ্গে ওরকম একটা জায়গা দেখার চান্স আর কখনও পাব? কাকাবাবু সবকিছু ভাল বুঝিয়ে দিতে পারবেন। চলো, চলো, সবাই তৈরি হয়ে নাও!
আধঘন্টার মধ্যেই বেরিয়ে পড়া হল। গেস্ট হাউসটা না ছেড়ে সেখানে রেখে যাওয়া হল কিছু জিনিসপত্র। সবাই ওঠার পর রঞ্জন গাড়িতে স্টার্ট দিয়ে বলল, ওই মোহন সিং ব্যাটা সিনেমায় ডাকাতের পার্ট করে, ব্যবহারটাও ডাকাতের মতন। আবার ওদের দলে একজন আশি নব্বই বছরের থুথুরে বুড়ো, সে নাকি একজন নামকরা পণ্ডিত, এই অদ্ভুত কম্বিনেশনটা আমি বুঝতে পারছি না।
রিঙ্কু বলল, ওরা দলবল মিলে সবাই হামপিতে গেছে নিশ্চয়ই। চলো,একটু পরেই সব বোঝা যাবে।
ওদের দু জনের এই কথা শুনে কাকাবাবু একটু মুচকি হাসলেন, কিন্তু কোনও মন্তব্য করলেন না।
কিছুদূর যাবার পর একটা ছোট্ট শহর মতন দেখা গেল। সেটার নাম হসপেট। কিছু দোকানপাট, হোটেল আর রেল স্টেশন আছে।
গেস্ট হাউসে শুধু ডিম আর পাউরুটি ছাড়া আর কিছু ছিল না বলে ওরা সেখানে ব্রেকফাস্ট খায়নি। ডিম আর টোস্ট তো রোজই খাওয়া হয়, বাইরে বেড়াতে এসেও ওসব খেতে ভাল লাগে না। রিঙ্কুর আজ পুরি-তরকারি-জিলিপি খাওয়ার ইচ্ছে হয়েছে।
সেরকম দু-তিনটে দোকান দেখা গেল। রঞ্জন গাড়ি দাঁড় করাল একটা দোকানের সামনে। সকালবেলার শীত-শীত ভাবটা এরই মধ্যে চলে গেছে, আজ অবশ্য সঙ্গে খাবার জল নেওয়া হয়েছে তিন বোতল।
গাড়ি থেকে নামতে নামতে কাকাবাবু বললেন, এখান থেকে হামপি আর ছ-সাত কিলোমিটার দূরে। কিন্তু একসময় বিজয়নগর রাজ্য শুরু হয়েছিল প্রায় এখান থেকেই। এইদিক দিয়েই পর্তুগিজরা আসত গোয়া থেকে। ওরা ঘোড়া বিক্রি করত। বিজয়নগরের রাজারা ঘোড়া আমদানি করত ইওরোপ থেকে। পর্তুগিজরা সেই ঘোড়া সাপ্লাই দিত।
জোজো জিজ্ঞেস করল, ইউরোপ থেকে ঘোড়া কিনত কেন? আমাদের দেশে তখন ঘোড়া পাওয়া যেত না?
কাকাবাবু বললেন, হ্যাঁ, পাওয়া যেত। কিন্তু সেগুলো ছোট-ছোট। ইওরোপের ঘোড়া অনেক বড় আর তেজি বেশি। তখনকার দিনে যে রাজার যত বেশি শক্তিশালী অশ্বারোহী সৈন্যবাহিনী থাকত, তারাই যুদ্ধে জিতে যেত।
সন্তু বলল, আমাদের দেশের ঘোড়াগুলো সব টাট্টু ঘোড়া?
কাকাবাবু বললেন, সব নয়, বেশির ভাগ। ভাল জাতের ঘোড়া বিদেশ থেকেই এসেছে।
রঞ্জন বলল, সেইসব ভাল ভাল ঘোড়া যুদ্ধেই মরে গেছে নিশ্চয়ই। এখানকার টাঙার ঘোড়াগুলো দেখুন, বেতো-বেতো, রোগা-রোগা?
এই শহরের রাস্তা দিয়ে টাঙ্গার মতন একরকম গাড়ি যাচ্ছে অনেক। রঞ্জনের কথাই ঠিক, সেগুলোর কোনও ঘোড়াই তাগড়া নয়।
পাঁচজনের এই দলটি গিয়ে বসল একটা রেস্তোরাঁর দোতলায়। এর মধ্যে রঞ্জনের চেহারাটাই আগে চোখে পড়ে। লম্বা-চওড়া, মুখভর্তি দাড়ি, আজ সে মাথায় একটা টুপি পরেছে ক্রিকেট খেলোয়াড়ের মতন। অনেকেই তার দিকে তাকিয়ে থাকে।
খাবারের অর্ডার দেবার পর রঞ্জন বলল, হামপিতে যাবার পর যতদূর মনে। হচ্ছে ওই মোহন সিং-এর সঙ্গে দেখা হবেই। সে যদি আবার ধমকাধমকি শুরু করে, তা হলে আমাদের স্ট্র্যাটেজি কী হবে, সেটা আগে ঠিক করে ফেলা যাক। রিঙ্কু বলল, ইশ, ধমকালে হলই নাকি! বিজয়নগরটা কী ওর মামাবাড়ি? ও যদি গায়ে পড়ে আর-একটা কথা বলতে আসে, তা হলে ওকে আমি পুলিশে ধরিয়ে দেব!
রঞ্জন বলল, কাকাবাবু, জানেন তো, রিঙ্কুর ধারণা, ভারতবর্ষের সব পুলিশ ওর হুকুম শুনতে বাধ্য।
রিঙ্কু বলল, কেন শুনবে না? একজন লোক যদি অন্যায় করে, পুলিশ। তাকে ধরবে না?
জোজো বলল, তোমরা আমার ওপর ছেড়ে দাও! এবার মোহন সিং কিছু করতে এলে আমি একাই ওকে ঢিট করব!
রঞ্জন বলল, তা জোজো পারবে। জোজো সব পারে।
টেবিলের ওপর থেকে একটা ছোেট প্লাস্টিকের বাটি তুলে নিল জোজো। সেই বাটিতে রয়েছে শুকনো লঙ্কার গুঁড়ো। এদিককার লোকেরা খুব ঝাল খায়, সব খাবারে শুকনো লঙ্কার গুঁড়ো মিশিয়ে নেয়। জোজো পকেট থেকে রুমাল বার করে তাতে ঢেলে নিল লঙ্কার গুঁড়োগুলো। তারপর রুমালটায় পুঁটুলি বেঁধে পকেটে রাখল।
সন্তু বলল, হাতটা ধুয়ে নে জোজো। নইলে কখন নিজের হাত চোখে লাগিয়ে কান্নকাটি শুরু করবি।
রিঙ্কু বলল, ওসব করবার দরকার নেই। লোকটাকে আমি ঠিক পুলিশে ধরাব!
রঞ্জন বলল, অর্থাৎ কিছুই ঠিক হল না। কাকাবাবু কিছু বলছেন না, তার মানে তিনি কিছু একটা ঠিক করে রেখেছেন। যাকগে! বিজয়নগর দেখার পর আমরা কোথায় যাব?
রিঙ্কু বলল, এরপর আমরা গোয়া যাব!
রঞ্জন বলল, সে তো অনেক দূরে! অতখানি কে গাড়ি চালাবে?
সন্তু বলল, রঞ্জনদা, ওই যে তুঙ্গভদ্রা নদী আমরা দেখলাম, সেই নদী কোনও এক জায়গায় কৃষ্ণা নদীতে মিশেছে। সেইখানটায় একবার গেলে হয় না?
রঞ্জন বলল, গ্রেট আইডিয়া, একসঙ্গে দুটো নদীর জল লুটোপুটি, হুটোপুটি করছে, সেটা তো দেখতেই হবে। সেখানে আমরা সাঁতার কাটব, কী বলল সন্তু?
রঞ্জন একথায় এত উৎসাহিত হয়ে গেল যে, ঝটপট সাত-আটখানা পুরি আর আলুর দম খেয়ে নিয়েই উঠে দাঁড়িয়ে বলল, তাড়াতাড়ি, সবাই তাড়াতাড়ি করো। আগে আমরা ইতিহাস-ফিতিহাস দেখা সেরে নিই, তারপর চলে যাব তুঙ্গভদ্রার ধার দিয়ে দিয়ে কৃষ্ণা নদীর দিকে। আহা, কৃষ্ণা নদী, কী সুন্দর নাম!
রঞ্জনের তাড়ায় গরম গরম কফি পেয়ালায় ঢেলে খেতে হল জোজো আর সন্তুকে। তারপর আবার গাড়িতে চড়া।
হামপিতে ঢোকার মুখে একদল গাইড দাঁড়িয়ে থাকে। বিজয়নগরের ভাঙা রাজধানী অনেকটা ছড়ানো, দেখবার জিনিসগুলো বেশ দূরে-দূরে, গাইডের সাহায্য ছাড়া খুঁজে পাওয়া মুশকিল। রঞ্জনদের গাড়িটা গেটের কাছে থামতেই চার-পাঁচজন গাইড ছুটে এল।
কাকাবাবু বললেন, গাইড নেবার দরকার নেই। জায়গাগুলো আমার মোটামুটি মনে আছে।
গাইডরা সবাই মিলে একসঙ্গে বলতে লাগল, অনেক নতুন নতুন জায়গা বেরিয়েছে। অনেক জায়গা খুঁড়ে নতুন জিনিস বেরিয়েছে।
রঞ্জন বলল, আরে ভাই, হামলোগ নতুন জিনিস দেখনে নেহি আয়া। হামলোগ পুরনো ইতিহাস দেখে গা!
একজন গাইড তবু জোর করে সামনের দরজা খুলে কাকাবাবুর পাশে উঠে পড়তে যাচ্ছিল, কাকাবাবু একটা হাত তুলে তাকে আটকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি আমাদের গাইড হতে চান তো? তার আগে আমার একটা প্রশ্নের উত্তর দিন। রাম রায় যখন বিজয়নগর আক্রমণের কথা শুনলেন, তখন তিনি কী করছিলেন?
লোকটি থতমত খেয়ে বলল, রাম রায়?
কাকাবাবু বললেন, আপনি রাম রায়ের নামও শোনেননি.? তা হলে আপনি আমাদের গাইড হবেন কী করে? আমার সঙ্গের এই ছেলেমেয়েরা যে অনেক প্রশ্ন করবে?
গাইডটি গাড়ির দরজা থেকে একটু সরে গেল। তারপর দাঁত-মুখ খিচিয়ে, ডান হাতের বুড়ো আঙুল তুলে কলা দেখিয়ে বলল, ঠিক আছে, যাও না, যাও! তোমরা কিছুই দেখতে পাবে না! কিছুই দেখতে পাবে না!
রঞ্জন আবার গাড়ি স্টার্ট দিল বটে, কিন্তু ভুরু কুঁচকে বলল, লোকটা কি আমাদের অভিশাপ দিল নাকি?
রিঙ্কু হাসতে হাসতে বলল, লোকটা খুব রেগে গেছে! ও বেচারা কী করে বুঝবে যে বিখ্যাত আরকিওলজিস্ট রাজা রায়চৌধুরী এই গাড়িতে আছেন, আর তিনি ওকে ইতিহাসের পড়া ধরবেন?
সন্তু জিজ্ঞেস করল, কাকাবাবু, রাম রায় কে ছিলেন? এখানকার শেষ রাজা?
কাকাবাবু বললেন, উঁহু, রাজা নন। ব্যাপারটা বোঝাতে গেলে অনেকটা লম্বা ইতিহাস বলতে হয়।
রঞ্জন বলল, না, না, দরকার নেই। ইতিহাস যত ছোট হয়, ততই ভাল। ফজলি আমের চেয়ে যেমন ল্যাংড়া আম মিষ্টি সেইরকমই, বড় ইতিহাসের চেয়ে…মানে, আমরা যখন ওইসব ভাঙা দেওয়াল-টেওয়াল দেখব, তখন ছোট্ট করে ইতিহাসটা শুনে নেব।
রিঙ্কু ধমক দিয়ে বলল, রঞ্জন, তোমার শুনতে ইচ্ছে না করে চুপ করে থাকো। কাকাবাবু, আপনি বলুন তো?
কাকাবাবু বললেন, সামনে অত ভিড় কিসের বলো তো? পুলিশ-টুলিসও দেখা যাচ্ছে।
রাস্তাটা সবে একটা বাঁক নিয়েছে, একটু দূরে দেখা গেল প্রচুর লোক জমে আছে। আরও কিছু লোক সেই দিকে ছুটছে। একটা বোমা ফাটার মতন জোর শব্দও হল।
কাকাবাবু বললেন, ওইখানেই মেইন গেট। কিছু একটা ঘটেছে মনে হচ্ছে।
একটা বড় গেট দেখা যাচ্ছে। সেখানেই লোকেরা ঠেলাঠেলি করছে, কয়েকজন পুলিশ লাঠি উঁচিয়ে সরিয়ে দিতে চাইছে তাদের।
রঞ্জন সেই গেটের উলটো দিকের মাঠে গাড়িটা থামিয়ে বলল, আপনারা বসুন, আমি দেখছি।
গাড়ির চাবিটা আঙুলে ঘোরাতে-ঘোরাতে সে এগিয়ে গেল। একটু বাদেই হাসতে হাসতে ফিরে এসে বলল, আজ আর ভেতরে ঢোকাই যাবে না। আজ সব বন্ধ।
রিঙ্কু ভুরু কুঁচকে বলল, ভেতরে ঢোকা যাবে না মানে? কেন ঢোকা যাবে না?
রঞ্জন দাড়ি চুমরে বলল, এখন ওই গাইডটার অভিশাপের মানে বুঝতে পারছি। ও সব জানত। আমাদের সঙ্গে গাড়িতে পর্যন্ত এসে কিছুই না জানার ভান করে পয়সা আদায় করার তালে ছিল।
রিঙ্কু বলল, গাইডের কথা বাদ দাও! ভেতরে যাওয়া যাবে না কেন, কী হয়েছে?
রঞ্জন বলল, বললুম না, আজ বন্ধ। ভিজিটারস নট অ্যালাউড! ওখানে একটা সিনেমার শুটিং হচ্ছে। পুলিশ কাউকে কাছে যেতে দিচ্ছে না।
রিঙ্কু আরও রেগে গিয়ে বলল, সিনেমার শুটিং হচ্ছে বলে আমরা যেতে পারব না? কতদূর থেকে এসেছি, এমনি-এমনি ফিরে যাব? আমি গিয়ে ওদের বলছি! এটা বেআইনি!
রিঙ্কুর সঙ্গে-সঙ্গে সন্তু আর জোজোও নেমে গেল গাড়ি থেকে। কাকাবাবু গাড়ির মধ্যে বসে থেকেই দরজাটা খুলে দিলেন হাওয়া খাওয়ার জন্য। রঞ্জন নাকে একটিপ নস্যি নিয়ে বলল, এইবার দেখা যাবে রিঙ্কুর তেজ কেমন গ্যাস বেলুনের মতন ফুটো হয়ে যায়! ওর সাধের পুলিশরাই ওকে কড়কে দেবে!
রিঙ্কুরা ফিরে এল মিনিট-দশেক বাদে। ওদের মুখ-চোখ দেখেই বোঝা গেল কিছু সুবিধে হয়নি। রিঙ্কু রাগে একেবারে ছটপট করছে।
রঞ্জন মজার সুরে জিজ্ঞেস করল, কী হল? পারমিশন পেয়ে গেছ? সন্তু বলল, শুটিং-এর সময় কাউকে ঢুকতে দেবে না।
জোজো বলল, খুব জোর একটা ফাইটিং সিন হচ্ছে মনে হচ্ছে। ওরা বলল, বিকেল পাঁচটার আগে কাউকে ভেতরে যেতে দেবে না।
রঞ্জন রিঙ্কুকে খোঁচা মেরে বলল, তুমি পুলিশের কাছে নালিশ করলে না? সিনেমা তো করছে মোহন সিং! তোমার পুলিশরা কী বলল?
রিঙ্কু রাগে-দুঃখে প্রায় কেঁদে ফেলে বলল, এইসব ঐতিহাসিক জায়গা এখন ন্যাশনাল মনুমেন্টস। সিনেমার শুটিং হচ্ছে বলে পাবলিক সেখানে ঢুকতে পারবে না? এটা অন্যায়, অত্যন্ত অন্যায়! কতকগুলো কনস্টেবল ওখানে রয়েছে, তারা কোনও কথাই শুনতে চায় না।
রঞ্জন বলল, তা হলে এখন কী করা যায় সেটা বলো? বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত এখানে এই রোদুরের মধ্যে বসে থাকার কোনও মানে হয় না!
রিঙ্কু বলল, এখানে বসে থাকব না, বিকেলে আবার ফিরে আসব।
রঞ্জন বলল, তাতেও কোনও সুবিধে হবে না। সিনেমার শুটিং পাঁচটা বললে সাতটায় শেষ হবে। কিংবা আজ হয়তো শেষই হবে না। কালও এইরকম চলবে। আমি যা বুঝতে পারছি, হামপি দেখার কোনও আশা আমাদের নেই। এইজন্যই মোহন সিং এখানে আসতে বারণ করেছিল। খুব খারাপ কিছু বলেনি?
রিঙ্কু বলল, তুমি বলতে চাও, আমরা এই জায়গাটা না দেখে ফিরে যাব? অসম্ভব!
রঞ্জন বলল, তা ছাড়া আর উপায় কী বলল! আমি তো তোমাদের বাধা দিইনি! অবশ্য আমি পার্সোনালি খুব একটা হতাশ হইনি। আমার ভাই অত ইতিহাসের দিকে ঝোঁক নেই। ভাঙা দেওয়াল, ভাঙা দুর্গ আর মন্দির-টন্দির সব জায়গাতেই প্রায় এক। তোমরা চাও তো, অন্য জায়গায় তোমাদের ওইসব জিনিস দেখিয়ে দেব। এখন আমি সাজেস্ট করছি, এখানে শুধু-শুধু বসে থেকে কোনও লাভ নেই। চলো, কৃষ্ণা আর তুঙ্গভদ্রা নদীর সঙ্গমের দিকে যাই, রাস্তায় খাবারদাবার কিনে নেব, সেখানে পিকনিক করব, একসঙ্গে দুটো নদীর জলে সাঁতার কাটব! ইতিহাসের চেয়ে জ্যান্ত প্রকৃতি অনেক ভাল!
রিঙ্কু বলল, আমরা বিজয়নগর না দেখে ফিরে যাব? কাকাবাবু, আপনি কিছু বলছেন না?
কাকাবাবু আকাশের দিকে চেয়েছিলেন। আকাশে অনেকগুলি চিল কিংবা শকুন উড়ছে একসঙ্গে। সম্ভবত বোমার শব্দে তারা এখান থেকে উড়ে গেছে।
কাকাবাবু সেখান থেকে চোখ নামিয়ে বললেন, রঞ্জন, তোমার ইতিহাস সম্পর্কে আগ্রহ নেই। কিন্তু এখানে অন্য একটা ভারী চমৎকার দেখার বা শোনার জিনিস আছে। রাজধানী বিজয়নগর প্রায় পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেলেও এর ভেতরে একটা মন্দির আছে, সেটা খুব বেশি ভাঙেনি। তার নাম এরা এখন বলে, বিঠলস্বামী টেম্পল! সেই মন্দিরটার মজা কী জানো তো, সেটা হচ্ছে মিউজিক্যাল টেম্পল! তার মানে, সেই মন্দিরের এক-একটা থামে একটু জোরে আঘাত করলে নানারকম সুর বেরোয়।
রঞ্জন চোখ বড় বড় করে বলল, থামে আঘাত করলে সুর বেরোয়?
কাকাবাবু বললেন, হ্যাঁ, সাতটা থামে টোকা মারলে তুমি সা-রে-গা-মা শুনতে পাবে। আর-এক জায়গায় পুরো একটা গানের সুর। একটা থামে তবলার লহরা!
রঞ্জন গান-বাজনা খুব ভালবাসে। সে খুব কৌতূহলের সঙ্গে কাকাবাবুর কথা শুনল। তারপর বলল, এটা আমি ঠিক বিশ্বাস করতে পারছি না, কাকাবাবু! মন্দিরের থামে টোকা দিলে সা-রে-গা-মা, তবলার লহরা শোনা যায়? যাঃ, হতেই পারে না! আষাঢ়ে গপ্পো?
জোজো গম্ভীরভাবে বলল, ইস্তাম্বুলে এরকম মন্দির আছে! রঞ্জন বলল, ইস্তাম্বুলে তো আমরা এখন যেতে পারছি না ভাই! তা ছাড়া ইস্তাম্বুলে কোনও মন্দির আছে বলেও শুনিনি।
রিঙ্কু বলল, রঞ্জন, তুমি বড্ড ইয়ে হয়ে গেছ! কাকাবাবু কি তোমায় মিথ্যে কথা বলবেন?
রঞ্জন বলল, আমি সে-কথা বলছি না। তবে, সিয়িং ইজ বিলিভিং! মানে, নিজের চোখে না দেখলে, নিজের কানে না শুনলে এসব কথা বিশ্বাস করা যায় না! তুমি আমার সঙ্গে বাজি ধরবে! কত, একশো টাকা?
কাকাবাবু বললেন, তুমি ওর সঙ্গে বাজি ধরছ কেন? কথাটা তো বলেছি আমি! চলো, তা হলে মন্দিরটা দেখে আসা যাক।
রঞ্জন বলল, যাব কী করে? যাবার উপায় নেই বলেই তো আপনি আমাকে এত ধোঁকায় ফেলে দিলেন!
কাকাবাবু বললেন, কেন যাওয়া যাবে না? ইচ্ছে থাকলেই উপায় হয়।
কাকাবাবু গাড়ি থেকে নেমে পড়তেই রঞ্জন একগাল হেসে বলল, ও তাই বলুন! আপনার আইডেন্টিটি কার্ড দেখলেই পুলিশরা আপনাকে রাস্তা ছেড়ে দেবে! আপনাকে কেউ আটকাবে না, সেকথা এতক্ষণ বললেই হত।
রিঙ্কু কিংবা সন্তু-জোজোর মুখে অবশ্য কোনও আশার ভাব ফুটল না। তারা। এইমাত্র পুলিশের সঙ্গে তর্ক করে এসেছে। অতি সাধারণ সব কনস্টেবল, তারা কোনও কথাই বুঝতে চায় না। সিনেমা কোম্পানির কিছু লোকও সেখানে রয়েছে, তারা খালি চেঁচিয়ে বলছে, হঠাও, ভিড় হঠাও।
এরা কি কাকাবাবুকে পাত্তা দেবে?
কাকাবাবু গাড়ি থেকে নেমে ক্রাচ দুটো বগলে নিয়ে বললেন, তোমরা গাড়ি বন্ধ করে চলে এসো আমার সঙ্গে।
ভিড় ঠেলে কাকাবাবু এগিয়ে গেলেন একেবারে সামনে। সন্তু মনে মনে একটু ভয় পাচ্ছে। সে জানে, কাকাবাবু কোনওদিন কাউকে আইডেন্টিটি কার্ড দেখান না। এমনকী কাকাবাবুর সেরকম কোনও কার্ড আছে কি না তাই-ই সে জানে না।
এই দলটাকে খুব সামনে এগিয়ে আসতে দেখে দুজন কনস্টেবল রুক্ষভাবে বলল, হঠো, হঠো, দূর হঠো!
কাকাবাবু আঙুল তুলে একটু দূরের একজন ষণ্ডামাকা লোককে দেখিয়ে পুলিশদের বললেন, আমরা এই সিনেমা ইউনিটের লোক। ওই লোকটাকে ডাকো, ও ঠিক বুঝবে! ৪০৬
ডাকো, ও ঠিক বুঝতে আমরা এই সিনেমা ইউণ্ডামাকা লোককে।
রঞ্জন সেই লোকটির দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বলল, আমাকে গলাধাক্কা দিয়েছিল! কী যেন নাম ওর, বিরজু সিং, তাই না?
কাকাবাবু হেসে বললেন, এবার দ্যাখো না, কী মজা হয়!
পুলিশরা কাকাবাবুর কথা শুনেও দ্বিধা করছিল, কাকাবাবু আবার তাদের বললেন, আমরা মোহন সিং-এর মেহমান। কেন দেরি করছ, ওই বিরজু সিং-কে এখানে ডেকে আনো!
এবার একজন সেপাই ছুটে গেল। বোঝা গেল যে, মোহন সিং-এর নামটা এদের খুব চেনা, সেই নামটাকে ওরা ভক্তি করে কিংবা ভয় পায়।
সেপাইয়ের কথা শুনে এগিয়ে এল বিরজু সিং। কাকাবাবুকে দেখে সে যেন ভূত দেখার মতন চমকে উঠল। ভুরু দুটো কপালে তুলে সে বলল, আপ? রাজা রায়চৌধুরী?
কাকাবাবু হেসে বললেন, আমি একা নই। মোহন সিং-কে খবর দাও, আমার সঙ্গে আরও চারজন আছে, আমরা ভেতরে যাব
বিরজু সিং আর কোনও কথা না বলে উলটো দিকে ফিরে এক দৌড় দিল।
দূরে আবার শোনা গেল বোমা ফাটার মতন শব্দ। কতকগুলো ঘোড়া চি-হি-হি করে উঠল। অবশ্য আসল জায়গাটা এখান থেকে দেখা যাচ্ছে না।
একটু বাদেই দূর থেকে ধুলো উড়িয়ে ছুটে এল একটা ঘোড়া। তার পিঠে জরি মখমলের পোশাক-পরা একজন বিরাট চেহারার লোক। কোমরবন্ধের একদিকে তলোয়ার, আর-একদিকে পিস্তল। মাথায় পালক দেওয়া শিরস্ত্রাণ। ইতিহাস বইয়ের পাতায় এই রকম মানুষের ছবি আঁকা থাকে।
সিনেমার পার্টের জন্য মেকআপ নিলেও সন্তুরা চিনতে পারল মোহন সিংকে। জোজো পকেটে হাত দিয়ে চেপে ধরল শুকনো লঙ্কার পুঁটলিটা, রঞ্জন হাতে নিল নস্যির কৌটো!
ঘোড়া চালিয়ে মোহন সিং থামল একেবারে কাকাবাবুর সামনে। প্রায় এক মিনিট হাঁ করে তাকিয়ে থেকে সে আস্তে-আস্তে বলল, রাজা রায়চৌধুরী, আপনি সত্যি এসেছেন? এসে বলেছেন কী যে আপনি আমার মেহমান?
কাকাবাবু হাল্কাভাবে বললেন, হ্যাঁ, এসে পড়লাম। আমাদের সিনেমার শুটিং দেখার খুব ইচ্ছে। পুলিশরা ঢুকতে দিচ্ছিল না, তাই তোমার নাম বললাম। কেন, তোমার কোনও আপত্তি আছে নাকি?
ঘোড়া থেকে নেমে মোহন সিং কাকাবাবুর একেবারে নাকের সামনে এসে দাঁড়াল।
একটু দূরে বিরজু সিং আরও কয়েকটি গুণ্ডা ধরনের লোক নিয়ে আসছে।
কাকাবাবু পিছন ফিরে একজন পুলিশকে বললেন, আমাদের গাড়িটার ওপর একটু নজর রেখো ভাই। আমরা খানিক বাদেই ফিরে আসব।
তারপর তিনি মোহন সিং-এর দিকে তাকিয়ে বললেন, চলো, এবার যাওয়া যাক!
মোহন সিং হঠাৎ যেন বদলে গেল। বেশি-বেশি বিনয় দেখিয়ে সে মাথা ঝুঁকিয়ে বলল, নমস্তে, নমস্তে! আইয়ে, আইয়ে! আপনার মতন গুণী লোক শুটিং দেখতে এসেছেন, এ তো অতি ভাগ্যের কথা। জানেন মিঃ রায়চৌধুরী, এর আগে অনেক মন্ত্রী আর সরকারি অফিসার শুটিং দেখতে চেয়েছিল, কারও কথায় পাত্তা দিইনি। কিন্তু আপনাদের কথা আলাদা!
কাকাবাবু বললেন, আমরা বেশিক্ষণ থাকব না। মোহন সিং, আপনার মেকআপ দেখে মনে হচ্ছে, আপনি শুটিং করতে করতে চলে এসেছেন? আপনার ব্যস্ত হবার কোনও দরকার নেই। আমরা ঘুরে-ঘুরে চারপাশটা দেখেই চলে যাব।
মোহন সিং বলল, আপনার যতক্ষণ ইচ্ছে হয় থাকবেন। প্রোফেসর শর্মাজি আমাদের বলে রেখেছেন যে, মিঃ রাজা রায়চৌধুরী এলে তাঁকে খাতির-যত্ন করবে। আপনি এই জায়গাটার হিস্ট্রির বিষয়ে অনেক কিছু জানেন। শুটিং-এর সময় আপনি অ্যাডভাইস দিতে পারবেন।
জোজো হঠাৎ উঃ করে চেঁচিয়ে উঠল।
সবাই সেদিকে ফিরতেই জোজো বলল, আমার চোখে কী যেন কামড়েছে হঠাৎ!
তারপরেই দুহাতে চোখ চাপা দিয়ে সে আর্তনাদ করতে লাগল, উঃ, জ্বলে গেল! চোখ জ্বলে গেল! আমি অন্ধ হয়ে যাব।
রঞ্জন সন্তুর দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসল।
রিঙ্কু ব্যস্ত হয়ে বলল, জল! কোথায় জল পাওয়া যাবে? ওর চোখে জলের ঝাপটা দিতে হবে।
মোহন সিং পেছন ফিরে হুকুম দিল, বিরজু, এই মেহমানদের টেষ্টে নিয়ে যাও। চা-পানি পিলাও। আমি শর্মাজিকে খবর দিয়ে আসছি।
অন্ধ মানুষের মতন জোজোকে ধরে ধরে নিয়ে চলল সন্তু। জোজো অনবরত উঃ, আঃ, মরে গেলুম বলে যাচ্ছে। সন্তু তার কানে কানে ফিসফিস করে বলল, তোকে হাতটা ভাল করে ধুয়ে নিতে বলেছিলুম না!
একটু দূরেই পরপর তিনটে তাঁবু খাটানো। বাইরে রঙিন ঝালর আর ফুলের মালা দিয়ে সাজানো। একটা তাঁবু বেশ বড়, তার মধ্যে অনেকগুলি চেয়ার। একপাশে তবলা, ঢোল, সেতার, সারেঙ্গি এইসব রাখা। আর-একপাশে অনেকগুলো তলোয়ার, খন্তা, কোদাল আর শাবল।
ওদের সেই তাঁবুর মধ্যে এনে বিরজু সিং বলল, আপলোগ বৈঠিয়ে। আমি এক্ষুনি পানি নিয়ে আসছি।
একটু পরেই একজন লোক এক জাগ জল নিয়ে এল। রিঙ্কু সেটা নিয়ে বলল, জোজো, চোখ খোলো। আমি ঝাপটা দিয়ে দিচ্ছি।
জোজো কিছুতেই চোখ খুলতে পারছে না, রঞ্জন এসে চেপে ধরল তার হাত। সন্তু জোর করে তার চোখের পাতা খুলে দেবার চেষ্টা করল, রিঙ্কু জল ছিটিয়ে দিতে লাগল তার মুখে।
রঞ্জন বলল, নিজের অস্ত্রে নিজেই ঘায়েল!
রিঙ্কু বলল, চুপ। এখন ওসব বলে না!
মিনিট-পাঁচেক বাদে জোজো অনেকটা সুস্থ হল। তার জামা ভিজে গেছে। অনেকখানি। একটা চেয়ারে হেলান দিয়ে সে বসে রইল আচ্ছন্নের মতন।
কাকাবাবু বললেন, কিছু ক্ষতি হবে না। এত জলের ঝাপটায় চোখটা বরং পরিষ্কার হয়ে গেল। তা হলে আর দেরি করে কী হবে? চলো, যাওয়া যাক। জোজো, আর কোনও অসুবিধে নেই তো?
জোজো এখনও চোখ খুলছে না। সে বলল, না, ঠিক আছে, যেতে পারব।
রঞ্জন বলল, জোজো চোখ বুজে বুজে শুটিং দেখবে। তাতেই বোধহয় বেশি ভাল দেখা যাবে!
বিরজু সিং বলল, না, না, আপনারা বসুন। শুটিং শুরু হতে দেরি আছে। এই রোদুরের মধ্যে কোথায় ঘুরবেন। এখানে বসে আরাম করুন।
কাকাবাবু বললেন, শুটিং শুরু না হলেও আমরা ততক্ষণ মন্দির-টন্দিরগুলো দেখি। বিঠলস্বামীর মন্দিরটা এদের দেখাব বলেছি।
বিরজু বলল, ওই মন্দিরের সামনে একটা অন্য সেট তৈরি হচ্ছে। বাঁশ বাঁধা হচ্ছে। এখন গেলে কিছুই দেখতে পাবেন না। বিকেলবেলা আপনাদের নিয়ে যাব সেখানে!
কাকাবাবু বললেন, বিকেল পর্যন্ত তো আমরা এখানে থাকব না?
এই সময় মোহন সিং ফিরে এসে বলল, মিঃ রায়চৌধুরী, আপনারা এসেছেন শুনে প্রোফেসর শর্মাজি খুব খুশি হয়েছেন। উনি একবার ডাকছেন আপনাকে। জরুরি কথা আছে। আপনি পাঁচ মিনিটের জন্য ঘুরে আসবেন? আপনার লোকেরা ততক্ষণ বসুক এখানে।
কাকাবাবু ক্রাচ নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ঠিক আছে, শমজির সঙ্গে একবার দেখা করে আসি। কতদূর যেতে হবে?
মোহন সিং বলল, এই তো কাছেই। উনি এইরকম আর-একটা তাঁবুতে আছেন। উনি এই ফিল্মে পার্টও করছেন জানেন তো? দেখবেন চলুন, কীরকম মেকআপ নিয়েছেন।
কাকাবাবু ভুরু তুলে বললেন, তাই নাকি? উনি সিনেমায় পার্ট করছেন? এই বয়েসে?
মোহন সিং বলল, জি হ। উনি রাম রায় সেজেছেন! খুব মানিয়েছে! সেই থুথুরে বুড়ো লোকটি সিনেমায় পার্ট করছে শুনে-সন্তুরঞ্জনদের মুখে একটা হাসির ঢেউ খেলে গেল।
কাকাবাবু ওদের বললেন, তোরা বোস তা হলে। আমি চট করে ঘুরে আসি। অন্য কোথাও চলে যাসনি যেন!
কাকাবাবুকে নিয়ে ওরা চলে যাবার পর সন্তু তাঁবুর এক কোণায় গিয়ে একটা তলোয়ার তুলে নিল হাতে। রঞ্জনও আর-একটা তুলে নিয়ে সামনের দিকে দুবার ঘুরিয়ে বলল, কী সন্তু, হবে নাকি সোর্ড-ফাইট?
সন্তু বলল, আমি তলোয়ার খেলতে জানি না। আপনি শিখেছেন বুঝি?
রঞ্জন দাড়িতে হাত বুলিয়ে বলল, অনেকদিন আগে। স্টুয়ার্ট গ্র্যাঞ্জারের চেয়ে একটু কম ভাল পারি। এদেশে চ্যাম্পিয়ান।
সন্তু বলল, সিনেমার জন্য অনেক সেট বানাতে হয়। মাটি-ফাটি খুঁড়তে লাগে বোধহয়। সিনেমায় যত রাজবাড়ি-ফাড়ি দেখা যায়, সবই তো নকল!
তাঁবুর পর্দা সরিয়ে রিজু সিং আবার ঢুকতেই ওরা তলোয়ার দুটো রেখে দিল।
বিরজু সিং-এর হাতে একটা ট্রে-তে চার গেলাস শরবত। বেশ লম্বা-লম্বা গেলাস, তাতে ভর্তি শরবতের ওপর বরফের টুকরো ভাসছে।
রঞ্জন প্রথমেই হাত বাড়িয়ে একটা গেলাস তুলে নিয়ে বলল, আরে, এসব আবার কেন?
বিরজু বলল, বাইরে বহুত গরম। একটু ঠাণ্ডা খেয়ে নিন!
রঞ্জন বলল, জোজো, খেয়ে নে, তোর চোখ ঠাণ্ডা হয়ে যাবে।
রিঙ্কু বলল, আমি শরবত খাব না।
বিরজু তার কাছে এসে বলল, খান, খেয়ে দেখুন। পেস্তা আর মালাইয়ের শরবত। শুটিং-এর সময় সবাই দু-তিন গেলাস করে খায়।
রঞ্জন প্রথম চুমুক দিয়ে বলল, চমৎকার! আমারও দু-তিন গেলাস খেতে। ইচ্ছে করছে।
অনিচ্ছা সত্ত্বেও রিঙ্কুকে নিতে হল গেলাসটা।
বিরজু সিং রঞ্জনকে বলল, আপনি আর-এক গেলাস নেবেন? আমি আনছি।
রঞ্জন বলল, না, না, আমার আর চাই না। এমনিই বলছিলাম।
রঞ্জন দ্বিতীয় চুমুকেই সবটা শেষ করে ফেলল। বিরজু সিং বেরিয়ে গেল তাঁবু থেকে।
রিঙ্কু বলল, আমার ভাল লাগছে না। বড্ড বেশি মিষ্টি! সবটা খাব না!
সন্তু আর জোজো প্রায় শেষ করে এনেছে। রঞ্জন বলল, রিঙ্কু, তুমি সবটা খাবে না? তা হলে আমাকে দিয়ে দাও!
জোজোর হাত থেকে খসে পড়ল গেলাসটা। মেঝেতে দড়ির কার্পেট পাতা, তাই গেলাসটা ভাঙল না।
সন্তু জিজ্ঞেস করল, কী হল রে? গেলাসটা ফেলে দিলি?
জোজো একটা বিরাট হাই তুলে বলল, আমার ঘুম পাচ্ছে।
সন্তু নিচু হয়ে গেলাসটা তুলতে যেতেই ঝিমঝিম করে উঠল তার মাথা। কী হচ্ছে তা বোঝবার আগেই সে জ্ঞান হারিয়ে ঘুরে পড়ে গেল কার্পেটের ওপর।
চোখ মেলার পর সন্তু দেখতে পেল আকাশে কয়েকটা তারা ঝিকমিক করছে। চারপাশে জমাট বাঁধা অন্ধকার। দু-এক মিনিট সন্তু আকাশের দিকেই তাকিয়ে রইল। সে যে কোথায় শুয়ে আছে তা নিয়ে চিন্তাও করল না।
একটু-একটু করে ঘুমের ঘোর কেটে তার মাথাটা পরিষ্কার হতে লাগল। সে চিত হয়ে শুয়ে আছে। পাশের দিকে হাত চাপড়ে বুঝতে পারল, বিছানা নেই, পাথর ও ঘাস। এটা তা হলে কোন্ জায়গা?
চারপাশে ঝিঝি ডাকছে। আকাশ ছাড়া আর কোনও দিকে কিছু দেখা যাচ্ছে। গাছের ডালপালার মধ্যে বাতাসের শব্দ শোনা যাচ্ছে মাঝে-মাঝে। এটা কি তা হলে কোনও জঙ্গল?
প্রায় খুব কাছেই একটা শেয়ালের ডাক শুনে ধড়মড় করে উঠে বসল। শেয়ালটা হঠাৎ এত জোরে ডেকে উঠেছে যে, তার বুকটা ধক করে উঠেছে। এদিক-ওদিক হাত চালিয়ে সে একটা পাথরের চাঁই খুঁজে পেয়ে সেটা ধরে বসে রইল।
কিন্তু শেয়ালটা তাকে কামড়াতে এল না। শুকনো পাতার ওপর দৌড়োবার শব্দ শুনে বোঝা গেল, সেটা দূরে চলে যাচ্ছে।
শেয়ালটার ডাক শুনে চমকাবার জন্যই তার মাথাটা পরিষ্কার হয়ে গেল একেবারে।
এবারে সে মনে করবার চেষ্টা করল কী কী ঘটেছে। সকালবেলা সবাই মিলে বেড়াতে আসা হল হামপিতে। মোহন সিং তাদের খাতির করে বসাল একটা তাঁবুতে। কাকাবাবুকে ডেকে নিয়ে গেল, ওদের শরবত খেতে দিল। তারপর? আর কিছু মনে নেই।
ওই শরবতের মধ্যে বিষ মিশিয়ে দিয়েছিল!
ওরা কি মৃত ভেবে সন্তুকে এই পাহাড়ি জঙ্গলে ফেলে দিয়ে গেছে?
সন্তু নিজের গায়ে হাত বুলোল। তার নাক দিয়ে নিশ্বাস পড়ছে। তা হলে সে মরেনি। উঠে দাঁড়িয়ে সে দু-তিনবার লাফাল। না, তার শরীরে ব্যথা-ট্যথাও কিছু নেই। সে শুধু অজ্ঞান হয়ে ছিল এতক্ষণ।
অন্য সবাই কোথায় গেল?
অন্ধকারটা এখন অনেকটা চোখে সয়ে গেছে। একটু-একটু জ্যোৎস্নাও আছে। অস্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে গাছপালা। এই বনে শেয়াল ছাড়া আরও কোনও হিংস্র জন্তু আছে নাকি? পাথরের চাঁইটা সন্তু আবার তুলে নিল মাটি থেকে।
কাকাবাবুর অসম্ভব সাহস। বাঘের গুহায় মাথা গলাবার মতন তিনি মোহন সিং-এর নাম করেই হামপির মধ্যে ঢুকলেন। তারপর মোহন সিং-এর সঙ্গেই নির্ভয়ে কোথায় চলে গেলেন! কাকাবাবুও কি ওই শরবত খেয়েছেন? মোহন সিং আগেই কাকাবাবুকে সরিয়ে নিয়ে গেল। কাকাবাবু থাকলে বোধহয় একচুমুক দিয়েই ওই শরবত যে বিষাক্ত তা বুঝতে পারতেন।
জোজো আর রঞ্জনদার কী হল? রিঙ্কুদি সবটা খায়নি। রঞ্জনদা খেয়েছে দেড় গেলাস। সর্বনাশ!
এখানে চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকে কোনও লাভ নেই। জায়গাটা ঢালু মতন। মনে হচ্ছে কোনও পাহাড়ের মাঝামাঝি জায়গা। এখান থেকে নামতে হবে।
একটুখানি যেতেই সন্তুর পায়ে কিসের যেন ধাক্কা লাগল। পাথর কিংবা গাছ নয়, কোনও জন্তু কিংবা মানুষ!
প্রথমে ভয় পেয়ে সন্তু ছিটকে সরে এল। কিন্তু প্রাণীটা কোনও নড়াচড়া করছে না দেখে সে ভাবল, তাদেরই দলের কেউ হতে পারে। হ্যাঁ, মানুষই, একপাশ ফিরে শুয়ে আছে। প্যান্ট পরা।
কাছে এসে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে সে মানুষটির মুখে হাত বুলিয়ে দেখল দাড়ি নেই। তার মানে রঞ্জনদা নয়। তা হলে জোজো।
সে ধাক্কা দিয়ে ডাকতে লাগল, জোজো, এই জোজো, ওঠ।
কোনও সাড়াশব্দ নেই। সন্তু নাকের নীচে হাত নিয়ে দেখল, নিশ্বাস পড়ছে। গাটা ঠাণ্ডা নয়। তা হলে জোজোও বেঁচে আছে।
বেশ কয়েকবার ধাক্কা দেবার পর জোজো হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল, কে? কে? কে? কে?
সন্তু বলল, ভয় নেই, আমি! আমি! উঠে বোস!
জোজো বলল, আমি কে? কে আমি?
সন্তু বলল, আমায় চিনতে পারছিস না? উঠে বোস। এখানে সাপ-টাপ থাকতে পারে।
সন্তু জানে যে জোজো সাপের কথা শুনলেই দারুণ ভয় পায়। কিন্তু এখন সে তা শুনেও উঠল না। কাতর গলায় বলল, সন্তু, আমার মাথাটা পাথরের মতন ভারী হয়ে আছে। আমায় টেনে তোল। আমি উঠতে পারছি না, এত জলতেষ্টা পেয়েছে যে গলাটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে।
সন্তু তাকে ধরে-ধরে দাঁড় করিয়ে দিয়ে বলল, এটা একটা পাহাড়, এখানে জল কোথায় পাব? চল, নীচে নেমে দেখি!
আমি হাঁটতে পারব না রে, সন্তু! পায়ে জোর নেই। বুকটা ধড়ফড় করছে?
চেষ্টা করতেই হবে। আমাকে ধরে আস্তে-আস্তে চল। কাকাবাবু কোথায়? জানি না! রঞ্জনদাদেরও খুঁজতে হবে। ভাগ্যিস তোকে পেয়ে গেলুম!
আমার মাথাটা যেন ছিঁড়ে যাচ্ছে। আমি আর বাঁচব না, কিছুতেই বাঁচব না এবার। মা-বাবার সঙ্গে আর দেখা হবে না! এই অন্ধকারের মধ্যে তুই কোথায় নিয়ে যাচ্ছিস আমাকে?
অত ভেঙে পড়িস না, জোজো। পাহাড়ের নীচে গেলে একটা কোনও রাস্তা পাওয়া যাবেই। সত্যি, আমার অন্যায় হয়েছে। তুই এবার আসতে চাসনি, তোকে আমি প্রায় জোর করে নিয়ে এসেছি। এরকম যে কাণ্ড হবে ভাবতেই পারিনি। এবার তো শুধু বেড়াবার কথা ছিল।
আমরা এই পাহাড়ের ওপর এলুম কী করে? আমরা কতদিন অজ্ঞান হয়ে ছিলুম? আজ কত তারিখ?
আমি কিছুই বুঝতে পারছি না এখনও!
খানিকটা নেমে আসার পর সন্তু দাঁড়াল। জোজোকে প্রায় পিঠে করে বয়ে আনতে হচ্ছে বলে সে হাঁপিয়ে গেছে। মাঝে-মাঝে শুকনো পাতার ওপর খরখর শব্দ হচ্ছে, তা শুনে চমকে-চমকে উঠতে হয়। মানুষ না কোনও জন্তু? হঠাৎ দূরে আর-একটা শেয়াল ডেকে উঠতেই জোজো ভয় পেয়ে দুহাতে জড়িয়ে ধরল সন্তুকে।
সন্তু বলল, সিধে হয়ে দাঁড়া, জোজো। তুই আর-একটু হলে আমাকে ফেলে দিচ্ছিলি! শেয়ালের ডাক চিনিস না? শেয়াল আমাদের কী করবে?
জোজো বলল, যদি এই জঙ্গলে বাঘ থাকে?
বাঘ থাকলে এতক্ষণে আমাদের খেয়ে ফেলত অজ্ঞান অবস্থাতেই!
পাহাড়ের ওপর দিকে বাঘ থাকে না, নীচের দিকে থাকতে পারে!
তা বলে কি আমরা নীচে নামব না? শুধু-শুধু ভয় পেয়ে কোনও লাভ নেই। সব সময় বাঁচার চেষ্টা করতে হয়। এবার তুই নিজে নিজে হাঁটতে পারবি না?
হ্যাঁ পারব।
আমি ভাবছি, রঞ্জনদারা কোথায় গেল? আর সবাইকেও এই পাহাড়েই। ফেলে দিয়ে গেছে? কিন্তু অন্ধকারের মধ্যে খুঁজব কী করে?
চেঁচিয়ে ডাকব?
ওরা যদি এখনও অজ্ঞান হয়ে থাকে? তবু ডেকে দেখা যাক!
দুজনে একসঙ্গে গলা মিলিয়ে চিৎকার করতে লাগল, রঞ্জনদা! রিঙ্কুদি!
কাকাবাবু!
বেশ কয়েকবার গলা ফাটিয়ে চেঁচিয়েও কোনও সাড়া পাওয়া গেল না। কাছাকাছি দু-একটা গাছের পাখিরা ভয় পেয়ে ডানা ঝটপটিয়ে উঠল।
জোজোর হাত ধরে সন্তু বলল, দিনের আলো না ফুটলে জঙ্গলের মধ্যে ওদের খোঁজা যাবে না। বরং তার আগে আমরা নীচে নেমে দেখি, অন্য কোনও সাহায্য পাওয়া যায় কি না! আমার হাত ছাড়িস না!
জোজো বলল, আমি জলতেষ্টায় মরে যাচ্ছি। আমার বুক ফেটে যাচ্ছে! মনে হচ্ছে তিন-চারদিন জল খাইনি।
আর খানিকটা নামতেই জঙ্গলের মধ্যে একটা রাস্তা পাওয়া গেল। সামান্য জ্যোৎস্নার আলোয় সেই রাস্তা ধরে-ধরে ওরা এগোতে লাগল। পাহাড়টা বেশি উঁচু নয়, টিলার মতন। সমতলে পৌঁছতে আর ওদের দেরি হল না।
সামনেই ওরা দেখতে পেল একটা নদী। জলে কেউ নেমেছে, সেই আওয়াজ হচ্ছে। একটুখানি এগিয়ে একটা বড় গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে সন্তু দেখল, একটা কোনও জন্তু জল খাচ্ছে, সেটা কুকুরও হতে পারে, শেয়ালও হতে পারে, ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। একবার জন্তুটা এদিকে মুখ ফেরাল। আগুনের গোলার মতন জ্বলজ্বল করে উঠল তার চোখ।
জন্তুটা ওদের দেখতে পেল কি না কে জানে, কিন্তু এদিকে তেড়ে এল না। হঠাৎ জল খাওয়া থামিয়ে সে নদীটার ধার দিয়ে দৌড়ে চলে গেল।
সন্তু আর জোজো কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। জন্তুটা অনেক দূর চলে যাবার পর জোজো ফিসফিস করে বলল, লেপার্ড? হায়না? উলফ?
সন্তু বলল, বুঝতে পারলুম না। চল, আমরাও জল খেয়ে নিই!
জোজো আঁতকে উঠে বলল, এই নদীর জল খাব? নোংরা, পলিউটেড, কত কী থাকতে পারে।
সন্তু বলল, খুব বেশি তেষ্টার সময় ওসব ভাবলে চলে না।
জোজো তবু বলল, এইমাত্র একটা জন্তু যে-জল খেয়ে গেল, আমরা সেই জল খাব?
সন্তু বলল, এই হাওয়াতেই তো জন্তু-জানোয়াররা নিশ্বাস নেয়, তা বলে কি। আমরা নিশ্বাস নেব না? তুই যদি জল না খেয়ে আরও কিছুক্ষণ থাকতে পারিস তো থাক, পরে ভাল জল খুঁজে দেখব।
সন্তু চলে গেল নদীর ধারে। হাঁটু গেড়ে বসে এক আঁজলা জল তুলে দেখল, বেশ টলটলে আর স্বচ্ছ। নদীতে স্রোত আছে। সেই জল সন্তু মুখে দিল, তার বিস্বাদ লাগল না। সে পেট ভরে জল খেয়ে নিল। এবার জোজোও ছুটে এসে প্রায় হুমড়ি খেয়ে পড়ল। জন্তুদের মতনই। চোঁ-চোঁ করে জল টানতে লাগল ঠোঁট দিয়ে। খাচ্ছে তো খাচ্ছেই। প্রায় দু-তিন মিনিট পরে সে মুখ তুলে বলল, আঃ, বাঁচলুম! সাধে কী বলে জলের আর-এক নাম জীবন! জল খেতে-খেতে আমি আর-একটা কী ভাবলুম বল, তো সন্তু?
কী?
তোর খিদে পাচ্ছে?
সেরকম কিছু টের পাচ্ছি না। অজ্ঞান অবস্থায় বোধহয় খিদে থাকে না।
কিন্তু আমরা যদি তিন-চারদিন না খেয়ে থাকতুম, তা হলে খালি পেটে এতটা জল খেলেই গা গুলিয়ে উঠত, পেট ব্যথা করত। আমরা সকালে বেশ হেভি ব্রেকফাস্ট খেয়েছিলুম, পুরি-তরকারি, তারপর শুধু দুপুর আর রাত্তিরটা খাওয়া হয়নি। খুব সম্ভব একদিনের বেশি কাটেনি।
এটা বোধহয় তুই ঠিকই ধরেছিস?
নদীর ওপারে দ্যাখ, এক জায়গায় মিটমিট করে আলো জ্বলছে, একটা ঘর রয়েছে।
নদীটা বেশি চওড়া নয়। প্রায় একটা সরু খালের মতন। কতটা গভীর তা অবশ্য বলা যায় না। জলে বেশ স্রোত আছে, হেঁটে পার হবার চেষ্টা করে লাভ নেই। সন্তু এক্ষুনি এটা সাঁতরে চলে যেতে পারে, কিন্তু জোজোর কী হবে? জোজো সাঁতার জানে না! কতবার জোজোকে সন্তু বলেছে সাঁতারটা শিখে নিতে।
সন্তু চারপাশটা দেখে নিয়ে বলল, আমার যতদূর মনে হচ্ছে, নদীর ওপার দিয়েই আমাদের যেতে হবে। হসপেট থেকে মপি আসবার পথে আমরা কোনও পাহাড় দেখিনি। হামপিতে ঢোকার আগে আমি হামপির পেছন দিকে কয়েকটা টিলা লক্ষ করেছিলুম। সেইরকম একটা টিলাতেই আমাদের ফেলে দিয়ে গিয়েছিল। ভেবেছিল বোধহয় অজ্ঞান অবস্থাতেই আমাদের শেয়াল-টেয়াল ছিঁড়ে খাবে।
জোজো বলল, অত সহজ নয়! আমাদের মেরে ফেলা অত সহজ নয়! অ্যাই সন্তু, তুই তখন বললি কেন রে, তুই এবারে আমাকে জোর করে এনেছিস? আমি নিজের ইচ্ছেতেই এসেছি! এসেছি তো কী হয়েছে? এ তো অতি সামান্য বিপদ! জানিস, একবার আফ্রিকায় আমি আর আমার এক মামা কী অবস্থায় পড়েছিলুম? নরখাদকেরা আমাদের দুজনকে একটা খুঁটির সঙ্গে বেঁধে…
সন্তু তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, বুঝেছি, বুঝেছি, তুই এখন আবার চাঙ্গা হয়ে উঠেছিস। কিন্তু এখন এই নদীটা পার হওয়া যাবে কী করে?
জোজো বলল, নো প্রবলেম। নদীটার ধার দিয়ে দিয়ে হাঁটি, কোনও একটা জায়গায় নদীটা শেষ হয়ে গেছে নিশ্চয়ই!
সন্তু বলল, নদীর শেষ খুঁজতে গিয়ে যদি সমুদ্রে পৌঁছে যাই? শোন, তোকে আমি পিঠে করে নিয়ে যেতে পারি। আমার লাইফ সেভিংসের ট্রেনিং আছে। কিন্তু তার আগে তোকে প্রতিজ্ঞা করতে হবে, তুই জলে নেমে ভয় পাবি না, ভয় পেয়ে আমার গলা আঁকড়ে ধরবি না! তা হলে কিন্তু তোকে আমি ফেলে দেব!
জোজো বলল, ঠিক আছে। এ তো অতি সহজ ব্যাপার। আমি আলতো করে তোর পিঠটা ছুঁয়ে থাকলেই ভেসে থাকতে পারব। আমি প্রায় থ্রি-ফোর্থ সাঁতার জানি। একবার ক্যাম্পিয়ান সাগরে…
সন্তু আবার তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, থ্রি-ফোর্থ সাঁতার বলে কিছু হয়। হয় কেউ সাঁতার জানে, অথবা জানে না। এখন বেশি কথা বলার সময় নেই। জুতো খুলে ফ্যাল!
জোজো বলল, ওটা কী রে, সন্তু?
ওদের বাঁ পাশে নদীর জলে একটা ঝুড়ির মতন কী যেন ভাসছে। সাধারণ। ঝুড়ির পাঁচ-ছ গুণ বড়। সন্তু সেদিকে এগিয়ে গিয়ে বলল, ইউরেকা! আর জামা-প্যান্ট ভেজাতে হল না। এটা তো একটা ডিঙি নৌকো। আমি কোনও গল্পের বইতে পড়েছিলুম, সাউথ ইন্ডিয়ার কোনও-কোনও নদীতে নৌকোগুলো হয় গোল-গোল। বুঝতে পেরেছি, এটা একটা খেয়াঘাট, তাই নৌকোটা এখানে বাঁধা রয়েছে।
সন্তু আগে নৌকোটাতে উঠল, তারপর জোজোর হাত ধরে টেনে নিল। দেখলে মনে হয় গোল ঝুড়িটা মানুষের ভারে ড়ুবে যাবে, কিন্তু ওঠার পর বোঝা গেল, সেটা বেশ মজবুত। কিন্তু বৈঠা হাতে নিয়ে চালাতে গিয়ে সন্তু মুশকিলে পড়ে গেল। বালিগঞ্জ লেকে সন্তু অনেকবার রোয়িং করেছে, কিন্তু এরকম গোল নৌকো তো কখনও চালায়নি। এটা খালি ঘুরে-ঘুরে যায়, সামনের দিকে এগোয় না।
সন্তু বলল, এটা চালাবার আলাদা টেকনিক আছে, ঠিক ম্যানেজ করতে পারছি না। এক কাজ করা যাক। তুই নৌকোটাতে বোস, আমি জলে নেমে এটাকে ঠেলে-ঠেলে নিয়ে যাচ্ছি।
জোজো শিউরে উঠে বলল, তুই জলে নামবি? যদি এই নদীতে কুমির থাকে?
সন্তু বিরক্ত হয়ে বলল, কী পাগলের মতন কথা বলছিস? এইটুকু ছোট নদীতে কুমির থাকবে? একটু আগে আমরা এটা সাঁতরে পার হবার কথা ভাবছিলুম না?
জোজো বলল, তা ঠিক। কিন্তু নৌকো দেখলে আর জলে নামার কথা মনে থাকে না।
সন্তু জামা আর জুতো খুলে নেমে গেল নদীতে। নদীটা খুব অগভীর নয়, স্রোতের টানও আছে বেশ। সন্তু সাঁতার দিতে-দিতে নৌকোটাকে ঠেলতে লাগল। কাজটা খুব সহজ না হলেও খানিকবাদে ওরা পৌঁছে গেল অন্য পারে।
নদীর এদিকে ঘাটেও একটা এইরকম গোল নৌকো বাঁধা। বোঝা গেল, এটা ফেরিঘাট, দুদিক থেকে লোকেরা এসে নিজেরাই নৌকো চালিয়ে পারাপার করে।
এপারে একটা ছোট্ট মন্দির, তার মধ্যে আলো রয়েছে। একটা বড় মাটির প্রদীপে মোটা করে পাকানো সলতে জ্বলছে। ভেতরের ঠাকুর ফুল-পাতা দিয়ে একেবারে ঢাকা, দেখাই যায় না। কোনও মানুষের সাড়াশব্দ নেই।
ওরা মন্দিরের পেছনটায় একটা কুঁড়েঘর দেখতে পেল। সেখানে একটা বিছানা পাতা রয়েছে, কিন্তু কোনও লোক শুয়ে নেই। বোধহয় এটা মন্দিরের পুরুতঠাকুরের ঘর, কিন্তু আজ রাত্তিরে তিনি অন্য কোথাও গেছেন। দরজাটা খোলা। একটা হ্যারিকেন টিমটিম করছে।
সেই ঘরের মধ্যে গোটা-তিনেক সাইকেল। শিকল দিয়ে বাঁধা। সন্তু সেদিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। একটা সাইকেল পেলে অনেক সুবিধে হয়।
সন্তু বলল, এখানে কোনও লোক থাকলে তাকে বলে কয়ে একটা সাইকেল ধার নিতাম!
জোজো বলল, না বলেও ধার নেওয়া যায়। পরে ফেরত দিলেই হবে।
ঘরের দরজা খুলে রেখে গেছে, এদেশে কি চুরি-টুরি হয় না?
আমরা একটা সাইকেল নিলে উনি ঠিক বুঝতে পারবেন, আমরা চুরি করিনি। বিপদে পড়ে ধার নিয়েছি। কাকাবাবুদের খুঁজে বার করা দারুণ জরুরি এখন আমাদের কাছে, তাই না?
শিকল দিয়ে বাঁধা, তাতে তালা লাগানো। খুলব কী করে?
ও তো একটা পুঁচকে তালা, ভাঙতে পারবি না, সন্তু?
আমি তালা ভাঙা কখনও শিখিনি। তুই পারবি? একটা হাতুড়ি-টাতুড়ি পেলেও হত।
জোজো এগিয়ে গিয়ে বিছানা থেকে বালিশটা তুলে ফেলল। তার তলায় একগোছা চাবি। একগাল হেসে জোজো বলল, দেখলি, বুদ্ধি থাকলেই উপায় হয়। এর মধ্যে নিশ্চয়ই এই তালারও চাবি আছে।
সন্তু একটা একটা করে চাবি লাগিয়ে তালা খোলার চেষ্টা করতে লাগল। জোজো উঁকি দিল খাটিয়ার নীচে। সেখানে অনেক হাঁড়ি বাটি রাখা। একটা-একটা করে টেনে সে দেখল, কোনওটার মধ্য চাল, কোনওটার মধ্যে ডাল। একটা হাঁড়িতে বাতাসা। জোজো একমুঠো বাতাসা মুখে পুরে বলল, সন্তু, খেয়ে নে, আগে খেয়ে নে! বেশ ভাল খেতে, কপূর দেওয়া আছে, চমৎকার গন্ধ!
সন্তু মুখ ফিরিয়ে বলল, এই, ওগুলো খাচ্ছিস? ওগুলো পুজোর বাতাসা মনে হচ্ছে!
জোজো বলল, তাতে কী হয়েছে? পুজো দেবার পর সেই প্রসাদ তো মানুষেই খায়। আমাদের যা খিদে পেয়েছে, একটু কিছু খেয়ে গায়ের জোর করে নেওয়া দরকার। ওই দ্যাখ, জলের কলসিও আছে।
তালাটা খোলা হয়ে গেছে। সন্তু লোভ সামলাতে পারল না। সেও কুড়ি-পঁচিশটা বাতাসা খেয়ে নিল। জোজো কলসি থেকে জল গড়াতে গড়াতে বলল, পুরুতমশাই লেখাপড়াও জানে। এই দ্যাখ, পাশের টুলে বই-খাতা রয়েছে। একটা কলমও আছে। আমরা একটা চিঠি লিখে রেখে গেলে উনি নিশ্চয়ই ঠিক বুঝবেন!
সন্তু বলল, এটা ভাল আইডিয়া, লিখে দে একটা চিঠি। ইংরিজিতে লিখিস।
জোজো খাতা থেকে একটা পাতা ছিঁড়ে নিয়ে জিজ্ঞেস করল, পুরুতমশাই-এর ইংরিজি কী রে?
সন্তু একটা সাইকেল বার করতে করতে বলল, প্রিস্ট! তাড়াতাড়ি কর। দু-তিন লাইনে সেরে দে।
সন্তু সাইকেলটা নিয়ে এল রাস্তায়। এতক্ষণ বাদে তার মনটা একটু হাল্কা হয়েছে। সাইকেলে তাড়াতাড়ি হামপি পৌঁছনো যাবে। একবার রাস্তা ভুল হলেও অন্য রাস্তায় ফিরতে অসুবিধে হবে না।
জোজো বেরিয়ে এসে বলল, বিছানার ওপর চাপা দিয়ে এসেছি, ফিরলেই চোখে পড়বে। আমি কিছু এক্সট্রা বাতাসাও পকেটে নিয়ে এসেছি। পরে কাজে লাগতে পারে।
সন্তু জিজ্ঞেস করল, তুই সাইকেল চালাতে জানিস?
জোজো অবজ্ঞার সঙ্গে বলল, সাইকেল? আমি মোটরবাইক চালাতে জানি খুব ভাল। কিন্তু সাইকেলে প্র্যাকটিস নেই।
সন্তু বলল, বুঝেছি। পেছনে ক্যারিয়ার নেই, তুই সামনের রডের ওপর বোস।
সাইকেলে আলো নেই। অল্প-অল্প জ্যোৎস্নায় রাস্তাটা মোটামুটি দেখা যাচ্ছে। খানিকটা দূর এগোতেই ওরা দূরে একজন লোককে দেখতে পেল, এদিকেই আসছে।
সন্তু বলল, ওই বোধহয় পুরুতমশাই!
জোজো বলল, কোনও কথা বলার দরকার নেই। জোরে চালিয়ে চলে যা! ফিরে গিয়ে তো চিঠিটা পড়বেই। অবশ্য যদি ইংরিজি পড়তে পারে।
আমি গোটা-গোটা অক্ষরে লিখেছি।
সন্তু লোকটির পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেল। লোকটি কোনও সন্দেহ করেনি।
আরও খানিকটা দূর যাবার পর বোঝা গেল, ওরা ভুল পথে আসেনি। সামনে এক জায়গায় বেশ কয়েকটা আলো দেখা যাচ্ছে। ওই জায়গাটা হামপি হলেও লোকজন আছে নিশ্চয়ই। তাদের খোঁজখবর নেওয়া যাবে।
সেই আলোর দিকে লক্ষ রেখে আরও কিছুটা আসার পর দেখা গেল একটা মন্দিরের চূড়া। একটা কিসের শব্দও শোনা যাচ্ছে। আকাশের দিকে তাকালে মনে হয়, এখন রাত দেড়টা-দুটো অন্তত হবেই।
সন্তু বলল, মন্দিরের কাছে অত আলো, লোকজন জেগে আছে মনে হচ্ছে, তা হলে ওটাই নিশ্চয়ই সেই শুটিং-এর জায়গা।
জোজো বলল, একেবারে সাইকেল নিয়ে হুড়মুড়িয়ে ওখানে পৌঁছনো কি ঠিক হবে? মোহন সিং আমাদের যদি আবার দেখে ফেলে?
সন্তু বলল, ঠিক বলেছিস। শেষ পর্যন্ত সাইকেল নিয়ে যাওয়া ঠিক হবে।
আলোর অনেকটা কাছে এসে ওরা সাইকেল থেকে নেমে পড়ল। মন্দিরের দিক থেকে বেশ কিছু লোকের অস্পষ্ট গুঞ্জন ভেসে আসছে, আরও একটা অন্যরকম আওয়াজ। কিছু একটা চলছে ওখানে।
সন্তু সাইকেলটা একটা ঝোপের মধ্যে লুকিয়ে রাখল। তারপর চারপাশটা একবার দেখে নিয়ে বলল, আমরা দুজন একদম পাশাপাশি না হেঁটে একটু দূরে-দূরে থাকব, বুঝলি? একজন ধরা পড়লে আর-একজন তবু পালাতে পারব। যে করেই হোক, পুলিশে খবর দিতেই হবে। মোহন সিং-এর এতবড় দলের বিরুদ্ধে তো আমরা দুজনে কিছু করতে পারব না!
জোজো একটু অভিমানের সঙ্গে জিজ্ঞেস করল, আমি ধরা পড়লেও তুই। পালিয়ে যাবি?
সন্তু বলল, দুজনেই চেষ্টা করব ধরা না পড়তে! এখানকার অবস্থাটা একটু দেখে নিয়ে হসপেট থানায় আমাদের পৌঁছতেই হবে।
মন্দিরের এই পাশটা দেওয়াল দিয়ে ঘেরা। গেটের বাইরে রাইফেল নিয়ে বসে আছে চার-পাঁচজন পুলিশ। তারা ঘুমে ঢুলছে।
জোজো ফিসফিস করে বলল, ওই তো পুলিশ। ওদের কাছে গিয়ে বললেই তো হয়, মোহন সিং আমাদের বিষ খাইয়েছিল।
সন্তু একটু চিন্তা করে বলল, উঁহুঃ, ওদের কাছে বলে লাভ নেই। ওরা সাধারণ কনস্টেবল, মোহন সিং ওদের ভাড়া করে এনেছে। ওরা আমাদের কথা বিশ্বাস করবে না। থানায় গিয়ে ডায়েরি করাতে হবে যে, কাকাবাবু, রিঙ্কুদি, রঞ্জনদাদাদের খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তাতে ওরা অ্যাকশান নিতে বাধ্য।
পুলিশগুলোকে এড়িয়ে আমরা ভেতরে ঢুকব কী করে?
পাঁচিলের পাশ দিয়ে দিয়ে চল। অন্য কোনও ঢোকার জায়গা আছে কি না খুঁজতে হবে। ওরা আমাদের দেখলে মোহন সিং-এর হাতে ধরিয়ে দেবে।
দেওয়াল ঘেঁষে-ঘেঁষে খানিকটা যেতেই দেখা গেল, এক জায়গায় দেওয়ালটা একেবারে ভাঙা। সেখানে কাঁটাতার দেওয়া রয়েছে। কিন্তু কোনও পাহারাদার নেই।
সন্তু একটা কাঁটাতার তুলে ধরল, জোজো সেই ফাঁক দিয়ে গলে গেল। তারপর সন্তুও ঢুকে পড়ল।
মন্দিরের সামনের চাতালে একটা বড় ফ্লাড লাইট জ্বলছে। একদল লোক খন্তা-শাবল দিয়ে মাটি খুঁড়ে চলেছে। লোকগুলোর চেহারা মোটেই কুলিদের মতন নয়, প্যান্ট-শার্ট পরা। এর মধ্যেই একটা কুয়োর মতন গর্ত খোঁড়া হয়ে গেছে সেখানে।
জোজো বলল, এটাই তা হলে বিঠলস্বামীর মন্দির। এর সামনে সিনেমার জন্য সেট তৈরি হচ্ছে বলেছিল না?
সন্তু অনেকটা এগিয়ে লোকগুলোকে ভাল করে দেখল। বিরজু সিং ছাড়া চেনা আর কেউ নেই।
বেশ খানিকটা দূরে মাঠের মধ্যে আর-একটা আলো দেখা গেল। সেটা ইলেকট্রিকের আলো নয়, মশাল। সন্তু আর জোজো এগিয়ে গেল সেদিকে। সেই জায়গাটা যেন তাদের চুম্বকের মতন টানল।
মাঠের মধ্যে সিংহাসনের মতন একটা চেয়ার পাতা। তার ওপরে জরির পোশাক পরে রাজা সেজে বসে আছে এক থুথুরে বুড়ো। তার মুখ-ভর্তি পাতলা-পাতলা সাদা দাড়ি, তার ভুরু পর্যন্ত পাকা। সেই বৃদ্ধ রাজা কিন্তু দিব্যি আরাম করে একটা সিগারেট টানছে।
তার পায়ের কাছে পড়ে আছে একজন মানুষ। নীল রঙের নাইলনের দড়ি দিয়ে তার সারা শরীর পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে বাঁধা। একপাশে পড়ে আছে একজোড়া ক্ৰাচ। কাকাবাবু!