কাকাবাবু হেরে গেলেন?

কাকাবাবু হেরে গেলেন?

গাড়ির দরজাটা বন্ধ হওয়ার পর কাকাবাবু জানলার কাচ খুলে একবার ওপর দিকে তাকালেন। দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে সন্তু। মনখারাপের ভাবটা সে কিছুতেই লুকোতে পারছে না। কাকাবাবু বাইরে যাচ্ছেন, কিন্তু এবার সঙ্গে যেতে পারছে না সন্তু। কিছুতেই সম্ভব নয়। পরশু থেকে তার পরীক্ষা আরম্ভ।

কাকাবাবু বারবার বলেছেন, তিনি এবার কোনও অ্যাডভেঞ্চারে যাচ্ছেন না। কোনও রহস্য-টহস্যের ব্যাপার নেই। এমনিই বেড়াতে যাচ্ছেন বিমানের সঙ্গে। বড়জোর দিন সাতেক থাকবেন। সন্তু তাতেও কোনও সান্ত্বনা পায়নি। কাকাবাবু যেখানেই যান, সেখানেই কিছু-না-কিছু একটা রোমাঞ্চকর ব্যাপার ঘটে যায়।

কাকাবাবু ওপরের দিকে তাকিয়ে হাত নাড়লেন। সন্তুও হাত নাড়ল বটে, কিন্তু তার মুখে হাসি ফুটল না।

কাকাবাবু বসেছেন সামনে ড্রাইভারের পাশে। পেছনে বিমান আর তার স্ত্রী দীপা। গাড়ি চলতে শুরু করার পর বিমান বলল, সন্তু বেচারা এল না বটে, কিন্তু ও কি এখন পড়াশোনায় মন বসাতে পারবে?

কাকাবাবু বললেন, আজ সকালটা ছটফট করবে বটে, তারপর ঠিক মন বসে যাবে। পরীক্ষার একটা ভয় তো আছে।

বিমান বলল, না, কাকাবাবু আজকাল দেখেছি ছেলেমেয়েরা পরীক্ষার আগে বিশেষ ভয়টয় পায় না। এখন সব সিস্টেম তো পালটে গেছে। বেশি মুখস্থ করারও দরকার হয় না।

কাকাবাবু বললেন, আমার ছোটবেলার কথা মনে আছে, ইস্কুলের ফাইনাল পরীক্ষার আগে প্রতি বছর ভয়ে বুক কাঁপত। প্রত্যেকবার মনে হত, এবার ঠিক ফেল করব! তাই শেষের দিনটায় ভাবতাম, ফেলই যখন করব, তখন আর পড়ে কী হবে? তাই টেক্সট-বইয়ের বদলে সেদিন গল্পের বই পড়তাম।

বিমান বলল, তারপর প্রত্যেক বছরই ফাস্ট হতেন। সবাই জানে, আপনি জীবনে কখনও শেষ পরীক্ষায় সেকেন্ড হননি।

কাকাবাবু হো হো করে হেসে উঠে বললেন, ও একটা বাজে গুজব বুঝলে! শেষের দিকে দু-একবার ফার্স্ট হয়েছিলাম, তাই অনেকে বলে আমি প্রত্যেক পরীক্ষায় ফার্স্ট হয়েছি।

দীপা জিজ্ঞেস করল, সত্যিই আপনি কখনও সেকেন্ড-থার্ড হয়েছেন?

কাকাবাবু বললেন, অনেকবার। প্রত্যেকবার আমি ফার্স্ট হব, এমন স্বার্থপর আমি নই। অন্যরা কী দো করেছে? আমার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল সুপ্রিয়, সে এখন ওয়ার্ল্ড ব্যাঙ্কে বড় কাজ করে। সে কখনও সেকেন্ড হলে তার চেয়ে আমার বেশি কষ্ট হত।

দীপা বলল, তাই আপনি ইচ্ছে করে তাকে ফার্স্ট করাতেন?

কাকাবাবু আবার হেসে বললেন, আরে না, না! সে আমার চেয়ে অনেক ভাল ছেলে ছিল। ইস্কুলে আমি ছিলাম বেশ ফাঁকিবাজ। ক্লাসের পড়ার বইয়ের চেয়ে গল্পের বই পড়ার দিকে ঝোঁক ছিল খুব। আর খুব কবিতা মুখস্থ করতাম।

দীপা বলল, আমি তো ইস্কুলে পড়াই। আমি লক্ষ করেছি। যেসব ছেলেমেয়ে শুধু টেক্সট বুক মুখস্থ না করে নানা রকম বাইরের বই পড়ে, তারাই কিন্তু ব্রিলিয়ান্ট হয়। তারা অনেক বেশি শেখে।

বিমান বলল, আর ছোটবেলায় কবিতা মুখস্থ করলে তা মানুষ কখনও ভোলে না। আমি ক্লাস সিক্সে পড়বার সময় সুকুমার রায়ের সব কবিতা মুখস্থ করেছিলাম। ক্লাস এইটে উঠে পুরো মেঘনাদবধ কাব্য। আজও সবটা মনে আছে। দেখবে? সম্মুখ সমরে পড়ি বীর চূড়ামণি, বীরবাহু চলি যবে গেলা যমপুরে অকালে, তখন কহ গো দেবী অমৃতভাষিণী…

দীপা বলল, থাক, থাক, তোমাকে আর পরীক্ষা দিতে হবে না!

কাকাবাবু বললেন, কহ গো দেবী, না কহ হে দেবী?

বিমান বলল, হ্যাঁ, হ্যাঁ, কহ হে দেবী! বাঃ, আপনারও তো বেশ মনে আছে!

দীপা বলল, আর কয়েকটা দিন পরে, সন্তুর পরীক্ষাটা হয়ে গেলে আমরা যদি যেতাম ভাল হত। সন্তু থাকলে বেশ মজা হয়।

বিমান বলল, দেরি করবার যে উপায় নেই। সামনের সোমবার থেকে বাড়িটা ভাঙতে শুরু করবে।

দীপা বলল, অত পুরনো বাড়ি। ভাঙবার সময় সাপটাপ বেরোবে না তো?

বিমান গম্ভীর মুখ করে বলল, বলা যায় না। শুনেছি, একতলার ঘরগুলো বহুদিন বন্ধ আছে। সেখান থেকে অজগর কিংবা পাইথন বেরোতে পারে। আর তহবিলখানার দিকে ভূত-পেত্নি তো আছেই, সে বেচারারা কোথায় যাবে কে জানে!

দীপা বলল, আমি সোমবারের আগেই ফিরতে চাই। বাড়ি ভাঙা-টাঙা আমি দেখতে পারব না!

গাড়িটা এলগিন রোডে নেতাজি সুভাষচন্দ্রের বাড়ির কাছেই আর-একটা বাড়ির সামনে থামল। বিমান ড্রাইভারকে বলল, দুবার হর্ন দাও।

এখান থেকে আর একজনকে তুলে নেওয়া হবে। এর নাম অসিত ধর। বিমানের এক বন্ধুর সূত্রে চেনা। এই অসিত ধর বছরের অনেকটা সময় ইংল্যান্ড-আমেরিকায় থাকে। পুরনো দামি জিনিসপত্র কেনাবেচার ব্যবসা আছে, ইংরেজিতে যেগুলোকে বলে অ্যান্টিক। বেশ ভাল ব্যবসা।

অসিত ধর তৈরিই ছিল, হর্ন শুনে নেমে এল।

খয়েরি রঙের সুট পরা বেশ ফিটফাট চেহারা। চোখে সানগ্লাস। সঙ্গে একটা বড় ব্যাগ আর ক্যামেরা।

বিমান কাকাবাবুর সঙ্গে আলাপ জমিয়ে দেওয়ার জন্য বলল, অসিতবাবু, ইনি হচ্ছেন মিঃ রাজা রায়চৌধুরী। খুব বিখ্যাত লোক, আমরা এঁকে কাকাবাবু বলি।

মুখ দেখেই বোঝা গেল, অসিত ধর কাকাবাবুর নাম আগে শোনোনি। কাকাবাবু সম্পর্কে কিছুই জানে না। সে ইংরেজি কায়দায় বলল, গ্ল্যাড টু মিট ইউ!

কাকাবাবু হাতজোড় করে বললেন, নমস্কার!

বিমান অসিত ধরকে পেছনের সীটে তুলে নিল।

গাড়ি আবার চলতে শুরু করলে বিমান বলল, কাকাবাবু, ইনি পুরনো ফার্নিচার, ঘড়ি, ছবিটবির ব্যবসা করেন। আমাদের আলিনগরের বাড়ির সব কিছুই তো বেচে দেব, ইনি দেখতে যাচ্ছেন যদি কিছু পছন্দ হয়।

অসিত ধর বলল, ঠিক সেজন্যও নয়। এমনিই বেড়ানো হবে। অনেকদিন তো কলকাতার বাইরে যাওয়া হয় না, প্রায় সারা বছরই বিদেশে কাটাতে হয়।

কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, বিমান, তোমাদের এই বাড়িটা কতদিনের পুরনো?

দীপা বলল, ওটা কিন্তু বিমানদের নিজের বাড়ি নয়। মামাবাড়ি। ওর একমাত্র মামা গত বছর মারা গেলেন। তাঁর কোনও ছেলেপুলে ছিল না। তাই বিমানরা তিন ভাই ওই সম্পত্তি পেয়েছে।

বিমান বলল, হ্যাঁ, প্রায় ফাঁকতালে পেয়ে গেছি বলতে পারেন। আমার মামা খুব কিঞ্জুস ছিলেন। অত বড় বাড়িতে একা-একা থাকতেন, আমাদের কখনও যেতেও বলতেন না। ছোটবেলা কয়েকবার গেছি, ভাল করে কথাও বলতেন না আমাদের সঙ্গে। সেই মামা চুরাশি বছর বেঁচে তারপর মারা গেলেন। ওবাড়ি যে আমরা কখনও পাব, তা ভাবিওনি। মামার মৃত্যুর পর জানা গেল, তিনি কোনও উইল করেননি। তাই মামার উকিল আমাদের তিন ভাইকে ডেকে সম্পত্তি দিয়ে দিল।

কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, তোমার মামা বিয়ে করেননি?

হ্যাঁ করেছিলেন। এক সময় উনি বিলেতে থাকতেন, তখন মেমসাহেব বউ ছিল। সেই মেম-মামিমা এদেশে আসেননি। তিনিও এতদিনে আর বেঁচে নেই। বোধ হয়। আমার আর একজন মামা ছিলেন, ছোটমামা। তিনি তাঁর বিয়ের ঠিক আগের দিন ওই বাড়িতেই মারা যান। এসব অবশ্য আমার জন্মের আগেকার কথা। আমার মা তো বলেন যে, ছোটমামাকে নাকি ওই বাড়িতে ভূতে ধাক্কা দিয়ে মেরে ফেলেছিল।

দীপা বলল, মা কিন্তু খুব বিশ্বাসের সঙ্গেই বলেন কথাটা!

অসিত ধর বলল, সব পুরনো বাড়ি সম্পর্কেই এরকম কিছু ভূতের গল্প থাকে। সেগুলো খুব ইন্টারেস্টিং হয়।

বিমান বলল, বাড়িটা ঠিক কতদিনের পুরনো তা বলতে পারব না। তবে দুশো বছর তো হবেই। আমার মামাদের এক পূর্বপুরুষ নবাব আলিবর্দির কাছ থেকে জায়গির পেয়ে এই বাড়িটা বানিয়েছিলেন শুনেছি।

কাকাবাবু বললেন, আলিবর্দি? তা হলে তো আড়াইশো বছর আগে। আলিবর্দি মারা গেছেন সতেরোশো ছাপান্ন সালে।

দীপা বলল, তার মানে পলাশী যুদ্ধেরও আগে।

কাকাবাবু বললেন, হ্যাঁ, তা তো হবেই। আলিবর্দির নাতি সিরাজদ্দৌল্লা, নবাবি করেছিলেন মাত্র চোদ্দ মাস।

অসিত ধর বলল, ইতিহাসের সাল তারিখ আপনার তো বেশ মুখস্থ থাকে।

বিমান বলল, সন্তু এসব পটাপট বলে দিতে পারে।

কাকাবাবু বললেন, সন্তুর কাছে শুনে-শুনেই তো আমারও মুখস্থ হয়ে গেছে। তা এত পুরনো বাড়ি? আমাদের দেশে এত পুরনো বাড়ি খুব কমই আছে।

অসিত ধর বলল, এত পুরনো বাড়ি ভেঙে ফেলবেন? ইউরোপে এইসব বাড়ি ওরা খুব যত্ন করে রেখে দেয়। যার বাড়ি সে ভাঙতে চাইলেও গভর্নমেন্ট বাধা দেয়।

দীপা বলল, অত বড় বাড়ি ঠিকঠাক রাখার মতন সাধ্য আছে নাকি আমাদের!

অসিত ধর বলল, ফরাসি দেশে পুরনো আমলের রাজা-মহারাজা বা জমিদারদের বিরাট-বিরাট বাড়িগুলোকে বলে শাতো। এইরকম অনেকগুলো শাতো আমি দেখেছি। সেখানে ঢুকতেই চারশো-পাঁচশো বছরের ইতিহাস ফিল করা যায়।

বিমান বলল, কুচবিহারের রাজাদের বাড়িটা দেখেছেন, অত চমৎকার একটা প্রাসাদ, সেটারই কী ভাঙাচোরা অবস্থা এখন। ফরাসি দেশের শাতোগুলোর চেয়ে সেই রাজপ্রাসাদ কোনও অংশে কম সুন্দর ছিল না।

গাড়িটা কলকাতা ছাড়িয়ে বালি ব্রিজ পেরিয়ে দিল্লি রোডে পড়েছে। মেঘলা-মেঘলা আকাশ, গরম নেই, বেড়াবার পক্ষে খুব ভাল সময়।

অসিত ধর ফরাসি দেশের শাতোর গল্প শোনাতে লাগল। বর্ধমানের কাছাকাছি এসে হঠাৎ বৃষ্টি নামল। সে একেবারে সাঙ্ঘাতিক বৃষ্টি। চতুর্দিক অন্ধকার। এই বৃষ্টির মধ্যে গাড়ি চালানোও বিপজ্জনক। সেইজন্য ওরা আশ্রয় নিল রাস্তার পাশে এক ধাবায়। গরম-গরম রুটি আর মাংস খাওয়া হল।

বৃষ্টির তেজ কমল প্রায় এক ঘন্টা পরে, তাও পুরোপুরি থামল না। রাস্তার অনেক জায়গায় জল জমে গেছে, গাড়ি চালাতে হল আস্তে-আস্তে।

বীরভূম জেলায় ঢুকে বড় রাস্তা ছেড়ে একটা সরু, কাঁচা রাস্তায় ঢুকতে হল। সে রাস্তায় আবার খুব কাদা। দুবার গাড়ির চাকা বসে গেল। দীপাকে শুধু গাড়িতে বসিয়ে অন্যরা সবাই গাড়ি ঠেলে তুলল।

অসিত ধর সাহেবি ধরনের মানুষ। তার ঝকঝকে পালিশ করা জুতো কাদায় একেবারে মাখামাখি। প্যান্টেও কাদা লেগেছে।

বিমান বলল, ইস, আপনাকে অনেক কষ্ট দিলাম। আমি গত সপ্তাহেও একবার এসেছিলাম, তখন রাস্তা এত খারাপ ছিল না।

অসিত ধর বলল, কষ্ট আবার কী! আমার তো বেশ মজা লাগছে। বেশ একটা অ্যাডভেঞ্চার হচ্ছে।

বিমান বলল, আজ আর বৃষ্টি থামবে না মনে হচ্ছে। আজ সন্ধেবেলা ভূতের গল্প খুব জমবে। পুরনো বাড়িতে এমনিতেই অন্ধকারে গা-ছমছম করে।

দীপা চেঁচিয়ে বলে উঠল, এই খবদার, ভূতটুতের কথা একদম উচ্চারণ করা চলবে না।

অসিত ধর খানিকটা অবাক হয়ে বলল, আপনি ভূত বিশ্বাস করেন নাকি?

দীপা বলল, মোটেই করি না। ভূত বলে আবার কিছু আছে নাকি। কিন্তু ওসব গল্পটল্প শুনতে আমার মোটেই ভাল লাগে না!

বিমান বলল, দীপা বিশ্বাস করে না বটে, কিন্তু অন্ধকারের মধ্যে ভূতের নাম করলেই ও ঠকঠক করে কাঁপে। অসিতবাবু, আপনি ভূতটুত মানেন না নিশ্চয়ই।

অসিত ধর বলল, এত ভাল-ভাল ভূতের গল্প শুনেছি যে, সত্যি বলে মানতে ইচ্ছে করে। ভূত দেখার ইচ্ছেও আছে খুব। ক্যামেরা এনেছি, ভূত দেখলেই ছবি তুলে ফেলব। ফরেনে সেই ছবি দেখলে হইচই পড়ে যাবে।

কাকাবাবু এতক্ষণ চুপ করে শুনছিলেন। এবার হেসে বললেন, ভূতের ছবি? এটা তো বেশ ভাল আইডিয়া! ভূতের গল্পগুলোতে শুধু আঁকা ছবি থাকে, ফোটোগ্রাফ কেউ কখনও দেখেনি!

গাড়ির ড্রাইভার বিলাস সারা রাস্তা কোনও কথাই বলেনি। এবারে সেও আর চুপ করে থাকতে পারল না। সে বলল, স্যার, ওনাদের ছবি তোলা যায় না। আমার এক কাকা একবার চেষ্টা করেছিল, ক্যামেরার ফিলিম সব সাদা হয়ে গেল।

বিমান উৎসাহের সঙ্গে জিজ্ঞেস করল, বিলাস, তোমার কাকা নিজের চোখে ভূত দেখেছেন নাকি?

বিলাস বলল, হ্যাঁ, স্যার। আমিও তো দেখেছি। আমি তখন কাকার পাশে ছিলাম!

বিমান বলল, বাঃ বাঃ! এই তো একজন প্রত্যক্ষদর্শী পাওয়া গেল। রাত্তিরবেলা ভাল করে শুনিও তো ঘটনাটা! দীপা বলল, আমি ঘুমিয়ে পড়ার পর।

অসিত ধর বলল, আমি এমন ক্যামেরা এনেছি, তাতে পুরো অন্ধকারেও ছবি তোলা যায়। ভূত দেখা গেলে তার ছবি উঠবেই!

কাকাবাবু বললেন, এবার মনে হচ্ছে, আমরা এসেই গেছি!
গাড়িটা একটা বাঁক ঘুরতেই দেখা গেল সেই বিশাল প্রাসাদ।

রোদ্র নেই বলে বিকেলবেলাতেই সন্ধে-সন্ধে ভাব। সেই ম্লান আলোয় বাড়িটাকে মনে হয় আকাশ জুড়ে দাঁড়িয়ে আছে। একদিক থেকে আর একদিকের যেন শেষ নেই।

কাকাবাবু মহাবিস্ময়ের সঙ্গে বলে উঠলেন, এত বড় বাড়ি, আমি যে আগে ধারণাই করতে পারিনি।

অসিত বলল, এ যে প্রায় কাল।

কাকাবাবু বললেন, আমি একবার ওড়িশার একটা পুরনো আমলের ফাঁকা রাজবাড়িতে থেকেছিলাম। কিন্তু সে-বাড়িটাও এত বড় নয়।

অসিত বলল, এমন একটা গজাস বাড়ি ভেঙে ফেলবেন? খুবই অন্যায় কথা কিন্তু!

বিমান বলল, কী করি বলুন তো! এ-বাড়ি এমনিতেই ভেঙে পড়ছে। পুরো মেরামত না করলে আর রক্ষা করা যাবে না। তার জন্য লক্ষ-লক্ষ টাকা দরকার, সে-টাকা কোথায় পাব বলুন।

দীপা বলল, মাঠের মধ্যে এরকম একটা জগদ্দল-মাকা বাড়ি রেখেই বা লাভ কী? আমরা তো কেউ এখানে থাকতে আসব না।

বিমান বলল, আমার আর দু ভাইয়ের মধ্যে একজন থাকে দিল্লিতে, আর-একজন জাপানে। তারাও কেউ দায়িত্ব নিতে চায় না। তারাই আমাকে বলেছে বিক্রি করে দিতে।

কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, যিনি কিনেছেন, তিনি এটা ভেঙে ফেলতে চাইছেন কেন?

বিমান বলল, কিনেছেন এক মাড়োয়ারি ভদ্রলোক। তাঁর পাইপের কারখানা আছে আসানসোলে। এ বাড়িটা ভেঙে তিনি এখানে আর একটা কারখানা তৈরি করবেন।

অসিত বলল, এত চমৎকার একটা প্যালেসের বদলে হবে চিমনিওয়ালা কারখানা! ছি ছি।

কাকাবাবু বললেন, ইংরেজিতে একটা কথা আছে না, ওল্ড অর্ডার চেইঞ্জেথ, ইলডিং প্লেস টু নিউ!

দীপা বলল, রবীন্দ্রনাথেরও লেখা আছে, হেথা হতে যাও পুরাতন, হেথায় নতুন খেলা আরম্ভ হয়েছে।

গাড়ির শব্দ শুনে বেরিয়ে এসেছে দুজন লোক। একজনের বয়েস পঁচিশ-ছাব্বিশ, অন্যজন বেশ বৃদ্ধ।

বৃদ্ধটিকে বিমান বলল, রঘুদা, মালপত্রগুলো নামিয়ে নাও, আর শিগগির চায়ের জল চাপাতে বলল। চা, দুধ চিনি আমি সঙ্গে এনেছি।

গাড়ি থেকে নেমে কাকাবাবুকে বলল, আসুন, আগে আমাদের ঘরগুলো দেখে নিই।

সামনেই একটা বিরাট সিংহ দরজা। দু পাশের দুটো পাথরের সিংহ একেবারে ভাঙা। লোহার গেটটা কিন্তু অটুট আছে। ভেতরে এককালে নিশ্চয় বাগান ছিল, এখন জংলা হয়ে আছে। তারপর ধাপেধাপে অনেকগুলো সিঁড়ি উঠে গেছে, মুর্শিদাবাদের নবাব প্যালেসের মতন।

কাকাবাবু কাচ নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে যেতেই অসিত এগিয়ে এসে ভদ্রতা করে বলল, আমি আপনাকে সাহায্য করব?

কাকাবাবু বললেন, ধন্যবাদ। দরকার হবে না। সিঁড়ি দিয়ে উঠতে আমার কোনও কষ্ট হয় না। নামার সময় বরং কিছুটা অসুবিধা হয়।

বিমান বলল, আরও সিঁড়ি আছে। এটা একতলা। একতলার ঘরগুলো ব্যবহার করা যায় না। আবর্জনায় ভর্তি। দোতলায় চার-পাঁচখানা ঘর মোটামুটি ঠিক আছে।

কাকাবাবু বললেন, এখানে কাছাকাছি নদী আছে নিশ্চয়ই?

দীপা বলল, না, নদী-টদি নেই ধারেকাছে।

কাকাবাবু বললেন, আগেকার দিনে সাধারণত নদীর ধারেই এরকম বড় বাড়ি তৈরি করা হত।

বিমান বলল, ঠিক বলেছেন, শুনেছি, আগে একটা নদী ছিল। সেটা শুকিয়ে গেছে অনেকদিন। তবে দিঘি আছে দুটো বেশ বড় বড়।

দোতলায় উঠে এসে বিমান বলল, আমাদের ঘরগুলো অবশ্য পাশাপাশি হবে না। এদিকে দুটো আছে ব্যবহার করা যায়। আর একটা একটু দূরে।

অসিত সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠল, আপনারা এদিকে থাকুন। আমাকে দূরের ঘরটা দিন।

বিমান বলল, ঠিক আছে। কাকাবাবু আমাদের পাশেই থাকবেন। তাতে দীপার যদি ভূতের ভয় একটু কমে।

একটা ঘরের তালা খুলে বিমান সুইচ টিপে আলো জ্বালল।

কাকাবাবু বললেন, ইলেকট্রিসিটি আছে, যাঃ, তা হলে তো অনেকটাই রহস্য চলে গেল। এসব জায়গায় টিমটিম করে লণ্ঠন জ্বলবে, হঠাৎ ঝড়ে সেই লণ্ঠন উলটে গিয়ে ভেঙে যাবে, তবেই তো মজা!

দীপা বলল, ইলেকট্রিসিটি থাকলে আমি আসতাম নাকি? রাত্তিরবেলা আলোর চেয়েও বেশি দরকার ফ্যান। ফ্যান না চললে আমি ঘুমোতেই পারি না।

ঘরটায় আসবাবপত্র বিশেষ কিছু নেই। একটা মাঝারি ধরনের খাট, একটা দেওয়াল আলমারি আর কয়েকটা চেয়ার। একটা ছোট শ্বেত পাথরের টেবিল। ঘরটা অবশ্য অন্য সাধারণ ঘরের চারখানা ঘরের সমান। এত জায়গা খালি পড়ে আছে যে মনে হয়, সেখানে ব্যাডমিন্টন খেলা যায়।

অসিত চেয়ারগুলো আর খাটটায় একবার হাত বুলিয়ে বলল, এগুলো তো তেমন পুরনো নয়।

বিমান বলল, আগেকার জিনিস তেমন কিছু নেই। অনেক নষ্ট হয়ে গেছে, আমার বড়মামা বেশ কিছু ফার্নিচার বিক্রিও করে দিয়েছেন। জমিদারি-টমিদারি তো কিছু আর ছিল না, অন্য আয়ও ছিল না, বড়মামা এখানকার জিনিসপত্র বিক্রি করে খরচ চালাতেন।

কাকাবাবু বললেন, উনি বৃদ্ধ বয়েসেও একা থাকতেন এত বড় বাড়িতে?

বিমান বলল, আগে দূর সম্পর্কের আত্মীয়স্বজন ছিল কয়েকজন। এখানে থেকে কোনও লাভ নেই বলে তারাও চলে গেছে আস্তে-আস্তে। বড়মামা মাঝে-মাঝে যেতেন কলকাতায়। আমাদের বাড়ি থাকতেন না, উঠতেন গ্র্যাণ্ড হোটেলে। কিছু একটা ব্যবসা করতেন শুনেছি, তবে সে ব্যবসা সাকসেসফুল হয়নি কখনও। টাকাটাই নষ্ট হয়েছে শুধু।

দীপা বলল, আসলে পাগল লোক ছিলেন, সেটা বলো না।

বিমান হেসে বলল, ঠিক পাগল নয়, পাগলাটে! আমার বাবা তো বলেন, আমাদের মামাবাড়ির সবাই ছিটগ্রস্ত! আমার মা সুন্ধু?

দীপা আবার বলল, তোমাদের এক দাদু একেবারে বদ্ধ পাগল ছিলেন না?

বিমান বলল, যা, ক্রিশ্চানদাদু! তাঁর গল্প পরে বলব! পুরনো বংশগুলোতে যেন কিছু একটা অভিশাপ লাগে, আস্তে-আস্তে শেষ হয়ে যায় এইরকমভাবে। বড়মামার পর রাও বংশ শেষ হয়ে গেল!

কাকাবাবু বললেন, রাও!

বিমান বলল, টাইটেল শুনলে অবাঙালি মনে হয় তো? আমার মামারা অবাঙালিই ছিলেন এককালে। নবাবি আমলে বাংলাদেশে এসে সেই করেছিলেন। হয়তো লড়াই করে নবাব আলিবর্দিকে খুশি করেছিলেন।

অসিত বলল, এইসব পুরনো বাড়িতে গুপ্তধন-টুপ্তধন থাকে অনেক সময়। দেখুন বাড়ি ভাঙার সময় কিছু পেয়ে যেতে পারেন!

বিমান বলল, সে গুড়ে বালি! আমার ছোটভাই, যে জাপানে থাকে, সেই ধীমানের মাথাতেও এই চিন্তা এসেছিল। বাড়িটা আমাদের ভাগে পড়বার পর ধীমান একবার এসেছিল এখানে। আমরা দু ভাই সারা বাড়ি তন্নতন্ন করে খুঁজে দেখেছি। দামি জিনিস প্রায় কিছুই নেই। আগেই যে-যা পেরেছে বিক্রি করে দিয়েছে। এ বাড়িতে সুড়ঙ্গ-টুরঙ্গ কিছু নেই।

কাকাবাবু বললেন, যাক, বাঁচা গেছে! সুড়ঙ্গ দিয়ে হাঁটাচলা করা আমাদের পক্ষে বড্ড কষ্টকর! অথচ আমার এমনই ভাগ্য, কতবার যে সুড়ঙ্গ দিয়ে পালাতে হয়েছে কিংবা চোর তাড়া করতে হয়েছে তার ঠিক নেই! এখানে এসে গুপ্তধনও খুঁজতে হবে না, সুড়ঙ্গতেও ঢুকতে হবে না।

অসিত বলল, সুড়ঙ্গ যে নেই, সে-বিষয়ে আপনি শিওর হলেন কী করে? হয়তো আপনারা খুঁজে পাননি। আগেকার দিনে গোপনে অন্য জায়গায় চলে যাওয়ার একটা ব্যবস্থা তো থাকতই!

বিমান বলল, সেরকম কিছু থাকলে আমার মা অন্তত জানতেন। আমার মা তো জন্মেছেন এই বাড়িতে। মায়ের কাছে গল্প শুনেছি, ওঁদের ছোটবেলা থেকেই গুপ্তধন আর সুড়ঙ্গ খোঁজা শুরু হয়েছিল। আমার ছোটমামা অনেক দেওয়াল ভেঙে ফেলেছেন। নাঃ, ওসব কিছু নেই।

অসিত ছোট শ্বেত পাথরের টেবিলটা টোকা মেরে পরীক্ষা করে বলল, এটা মন্দ নয়। তবে মাত্র ষাট-সত্তর বছরের পুরনো। চলুন, আমার ঘরটা দেখা যাক।

সবাই বেরিয়ে যাওয়ার পর কাকাবাবু ঘরটার পেছন দিকের একটা জানলা খুললেন। অনেকদিন এ-জানলা খোলা হয়নি বোঝা যায়। বড় পেতলের ছিটকিনি আটা, খুলতে বেশ জোর লাগল।

জানলাটা খুলতেই এমন একটা সরু আর তীক্ষ আওয়াজ শোনা গেল যে, কাকাবাবু চমকে উঠলেন। তারপর ঝটাপট শব্দে উড়ে গেল একটা চিল। জানলার বাইরেই চিলটা বাসা করেছে, জানলা খোলায় সে বেশ বিরক্ত হয়েছে।

জানলা দিয়ে একটা সুন্দর দৃশ্য দেখা গেল।

বৃষ্টি থেমে গেছে, পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে আকাশ। কাছেই একটা মস্ত বড় ঝিল, সেখানে ফুটে আছে অজস্র পদ্মফুল। ঝিলের ওপারের আকাশে অস্ত যাচ্ছে সূর্য। দারুণ লালের ছড়াছড়ি।• আকাশ থেকে লাল-লাল শিখা এসে পড়েছে পদ্মফুলগুলোর ওপর।

কাকাবাবু মুগ্ধ হয়ে দেখতে লাগলেন সেই দৃশ্য।

একটু পরেই দরজার কাছ থেকে একজন বলল, সার, চা দেওয়া হয়েছে। আপনাকে ডাকছেন?

কাকাবাবু পেছন ফিরে দেখলেন অল্পবয়েসী কাজের লোকটিকে।

কাকাবাবু বললেন, চলো, যাচ্ছি।

বারান্দাটা প্রায় একটা রাস্তার মতন চওড়া, তার পাশে-পাশে ঘর। কাকাবাবু ডান দিকে একটুখানি গিয়েই দেখতে পেলেন, ডাইনিং রুম। এ-ঘরেও প্রায় বিশেষ কিছুই নেই, একটা বড় কাঠের টেবিল আর কয়েকখানা সাধারণ চেয়ার, দেওয়ালের গায়ে একটা কাচ-ভাঙা আলমারি। টেবিলটার পালিশ উঠে গেছে। জমিদার বাড়িতে এসব একেবারেই মানায় না!

অসিত টেবিল-চেয়ারগুলোয় হাত বুলিয়ে অবজ্ঞার সঙ্গে বলল, আপনার মামা ভাল-ভাল জিনিস সব বিক্রি করে দিয়ে বাজে ফার্নিচারে ভরিয়ে রেখে গেছেন বাড়িটা। আমার ঘরে যে খাটটা রয়েছে, সেটার দাম একশো টাকাও হবে না।

বিমান লজ্জা পেয়ে বলল, আপনি তা হলে আমাদের ঘরটায় এসেই থাকুন। সেখানে একটা পুরনো পালঙ্ক আছে।

অসিত বলল, না, না, তার দরকার নেই। ঘরটা আমার বেশ পছন্দ হয়েছে। জানলা দিয়ে অনেকখানি ফাঁকা মাঠ দেখা যায়, দূরে একটা জঙ্গল।

দীপা বলল, খাবারগুলো জুড়িয়ে যাবে, আগে খেয়ে নিন।

দুজন কাজের লোক টেবিলের ওপর কয়েকটা প্লেট সাজিয়ে দিয়ে গেল। একটাতে হ্যামবার্গার, একটাতে প্যাটিস, একটাতে সন্দেশ।

কাকাবাবু বললেন, এ কী, এর মধ্যে এতসব খাবার জোগাড় করলে কী করে?

দীপা বলল, আমি সব জিনিসপত্র সঙ্গে নিয়ে এসেছি। এখানে কী পাওয়া যাবে, না যাবে তার ঠিক নেই।

বিমান বলল, দীপা গাড়ি ভর্তি করে ভাল চাল, মুগের ডাল, পাঁপড়, আচার, চিজ, মাখন এইসব নিয়ে এসেছে।

কাকাবাবু বললেন, খাওয়াদাওয়া তা হলে বেশ ভালই হবে মনে হচ্ছে।

বিমান বলল, কালকে দিঘিতে জাল ফেলিয়ে মাছ ধরব।

অসিত একটা হ্যামবার্গারে কামড় দিয়ে বলল, চা-টা খাওয়ার পর আমরা পুরো বাড়িটা একবার ঘুরে দেখব।

বিমান বলল, সন্ধে হয়ে গেল। সব জায়গায় কিন্তু আলো নেই। ইলেকট্রিক রয়েছে মাত্র চার-পাঁচখানা ঘরে।

অসিত বলল, আমার কাছে বড় টর্চ আছে।

বিমান বলল, ঠিক আছে আমরা যতটা পারি দেখব। তবে সারা বাড়িটা কাল দিনের আলোতেই ভাল দেখা যাবে।

কাকাবাবু চায়ে চুমুক দিয়ে বললেন, এতদিনের পুরনো বাড়ি, এখানে সেকালের কোনও অস্ত্রশস্ত্র নেই?

বিমান বলল, সেরকম কিছু নেই। আমি ছেলেবেলায় এসে কয়েকখানা তলোয়ার আর বশা দেখেছিলাম। কিছু বন্দুক-পিস্তল ছিল। কিন্তু সবই বিক্রি হয়ে গেছে। শেষপর্যন্ত বড়মামার ঘরে একটা রাইফেল ছিল। সেটাও আমি থানায় জমা দিয়ে দিয়েছি। আমাদের কলকাতার বাড়িতে রাইফেল রাখার কোনও মানে হয় না। এখানে থাকলে চুরি হয়ে যেত!

অসিত বলল, পুরনো ফায়ার আর্মসের অনেক দাম হয়। ইস, আমাকে একবার দেখালেন না!

দীপা বলল, হাতির দাঁতের হাতলওয়ালা দুখানা ছুরিও পাওয়া গিয়েছিল। সে দুটো আমরা রেখে দিয়েছি।

অসিত ব্যস্ত হয়ে বলল, কই, কই, দেখান তো?

দীপা বলল, সে দুটো কলকাতার বাড়িতে রয়েছে। আর-একটা বেশ ছোট্ট সুন্দর পাথরের বাক্সও পেয়েছিলাম। দেখলেই মনে হয়, গয়নার বাক্স। কিন্তু তার মধ্যে একটুকরো গয়নাও নেই!

বিমান বলল, বড়মামা তো অনেকদিন বেঁচেছেন, দামি জিনিস সবই বিক্রি করে দিয়ে গেছেন।

অসিত বলল, খালি গয়নার বাক্সেরও অনেক দাম হতে পারে। সেটা কতদিনের পুরনো সেটা দেখতে হবে।

দীপা জিজ্ঞেস করল, আপনারা কী করে বোঝেন কতদিনের পুরনো?

অসিত বলল, তা পরীক্ষা করার ব্যবস্থা আছে। সামান্য একটুকরো কাগজও পরীক্ষা করে বলা যায়, কতদিন আগে সেটা তৈরি হয়েছিল।

কাকাবাবু হেসে বললেন, মনে করো দীপা, তোমার ওই গয়নার বাক্সটা ছিল বেগম নূরজাহানের, তা হলেই ওটার দাম হয়ে যাবে কয়েক লক্ষ টাকা। আমি কলকাতায় একটা বাড়িতে একটা সাধারণ কাচের দোয়াত দেখেছিলাম, সেই দোয়াতটা সম্রাট নেপোলিয়ান ব্যবহার করতেন। সেইজন্যই সেটার অনেক দাম।

অসিত বলল, ওই দোয়াতটা কোন বাড়িতে আছে আমি জানি। আমি পাঁচ লক্ষ টাকা দাম দিতে চেয়েছিলাম, তাও তারা বিক্রি করতে রাজি হয়নি।

দীপা বলল, একটা দোয়াতের দাম পাঁচ লাখ টাকা?

বিমান বলল, নেপোলিয়ানের দোয়াত!

চা-পর্ব শেষ হতে সবাই বেরিয়ে এল ঘর থেকে।

বারান্দাটা দুদিকেই চলে গেছে অনেকখানি। বিমান বলল, ডান দিকটায় অনেকখানি ভাঙা। ছাদ খসে পড়েছে। বিশেষ কিছু দেখার নেই। চলুন, বাঁ দিকটা দেখা যাক।

অসিত বলল, চলুন, পরে ডান দিকটাও দেখব।

অন্ধকার হয়ে গেছে বাইরেটা, আবার বৃষ্টি শুরু হয়েছে। সারা বাড়ি নিস্তব্ধ। শুধু কাকাবাবুর ক্রাচের আওয়াজ হতে লাগল খট খট করে। পর পর। ঘরগুলোর দরজা বন্ধ। কোনওটাতেই তালা নেই, বিমান দরজা ঠেলে ঠেলে খুলে দেখতে লাগল। তিন-চারখানা ঘরে কিছুই নেই। একটা ঘরে অনেকগুলো ভাঙা চেয়ার-টেবিল উলটোপালটা করে রাখা। একটা ঝাড়লণ্ঠন চূর্ণ-বিচূর্ণ অবস্থায় পড়ে আছে, মনে হয়, ওপর থেকে একদিন খসে পড়েছিল, তারপর আর কেউ সেটাতে হাত দেয়নি।

অসিত জিনিসগুলো পরীক্ষা করে দেখতে লাগল।

দীপা খানিকটা অধৈর্যের সঙ্গে বলল, ওগুলো কালকে ভাল করে দেখবেন। এখন চলুন, তাড়াতাড়ি একবার চক্কর দিয়ে আসা যাক।

অসিত ঝাড়লণ্ঠনের একটা প্রিজম তুলে নিয়ে এসে বলল, ঠিক আছে, চলুন।

আর-একটা ঘরে রয়েছে শুধু বালিশ আর তোশক। লাল মখমলের কয়েকটা তাকিয়া বেশ দামি মনে হলেও সেগুলো ছিঁড়ে তুলো বেরিয়ে এসেছে।

দীপা বলল, এই ঘরটায় কি বিশ্রী বোঁটকা গন্ধ। এখানে কোনও বাঘ-টাঘ লুকিয়ে নেই তো?

কাকাবাবুর সঙ্গেও টর্চ রয়েছে। তিনি ওপরের দিকে আলো ফেলে বললেন, ওই দ্যাখো, কত চামচিকে বাসা বেঁধে আছে। চামচিকের এইরকম গন্ধ হয়!

দীপা বলল, চলো, চলো, শিগগির এখান থেকে বেরিয়ে চলো।

আর-একটুখানি যাওয়ার পর বারান্দাটা একদিকে বাঁক নিয়েছে। সেখানে ছাতের দিকে একটা সিঁড়ি উঠে গেছে, একটা সিঁড়ি নেমে গেছে নীচের দিকে। পাশে একটা খালি ঘর, তার দরজা খোলা।

সেখানে দাঁড়িয়ে বিমান বলল, আমার ছোটমামা এখান থেকে পড়ে মারা গিয়েছিলেন।

দীপা বলল, পড়ে গিয়েছিলেন, না ঠেলে মেরে ফেলা হয়েছিল?

বিমান বলল, অনেকে তা-ই বলে। কিন্তু শুধু-শুধু কেউ ঠেলে ফেলবে কেন?

দীপা বলল, তোমার মা-ও তো বলেন, কেউ ঠেলে ফেলে দিয়েছিল!

অসিত বারান্দার রেলিংটায় ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, এটা তো বেশ মজবুতই রয়েছে এখনও, এখান দিয়ে শুধু-শুধু কারও পড়ে যাওয়া তো স্বাভাবিক নয়!

বিমান বলল, মোট কথা, কেউ ঠেলে ফেলে দিয়েছিল কি না, তার কোনও প্রমাণ পাওয়া যায়নি।

কাকাবাবু বললেন, বিমান, তোমার ওই ছোটমামা কতদিন আগে মারা গেছেন?

বিমান বলল, প্রায় কুড়ি বছর!

কাকাবাবু বললেন, ওঃ অতদিন আগে। তা হলে আর ওই ব্যাপারে মাথা ঘামাবার কোনও দরকার নেই। এখন তো আর ওই রহস্যের সমাধান করা যাবে না।

অসিত জিজ্ঞেস করল, ওপরের সিঁড়িটা ছাদে গেছে? নিশ্চয়ই মস্ত বড় ছাদ।

বিমান বলল, ছাদে একখানা ঘর আছে, সেটাই ছিল আমাদের ক্রিশ্চান দাদুর ঘর। সেটা বছরের পর বছর তালাবন্ধই পড়ে থাকে।

দীপা বেশ জোরে বলে উঠল, ওখানে এখন যাওয়া হবে না। না, না, কিছুতেই না। দিনের বেলা দেখবেন।

অসিত বলল, ছাদে যেতে তো ভালই লাগবে। বাইরেটাও অনেকখানি। দেখা যাবে।

দীপা আবার সেইরকমভাবে বলল, কাল সকালে।

অসিত আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল, এমন সময় পাশের খালি ঘরটায় কিসের যেন একটা শব্দ হল।

চমকে ঘুরে দাঁড়াল চারজনই।

বিমান টর্চ সেদিকে ফিরিয়ে বলল, কে?

আর কোনও সাড়া নেই, শব্দ নেই।

আর এগোতে যেতেই দীপা হাত চেপে ধরে বলল, এই, তুমি ভেতরে যেও না!

বিমান বলল, দাঁড়াও, দেখি ভেতরে কী আছে। তুমি শব্দ শোনোনি?

অসিত এগিয়ে গিয়ে টর্চের জোরালো আলো ফেলতেই দেখা গেল, ঘরের এক কোণে দাঁড়িয়ে আছে একটি ছায়ামূর্তি। মুখভর্তি দাড়িগোঁফ, খালি গা। আলোয় যেন চকচক করে উঠল তার দু চোখ।

দীপা ও মা গো বলে আর্ত চিৎকার করে উঠল।

অসিত নিজের টর্চটা ফেলে দিয়ে চিৎকার করে বলল, আপনারা কেউ, আলোটা ধরুন তো! ক্যামেরা! আমি ক্যামেরা বার করছি।

কাকাবাবু ততক্ষণে পকেটের রিভলভারে হাত দিয়েছেন, ওটা সব সময় তাঁর সঙ্গে থাকে। কিন্তু তিনি রিভলভারটা বার করলেন না। সেই মূর্তিটা ছুটে এল ওদের দিকে। বিমান আর দীপাকে ধাক্কা দিয়ে চলে গেল সিঁড়ির দিকে। কাকাবাবু হাত বাড়িয়ে তাকে ধরার চেষ্টা করেও পারলেন না।

বিমান আর দীপা দুজনেই দারুণ ভয় পেয়ে বসে পড়ল মাটিতে।

অসিত ততক্ষণে ক্যামেরা খুলে বলল, চলে গেল? ভূতটা চলে গেল?

কাকাবাবু হেসে বললেন, ঘরটার এক কোণে একটা বিছানা পাতা আছে। ভূতেরা বিছানা পেতে শোয়, এমন কখনও শুনিনি।

সত্যিই এবার দেখা গেল, ঘরের মধ্যে রয়েছে একটা মাদুর, বালিশ, ছেঁড়া কাঁথার বিছানা। কিছু এঁটো শালপাতা, একটা কলকে।

কাকাবাবু বললেন, আমরা বোধ হয় কারও ঘুম ভাঙিয়েছি। আমাদের চেয়েও ও বেচারা ভয় পেয়েছে বেশি।

অসিত বলল, যাঃ! প্রথম ভূতটা ফসকে গেল।

বিমান উঠে দাঁড়িয়ে এবার মেজাজ গরম করে বলল,এখানে কে থাকবে? কারও তো থাকার কথা নয়।

সে গলা চড়িয়ে ডাকল, রঘুদা! ভানু!

দু-তিনবার ডাকতেই ছুটতে ছুটতে এল অল্প বয়েসী কাজের ছেলেটি।

বিমান জিজ্ঞেস করল, ভানু! এখানে কে থাকে?

ভানু বলল, কেউ না তো!

বিমান প্রচণ্ড ধমক দিয়ে বলল, কেউ থাকে না তো কার বিছানা পাতা রয়েছে? ভূতে পেতেছে?

ভানু ঘরের মধ্যে উঁকি দিয়ে বলল, তা হলে বোধ হয় দিনু পাগলটা?

দিনু পাগলটা মানে?

এত বড় বাড়ি, সব ঘরে তো নজর রাখা যায় না? খুব বৃষ্টিবাদলায় গ্রামের কিছু লোক এ-ঘরে ও-ঘরে এসে শুয়ে থাকে।

তার মানে, যার খুশি বাড়ির মধ্যে ঢুকে পড়বে? রাত্তিরবেলা বাইরের সব দরজা বন্ধ করে রাখতে পারো না?

পেছন দিকের অনেকগুলো দরজাই একেবারে ভাঙা। বন্ধ করব কী করে? এই সিঁড়িটার নীচের দরজাটা পুরোটাই নেই!

কাকাবাবু বললেন, কয়েকদিন পর বাড়িটা পুরোটাই ভেঙে ফেলা হবে। এই কটা দিন গ্রামের লোক যদি শুতে চায়, শুয়ে নিক না ক্ষতি কী?

দীপা বলল, ওমা, যে-সে এসে ঢুকে পড়বে! দোতলায় উঠে আসবে? তারপর যদি রাত্তিরবেলা আমাদের গলা টিপে মেরে ফেলে?

বিমান বলল, ভানু, যেমন করে হোক, এই সিঁড়ির মুখটা আটকাও! একতলায় তো অনেক ভাঙা দরজা-জানলা পড়ে আছে, সেইগুলো দিয়ে যা হোক একটা কিছু করো! কেউ যেন ওপরে আসতে না পারে।
রাত্তিরে খাওয়ার আগে বারান্দায় কয়েকখানা চেয়ার পেতে নানারকম গল্প হল অনেকক্ষণ। এ-দিকের কয়েকটা ঘরে ইলেকট্রিকের আলো থাকলেও নিভে গেল একটু বাদেই। গ্রামের দিকে লোডশেডিং হয় শহরের চেয়েও বেশি। এক-এক সময় দু-তিনদিন একটানা কারেন্ট থাকে না।

দীপা বলল, এই রে, সারারাত অন্ধকারে থাকতে হবে! পাখাও ঘুরবে!

বিমান বলল, বৃষ্টির জন্য গরম অনেক কমে গেছে। একটা হ্যাজাক বাতি জ্বেলে আনব?

অসিত বলল, এখন থাক। এই তো বেশ লাগছে। পরে খাওয়ার সময় হ্যাজাক দরকার হবে।

বিমান বলল, তখন একটা নিরীহ লোককে দেখে আমরা কী ভয় পেয়ে গেলাম! লজ্জার কথা?

দীপা বলল, সব সময় আমাকে দোষ দাও। কিন্তু তুমিই বেশি ভয় পেয়েছিলে!

বিমান জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা কাকাবাবু, আমরা কেউই তো ভূতে বিশ্বাস করি না। এমন কী দীপাও মানে যে, ভূত বলে কিছু নেই। মানুষ মরে গেলে আর কোনওরকমেই তার পৃথিবীতে ফিরে আসার উপায় নেই, এ তো আমরা সবাই জানি। তবু ভয় পাই কেন?

কাকাবাবু বললেন, আমরা ভূতের ভয় পাই না। আমরা অন্ধকারকে ভয় পাই। এটা বহু যুগের সংস্কারের ব্যাপার।

দীপা বলল, শুধু অন্ধকারের জন্যই ভয়?

কাকাবাবু বললেন, দিনের বেলায় রোদ্দুরের আলোয় তুমি যদি দ্যাখো একটা জীবন্ত কঙ্কাল খটখটিয়ে আসছে, তা দেখে কি তোমার ভয় হবে? বরং তোমার হাসি পাবে। কারণ, তুমি জানো, কোনও কঙ্কালের পক্ষে হাঁটা সম্ভব নয়। কেউ নিশ্চয়ই কোনও কায়দা করে তোমাকে ঠকাতে চাইছে। কিংবা ধরো, এখানে একশো পাওয়ারের একটা বাল্ব জ্বলছে, তার মধ্যে যদি একটা ঘোমটাপরা পেত্নি এসে পড়ে, তা হলে তুমি কি ভয় পাবে? তুমি অমনি জিজ্ঞেস করবে, অ্যাই, তুই কে রে? এখানে ন্যাকামি করছিস?

অসিত বলল, যেসব দেশে লোডশেডিং হয় না, সমস্ত গ্রামেও আলো জ্বলে, সেসব দেশ থেকে ভূত পালিয়ে গেছে চিরকালের জন্য।

কাকাবাবু বললেন, অন্ধকার সম্পর্কে বহু যুগ আগেকার ভয় এখনও আমাদের রক্তের মধ্যে রয়ে গেছে। অন্ধকারে বিপদ আসতে পারে যে-কোনও দিক থেকে। যে-বিপদটাকে আমরা চোখে দেখতে পাই না। সেটা সম্পর্কে আমাদের যুক্তিও গুলিয়ে যায়।

অসিত বলল, আমারও প্রথমটা লোকটাকে দেখে বুকটা কেঁপে উঠেছিল, স্বীকার করতে লজ্জা নেই।

কাকাবাবু বললেন, ভাগ্যিস আমি বিছানাটা দেখতে পেয়েছিলাম, তাই লোকটাকে গুলি করিনি।

অসিত বেশ অবাক হয়ে মুখ ফিরিয়ে বলল, গুলি করতেন মানে? আপনার কাছে কি রিভলভার-টিভলভার আছে নাকি?

বিমান বলল, বাঃ, আপনি রাজা রায়চৌধুরী, মানে কাকাবাবু সম্পর্কে কিছু জানেন না? ওঁর কত শত্রু। সব সময় একটা অস্ত্র তো সঙ্গে রাখতে হবেই!

অসিত আবার জিজ্ঞেস করল, ওঁর এত শত্ৰু কেন? উনি কী করেন?

কাকাবাবু বললেন, ওসব কথা থাক। বিমান, তুমি যে তখন বললে, ছাদের ঘরে তোমার এক ক্রিশ্চান দাদু থাকতেন। তিনি সত্যিই ক্রিশ্চান ছিলেন?

বিমান বলল, হ্যাঁ, উনি ছিলেন আমার মায়ের এক কাকা। ঠিক আপন নন, একটু দূর সম্পর্কের। উনি এবাড়িতেই থাকতেন। শুনেছি অনেক লেখাপড়া করেছিলেন। এখানে কাছাকাছি ক্রিশ্চান মিশনারিদের একটা চার্চ আছে। সেখানে কিছুদিন যাতায়াত করতে করতে উনি হঠাৎ দীক্ষা নিয়ে ফেললেন। ওঁর আগে নাম ছিল ধর্মনারায়ণ রাও, দীক্ষা নেওয়ার পর নাম হল গ্রেগরি রাও।

তাই নিয়ে খুব গোলমাল হয়েছিল নিশ্চয়ই!

তা তো হবেই। আগেকার দিনের ব্যাপার। ধর্ম বদল করার ব্যাপারটা কেউ সহজে মেনে নিতে পারত না। এ বাড়ির যিনি তখন কর্তা ছিলেন; তিনি এত রেগে গেলেন যে, সেই গ্রেগরি রাওকে তাড়িয়ে দিলেন বাড়ি থেকে। শুধু তাই নয়, হুকুম দেওয়া হল যে সে এই জেলাতেই কোথাও থাকতে পারবে না। এবাড়ির সঙ্গে তার সম্পর্কের কথাও যেন কেউ না জানতে পারে। গ্রেগরি রাও নিরুদ্দেশে চলে গেলেন।

দীপা বলল, তারপর তো অনেক বছর পর তাঁকে বম্বে না কোথায় আবার খুঁজে পাওয়া গেল।

বিমান বলল, আমাকে বলতে দাও না! আমার মামাবাড়ির ব্যাপার আমি তোমার থেকে ভাল জানি। গ্রেগরি রাও নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়ার পর অনেকদিন তার কোনও খবর পাওয়া যায়নি, কেউ খবর জানতেও চায়নি!

কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, উনি বিয়ে-টিয়ে করেননি?

না। কখনও চাকরিবাকরি করেননি, টাকা রোজগার করতেও শেখেননি। এবাড়িতে তাঁর কোনও দরকারও হত না সে-আমলে। তিনি কোথায় চলে গেলেন কে জানে। প্রায় বছর দশেক বাদে আমার মায়ের বাবা, তার মানে আমার দাদু একবার কী কাজে গিয়েছিলেন, বম্বেতে। সেখান থেকে বেড়াতে গেলেন গোয়র পাঞ্জিম শহরে। যে হোটেলে উঠলেন, তার ম্যানেজার বাঙালি। তিনি আমার দাদুকে আগে থেকেই চিনতেন। কথায় কথায় সেই ম্যানেজার বললেন, আপনাদের বংশের একজন মানুষ এখানে খুবই খারাপ অবস্থায় রয়েছেন। তিনি খুব অসুস্থ, বিনা চিকিৎসায়, না খেতে পেয়ে মারা যাবার উপক্রম।

গ্রেগরি রাও গোয় চলে গিয়েছিলেন?

হ্যাঁ। বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেওয়ায় তাঁর এত অভিমান হয়েছিল যে, বাংলা থেকে যত দূরে সম্ভব তিনি চলে যেতে চেয়েছিলেন। গোয়াতে অনেক বড় বড় চার্চ আছে জানেন নিশ্চয়ই। সেইরকম একটা চার্চে আশ্রয় পেয়েছিলেন গ্রেগরি রাও। সেখানে একজন পর্তুগিজ পাদ্রি তাঁকে খুব স্নেহ করতেন, দুজনে থাকতেন এক বাড়িতে। তারপর সেই পর্তুগিজ পাদ্রির সঙ্গে চার্চের কী যেন গণ্ডগোল হল, তিনি চার্চের সঙ্গে সম্পর্ক চুকিয়ে থাকতে লাগলেন আলাদাভাবে। গ্রেগরি রাও কিন্তু তাঁকে ছাড়লেন না, তিনিও চার্চ ছেড়ে দিয়ে সেই পাদ্রির সঙ্গেই রয়ে গেলেন। আমার দাদু যখন গোয়ায় গেলেন, তখন সেই পাদ্রিও মারা গেছেন, গ্রেগরি রাও একা থাকেন।

হোটেলের ম্যানেজারের কাছে এইসব কথা শুনে তোমার দাদু গেলেন গ্রেগরি রাওয়ের সঙ্গে দেখা করতে?

প্রথমে দাদু রাজি হননি। তিনি বলেছিলেন, ওকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল, ও রাও পরিবারের কেউ না! কিন্তু আমার দিদিমা ছিলেন খুব দয়ালু। তিনি প্রচুর দান-ধ্যান করতেন। তিনি সব শুনে বললেন, আচ্ছা, একজন লোক অসুস্থ অবস্থায় একা একা পড়ে আছে, তাকে সাহায্য করবে না? তা কি হয়? সে মারা গেলে লোকে বলবে তো রাও বংশের একজন মানুষ না খেয়ে মরেছে! আমাদের বাড়িতে তো কত লোক এমনই থাকে, খায়। দিদিমার। অনুরোধে দাদু গেলেন দেখা করতে। পাঞ্জিম থেকে খানিকটা দূরে, কালাংগুটে। বাড়ি ভাড়া দেওয়ার ক্ষমতা ছিল না, গ্রেগরি রাওয়ের আস্তানা তখন একজন লোকের বাড়ির আস্তাবলে। সেখানকার লোকে তার গ্রেগরি নামটাও জানে না। সবাই বলে বাঙালিবাবু। আমার দাদু গিয়ে কী দেখলেন জানেন?

কী?

গ্রেগরি রাও তখন বদ্ধ পাগল। তাঁর অন্য কোনও অসুখ নেই। এমনই পাগল যে, মানুষ চিনতেও পারেন না। দাদুকেও চিনতে পারলেন না। পর্তুগিজ ভাষায় কী সব বিড়বিড় করতে লাগলেন। দাদু ভেবেছিলেন, কিছু টাকাপয়সা দিয়ে সাহায্য করে আসবেন। কিন্তু দিদিমা বললেন, ওই পাগলকে টাকা দিয়ে কী হবে? ওঁর তো টাকা-পয়সা সম্পর্কেও কোনও জ্ঞান নেই। ওঁর হাতে টাকা দিলে দুদিনেই অন্য লোকরা লুটেপুটে নেবে। তখন ঠিক হল, সেই পাগলকে সঙ্গে নিয়ে আসা হবে এখানে। কিন্তু, পাগলকে আনা কি সহজ? তাঁর ওই আস্তাবলের ঘরের মধ্যে নানারকমের নুড়িপাথর, ঝিনুক, পুঁতির মালা, ছেঁড়াখোঁড়া বইপত্র ছড়ানো। এইসব হল পাগলের সম্পত্তি। তাঁকে ঘর থেকে বার করা যায় না, ওইসব জিনিস বুকে চেপে ধরে চিৎকার করতে থাকেন। দাদু বিরক্ত হয়ে গিয়েছিলেন। দিদিমার দয়াতেই শেষ পর্যন্ত লোজন জুটিয়ে ওই ঘরের সমস্ত হাবিজাবি জিনিসপত্ৰসমেত গ্রেগরি রাওকে নিয়ে আসা হল বীরভূমের এই বাড়িতে। চিকিৎসার ব্যবস্থাও হয়েছিল। কিন্তু ডাক্তার কবিরাজরা বললেন, ওঁর ভাল হওয়ার আর কোনও আশা নেই। বাড়িতে একটা পাগল রাখা তো সোজা কথা নয়। সেইজন্য তাঁকে রাখা হল ওই ছাদের ঘরটায়। ওখানেই তিনি আপনমনে থাকতেন। এখানে আসার পর এগারো বছর বেঁচে ছিলেন।

অসিত জিজ্ঞেস করল, এইসব ঘটনা আপনি কার কাছে শুনেছেন! আপনার মার কাছে?

বিমান বলল, হ্যাঁ, মার কাছে তো অনেকবার শুনেছি। আমার দিদিমার কাছেও শুনেছি। খুব ছোটবেলায় আমি পাগলাদাদুকে দেখেছিও। বাচ্চা ছেলেমেয়েদের দেখলেই দাঁত খিচিয়ে মারতে আসতেন। ওঁর ভয়ে আমরা ছাদে যেতাম না। সারা মুখে দাড়িগোঁপের জঙ্গল, মাথার চুল জট পাকানো, চেহারাটাও হয়ে গিয়েছিল ভয়ঙ্কর। তবে ছাদ থেকে কখনও নীচে নেমে আসতেন না বলে আর কোনও ভয় ছিল না।

এগারো বছর ওই ছাদের ঘরে ছিলেন?

তাই তো শুনেছি। একদিনের জন্যও কেউ ওঁকে ঘর থেকে বার করতে পারেনি। ওই ঘরের সঙ্গেই একটা বাথরুম তৈরি করে দেওয়া হয়েছিল সেইজন্য। বাড়ির একজন কাজের লোক রোজ ওঁর ঘরের সামনে খাবার দিয়ে আসত। সেও ভয়ে ঘরের মধ্যে ঢুকত না। একদিন নাকি পাগলাদাদু তার হাত কামড়ে দিয়েছিল।

দীপা বলল, তোমার ছোটমামার কথাটা বলো।

বিমান বলল, হ্যাঁ। একমাত্র আমার ছোটমামার সঙ্গেই ওই পাগলাদাদুর কিছুটা ভাব ছিল। ছোটমামা ছিলেন অনেকটা আমার দিদিমার মতন। মায়া-দয়া ছিল খুব। প্রথম থেকেই তিনি পাগলাদাদুর সেবা করতেন। সাহস করে ওঁর ঘরে ঢুকে জোর করে কয়েকদিন ওঁকে স্নান করিয়ে দিয়েছেন। বুঝতেই পারছেন, ঘরখানা অসম্ভব নোংরা হয়ে উঠেছিল দিনের পর দিন। অনেকটা যেন সিংহের খাঁচার মতন। ভয়ে কোনও কাজের লোক ঢোকে না। ছোটমামাই শুধু ঢুকতেন, এবং জমিদারের ছেলে হয়েও তিনি নিজের হাতে সে-ঘরের ময়লা পরিষ্কার করেছেন কয়েকবার। পাগলাদাদু নাকি ছোটমামার মাথায় হাত দিয়ে কী সব যেন বলতেন, তা বোঝা যেত না কিছুই, কিন্তু মনে হত যেন আশীবাদ করছেন। কিন্তু পাগলের ব্যাপার তো। হঠাৎ একদিন মেজাজ বদলে গেল। ছোটামামা সেদিন ঘরটা একটু গুছিয়ে দিচ্ছেন, পাগলাদাদু আচমকা খেপে গিয়ে প্রথমে ছোটমামাকে এক লাথি কষালেন। চিৎকার করে বললেন, শয়তান, তুই আমার ঘরে জিনিস চুরি করতে এসেছিস? সাত রাজার ধন এক মানিক আছে আমার কাছে। দেব না! কাউকে দেব না! তারপর হাতের বড় বড় নোখ দিয়ে ছোটমামার গাল চিরে দিলেন। বোধ হয় চোখ দুটোও গেলে দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। ছোটমামা কোনওক্রমে পালিয়ে আসে। তারপর থেকে দিদিমা ছোটমামাকে ওপরে যেতে বারণ করে দিয়েছিলেন।

কাকাবাবু বললেন, বাবাঃ, সাঙ্ঘাতিক পাগল ছিলেন তো!

বিমান বলল, অথচ কিন্তু লেখাপড়া জানতেন বেশ। পাগল অবস্থাতেও চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে ইংরেজি কবিতা আবৃত্তি করতেন। বাইবেলের শ্লোক বলতেন। কিন্তু লোকজন দেখলেই হিংস্র হয়ে উঠতেন।

অসিত বলল, হুঁ। তা হলে মনে হচ্ছে, উনিই আপনার ছোটমামাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছিলেন। ওঁর কাছে কোনও দামি জিনিস আছে সেটা টের পেয়ে আপনার ছোটমামা রাত্তিরবেলা চুরি করতে গিয়েছিলেন। পাগল জেগে উঠে তাঁকে ঠেলে নীচে ফেলে দেয়।

কাকাবাবু বললেন, অনেক বছর আগেকার ব্যাপার। এখন আর এ-নিয়ে গবেষণা করে কোনও লাভ নেই।

বিমান একগাল হেসে বলল, তা ছাড়া ওঁর ঘরে দামি জিনিস কিছু ছিল না। ওটা পাগলের প্রলাপ।

অসিত বলল, নানারকম পাথর, ঝিনুক ছিল বলছিলেন। তার মধ্যে কোনও-কোনওটা খুব দামি হতে পারে।

বিমান বলল, কিচ্ছু না, কিছু না! সেগুলো সব ওই ঘরের মধ্যেই আছে, কাল সকালে দেখবেন। নদীর ধারে কিংবা সমুদ্রের ধারে যে নানারকম ছোট-ছোট নুড়িপাথর থাকে, অনেকে কুড়িয়ে আনে, ওই পাথরগুলো সেরকম। আর কিছু ঝিনুক। তাও সমুদ্রের ধার থেকে কুড়োনো, তার মধ্যে আবার অনেকগুলোই ভাঙা। আর ছিল পুঁতির মালা, অনেকগুলো। নানান রঙের, কিন্তু অতি সাধারণ পুঁতি। ক্রিশ্চানদের রোজারি বলে একরকম জপের মালা থাকে, ওঁর বোধ হয় সেইরকম মালা জমানোর শখ ছিল!

দীপা বলল, ওইসব পুঁতিটুতির মধ্যে দু-একটা হিরে-মুক্তোও থেকে যেতে পারে।

বিমান বলল, সেসব কী আর কম খুঁজে দেখা হয়েছে। জমিদারি চলে যাওয়ার পর যখন এই বংশের রোজগার বন্ধ হয়ে যায়, তখন হ্যাংলার মতন সবাই সারা বাড়ি তন্নতন্ন করে খুঁজে দেখেছে কোথাও কোনও দামি জিনিস আছে কি না! বড়মামা চেয়ার-টেবিল বিক্রি করতে শুরু করেছিলেন, তাতেই বুঝতে পারছ, দামি জিনিস আর কিছু বাকি ছিল না।

অসিত জিজ্ঞেস করল, আপনার পাগলাদাদুর ঘরের জিনিসপত্রগুলো আপনি নিজেও পরীক্ষা করে দেখেছেন?

অনেকবার। আমার ছোটভাই একজন স্যাকরা ডেকে এনে পুঁতির মালাগুলো দেখিয়েছে। সেই স্যাকরা বলেছিল, ওইসব মালার দাম দশ টাকাও হবে না। আমাদের আগেও অনেকে দেখেছে। তবে পাগলাদাদু মারা যাওয়ার আগে কেউ ঘরে ঢুকে দেখেনি। উনি মারা যাওয়ার পরেও কয়েক মাস ভয়ে কেউ ও-ঘরে ঢোকেনি।

তখনও ভয় ছিল কেন?

ওঁর মৃত্যুর ব্যাপারটা যে ভয়াবহ। আগেই বলেছি, বাড়ির একজন কাজের লোক রোজ ওঁকে খাবার দিয়ে আসত। সেই লোকটি এক সময় ছুটি নেয় দেশে যাওয়ার জন্য। আর একজনের ওপর ভার দিয়ে যায়। সেই লোকটা পর-পর দুদিন দেখে যে খাবার বাইরে পড়ে আছে, পাগলাদাদু কিছু খাননি। সে ভেবেছিল, পাগলের খেয়াল। কাউকে বলেনি কিছু। তৃতীয় দিনেও ওইরকম খাবার পড়ে থাকতে দেখে সে কয়েকবার ডাকাডাকি করেও কোনও সাড়াশব্দ পায়নি। তখন সে জানিয়েছিল বড়মামাকে। বড়মামা পাত্তা দেননি, বলেছিলেন, খিদে পেলে ঠিক খাবে। দিদিমা তখন বেঁচে নেই, ওই পাগলের জন্য বাড়িতে কারও কোনও মায়া-দয়া ছিল না। আরও দুদিন পর বিশ্রী গন্ধ পেয়ে দরজা ভাঙা হল। পাগলাদাদু অন্তত তিন দিন ধরে ঘরের মধ্যে মরে পড়ে আছেন। শীতকাল ছিল, খুব শীত ছিল সেবার, তাই আগে গন্ধ পাওয়া যায়নি। এইরকমভাবে মৃত্যু হলে নানারকম ভয়ের গল্প রটে যায়। কাজের লাোে ধরেই নিল পাগলাদাদু অপঘাতে মরে ভূত হয়েছেন। একে ছিলেন হিংস্র পাগল, তার ওপরে ভূত, কেউ আর ওই ঘরের ধারেকাছে যায়? ঘরটা সেইরকমই পড়ে আছে। এখনও নাকি ছাদে মাঝে-মাঝে শব্দ হয় রাত্তিরে, এরা বলে যে পাগলা সাহেবের ভূত ঘুরে বেড়াচ্ছে।

দীপা কান খাড়া করে বলল, চুপ, চুপ! শোনো, ওপরে কিসের শব্দ হচ্ছে না?

সবাই শোনার চেষ্টা করল। বিমান বলল, ধ্যাত! কোথায় শব্দ? এখনও তোমার ভূত-প্রেতের ভয় গেল না?

অসিত বলল, বোধ হয় নীচে কোনও শব্দ হয়েছে, আপনি ভেবেছেন ছাদে। এরকম হয়। আচ্ছা, বিমানবাবু, আপনার ওই পাগলাদাদু যখন মারা যান, তখনও কি দরজা ভেতর থেকে বন্ধ ছিল?

বিমান বলল, হ্যাঁ! আপনি ভাবছেন, কেউ তাঁকে মেরে ফেলেছিল? তা নয়! দরজা বন্ধই ছিল।

দীপা বলল, থাক, আর ওসব কথার দরকার নেই। কতকালের পুরনো ব্যাপার!

একজন কাজের লোক এই সময় এসে জানাল যে, খাবার তৈরি হয়ে গেছে।

সবাই এবার উঠে গেল খাবার ঘরে। টেবিলের ওপর পাঁচখানা প্লেট পাতা রয়েছে।

কাকাবাবু একটা চেয়ার টেনে বসে বললেন, আমরা তো চারজন। পাঁচজনের ব্যবস্থা কেন? আর কেউ আসবে?

বিমান হেসে বলল, না, আর কেউ নেই। এটা এ-বাড়ির একটা অনেককালের নিয়ম। খাবার সময় একটা জায়গা সব সময় বেশি রাখা হত। যদি হঠাৎ কোনও অতিথি এসে পড়ে!

কাকাবাবু বললেন, বাঃ, বেশ ভাল নিয়ম তো।

দীপা বলল, আমার কিন্তু ভাল লাগে না। একটা খালি প্লেট দেখলে বারবার মনে হয়, এক্ষুনি বুঝি কেউ আসবে। বারবার দরজার দিকে চোখ চলে যায়।

বিমান বলল, আমাদের বাড়িতে কিন্তু এরকম অনেকবার হয়েছে। খেতে বসেছি, এমন সময় কোনও খুড়তুতো কিংবা মাসতুতো ভাই এসে পড়ল। আমরা অমনই বলি, এসো, এসো, খেতে বসে যাও। প্লেট সাজানো দেখে সে অবাক হয়ে যায়। তখন আমরা বলি, তুমি যে আসবে, তা আমরা আগে থেকেই জানতাম!

দীপা খাবার পরিবেশন করতে লাগল। পদ বেশি নেই। সরু চালের সাদা ধপধপে ভাত, বেগুনভাজা আর আলুভাজা, মুর্গির ঝোল। ঝোলটার চমৎকার স্বাদ।

খাওয়া যখন প্রায় শেষ হয়ে এসেছে, এমন সময় কোথায় যেন ধুড়ম-ধড়াম শব্দ হল। বেশ জোর আওয়াজ। চমকে উঠল সবাই।

বিমান চেঁচিয়ে উঠল, ভানু, ভানু!

অল্পবয়েসী কাজের ছেলেটি এসে দাঁড়াল দরজার কাছে।

বিমান জিজ্ঞেস করল, ও কিসের শব্দ রে?

ভানু বলল, পশ্চিম দিকের বারান্দাটা খানিকটা ভেঙে পড়ল। মাঝে-মাঝেই ভাঙছে। আজ খুব বৃষ্টি হয়েছে তো।

দীপা সঙ্গে-সঙ্গেই চোখ ওপরে তুলে বলল, ওরে বাবা, এ-দিকটাও ভাঙবে না তো?

বিমান বলল, না, না, সে-ভয় নেই। এ-দিকের অংশটা মজবুত আছে। কয়েক বছর আগে সারানোও হয়েছিল খানিকটা!

দীপা তবু বলল, কেন যে সাধ করে এই ভুতুড়ে বাড়িতে আসা!

ভানু চলে যাওয়ার পর কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, এই বাড়িটা ভেঙে ফেলা হবে, তারপর তোমাদের এ বাড়িতে যারা কাজ করত, তাদের কী হবে? তারা বেকার হয়ে যাবে?

বিমান বলল, ওদের জন্য ব্যবস্থা করেছি। এখন এখানে কাজ করে পাঁচজন। তাদের মধ্যে দুজন খুবই বুড়ো হয়ে গেছে, তাদের কিছু টাকা দিয়ে। রিটায়ার করিয়ে দেব, তারা নিজেদের দেশের বাড়িতে ফিরে যাবে। আর তিনজন এখানে পাইপের কারখানা হবে, তাতে চাকরি পাবে। যিনি এ-জায়গাটা কিনেছেন, তিনি ওদের চাকরি দিতে রাজি হয়েছেন।

অসিত বলল, এ-দিকের বারান্দারও অনেক টালি খসে গেছে। আর কিছুদিনের মধ্যে পুরো বাড়িটা নিজে নিজে ভেঙে পড়ত।

খাওয়ার পর আর বেশিক্ষণ গল্প হল না। যে যার নিজের ঘরে শুতে চলে গেল।

কাকাবাবু পোশাক পালটে পাজামা-পাঞ্জাবি পরলেন। এক্ষুনি তাঁর শুতে ইচ্ছে করছে না। তিনি বাইরের দিকের জানলাটার কাছে দাঁড়ালেন।

বৃষ্টি থেমে গেলেও আকাশ এখনও মেঘলা। বাইরের কিছুই প্রায় দেখা যায়। তবু হাওয়া দিচ্ছে বেশ। যখন একদম একলা থাকেন, তখন কাকাবাবু গুনগুন করে গান করেন। তাঁর এই গানের কথা কেউ জানে না। এ একেবারে তাঁর নিজস্ব অদ্ভুত গান। কোনও বিখ্যাত কবিতার তিনি নিজে সুর লাগিয়ে দেন।

এখন তিনি সুর দিতে লাগলেন সুকুমার রায়ের একটি কবিতায় :

শুনেছ কী বলে গেল
সীতানাথ বন্দ্যো
আকাশের গায়ে নাকি
আকাশের গায়ে নাকি
টক টক গন্ধ…
(আ-হা-হা-হা- না-না-না-না)
টক টক থাকে নাকো
যদি পড়ে বৃষ্টি
তখন দেখেছি চেটে
তখন দেখেছি চেটে
একেবারে মিষ্টি!

এই গানটাই ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে নানারকমভাবে গাইতে লাগলেন। অনেকক্ষণ ধরে। তারপর আর-একটা গানে সুর দিলেন :

আম আছে, জাম আছে
আর আছে কদবেল
সবসে বড়া হ্যায়
জাঁদরেল, জাঁদরেল…

গানটান শেষ করার পর কাকাবাবু বিছানায় চলে এলেন। তবু তাঁর ঘুম এল। নানারকম কথা ভাবতে লাগলেন। একবার সন্তুর কথাও মনে এল। সন্তু কি এখন রাত জেগে পড়াশোনা করছে? ওর পরীক্ষা মাত্র তিনদিনের। এখানে তার বেশিদিন থাকা হলে সন্তু ঠিক চলে আসবে!

ঘন্টা দু-এক কেটে গেল, তবু ঘুম আসার নাম নেই। নতুন জায়গায় এলে তাঁর এরকম হয় প্রথম রাত্তিরটা। ঘুমের জন্য তিনি ব্যস্ত নন। একটা রাত না ঘুমোলেও কোনও ক্ষতি হয় না।

চতুর্দিক একেবারে নিস্তব্ধ। এইসব গ্রাম-দেশে সন্ধের পর এমনিতেই কোনও শব্দ থাকে না। আজ ভাল বৃষ্টি হয়ে বাতাস ঠাণ্ডা হয়ে গেছে, সবাই আরাম করে ঘুমোচ্ছে।

এক সময় ছাদে তিনি অস্পষ্ট শব্দ শুনতে পেলেন। কাকাবাবুর কান খুব তীক্ষ্ণ, সামান্য শব্দও তিনি শুনতে পান। মনে হচ্ছে, ছাদে কেউ হাঁটছে।

কাকাবাবু আর একটুক্ষণ শুনলেন। কোনও সন্দেহ নেই, কোনও মানুষের পায়ের শব্দ। এ বাড়ির দরজা-জানলা এতই ভাঙা যে, চোর-টোরের ঢুকে পড়া খুব স্বভাবিক। কয়েকদিনের মধ্যেই বাড়িটা একেবারে গুঁড়িয়ে দেওয়া হবে, তার আগে এ-গ্রামের চোরেরা এসে যা পাবে তাই নিয়ে যেতে চাইবে। ভাঙা চেয়ার-টেবিল কিংবা পুরনো লোহাও বিক্রি হয়।

এর পর একটা চাপা ঝনঝন শব্দ হতে লাগল। যেন কোনও লোহার শিকল ধরে টানাটানি করা হচ্ছে। একটু পরেই আবার বদলে গেল শব্দটা। খট খট খট। কেউ যেন কিছু ভাঙার চেষ্টা করছে।

কাকাবাবু খাট থেকে নেমে পড়লেন। তিনি কৌতূহল দমন করতে পারছেন। ছাদে নানারকম শব্দ হলে তিনি ঘুমোবেন কী করে?

বালিশের তলা থেকে রিভলভারটা নিয়ে পাঞ্জাবির পকেটে ভরলেন। এক হাতে নিলেন টর্চ। তারপর ক্রাচ দুটো বগলে নিয়ে এগোলেন।

দরজাটা খোলার সময় কাচ করে একটা শব্দ হল। কাকাবাবু একটুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলেন। তারপর বেরোলেন বাইরে। লম্বা-টানা বারান্দাটা পুরো অন্ধকার। কাকাবাবু দেওয়ালের একটা সুইচ টিপে দেখলেন, এখনও লোডশেডিং।

কাকাবাবুর পক্ষে নিঃশব্দে চলার কোনও উপায় নেই। ক্রাচের শব্দ হবেই। এত রাত্তিরে যেন বেশি জোর শব্দ হচ্ছে খটখট করে।

বিমানদের ঘরের দরজা খুলে গেল।

বিমান মুখ বাড়িয়ে বলল, কে? কে?

কাকাবাবু বললেন, আমি।

এ কী, কাকাবাবু! কোথায় যাচ্ছেন?

একটু ভূত দেখে আসি।

অ্যাঁ? কী বললেন?

ছাদে একটা শব্দ হচ্ছে। যদি ভূত-টুত হয়, তা হলে একবার দেখে চক্ষু সার্থক করে আসি।

না, না, কাকাবাবু, এত রাত্তিরে ছাদে যাবেন না।

ঘুম আসছে না। আমার একটু পায়চারি করতে ইচ্ছে হচ্ছে।

দাঁড়ান, তা হলে আমিও যাব আপনার সঙ্গে। চটিটা পরে আসছি।

পাশ থেকে দীপা বলল, আমি একলা এই অন্ধকারের মধ্যে থাকব নাকি? ওরে বাবা রে, না, কিছুতেই না!

বিমান বলল, তা হলে তুমিও চলো।

দীপা বলল, আমি এখন কিছুতেই ছাদে যেতে পারব না। তোমাদেরও যেতে হবে না!

কাকাবাবু বললেন, বিমান, তুমি থাকো। আমি আগে দেখে আসছি। কোনও চিন্তা নেই।

বিমান তবু চেষ্টা করল কাকাবাবুকে থামাবার। কাকাবাবু এগিয়ে গেলেন।

টর্চের আলো ফেলে-ফেলে তিনি দেখছেন। খানিকটা পরে অসিতের ঘর। কাকাবাবু একবার ভাবলেন, অসিত যদি জেগে থাকে, তা হলে তাকেও সঙ্গে নিয়ে যাবেন। দরজাটা ঠেলা দিলেন আলতো করে। সেটা ভেতর থেকে বন্ধ। শব্দ শুনে অসিত জাগেনি, তার গাঢ় ঘুম।

ছাদে ওঠার সিঁড়িটার কাছে এসে কাকাবাবু থমকে দাঁড়ালেন। তাঁর ক্রাচের আওয়াজ আর বিমানের কথাবার্তা শুনে চোরের সজাগ হয়ে যাওয়ার কথা। সে যদি সিঁড়ি দিয়ে নেমে পালাতে চায়, কাকাবাবুর সঙ্গে ধাক্কা লেগে যাবে। সে ইচ্ছে করেও কাকাবাবুকে ঠেলে দিতে পারে।

কাকাবাবু এবার রিভলভারটা বার করে তৈরি রাখলেন। তারপর সিঁড়ি দিয়ে উঠতে লাগলেন আস্তে-আস্তে। সামান্য একটা চোর ধরার জন্য এতটা ঝুঁকি নেওয়ার কোনও মানে হয় না। কিন্তু এই ধরনের উত্তেজনা বোধ করতে কাকাবাবুর ভাল লাগে।

ছাদের দরজাটা একেবারে হাট করে খোলা। যদি দরজার পাশেই কেউ লুকিয়ে থাকে, সেইজন্য কাকাবাবু টর্চ দিয়ে দেখে নিলেন ভাল করে। একটা ক্রাচ বাড়িয়ে দিলেন প্রথমে। কেউ কিছু করল না।

এবার কাকাবাবু ঢুকে পড়লেন ছাদে।

কেউ কোথাও নেই। শব্দটা থেমে গেছে অনেক আগেই। এত বড় ছাদ যে, অন্য দিক দিয়ে পাঁচিল টপকে কারও পক্ষে পালিয়ে যাওয়া খুবই সহজ।

ছাদের ঘর সাধারণত সিঁড়ির পাশেই থাকে। এটা কিন্তু তা নয়। সিঁড়ি থেকে অনেকটা দূরে, মাঝামাঝি জায়গায় বেশ বড় একটা ঘর। এক সময় যত্ন করে তৈরি করা হয়েছিল। চার-পাঁচখানা শ্বেতপাথরের সিঁড়ি, তারপর দরজা। কাকাবাবু সেদিকে এগিয়ে যেতে-যেতে আন্দাজ করলেন যে, এই ঘরটার প্রায় নীচেই দোতলায় তাঁর ঘর।

এ-ঘরের দরজাটা বেশ শক্তপোক্ত রয়েছে এখনও। আগেকার দিনের কায়দা অনুযায়ী সেই দরজার তলার দিকে একটা শিকল, ওপর দিকে একটা শিকল। দুটো শিকলেই তালা দেওয়া। পেতলের বেশ বড় তালা।

কেউ একজন এই শিকল খোলার ও তালা ভাঙার চেষ্টা করেছিল।

কাকাবাবু টর্চ ঘুরিয়ে-ঘুরিয়ে সিঁড়ির নীচটা ভাল করে দেখলেন। বৃষ্টিতে ছাদে জল জমেনি বটে, তবে অনেক দিনের পুরু ধুলো ভিজে দইয়ের মতন হয়ে আছে। তার ওপর পায়ের ছাপ।

কাকাবাবু যদি শার্লক হোমসের মতন গোয়েন্দা হতেন, তা হলে সেই পায়ের ছাপ মাপবার চেষ্টা করতেন বসে পড়ে। কিন্তু ওসব তাঁর ধাতে পোষায় না। তিনি শুধু লক্ষ করলেন, আসা ও যাওয়ার দুরকমের ছাপ। যে এসেছিল, সে এসেছিল পা টিপেটিপে, গোড়ালির ছাপ পড়েনি। আর যাওয়ার সময় গেছে দৌড়ে। একটু দূরে গিয়েই মিলিয়ে গেছে, সেখানটায় শ্যাওলা।

কাকাবাবু মনে-মনে বললেন, বিমানের পাগলাদাদু বেশ ভালই থাকবার জায়গা পেয়েছিল। এই ঘরটাই এ-বাড়ির শ্রেষ্ঠ ঘর বলা যায়। চতুর্দিক খোলা। আজ যদি জ্যোৎস্না থাকত, তা হলে বহুদূর পর্যন্ত দেখা যেত।

কাকাবাবু নীচে নেমে আসার পরই বিমানের গলা শোনা গেল। সে দরজার কাছেই ব্যাকুলভাবে অপেক্ষা করছিল। সে জিজ্ঞেস করল, কী হল কাকাবাবু?

কাকাবাবু হালকা গলায় বললেন, ভূত দেখা আমার ভাগ্যে নেই। তোমার পাগলাদাদুকে দেখা গেল না। ওখানে কেউ নেই।
সকালবেলা চায়ের পাট শেষ করার পর বিমান বলল, চলুন, এবার আপনাদের সারা বাড়িটা ঘুরিয়ে দেখানো যাক। প্রথমে কোনদিকে যাবেন? নীচের তলা থেকে শুরু করব?

অসিত বলল, না, না, আগে ছাদের ঘরটা দেখব। ওই ঘরটা সম্পর্কে এমন গল্প বলেছেন যে, কৌতূহলে ছটপট করছি।

দীপা বলল, সেই ভাল। আগে ছাদটা ঘুরে আসা যাক।

বিমান তার ব্যাগ থেকে একটা চাবির তোড়া বার করল। তাতে অন্তত পঞ্চাশ-ষাটটা চাবি।

অসিত ভুরু তুলে বলল, এত চাবি?

বিমান বলল, আগে তো সব ঘরের জন্যই তালা-চাবি লাগত। এখন অবশ্য অনেক চাবিই কাজে লাগে না।

দীপা বলল, কাল রাত্তিরে চোর এসেছিল। ছাদে তো তালা লাগাতে পারোনি!

বিমান বলল, ছাদের দরজার একটা পাল্লা যে ভাঙা!

অসিত বলল, অ্যা! কাল চোর এসেছিল? কখন?

কাকাবাবু বললেন, তখন রাত প্রায় দুটো।

অসিত বলল, আমি কিছু টের পাইনি তো! একবার ঘুমিয়ে পড়লে আমার আর ঘুম ভাঙে না।

সবাই মিলে চলে এল ছাদে। আগের দিন অনেকক্ষণ বৃষ্টি হলে পরের দিনের সকালটা বেশি ফরসা দেখায়। ঝকঝক করছে রোদ। ফুরফুরে হাওয়া দিচ্ছে।

একদিকের ছাদের কার্নিসে একটা বেশ বড়, খয়েরি রঙের ল্যাজ-ঝোলা পাখি বসে আছে চুপটি করে।

দীপা জিজ্ঞেস করল, ওটা কী পাখি?

কাকাবাবু বললেন, ইষ্টকুটুম।

দীপা বলল, কী সুন্দর পাখিটা! ইষ্টকুটুমের নামই শুনেছি, দেখিনি কখনও। ওর একটা ছবি তুলে রাখব, ক্যামেরাটা নিয়ে আসি। দেখবেন যেন পাখিটা উড়ে না যায়!

কাকাবাবু হেসে বললেন, সে-দায়িত্ব কিন্তু আমরা নিতে পারব না।

দীপা ক্যামেরা আনবার জন্য নীচে ছুটে যেতেই পাখিটা উড়ে চলে গেল!

বিমান বলল, যাঃ—

অসিত পাখির দিকে মনোযোগ দেয়নি। সে এগিয়ে গেল ঘরটার দিকে। কাকাবাবু তার পাশে-পাশে হাঁটতে-হাঁটতে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি যে অ্যান্টিকের ব্যবসা করেন, আপনার কি কলকাতায় কোনও দোকান আছে?

অসিত বলল, না। দোকান-টোকানে বসা আমার পোষায় না। লন্ডনের এক অ্যান্টিক ডিলারের সঙ্গে আমার পার্টনারশিপ আছে। আমি নানা দেশ ঘুরে-ঘুরে খাঁটি জিনিস জোগাড় করি। সে বিক্রি করে। অস্ট্রেলিয়াতেও একটা দোকানের সঙ্গে আমার যোগাযোগ আছে, ওরা খুব কেনে।

বিমান চাবির তোড়া থেকে এই পাগলাদাদুর ঘরের তালার চাবি খুঁজছে।

কাকাবাবু বললেন, এই ঘরটায় এত বড় আর শক্ত পেতলের তালা কেন? অন্য ঘরে তো দেখিনি!

বিমান বলল, কী জানি! অনেকদিন ধরে এখানে এ-তালাই ছিল, তাই রয়ে গেছে। এ-ঘরটায় দামি জিনিস কিছু না থাকলেও একটা খাট আছে, একটা অনেকগুলি ড্রয়ারওয়ালা টেবিল আছে।

কাকাবাবু বললেন, খাট আছে? বাঃ, তা হলে আজ রাত্তিরে আমি এ-ঘরেই থাকব।

বিমান বলল, না, না, তা হয় নাকি? ছাদের ওপর আপনি একা-একা থাকবেন?

কাকাবাবু বললেন, এটাই তো এবাড়ির সবচেয়ে সুন্দর ঘর। আমার এখানেই থাকতে ভাল লাগবে। খাট যখন আছে, একটা তোশক আর বালিশ এনে দিলেই চলবে।

অসিত বলল, থাকার পক্ষে এই ঘরটা কিন্তু সত্যিই আইডিয়াল!

কাকাবাবু মাথা নেড়ে বললেন, আমি কিন্তু আগে বুক করেছি।

অনেকগুলো চাবি লাগিয়ে-লাগিয়ে দেখার পর ঠিক-ঠিক দুটো চাবি খুঁজে পাওয়া গেল। বিমান পেতলের তালা দুটো খুলছে। কাকাবাবু দেখলেন, সিঁড়ির নীচে একটা ইট পড়ে আছে, তালার গায়েও খানিকটা ইটের গুঁড়ো লেগে আছে। কাল যে চোর এসেছিল, সে এই ইট মেরে তালা ভাঙার চেষ্টা করেছিল।

দরজার ওপর আর নীচের শিকল খুলে একটা ধাক্কা মারার পর ভেতর থেকে একটা পচা গন্ধ বেরিয়ে এল।

বিমান একটা ভয়ের শব্দ করে পিছিয়ে গেল কয়েক পা।

কাকাবাবু হো-হো করে হেসে উঠে বললেন, তোমার পাগলাদাদু এই ঘরে মরে পচে ছিলেন, তুমি কি ভাবছ, সেই গন্ধ এখনও আছে? তারপর তো এই ঘরে অনেকে ঢুকেছিল, তুমিই বলেছ!

অসিতের মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে গেছে।

বিমান লজ্জা পেয়ে বলল, আমি নিজেই তো চার-পাঁচবার ঢুকেছি।

কাকাবাবু বললেন, নিশ্চয়ই কোনও ইঁদুর-টিঁদুর মরে আছে।

অসিত বলল, জানলাগুলো সব বন্ধ। খুলে দিলে হাওয়া আসবে। এই সময় ছাদের দরজার কাছে ভানু নামের কাজের লোকটি এসে ডাকল, দাদাবাবু?

বিমান মুখ ফিরিয়ে দেখল, ভানুর সঙ্গে আর-একজন লোক এসেছে। ধুতি পাঞ্জাবি পরা, মাথার চুল ছোট করে ছাঁটা, কাঁধে ঝোলানো একটি ব্যাগ।

কাকাবাবু ঘরটার মধ্যে ঢুকতে যাচ্ছিলেন, বিমান তাঁকে ডেকে বলল, কাকাবাবু, আপনাকে একটা কথা বলতে ভুলে গিয়েছিলুম। এর নাম ব্ৰজেন হালদার। আমার ছোটবেলার বন্ধু। এই গ্রামের স্কুলে ইংরেজি পড়ায়। আপনি আসবেন শুনে ও খুব ধরেছিল আপনার সঙ্গে একটু আলাপ করিয়ে দেওয়ার জন্য। আপনার খুব ভক্ত।

কাকাবাবু সিঁড়ি থেকে নেমে এলেন।

ইংরেজি মাস্টারটি ছুটে এসে কাকাবাবুর পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করল। তারপর গদগদ স্বরে বলল, আপনিই কাকাবাবু! সন্তু কোথায়?

কাকাবাবু বিব্রতভাবে পাসরিয়ে নিয়ে বললেন, সন্তু আসেনি।

ব্ৰজেন বলল, সন্তুকে ছাড়া..আপনি কোথাও যান নাকি? আমার ধারণা ছিল, সন্তু সব সময় আপনার সঙ্গে থাকে।

বিমান বলল, সন্তুর এখন পরীক্ষা চলছে, সে আসতে পারেনি।

ব্ৰজেন চোখ বড় করে বলল, সন্তু পরীক্ষাও দেয়? অন্য ছেলেদের মতন?

বিমান বলল, কেন, সন্তু পরীক্ষা দেবে না কেন?

ব্ৰজেন বলল, আমার ধারণা ছিল, সন্তু একটা গল্পের চরিত্র, তাকে পরীক্ষা-টরিক্ষা দিতে হয় না। সে সব সময় অ্যাডভেঞ্চার করে বেড়ায়।

কাকাবাবু ও বিমান দুজনেই হেসে উঠলেন।

বিমান বলল, সন্তু গল্পের চরিত্র হবে কেন? সন্তু আমাদের পাড়ায় থাকে, বাচ্চা বয়েস থেকে তাকে চিনি।

ব্ৰজেন কাকাবাবুর দিকে তাকিয়ে বলল, আমার এতদিন ধারণা ছিল, কাকাবাবু বলে সত্যিকারের কেউ নেই। লেখকদের বানানো ব্যাপার। বিমান যখন প্রথম বলল, আপনি এখানে আসবেন, আমি বিশ্বাসই করিনি।

বিমান বলল, ছুঁয়ে দেখবি নাকি সত্যি কি না!

ব্ৰজেন বলল, ইস, আমার ছেলেটাকে আনলাম না। আমার ছেলে একেবারে পাগলের মতন আপনার ভক্ত। ও আপনার অটোগ্রাফ নিলে কত খুশি হত! একটা কথা বলব, সার? একবার দয়া করে আমাদের বাড়িতে যাবেন? সামান্য, পাঁচ মিনিটের জন্য?

বিমান বলল, ঠিক আছে, বিকেলের দিকে আমরা একবার বেড়াতে বেরোব। তখন তোমার বাড়িটাও ঘুরে আসব। তোমার বাড়িতে একবার আচারের তেল দিয়ে মাখা মুড়ি খেয়েছিলাম, মনে আছে, দারুণ লেগেছিল। সেইরকম মুড়ি খাওয়াবে?

নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই! মুড়ির মতন সামান্য জিনিস, তা কি উনি খাবেন?

হ্যাঁ, খাবেন। কাকাবাবু মুড়ি ভালবাসেন। আর কোনও খাবার-টাবার রাখার দরকার নেই কিন্তু।

কাকাবাবুর মুখের দিকে তাকাল ব্ৰজেন। কাকাবাবু বললেন, হ্যাঁ, যাব।

ব্ৰজেন বলল, আমার বাড়ি খুব কাছে। এখান থেকে দেখা যায়। আসুন, দেখবেন।

বিমান বলল, ঠিক আছে। বিকেলবেলা তো যাচ্ছিই! ৩০৬

ব্ৰজেন তবু বলল, কাকাবাবুকে আমার বাড়িটা দেখিয়ে রাখি।

প্রায় জোর করেই ব্ৰজেন ওদের নিয়ে গেল পাঁচিলের দিকে। পেছন দিকে পদ্মফুলে ভরা দিঘিটার ডান পাশে অনেক গাছপালা, প্রায় জঙ্গলের মতন। সেইদিকে আঙুল দেখিয়ে ব্ৰজেন বলল, ওই যে দেখুন, শিমুলগাছটার ফাঁক দিয়ে..

বাড়িটা প্রায় দেখাই যাচ্ছে না, তবু কাকাবাবু ও বিমান একসঙ্গে বলল, হ্যাঁ, দেখেছি।

ব্ৰজেন বলল, আমাদের ওখান থেকে এই বাড়িটাকে মনে হয় একটা পাহাড়ের মতন। দিগন্ত ঢেকে থাকে। এই বাড়িটার জন্যই আমাদের গ্রামের অনেক নাম। কত দূরদূর থেকে লোকে এই বাড়িটা দেখতে আসে। এত বিখ্যাত বাড়ি ভেঙে ফেলা হবে, ছি ছি, কী লজ্জার কথা বলুন তো! আমার যদি সেরকম টাকা থাকত, আমি এ বাড়িটা কিনে নিতাম।

কাকাবাবু বললেন, এটা সত্যিই খুব দুঃখের কথা। তবে বাড়িটা তো ভেঙেই পড়ছে ক্রমশ।

ব্ৰজেন বলল, ঐতিহাসিক বাড়ি! এখানে আলিবর্দি আর সিরাজদ্দৌল্লা এসে থেকে গেছেন!

বিমান বলল, এসব আবার তুমি কোথা থেকে পেলে?

ব্ৰজেন বলল, নবাব আলিবর্দির আমলের বাড়ি নয় এটা? বর্গির হাঙ্গামার সময় নবাব আলিবর্দি তাঁর নাতিকে নিয়ে একসময় পালিয়ে এসেছিলেন এদিকে। এ বাড়িতে রাত কাটিয়েছেন।

বিমান হেসে বলল, এসব গালগল্প। কোনও প্রমাণ নেই।

ব্ৰজেন জোর দিয়ে বলল, রামমোহন রায় থেকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পর্যন্ত অনেকেই যে এসেছিলেন, তা নিশ্চয়ই জানো!

বিমান বলল, তা যাই বলল। এ বাড়ি মেরামত করার সাধ্য আমার নেই।

ব্ৰজেন বেশি কথা বলতে ভালবাসে। সে বাড়িটা সম্পর্কে অনেক কথা বলে যেতে লাগল। কাকাবাবু খানিকটা অস্থির বোধ করলেন।

দীপা ফিরে এসে বলল, এই ক্যামেরাটা কোথায় রেখেছ? খুঁজেই পেলাম না।

বিমান বলল, তোমার পাখি করে উড়ে গেছে। আর ক্যামেরা দিয়ে কী হবে?

দীপা বলল, তবু বলল না ক্যামেরাটা কোথায়? আমি ছাদে তোমাদের ছবি তুলব।

এই সময় ঘরটার মধ্যে ঘটাং করে একটা জোর শব্দ হল।

বিমান বলল, এই যে, ওখানে মেঝের অনেক পাথর আলগা আছে। দীপা, দ্যাখো তো, অসিতবাবুকে একটু বলে দাও।

দীপা ঢুকে গেল সেই ঘরের মধ্যে। ব্ৰ

জেন প্রসঙ্গ পালটে বলল, আচ্ছা কাকাবাবু, আপনার উল্কা রহস্য-এর প্রথম দিনে আপনি যে জাটিঙ্গা পাখিদের কথা বলেছিলেন, পরে সেই পাখিদের রহস্য সম্পর্কে তো আর কিছু জানা গেল না। পাখিগুলো আগুন দেখলে ইচ্ছে করে ঝাঁপ দেয় কেন?

কাকাবাবু বললেন, জাটিঙ্গা পাখিদের রহস্যের কোনও মীমাংসা এখনও হয়নি।

বিমান বলল, আচ্ছা ব্ৰজেন, বিকেলে তো তোমাদের বাড়িতে যাচ্ছিই। তখন এসব কথা আলোচনা হবে। এখন আমাদের কিছু কাজ আছে।

ব্ৰজেন বলল, ছি, ছি, হঠাৎ এসে তোমাদের ডিস্টার্ব করলাম। এই ছাদটা আমার খুব ভাল লাগে। রঘুদাকে বলে মাঝে-মাঝে আমি এখানে এসে বসে থাকি। আচ্ছা, আসি তা হলে এখন। বিকেলে কিন্তু ঠিক আসতে হবে।

ব্ৰজেন সিঁড়ি দিয়ে নেমে যাওয়ার পর বিমান বলল, আমি ছোটবেলায় যখন মামার বাড়ি আসতাম তখন ওর সঙ্গে ভাব হয়েছিল। আমরা একই বয়েসী।

কাকাবাবু বললেন, চলো, এবার তোমার পাগলাদাদুর ঘরটা দেখা যাক।

ঘরটা খুব ছোট নয়। এক সময় বেশ যত্ন করেই তৈরি করা হয়েছিল। মেঝেতে শ্বেতপাথরের টালি বসানো। সেগুলো মাঝে-মাঝে ভেঙে গিয়ে গর্ত হয়ে গেছে এখন। একপাশে একটা বড় খাট পাতা। কয়েকটা ঘুণ-ধরা কাঠের বাক্স। সারা ঘরে ছড়ানো ছেঁড়া পুঁতির মালা, ঝিনুক, ছোট-ছোট শাঁখ, প্রচুর ছেঁড়াখোঁড়া বই, পুরনো খবরের কাগজ, কয়েকটা ম্যাপ।

অসিত ঘরের একটা জানলা খুলে দিয়েছে, তাতেই প্রচুর রোদ এসেছে। পচা গন্ধটা নেই।

বিমান জিজ্ঞেস করল, ইঁদুরটা দেখতে পেলেন? দীপা ভয়ে লাফিয়ে উঠে বলল, ইঁদুর! ইঁদুর কোথায়?

অসিত হেসে বলল, না, না, ইঁদুর টিদুর দেখতে পাইনি। ওটা আসলে বন্ধ ঘরের ভ্যাপসা গন্ধ!

দীপা বিরক্তভাবে বলল, এই রাজ্যের ঝিনুক মিনুকগুলো ঘরের মধ্যে জমিয়ে রেখেছ কেন তোমরা এতদিন? ঝেটিয়ে বার করে দেওয়া উচিত ছিল।

বিমান বলল, যদি এর মধ্যে কোনওটা দামি হয়, সেইজন্য কেউ ফেলেনি।

অসিত একটা ঝিনুক তুলে নিয়ে জোর করে টিপে ভেঙে ফেলল। তারপর হাসতে হাসতে বলল, এগুলো অতি সাধারণ। কোনও দাম নেই।

কাকাবাবু একটা ছেঁড়া বই তুলে নিয়ে দেখলেন, সেটা একটা শেক্সপীয়রের নাটক। সামনের দিকের অনেক পাতা নেই।

বিমান বলল, আপনার কী মনে হয়, অসিতবাবু, এ ঘরে কোনও দামি জিনিস থাকতে পারে? বহুবার সার্চ করে দেখা হয়েছে। আমার বড়মামা মেঝে খুঁড়ে-খুঁড়েও দেখেছেন। কেউ কিছু পায়নি।

অসিত বলল, দামি জিনিস কিছু থাকলেও অন্য কেউ আগেই নিয়ে নিয়েছে। এখন যা পড়ে আছে, সবই রদ্দি জিনিস। আবর্জনা। মোটামুটি সবই তো দেখলাম।

দীপা বলল, মার্বেলের টালিগুলোর কিছু দাম হতে পারত, তাও তো সবই প্রায় ভাঙা।

বিমান বলল, কাকাবাবু, আপনি এই ঘরে থাকবেন বলছিলেন? দেখলেন তো কিরকম নোংরা?

কাকাবাবু বললেন, তাতে আমার কোনও অসুবিধে হবে না। একটু ঝাঁট-টটি দিয়ে নিলেই চলবে। চতুর্দিকে জানলা। সবকটা খুলে দিলে…

অসিত হঠাৎ চেঁচিয়ে বলে উঠল, ওই বন্ধ জানলাটার কাছে ওটা কী দেখুন তো? চকচক করছে?

সবাই ফিরে তাকাল। সত্যি, যে-জানলাটা খোলা, তার ঠিক উলটো দিকের জানলাটার পাশে কী যেন চকচক করছে হিরের মতন।

অসিত সেদিকে এগোবার আগেই কাকাবাবু বললেন, আমি দেখছি।

ক্রাচ বগলে নিয়ে দু পা এগোলেন কাকাবাবু। তৃতীয়বার একটা ক্রাচ একটা পাথরের ওপর ফেলতেই সেটা নড়বড় করতে করতে সম্পূর্ণ উলটে গেল। তার নীচে একটা বড় গর্ত। কাচটা পিছলে ঢুকে গেল সেই গর্তের মধ্যে। কাকাবাবু তাল সামলাতে পারলেন না। তিনি পড়ে গেলেন, দেওয়ালে খুব জোর ঠুকে গেল তাঁর মাথা। গলগল করে রক্ত বেরোতে লাগল। গর্তের মধ্যে ঢুকে গেছে তাঁর একটা পা। কিন্তু কাকাবাবু উঠতে পারলেন না, তার আগেই জ্ঞান হারিয়ে ফেললেন।

জানলা দিয়ে এসে পড়েছে সকালের আলো। কাছেই ডেকে চলেছে একটা চিল। অনেক দূরে কারা যেন কথা বলছে। খুব মিষ্টি এক ঝলক বাতাসের স্পর্শে কাকাবাবু চোখ মেলে তাকালেন।

প্রথমে তিনি বুঝতেই পারলেন না, এটা কোন দিন। তিনি কতক্ষণ শুয়ে আছেন। মাথাটা ভারী মনে হতেই হাত দিয়ে দেখলেন অনেকখানি ব্যাণ্ডেজ বাঁধা। তারপর তিনি টের পেলেন তাঁর যে-টা ভাল পা, সেই পা-টাতেও খুব ব্যথা।

ওই পায়ের ব্যথাটার জন্যই কাকাবাবুভয় পেয়ে গেলেন। যাঃ, এই পা-টাও ভাঙল নাকি? তা হলে সারাজীবনের মতন একেবারে পঙ্গু হয়ে থাকতে হবে?

তিনি ডাকলেন, বিমান, বিমান। ঘরে ঢুকল দীপা।

খাটের কাছে এসে বলল, আপনার ঘুম ভাঙাইনি। চা দেব? এখন কেমন লাগছে? খুব ব্যথা আছে?

কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, আমার কী হয়েছিল বলো তো?

দীপা চোখ বড় বড় করে বলল, উঃ কী কাণ্ড! যা ভয় পেয়েছিলাম। ছাদের ঘরটায় আপনি পা পিছলে পড়ে গেলেন। পাথরের টালিগুলো সব আলগা হয়ে আছে। একটাতে তো আমিও পড়ে যাচ্ছিলাম আর একটু হলে! কাকাবাবু মনে করার চেষ্টা করে বললেন, হ্যাঁ, আছাড় খেয়েছিলাম। একটা পাথর উলটে গেল!

দীপা বলল, আপনার মাথা ফেটে রক্তারক্তি। তখনও বুঝতে পারিনি যে পায়ে কিছু হয়েছে। কিন্তু আপনার একটু জ্ঞান ফিরতেই আপনি পা-টা চেপে ধরে আঃ আঃ করতে লাগলেন। মনে হল যেন পায়েই বেশি যন্ত্রণা হচ্ছে..

কাকাবাবু উত্তেজিতভাবে বললেন, কী হয়েছে আমার পায়ে? কম্পাউণ্ড ফ্র্যাকচার?

দীপা বলল, ভাগ্যিস সেরকম কিছু হয়নি। বিমান ঘাবড়ে গিয়ে পানাগড় চলে গেল। এ-গ্রামে ভাল ডাক্তার নেই। একজন বড় ডাক্তার নিয়ে এল পানাগড় থেকে। তিনি আবার অথোপেডিক সার্জেন। খুব ভাল করে দেখে বললেন, পায়ে কিছু হয়নি, শুধু বুড়ো আঙুলের নখ আধখানা উড়ে গেছে। সেইজন্যই অত ব্যথা। তবে, আপনার মাথায় তিনটে স্টিচ করতে হয়েছে, রক্ত বেরিয়েছে অনেকটা।

কাকাবাবু এবার যেন খানিকটা আশ্বস্ত হয়ে বললেন, মাথায় তিনটে সেলাই এমন কিছু নয়। পায়ে তা হলে বড়রকমের কোনও ক্ষতি হয়নি।

বাঃ, অর্ধেকটা নখ উড়ে গেছে, তাও কম নাকি?

নখ উড়ে গেলে আবার নখ হবে। এটা কবে হয়েছে? আজ, না কাল, না পরশু?

কাল সকালে।

তা হলে তারপর কাল সারা দিন আমি কী করলাম?

বাঃ, এতবড় একটা অ্যাকসিডেন্ট হল, তারপরও কি আপনি ঘুরে বেড়াবেন নাকি? আপনার খুব যন্ত্রণা হচ্ছিল বলে ডাক্তার আপনাকে ঘুমের ইঞ্জেকশান দিয়েছিলেন। তার মধ্যেও আপনি জেগে উঠেছিলেন মাঝে-মাঝে।

সেসব কিছু মনে পড়ছে না। এমন বিচ্ছিরিভাবে আছাড় খেয়ে তোমাদের খুব বিপদে ফেললাম।

আমাদের আবার কী বিপদ?

বিপদ মানে দুশ্চিন্তা।

হ্যাঁ, দুশ্চিন্তা তো হয়েছিল খুবই। কিন্তু ডাক্তারটি খুব ভাল। উনি অনেকক্ষণ ছিলেন। আপনার নাম জানেন আগে থেকে। উনি বলে গেছেন যে ভয়ের কিছু নেই। উনি আজ আবার আসবেন।

বিমান কোথায়?

বাড়ি ভাঙার লোকজন সব আসতে শুরু করেছে। এ বাড়ির নতুন মালিকও এসেছে, বিমান তার সঙ্গে কথা বলছে। লোকটা বলে কী জানেন? বলল, আপনারা এ-পাশটায় থাকুন, আমরা অন্য-পাশটা ভাঙতে শুরু করে দিই। আমি বলে দিয়েছি, তা চলবে না। আমরা চলে গেলে তারপর ওসব

শুরু হোক গে। আমি আওয়াজ সহ্য করতে পারব না।

এতক্ষণে কাকাবাবুর মুখে সামান্য একটু হাসি ফুটল।

তিনি বললেন, বাড়ির একদিকে আমরা থাকব, আর-একটা দিক ভাঙা শুরু হয়ে যাবে, এটা সত্যিই অদ্ভুত। আর বুঝি দেরি করতে পারছে না?

এই সময় বিমান ঘরে ঢুকে বলল, কাকাবাবু! অল রাইট? ওফ! আমার এবাড়িতে আপনার যদি বড় রকম কোনও ক্ষতি হত, তা হলে সারাজীবন আমার দুঃখের শেষ থাকত না।

দীপা বলল, বলেছিলাম না এটা একটা অপয়া বাড়ি। আর ওপরের ওই ঘরটা, ওটা একটা ভুতুড়ে ঘর। ঢুকলেই গা ছমছম করে। ওই ঘরটাই আগে ভেঙে ফেলা উচিত।

কাকাবাবু বললেন, অ্যাকসিডেন্ট ইজ অ্যাকসিডেন্ট। তা যে কোনও জায়গায় হতে পারে।

চা এল। কাকাবাবু চায়ে চুমুক দিতে লাগলেন।

বিমান বলল, অসিত আপনার কাছে দুঃখপ্রকাশ করেছে। আপনার সঙ্গে দেখা করে যেতে পারল না।

কাকাবাবু চমকে উঠে বললেন, অসিত চলে গেছে?

বিমান বলল, হ্যাঁ, আজ ভোরবেলাই চলে গেল। আমাদের গাড়ি পানাগড়ে গিয়ে ওকে ট্রেন ধরিয়ে দেবে। সেই গাড়িতেই ডাক্তারবাবুকে নিয়ে আসবে।

কেন, এত তাড়াতাড়ি চলে গেল কেন?

ও বলল, আর থেকে তো কোনও লাভ নেই। এ-বাড়ির সব কিছুই ওর দেখা হয়ে গেছে। কলকাতায় কাজও আছে কী একটা।

ওর পছন্দমতন জিনিসপত্র কিছু পেল? ভাল কোনও অ্যান্টিক?

ও বলল, দামি জিনিস কিছু নেই। বড়মামা সবই বেচে দিয়েছে। শুধু কয়েকটা ঘড়ি, বুঝলেন কাকাবাবু, একতলায় গুদামঘরগুলোয় কয়েকটা ভাঙা দেওয়াল ঘড়ি পড়ে ছিল, একেবারেই অকেজো, ভেতরের কলকজা নেই। সেইগুলো দেখে অসিত বলল, পুরনো ঘড়ির কিছু দাম আছে বিদেশে। আমি তো ওগুলো একেবারে ফেলেই দেব ঠিক করেছিলাম। আর একটা ক্যামেরা। আগেকার দিনের এক্সকম প্লেট ক্যামেরা ছিল, তেপায়া স্ট্যাণ্ডের ওপর দাঁড় করিয়ে, মাথায় কালো কাপড় মুড়ি দিয়ে ছবি তোলা হত, সেই ছিল একটা। তা-ও ভাঙা, বহুকাল ব্যবহার করা হয়নি। এই ক্যামেরাও তো ফিল্ম দিয়ে ছবি ভোলা যায় না, কাচের প্লেট লাগত, সেপ্লেটও পাওয়া যায় না। ওটাও ফেলে দেওয়ারই জিনিস ছিল। কিন্তু অসিত বলল, ওটার জন্য এক হাজার টাকা দাম দেবে। আমি অবাক! আর একটা ড্রেসিং টেবিলের হাতল। টেবিলটা নেই, শুধু কাচের হাতলটা পড়ে ছিল, সেটাও ওর পছন্দ। সব মিলিয়ে তিন হাজার টাকা দাম ধরেছে। যা পাওয়া যায় তাই লাভ!

ইস, জিনিসগুলো আমার দেখা হল না। সব নিয়ে গেছে?

হ্যাঁ। এক জায়গায় প্যাক করে দেওয়া হয়েছে। তবে আপনাকে বলছি কাকাবাবু, একদমই রদ্দি জিনিস। আমাদের দেশে কেউ এক পয়সাও দাম দিত না। হয়তো বাতিকগ্রস্ত সাহেবরা কিনতে পারে। শুনেছি অস্ট্রেলিয়ানরা এইসব জিনিস বাড়িতে ছড়িয়ে রাখে, যাতে লোকে ভাবে ওদের বংশ অনেক পুরনো।

ওপরের ঘরে কিছু পায়নি অসিত?

নাঃ! সারা দুপুর ধরে প্রতিটি জিনিস তন্নতন্ন করে দেখেছে। প্রতিটি ঝিনুক, পুঁতি, কাচের টুকরো। ওর কাছে ম্যাগনিফাইং গ্লাস ছিল, আর একটা কী যেন চোখে লাগাবার যন্ত্র, সব কিছু দিয়ে পরীক্ষা করে দেখল। সব বাজে জিনিস। শুধু বলল, খাটের চারটে পায়ার কিছু দাম আছে। অনেকরকম লতাপাতার কাজ রয়েছে, ওরকম এখন পাওয়া যায় না। তবে, অসিত কাঠের জিনিস কেনে না। ও বলল, কলকাতায় অ্যান্টিক ডিলাররা এই চারটে পায়ার জন্য অন্তত দু হাজার টাকা দিতে পারে।

দীপা বলল, যাই বলল প্লেট ক্যামেরার দাম আরও বেশি হওয়া উচিত ছিল। আমি শুনেছি, পুরনো ক্যামেরার অনেক দাম হয়।

বিমান বলল, আরে, ওই ক্যামেরাটা যে ছিল, তাই তো জানতুম না। একতলার একটা ভাঙা ঘরে অনেক আবর্জনার মধ্যে পড়ে ছিল। অসিতই তো খুঁজে বার করল। অসিত না দেখতে পেলে আমি ওটাকে ক্যামেরা বলে চিনতেই পারতুম না। আর সব বাজে জিনিসের সঙ্গে চলে যেত!

কাকাবাবু বললেন, অসিতের বাড়ি গেলে ওই ঘড়ি আর ক্যামেরা দেখতে দেবে নিশ্চয়ই?

বিমান বলল, তা দেবে না কেন? ও বলে গেল, আগামী পনেরো তারিখে ওর টিকিট কাটা আছে। লন্ডনে যাবে। তার আগে পর্যন্ত কলকাতাতেই ৩১২

থাকবে।

কাকাবাবুর গায়ের ওপর একটা পাতলা চাদর দেওয়া ছিল। সেটা সরিয়ে ফেলে খাট থেকে নামবার জন্য পা বাড়ালেন।

দীপা অমনই ব্যস্ত হয়ে বলে উঠলেন, ও কী করছেন? ও কী করছেন? নামবেন না!

কাকাবাবু অবাক হয়ে বললেন, কেন, নামব না কেন?

দীপা বলল, এই অবস্থায় আপনি হাঁটাচলা করবেন নাকি? না, না, শুয়ে থাকুন।

কাকাবাবু বললেন, সামান্য একটু মাথা ফেটে গেছে আর পায়ের আধখানা নখ ভেঙে গেছে বলে আমি শুয়ে থাকব? এ তো ভারী আশ্চর্য কথা!

বিমান বলল, কাকাবাবুকে তুমি আটকাতে পারবে না। এর চেয়ে অনেক খারাপ অবস্থায় কাকাবাবু পাহাড়ে পর্যন্ত উঠেছেন।

কাকাবাবু বললেন, আধ ঘন্টার মধ্যে আমি তৈরি হয়ে নিচ্ছি। তারপর ছাদের ঘরে যাব। সে ঘরটা তো আমার দেখাই হয়নি।

ঠিক আধ ঘন্টা পরে কাকাবাবু পোশাক বদলে বেরিয়ে এলেন ঘর থেকে। বগলে ক্রাচ কিন্তু খালি পা।

বিমানকে দেখে বললেন, ব্যথার জন্য পায়ে জুতো পরতে পারলাম না। আমার রবারের চটিটাতেও সুবিধে হচ্ছে না। তোমাদের একজোড়া চটি দিতে পারো?

বিমানের চটি পায়ে গলিয়ে কাকাবাবু উঠে এলেন ছাদে। বিমান তাড়াতাড়ি তালা খুলে দিল। ঘরের একটা জানলা খোলাই ছিল, রাত্তিরে সেখান থেকে বৃষ্টির ছাঁট এসেছে, মেঝেতে একটু একটু জল জমে আছে।

কাকাবাবু প্রথমেই ভাঙা পাথরটার দিকে তাকালেন।

পাথরটা আর ঠিকমতন লাগানো হয়নি, সেখানে একটা গর্ত। এই ঘরের মেঝেতে কোনও দামি জিনিস পোঁতা আছে কি না তা জানার জন্য গর্ত খুঁড়েও দেখা হয়েছিল। গর্তটার ওপরে পাথরখানা ঠিক মাপমতন বসেনি।

বিমান বলল,সাবধান, কাকাবাবু, আরও অনেক পাথর আলগা আছে!

কাকাবাবু বললেন, এরকম বাজে অ্যাকসিডেন্ট আমার কখনও হয়নি।

তারপর তিনি ঘরের মাঝখানে এসে দাঁড়ালেন।

দীপা জিজ্ঞেস করল, এত যে সব বইটই রয়েছে, এগুলোর কোনও দাম নেই?

বিমান বলল, এসব ছেঁড়াখোড়া বই কে কিনবে? কিলো দরে পুরনো কাগজওয়ালার কাছে বিক্রি করতে পারো, কিন্তু কলকাতা পর্যন্ত বয়ে নিয়ে যাবে?

দীপা একটা বই তুলে নিয়ে বলল, এই বইটা তো তেমন ঘেঁড়েনি। মলাট ঠিক আছে।

বিমান বলল, ওখানা তো বাইবেল! বিনা পয়সায় পাওয়া যায়। বড় বড় হোটেলের প্রত্যেক ঘরে একখানা করে বাইবেল থাকে, খুব সুন্দর ছাপা আর বাঁধাই, যে-খুশি নিয়ে যেতে পারে।

কাকাবাবু ক্রাচ দুটো পাশে রেখে মেঝেতে বসে পড়লেন। চারদিকে ঝিনুক আর পুঁতির মালা ছড়ানো। আগে তিনি দেখতে লাগলেন বইগুলো। অনেকগুলোই বাইবেল। ইংরিজিতে আর পর্তুগিজ ভাষায়। কিছু ধর্মের বই। কিছু পত্রপত্রিকা। বেশ কয়েকটি নাটক। অনেক বইয়ের পাতা ছেঁড়া। এসব বইয়ের সত্যিই কোনও দাম নেই। কিছু হাতের লেখা কাগজও রয়েছে। সেগুলো কিছুই প্রায় পড়া যায় না। বিমানের খ্রিস্টান দাদুও বোধ হয় পাগল অবস্থায় এসব লিখেছিলেন।

দীপা পুঁতির মালা কয়েকটা হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করতে শুরু করেছে। বিমান বলল, আর কতবার দেখবে? অনেকবার তো দেখেছ? ওগুলো খুবই সাধারণ। কোনও দাম নেই।

কাকাবাবু কয়েকটা ঝিনুক তুলে নিয়ে দেখলেন। খাটের নীচে, ঘরের কোণে কোণে রাশিরাশি ঝিনুক।

দীপা বলল, পাগলাদাদু ঝিনুক কুড়িয়ে কুড়িয়ে মুক্তো খুঁজতেন বোধ হয়। দু-একটা মুক্তোটুক্তো আমাদের জন্য রেখে যেতে পারলেন না?

কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, এই ঘর থেকে কোনও দামি জিনিস আগে পাওয়া গেছে কি?

বিমান বলল, আমি যতদূর জানি, কিছুই পাওয়া যায়নি।

কাকাবাবু একটা কালো রঙের চৌকো ছোট বাক্স দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ওটার মধ্যে কী ছিল?

দীপা ঠোঁট উলটে বলল, ওটাও তো আমি খালিই দেখেছি। ভেতরে একটা মোহর-টোহরও নেই। একটা প্লাস্টার অব প্যারিসের যিশু মূর্তি ছিল, তাও ভাঙা।

কাকাবাবু বাক্সটা খুলে দেখলেন, খুবই পুরনো বাক্স, ভেতরটায় একসময় লাল ভেলভেটের লাইনিং ছিল, এখন তা কুচিকুচি হয়ে গেছে।

দীপা বলল, দেখলে মনে হয় গয়নার বাক্স।

কাকাবাবু বললেন, ওরকম এক বাক্সভর্তি গয়না থাকলে তা তো আগে থেকে হাওয়া হয়ে যাবেই। তা ছাড়া গির্জার পাদ্রির সঙ্গে উনি থাকতেন, গয়না পাবেন কোথায়?

হঠাৎ মুখ ফিরিয়ে কাকাবাবু বললেন, আচ্ছা, জানলার কাছে একটা খুব চকচকে জিনিস দেখে এগোতে গিয়ে আমি যে আছাড় খেয়ে পড়লাম, সেটা কী ছিল?

বিমান বলল, সেটাও কিছুই না। একটা প্রিজমের টুকরো। রোদ পড়ে সেটা ঝকঝক করছিল।

দীপা বলল, ওই যে কতকগুলো লম্বা-লম্বা ম্যাপ রয়েছে, ওগুলোর কোনওটার মধ্যে কোনও গুপ্তধনের সঙ্কেত নেই তো? উনি বলতেন কেন যে ওঁর কাছে সাত রাজার ধন এক মানিক আছে?

বিমান বলল, ওসব পাগলের প্রলাপ। যার কাছে সত্যিকারের দামি জিনিস থাকে, সে কি চেঁচিয়ে-চেঁচিয়ে বলে? ম্যাপগুলো হাতে আঁকা নয়, সাধারণ ছাপা ম্যাপ। এ-ম্যাপ সব জায়গায় পাওয়া যায়।

একটা লম্বা করে গোটানো ম্যাপ সে তুলে দিল কাকাবাবুর হাতে। কাকাবাবু দেখলেন, সেটা গোয়া, দমন আর দিউ এই তিন জায়গার ম্যাপ। ওইগুলি ছিল পর্তুগিজ কলোনি। দুটো একই রকম ম্যাপ পশ্চিম ইউরোপের। কোনও ম্যাপেই কিছু আলাদা দাগটাগ নেই।

কাকাবাবু বললেন, এর মধ্যে গুপ্তধনের সঙ্কেত থাকলেও তা বোঝার সাধ্য নেই আমাদের।

বিমান বলল, ছোটবেলায় আমার পাগলাদাদুর গলায় ঝোলানো একটা সোনার ক্রস দেখতাম। সেটাই বোধ হয় ওঁর একমাত্র দামি জিনিস ছিল। সেটা উনি গলা থেকে কক্ষনো খুলতেন না। মাঝে-মাঝে তিনি সেটায় চুমু খেতেন।

দীপা বলল, সেটা কে নিল?

বিমান বলল, কে জানে কে নিয়েছে! ওঁর মৃত্যুর সময় তো আমি এখানে ছিলাম না!

কাকাবাবু বললেন, বসো, এ-ঘরের সব কিছু দেখা হয়ে গেছে। এবার নীচে যাওয়া যাক! একটা মজার ব্যাপার কী জানো, পরশুদিন রাত্তিরবেলা আমি এই ছাদে একা-একা ঘুরে গেলাম, তখন ভূতের দেখা পেলাম না। অথচ দিনের বেলা এই ঘরের মধ্যে আমাকে ভূতে ঠেলা মারল?

দীপা চমকে উঠে বলল, আপনাকে ভূতে ঠেলা মেরেছে!

কাকাবাবু একগাল হেসে বললেন, তবে কি আমি এমনি-এমনি পড়ে গেলাম?

দীপা বলল, না, না, আমি তো আপনার পাশেই ছিলাম। কেউ আপনাকে ঠেলা মারেনি।

নীচে নেমে আসার পর খবর পাওয়া গেল যে পানাগড় থেকে ডাক্তারবাবু এসেছেন।

ডাক্তারের নাম শিবেন সেনশর্মা, বয়েস বেশ কম, সুন্দর চেহারা। কাকাবাবুকে দেখে বলল, এ কী, আপনি হাঁটাচলা শুরু করেছেন? পায়ের আঙুলে ব্যথা নেই?

কাকাবাবু বললেন, হ্যাঁ। ব্যথা আছে। তবে শুয়ে থাকলে ব্যথার কথাটা বেশি মনে পড়ে।

ডাক্তার কাকাবাবুর মাথার ব্যাণ্ডেজ খুলে ক্ষতটা পরীক্ষা করল, আবার বেঁধে দিল নতুন ব্যাণ্ডেজ। তারপর পা দেখে একটু চিন্তিতভাবে বলল, আঙুলটা একটু ফুলেছে কেন? আর একটা ইঞ্জেকশান দিতে হবে। আপনার কিন্তু এইরকম পা নিয়ে এখন হাঁটাচলা করা উচিত নয়। একটু বিশ্রাম নেওয়া দরকার।

দীপা বিমানকে বলল, চলো, কাল আমরা কলকাতায় ফিরে যাই। আর এখানে থেকে কী হবে?

বিমান বলল, চলো, আমার আপত্তি নেই। নতুন মালিক বাড়িটা ভাঙার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েছে…

ডাক্তার হাত ধুতে ধুতে বলল, এই বাড়িটা ভাঙা হচ্ছে… আচ্ছা, আপনাদের পরিবারে একটা চুনির মালা ছিল, যেটা নবাব সিরাজদ্দৌল্লা উপহার দিয়েছিলেন আপনাদের এক পূর্ব পুরুষকে, সেটা একবার দেখতে পারি?

বিমান ভুরু তুলে বলল, নবাব সিরাজদ্দৌল্লার দেওয়া চুনির মালা? আমি কখনও শুনিনি তো সে মালার কথা!

ডাক্তার বলল, সে কী! আমি আমাদের বাড়িতে গল্প শুনেছি। আপনাদের বাড়িতে একজন ক্রিশ্চান হয়েছিলেন, তিনি সেই মালাটা চুরি করে পালিয়েছিলেন। তারপর গোয়াতে গিয়ে সেটা বিক্রি করতে যেতেই ধরা পড়ে যান। তাই না?

বিমান হেসে বলল, ওসব গল্পই। ক্রিশ্চানদাদু কিছু চুরি করেননি। গোয়াতে গিয়ে ধরাও পড়েননি।

ডাক্তার বলল, তিনি তো পাগল হয়ে গিয়েছিলেন? এ বাড়িতে এসে আবার কী করে সেই মালাটা হাতিয়ে লুকিয়ে ফেলেন।

দীপা বলল, সেটাই তবে সাত রাজার ধন এক মানিক। নবাব সিরাজের দেওয়া চুনির মালা!

বিমান বলল, ধ্যাত! আমি কোনওদিন সেরকম মালার কথা শুনিনি। আমার মার কাছেও শুনিনি।

ডাক্তার বলল, আমাদের এদিকে কিন্তু অনেকেই শুনেছে। কান্না আর রক্ত নামে একটা যাত্রা হয়, সেটাতেও আপনাদের এবাড়ির চুনির মালার কথা আছে। নবাব সিরাজদ্দৌল্লা মালাটা আপনাদের এক পূর্বপুরুষের বিয়েতে উপহার দিয়েছিলেন। সিরাজকে যেদিন মেরে ফেলা হয় মুর্শিদাবাদে, সেদিন আপনাদের এই বাড়িতে মালাটা থেকে ফোঁটা-ফোঁটা রক্ত পড়ছিল।

কাকাবাবুর ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠল।

বিমান বলল, গাঁজাখুরি গল্প আর কাকে বলে!

ডাক্তার বলল, কান্না-টান্নার ব্যাপারগুলো নিশ্চয়ই বানানো। কিন্তু একরকম একটা ঐতিহাসিক মালা আপনাদের এখানে বোধ হয় সত্যিই ছিল। সেটার খোঁজ পাননি? আপনার পাগলাদাদু তো ছাদের ওপরে একটা ঘরে থাকতেন। সেই ঘরটা খুঁজে দেখেছেন ভাল করে?

বিমান কাকাবাবুর দিকে তাকিয়ে বলল, আর কি খুঁজতে কিছু বাকি আছে? আমার আগে আরও কতজন ও ঘরের সব কিছু ওলোট-পালোট করে দেখেছে?

দীপা বলল, তবু, মনে করো, ওই ঘরে যদি অত দামি জিনিসটা থেকে যায়? আমরা চলে যাব… নতুন মালিক এসে বাড়ি ভাঙার সময় যদি পেয়ে যায় সেটা? তা হলে কি আর আমাদের দেবে?

বিমান এবার খানিকটা বিরক্তভাবে বলে উঠল, বলেছি ওরকম কিছু দামি জিনিস এখানে নেই। কোনও এক সময় থাকলেও বড়মামা সব বিক্রি করে দিয়ে গেছেন। ঠিক আছে, সন্দেহ মেটাবার জন্য ছাদের ঘরটা আজ আমি নিজেই ভাঙব। লোক ডাকিয়ে দেয়াল ভেঙে, মেঝের পাথর সরিয়ে দেখা হবে! তারপর নিশ্চিন্ত হবে তো!
পরদিন কলকাতায় ফেরার পথে কাকাবাবুর একটু-একটু জ্বর হল।

বিমান আর দীপা বেশ চিন্তায় পড়ে গেল। মাথায় আর পায়ে চোট লাগার পর প্রথম দুদিন জ্বর আসেনি, এখন হঠাৎ জ্বর হল কেন? সেপটিক-টেপটিক হয়নি তো!

কাকাবাবু বললেন, না, না, চিন্তার কিছু নেই। ছাদের ঘরটা যখন ভাঙা হচ্ছিল, তখন প্রচুর ধুলো উড়ছিল তো। ধুলোতে আমার অ্যালার্জি আছে, তার জন্যই জ্বর হয়েছে। কমে যাবে একদিন বাদেই।

বিমান বলল, দেখলেন তো, শুধু-শুধু ছাদের ঘরটা ভাঙাতে হল আমাকে। আমার পয়সা খরচ হল, পাওয়া গেল কিছু?

দীপা বলল, মারবেল-টালিগুলো তো পাওয়া গেল কয়েকটা। ওরও কিছু দাম আছে। আগেকার দিনের ইটালিয়ান মারবেল, এখন অনেক দাম।

বিমান বলল, যাই হোক, এবার এসে মোটামুটি লাভই হল। বাড়িটা বিক্রি করে দেওয়ার পরেও পুরনো চেয়ার-টেবিল, কিছু পাথর, কিছু ভাঙা জিনিসপত্র মিলিয়ে আরও প্রায় হাজার পঁচিশেক টাকা পাওয়া যাবে। অসিত ধর যে ভাঙা ক্যামেরা আর ঘড়িগুলো কিনল, সেগুলোর জন্য আমি তো একটা পয়সাও পাব ভাবিনি।

কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, আচ্ছা, অসিত ধর কি নবাব সিরাজের দেওয়া চুনির মালার গল্পটা শুনেছিল?

বিমান বলল, ও-গল্প আমিই তো আগে শুনিনি। বাড়িতে গিয়েই মাকে জিজ্ঞেস করব।

কাকাবাবু হেসে বললেন, যাত্রার গল্পটা বেশ বানিয়েছে। মুর্শিদাবাদে খুন করা হল নবাব সিরাজকে, আর বীরভূমে তোমাদের বাড়িতে তাঁর দুঃখে মালা থেকে রক্ত ঝরতে লাগল।

দীপা বলল, রক্ত আর কান্না! এই যাত্রাটা কলকাতায় এলে আমি দেখব।

গাড়িতে বাকি রাস্তা আর বিশেষ কিছু কথা হল না। কাকাবাবু জ্বরের ঘোরে এক সময় ঘুমিয়ে পড়লেন।

বাড়ির সামনে পৌঁছবার পরও কাকাবাবুর ঘুম ভাঙেনি। বিমান একটু ঠেলা দিয়ে বলল, কাকাবাবু, কাকাবাবু, এসে গেছি!

কাকাবাবু জেগে উঠে বললেন, ওহ! খুব ঘুমিয়েছি তো! তাতেই জ্বরটা কমে গেছে মনে হচ্ছে।

দীপা বলল, শরীর দুর্বল লাগছে? আপনি ওপরে উঠতে পারবেন, না বিমান আপনাকে তুলে দিয়ে আসবে?

কাকাবাবু বললেন, শরীর ঠিক আছে।

ক্রাচ দুটো বগলে নিয়ে তিনি গাড়ি থেকে নামলেন, তারপর বললেন, যাওয়ার সময় অসিত আমাদের সঙ্গে ছিল। ফেরার সময়েও সে সঙ্গে থাকলে ভাল লাগত। সে যে হঠাৎ আগেই ফিরে এল এটা তোমার কাছে অস্বাভাবিক মনে হয়নি, বিমান?

বিমান বলল, না, না। সত্যি তার একটা জরুরি কাজের কথা মনে পড়ে গিয়েছিল। বিদেশ থেকে কেউ আসবে। আপনার সঙ্গে দেখা করে আসতে পারেনি বলে বারবার ক্ষমা চেয়েছে।

কাকাবাবু বললেন, না, না, এতে আর ক্ষমা চাইবার কী আছে। ঠিক আছে, নবাব সিরাজের চুনির হারটা সম্পর্কে তোমার মা কী বলেন আমাকে জানিও!

বিকেল চারটে, সন্তু এখনও ফেরেনি। কাকাবাবু নিজের ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়লেন। কিন্তু তাঁর আর ঘুম এল না, শুয়ে-শুয়ে আকাশপাতাল চিন্তা করতে লাগলেন।

সন্ধের একটু আগেই সন্তু বাড়ি এল। কাকাবাবু ফিরে এসেছেন শুনেই সে ছুটে এল কাকাবাবুর ঘরে। ঘর অন্ধকার করে শুয়ে আছেন কাকাবাবু।

সন্তু ব্যগ্রভাবে জিজ্ঞেস করল, ওখানে কী হল, কাকাবাবু? পুরনো বাড়ি, কোনও গুপ্তধনের সন্ধান পাওয়া গেল?

কাকাবাবু এ-প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, তোর পরীক্ষা কেমন হচ্ছে রে?

বেশ ভালই। সোজা-সোজা কোশ্চেন এসেছে।

আর কটা পরীক্ষা বাকি আছে?

আর মোটে একটা। কালকেই শেষ!

ঠিক আছে, এখন পড়াশোনা কর। কাল পরীক্ষা হয়ে গেলে ওখানকার গল্প বলব।

একটুখানি বলল না। ওখানে মারামারি হয়েছিল?

এখন তোর মাথায় ওসব ঢোকাতে হবে না। মন দিয়ে পড়ে পরীক্ষা শেষ কর। তারপর তোকে কয়েকটা কাজ করতে হবে।

সন্তু চলে যাওয়ার পর কাকাবাবু পুলিশ কমিশনার আর হোম সেক্রেটারিকে দুটো ফোন করলেন।

তারপরেই বিমানের ফোন এল।

আপনার শরীর কেমন আছে, কাকাবাবু?

জ্বরটর বাড়েনি তো? না না, এখন একদম ভাল হয়ে গেছি। কোনও চিন্তা কোরো না।

সেই রক্তঝরা চুনির মালাটার কথা মাকে জিজ্ঞেস করলুম। মা আমাকে আগে বলেননি, এখন মার মনে পড়ল। ছোটবেলায় মা ওইরকম একটা মালার কথা শুনেছিলেন। তবে, মা নিজেও সেটা কখনও দেখেননি।

তা হলে নবাবের মালা তোমাদের বাড়িতে সত্যিই ছিল?

সত্যিও হতে পারে, গল্পও হতে পারে। মা ও বাড়ির মেয়ে, মা পর্যন্ত নিজের চোখে দেখেননি। সেরকম মালা থাকলেও পঞ্চাশ-ষাট বছর আগেই সেটা বিক্রি হয়ে গেছে।

ওইরকম একটা ঐতিহাসিক মালা কে কিনল? ওইসব জিনিস আমাদের মিউজিয়মে থাকা উচিত।

আমার কিন্তু এখনও ধারণা, ওটা গুজব।

ফোন রেখে দিয়ে কাকাবাবু কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইলেন। তাঁর ভুরু কুঁচকে গেল। কিছু একটা ধাঁধার যেন উত্তর খুঁজে পাচ্ছেন না তিনি। রাত্তিরে তাঁর ভাল করে ঘুম হল না।

সকালে চা-টা খেয়েই তিনি বেরিয়ে পড়লেন ট্যাক্সি নিয়ে। এলগিন রোডে অসিত ধরের বাড়ির কাছে এসে থামলেন।

ট্যাক্সি ছেড়ে তিনি প্রথমে রাস্তা থেকে দেখলেন বাড়িটা। একটু পুরনো ধরনের তিনতলা বাড়ি। একতলায় সামনের দিকে কয়েকটা দোকান। দরজার পাশে তিন-চারটে নেম প্লেট। অসিত ধর থাকেন তিনতলায়।

সামনের গেটটা খোলা। কাকাবাবু সিঁড়ি ভেঙে তিনতলায় উঠে এলেন। দোতলায় তিনখানা ফ্ল্যাট, তিনতলায় মোটে একটা। সিঁড়ি দিয়ে উঠেই একটা ছোট বারান্দা, পাশের একটা জানলা দিয়ে দেখা যায় যে বাড়িটার পেছনে ছোট্ট বাগান রয়েছে।

দরজার বেলে আঙুল রাখলেন কাকাবাবু।

অসিত ধর নিজেই দরজা খুলল। কাকাবাবুকে দেখে সে একটুও অবাক হয়নি। হাসিমুখে বলল, মিঃ রায়চৌধুরী, আসুন, আসুন। কেমন আছেন এখন? মাথার চোটটা…

কাকাবাবু মাথার ব্যান্ডেজ খুলে ফেলেছেন কলকাতায় ফেরার আগেই। পায়ের আঙুলে সেলোটেপ জড়ানো, জুতো পরতে গেলে ব্যথা লাগে বলে আজও চটি পরে এসেছেন।

কাকাবাবু বললেন, কোনও খবর না দিয়ে এসে পড়লাম।

অসিত বলল, তাতে কী হয়েছে? আমি মোটেই ব্যস্ত ছিলাম না। আসুন, ভেতরে আসুন।

বসবার ঘরটি জিনসপত্রে ঠাসা। কোনওরকমে মাঝখানে একটা সোফা-সেট রাখা হয়েছে, আর সব দেওয়ালের ধারে-ধারে অনেকরকমের মূর্তি, পাথরের, ব্রোঞ্জের, পেতলের। মাটির ওপর জড়ো করে রাখা আছে প্রচুর স্ট্যাম্পের অ্যালবাম, বই, ছবি। কোনও কিছুই নতুন নয়, সবই পুরনো।

সাদা প্যান্ট আর নীল রঙের একটি টি-শার্ট পরে আছে অসিত, তার চেহারা সুন্দর, যে-কোনও পোশাকে তাকে মানায়। একটা সিগারেট ধরিয়ে প্যাকেটটা কাকাবাবুর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, নেবেন?

কাকাবাবু বললেন, আমি অনেককাল ধূমপান ছেড়ে দিয়েছি।

অসিত বলল, তা হলে কী খাবেন? চা, কফি? আমার কাজের লোকটি বাইরে গেছে, আমি নিজেই অবশ্য বানিয়ে দিতে পারি। আমি এখানে একাই থাকি, বছরে ছ মাসের বেশি তো বিদেশেই কাটাতে হয়।

আপনি ব্যস্ত হবেন না, বসুন। আমি কিছু খাব না।

আপনারা কালকেই ফিরেছেন, খবর পেয়েছি। বিমান ফোন করেছিল। ওদের বাড়ি থেকে আমি যে ভাঙা ক্যামেরা আর ঘড়ি এনেছি, সেগুলো আপনি দেখতে চান?

না।

দেখতে চান না? বিমান বলছিল… আপনার সম্পর্কে আমি আগে বিশেষ কিছু জানতাম না। ওখানে গিয়ে বিমানের মুখেই শুনেছি, আপনি প্রচুর অ্যাডভেঞ্চার করেছেন, অনেক মিস্ত্রি সম্ভ করেছেন।

কাকাবাবু কড়া চোখে কয়েকপলক তাকিয়ে রইলেন অসিতের দিকে। এ পর্যন্ত তিনি অসিতের সঙ্গে আপনি বলে কথা বলছিলেন, এবার তিনি তুমিতে নেমে এলেন।

ধমকের সুরে বললেন, তুমি এটা শোনোনি যে, আমার গায়ে কেউ হাত তুললে আমি তাকে ক্ষমা করি না?

অসিত যেন বিস্ময়ের একটা ধাক্কা খেল। আস্তে-আস্তে বলল, তার মানে?

আমার একটা প্রতিজ্ঞা আছে, কেউ যদি আমার দিকে রিভলভার তোলে, কিংবা কেউ যদি আমাকে শারীরিকভাবে আঘাত করে, তবে তাকে আমি শাস্তি দিতে ছাড়ি না।

আমি আপনার দিকে রিভলভার তুলিনি, আপনার গায়ে হাতও ছোঁয়াইনি। তা হলে হঠাৎ এসব কথা আমাকে বলছেন কেন?

তুমি ফাঁদ পেতে আমাকে আঘাত দিয়েছ?

তার মানে?

তার মানে তুমি ভালই জানো। ছাদের ঘরটার মেঝেতে কয়েক জায়গায় গর্ত খোঁড়া ছিল। সেইরকম একটা গর্তের মুখে তুমি আলগা করে একটা পাথর চাপা দিয়ে রেখেছিলে। তুমি জানতে, সেখানে আমার ক্রাচটা পড়লেই উলটে যাবে। আমি যাতে সেদিকে তাড়াহুড়ো করে যাই, সেইজন্য তুমি জানলার ধারে একটা প্রিজমের টুকরো রেখেছিলে। রোদ পড়ে সেটা ঝকমক করছিল।

আমি এতসব করতে যাব কেন? আপনাকে আঘাত দিয়ে লাভ কী?

এর একটাই মাত্র কারণ হতে পারে। তিনতলার ঘরটা তুমি আমার আগে নিজে ভাল করে সার্চ করতে চেয়েছিলে। আগের রাত্তিরে তুমি ছাদে উঠে তালাটা ভাঙার চেষ্টা করেছিলে। পারোনি। পরের দিন সকালে তোমার একটা সুবিধা হয়ে গেল। একজন ইংরেজির মাস্টার আমার সঙ্গে দেখা করতে এসে অনেকটা সময় নিয়ে নিল। তুমি আমার আগে ঘরে ঢুকে গেলে। তুমি অ্যান্টিকের ব্যবসা করো, নিশ্চয় কোনও দামি জিনিস তোমার নজরে পড়ে গিয়েছিল। আমি যাতে সেটা দেখতে না পাই, সেইজন্যই তুমি আমাকে সরিয়ে দিতে চেয়েছিলে!

আমি যদি বলি, এ-সবই আপনার উর্বর মস্তিষ্কের কল্পনা? আপনি যা বললেন, এক বিন্দুও প্রমাণ করতে পারবেন? আপনার মাথায় চোট লেগেছিল, তারপর দেখছি, এখনও আপনার মাথা ঠিক হয়নি। আপনি ভাল করে ডাক্তার দেখান!

অসিত ধর, কথা ঘোরাবার চেষ্টা কোরো না! রাজা রায়চৌধুরীর চোখকে তুমি ফাঁকি দিতে পারবে না!

অসিত এবার হা-হা করে হেসে উঠল। তাচ্ছিল্যের সঙ্গে ঠোঁট বেঁকিয়ে বলল, মিঃ রাজা রায়চৌধুরী, আপনি নিজেকে খুব বুদ্ধিমান ভাবেন, তাই না? ঠিক আছে, আপনাকে আমি চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছি। আপনি যা বললেন, তা সবই সত্যি। তবে, এসব প্রমাণ করতে হলে আপনাকে জানতে হবে, ওই ছাদের ঘর থেকে আমি কী নিয়েছি! হ্যাঁ, সত্যিই আমি একটা মহা মূল্যবান জিনিস পেয়েছি। ওই ছাদের ঘর থেকে। বছরের পর বছর জিনিসটা ওই ঘরে রয়েছে, এর আগে যারা খুঁজেছে, কেউ সেটা চিনতে পারেনি। সেটা আবিষ্কারের কৃতিত্ব আমার। সুতরাং সেটা আমি নেবই নেব, এটা তো স্বাভাবিক। সেটা কী, আপনি হাজার চেষ্টা করলেও বুঝতে পারবেন না!

কাকাবাবু কয়েক মুহূর্ত চুপ করে গেলেন। তারপর বললেন, সেটা দেখলে।

আমিও হয়তো চিনতে পারতাম।

অসিত বলল, সে চান্স আমি দেব কেন? আপনি আর আমি দুজনেই বাইরের লোক। বিমানরা তো এত বছর ধরে খোঁজাখুঁজি করেও সেটা পায়নি!

কাকাবাবু আদেশের সুরে বললেন, সে জিনিসটা আমি একবার দেখতে চাই।

অসিত তা গ্রাহ্য না করে বলল, বাবা বাবা। আপনি চাইলেই সেটা আমি দেখাব? আপনাকে তো আমি চ্যালেঞ্জ জানালাম। অন্য কারও কাছে আমি স্বীকারই করব না যে, কিছু নিয়েছি। বিমান আপনার কাছে কোনও অভিযোগ করেছে? পুরনো ঘড়ি, ক্যামেরাগুলো আমি দাম দিয়ে কিনে নিয়েছি। সে জানে, আমি আর কিছু আনিনি।

তোমার জন্য আমার মাথা ফেটেছে। পায়ের নখ আধখানা উড়ে গেছে।

জানলার ধারে একটা ঝকঝকে কাচ দেখে আপনি লোভীর মতন সেটা ধরতে গেলেন কেন? আপনি অত তাড়াহুড়ো না করলে পড়ে যেতেন না! সুতরাং ওটা একটা অ্যাকসিডেন্ট।

আমি অজ্ঞান হয়ে যেতেই অন্যরা ব্যস্ত হয়ে পড়ল, সেই ফাঁকে তুমি জিনিসটা সরিয়ে ফেললে?

কী সরালাম?

কাকাবাবু আবার চুপ করে যেতেই অসিত হা-হা করে অবজ্ঞার হাসি হেসে উঠল।

এই সময় ফ্ল্যাটে একজন তাগড়া চেহারার লোক ঢুকল। লোকটি যেমন লম্বা, তেমনই চওড়া। নাকের নীচে মস্ত বড় গোঁফ।

অসিত বলল, কিষণ, এসেছিস? দু কাপ কফি বানা বেশ ভাল করে।

তারপর কাকাবাবুর দিকে ফিরে বলল, কিষণের হাতে কফি খেয়ে দেখুন, খুব ভাল করে। আমি যখন বিদেশে থাকি, তখন কিষণই আমার ফ্ল্যাটটা পাহারা দেয়। খুব বিশ্বাসী লোক।

কাকাবাবু উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, নাঃ, আমি কফি খাব না!

অসিত মিটিমিটি দুষ্টুমির হাসি দিয়ে বলল, আপনি কী ভাবছেন, বলে দেব? পুলিশ দিয়ে আমার ফ্ল্যাটটা সার্চ করাবেন, তাই তো? পুলিশের বড়কর্তাদের সঙ্গে আপনার চেনা আছে। কিন্তু পুলিশের বাপের সাধ্য নেই বিনা অভিযোগে কারও বাড়ি সার্চ করার। ঠিক আছে, ধরে নিলাম, আপনার কথা শুনে পুলিশ কোনও মিথ্যে অভিযোগ এনে আমার বাড়ি সার্চ করল। তা হলেও সেই জিনিসটা চিনতে পারার মতন বুদ্ধি পুলিশেরও নেই!

কাকাবাবু বললেন, আমার মনের কথা বোঝা এত সহজ? আমি জানি, এমনি-এমনি তোমার বাড়ি সার্চ করানো যাবে না। কিন্তু আমি আর-একটা ব্যবস্থা করে রেখেছি। সেই দামি জিনিসটা তুমি এদেশে রাখবে না, বিদেশে নিয়ে বিক্রি করবার চেষ্টা করবে। তুমি এদেশ ছেড়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে এয়ারপোর্টে যাতে তোমাকে তন্নতন্ন করে সার্চ কানো যায়, সে ব্যবস্থা করব। পুরনো আমলের দামি জিনিস বিদেশে নিয়ে যাওয়া বেআইনি, তা জানো নিশ্চয়ই?

অসিত ঠোঁট উলটে বলল, আই ডোন্ট কেয়ার! আমি প্লেনের টিকিট বুক করে রেখেছি। যেদিন যাওয়ার কথা, সেদিন ঠিক চলে যাব, কেউ আমায় আটকাতে পারবে না।

তিনতলা থেকে নেমে এসে রাস্তায় দাঁড়িয়ে ট্যাক্সি খুঁজতে লাগলেন কাকাবাবু। বুকটা খালি-খালি লাগছে। অসিতের কাছে যেন তিনি হেরে গেলেন। ওকে তিনি যতটা চালাক ভেবেছিলেন, ও তার চেয়েও অনেক বেশি ধুরন্ধর। নিজেই চট করে স্বীকার করল যে, একটা খুব দামি জিনিস পেয়ে গেছে। কাকাবাবু ভেবেছিলেন, অনেক চাপ দিয়ে কথাটা আদায় করতে হবে। তার বদলে ও হাসতে-হাসতে চ্যালেঞ্জ জানাল!

জিনিসটা কী হতে পারে?

নবাব সিরাজের দেওয়া সেই চুনির মালা? ছাদের ঘরে একটা পুরনো গয়নার বাক্স ছিল ঠিকই। কিন্তু তার মধ্যে মালাটা থাকলে আগে আর কেউ নিশ্চয়ই দেখতে পেত! চুনি পাথর উজ্জ্বল লাল রঙের হয়। সাধারণ পুঁতির মালার সঙ্গে তার অনেক তফাত! বিমানের মামারা অনেককালের জমিদার বংশ, হিরে-মুক্তো-চুনি-পান্না চিনতে ওদের কোনও অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। অনেকেই ওই ঘরটা খুঁজেছে, সেরকম দামি জিনিস কেউ-না-কেউ দেখতে পেতই!

ছোট কোনও মূর্তি? তিন-চারশো বছরের পুরনো কোনও মূর্তি হলে তার দামও অনেক হতে পারে। ও ঘরে দু-একটা ভাঙা মূর্তি ছিল যিশু খ্রিস্টের, সেগুলো মোটেই দামি নয়। খাটের তলায় আর কোনও মূর্তি পড়ে ছিল?

জিনিসটা যাই-ই হোক, সেটা উদ্ধার করা যাবে কী করে? বিমানরা কোনও অভিযোগ করেনি। জিনিসটা কী তা না জানলে অভিযোগ করবেই বা কী করে? অসিত ফাঁদ পেতে তাঁর মাথা ফাটিয়েছে, সেটাও তো প্রমাণ করা অসম্ভব। ছাদের ঘরটা একেবারে ভেঙে ফেলা হয়েছে। গর্তের ওপর পাথর চাপা দিয়ে রাখার ব্যাপারটাও এখন কেউ বিশ্বাস করবে না। সবাই বলবে, কাকাবাবুরই সাবধানে পা ফেলা উচিত ছিল।

ভাবতে-ভাবতে কাকাবাবুর চোয়াল শক্ত হয়ে গেল। তিনি মনে-মনে বললেন, তবু অসিত ধরকে শাস্তি পেতেই হবে।

একটা ট্যাক্সি পেয়ে তখনই বাড়ি না ফিরে কাকাবাবু চলে এলেন লালবাজারে। পুলিশ কমিশনার তাঁর বন্ধুস্থানীয়, দুজনেই একবয়েসী।

কমিশনার সাহেবের ঘরে ভিড় ছিল, কাকাবাবু অপেক্ষা করতে লাগলেন। ভিড় ফাঁকা হলে কাকাবাবু বললেন, এক কাপ কফি দিতে বলল, তোমাকে মন দিয়ে কিছু কথা শুনতে হবে।

সব শোনার পর কমিশনার সাহেব বললেন, রাজা, আমি যে এর মাথামুণ্ড কিছু বুঝতে পারছি না। কী জিনিস চুরি করেছে, তা বুঝতে না পারলে একটা লোককে চোর বলি কী করে?

কাকাবাবু বললেন, সে নিজের মুখে আমার কাছে স্বীকার করেছে।

কমিশনার বললেন, হয়তো, সেটাও মিথ্যে কথা। তোমার সঙ্গে প্র্যাকটিক্যাল জোক করতে চাইছে। বাড়ির মালিকই বলছে, ও ঘরে দামি জিনিস কিছু ছিল না।

কাকাবাবু বললেন, আমার দৃঢ় বিশ্বাস ও কিছু একটা পেয়েছে। ঘরে ঢুকেই ওর অভিজ্ঞ চোখে সেটা নজরে পড়েছে। তাও ও আমাকে সরিয়ে দিতে চেয়েছিল?

কমিশনার সাহেব বললেন, খুব ছোট জিনিস, মনে করো একটা স্ট্যাম্প, তাও খুব দামি হতে পারে। কিংবা খুব ছোট একটা মূর্তি। কিন্তু ডেফিনিট কোনও অভিযোগ না থাকলে তো এসব কিছু খোঁজ নেওয়া যায় না। আমি বরং একটা কাজ করতে পারি। আমি খোঁজখবর নিচ্ছি, অসিত ধর লোকটা কেমন। আগে কোনও বেআইনি কাজ করেছে কি না। আজ রাত্তিরের মধ্যেই তুমি সব জেনে যাবে।

কাকাবাবু বললেন, গোয়াতে এখন পুলিশের বড়কর্তা ডি সিম্বা না? তার ঠিকানা আর ফোন নাম্বারটা আমাকে দাও।

বাড়িতে ফিরে কাকাবাবু দেখলেন দীপা এসে তাঁর বউদির সঙ্গে গল্প করছে। কাকাবাবুকে দেখে সে বলে উঠল, এর মধ্যেই টো-টো করে বেড়াচ্ছেন? ডাক্তার আপনাকে বিশ্রাম নিতে বলেছিল না?

সন্তুর মা অবাক হয়ে বললেন, ডাক্তার… কেন, কী হয়েছিল?

কাকাবাবু হেসে বললেন, চিন্তার কিছু নেই বউদি। এবারে কোনও গুণ্ডা, ডাকাত কিংবা অপরাধচক্রের নায়কের পাল্লায় পড়িনি। এমনিই পড়ে গিয়ে মাথায় একটু চোট লেগেছিল।

তারপর তিনি দীপাকে বললেন, তুমি একবার আমাদের ঘরে এসো তো! তোমার সঙ্গে কয়েকটা কথা আছে।

ঘরে এসে দীপাকে তিনি একটা ইজিচেয়ারে বসতে বললেন। ঘরের সবকটা জানলা বন্ধ করে দিতে অন্ধকার হয়ে গেল। মাঝখানের একটা আলো জ্বেলে দিলেন। তারপর কাকাবাবু এককোণে দাঁড়িয়ে বললেন, দীপা, তুমি আমার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকবে শুধু। আমি তোমাকে যা জিজ্ঞেস করব, তা মনে করবার চেষ্টা করবে। ছোটখাটো, খুঁটিনাটি সব কিছু। তোমাদের এই বাড়িটার ছাদের ঘরে সেদিন সকালবেলা তুমি আমার চেয়ে আগে ঢুকেছিলে। ঢুকে তুমি কী দেখলে?

দীপা বলল, অসিতবাবু আগে থেকেই সেই ঘরের মধ্যে ছিলেন।

সে কী করছিল?

অসিতবাবু খুব ব্যস্ত হয়ে সবকিছু উলটে পালটে দেখছিলেন।

সবকিছু মানে?

ঝিনুক, পুঁতির মালা, বই, ম্যাপ, টেবিলের ড্রয়ার…

সবগুলোই একসঙ্গে দেখছিলেন?

তাই তো মনে হল। অন্যদের আগেই তিনি সব দেখে নিতে চান।

কোনও জিনিসটা উনি নিজের কাছে রেখে দিয়েছিলেন?

না। খালি বলছিলেন, বাজে, বাজে, ঝুটো মাল!

আর-একটু ভাল করে ভাবো। কোন জিনিসটা বেশি করে দেখছিলেন? ঝিনুক, বই… . .

পুঁতির মালা। প্রত্যেকটা মালা তুলে-তুলে চোখের সামনে দেখছিলেন আর ছুঁড়ে ফেলে দিচ্ছিলেন মাটিতে…

খাটের ওপর বিছানা-বালিশ ছিল। আমি পরের দিন গিয়ে দেখেছি, বালিশটা ফালাফালা করে ভেঁড়া। তুলো বার করা। তুমিও সেরকম দেখেছিলে, না বালিশটা তখন আস্ত ছিল?

বালিশটা ছেঁড়াই ছিল। অনেকদিন থেকেই ছেঁড়া।

তোশকও ছেঁড়া?

হ্যাঁ। ছেঁড়া ছিল।

ঘরের মেঝেটা কীরকম ছিল?

মাঝে-মাঝে গর্ত ছিল। পাথর তোলা ছিল।

আমি যেখানে পড়ে গেলাম, সেখানেও গর্ত ছিল, না পাথর বসানো ছিল?

মনে নেই।

মনে করার চেষ্টা করো।

আমি ওদিকটা ভাল করে দেখিনি।

কাকাবাবু এগিয়ে এসে দীপার চোখের সামনে একটা হাত রেখে খুব নরম গলায় বললেন, আর-একটু মনে করার চেষ্টা করো।

আর কিছু মনে পড়ছে না, কাকাবাবু! ভাবো। খুব একমনে ভাববা।

হ্যাঁ, আমি জানলার কাছে যাচ্ছিলাম, তখন অসিতবাবু আমার হাত ধরে টেনে বললেন, এদিকে দেখুন। এই আয়নার বাক্সটা দেখুন! আমাকে জানলার দিকে যেতে দেয়নি! জানলার দিকে গেলে আমিও আপনার মতন আছাড় খেয়ে পড়তাম।

তা হলে অসিত জানত যে ওদিকে গর্তের ওপর একটা পাথর আলগা করে বসানো আছে। কিংবা সেটা সে নিজেই বসিয়েছে।

কাকাবাবু এবার সব জানলাগুলো খুলে আলো নিভিয়ে দিলেন।

দীপা চোখ বিস্ফারিত করে বসে রইল কয়েক মুহূর্ত। তারপর বলল, অসিতবাবু জেনেশুনে ইচ্ছে করে আপনাকে আছাড় খাইয়েছে? কেন?

কাকাবাবু বললেন, আমি অজ্ঞান হয়ে পড়ার পর তোমরা আমাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লে। সেই সুযোগে অসিত ঘর থেকে কোনও দামি জিনিস সরিয়ে ফেলতে পারে অনায়াসে, তাই না?

দীপা প্রায় আর্তনাদের ভঙ্গিতে চেঁচিয়ে উঠে বলল, কী সরিয়ে ফেলেছে? নবাবের দেওয়া সেই চুনির মালা?

কাকাবাবু বললেন, সেটা যদি অসিত ঘরে ঢোকামাত্র খুঁজে নিতে পারে, তা হলে সে দোষ তোমাদের। তোমরা অনেকে মিলে ওই ঘরে অনেকবার খোঁজাখুঁজি করেছ, কিন্তু দামি জিনিস কিছুই পাওনি। এমন কী, ওই চুনির মালাটার কথা তোমরা জানতেই না। সুতরাং অসিত যদি ওটা আবিষ্কার করে থাকে, তা হলে সেটা তার কৃতিত্ব!

দীপা বলল, পাগল দাদুটা হয়তো মালাটা এমন জায়গায় লুকিয়ে রেখেছিল, যা কেউ ধারণাই করতে পারেনি। পাগলদের মতিগতি কি বোঝা যায়? ইস, অমন দামি জিনিসটা অসিত ধর নিয়ে নিল? আমাদের ঠকাল? ওকে পুলিশে ধরিয়ে দেওয়া যায় না?

কাকাবাবু হেসে বললেন, আরে, দাঁড়াও দাঁড়াও? সে যে নিয়েছে, তার কোনও প্রমাণ আছে? ওরকম একটা মালা ছিল কি না, তারই তো ঠিক নেই। হুট করে কি কাউকে চোর বলা যায়? তুমি এক কাজ করো। বাড়ি গিয়ে বিমানকে জিজ্ঞেস করো, ওই ঘরটায় কী কী জিনিস ছিল, তার কোনও লিস্ট বানানো আছে কিনা! যদি সেরকম না থাকে, তা হলে বিমানকে একটা লিস্ট বানাতে বলো—ও তো ওই ঘরে বেশ কয়েকবার ঢুকেছে, যা যা জিনিস দেখেছে সব মনে করে লিখতে বলো। যেসব জিনিসকে মনে হয় আজেবাজে, তাও যেন বাদ না দেয়! তুমি যেমন মেঝের গর্তটার কথা ভুলে গিয়েছিলে, সেরকম কিছুও ভুললে চলবে না।

দীপা ঠোঁট উলটে বলল, ওর আমার চেয়েও ভুলো মন।

দীপা চলে যাওয়ার পর কাকাবাবু নিজের টেবিলের কাগজপত্রের মধ্যে খুঁজে একটা টেলিগ্রামের ফর্ম বার করলেন। তারপর গোয়ার পুলিশের কর্তার কাছে কয়েকটা খবর জানতে চেয়ে লিখলেন অনেকখানি। বাড়ির কাজের লোকটির হাতে টাকা দিয়ে টেলিগ্রামটা পাঠিয়ে দিলেন পোস্ট অফিসে।

সন্ধেবেলাতে পুলিশ কমিশনার ফোন করলেন। হাসতে-হাসতে বললেন, রাজা রায়চৌধুরী, এবার তো মনে হচ্ছে, তোমার পুরো ব্যাপারটা ওয়াইল্ড গুজ চেইজ!

কাকাবাবু শুকনো গলায় বললেন, কেন?

কমিশনার-সাহেব বললেন, অসিত ধর সম্পর্কে সমস্ত খোঁজখবর নেওয়া হয়েছে। তার নামে কোনও অভিযোগ নেই। সে কখনও জেল খাটেনি, চুরি-জোচ্চুরি কোনও কেস তার নামে কখনও ওঠেনি। পাড়ার লোক তাকে নিঝঞ্ঝাট, ভদ্রলোক বলে জানে। যদিও সে পাড়ায় লোকদের সঙ্গে তেমন মেশে না। সে প্রায়ই বিদেশে যায়, সেখানে তার ব্যবসা আছে। তার পাসপোর্টেও কোনও গোলমাল নেই। শিগগিরই আবার বিদেশে যাবে, তার টিকিট কাটা আছে। এরকম লোককে তো পুলিশ কোনও কারণেই ধরতে পারে না!

আমি তো তোমাকে ধরতে বলিনি।

এরকম লোককে তুমিই বা সন্দেহ করছ কেন?

দ্যাখো, সন্দেহ যখন আমার মনে জেগেছে, তখন নিশ্চয়ই কোনও কারণ আছে।

আরও একটা ব্যাপার। আমি আজ বীরভূমের এসপি.-কে ফোন করেছিলাম। মজার কথা কী জানো, এসপির নাম চঞ্চল দত্ত, সে নাকি বীরভূমের ওই রাও-পরিবারের দূর সম্পর্কের আত্মীয়। নবাবের উপহার দেওয়া পান্নার মালাটার কথা চঞ্চলও জানে।

পান্না নয়, চুনির মালা।

তাই নাকি? ও যে বলল, পান্না?

চুনি হচ্ছে লাল রঙের, আর পান্না সবুজ। দুটো একেবারে দুরকম।

তাই নাকি? আমি আবার অত চুনি-পান্না চিনি না। চঞ্চলও বোধ হয় গুলিয়ে ফেলেছে। যাই হোক, চঞ্চল ওই মালাটার কথা শুনেছে। এখন ওটার দাম হবে কয়েক কোটি টাকা। আজও কেউ মালাটা খুঁজে পায়নি। এখন তো বাড়িটা ভাঙা হচ্ছে, কোনও দেওয়ালের গর্ত থেকে কোনও মিস্তিরি-মজুর পেয়ে যেতে পারে। চঞ্চলকে বলেছি নজর রাখতে।

বেশ ভাল কথা।

শোনো রাজা, অসিত ধর যদি লোভের বশে ছোটখাটো কোনও জিনিস হাতসাফাই করে ওখান থেকে নিয়েও থাকে, তা নিয়ে তোমার মাথা ঘামাবার কী দরকার? বিমান তো কোনও অভিযোগ করেনি।

সেটা ঠিক। আমার মাথা ঘামাবার কোনও কারণ ছিল না। কিন্তু সে আমার চোখে ধূলো দেওয়ার চেষ্টা করেছে কেন, তা জানতে হবে না? সে কয়েক হাজার টাকা দিয়ে বিমানের কাছ থেকে কয়েকটা ভাঙা জিনিসপত্র কিনেছে। বিমান তাতেই খুশি। কিন্তু আমার পায়ের নখ আধখানা কেন উড়ে গেল, তা নিয়ে আমি মাথা ঘামাব না?

তোমার পায়ের নখ উড়ে গেছে? সেটা আবার কী ব্যাপার? কিছু বলোনি তো?

থাক, পরে বলব। এখন আপাতত আমি নিজেই মাথা ঘামাই।

সন্তু শেষ পরীক্ষা দিয়ে, বন্ধুদের সঙ্গে একটা সিনেমা দেখে ফিরল রাত সাড়ে আটটায়। এসেই কাকাবাবুর ঘরে ঢুকে বলল, এবার বলো! কী হল বীরভূমে।

কাকাবাবু একটা ইজি-চেয়ারে হেলান দিয়ে বসেছিলেন ঘর অন্ধকার করে। উঠে আলো জ্বাললেন। তারপর বললেন, বলছি। কাল সকাল থেকে তোকে একটা কাজ করতে হবে, সন্তু। একটা লোককে সারাদিন ফলো করতে পারবি? পুলিশের সাহায্য পাওয়া যাবে না। লোকটি তোকে চেনে না, এই একটি সুবিধে আছে।

সন্তু জিজ্ঞেস করল, কাকে ফলো করব? লোকটিকে আমি চিনব কী করে?

কাকাবাবু বললেন, আমি লোকটির বাড়ি আর লোকটিকে চিনিয়ে দেব। সারাদিনে ও কোথায় কোথায় যায়, কার কার সঙ্গে দেখা করে, সব তোকে নোট করতে হবে।

লোকটা যদি গাড়ি করে যায়?

সেও একটা সমস্যা বটে। তোকে ট্যাক্সি ভাড়ার জন্য টাকা দিতে পারি, কিন্তু কলকাতা শহরে যে ঠিক সময়মতন ট্যাক্সি পাওয়াই যায় না।

আমি মোটর সাইকেল চালাতে শিখে গেছি। বিমানদার মোটর সাইকেলটা চেয়ে নেব?

চালাতে শিখেছিস? তোর এখনও লাইসেন্স হয়নি? না।

তা হলে চালাতে হবে না। তা ছাড়া মোটর সাইকেলে বড্ড আওয়াজ হয়। সবাই তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে। এমনিই দ্যাখ যতটা পারিস। উপস্থিত বুদ্ধি খাটাবি।

এর পর কাকাবাবু প্রথম থেকে বলতে শুরু করলেন সন্তুকে। পুরনো আমলের বিশাল বাড়ি, ভূতের ভয়, ছাদের ওপর পাগলা দাদুর ঘর…।

অনেকটা যখন বলা হয়েছে, সেই সময় ঝনঝন করে বেজে উঠল টেলিফোন। সন্তুই ফোনটা ধরে বলল, কাকাবাবু, তোমাকে চাইছে।

কাকাবাবু রিসিভারটা নিয়ে হ্যালো বলতেই ওপাশ থেকে একটা হাসির আওয়াজ ভেসে এল।

কাকাবাবুর ভুরু কুঁচকে গেল। তিনি আবার বললেন, হ্যালো, কে?

এবার ওদিক থেকে একজন বলল, সরি, মিস্টার রায়চৌধুরী। হঠাৎ হাসি পেয়ে গিয়েছিল। সকালে আপনি যখন রাগারাগি করছিলেন, সেই মুখখানা মনে পড়ে গেল কি না! যাই হোক, ভেবেচিন্তে কিছু পেলেন?

অসিত ধরের গলা!

কাকাবাবু বললেন, না, কিছু পাইনি।

অনেকের মুখেই শুনেছি, আপনার নাকি দারুণ বুদ্ধি। অনেক রহস্যের সমাধান করেছেন। এবার তা হলে আপনার ওপর টেক্কা দিলুম, কী বলুন!

আমার চেয়ে যাদের বুদ্ধি বেশি, তাদের আমি শ্রদ্ধা করি। তোমার কাছে আমি হেরে গেলে তোমাকে আমি অভিনন্দন জানাব। তবে, তিনতলার ঘরখানা তুমি আর আমি যদি একসঙ্গে দেখতাম, তা হলেই আসল বুদ্ধির পরীক্ষা হত। তুমি অন্যায়ভাবে আমাকে সরিয়ে দিয়েছ।

সে-চান্সটা আমাকে নিতেই হয়েছে। তবে আপনার চিন্তার বোঝাটা আমি একটু কমিয়ে দিচ্ছি। ওই যে সিরাজদ্দৌল্লার দেওয়া একটা চুনির মালার কথা এখন শোনা যাচ্ছে, সেটা কিন্তু আমি নিইনি! মালা জাতীয় কোনও কিছু আমি নিইনি, এ-বিষয়ে আপনাকে আমি ওয়ার্ড অব অনার দিতে পারি।

মালাটা ছিঁড়ে পাথরগুলো আলাদা করে নিলেও তার দাম একই থাকে। আলাদা-আলাদাভাবে পাথরগুলো লুকিয়ে রাখাও সোজা।

হা-হা-হা! মিস্টার রায়চৌধুরী, অত সোজা নয়! ভাবুন, ভাবুন, হাল ছেড়ে দেবেন না, ভাবুন, ভেবে যান!

কাকাবাবু আর কিছু বলার আগেই ফোন রেখে দিল অসিত।

অপমানে কাকাবাবুর মুখটা কালো হয়ে গেল।
সকাল আটটা থেকে এলগিন রোডে অসিত ধরের বাড়ির উলটো দিকের ফুটপাথে দাঁড়িয়ে আছে সন্তু। কাকাবাবু আসেননি, বাড়ির নাম্বার আর অসিত ধরের চেহারার একটা নিখুঁত বর্ণনা দিয়ে দিয়েছিলেন।

প্রায় পঁয়তাল্লিশ মিনিট কেটে গেল, তবু অসিত ধরের দেখা নেই। এমনিতে সন্তু ঘন্টার পর ঘন্টা হাঁটতে পারে, কিন্তু এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকতে তার পায়ে ব্যথা করছে। এক-একবার একটা ল্যাম্পপোস্টের গায়ে হেলান দিচ্ছে। সে একবার ভাবল, ট্রাফিক পুলিশরা সারা দিন দাঁড়িয়ে থাকে কী করে?

সকালবেলায় সবাই ব্যস্ত, কতরকম মানুষ যাচ্ছে হনহনিয়ে। সন্তুই শুধু দাঁড়িয়ে আছে এক জায়গায়। অন্যরা কী ভাবছে? কেউ যদি তাকে সন্দেহ করে?

কাছাকাছি কোনও চায়ের দোকানও নেই যে, সেখানে গিয়ে বসবে।

সন্তু একটা ছাই রঙের প্যান্ট ও সাদা শার্ট পরে এসেছে। ইচ্ছে করে বেশি রংচঙে পোশাক পরেনি, যাতে তার প্রতি লোকের দৃষ্টি না পড়ে। কাঁধে ঝোলানো একটা সাধারণ ব্যাগ, তাতে রয়েছে দু-একখানা গল্পের বই, আর ক্যামেরা।

প্রায় সাড়ে নটার সময় অসিত ধর নেমে এল রাস্তায়। সুট-টাই পরা, পুরোদস্তুর সাহেবি পোশাক পরা, হাতে একটা চামড়ার ব্যাগ। সন্তু রাস্তা পেরিয়ে তার কাছাকাছি গিয়ে দাঁড়াল।

অসিত প্রথমে হাত তুলে একটা চলন্ত ট্যাক্সি থামাবার চেষ্টা করল। সেটা থামল না। তখন সে হাঁটতে লাগল বাঁ দিকে।

নেতাজি সুভাষ বসুর বাড়ির সামনে দুখানা ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে আছে। সন্তুর মনটা নেচে উঠল আনন্দে। একেই বলে ভাগ্য। একসঙ্গে দুখানা ট্যাক্সি, সন্তুর কোনও অসুবিধাই হবে না।

অসিত প্রথম ট্যাক্সি ড্রাইভারের সঙ্গে জানলা দিয়ে দু-একটা কথা বলল। ড্রাইভারটি রাজি হয়ে খুলে দিল দরজা।

সে ট্যাক্সিটা স্টার্ট করার পরই সন্তু ঝট করে উঠে পড়ল দ্বিতীয়টায়। এ ট্যাক্সির ড্রাইভার মিটার ঘোরাবার আগে সন্তুর দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করল, কোথায় যাবে?

সন্তু ব্যস্তভাবে বলল, জলদি, জলদি, ওই সামনের ট্যাক্সিটাকে ফলো করুন।

ড্রাইভারটি ভুরু তুলে বলল, তার মানে?

সন্তু বলল, ওই ট্যাক্সিটাকে ফলো করুন! দূরে চলে যাবে।

ড্রাইভারটি বলল, কেন, ফলো করব কেন?

সন্তু অস্থির হয়ে বলল, কী মুশকিল! বলছি যে ট্যাক্সিটা হারিয়ে যাবে, শিগগির চলুন।

ইয়ার্কি হচ্ছে?

আপনার সঙ্গে ইয়ার্কি করব কেন? আমার কাছে টাকা আছে, আমি ভাড়া যত লাগে দেব, আপনি ট্যাক্সি চালাবেন।

কই, দেখি টাকা।

এই তো দেখুন না। এবার দয়া করে তাড়াতাড়ি চলুন। স্পিড় নিন। আগের গাড়িটাকে ধরতে হবে।

কেন, ধরতে হবে কেন?

ওই ট্যাক্সিতে একজন…একজন ডেঞ্জারাস ক্রিমিনাল বসে আছে।

ওই লোকটা যদি ক্রিমিনাল হয়, তা হলে তুমি কে?

আমি, মানে আমি, আমার বিশেষ দরকার।

চোর-পুলিশ খেলা হচ্ছে? নামো, নামো আমার গাড়ি থেকে।

তর্ক করে লাভ নেই। অসিতকে নিয়ে অন্য ট্যাক্সিটা রাস্তার গাড়ির ভিড়ে মিলিয়ে গেছে। ড্রাইভারটাকে একটা ভেংচি কেটে সন্তু নেমে পড়ল।

কত ইংরেজি বইতে সে পড়েছে কিংবা বিদেশি সিনেমায় দেখেছে যে, রাস্তায় ঝট করে একটা ট্যাক্সি ধরে আগের গাড়িটাকে ফলো করতে বললে, ড্রাইভার বিনা বাক্যব্যয়ে অমনই ফলো করে। কলকাতার ট্যাক্সি ড্রাইভারগুলো এক-একটি জ্যাঠামশাই! কোথায় যাবে, কেন যাবে, সব জিজ্ঞেস করা চাই।

প্রথম চেষ্টাতেই ব্যর্থ। সন্তু বিরক্ত মুখে হাঁটতে লাগল। শম্ভুনাথ হাসপাতালের কাছে আর-একটি ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সন্তুর একটা কথা মনে পড়ল। অসিত ট্যাক্সিতে ওঠার সময় বলেছিল, বউবাজার। সেখানে গিয়ে একবার খুঁজে দেখা যেতে পারে। যদিও বউবাজার স্ট্রিট চেনা রাস্তা, সেখানে অসিত এর মধ্যে কোন্ বাড়িতে ঢুকে পড়বে কে জানে। তবু চেষ্টা করা যেতে পারে।

এই ট্যাক্সির কাছে গিয়ে সন্তু জিজ্ঞেস করল, বউবাজার যাবেন?

ড্রাইভারটি সন্তুর আপাদমস্তক দেখে নিয়ে জিজ্ঞেস করল, কোনও রুগি যাবে? কিসের রুগি?

সন্তু বলল, না, অন্য কেউ যাবে না। আমি একা যাব।

ড্রাইভারটি বলল, বাসে চলে যাও। অনেক শস্তা পড়বে!

এবার সন্তু বুঝল। তার বয়েসী ছেলেরা কলকাতা শহরে একা একা ট্যাক্সি চড়ে না, ট্রামে বাসে যায়। তাই ট্যাক্সি-ড্রাইভাররা তাকে পাত্তা দিচ্ছে না। কিন্তু ট্রামে বাসে চেপে কি কাউকে ফলো করা যায়?

আর একটু হাঁটতে-হাঁটতে সন্তুর মাথায় একটা বুদ্ধি এল। কলকাতায় এখন তো গাড়িও ভাড়া পাওয়া যায়। অনেক জায়গায় সে Rent A Car সাইনবোর্ড দেখেছে। কাকাবাবু তাকে পাঁচশো টাকা দিয়ে দিয়েছেন, এই টাকায় সারাদিনের জন্য একটা গাড়ি ভাড়া করা যেতে পারে অনায়াসে।

এদিকে কোথায় Rent A Car আছে? খুব দরকারের সময় ঠিক সেই জিনিসটাই পাওয়া যায় না। আগে থেকেই এসব চিন্তা করা উচিত ছিল। যাই হোক, কাকাবাবু বলেছেন উপস্থিত বুদ্ধি খাটাতে। কোনও পেট্রোল পাম্পে গেলে ওরা নিশ্চয়ই গাড়ির খবর দিতে পারবে।

ভবানীপুরের দিকে একটা পেট্রোল পাম্প আছে। কিন্তু সেখানে জিজ্ঞেস করতে হল না, পাম্পের পাশেই সন্তু একটা গাড়ি ভাড়ার সাইন বোের্ড দেখতে পেল। সেখানে ব্যবস্থা হয়ে গেল সহজেই। ড্রাইভার সমেত গাড়ি পাওয়া যাবে, ঘন্টা হিসাবে ভাড়া দিতে হবে। আড়াইশো টাকা জমা দিয়ে দিল সন্তু। তার বেশি ভাড়া হলে বাড়ি পৌঁছে দেওয়া যায়।

নতুন একটা গাড়িই পাওয়া গেল। ড্রাইভারটি তেইশ-চব্বিশ বছর বয়েসের, বেশ চটপটে ধরনের। গাড়িতে ওঠার পর সন্তু যেন নিজের বয়েসের চেয়েও বড় হয়ে গেল। গাড়িটাকে নিজের গাড়ি বলে মনে করা যায়।

সে বলল, প্রথমে বউবাজার চলুন।

ড্রাইভার জিজ্ঞেস করল, বউবাজারে কোথায়?

সন্তু বলল, কোথায় মানে? বউবাজার মানে বউবাজার!

ড্রাইভার বলল, বউবাজার রাস্তাটা তো শিয়ালদা থেকে আরম্ভ আর ডালহাউসিতে শেষ। সেইজন্যই জিজ্ঞেস করছি, কোন্ দিকে যাব!

সন্তু বলল, শিয়ালদা থেকে শুরু করুন, ডালহাউসি পর্যন্ত চলুন। আর-একটা কথা শুনে রাখুন। আমি টাকা দিয়ে গাড়ি ভাড়া করেছি, আমি যেখানে খুশি যাব। কোথায় যাচ্ছি, কেন যাচ্ছি, এসব কিছু জিজ্ঞেস করবেন না!

গাড়িটা শিয়ালদার দিক থেকে বউবাজারে ঢুকে চলে এল রাইটার্স বিল্ডিং পর্যন্ত। তারপর ড্রাইভারটি জিজ্ঞেস করল, এবার?

সন্তু নিজেই বুঝতে পারছে না, এত বড় রাস্তায় কোথায় সে অসিতকে খুঁজবে। কোন্ বাড়িতে সে গেছে, তা জানা অসম্ভব। কিন্তু এখন ফিরে গিয়ে কাকাবাবুকে যদি বলতে হয়, অসিতকে সে হারিয়ে ফেলেছে, তার চেয়ে লজ্জার আর কিছু হতে পারে না।

সে ড্রাইভারটিকে বলল, গাড়ি ঘুরিয়ে নিন, আবার শিয়ালদার দিকে চলুন।

গাড়িটা আবার শিয়ালদার প্রায় কাছাকাছি পৌঁছে গেছে, তখন সন্তু চেঁচিয়ে উঠল, থামান, থামান।

ড্রাইভারটি ঘ্যাঁচ করে ব্রেক কষল।

উলটো দিকে একটা ট্যাক্সি থৈমে আছে। সন্তু সেদিকে চেয়ে রইল একদৃষ্টিতে। হঠাৎ তার বুকের ভেতরটা ধক করে উঠল।

অসিত যখন এলগিন রোডে ট্যাক্সিতে চাপে, সেই সময়টার দৃশ্যটুকু সে প্রাণপণে নিখুঁতভাবে মনে করার চেষ্টা করছিল। ট্যাক্সিটার নাম্বার সে ভাল করে দেখেনি, কিন্তু শেষে দুটো জিরো ছিল। আর ড্রাইভারটির মুখে তিন-চারদিনের খোঁচা-খোঁচা দাড়ি। এই তো সেই ট্যাক্সি।

ট্যাক্সিটার মিটার ডাউন করা, আর ড্রাইভারটি এমনভাবে গা এলিয়ে দিয়ে বিড়ি খাচ্ছে যে বোঝা যায়, কেউ তাকে ভাড়া করে রেখেছে। এই ড্রাইভারের কাছ থেকে কায়দা করে জেনে নেওয়া যায়, অসিত কোথায় নেমেছে।

ট্যাক্সিটা দাঁড়িয়ে আছে একটা বড় গয়নার দোকানের সামনে। আবার বুক কেঁপে উঠল সন্তুর। নবাবের সেই চুনির মালা এখানে বিক্রি করতে এসেছে অসিত?

গাড়ি থেকে নেমে অন্য ফুটপাথে চলে এল সন্তু। দোকানটার সামনে দিয়ে হেঁটে গেল। হ্যাঁ, ঠিক, একটু ভেতর দিকে চেয়ারে বসে আছে অসিত, মন দিয়ে কথা বলছে একজনের সঙ্গে।

খবরটা এক্ষুনি জানানো দরকার কাকাবাবুকে। টেলিফোন পাওয়া যাবে কোথায়? ইংরেজি ছবিতে দেখা যায়, ওদের দেশের রাস্তার মোড়ে মোড়ে পাবলিক টেলিফোনের কাচের ঘর থাকে। আমাদের দেশে সেসব কিছু নেই। পোস্ট অফিসে ফোন করা যায়, কিন্তু সেখানে সব সময় লোক থাকে। কেউ টেলিফোন করলে অন্যরা কান খাড়া করে সব কথা শোনে।

বেশি দূর যাওয়া যাবে না, অসিত যদি বেরিয়ে পড়ে।

কাছাকাছি একটা ওষুধের দোকানে ঢুকে পড়ে সন্তু কাঁচুমাচু মুখ করে বলল, একটা ফোন করতে দেবেন? আমার খুব দরকার। যা পয়সা লাগে দেব।

দোকানের একজন কর্মচারি বলল, দু টাকা।

সন্তু ডায়াল ঘোরাতে ঘোরাতে মনে-মনে বলতে লাগল, হে ভগবান, যেন, নাম্বারটা পাওয়া যায়। টেলিফোনের দেবতা কে? বিশ্বকর্মা? হে বিশ্বকর্মা, যেন নাম্বারটা পাওয়া যায় তাড়াতাড়ি।

একবারেই পাওয়া গেল। কাকাবাবুর গলা শুনেই সন্তু বলল, কাকাবাবু, পার্টি এখন বউবাজারেএকটা গয়নার দোকানে, পার্টি অনেকক্ষণকথা-কলছ।

কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, দোকানটার নাম কী?

সন্তু উঁকি দিয়ে দোকানটার নাম দেখে নিয়ে বলল, এস. পি. জুয়েলার্স!

কাকাবাবু বললেন, ঠিক আছে। তুই নজর রাখ।

সন্তু বলল, আমি আর ওকে চোখের আড়ালে যেতে দিচ্ছি না!

ফোন রেখে সন্তু দোকান থেকে বেরিয়ে গাড়িতে এসে বসল। ট্যাক্সিটা থেমে আছে। অসিতের বেরোবার নাম নেই।

কাঁধের ঝোলা থেকে সন্তু একটা বই আর ক্যামেরাটা বার করল। এমনিই গয়নার দোকানটার ছবি তুলল দুখানা।

সন্তুর গাড়িটার একটু আগেই আর-একটা সাদা রঙের গাড়ি থেমে আছে। তাতে বসে আছে দুজন লোক। লোক দুটো পেছন ফিরে মাঝে-মাঝে সন্তুকে দেখছে। এরা কারা?

মিনিটদশেক বাদে গয়নার দোকান থেকে বেরোল অসিত। হাতে সেই কালো ব্যাগ। ওই ব্যাগ ভর্তি কি হার বিক্রির টাকা?

অসিত ফুটপাথে দাঁড়িয়ে এদিক-ওদিক তাকাল, তারপর একটা সিগারেট ধরাল।

সেই ফাঁকে অসিতের একটা ছবি তুলে নিল সন্তু।

সামনের সাদা গাড়িটা থেকে একজন লোক নেমে গিয়ে ঢুকে গেল ওই গয়নার দোকানে। অসিতের ট্যাক্সিটা স্টার্ট দিতেই সাদা গাড়িটাও চলতে শুরু করল।

সন্তু বেশ অবাক হয়ে গেল। এই সাদা গাড়িটাও অসিতকে ফলো করছে। নাকি?

বউবাজার আর কলেজ স্ট্রিটের মোড়ের কাছে ট্র্যাফিক জ্যাম। গাড়িগুলো নড়ছে না। সন্তু ছটফট করতে লাগল। অসিত কিন্তু মন দিয়ে একটা বই পড়ছে, কোনওদিকে তাকাচ্ছে না।

কিসের জন্য এমন জ্যাম হয়েছে দেখার জন্য সন্তু গাড়ি থেকে নেমে গেল। অসিতের ট্যাক্সিটা ডান পাশের দ্বিতীয় সারিতে একটু এগিয়ে আছে। অসিতকে ভাল করে দেখার জন্য সন্তু সেই ট্যাক্সির পাশ দিয়ে হেঁটে গেল। অসিতের ব্যাগে নিশ্চয়ই কয়েক লক্ষ টাকা আছে, তবু জ্যাম নিয়ে তার কোনও চিন্তা নেই, সে বই পড়ে যাচ্ছে মন দিয়ে।

একেবারে সামনের দিকে এসে সন্তু দেখল একটা লরি থেকে অনেকগুলো বস্তা পড়ে গেছে মাটিতে, লরিটাও বোধ হয় খারাপ হয়ে গেছে, সেইজন্য অন্য গাড়িগুলোও যেতে পারছে না। একজন পুলিশ কনস্টেবল এসে হম্বি-তম্বি করছে সেখানে।

একটু বাদে রাস্তা পরিষ্কার হল। ডান দিকে ঘুরে গিয়ে খানিক দূরে অসিতের ট্যাক্সিটা থামল। পাশেই একটা ব্যাঙ্ক। অসিত ওখানে টাকাগুলো জমা দেবে? সত্যিই অসিত ঢুকে গেল ব্যাঙ্কের মধ্যে।

অন্য সাদা গাড়িটাও এখানে থেমেছে। তার থেকে কালো চশমা পরা একজন লোক নেমে ব্যাঙ্কের মধ্যে চলে গেল অসিতের পেছন-পেছন। এই সাদা গাড়ির লোকেরা কি অসিতের কাছ থেকে টাকাগুলো কেড়ে নেওয়ার মতলবে আছে? ব্যাঙ্কের ভেতরে গিয়ে ডাকাতি করবে?

অসিত ট্যাক্সিটা ছাড়েনি। কাকাবাবু বলেছেন, অসিত কোথায় যায়, কার সঙ্গে দেখা করে, সেইসব লক্ষ রাখতে। অসিত ব্যাঙ্কে টাকা জমা দিতে গেলে তো সন্তু বাধা দিতে পারবে না! ডাকাতরা অসিতের ওপর হামলা করলেই বা সে কী করবে?

সন্তু গাড়িতে বসে রইল। একটা বই খুলেও পড়তে পারল না। প্রত্যেক মুহূর্তে তার মনে হচ্ছে ব্যাঙ্কের মধ্যে গোলাগুলির আওয়াজ শুনতে পাবে।

সেরকম কিছুই হল না।

মিনিট দশেক বাদে অসিত বেরিয়ে এল ব্যাঙ্ক থেকে। ট্যাক্সিতে ওঠার আগে আবার সে চারদিকটা একবার দেখে নিল। সন্তু মাথাটা নিচু করে নিল, যাতে তার দিকে অসিতের নজর না পড়ে।

অসিতের ট্যাক্সি এবার চলতে লাগল উত্তর কলকাতার দিকে। আবার অসিত বই খুলে পড়তে শুরু করেছে। সন্তু ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল, সাদা গাড়িটাও আসছে পেছনে-পেছনে।

কলেজ স্ট্রিটের বইপাড়া ছাড়িয়ে গিয়ে অসিতের ট্যাক্সি থামল একটা বড় জুতোর দোকানের সামনে। সন্তুকে অবাক করে অসিত ঢুকে গেল সেই জুতোর দোকানের মধ্যে। এটা কি জুতো কেনার সময়? বড় বড় চোর ডাকাতদের কারও হঠাৎ জুতো কেনার শখ হয়, এটা কেমন যেন অদ্ভুত।

জুতোর দোকানে সবাই ঢুকতে পারে। সন্তু নিজের জন্য একটা চটিই না হয় কিনে ফেলবে। সেও ভেতরে চলে এল।

দোকানটাতে বেশ ভিড়। সেল্সম্যানরা সবাই ব্যস্ত। অসিত একটা জায়গায় বসল, কিন্তু সন্তু আর কোনও চেয়ার খালি পেল না। সে দাঁড়িয়ে রইল একপাশে। সাদা গাড়ি থেকে কালো চশমা পরা লোকটাও নেমে এসেছে। চশমায় লোকটার চোখ ঢাকা, কোন দিকে তাকায় তা বোঝা যায় না। এই লোকটা কার ওপর নজর রাখছে? এমন কী হতে পারে যে, এই লোকটা অসিতের বডি গার্ড? কিন্তু বডি গার্ড গাড়ি করে ঘুরছে, আর অসিত কেন ট্যাক্সিতে? কিছুই বোঝা যাচ্ছে না।

অসিত হাতের কালো ব্যাগটা পাশে না রেখে কোলের ওপর নিয়ে বসে আছে। সন্তু এসে দাঁড়াল ঠিক তার পেছনে।

একটু বাদে একজন সেলসম্যান এল অসিতের কাছে। অসিত গম্ভীরভাবে বলল, চটি দেখান। বাড়িতে পরার ভাল চটি।

সেলসম্যান বলল, আপনার পায়ের মাপটা দেখি, সার!

অসিত পা থেকে জুতো-মোজা খুলে ফেলল।

সেলসম্যানটি দু জোড়া চটি আনতেই অসিত সেগুলো পায়ে না দিয়েই বিরক্তভাবে বলল, এগুলো কী এনেছেন? আমি কম দামি জিনিস চাইনি। সবচেয়ে ভাল ডিজাইনের কী কী চটি আছে দেখান!

সেলসম্যানটি বলল, ভেতর থেকে আনতে হবে। একটু বসবেন সার? আপনার পায়ের সাইজ দশ নম্বর। দশ নম্বরের চটির বেশি ডিজাইন নেই। পেছনের গোডাউন থেকে আনব, পাঁচ মিনিট লাগবে।

অসিত বলল, ঠিক আছে, আনুন।

কালো ব্যাগটা খুলে একটা বই বার করে সে পড়তে লাগল ওইটুকু সময়, কাটাবার জন্য।

সন্তু উঁকি মেরে দেখল, বইটার প্রত্যেক পাতার তলায়-তলায় রঙিন ছবি।

এই সময় একটা কাণ্ড ঘটল। দারুণ সাজগোজ করে একজন খুব ফর্সা মহিলা ঢুকলেন সেই দোকানে। সঙ্গে ছোটখাটো একটা দল। মহিলার মুখখানা কেমন যেন চেনা-চেনা মনে হল সন্তুর।

দোকানের সব লোক ফিসফাস করতে লাগল। অনেকে সেই মহিলার কাছে এগিয়ে গেল। একজন কেউ চেঁচিয়ে বলল, ডিম্‌প্‌ল! ডিম্‌প্‌ল!

মহিলাটি হিন্দি সিনেমার নায়িকা। সন্তু হিন্দি সিনেমা দেখে না, কিন্তু সারা কলকাতার দেওয়ালে এইসব নায়িকার এত ছবি থাকে যে, মুখগুলো চেনা হয়ে। যায়।

হিন্দি সিনেমার নায়িকা এই দোকানে এসেছে জুতো কিনতে, তাই হইচই পড়ে গেল সারা পাড়ায়। দোকানের বাইরে ভিড় জমে গেল। দোকানের ম্যানেজার বলল, ছবি তুলে রাখতে হবে, ক্যামেরা, ক্যামেরা!

দু-তিনটে ক্যামেরা বেরিয়ে পড়ল।

অসিত হিন্দি সিনেমার নায়িকাটিকে গ্রাহ্য করল না। একবার শুধু ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে আবার মন দিল বইয়ের পাতায়।

বাইরে থেকেও অনেক লোক ক্যামেরা নিয়ে ঢুকে এল। সবাইকে ছবি তুলতে দিতে হবে। নায়িকাটির তাতে কোনও আপত্তি নেই। দোকানের ঠিক মাঝখানে তিনি পোজ দিয়ে দাঁড়ালেন। অনেকগুলি ক্যামেরার ফ্ল্যাশ বা জ্বলে উঠল।

সন্তুই বা এই সুযোগ ছাড়বে কেন? সেও তার ক্যামেরা বার করল। কিন্তু নায়িকার ছবি তুলল মোটে একটা, আর তিনখানা ছবি তুলল শুধু অসিতের। এত ফ্ল্যাশ জ্বলছে যে, অসিত কোনও সন্দেহ করল না। অসিতের খুব ক্লোজআপ ছবি তুলে নিল সন্তু, যদিও এত ছবি কী কাজে লাগবে সে জানে না, কিন্তু একটা কিছু তো করতে হবে।

সেই নায়িকাকে নিয়ে সবাই এমন ব্যস্ত হয়ে পড়ল যে, অসিতের কাছে আর কেউ এলই না। অসিত ঘড়ি দেখল, দশ মিনিট কেটে গেছে।

বেশ রাগের সঙ্গে সে আবার মোজা-জুতো পরল, তারপর গটমট করে বেরিয়ে গেল।

সন্তু ভেবেছিল, জুতো কেনাটা একটা ছুতো, অসিত নিশ্চয়ই এখানে কারও সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল। জুতো কেনার ছলে কোনও গোপন কথা বলা কিংবা কোনও জিনিস পাচার করে দেওয়া সহজ।

কিন্তু সেরকম কিছুই হল না। কালো ব্যাগটা নিয়ে অসিত আবার ট্যাক্সিতে উঠে গেল।

এ-পাড়ায় অনেক জুতোর দোকান। কিন্তু অন্য কোনও দোকানে আর গেল অসিত। জুতো কেনার দরকার নেই, না খুব রেগে গেছে?

এবার অসিতের গাড়ি চলে এল ডালহাউসিতে। ট্রেনের টিকিটের বড় অফিসটার সামনে থামল। ট্রেনের টিকিট কাটবে? কোথাকার টিকিট কাটছে, সেটা জানা খুব দরকার। সন্তুও ঢুকে পড়ল সেখানে। টিকিট কাটার অনকেগুলো লাইন। অসিত কিন্তু কোনও লাইনে দাঁড়াল না। একপাশের একটা ছোট দরজা দিয়ে ঢুকে গেল ভেতরে। সন্তুও সেখান দিয়ে ঢুকতে যেতে একজন লোক তাকে আটকাল। ভেতরে যাওয়া নিষেধ। অসিত নিশ্চয়ই কোনও চেনা লোকের নাম বলেছে। ভেতর থেকে সে টিকিট কাটবে।

অগত্যা সন্তুকে ঘোরাঘুরি করতে হল বাইরে। সাদা গাড়ির কালো চশমা পরা লোকটাও বাইরে দাঁড়িয়ে আছে।

সেখান থেকে বেরিয়ে অসিত গেল সার্কুলার রোড আর ল্যান্সডাউনের মমাড়ের কাছে একটা দোকানে। এখানে পুরনো দামি-দামি জিনিস বিক্রি হয়। অ্যান্টিকের দোকান। অসিতেরও এই ব্যবসা।

দোকানের কাউন্টারে দাঁড়িয়ে মাত্র মিনিট পাঁচেক কথা বলল, কিছু নিল না কিংবা দিল না। অন্তত দেখা গেল না সেরকম কিছু। কাউন্টারের লোকটা তার চেনা, সে হাসিমুখে বারবার অসিতকে হাত ধরে টেনে ভেতরে বসাবার চেষ্টা করল, অসিত বলল, সময় নেই, খুব ব্যস্ত আছি।

দুপুর প্রায় বারোটা। আকাশে গনগনে রোদ। প্রথম প্রথম সন্তু যতটা উত্তেজনা বোধ করছিল, এখন তা অনেকটা থিতিয়ে আসছে। অসিত কোথায় যেন যাচ্ছে, তা ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। কিন্তু সন্তু আর কী করতে পারে? এর চেয়ে বেশি কাছাকাছি গেলে অসিত বুঝে যাবে।

থিয়েটার রোডের দুটো দোকানেও থামল অসিত। একটা ফ্ল্যাট বাড়িতে ঢুকে লিফট দিয়ে ছ তলায় উঠে গেল। সন্তু সাহস করে একই লিফটে উঠে গেল ওর সঙ্গে। অসিত বাঁ দিকের একটা ফ্ল্যাটে বেল বাজাল। দরজা খুলে একজন অসিতকে দেখে কী যেন বলল, আনন্দের সঙ্গে। লোকটা যেন

অসিতেরই অপেক্ষায় ছিল। সন্তু তাড়াতাড়ি ডান দিকের একটা অচেনা ফ্ল্যাটে . বেল বাজাল, তার বুক ঢিপ ঢিপ করছে। অসিত তার দিকে মনোযোগ দেয়নি, ওদিকের লোকটি অসিতকে ভেতরে ঢুকিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল, এদিকের ফ্ল্যাটের দরজা তখনও খুলল না, বোধ হয় ভেতরে কেউ নেই। সন্তু আর দেরি না করে নেমে গেল নীচে।

অসিত কিন্তু ট্যাক্সিটা ছাড়েনি। সাদা গাড়িটাকে আর দেখা যাচ্ছে না।

এবার আধ ঘন্টা বাদে নীচে নামল অসিত। এর মধ্যে সন্তু গাড়িতে বসে বসে তার নোট বুকে টুকে নিয়েছে অসিত কোথায়-কোথায় গেছে। গয়নার দোকান, ব্যাঙ্ক, জুতোর দোকান, রেলের টিকিটের অফিস, অ্যান্টিক শপ, ফোটোগ্রাফি শপ, ঘড়ির দোকান, থিয়েটার রোডের বলাকা বাড়ির ফ্ল্যাট নং ৬বি।

ট্যাক্সিটা খুব কাছেই একটা হোটেলের মধ্যে ঢুকে পড়ল।

এই হোটেলটার বাইরের বাগানে অনেকগুলো রঙিন ছাতা পোঁতা আছে। তার নীচে একটা করে টে। অসিত বসল সেরকম একটা টেবলে। বোঝ যাচ্ছে, এবার সে লাঞ্চ খাবে।

সন্তুরও খিদে পেয়ে গেছে। পকেটে এখনও আড়াইশো টাকা আছে। সেও এখানে খেয়ে নিতে পারে। গাড়ির ড্রাইভারকে সে জিজ্ঞেস করল, আপনি খেয়ে এসেছেন? আপনি এখানে খাবেন?

ড্রাইভারটি বলল, সে খেয়ে-দেয়েই ডিউটি করতে এসেছে। এখন কিছু খাবে না।

সন্তু হোটেলের বাগানে অসিতের থেকে খানিকটা দূরের একটা ছাতার তলায় বসল। বেয়ারা আসবার পর সে অর্ডার দিল তন্দুরি নান আর রেশমি কাবাব। এত বড় হোটেলে সন্তু আগে কখনও একা একা আসেনি। তার বয়েসী আর কেউ নেইও এখানে।

অসিতের টেবিলে এসে বসল দুটি মেয়ে। একজনের বয়েস সতেরো-আঠারো, আর একজনের তিরিশের কাছাকাছি। আগে থেকেই ওদের আসার কথা ছিল? না, এখানে হঠাৎ দেখা হয়ে গেল, তা ঠিক বোঝা গেল না। তবে বেশ ভালরকম চেনা, তা বোঝা গেল!

এবার কোটের পকেট থেকে একটা লাল পাথরের মালা বার করল অসিত। সন্তুর চোখ দুটো ছানাবড়া হওয়ার উপক্রম। এই সেই নবাব সিরাজদ্দৌল্লার দেওয়া চুনির হার! এরকম সবার সামনে বার করে দেখাচ্ছে অসিত? অবশ্য এখানে অন্য কেউ ওটার কথা জানে না।

একজন বেয়ারা ওদের টেবিলে অর্ডার নিতে এসেও হাঁ করে মালাটা দেখতে লাগল। মেয়ে দুটিও এ একবার, ও একবার মালাটা হাতে নিয়ে দেখছে।

সন্তু একটা জয়ের নিঃশ্বাস ফেলল। যাক, ওই বিখ্যাত মালাটা যে অসিত চুরি করেছে, তা প্রমাণ হয়ে গেল। নিজের চোখেই তো দেখল সন্তু। এর পর কাকাবাবু যা করবার করবেন।

ক্যামেরাটা বার করে যেন এমনিই নাড়াচাড়া করছে, এমন ভান করে সন্তু খচাখচ কয়েকটা ছবি তুলে ফেলল ওই টেবিলের। মেয়ে দুটির ছবি তোেলা থাক, পরে কাজে লাগবে।

সাদা গাড়ির কালো চশমা পরা লোকটাকে এখন আবার দেখা গেল এখানে। সে কোনও টেবিলে বসল না, শুধু একবার পাশ দিয়ে ঘুরে গেল। সন্তু তারও ছবি তুলে নিল চট করে। এ-লোকটা যদি গুণ্ডা হয়, তা হলে একেও পরে চেনা যাবে। অবশ্য কালো চশমার জন্য তার মুখখানা ভাল বোঝা যাচ্ছে না। তবে লম্বা, গাঁট্টাগোট্টা চেহারাটা গুণ্ডাদেরই মতন।

অসিত তার কালো রঙের ব্যাগটা পাশে নামিয়ে রাখেনি, এখানেও কোলের ওপর রেখেছে। ব্যাগটাতে আরও কী আছে? টাকা? এমনকী হতে পারে যে, এই মেয়ে দুটো চুনির হারটার দাম আগেই দিয়ে দিয়েছে, অসিত ব্যাঙ্ক থেকে সেই চেক ভাঙিয়ে নিল?

ওরা অনেক খাবারের অর্ডার দিয়েছে। সন্তু আস্তে-আস্তে খেতে লাগল। বেশ খানিকটা সময় লাগবে মনে হচ্ছে। সন্তু এক গেলাস লস্যি নিল।

কালো চশমা-পরা লোকটা দূরে ঘোরাঘুরি করছে। ওর কাছে যদি রিভলভার থাকে, তা হলে তো এখন ওই দামি চুনির হারটা কেড়ে নেওয়া কিছুই নয়। লোকটা নিচ্ছে না কেন?

যে-মেয়েটির কম বয়েস, সে এখন মালাটা গলায় পরে আছে। রোদ্দুরে ঝকঝক করছে লাল রঙের পাথরগুলো।

ওদের খাওয়া শেষ হতে দেরি আছে। সন্তু ঝট করে একবার উঠে গেল। বাগানের রেস্তরাঁর একপাশেই হোটেল। এখানে লোক থাকে। লবিতে ফোন রয়েছে কয়েকটা। সন্তু পয়সা ফেলে ফোন করল বাড়িতে।

কাকাবাবু নেই, মা ধরলেন।

সন্তু একটু নিরাশ হয়ে বলল, কাকাবাবু নেই? ফিরলেই বলবে, গ্রিনভিউ হোটেল, একটি সতেরো বছর বয়েসী মেয়ে, চুনির মালা!

মা দারুণ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কী বললি?

সন্তু বলল, মনে রাখতে পারবে না? গ্রিনভিউ হোটেল, একটি সতেরো বছর বয়েসী মেয়ে..

তার মানে কী?

তোমাকে মানে বুঝতে হবে না। শুধু কথাগুলো মনে রাখবে!

গ্রিনভিউ হোটেল? তুই সেখানে কী করছিস?

কাজ আছে। কাজ আছে।

একটা সতেরো বছরের মেয়ে। তার সঙ্গে তোর কী করে ভাব হল? সন্তু, ওইসব হোটেলের মেয়েদের সঙ্গে ভাব করতে তোকে কে বলেছে?

আঃ, কে বলেছে যে আমার সঙ্গে ভাব হয়েছে? তার সঙ্গে আমার কোনও কথাই হয়নি!

তবে তার কথা বলছিস কেন?

তা তুমি বুঝবে না। শুধু কথাগুলো মনে রাখবে।

তুই দুপুরে বাড়িতে খেতে আসবি না?

না।

ফোন রেখে সন্তু আবার তাড়াতাড়ি নিজের জায়গায় ফিরে গেল।

ওরা বিল মেটাচ্ছে। সন্তু আগেই বিল দিয়ে দিয়েছে, নিজের থলেটা তুলে নিয়ে চলে গেল এক কোণে।

ওরা খাবার টেবিল ছেড়ে চলে গেল হোটেলের লবির দিকে। সেখানে গিয়ে দাঁড়াল লিফটের সামনে। ওই হোটেলেরই কোনও ঘরে মেয়ে দুটি থাকে তা হলে! কেননা, অল্প বয়েসী মেয়েটি চাবি চেয়ে আনল কাউন্টার থেকে।

লিফট থামার পর অল্প বয়েসী মেয়েটি ঢুকে গেল, অসিত আর অন্য মহিলাটি গেল না। দূর থেকে সন্তু দেখল, সেই কম বয়েসী মেয়েটির গলায় দুলছে চুনির মালা। অন্য মহিলাটি ও অসিত হোটেল থেকে বেরিয়ে এসে ওদের ট্যাক্সিতে উঠল।

সন্তু একবার ভাবল, বাচ্চা মেয়েটা হোটেলের ঘরে একলা থাকবে, ওর কাছ থেকে এখন যদি চুনির মালাটা কেউ কেড়ে নেয়? সন্তুর কি উচিত মেয়েটার ঘরের বাইরে পাহারা দেওয়া? কিন্তু মেয়েটা লিফটে উঠে কোন্ তলায়, কত নম্বর ঘরে গেল কে জানে!

তা ছাড়া কাকাবাবু তাকে বলেছেন, অসিতকে ফলো করতে।

অসিতদের ট্যাক্সি এল নিউ মার্কেটে। এখানে বিভিন্ন দোকানে ঘুরে ঘুরে ওরা গেঞ্জি, রুমাল, মোজা কিনল অনেকগুলো। এক দোকান থেকে চটিও কিনল অসিত। সন্তু পেছন-পেছন ঘুরছে, তার আর কিছুই করার নেই।

নিউ মার্কেটে কেনাকাটা সেরে অসিত সেই মহিলাকে নিয়ে ইডেন গার্ডেনের পাশ দিয়ে চলে এল গঙ্গার ধারে। খানিকটা যাওয়ার পর এক জায়গায় ট্যাক্সিটা থামাল। তার থেকে নেমে এবার অসিত ভাড়া মিটিয়ে দিল, খালি ট্যাক্সিটা ঘুরে চলে গেল উলটো দিকে।

গঙ্গার ধার দিয়ে অলসভাবে পাশাপাশি হাঁটছে অসিত আর সেই মহিলাটি। দুজনে মাথা নেড়ে কী যেন বলছে। কেউ রাস্তা দিয়ে আস্তে-আস্তে হাঁটলে, তাকে গাড়ি নিয়ে ফলো করা যায় না। সেটা বিচ্ছিরি দেখায়। সন্তুও গাড়িটাকে এক জায়গায় থামতে বলে নেমে পড়ল। অসিত এখনও তাকে লক্ষ করেনি। একবারও তার দিকে ফিরে চায়নি। একজন ছোট ছেলে অনুসরণ করবে, এরকমটা কেউ ভাবতে পারে না।

সন্তু ঠিক করল, অসিতের খুব কাছাকাছি গিয়ে হাঁটবে। ওরা কী কথা বলছে, তা শোনার চেষ্টা করবে।

কিন্তু কিছুই শোনা গেল না। ওদের কাছাকাছি যেতেই অসিত সেই মহিলাকে নিয়ে একটা সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেল জলের ধারে। সেখানে একটা নৌকো থেমে আছে। নৌকোর মাঝির সঙ্গে দু-একটা কী কথা বলে ওরা নৌকোয় উঠে গেল, মাঝিটিও দড়ি খুলে দিল। সন্তু মহা ফাঁপরে পড়ে গেল। এবার কী করা যায়? কাছাকাছি আর কোনও নৌকো নেই। একটু দূরেই গোটা দু-এক জাহাজ দাঁড়িয়ে আছে। অসিতদের নৌকোটা সেইদিকেই যাচ্ছে, একটু বাদেই জাহাজের আড়ালে চলে যাবে।

সেই সাদা রঙের গাড়িটাকে অনেকক্ষণ দেখেনি সন্তু। হঠাৎ কোথা থেকে খুব জোরে এসে থামল। কালো চশমা পরা লোকটি নেমে এসে দৌড়ে গঙ্গার ধারে রেলিং-এর কাছে গিয়ে দেখল অসিতদের নৌকোটা। মনে হল, এই লোকটাও খুব হতাশ হয়েছে। গাড়ি নিয়ে তো কোনও নৌকোকে ফলো করা যায় না। গঙ্গায় আরও অনেক নৌকো ভাসছে, কিন্তু এখানে ঘাটের কাছে একটাও নেই।

কালো চশমা-পরা লোকটা আবার ফিরে এল নিজের গাড়ির কাছে। একবার যেন সন্তুর দিকে তাকিয়ে একটু হাসল। কিংবা অন্য কোনও কারণেও হাসতে পারে। তার গাড়িটা স্টার্ট নিয়েই ফুল স্পিডে চলে গেল হাওড়া ব্রিজের দিকে।

সন্তু ক্যামেরা বার করে নৌকোটার ছবি তোলার চেষ্টা করল। কিন্তু শাটার টেপা গেল না। তার মানে ফিল্ম শেষ।

সন্তুর মনে হল, আর অসিতকে ফলো করা মানে বৃথা চেষ্টা। শুধু-শুধু গাড়ি ভাড়া বাড়বে। নৌকো থেকে অসিত কোথায় নামবে, তার কি কোনও ঠিক আছে? গঙ্গার ওপারে চলে যেতে পারে।

গাড়িতে উঠতেই ড্রাইভারটি জিজ্ঞেস করল, এবার কোথায় যাব? ট্যাক্সিটা তো চলে গেল, লোকটাকে এখন কোথায় পাবেন?

সন্তু ধমক দিয়ে বলল, আপনাকে বলেছি না, কোথায় যাব, কেন যাব জিজ্ঞেস করবেন না। এখন আমার বাড়িতে চলুন।

ড্রাইভারটি ধমক খেয়েও মজা করে বলল, আপনার বাড়ি কোথায়, সেটা কি আমার জানার কথা? আপনি কি রাজভবনে থাকেন?

সন্তু বলল, সোজা চলুন। তারপর বাঁ দিকে।

একদম বাড়ির সামনে না গিয়ে কাছাকাছি এসে গাড়িটাকে ছেড়ে দিল সন্তু। বাড়ি চিনিয়ে দেওয়া উচিত নয়। ড্রাইভারকে আর কিছু টাকা দিতে হল।

সন্তুদের পাড়াতেই একটা ফোটোগ্রাফির দোকান আছে, সেখানে এক ঘন্টার মধ্যে ফিল্ম ডেভেলাপ করে প্রিন্ট দেয়। সন্তুর নতুন ক্যামেরা, তাই ছবিগুলো দেখার খুব ইচ্ছে। ফিমের রোল্টা খুলে সেখানে জমা দিয়ে বাড়ি ফিরে গেল সন্তু।
কাকাবাবু সন্তুর প্রথম ফোন পাওয়ার পরই বেরিয়ে গিয়েছিলেন, দুপুরে আর বাড়িতে আসেননি। ফিরলেন প্রায় রাত আটটার সময়।

সারা দিনের রিপোর্ট দেওয়ার জন্য সন্তু ছটফট করছিল। কাকাবাবু না ফিরলে সে বাড়ি থেকে বেরোতে পারছিল না। একবার শুধু দৌড়ে গিয়ে ছবিগুলো নিয়ে এসেছে। অনেকগুলো ছবিই উঠেছে বেশ ভাল।

কাকাবাবু ক্লান্ত হয়ে ফিরেছিলেন। প্রথমেই স্নান করলেন, তারপর নিজের ঘরে এক কাপ কফি নিয়ে বসার পর সন্তু বলল, কাকাবাবু, আমি সকাল পৌনে দশটা থেকে বিকেল চারটে পর্যন্ত অসিত ধরকে ফলো করেছি, তারপর ওকে হারিয়ে ফেললাম। আর কোনও উপায় ছিল না। এতে কোনও কাজ হল কি?

কাকাবাবু বললেন, তুই আগাগোড়া দারুণ উপস্থিত বুদ্ধির পরিচয় দিয়েছিস। কোনও পেশাদার গোয়েন্দাও এত ভালভাবে কাজটা করতে পারত না।

সন্তু বলল, চুনির মালাটা যে অসিত ধর নিয়েছে, সেটা তো বোঝা গেছে। সেই মালাটা আছে গ্রিন ভিউ হোটেলে একটা মেয়ের কাছে। সেটা কী করে উদ্ধার হবে?

কাকাবাবু একগাল হেসে বললেন, ও মালাটা নকল।

সন্তু আঁতকে উঠে বলল, অ্যাঁ নকল? কী করে জানা গেল?

কাকাবাবু বললেন, অসিত ধর অতি চালাক। ও জানত, ওকে ফলো করা হবে। তাই আগাগোড়া তোদের সঙ্গে মজা করেছে। বউবাজারে গয়নার দোকানে খোঁজ নিয়ে জানা গিয়েছে, সেখানে কোনও মালা বিক্রি করেনি, কিছু কেনেওনি। চোরাই চুনির মালার জন্য সে-দোকান সার্চ করা হয়েছিল, সব কর্মচারীরা একবাক্যে বলেছে, ওরকম কোনও মালা দোকানে আসেনি। অসিত। ওখানে কয়েকটা আংটি নিয়ে দর করছিল। শেষ পর্যন্ত কিছু কেনেনি অবশ্য! ব্যাঙ্কে গিয়েও সে কোনও চেক কিংবা টাকা জমা দেয়নি, শুধু দু হাজার টাকা। তুলেছে। সেটা কিছুই না। থিয়েটার রোডে একটা বাড়িতে যে-ফ্ল্যাটে গিয়েছিল, সেই ফ্ল্যাটের মালিক অসিতের মামা হন। অসিত তাঁর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিল। সেই ভদ্রলোক আগে পুলিশে কাজ করতেন, এখন রিটায়ার করেছেন। তাঁকে কোনওক্রমেই সন্দেহ করা যায় না।

সন্তু বলল, দাঁড়াও, দাঁড়াও! অসিত ধর যে থিয়েটার রোডের একটা বাড়িতে গিয়েছিল, সেটা তো তোমাকে এখনও বলিনি। তুমি জানলে কী করে?

কাকাবাবু কয়েক পলক সন্তুর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, তুই সাদা গাড়িটা দেখিসনি?

সন্তু বলল, হ্যাঁ, দেখেছি! ওটা কাদের গাড়ি?

পুলিশের গাড়ি!

আমি তো ভেবেছিলাম গুণ্ডাদের। কালো চশমা-পরা লোকটাকে আমার গুণ্ডা মনে হয়েছিল।

অনেক সময় গুণ্ডা আর সাধারণ পুলিশদের চেহারার তফাত বোঝা যায়। সাদা গাড়িতে সাদা পোশাকে পুলিশ ছিল।

হঠাৎ সন্তুর খুব অভিমান হল। পুলিশই যদি সারাদিন অসিতকে ফলো করে যাবে, তা হলে সন্তুর এত কষ্ট করার কী দরকার ছিল?…

সন্তু অভিযোগের সুরে বলল, পুলিশ ছিল, তা হলে কাকাবাবু, তুমি আমাকে পাঠালে কেন?

কাকাবাবু সন্তুর তোলা ছবিগুলো দেখতে-দেখতে বললেন, পুলিশ যে যাবে, তা আমি আগে জানতাম না রে সন্তু। পুলিশ কমিশনার বলেছিল, অসিতের ব্যাপারে আমাকে কোনও সাহায্য করতে পারবে না। তবু সে গোয়েন্দা দফতরকে বলে অসিতের পেছনে লোক লাগিয়েছিল। আমি পরে জেনেছি। তোর যাতে কোনও বিপদ না হয়, সেদিকেও নজর রেখেছিল পুলিশ। যাই হোক, তুই যৈমনভাবে দেখেছিস, তেমনভাবে তো পুলিশ দেখতে পারে না। তুই আজ পাকা ডিটেকটিভের মতন কাজ করেছিস। পুলিশ তো এত ছবি তোলেনি!

সন্তু তবু নিরাশ গলায় বলল, চুনির মালাটা নকল? আমি ভেবেছিলাম..

কাকাবাবু বললেন, আমি নিজে গ্রিন ভিউ হোটেলে সে মেয়েটির ঘরে গিয়ে দেখেছি। মেয়েটির নাম রাজিয়া। ওর মায়ের নাম নাজিয়া সুলতানা। ওরা লন্ডনে থাকে, কলকাতায় বেড়াতে এসেছে। অসিত লন্ডনেই ওদের চেনে। মেয়েটিকে একটা মালা উপহার দিয়েছে, সেটা চুনি তো নয়ই, আসল পাথরও নয়, ঝুটো। তোদের ঠকাবার জন্যই অমনভাবে দেখিয়ে-দেখিয়ে অসিত মালাটা দিয়েছে।

সন্তু বলল, তা হলে অসিত ধর বীরভূমের সেই পুরনো বাড়ি থেকে কী চুরি করেছে, তা জানা গেল না?

কাকাবাবু বললেন, নাঃ! জানা গেল না। আমার মাথাতেও কিছুই আসছে। হয়তো ও কিছুই চুরি করেনি। আগাগোড়াই আমাদের সঙ্গে প্র্যাকটিক্যাল জোক করছে।

দরজার সামনে এসে দাঁড়াল এ বাড়ির কাজের লোক রঘু। সাড়ে নটা প্রায় বাজে। সন্তু ভাবল, রঘু নিশ্চয়ই খেতে যাবার জন্য তাড়া দিতে এসেছে।

রঘু বলল, নীচে একজন ভদ্রলোক ডাকছে। ওপরে আসবার জন্য খুব পেড়াপিড়ি করছে!

কাকাবাবু ভুরু কুঁচকে বললেন, এত রাতে আবার কে ওপরে আসতে চায়। দেখে আয় তো, সন্তু!

সন্তু নীচে চলে গেল। সদর দরজা দিয়ে বাইরে উঁকি মারতেই সে দারুণ চমকে গেল। এরকম অবাক সে কখনও হয়নি।

বাইরে দাঁড়িয়ে আছে অসিত ধর!

অসিত হেসে বলল, তোমার নামই তো সন্তু, তাই না? আজ সারাদিন কলকাতা দেখা হল কেমন? মাঝে-মাঝে সারা শহরটা এরকম ঘুরে দেখা ভাল।

সন্তুর মুখ দিয়ে কোনও কথাই বেরোল না।

অসিত সন্তুর মাথার চুলে হাত দিয়ে আদর করে বলল, তুমি খুব ব্রাইট বয়। চলো, তোমার কাকাবাবুর সঙ্গে একবার দেখা করে আসি!

সন্তু প্রায় মন্ত্রমুগ্ধের মতন অসিতকে নিয়ে এল ওপরে। অসিতের ব্যবহারের মধ্যে অপছন্দ করার কিছু নেই।

কাকাবাবুর ঘরের দরজার কাছে দাঁড়িয়ে অসিত বেশ নাটকীয়ভাবে বলল, নমস্কার, মিস্টার রায়চৌধুরী, নমস্কার। ভাল আছেন? পায়ের ব্যথাটা কমেছে?

কাকাবাবু বললেন, নমস্কার। আসুন, ভেতরে এসে বসুন।

অসিত একটা সোফায় এসে বসল। এখানেও তার হাতে সেই কালো ব্যাগ। সারা মুখ হাসিতে ভরিয়ে বলল, তা হলে কী ঠিক হল শেষ পর্যন্ত? বোঝা গেল কিছু? আমি বিমানদের বীরভূমের বাড়ি থেকে কিছু চুরি করেছি, না। করিনি?

কাকাবাবু বললেন, আমি হার স্বীকার করছি। আমি এখনও কিছু বুঝতে পারিনি। হয়তো আপনাকে মিথ্যে সন্দেহ করেছি।

অসিত হা-হা করে খুব জোরে হেসে উঠল, তারপর বেশ তৃপ্তির সঙ্গে বলল, আপনি হার স্বীকার করছেন তা হলে? আপনি বিখ্যাত লোক, আপনি অনেক রহস্যের সমাধান করেছেন শুনেছি। আপনার মুখে হার-স্বীকারের কথা শোনাটা একটা নতুন ব্যাপার, কী বলুন?

কাকাবাবু বললেন, নিজের ভুল স্বীকার করতে আমার কোনও লজ্জা নেই। আপনি তা হলে কিছু নেননি ওখান থেকে?

হ্যাঁ, নিয়েছি।

নিয়েছেন? সত্যি, কিছু নিয়েছেন?

সে কথা তো আপনার কাছে আগেই স্বীকার করেছি! আসল প্রশ্ন ছিল, আমি কী নিয়েছি? এবার বলে দিই?.

আগে বলুন, সে-জিনিসটা কোথায় লুকোনো ছিল?

হুঁ! সেটাই বড় কথা। আগে অনেকেই খুঁজেছে। সব্বাই বোকা! চোখ থাকলেও অনেকে অনেক জিনিস দেখতে পায় না। মিস্টার রায়চৌধুরী, আপনার কি মনে আছে যে, বিমানকে আমি বলেছিলাম, তার পাগলা-দাদুর ঘরের খাটের যে চারটে পায়া, সেগুলো বেশ দামি?

সেই খাটের পায়াগুলো আমিও দেখেছি। কাঠের ওপর নানারকম কারুকার্য করা। সেগুলোর কিছু দাম পাওয়া যাবে নিশ্চয়ই!

আপনি আসল ব্যাপারটাই দেখেননি, মিস্টার রায়চৌধুরী। ও ঘরে ঢোকা মাত্র আমি চিনতে পেরেছিলাম। ইতালির ফ্লোরেন্স শহরে বড় লাোকেরা ওই ধরনের খাটের পায়া ব্যবহার করত দুশো-আড়াইশো বছর আগে। ওই খাটের পায়াগুলো মাঝখান থেকে খোলা যায়। ভেতরে গর্ত থাকে। সেই গর্তে বড়লোকেরা দামি-দামি জিনিস লুকিয়ে রাখত।

কাকাবাবু সন্তুর দিকে তাকিয়ে একটু হেসে বললেন, আমার আবার পরাজয়! অসিত ঠিকই বলেছে, খাটের পায়ার মধ্যে দামি জিনিস লুকিয়ে রাখার একটা প্রথা এক সময় ছিল ইউরোপে। বিমানরা তা জানে না। আমিও খেয়াল করিনি। কারণ আমি ধরেই নিয়েছিলাম, আসল দামি জিনিস অসিত আগেই নিয়ে চলে গিয়েছে!

অসিত বলল, এমন কিছু দামি জিনিস নয়। নবাবের দেওয়া চুনির মালা-টালা যে একেবারে বাজে গপ্পো, তা আপনি স্বীকার করবেন? হিরে-জহরত নিয়ে যারা কারবার করে, তারা এসব খবর রাখে। গত পঞ্চাশ বছরের মধ্যে এরকম চুনির মালার কথা কেউ শোনেনি। আমার ধারণা, নবাব সিরাজ যদি সেরকম কোনও মালা দিয়েও থাকেন, তা হলেও ওবাড়ির কোনও পূর্ব পুরুষ পঞ্চাশ-ষাট বছর আগেই সেটা বিক্রি করে দিয়েছেন।

কাকাবাবু বললেন, আমারও তাই মনে হয়। অমন একটা মালা ওবাড়ির দূর সম্পর্কের আত্মীয় এক পাগলের ঘরে থাকা সম্ভব নয়!

অসিত বলল, কিন্তু ওই ধরনের খাটের পায়া দেখেই আমার সন্দেহ হয়েছিল, ভেতরে কিছু লুকোনো আছে। খাটটা বেশ ভারী, সেটা তুলে পায়াগুলো খুলে দেখতে গেলে অনেকটা সময় লাগবে। সেইজন্যই আপনাকে ও-ঘর থেকে কিছুক্ষণের জন্য সরিয়ে দেওয়ার দরকার ছিল, তাই আপনাকে আমি একটা আছাড় খাইয়েছিলাম। আমি দুঃখিত। তবে, আপনার যে অত জোরে লাগবে, পায়ের আধখানা নখ উড়ে যাবে, তা আমি বুঝিনি। ভেবেছিলাম, আপনার মাথায় খানিকটা চোট লাগবে, সবাই আপনাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়বে!

কাকাবাবু বললেন, তাই-ই হয়েছিল। আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেললাম। বিমানরা ব্যস্ত হয়ে আমাকে ও-ঘর থেকে সরিয়ে নিয়ে গেল, ডাক্তার ডাকল..

অসিত বলল, সেই সুযোগে আমি নিরিবিলিতে ঘরখানা ভাল করে খুঁজলাম, খাটের পায়া চারটেও খুলে দেখলাম।

এবার অসিত কালো ব্যাগটা খুলে বার করল একগাদা পুরনো কাগজ। সেগুলো গোল করে গোটানো।

কাগজগুলো কাকাবাবুর দিকে এগিয়ে দিয়ে অসিত বলল, এগুলো বাজে কাগজ নয়। নানারকম জমির দলিল। বিমানবাবুকে পড়ে দেখতে বলবেন। হয়তো উনি আরও কিছু সম্পত্তি পেয়ে যেতে পারেন। ওঁর মামাদের যে অন্য জায়গাতেও জমিটমি ছিল, তা বোধ হয় উনি জানতেন না!

কাকাবাবু একটা দলিল খুলে দেখলেন।

অসিত বলল, তিনখানা খাটের পায়ায় এইসব দলিল ছিল। আর একখানায়…

অসিত কোটের পকেটে হাত দিয়ে বার করল দুটো কাগজের মোড়ক। একটাতে রয়েছে চারখানা ছোট ক্রস। ক্রিশ্চান পাদ্রীরা যেগুলো গলায় ঝোলান।

অসিত বলল, ধুলো জমে গেলেও এগুলো সোনার তৈরি। একটার পেছনে লেখা রয়েছে সেন্ট জোসেফ চার্চ, গোয়। মনে হয়, বিমানবাবুর পাগলাদাদুর গুরু ছিলেন যে পাদ্রী, তাঁর জিনিস।

আর-একটা কাগজের মোড়ক খুলে অসিত জিজ্ঞেস করল, এগুলো কি চিনতে পারছেন?

কাকাবাবু মোড়কটি হাতে নিলেন। সন্তু পাশ থেকে হুমড়ি খেয়ে দেখে বলে উঠল, এগুলো তো পুঁতি।

অসিত হেসে বলল, ছাদের ওই ঘরটায় অনেক ঝিনুক ছিল, পুঁতির মালা ছিল মনে আছে? পাগলদের খেয়াল, অত পুঁতির মালা জমিয়ে তিনি হয়তো

অন্যদের ঠকাতে চাইতেন। কিন্তু এগুলো পুঁতি নয়, খাঁটি মুক্তো!

কাকাবাবু বিস্ময়ের সঙ্গে বলে উঠলেন, মুক্তো? এত ছোট-ছোট?

অসিত বলল, হ্যাঁ, মুক্তো। আমি গয়নার দোকানে দেখিয়েছি। পুরনো খবরের কাগজ খুললে দেখতে পাবেন, বছর চল্লিশেক আগে গোয়র সমুদ্রের ধারে কিছু কিছু ঝিনুকের মধ্যে মুক্তো পাওয়া যাচ্ছিল। তাই নিয়ে হইচই হয়েছিল খুব। দলে-দলে লোক ছুটে গিয়েছিল গোয়ায়। সবাই ঝিনুক কুড়োতে শুরু করল। বিমানের পাগলা-দাদুটিও ঝিনুক কুড়িয়েছিলেন অনেক। এই বারোটা মুক্তো তিনি পেয়েছিলেন।

কাকাবাবু বললেন, সেইজন্যই ঘরে অত ঝিনুক!

অসিত বলল, মুক্তো পেয়ে তিনি ঝিনুকগুলোও ফেলেননি। চার-পাঁচশো ঝিনুক খুলে একটা মুক্তো পাওয়া যেত! তবে, এগুলো মুক্তো হলেও কিন্তু তেমন দামি নয়। জাপানে এরকম মুক্তো অনেক পাওয়া যায়। এক-একটার দাম বড়জোর পাঁচশো টাকা।

কাকাবাবু বললেন, পাগলা-দাদু এগুলো কাউকে দিয়েও যাননি, কেউ খুঁজেও পায়নি।

অসিত বলল, তা হলে এগুলো আবিষ্কারের কৃতিত্ব আমার?

কাকাবাবু বললেন, অবশ্যই। বিমানরা এগুলোর অস্তিত্বই জানে না। কাঠের পায়াগুলো এমনিই বিক্রি করে দিত কোনও কাঠের মিস্তিরির কাছে। সুতরাং এগুলো তোমারই প্রাপ্য!

অসিত কালো ব্যাগটা বন্ধ করে বলল, মিস্টার রায়চৌধুরী, আমি চোর নই। অন্যের জিনিস আমি নেব কেন? এই চারটে সোনার ক্রস আর বারোটা মুক্তোর দাম বেশ কয়েক হাজার টাকা তো হবেই। এর কিছু আমি চাই না। এগুলো আপনি সব বিমানবাবুদের দিয়ে দেবেন!

কাকাবাবু বললেন, আমি দেব কেন? তুমিই নিজে দিয়ে এসো।

অসিত বলল, আপনি দিলে আপনিও খানিকটা আবিষ্কারের কৃতিত্ব পাবেন। আপনি বলবেন যে, আপনি সন্দেহ করেছিলেন বলেই আমি এগুলো ফেরত দিয়েছি।

কাকাবাবু বললেন, আমি তো কৃতিত্ব চাই না। আমি তো স্বীকারই করছি যে, আমি তোমার কাছে হেরে গিয়েছি।

অসিত বলল, তবু এগুলো আপনার কাছেই থাক। বিমানবাবুর সঙ্গে দেখা করার আমি সময় পাব না।

চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে অসিত সন্তুর দিকে তাকিয়ে হাসল।

সন্তুর কাঁধে চাপড় মেরে বলল, জানি, এই ছেলেটির মনের মধ্যে এখন কোন্ কথাটা ঘুরপাক খাচ্ছে। ও ভাবছে, খাটের পায়ার মধ্যে আরও কিছু ছিল কি? আরও কোনও দামি জিনিস? সেটা আমি নিয়ে পালাচ্ছি।

সন্তু ঠিক সেই কথাটা ভাবছিল, তাই লজ্জা পেল।

অসিত বলল, কী হে সন্তু, আমায় সার্চ করে দেখবে নাকি?

কাকাবাবু বললেন, না, না! এই দামি জিনিসগুলো তুমি নিজে থেকে ফেরত দিয়ে গেলে। অন্য কেউ হলে হয়তো দিত না। কেউ কিছু জানতেও পারত না।

অসিত বলল, খাটের পায়ার মধ্যে অন্য আর কিছু ছিল না। এটা একেবারে ধ্রুব সত্য। এ-বিষয়ে আমি ওয়ার্ড অব অনার দিয়ে যাচ্ছি।

কাকাবাবু বললেন, নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই!

অসিত বলল, এবার আমি চলি! আপনাকে নিয়ে আমি খানিকটা মজা করেছি, এই ছেলেটাকে আজ সারাদিন কলকাতা শহরে ঘুরপাক খাইয়েছি। এ জন্য আশা করি আমার ওপর রাগ পুষে রাখবেন না। তবে, আপনার পায়ের ওই আঘাতটার জন্য আমি দুঃখিত। সত্যি দুঃখিত! একদিন আসবেন আমাদের বাড়িতে। অনেক পুরনো-পুরনো জিনিস আছে, দেখে আপনার ভাল লাগবে। আচ্ছা, নমস্কার!

কাকাবাবু বললেন, সন্তু, তুই ওকে সদর দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আয়।

অসিত হাসিমুখে বেরিয়ে গিয়ে সিঁড়ি দিয়ে তরতর করে নামতে লাগল।

এই লোকটা কাকাবাবুকে হারিয়ে দিয়ে গেল, কাকাবাবু কিছুই করতে পারলেন না, এটা কিছুতেই সহ্য করতে পারছে না সন্তু। এরকম আগে কোনওদিন হয়নি। লোকটা অতি ধুরন্ধর।

সদর দরজাটা বন্ধ রয়েছে। আর পাঁচখানা সিঁড়ি মাত্র বাকি, এই সময় সন্তু তাড়াহুড়ো করে আগে যাওয়ার ভান করে অসিতের পায়ে পা দিয়ে একটা ল্যাং মারল।

অসিত ধড়াম করে আছাড় খেয়ে গড়িয়ে পড়ে গেল। তার হাত থেকে ছিটকে গেল কালো ব্যাগটা।

সন্তু চেঁচিয়ে বলে উঠল, ইস, কী হল? আপনার লাগল? ইস, ছি-ছি-ছি, আমি দেখতে পাইনি। আমি ভাবলুম, আগে গিয়ে দরজাটা খুলে দেব।

অসিতের বেশ লেগেছে। তার নাক দিয়ে ফোঁটা-ফোটা রক্ত পড়ছে। আস্তে-আস্তে উঠে দাঁড়িয়ে সে রুমাল দিয়ে রক্ত মুছতে লাগল।

কালো ব্যাগটা খুলে গিয়েছে। তার থেকে বেরিয়ে এসেছে শুধু একটা বই। আর কিছু নেই। সন্তু নিজেই ব্যাগটা তুলে নিয়ে একবার ঝাড়ল। লোকটা সত্যি কথাই বলেছে তা হলে, ব্যাগে আর কিছু লুকিয়ে রাখেনি।

অসিত চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, তোমার কাকাবাবুকে আমি আছাড় খাইয়েছিলুম, তুমি আমাকে ফেলে দিয়ে তার শোধ নিলে, তাই না? স্মার্ট বয়। ঠিক আছে, এজন্য তোমাকে আমি ক্ষমা করলাম।

বইটা কুড়িয়ে নিয়ে ব্যাগে ভরল অসিত। বেরিয়ে এল রাস্তায়। এ-বেলাও সে একটা ট্যাক্সি দাঁড় করিয়ে রেখেছে। ট্যাক্সিতে উঠে অসিত বলল, কাটাকুটি তো? এর পর নিশ্চয়ই আমাদের বন্ধুত্ব হবে!

ট্যাক্সিটা স্টার্ট নিয়ে চলে গেল।

দরজা বন্ধ করে সন্তু উঠে এল কাকাবাবুর ঘরে।

কাকাবাবু সন্তুর তোলা ছবিগুলো মন দিয়ে দেখছেন। টেবল ল্যাম্প জ্বেলে একখানা ছবি ভাল করে দেখার জন্য সেই আলোর নীচে ধরলেন। জুতোর দোকানে সন্তু যে ছবি তুলেছিল, তার একটা। ছবিটা খুব স্পষ্ট। দোকানে অনেক ভিড়, তার মধ্যে বসে অসিত বই পড়ে যাচ্ছে।

ড্রয়ার থেকে একটা ম্যাগনিফাইং গ্লাস বার করে কাকাবাবু ছবিটাকে আরও বড় করে দেখতে লাগলেন। আপনমনে বললেন, লোকটার সত্যিই খুব বুদ্ধি, না রে সন্তু? আমাদের একেবারে জব্দ করে দিয়ে গেল। জিনিসগুলো পর্যন্ত ফেরত দিয়ে গেল?

সন্তু বলল, কাকাবাবু, অসিত ধর নিজেও কি ক্রিশ্চান? সব সময় বাইবেল নিয়ে ঘোরে কেন?

কাকাবাবু যেন শুনতেই পেলেন না সন্তুর কথাটা। তিনি ছবিটার ওপর ঝুঁকে পড়েছেন।

সন্তু বলল, আমি সারাদিন ওকে ওই বইটা পড়তে দেখেছি। খুব ভক্ত ক্রিশ্চান?

কাকাবাবু হঠাৎ মুখ তুলে জিজ্ঞেস করলেন, অ্যাঁ? কী বললি?

সন্তু বলল, অসিত ধর কি ক্রিশ্চান? এইমাত্র ওর ব্যাগটা খুলে গেল, দেখলাম শুধু একটা বাইবেল…

কাকাবাবু বিস্ফারিত চোখে সন্তুর দিকে কয়েক মুহূর্ত চেয়ে রইলেন। হাতের ছবিটা আবার দেখলেন।

তারপর নিজের গালে পটাশ করে এক চড় মেরে বললেন, হোয়াট আ ব্লাডি ফুল আই অ্যাম!

তারপর প্রায় লাফিয়ে উঠে বললেন, সন্তু, লোকটা চলে গেল? শিগগির চল, ওকে ধরতে হবে!

ক্রাচ না নিয়ে কাকাবাবু লাফিয়ে বেরোতে যাচ্ছিলেন, সন্তু তাড়াতাড়ি ক্রাচ দুটো ওঁর বগলে গুঁজে দিল। কাকাবাবু সিঁড়ি দিয়ে এমনভাবে হুড়মুড়িয়ে নামতে লাগলেন, সন্তুর ভয় হল উনি পড়ে না যান।

রাস্তায় এসেই কাকাবাবু চিৎকার করে বললেন, ট্যাক্সি! শিগগির একটা ট্যাক্সি ডাক।

রাত প্রায় দশটা বাজে। এখন সহজে ট্যাক্সি পাওয়া যায় না। হাজরার মোড়ের দিকে যেতে হবে। কাকাবাবুর এত ধৈর্য নেই। অস্থিরভাবে বলতে লাগলেন, আঃ, দেরি হয়ে যাচ্ছে, যে-কোনও উপায়ে একটা ট্যাক্সি।

এমন সময় একটা গাড়ি এসে থামল ওদের সামনে। জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে বিমান জিজ্ঞেস করলেন, কাকাবাবু, কোথায় যাচ্ছেন?

বিমানকে দেখে খুশি হওয়ার বদলে কাকাবাবু বললেন, ইডিয়েট!

নিজেই দরজা খুলে গাড়িতে উঠে পড়ে ধমকে বললেন, শিগগির চলো, এলগিন রোড।

বিমান ভ্যাবাচাকা খেয়ে বলল, কেন? কী হয়েছে?

কাকাবাবু বললেন, তুমি একটা আস্ত গবেট। পাগলা-দাদুর ঘরটা অতবার খুঁজে দেখেছিলে, কিন্তু অত দামি জিনিস যে চোখের সামনে পড়ে আছে, তা বুঝতে পারোনি? যার দাম কয়েক কোটি টাকা!

বিমানের পাশে বসা দীপা প্রায় কেঁদে ফেলে বলল, অ্যাঁ কয়েক কোটি টাকা? সেই চুনির মালা?

কাকাবাবু বললেন, মালা না ছাই! সে মালা পাওয়া গেলেও তার দাম হত। কয়েক হাজার মাত্র। আর এর দাম দশ কোটি টাকা তো হবেই। শুধু টাকা দিয়েও এর দাম কষা যায় না!

বিমান বলল, কী জিনিস? কী জিনিস?

কাকাবাবু বললেন, আগে অসিতের বাড়ি চলো!

বিমান গাড়ির স্পিড দারুণ বাড়িয়ে দিয়ে বলল, কী জিনিস, কাকাবাবু, বলুন, বলুন!

কাকাবাবু বললেন, একখানা বাইবেল!

দীপা যেন অগাধ জলে পড়ে গিয়ে বলল, বাইবেল? তার আবার অত দাম হয় নাকি? পাগলা-দাদুর ঘরে তো অনেকগুলো বাইবেল ছিল।

এবার সন্তু ফিসফিস করে বলল, গুটেনবার্গ বাইবেল?

কাকাবাবু বললেন, এই দ্যাখো, সন্তুও জানে। অথচ তোমরা জানো না?

দীপা বলল, গুটেনবার্গ বাইবেল কী রে, সন্তু? আমরা তো জানি বাইবেল বিনা পয়সায় পাওয়া যায়। তা হলে ওটার অত দাম কেন?

সন্তু বলল, গুটেনবার্গ বাইবেল হল পৃথিবীর সবচেয়ে প্রথম ছাপা বই। আমি এনসাইক্লোপিডিয়াতে পড়েছি, সে বাইবেল এখন পাওয়া যায় না। সেই বাইবেল পৃথিবীর সবচেয়ে দামি জিনিস। কালেক্টারস আইটেম। কিছুদিন আগে একখানা পাওয়া গিয়েছিল, লন্ডনে নিলামে সেটার দাম উঠেছিল দশ কোটি টাকা।

কাকাবাবু বললেন, পৃথিবীর সবচেয়ে প্রথম ছাপা বই নয়। সাহেবদের অনেক আগে জাপান আর কোরিয়ার লোকেরা কাঠের ব্লক দিয়ে বই ছাপা শিখেছিল।

বিমান বলল, আমি যতদূর জানি, ইউরোপে প্রথম বই ছাপে ক্যাক্সটন।

কাকাবাবু বললেন, সে তো ইংল্যান্ডে। গুটেনবার্গ তারও আগে। জোহান গুটেনবার্গ ছিলেন একজন জার্মান। তিনি আবিষ্কার করেছিলেন মেটাল টাইপ। সেই টাইপ সাজিয়ে বই ছাপা। এতকাল তাই-ই চলেছে। গুটেনবার্গ ছিলেন সত্যিকারের প্রতিভাবান। কিন্তু তাঁর টাকাপয়সা ছিল না। অন্যের কাছ থেকে ধার করে একটা প্রেস বানিয়েছিলেন। নিজের আবিষ্কার করা টাইপ দিয়ে মাত্র কয়েকখানা বাইবেল ছাপার পরেই তাঁর প্রেস বিক্রি হয়ে যায়। ১৪৫৫ সালে সেই প্রথম ছাপা কয়েকখানা বাইবেল পৃথিবীর সবচেয়ে দুর্লভ বই।

দীপা প্রায় অজ্ঞান হওয়ার মতন ঢলে পড়ে গিয়ে বলল, দশ কোটি টাকা? ওঃ ওঃ ওঃ! আমাদের সর্বনাশ হয়ে গেল?

বিমান বলল, পাগলা-দাদুর ঘরে আরও অনেক বাইবেলের সঙ্গে গুটেনবার্গ বাইবেল মিশে ছিল? আমরা চিনব কী করে?

কাকাবাবু বললেন, অসিতের অভিজ্ঞ চোখ। এক নজর দেখেই চিনেছে। ল্যাটিন ভাষায় লেখা, প্রত্যেক পাতার নীচে হাতে আঁকা রঙিন ছবি।

বিমান বলল, আমার পাগলা-দাদু ওই বাইবেল পেলেন কী করে?

কাকাবাবু বললেন, গোয়া। সেন্ট জোসেফ চার্চ। আগেই আমার মনে পড়া উচিত ছিল। ওই বাইবেলের এক কপি গোয়ার সেন্ট জোসেফ চার্চে সযত্নে রাখা ছিল। অনেক বছর আগে সেটা রহস্যময়ভাবে উধাও হয়ে যায়। অনেক বইতে একথা লেখা আছে। খুব সম্ভবত তোমার পাগলা-দাদুর যিনি গুরু ছিলেন, তিনি সেটা সরিয়েছিলেন। বিক্রি করতে পারেননি কিংবা চাননি। তিনি মারা যাওয়ার পর সেটা তোমার পাগলা-দাদুর কাছে আসে।

রাত্তিরবেলা ফাঁকা রাস্তা, গাড়ি চলেছে দারুণ জোরে। এলগিন রোড প্রায় এসে গেল।

কাকাবাবু বললেন, অসিতের কী সাহস, আমার বাড়িতে, আমার সামনে সেই বাইবেল নিয়ে বসে ছিল। অন্য জিনিসগুলো ফেরত দেওয়ার নাম করে ধোঁকা দিয়ে গেল আমাকে। সন্তু যদি জুতোর দোকানে অত ভাল ছবি না তুলত, আর বাইবেলের কথা না বলত, তা হলে আমিও কিছুই বুঝতে পারতাম না! ছবিতে অসিতের হাতে যে বই, সেই পাতাটার ছবি আমি আগে দেখেছি।

সন্তু বলল, সারাদিন ও বাইবেলটা সঙ্গে নিয়ে ঘুরছে। কেউ কিছু সন্দেহ করেনি।

গাড়িটা জোরে ব্রেক কষল অসিতের বাড়ির সামনে। সবাই হুড়মুড় করে নামল গাড়ি থেকে।

সদর দরজা বন্ধ। তিনতলায় আলো জ্বলছে না। বিমান ঘন-ঘন বেল বাজাতেই দোতলার বারান্দা থেকে একজন বলল, কে?

বিমান বলল, দরজাটা খুলে দিন, পুলিশ।

লোকটি এসে দরজা খুলতেই সবাই তাকে প্রায় ঠেলে সরিয়ে উঠে গেল সিঁড়ি দিয়ে।

এত গোলমাল শুনে তিনতলায় ফ্ল্যাটের দরজা খুলে দাঁড়িয়েছে কাজের লোকটি।

বিমান জিজ্ঞেস করল, বাবু কোথায়? অসিতবাবু? লোকটি অবাক হয়ে বলল, বাবু তো চলে গিয়েছে। কোথায়? বিলেত চলে গিয়েছেন, বাবু! বিলেত গিয়েছেন? কখন? সাড়ে আটটার সময় সুটকেস নিয়ে চলে গেলেন।

কাকাবাবু ততক্ষণে ঢুকে পড়েছেন ফ্ল্যাটের মধ্যে। সন্তুও সব ঘর খুঁজে দেখল। অসিত ধর কোথাও নেই।

কাকাবাবু বললেন, এখান থেকেই সে আমার বাড়িতে গিয়েছিল। তারপর চলে গিয়েছে। রাত সাড়ে বারোটার সময় এয়ার ইন্ডিয়ার একটা ফ্লাইট আছে দমদম থেকে। এখনও গেলে তাকে ধরা যেতে পারে।

সন্তু বলল, আর যদি ট্রেনে বম্বে কিংবা দিল্লি যায়। সেখান থেকে প্লেনে ওঠে? আজ ট্রেনের টিকিট কাটতে গিয়েছিল!

কাকাবাবু বললেন, ট্রেনে গেলে এখন তাকে ধরার কোনও উপায় নেই। বম্বে-দিল্লি এয়ারপোর্টে জানিয়ে দিতে হবে। তার আগে দমদম গিয়ে একবার দেখা যাক। হয়তো ট্রেনের টিকিট কাটাও তার ধোঁকা দেওয়ার চেষ্টা।

সবাই দুমদাম করে নেমে এল নীচে। গাড়িতে উঠেই বিমান বলল, সবাই সিট ধরে বসে থাকো। আমি খুব জোরে চালাব। হঠাৎ ব্রেক কষলে ঝাঁকুনি লাগবে।

দীপা বলল, অ্যাকসিডেন্ট কোরো না। মরে গেলে আর অত টাকা পেয়েই বা লাভ কী হবে?

কাকাবাবু গম্ভীরভাবে বললেন, বাইবেলটা পাওয়া গেলেও তার টাকা তোমরা পাবে না।

বিমান বলল, আগে তো জিনিসটা উদ্ধার করা হোক। তারপর ওসব চিন্তা করা যাবে।

কাকাবাবু বললেন, বইটা একবার দেশের বাইরে নিয়ে গেলে আর উদ্ধারের কোনও আশা নেই। এ-দেশের কাস্টমস বা পুলিশের লোকেরা ও-বই দেখে চিনতে পারবে কি না সন্দেহ।

বাকি রাস্তা প্রায় কেউ কোনও কথা বলল না। গাড়ি ছুটল ঝড়ের বেগে। আধঘন্টার মধ্যে পৌঁছে গেল এয়ারপোর্টে।

বিদেশের যাত্রীরা যেখান থেকে চেক ইন করে, সেখানে বাইরের লোকদের ঢুকতে দেওয়া হয় না। কাকাবাবু সেই গেটের কাছে যেতেই একজন বন্দুকধারী রক্ষী তাঁকে আটকাল। কাকাবাবু তাকে ঠেলে ঢোকার চেষ্টা করতেই আর একজন রক্ষী এসে বলল, কী করছেন? আপনাকে অ্যারেস্ট করা হবে।

এইসব সাধারণ রক্ষী কাকাবাবুকে চেনে না। জোর করে ভেতরে ঢোকা যাবে না।

খানিকটা দূরেই দেখা গেল, সিকিউরিটি চেকের লাইন। তার সামনের দিকে দাঁড়িয়ে আছে অসিত। সে-ও কাকাবাবুদের দেখতে পেল। তার মুখে কোনও ভয়ের ছাপ ফুটল না। বরং সারা মুখে হাসি ছড়িয়ে সে একটা হাত তুলে কাকাবাবুর উদ্দেশে বলল, টা-টা!

তারপর সে ঢুকে গেল ভেতরে।

এখনও কিছুটা সময় আছে। একবার প্লেন ছেড়ে গেলে আর কিছু করা যাবে না।

কাকাবাবু একজন পুলিশকে জিজ্ঞেস করলেন, এয়ারপোর্টে যে এস পি থাকেন, তাঁর নাম নজরুল ইসলাম না? নামটা আমার মনে আছে।

পুলিশটি বলল, হ্যাঁ।

সেই নজরুল ইসলাম সাহেব কোথায়?

তিনি কোয়ার্টারে আছেন।

শিগগির একবার তাঁকে ডাকুন। বিশেষ দরকার।

দরকার আমাকে বলুন। যে-কেউ বললেই কি আমাদের বড় সাহেবকে এয়ারপোর্টে আসতে হবে?

প্রতিটি মিনিট মূল্যবান। অকারণ তর্ক করে সময় নষ্ট করার কোনও মানে হয় না।

কাকাবাবু এবার ক্রাচ তুলে সাঙ্ঘাতিক রাগের সঙ্গে বললেন, এবার আমি কাচ ভাঙব, অনেক কিছু ভেঙে হাঙ্গামা বাধাব, তখন এস পি-কে আসতেই হবে। যান, নজরুল ইসলামকে বলুন, আমার নাম রাজা রায়চৌধুরী। আমি পুলিশ কমিশনারের বন্ধু। আমার বিশেষ প্রয়োজনে ডাকছি। শিগগির যান।

কাকাবাবু এবার একটা টেলিফোন বুথে পুলিশ কমিশনারকে ফোন করলেন বাড়িতে। তিনি বাড়িতে নেই। এক জায়গায় নেমন্তন্ন খেতে গিয়েছেন। সেখানকার টেলিফোন নাম্বার জানিয়ে দিয়েছেন বাড়িতে।

সেই নাম্বারে ফোন করলেন কাকাবাবু। একজন তোক ধরে বলল, হ্যাঁ, তিনি আছেন, ডেকে দিচ্ছি।

তারপর আর কেউ আসে না। কোনও সাড়া-শব্দ নেই। ধৈর্য হারিয়ে কাকাবাবু বারবার ক্রাচটা ঠুকছেন মাটিতে। বাড়ি থেকেই এই ফোনটা করা উচিত ছিল, তখন মনে পড়েনি।

একটু পরেই একজন বলল, হ্যালো।

পুলিশ কমিশনারের গলা চিনতে পেরেই কাকাবাবু ধমক দিয়ে বললেন, এখানে এত বড় একটা সাঙ্ঘাতিক ব্যাপার হচ্ছে, আর তুমি আরাম করে নেমন্তন্ন খাচ্ছ?

পুলিশ কমিশনার হেসে বললেন, আরে, রাজা, কী ব্যাপার বলো আগে! নেমন্তন্ন খেতে এসে কী দোষ করলাম?

কাকাবাবু বললেন, সেই অসিত ধর, তুমি তো তখন বিশ্বাস করোনি, সে একটা দশ কোটি টাকার জাতীয় সম্পত্তি নিয়ে পালাচ্ছে!

কমিশনার বললেন, অ্যাঁ দশ কোটি টাকা? ঠিক বলছ? আমি এক্ষুনি চলে আসব এয়ারপোর্টে?

কাকাবাবু বললেন, তুমি আসতে-আসতে পাখি উড়ে যাবে। প্লেন ছাড়বে এক্ষুনি। দরকার হলে ওকে প্লেনের ভেতরে গিয়েও গ্রেফতার করতে হবে। সেই ব্যবস্থা করো।

এই সময় নজরুল ইসলাম চলে এলেন। তিনি বললেন, মিস্টার রায়চৌধুরী, আমি তো আপনাকে চিনি। কী ব্যাপার বলুন তো?

কাকাবাবু বললেন, এই ফোনে কথা বলুন!

পুলিশ কমিশনার কী সব নির্দেশ দিতে লাগলেন, আর নজরুল ইসলাম বলতে লাগলেন, হ্যাঁ সার! না, সার! ইয়েস সার। অবশ্যই সার!

ফোন রেখে দিয়ে তিনি কাকাবাবুকে বললেন, চলুন?

অন্যদের সেখানেই অপেক্ষা করতে বলে নজরুল ইসলাম কাকাবাবুকে তুলে নিলেন নিজের জিপে। সেই জিপ চলে এল এয়ারপোর্টের টারম্যাকে।

বিশাল প্লেনটা দাঁড়িয়ে আছে বেশ খানিকটা দূরে। সিঁড়ির কাছে লাইন দিয়েছে যাত্রীরা। অসিতের সামনে দশ বারোজন রয়েছে।

জিপটা একেবারে কাছে এসে থামল। কাকাবাবু নেমে গিয়ে অসিতের কাঁধে হাত দিয়ে শান্তভাবে বললেন, বইটা দাও!

অসিত মুখ ফিরিয়ে বলল, শেষ পর্যন্ত বুঝেছেন তা হলে? অনেক দেরি হল, তাই না? আমি এক্ষুনি প্লেনে উঠব। আমাকে আটকাবার কোনও ক্ষমতা আপনার নেই।

কাকাবাবু বললেন, বইটা জাতীয় সম্পত্তি। একশো বছরের বেশি পুরনো কোনও বই দেশের বাইরে নিয়ে যাওয়া যায় না। এটা বেআইনি।

নজরুল ইসলাম বললেন, আপনি লাইন থেকে বেরিয়ে আসুন। বইটা না দিলে আপনাকে অ্যারেস্ট করব।

অসিত এবার কটমট করে দুজনের দিকে তাকাল। তারপর ব্যাগটা খুলে বইটা হাতে নিয়েই ব্যাগটা ছুড়ে মারল কাকাবাবুর মুখে।

কাকাবাবু এরকম কিছুর জন্য তৈরি ছিলেন, ব্যাগটা তাঁর মুখে লাগল না, তার আগেই লুফে নিলেন সেটা।

অসিত ফস করে পকেট থেকে একটা লাইটার বার করে চিৎকার করে বলল, দেব না। বইটা পুড়িয়ে ফেলব। দেব না!

গণ্ডগোল দেখে ভয়ে অন্য যাত্রীরা ছিটকে সরে গেল দূরে। দুজন সিকিউরিটি গার্ড রাইফেল তুলল। নজরুল ইসলামও রিভলভার বার করে উঁচিয়ে ধরলেন অসিতের দিকে।

অসিত বিকৃত গলায় চিৎকার করে উঠল, খবদার! আমার কাছ থেকে কাড়তে এলেই এটা আমি পুড়িয়ে দেব। নষ্ট করে দেব।

নজরুল ইসলাম বললেন, আপনি পাগল নাকি? আমি যদি গুলি করি। এক সেকেণ্ডের মধ্যে আপনি শেষ হয়ে যাবেন। বইটার কোনও ক্ষতি করতে পারবেন না।

কাকাবাবু বললেন, না, না, গুলি করার কোনও দরকার নেই। আমি জানি, অসিত কিছুতেই ও বই নষ্ট করবে না। ও বইয়ের মর্ম অসিত জানে। দাও, অসিত, বইটা আমাকে দাও।

অসিত বলল, দেব না, দেব না, কিছুতেই দেব না। এটা আমার আবিষ্কার! আমি ছাড়া কেউ খুঁজে পায়নি। এত বছর ধরে পড়ে ছিল।

কাকাবাবু কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে বললেন, দাও, অসিত, বইটা দাও!

অসিত বলল, কাছে এলে আমি আপনাকে শেষ করে দেব। খুন করব।

কাকাবাবু তবু আর-একটু এগিয়ে বললেন, দাও, অসিত! আমি জানি, তুমি মানুষ খুন করতে পারো না।

অসিত এবার কান্নায় ভেঙে পড়ল। কাঁদতে কাঁদতে বসে পড়ল মাটিতে। বইটা ছুঁড়ে দিল সামনের দিকে।

কাকাবাবু বইটা তুলে নিয়ে কপালে ছোঁয়ালেন।

তারপর নজরুল ইসলামের হাতে বইটা দিয়ে বললেন, সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে বইটা আপনাকে দিলাম। এটা সারা দেশের সম্পদ। ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে জমা থাকবে, সব মানুষ দেখতে পাবে।

তারপর তিনি অসিতের হাত ধরে বললেন, ওঠো, অসিত। তুমিই এটা আবিষ্কার করেছ। আবিষ্কারক হিসেবে তোমার নামই লেখা থাকবে। তোমার জন্যই তো আমরা এটা পেলাম।

অসিতকে তুলে বুকে জড়িয়ে ধরলেন কাকাবাবু।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত