কাকাবাবু ও মরণফাঁদ

কাকাবাবু ও মরণফাঁদ

সকাল থেকে সন্তু আর জোজো নিজেদের মধ্যে কী যেন বলছে ফিসফিস করে। কাছাকাছি কাকাবাবুকে দেখলেই থেমে যাচ্ছে হঠাৎ। যেন তাদের একটা কিছু গোপন কথা আছে।

বাড়ির সামনে অনেকখানি জায়গা জুড়ে বাগান। বড় বড় সব ফলের গাছ। মাঝখানটায় মখমলের মতন সবুজ ঘাসে ভরা লন। ওখানে ব্যাডমিন্টন খেলার জন্য জাল টাঙানো আছে। কিন্তু ব্যাডমিন্টন খেলা শীতকালেই ভাল জমে। এখন ভরা বর্ষা, বৃষ্টি নামে যখন-তখন। বৃষ্টি না থাকলেও প্রবল হাওয়া দেয়। সন্তু আর জোজো এরই মধ্যে খেলার চেষ্টা করেছে কয়েকবার, কিন্তু খেলার বদলে হেসেই কুটি কুটি হয়েছে। পালকের কক উড়ে চলে যায় কোর্টের বাইরে, র্যাকেটে ছোঁয়াই যায় না।

একবার সন্তু সার্ভ করল জোজোর দিকে, ককটা ডান দিকে ঘুরে গিয়ে অনেকটা দূরে আটকে গেল একটা আমগাছের ডালে! গাছে উঠে সে ককটা পাড়তে গিয়ে জোজো পা পিছলে পড়ে গেল মাটিতে। যদিও তেমন কিছু লাগেনি, তবু জোজো ইচ্ছে করে খোঁড়াতে লাগল অনেকক্ষণ।

সেই লনের পাশেই একটা জামরুল গাছের নীচে একটা টেবিল ও চেয়ার পাতা। কাকাবাবু প্রায় সারাদিনই বসে থাকেন সেখানে। বই পড়েন। বই পড়তে পড়তে ঝিমুনিও আসে। তখনই হেঁকে বলেন, ওরে রঘু, এক কাপ কফি দিয়ে যা।

বৃষ্টি এসে গেলে অবশ্য উঠে আসতেই হয়। তখন এসে বসেন বারান্দায়। সেখানেও বৃষ্টির ছাট আসে। বাইরে কোথাও বেড়াতে এসে কাকাবাবু ঘরের মধ্যে বসে থাকতে চান না।

এটা সন্তুর মামার বাড়ি। জায়গাটার নাম টাকি। একসময় বেশ বড়সড় গ্রাম ছিল, এখন প্রায় শহরই হয়ে গেছে। তবে এখনও অনেক ফাঁকা ফাঁকা জায়গা আর

অনেক গাছপালা আছে। এই বাড়িটা থেকে ইছামতী নদীটাও খুব দূরে নয়।

নদী পেরিয়ে খানিকটা গেলেই বাংলাদেশের সীমানা। ওদিকে সাতক্ষীরা শহর। এত কাছে বলেই সন্তু আর জোজোর বাংলাদেশে বেড়িয়ে আসার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু এমনি এমনি তো যাওয়া যায় না। পাসপোর্ট আর ভিসা লাগে। এ বাড়ির কাজের লোক রঘু অবশ্য বলেছে যে ওদিক থেকে, এদিক থেকে অনেক লোক ভিসা-পাসপোর্ট ছাড়াই যাওয়া-আসা করে, সকালে আসে, বিকেলে চলে যায়, কিংবা দু-একদিন থেকেও যেতে পারে। রঘুই সন্তু আর জোজোকে নিয়ে যেতে পারে বাংলাদেশে!

ওরা তাতে রাজি হয়নি। মনে মনে খানিকটা ইচ্ছে জাগলেও সন্তু জানে একথা শুনলেই কাকাবাবু বকুনি লাগাবেন।

একটু আগে বৃষ্টি থেমে গেছে। কাকাবাবু গিয়ে আবার বসেছেন গাছতলার নীচের চেয়ারে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে সন্তু আর জোজো গুজগুজ করতে শুরু করেছে। আবার।

সন্তুর ছোটমামা ভেতর থেকে বেরিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলেন, কী রে, সন্তু, তোরা কিছু ঠিক করলি?

সন্তু আমতা আমতা করে বলল, না, মানে, আমাদের তো সোমবারই ফিরে যাওয়ার কথা। কলেজ খুলে যাচ্ছে।

ছোটমামা বললেন, কলেজ খুলে যাবে তো কী হয়েছে? এখান থেকেই। কলেজে যাবি! সন্ধেবেলা ফিরে আসবি।

সন্তু খানিকটা অবিশ্বাসের সুরে বলল, এখান থেকে..মানে এত দূর থেকে কলেজে যাওয়া যায়?

ছোটমামা বললেন, কেন যাবে না? কত ছেলে যায়। কলকাতা কি খুব দূর নাকি? বাস বা ট্রেনে বড়জোর দু ঘণ্টা লাগে।

জোজো বলল, কত লোক বর্ধমান থেকে, আসানসোল থেকে কলকাতায় চাকরি করতে আসে। আমার এক পিসতুতো দাদা প্রত্যেকদিন দিল্লি থেকে কলকাতা যাওয়া-আসা করে।

এবারে অবিশ্বাসের ছাপ ফুটে উঠল ছোটমামার মুখে। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, কী কাজ করেন তোমার পিসতুতো দাদা?

জোজো বলল, পাইলট! থতমত খেয়ে ছোটমামা বললেন, ও, সেটা আলাদা কথা!

সন্তু বলল, কাকাবাবুকে কিছু বলা হয়নি। কাকাবাবু সোমবারই ফিরবেন ঠিক করেছেন।

ছোটমামা বললেন, আরে, তোর কাকাবাবুকে তো আর কলেজে যেতে হয়। না, কোথাও যাতায়াতও করতে হবে না। আরও কিছুদিন থেকে গেলে ক্ষতি কী? মোটে তো দশটা দিন। মাঝখানে আমার তিনদিন ছুটি। তোরা কয়েকটা দিন একটু কষ্ট করে কলেজে ক্লাস করে আসবি, তারপর সন্ধেবেলা রিহার্সাল। আমি গিয়ে রাজাদাকে বলব?

সন্তু বলল, না, না, আমি বললেই ভাল হয়।

কিছুদিনের জন্য গ্রামের বাড়িতে এসে থাকতে ভালই লাগে। যেমন টাটকা বাতাস, তেমনই টাটকা মাছ আর ফল আর তরিতরকারি। তা বলে কি আর খুব বেশিদিন থাকা যায়? কয়েকদিন পরই কলকাতার জন্য মন ছটফট করে। এরমধ্যেই এখানে আটদিন কেটে গেছে।

সন্তুর মামা আর মাসিদের মধ্যে আর কেউ থাকেন না এখানে। সবাই চলে গেছেন শহরে। শুধু ছোটমামা একলা পড়ে আছেন এখানে। ছোটমামা আদর্শবাদী, তিনি এখানে থেকে গ্রামের সাধারণ মানুষদের জন্য অনেক কাজটাজ করেন। কেউ বিপদে-আপদে পড়লেই ছুটে আসে তার কাছে। ছোটমামার নাম চন্দ্রশেখর। সবাই বলে চাদুবাবু!

এখানকার একটা স্কুলবাড়ি গত বছর বন্যায় ড়ুবে গিয়েছিল। অনেক ক্ষতি হয়েছে, তিনখানা ঘর হেলে পড়ে গেছে। ছোটমামা স্কুলটাকে নতুনভাবে গড়ে তুলতে চান। সেজন্য অনেক টাকা লাগবে। ছোটমামা নিজে তো কিছু দিচ্ছেনই, আরও টাকা জোগাড় করার জন্য মাঝে মাঝে চ্যারিটি শো করছেন। একটা বিরাট গানবাজনার জলসা হবে, কলকাতা থেকে বড় বড় শিল্পীরা আসবেন।

কিন্তু ছোটমামা বলছেন, সবই শহরের শিল্পীরা এসে করবে কেন? গ্রামের মানুষও কিছু করতে পারে না ইস্কুল বাড়িটার জন্য? তাই তার ইচ্ছে, ছোটদের দিয়ে একটা থিয়েটার করাবেন। তাঁর নিজের অনেক কাজ, সন্তু আর জোজো যদি একটা নাটক বেছে নিয়ে অন্য ছেলেদের সঙ্গে নিজেরাও পার্ট করে, তা হলে বেশ ভাল হয়।

কিন্তু কলেজ কামাই করে গ্রামে বসে থিয়েটার করলে, মা-বাবারাই রেগে যাবেন। আর কাকাবাবু রাজি না হলে তো প্রশ্নই ওঠে না।

বাগানের গেটের কাছে একটা সাইকেল রিকশা এসে থামল। একজন কেউ ডেকে উঠল, চাঁদুদা, চাঁদুদা।

ছোটমামা চলে গেলেন সেদিকে।

কাকাবাবু বারান্দার দিকে পেছন ফিরে বসে আছেন। তাঁর হাত থেকে বইটা পড়ে গেল। তার মানে ঘুমিয়ে পড়েছেন। সন্তু দৌড়ে গেল মাটি থেকে বইখানা তুলে দিতে। মাটি এখনও ভেজা।

সন্তু বইটা টেবিলে রাখতেই কাকাবাবু চোখ মেলে বললেন, তোরা দুটিতে আজ সকাল থেকে কী করছিস রে? আমার সঙ্গে তো একবারও কথা বলিসনি!

সন্তু বলল, তুমি বই পড়ছিলে—

কাকাবাবু বললেন, আজ বুঝি তুই আর জোজো ঝগড়া করিসনি? জোজো কাছে এসে বলল, দেখুন না কাকাবাবু, সন্তুটা এমন ভিতু, আপনাকে একটা কথা বলা দরকার, আমাকেও বলতে দিচ্ছে না!

কাকাবাবু হেসে বললেন, সন্তু, আমাকে কিছু বলতে ভয় পায়? এ তো নতুন কথা শুনছি! তুমি তো ভিতুনও, তুমিই বলে ফেলো! আমি তোমাদের কাকাবাবু, তোমাদের জ্যাঠামশাই তো নই! ছেলেরা জ্যাঠামশাইদের ভয় পায়।

জোজো বলল, কাকাবাবু, আমরা এখানে থিয়েটার করতে পারি?

কাকাবাবু একটু অবাক হয়ে বললেন, থিয়েটার মানে? কী থিয়েটার?

জোজো বলল, এখানকার ইস্কুল বাড়িটা ভাল করার জন্য চ্যারিটি শো হচ্ছে। কলকাতা থেকে অনেক আর্টিস্ট আসবেন। ছোটমামা বলছেন, গ্রামের ছেলেদের নিয়ে আমরাও একটা নাটক করি।

কাকাবাবু বললেন, থিয়েটার করতে গেলে রিহার্সাল দিতে হয়, পার্ট মুখস্থ করতে হয়। অনেক সময় লাগে। হুট করে কি থিয়েটার করা যায়?

জোজো বলল, এখনও দশদিন সময় আছে।

কাকাবাবু বললেন, দশদিন? আমাদের যে সোমবারই ফিরে যাওয়ার কথা। এবারে সন্তু বলল, সেইজন্যই তো ভাবছি…আমাদের কলেজ খুলে যাবে।

জোজো বলল, এখান থেকেও কলেজে ক্লাস করা যায়। সকালে গিয়ে বিকেলে ফিরে আসব! যেতে দু ঘণ্টা, আসতে দুঘণ্টা, তারপর সন্ধে থেকে টানা রিহার্সাল!

কাকাবাবু চোখ বড় বড় করে বললেন, যেতে দুঘণ্টা, আসতে দুঘণ্টা? তার মানে, আরও বেশি সময়ও লাগতে পারে। কখন বাস বন্ধ হয়, ট্রেন বন্ধ হয়, তার কি কোনও ঠিক আছে?

তারপর গম্ভীরভাবে বললেন, না, হবে না, অসম্ভব!

সন্তু আর জোজো পরস্পরের চোখের দিকে তাকাল। সন্তুর মুখের ভাবখানা এমন, যেন জোজোকে সে বোঝাচ্ছে, তোকে আগেই বলেছিলুম না যে কাকাবাবু রাজি হবেন না!

কাকাবাবু আবার মুখ তুলে বললেন, অত ধকল আর সময় নষ্ট করে কলেজে যাওয়ার বদলে আট-দশদিন কলেজে না গেলেও এমন কিছু ক্ষতি হয় না। তার চেয়ে থিয়েটার করা অনেক বেশি উপকারী!

সন্তু আর জোজো দুজনেই হকচকিয়ে গেল। কাকাবাবু কলেজে যেতে বারণ করছেন?

কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, কী নাটক হবে?

জোজো বলল, আপনি পারমিশান দিচ্ছেন? নাটক এখনও ঠিক হয়নি। এখানকার লাইব্রেরি থেকে কয়েকটা বই আনিয়েছি।

কাকাবাবু বললেন, নাটক বাছাই করতে দেরি করলেই তর্কাতর্কি হবে। এ বলবে ওটা, সে বলবে সেটা! বড়রাও থাকবে, না ছোটরা?

জোজো বলল, আমরা বড়দের নেব না!

কাকাবাবু বললেন, যাঃ, তা হলে তো আমার পার্ট পাওয়ার আশা রইল না। তোদের নাটকে একটা খোঁড়া লোকের যদি পার্ট থাকত?

জোজো বলল, সত্যি আপনি করবেন?

কাকাবাবু বললেন, ভেবেছ বুঝি পারি না? ছেলেবেলায় আমি অনেক শখের থিয়েটার করেছি, তখন তো খোঁড়া ছিলাম না! যাকগে, এখানকার ছোটরা করছে, সেটাই ভাল। নিজেদের স্কুলের জন্য একটা কিছু সাহায্য করা হবে। তোমরা তাদের সঙ্গে যোগ দেবে, তোমরাও তো কলকাতার আর্টিস্ট হয়ে গেলে!

সন্তু বলল, ছোটমামা যে বললেন!

কাকাবাবু বললেন, ঠিক আছে। ইস্কুলের জন্য যে-কেউ সাহায্য করতে পারে। নাটকের পরিচালক কে? সেটা ঠিক করা খুব জরুরি।

জোজো বলল, আমি আর সন্তু দুজনে মিলে ম্যানেজ করব!

কাকাবাবু বললেন, দুজন পরিচালক? সর্বনাশ! পদে পদে ঝগড়া হবে। তোমাদের এমনিতেই ঝগড়া হয়—

জোজো বলল, সন্তুকেও লাগবে না। আমি একলাই পারব।

কাকাবাবু বললেন, তোমার যোগ্যতা কী? তুমি আগে কখনও পরিচালনা করেছ?

জোজো বলল, আমার বাবা শম্ভু মিত্র আর উৎপল দত্তকে আবৃত্তি শিখিয়েছিলেন!

কাকাবাবু হেসে ফেলে বললেন, তোমার বাবা অত বড় বড় অভিনেতাদের আবৃত্তি শিখিয়েছিলেন, সেটা তোমার বাবার যোগ্যতা হতে পারে, তোমার হবে কী করে?

জোজো বলল, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় আমাদের বাড়িতে প্রায়ই আসেন, আমার সঙ্গে ভাব আছে।

কাকাবাবু বললেন, সে তুমি যাই-ই বলো জোজো, তুমি পরিচালক হলে সবাই কি তোমাকে মানবে? পরিচালকের কথার ওপর কথা চলে না। সেইজন্যই ভাবছি পরিচালনার দায়িত্বটা আমারই নেওয়া উচিত। আমার কথা সবাই শুনবে!

সন্তু বলল, তা হলে তো খুব ভাল হয়!

জোজো বলল, কিন্তু কাকাবাবু, আপনার যোগ্যতা কী? আপনি কি কখনও পরিচালনা করেছেন?

কাকাবাবু বললেন, না, নাটক পরিচালনা করিনি বটে, তবে অভিনয় তো করেছি অনেকবার। অভিনয় করতে করতেও অনেকে পরিচালক হয়।

জোজো বলল, ঠিক আছে, আপনাকে পরিচালনার ভারটা ছেড়ে দিচ্ছি, কিন্তু আমাকে বড় পার্ট দিতে হবে!

কাকাবাবু বললেন, এই তো, কে কোন পার্ট করবে, তা নিয়ে মনোমালিন্য শুরু হয়ে যায়। সবাই বড় পার্ট চায়। আগে তো নাটক ঠিক হোক! আমি সাজেস্ট করছি, তোমরা লক্ষ্মণের শক্তিশেল নাটকটা করো।

জোজো বলল, রামায়ণ?

সন্তু বলল, না, না, সুকুমার রায়ের লেখা!

জোজো সেটা পড়েনি। সন্তু পড়েছে, অনেক আগে।

কাকাবাবু বললেন, এ নাটকটা দারুণ মজার। একটু ভুলভাল করলেও জমে যায়। আর একটা সুবিধে হল, আমি নিজে এ নাটকে কয়েকবার অভিনয় করেছি। তো। অনেক সংলাপ এখনও মুখস্থ আছে। আমাদের পরিচালক যেমন শিখিয়েছিলেন, তোমাদেরও তেমনই শেখাব।

সন্তু বলল, কাকাবাবু, এ নাটকে যে অনেক গান আছে?

কাকাবাবু বললেন, তোরাই গেয়ে দিবি! শক্ত কিছু নয়।

সন্তু বলল, গানের সুর কী করে জানব?

কাকাবাবু বললেন, আমি গাইতে পারি না। কিন্তু সুর সব জানি। তোদের মোটামুটি শিখিয়ে দেব। এ এমনই নাটক, ভুল সুরে গান গাইলেও ঠিক খাপ খেয়ে যাবে।

তারপর উঠে দাঁড়িয়ে তিনি বললেন, আমি করেছিলাম রাবণের পার্ট, বড়সড় চেহারা তো আমার। গদা ঘুরিয়ে সুগ্রীবের সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে গান গেয়েছি। শুনবি?

মাথার ওপর হাত ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে তিনি গাইতে লাগলেন হেঁড়ে গলায়!

ওরে পাষণ্ড, তোর ও মুণ্ড খণ্ড খণ্ড করিব।

যত অস্থি-হাড়, হবে চুরমার, এমনই আছাড় মারিব।

ব্যাটা গুলিশোর, বুদ্ধি নেই তোর, নেহাত তুই চ্যাংড়া

আয় তবে আয় যষ্টির ঘায় করিব তোরে ল্যাংড়া…
রিহার্সালের জন্য বড় বৈঠকখানা ঘরটিকে ঠিক করা হয়েছে। পুরনো আমলের ঢাউস ঢাউস সোফাগুলোকে ঠেলে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে দেওয়ালের পাশে। ওগুলো সবই এখন ছেঁড়াখোঁড়া। হাড়গোড় বার করা অবস্থা, ফেলে দিলেই ভাল হয়।

টাকিতে বেশ কয়েকটি দল যাত্রা করে, নাটক করে, তাদের ডাকা হয়নি। শুধু বেছে নেওয়া হয়েছে ইস্কুলের কিছু ছেলেকে।

কাকাবাবুর উৎসাহ দেখে সন্তুর খুব মজা লাগছে। আগে তিনি বলেছিলেন, সামনের মঙ্গল-বুধবার তাঁর জরুরি কাজ আছে কলকাতায়। এখন সেসব ভুলে গিয়ে মেতে উঠেছেন নাটক নিয়ে।

প্রথমে তিনি পুরো নাটকটি সবাইকে পড়ে শোনালেন। গানগুলোও গাইলেন একটু একটু। তারপর বললেন, এবারে ঠিক করতে হবে, কে কোন পার্ট করবে। শোনো, অভিনয়ের সময় নাটকের ছোট-বড় সব পার্টই গুরুত্বপূর্ণ। সাধারণ একটা পার্টও খারাপ হলে নাটক ঝুলে যায়। আমি প্রত্যেককে দু-তিন লাইন করে বলতে বলে টেস্ট নেব। তারপর আমি যাকে যে পার্ট দেব, মেনে নিতে হবে। কোনও আপত্তি চলবে না।

তিনি ভূমিকা বাছাই শুরু করার আগেই ছোটমামা এসে বললেন, রাজাদা, এক মিনিট একটু বাইরে এসো, একটা কথা বলব।

কাকাবাবু উঠে গেলেন।

ছোটমামা বললেন, আমার একটা অনুরোধ আছে, এখানকার পুলিশসাহেবের ছেলে সুকোমলকে রামের পার্টটা দিতে হবে। ওর মায়ের খুব ইচ্ছে!

কাকাবাবু বিরক্ত হয়ে বললেন, এই রে, তুমি প্রথম থেকেই এসব শুরু করলে? আমার কাজে মাথা গলালে আমি এর মধ্যে থাকতে চাই না। এই করে নাটক নষ্ট হয়? সবাই যোগ্যতা অনুসারে পার্ট পাবে।

ছোটমামা মিনতি করে বললেন, আমি আর কিছুতে মাথা গলাব না। পুলিশসাহেব আমাদের অনেক উপকার করেন। উনি সাহায্য করলে আমাদের টিকিটও বেশি বিক্রি হবে।

কাকাবাবু বললেন, রামের পার্টে যাকে-তাকে মানায় নাকি? চেহারাটা সুন্দর হওয়া দরকার।

ছোটমামা বললেন, তুমি ছেলেটাকে আগে দেখো। আমার ধারণা, বেমানান হবে না। মফস্সলে এইসব অনুরোধ একটু রাখতেই হয়।

প্রথমেই ডাকা হল সেই ছেলেটিকে। তার চেহারা বেশ ভালই। বারো-তেরো বছর বয়েস, সেই তুলনায় বেশ লম্বা, ফরসা রং, টানা টানা চোখ। পুলিশসাহেবের ছেলে হলেও তার মুখে অন্ধকারের ভাব নেই। শান্ত, কোমল মুখোনি, তার নামের সঙ্গে মিল আছে।

কাকাবাবু তাকে কয়েকটা লাইন বলতে দিলেন :

পিঁপড়ের পাখা উঠে মরিবার তরে।
জোনাকি যেমতি হায়, অগ্নিপানে রুষি
সম্বরে খদ্যোত লীলা—

ছেলেটির গলার আওয়াজও ভাল। দোষের মধ্যে এই, সে একটু তোতলা।

কাকাবাবু মনে মনে একটু হাসলেন। সুকুমার রায়ের নাটকে সব কিছুই উলটোপালটা, তা হলে রাম একটু তোতলা হলেই বা ক্ষতি কী?

অন্য সবাই হেসে উঠেছে, কাকাবাবু তাদের থামিয়ে দিয়ে বললেন, চুপ! একেই রাম মানাবে।

তারপর একে একে অন্য পার্ট দেওয়া হতে লাগল। কাকাবাবু জোজোকে বললেন, তুমি হবে হনুমান!

জোজো দাঁড়িয়ে উঠে বলল, হনুমান? না, না, আমি এ পার্ট চাই না!

কাকাবাবু বললেন, আগেই বলেছি না, আমার কথায় আপত্তি করা চলবে না? নাটক সাকসেসফুল হয় কীসে জানো? যদি হাসির কথায় দর্শক হেসে ওঠে আর ভাল ভাল জায়গায় হাততালি দেয়। থিয়েটারের ভাষায় হাততালিকে বলে ক্ল্যাপ। এই নাটকে হনুমানের পার্টেই সবচেয়ে বেশি হাসির কথা আছে, আর সবচেয়ে বেশিবার ক্ল্যাপ পেতে পার! রাম-লক্ষ্মণের চেয়েও হনুমানই এখানে আসল হিরো!

জোজো বলল, তা বলে আমাকে হনুমান সাজতে হবে? মুখে মুখোশ?

কাকাবাবু বললেন, না, না, সেরকম কিছুই না। শুধু একটা লম্বা ল্যাজ থাকবে আর মাঝে মাঝে তুমি হুপ হুপ শব্দ করে লাফাবে!

জাম্বুবানের পার্ট পেয়ে সন্তু কোনও আপত্তি করেনি।

সব পার্ট দেওয়া হয়ে গেল। নিচু ক্লাসের কয়েকটি বাচ্চা ছেলেকে সাজানো হবে বানর-সেনা, তাদের কোনও কথা নেই।

তারপর কাকাবাবু বললেন, শোনো সবাই, দুদিনের মধ্যে সবাইকে যার যার পার্ট মুখস্থ করে ফেলতে হবে। এখন কয়েকদিন ইস্কুল কলেজের পড়া না করলেও চলবে। শুধু পার্ট মুখস্থ। ইস্কুলের পড়া প্রতি বছর বদলে যায়, পরে অনেক কিছু মনেও থাকে না। কিন্তু দেখো, এই থিয়েটারের কথা তোমাদের সারাজীবন মনে থাকবে! আর একটা কথা, রিহার্সালের সময় এক মিনিটও দেরি করে হাজির হলে চলবে না। যার দেরি হবে, তাকে আমি কান ধরে ওঠ-বোস করাব, আর পর পর দুদিন যে দেরি করে আসবে, সে থিয়েটার থেকে বাদ!

পর পর দুদিন বেশ ভালই রিহার্সাল হল। সকাল থেকে সন্ধে পর্যন্ত। মাঝখানে দুপুরবেলা এ বাড়িতেই সবাই মিলে একসঙ্গে খিচুড়ি-মাংস খাওয়া।

তৃতীয় দিনে হঠাৎ দেখা দিল এক উপদ্রব।

বিকেলবেলা গাড়ি নিয়ে উপস্থিত হল দেবলীনা।

রিহার্সাল বেশ জমে উঠেছে, তার মধ্যেই সে ঢুকে পড়ে এগিয়ে গেল কাকাবাবুর দিকে। টকটকে লাল রঙের ফ্রক পরেছে, তাকে মনে হচ্ছে আগুনের হলকা।

কাকাবাবুকে সে জিজ্ঞেস করল, কী ব্যাপার, তোমাদের সোমবারে ফেরার কথা ছিল না? আমি দুদিন ধরে টেলিফোন করে করে পাচ্ছি না।

কাকাবাবু বললেন, নাঃ, ফেরা হল না।

দেবলীনা সন্তুর দিকে ফিরে চোখ পাকিয়ে বলল, অ্যাই সন্তু, খুব কলেজে ফাঁকি দেওয়া হচ্ছে? লেখাপড়া গোল্লায় গেছে। বেশিদিন গ্রামে থাকলে পেঁয়ো ভূত হয়ে যায়, জানিস না?

জোজো বলল, এই রে, এসে গেছে মূর্তিমতী ঝঞ্ঝা!

দেবলীনা তার দিকে ফিরে বলল, কী বললি, কী বললি?

সন্তু জোজোকে বলল, এত শক্ত শক্ত বাংলা এ বোঝে না!

দেবলীনা বলল, আমি বাংলা বুঝি না? আমি ঝঞ্ঝা মানে জানি, কুজ্ঝটিকা মানেও জানি! তুই কিংকর্তব্যবিমূঢ় মানে বলতে পারবি?

সময় নষ্ট হচ্ছে বলে, কাকাবাবু অস্থির হয়ে বললেন, দেবলীনা, তুমি একটু পাশে বসে থাকে। আমরা একটা কাজ করছি।

এতক্ষণ ঘরের মধ্যে আর কে আছে, না আছে, তা লক্ষই করেনি দেবলীনা। এবার সে মুখ ঘুরিয়ে সবাইকে দেখল। তারপর বলল, এরা সবাই একটা করে বই হাতে নিয়ে বসে আছে কেন? ইস্কুল হচ্ছে বুঝি?

কাকাবাবু বললেন, না, আমরা নাটকের রিহার্সাল দিচ্ছি।

দেবলীনা বলল, নাটকের রিহার্সাল মানে?

জোজো বলল, কাকাবাবু, ও রিহার্সাল মানেও জানে না। কা

কাবাবু বললেন, এখানে থিয়েটার হবে।

দেবলীনা ভুরু কুঁচকে, জোর দিয়ে বলল, থিয়েটার? থিয়েটার? আমাকে বাদ দিয়ে? ও সেইজন্য তোমরা গ্রামে লুকিয়ে বসে আছ? ঠিক সময়ে এসে পড়েছি।

আমাকেও পার্ট দিতে হবে।

জোজো বুড়োআঙুলে কলা দেখিয়ে বলল, উপায় নেই! উপায় নেই, সব পার্ট দেওয়া হয়ে গেছে!

দেবলীনা সে-কথা গ্রাহ্য না করে কাকাবাবুর দিকে ফিরে বলল, ওসব আমি জানি না। আমাকে পার্ট দিতেই হবে। ওই সন্তুটা তো কিছু পারে না, ওর পার্টটা আমাকে দাও!

সন্তু সঙ্গে সঙ্গে বলল, আমি আমার পার্ট ছেড়ে দিতে রাজি আছি। তোকে কিন্তু পুরুষ সাজতে হবে!

দেবলীনা বলল, পুরুষ সাজতে হবে কেন? তোর ইচ্ছে হয়, তুই মেয়ে সাজ গিয়ে। আমি মেয়ের পার্টই চাই!

সন্তু বলল, এ নাটকে তো একটাও মেয়ের পার্ট নেই!

দেবলীনা বলল, কেন, মেয়ের পার্ট নেই কেন?

সন্তু বলল, তা আমি কী জানি! নাট্যকারকে জিজ্ঞেস করতে হবে।

কাকাবাবু বললেন, নাট্যকারকে জিজ্ঞেস করার একটু অসুবিধে আছে। সুকুমার রায় আমারও জন্মের আগে স্বর্গে চলে গেছেন?

দেবলীনা সন্তুর হাত থেকে বইটা নিয়ে ছুড়ে ফেলে দিয়ে বলল, মেয়েদের পার্ট নেই, তার মানে এটা বিচ্ছিরি নাটক! অন্য বই করো।

কাকাবাবু বললেন, অনেকদূর এগিয়ে গেছে, এখন তো আর বদলানো যায় না। আমরা বরং কলকাতায় গিয়ে আবার থিয়েটার করব। তখন তোমাকে

দেবলীনা বলল, ওসব শুনতে চাই না। আমাকে এই থিয়েটারেই পার্ট দিতে হবে!

জোজো বলল, কাকাবাবু, ওকে কাটা সৈনিকের পার্ট দেওয়া যেতে পারে। স্টেজে মরে পড়ে থাকবে!

দেবলীনা জিজ্ঞেস করল, কাকাবাবু, এই জোজোটা কীসের পার্ট করছে?

কাকাবাবু বললেন, হনুমান!

দেবলীনা ভেংচি কেটে বলল, হনুমান? ঠিক মানিয়েছে। নিশ্চয়ই মস্ত বড় ল্যাজ থাকবে? থিয়েটারের দিনে আমি ওর ল্যাজে আগুন ধরিয়ে দেব!

জোজো বলল, বোকা মেয়ে, হনুমান বুঝি আগুনকে ভয় পায়? রামায়ণ পড়িসনি?

গ্রামের অন্য ছেলেরা দেবলীনার কাণ্ডকারখানা দেখে হা হয়ে আছে। অনেক সময় নষ্ট হচ্ছে বলে কাকাবাবু একরকম জোর করেই দেবলীনাকে টেনে এনে নিজের পাশের একটা চেয়ারে বসিয়ে দিলেন।

দেবলীনার মুখোনা থমথমে হয়ে আছে। মনে হয় যেন রাগে আর দুঃখে সে কেঁদেই ফেলবে।

তারপর রিহার্সালে মজার মজার কথাগুলো শুনে একটু একটু বদলাতে লাগল তার মুখের রং।

একসময় বিভীষণ হনুমানের উদ্দেশে গান ধরল :

শোন রে ওরে হনুমান
হও রে ব্যাটা সাবধান
আগে হতে স্পষ্ট বলে রাখি।
তুই ব্যাটা জানোয়ার
নিষ্কর্মার অবতার
কাজেকন্মে দিস বড় ফাঁকি!

তা শুনতে শুনতে হি হি করে হেসে ফেলল দেবলীনা। এবার সেও দুই আঙুলে কলা দেখাল জোজোর দিকে।
চারদিনের মধ্যেই সবার বেশ পার্ট মুখস্থ হয়ে গেল।

কাকাবাবুর নিজেরও সব মনে পড়ে গেছে। গানগুলো তিনি বই না দেখেই গেয়ে শোনাতে পারেন।

ছোটমামা এরমধ্যে পোস্টার ছাপিয়ে ফেলেছেন। টাকি থেকে বসিরহাট পর্যন্ত অনেক দেওয়ালে দেওয়ালে সেই পোস্টার। পরিচালক হিসেবে বড় বড় অক্ষরে লেখা : রাজা রায়চৌধুরী, ব্রাকেটে কাকাবাবু।

সকালবেলা বেড়াতে বেরিয়ে সেই পোেস্টার দেখে কাকাবাবু লজ্জা পেয়ে গেলেন।

বাড়িতে ফিরে এসে তিনি ছোটমামাকে বললেন, আরে চাদু, এটা কী করেছ, তুমি আমার নামটা দিতে গেলে কেন?

ছোটমামা বললেন, তোমার নামে বেশি টিকিট বিক্রি হবে!

কাকাবাবু বললেন, ধ্যাত, আমাকে এখানে কে চিনবে? লোকে ভাববে বুঝি, কোনও যাত্রাদলের অধিকারী!

ছোটমামা বললেন, তুমি জানো না রাজাদা, তুমি কতটা বিখ্যাত। অনেকেই আমাকে জিজ্ঞেস করেছে, ইনিই কি সেই সবুজ দ্বীপের রাজার কাকাবাবু? অনেকেই তো টিভি-তে তোমার আরও সিনেমা দেখেছে!

কাকাবাবু বললেন, বেশি লোকে আমাকে চিনে ফেলুক, আমি মোটেই তা চাই। আমার শত্রুরও তো অভাব নেই!

সব পোস্টার দেওয়ালে দেওয়ালে সেঁটে দেওয়া হয়েছে, এখন তো আর তুলে ফেলাও যায় না।

বৃষ্টির জন্য রিহার্সালে ব্যাঘাত হচ্ছে খানিকটা। এক এক সময় এত জোর বৃষ্টি নামে, কেউ বাড়ি থেকে বেরোতেই পারে না। তবু কিছু কিছু ছেলে এমনই মজা পেয়ে গেছে যে, সেই বৃষ্টির মধ্যেও দৌড়ে দৌড়ে এসে হাজির হয়।

আজ সকাল ও দুপুরে একটানা বৃষ্টি হল।

এরমধ্যেই বাড়িতে বাড়িতে খবর পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে, বিকেলবেলা ঝড়, বৃষ্টি, বজ্রপাত যাইই হোক, চারটে থেকে রিহার্সাল শুরু করতেই হবে। থিয়েটার করতে গেলে ভালভাবে করা উচিত।

সৌভাগ্যবশত দুপুর সাড়ে তিনটের পরই বৃষ্টি থেমে গেল। আকাশ পরিষ্কার। চারটে বাজতেই কাকাবাবু বললেন, সন্তু, দ্যাখ, সবাই এসেছে কিনা! হ্যাঁ। প্রত্যেকেই এসেছে বলতে গেলে, শুধু সুকোমল ছাড়া। অন্যদিন কিন্তু সুকোমল আগে আগেই এসে হাজির হয়। অনেক নাটকের দলে, কেউ একজন অনুপস্থিত থাকলে প্রক্সি দিয়ে রিহার্সাল শুরু হয়ে যায়। কাকাবাবু সেটা পছন্দ করেন না। তিনি মাঝখান থেকেও রিহার্সাল দেন না। প্রত্যেকদিন-একেবারে প্রথম দৃশ্য থেকে টানা শেষ পর্যন্ত। রাম আছে প্রথম দৃশ্যেই। কিছুক্ষণ তার জন্য অপেক্ষা করা হল। পাঁচ মিনিট, দশ মিনিট, আধঘণ্টা কেটে গেল, সুকোমল এল না।

যে ছেলেটি লক্ষ্মণের পার্ট করছে, তার নাম দিবাকর। সে সুকোমলকে পছন্দ করে না। এক সময় সুকোমলের সঙ্গে তার কী নিয়ে যেন ঝগড়া হয়েছিল, অর্থাৎ রাম আর লক্ষ্মণের মধ্যে ভাব নেই।

দিবাকর উঠে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করল, কাকাবাবু, সুকোমল এলে আপনি তাকে কান ধরে ওঠবোস করাবেন?

কাকাবাবু গম্ভীর মুখে বললেন, নিশ্চয়ই! পুলিশসাহেবের ছেলেকে সত্যি সত্যি কান ধরে ওঠ-বোস করানো হবে কি না তা নিয়ে অনেকেরই কৌতূহল আছে। সবাই ঘন ঘন তাকাচ্ছে দরজার দিকে।

আরও দশ মিনিটের মধ্যেও সুকোমল এল না।

কাকাবাবু বেশ বিরক্ত হয়েছেন। বইটার পাতা থেকে চোখ তুলছেন না।

একটু বাদে বললেন, আর তো দেরি করা যাবে না। ততক্ষণ গানগুলো প্র্যাকটিস হোক। সুকোমলের বাড়ি কত দূরে? কেউ গিয়ে খবর নিয়ে আসতে পারবে?

দিবাকরই উঠে দাঁড়াল। সাইকেলে যেতে-আসতে দশ মিনিটও লাগবে না।

কয়েকটা কোরাস গান আছে, সেগুলো এখনও ঠিক তৈরি হয়নি। কাকাবাবু সে-গুলোই ভাল করে শেখাতে লাগলেন।

দিবাকর ফিরে এসে জানাল, সুকোমল বাড়িতেও নেই। তার মা বলেছেন, সে রিহার্সাল দেওয়ার জন্য চারটের আগেই বেরিয়ে গেছে।

তবে কি সুকোমল নাটকের রিহার্সাল দেওয়ার নাম করে অন্য জায়গায় আড্ডা দিতে গেছে? ছি ছি ছি। নাটক সম্পর্কে তার উৎসাহ নেই? তা হলে জোর করে

সে রামের পার্ট নিতে গেল কেন?

এর পরেও একঘণ্টা, দেড়ঘণ্টা কেটে গেল, সুকোমল আর এলই না। রিহার্সাল শেষ হল সাড়ে সাতটায়।

এখানে প্রায়ই লোডশেডিং হয়। অন্ধকারে রাস্তায় হাঁটা বিপজ্জনক। এই বর্ষাকালে সাপটাপ বেরোয়, তাই ছেলেদের আর আটকে রাখা যায় না।

সবাই চলে যাওয়ার পর কাকাবাবু বারান্দায় বসলেন এক কাপ কফি নিয়ে। জোজো আর সন্তু এসে বসল কাছে।

জোজো বলল, কাকাবাবু, আপনি যে লক্ষ্মণের শক্তিশেল নাটকে অভিনয় করেছিলেন, কেমন হয়েছিল? ভাল? না কি কোনও গণ্ডগোল হয়েছিল?

কাকাবাবু বললেন, সে অনেকদিন আগের কথা, কিন্তু আমার মনে আছে সব। একটু-আধটু গণ্ডগোল হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু সেসব কথা এখন বলতে ইচ্ছে করছে। পরে সে গল্প শোনাব। আমি ভাবছি সুকোমলের কথা। কেন সে আজ এল? তাকে এমনিতে বেশ সিনসিয়ার মনে হয়েছিল। রিহার্সালের নাম করে সে অন্য কোথাও যাবে আড্ডা দিতে?

জোজো বলল, নিশ্চয়ই ট্রাফিক জ্যামে পড়েছে!

কাকাবাবু বললেন, সাইকেলে যার বাড়িতে যেতে পাঁচ মিনিট লাগে, তার মধ্যে ট্রাফিক জ্যাম?

সন্তু জানে, কাকাবাবু কোনও একটা কাজে হাত দিলে সেটা ঠিকঠাক শেষ না করা পর্যন্ত কিছুতেই স্বস্তি বোধ করেন না। আজ রাত্তিরে সুকোমলের কথা চিন্তা করে ঘুমোতেই পারবেন না তিনি।

কথা ঘোরাবার জন্য সে বলল, কাকাবাবু, শিশির ভাদুড়ি নামে একজন বড় অভিনেতার কথা আমরা বইতেই পড়েছি। তুমি কি তার থিয়েটার দেখেছ?

কাকাবাবু কিছু বলার আগেই জোজো বলল, আরে শিশির ভাদুড়ি তো আমার বাবার শিষ্য ছিলেন। একবার তার গলায় এমন ব্যথা হল—

জোজো গল্পটা শেষ করতে পারল না।

ছোটমামা এসে বললেন, রাজাদা, একটা খুব চিন্তার ব্যাপার হল। সুকোমল বাড়ি থেকে বেরিয়েছিল রিহার্সালে আসবে বলে। এখানে সে আসেনি। বাড়িতেও

সে ফেরেনি। কেউ তার কোনও খবর বলতে পারছে না!

কাকাবাবু বললেন, বাড়িতে ঝগড়াটগড়া করেছিল নাকি?

ছোটমামা বললেন, না, সেসব কিছু হয়নি। বাড়ি থেকে দুধ-কলা আর মুড়ি খেয়ে বেরিয়েছিল। ওর মা বলল, সবটা খায়নি, রিহার্সালের দেরি হয়ে যাচ্ছে বলে তাড়াতাড়ি জামাটামা পরে নিয়ে দৌড়ে বেরিয়ে গেল, আবার ফিরেও এল, বইটা নিয়ে যায়নি। তখন চারটে বাজতে ঠিক দশ মিনিট বাকি।

কাকাবাবু বললেন, ধরা যাক, রিহার্সালে না এসে সে মিথ্যে কথা বলে অন্য কোথাও গেছে। এত রাত পর্যন্ত সে বাড়ির বাইরে থাকে?

ছোটমামা বললেন, এখানে তো সন্ধের পর আর করার কিছু নেই। কোথায় থাকবে? অন্য সময় সে বাবলু নামে তার এক বন্ধুর বাড়িতে ক্যারাম খেলতে যায়। সে ছেলেটির জ্বর হয়েছে কদিন থেকে। তার বাড়িতেও খোঁজ নেওয়া হয়েছে, সেখানেও সে যায়নি।

সামনের রাস্তা দিয়ে বিকট শব্দে একটা মোটরসাইকেল ছুটে গেল।

তারপরেই দেখা গেল, বাগানের মধ্যে গোলমতন কী একটা জিনিস এসে পড়েছে, তাতে চিড়িক চিড়িক করে আগুন জ্বলছে।

সন্তু আর জোজো সেদিকে যাওয়ার চেষ্টা করতেই কাকাবাবু চেঁচিয়ে উঠলেন, যাবি না, কাছে যাবি না!

সঙ্গে সঙ্গে সেটা প্রচণ্ড শব্দে ফেটে গেল।

ছোটমামা দারুণ অবাক হয়ে বললেন, কী, আমার বাড়িতে বোমা? কার এত সাহস?

কাকাবাবু বললেন, আওয়াজ শুনেই বুঝতে পেরেছি, ওটা আসল বোমা নয়। বোমাবাজি। এমনি কেউ ভয় দেখাবার চেষ্টা করেছে।

ছোটমামা বললেন, আমাকে কে ভয় দেখাবে? কীসের জন্য ভয় দেখাবে?

কাকাবাবু বললেন, তুমি গ্রামের মানুষের জন্য অনেক কাজ করছ। অনেকে তোমায় ভালবাসে। আবার তোমার বিরুদ্ধপক্ষও আছে নিশ্চয়ই!

ছোটমামা বললেন, তা তো থাকবেই। কেউ কেউ আমার পেছনে লাগতে যায়। সে আমি গ্রাহ্য করি না।

কাকাবাবু বললেন, তুমি যে এত বড় অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছ, কলকাতা থেকে বড় বড় আর্টিস্ট আনাচ্ছ, সে ব্যাপারে সবাই তোমাকে সাহায্য করছে?

ছোটমামা বললেন, সবাই কি আর একমত হয়? গগন সাহা নামে এখানে একজন পাণ্ডাগোছের লোক আছে, মাছের ব্যবসায় অনেক টাকা করেছে, সে চেয়েছিল কমিটির সেক্রেটারি হতে। এখানে জানেন তো, কিছু করতে গেলেই একটা কমিটি হবে, আর তার সেক্রেটারি হওয়ার জন্য কিছু লোক ব্যস্ত হয়ে পড়ে।

কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, সেই গগন সাহাকে সেক্রেটারি করা হয়নি?

ছোটমামা বললেন, গগন এমনিতে বেশ কাজের লোক, খুব খাটতে পারে, কিন্তু একটাই ওর দোষ। কিছু হলে তার থেকে ও টাকা চুরি করবেই। এমনিতে ওর এখন খুব ভাল অবস্থা, গ্রামে মস্ত বাড়ি, শহরে বাড়ি। তবু পাবলিকের টাকা চুরি না করে পারে না। সেইজন্যই গগন সাহাকে নিলে অন্য অনেকে আপত্তি করত।

কাকাবাবু বললেন, তাতে গগন সাহা নিশ্চয়ই চটে গেছে। সে তোমার অনুষ্ঠান ভণ্ডুল করার চেষ্টা করতেই পারে। অনুষ্ঠানটা শেষ পর্যন্ত ঠিকঠাক না হলে তোমারই তো বদনাম হবে।

সন্তু জিজ্ঞেস করল, ওই গগন সাহার কি মোটরসাইকেল আছে?

ছোটমামা একটু থমকে গিয়ে বললেন, ঠিক বলেছিস তো! আজকাল গগন একটা নতুন মোটরবাইক হাঁকিয়ে বেড়ায়!

তারপরই তিনি আবার বললেন, তা বলে গগন আমার বাগানে বোমা ছুড়ে যাবে, এত সাহস তার হবে না। আমাকে সে ভয়ও পায়।

কাকাবাবু বললেন, তোমাকে ভয় পাবে কেন? তোমার কীসের জোর? পুলিশ তোমাকে সাহায্য করে?

ছোটমামা বললেন, না, না, আমি নিজের কোনও ব্যাপারে পুলিশের সাহায্য নিই না। সুকোমলের বাবাকেও কখনও বাড়িতে ডাকিনি। গ্রামের মানুষ আমাকে ভালবাসে। আমার মুখের কথায় হাজার হাজার মানুষ ওর বাড়ি ঘিরে ফেলতে পারে। দু-একবার এমনিই গ্রামের মানুষ ওকে মারতে গেছে। শেষ পর্যন্ত আমিই ওকে বাঁচিয়েছি।

কাকাবাবু বললেন, তুমি ওকে বাঁচিয়েছ, সেইজন্য তোমার ওপর ওর আরও রাগ বাড়বে। সেটাই তো নিয়ম!

জোজো জিজ্ঞেস করল, সুকোমলের বাবা কোথায়?

কাকাবাবুও মনে মনে এই কথাটাই ভাবছিলেন অনেকক্ষণ ধরে। সুকোমলের বাবা এর মধ্যে একবারও আসেননি। সন্তু আর জোজোও জানে, কাকাবাবু যেখানে যান পুলিশের কর্তারা এসে তাঁর সঙ্গে দেখা করে যায়।

ছোটমামা বললেন, সুকোমলের বাবার নাম নিখিল মাহাতো। উনি বিশেষ কাজে বারাসত গেছেন, টেলিফোনেও তাকে ধরা যায়নি। উনি এখনও কিছু খবর পাননি!

কাকাবাবু উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, চলো, একবার গগন সাহার সঙ্গে দেখা করে আসি!

ছোটমামা বললেন, এখন যাবেন? অনেক রাত হয়ে গেছে। খাওয়াদাওয়া হয়নি।

কাকাবাবু বললেন, খাওয়াদাওয়া পরে হবে। কীরে সন্তু, জোজো, তোদের খিদে পায়নি তো? আজ রাত্তিরের মধ্যেই সুকোমলের খোঁজ বার করতে হবে। কাল রিহার্সাল বন্ধ রাখা চলবে না।
রাস্তা একেবারে অন্ধকার। এদিকে গাড়ি বিশেষ চলে না, সাইকেল রিকশাও কমে এসেছে। ছোটমামা সাইকেল চালিয়ে গিয়ে দুটো সাইকেল রিকশা ডেকে আনলেন।

রাস্তার পাশের বাড়িগুলোতে মানুষজন জেগে আছে, না এরই মধ্যে ঘুমিয়ে পড়েছে তা বোঝার উপায় নেই। লোডশেডিং, কয়েকটা বাড়িতে টিম টিম করে হ্যারিকেন জ্বলছে।

বাজারের কাছে অবশ্য এখনও অনেক লোক আছে। কিছু কিছু দোকান খোলা রেখেছে হ্যাজাক জ্বালিয়ে। বাজারের বাইরের রাস্তায় বসা তরকারিওয়ালারা চেঁচাচ্ছে, নিয়ে যান, শস্তায় পটল! শস্তায় ঝিঙে! দেড় টাকায় একটা লাউ, নিয়ে যান, নিয়ে যান!

বাজার পেরিয়ে আরও খানিকটা যাওয়ার পর গগন সাহার বাড়ি।

নতুন বাড়ি, দোতলা। পাঁচিল দিয়ে ঘেরা, সামনে লোহার গেট। একতলা অন্ধকার, দোতলায় আলো জ্বলছে, অর্থাৎ এদের নিজস্ব জেনারেটার আছে। গ্রামে সেটাই বড়লোকদের চিহ্ন।

লোহার গেটে তালাবন্ধ। ছোটমামা কয়েকবার ঘটাঘট শব্দ করলেন, কেউ এল। তখন হাঁক দিলেন, গগন, গগন!

এবারে ভেতর থেকে একজন বলল, দাদা নেই!

ছোটমামা বললেন, একবার গেটটা খোলো। আমি চাঁদুবাবু বলছি!

ভেতর থেকে আবার উত্তর এল, বলছি তো দাদা বাড়ি নেই।

কোথায় গেছে?

তা জানি না।

একবার গেটটা খুলতে পারছ না?

কী মুশকিল! দাদা বাড়ি নেই। গেটে তালা পড়ে গেছে, এখন খোলা বারণ!

ওপরে তো আলো জ্বলছে দেখছি!

আলো জ্বালা কি নিষেধ নাকি?

গগন বাড়িতে নেই বলছ!

বাড়িতে নেই, তবু কি আছেন বলব? দাদার জ্যাঠাবাবু এসে এখানে রয়েছেন, তাই তেনার ইচ্ছেতে আলো জ্বালিয়েছেন!

কাকাবাবু বললেন, এরপর একমাত্র পুলিশই জোর করে বাড়িতে ঢুকতে পারে। আমরা তা পারি না।

জোজো বলল, অন্যভাবেও ঢোকা যায়। পেছনের জলের পাইপ বেয়ে সন্তু অনায়াসে ছাদে উঠে যেতে পারে।

সন্তু বলল, আমি তো পারবই। তুই পারবি না?

জোজো বলল, আমিও পারি। কতবার দশতলা-বারোতলা উঠে গেছি, এ তো মোটে দোতলা। আমার শুধু একটাই মুশকিল। যদি কুকুর থাকে? আমি কুকুর ম্যানেজ করতে পারি না।

কাকাবাবু বললেন, থাক, অতটা দরকার নেই।

সন্তু বলল, ভেতর থেকে যে-লোকটা কথা বলল, তার দাড়ি আছে, আর একটা চোখ ট্যারা।

জোজো বলল, তুই কী করে জানলি?

সন্তু বলল, তুই গিয়ে দেখে আয় মেলে কিনা!

জোজো বলল, শার্লক হোমস হলে এখান থেকেই প্রমাণ করে দিত।

ছোটমামা বললেন, আমার মনে হয়, গগন সত্যিই বাড়ি নেই। এতটা বাড়াবাড়ি সে করবে না। তবে, আজ বিকেলেও আমি তাকে দেখেছি।

কাকাবাবু বললেন, ভেতরের লোকটি তো বলল, রাত্তিরে আর সে ফিরবে না।

ছোটমামা বললেন, এক হতে পারে, গগনের গ্রামেও একটা বাড়ি আছে। এখন সে শহরে থেকে ব্যবসা করলেও গ্রামের সঙ্গে যোগাযোগ রাখে। সেখানকার বাড়িটা আরও বড় করে, সুন্দর করে সাজিয়েছে। মাঝে মাঝে সেখানে গিয়ে থাকে দু-একদিন।

কাকাবাবু বললেন, চলো, সেই বাড়িতে।

ছোটমামা প্রায় আঁতকে উঠে বললেন, এখন? অসম্ভব!

কাকাবাবু শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করলেন, অসম্ভব কেন? অনেক দূর!

ছোটমামা বললেন, না, অনেক দূর নয়। কিন্তু রাস্তা খারাপ। বর্ষাকালে কাদায় ভরা। সাইকেল রিকশা যেতে পারবে না।

কাকাবাবু বললেন, গগন যায় কী করে?

ছোটমামা বললেন, মোটরসাইকেল যেতে পারে। জিপগাড়িও যেতে পারে। এমনিতে রাস্তা চওড়া, তবে—

কাকাবাবু বললেন, একটা জিপগাড়ি জোগাড় করো!

ছোটমামা বললেন, তুমি কী বলছ রাজাদা? এত রাতে আমি জিপ জোগাড় করব কোথা থেকে?

কাকাবাবু এবার প্রচণ্ড রেগে উঠে বললেন, দ্যাখো চাঁদু, তুমি এত বছর ধরে গ্রামে আছ। জিপ কোথা থেকে জোগাড় করবে, তা কি আমাকে বলে দিতে হবে? যেখান থেকে পারো একটা জিপ নিয়ে এসো!

কাকাবাবুর ধমক খেয়ে ছোটমামা কুঁকড়ে গেলেন। খানিকটা কাজও হল। সবাইকে সেখানে দাঁড় করিয়ে রেখে ছোটমামা একটা সাইকেল রিকশা নিয়ে চলে গেলেন বাজারের দিকে।

জোজো বলল, সন্তু, বাজি ধরবি, ছোটমামা জিপ আনতে পারবেন কিনা।

সন্তু বলল, ঠিক পঁয়তিরিশ মিনিটের মধ্যে জিপ নিয়ে এসে পড়বেন।

কাকাবাবু বললেন তোমরা বরং আর একটা বাজি ধরো। গগন সাহা এবাড়িতেই লুকিয়ে আছে, না গ্রামের বাড়িতে আছে?

জোজো বলল, এ-বাড়িতেই আছে।

সন্তু জিজ্ঞেস করল, তুই কী করে বুঝলি?

জোজো বলল, তুই যেভাবে তখন বুঝলি যে, ভেতরে লোকটার দাড়ি আর এক চোখ ট্যারা।

সন্তু বলল, এত সাততাড়াতাড়ি গেটে তালা দেওয়ার কী মানে হয়? মোটে তো নটা বাজে!

কাকাবাবু বললেন, তোদের কী মত? এই রাত্তিরেই গ্রামের বাড়িটা একবার দেখে আসা উচিত।

দুজনে প্রায় একই সঙ্গে বলে উঠল, নিশ্চয়ই!

কাকাবাবু বললেন, কিছু না পাওয়া গেলেও রাত্তিরবেলা গ্রাম তো ঘুরে আসা হবে। তাই বা মন্দ কী?

দূরে একটা মোটরসাইকেলের আওয়াজ শোনা গেল।

তীব্র হেডলাইট জ্বেলে সেটা এদিকেই আসছে।

জোজো বলল, এইবার গগন সাহা ধরা পড়বে! ওর কাছে যদি বোমা থাকে?

কাকাবাবু বললেন, তোমরা একটু দূরে সরে গিয়ে অন্ধকারে গা-ঢাকা দিয়ে থাকো।

অন্য সাইকেল রিকশাটা এর মধ্যে চলে গেছে। কাকাবাবু একলা দাঁড়িয়ে রইলেন মাঝরাস্তায়।

মোটরসাইকেলটা গর্জন করতে করতে এসে থামল এই বাড়ির সামনে। যে চালাচ্ছে, তার মাথায় হেলমেট। এবার সেটা খুলতেই, অল্প আলোয় বোঝা গেল, তার বয়েস মাত্র তেইশ-চব্বিশের বেশি নয়। অর্থাৎ সে গগন সাহা হতেই পারে না।

সঙ্গে সঙ্গে খুলে গেল বাড়িটার ভেতরের দরজা, বেরিয়ে এল দুজন। তাদের মধ্যে একজন গাঁট্টাগোট্টা লোক, আর একজন মেয়ে। উনিশ-কুড়ির মতন বয়েস।

গেটও খোলার পর মেয়েটি এসে বসল মোটরবাইকের পেছনের সিটে।

যে-চালাচ্ছে, সে চেঁচিয়ে বলল, সব ঠিক আছে তো নিবারণদা?

অন্য লোকটি কী বলল তা শোনা গেল না। মোটরসাইকেলটি আবার বেরিয়ে গেল হুস করে।

এবার সে বাড়ির দোতলার আলোও নিভে গেল। সন্তু আর জোজো কাছে চলে আসার পর কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, কী রে, কী বুঝলি?

জোজো বলল, যাকে বলে, রহস্য ঘনীভূত! এই কি সেই মোটরসাইকেলের লোকটা, যে বোমা ছুড়েছে? ও আসতেই গেট খুলে গেল কেন?

কাকাবাবু বললেন, অনেক সময় অনেক সাধারণ ঘটনাও রহস্যময় মনে হয়। আরও অনেক লোক মোটরসাইকেল চালাতে পারে। হয়তো এই মেয়েটা এই বাড়িতে কোনও কাজ করে। এই ছেলেটি রোজ এইসময় তাকে নিয়ে যায়!

জোজো বলল, ছেলেটা যে বলল, সব ঠিক আছে তো?

কাকাবাবু বললেন, তারও অনেক রকম মানে হতে পারে।

সন্তু বলল, অন্য যে-লোকটা বাড়ি থেকে বেরিয়ে এল, তার দাড়ি ছিল। সে-ই নিশ্চয়ই আগে কথা বলছিল।

জোজো বলল, হ্যাঁ, দাড়ি ছিল, আমি দেখেছি। কিন্তু ট্যারা ছিল কি?

সন্তু বলল, ট্যারা হতে বাধ্য। কাল এসে দেখে যাস।

দূরে চোখে পড়ল একটা গাড়ির হেডলাইট।

সন্তু বলল, ওই যে ছোটমামা জিপ নিয়ে আসছেন। পঁয়তিরিশি মিনিট হয়েছে—

সন্তুর কথা পুরোপুরি মিলল না।

সামনে এসে যে-গাড়িটা দাঁড়াল সেটা জিপ নয়। অ্যাম্বাসাডর। সেটা থেকে নেমে ছোটমামা বললেন, ওঃ রাজাদা, এই ড্রাইভারকে ডেকে তুলতে আমাকে কী কাণ্ডই না করতে হয়েছে। ও একেবারে ঘুমিয়ে কাদা হয়ে ছিল। নেহাত আমি ওর ব্যাঙ্কের ঋণের পক্ষে দাঁড়িয়েছি, তাই আসতে রাজি হয়েছে। ওর নাম সুধীর।

সবাই মিলে ওঠা হল গাড়িতে।

ড্রাইভার রুক্ষ গলায় বলল, শুনুন স্যার, আমি কিন্তু হাফ অ্যান আওয়ারের বেশি দেরি করতে পারব না। কাল সকালেই আমাকে ভাড়া খাটতে যেতে হবে।

কাকাবাবু খুব মোলায়েম গলায় বললেন, সুধীর, তুমি যে আসতে রাজি হয়েছ, তাতেই আমরা তোমার কাছে কৃতজ্ঞ! তুমি তোমার গাড়ি ভাড়া খাটাও? তোমার লাইসেন্স আছে?

সুধীর বলল, নিশ্চয়ই লাইসেন্স আছে! আমি বেআইনি কোনও কাজ করি না।

কাকাবাবু বললেন, তা হলে তুমি এই আইন জান নিশ্চয়ই, যে মুহূর্তে আমি তোমার গাড়িতে চাপলাম, তারপর থেকেই তুমি আমার ড্রাইভার হয়ে গেলে? এখন আমি যেখানে যাব, তোমাকে নিয়ে যেতে হবে! এমনকী, যদি দার্জিলিং যেতে চাই–

লোকটি মুখ ফিরিয়ে তাকাতেই কাকাবাবু হেসে বললেন, আমি এমনি এমনি তোমাকে ভয় দেখাচ্ছি। আমরা বেশিক্ষণ তোমাকে আটকাব না। বড়জোর এক ঘণ্টা। ডবল ভাড়া পাবে!

ছোটমামা বললেন, বাজারে সবাই জেনে গেছে যে, পুলিশসাহেবের ছেলেকে পাওয়া যাচ্ছে না, তার মা কান্নাকাটি শুরু করেছে।

কাকাবাবু বললেন, ছেলেটা যদি অবাধ্য, ছটফটে হত, তা হলেই না হয় মনে করা যেত সে নিজেই কোথাও চলে গেছে। কিন্তু শান্তশিষ্ট, নরম স্বভাবের ছেলে, খুব উৎসাহের সঙ্গে রিহার্সাল দিচ্ছিল!

জোজো বলল, কাকাবাবু, দেবলীনা সুকোমলকে ভুলিয়ে ভালিয়ে নিয়ে যায়নি তো? ও বলেছিল, আমাদের থিয়েটার ভণ্ডুল করে দেবে!

সন্তু বলল, সুকোমল কি বাচ্চা ছেলে যে, ভুলিয়ে ভালিয়ে নিয়ে যাবে?

কাকাবাবু বাইরে তাকিয়ে বললেন, রাস্তাটা তো বেশ চওড়া দেখছি।

ছোটমামা বললেন, গগন নিজে উদ্যোগ নিয়ে রাস্তাটা সারিয়েছে। তার গ্রামের বাড়িতে অনেকে বেড়াতে আসে!

সারা সকাল বৃষ্টি হলেও তেমন কাদা নেই, গাড়ি চালাতে অসুবিধে হচ্ছে না। মাঝে মাঝে কুকুর ডাকছে। এ ছাড়া আর কোনও শব্দ নেই।

ড্রাইভার গগনের বাড়ি চেনে। একটু বাদেই সে বলল, এই তো এসে গেছি!

বেশ বড় বাড়ি, পাকা বাড়ি। এটাও পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। গেটের সামনে আলো। একজন লোক টুলের ওপর বসে ঢুলছিল, এত লোকজনের শব্দ পেয়ে উঠে দাঁড়াল। তার হাতে বন্দুক।

কাকাবাবু বললেন, বেশ পাহারার ব্যবস্থা আছে দেখছি!

ছোটমামা বললেন, গ্রামে যারা হঠাৎ বড়লোক হয়, তাদের ওপর ডাকাতদের নজর থাকে। পাহারা তো রাখতেই হয়। এখানে ডাকাতি হয় প্রায়ই।

তিনি এগিয়ে গিয়ে দরোয়ানটিকে বললেন, গগনবাবুকে খবর দাও! বলো, চাঁদুবাবু এসেছেন।

দরোয়ানটি বলল, আভি কুছু হবে না।

কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, গগনবাবু এ বাড়িতে আছেন?

দরোয়ানটি একই ভাবে বলল, বলছি তো, আভি কুছু হবে না। রাত হো গিয়া।

ছোটমামা বললেন, তোমার বাবু আমাকে চেনেন। নাম বলো গিয়ে—

দরোয়ানটি বলল, নাম বলনে সে কেয়া হোগা? ইতনা রাত মে গেট খুলনে কা হুকুম না আছে! যাইয়ে যাইয়ে!

লোকটি বন্দুকটি তুলে বলল, কাল সকালমে আইয়ে। আভি কুছু হবে না!

কাকাবাবু বললেন, আমরা যদি ডাকাত হতাম, তা হলে কি ওই বন্দুকটা আমাদের আটকাতে পারত?

সন্তু হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল, বাদুড়! বাদুড়! ওই যে একটা বাদুড়!

সবাই মুখ তুলে তাকাল ওপরের দিকে।

তারই মধ্যে সন্তু এক ঝটকায় দরোয়ানের হাত থেকে বন্দুকটা ছিনিয়ে নিয়েছে।

লোকটি একেবারে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছে।

সন্তু বলল, রাগ মাত কিজিয়ে দরোয়ানজি, আমি শুধু একটু মজা করেছি!

বাড়ি থেকে একজন লোক বেরিয়ে এসে জিজ্ঞেস করল, কে ওখানে? কারা এসেছে?

গলার আওয়াজ চিনতে পেরে ছোটমামা বললেন, গগন, আমি চাঁদুদা।

গগন নামের লোকটি বেশ লম্বা-চওড়া। পাজামার ওপর গেঞ্জি পরা। এগিয়ে আসতে আসতে বলল, চাঁদুদা? কী ব্যাপার, এত রাতে?

ছোটমামা বললেন, হ্যাঁ, রাত হয়ে গেছে বটে। একটা বিশেষ কারণে তোমার সঙ্গে একজন একটু কথা বলতে চান। এঁর নাম রাজা রায়চৌধুরী, নাম শুনেছ বোধ হয়।

গগন বলল, আমি নাম শুনিনি, তবে নিশ্চয়ই খুব বিখ্যাত মানুষ। আসুন, আসুন, ভেতরে আসুন!

ভেতর থেকে একটা বেশ বড় কুকুরের ঘাউ ঘাউ ডাক শোনা গেল।

জোজো জিজ্ঞেস করল, কুকুরটা বাঁধা আছে!

গগন বলল, বাঁধা না থাকলে এতক্ষণ এসে ঝাঁপিয়ে পড়ত। আমার এই দরোয়ানটা কোনও কম্মের না। কিন্তু এই কুকুরের ভয়ে রাত্তিরে কেউ আমার বাড়ির ধারে কাছে আসে না।

ভেতরে বেশ সাজানো গোছানো বসবার ঘর। কয়েকখানা চেয়ার আর জাজিম পাতা। এদিকের দেওয়ালে কয়েকখানা লক্ষ্মীর সরা আটকানো।

গগন বলল, বসুন, বসুন!

ছোটমামা বললেন, বেশি সময় নেব না। গ্রামের ছেলেদের নিয়ে আমরা একটা নাটক করছি জান তো?

গগন বলল, জানব না কেন? চতুর্দিকে পোস্টার পড়েছে।

তারপর কাকাবাবু দিকে তাকিয়ে বলল, সেই পোস্টারেই তো আপনার নাম দেখেছি। আপনি বুঝি কলকাতায় থিয়েটার করেন?

কাকাবাবু হাসিমুখে দুদিকে মাথা নাড়লেন।

তিনি কথা না বলে গগনকে লক্ষ করে যাচ্ছেন।

ছোটমামা বললেন, সারারাত ধরে ফাংশান হবে, কলকাতার শিল্পীরা আসবেন, আমাদের গ্রামের স্কুলের টাকা তোলার জন্য আমাদের কেউ কিছু করবে না? তাই ছেলেদের নিয়ে এই থিয়েটার।

সে তো ভাল কথা।

তুমি তো আমাদের কোনও সাহায্য করলে না।

আপনার অনেক চ্যালা আছে, আকবর আলি, নিতাই ঘোষ, তারাই তো খুব খাটাখাটনি করছে। আমি আর কী সাহায্য করব? আপনি কি আমার কাছে কোনও বিশেষ সাহায্য চাইতে এসেছেন?

হ্যাঁ। এই নাটকে রামের পার্ট করছে আমাদের সার্কেল অফিসারের ছেলে সুকোমল।

পুলিশের কর্তার ছেলে হিরোর পার্ট পাবে, এটাই তো স্বাভাবিক।

সেজন্য নয়। ওর মতন সুন্দর চেহারায় ছেলে আর কে আছে?

বেশ, মানলাম।

সেই সুকোমলকে আজ বিকেল থেকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।

তাই নাকি?

ছোটমামার সঙ্গে কথা বলতে বলতে গগন বারবার তাকাচ্ছে কাকাবাবুর দিকে।

এই ভদ্রলোক তার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন, অথচ কোনও কথা বলছেন না, এতে তার খটকা লেগেছে।

সুকোমলকে পাওয়া যাচ্ছে না শুনে গগন তেমন কিছু অবাক হয়নি, কাকাবাবু সেটাও লক্ষ করলেন।

ছোটমামা বললেন, আমাদের থিয়েটার যাতে না হয়, সেইজন্য কেউ ছেলেটাকে কোথাও লুকিয়ে রেখেছে মনে হচ্ছে।

চিঠি আসেনি?

চিঠি?

চাঁদুদা, যারা ছেলে চুরি করে, তারা এসব থিয়েটার ফিয়েটার গ্রাহ্য করে না। তারা টাকা চায়। এমনি এমনি কেউ অতবড় একটা ছেলেকে লুকিয়ে রাখার ঝুঁকি নিতে যাবে কেন? তাও পুলিশের ছেলে।

সুকোমলকে চুরি করেছে কেউ?

তাই তো মনে হয়। আজকাল এরকম আকছার হচ্ছে।

কী সর্বনাশ!

এইবারে কাকাবাবু উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, আমি একটু বাথরুমে যেতে পারি?

গগন বলল, হ্যাঁ, হ্যাঁ, আসুন। কাছেই আছে, আমি দেখিয়ে দিচ্ছি।

বাথরুমের দরজার কাছে এসে কাকাবাবু গগনের কাঁধে হাত রেখে নিচু গলায় বললেন, অন্যদের সামনে বলতে চাইনি, আমি স্পষ্ট জিজ্ঞেস করছি। আপনি সুকোমলকে লুকিয়ে রেখেছেন?

গগন ভুরু তুলে বলল, আমি? এরকম একটা বাজে কাজ আমি করতে যাব কেন?

কাকাবাবু বললেন, থিয়েটার বন্ধ হয়ে যাবে। তাতে চন্দ্রশেখরের বদনাম হবে। আপনি ওকে পছন্দ করেন না।

গগন বলল, চাঁদুদা আমাকে পছন্দ করে না, আমিও ওকে গুরুঠাকুর মনে করি না। সেটা অন্য ব্যাপার! আমি মশাই মাছের ব্যবসা করি, ছেলেচুরির ব্যবসা করি না।

কাকাবাবু বললেন, সুকোমলকে এ বাড়ির কোথাও লুকিয়ে রাখা হয়নি?

গগন বলল, বাড়ি সার্চ করে দেখতে চান? আপনি কি পুলিশ?

কাকাবাবু বললেন, না, আমি পুলিশ নই। জোর করে সার্চ করার অধিকার আমার নেই। আমি আপনাকেই জিজ্ঞেস করছি।

গগন এবার হো হো করে হেসে উঠল।

তারপর বলল, আরে মশাই, থিয়েটার বন্ধ করার ব্যাপারে আমার কোনও হাত থাকলে সবচেয়ে বেশি কে রেগে যাবে জানেন? আমার বউ! সে আমাকেই বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেবে।

কাকাবাবু বললেন, আপনার স্ত্রী বুঝি থিয়েটার খুব পছন্দ করেন?

গগন বলল, সে তো পছন্দ করে বটেই। আমি ওসব দেখি না। আপনাদের এই নাটকে তো আমার ছেলেও পার্ট করছে। আমার বউ দিনরাত তার পার্ট মুখস্থ করাচ্ছে।

তারপর সে হাঁক দিল, বিন্দু বিন্দু! ঘুমিয়ে পড়ল নাকি!

মোটেই ঘুমিয়ে পড়েনি, ভেতর দিকের দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে ছিল সে।

বেরিয়ে এল ডাক শুনে। বারো-তেরো বছরের ছেলে।

তাকে দেখেই সন্তু বলে উঠল, এ তো আমাদের সুগ্রীব!

ছোটমামাও খুব অবাক হয়ে গগনকে বললেন, এ তোমার ছেলে? তোমার বড় ছেলেটিকে চিনি, একে আগে দেখিনি!

গগন বলল, আমার ছোট ছেলে। কী যেন বাঁদরটাঁদরের পার্ট করছে। এমনিতেও বেশ বাঁদর। মানাবে ভাল।

এই সময় বাইরে শোনা গেল একটা মোটরসাইকেলের শব্দ!
সকালবেলাতেই সুকোমলের বাবা নিখিল মাহাতো এসে হাজির।

বেশ গড়াপেটা, কালো রঙের লম্বা চেহারা, ছেলের মতনই ইনিও খুব বিনীত আর ভদ্র, মুখে একটা লাজুক ভাব। দেখলে পুলিশ বলে মনেই হয় না।

কাকাবাবু ভোরেই উঠেছেন, দ্বিতীয় কাপ চা খাচ্ছেন বাগানে বসে।

আজ আকাশে মেঘ নেই।

নিখিল মাহাতো নমস্কার করে বললেন, সার, আপনার সব কথাই জানি, কিন্তু আপনার সঙ্গে আগে আমি দেখা করতে আসিনি ভয়ে।

কাকাবাবু বললেন, ভয়ে কেন?

নিখিল মাহাতো বললেন, পুলিশের সব বড় বড় কর্তাদের সঙ্গে আপনার চেনাশোনা। আই জি, ডি আই জিরা আপনার ভক্ত। আমি অতি সাধারণ অফিসার। আমি এসে আপনার সময় নষ্ট করতে চাইনি! এখন আসতেই হল।

একটা চেয়ার খালি পড়ে আছে, নিখিল মাহাতো তবু বসছেন না।

কাকাবাবু বললেন, বসুন! বসুন! আমি নিজে কিন্তু একজন সাধারণ মানুষ।

চেয়ারে বসে, পকেটে হাত দিয়ে একটা কাগজ বার করে নিখিল মাহাতো শুকনো গলায় বললেন, বিশেষ কাজে বারাসত গিয়েছিলাম, ফিরেছি অনেক রাতে। তার আগেই ডাকবাক্সে কেউ এই চিঠিটা দিয়ে গেছে।

কাকাবাবু হাত বাড়িয়ে চিঠিটা নিলেন। কাগজটার চারপাশে মোটা, কালো বর্ডার দেওয়া। ওপরের ডান দিকের কোণে একটা মানুষের খুলির ছাপ। ভেতরে গোটা গোটা অক্ষরে হাতে লেখা :

তোমার ছেলে সুকোমলের কোনও ক্ষতি হবে না। ৭ তারিখ রাত নটার মধ্যে পাঁচ লাখ টাকা নিয়ে এলে তাকে ফেরত পাবে। মাঝনদীতে নৌকো নিয়ে একজনমাত্র লোক টাকা নিয়ে আসবে। আমাদের নৌকো থেকে টর্চ জ্বালিয়ে সিগন্যাল দেওয়া হবে নদীর ঠিক বাঁকের মুখে। টাকা না পেলে কিংবা পুলিশ দিয়ে ঘেরাওয়ের চেষ্টা করলে ছেলের দায়িত্ব আমাদের নয়। আর কেউ যেন এর মধ্যে কেরানি দেখিয়ে নাক গলাতে না আসে। আমরা নজর রাখছি। টাকা দে, তা হলে ছেলে পাবি, না হলে পাবি না।

ইতি—
শঙ্খচুড়

চিঠিটা টেবিলের ওপর রেখে কাকাবাবু বললেন, লেখাটা দেখলে মনে হয়, কোনও লেখাপড়া জানা লোকই ইচ্ছে করে খারাপভাবে লিখেছে।

নিখিল মাহাতো বললেন, একেবারে অশিক্ষিত চোর-ডাকাতরা এসব কাজ করে না। আগের কয়েকটা কেসে দেখা গেছে, এর মধ্যে চেনাজানা লোকরাও জড়িত থাকে।

কাকাবাবুর মনে পড়ল, সুকোমলের খবরটা শুনে গগন সাহা প্রথমেই চিঠির কথা বলেছিল। চিঠি যে আসবে, সে জানত। যারা এ চিঠি পাঠিয়েছে তাদেরও হয়তো সে চেনে!

নিখিল মাহাতো দুহাত দিয়ে মুখ ঢেকে ফেললেন।

একজন পুলিশ অফিসারকে এরকম ভাবে কেঁদে ফেলতে কখনও দেখা যায় না। কিন্তু এখন তো তিনি পুলিশ নন, একটি ছেলের বাবা।

অন্য কাউকে কাঁদতে দেখলে কাকাবাবুরও চোখে জল এসে যায়। তিনি অন্যদিকে মুখ ফেরালেন।

একটু পরেই নিখিল মাহাতো রুমাল দিয়ে চোখ মুছে বললেন, মাফ করবেন, হঠাৎ দুর্বল হয়ে পড়েছিলাম। এখন কী করি বলুন তো সার? আমার পাঁচ লাখ টাকা নেই। সে তো অনেক টাকা। তবু যদি ধরুন আমার স্ত্রীর গহনা বিক্রি করে, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবদের কাছ থেকে ধার করে টাকাটা জোগাড় করাও যায়, তবু তো সেভাবে আমি ছেলেকে ছাড়িয়ে আনতে পারব না। আমি সরকারি কাজ করি। এভাবে মুক্তিপণ দেওয়ায় সরকারের নিষেধ আছে, আমাকে ওপরওয়ালাদের কাছে জানাতেই হবে।

কাকাবাবু ওঁর মুখের দিকে চেয়ে রইলেন।

নিখিল মাহাতো আবার বললেন, মুশকিল হয়েছে কী জানেন, আমার স্ত্রী দারুণ কান্নাকাটি করছেন। পুলিশের সাহায্য নিতে তাঁর ঘোর আপত্তি। মাস দু-এক আগে এরকম একটা কেস হয়েছিল, পুলিশ খোঁজখবর পেয়ে একটা বাড়ি ঘিরে ফেলল। তারপর দেখা গেল, বদমাশগুলো ছেলেটার গলা টিপে মেরে রেখে গেছে!

কাকাবাবু বললেন, একটা ব্যাপারে খটকা লাগছে। সাধারণত দেখা যায়, খুব বাচ্চা ছেলেদেরই কিডন্যাপ করা হয়। ফিরে এসে তারা বিশেষ কিছু বলতে পারে না। তেরো-চোদ্দো বছরের ছেলেকে আটকে রাখাও তো মুশকিল। সন্তুকে এই বয়েসে কয়েকবার ধরে নিয়ে গিয়েছিল, ও নিজেই পালিয়ে এসেছে!

নিখিল মাহাতো বললেন, আপনার ভাইপো সন্তু সম্পর্কেও সবাই জানে। তার মতন সাহসী ছেলে কজন হয়? আমার ছেলেকে তো দেখেছেন, স্বভাবটা খুব নরম। এখন আপনি সাহায্য না করলে ওকে উদ্ধার করা যাবে না।

কাকাবাবু বললেন, নিখিলবাবু, আমি কী সাহায্য করব বলুন তো। আমি বনেজঙ্গলে, পাহাড়ে-পর্বতে ঘুরে বেড়াতে ভালবাসি, চোর-ডাকাত ধরার ক্ষমতা তো আমার নেই। ওসব তো আপনাদেরই কাজ।

নিখিল মাহাতো বললেন, আপনি অনেক কিছুই পারেন।

কাকাবাবু দুদিকে মাথা নাড়তে নাড়তে বললেন, তা ঠিক নয়। লোকে বাড়িয়ে বাড়িয়ে ভাবে। তা ছাড়া এই চিঠির মধ্যে আমার সম্পর্কে ইঙ্গিত আছে। আর কেউ যেন এর মধ্যে কেরানি দেখিয়ে নাক গলাতে না আসে। এই আর কেউ বলতে বোধ হয় আমাকেই বোঝাচ্ছে।

এইসময় জোজো দূর থেকে চেঁচিয়ে বলল, কাকাবাবু, একবার পুকুরধারে আসুন। শিগগিরই!

জোজোর গলায় আওয়াজ শুনে মনে হল, সে খুবই উত্তেজিত, আর কোনও কারণে ভয় পেয়েছে।

বাড়ির পেছন দিকে একটা পুকুর। খুব বড় নয়। একদিকে বাঁধানো ঘাট। আর একদিকে কয়েকটা তালগাছ।

জোজোর সঙ্গে নিখিল মাহাতো আর কাকাবাবু তাড়াতাড়ি পুকুরের কাছে এসে দেখলেন, ঘাটের একটা সিঁড়িতে চিত হয়ে শুয়ে আছে সন্তু। হাত-পা ছড়ানো।

দেখলে প্রথমেই মনে হয়, তার প্রাণ নেই।

কাকাবাবু থমকে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কী হয়েছে, জোজো?

জোজো ফ্যাকাশে মুখে বলল, কিছুই বুঝতে পারছি না। পুকুরে লাল রঙের একটা বল ভাসছিল। সন্তু জলে নেমে সেটা তুলতে গেল। আমি ওদিকের একটা গাছে অনেক কামরাঙা হয়েছে, কয়েকটা পাড়তে গেলাম। হঠাৎ ফটাস করে একটা শব্দ হল! কীসের শব্দ বুঝতেই পারিনি। সন্তুকে ডাকলাম দুবার। কোনও সাড়া না পেয়ে দৌড়ে এসে দেখি, সন্তু এইভাবে পড়ে আছে। কেউ গুলি করেছে?

কাকাবাবু জোরে জোরে কয়েকবার শ্বাস নিয়ে বললেন, কীসের যেন গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে না!

নিখিল মাহাতো বললেন, হ্যাঁ, মনে হচ্ছে কোনও গ্যাসের গন্ধ।

কাকাবাবু বললেন, আপনারা দাঁড়ান। আগে আমি দেখি—

পকেট থেকে রুমাল বার করে জোজোকে বললেন, এটা ভিজিয়ে নিয়ে এসো তো! ঘাটের কাছে যেয়ো না। অন্য জায়গা থেকে।

জোজো ছুটে গিয়ে সেই রুমালটা ভিজিয়ে আনল।

কাকাবাবু সেটা মুখে বেঁধে, নাকচাপা দিয়ে এগিয়ে গেলেন। ক্রাচ নামিয়ে রেখে হাঁটু গেড়ে বসলেন সন্তুর পাশে।

তার সারা গায়ে হাত বুলিয়ে দেখলেন, কোথাও রক্ত নেই, গুলির চিহ্ন নেই, ক্ষতও নেই। পাশে পড়ে আছে একটা লাল রঙের ফাটা বল।

কাকাবাবু শান্তভাবে দুবার ডাকলেন, সন্তু, সন্তু!

সন্তুর দুচোখ বোজা।

কাকাবাবু এবার নিজের নাক থেকে ভিজে রুমালটা খুলে ফেলে সেটা দিয়ে সন্তুর চোখ মুছে দিতে লাগলেন।

জোজো আর নিখিল মাহাতো কৌতূহল সামলাতে না পেরে এগিয়ে এসেছে। কাছে।

কাকাবাবু বললেন, জোজো, রুমালটা আবার ভিজিয়ে আনন।

সেই ভিজে রুমাল দিয়ে সন্তুর মুখ মুছিয়ে দিতে দিতে কাকাবাবু আবার ডাকলেন, সন্তু, সন্তু!

একটু পরেই সন্তু চোখ মেলে তাকাল।

জোজো বলল, উঃ বাবা, বাঁচলুম! সন্তু ধড়মড় করে উঠে বসে বলল, কী হয়েছে?

কাকাবাবু বললেন, এক্ষুনি উঠিস না। আর একটু শুয়ে থাক। তুই জল থেকে একটা লাল বল তুলে এনেছিলি?

সন্তু বলল, হ্যাঁ, বলটা জলে ভাসছিল। ঘাটের কাছেই। আমি সেটা তুলে আনতেই ফটাস করে ফেটে গেল আর ভেতর থেকে বিশ্রী ধোঁয়া বেরুতে লাগল।

নিখিল মাহাতো বললেন, বলটার মধ্যে গ্যাস ভরা ছিল। পুকুরে এরকম একটা বল এল কী করে?

জোজো চেঁচিয়ে উঠল, ওই যে, আর একটা। আর একটা!

কাকাবাবুরা মুখ তুলে তাকালেন। সত্যিই পুকুরে আর একটা লাল রঙের বল ভাসছে। পাঁচ নম্বরি ফুটবলের মতন। তবে সেটা ঘাট থেকে অনেকটা দূরে, প্রায় মাঝখানে।

সন্তু বলল, আগের বলটা ঠিক এইরকমই ছিল।

নিখিল মাহাতো বললেন, এরকম বল আমরা আগে এদিকে কোথাও দেখিনি।

কাকাবাবু বললেন, এরকম গ্যাসভরা বল তো এখানে ভাসতে দেওয়া যায়। অন্য কেউ দেখলেই ওটা ধরতে যাবে। সন্তু ঘাটের ওপর তুলে আনার পর ওটা ফেটেছে। তাই বেঁচে গেছে। অন্য কেউ যদি মাঝপুকুরে সাঁতরে গিয়ে ওটা ধরতে চায়, তখন ফেটে গেলে তো সে অজ্ঞান হয়ে জলে ড়ুবে যাবে।

নিখিল মাহাতো বললেন, ওটাকে আগেই ফাটিয়ে দেওয়া দরকার।

জোজো বলল, আমি এক্ষুনি ফাটিয়ে দিচ্ছি।

সে একটা ইটের টুকরো ছুড়ে মারল। লাগল না, সেটা চলে গেল বলটার অনেক ওপর দিয়ে।

নিখিল মাহাতোও একটা ঢিল ছুড়লেন, লাগাতে পারলেন না।

জোজো বলল, এখানে ভাল ঢিল নেই। একটা গুলতি পেলে আমি একবারেই—

কাকাবাবু নিখিল মাহাতোকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনার সঙ্গে রিভলভার নেই?

নিখিল মাহাতো বললেন, না, সার, সঙ্গে আনিনি।

কাকাবাবু বললেন, জোজো, আমার ড্রয়ার থেকে রিভলভারটা নিয়ে এসো তো?

জোজো দৌড়ে চলে গেল।

সন্তু মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে। তার মাথাটা এখনও ঝিমঝিম করছে।

বলটা ভাসছে পুকুরের জলে। দুলছে একটু একটু। দুটো ফড়িং সেটাকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছে।

জোজো রিভলভারটা নিয়ে ফিরে এল।

কাকাবাবু সেটা হাতে নিয়ে টিপ করে ট্রিগারে আঙুল দিলেন।

সঙ্গে সঙ্গে ফেটে গেল বলটা। ভুস ভুস করে সেটা থেকে বেরোতে লাগল ধোঁয়া।

নিখিল মাহাতো মুগ্ধভাবে কাকাবাবুকে বললেন, দারুণ! একবারেই হিট।

কাকাবাবু ভুরু কুঁচকে বললেন, এটা কী হল? আমি তো গুলি চালাইনি। ট্রিগার টেপার আগেই ওটা নিজে নিজে ফেটে গেল।

নিখিল মাহাতো অবাক হয়ে বললেন, নিজে নিজে ফেটে গেল? ঠিক এই মুহূর্তে!

পুকুরের ওপারে ঝোপের আড়াল থেকে কে যেন হেসে উঠল বিশ্রীভাবে হিহি করে।

তারপরই শোনা গেল একটা মোটর বাইকের স্টার্ট দেওয়ার শব্দ। কালো জামা পরা একজন লোক পুকুরের ওপাশের রাস্তা দিয়ে সেই বাইকে চেপে চলে গেল হুস করে।

জোজো আর নিখিল মাহাতো খানিকটা দৌড়ে গিয়েও লোকটিকে দেখতে পেল না ভাল করে।

কাকাবাবুর হাতে রিভলভার, তিনি ইচ্ছে করলে গুলি চালাতে পারতেন। কিন্তু শুধু হিহি করে হেসেছে বলেই তো একটা লোককে গুলি করে মারা যায় না।

তিনি সন্তুর হাত ধরে তুলে দাঁড় করিয়ে বললেন, এখন ঠিক আছিস তো?

সন্তু দুবার মাথাটা ঝাঁকিয়ে বলল, হ্যাঁ, ঠিক হয়ে গেছে। শুধু একটু বমি বমি ভাব হচ্ছে।

কাকাবাবু বললেন, ভেতরে গিয়ে অনেকটা জল খেয়ে নে। তার পরেও যদি বমি পায়, বমি করে নিবি।

তিনি ফাটা লাল বলটা তুলে নিয়ে বললেন, এটার ভেতরে কী গ্যাস ছিল, পরীক্ষা করে দেখতে হবে।

নিখিল মাহাতো ফিরে এসে বললেন, লোকটা পুকুরের ওপাশে কেন লুকিয়ে বসে ছিল, তা কিছুই বোঝা গেল না।

জোজো বলল, লোকটার মুখে মুখোশ পরা ছিল।

নিখিল মাহাতো বললেন, মুখোশ? আমরা তো শুধু পিঠের দিকটা দেখলাম!

জোজো বলল, একবার মুখ ফিরিয়েছিল। ওর হাতে একটা মোবাইল ফোন ছিল।

কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, মোবাইল ফোন? তুমি ঠিক দেখেছ?

জোজো বলল, আমি কিছু ভুল দেখি না!

কাকাবাবু নিখিল মাহাতোকে বললেন, কাল থেকে একটা মোটরসাইকেল আমাদের আশেপাশে ঘোরাফেরা করছে। এখানে কার কার মোটরসাইকেল আছে, খবর নিতে পারবেন? গগন সাহার একটা আছে জানি।

নিখিল মাহাতো বললেন, আরও বেশ কয়েকজনের আছে। এসব জায়গায় যারা হঠাৎ বড়লোক হয়, তারা আগে গাড়ি কেনে না, মোটরসাইকেল কেনে। মোটরসাইকেল বিকট আওয়াজ করে পাড়া কাঁপিয়ে যায়, সবাই তাকিয়ে দেখে, তাতেই মালিকের গর্ব হয়। আপনি গগন সাহাকে চেনেন?

কাকাবাবু বললেন, হ্যাঁ, কাল রাত্তিরে আলাপ হয়েছে।

নিখিল মাহাতো বললেন, গগন সাহা আজ সকালেই এসে ডায়েরি করে গেছে, তার মোটরসাইকেলটা চুরি হয়েছে।
বিকেল থেকেই দারুণ মেঘ করে আছে। আকাশ একেবারে কালো, নেমে আসছে অন্ধকার।

সুকোমলের কোনও খোঁজ পাওয়া যায়নি। দুপুরে পুলিশের দুজন বড় অফিসার এসে দেখা করে গেছেন কাকাবাবুর সঙ্গে। তাঁদের ধারণা, ছেলেটাকে পাচার করে দেওয়া হয়েছে বাংলাদেশের সীমান্তের ওপারে। এখানকার পুলিশ ওদিকে যেতে পারবে না।

তাঁরা আরও বললেন, এসব ব্যাপারে পুলিশ বাড়াবাড়ি করতে সাহস পায় না। ছেলেটাকে ওরা মেরে ফেলতে পারে। এরা এতই নিষ্ঠুর। আগে দু-একবার এরকম হয়েছে। এখন কাকাবাবু যদি কিছু বুদ্ধি দিতে পারেন!

কাকাবাবু মাথা নাড়তে নাড়তে বলেছিলেন, আমি কী বুদ্ধি দেব? ছেলেটার প্রাণের ঝুঁকি রয়েছে। আমার কোনও ভুলের জন্য যদি ছেলেটার প্রাণ যায়, তা হলে আমি সারাজীবনেও নিজেকে ক্ষমা করতে পারব না।

পুলিশের এস পি বলেছিলেন, টাকা দিয়ে যদি ছেলেটাকে ছাড়িয়ে নিতে হয়, তা হলে ওরা লাই পেয়ে যাবে। বার বার এরকম করবে!

তাও ঠিক!

সারাদুপুর কাকাবাবু শুয়ে শুয়ে চিন্তা করলেন।

জোজো আর সম্ভুর মুখেও কথা নেই। থিয়েটার তো বন্ধ হয়ে গেলই, এখন সুকোমলকে ভালয় ভালয় ফিরিয়ে আনাই বড় কথা। জোজো বেশিক্ষণ চুপ করে থাকতে পারে না।

একসময় সে বলল, এক কাজ করলে হয় না? মনে কর, পাঁচ লাখ টাকা দিয়ে সুকোমলকে ছাড়িয়ে আনা হল। তারপর ব্যাটাগুলোকে ধরে এমন মার মারব!

সন্তু বলল, পাঁচ লাখ টাকা পাবি কোথায়? তারপর ব্যাটাগুলোকে ধরবিই বা কী করে?

জোজো বলল, পি সি সরকারকে খবর দিলে হয়! উনি তো ম্যাজিকে হাওয়া থেকে টাকা বানাতে পারেন। উনি টাকা বানিয়ে দেবেন, সেই টাকা ওদের দেওয়া হল, একটু পরেই টাকাগুলো আবার অদৃশ্য হয়ে যাবে!

সন্তু বলল, তোর আইডিয়াটা মন্দ নয়। কিন্তু কাগজে পড়েছি, পি সি সরকার এখন ইন্ডিয়াতেই নেই, রাশিয়ায় ম্যাজিক দেখাচ্ছেন!

জোজো বলল, ইস, তা হলে তো খুব মুশকিল! সন্তু জিজ্ঞেস করল, টাকা দেওয়ার পর তুই লোকগুলোকে ধরবি কী করে?

জোজো বলল, সেটা খুব সহজ। আমি এমন একটা মজার মন্ত্র জানি, সেটাতেই ধরা পড়ে যাবে। মন্ত্রটা শুনবি?

সন্তু বলল, শুনি।

জোজো বলল, পাগলা কুকুর কামড়ে দিল, দুম পট পট পটাস! মাসির বাড়ি ফাটল হাঁড়ি, খুট খট খট খটাস!

সন্তু বলল, এটা মন্ত্র নাকি?

জোজো তার হাতে একটা চাপড় মেরে বলল, তুই বল, একবার বলে দ্যাখ!

সন্তু বলল, পাগলা কুকুর কামড়ে দিল, দুম পট পট পটাস! মাসির বাড়ি ফাটল হাঁড়ি, খুট খট খট খটাস! এই তো বললাম, তাতে কী হল?

জোজো বলল, বললি তো। এবার এটা ভুলে যাওয়ার চেষ্টা কর। কিছুতেই ভুলতে পারবি না। খানিক বাদে এটা মনে মনে বিড়বিড় করবি। তারপর জোরে জোরে বলবি। তারপর রাস্তা দিয়ে নিজেই পাগলের মতন চ্যাঁচাবি, পাগলা কুকুর কামড়ে দিল…। যে লোক রাস্তায় এটা চ্যাঁচাতে চ্যাঁচাতে যাবে, পুলিশ তাকে ধরতে পারবে না।

সন্তু বলল, সর্বনাশ! আমারও সেই অবস্থা হবে নাকি?

জোজো বলল, তোকে আমি উলটো মন্ত্র দিয়ে চুপ করিয়ে দেব!

সন্তু বলল, ছেলেচোরেরা যদি রাস্তা দিয়ে চ্যাঁচাতে চ্যাঁচাতে এটা বলতে বলতে যায়, তা হলে তো আরও অনেক লোক শুনবে! সেই লোকেরাও তা হলে চ্যাঁচাবে?

জোজো বলল, তা হবে না। এই যে আমি তোর হাতে চাপ মারলাম! আমি যাকে ছুঁয়ে এই মন্ত্র দেব, তারই শুধু মাথায় এটা গেঁথে যাবে!

সন্তু বলল, তা হলে পাঁচ লাখ টাকা জোগাড় করাই আগে দরকার।

গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি শুরু হয়েছে, বাগানে বসা যাবে না। কাকাবাবু বিকেলে চা খেতে বসেছেন বারান্দায়।

সন্তুর হাতে বিস্কুটের কৌটো। একবার সেটা পড়ে গেল, মাটিতে ছড়িয়ে গেল কয়েকটা বিস্কুট।

সন্তু সেগুলো তুলতে গিয়ে একদিকে তাকিয়ে বলল, আরে, এটা এখানে কোত্থেকে এল? আগে তো ছিল না।

বারান্দায় কয়েকটা ফুলগাছের টব রয়েছে, তার মধ্যে দাঁড় করানো রয়েছে একটা মূর্তি। কাঠের কিংবা ফাইবার গ্লাসের। মূর্তিটা হাত দেড়েক লম্বা, সারা গা কালো রং করা, শুধু মুখোনা লাল রঙের।

মূর্তিটা সত্যিই আগে এখানে ছিল না।

জোজো সেটা ধরতে যেতেই সন্তু বলল, এই, এই, এই ধরবি না!

কাকাবাবু বললেন, হ্যাঁ, কোনও নতুন জিনিস দেখলে ছুঁয়ো না। সকালবেলা লাল বলটার কথা মনে নেই? এটা এখানে এল কী করে?

সন্তু ভেতর থেকে একটা টর্চ নিয়ে এল।

সেই আলোয় ভাল করে দেখা গেল। মূর্তিটার মুখোনা বীভৎস রকমের, ঠিক যেন একটা রাক্ষস। হাতদুটো দুদিকে ছড়ানো। হাতদুটো শরীরের তুলনায় বেশি লম্বা।

কাকাবাবু বললেন, এটা কি বাড়ির ভেতর থেকে কেউ এখানে এনে রেখেছে? রঘুকে ডাক তো।

রঘু এল, ছোটমামাও বেরিয়ে এলেন।

তিনি দেখে বললেন, এটা তো আমাদের বাড়ির জিনিস নয়। আমি কখনও দেখিইনি! এমন বিচ্ছিরি একটা পুতুল এখানে কে রাখল?

কাকাবাবু বললেন, সেটা বোঝা যাচ্ছে না। তবে, ওটা ধরা ঠিক হবে না!

এর পরেই অদ্ভুত কাণ্ড শুরু হল।

মূর্তিটা ঠক করে পড়ে গেল মাটিতে। তারপর নিজে নিজেই আবার উঠে দাঁড়াল।

জোজো বলল, আরিব্বাস! এটা জ্যান্ত নাকি?

যেন সেই কথা শুনেই মূর্তিটা ঠক ঠক করে এগিয়ে এল দুপা।

কাকাবাবু ছাড়া আর সবাই পিছিয়ে গেল ভয় পেয়ে। কাকাবাবু তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে রইলেন মূর্তিটার দিকে।

সেটা এবারে ঠক ঠক করে শুরু করে দিল নাচ। ঠিক পুতুল নাচের মতন। কিন্তু মূর্তিটায় কোনও সুতো বাঁধা নেই।

একবার বড় লাফ দিয়ে মূর্তিটা উঠে গেল শূন্যে। তারপর সবার মাথার ওপর দিয়ে ঘুরতে লাগল বোঁ বোঁ করে।

কাকাবাবু ছাড়া আর সবাই মাথা বাঁচাতে ব্যস্ত। রঘু বলল, লাঠি দিয়ে এটাকে মারব?

কাকাবাবু বললেন, না। তার দরকার নেই। কয়েকবার ঘোরার পর মূর্তিটা বারান্দা থেকে বেরিয়ে গেল বাইরে। তারপর বাগান পেরিয়ে একটা পাখির মতন উড়তে উড়তে চলে গেল রাস্তার দিকে।

তারপরেই শোনা গেল একটা মোটরবাইরের স্টার্ট দেওয়ার শব্দ!

ছোটমামা হতভম্বের মতন বললেন, ব্যাপারটা কী হল?

কাকাবাবু বললেন, ছেলেখেলা!

ছোটমামা বললেন, তার মানে কী রাজাদা? একটা কাঠের মূর্তি নিজে নিজে উড়তে লাগল আমাদের চোখের সামনে? না কি চোখে ভুল দেখলাম।

কাকাবাবু বললেন, ঠিকই দেখেছ। তবে এমন কিছু আশ্চর্যের ব্যাপার নয়। রিমোট কন্ট্রোল। অনেক খেলনা, রেলগাড়ি, এরোপ্লেন রিমোট কন্ট্রোলে চালানো যায়। বাগানের বাইরে থেকে এটাও কেউ চালাচ্ছিল। সকালে পুকুরের লাল বলটা এরকম রিমোট কন্ট্রোলেই ফাটানো হয়েছে। জোজো, তুমি মোটরবাইকে চড়া লোকটির হাতে যা দেখেছিলে সেটা মোবাইল ফোন নয়, রিমোট কন্ট্রোল।

জোজো বলল, খুব চমকে দিয়েছিল কিন্তু?

কাকাবাবু বললেন, আমাদের সঙ্গে এরকম ছেলেখেলা করার মানে কী? ছোটমামা বললেন, কে করছে এসব।

কাকাবাবু বললেন, সেটাই তো পুলিশের বার করার কথা।

সন্তু বলল, বার বার যে লোকটা মোটরসাইকেল চেপে আসছে আর পালাচ্ছে, ওকে আগে ধরা দরকার।

জোজো জিজ্ঞেস করল, সন্তু, তুই মোটরসাইকেল চালাতে জানিস?

সন্তু বলল, না, কখনও চেষ্টা করে দেখিনি।

জোজো বলল, আমি খুব ভাল পারি। একটা মোটরসাইকেল পেলে আমি তাড়া করে লোকটাকে ঠিক ধরে ফেলতাম। একবার সিডনিতে একটা লোক একজন ভদ্রমহিলার হ্যান্ডব্যাগ কেড়ে নিয়ে মোটরসাইকেলে চেপে পালিয়ে যাচ্ছিল। ভদ্রমহিলা অসহায়ভাবে চ্যাঁচামেচি করছেন, আমি আর থাকতে পারলাম না। পাশেই অন্য কার একটা মোটরসাইকেল রাখা ছিল, লাফিয়ে সেটায় উঠে পড়ে তাড়া করলাম চোরটাকে। সিডনির উঁচু-নিচু রাস্তা, চোরটা যত স্পিড দিচ্ছে, আমিও তত স্পিড বাড়াচ্ছি। চোরটা ট্র্যাফিকের লাল বাতি মানছে না, আমিও মানছি না। রাস্তার সব লোক অবাক হয়ে আমাদের দেখছে।

সন্তু বলল, ঠিক সিনেমার মতন।

জোজো বলল, লোকটাকে কিছুতেই চোখের আড়াল হতে দিচ্ছি না। সিডনি শহরে তো গলিখুঁজি নেই, সব বড় রাস্তা, লোকটা লুকোবে কোথায়! খানিক পরে দেখি, রাস্তাটা অনেক উঁচু থেকে খাড়া নেমে গেছে, সামনেই সমুদ্র। ইন্ডিয়ান ওশান!

কাকাবাবু বললেন, সিডনি শহরের পাশে তো ইন্ডিয়ান ওশান দেখতে পাওয়া সম্ভব নয়, ওটা প্রশান্ত মহাসাগর হতে বাধ্য।

জোজো বলল, তা হতে পারে। সব মহাসাগরের চেহারাই তো এক!

সন্তু বলল, তারপর কী হল? তোরা দুজনেই সমুদ্রে গিয়ে পড়লি!

জোজো বলল, তখন এত স্পিডে চালাচ্ছি যে, থামবার উপায় নেই। সোজা গিয়ে সমুদ্রে পড়তেই হবে। তখন চোরটাকে ধরা যাবে ঠিকই, কিন্তু ভদ্রমহিলার হ্যান্ডব্যাগটা যদি ড়ুবে যায়! সেটা উদ্ধার করার জন্যই তো তাড়া করেছি। চোরটাকে। তাই শেষ মুহূর্তে আমি মোটরসাইকেলের ওপর দাঁড়িয়ে উঠে ঝাঁপিয়ে পড়লাম লোকটার ঘাড়ের ওপর। সমুদ্রের ধারে অনেক লোকজন ছিল, তারা ছুটে এল!

সন্তু বলল, সমুদ্রে গিয়ে পড়লে তোরও মুশকিল হত, তুই তো আবার সাঁতার জানিস না।

কাকাবাবু বললেন, বাঃ, বেশ ভাল গল্প। শোনো, আমি ভাবছি আমার একবার কলকাতায় যাওয়া দরকার।

সন্তু বলল, আমরাও যাব?

কাকাবাবু বললেন, না, তোরা এখানে থাকতে পারিস। আমি আবার ফিরে আসব। পুলিশের ওপর মহলের সঙ্গে এই ব্যাপারে একটু কথা বলে দেখি। বাংলাদেশের পুলিশের সঙ্গেও যোগাযোগ করতে হবে মনে হচ্ছে।

এই সময় বাড়ির সামনে একটা গাড়ি এসে থামল।

জোজো বলল, আমি চোখ বুজে বলে দিতে পারি, দেবলীনা এসেছে।

ঠিক তাই, গাড়ির দরজা খুলে ছুটতে ছুটতে এল দেবলীনা। জিন্স আর শার্ট পরা, মাথায় একটা স্কার্ফ বাঁধা। কাঁধে ঝোলা ব্যাগ।

বারান্দায় উঠেই বলল, কই, তোমাদের রিহার্সাল হচ্ছে না?

জোজো আর সন্তু চোখাচোখি করল।

কাকাবাবু বললেন, না, রিহার্সাল বন্ধ আছে।

দেবলীনা বলল, ভালই হয়েছে। তোমরা নাটক বদলাও!

ঝোলা-ব্যাগ থেকে সে একটা পাতলা বই বার করল। সে আবার বলল, আমি অন্য নাটকের বই এনেছি। সুলতানা রাজিয়া। এর নাম-ভূমিকায় আমি পার্ট করব।

সন্তু বলল, বাঃ! সুলতানা রিজিয়া, তোকে ভাল মানাবে!

জোজো বলল, গৈরিক পতাকা কিংবা লাল কেল্লা নাটকের নামভূমিকায় ওকে আরও ভাল মানাত।

সন্তু বলল, কিংবা বঙ্গে বর্গি নাটকটা আরও ভাল। দেবলীনা হবে বর্গি।

দেবলীনা কয়েক মুহূর্ত ভুরু কুঁচকে বুঝে নেওয়ার পর বলল, ইয়ার্কি হচ্ছে আমার সঙ্গে?

সন্তু বলল, পাগলা কুকুর কামড়ে দিল, দুম পট পট পটাস। মাসির বাড়ি ভাঙল হাঁড়ি, খুট খট খট খটাস!

দেবলীনা বলল, ওটা আবার কী?

সন্তু বলল, এটা মুখস্থ বলতে পারবি? বল তো একবার!

দেবলীনা বলল, ওরকম বিচ্ছিরি কবিতা মোটেই আমি বলতে চাই না। কাকাবাবু মুচকি মুচকি হাসছেন।

দেবলীনা তাঁর দিকে ফিরে বলল, কাকাবাবু, তুমি ছেলেদুটোকে বড্ড লাই দিচ্ছ! তুমি সুলতানা রিজিয়া নাটকটা করবে কিনা বলো।

জোজো বলল, লাল কেল্লা!

সন্তু বলল, বঙ্গে বর্গি!

কাকাবাবু বললেন, এই, তোরা ওকে কেন রাগাচ্ছিস! শোনো দেবলীনা, যেকোনও নাটকে তুমি খুব ভাল পার্ট করতে পারবে জানি, কিন্তু মুশকিল হচ্ছে নাটক আপাতত বন্ধ। আমাকে জরুরি কাজে কলকাতায় যেতে হবে। ভাবছি, তোমার সঙ্গেই চলে যাব।

দেবলীনা বলল, এই পাজিদুটোও যাবে নাকি?

কাকাবাবু বললেন, না, সন্তু আর জোজো থাকবে। আমি আবার ফিরে আসব।

দেবলীনা বলল, বেশ হবে। ওরা এই ধ্যাদ্ধেড়ে গোবিন্দপুর গ্রামে পড়ে থাকুক। এমন বৃষ্টি হবে, ওরা কোথাও যেতেও পারবে না।

জোজো বলল, নদী থেকে ইলিশ মাছ ধরা হয়েছে, আমরা সেই টাটকা ইলিশ মাছ ভাজা আর গরম গরম খিচুড়ি খাব।

সন্তু বলল, অনেক বড় বড় চিংড়িও এনেছে, তুই দেখিসনি বুঝি!

দেবলীনা বলল, কলকাতাতেও অনেক ভাল ইলিশ আর চিংড়ি পাওয়া যায়।

একটু বাদেই কাকাবাবু তৈরি হয়ে নিলেন। দেবলীনাকে বললেন, চলো, বেরিয়ে পড়ি। বেশি রাত করার দরকার নেই।

দেবলীনা তখনও সন্তু আর জোজোর সঙ্গে ঝগড়া করে যাচ্ছিল, এবার সে উঠে দাঁড়াল। তারপর ঝোলা-ব্যাগ থেকে দুটো বড় চকোলেটের প্যাকেট বার করে বলল, তোদের জন্য এনেছিলাম, এখন আর দেব না ভাবছি!

জোজো ঠোঁট উলটে বলল, চকোলেট? অ্যাঃ! আমরা মোটেই ভালবাসি না, তাই না রে সন্তু?

দেবলীনা এবার ফিক করে হেসে ফেলে প্যাকেটদুটো ওদের হাতে গুঁজে দিল।

জোজো দেবলীনার একটা হাত চেপে ধরে বলল, থ্যাঙ্ক ইউ! পাগলা কুকুর কামড়ে দিল দুম পট পট পটাস! মাসির বাড়ি ভাঙল হাঁড়ি, খুট খট খট খটাস!

কাকাবাবু বললেন, আর দেরি কোরো না! চলো—

দেবলীনাদের গাড়ির ড্রাইভার অনেক দিনের পুরনো। তার নাম লছমনসিংহ, ওদের বাড়িতেই থাকে। দেবলীনাকে সে খুব ছোট্টবেলা থেকে দেখেছে বলে তাকে সে খুকুমণি বলে ডাকে।

কাকাবাবুকে দেখে সে নমস্কার করে বলল, ভাল আছেন সার?

কাকাবাবু বললেন, হ্যাঁ, লছমন, তুমি ভাল আছ তো? কদিন ধরে বর্ষা হচ্ছে, রাস্তার অবস্থা কীরকম?

লছমন বলল, খুব খারাপ। আসবার সময় জ্যাম পেয়েছিলাম।

গাড়িটা স্টার্ট দিয়ে বড় রাস্তায় পড়তেই একটু পরে পাশ দিয়ে একটা মোটরসাইকেল বেরিয়ে গেল জোর শব্দ করে।

কাকাবাবু কৌতূহলী চোখে তাকিয়ে রইলেন। চালকের মুখটা দেখতে পেলেন।

দেবলীনা বলল, পাগলা কুকুর কামড়ে দিল, দুম পট পট পটাস! মাসির বাড়ি ভাঙল হাঁড়ি খুট খট খট খটাস! কাকাবাবু, এর মানে কী?

কাকাবাবু বললেন, মানে আবার কী? কিচ্ছু নেই! জোজোর মাথা থেকে উদ্ভট বুদ্ধি বেরোয়!

দেবলীনা আবার বলল, পাগলা কুকুর কামড়ে দিল…নাঃ, এটা আর কিছুতেই বলব না! কিন্তু মুখস্থ হয়ে গেল যে!

কাকাবাবু বললেন, অন্য কবিতা ভাবো। তা হলে ওটা ভুলে যাবে। দেবলীনা একটু চিন্তা করে বলল, গান জুড়েছে গ্রীষ্মকালে ভীষ্মলোচন শর্মা, আওয়াজখানা দিচ্ছে হানা দিল্লি থেকে বর্মা—তারপর কী যেন?

কাকাবাবু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছেন, উত্তর দিলেন না। মোটরসাইকেলটার শব্দ আর একবার শোনা গেল। আওয়াজটা খুব জ্বালাচ্ছে। লোকটা কি বাড়ির কাছাকাছি কোথাও লুকিয়ে থেকে লক্ষ রাখছিল?

দেবলীনা বলল, পাগলা কুকুর কামড়ে দিল দুম পট পট…এই রে, আবার সেই বিচ্ছিরি পদ্যটা মনে আসছে! ও কাকাবাবু, বলো না, এটাকে মাথা থেকে তাড়াই

কী করে?

কাকাবাবু বললেন, একটা গান গাও, তা হলে ভুলতে পারবে!

দেবলীনা বলল, ধ্যাত! আমি কি গান জানি নাকি?

কাকাবাবু বললেন, এই গানটা শিখে নাও, খুব সহজ। জোজোকে দেখলেই গাইবে। শোন রে ওরে হনুমান, হও রে ব্যাটা সাবধান, আগে হতে স্পষ্ট বলে রাখি! তুই ব্যাটা জানোয়ার, নিষ্কর্মার অবতার, কাজেকম্মে দিস বড় ফাঁকি!

দেবলীনা উঁচু গলায় হেসে উঠল।

বড় রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে গাড়িটা থেমে যাচ্ছে মাঝে-মাঝে। সামনে পর পর অনেক ট্রাক। একে তো অন্ধকার, আবার শুরু হয়েছে বৃষ্টি।

এক জায়গায় গাড়ি একেবারে থেমেই গেল। সামনে অনেকখানি জ্যাম। লছমন উঁকি মেরে দেখে বলল, লেভেল ক্রসিং। আসবার সময়ও এখানে অনেকক্ষণ দাঁড়াতে হয়েছিল। সামনের লরিটা কিছুতেই জায়গা ছাড়ছে না।

সে দু-একবার হর্ন বাজাতেই কাকাবাবু বললেন, শুধু শুধু হর্ন বাজিয়ো না। তাতে কী লাভ হবে?

বৃষ্টির জন্য সব জানলার কাচ ভোলা। একটা বাচ্চা ছেলে ধূপকাঠি বিক্রি করার জন্য কাকুতিমিনতি করছে।

দেবলীনা হাত নেড়ে বলল, চাই না। চাই না।

ছেলেটা তবু যাচ্ছে না।

লছমন তার দিকের জানলার কাচ নামিয়ে আর একবার সামনে উঁকি দিল।

বাচ্চা ছেলেটা দৌড়ে সেদিকে গিয়ে জানলা দিয়ে হাত বাড়িয়ে বলল, নিন না দিদি, ভাল ধূপ, নিন না, আমি সারাদিন কিছু খাইনি—

দেবলীনা হাত-ব্যাগ খুলে পয়সা বার করতে গেল।

তখনই একজন লোক বাচ্চা ছেলেটাকে টেনে সরিয়ে দিয়ে দাঁড়াল জানলার কাছে। তার হাতে একটা ছোট গ্যাস সিলিন্ডারের মতন জিনিস।

সেটা থেকে সে ফোঁসফোঁস করে কী যেন স্প্রে করে দিতে লাগল গাড়ির মধ্যে।

কাকাবাবু বললেন, এই, কী করছ, কী করছ?

তারপরই গ্যাসের গন্ধ পেয়ে তিনি চেঁচিয়ে উঠলেন,দেবলীনা, শিগগির নাকে রুমাল চাপা দাও—

কিন্তু তিনি নিজেই পকেট থেকে রুমাল বার করার সময় পেলেন না। ঢলে পড়লেন অজ্ঞান হয়ে।

দেবলীনা আর লছমনও জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে।

একজন লোক গাড়ির সামনের দরজা খুলে লছমনকে ঠেলে সরিয়ে নিজে বসল স্টিয়ারিং হাতে নিয়ে।

অন্য একজন লোক পেছনের দরজা দিয়ে উঠে কাকাবাবুর হাত বেঁধে ফেলল লোহার চেন দিয়ে।

সে লোকটি সামনের লোকটিকে জিজ্ঞেস করল, মেয়েটাকে নিয়ে কী করব?

সামনের লোকটি বলল, থাক, এখন অমনিই থাক।

তারপর সে গাড়িতে স্টার্ট দিয়ে রাস্তা ছেড়ে নেমে পড়ল পাশের মাঠে। গাড়িটা লাফাতে লাফাতে মিলিয়ে গেল অন্ধকারে।
জোজো আরাম করে বিছানায় শুয়ে গল্পের বই পড়ে যাচ্ছে, কত বেলা হল তার হুঁশই নেই।

পাশের একটা ছোট টুলে রাখা আছে পেঁয়াজ-লঙ্কা দিয়ে মাখা একবাটি মুড়ি, মাঝে মাঝে সেই মুড়ি খাচ্ছে মুঠো করে।

বইটা শেষ হয়নি, কিন্তু মুড়ি শেষ হওয়ার পর তার খেয়াল হল, অনেকক্ষণ সন্তুর সাড়াশব্দ নেই। সন্তু কোথায় গেল?

বিছানা থেকে নেমে পড়ল সে।

পাশের ঘরে গিয়ে দেখল, সন্তু খুব কাজে ব্যস্ত।

সারা ঘরে পুরনো খবরের কাগজ ছড়ানো। একটা কাঁচি নিয়ে সন্তু সেই খবরের কাগজ কাটছে।

জোজো অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, কী করছিস রে সন্তু?

সন্তু বলল, পাগলা কুকুর কামড়ে দিল, দুম পট পট পটাস! জোজো তার পাশে বসে পড়ে বলল, কাগজ কাটছিস কেন?

সন্তু এবার গম্ভীরভাবে বলল, টাকা বানাচ্ছি! আজ সন্ধের মধ্যেই পাঁচ লাখ টাকা চাই!

পাশে তিনখানা একশো টাকার নোট। সন্তু খবরের কাগজ কাটছে সেই নোটের সাইজে।

জোজো বলল, এই খবরের কাগজের টাকা দিয়ে তুই ছেলেচোরদের ঠকাবি? এত সহজ নাকি?

সন্তু বলল, সহজ নয় ঠিকই। খুব কঠিন। সেই কঠিন কাজটাই চেষ্টা করতে হবে। শঙ্খচূড় আবার চিঠি দিয়েছে, টাকাটা আজই রাতে নিয়ে যেতে হবে নৌকোয় করে। কোনও পুলিশের লোক থাকলে সুকোমলকে আর জ্যান্ত ফেরত পাওয়া যাবে না। তাই পুলিশের লোকের বদলে আমি যাব টাকা নিয়ে। সুকোমলের বাবার সঙ্গে আমার কথা হয়ে গেছে।

জোজো বলল, কিন্তু এই খবরের কাগজের টাকা ওরা বুঝি ব্যাগ খুলে দেখবে না?

সন্তু বলল, তা দেখবে নিশ্চয়ই। প্রথম তিনটে বান্ডিলের ওপর এই সত্যিকারের একশো টাকার নোট থাকবে একটা করে। ছোটমামার কাছ থেকে তিনশো টাকা চেয়ে নিয়েছি। এই দেখে যদি ওরা সন্তুষ্ট থাকে তো ভাল কথা।

জোজো বলল, আর যদি সব বান্ডিল দেখে?

সন্তু বলল, তখন অন্য ব্যবস্থা করতে হবে।

জোজো জিজ্ঞেস করল, অন্য ব্যবস্থা মানে?

সন্তু বলল, সে তখন দেখা যাবে। অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা।

জোজো বন্ধুর মুখের দিকে একটুক্ষণ একদৃষ্টিতে চেয়ে থেকে আড়ষ্ট গলায় বলল, সন্তু, তুই এই নকল টাকা নিয়ে একা যাবি?

সন্তু বলল, তুই তো যেতে পারবি না। তুই সাঁতার জানিস না। নৌকোটা যদি উলটেফুলটে যায়।

জোজো বলল, কাকাবাবু ফিরলেন না—

সন্তু বলল, কাকাবাবু ফেরেননি, কোনও খবর পাঠাননি। নিশ্চয়ই কোনও কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। এখন আমাদের বুদ্ধিমতন কাজ করা উচিত।

জোজো বলল, পাঁচ লাখ টাকা তৈরি হয়নি? তার মানে কত টুকরো জানিস?

সন্তু বলল, জানব না কেন? পাঁচ লাখ মানে পাঁচ হাজার একশো টাকার নোট!

জোজো বলল, এরকমভাবে কাঁচি দিয়ে কাটলে সারাদিনেও পাঁচ হাজার হবে।

সন্তু বলল, তুইও একটা কাঁচি জোগাড় করে আন। হাত লাগা।

জোজো বলল, আমি একসঙ্গে দশখানা নোট বানাবার টেকনিক শিখিয়ে দিচ্ছি তোকে

প্রায় ঘণ্টাখানেক ধরে দুজনে দর্জির মতন কাঁচি চালাতে লাগল কচাকচ শব্দে।

তারপর পরোটা আর বেগুনভাজা খাওয়ার বিরতি।

ছোটমামা এসে বললেন, গগন এসেছে। রাজাদার খোঁজ করছে। বললাম, রাজাদা নেই, তোদের সঙ্গে কথা বলতে চায়।

সন্তু আর জোজো বারান্দায় বেরিয়ে এল।

গগন সাহা খাকি প্যান্ট আর হলুদ রঙের শার্ট পরে আছে, হাতে একটা গোল করে পাকানো খবরের কাগজ। চেয়ারে বসেনি, দাঁড়িয়ে আছে এক কোণে, মুখে একটা ছটফটে ভাব।

ওদের দেখে বলল, কী হে, কেমন আছ তোমরা? তোমাদের কাকাবাবু কলকাতায় গেছেন শুনলাম। আজ ফিরে আসবেন?

সন্তু বলল, ঠিক বলতে পারছি না।

তোমাদের থিয়েটার আর হচ্ছে না তা হলে?

সুকোমলকে পাওয়া গেলে এখনও হতে পারে।

আমার ছেলে বিল্ট তো খুব মুষড়ে পড়েছে।

ওকে বলবেন, একা-একাই পার্ট মুখস্থ করতে।

সে আর বলতে হবে না। সর্বক্ষণই তো সুগ্রীব সেজে বিড়বিড় করছে। পড়াশোনায় মন নেই।

তারপর সে ছোটমামার দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করল, চাঁদুদা, নিখিল মাহাতোর ছেলের কোনও খোঁজ পাওয়া গেল?

ছোটমামা বললেন, নাঃ! টাকা চেয়ে আর-একটা চিঠি এসেছে।

গগন বলল, নিখিল মাহাতো টাকা দেবে না ঠিক করেছে। খুবই বিপজ্জনক ব্যাপার।

ছোটমামা বললেন, টাকা জোগাড় করার একটা চেষ্টা হচ্ছে শুনেছি।

গগন বলল, তা হলে তো খুব ভাল কথা। সে যাই হোক, আমার বউ আজ রাত্তিরে আপনাদের সবাইকে আমাদের বাড়িতে নেমন্তন্ন করেছে। সেদিন তো আপনারা গিয়ে এক কাপ চাও খেলেন না। রাজা রায়চৌধুরী বিখ্যাত মানুষ। তিনি নিজে থেকে আমাদের বাড়িতে এলেন, কোনও খাতির-যত্ন করা হল না। আমার ভেড়ি থেকে বড় বড় চিংড়ি আনিয়েছি, আজ আপনারা সবাই খেতে যাবেন আমাদের বাড়িতে।

ছোটমামা বললেন, রাজাদা ফিরবেন কিনা তার তো ঠিক নেই। তুমি তো তাঁর জন্যই ব্যবস্থা করছ!

গগন বলল, ফিরবেন নিশ্চয়ই। এই ছেলেরা এখানে রয়ে গেছে। তা হলে আসবেন কিন্তু। আমার বউ সকাল থেকেই রান্না করতে লেগে গেছে।

সিঁড়ি দিয়ে একধাপ নেমে সে আবার বলল, এখানকার পুলিশরা একেবারে অপদার্থ। আমার মোটরসাইকেলটা চুরি গেছে, এখনও উদ্ধার করতে পারল না!

বাগানের বাইরে একটা সাইকেল রিকশা দাঁড় করানো ছিল। গগন উঠে গেল তাতে।

জোজো বলল, আরে, উনি খবরের কাগজটা ফেলে গেলেন যে!

গগনের হাতে যে পাকানো খবরের কাগজটা ছিল, সেটা পড়ে আছে বারান্দার বেদির ওপর।

ততক্ষণে সাইকেল রিকশাটা মিলিয়ে গেছে রাস্তার বাঁকে।

সন্তু বলল, দৌড়ে গিয়ে দিয়ে আসব? ছোটমামা বললেন, তার দরকার নেই, খবরের কাগজ তো পড়া হলে লোকে এমনিই ফেলে দিয়ে যায়।

জোজো কাগজটা খুলে বলল, ওরেব্বাস, এ যে দেখছি দারুণ খবর!

এটা কলকাতার কাগজ নয়। স্থানীয় সংবাদপত্র, নাম বসিরহাট বার্তা, ধ্যাবড়া কালিতে ছাপা। প্রথম পাতায় নীচের দিকে, হাতে-আঁকা একটা মস্তবড় সাপের ছবি। তার তলার দিকটা কুণ্ডলী পাকানো, ওপরে ফণা তুলে আছে। নীচে লেখা : শঙ্খচূড়। তারপর বড় বড় অক্ষরে লেখা : আজই সুকোমল মাহাতোর উদ্ধারের শেষ দিন। আজ রাতের মধ্যে টাকা না পৌঁছে দিলে শঙ্খচূড়ের দংশন থেকে কেউ তাকে রক্ষা করতে পারবে না। আমরা সবদিকে নজর রাখছি। পুলিশ কিংবা কোনও ফোঁপরদালাল কোনওরকম চালাকির চেষ্টা করলে ছেলেটির লাশ নদীর জলে ভাসবে। মনে থাকে যেন, ঠিক রাত নটায় মাঝনদীতে বাঁকের মুখে।

সবাই লেখাটা পড়ে একটুক্ষণ এ-ওর মুখের দিকে তাকাল। ছোটমামা বললেন, গগন কি ইচ্ছে করে কাগজটা এখানে রেখে গেল?

সন্তু বলল, নাও হতে পারে।

ছোটমামা বললেন, বলা যায় না। ভারী ধূর্ত লোক। একদিকে আমাদের কত খাতির দেখিয়ে নেমন্তন্ন করে গেল, আবার ভয় দেখিয়েও গেল মনে হচ্ছে?
হাটবার ছাড়া নদীর এই ঘাটে সন্ধের পরই নৌকো চলাচল প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। যাত্রী থাকে না বলে ফেরিনৌকোও চলে না। দু-তিনটে যে খাবারের দোকান আছে, তারাও ঝাঁপ ফেলে দেয় তাড়াতাড়ি।

কৃষ্ণপক্ষের রাত, একেবারে ঘুটঘুটে অন্ধকার।

একটিমাত্র নৌকোয় বসে তামাক খাচ্ছে একজন মাঝি। তার নৌকোয় টিমটিম করে জ্বলছে একটা কেরোসিনের লণ্ঠন।

ঠিক পৌনে নটার সময় একটা সাইকেল রিকশায় চেপে সন্তু পৌঁছোল সেই নদীর ঘাটে। তাকে নামিয়ে দিয়েই সাইকেল রিকশাটা ফিরে গেল পোঁ পোঁ করে।

সন্তুর হাতে একটা ঢাউস ক্যাম্বিসের ব্যাগ।

ঘাটের কাছটায় কাদা কাদা হয়ে আছে। সন্তু পা টিপে টিপে নেমে নৌকোটায় চড়ে বসল। কাদা লাগবেই জেনে সে খালি পায়ে এসেছে। সন্তু ফুলপ্যান্টই পরে কলেজে ভর্তি হওয়ার পর থেকে, কিন্তু এখন পরে আছে হাফপ্যান্ট ও শুধু একটা গেঞ্জি।

এ-নৌকোর মাঝি কোনও কথা না বলে নৌকো ছেড়ে দিল। সে আগে থেকেই যেন জানে কোথায় যেতে হবে।

আকাশে ঘন ঘন বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে, যে-কোনও সময় বৃষ্টি আরম্ভ হবে। এ নৌকোটায় ছই নেই, বৃষ্টি এলে ভিজতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা, টাকার থলেটা ভিজে গেলেই মুশকিল।

জলের কুলুকুলু ধ্বনি ছাড়া আর কোনও শব্দ নেই।

নৌকোটা নদীর বাঁকের মুখে পৌঁছোবার পর মাঝিটি জিজ্ঞেস করল, এবারে কী করব?

সন্তু বলল, আর যেতে হবে না, এইখানেই চুপ করে বসে থাকতে হবে কিছুক্ষণ।

নদীতে তেমন স্রোত নেই, নৌকোটি একটু একটু দুলছে, সরে যাচ্ছে মাঝখান থেকে, মাঝি আবার নৌকোটাকে নিয়ে আসছে মাঝনদীতে। ভরা বর্ষার নদীতে এখন প্রচুর জল।

এখন শুধু প্রতীক্ষা।

সন্তুর একটু বুক দুরু দুরু করছে ঠিকই।

একেবারে শেষ মুহূর্তে ছোটমামা বেঁকে বসেছিলেন, সন্তুকে তিনি এই বিপদের মধ্যে একা যেতে দেবেন না। জোজোও বন্ধুর বিপদের কথা ভেবে কঁদো কাঁদো হয়ে গ্লিয়েছিল। এমনকী নিখিল মাহাতো পর্যন্ত বলেছিলেন, তার ছেলেকে বাঁচাবার জন্য অন্য একজনের ছেলেকে তিনি এমন ঝুঁকির মধ্যে পাঠাতে চান না। স(কেও যদি মেরে ফেলে, তা হলে সারাজীবন তাকে দ্বিগুণ শোক সইতে হবে।

কিন্তু সন্তু জেদ ধরে ছিল আগাগোড়া।

কাকাবাবু ফিরে আসেননি, কোনও খবরও পাঠাননি। তবু সন্তুর দৃঢ় ধারণা, কাকাবাবু যে-কোনও উপায়েই হোক, এই ছেলেচোরদের সঙ্গে দেখা করার চেষ্টা করতেন। ওদের টাকা না দিয়ে।

এমনও হতে পারে, কাকাবাবু এই নদীর ধারে কোথাও অন্ধকারে লুকিয়ে রয়েছেন।

মাঝিটি ধৈর্য ধরতে না পেরে হঠাৎ বলে উঠল, খোকাবাবু, এখানকার চোর ডাকাতগুলি অতি সেয়ানা। আর যখন-তখন ছুরি-বন্দুক চালায়। তুমি একা একা এদের মুকাবেলা করতে পারবে?

সন্তু বলল, দেখা যাক!

মাঝিটি বলল, আহা রে, কার বাড়ির দুধের বাছা। কেন মরতে এলি?

এত উত্তেজনার মধ্যেও সন্তু হেসে ফেলল। হাফপ্যান্ট পরে এসেছে বলে তাকে খোকাবাবু তবু বলা যেতে পারে। কিন্তু একেবারে দুধের বাছা! বড্ড বাড়াবাড়ি!

একসময় দূরে ভটভট শব্দ হল। এখন বেশিরভাগ নৌকোই ডিজেল এঞ্জিনে চলে, তাই এগুলির নামই হয়ে গেছে ভটভটিয়া।

আওয়াজটা আসছে উলটো দিক থেকে, এদিকেই। একটু পরে দেখা গেল একটা জোরালো টর্চের আলো জ্বলছে আর নিভছে।

সন্তুর কাছে টর্চ নেই, সে দাঁড়িয়ে রইল চুপ করে। অন্য নৌকোর টর্চের আলো এসে পড়ছে তার মুখে।

ভটভটিয়াটা একেবারে পাশে এসে দাঁড়াল। একজন কেউ কর্কশ গলায় জিজ্ঞেস করল, টাকা এনেছিস?

সন্তু বলল, হ্যাঁ, এনেছি।

লোকটি বলল, পুরো টাকা এনেছিস তো? আমরা ধারে কারবার করি না।

সন্তু একটুও নার্ভাস না হয়ে বলল, হ্যাঁ, পুরো পাঁচ লাখ।

লোকটি বলল, তোর সঙ্গে আর কে আছে?

সন্তু বলল, আর কেউ না।

লোকটি টর্চ ফেলে নৌকোটা ভাল করে দেখল। খোলা নৌকোয় কারও লুকোবার কোনও জায়গা নেই।

মাঝির মুখের ওপর আলো ফেলে ভাল করে দেখে ওদিকের লোকটি বলল, এ তো বদরু শেখ।

তারপর সেই লোকটি অন্য একটি লোককে বলল, ভয়ের চোটে ওরা একটা পুঁচকে ছেলেকে পাঠিয়েছে।

অন্য লোকটি সন্তুকে বলল, এই ছোড়া, টাকার থলেটা আগে এই নৌকোয় ছুড়ে দে।

সন্তু বলল, না, আগে আমি সুকোমলকে দেখতে চাই। হাতে হাতে দেব আর নেব।

অন্য লোকটি বলল, আমরা কথার খেলাপ করি না। তুই মাথার ওপর দুহাত তুলে দাড়া।

সন্তু বাধ্য ছেলের মতন দুহাত তুলল মাথার ওপর।

ওদিক থেকে বন্দুক হাতে একজন লোক লাফিয়ে এ-নৌকোয় এসে সন্তুর সারা গা থাবড়ে থাবড়ে দেখল।

তারপর বলল, তুই অস্তরটস্তর কিছু আনিসনি তা হলে? একটা পেনসিল কাটা ছুরিও না? এবার তুই টাকার থলেটা নিয়ে ওই নৌকোয় চলে যা।

সন্তু অন্য নৌকোটায় গিয়ে দাড়াতেই লোকটি সন্তুর নৌকোর মাঝিকে বলল, বদরু তুই ফিরে যা! এদের আমরা নামিয়ে দেব।

সন্তু ব্যাগটা বুকে চেপে ধরে রইল।

মাঝি ছাড়া এ-নৌকোয় রয়েছে দুজন লোক, আর সুকোমল বসে আছে হাঁটুতে থুতনি ঠেকিয়ে। সন্তুর দিকে সে তাকালও না। বোধ হয় সে ঘুমিয়ে আছে।

একজন লোকের হাতেই শুধু বন্দুক।

সে হাত বাড়িয়ে টাকার থলিটা নিয়ে চেন টেনে খুলে ভেতরটা দেখল। বলল, ঠিক আছে। তোদের নামাব তেঁতুলতলার ঘাটে।

অন্য লোকটি বলল, কটা বান্ডিল আছে গুনে দেখবি না?

বন্দুকধারী বলল, ডেরায় গিয়ে গুনে নেব। এখন নৌকোয় স্টার্ট দে!

অন্য লোকটি বলল, এখনই গুনে নে। একটা দুটো কম পড়লে ওস্তাদ আমাদের নামে দোষ দেবে।

বন্দুকধারীটি আবার ব্যাগ খুলল।

বন্দুকটা পাশে নামিয়ে রেখে বার করতে লাগল বান্ডিলগুলো। একটা, দুটো, তিনটে-প্রত্যেকটারই ওপরে আসল একশো টাকার নোট।

চতুর্থ বান্ডিলটা বার করতেই সন্তু এক লাফে সুকোমলের কাছে গিয়ে তার একটা হাত ধরে লাফিয়ে পড়ল নদীতে।

তার পায়ের ঝাঁকুনিতে দারুণভাবে দুলে উঠল নৌকোটা, প্রায় ড়ুবে যাওয়ার মতন অবস্থা।

ঘটনার আকস্মিকতায় এই নৌকোর দুজন লোক হকচকিয়ে গিয়ে তাল সামলাতে সামলাতেই কেটে গেল কয়েক মুহূর্ত, তার মধ্যে সন্তু ড়ুব দিয়ে চলে গেছে অনেক নীচে।

সুকোমল ভয় পেয়ে জাপটে ধরেছে সন্তুকে।

সন্তু সাঁতারের চ্যাম্পিয়ান, পরপর দুবছর সে অল বেঙ্গল সুইমিং কম্পিটিশানে ফার্স্ট হয়েছে। তা ছাড়া লাইফ সেভিং-এর ট্রেনিং নেওয়া আছে, সাঁতারের সুবিধে হবে বলেই তো সে আজ ফুলপ্যান্ট পরেনি, খালি পায়ে এসেছে।

শ্বাস নেওয়ার জন্য একবার ভুস করে মাথা তুলে সন্তু বলল, সুকোমল, ভয় পাসনি! শরীরটা আলগা করে রাখ। আমরা ঠিক পৌঁছে যাব!

এ-নৌকোর লোকদুটো ধারণাই করতে পারেনি যে, এই ভরা বর্ষার নদীতে সন্তুর মতন একটা অল্পবয়েসি ছেলে ইচ্ছে করে ঝাপ দিতে পারে। এমনিতেই এনদীতে ভয়ে কেউ নামে না, এখানে কামঠ নামে একরকম ছোট ছোট হাঙর আছে, তারা মানুষের পা কেটে নেয়। কুমিরও আছে।

সন্তু আর একবার মাথা তুলতেই ওরা গুলি চালাল।

সঙ্গে সঙ্গে নদীর ধার থেকেও ছুটে এল গুলি। নৌকোর দিকে।

সন্তুর ধারণা হল, কাকাবাবু এসে গেছেন, তা হলে আর কোনও চিন্তা নেই!

গুলি চলতে লাগল দুদিক থেকে।

একটা গুলি নৌকোর মাঝির গায়ে লাগতেই সে আর্তনাদ করে উঠল। তখন একজন চালিয়ে দিল ভটভটি। গুলি চালাতে চালাতে তারা পালাল।

সন্তু সুকোমলকে নিয়ে চলে এল পাড়ের কাছে।

সেখানে ঘাট নেই, খুব কাদা। তার মধ্য থেকে সে সুকোমলকে টানতে টানতে উঠে এল ওপরে।

তারপর ডাকল, কাকাবাবু!

কাকাবাবু নয়, রিভলভার হাতে নিয়ে ছুটে এলেন নিখিল মাহাতো।

তিনি সুকোমলের দিকে ভাল করে না তাকিয়েই জলকাদা-মাখা স্যুকে বুকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললেন ঝরঝর করে। আবেগের সঙ্গে বলতে লাগলেন, সন্তু, সন্তু, তুমি আমার ছেলেকে উদ্ধার করে আনলে… তোমার ঋণ যে কী করে শোধ করব—

কেউ সামনা সামনি প্রশংসা করলে সন্তুর খুব অস্বস্তি হয়। সে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলল, সুকোমলকে দেখুন। ও কথা বলছে না কেন?

পেটে জল ঢুকে যায়নি তো!

নিখিল মাহাতো এবার ছেলের পাশে বসে পড়ে বললেন, সুকু, তুই ঠিক আছিস তো? তোকে ওরা কষ্ট দিয়েছে?

তারপরই তিনি চেঁচিয়ে উঠলেন, এ কী? এ কে?

সন্তুও দারুণ চমকে উঠল। যাকে সে উদ্ধার করে এনেছে, সে সুকোমল তো নয়। অন্য একটি ছেলে।

সে-ও ছেলেটির পাশে বসে পড়ে বলল, এই, তুমি কে?

ছেলেটি কাঁচুমাচু ভাবে বলল, আমি লুতফর!

নিখিল মাহাতো বললেন, লুতফর? তুই ওদের নৌকোয় কী করছিলি? তুইও ওদের দলের?

লুতফর বলল, আমি কিছু জানি না সার। আমি নদীতে মাছ ধরছিলাম, দুজন জোয়ান লোক জোর করে আমারে ধরে টেনে নিয়ে গেল। তারপর সন্দেশ খেতে দিল নৌকোয় তুলে। ধমকাতে ধমকাতে বলল, খা, খা! সেই সন্দেশ খেয়ে, কী যেন হল, ঘুম এসে গেল, আর আমি কিছু জানি না!

নিখিল মাহাতো দারুণ হতাশভাবে বললেন, যাঃ! ওরাও আমাদের ঠকিয়েছে!
কাকাবাবু ভাল করে চোখ চাইতে পারছেন না, সবই অস্পষ্ট দেখছেন।

যা দেখছেন, তার মানে বুঝতে পারছেন না। একবার মনে হল, উলটো দিকে একজন লোক দাঁড়িয়ে আছে, তার চেহারা অবিকল তার মতন। যেন আর একজন রাজা রায়চৌধুরী। ঠিক তার মতন গোঁফ, তার মতন দুবগলে ক্রাচ।

কাকাবাবু ভাবলেন, তার তো কোনও যমজ ভাই ছিল না কখনও। তা হলে এ লোকটা এল কোথা থেকে?

কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই লোকটা যেন কুঁকড়ে ছোট হয়ে গেল।

আবার সব কিছু অন্ধকার।

সেই অন্ধকারের মধ্যে একজন কেউ গম্ভীর গলায় বলল, ওয়েক আপ! ওয়েক আপ! মিস্টার রায়চৌধুরী, অনেক ঘুমিয়েছেন, এবার উঠুন!

আবার আলো জ্বলে উঠল। কে যেন একবাটি জল ছিটিয়ে দিল কাকাবাবুর মুখে। কনকনে ঠাণ্ডা জল। এবার তিনি জোরে মাথা ঝাকুনি দিলেন। তাকালেন পুরো চোখ মেলে।

ফের আলো নিভে গিয়ে জ্বলে উঠেছে একটা স্পটলাইট। তাতে দেখা যাচ্ছে মস্তবড় একটা সাপের ফণা। সেটা দুলছে আর ফোস ফোস শব্দ হচ্ছে।

সেই সাপ মানুষের মতন কথা বলে উঠল। তাও ইংরেজিতে। ফোস ফোস করতে করতে বলল, মিস্টার রায়চৌধুরী, মিট শঙ্খচূড়।

কাকাবাবু হাত তুলতে গিয়ে টের পেলেন তাঁর দুটো হাত পেছন দিকে বাঁধা।

কয়েক মুহূর্ত পরেই জায়গাটা ভরে গেল ঝলমলে আলোয়।

এবার দেখা গেল, সেটা একটা বড় ঘর। তার চারদিকে কয়েকটা কম্পিউটার আর অন্য নানারকম যন্ত্রপাতি। মাঝখানে একটা চেয়ারে সেই মস্তবড় সাপের ফণা।

সেটা যে আসল সাপ নয়, একটা মুখোশ, তা বুঝতে কাকাবাবুর অসুবিধে হল না।

তিনি ভাবলেন, তিনি যে দ্বিতীয় একজন রাজা রায়চৌধুরীকে দেখেছিলেন, সে কোথায় গেল? নাকি সেটা চোখের ভুল?

টেবিলের ওপাশের লোকটি এবার মাথা থেকে সাপের ফণার মুখোশটা খুলে ফেলে রাখল টেবিলের ওপর। একটা চিরুনি দিয়ে চুল আঁচড়াতে লাগল।

লোকটির বয়েস চল্লিশ থেকে পঁয়তাল্লিশের মধ্যে। রং ফরসা। খুব মোটা ভুরু, সেরকমই অনেকখানি লম্বা জুলপি। হরতনের গোলামের মতন তার মোটা গোঁফ মিশে গেছে জুলপির সঙ্গে। মাথায় বাবরি চুল। চোখের মণিদুটো নীল।

লোকটিকে দেখলে বাঙালি বলে মনে হয় না।

সে মাথার চুল আঁচড়াবার পর ভুরু আর গোঁফও আঁচড়ে নিল।

তারপর চওড়াভাবে হেসে বলল, আপনার সঙ্গে একটু ছেলেমানুষি করছিলাম, তাই না? মাঝে মাঝে এরকম ছেলেমানুষি করতে আমার ভাল লাগে।

কাকাবাবুর মাথাটা আস্তে আস্তে পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে। তিনি কোনও কথা না বলে সোজা তাকিয়ে রইলেন লোকটির দিকে।

লোকটি বলল, মিস্টার রাজা রায়চৌধুরী, আমি আপনার পরিচয় সবই জানি। আপনি আমার সম্পর্কে কিছুই জানেন না। আমি সংক্ষেপে জানাচ্ছি। আমার অনেক নাম। শঙ্খচূড়, কার্লোস, রুস্তম, মহাবীর সিং, ভ্যাম্পায়ার, ডেভিল ইনকারনেট, হলাকু, এইরকম আরও আছে। এখানে আমি শঙ্খচূড়, এর ঠিক আগেই ছিলাম হলাকু। আপনি আমাকে এর যে-কোনও একটা নাম ধরে ডাকতে পারেন।

টেবিলের ওপর লোকটির বাঁ হাত রাখা। কাকাবাবু দেখলেন, বুড়োআঙুল ছাড়া ওর সব আঙুলেই দুটো-তিনটে করে আংটি।

ওর মুখোশটা খুলে ফেললেও কাকাবাবু বুঝতে পারলেন, লোকটি এখনও ছদ্মবেশ ধরে আছে। ওর ভুরু, গোঁফ, মাথার চুল সবই নকল। খুব সম্ভবত চোখেও কনটাক্ট লেন্স পরা, তাই মণিদুটো নীল দেখাচ্ছে।

লোকটি বলল, আপনাকে বেশি বেশি গ্যাস দিয়ে অজ্ঞান করা হয়েছিল। আপনি কতক্ষণ ঘুমিয়েছেন জানেন? পাকা চব্বিশ ঘণ্টা।

তারপর সে একটা বেল বাজাতেই পেছন দিকের দরজা খুলে ঢুকল একজন লোক। তার মুখে একটা নীল রঙের মুখোশ।

লোকটি বলল, রাজা রায়চৌধুরী চব্বিশ ঘণ্টা ঘুমিয়ে আছেন, না খেয়ে আছেন। ওঁকে কিছু খেতে দেবে না? আমাদের বদনাম হয়ে যাবে যে! শিগগির কফি আর কেক-বিস্কুট নিয়ে এসো!

একটা কম্পিউটারে পি পি করে শব্দ হতেই লোকটি সেটার কাছে চলে গিয়ে টেপাটিপি করতে লাগল কি-বোর্ডে।

দু মিনিটের মধ্যে নীল মুখোশপরা লোকটি একটা ট্রে-তে সাজিয়ে দুকাপ কফি আর এক প্লেট খাবার এনে রাখল টেবিলের ওপর।

শঙ্খচূড় লোকটিকে ধমক দিয়ে বলল, আরে বেওকুফ, ওঁর হাত বাঁধা থাকলে উনি খাবেন কী করে? আনটাই হিজ হ্যান্ডস্!

নীল মুখোশপরা লোকটি কাকাবাবুর হাতের বাঁধন খুলে দিল।

রক্ত জমে গিয়ে হাতদুটো প্রায় অসাড় হয়ে গেছে। কাকাবাবু হাতে হাত ঘষতে লাগলেন।

কম্পিউটারের কাছ থেকে ফিরে এসে শঙ্খচূড় বলল, আপনি আমার সঙ্গে বাংলা, ইংরেজি, স্প্যানিশ, অ্যারাবিক, ফ্রেঞ্চ যে-কোনও ভাষায় কথা বলতে পারেন। আমি বাংলা কেমন বলছি, ঠিক হচ্ছে না? অবশ্য আপনাদের মতন উচ্চারণ হবে না।

কাকাবাবু এবারও কোনও মন্তব্য করলেন না।

শঙ্খচূড় বলল, নিন, খেতে আরম্ভ করুন।

সে নিজেও কফিতে চুমুক দিয়ে একটা লম্বা চুরুট ধরাল।

এতক্ষণ পরে কাকাবাবু বললেন, আপনি চুরুটটা নিভিয়ে ফেলুন। চুরুটের গন্ধ আমি সহ্য করতে পারি না।

লোকটি কয়েক মুহূর্ত অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল কাকাবাবুর দিকে। তারপর হো হো করে হেসে উঠল।

হাসতে হাসতে বলল, আপনি তো দেখছি, সত্যিই অদ্ভুত লোক! আমার ঘরে বসে আমাকেই হুকুম করছেন?

কাকাবাবু বললেন, হুকুম নয়, অনুরোধ। আমার প্লিজ বলা উচিত ছিল। একসময় আমি খুব চুরুট খেতাম। অনেকদিন ছেড়ে দিয়েছি। এখন চুরুটের গন্ধই সহ্য হয় না।

লোকটি চেয়ার ছেড়ে কাকাবাবুর কাছে চলে এসে বলল, যদি আপনার হাত আবার বাঁধি আর আপনার নাকের কাছে এই জ্বলন্ত চুরুটটা ধরে রাখি, তা হলে বেশ মজা হয়, তাই না?

কাকাবাবু বললেন, ওটাকে মজা বলে না। ওটা অভদ্রতা।

লোকটি বলল, আমার নাম শঙ্খচূড়। আমি যে কত অভদ্র নিষ্ঠুর হতে পারি, আপনি তা ধারণাই করতে পারবেন না। যাক গে, এখন কাজের কথা হোক। কফিটা খেয়ে নিন।

কাকাবাবু এবার কফিতে এক চুমুক দিলেন।

শঙ্খচূড় বলল, মিস্টার রায়চৌধুরী, আপনার সঙ্গে আমার পার্সোনালি কোনও শত্রুতা নেই। আমি প্রফেশনাল লোক। আমি টাকার বিনিময়ে অন্যদের হয়ে নানারকম কাজ করি। সেরকম একটা কাজের জন্যই—

তাকে থামিয়ে দিয়ে কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, গাড়িতে আমার সঙ্গে একটি ছোট মেয়ে ছিল। সে কোথায়?

শঙ্খচূড় ভুরু কুঁচকে বলল, ছোট মেয়ে? ছিল নাকি? ফরগেট ইট। তা নিয়ে এখন মাথা ঘামাতে হবে না। আপনাকে একটা বিশেষ উদ্দেশ্যে ধরে আনা হয়েছে। আমার কথামতন আপনাকে একটা কাজ করে দিতে হবে।

কাকাবাবু বললেন, অন্যের কথামতন কিছু কাজ করার অভ্যেস যে আমার নেই!

শঙ্খচূড় বলল, এক্ষেত্রে আপনার বাঁচবার যে এই একটাই রাস্তা। অন্য কোনও উপায় নেই।

কাকাবাবু বললেন, এর আগে আরও অনেকেই আমাকে মেরে ফেলার হুমকি দিয়েছে। কিন্তু কেউ তো পারেনি শেষ পর্যন্ত।

শঙ্খচূড় বলল, এই রে, আপনি এখনও আমার ক্ষমতাই বুঝতে পারেননি। অন্যদের সঙ্গে তুলনা করছেন? আমার সম্পর্কে আপনার কী ধারণা হয়েছে বলুন তো!

কাকাবাবু বললেন, আপনি তো বললেন, আপনি প্রফেশনাল লোক। টাকার বিনিময়ে কাজ করেন। তার মানে মারসিনারি?

শঙ্খচূড় বলল, আরে না, না। আমাকে অত ছোট ভাববেন না। মারসিনারি মানে তো ভাড়াটে সৈন্য। বিভিন্ন দেশে গিয়ে লড়াই করে। আমি লড়াই করি না, অনেক বড় বড় কাজের দায়িত্ব নিই। যেমন ধরুন, হাওড়া ব্রিজের মতন কোনও ব্রিজ উড়িয়ে দেওয়া, প্লেন ধ্বংস করা কিংবা কোনও দেশের প্রাইম মিনিস্টার কিংবা প্রেসিডেন্টকে খুন করা, এইসব। এখানে আমার কাজটা আরও বড়। প্রায় একশো কোটি টাকার প্রজেক্ট। সব ঠিক হয়ে যাবে, শুধু মাঝখানে ছোট একটা বাধার সৃষ্টি হয়েছে। আপনাকে দিয়ে সেই বাধাটা দূর করাব। কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলা বোঝেন তো!

কাকাবাবু বললেন, আপনি ধরেই নিচ্ছেন, আপনার কথা অনুযায়ী আমি কাজ করব!

শঙ্খচূড় বলল, ওই যে বললাম, আপনার অন্য কোনও উপায় নেই! এই কাজ শুরু করার আগে আমি আপনাকে খুব ভালমতন স্টাডি করেছি। এই দেখুন!

একটা কম্পিউটারের বোতাম টিপতেই তাতে ফুটে উঠল কাকাবাবুর ছবি। পরপর অনেক। সঙ্গে সন্তু আর জোজোর ছবিও আছে। পাশে পাশে অনেক কিছু লেখা।

শঙ্খচূড় বলল, অনেক কেসে দেখেছি, আপনি ইচ্ছে করে শত্রুর ডেরায় ঢুকে পড়েন। কখনও তারা ধরে নিয়ে আসে কিংবা আপনি নিজে থেকে ধরা দেন। তারপর নানারকম বুদ্ধি খাটিয়ে বেরিয়ে আসেন সেখান থেকে, শত্রুরাও ধরা পড়ে যায়। এই তো? কিন্তু এবারে আপনাকে আর বুদ্ধি খাটিয়ে কিংবা গায়ের জোর দেখিয়ে বেরোতে হবে না।

কাকাবাবু বললেন, বেরোতে পারব না?

শঙ্খচূড় একগাল হেসে বলল, আপনাকে আমিই ছেড়ে দেব। আপনি এখান থেকে সুস্থ অবস্থায় বেরিয়ে যাবেন, হাত-পা বাঁধা থাকবে না, রাস্তা দিয়ে হাঁটবেন। কিন্তু তখনও আপনি মুক্তি পাবেন না। আমার কথা অনুযায়ীই আপনাকে চলতে হবে।

কাকাবাবুও হেসে বললেন, ম্যাজিক নাকি? অথবা আমাকে হিপনোটাইজ করা হবে? তাতে কিন্তু বিশেষ সুবিধে হবে না!

শঙ্খচূড় বলল, ওসব হিপনোটিজম ফিজমের আমি ধার ধারি না। বিজ্ঞান, স্রেফ বিজ্ঞান। দেখুন তা হলে ব্যাপারটা কীরকম হবে।

টেবিলের ওপাশ থেকে সে একটা মূর্তি তুলে আনল। সেটা দেখে চমকে গেলেন কাকাবাবু। মূর্তিটা তাঁরই, অবিকল রাজা রায়চৌধুরী। সেরকম গোঁফ, সেরকম দুবগলে ক্রাচ। পুরোপুরি জ্ঞান হওয়ার আগে এটা দেখেই তিনি জীবন্ত মানুষ মনে করেছিলেন।

মূর্তিটা প্রায় দুহাত লম্বা। ফাইবার গ্লাস কিংবা ওই ধরনের কোনও হালকা জিনিস দিয়ে তৈরি।

শঙ্খচূড় সেটাকে নিয়ে রাখল ঘরের এক কোণে। একটা দরজার কাছে। কাকাবাবুর চেয়ারটাও সরিয়ে দিল অন্য এক কোণে, সে চেয়ারের পায়ায় চাকা লাগানো।

তারপর বলল, ওই হচ্ছে রাজা রায়চৌধুরীর রেলিকা। আমি যা বলব, তাই শুনবে। আর যদি না শোনে, তা হলে কী হবে? দেখুন কী হয়।

সে কম্পিউটারের কাছে গিয়ে দুবার কি-বোর্ড টিপতেই প্রচণ্ড শব্দ হল। সেই মূর্তিটা ছিন্নভিন্ন হয়ে টুকরোগুলো ছড়িয়ে গেল চতুর্দিকে। ঘর ভরে গেল ধোঁয়ায়।

সেই আওয়াজে কাকাবাবু চমকে উঠলেও মুখে কোনও রেখা ফুটল না।

শঙ্খচূড় বলল, দেখলেন তো কী হবে?

কাকাবাবু বললেন, ওটা তো একটা পুতুল। রিমোট কন্ট্রোলে বেলুন ফাটানো যায়, একটা পুতুল ধ্বংস করা যায়, কিন্তু আমি তো মানুষ। আমার কী ক্ষতি হবে?

শঙ্খচূড় এবারে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, রাজা রায়চৌধুরী, এখন থেকে তুমিও আমার হাতের পুতুল!
লুতফরকে ধরে রেখে কোনও লাভ নেই। তাকে অনেক জেরা করে বোঝা গেল, সে কিছুই জানে না। সে নদীর ওপারের হাঁসখালি গ্রামের ছেলে। তাকে সত্যিই জোর করে ধরে আনা হয়েছে।

তাকে ভাল করে খাইয়েদাইয়ে ফেরত পাঠিয়ে দেওয়া হল পরদিনই।

তা হলে সুকোমলকে কোথায় রাখা হয়েছে?

টাকাগুলো নকল না হয়ে আসল পাঁচ লাখ টাকা হলেও কি ওরা সুকোমলকে ফেরত দিত না?

সুকোমলের মা দারুণ কান্নাকাটি শুরু করেছেন। নিখিল মাহাতোরও মুখোনা শুকনো। অনেকেরই ধারণা হয়েছে, নকল টাকা দিয়ে ওদের ঠকাবার চেষ্টা করার জন্য শঙ্খচূড় এমন রেগে যাবে যে, সুকোমলকে হয়তো খুন করে ফেলবে।

কেউ মুখে কিছু না বললেও সন্তুর মনে হচ্ছে, সবাই যেন তাকেই দোষ দিচ্ছে। সে যেন বাড়াবাড়ি করে ফেলেছে। নকল টাকা দিয়ে কি চোর-ডাকাতদের ঠকানো যায়?

কিন্তু পুলিশ তো এর মধ্যে শঙ্খচূড়ের দলবলের কোনও খোঁজই পায়নি। সুকোমলকে উদ্ধার করার আর কী উপায় আছে।

নিখিল মাহাতো অবশ্য সরে নামে একটুও দোষ দিচ্ছেন না। বার বার বলছেন, সন্তু যেরকম সাহস দেখিয়েছে, তার কোনও তুলনাই হয় না।

তিনি মামার বাড়িতে পুলিশ পাহারার ব্যবস্থা করেছেন। ছোটমামা বলে দিয়েছেন, সন্তু একা একা বাড়ি থেকে বেরোতে পারবে না। ওর ওপরে শঙ্খচূড়ের দলের নিশ্চয়ই খুব রাগ হয়ে আছে। ওরা প্রতিশোধ নেওয়ার চেষ্টা করবে।

এর মধ্যেই খবর এসে গেছে যে, কাকাবাবুকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।

বারাসতের কাছাকাছি একটা ধানখেতের মধ্যে পড়ে ছিল দেবলীনাদের গাড়ি, তার মধ্যে দেবলীনা ও গাড়ির ড্রাইভার অজ্ঞান, কোনও চিহ্ন নেই কাকাবাবুর।

দেবলীনাকে ওই অবস্থায় ফেলে কাকাবাবু নিশ্চয়ই নিজে কোথাও চলে যাবেন না। তাঁকে কেউ ধরে নিয়ে গেছে।

সন্তু অবশ্য এটা জেনেও বিশেষ বিচলিত হয় না। তার ধারণা, কাকাবাবুকে আটকে রাখার সাধ্য পৃথিবীতে কারও নেই। তার বেশি চিন্তা সুকোমলের জন্য।

জোজো বলল, চল সন্তু, আমরা কলকাতায় ফিরে যাই। এখানে আর বসে থেকে কী করব?

সন্তু বলল, কাকাবাবু আমাদের এখানেই অপেক্ষা করতে বলেছিলেন।

জোজো বলল, কাকাবাবু তো একদিন পরে ফিরে আসবেনও বলেছিলেন। ফিরে তো এলেন না! কলকাতায় গিয়ে বরং দেবলীনাকে জিজ্ঞেস করে শোনা যাক। গাড়িটা মাঠের মধ্যে গেল কী করে?

সন্তু বলল, পুলিশ নিশ্চয়ই সেসব খোঁজখবর নিয়েছে। তুই বরং কলকাতায় চলে যা জোজো। আমি এখানে থাকি।

জোজো বলল, আমরা হচ্ছি লরেল হার্ডির মতন। একজনকে বাদ দিলে চলে। ইউনাইটেড উই স্ট্যান্ড, ডিভাইডেড উই ফল!

সন্তু বলল, চল, আমরা একবার নদীতে সাঁতার কেটে আসি।

জোজো বলল, ওরে বাবা, সাঁতার? এই নদীতে? হাঙর আছে, কুমির আছে। তুই খুব জোর প্রাণে বেঁচে গেছিস! কী করে বাঁচলি বল তো? রাত্তিরবেলা হাঙর-কুমিরেরা ঘুমোয়।

সন্তু বলল, তাই নাকি? আসল কথা, তুই সাঁতার জানিস না। তা হলেই বুঝতে পারতিস, সব কাজ আমরা একসঙ্গে করতে পারব না!

জোজো বলল, সব কাজ কি একসঙ্গে করা যায় রে? মনে কর, তুই হঠাৎ পা পিছলে আলুর দম হলি। তা বলে কি সঙ্গে সঙ্গে আমিও আছাড় খাব? তোর হাত ধরে টেনে তুলব। তুই সাঁতার কাটবি, আমি পাড় থেকে দেখব।

এইসময় গেটের কাছে একটা জিপগাড়ি থেকে নামলেন নিখিল মাহাতো।

কাছে এসে বললেন, তোমরা তৈরি হয়ে নাও। কলকাতা থেকে আমাদের থানায় ফোন এসেছে। তোমাদের দুজনকে পুলিশ পাহারায় পাঠিয়ে দিতে বলা হয়েছে কলকাতায়।

জোজো সন্তুকে বলল, দেখলি, দেখলি, আমি ঠিকই ভেবেছিলাম।

নিখিল মাহাতো হঠাৎ রাগে ফেটে পড়ে বললেন, পুলিশের ওপর মহল থেকে আমার ছেলের ব্যাপারে কোনও গুরুত্বই দেওয়া হল না! কলকাতায় বড়কর্তারা আমাদের মতন মফসলের লোকদের নিয়ে মাথাই ঘামাতে চায় না!

জোজো বলল, আঙ্কল, আপনার ছেলে সুকোমল ভাল আছে।

ঝট করে তার দিকে ফিরে নিখিল মাহাতো চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন, তাই নাকি? তুমি কী করে জানলে?

জোজো বলল, আমি একটা মন্ত্র জানি। সেই মন্ত্রটা পড়ে ধ্যান করলে আমি যে-কোনও মানুষকে দেখতে পাই। কাল রাত্তিরে আমি সুকোমলকে দেখেছি, তার সঙ্গে কথাও বলেছি!

নিখিল মাহাতো জোরে ধমক দিয়ে বললেন, চুপ করো! ওসব বাজে কথা শোনার সময় নেই আমার। এখন তোমাদের আঙ্কল মিস্টার রাজা রায়চৌধুরী ধরা পড়েছেন, এখন গোটা পুলিশ ডিপার্টমেন্ট তাঁকে নিয়েই ব্যস্ত হয়ে পড়বে, আমার ছেলের কথা ভুলেই যাবে। কিন্তু আমার কাছে আমার ছেলের জীবনই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।

সন্তু বলল, আমি এখন কলকাতায় যেতে চাই না।

নিখিল মাহাতো গলার আওয়াজ একটু নরম করে বললেন, তুমি আর থেকে কী করবে? তুমি খুবই চেষ্টা করেছিলে।

সন্তু বলল, আঙ্কল, আমি একবার নদীর ঘাটে যেতে চাই। সেদিন যেখান থেকে নৌকোয় উঠেছিলাম।

নিখিল মাহাতো বললেন, সেখানে গিয়ে আর কী হবে? লোকগুলো কি সেখানে বসে থাকবে?

সন্তু বলল, তবু একবার যাওয়া দরকার। একটা ব্যাপার যাচাই করে নিতে চাই।

জোজোর দিকে ফিরে বলল, জোজো, তুই এখানে থাক, যদি কোনও খবর আসে। আমি সাঁতার কাটতে যাচ্ছি না, অন্য কাজে যাচ্ছি।

সন্তু গিয়ে নিখিল মাহাতোর জিপে চড়ে বসল।

নদীর ঘাটে দিনেরবেলা অনেক লোকজন। বেশ কয়েকটি নৌকো রয়েছে, যাতায়াত করছে এপার থেকে ওপারে। কয়েকটি দোকানেও মানুষের বেশ ভিড়।

এক দোকান থেকে ভেসে আসছে জিলিপি ভাজার গন্ধ।

জিপ থেকে নেমে নিখিল মাহাতো জিজ্ঞেস করলেন, এখানে কী করতে চাও, সন্তু?

সন্তু বলল, সেদিন আমি যে নৌকোয় উঠেছিলাম, তার মাঝির নামটা আমার মনে আছে। বদরু শেখ। তার সঙ্গে একটু কথা বলতে চাই।

নিখিল মাহাতো বললেন, সে তো তোমাকে অন্য নৌকোটায় তুলে দিয়ে ফিরে এসেছিল। আমি দেখেছি। সে কী জানবে?

সন্তু বলল, আমি তাকে একটা নাম জিজ্ঞেস করব।

কয়েকটি নৌকোর মাঝিরা বসে বসে বিড়ি খাচ্ছে। তাদের মধ্যে বদরু শেখ নেই।

অন্য মাঝিরা ঠিক কিছু বলতে পারে না। একজন বলল, এই তো ছিল এখানে। আর-একজন বলল, ওপারে চলে গেল মনে হয়। অন্য একজন বলল, বদরুর নৌকোটা তো রয়েছে দেখছি।

একটু পরে তাকে পাওয়া গেল একটা চায়ের দোকানে। সন্তুকে দেখেই সে বলল, আমি এখন ভাড়া যাব না! নিখিল মাহাতো পুলিশের পোশাক পরে আসেননি, এমনি প্যান্ট-শার্ট, তাঁকে কেউ চিনতে পারেনি। তিনি বললেন, কেন, ভাড়া যাবে না কেন?

বদরু শেখ বলল, আমার অন্য খদ্দের ঠিক করা আছে।

নিখিল মাহাতো আবার জিজ্ঞেস করলেন, সে খদ্দের কখন আসবে?

বদরু শেখ ঝাঁঝের সঙ্গে বলল, সে যখনই আসুক। মোট কথা এখন ভাড়া যাব না। আমার মর্জি।

আশপাশে অনেক লোক দেখে সন্তু নিচু গলায় বলল, ভাড়া না যেতে চান, ঠিক আছে। আপনার নৌকোয় বসে একটু কথা বলতে পারি?

প্রবল বেগে দুদিকে মাথা নেড়ে সে বলল, না। ওসব হবে না। আমার সময় নেই!

নিখিল মাহাতো বললেন, তা হলে তো তোমায় একবার থানায় যেতে হয়!

এবারে বদরু শেখ ভয় পেয়ে চোখ বড় বড় করে বলল, থানায়?

সন্তু তার হাত ধরে খুব নরম সুরে বলল, চলুন না, আপনার নৌকোয় গিয়ে একটু বসি!

এবারে আর বদরু আপত্তি করল না।

নৌকোয় ওঠার পর সন্তু বলল, দুদিন আগে রাত্তিরবেলা আমি আপনার নৌকো ভাড়া নিয়েছিলাম, মনে আছে?

বদরু বলল, কত মানুষে ভাড়া নেয়, সবার কথা কি মনে থাকে?

সন্তু বলল, মাত্র দুদিন আগেকার কথা।

বদরু এক হাত দিয়ে দাড়ি চুলকোতে চুলকোতে বলল, মনে আছে।

সন্তু বলল, আপনি আমাকে মাঝনদীতে নিয়ে গেলেন, তারপর খানিক বাদে একটা ভটভটি এল উলটো দিক থেকে!

বদরু বলল, আপনারে সে লৌকোয় লামায়ে দিয়ে আমি ফিরে এসেছি।

সন্তু বলল, তা ঠিক। অন্য নৌকোয় মাঝি ছাড়াও দুজন লোক ছিল, আপনি তাদের চেনেন?

বদরু বলল, আমি তাদের দেখি নাই, শুনি নাই, চিনব কী করে? অন্ধকার ছিল।

সন্তু বলল, তাদের মধ্যে একজন আপনার নাম ধরে ডেকেছিল। বলেছিল, এ তো বদরু শেখ। বলেনি?

বদরু বলল, কী জানি, শুনি নাই আমি। যদি বা ডেকেও থাকে, সে আমারে চিনলেও আমাকেও কি তাকে চিনতে হবে?

নিখিল মাহাতো বললেন, তুমি খুব বিখ্যাত লোক বুঝি? তোমাকে অন্য অনেকে চেনে, তুমি তাদের চেনো না! কে তোমার নাম ধরে ডেকেছিল?

এবারে বদরু হাউহাউ করে কেঁদে নিখিল মাহাতোর হাঁটু চেপে ধরে বলল, আমারে মাপ করেন সার। আমি কিছু জানি না। আমি কোনও কথা বললে ওরা আমাকে মেরে ফেলবে। আমি বউ-বাচ্চা নিয়ে ঘর করি। আমারে ছেড়ে দ্যান সার।

সন্তু বলল, সেদিনের ঘটনা বার বার চিন্তা করতে করতে আমার এই খটকা লেগেছে। ওদের একজন এই মাঝির নাম জানে। তা হলে এই মাঝিও ওদের নাম জানতে পারে। এর কাছ থেকে ওদের খোঁজ পাওয়া যেতে পারে। একই দলেরও হতে পারে।

বদরু আবার বলল, আমি কোনও দলে নাই সার। আমি কিছু জানি না সার।

নিখিল মাহাতো বললেন, ওরা তোমাকে ভয় দেখিয়েছে। গুন্ডা-ডাকাতরা অনেক মানুষকে ভয় দেখিয়ে বেড়ায়। সবাই যদি ভয় পেয়ে মুখ না খোলে, তা হলে সমাজ-সংসার চলবে কী করে? ওরাই তো রাজত্ব করবে!

বদরু বলল, আমারে বিপদে ফেলবেন না সার। দয়া করুন সার।

নিখিল মাহাতো বললেন, আমিও তো তোমায় ভয় দেখাতে পারি। থানায় ধরে নিয়ে গিয়ে তোমায় পেটাব। মারতে মারতে অজ্ঞান করে দেব। তাতেও যদি মুখ না খোল, তোমার নামে চুরি-ডাকাতির মিথ্যে কেস দিয়ে ভরে দেব হাজতে। তাতে তোমার বউ-ছেলেমেয়ে তো আরও বিপদে পড়বে!

বদরু ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল।

নিখিল মাহাতো বললেন, বদরু, তুমি ভাল লোক, না খারাপ লোক?

বদরু মুখ তুলে বলল, সার, আমি নিরীহ মানুষ, জীবনে কখনও চুরিজোচ্চুরি, অন্যায়, পাপের কার্য করি নাই বিশ্বাস করেন। আল্লার দয়ায় এই নৌকো চালিয়ে যা রোজগার হয়, তাতেই আমি সন্তুষ্ট।

নিখিল মাহাতো বললেন, তোমার কথায় বিশ্বাস করলাম। তুমি যদি সৎ মানুষ হও, তবে যারা অসৎ, বদমায়েশ, তাদের ধরিয়ে দিয়ে শাস্তি দেওয়াও তোমার কর্তব্য। তোমার যাতে বিপদ না হয়, আমরা দেখব। এই ছেলেটিকে দ্যাখো, তোমার চেয়ে বয়েসে কত ছোট। ও যদি বিপদের ভয় না পায়, তুমি জোয়ান পুরুষ হয়ে এত ভয় পাচ্ছ কেন? কারা ছিল সেই নৌকোয়?

বদরু কাঁধের গামছা দিয়ে চোখ মুছে বলল, একজনকে চিনি। তার নাম বিশাই সামন্ত।

নিখিল মাহাতো বললেন, বিশাই সামন্ত! নামটা চেনা চেনা মনে হচ্ছে। আগে কোনও একটা কেসে বোধ হয় ধরা পড়েছিল। এই বিশাই সামন্তর বাড়ি কোথায়?

বদরু বলল, কোথায় বাড়ি তা জানি না। তবে কবুতরডাঙায় তারে কয়েকবার দেখেছি।

নিখিল মাহাতো বললেন, কবুতরডাঙা? খুব বেশি দূর নয়। আমি এক্ষুনি সেখানে যেতে চাই। খোলো খোলো, নৌকো খোলো!

বদরু বলল, সে অতি সাঙ্ঘাতিক লোক সার। সঙ্গে বন্দুক-পিস্তল রাখে। এখন যাবেন না সার। আরও পুলিশ নিয়ে আসেন—

নিখিল মাহাতো অস্থিরভাবে বললেন, না, না, দেরি করার উপায় নেই। যত সময় নষ্ট হবে, ততই বিপদ বাড়বে। কী সন্তু, তুমি এক্ষুনি কবুতরডাঙায় যাওয়া উচিত মনে কর না? তুমি রাজি?

সন্তু বলল, হ্যাঁ, রাজি।

কাকাবাবুর হাত বাঁধা, পা দুটোও বাঁধা। দুজন লোক কাকাবাবুকে প্রায় চ্যাংদোলা করে বয়ে নিয়ে এল।

লম্বা বারান্দার একেবারে শেষে একটা ঘর। এই ঘরটাতেই সাজানো রয়েছে। কয়েকটা কম্পিউটার ও নানারকম যন্ত্র। টেবিলের ওপাশে বসে আছে শঙ্খচূড়। এখন সে পরে আছে একটা রঙিন ড্রেসিং গাউন। তার পাশে রয়েছে একটা মস্ত বড় কুকুর।

লোকদুটি কাকাবাবুকে বসিয়ে দিল একটা চেয়ারে।

শঙ্খচূড় বলে উঠল, আরে ছি ছি, ভদ্দরলোককে ওইভাবে নিয়ে এসেছ? উনি কি অসুস্থ না বাচ্চা ছেলে? হটিয়ে আনতে পারনি?

একজন বলল, আপনি তো অর্ডার দেননি সার।

শঙ্খচূড় বলল, উনি দারুণ চালাক লোক। তোমাদের জব্দ করতে পারেন বলে অন্য সময় হাত-পা বেঁধে রাখতে বলেছি। তা বলে আমার সামনে ওইভাবে নিয়ে আসবে? দাও, দাও, হাত, পা খুলে দাও।

লোকদুটি সঙ্গে সঙ্গে শিকলের বাঁধন খুলে নিল।

শঙ্খচূড় একজনকে জিজ্ঞেস করল, ওঁকে কিছু খেতে দিয়েছ তো?

সে আমতা আমতা করে বলল, আপনি কিছু বলেননি—

শঙ্খচূড় ধমক দিয়ে বলল, বলিনি মানে কী? আমি কি কখনও অর্ডার দিয়েছি যে অতিথিদের না খাইয়ে রাখবে? কিছু না খেলে দুর্বল হয়ে পড়বে, তাতে কোনও কাজ হবে না। যাও, শিগগির খাবার নিয়ে এসো।

লোকদুটো চলে যাওয়ার পর শঙ্খচূড় বলল, সরি মিস্টার রায়চৌধুরী, খুব খিদে পেয়েছে নিশ্চয়ই?

কাকাবাবু বললেন, আমি কি আপনার অতিথি?

শঙ্খচূড় বলল, এক হিসেবে অবশ্যই। গভর্নমেন্ট যাদের জেলখানায় ভরে রাখে, তারাও তো গভর্নমেন্টের অতিথি। তাদের দুবেলা খাবার দেওয়া হয়?

কাকাবাবু বললেন, হ্যাঁ, ফাঁসি দেওয়ার আগেও খাবার দেওয়া হয়।

হাহা করে হেসে উঠল শঙ্খচূড়।

হাত নাড়তে নাড়তে বলল, না, না, আমি আপনাকে ফাঁসি দিতে চাই না মোটেই। আগেই তো বলেছি, আপনাকে ছেড়ে দেব। তার আগে আপনাকে শুধু একটা ছোট্ট কাজ করে দিতে হবে।

কাকাবাবু বললেন, ছোট কাজের জন্য তো আমাকে দরকার হয় না!

শঙ্খচূড় বলল, এ-কাজটা শুধু আপনিই পারবেন। এ-রাজ্যের হোম সেক্রেটারি মিস্টার এম এম রায় তো আপনার খুব ভক্ত, তাই না?

হ্যাঁ, ওঁর সঙ্গে আমার পরিচয় আছে।

আপনাকে আমরা কলকাতায় রাইটার্স বিল্ডিংসের সামনে নামিয়ে দেব। আপনি ভেতরে ঢুকে যাবেন।

রাইটার্স বিল্ডিংসের মধ্যে ঢুকে যাব? সেখানে তো আমি নিরাপদ। তারপর আর আপনার কাজ করতে যাব কেন?

করবেন, করবেন, করতেই হবে। কাজটাও খুব সহজ। এম এম রায়ের কাছে একটা ইলেকট্রনিক নোটবুক আছে। সেটা আপনি চেয়ে নেবেন।

ইলেকট্রনিক নোটবুক? নিশ্চয়ই খুব গোপন ব্যাপার। সেটা তিনি আমাকে দেবেন কেন?

দেবে, দেবে, আপনাকেই একমাত্র বিশ্বাস করে দিতে পারে। সেটা নিয়ে এসে আপনি আমার হাতে তুলে দেবেন, তা হলেই আপনার ছুটি হয়ে যাবে, মিস্টার রায়চৌধুরী।

এবার বলুন তো মিস্টার শঙ্খচূড়, আপনার এই কাজটা আমি করতে বাধ্য হব কেন?

আপনাকে তো আমি আগেই বলেছি, এখন আপনি আমার হাতের পুতুল। একবার নিজের পিঠে হাত দিয়ে দেখুন তো।

কাকাবাবু আগেই অনুভব করছিলেন তাঁর পিঠে কী যেন একটা লেগে আছে। এবার হাত দিয়ে দেখলেন, তাঁর জামার নীচে বাঁধা আছে একটা চাকতি।

শঙ্খচূড় মিটিমিটি হেসে বলল, ওটা কী জানেন? আর ডি এক্স-এর কথা জানেন নিশ্চয়ই। এটা প্রায় সেইরকমই আমারই আবিষ্কার করা প্রচণ্ড এক বিস্ফোরণ। কাল পুতুলটাকে যেরকম উড়িয়ে দিলাম, সেইরকম। আমি রিমোট কন্ট্রোল টিপলেই আপনি ঠিক সেইরকম ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবেন। আপনার হাত, পা, ধড়, মাথা এমন টুকরো টুকরো হয়ে যাবে যে, আপনাকে আর চেনাই যাবে না!

কাকাবাবু কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বললেন, কিন্তু মাঝখানে যদি দেওয়াল থাকে, তাতেও রিমোট কন্ট্রোল কাজ করে? আমি থাকব রাইটার্স বিল্ডিংসের তিনতলায়, আপনি থাকবেন বাইরে, অতদূর থেকে আপনি কী করে আমায় মারবেন?

এটা এত শক্তিশালী যে, এক মাইল দূর থেকেও কাজ করবে।

কিন্তু ঘরের মধ্যে আমি কী করছি, তা তো আপনি দেখতে পাবেন না। ঘরে ঢুকেই যদি হোম সেক্রেটারিকে সব জানিয়ে পিঠের জিনিসটা খুলে ফেলি?

সে-কথা কি আমি ভাবিনি রাজা রায়চৌধুরী? আমি এত বোকা? প্রথম কথা, এটা খুলতে যাওয়াই খুব বিপজ্জনক। তাতে আপনিও মরবেন, যে খুলতে যাবে, সেও মরবে। দ্বিতীয় কথা, ঘরের মধ্যে আপনি কী করছেন, তা দেখতে না পেলেও কাকে কী বলছেন, সব শুনতে পাব।

কী করে শুনবেন?

এমন কিছুই শক্ত নয়। এবার দেখুন, আপনার জামার নীচে বুকের সঙ্গে একটা ছোট্ট বোতাম আটকানো আছে। ওটা একটা মাইক্রো-রিসিভার। আপনি যেখানে বসে যা কথা বলবেন, সব আমি শুনতে পাব। সব রেকর্ডও হয়ে যাবে। প্রমাণ চান?

সে একটা যন্ত্রের সুইচ টিপলেই শোনা গেল কাকাবাবুর গলা। এই একটু আগে তিনি ওই লোকটির সঙ্গে যা কথা বলছিলেন, সব রেকর্ড হয়ে গেছে।

যন্ত্রটা বন্ধ করে শঙ্খচূড় বলল, অর্থাৎ এখন আপনি একটি মানব-বোমা। আপনার ব্যবহারে কোনও গণ্ডগোল দেখলেই আপনাকে আমি উড়িয়ে দিতে পারি।

কাকাবাবু আবার একটুক্ষণ চুপ করে রইলেন।

তারপর জিজ্ঞেস করলেন, আপনি আমাকে রাইটার্স বিল্ডিংসে পাঠাচ্ছেন। হোম সেক্রেটারির ঘরে। সেখানে আমাদের দুজনকেই যে একসঙ্গে উড়িয়ে দিতে চান কিনা, তা বুঝব কী করে? রাইটার্স বিল্ডিংসেরও ক্ষতি করতে পারেন।

শঙ্খচূড় বলল, তাও পারি ঠিকই। কিন্তু ওই যে ইলেকট্রনিক নোটবুকটার কথা বললাম, সেটা ফেরত পাওয়াটাই আমার কাছে সবচেয়ে জরুরি। ওটা আমার চাই-ই চাই। আর সেটা আপনাকেই এনে দিতে হবে।

একজন মুখোশধারী এইসময় খাবার নিয়ে এল ট্রে-তে করে। একটা ডিমসেদ্ধ, গোটা চারেক টোস্ট, দুটো সন্দেশ, এক কাপ কফি ও এক গেলাস জল।

কাকাবাবুর সত্যিই খিদে পেয়েছে। এ-পর্যন্ত শুধু এক কাপ কফি ছাড়া আর কিছুই খাননি। এখন তিনি প্রথমেই ডিমটা দুটুকরো করে একটা টুকরো মুখে পুরে দিলেন।

অন্য টুকরোটাও খেয়ে নিয়ে তিনি তুলে নিলেন একটা টোস্ট। তারপর বললেন, তা হলে যা বুঝতে পারছি, আপনার কথা শুনতেই হবে, নইলে আমাদের মরতে হবে।

শঙ্খচূড় বলল, এই তো ঠিক বুঝেছেন। হঠাৎ গোঁয়ারের মতন মারামারি করার চেষ্টা করে কোনও লাভ নেই। আপনার পিঠে যা বাঁধা আছে, তা ছুরি বা বন্দুক-পিস্তলের চেয়েও অনেক বেশি ডেঞ্জারাস। ছুরি কিংবা গুলি ঠিকমতন গায়ে না লাগতেও পারে, কিন্তু রিমোট কন্ট্রোল একেবারে নির্ভুল। চোখের নিমেষে আপনি শেষ হয়ে যাবেন।

কাকাবাবু বললেন, কিন্তু একটা ব্যাপার এখনও বুঝতে পারিনি। ইলেকট্রনিক নোটবুক জিনিসটা কী? সেটা এত মূল্যবান কেন? এসব না জানলে আমি হোম সেক্রেটারির কাছে সেটা চাইব কী করে?

শঙ্খচূড় বলল, ইলেকট্রনিক নোটবুক একটা ডায়েরির মতন। ডায়েরিতে, যেমন হাতে লিখতে হয়, এতে তা হয় না, কি-বোর্ডে টাইপ করলে সব মেমরিতে বসে যায়।

কাকাবাবু বললেন, অর্গানাইজার?

শঙ্খচূড় বলল, তারও উন্নত সংস্করণ। আমার আবিষ্কার। আমাদের একজন। লোক ধরা পড়েছে, পুলিশ তার কাছ থেকে এটা কেড়ে নিয়েছে। অবশ্য এতে কী লেখা আছে, তা পুলিশ এখনও কিছুই বুঝতে পারেনি, কারণ সবই কোডে লেখা। আমরা খবর পেয়েছি, দিল্লি থেকে দুজন এক্সপার্ট আসছে সেই কোড। উদ্ধার করার জন্য। তার আগেই সেটা আমার ফেরত চাই। যে-কোনও মূল্যে।

কাকাবাবু বললেন, এটা যদি এতই মূল্যবান জিনিস হয়, তা হলে হোম সেক্রেটারি আমাকে দেবেন কেন?

শঙ্খচূড় বলল, আপনি একদিনের জন্য চেয়ে নেবেন। আপনিও যে একজন সাংকেতিক লিপি পাঠ করার এক্সপার্ট তা অনেকেই জানে। এর আগে অনেক শক্ত শক্ত কোড পড়ে ফেলেছেন।

কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, আপনার লোকটি কোথায় ধরা পড়েছে?

শঙ্খচূড় বলল, নিউ জলপাইগুঁড়ি রেল স্টেশনে। তার পেট থেকে অবশ্য কোনও কথা বার করার উপায় নেই। সে এর মধ্যেই খুন হয়ে গেছে জেলখানার ভেতরে। ইলেকট্রনিক নোটবইটা পরীক্ষা করার সুযোগ আপনাকেও দেওয়া হবে না। সেটা পাওয়ার পরই সোজা নিয়ে আসবেন আমার কাছে। অন্য কারও হাতেও দেওয়ার দরকার নেই।

কাকাবাবু একটা সন্দেশ খাওয়ার পর জলের গেলাসটা হাতে নিতে যেতেই শঙ্খচূড় ঝুঁকে নিজেই গেলাসটা তুলে নিল।

কাকাবাবু অবাক হয়ে তার দিকে তাকাতেই সে বলল, জল খেতে হবে না, কফি খান। ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে।

মস্ত বড় কুকুরটা একটা হাই তুলে উঠে দাঁড়াল। তারপর কাকাবাবুর কাছে চলে এসে গন্ধ শুকতে লাগল চারপাশে ঘুরে ঘুরে।

কাকাবাবু কুকুরটার দিকে পলক চেয়ে থেকে তার মাথায় হাত দিয়ে আদর করলেন।

শঙ্খচূড় চেঁচিয়ে বলল, ওর গায়ে হাত দেবেন না। ও দারুণ হিংস্র।

কাকাবাবু বললেন, কুকুররা আমায় ভালবাসে। আমাদের বাড়িতেও কুকুর আছে।

সত্যিই কাকাবাবু কুকুরটাকে আদর করায় সে কোনওরকম হিংস্রতা দেখাল না।

শঙ্খচূড় ডাকল, টবি, টবি, কাম হিয়ার!

কুকুরটা ফিরে গেল তার মালিকের কাছে।

কাকাবাবু আর-একটা সন্দেশও খেয়ে নিয়ে বললেন, এটাও যেন ঠিক ফাঁসির খাওয়া। ইলেকট্রনিক ডায়েরিটা এনে দিলেই আপনি আমাকে মেরে ফেলবেন, তাই তো?

শঙ্খচূড় বলল, কেন, মারব কেন? বলেছিই তো, এই কাজটা করে দিলেই আপনাকে মুক্তি দেব।

কাকাবাবু বললেন, কেন, মুক্তি দেবেন কেন? মুক্তি পেলেই তো আমি পুলিশকে সব জানিয়ে দেব। আমাকে বাঁচিয়ে রেখে তো আপনার কোনও লাভ নেই।

শঙ্খচূড় বলল, আপনাকে সত্যিই মারব না। আমাকে যারা এই কাজের ভার দিয়েছে তাদের ইচ্ছে আপনাকে ছেড়ে দেওয়া হোক। ইলেকট্রনিক নোটবুকটা ফেরত পাওয়ার তিনদিন পরই সাঙ্ঘাতিক সব কাণ্ড শুরু হয়ে যাবে এই রাজ্যে। তখন দেখতে পাবেন শঙ্খচূড়ের আসল খেলা। তার মধ্যেই আমি রটিয়ে দেব, এক কোটি টাকার বিনিময়ে রাজা রায়চৌধুরী হোম সেক্রেটারির চোখে ধুলো দিয়ে ওই নোটবুকটা আমাদের হাতে তুলে দিয়েছে। আপনি হয়ে যাবেন চোর, লোভী, বিশ্বাসঘাতক। সবাই আপনাকে ছি ছি করবে! বাকি জীবনটা আপনাকে এই বদনাম নিয়ে কাটাতে হবে।

বাইরে কোথাও একটা কুকুরের ডাক শোনা যেতেই এ ঘরের কুকুরটা বিকট শব্দে ঘেউ ঘেউ করে উঠল।

শঙ্খচূড় তাকে সামলে নিয়ে বলল, তা হলে আর দেরি করে লাভ নেই। এবার বেরিয়ে পড়তে হবে। রাজা রায়চৌধুরী, মনে রাখবেন, আপনার প্রাণ আমার হাতের মুঠোয়। আমার কথায় এক চুল এদিক-ওদিক হলে সঙ্গে সঙ্গে আপনি ধ্বংস হয়ে যাবেন।
গাড়িটার কাচ কালো রঙের। কাকাবাবুর চোখ বাঁধা, হাত বাঁধা। গাড়িটা কোন রাস্তা দিয়ে যাচ্ছে, তা কাকাবাবুর পক্ষে বোঝার কোনও উপায় নেই।

এটুকু বোঝা গেছে, পেছনের সিটে তাঁর পাশে বসে আছে একজন, আর সামনে ড্রাইভারের পাশে বসে আছে আর একজন। আর ওদের মাঝখানে টবি নামের কুকুরটা। এই লোক দুজনের একজন শঙ্খচূড় নিজে কিনা তা বোঝা যাচ্ছে না।

কাকাবাবু বসে আছেন শক্ত হয়ে কাঠের মতন। তাঁকে হেলান দিয়ে বসতে বারণ করা হয়েছে।

এরকম অস্বস্তিতে তিনি জীবনে কখনও পড়েননি। তিনি অন্যের হাতের পুতুল। মুক্তি পাওয়ার কোনও চেষ্টা করাও বৃথা।

একটু বাদে তাঁর পাশের লোকটি চেঁচিয়ে বলল, এই যে, ঢুলছেন নাকি? খবরদার ঘুমোতে পারবেন না। ঘুমোতে দেখলেই কিন্তু আমি কান ধরে টেনে জাগিয়ে দেব।

কাকাবাবু আপন মনে বললেন, সেই ইস্কুলে পড়বার সময় অঙ্কের মাস্টারমশাই একদিন আমার কান মলে দিয়েছিলেন। তারপর এত বছরে আর কেউ আমার কানে হাত দেয়নি।

লোকটি বলল, একবার কান মলে দিলেই তক্ষুনি একেবারে ঘুম ভেঙে যায়।

সামনে থেকে ড্রাইভারটি বলল, আমাদের মতন ড্রাইভারদের যখন গাড়ি চালাতে চালাতে হঠাৎ ঘুম আসে, তখন আমরা নিজেরাই নিজেদের কান মলে দিই ভাল করে।

টবি হঠাৎ ঘেউ ঘেউ করে উঠল। নিশ্চয়ই রাস্তায় কোনও কুকুর দেখেছে।

পাশের লোকটি বলতে লাগল, টবি, টবি, নো, নো।

ঝনঝন শব্দ শুনে কাকাবাবু বুঝলেন, টবির গলায় চেন বাঁধা।

কুকুরটা তবু হিংস্রভাবে ডেকেই চলেছে। কাকাবাবুর ইচ্ছে হল, ওর মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করতে। কিন্তু তাঁর হাত যে বাঁধা।

ড্রাইভার আর অন্য দুজন লোকের গলার আওয়াজ শুনে কাকাবাবু বুঝলেন, শঙ্খচূড় নিজে আসেনি।

এদের মধ্যে রিমোট কন্ট্রোলটা কার কাছে?

গাড়িটা চলছে, কিছুক্ষণ সবাই চুপচাপ।

একটু পরে ড্রাইভার বলল, এই রে, সামনের রাস্তায় জল জমে আছে। কাল সারারাত বৃষ্টি হয়েছে।

সামনের সিটের লোকটি বলল, থামাও, থামাও, গাড়ি থামাও!

ড্রাইভার বলল, বেশি জল নয়, ওপর দিয়ে চলে যেতে পারব।

সামনের লোকটি বলল, না, না, না, জলের ওপর দিয়ে গাড়ি চালানো নিষেধ। আছে। ব্যাক করো, ব্যাক করো।

ড্রাইভারটি বলল, অন্য গাড়ি তো যাচ্ছে, অসুবিধে হবে না।

এবারে সামনের লোকটি কঠোরভাবে বলল, বললাম না, জলের ওপর দিয়ে যাওয়ার অর্ডার নেই। খানিকটা ব্যাক করো, বাঁ দিক দিয়ে একটা সরু রাস্তা আছে।

এর মধ্যে পেছনে অন্য গাড়ি এসে গেছে। একজন লোক নেমে গিয়ে সেইসব গাড়ি সরিয়ে এ-গাড়িটাকে ব্যাক করানো হল। তারপর ঢুকে পড়ল একটা গলিতে।

যে নীচে নেমেছিল সে গাড়িতে উঠে পড়ে বলল, এই জ্যামের মধ্যে গাড়ি ব্যাক করানোর কত ঝামেলা। ওইটুকু জলের ওপর দিয়ে চলে গেলে কী হত?

অন্যজন বলল, শাট আপ! সারের অর্ডারের ওপর কোনও কথা নয়।

কাকাবাবু বললেন, আমাদের পৌঁছোতে কতক্ষণ লাগবে?

অন্য লোকটি আবার বলল, শাট আপ! কোনও প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হবে না!

গাড়িটা আস্তে চলছে, মাঝে মাঝে থেমে যাচ্ছে, মনে হয় রাস্তায় কিছুটা জ্যাম আছে। এক জায়গায় গাড়িটা কয়েক মিনিট থামার পর কাকাবাবু একটা ট্রেনের শব্দ শুনতে পেলেন। তার মানে, এ-জায়গাটা লেভেল ক্রসিং।

আবার কিছুক্ষণ চলার পর গাড়ি থামল। দরজা খুলে নেমে গেল ওদের একজন। টবিও আবার ঘেউ ঘেউ করতে শুরু করেছে।

গাড়ির দরজা খোলা বন্ধের শব্দ পেয়ে কাকাবাবু বুঝলেন, লোকটি ফিরে এসেছে। তারপর ওরা কী যেন খেতে শুরু করল।

একজন বলল, টবিকে একটা দে। টবি মিষ্টি খেতে ভালবাসে।

অন্যজন বলল, রায়চৌধুরীকেও একটা দিবি নাকি?

তার সঙ্গী বলল, এ-ব্যাপারে কোনও অর্ডার নেই। তবে, সার তো নিজেই ওকে খাবার খাইয়েছেন।

অন্যজন কাকাবাবুকে একটু ঠেলা দিয়ে জিজ্ঞেস করল, এই যে, একটা মিষ্টি খাবেন?

কাকাবাবু মাথা নেড়ে বললেন, না।

সে বলল, খেয়ে দেখুন না, ভাল মিষ্টি।

সে জোর করে কাকাবাবুর মুখে কিছু একটা চেপে ধরল। কাকাবাবু বাধ্য হয়ে একটুখানি খেলেন। তাঁর ভালই লাগল, খেয়ে নিলেন সবটা।

এরপর গাড়ি চলতে লাগল অনেকক্ষণ ধরে, না থেমে।

কাকাবাবুর সত্যিই ঘুম এসে যাচ্ছে। কিন্তু হেলান দেওয়ার উপায় নেই। পিঠে যে জিনিসটা বাঁধা, সেটা মনে হচ্ছে ভারী হয়ে উঠছে ক্রমশ।

একবার তিনি সামনের দিকে ঢুলে পড়তেই পাশের লোকটি তার একটা কান চেপে ধরল।

কাকাবাবু বললেন, দাও, ভাল করে কানটা মলেই দাও, আমি ঘুমোতে চাই না।

সামনের লোকটি বলল, আর-একটা মিষ্টি খাবেন?

কাকাবাবু এবারে আর আপত্তি না করে বললেন, দাও।

সেটা খেয়ে তিনি একটু জল চাইলেন। লোকটি বলল, গাড়িতে জলের বোতল নেই, এখন আর থামাও যাবে না, দেরি হয়ে যাবে।

ক্রমশ রাস্তায় অন্য গাড়ির হর্নের আওয়াজ বাড়তে লাগল। তারপর ট্রামের আওয়াজ পেয়ে কাকাবাবু বুঝলেন, গাড়িটা কলকাতা শহরে এসে পড়েছে।

এবারে পাশের লোকটি তার চোখের বাঁধন আর হাতের শিকল খুলে দিল।

দুপাশে কালো কাচ, সামনের দিকে তাকিয়ে কাকাবাবু বুঝলেন, গাড়িটা ছুটছে ময়দানের মধ্য দিয়ে। পাশ দিয়ে যাচ্ছে আলিপুরের ট্রাম।

গাড়িটা লালদিঘি ঘুরে এসে থামল রাইটার্স বিল্ডিংসের সামনে।

পাশের লোকটি দরজা খুলে বলল, নামুন।

কাকাবাবু বললেন, আমার ক্রাচ কোথায়? ক্রাচ না পেলে আমি হাঁটতে পারব না।

লোকটি বলল, ক্রাচ আনা হয়েছে। আধঘণ্টার মধ্যে অবশ্যই ফিরবেন, আমি এখানে অপেক্ষা করব। আমাদের সার কী বলে দিয়েছেন শুনুন। আপনাকে শেষবারের মতন সাবধান করে দিচ্ছি। আপনি মুখে যা বলবেন, সব আমরা শুনতে পাব। আপনি লিখেলিখে কিছু জানাবার চেষ্টা করলেও কোনও লাভ হবে। আপনার পিঠ থেকে ওই জিনিসটা খোলার চেষ্টা করলে আপনি কিছুতেই বাঁচবেন না। সঙ্গে সঙ্গে রিমোট কন্ট্রোল চালু হয়ে যাবে। আপনি ছাতু হয়ে যাবেন! আধঘণ্টার বেশি দেরি হলেও তাই হবে।

কাকাবাবু বললেন, হোম সেক্রেটারি যদি এখন ঘরে না থাকেন?

লোকটি বলল, তা হলে ফিরে আসবেন সঙ্গে সঙ্গে। পরে আবার চেষ্টা করা হবে।

কাকাবাবু বুঝতে পারলেন, এরা সবদিক ভেবে রেখেছে। হোম সেক্রেটারিকে লিখে জানাবার কথাটা তাঁরও মনে এসেছিল। জানালেও এই বিপদ থেকে উদ্ধার পাওয়ার সময় মিলবে না।

একতলার অভ্যর্থনাকক্ষে গিয়ে কাকাবাবু হোম সেক্রেটারির সঙ্গে দেখা করতে চাইলেন। সেখানকার একজন বলল, আপনার অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে? নেই? তা হলে আজ দেখা হবে না। উনি সারাদিন ব্যস্ত থাকবেন।

কাকাবাবু বললেন, হোম সেক্রেটারি মৃগাঙ্ক আমার ভাই। আমি বিশেষ দরকারে এসেছি। ওকে আমার নামটা শুধু বলুন, তাতেই কাজ হবে।

কর্মচারীটি টেলিফোনে হোম সেক্রেটারির সঙ্গে একটু কথা বলেই ফোন রেখে দিল। তারপর ব্যস্ত হয়ে বলল, হ্যাঁ, হ্যাঁ, উনি এক্ষুনি আপনার সঙ্গে দেখা করতে চান। আপনি লিফটে উঠে চলে যান।

লিফটে অনেক লোক উঠে পড়েছে, কাকাবাবু প্রথমবার উঠলেন না। অন্যদের সঙ্গে যদি ধাক্কাধাক্কি হয়, তাতেও তিনি ভয় পাচ্ছেন।

লম্বা বারান্দা দিয়ে ক্রাচ নিয়ে হাঁটতে লাগলেন কাকাবাবু। দু-চারজন লোক তাঁকে চিনতে পেরে নমস্কার করল।

কাকাবাবু মনে মনে ভাবলেন, আমি যে একটি সাঙ্ঘাতিক মানব-বোমা, তা কেউ বুঝতে পারছে না।

হোম সেক্রেটারি মৃগাঙ্কমৌলী রায় ব্যস্ত হয়ে ঘরের বাইরে এসে দাঁড়িয়ে আছেন। কাকাবাবুকে দেখেই বললেন, কী ব্যাপার রাজাদা, আপনি কোথায় ছিলেন? আপনাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। মুখ্যমন্ত্রীও আপনার জন্য চিন্তিত।

কাকাবাবু বললেন, চলো, তোমার ঘরে বসে বলছি।

হোম সেক্রেটারির ঘরে আর একজন লোক বসে আছেন। পুরোদস্তুর পুলিশের পোশাক পরা।

হোম সেক্রেটারি কাকাবাবুকে বললেন, এঁর সামনে সব বলতে পারেন। ইনি ডি আই জি শামসুল আলম।

আলম হাতজোড় করে নমস্কার করে বললেন, আমি আপনাকে অনেকবার দেখেছি।

কাকাবাবুও নমস্কার করে বললেন, আগে এক গেলাস জল খাওয়াও। খুব তেষ্টা পেয়েছে।

ঢক ঢক করে পুরো গেলাস জল খেয়ে ফেলার পর কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, আগে বলল, দেবলীনার কী খবর?

মৃগাঙ্কমৌলী বললেন, তাকে তো মাঠের মধ্যে পাওয়া গেছে। গাড়িতে অজ্ঞান হয়ে পড়ে ছিল। ড্রাইভারেরও একই অবস্থা। ওরা দুজনেই বলেছে, গাড়ির জানলা দিয়ে একজন ফুস ফুস করে কী একটা গ্যাস স্প্রে করে দিল। সঙ্গে সঙ্গে অজ্ঞান। তারপর কী হয়েছে কিছু জানে না।

কাকাবাবু বললেন, কী আশ্চর্য, ওরা দেবলীনাকে কিছু করল না। শুধু আমাকে অজ্ঞান অবস্থায় ধরে নিয়ে গেল।

মৃগাঙ্কমৌলী জিজ্ঞেস করলেন, কোথায় ধরে নিয়ে গেল?

কাকাবাবু বললেন, তা তো জানি না। বুঝতে পারিনি।

আলম বললেন, হঠাৎ এ-রাজ্যে অ্যাবডাকশানের কেস খুব বেড়ে গেছে। এই মুহূর্তে একত্রিশ জনকে পাওয়া যাচ্ছে না। এদের মধ্যে যেমন বয়স্ক লোক আছে, তেমনই অল্পবয়েসি ছেলেমেয়েও আছে। এক-একজনের জন্য পাঁচ লাখ, দশ লাখ মুক্তিপণ চাওয়া হয়েছে।

মৃগাঙ্কমৌলী বললেন, এসব একই দলের কাজ না আলাদা আলাদা দল, তাও ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। কোনও চিঠিতে লেখা শঙ্খচুড়, কোনওটাতে রুস্তম, কোনওটাতে ভ্যাম্পায়ার। তবে চিঠির ধরনগুলো একই রকম।

কাকাবাবু বললেন, আমার মতন একজন খোঁড়া লোককে ধরে নিয়ে গিয়ে ওরা ভুল করেছিল। আমি ওদের বললাম, আমার মুক্তিপণের দশ লাখ, পাঁচ লাখ দূরে থাক, কেউ এক টাকাও দেবে না!

আলম বললেন, এই শুনেই আপনাকে ওরা ছেড়ে দিল?

কাকাবাবু বললেন, তা কী আর দেয়! কিছু অত্যাচার টত্যাচার করবে ভেবেছিল।

মৃগাঙ্কমৌলী বললেন, আপনাকে ওরা চিনতে পারেনি? আপনিই যে বিখ্যাত কাকাবাবু, রাজা রায়চৌধুরী।

কাকাবাবু বললেন, তা জানত বোধ হয়। তবে অনেকবার তো দেখলাম, আমাকে কেউ বেশিদিন আটকে রাখতে পারে না।

মৃগাঙ্কমৌলী বললেন, আপনাকে আটকাবে কার সাধ্য!

মৃগাঙ্কমৌলীর সামনে টেবিলের ওপর একটা খাতার সাইজের চৌকো জিনিস রয়েছে।

সেটার দিকে তাকিয়ে কাকাবাবু বললেন, আমি কী করে পালালাম, সেসব কথা বিস্তারিতভাবে পরে বলব, এখন বাড়ি গিয়ে ভাল করে ঘুমোনো দরকার। দেবলীনার সঙ্গেও একবার দেখা করতে হবে। তোমার কাছে আগে এসেছি অন্য কারণে। এইটাই কি সেই জিনিস?

মৃগাঙ্কমৌলী বললেন, সেই জিনিস মানে? আপনি এটার সম্পর্কে কিছু জানেন? আমরা এটার কথা যথাসম্ভব গোপন রাখার চেষ্টা করেছি।

কাকাবাবু বললেন, এটা যার কাছে পাওয়া গেছে, সে ধরা পড়েছিল নিউ জলপাইগুঁড়ি স্টেশনে। তারপর সে খুন হয় জেলের মধ্যে। এ-খবর তো বেরিয়েছে দিল্লির এক কাগজে।

আলম বললেন, তাই নাকি? দেখিনি তো। কলকাতার কাগজে কিছু বেরোয়নি। লোকটির কাছ থেকে কোনও কথাই বার করা যায়নি। কিন্তু তার মুখ-চোখ দেখে মনে হয়েছিল, এই জিনিসটা তার কাছে খুবই দামি।

কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, লোকটি খুন হল কী করে?

আলম বললেন, খুন না আত্মহত্যা, সেটাও ঠিক বোঝা যাচ্ছে না।

মৃগাঙ্কমৌলী বললেন, এটা একটা অর্গানাইজার। খুবই আধুনিক ধরনের। পার্সোনাল কম্পিউটারের সঙ্গে লিঙ্ক করা যায়। জলপাইগুঁড়ি থেকে এটা পুলিশের গাড়িতে আনবার সময় কোনও একটা দল এটা কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছিল। গাছের গুঁড়ি দিয়ে আটকে দিয়েছিল রাস্তা। তারপর বোমা ছুড়তে ছুড়তে এগোচ্ছিল। দৈবাৎ সেই সময় আর-একটা পুলিশের গাড়ি এসে যায় উলটো দিক থেকে। আমাদের পুলিশের গুলিতে ওদের একজন মারাও যায়। সেইজন্যই এটাকে এত সাবধানে রাখা হয়েছে।

আলম বললেন, এর মেমরিতে অনেক তথ্য ঠাসা আছে। তার কিছু বার করতেও পেরেছি। কিন্তু কিছুই মানে বোঝা যাচ্ছে না। শুধু কিছু অক্ষর আর সংখ্যা।

মৃগাঙ্কমৌলী বললেন, এটা বোঝা যাচ্ছে, কোনও সাংকেতিক ভাষায় কিছু তথ্য রয়েছে। এটাকে দিল্লিতে পাঠাতেও ভরসা পাচ্ছি না। যদি মাঝপথে খোয়া যায়! তাই দিল্লি থেকে দুজন এক্সপার্ট আসছেন—

কাকাবাবু বললেন, দিল্লি থেকে এক্সপার্ট আনতে হবে? এখানে কেউ পারবে না?

মৃগাঙ্কমৌলী বললেন, এখানে কয়েকজন তো অনেক চেষ্টা করে দেখল, কেউ,—। বলতে বলতে থেমে গেলেন মৃগাঙ্কমৌলী। তারপর লজ্জা পেয়ে গিয়ে বললেন, আপনিই তো রয়েছেন। আপনি এর আগে কত সাংকেতিক লিপি উদ্ধার করেছেন, এমনকী ইজিপ্টের পিরামিডের মধ্যে হিয়েরোগ্লিফিক্স পর্যন্ত আপনার কথা মনে পড়েনি।

আলম বললেন, উনি তো এখানে ছিলেন না।

কাকাবাবু বললেন, পারব কিনা জানি না, তবু একবার চেষ্টা করে দেখতে পারি। দেখব?

মৃগাঙ্কমৌলী সেটা কাকাবাবুর হাতে তুলে গিয়ে ব্যগ্রভাবে বললেন, দেখুন, দেখুন না।

কাকাবাবু জিনিসটা ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখতে দেখতে আপনমনে বললেন, ২৫৬ কে বি মেমরি, প্রচুর জিনিস থাকতে পারে। কিন্তু এখানে তো হবে না। বাড়িতে গিয়ে ঠাণ্ডা মাথায় দেখা দরকার। এটা আমি বাড়িতে নিয়ে যেতে পারি?

মৃগাঙ্কমৌলী আড়ষ্টভাবে বললেন, সেটা তো সম্ভব নয়, রাজাদা!

কাকাবাবু বললেন, সম্ভব নয়? কেন?

মৃগাঙ্কমৌলী বললেন, টপ সিকিউরিটি। চিফ মিনিস্টারের অর্ডার ছাড়া এটা কোনওক্রমেই বাইরে নেওয়া যাবে না।

আলম বললেন, চিফ মিনিস্টার এখন দিল্লিতে।

কাকাবাবু বললেন, তোমরা কি আমাকে বিশ্বাস করতে পার না?

মৃগাঙ্কমৌলী বললেন, বিশ্বাসের প্রশ্ন নয়। রাজাদা, আপনাকে আমি অবিশ্বাস করতে পারি? কিন্তু আমাদের ওপর যা অর্ডার আছে।

কাকাবাবু ঘড়ির দিকে তাকালেন। এর মধ্যেই প্রায় কুড়ি মিনিট কেটে গেছে। ওরা সময় দিয়েছে মাত্র আধঘণ্টা।

সেই আধঘণ্টা পার হয়ে গেলে ওরা কী করবে? রিমোট কন্ট্রোল চালু করে দেবে। তাতে কাকাবাবু শুধু নিজে মরবেন না, এই মৃগাঙ্কমৌলী আর আলমও খতম হয়ে যেতে পারে।

অন্তত ওদের বাঁচবার জন্যও কাকাবাবুকে এখানে থেকে বেরিয়ে যেতে হবে আর দশ মিনিটের মধ্যে।

মৃগাঙ্কমৌলী বললেন, রাজাদা, আপনাকে দারুণ ক্লান্ত দেখাচ্ছে। মুখোনা কালো হয়ে গেছে। শরীর খারাপ হয়নি তো?

কাকাবাবু বললেন, না। সেরকম কিছু না। ভাল করে ঘুম হয়নি।

মৃগাঙ্কমৌলি বললেন, আপনি বাড়িতে গিয়ে ভাল করে ঘুমিয়েটুমিয়ে নিন। আমি বরং সন্ধের পর আপনার সঙ্গে দেখা করতে যাব।

কাকাবাবু বললেন, আমরা আজকাল সব ব্যাপারেই দিল্লির ওপর নির্ভর করি। আমরা বাঙালিরা নিজেরা বুঝি কিছু পারি না? চিফ মিনিস্টার যদি এখানে উপস্থিত থাকতেন, তিনি কি ওটা একদিনের জন্য আমাকে দিতে আপত্তি করতেন?

মৃগাঙ্কমৌলী তাকালেন আলমের দিকে।

আলম বললেন, দিল্লির এক্সপার্ট দুজন আসবেন কাল মর্নিং ফ্লাইটে। এখানে পৌঁছোতে পৌঁছোতে দশটা সাড়ে দশটা বেজে যাবে। তার আগেই যদি কাকাবাবু এই কোডগুলো পড়ে দিতে পারেন, তা হলে কিন্তু আমাদের খুব ক্রেডিট হবে। আমাদের এখানেও কাকাবাবুর মতন এমন গুণী মানুষ রয়েছেন।

কাকাবাবু বললেন, আমি পারব কিনা জানি না। তবে, কাল সকাল দশটার মধ্যে আমি এটা ফেরত দিয়ে যাব, এই কথা দিতে পারি।

মৃগাঙ্কমৌলী বললেন, এটা বাড়িতে নিয়ে যেতেই হবে? এখানে বসে চেষ্টা করতে পারেন না?

কাকাবাবু অধৈর্যভাবে বললেন, না, তা সম্ভব না।

তারপর আর একবার ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললেন, ঠিক আছে, আমি উঠছি। তোমাদের ব্যাপার তোমরা বুঝবে।

মৃগাঙ্কমৌলী বললেন, ঠিক আছে, আলমসাহেব এটা আপনার বাড়ি পৌঁছে। দিচ্ছেন।

কাকাবাবু বললেন, দিচ্ছ তা হলে? আলমসাহেবকে পৌঁছে দিতে হবে না, আমার সঙ্গে একটা গাড়ি আছে।

আলম বলল, সে-গাড়ি ছেড়ে দিন। আপনি আমার গাড়িতে যাবেন।

কাকাবাবু বললেন, বলছি তো, তার কোনও দরকার নেই।

আলম বলল, কাকাবাবু, এরকম একটা সাঙ্ঘাতিক জিনিস আপনি একলা নিয়ে যেতে চাইছেন? যদি রাস্তায় আপনার ওপর হামলা হয়?

কাকাবাবু বললেন, সেকথা কি আমি ভাবিনি? তোমাদের থেকে আমার অভিজ্ঞতা অনেক বেশি। যদি কেউ সামনের রাস্তায় দাঁড়িয়ে নজর রাখে, তা হলে পুলিশের পোশাকে তোমাকে আমার সঙ্গে দেখলেই সন্দেহ করবে। আর আমি যদি জিনিসটা পকেটে নিয়ে একলা এমনিই বেরিয়ে পড়ি, কেউ কিছুই ভাববে না।

মৃগাঙ্কমৌলী বললেন, তা হলে আলমসাহেব আপনাকে একটু দূর থেকে ফলো করুক।

কাকাবাবু বললেন, সেটাও ঠিক হবে না। আমি চলে যাওয়ার পর আলম এখানে অন্তত পনেরো মিনিট অপেক্ষা করুক। তারপর সোজা চলে আসুক আমার বাড়িতে।

মৃগাঙ্কমৌলী বললেন, আমিও এক ঘণ্টার মধ্যে পৌঁছে যাব আপনার বাড়ি।

কাকাবাবু ঘড়িতে দেখলেন, আর সময় আছে মাত্র চার মিনিট। তিনি বললেন, বাইরে হঠাৎ হঠাৎ বৃষ্টি আসছে। এটাতে যদি জল লেগে যায়— একটা পলিথিনের প্যাকেটে ভাল করে মুড়ে দাও তো।

পলিথিনের প্যাকেটে মোড়ার পর কাকাবাবু ইলেকট্রনিক নোট বুকটা পকেটে নিলেন না। পকেটে রাখার পক্ষে সেটা একটু বড়। জামার বোতাম খুলে তিনি

সেটাকে বুকের কাছে রেখে আবার বোতাম আটকে দিলেন।

ওঁদের দুজনের দিকে তাকিয়ে বললেন, কেউ বুঝতে পারবে যে আমার কাছে কিছু আছে? তোমরা তা হলে আমার বাড়িতে চলে এসো, সেখানে আমাকে পাহারা দেবে, আমি কাজ করব।

আলম আর মৃগাঙ্কমৌলী কাকাবাবুকে এগিয়ে দিলেন লিট পর্যন্ত।

কাকাবাবু রাইটার্স বিল্ডিংস থেকে বেরোতেই দেখলেন, টবির গলায় চেন ধরে দাঁড়িয়ে আছে একজন লোক।

সে বলল, আর ঠিক দেড় মিনিট বাকি ছিল। কাজ উদ্ধার হয়েছে?

কাকাবাবু জামার বোতাম খুলে প্যাকেটটা দেখিয়ে বললেন, হ্যাঁ।

সে হাত বাড়িয়ে বলল, দিন।

কাকাবাবু বললেন, না তো। একেবারে তোমাদের সারের হাতে তুলে দেওয়ার কথা।

লোকটি বলল, ঠিক আছে। এখানে গাড়ি রাখা যায় না। গাড়িটা আছে ওই যে লালদিঘির পার্কিং লটে। ওখানে যেতে হবে।

কাকাবাবু বললেন, জানি।

লাল আলো জ্বলবার পর কাকাবাবু রাস্তা পার হলেন। পাশে পাশে টবি আর সেই লোকটি।

ভেতরে অনেক গাড়ি। অন্য লোকটি এগিয়ে এসে বলল, আমাদের গাড়ির পেছনে আর একটা গাড়ি রেখেছে। আপনি এখানে দাঁড়ান, আমি গাড়িটা বার করে আনছি।

যে লোকটি টবির গলায় চেন ধরে আছে, সেও মুখ ফিরিয়ে গাড়িটা বার করা দেখছে।

কাকাবাবু একবার টবির মাথায় মৃদু চাপড় মেরে আদর করলেন। তারপর আস্তে আস্তে এগিয়ে গেলেন রেলিংয়ের কাছে। দেখতে লাগলেন পুকুরটা।

তারপর তিনি হঠাৎ এক কাণ্ড করলেন।

ক্রাচদুটো পাশে নামিয়ে রেখে তিনি প্রায় চোখের নিমেষে রেলিং ডিঙিয়ে চলে গেলেন ওপাশে। ঝাঁপ দিয়ে পড়লেন জলে।

টবি ঘাউ ঘাউ করে ডেকে উঠল।

একজন লোক ছুটে এল এদিকে। তার এক হাতে রিমোট কন্ট্রোল, অন্য হাতে রিভলভার।

ভরা বর্ষার লালদিঘিতে অনেক জল। কাকাবাবু ড়ুবতে ড়ুবতে নেমে গেলেন অনেক নীচে।

শঙ্খচূড়ের অনুচর দুজনই রেলিংয়ের কাছে এসে গেছে। কাকাবাবু জলের মধ্যে আছেন বলে সম্ভবত রিমোট কন্ট্রোলে কোনও কাজ হচ্ছে না। দিশেহারা হয়ে একজন গুলি চালাতে লাগল।

সেই গুলির শব্দে ভয় পেয়ে পালাতে লাগল অনেক লোক। আবার রাইটার্স বিল্ডিংসের সামনে থেকে পুলিশ ছুটে এল এদিকে।

কাকাবাবু শ্বাস নেওয়ার জন্য একবার সামান্য মাথা তুলেই আবার ড়ুব দিলেন। ড়ুব-সাঁতার দিয়ে এগিয়ে যেতে লাগলেন দিঘির মাঝখানে।
কবুতরডাঙায় সপ্তাহে দুদিন হাট হয়। তখন কত লোকজন, কত চ্যাঁচামেচি, কতরকম তরিতরকারি আর মাছের গন্ধ। অন্য দিনগুলোতে সব শুনশান। চালাঘরগুলো ফাঁকা পড়ে থাকে, ঘুরে বেড়ায় কয়েকটা কুকুর।

শুধু এক কোণে খোলা থাকে একটা মুদিখানা, আর একটা চায়ের দোকান। গ্রামের বড় বড় ছেলেরা বিকেলের দিকে সেই চায়ের দোকানে বসে আড্ডা মারে।

বদরুর নৌকোটা এসে লাগল ঘাটে।

সন্তু ও নিখিল মাহাতো উঠে এলেন ওপরে।

একটু একটু সন্ধে হয়ে এসেছে। চায়ের দোকানে রয়েছে ছ-সাতজন ছেলে। তারা ক্রিকেট খেলা নিয়ে কথা বলছে। সচিন তেন্ডুলকর আর সৌরভ গাঙ্গুলির মধ্যে কে বেশি ভাল ক্যাপ্টেন তা নিয়ে তর্ক বেঁধে গেছে প্রায়।

সেই তর্কের মাঝখানেই নিখিল মাহাতো একজনকে জিজ্ঞেস করলেন, ভাই, বিশাই সামন্তর বাড়িটা কোথায় বলতে পারো?

সেই লোকটি কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে বলল, বিশাই সামন্ত? সে কে? চিনি না তো?

সে পাশের লোকটিকে জিজ্ঞেস করল, কী রে, তুই চিনিস?

সে লোকটি পিক করে থুতু ফেলে বলল, বাপের জন্মে নাম শুনিনি।

আর-একজন নিজের থেকেই বলল, এ-গ্রামে কোনও সামন্ত থাকে না।

নিখিল মাহাতো বললেন, এ-গ্রামে তার বাড়ি না হতে পারে, কিন্তু সে এখানে প্রায়ই আসে শুনেছি।

প্রথম লোকটি বলল, যারা আসে, সবাইকে আমরা চিনি। ও নামে কাউকে দেখিনি কখনও।

নিখিল মাহাতো সন্তুর দিকে তাকালেন।

সন্তুর মনে হল, এই লোকগুলো সবাই বিশাই সামন্তকে চেনে। কোনও কারণে তাকে ভয় পায় বলেই কিছু বলছে না।

সন্তু বলল, আসুন, আমরা এখানে একটু চা খেয়ে নিই!

চায়ের দোকানদারটি বার বার তাকাচ্ছে এঁদের মুখের দিকে।

সে বলল, আপনারা কে? কোথা থেকে আসছেন?

নিখিল মাহাতো গম্ভীরভাবে বললেন, তোমার দোকানে চা খেতে গেলে পরিচয় দিতে হয় নাকি?

সে থতমত খেয়ে বলল, আজ্ঞে তা নয়। এমনিই জিজ্ঞেস করছিলাম।

নিখিল মাহাতো বললেন, তুমি বিশাই সামন্তকে চেনো?

লোকটি বলল, আজ্ঞে না। নাম শুনিনি।

এখানে কাপের বদলে গেলাসে চা দেয়। সন্তু আর নিখিল মাহাতো গেলাসদুটি নিয়ে বসলেন একটু দূরে।

সন্তু বলল, বিশাই সামন্তকে এরা অনেকেই চেনে, তা বোঝাই যাচ্ছে।

নিখিল মাহাতো বললেন, আমারও তাই মনে হচ্ছে।

সন্তু বলল, আপনি কে, তা এরা জানে না।

নিখিল মাহাতো বললেন, থানার দারোগাদেরই লোকে চেনে। আমি তো দারোগা নই। এখানে বাংলাদেশ থেকে অনেক জিনিস চোরাচালান হয়ে আসে। এই ছেলেগুলোর মধ্যে দু-একজন তাতে জড়িত থাকতে পারে। এরা যদি বিশাই সামন্ত সম্পর্কে কিছু বলতে না চায়, তা হলে একটাকে থানায় ধরে নিয়ে গিয়ে ভয় দেখাতে হবে।

সন্তু বলল, একটু ভিড় কমলে এই চা-ওয়ালাকে ভাল করে জিজ্ঞেস করা দরকার।

নিখিল মাহাতো বললেন, চা-টা মন্দ করেনি। আরও এক গেলাস করে খেলে হয়।

একটু পরেই একটা মোটরসাইকেলের শব্দ শোনা গেল।

কাছে আসার পর দেখা গেল, চালাচ্ছে একজন। পেছনে বসে আছে আরএকজন। দুজনেই প্যান্ট আর শার্ট পরা।

চালকটি চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করল, এখানে কে বিশাই সামন্তর খোঁজ করছে?

নিখিল মাহাতো একবার কোমরে হাত দিলেন। বোঝা গেল, ওখানে রয়েছে তাঁর রিভলভার।

মোটরসাইকেলের পেছনের লোকটি এদিকে এসে জিজ্ঞেস করল, আপনারা বিশাই সামন্তকে খুঁজছেন?

নিখিল মাহাতো উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, হ্যাঁ।

লোকটি বলল, কেন খুঁজছেন?

নিখিল মাহাতো বললেন, সেটা তাকেই বলব।

লোকটি বলল, সে তো অসুস্থ। তার জ্বর হয়েছে। এ-গ্রামে তার মামাবাড়ি, সেখানেই শুয়ে আছে।

নিখিল মাহাতো বললেন, তার সঙ্গে একবার দেখা করা যায় না? খুব জরুরি দরকার।

লোকটি বলল, তা যেতে পারে। আসুন আমার সঙ্গে।

এই লোকটি পথ দেখিয়ে নিয়ে চলল, মোটরসাইকেল চলে গেল অন্যদিকে। নদীর ধার দিয়ে কাঁচা রাস্তা। সন্ধে হয়ে গেছে। আকাশে একটু একটু জ্যোৎস্না ছাড়া আর কোনও আলো নেই। লোকটি মাঝে মাঝে টর্চ জ্বালছে।

হাঁটতে হল বেশ কিছুক্ষণ। ক্রমশ গ্রামের বাড়ি-ঘর শেষ হয়ে গেল। একদিকে নদী, আর একদিকে শুধু মাঠ। মাঝে মাঝে রাস্তার পাশে ঝোপজঙ্গল।

এক জায়গায় এসে লোকটি থমকে দাঁড়াল। দাঁড়িয়েই রইল।

নিখিল মাহাতো জিজ্ঞেস করলেন, কী হল?

লোকটি বলল, সামনে দিয়ে একটা সাপ যাচ্ছে। ওটা চলে যাক।

নিখিল মাহাতো বললেন, কোথায় সাপ? দেখতে পাচ্ছি না তো!

লোকটি বলল আমরা ঠিক দেখতে পাই। ভারী বিষধর সাপ। শঙ্খচুড়!

নিখিল মাহাতো চমকে উঠে বললেন, কী বললে? তুমি আমাদের কোথায় নিয়ে যাচ্ছ বলো তো? এদিকে তো কোনও বাড়ি নেই।

লোকটি বলল, তোমাদের নিয়ে যাচ্ছি যমের বাড়ি!

নিখিল মাহাতো কোমর থেকে রিভলভারটা বার করতে করতে বললেন, আমি কে জান না? সবকটাকে—

তিনি আর কিছু বলতে পারলেন না। শুধু আঃ বলে পড়ে গেলেন মাটিতে।

পেছন থেকে একজন লোক তাঁর মাথায় একটা ডাণ্ডা মেরেছে। ঝোপ থেকে বেরিয়ে এল আরও তিনজন লোক।

তাদের একজন বলল, এঃ পুলিশ বলে যেন মাথা কিনে নিতে চায়। ওরকম কত পুলিশ দেখেছি!

আর-একজন বলল, এই তো সেই শয়তানের বাচ্চাটা। বাঁধ এটাকে।

প্রথম যে লোকটি সন্তুকে ধরতে এল, তাকে এক ধাক্কায় উলটে ফেলে দিয়ে দৌড় লাগাল সন্তু।

কিন্তু বেশিদূর যেতে পারল না। দপ করে জ্বলে উঠল একটা মশাল। সামনের দিকে সেই মশাল হাতে দাঁড়িয়ে আছে একজন লোক।

সন্তু অন্যদিকে ফিরল।

কিন্তু ওরা চারদিক থেকে তাকে ঘিরে ফেলেছে। ফাঁদে পড়া ইঁদুরের মতন এদিক-ওদিকে ছোটাছুটি করেও কোনও লাভ নেই।

একজন লোক কাছে এসে পড়ে জ্বলন্ত মশাল দিয়ে তাকে মারতে যেতেই সে শুয়ে পড়ল মাটিতে। আগুনের সঙ্গে সে লড়াই করতে পারবে না।

একজন তার পিঠের ওপর পা রেখে বলল, এবার বাঁধ এটাকে।

আর-একজন নিচু হয়ে সন্তুর হাত বাঁধতে বাঁধতে বলল, এটার ওপর আমাদের বাবুর খুব রাগ। এটার জন্য ভাল টাকা পাওয়া যাবে।

শুধু হাত নয়, সন্তুর সারা শরীরে দড়ি বাঁধা হল পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে। তারপর তাকে দাঁড় করিয়ে টেনে নিয়ে যেতে লাগল। মাঝে মাঝে সে আছাড় খেয়ে পড়ছে, ওরাই তার চুলের মুঠি ধরে দাঁড় করাচ্ছে।

নদীর ধারে একটা গাছতলায় হ্যাজাক বাতি জ্বলছে। সেখানে দাঁড়িয়ে আছে দুজন লোক। একজনের হাতে রাইফেল। তার পায়ের কাছে ফেলে দেওয়া হল সন্তুকে।

রাইফেলধারী লোকটি বেশ লম্বা-চওড়া। গম্ভীর গলায় সে বলল, ধরেছিস বিচ্ছুটাকে? বাঃ!

গলার আওয়াজ শুনে দারুণ চমকে উঠল সন্তু। এ তো গগন সাহা।

সে তার সঙ্গীদের জিজ্ঞেস করল, সেই পুলিশটার কী হল?

একজন বলল, সে পড়ে আছে রাস্তায়।

গগন বলল, ওখানেই থাক। ওকে জানে মারিস না। তার দরকার নেই। ও আর কিছু করতে পারবে না। গাধা আর কাকে বলে, একখানা মোটে অস্তর নিয়ে এসেছে ছেলেকে উদ্ধার করতে!

সন্তু এখনও যেন বিশ্বাস করতে পারছে না। এই গগন সাহার ছেলে তাদের সঙ্গে থিয়েটারের রিহার্সাল দিচ্ছিল। এই লোকটা সেই থিয়েটার নষ্ট করে অন্যের ছেলেকে চুরি করেছে!

গগন সন্তুকে জুতো দিয়ে একটা ঠোক্কর মেরে বলল, কী রে শয়তানের বাচ্চা, নকল টাকা দিয়ে আমাদের ঠকাবি ভেবেছিলি? আমরা ঘাসে মুখ দিয়ে চলি? ওই ছেলেকে ফেরত পেতে হলে এখন পাঁচের বদলে দশ লাখ দিতে হবে!

একজনকে এক তাড়া নোট দিয়ে সে বলল, কাশেম, এটা তোরা ভাগ করে নে। এ-ছেলেটাকে তুলে দে আমার ভটভটিতে।

সন্তুকে দাঁড় করাবার পর গগন চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, কী রে, সেদিন তো খুব নদীতে সাঁতারের কেরানি দেখিয়েছিলি। আজ তোকে এইরকমভাবে বেঁধে জলে ফেলে দিলে বাঁচতে পারবি? চল, দেখি!

একজন বলল, একেবারে তলিয়ে যাবে, হাঙরে-কুমিরে খেয়ে নেবে।

আর-একজন বলল, কিংবা জোয়ারের টান এলে টেনে নিয়ে যাবে একেবারে সুমুদুরে।

সন্তকে ধরাধরি করে শুইয়ে দেওয়া হল ভটভটিতে। গগন হাল ধরে বসল। তার সঙ্গী জিজ্ঞেস করল, আমি যাব না? গগন বলল, না, আমি একাই পারব। তোরা কদিন গা-ঢাকা দিয়ে থাক। হ্যাজাকটা আমার সঙ্গে দে।

ভটভটিটা চালু হওয়ার পর একজন চেঁচিয়ে বলল, একেবারে মাঝগাঙে ফেলে দেবেন সার। কম পানিতে ফেললে কিনারায় এসে ঠেকে যেতে পারে।

ভটভটিটা চলল মাঝনদীর দিকে।

এই অবস্থাতেও সন্তু ভাবল, কাকাবাবু কোথায়? তিনি কোনও খবরও দিলেন না। তা হলে তিনিও কি বন্দি? কাকাবাবুকে কেউ বন্দি করে বেশিদিন রাখতে পারে?

হাত-বাঁধা অবস্থায় সাঁতার কাটা সম্ভব নয়। আজই তার জীবনের শেষ? মাবাবা, কাকাবাবুর সঙ্গে, জোজোর সঙ্গে, দেবলীনার সঙ্গেও আর দেখা হবে না।

অনেকখানি দূরে এসে মাঝনদীতে ভটভটিটা থেমে গেল।

তারপর আবার একটা চমক লাগল সন্তুর। গগন সাহা হঠাৎ ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। তারপর বেশ জোরে, ওঃ আঃ শব্দ করে। যেন তার বুকের মধ্যে খুব কষ্ট হচ্ছে।

সেইরকম কাঁদতে কাঁদতেই সে বলল, আমি আর বাঁচতে চাই না সন্তু। আমি মহাপাপী। আজ এইখানে আমি মরব।

সন্তু কিছু না বুঝতে পেরে বলল, কী হয়েছে?

গগন বলল, দাঁড়াও, আগে তোমার বাঁধন খুলে দিই।

পকেট থেকে একটা ছোট ছুরি বার করে কচকচ করে কেটে ফেলল সব দড়ি।

তারপর বলল, সন্তু, তুমি ভটভটি চালাতে পারবে? শক্ত কিছু নয়। এখানে এসে মোটর চালু করে হাল ধরে থাকবে। একটু এদিক-ওদিক হবে, কিন্তু ওলটাবে না। আমি তোমার কাছ থেকে শেষ বিদায় নিচ্ছি।

সন্তু আবার জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে আপনার?

গগন বলল, আমি মহাপাপী। তোমাদের রিহার্সাল শুরুর অনেক আগেই ওই পুলিশের ছেলেকে চুরি করার প্ল্যান করা হয়েছিল। আমার ছেলেও যে তোমাদের সঙ্গে থিয়েটার করতে যাবে, তা আমি ঘুণাক্ষরেও জানতাম না। তবে বিশ্বাস করো, মানুষ চুরি করে টাকা রোজগার করা আমার পেশা নয়। আগে কখনও একাজ করিনি। ওই শঙ্খচূড় মহা শয়তান। সে আমাকে ভয় দেখিয়ে জোর করে এর মধ্যে জড়িয়েছে। আমার বউ বা ছেলে কিছুই জানে না।

রাইফেলটা তুলে নিয়ে গলার কাছে ঠেকিয়ে সে বলল, ওই যে দূরে দেখছ একটা মিটিমিটি আলো, ওটা একটা দ্বীপ। ওখানে আমার একটা খামারবাড়ি আছে। সুকোমল ওইখানে আছে। আরও তিনজন মানুষকে ওখানে আটকে রাখা হয়েছে। তুমি একা যেয়ো না, অনেক পুলিশ সঙ্গে নিয়ে যেয়ো। আমি চললাম।

সন্তু বলল, দাঁড়ান, দাঁড়ান, এটা কী করছেন?

গগন বলল, শঙ্খচূড় আমাকে দিয়ে এই জঘন্য কাজ করিয়েছে। আমার বউছেলে যদি কখনও টের পায়, তাদের কাছে আমি মুখ দেখাব কী করে? তাই আমি মরতে চাই। আর দেরি করে লাভ নেই।

সন্তু বলল, দাঁড়ান, আর-একটা কথা। শঙ্খচূড় জোর করে ভয় দেখিয়ে আপনাকে দিয়ে অন্যায় কাজ করিয়েছে। সেজন্য শঙ্খচুড়কে তো শাস্তি দিতে হবে। আপনি সেই শাস্তি দিতে সাহায্য করুন, তা হলেই আপনার দোষ কেটে যাবে।

গগন বলল, শঙ্খচূড়ের যে কী সাঙ্ঘাতিক শক্তি, তা তুমি ধারণাও করতে পারবে না। এই ছেলে চুরি, মানুষ চুরি এগুলো তার আসল কাজ নয়। অন্য লোকদের দিয়ে এই কাজ করিয়ে অনেক টাকা তুলছে। সেই টাকায় আবার অনেক লোক জোগাড় করেছে। একটা কোনও বিদেশি শক্তি আছে ওর পেছনে। সারা দেশে সাঙ্ঘাতিক সব কাণ্ড ঘটবে শিগগিরই। কত মানুষ যে মরবে, কত কিছু যে ধ্বংস হবে, তার ঠিক নেই। তোমার কাকাবাবুকেও বোধ হয় এতক্ষণে মেরে ফেলেছে।

সন্তু বলল, অনেকেই চেষ্টা করেছে। কাকাবাবুকে এ পর্যন্ত কেউ মারতে পারেনি।

গগন বলল, আমি আর এই পাপের ভাগী হতে চাই না। বিদায় সন্তু!

গগন ট্রিগার টেপার আগেই সন্তু স্প্রিং-এর মতন লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল তার ওপর। দুজনে ধস্তাধস্তি করতে করতে রাইফেলটা পড়ে গেল জলে।

গগন তবু হাত বাড়িয়ে সেটা ধরতে যেতেই সন্তু আবার একটা ধাক্কা দিল তাকে। রাইফেলটা জলে তলিয়ে গেল।

গগন নিরাশভাবে বলল, এ কী, ফেলে দিলে?

সন্তু মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল, এবার কী করে আত্মহত্যা করবেন? সাঁতার জানেন নিশ্চয়ই। নদীতে ঝাঁপ দিলেও ড়ুববেন না।

গগন বলল, আমি আর সত্যিই বাঁচতে চাই না সন্তু! এত অপরাধ করেছি—

সন্তু বলল, চলুন, আগে সুকোমলকে উদ্ধার করি। একটা একটা করে ভাল কাজ শুরু করলেই খারাপ কাজগুলোর দোষ একটা একটা করে কেটে যাবে।
কাকাবাবু বসে আছেন একটা জেলখানার মধ্যে। সেখানে টেবিল ও চেয়ার রয়েছে অবশ্য। টেবিলের ওপর অনেক কাগজ ছড়ানো। তিনি একমনে লিখে যাচ্ছেন কীসব।

লোহার দরজা খোলার শব্দ হতে তিনি ফিরে তাকালেন।

মৃগাঙ্কমৌলী আর আলম এসেছেন দেখা করতে।

নমস্কার জানিয়ে মৃগাঙ্কমৌলী জিজ্ঞেস করলেন, কোনও অসুবিধে হচ্ছে না তো রাজাদা?

কাকাবাবু চেয়ারে হেলান দিয়ে বললেন, না, অসুবিধে কিছু নেই। প্রথমে আমি রাজি হইনি। এখন দেখছি জেলের মধ্যে আমাকে রেখে ভালই করেছ।

আলম বললেন, এখন আপনার নিজের বাড়িতে থাকা কোনওক্রমেই সেফ নয়। আপনি একবার বেঁচে গেছেন, ওরা আপনাকে মেরে ফেলার আবার চেষ্টা করবেই। আপনার বাড়ির লোকেরও বিপদ হতে পারত।

কাকাবাবু বললেন, তা ঠিক। এখানে বেশ নিরিবিলিতে কাজ করা যাচ্ছে। খাবারদাবারও ভাল দিচ্ছে। জেলখানায় বুঝি এত ভাল খাবার দেয়?

মৃগাঙ্কমৌলী হেসে বললেন, না, এ-খাবার শুধু আপনার জন্য।

আলম বললেন, আপনাকে তো আর ক্রিমিনাল হিসেবে আটকে রাখা হয়নি। আপনি আমাদের অতিথি। ওই সাংকেতিক লিপি কিছু উদ্ধার করতে পারলেন? দিল্লির এক্সপার্টরা তো এখনও কিছু বুঝতে পারছে না।

কাকাবাবু বললেন, একটা সূত্র পেয়েছি। এরপর আর বেশি সময় লাগবে।

মৃগাঙ্কমৌলী বললেন, রাজাদা, আপনার পিঠে যে জিনিসটা বাঁধা ছিল তা ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা করে দেখা হয়েছে। সাঙ্ঘাতিক একটা বিস্ফোরক আর ডি এক্স নয়, ওই ধরনেরই এক্সপ্লোসিভ। একসঙ্গে দশ-বারোজন লোককে মেরে ফেলতে পারে।

আলম বললেন, বাপরে বাপ, আপনি রাইটার্স বিল্ডিংসে যখন আমাদের সামনে বসে ছিলেন, তখন আপনার পিঠে ওটা বাঁধা ছিল। আমাদের কিছু বলেননি।

কাকাবাবু বললেন, বলার উপায় ছিল না। ওটা খুলতে গেলে রিমোট কন্ট্রোলে ফাটিয়ে দিতে পারত। তাতে তোমরাও বাঁচতে না। মাত্র আধঘণ্টা সময় দিয়েছিল আমাকে।

মৃগাঙ্কমৌলী বললেন, অতদূর থেকে কি রিমোট কন্ট্রোল কাজ করে?

কাকাবাবু বললেন, তা জানি না। ওরা তো সেইরকমই ভয় দেখিয়েছিল। ঝুঁকি নেওয়া যায় না। যদি সত্যি হয়? আজকাল বিজ্ঞান তো অনেক অসম্ভবকে সম্ভব করে দিচ্ছে।

আলম বললেন, তা হলে জলে ঝাঁপ দিলেন কী করে? সেখানেও তো বিস্ফোরণ হতে পারত।

কাকাবাবু বললেন, তা হলেও শুধু আমি মরতাম, আর কারও ক্ষতি হত না। ওরা আমাকে মৃত্যুভয় দেখিয়েছিল। কিন্তু নিজে বাঁচবার জন্য আমি কি এরকম একটা সাঙ্ঘাতিক জিনিস ওদের হাতে তুলে দিতে পারি? তা ছাড়া, আমার সন্দেহ হয়েছিল, ওই জিনিসটা জলের মধ্যে কাজ করে না। শঙ্খচূড় নামের লোকটা জলকে ভয় পায়। সত্যিই তো, জলের মধ্যে ওটা ফাটল না। জলের মধ্যে গা ড়ুবিয়ে রেখে ওটা খুলে ফেললাম।

মৃগাঙ্কমৌলী বললেন, রাজাদা, আপনি অসাধ্যসাধন করেছেন বলা যায়। আপনি একবারও ভয় পাননি?

কাকাবাবু বললেন, ভয়? হ্যাঁ, মানে, মনে হয়েছিল, এবার বুঝি আর বাঁচা যাবে না। আমি মৃত্যুর জন্য তৈরি হয়েছিলাম। মানব-বোমা তো সত্যি অনেক দেশে দেখা যাচ্ছে।

আলম বললেন, দিল্লি থেকে রিপোর্ট এসেছে, কোনও একটি বিদেশি শক্তি আমাদের সারা দেশে দারুণ সব ধ্বংসের কাজ চালাবে। একসঙ্গে একই দিনে কোনও এয়ারপোর্ট উড়িয়ে দেবে, ব্রিজ উড়িয়ে দেবে, বহু মানুষ মরবে। আগে থেকে জানতে না পারলে আমরা তো আটকাতেও পারব না।

কাকাবাবু বললেন, এই সাঙ্ঘাতিক লেখাগুলোয় সেইরকমই একটা পরিকল্পনার ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে।

মৃগাঙ্কমৌলী বললেন, আপনি কতটা পড়তে পেরেছেন?

কাকাবাবু বললেন, আমি অনেকরকম পরীক্ষা করে অতি কষ্টে একটা নিয়ম ধরে ফেলেছি। তোমাদের বুঝিয়ে দিচ্ছি। যেমন ধরো, একটা লেখা ফুটে উঠেছে। ZHQONQS,এর কোনও মানেই হয় না। এখানে এর ইংরেজি পরের অক্ষর দিয়ে বদলে দিতে হবে। Z-এর পর কী? আবার A, তাই না? H এর পর I, Q-এর পর R, এইভাবে এটা হয়ে গেল AIRPORT.তারপর রয়েছে AZFCNFQZ, এটা হয়ে যাবে BAGDOGRA, তারিখগুলোও লেখা আছে সংখ্যা দিয়ে নয়। অক্ষরে। বাগডোগরা এয়ারপোর্টটা উড়িয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করা আছে ২৪ তারিখ, তার মানে আর চারদিন পরে। পাঁচজন লোকের নামও দেওয়া আছে।

আলম বললেন, এরকম তো অনেক লেখা আছে দেখছি।

কাকাবাবু বললেন, সবগুলির জন্য একই নিয়ম খাটবে না। বার করতে সময় লাগবে। মৃগাঙ্ক, তোমরা এক কাজ করো। আজই প্রেস কনফারেন্স করে ঘোষণা করে দাও যে, আমরা সবই সাংকেতিক অক্ষর পড়ে ফেলেছি। জায়গার নাম, লোকগুলোর নাম জেনে গেছি। তাতে ওরা পরিকল্পনা বাতিল করবে নিশ্চয়ই।

আলম বললেন, তা ছাড়া এক্ষুনি তো বাগডোগরা এয়ারপোর্ট ঘিরে ফেলার ব্যবস্থা করতে হয়।

কাকাবাবু বললেন, ওই পাঁচটা লোক খুব সম্ভবত শিলিগুঁড়িতে লুকিয়ে আছে, তাদের ধরে ফেলার ব্যবস্থা করো।

মৃগাঙ্কমৌলী বললেন, এয়ারপোর্ট উড়িয়ে দিতে চায়? এদের এত ক্ষমতা। রাজাদা, ওই শঙ্খচূড় নামের লোকটা যদি মানব-বোমা পাঠায়? তাদের তো আটকানো যায় না?

কাকাবাবু বললেন, ঠিকই বলেছ, ওই শঙ্খচূড়ের ডেরাটা খুঁজে বার করতেই হবে।

আলম বললেন, আপনাকে কোথায় আটকে রেখেছিল, সেই জায়গাটা চিনতে পেরেছেন?

কাকাবাবু বললেন, না। আমাকে অজ্ঞান করে নিয়ে গিয়েছিল। বেরিয়ে আসার সময় চোখ বাঁধা ছিল। তবে গাড়ি করে রাইটার্স বিল্ডিংসের সামনে নিয়ে এসেছে, তাতে মোটামুটি সময় লেগেছে চার ঘণ্টা। আস্তে আস্তে গাড়ি চালিয়েছে, যাতে আমার ঝাঁকুনি না লাগে। তা হলে ধরে নেওয়া যেতে পারে, কলকাতা থেকে সেই জায়গাটার গাড়িতে দূরত্ব অন্তত সাড়ে তিন ঘণ্টা।

মৃগাঙ্কমৌলী বললেন, কিন্তু কোন দিকে, তা বোঝা যাবে কী করে? মুর্শিদাবাদ-বহরমপুরের দিকে হতে পারে, দুর্গাপুরের দিকে কিংবা আসানসোল যেতেও ঘণ্টাচারেক লাগে। কোন দিকে খোঁজ করব?

কাকাবাবু বললেন, সবদিকেই। তবে আমার একটা সন্দেহ হচ্ছে, বর্ধমান-দুর্গাপুরের মাঝামাঝি কোথাও হতে পারে।

মৃগাঙ্কমৌলী বললেন, কী করে আপনার এই সন্দেহ হল? আপনার চোখ বাঁধা ছিল বললেন—

কাকাবাবু বললেন, কী করে সন্দেহ হল, তা শুনলে হয়তো তোমরা হাসবে। অনেক ছোটখাটো জিনিস থেকেই বড় ব্যাপার জানা যায়। আমাকে যখন নিয়ে আসে, তখন সঙ্গের লোকেরা মাঝপথে গাড়ি থামিয়ে এক জায়গা থেকে মিষ্টি কিনেছিল—

আলম ব্যগ্রভাবে জিজ্ঞেস করল, ওরা জায়গাটার নাম বলেছিল?

কাকাবাবু বললেন, না, জায়গাটার নাম বলেনি। সেই মিষ্টি আমাকে একটা খেতে দিয়েছিল। সেটার স্বাদ আমার চেনা চেনা মনে হল। সেটা ল্যাংচা। কোথাকার ল্যাংচা বিখ্যাত?

মৃগাঙ্কমৌলী বললেন, শক্তিগড়ের।

কাকাবাবু বললেন, বর্ধমানের দিকে যারা গাড়িতে যাতায়াত করে, তারা অনেকেই শক্তিগড়ে গাড়ি থামিয়ে ল্যাংচা কেনে, তাই না?

আলম বললেন, আপনি চোখ-বাঁধা অবস্থায় একটা মিষ্টি খেয়েই বুঝে গেলেন, সেটা শক্তিগড়ের ল্যাংচা?

কাকাবাবু বললেন, আমি অনেকরকম বিখ্যাত মিষ্টি খেয়েই মোটামুটি বলে দিতে পারি কোথাকার তৈরি। হয়তো দু-একটা ভুলও হতে পারে। যাই হোক, বর্ধমানের দিকেই প্রথম খোঁজাখুঁজি শুরু করতে হবে। শোনো, এখন খুব জরুরি হচ্ছে দুটো ব্যাপার। সমস্ত খবরের কাগজ আর টিভি চ্যানেলগুলোকে জানিয়ে দাও যে, আমরা ইলেকট্রনিক নোট বুকটা থেকে সমস্ত গুপ্ত সাংকেতিক লিপি উদ্ধার করে ফেলেছি, বিদেশি চক্রান্ত ফাঁস হয়ে গেছে। তাতে ওরা থমকে যাবে। আর শঙ্খচূড় যাতে নতুন কিছু শুরু করতে না পারে, তার ডেরাটা খুঁজে বার করতেই হবে।

মৃগাঙ্কমৌলী বললেন, আমি প্রেসে আর টিভি চ্যানেলগুলোয় এক্ষুনি খবর পাঠাবার ব্যবস্থা করছি।

কাকাবাবু বললেন, যে-গাড়িটা আমাকে নিয়ে এসেছিল, সেটাকে আটকানো যায়নি শেষ পর্যন্ত?

আলম বললেন, না, গেল না। দুটো লোক গুলি চালাতে লাগল, গাড়িটা দারুণ স্পিডে, একটা লোককে চাপা দিয়ে পালিয়েছে। তবে ওদের সঙ্গে বোধ হয় একটা কুকুর ছিল, সেটাকে গাড়িতে তোলার সময় পায়নি। সেটা সাঙ্ঘাতিক হিংস্র কুকুর, পাগলের মতন ছোটাছুটি করছিল ডালহৌসি স্কোয়ারে, লোকজন ভয়ে পালাচ্ছিল, শেষ পর্যন্ত দুজন ডগ ক্যাচারকে দিয়ে কুকুরটাকে ধরা হয়েছে।

কাকাবাবু দারুণ উত্তেজিতভাবে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, কুকুর? খুব বড় সাইজের কুকুর? আলম বললেন, হ্যাঁ, ডোবারম্যান, দারুণ হিংস্র। ডাক শুনলে বুকের রক্ত হিম হয়ে যায়।

কাকাবাবু বললেন, টবি, টবি! শঙ্কচুড়ের পোষা কুকুর। ওই কুকুরটাই তো ওর প্রভূর ডেরায় আমাদের পৌঁছে দিতে পারবে।

আলম বললেন, কুকুর, কি একশো-দুশো মাইল দূরের বাড়িও খুঁজে বার করতে পারে? সেটা বোধ হয় অসম্ভব!

কাকাবাবু বললেন, আপাতত শক্তিগড় পর্যন্ত তো গাড়িতে যাওয়া যাক!

আধঘণ্টার মধ্যে সব ব্যবস্থা হয়ে গেল।

মৃগাঙ্কমৌলী রয়ে গেলেন প্রেস কনফারেন্স ডাকার ব্যবস্থা করার জন্য। টবি

কুকুরকে নিয়ে কাকাবাবু আর আলম চাপলেন একটা স্টেশন ওয়াগনে। পেছন পেছন আর-একগাড়ি পুলিশ।

টবি আর সবাইকেই কামড়াতে যায়, কিন্তু কাকাবাবু তাকে একটু আদর করে দিলেই সে চুপ করে।

কাকাবাবু বললেন, ও একমাত্র আমাকেই চেনে এখন। এমনিতেই কোনও কুকুর আমাকে কামড়ায় না, ওরা বোঝে আমি কুকুর ভালবাসি।

আলম বললেন, আমিও কুকুর পছন্দ করি, কিন্তু ছোট কুকুর। এত বড় কুকুর দেখলে আমার ভয় লাগে।

কাকাবাবু বললেন, মজার ব্যাপার এই, কুকুরটাকে পাঠানো হয়েছিল আমাকে পাহারা দেওয়ার জন্য, এখন সে-ই আমাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবে।

শক্তিগড় পৌঁছোতে পৌঁছোতে বিকেল হয়ে গেল। টবিকে নিয়ে কাকাবাবু গাড়ি থেকে নামলেন। টবি অমনই খুব জোরে ডাকতে ডাকতে চেন ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করতে লাগল।

কাকাবাবু আলমকে বললেন, তা হলে শক্তিগড় পর্যন্ত ঠিকই এসেছি।

তিনি টবির চেন ছেড়ে দিলেন। টবি ছুটতে লাগল সামনের দিকে।

কাকাবাবু চট করে গাড়িতে উঠে পড়ে বললেন, ওকে ফলো করো, দেখা যাক, ও কোথায় যায়!

টবি সোজা ছুটল জি টি রোড ধরে।

কাকাবাবু বললেন, দ্যাখো আলম, টবি থামছে না, ডাইনে-বাঁয়ে বেঁকছে না, তার মানে ও এদিককার রাস্তাঘাট চেনে।

আলম বললেন, অদ্ভুত ওদের ঘ্রাণশক্তি।

কাকাবাবু বললেন, কিছু কিছু ব্যাপার মানুষও পারে না। কুকুর পারে। মানুষ বিশ্বাসঘাতক হয়, কুকুর হয় না। টবি ওর প্রভুকে খুঁজে বার করবেই।

বর্ধমানের কাছে এসে টবি শহরের দিকে গেল না। ছুটল বাইপাস ধরে।

আলম জিজ্ঞেস করলেন, একটা কুকুর কতক্ষণ ছুটতে পারে?

কাকাবাবু বললেন, ঘণ্টা দু-এক তো পারবেই।

একসময় টবি বড় রাস্তা ছেড়ে ঢুকে পড়ল একটা ছোট রাস্তায়। দুটো গাড়ি যাচ্ছে তার পেছনে পেছনে কিছুটা দূরত্ব রেখে।

একদিকের আকাশ লাল হয়ে গেছে, একটু পরেই সূর্যাস্ত হবে।

হঠাৎ খানিক দূরে দুম দুম শব্দ হতে লাগল। সেইসঙ্গে বহু লোকের চিৎকার। সামনে খানিকটা জঙ্গলের মতন। তার পেছনে লাল আভা।

আর একটু এগোতেই দেখা গেল আগুনের শিখা।

অনেকখানি জায়গা জুড়ে একটা বাড়ি, তার সবটা জুড়ে জ্বলছে আগুন দাউ দাউ করে।

দেখলেই বোঝা যায়, হঠাৎ আগুন লাগেনি। খুব সম্ভবত ইচ্ছে করে আগুন লাগানো হয়েছে, কেউ নেভাবারও চেষ্টা করছে না।

কাকাবাবু বললেন, এটাই শঙ্খচূড়ের আস্তানা। সব পুড়িয়ে প্রমাণ নষ্ট করে দিচ্ছে!

আলম হতাশভাবে বললেন, যাঃ!

আগুন দেখে টবি থমকে দাঁড়িয়ে গেছে আর ডাকছে তারস্বরে।

আলম বললেন, আর কি শঙ্খচূড়কে ধরা যাবে?

কাকাবাবু বললেন, সে নানারকম ছদ্মবেশ ধরতে পারে।

আগুন দেখতে কাছাকাছি গ্রাম থেকে লোক ছুটে আসছে এদিকে। তার মধ্যে একটা মোটরবাইকের শব্দ শুনে কাকাবাবু ফিরে তাকালেন।

সেই বাইক চালাচ্ছে গগন সাহা। তার পেছনে সন্তু।

সন্তুই আগে বাইক থেকে প্রায় লাফিয়ে নেমে ছুটে এল কাকাবাবুর দিকে।

কাকাবাবু রীতিমতো অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, তোরা এ সময়ে কী করে এখানে এলি?

সন্তু বলল, তোমাকে খুঁজতে।

কাকাবাবু বললেন, এই জায়গাটা চিনলি কী করে?

সন্তু বলল, এটাই তো শঙ্খচূড়ের ডেরা। গগনদা চিনিয়ে এনেছেন।

কাকাবাবু, সুকোমলকে আমরা উদ্ধার করেছি। আরও তিনজনকে। গগনদা সাহায্য করেছেন।

গগন কাছে এসে কাঁচুমাচু মুখ করে বলল, কাকাবাবু, আপনার কাছে আমার অপরাধের শেষ নেই।

কাকাবাবু বললেন, সেসব কথা পরে শুনব। এদিকে যে পাখি উড়ে গেল মনে হচ্ছে। কোনও চিহ্নও রাখল না।

হাওয়ায় সেই প্রচণ্ড আগুনের আঁচ খানিকটা দূর থেকেও টের পাওয়া যাচ্ছে।

আলম বললেন, এদিক দিয়ে আমরা কোনও গাড়ি যেতে দেখিনি। পেছন দিকের রাস্তা দিয়ে যদি সে পালায়, তা হলে আমাদের এক্ষুনি ধাওয়া করা উচিত।

আলমের গাড়ির ড্রাইভার বলল, সার, আমি এদিকটা চিনি। এর পরে আর পাকা রাস্তা নেই। গ্রামের কাঁচা রাস্তা।

কাকাবাবু বললেন, সে রাস্তা দিয়েও সে পালাবার চেষ্টা করতে পারে। কিংবা ছদ্মবেশে গ্রামের লোকদের মধ্যে মিশে থাকতেও পারে। সে ভাল বাংলা জানে। কিংবা লোকটা হয়তো আসলে বাঙালি, আমার সঙ্গে ইচ্ছে করে বেঁকিয়ে বেঁকিয়ে বাংলা বলছিল। পেছনের রাস্তাটায় যাওয়ার আগে টবিকে নিয়ে আর-একটা পরীক্ষা করা যাক।

টবি জ্বলন্ত বাড়িটার দিকে এগোচ্ছে না, এক জায়গায় দাঁড়িয়ে চিৎকার করে যাচ্ছে।

কাকাবাবু একটা ক্রাচ ফেলে দিয়ে শুধু একটা ক্রাচ নিয়ে খোঁড়াতে খোঁড়াতে গিয়ে টবির গলার চেনটা ধরলেন। তারপর তাকে টেনে নিয়ে চললেন সামনের দিকে।

আগুন দেখতে গ্রামের লোক একদিকে ভিড় করে আছে। জ্বলন্ত বাড়িটার একপাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে আট-দশজন নারী-পুরুষ। তাদের পোশাকও সাধারণ, তবু ভাবভঙ্গি দেখে মনে হয়, তারা ঠিক এখানকার গ্রামের লোক নয়।

কাকাবাবু সেই দলটার দিকেই এগোতে এগোতে আলমদের বললেন, তোমরা আমার পেছনে পেছনে এসো!

অনেকটা কাছে গিয়ে কাকাবাবু টবির মাথায় চাপড় মেরে বললেন, গো টবি, গো টু ইয়োর মাস্টার!

তার চেনটা ছেড়ে দিতেই সে তীব্রবেগে ছুটে গেল, তারপর সেই দলটার মধ্যে একজন মহিলার পায়ের কাছে গিয়ে মাথা ঘষতে লাগল, লুটিয়ে পড়ে কুঁইকুই শব্দ করতে লাগল।

আলম কাকাবাবুর কাছে এসে বললেন, একজন মহিলা! এ কি শঙ্খচূড়ের বউটউ নাকি?

কাকাবাবু বললেন, বউ হোক বা না হোক, শঙ্খচূড়ের ঘনিষ্ঠ কেউ নিশ্চয়ই। নইলে সকলের মধ্যে শুধু এর কাছে গিয়েই টবি এরকম করত না। এ-মহিলাকে ধরে রাখতে হবে। এর কাছ থেকে অনেক কিছু জানা যাবে।

আলম রিভলভার তাক করে সেই মহিলাকে বললেন, ইউ আর আন্ডার অ্যারেস্ট। আপনি এগিয়ে আসুন।

মহিলাটি নাকি নাকি গলায় বলল, আমি কিছু জানি না। আমি আগুন দেখতে এসেছি। এই কুকুরটা কেন এরকম করছে, আমি বুঝতে পারছি না।

আলম বললেন, আপনি এগিয়ে আসুন, নইলে হাতকড়া পরাতে বাধ্য হব। আপনাকে থানায় যেতে হবে।

তখন সেই মহিলা মাথার ঘোমটা সরিয়ে ফেলে গম্ভীর পুরুষের গলায় বলল, খবরদার, কেউ আমার কাছে আসবে না। সবাই আমার পাশ থেকে সরে যাও!

কাকাবাবুর দিকে তাকিয়ে সে বলল, রায়চৌধুরী, আমাকে জীবন্ত ধরার সাধ্য কারও নেই। আমি কিছুতেই ধরা দেব না। ধরা দেওয়ার আগেই মরব। আমার গায়ে আর ডি এক্স বাঁধা আছে। আমাকে কেউ ছুঁলেই প্রচণ্ড বিস্ফোরণে আমি যেমন খতম হয়ে যাব, তেমনই যে আমাকে ছোঁবে সেও ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে!

কাকাবাবু তবু এক পা এগোলেন তার দিকে।

শঙ্খচূড় বলল, রায়চৌধুরী, তুমি একবার বেঁচে গেছ, এবার কিন্তু বাঁচবে না। যদি আমাকে ধরার চেষ্টা কর, তা হলে আমরা দুজনেই একসঙ্গে মরব। এত জোর বিস্ফোরণ হবে যে, এই পুলিশটুলিস এরাও কেউ বাঁচবে না।

কাকাবাবু বললেন, আমি তোমার কথা বিশ্বাস করি না। যারা নির্মমভাবে অন্য মানুষ মারে, তারা নিজেরা মরতে ভয় পায়। তারা কাপুরুষ। তুমি নিজের গায়ে আর ডি এক্স বাঁধার ঝুঁকি নেবে না।

শঙ্খচূড় বিদ্রুপের হাসি দিয়ে বলল, তা হলে এসোই না, আমাকে ধরার চেষ্টা করে দ্যাখো! আমি এখনও সাবধান করে দিচ্ছি, এখান থেকে সরে যাও, আমাকে গাড়িতে উঠতে দাও।

হঠাৎ পেছন থেকে ছুটে এল গগন। সে কাকাবাবুকে থামিয়ে দিয়ে বলল, কাকাবাবু, আপনারা পিছিয়ে যান, আমি ওকে ধরছি। যদি আমি মরি, তাতে ক্ষতি নেই। আপনারা সরে যান।

আলমের কাছ থেকে রিভলভারটা চেয়ে নিয়ে এক পা এক পা করে সে এগোতে লাগল শঙ্খচূড়ের দিকে।

শঙ্খচূড় বলল, তুই? তুই এসেছিস আমার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করতে। তুই কিছুতেই প্রাণে বাঁচবি না।

গগন বলল, আর আমাকে কী প্রাণের ভয় দেখাচ্ছ! আমি মরতে রাজি আছি। কিন্তু তোমাকেও আর বাঁচতে দেব না।

গগন একেবারে কাছাকাছি পৌঁছোতেই শঙ্খচূড়ের মুখ শুকিয়ে গেল। সে পেছন ফিরে দৌড় লাগাতেই গগন বাঘের মতন লাফিয়ে পড়ল তার ঘাড়ে।

কোনও বিস্ফোরণ হল না।

কাকাবাবু ঠিকই বলেছিলেন, এইসব নিষ্ঠুর খুনিরা নিজেরা মরতে ভয় পায়।

টবি গগনকে হিংস্রভাবে আক্রমণ করে কামড়াতে শুরু করেছিল, কাকাবাবু দ্রুত এসে তার চেনটা ধরে টেনে সরিয়ে নিলেন।

গগন রিভলভারের বাঁট দিয়ে শঙ্খচূড়ের মাথায় এমন মারতে শুরু করেছে যে, তার মাথাটা চৌচির হয়ে যেতে পারত, আলম এসে তাকে চেপে ধরে বললেন, ও কী করছেন, ও কী করছেন? ওকে আমরা জ্যান্ত ধরতে চাই।

শঙ্খচূড় ততক্ষণে অজ্ঞান হয়ে গেছে।
গগনের মোটরবাইকটা তুলে দেওয়া হয়েছে পুলিশের জিপে।

আলমের গাড়িতে কাকাবাবুর সঙ্গে বসেছে সন্তু আর গগন।

কাকাবাবু সন্তুকে জিজ্ঞেস করলেন, হ্যাঁ রে, সুকোমল ভাল আছে? তাকে কোথায় পেলি?

সন্তু এক পলক গগনের দিকে তাকিয়ে বলল, একটা দ্বীপে। না, ওকে মারধর করেনি। এমনই ভাল আছে।

কাকাবাবু গগনকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি এর মধ্যে জড়িয়ে পড়লে কী করে? তোমার তো নিজস্ব ভালই ব্যবসাট্যাবসা আছে।

গগন বলল, বিশ্বাস করুন, কাকাবাবু, টাকার লোভে যাইনি। এদের সঙ্গে হাত মেলাতে হয়েছে প্রাণের ভয়ে। একটা বিরাট গ্যাং ছড়িয়ে আছে সারা দেশে। তাদের সব কাজ ভাগ ভাগ করা। আমাকে বলেছিল, মানুষ ধরে ধরে এনে মুক্তিপণের ব্যবস্থা সব ওরা নিজেরাই করবে, আমাকে শুধু লুকিয়ে রাখার জায়গাটা দিতে হবে। যদি রাজি না হই কিংবা পুলিশের কাছে মুখ খুলি, তা হলে আমাকে খুন করে ফেলবে। ওরা এমনই সাঙ্ঘাতিক যে, ওদের হাত ছাড়িয়ে বাঁচার উপায় নেই। তাই বাধ্য হয়ে রাজি হয়েছিলাম। একসময় নিজের ওপর ঘেন্না হল, মনে হল, এ আমি কী করছি, মুক্তিপণ আদায় করতে না পারলে এরা ছোট ছেলে কিংবা বয়স্ক লোক যে-ই হোক, তাকে মেরে ফেলে, আমি তাতে সাহায্য করছি! নিজের ওপর ঘেন্না হতেই প্রাণের ভয়টা কেটে গেল।

কাকাবাবু বললেন, শুধু মানুষ চুরি নয়, এদের পরিকল্পনা ছিল আরও সাঙ্ঘাতিক। এয়ারপোর্ট উড়িয়ে দেওয়া, রেল স্টেশন, ট্রেন ধ্বংস করা, অনেক কিছু। দেখো, বেশিরভাগ মানুষ শান্তিই চায়, শুধু কিছু কিছু মানুষ টাকার জন্য, ক্ষমতার জন্য সারা পৃথিবী জুড়েই অশান্তির সৃষ্টি করে চলেছে। যাক গে, সেসব কথা পরে হবে। সন্তু, আমাদের লক্ষণের শক্তিশেল নাটকটা কিন্তু বন্ধ করা চলবে না। আবার রিহার্সাল দিয়ে স্টেজে নামাতেই হবে?

সন্তু বলল, হ্যাঁ, আর কয়েকদিন রিহার্সাল দিলেই সব ঠিক হয়ে যাবে।

গগন বলল, কাকাবাবু, আমাকে একটা পার্ট দেবেন?

কাকাবাবু বললেন, আর তো পার্ট বাকি নেই। তা ছাড়া এটা ছোটরাই। করবে। তুমি প্রম্পটার হতে পারো। উইংসের পাশে দাঁড়িয়ে প্রম্পট করবে, যদি কেউ পার্ট ভুলে যায়—-

গগন বলল, আমি তাতেই রাজি।

কাকাবাবু বললেন, তোর পার্ট মনে আছে সন্তু, তুই তো জাম্বুবান। আচ্ছা এই জায়গাটা বল তো, রামের সামনে সবাই মিলে খুব জরুরি আলোচনা হচ্ছে, এর মধ্যে মন্ত্রী জাম্বুবান ঘুমিয়ে পড়লেন। তখন ধাক্কাধাক্কি করে তাকে জাগিয়ে দেওয়ার পর তুই কী বলবি?

সন্তু বলল, হ্যাঁ রে, আমার কাঁচা ঘুম ভাঙিয়ে দিলি! ব্যাটা বেল্লিক, বেআক্কেল, হড়িমুখো ভূত!

কাকাবাবু বললেন, হ্যাঁ, ঠিক হয়েছে। আচ্ছা, সেই গানটা মনে আছে? সবাই মিলে গাইবে, রাবণ ব্যাটায় মারো—

সন্তুর সঙ্গে সঙ্গে কাকাবাবুও গান করলেন :

রাবণ ব্যাটায় মারো, সবাই রাবণ ব্যাটায় মারো
(তার) মাথায় ঢেলে ঘোল, (তারে) উলটো গাধায় তোল
(তার) কানের কাছে পিটতে থাকো চোদ্দো হাজার ঢোল।
কাজ কি ব্যাটার বেঁচে, (তার) চুল দাড়ি দাও চেঁচে
নস্যি ঢোকাও নাকে ব্যাটা মরুক হেঁচে হেঁচে।
(তার) গালে দাও চুনকালি, (তারে) চিমটি কাটো খালি
(তার) চোদ্দো পুরুষ উড়িয়ে দাও পেড়ে গালাগালি
(তারে) নাকাল করো আরও, যে-যেরকম পারো
রাবণ ব্যাটায় মারো সবাই রাবণ ব্যাটায় মারো—

গগন বলল, ওই শঙ্খচূড় ব্যাটাকেও এইভাবে মারা দরকার!

কাকাবাবু শুরু করলেন আর-একটা গান।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত