কাকাবাবু ও চন্দনদস্যু

কাকাবাবু ও চন্দনদস্যু

বই পড়তে পড়তে মাঝে মাঝে একটু ঘুমিয়ে নেওয়া কাকাবাবুর অভ্যেস। একটানা বেশিক্ষণ পড়তে পারেন না। বড়জোর আধঘণ্টা পড়ার পর চোখ বুজে যায়। দশ-পনেরো মিনিট সেই অবস্থায় থাকেন, কখনও সখনও একটু একটু নাকও ডাকে। তারপর আবার পড়া শুরু হয়। তাতে নাকি তাঁর আরাম হয় চোখের।

এক-একদিন সারারাত ধরে খানিকক্ষণ ঘুমিয়ে, খানিকক্ষণ জেগে পড়ে শেষ করে ফেলেন এক-একটা বই।

এখন বেলা এগারোটা। জোজো ঘরে ঢুকে দেখল, কাকাবাবু ইজিচেয়ারে হেলান দিয়ে শুয়ে আছেন, কোলের ওপর একটা মোটা ইংরেজি বই। চক্ষু বোজা।

কিন্তু কাকাবাবুর ঘুম খুব পাতলা। ঘরে কেউ ঢুকলেই টের পেয়ে যান। জোজো কোনও শব্দ করেনি, তবু কাকাবাবু চোখ মেলে তাকালেন।

সোজা হয়ে বসে বললেন, এসো, এসো, জোজো মাস্টার। নতুন কী খবর বলো!

সাদা প্যান্টের ওপর একটা হলুদ রঙের টি-শার্ট পরে আছে জোজো। দুএকদিন আগেই চুল কেটেছে। সে সবসময় বেশ ফিটফাট থাকে।

জোজো বলল, গরমের ছুটি পড়ে গেছে। দিনগুলো নষ্ট হচ্ছে।

কাকাবাবু বললেন, কেন, নষ্ট হচ্ছে কেন?

জোজো বলল, এখন কলকাতায় থাকার কোনও মানে হয়? কোথাও বেড়াতে যাওয়া উচিত ছিল। বাবা অবশ্য আমাকে পাপুয়া নিউগিনি পাঠাতে চেয়েছিলেন, কিন্তু সন্তু না গেলে, মানে আপনার আর সন্তুর সঙ্গে যেতেই আমার বেশি ভাল লাগে। আপনাকে এবার কোনও জায়গা থেকে কেউ ডাকেনি?

কাকাবাবু বললেন, না তো! অবশ্য কেউ না ডাকলেও তো এমনিই কোথাও যাওয়া যায়।

জোজো বলল, স্পেনে যাবেন? বার্সেলোনার আকাশে পরপর তিনদিন অন্য গ্রহের রকেট দেখা গেছে।

কাকাবাবু সরলভাবে অবাক হয়ে বললেন, তাই নাকি! কোন গ্রহের রকেট?

জোজো বলল, তা এখনও জানা যায়নি। তবে হাতির মতন শুড়ওয়ালা একটা মানুষকেও নাকি দেখা গেছে সেই রকেট থেকে উঁকি মারতে।

কাকাবাবু বললেন, গণেশ দেবতা নাকি? বোধ হয় স্বর্গ থেকে পৃথিবীতে বেড়াতে এসেছেন। কিন্তু আমাদের দেশে না এসে স্পেনে গেলেন কেন? ওরা তো আর ঠাকুর-দেবতায় বিশ্বাস করে না। তুমি এ খবর জানলে কী করে?

জোজো বলল, স্পেন দেশের কাগজে বেরিয়েছে। আমাদের বাড়িতে তো পৃথিবীর সব দেশের কাগজ আসে। আমার বাবা সাতাশটা ভাষা জানেন। চলুন না দেখে আসি।

কাকাবাবু বললেন, আমি তো অত ভাষা জানি না। অন্য গ্রহের প্রাণীদের সঙ্গে কোন ভাষায় কথা বলব? যদি গণেশ ঠাকুর হন, তাঁর সঙ্গে কথা বলতে হবে সংস্কৃত ভাষায়। আমি সংস্কৃতও ভাল জানি না। তা ছাড়া স্পেনে যাওয়ার অনেক খরচ।

জোজো বলল, তা হলে ইন্দোনেশিয়ায় চলুন। সত্যিকারের ড্রাগন দেখতে পাওয়া গেছে। মুখ দিয়ে আগুন বেরোয়। সেই আগুনে গাছপালা পুড়িয়ে দিচ্ছে।

কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, এ-খবরটা আবার কোথায় বেরিয়েছে?

জোজো বলল, কোথাও বেরোয়নি। আমেরিকানরা জানতে পারলেই তো ড্রাগনটা কিনে নিয়ে যাবে। আমার বাবার কাছে ইন্দোনেশিয়া থেকে এক ভদ্রলোক এসেছিলেন, তিনি চুপি চুপি বলে দিয়েছেন।

কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, সন্তু কোথায়? তোমার সঙ্গে দেখা হয়নি?

জোজো বলল, হ্যাঁ। ও কাঁচা আম মাখছে। নুন আর লঙ্কা দিয়ে। আপনি খাবেন?

কাকাবাবু বললেন, শুনেই তো জিভে জল আসছে। নিশ্চয়ই খাব। এখন তো আমের সিজুন নয়। কাঁচা আম কোথায় পেল!

জোজো বলল, ও পায়নি। আমি এনেছি। আফ্রিকা থেকে একজন পাঠিয়েছে।

কাকাবাবু বললেন, বাঃ! সারা পৃথিবী জুড়ে তোমার চেনাশুনো।

জোজো এবার প্যান্টের পকেট থেকে একটা রুপোর মেডেল বার করল। ডান হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল, এটা দেখেছেন?

কাকাবাবু বললেন, মেডেল? এটা কে দিয়েছে তোমায়? ইংল্যান্ডের রানি না জাপানের সম্রাট?

জোজো হেসে ফেলে বলল, এটা আমার নয়, সন্তুর। ও লজ্জায় আপনাকে দেখায়নি।

কাকাবাবু হাত বাড়িয়ে সেটা নিয়ে বললেন, সন্তুকে হঠাৎ কে দিল? গোল মেডেলটির মাঝখানে লেখা :

শরৎ স্মৃতি পুরস্কার
১ম
শ্রীসুনন্দ রায়চৌধুরী

কাকাবাবু কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কীসের পুরস্কার বলো তো? সাঁতারের?

জোজো বলল, না। প্রবন্ধ প্রতিযোগিতা। সব কলেজের মধ্যে। সন্তু ফার্স্ট প্রাইজ পেয়েছে। বিষয়টা ছিল, পৃথিবীর আয়ু কতদিন।

কাকাবাবু বললেন, খুব শক্ত বিষয় তো। আমি নিজেই জানি না। পৃথিবীর আয়ু কতদিন? জোজো, এই প্রতিযোগিতায় তুমি নাম দাওনি?

জোজো বলল, কী যে বলেন কাকাবাবু! একই প্রতিযোগিতায় সন্তু আর আমি দুজনে কি একসঙ্গে নাম দিতে পারি? আমি ফার্স্ট হয়ে গেলে সন্তু দুঃখ পেত না? সন্তুকে আমি অনেক পয়েন্ট বলে দিয়েছি। আসলে একটাই মেন পয়েন্ট।

কাকাবাবু বললেন, কী বলো তো মেন পয়েন্ট!

জোজো বলল, সাবজেক্টটা হল পৃথিবীর আয়ু কতদিন। এতে কিন্তু পৃথিবী নিয়ে কিছু লিখতে হবে না। লিখতে হবে, মানুষের আয়ু কতদিন। ধরুন, কোনও কারণে যদি পৃথিবী থেকে সব মানুষ শেষ হয়ে যায়, তা হলে তার পরেও পৃথিবী থাকবে কি থাকবে না, কে তার হিসেব রাখবে?

কাকাবাবু বললেন, ঠিক বলেছ তো? আচ্ছা জোজো, তুমি ভূতের আয়ু কতদিন তা বলতে পারো?

জোজো বেশ অবাক হয়ে বলল, তার মানে?

কাকাবাবু বললেন, একজন মানুষ ষাট-সত্তর-আশি বছর বাঁচে। তারপর মরে গিয়ে ভূত হয়। ভূত হয়ে আবার কতদিন বেঁচে থাকে? চার-পাঁচশো বছর কি ভূতের আয়ু হতে পারে?

জোজো ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে রইল কয়েক মুহূর্ত। তারপর জিজ্ঞেস করল, আপনি ভূতে বিশ্বাস করেন?

কাকাবাবু একগাল হেসে বললেন, আগে তো করতাম না। এখন মাঝে মাঝে বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে।

এই সময় সন্তু একটা পাথরের বাটি হাতে নিয়ে ঢুকল। তাতে কাঁচা আম পাতলা পাতলা করে কেটে নুন আর কাঁচালঙ্কা দিয়ে মাখা।

কাকাবাবু একটুখানি আমমাখা তুলে নিয়ে মুখে দিয়ে বললেন, দারুণ! অনেকদিন পরে খেলাম! আর একটু দে তো!

জোজো বলল, বেশি খেলে দাঁত টকে যাবে।

কাকাবাবু বললেন, হ্যাঁ রে সন্তু, তুই প্রবন্ধ লিখে ফার্স্ট প্রাইজ পেয়েছিস, আমাকে বলিসনি কেন?

সন্তু লাজুকভাবে বলল, ও এমন কিছু না।

কাকাবাবু বললেন, তোকে আমারও একটা প্রাইজ দেওয়া উচিত। জোজো বলছিল কোথাও বেড়াতে যাওয়ার কথা। সেটাই প্রাইজ হতে পারে। কিন্তু আমি বিদেশে নিয়ে যেতে পারব না। তাতে অনেক খরচ। কেউ তো আমাদের ডাকছে না। এমনিই বেড়ানো হবে। কোথায় যেতে চাস বল! এমন কোথাও যাওয়া যাক, যেখানে আমরা আগে যাইনি।

সন্তু বলল, জয়শলমির! রাজস্থানে কখনও—

জোজো বলল, আমি গেছি!

সন্তু বলল, তা হলে রাজগির?

জোজো বলল, তাও আমার দেখা!

কাকাবাবু বলল, আমি কয়েকটা জায়গার নাম বলছি, জোজো বলো তো, সেগুলো তোমার দেখা কি না! চেরাপুঞ্জি। উটকামণ্ড। কালিকট। রামটেক। পারো। মহাবলীপুরম।

জোজো বলল, এইসব ছোট জায়গা… না, আমার যাওয়া হয়নি।

সন্তু বলল, অনেক সময় ছোট জায়গাই বেশি ভাল লাগে।

কাকাবাবু বললেন, তা হলে এর মধ্যেই একটা বেছে নেওয়া যাক। কোথায় যাবে ঠিক করো।

সন্তু বলল, চেরাপুঞ্জি।

জোজো বলল, মহাবলীপুরম।

কাকাবাবু বললেন, ওভাবে হবে না। লটারির মতন একটা কিছু করা যাক।

তিনি একটা কাগজকে ছ টুকরো করে প্রত্যেকটাতে লিখলেন এক-একটা জায়গার নাম। তারপর কাগজগুলো উলটে দুহাতে ধরে জোজোর দিকে এগিয়ে বললেন, তুমি একটা টেনে নাও!

জোজো একটা কাগজ নিয়ে পড়ে দেখে বলল, কালিকট।

কাকাবাবু সন্তুকে জিজ্ঞেস করলেন, তোর কালিকট যেতে আপত্তি আছে?

সন্তু বলল, ঠিক আছে কালিকটেই যাব। এটা কি সেই কালিকট, যেখানে ভাস্কো দা গামা প্রথমে এসে জাহাজ ভিড়িয়েছিল?

কাকাবাবু বললেন, কালিকট একটাই আছে।

জোজো বলল, কালিকটের রাজার নাম ছিল জামোরিন। তার সঙ্গে ভাস্কো দা গামার আলাপ হয়। সেই প্রথম সমুদ্র পেরিয়ে ইওরোপের বণিকরা এসেছিল। ভারতে।

সন্তু বলল, ভালই হল। নিশ্চয়ই ওখানে ইতিহাসের অনেক চিহ্ন দেখতে পাওয়া যাবে!

কাকাবাবু বললেন, তা জানি না। হয়তো এখন আর কিছুই নেই। যাই হোক, একটা নতুন জায়গা তো দেখা হবে

সন্তু জিজ্ঞেস করল, কী করে যেতে হয়? ট্রেনে?

কাকাবাবু বললেন, ট্রেনে যেতে অনেক সময় লেগে যাবে। প্লেনেও যাওয়া যায় নিশ্চয়ই।

কাকাবাবুর ঘরের এক দেওয়ালে সবসময় একটা বড় ম্যাপ টাঙানো থাকে ভারতের। সেখানে উঠে গিয়ে তিনি বললেন, এই যে দ্যাখ, কেরালায় কালিকট শহর। বম্বে দিয়ে যাওয়া যায়, ম্যাড্রাস দিয়েও যাওয়া যায়।

জোজো বলল, বম্বে নয়, এখন মুম্বই। ম্যাড্রাস নয়, চেন্নাই।

কাকাবাবু বললেন, তা বটে! মনে থাকে না। ভাগ্যিস আমাদের কলকাতার নামটাও বদলায়নি। আমরা মুম্বই দিয়েই যাব।

একটু পরেই একজন তোক দেখা করতে এল কাকাবাবুর সঙ্গে। খাকি প্যান্ট ও খাকি শার্ট পরা। কাকাবাবুর দিকে একটা লম্বা খাম এগিয়ে দিয়ে বলল, সার, এই আপনার প্লেনের টিকিট।

কাকাবাবু খাম খুলে একটা প্লেনের টিকিট বার করে ভাল করে দেখলেন। তারপর বললেন, হ্যাঁ ঠিক আছে। কিন্তু রামরতন, ঠিক এইরকম আরও দুটো টিকিট যে চাই, আমি নাম লিখে দিচ্ছি, আজ বিকেলের মধ্যেই দিয়ে যেতে হবে!

লোকটি বলল, হ্যাঁ সার, পৌঁছে দেব।

কাকাবাবু তাঁর প্যাডে সন্তু ও জোজোর নাম লিখে দিলেন।

লোকটি চলে যাওয়ার পর সন্তু জিজ্ঞেস করল, কাকাবাবু, এটা কোথাকার টিকিট? তুমি অন্য কোথাও যাচ্ছ?

কাকাবাবু মুচকি হেসে বললেন, না তো! এটা কালিকটের টিকিট। তোদের জন্যও আর দুটো টিকিট আসছে।

সন্তু বলল, তার মানে? কালিকট যাওয়া তো এইমাত্র ঠিক হল। আর সঙ্গে সঙ্গে কালিকটের টিকিট এসে গেল? এটা কি ম্যাজিক নাকি?

কাকাবাবু এবার উত্তর না দিয়ে গোঁফে আঙুল বোলালেন।

জোজো বলল, আমি যে কালিকট লেখা কাগজটা টানলাম, আমি তো অন্য কাগজও টানতে পারতাম!

কাকাবাবু বললেন, না। তা পারতে না। আমি একটু একটু ম্যাজিক শিখছি। ম্যাজিশিয়ানরা একটা তাসের ম্যাজিক দেখায়, দেখোনি? তুমি যে-কোনও একটা তাস টানলে, ম্যাজিশিয়ান দূর থেকেই বলে দিল সেটা কী তাস। এটা এক ধরনের হাতসাফাই, ইংরেজিতে বলে ফোর্সিং। ম্যাজিশিয়ান ইচ্ছেমতন একটা বিশেষ তাস তোমাকে গছিয়ে দেবে। দেখবে খেলাটা?

কাকাবাবু বিভিন্ন শহরের নাম লেখা কাগজগুলো একসঙ্গে মিশিয়ে দিলেন। কয়েকবার সবকটা ওলটপালট করার পর, আবার বিছিয়ে ধরে বললেন, সন্তু, তুই একটা টান।

সন্তু বেশ কয়েক মুহূর্ত চিন্তা করে একেবারে কোণের কাগজটা টেনে নিল।

কাকাবাবু বললেন, ওটা উটকাম, তাই না?

সন্তু দারুণ অবাক। সে জোজোর চোখের দিকে তাকাল। জোজো হাততালি দিয়ে বলল, চমৎকার। কাকাবাবু আপনি আর কী কী ম্যাজিক শিখেছেন?

কাকাবাবু বললেন, আরও শিখেছি কয়েকটা। পরে দেখাব।

জোজো বলল, আপনি আগেই কালিকট যাবেন বলে ঠিক করে রেখেছিলেন। তার মানে, ওখানে আপনার কোনও কাজ আছে?

কাকাবাবু খানিকটা অন্যমনস্ক ভাবে বললেন, না, কাজ ঠিক নেই। বেড়াতেই যাচ্ছি। তবে ফাউ হিসেবে একটা চার-পাঁচশো বছরের বুড়ো ভূতের সঙ্গে দেখা হয়ে যেতে পারে।
কালিকটের প্লেন মুম্বই থেকে সকাল সাড়ে আটটায় ছাড়ে। কলকাতা থেকে ভোরের প্লেনে এলেও সেটা ধরা যায় না। তাই মুম্বই যেতে হল আগের দিন রাত্তিরে।

ওখানে কাকাবাবুর চেনাশুনো অনেক মানুষ আছে। কিন্তু কারও বাড়িতে উঠলেই সে অন্তত দু-তিনদিন ধরে রাখতে চাইবে। কিছুতেই পরের দিন যেতে পারবেন না।

সেইজন্য কাকাবাবু কাউকে কিছু না জানিয়ে মুম্বইয়ের একটা হোটেলে টেলিফোন করে দুটো ঘর বুক করে রেখেছেন।

প্লেন মুম্বই পৌঁছল রাত সাড়ে আটটায়। মালপত্র নিয়ে ট্যাক্সিস্ট্যান্ডের দিকে এগোতেই একটা চোদ্দো-পনেরো বছরের মেয়ে দৌড়ে এসে কাকাবাবুর সামনে দাঁড়াল। তার দুচোখ ভরা বিস্ময়।

সে আস্তে আস্তে বলল, আপনি কাকাবাবু?

কাকাবাবু হেসে বললেন, হ্যাঁ, তুমি চিনলে কী করে?

মেয়েটি বলল, আমার বাবা দূরে দাঁড়িয়ে আছেন। বাবা দেখিয়ে দিলেন।

নিচু হয়ে সে কাকাবাবুর পা ছুঁয়ে প্রণাম করল। তা

রপর সন্তু আর জোজোর দিকে তাকাল।

কাকাবাবু বললেন, এদের চিনতে পারোনি? এই হচ্ছে সন্তু, আর এ জোজো। তোমার নাম কী?

মেয়েটি বলল, নিশা সেন।

সে মুগ্ধভাবে জোজোর দিকে চেয়ে রইল কয়েক মুহূর্ত। কাঁধের ঝোলা ব্যাগ থেকে একটা ছোট্ট খাতা বার করে বলল, একটা অটোগ্রাফ দেবেন?

জোজো সই করে দেওয়ার পর সে সন্তু আর কাকাবাবুরও সই নিল।

কাকাবাবু তার মাথায় হাত রেখে বললেন, ভাল থেকো। এবার আমরা যাই?

নিশা বলল, আমরা এখানেই থাকি। কলকাতায় বেড়াতে গিয়েছিলাম। প্লেনে আপনাদের দেখতে পাইনি। একবার আমাদের বাড়িতে চলুন না। একটু চা খেয়ে যাবেন।

কাকাবাবু কিছু বলার আগেই পাশ থেকে আর একজন তোক বলল, তা তো সম্ভব নয় ভাই। এখন ইনি আমার সঙ্গে যাবেন।

কাকাবাবু মুখ ঘুরিয়ে দেখলেন কাছেই দুজন লোক দাঁড়িয়ে আছে। তাদের মধ্যে একজন হাত বাড়িয়ে সন্তুর কাছ থেকে একটা ব্যাগ নিতে যাচ্ছে।

কাকাবাবু অবাক হয়ে বললেন, আরে, অমল? তুমিও এই প্লেনে ফিরলে নাকি?

সেই যুবকটি পরে আছে সাদা প্যান্ট আর সাদা শার্ট। মুখে মিটিমিটি হাসি।

সে বলল, না। আমি আপনাদের নিতে এসেছি।

কাকাবাবু বললেন, তার মানে? আমরা যে আজ এখানে আসছি, তা তুমি জানলে কী করে?

সে বলল, বাঃ, আপনি বম্বে আসছেন, আমি জানব না? বম্বের বহু লোক জেনে গেছে।

কাকাবাবু বললেন, বাজে কথা বলো না, আমি কাউকেই জানাইনি। তুমি কী। করে খবর পেলে?

সে বলল, ধরে নিন ম্যাজিক।

কাকাবাবু সন্তু আর জোজোর দিকে তাকিয়ে বললেন, আজকাল দেখছি অনেকেই ম্যাজিকের চর্চা করছে। আসল ব্যাপারটা কী বলো তো?

সে বলল, আসল ব্যাপারটা খুব সোজা। আমি সন্ধেবেলা আপনার বাড়িতে ফোন করেছিলাম। আপনার দাদা ফোন ধরে বললেন, রাজা আর সন্তু তো আজই বম্বে গেল। একটু আগে রওনা হয়েছে। ব্যস, আমি বুঝে গেলাম, আপনারা কোন ফ্লাইটে আসছেন। আরও অনেকে জানে, এটা কেন বললাম জানেন? আপনি তো রিজেন্ট হোটেলে ফোন করে দুটো ঘর বুক করেছেন, তাই না? সেই হোটেলের ম্যানেজার বাঙালি, তার নাম শেখর দত্ত, আমার খুব চেনা। সেও একটু আগে আমায় ফোন করে বলল, অমলদা, রাজা রায়চৌধুরীর নাম শুনেছেন তো? যাঁকে সবাই কাকাবাবু বলে। তিনি আজ আসছেন আমাদের হোটেলে। দেখা করবেন নাকি? আমি শেখরকে বললাম, দেখা করব তো বটেই। তবে, তোমার হোটেলের বুকিং ক্যানসেল করে দাও। উনি হোটেলে থাকবেন না।

কাকাবাবু বললেন, কেন, আমরা হোটেলে…

অমল বলল, অসম্ভব। আপনাদের কে হোটেলে যেতে দিচ্ছে? আমার বাড়ি একদম খালি।

নিশা নামের মেয়েটিকে তার বাবা ডাকছে, সে বিদায় নিয়ে চলে গেল।

অমল এর মধ্যেই সন্তু আর জোজোর কাছ থেকে ব্যাগ দুটো নিয়ে নিয়েছে।

কাকাবাবু বললেন, তোদের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিই। এর নাম অমল ভট্টাচার্য। এঞ্জিনিয়ার আর কবি। অনেকদিন আফ্রিকায় ছিল। এখানে ও একটা ছাপার কালির কোম্পানিতে কাজ করে। তাই না অমল?

অমল বলল, কালি, রং, এরকম অনেক কিছু।

কাকাবাবু বললেন, সেইজন্যই ও সবসময় সাদা শার্ট-প্যান্ট পরে।

এয়ারপোর্টের বাইরে এসে অমল নিজের গাড়িতে সব মালপত্র তুলল। কাকাবাবু বসলেন সামনে।

গাড়ি ছাড়ার পর অমল বলল, একটা মজার জিনিস লক্ষ করলেন কাকাবাবু। ওই যে নিশা মেয়েটি, ও কিন্তু সন্তুর আগে জোজোর অটোগ্রাফ নিল। এমনকী আপনারও আগে। তার মানে কি জোজো আপনাদের দুজনের চেয়েও জনপ্রিয়?

কাকাবাবু বললেন, তা তো হতেই পারে। আমি খোঁড়া মানুষ, আর সন্তু সবসময় লাজুকের মতন আড়ালে থাকে। আমরা তিনজন একসঙ্গে থাকলে প্রথমে জোজোর দিকেই সকলের চোখ পড়ে। জোজোর অমন সুন্দর চেহারা, মেয়েরা তো ওকে বেশি পছন্দ করবেই।

জোজো গম্ভীরভাবে বলল, শুধু মেয়েরা নয়, অনেক ছেলেও আমার অটোগ্রাফ নেয়। একটা মজার ঘটনা শুনবেন? মারাদোনার নাম শুনেছেন। নিশ্চয়ই?

অমল বলল, মারাদোনা মানে, ফুটবল খেলার রাজা? তার নাম কে না শুনেছে?

সন্তু প্রতিবাদ করে বলে উঠল, মারাদোনাকে মোটেই ফুটবলের রাজা বলা যায় না। রাজা হচ্ছেন পেলে। অল টাইম গ্রেট। মারাদোনাকে বড়জোর সেনাপতি বলা যায়।

কাকাবাবু বললেন, ও তর্ক থাক। মজার ঘটনাটা কী শুনি?

জোজো বলল, আগেরবার যে ফুটবলের ওয়ার্ল্ড কাপ হল, সেটা তো আমি দেখতে গিয়েছিলাম। একদিন মারাদোনার মুখোমুখি পড়ে যেতেই আমি অটোগ্রাফ চাইলাম। মারাদোনা এমনিতে কাউকে অটোগ্রাফ দেয় না। অনেক টাকা চায়। আমাকেও প্রথমে দেবে না বলেও একটুক্ষণ আমার মুখের দিকে চেয়ে রইল। তারপর সই করে দিয়ে ফস করে নিজের পকেট থেকে একটা অটোগ্রাফ খাতা বার করে বলল, তুমিও আমাকে একটা সই দাও। তোমার মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে, ভবিষ্যতে তুমি একজন বিখ্যাত লোক হবে!

কাকাবাবু বললে, বাঃ। মারাদোনার কথা এর মধ্যেই অনেকটা মিলে গেছে।

সন্তু বলল, তোর কাছে মারাদোনার অটোগ্রাফ আছে? একদিন আমায় দেখাস তো!

জোজো বলল, দুঃখের কথা কী জানিস, সেই অটোগ্রাফ খাতাটা কিছুদিন ধরে খুঁজে পাচ্ছি না। তার মধ্যে আরও কত বড় বড় লোকের সই ছিল।

অমল বলল, তোমারটা হারিয়ে গেলেও মারাদোনা নিশ্চয়ই তার অটোগ্রাফ খাতা হারায়নি। তার মধ্যে তোমার সই রয়ে গেছে। শুধু সই করেছিলে, না কিছু লিখেও দিয়েছিলে?

জোজো বলল, বাংলায় লিখে দিয়েছিলাম, চালিয়ে যা পঞ্চা!

অমল হো হো করে হেসে উঠে বলল, চমৎকার! জোজোর তুলনা নেই। কাকাবাবু, এই রত্নটিকে কোথায় পেলেন?

কাকাবাবু বললেন, জোজোর সত্যি অনেক গুণ আছে।

জোজো বলল,সন্তু, ওই যে মেয়েটি অটোগ্রাফ নিল, নিশা নামের মানে কী রে?

সন্তু বলল, রাত্রি। নিশা, নিশি, নিশীথিনী, সব মানেই এক।

অমল বলল, রবীন্দ্রনাথের গান আছে, ভরি দিয়া পূর্ণিমা নিশা, অধীর অদর্শন তৃষা—।

সুর করে সে গানটা গেয়ে উঠল।

গান থামতে কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, অমল, তোমার সঙ্গে যে আর একজন লোক ছিল, সে গাড়িতে উঠল না?

অমল বলল, আমার সঙ্গে তো আর কেউ ছিল না।

কাকাবাবু বললেন, তোমার পাশেই একজন দাঁড়িয়ে ছিল, আমাদের পেছন পেছন গাড়ির কাছাকাছিও এল—

সন্তু বলল, আমিও লক্ষ করেছি, জুলপিদুটো বেশ বড়, মাথার সামনের দিকে একটু টাক।

অমল বলল, আমার সঙ্গে আসেনি। হয়তো অন্য কোনও বাঙালি আপনাদের চিনতে পেরে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল।

কাকাবাবু বললেন, একটা চকোলেট রঙের গাড়ি অনেকক্ষণ ধরে আমাদের পেছন পেছন আসছে।

অমল বলল, তাই নাকি? কাকাবাবু, আপনি বুঝি সবসময় রহস্য খোঁজেন? আমাদের কে ফলো করবে?

কাকাবাবু বললেন, কোনও কারণ নেই। তবে অনেকক্ষণ ধরে গাড়িটা দেখছি ঠিকই৷

আর খানিকটা বাদে অমলের গাড়ি থামল একটা উনিশতলা ফ্ল্যাটবাড়ির সামনে। কাকাবাবু নামতেই পাশ দিয়ে একটা চকোলেট রঙের গাড়ি বেরিয়ে গেল। কাকাবাবু সেদিকে ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে রইলেন।

অমল থাকে সতেরোতলায়। তার বউ, ছেলেমেয়েরা গেছে কলকাতায়, ফ্ল্যাটটা ফাঁকা।

অমল দুহাত ছড়িয়ে বলল, আমি রান্নাবান্না সব করে রেখেছি। আপনারা আরাম করে বসুন। এখন জমিয়ে গল্প হবে।

কাকাবাবু বললেন, তুমি রান্না করতেও জানো নাকি?

অমল বলল, বাংলায় একটা কথা আছে, যে রাঁধে, সে কি চুল বাঁধে না? সেইরকমই বলা যায়, যে কবিতা লেখে, সে কি রাঁধতে পারে না? রান্নার জন্য আমি বন্ধুবান্ধব মহলে বিখ্যাত।

কাকাবাবু বললেন, আমি কবিতা লিখতেও পারি না, রান্নাও জানি না। আচ্ছা অমল, তুমি আজ কলকাতায় আমাকে ফোন করেছিলে কেন?

অমল বলল, অনেকদিন আপনার সঙ্গে দেখা হয়নি। তা ছাড়া একটা বই পড়ছিলাম, একটা জায়গা বুঝতে পারিনি। তাই ভাবলাম, কাকাবাবুকে ফোন করলে উনি ঠিক বলে দিতে পারবেন। আমার এমন সৌভাগ্য, ফোনে কথা বলার বদলে আপনাকে সশরীরে পাওয়া গেল। অফিস থেকে কাল-পরশু ছুটি নিচ্ছি, আপনাদের সারা বম্বে ঘুরিয়ে দেখাব। কাছাকাছি অনেক সুন্দর জায়গা আছে।

কাকাবাবু বললেন, আমরা তো বম্বে বেড়াতে আসিনি। কাল সকালে কালিকট যাব।

কয়েকদিন পরে সেখানে যাবেন।

প্লেনের টিকিট কাটা হয়ে গেছে।

টিকিট পালটানো খুব সোজা। কাল সকালেই ফোন করে দেব।

কিন্তু আমি ওদের কালিকট দেখাব বলে নিয়ে এসেছি। কী রে, তোরা কি বম্বেতে থাকতে চাস?

জোজো ঠেটি উলটে বলল, আমি এখানে অন্তত দশবার এসেছি। দেখার কিছু নেই।

সন্তু বলল, আমি একবার এসেছি অবশ্য। সেবারেই অনেক কিছু দেখা হয়ে গেছে। কালিকট গেলেই ভাল হয়।

অমল কয়েক মুহূর্ত অবাক হয়ে ওদের দিকে চেয়ে থেকে বলল, কালিকটে কী আছে? সেখানে তো কেউ বেড়াতে যায় না।

কাকাবাবু বললেন, আমরা ঠিক করেছি, বড় বড় শহরের বদলে মাঝে মাঝে আমরা ছোটখাটো জায়গায় ঘুরে আসব।

অমল বলল, অফিসের কাজে আমাকে দু-একবার যেতে হয়েছে কালিকটে। ওখানে দেখার মতন কিছু নেই।

কাকাবাবু বললেন, অফিসের কাজে গেলে তো আর বেড়ানো হয় না!

হঠাৎ অমলের চোখদুটো বড় বড় হয়ে গেল। নতুন কিছু আবিষ্কার করার মতন আনন্দে সে চেঁচিয়ে উঠল, ও বুঝেছি! বুঝেছি! নতুন অভিযান। কালিকটে নিশ্চয়ই সাঙ্ঘাতিক কিছু ঘটেছে, আপনি তার সমাধান করতে যাচ্ছেন। আমি যাব, আমি আপনাদের সঙ্গে যাব! কাকাবাবু, আমি সাঁতার জানি, বক্সিং জানি, বন্দুক চালাতে জানি, ঘোড়ায় চড়তেও জানি!

কাকাবাবু হেসে ফেলে বললেন, তুমি কবিতা লেখা ছাড়াও এত কিছু জানো! কারও সঙ্গে লড়াই করতে গেলে তোমাকে তো সঙ্গে নিতেই হবে। কিন্তু কালিকটে সেরকম কোনও সম্ভাবনাই নেই। তুমি শুধু শুধু অফিস কামাই করবে কেন?

অমল তবু জোর দিয়ে বলল, না কাকাবাবু, আমি যাবই আপনাদের সঙ্গে। আমার অনেক ছুটি পাওনা আছে।

এবার জোজো বলল, আসল ব্যাপার কী জানেন তো? কালিকটে আমার এক মাসির বাড়ি। আমার এই মাসি সাউথ ইন্ডিয়ান বিয়ে করেছেন। অনেকদিন দেখা হয়নি, অনেকবার আসতে বলেছেন। নায়ারমামা চমৎকার লোক, ভাল বাংলা জানেন, বড় ব্যবসায়ী। আমরা সেখানে যাচ্ছি।

অমল বলল, মাসির বাড়ি বেড়াতে যাচ্ছ খুব ভাল কথা। কিন্তু ভাই মাসির বর তো মামা হয় না!

জোজো বলল, ও সরি সরি, নায়ারমেসো। ভুল করে মামা বলে ফেলেছি!

অমল বলল, আমাকে বলেছ বলেছ, ওখানে গিয়ে যেন অমন ভুল কোরো না!

কাকাবাবু বললেন, আমরা বরং ওখান থেকে ফেরার সময় তোমার এখানে দিন দু-এক থেকে যাব।

অমল বলল, তা তো থাকতেই হবে। জানেন কাকাবাবু, বেশিরভাগ লোকেরই কালিকট বন্দরের নাম শুনলেই ভাস্কো ডা গামার নাম মনে পড়ে। সবাই ইতিহাসে পড়েছে। এখনকার কালিকটে কিন্তু সেসব ইতিহাসের কোনও চিহ্নও খুঁজে পাওয়া যাবে না। ওখানে দেখার মধ্যে আছে শুধু নারকোল গাছ। আর এই সময়টায় অসহ্য গরম!

কাকাবাবু আর কিছু না বলে মুচকি মুচকি হাসতে লাগলেন।
সকালবেলা অমলই পৌঁছে দিয়ে গেল এয়ারপোর্টে। প্লেন ছাড়ল ঠিক সময়ে। জোজো জানলার ধারে বসেছে। তারপর সন্তু, একপাশে কাকাবাবু।

সন্তু ফিসফিস করে বলল, কাকাবাবু, সেই বড় জুলপিওয়ালা লোকটাও এই প্লেনে উঠেছে।

জোজো বলল, কোথায়? কোথায়?

সন্তু বলল, আমাদের পেছনে, দুটো সারি পরে।

কাকাবাবু বললেন, হয়তো ব্যাপারটা কাকতালীয়।

জোজো জিজ্ঞেস করল, কাকাবাবু, এই কাকতালীয় কথাটা বইতে মাঝে মাঝে পড়ি। কথাটার ঠিক মানে কী?

কাকাবাবু বললেন, মানে জানোনা? তোমাদের দোষ নেই। যে ছেলেমেয়েরা শুধু শহরেই থাকে, তারা তালগাছ আর নারকোল গাছের তফাত বোঝে না। শহরের লোকেরা তাল খায়ও না। আগে আমরা অনেক তাল খেয়েছি, তালের বড়া, তালের ক্ষীর—

সন্তু বলল, আমরা তালশাঁস খাই। খুব ভাল খেতে। কা

কাবাবু বললেন, হ্যাঁ তালশাঁসও ভাল। লোকে পাকা তাল পছন্দ করে না বলে কাঁচা অবস্থায় তালশাঁস বের করে নেওয়া হয়। পাকা কাঁঠালের বদলে আমরা যেমন এঁচোড়ের তরকারি খাই। তাল কাঁঠাল নিয়ে এক সময় বাংলায় বেশ সুন্দর সুন্দর কথা তৈরি হয়েছিল। যেমন, তিলকে তাল করা। তাল পাকলে কাকের কী? গাছে কাঁঠাল গোঁফে তেল। সাধলে জামাই খায় না কাঁঠাল ভুচড়ো নিয়ে টানাটানি! এইসব কথার মধ্যে বেশ একটা করে গল্প আছে। কিন্তু ফলগুলো সম্বন্ধে ভাল করে না জানলে সেই গল্প ঠিক বোঝা যায় না।

সন্তু বলল, তুমি শেষেরটা যা বললে, সাধলে জামাই না কি, ওটা কখনও বইতেও দেখিনি।

কাকাবাবু বললেন, এখনকার লেখকরা নিজেরাই এসব জানেন না, তাই লেখেনও না। ওটার গল্পটা বেশ মজার। জামাই-আদর কাকে বলে জানিস তো? বাড়িতে জামাই এলে তাকে খুব খাতিরযত্ন করতে হয়। সেইরকমই গ্রামের এক বাড়িতে জামাই এসেছে। সে জামাই খুব লাজুক। তাকে যাই খেতে দেওয়া হয়, সে খাবে না খাবে না বলে। তার জন্য গাছ থেকে একটা পাকা কাঁঠাল পেড়ে আনা হয়েছে। জামাই কাঁঠাল খেতে ভালবাসে, কিন্তু কাঁঠাল খাওয়ার জন্য তাকে যখন সাধাসাধি করা হল, সে লজ্জায় না না বলতে লাগল। তখন বাড়ির লোকরাই কাঁঠালটা খেয়ে ফেলল। কাঁঠালের কোয়াগুলো বার করে নিলেও মোটা খোসাটার মধ্যে সরু সরু এক ধরনের জিনিস থাকে, তাকে বলে ভুচড়ো। সেগুলো কেউ খায় না। মাঝরাত্তিরে শাশুড়ি উঠে এসে দেখেন কী, বাড়ির উঠোনে ফেলে দেওয়া সেই কাঁঠালের খোসাটা থেকে ভুচড়োগুলো তুলে তুলে খাচ্ছে সেই জামাই।

জোজো জিজ্ঞেস করল, আর, গাছে কাঁঠাল গোঁফে তেল?

কাকাবাবু বললেন, কাঁঠালের মধ্যে আঠা থাকে, হাত দিয়ে ছাড়াতে গেলে চটচট করে। তাই যে কাঁঠাল ছাড়ায়, সে হাতে তেল মেখে নেয়। এখন, একটা গাছে একটা কাঁঠাল ঝুলছে, তাই দেখে একজন লোকের খুব লোভ হয়েছে। সে হাতে তেল-টেল মেখে রেডি হয়ে আছে, কিন্তু না পাকলে খাবে কী করে? হাতের তেল গোঁফে লাগিয়ে সে কাঁঠালের দিকে হাঁ করে চেয়ে আছে। এইসব কথার এখন অনেকরকম মানে হয়। যাকগে, কথা হচ্ছিল কাকতালীয় নিয়ে।

জোজো বলল, তালীয় মানে তালের ব্যাপার? মানে তাল ফল? আমার ধারণা ছিল গানের তাল। কিংবা এক হাতে তালি বাজে না, সেই তালি।

কাকাবাবু বললেন, না। পাকা তাল গাছ থেকে আপনি আপনি খসে পড়ে। মনে করো, একটা তালগাছে একটা কাক বসে আছে। এক সময় কাকটা যেই উড়ে গেল, অমনই ধুপুস করে একটা পাকা তাল খসে পড়ল। কাকটা ভাবল, সে উড়ল বলেই খসে পড়ল তালটা। তা কিন্তু নয়, ওই সময় তালটা এমনই পড়ত। অর্থাৎ একই সঙ্গে দুটো ঘটনা ঘটল, কিন্তু তাদের মধ্যে কোনও সম্পর্ক নেই। ইংরেজিতে যাকে বলে কয়েনসিডেন্স!

জোজো বলল, ও কয়েনসিডেন্স? এরকম তো অনেকই হয়।

কাকাবাবু বললেন, সেইরকমই, বড় জুলপিওয়ালা লোকটাকে কাল এয়ারপোর্টে দেখা গেছে, আজ আবার সে আমাদের সঙ্গে এই প্লেনে চেপেছে, এর মধ্যে হয়তো কোনও যোগাযোগ নেই। যেতেই তো পারে।

জোজো জিজ্ঞেস করল, সাধলে জামাই… পুরো কথাটা কী রে সন্তু?

সন্তু বলল, সাধলে জামাই খায় না কাঁঠাল, ভুচড়ো নিয়ে টানাটানি!

জোজো বলল, বেশ কথাটা। আমার মনে পড়ল, একবার স্পেনের রাজা আমাদের নেমন্তন্ন করেছিল, কী দারুণ দারুণ সব খাবার। বাবা বলে দিয়েছিলেন, হ্যাংলার মতন সবকিছু খাবে না, আর কোনও জিনিসই দুবার দিতে এলে নেবে না। বাবা যেগুলো না না বলছেন, আমিও লাগবে না বলছি। একটা খাবার দেখে এমন লোভ হয়েছিল, ছোট ছোট হাঁস, আস্ত রোস্ট করা, বাবা মাথা নেড়ে দিতেই বাধ্য হয়ে আমিও…

সন্তু বলল, রাত্তিরে বুঝি সেই হাঁসের পালকগুলো খেলি?

এর মধ্যেই ঘোষণা করা হল, প্লেন কালিকটে নামছে।

সন্তু আর জোজো জানলা দিয়ে তাকাল বাইরে।

পরিষ্কার রোদঝলমলে দিন। নীচে দেখা যাচ্ছে সমুদ্র। একদিকে ভারতের সীমারেখা। ম্যাপে যেরকম দেখা যায়। এখানে এত সবুজ গাছপালা যে, বাড়িঘর চোখেই পড়ে না।

এয়ারপোর্ট থেকে কাকাবাবু একটা গাড়ি ভাড়া করলেন।

সন্তু সেই বড় জুলপিওয়ালা লোকটির দিকে নজর রেখেছে। সে ওদের দিকে তাকাচ্ছেই না। গাড়িতে ওঠার আগে সন্তু ইচ্ছে করে লোকটির পাশে গিয়ে একটা ধাক্কা লাগিয়ে বলল, খুব দুঃখিত, মাপ করবেন।

লোকটি হিন্দিতে বলল, ঠিক হ্যায়, কুছ নেই হুয়া।

ফিরে এসে গাড়িতে উঠে সন্তু বলল, লোকটি বাঙালি নয়। তবু কাল রাত্তিরে এয়ারপোর্টে অমলদার পাশে দাঁড়িয়ে আমাদের কথা শুনছিল কেন?

কাকাবাবু বললেন, শুনছিল, না দেখছিল?

সন্তু বলল, কী দেখছিল?

কাকাবাবু বললেন, আমি খোঁড়া লোক বলে অনেকেই আমার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে।

জোজো বলল, ছাড় তো সন্তু। তুই লোকটাকে নিয়ে বেশি বেশি ভাবছিস। কাকতালীয়ই ঠিক!

আগে থেকে হোটেল ঠিক করা ছিল না। দু-তিনটে হোটেল ঘুরে একটা পছন্দ হয়ে গেল। হোটেলটা একেবারে নতুন, সেইজন্যই ঝকঝকে পরিষ্কার। ঘরগুলো বড় বড়। একটা ঘরের নাম ফ্যামিলি রুম, সেখানে চারজন শুতে পারে। সেই ঘরটাই নেওয়া হল।

জিনিসপত্র গুছিয়ে ফেলার পর কাকাবাবু বললেন, গাড়িটা সারাদিনের জন্য ভাড়া করা হয়েছে, চল, এই শহরটা আর কাছাকাছি জায়গাগুলো একটু ঘুরে দেখে আসি৷

ড্রাইভারের নাম অ্যান্টনি। ত্রিশ-বত্রিশ বছর বয়েস, কুচকুচে কালো গায়ের রং, মাথায় ঝাঁকড়া ঝাঁকড়া চুল। সে ভাঙা-ভাঙা ইংরেজি জানে।

শহরটাতে সত্যি দেখার মতন কিছু নেই। ছোট শহর যেমন হয়। কিছু অফিসটফিস, দোকানপাট আছে। শহরের বাইরেটা ঢেউখেলানো। ছোট ছোট পাহাড় আর প্রচুর নারকোল গাছ। এক এক জায়গায় মনে হয় যেন নারকোল গাছের জঙ্গল।

গরমও প্রচণ্ড। সেইসঙ্গে ঘাম। গাড়ির সবকটা জানলার কাচ নামানো, কিন্তু হাওয়া নেই, দরদর করে ঘামতে হচ্ছে।

জোজো বলল, অমলদা তো ঠিকই বলেছিল। এখানে নারকোল গাছ আর গরম ছাড়া কিছুই নেই। খুব জলতেষ্টা পাচ্ছে।

রাস্তার ধারে ধারে ডাব বিক্রি হচ্ছে। এক জায়গায় গাড়ি থামানো হল।

ডাবওয়ালা দৌড়ে এসে বলল, টেন্ডার কোকোনাট। ভেরি গুড।

তার মানে ডাবের জল খাওয়ার পর সেটা কেটে দিল। ভেতরে নরম নেওয়া। খেতে খুব ভাল।

ড্রাইভার অ্যান্টনি বলল, আপনারা চিকিৎসা করাতে এসেছেন তো? আমি খুব ভাল নার্সিং হোমে নিয়ে যেতে পারি।

কাকাবাবু সন্তুদের বললেন, শুনেছিলাম বটে যে এখানকার কাছাকাছি একটা জায়গায় খুব ভাল কবিরাজি চিকিৎসা হয়। সারা ভারতের দূর দূর জায়গা থেকে শক্ত শক্ত অসুখের রুগিরা এখানে চিকিৎসা করাতে আসে। আমার খোঁড়া পা দেখে ধরে নিয়েছে, আমি এটা সারাতে এসেছি।

তিনি অ্যান্টনিকে বললেন, সেখানে পরে যাওয়া যাবে। এখন গরমে আর টেকা যাচ্ছে না, তুমি হোটেলে ফিরে চলল।

হোটেলের ঘরটা এয়ার কন্ডিশনড। সেখানে ফিরে বেশ আরাম হল।

কাকাবাবু বললেন, এ যা দেখছি, সারাদিন ঘরেই বসে থাকতে হবে। এ গরমে ঘোরাঘুরি করা যাবে না। সন্ধের পর গরম কমে কি না দেখা যাক।

জোজো বিছানায় শুয়ে পড়েছে।

সন্তুও দমে গেছে খানিকটা। এ-জায়গাটা সত্যিই বেড়াবার মতন নয়। বিশেষত গরমকালে। এর চেয়ে চেরাপুঞ্জি গেলে কত ভাল লাগত। সেখানে গরম নেই, যখন-তখন বৃষ্টি হয়। তবু কাকাবাবু এখানেই এলেন কেন?

সে জিজ্ঞেস করল, কাকাবাবু, তুমি সত্যিই ভূতে বিশ্বাস করো?

কাকাবাবু বললেন, বিশ্বাস থাক বা না থাক, ভূতের গল্প শুনতে বেশ ভাল লাগে। তাই না?

জোজো বলল, আমি কিন্তু ভূত দেখেছি। তিনবার। একবার মেক্সিকোতে, একবার কাঠমাণ্ডুতে, আর একবার… ইয়ে অস্ট্রেলিয়ায়…

সন্তু জোজোর দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করল, তুই বাঙালি ভূত দেখিসনি?

জোজো বলল, হ্যাঁ, কাঠমাণ্ডুর ভূতটা বাংলায় কথা বলছিল। তবে মজা কী জানিস, বাবা আমাকে মন্ত্ৰপড়া একটা সুপুরি দিয়েছেন, সেটা তুলে ধরলেই ভূতগুলো একেবারে ভেঙে গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে যায়।

সন্তু বলল, কাচের মতন?

জোজো বলল, অনেকটা কাচের মতন, তবে দেখতে দেখতে মিলিয়ে যায়। হাতে ধরা যায় না।

কাকাবাবু বললেন, বাঃ। সেই সুপুরিটা সঙ্গে এনেছ তো? এখানে কাজে লাগতে পারে।

সন্তু বলল, কাকাবাবু, আমি আগে কক্ষনও তোমার কাছে ভূত-টুতের কথা, শুনিনি। কেউ ভূতের কথা বললে, তুমি হেসে উড়িয়ে দিতে।

কাকাবাবু বললেন, মানুষ মরে গেলে তাকে পুড়িয়ে দেওয়া হয়, কিংবা কবর দেওয়া হয়। সেখানেই সব শেষ। তার পরেও কিছু আছে কি না, তার কোনও স্পষ্ট প্রমাণ এ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। সেইজন্যই অনেকে ভূত-পেত্নি, স্বর্গ-নরক— এসবে বিশ্বাস করে না। আবার অনেকে মনে করে, মৃত্যুতেই সব শেষ নয়, পুনর্জন্ম আছে, স্বর্গ-নরক আছে। আমি প্রথম দলে। কিন্তু অনেক লোক মিলে যদি বলে তারা একজন মৃত মানুষকে চলাফেরা করতে দেখেছে, সেই অনেক মানুষের মধ্যে বেশ কিছু শিক্ষিত, দায়িত্বপূর্ণ লোকও থাকে, তা হলে সেই ঘটনাটা সঠিকভাবে জানার জন্য কৌতূহল হবে না?

সন্তু আবার বলল, তার সঙ্গে এখানে আসার সম্পর্ক কী?

কাকাবাবু বললেন, এটা কত সাল। ১৯৯৮ তো? আজ কত তারিখ? ২৩ মে? ঠিক পাঁচশো বছর আগে, অর্থাৎ ১৪৯৮ সালে, এই দিনটিতে ভাস্কো দা গামা কালিকট বন্দরে জাহাজ ভিড়িয়েছিল।

সন্তু তবু ভুরু কুঁচকে বলল, ঠিক বুঝলাম না। তেইশে মে এখানে কোনও উৎসব হয়?

কাকাবাবু বললেন, না, না, উৎসব হবে কেন? ভাস্কো দা গামা ভারতের বহু ক্ষতি করেছে, বহু লোককে মেরেছে, তাকে নিয়ে আবার উৎসব কীসের?

জোজো বলল, বুঝলি না, ভাস্কো দা গামা ভূত হয়ে এই দিনটায় ফিরে আসে।

কাকাবাবু বললেন, জোজো ঠিক ধরেছে। এখানে অনেকের ধারণা, প্রতি বছর তেইশে মে ভাস্কো দা গামাকে দেখা যায়। বেশ অনেকক্ষণ ধরে। গত বছর প্রায় দেড়শোজন তোক দেখেছে। তাদের মধ্যে আছে একজন ইতিহাসের অধ্যাপক, একজন পুলিশের কর্তা, দুজন সাংবাদিক, একজন ডাক্তার। অন্তত চোদ্দোপনেরোজন চিঠি লিখে কিংবা টেলিফোন করে ঘটনাটা আমাকে জানিয়েছে। এই লোকেরা কি নেহাত একটা আজগুবি কথা রটাবে?

সন্তু বলল, এরা সবাই… এত দূর থেকে তোমাকে ঘটনাটা জানাল কেন? তুমি তো ভূত ধরার ওঝা নও!

কাকাবাবু হাসতে হাসতে বললেন, ঠিক বলেছিস। আমার বদলে বরং জোজোকে জানানো উচিত ছিল। জোজো মন্ত্র পড়া সুপুরি দেখিয়ে ভাস্কো দা গামার ভূতকে গুঁড়ো গুঁড়ো করে দিত। তবে জোজোকে তো এরা এখনও চেনে না। আমাকে জানাবার একটা কারণ আছে অবশ্য। তোরা তো জানিস, আমি ইতিহাস নিয়ে পড়াশুনা করতে ভালবাসি। মাঝে মাঝে দু-একটা প্রবন্ধও লিখি। গত বছর আমি বম্বের একটা কাগজে একটা প্রবন্ধ লিখেছিলাম, সেটার নাম ছিল, ভাস্কো দা গামা কি খুন হয়েছিলেন? খুব আলোচনা হয়েছিল সেটা নিয়ে। অনেক লোক আমার পক্ষে-বিপক্ষে চিঠি লিখেছিল।

সন্তু জিজ্ঞেস করল, ভাস্কো দা গামা সত্যি খুন হয়েছিলেন?

কাকাবাবু বললেন, স্পষ্ট কোনও প্রমাণ নেই। তবে এদেশে তার অনেক শত্রু ছিল। আরব ব্যবসায়ীদের সঙ্গে তার ঝগড়া মারামারি হয়েছে অনেকবার। লোকটা ছিল খুব অহঙ্কারী আর নিষ্ঠুর ধরনের। এমনকী তার নিজের দেশের অনেক লোকও তাকে পছন্দ করত না। পর্তুগিজরা ক্রমে ক্রমে কোচিন, গোয়া এইসব জায়গা দখল করে বসে। সেখানে অনেক পর্তুগিজ কর্মচারী ছিল, তারা অনেকে ভাস্কো দা গামার ব্যবহার সহ্য করতে পারত না। ভাস্কো দা গামা মারা যায় কোচিনে, এক ক্রিসমাসের দিনে। জানিস তো, ক্রিসমাসের আগের রাত্তিরে খুব বড় পার্টি হয়। মদ খেয়ে হইহল্লা করার সময় কেউ তার পেটে একটা ছুরি বসিয়ে দিতেও পারে।

সন্তু বলল, ভাস্কো দা গামা মারা গেল কোচিনে। ভূত হয়ে থাকলে তো তাকে। সেখানেই দেখতে পাওয়ার কথা। এখানে আসবে কেন?

কাকাবাবু বললেন, কোচিনেই তাকে কবর দেওয়া হয়েছিল বটে, কিন্তু কিছুদিন পরে তার হাড়গোড় সেখান থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। পর্তুগালে। সেখানে আবার কবর দেওয়া হয়। সেখান থেকে সাগর পেরিয়ে ভূতটা আসে, প্রথম যেখানে এসেছিল।

সন্তু বলল, পাঁচশো বছরের বুড়ো ভূত!

কাকাবাবু বললেন, ভূতেরা নাকি বুড়ো হয় না। এখানে যারা দেখেছে, তারা নাকি ভাস্কো দা গামাকে আগের চেহারাতেই দেখেছে।

জোজো বলল, ভাস্কো দা গামার ভূতটাকে জিজ্ঞেস করলেই তো হয়, তুমি কি খুন হয়েছিলে? না এমনি এমনি মরেছ?

কাকাবাবু বললেন, ঠিক বলেছ। আজ মাঝরাত্তিরে একবার যেতে হবে পোর্টে, সেখানেই যাকে বলে চক্ষুকর্ণের বিবাদ ভঞ্জন করা যাবে।

জোজো বলল, কী বললেন? কী বললেন? ওই কথাটার মানে কী?

সন্তু বলল, এর মানে আমি জানি। কান আর চোখ। লোকে অনেক কিছু বলে, তা আমরা কান দিয়ে শুনি কিন্তু চোখে তা দেখা না গেলে বিশ্বাস হয় না। এই নিয়ে চোখ আর কানের ঝগড়া। কানে যা শোনা যায়, চোখের দেখাতেও তা মিলে গেলে ঝগড়া মিটে যায়। তাকে বলে বিবাদ ভঞ্জন।

কাকাবাবু বললেন, এটা আগেকার বাংলা, এখন আর বিশেষ কেউ বলে না বা লেখে না। তবে মাঝে মাঝে শুনতে বেশ লাগে। তোদের খিদে পায়নি? এবারে কিছু খেলে হয়।

জোজো বলল, খিদে পায়নি মানে? পেটে আগুন জ্বলছে। এখানে নিশ্চয়ই চিংড়ি মাছ পাওয়া যায়?

কাকাবাবু বললেন, দেখা যাক। পাওয়া উচিত।

তিনি বেল বাজিয়ে বেয়ারাকে ডেকে খাবারের অর্ডার দিতে গেলেন।

বেয়ারাটি বলল, এই হোটেলে ঘরে খাবার এনে দেওয়ার নিয়ম নেই। একতলায় ডাইনিং হল আছে, সেখানে গিয়ে খেতে হবে।

ঘর বন্ধ করে ওরা নেমে এল নীচে। মস্ত বড় ডাইনিং হল। কয়েকটা টেবিলে কিছু লোক খেতে শুরু করেছে। কোণের একটা টেবিলে এক ঝলক তাকিয়েই সন্তু বলল, সেই বড় জুলপিওয়ালা লোকটা এখানেও এসেছে।

সত্যিই সেই লোকটি আর দুজন লোকের সঙ্গে বসে আছে। সামনে জলের গেলাস, এখনও টেবিলে খাবার দেয়নি।

সন্তু বলল, এটাও কি কাকতালীয়?

কাকাবাবু বললেন, হতেও পারে। হয়তো এই হোটেলের খাবার বিখ্যাত। অনেকেই খেতে আসে।
খাবারের তালিকা দেখে জোজো খুব নিরাশ হয়ে গেল।

চিংড়ি মাছ তো নেই-ই, কোনওরকম মাছ-মাংসই পাওয়া যাবে না। এই হোটেলে সবই নিরামিষ। ইডলি, বোসা, সম্বর এইসব, ভাতও আছে।

কাকাবাবু বললেন, এবেলা এইসবই খেয়ে দেখা যাক। বাইরে অনেক রেস্তরাঁ আছে। রাত্তিরে সেরকম কোনও জায়গা থেকে খেয়ে এলেই হবে।

সন্তু বলল, আমি ধোসা খুব পছন্দ করি।

খাবারগুলোর বেশ স্বাদ আছে। ভাতের সঙ্গে একটা তরকারি ছিল, টক-টক-ঝাল-ঝাল, চমৎকার খেতে। জোজো তিনবার চেয়ে নিল সেই তরকারি।

সন্তু মাঝে মাঝে চোরা চোখে দেখছে কোণের টেবিলটা, বড় জুলপিওয়ালা লোকটি এদিকেই তাকিয়ে আছে, তার সঙ্গীদের কী যেন বলছে ফিসফিস করে।

সন্তুদের খাওয়া শেষ হওয়ার পরেও ওরা বসে রইল।

হাত ধুয়ে ওপরে উঠে আসার পর কাকাবাবু বললেন, তোরা দুজনে গড়িয়ে নিতে চাস তো নে। আমাকে কয়েকটা ফোন করতে হবে।

কাকাবাবু ব্যাগ থেকে নোটবইটা খুঁজতে লাগলেন। এই সময় দরজায় টক টক শব্দ হল।

সন্তু দরজা খুলে অবাক হলেও মুখে কোনও ভাব দেখাল না।

সেই বড় জুলপিওয়ালা লোকটি ও আর দুজন লোক দাঁড়িয়ে আছে।

বড়জুলপি হিন্দিতে বলল, একটু ভেতরে আসতে পারি? তোমার আঙ্কেলের সঙ্গে দুটো-একটা কথা বলতে চাই।

সন্তু দরজার পাশ থেকে সরে দাঁড়াল।

প্রথমে বড়জুলপি ভেতরে ঢুকে কাকাবাবুর দিকে হাত তুলে নমস্কার করে খুব বিনীতভাবে বলল, সার, খুবই দুঃখিত, অসময়ে এসে আপনাকে ডিসটার্ব করলাম। হয়তো এখন বিশ্রাম নিতেন। খুব বিপদে পড়ে আপনার সাহায্য চাইতে এসেছি। যদি অনুমতি করেন—

কাকাবাবু বললেন, না, না, ঠিক আছে। বসুন। কী ব্যাপার বলুন।

ঘরে একটিমাত্র চেয়ার। বড়জুলপি বসল সেখানে। অন্য দুজন খাটে।

বড়জুলপি পকেট থেকে এখটা কার্ড বার করে বলল, সার, আমার নাম এস প্রসাদ। আমি একটা ফিল্ম কোম্পানির প্রোডাকশন ম্যানেজার। বম্বে থেকে এসেছি। এখানে আমাদের একটা হিন্দি ফিমের শুটিং চলছে। সেই ব্যাপারে আপনার একটু সাহায্য চাই।

কাকাবাবু বললেন, ফিল্‌মের শুটিংয়ের ব্যাপারে আমি কী সাহায্য করব তা তো বুঝতে পারছি না?

প্রসাদ বলল, আপনার সঙ্গে যে ছেলেদুটি এসেছে, এদের একজনকে পেলে বড় উপকার হয়।

সে জোজোর দিকে ফিরে তাকাল।

কাকাবাবু বললেন, ও কী করবে?

সে বলল, ব্যাপারটা কী হয়েছে, একটু খুলে বলি। আজকের রাত্তিরের শুটিংয়ে এই ছেলেটির বয়েসি একটি ছেলের পার্ট আছে। যে ছেলেটির সেই পার্ট করার কথা, আজ সকাল থেকে তার কলেরা শুরু হয়ে গেছে, তাকে হাসপাতালে পাঠাতে হয়েছে। সে কিছুতেই পারবে না। শুটিং বন্ধ রাখলে আমাদের বহু টাকা লোকসান হয়ে যাবে। তাই বলছিলাম কী, এই ছেলেটি যদি পার্টটা করে দেয়, তা হলে বেঁচে যাই। ওই পার্টে ওকে খুব মানাবে।

কাকাবাবু হেসে ফেলে বললেন, ও, এই ব্যাপার! তা হলে ওকেই জিজ্ঞেস করা যাক। কী হে জোজো, সিনেমায় পার্ট করবে নাকি?

জোজো গম্ভীরভাবে বলল, কী ধরনের পার্ট আগে শুনি?

প্রসাদ বলল, হিরোইন একটা খুঁটিতে দড়ি দিয়ে বাঁধা থাকবে। রাত্তিরে ডাকাতের দল ঘুমোবে। শুধু পাহারায় থাকবে একজন। তুমি পেছন দিক দিয়ে হামাগুঁড়ি দিয়ে আসবে। পাহারাদারটাও ঝিমোচ্ছে। তুমি হিরোইনের বাঁধন খুলে দেবে। তারপর তার হাত ধরে দৌড়াবে। জঙ্গলের মধ্য দিয়ে দৌড়বে দৌড়বে। কাট। ব্যস, তারপর হিরো ঘোড়ায় চড়ে এসে হিরোইনকে তুলে নেবে।

জোজো অবজ্ঞার সঙ্গে ঠোঁট উলটে বলল, এইটুকু পার্ট! এর মধ্যে আমি নেই।

প্রসাদ বলল, একটু করে দাও না ভাই!

জোজো বলল, হলিউড থেকে স্পিলবার্গ কতবার আমাকে অনুরোধ করেছে। আমি বলেছি, ছোট পার্ট কক্ষনও করব না। যদি সিনেমায় পার্ট করতেই হয়, প্রথমেই হিরো হব।

প্রসাদ বলল, তোমার বয়েসে তো হিরো হতে পারবে না। আগে ছোটখাটো পার্ট করার পরই হিরো হতে পারবে। এটায় যদি তোমার পাৰ্ট চোখে লেগে যায়—

জোজো বলল, না, না, যারা ছোটখাটো পার্ট করে, তারা চিরকালই ছোটই থেকে যায়।

প্রসাদের সঙ্গী একজন বলল, টাকার কথাটা বলো।

প্রসাদ বলল, মাত্র একদিনের শুটিং, তিন-চার ঘণ্টা, তার জন্য পাঁচ হাজার টাকা দেওয়া হবে।

জোজো তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলল, টাকার দরকার নেই আমার। হলিউডে ওইটুকু পার্ট করলে পাঁচ লাখ টাকা দেয়, সেটাই আমি নিইনি—

লোকটি আরও কয়েকবার অনুরোধ করল, জোজো কানই দিল না।

তখন সে সন্তুর দিকে ফিরে বলল, তা হলে তুমি করে দেবে পার্টটা? তোমাকে দিয়েও চলবে।

সন্তু বলল, আ-আ-আমি তো-তো-তো-তোতলা। ক-ক-ক-কথা বলতেই পা-পা-পা-পারি না!

প্রসাদ একটু চমকে গেলেও বলল, তাতে ক্ষতি নেই। ডায়ালগ খুব কম। পরে ডাব করে নেওয়া যেতে পারে।

সন্তু বলল, আ-আ-আ-আমার ভ-ভ-ভয় করে। ক্যা-ক্যা-ক্যামেরা দেখলেই ভ-ভ-ভয় করে।

প্রসাদ কাকাবাবুর দিকে তাকাল।

কাকাবাবু বললেন, ওরা রাজি না হলে আর আমি কী করতে পারি বলুন! আমাকে দিয়ে তো আর ওই পার্ট হবে না। লোক তিনটি নিরাশ হয়ে চলে গেল।

দরজা বন্ধ করার পরই কাকাবাবু হো-হো করে হেসে উঠলেন। হাসতে হাসতে বললেন, শেষ পর্যন্ত এই? সিনেমায় পার্টের ব্যাপার। ওরে সন্তু, তোর ওই বড়-জুলপিওয়ালাটা তো নিরীহ সিনেমার লোক!

সন্তু জোজোকে বলল, তুই রাজি হলি না কেন রে? আমরা বেশ শুটিং দেখতে যেতাম।

জোজো বলল, ওইসব এলেবেলে পার্ট আমি করি না।

সন্তু বলল, হিরোইনের সঙ্গে পার্ট ছিল। হিরোইনের হাত ধরে দৌড়োতি। তাতেই লোকে তোকে হিরো বলত!

জোজো বলল, তোকেও তো বলেছিল। তুই নিলি না কেন? তুই হঠাৎ তোতলা সাজতে গেলি?

সন্তু বলল, পাঁচ হাজার টাকা পেলে আমার ভালই হত। রাজি হতাম। কিন্তু লোকটা আগে তোকে বলেছে, আমায় তো বলেনি! সেইজন্যই আমার রাগ হয়ে গেল।

কাকাবাবু বললেন, আমায় তো পার্ট দিতে চাইলই না। কলেজে পড়ার সময় দু-তিনবার নাটকে অভিনয় করেছি! খোঁড়া লোককে আর কে চান্স দেবে!

কাকাবাবু এবার টেলিফোন তুলে একটা লাইন চাইলেন।

একটু পরে অপারেটর জানাল যে, নম্বরে নিশ্চয়ই কিছু ভুল আছে। কোনও সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছে না।

কাকাবাবু বললেন, ভুল আছে? এঁর নাম আবু তালেব, ইতিহাসের অধ্যাপক। আমাকে দু-তিনবার ফোন করেছেন এখান থেকে, নিজে এই নম্বর দিয়েছেন। তা হলে কি নম্বর বদলে গেল?

অপারেটর জানালেন, টেলিফোন বইতে আবু তালেবের নাম নেই।

কাকাবাবু বললেন, মুশকিল হল, লোকটিকে খুঁজে পাব কী করে?

তিনি বললেন, আর একটা নম্বর দেখুন। বিক্রমন নায়ার। ইনি একজন সাংবাদিক। এটা ওঁর বাড়ির ফোন।

এবারে রিং হল বটে। কিন্তু একজন কেউ ধরে বলল, এখানে বিক্রমন নায়ার নামে কেউ থাকে না।

কাকাবাবু খানিকক্ষণ ভুরু কুঁচকে রইলেন। তারপর একজন পুলিশ অফিসারের নম্বর দিলেন, তাতেও কোনও লাভ হল না, সাড়া পাওয়া গেল না।

কাকাবাবু বললেন, এখানকার সব টেলিফোন নাম্বার বদলে গেল নাকি? এরাই বলতে গেলে আমাকে ডেকে এনেছে। এদের দু-একজনের সঙ্গে যোগাযোগ করা দরকার।

ক্রাচ দুটো নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে তিনি সন্তুদের বললেন, এই গরমে তোদের আর বেরোতে হবে না। আমি একটু ঘুরে আসছি।

নীচে এসে তিনি অ্যান্টনিকে বললেন, চলো তো এখানকার বড় থানায়।

গরমের জন্য রাস্তা একেবারে সুনসান। থানার সামনেও বেশি লোকজন নেই।

কাকাবাবু সোজা ভেতরে ঢুকে গেলেন, কেউ বাধা দিল না। বড়সাহেবের ঘরের দরজা খোলা, সেখানে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ভেতরে আসতে পারি?

কাকাবাবুর চেহারাতেই এমন একটা ব্যক্তিত্বের ছাপ আছে যে কেউ তাঁকে সাধারণ মানুষ মনে করে না। অফিসারটি বললেন, হ্যাঁ, আসুন, বসুন।

কাকাবাবু ভেতরে এসে বললেন, নমস্কার। সার্কল অফিসার বাসুদেবন-এর সঙ্গে একটু দেখা করতে পারি?

অফিসারটি বললেন, কোন বাসুদেবন?

কাকাবাবু বললেন, এস কে বাসুদেবন।

অফিসারটি বললেন, ওই নামে তো এখানে কেউ নেই।

কাকাবাবু বললেন, নেই? তা হলে কি ট্রান্সফার হয়ে গেছেন? আমি পনেরোদিন আগেও টেলিফোনে কথা বলেছি।

অফিসারটি বললেন, আমি এখানে আড়াই বছর আছি। ওই নামে কোনও সার্কল অফিসার কিংবা কোনও অফিসারই ছিল না। আপনি যার সঙ্গে কথা বলেছেন, সে কি পুলিশ হিসেবে নিজের পরিচয় দিয়েছে?

কাকাবাবু বললেন, হ্যাঁ। ফোন করেছেও থানা থেকে। বেশ কয়েকবার।

অফিসারটি জিজ্ঞেস করলেন, আপনার পরিচয়টা জানতে পারি?

কাকাবাবু নাম বললেন, পরিচয় দিলেন। অফিসারটি চিনতে পারলেন না। তিনি আবার জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কি ওই বাসুদেবন নামের লোকটিকে কখনও এই থানায় ফোন করেছেন কলকাতা থেকে?

কাকাবাবু বললেন, না, তা অবশ্য করিনি। উনি নিজেই করতেন।

অফিসারটি খুবই কৌতূহলী হয়ে বললেন, ব্যাপারটা বুঝতে পারছি না। একজন লোক মিথ্যে পরিচয় দিয়ে আপনাকে ফোন করেছে। কী মতলব? কী বলেছে আপনাকে?

কাকাবাবু কোনও উত্তর দিলেন না। পকেট থেকে একটা কাগজ বার করলেন। তাতে পনেরোজন লোকের নাম লেখা। সেই কাগজটা এগিয়ে দিয়ে বললেন, দেখুন তো, এঁদের কাউকে আপনি চেনেন কি না?

অফিসারটি দু-তিনবার সেই তালিকায় চোখ বুলিয়ে বললেন, এইসব নামের কোনও লোক কালিকটে থাকে না। আপনি নামগুলোর পাশে পাশে লিখেছেন, কেউ অধ্যাপক, কেউ সাংবাদিক, কেউ ডাক্তার। অন্তত কয়েকজনকে আমার চেনা উচিত ছিল। সাংবাদিকদের প্রত্যেককে চিনি। বিক্রমন নায়ার নামে কোনও সাংবাদিক এখানে থাকে না। তা জোর দিয়ে বলতে পারি।

কাকাবাবু বললেন, আশ্চর্য, বিক্রমন নায়ার নামে একজন আমাকে এখান থেকেই ফোন করেছে।

আর একজন তরুণ পুলিশ অফিসার এই সময় একটা ফাইল নিয়ে ঢুকে টেবিলের কাছে এসে থমকে গেলেন। কাকাবাবুর দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, আপনি…আপনি রাজা রায়চৌধুরী না?

কাকাবাবু মাথা নাড়লেন।

সেই অফিসারটি বললেন, দিল্লিতে নরেন্দ্র ভার্মার বাড়িতে আপনাকে দেখেছি। আমি ওঁর বোনের ছেলে। অর্থাৎ উনি আমার মামা। ওঁর কাছে আপনার অনেক গল্প শুনেছি। আমার নাম ওম প্রকাশ।

কাকাবাবু বললেন, নরেন্দ্র ভার্মা আমার বিশেষ বন্ধু।

ওম প্রকাশ অন্য অফিসারের দিকে ফিরে বললেন, সার, রাজা রায়চৌধুরী বিখ্যাত লোক। অনেক দারুণ রহস্যের সমাধান করেছেন। বহু অভিযানে গেছেন।

এর একটা ডাকনাম আছে, অনেকেই এঁকে কাকাবাবু বলেন।

অফিসারটি কাকাবাবুর দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, আপনার সঙ্গে আলাপ করে খুশি হলাম। আমার নাম রফিক আলম। আমরা আপনাকে সাহায্য করতে পারলে খুবই খুশি হব।

ওম প্রকাশ বললেন, কাকাবাবু, আপনি কি এখানে কোনও রহস্য সমাধান করতে এসেছেন?

কাকাবাবু এবারে চেয়ারে হেলান দিয়ে হাসলেন।

ওম প্রকাশের দিকে তাকিয়ে বললেন, সেরকম কোনও উদ্দেশ্য নিয়ে আসিনি। কিন্তু আসবার পরে খুব ধাঁধায় পড়ে গেছি। কালিকট থেকে বেশ কয়েকজন লোক ফোন করে একটা ব্যাপার জানিয়েছে। ফোন করেছে, চিঠিও লিখেছে। কিন্তু রফিক আলম সাহেব বলছেন, এখানে সেরকম কোনও লোকই নেই। বাসুদেবন নামে একজন লোক এখানকার পুলিশ অফিসার বলে পরিচয় দিয়েছেন।

ওম প্রকাশ কাগজটা নিয়ে নামগুলো পড়তে পড়তে বললেন, আমিও তো এদের কাউকেই চিনি না। বাসুদেবনটা আবার কে?

রফিক আলম বললেন। এই লোকেরা ফোন করে আপনাকে কী বলেছে?

কাকাবাবু বললেন, সে ব্যাপারটা শুনলে হয়তো আপনারা হাসবেন। আমি বম্বের একটা কাগজে ভাস্কো দা গামা সম্পর্কে একটা প্রবন্ধ লিখেছিলাম। তাতে অনেকে ধরে নিয়েছে, আমি ভাস্কো দা গামা সম্পর্কে একজন বিশেষজ্ঞ। সেইজন্যই কালিকট থেকে কয়েকজন লোক বারবার আমাকে একটা কথা জানিয়েছে।

আলম বললেন, সেই কথাটা কী?

কাকাবাবু বললেন, প্রতি বছর এই দিনটাতে নাকি এখানকার বন্দরে ভাস্কো দা গামার ভূত দেখা যায়!

আলম আর প্রকাশ পরস্পরের দিকে তাকালেন।

কাকাবাবু বললেন, জানি, আপনারা ভাবছেন, ভূতের গল্পে বিশ্বাস করে আমি এতদূর ছুটে এসেছি, তার মানে আমি একজন বোকা লোক! বিশ্বাসের কোনও প্রশ্নই নেই। তবে একজন-দুজন নয়, পনেরোজন লোক, তারা সমাজের বিশিষ্ট লোক, এরা সবাই মিলে একই কথা বললে খটকা লাগে না? এরা অনেকেই জানিয়েছে যে, এরাও ভূত-টুতে বিশ্বাস করে না, কিন্তু নিজের চোখে দেখেছে। ভাস্কো দা গামার ভূত। আবার সেই ভূত নাকি বিড় বিড় করে কীসব কথাও বলে।

আলম বললেন, আমরা তো এরকম কখনও কিছু শুনিনি। প্রতি বছর এরকম কিছু ঘটলে পুলিশের কানে আসত না?

প্রকাশ বললেন, যে-লোকগুলোর নাম লিখে এনেছেন, তাদের কোনও অস্তিত্ব নেই। এরাই তো দেখছি আসল ভূত!

আলম বললেন, ফোন নম্বর রয়েছে। ফোন করে দেখা যেতে পারে। আমরা চিনলেও যদি কেউ থাকে।

কাকাবাবু বললেন, কয়েক জায়গায় আমি ফোন করেছি। প্রত্যেকটি নম্বরই ভুল। এখন বোঝা যাচ্ছে, কেউ আমার সঙ্গে প্র্যাকটিক্যাল জোক করেছে। এতবার ফোন করে, চিঠি লিখে এতদূর টেনে এনে বোকা বানিয়েছে।

আলম বললেন, আপনি এখানে আসবার আগে একবার ফোন করে কনফার্ম করেননি?

কাকাবাবু বললেন, না, করিনি। আমি তো জানিই, এ-ভূতের গল্প সত্যি হতে পারে না। হয়তো নকল কাউকে ভূত-টুত সাজায়। এমনিই কোথাও বেড়াতে যাওয়ার ইচ্ছে হয়েছিল, তাই ভাবলাম, একবার এখানে এসে মজাটা দেখাই যাক না! এখন বুঝতে পারছি, আমাকে নিয়েই অন্য কেউ কেউ মজা করেছে।

আলম বললেন, এবারে একটু চা খাওয়া যাক। যে আপনার সঙ্গে প্র্যাকটিক্যাল জোক করেছে, সে নিশ্চয়ই পরে আপনার সঙ্গে দেখা করে খুব হাসবে।

চা বিস্কুট খেতে খেতে কিছুক্ষণ গল্প হল।

হোটেলে ফিরে কাকাবাবু দেখলেন, সন্তু আর জোজো দিব্যি ঘুমোচ্ছে। তিনি ওদের জাগালেন না। গরম থেকে এসে হোটেলের ঠাণ্ডা ঘরে বেশ আরাম হল, তিনিও শুয়ে পড়লেন।

ঘুম ভাঙল সন্ধেবেলা।

জোজো সবচেয়ে আগে উঠেছে, সে একটা কেক খাচ্ছে।

কাকাবাবুকে চোখ মেলতে দেখে সে বলল, দুপুরে নিরামিষ খেয়েছি তো, তাই খিদে পেয়ে গেল। হোটেলের সামনেই একটা দোকানে কেক পাওয়া যায়। কিনে আনলাম। কেকের মধ্যেও নারকোল। এটা একেবারে নারকোলের দেশ!

সন্তু একটা কেকে কামড় দিয়ে বলল, খেতে খারাপ নয়!

জোজো বলল, কাকাবাবু, দুপুরের স্বপ্ন কি সত্যি হয়?

কাকাবাবু বললেন, দুপুরে স্বপ্ন দেখেছ তুমি?

জোজো বলল, ভাস্কো দা গামাকে স্বপ্ন দেখলাম। একেবারে স্পষ্ট। বন্দরে একটা মস্ত বড় জাহাজ দাঁড়িয়ে আছে। তার ডেকের ওপর একলা ভাস্কো দা গামা, এক হাতে তলোয়ার, সারা গা দিয়ে যেন আগুন বেরুচ্ছে। চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে পর্তুগিজ ভাষায় কী যেন বলছে!

কাকাবাবু বললেন, তুমি আগেই দেখে ফেললে? হয়তো তোমার স্বপ্নটা সত্যি হতেও পারে।

সন্তু জিজ্ঞেস করল, তুই কী করে বুঝলি পর্তুগিজ ভাষায় কথা বলছে? তুই পর্তুগিজ জানিস?

জোজো বলল, ভাস্কো দা গামা পর্তুগিজ ভাষা না বলে কি বাংলা বলবে?

সন্তু বলল, ভূতেরা সব ভাষা জেনে যায়! গল্পে সেরকমই থাকে।

জোজো বলল, কয়েকবার পাঁউ পাঁউ শব্দটা বলছিল। পর্তুগিজ ভাষায় পাউ মানে রুটি, জানিস না? সেই থেকেই আমরা বলি পাউরুটি।

সন্তু বলল, আহা রে, ভূতটার নিশ্চয়ই খুব খিদে পেয়েছিল। না হলে পাউরুটির কথা বলবে কেন?

এমন সময় জানলার কাছে পটাপট শব্দ হতেই সবাই সেদিকে তাকাল।

বৃষ্টি নেমেছে খুব জোরে। সেইসঙ্গে ঝোড়ো হাওয়া।

কাকাবাবু জানলার কাছে এসে বাইরের বৃষ্টি দেখতে দেখতে বললেন, আঃ বাঁচা গেল, এবার গরমটা আশা করি কমবে।

সন্তু বলল, ভাস্কো দা গামা মে মাসে এসেছিল। এই সাঙ্ঘাতিক গরম সহ্য করেছিল কী করে?

কাকাবাবু বললেন, স্পেন-পর্তুগালে এক-এক সময় খুব গরম পড়ে। ওদের গরম সহ্য করার অভ্যেস আছে।

সন্তু বলল, গরমের মধ্যেও অত জামাকাপড় পরে থাকত?

কাকাবাবু বললেন, অভিজাত লোকদের ওরকম পরতেই হত, না হলে সাধারণ লোকরা তাদের মানবে কেন?

সন্তু বলল, অভিজাত লোকদের বুঝি ঘামে গেঞ্জি ভিজে যায় না?

জোজো বলল, তা তো যায়ই, সেইজন্য ওদের খুব সর্দি হয়। স্বপ্নে দেখলাম, কথা বলতে বলতে ভাস্কো দা গামা কয়েকবার হ্যাঁচ্চো হ্যাঁচ্চো করে উঠল!

সন্তু বলল, ভূতের সর্দি!
সন্ধের পর সত্যিই গরম অনেক কমে গেল।

বৃষ্টি একেবারে থামেনি, মাঝে মাঝেই পড়ছে। আটটা বাজার পর ওঁরা হোটেল থেকে বেরিয়ে পড়লেন।

অ্যান্টনি জিজ্ঞেস করল, সার, একটা চার্চ দেখতে যাবেন? একটু দূরে একটা ভাল চার্চ আছে।

কাকাবাবু বললেন, চার্চ কাল দেখব। একবার চলো তো বন্দরটা দেখে আসি।

অ্যান্টনি বলল, সেখানে তো দেখার কিছু নেই। এই পোর্টে এখন আর কোনও বড় জাহাজ থামে না। মাছধরার কিছু বোটের জন্য ব্যবহার করা হয়।

কাকাবাবু বললেন, তা জানি। তবু একবার দেখে আসতে চাই।

কালিকট যে এককালে বিখ্যাত বন্দর ছিল, তা এখন দেখে কিছুই বোঝা যায়। কেমন যেন নিষ্প্রাণ অবস্থা। টিম টিম করে আলো জ্বলছে, লোকজন প্রায় দেখাই যায় না। বেশ কিছু নৌকো আর দু-একটা স্টিমার রয়েছে।

কাকাবাবু অন্যমনস্কভাবে বললেন, হু।

তারপর গাড়ির দিকে হাঁটতে শুরু করে বললেন, মাঝরাত্তিরে আর একবার আসতে হবে। ভূতের দেখা না পেলেও অন্য কারও দেখা পাওয়া যেতে পারে। চলো, এখন খেয়ে নেওয়া যাক।

অ্যান্টনি এবার অন্য একটা হোটেলে নিয়ে গেল। সেখানে মাছ-মাংস সবই পাওয়া যায়।

কাকাবাবু বললেন, আগে দেখা যাক, জোজোর জন্য চিংড়ি মাছ।

জোজো বলল, চিংড়ি মাছ আমি একাই ভালবাসি না। সন্তুও ভালবাসে। এখানে কাঁকড়া পাওয়া যায় না?

কাকাবাবু বললেন, মেনুতে তো কাঁকড়া দেখছি না।

সন্তু বলল, কাকাবাবু, এখানে দেখছি, হোটেলের বেয়ারা আর ম্যানেজার, সবাই লুঙ্গি পরে!

জোজো বলল, লুঙ্গিটাই এদের জাতীয় পোশাক।

সন্তু বলল, লক্ষ করেছিস, এখানে কেউ পাঞ্জাবি পরে না। লুঙ্গির ওপর শার্ট।

জোজো বলল, পাঞ্জাবি পরে না?

সন্তু বলল, আমি সারাদিনে একজনও পাজামা পাঞ্জাবি পরা লোক দেখিনি। এখানে বোধ হয় কেউ পাজামা পরে বাইরে বেরোয় না।

জোজো নিজেই সন্ধেবেলা পাজামা আর লাল পাঞ্জাবি পরে বেরিয়েছে। সে অন্য টেবিলের লোকদের দেখে নিয়ে বলল, তাই তো!

বেয়ারা টেবিলে খাবার সাজিয়ে দিচ্ছে, এই সময় কিছু দূরে খুব জোরে দুম দুম করে দুবার শব্দ হল। বোমা কিংবা কামান দাগার মতন।

কাকাবাবু বেয়ারাটিকে জিজ্ঞেস করলেন, ও কীসের শব্দ?

বেয়ারাটি বলল, সিনেমার শুটিং হচ্ছে সার। হিন্দি সিনেমা। দুজন হিরোইন।

সন্তু জোজোর দিকে তাকিয়ে বলল, তোর বদলে অন্য একজনকে পেয়ে গেছে।

জোজো বলল, আমার সিনে তো কামান দাগা ছিল না। এটা অন্য সিন।

অ্যান্টনি অন্য টেবিলে বসে খেয়ে নিয়েছে। কাকাবাবু তাকে বললেন, তুমি আবার সাড়ে এগারোটার সময় এসো। এখন আমরা কিছুক্ষণ হেঁটে বেড়াব।

বৃষ্টি থেমে গেছে, গরমও নেই। খাওয়ার পর খানিকটা হাঁটতে ভালই লাগে।

রাস্তায় লোকজন প্রায় দেখাই যাচ্ছে না। আলোও জোরালো নয়। আকাশ মেঘলা, চাঁদ আছে কি না বোঝার উপায় নেই।

ওঁরা গল্প করতে করতে হাঁটতে লাগলেন। এক জায়গায় পথ একেবারে নির্জন, কাকাবাবুর ক্রাচের খট খট শব্দ ছাড়া আর কোনও শব্দও শোনা যাচ্ছে না।

হঠাৎ দুটো গাড়ি এসে থামল ওঁদের সামনে আর পেছনে। টপাটপ নেমে পড়ল পাঁচ-ছজন লোক, তাদের মুখে কালো রুমাল বাঁধা, হাতে রিভলভার। একজন ইংরেজিতে বলল, হাত তোলো!

কাকাবাবু বললেন, কী ব্যাপার? তোমরা কারা?

লোকটি কোনও উত্তর না দিয়ে এগিয়ে এসে কাকাবাবুর পকেট থাবড়াতে লাগল।

কাকাবাবু নিজের রিভলভার সবসময় সঙ্গে রাখেন। বার করার সময়ই পেলেন না। লোকটি কাকাবাবুর রিভলভারটা নিয়ে বলল, গাড়িতে ওঠো।

অন্য দুজন সন্তু আর জোজোকে ঠেলতে শুরু করেছে।

বাধা দেওয়ার প্রশ্ন নেই। হুড়মুড়িয়ে গাড়িতে উঠতে হল। কাকাবাবুর একটা ক্রাচ পড়ে গেল বাইরে, তিনি বললেন, আরে, আরে, ওটা তুলতে হবে।

সন্তু কোনওরকমে ক্ৰাচটা তুলে নিল। গাড়িটা একটা ভ্যানের মতন। ভেতরটা অন্ধকার। কাকাবাবুদের ভেতরে ঠেলে দিয়ে দুজন রিভলভারধারী বসল দরজার কাছে।

কাকাবাবু বললেন, ব্যাপারটা কী হল বল তো? আমাদের এখানে কোনও শত্রু নেই, কারও কোনও কাজে বাধা দিতেও আসিনি। তবে শুধু শুধু আমাদের ধরে নিয়ে যাবে কেন?

সন্তু বলল, এক হতে পারে। জোজোকে দিয়ে জোর করে সিনেমায় পার্ট করাবে।

জোজো বলল, ইস! হাজার জোর করলেও আমি ওই ছোট পার্ট করব না!

সন্তু বলল, যদি কপালের কাছে রিভলভার ছুঁইয়ে সেটে নিয়ে যায়?

জোজো বলল, ওই অবস্থায় কেউ পার্ট করতে পারে নাকি? মুখ দেখেই তো বোঝা যাবে।

কাকাবাবু পাহারাদারদের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ওহে, তোমরা আমাদের কোথায় নিয়ে যাচ্ছ? আমাদের কাছে কিন্তু টাকা পয়সা বিশেষ কিছু নেই।

একজন বলল, শাট আপ! গাড়িটা চলল অনেকক্ষণ। আন্দাজে মনে হল এক ঘণ্টার বেশি। তারপর থামল এক জায়গায়।

পেছনের দরজা খুলে একজন হুকুম দিল, নামো!

একটা দোতলা বাড়ি, সামনে বাগান। বাইরে একটা আলো জ্বলছে। ওদের দোতলায় উঠিয়ে একটা ঘরে এনে দরজা বন্ধ করে দেওয়া হল বাইরে থেকে।

সেই ঘরের মেঝেতে দুটো বড় শতরঞ্চি পাতা। খাট বা চেয়ার-টেবিল কিছু নেই। অন্য দিকে আর একটা দরজা, সেটা খুলে দেখা গেল বাথরুম। জানলায় লোহার গরাদ।

সন্তু বলল, সিনেমায় পার্ট করতে গেলে মুখে রং-টং মেখে মেক আপ নিতে হয়। জোজো, এবার বোধ হয় তোকে মেক আপ দিতে নিয়ে যাবে।

জোজো বলল, তোর অত গরজ, তুই ওই পার্ট কর না। আমি তো করবই না বলে দিয়েছি।

বসে থাকতে থাকতে এক সময় তিনজনেরই ঘুম পেয়ে গেল। আর কেউ এল।

জানলা দিয়ে ভোরের আলো এসে ওদের ঘুম ভাঙাল।

বেলা বাড়তে লাগল, তবু কারও দেখা নেই। কোনও সাড়াশব্দও পাওয়া যাচ্ছে।

দুদিকের দুটো জানলা দিয়ে বাগান আর দূরে অসংখ্য নারকোল গাছ দেখা যায়।

জোজো বলল, টুথপেস্ট-টুথব্রাশ নেই, মুখ পোব কী করে?

সন্তু বলল, শুধু জল দিয়ে ধুয়ে নে।

জোজো বলল, সকালবেলা ব্রেকফাস্ট দেবে না?

কাকাবাবু বললেন, আর কিছু না হোক, এক কাপ চা কিংবা কফি বিশেষ দরকার।

সন্তু বলল, জোজো, তোর দিবাস্বপ্নটা সত্যি কি না মিলিয়ে দেখা হল না!

কাকাবাবু বললেন, ঠিক বলেছিস। এতদূর এলাম, ভূতের গল্পটা কতখানি বানানো কিংবা কারা বানিয়েছে, সেটাও জানা গেল না।

ভাল করে রোদুর উঠতেই আবার গরমে গা চিটচিট করতে লাগল। দশটার সময় দরজা খুলল।

দুজন লোকের হাতে রিভলভার, তাদের পেছনে দাঁড়িয়ে আছে সেই বড় জুলপিওয়ালা লোকটি।

কাকাবাবু বললেন, তা হলে সিনেমাওয়ালাদেরই ব্যাপার! মিস্টার প্রসাদ, আমাদের জোর করে আটকে রাখবার দরকার নেই। সন্তু রাজি হয়েছে, ওকে দিয়ে কাজ চালিয়ে নিন। সন্তু মোটেই তোতলা নয়।

প্রসাদ বলল, শাট আপ!

আর একজন তোক একটা ট্রে-তে করে কিছু পরোটা আর ঢ্যাঁড়স-টম্যাটোর তরকারি রেখে গেল।

জোজো বলল, আমি ঢ্যাঁড়স খাই না। আমার জন্য টোস্ট আর ডিম সেদ্ধ আনতে বলুন।

প্রসাদ বলল, শাট আপ!

কাকাবাবু বললেন, আপনারা সিনেমা কোম্পানির লোক। কাউকে জোর করে রাস্তা থেকে ধরে আনা যে বেআইনি, তা জানেন না?

প্রসাদ একই সুরে আবার বলল, শাট আপ!

কাকাবাবু বললেন, শুধু শাট আপ, শাট আপ বললে চলবে কী করে? কাল তো বেশ নরম সুরে কথা বলছিলেন।

কাকাবাবু দরজার দিকে একটু এগোতেই প্রসাদ হিংস্র গলায় বলল, আর এক পা কাছে এলে আমি গুলি করতে বাধ্য হব!

কাকাবাবু থমকে গেলেন।

তারপর খানিকটা হালকাভাবে বললেন, হঠাৎ কী অপরাধ করলাম আমরা। যে-জন্য এত খারাপ ব্যবহার? মশাই, একটা কিছু কারণ জানাবেন তো!

প্রসাদ কোনও উত্তর না দিয়ে দরজাটা টেনে বন্ধ করে দিল।

কাকাবাবু দু কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললেন, অদ্ভুত! কারও সঙ্গে শত্রুতা হয়, তা হলেও বুঝি! আমরা তো কিছুই করিনি।

সন্তু একটা পরোটা তুলে নিয়ে বলল, নে জোজো, খেতে শুরু কর।

জোজো বলল, বললাম না, আমি ঢ্যাঁড়স খাই না!

সন্তু বলল, তুই যে সিনেমা স্টারের মতন হুকুম করলি, তোকে টোস্ট আর ডিম দিতে হবে। আমরা তো বন্দি, যা দেয় তাই খেতে হবে।

জোজো বলল, ওসব বাজে জিনিস আমি খাব না।

সন্তু বলল, দ্যাখ, আমরা এইরকমভাবে আরও অনেক জায়গায় বন্দি হয়েছি। এই অবস্থায় যা খাবার পাওয়া যায়, তাই খেয়ে নিতে হয়। পরে যদি আর কিছুই না দেয়?

কাকাবাবুও খেতে শুরু করেছেন।

সন্তু একটা পরোটার মধ্যে খানিকটা তরকারি দিয়ে রোল বানিয়ে জোজোকে বলল, নে, একটু খেয়ে দ্যাখ।

জোজো একটা কামড় দিয়ে মুখ বিকৃত করে বলল, এঃ! একে তো ঢ্যাঁড়স, তাতে আবার নুন বেশি!

তারপর অবশ্য সে পর পর তিনটে পরোটা খেয়ে ফেলল।

সন্তু বলল, দিব্যি তো খেয়ে নিলি দেখছি। জোজো গম্ভীরভাবে বলল, খিদে পেলে বাঘেও ঘাস খায়।

সন্তু বলল, তোকে বাঘের মতনই দেখাচ্ছে বটে। জোজো কাকাবাবুর দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করল, আমরা কতক্ষণ এইভাবে বন্দি থাকব?

কাকাবাবু গোঁফ পাকাতে পাকাতে বললেন, কিছুতেই বুঝতে পারছি না, এরা আমাদের ধরে এনেছে কেন? তোমরা সিনেমায় পার্ট করতে রাজি হওনি বলে জোর করে গুম করবে, এ কখনও হয়? ব্যাপারটা এখনও আমার কাছে ধাঁধা মনে হচ্ছে।

সন্তু বলল, সিনেমায় পার্ট করার ব্যাপারটাই বোধহয় বাজে কথা। প্রথমে ওই লোভ দেখিয়ে আমাদের ধরে নিয়ে যেতে চাইছিল।

কাকাবাবু বললেন, তা হতে পারে। কিন্তু আমাদের ধরে এনে ওদের কী লাভ? ওই প্রসাদ নামের লোকটিকে আগে কখনও দেখিনি। আমরা ওর কোনও ক্ষতিও করিনি।

জোজো বলল, কাকাবাবু একটা কিছু করুন। আমার এখানে থাকতে একটুও ভাল লাগছে না।

কাকাবাবু বললেন, কী করা যায় বলো তো? লোকটা তো কোনও কথারই উত্তর দিচ্ছে না। রিভলভার তুলে ভয় দেখাচ্ছে।

জোজো বলল, ওই রিভলভারটা ফল্স। সিনেমার লোকদের কাছে আসল রিভলভার থাকে নাকি? খেলনা পিস্তল থাকে।

সন্তু বলল, যদি এরা সিনেমার লোক না হয়? আমার কিন্তু রিভলভারটা দেখে আসলই মনে হল।

জোজো বলল, একটা কাজ করতে হবে। এর পর যখন লোকটা আসবে, সন্তু তুই আর আমি দরজার দুপাশে লুকিয়ে থাকব। কাকাবাবু কথায় কথায় ভুলিয়ে লোকটাকে ঘরের মধ্যে নিয়ে আসবেন, আমরা দুজনে দুদিক থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ে ওর হাত থেকে রিভলভারটা কেড়ে নেব!

কাকাবাবু বললেন, অনেক গল্পের বইয়ে এরকম থাকে। অনেক সিনেমাতেও দেখা যায়। এরা কি সেইসব সিনেমা দেখে না?

জোজো বলল, আপনি কথা বলে বলে লোকটাকে ভুলিয়ে দেবেন। তারপর আমরা ঠিক ওকে ঘায়েল করে ফেলব।

কাকাবাবু বললেন, ঠিক আছে, আমি আমার পার্ট যতদূর সম্ভব ভাল করার চেষ্টা করব। আসুক লোকটা।

এর পর ঘণ্টার পর ঘণ্টা কেটে গেল, আর কারও দেখা নেই। কোনও সাড়াশব্দও পাওয়া যাচ্ছে না। জানলা দিয়ে তাকিয়ে থেকেও একটা লোককেও দেখা যায় না।

জোজো কয়েকবার দরজার ওপর দুম দুম করে ধাক্কা দিল, তাতেও এল না কেউ।

সন্তু বলল, জোজো অন্ত্যাক্ষরী খেলবি? গানের লাইনের শেষ কথাটা দিয়ে—

জোজো বলল, ধ্যাত, কিছু ভাল লাগছে না।

কাকাবাবু বললেন, মেজাজ খারাপ না করে অন্যদিকে মন ফেরানোই ভাল, আমি বেশি গান জানি না। অন্য খেলা করা যাক, সময় কাটাবার জন্য। কে এটা দশবার ঠিক ঠিক বলতে পারবে? জলে চুন তাজা, তেলে চুল তাজা।

জোজো প্রথমেই বলল, কী বলতে হবে? জলে চুল তাজা, তেলে চুন তাজা?

কাকাবাবু বললেন, না, ঠিক এর উলটো।

সন্তু আর জোজো দুজনেই চেষ্টা করল বলতে। পর পর দশবার তাড়াতাড়ি ঠিক বলা মোটেই সহজ নয়। নানারকম মজার মজার ভুল হয়। জোজো একবার বলল, জলে তুন তাজা তেলে চুল চাজা!

কাকাবাবুই জিতলেন এ খেলায়। তারপর বললেন, ইংরেজিতে একটা আছে, সেটা চেষ্টা করে দ্যাখো। She sells sea-shells on the sea-shore. এটাও, তাড়াতাড়ি বলতে হবে দশবার। শি সেক্স সি-সেল অন দ্য সি-শোর।

দু-তিনবার বলতে বলতেই দরজাটা খোলার শব্দ হল। সঙ্গে সঙ্গে জোজো আর সন্তু তড়াক করে লাফিয়ে উঠে দরজার দুপাশে গিয়ে লুকোল।

এবারেও রিভলভার হাতে প্রসাদ, দুজন গাঁট্টাগোট্টা লোক।

কাকাবাবু কিছু বলার আগেই প্রসাদ বলল,ছেলেদুটো গেল কোথায়? দরজার পাশে লুকিয়েছে? সামনে আসতে বলুন। বেশি চালাকি করলে কিন্তু আমি সত্যি সত্যি গুলি চালাব!

কাকাবাবু হেসে ফেলে সন্তু আর জোজোর দিকে তাকিয়ে বললেন, ওরে আয় রে, আমাদের জন্য খাবার এনেছে।

একজন লোক দুটো প্লেট নামিয়ে রাখল। একটাতে একগোছা রুটি, আর একটাতে সেই সকালবেলারই মতন তরকারি।

জোজো আর্তনাদ করে উঠল, আবার ঢ্যাঁড়স! এ দেশে কি আর কিছু পাওয়া যায় না?

প্রসাদ বলল, শাট আপ!

কাকাবাবু বললেন, ওগো শাট আপ বাবু, একটু খাবার জলও কি পাওয়া যাবে না?

প্রসাদ বলল, বাথরুমের কলে জল আছে। সেই জল খাবে। দরজা বন্ধ হয়ে গেল আবার।

জোজো বলল, আমি খাব না। খাব না, খাব না, কিছুতেই আর ঢ্যাঁড়স খাব।

সন্তু বলল, খিদে পেলে বাঘ ঢ্যাঁড়স খায়!

জোজো বলল, কলের জল খেলে আমার পেট খারাপ হবে।

সন্তু বলল, তেষ্টা পেলে বাঘে কাদাজলও খায়।

জোজো বলল, তুই বারবার বাঘ বাঘ করবি না তো?

সন্তু বলল, তুই-ই তো প্রথমে বলেছিস।

জোজো রাগ করে বলল, তুই ফ্যাক ফ্যাক করে হাসছিস? আমরা এখানে দিনের পর দিন বন্দি হয়ে থাকব?

কাকাবাবু বললেন, এরা দিনের পর দিন আমাদের রুটি-তরকারি খাইয়ে আটকে রাখবে, এরকম মনে হয় না। একটা কিছু ঘটবেই।

জোজো বলল, কাকাবাবু, আপনি তো হিপনোটিজম জানেন। হিপনোটাইজ করে ওই জুলপিওয়ালাটাকে ঘুম পাড়িয়ে রিভলভারটা কেড়ে নিতে পারেন না?

কাকাবাবু বললেন, তা হয়তো পারা যায়। কিন্তু মুশকিল কী জানো, আমি যাঁর কাছে ওই বিদ্যেটা শিখেছি তাঁর কাছে প্রতিজ্ঞা করা আছে, আমি নিজে থেকে আগে কারও ওপর ওটা প্রয়োগ করব না! কেউ আমাকে হিপনোটাইজ করার চেষ্টা করলে তবেই আমি-

জোজো বলল, বাঃ, নিজের প্রাণ বাঁচাবার জন্য ওই প্রতিজ্ঞা ভাঙা যায় না? বিপদে পড়লে মানুষ সব কিছু করতে পারে।

কাকাবাবু বললেন, প্রতিজ্ঞা ভাঙলেও এখানে বিশেষ কিছু সুবিধে হবে না। ওরা তিনজন ছিল। একসঙ্গে তিনজন লোকের দিকে তাকিয়ে হাত ঘুরিয়ে অজ্ঞান করে দেওয়া সম্ভব নয়। ওটা গাঁজাখুরি ব্যাপার। একজন-একজন করে করতে হয়, তাও সময় লাগে। প্রসাদের সঙ্গের একটা লোকের হাতে লোহার ডাণ্ডা ছিল। আমি প্রসাদকে হিপনোটাইজ করতে গেলে ওই লোকটা যদি ডাণ্ডা দিয়ে আমার মাথায় মারত, তা হলেই আমার সব জারিজুরি ভেঙে যেত।

জোজো অসহায় ভাবে বলল, তা হলে কি কোনওই উপায় বার করা যাবে না?

সন্তু বলল, আয়, আগে খেয়ে নিই। তারপর একটু ঘুমোই। তারপর বুদ্ধি খেলাতে হবে। দরজার পাশে লুকিয়ে থাকার বুদ্ধিটা তো খাটল না।

এক ঘণ্টা পরে আবার দরজা খুলে গেল।

এবারেও প্রসাদ, আর তার সঙ্গে দুজন লোক। তীক্ষ্ণ নজরে সারা ঘরটা দেখে নিয়ে সে কাকাবাবুকে বলল, তুমি বেরিয়ে এসো। শুধু তুমি। ছেলেদুটো এখানেই থাকবে।

কাকাবাবু বললেন, যাক বাঁচা গেল। বন্ধ ঘরে বসে থেকে থেকে দম আটকে আসছিল। চলো, কোথায় যেতে হবে?

কাকাবাবু বেরিয়ে এলেন। আবার বন্ধ হয়ে গেল দরজা।
সিঁড়ি দিয়ে নামতে হল নীচে। প্রসাদ তাঁর ঘাড়ে রিভলভারটা ঠেকিয়ে আছে।

কাকাবাবু বললেন, রিভলভারটা সরাও। অত কিছুর দরকার নেই। আমি

খোঁড়া মানুষ, আমি কি দৌড়ে পালাতে পারব নাকি?

প্রসাদ বলল, শাট আপ!

কাকাবাবু বললেন, তুমি বুঝি আর কোনও ইংরিজি কথা জানো না?

প্রসাদ কাকাবাবুকে এমন একটা ধাক্কা দিল যে, তিনি আর একটু হলে হুড়মুড়িয়ে পড়ে যাচ্ছিলেন।

কোনওরকমে সামলে নিয়ে বললেন, আমার ওপর এত রাগ কেন বাপু? আমি তোমার কী ক্ষতি করেছি, সেটা বলবে তো!

প্রসাদ আবার বলল, শাট আপ!

কাকাবাবু বললেন, ঠিক আছে, তাই বলে যাও!

একতলায় একটা ঘরে কাকাবাবুকে ঢুকিয়ে দিয়ে প্রসাদ দরজা বন্ধ করে দিল পেছন থেকে। সে নিজে ঘরে ঢুকল না।

ঘরটি বেশ বড়, সোফা দিয়ে সাজানো। একদিকে একটা সিংহাসনের মতন লাল ভেলভেট দিয়ে মোড়া চেয়ার। তার ওপরে বসে আছে একজন মহিলা। তিরিশ-বত্রিশ বছর বয়েস হবে, খুবই সুন্দর চেহারা। দুধে-আলতা গায়ের রং, একটা সাদা সিল্কের শাড়ি পরা, সারা গা ভর্তি গয়না। এমন ঝকমক করছে যে, মনে হয়, সবগুলোই হিরের, তাকে দেখাচ্ছে রানির মতন।

কাকাবাবু তাকে চিনতে পারলেন না। হাত জোড় করে বললেন, নমস্কার।

মহিলাটি কিন্তু নমস্কার করল না। তার ভুরু কুঁচকে গেল, অমন সুন্দর মুখোনা নিষ্ঠুর হয়ে উঠল। সামনের দিকে একটু ঝুঁকে বলল, এইবার রাজা রায়চৌধুরী, তোমাকে বাগে পেয়েছি। কুকুর দিয়ে তোমার মাংস খাওয়াব।

কাকাবাবু খুবই অবাক হয়ে বললেন, আপনাকে তো আমি চিনি না। আমার ওপর এত রাগ করছেন কেন? আমি কি আপনার কোনও ক্ষতি করেছি?

মহিলাটি বলল, চিনতে পারছ না? ন্যাকামি হচ্ছে। আমার পোষা ডালকুত্তা যখন তোমার মাংস ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাবে, তখন ঠিক চিনবে!

কাকাবাবু বললেন, আমার মাংস কী এমন সুস্বাদু যে, আপনার ডালকুত্তার পছন্দ হবে? বাজারে অনেক পাঁঠার মাংস পাওয়া যায়, কুকুররা সেই মাংসই বেশি পছন্দ করে। আমার ওপর আপনার এত রাগ কেন? আপনি কে?

মহিলাটি বলল, আমি তোমার যম। আমার হাতেই তুমি মরবে।

কাকাবাবু বললেন, যম তো মেয়ে নয়, পুরুষ। আমি মেয়েদের সঙ্গে কক্ষনও লড়াই করি না। আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।

সেই সুন্দরী মহিলাটি রাক্ষুসির মতন হিংস্র মুখ করে বলল, পাঁচ বছর ধরে আমি রাগ পুষে রেখেছি। তোমাকে ধরার অনেক চেষ্টা করেছি। এইবার বাগে পেয়েছি। আজ চোখের সামনে তোমাকে একটু একটু করে মরতে দেখে, তারপর রাত্তিরে শান্তিতে ঘুমোব!

কাকাবাবু নকল দুঃখের ভাব করে বললেন, অনেকেই এই কথা বলে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমি মরি না। কী করব বলো! আজও তোমার শান্তিতে ঘুম হবে না!

এই সময় পাশের দরজা দিয়ে আর একজন লোক ঢুকল। সে যেমন লম্বা, তেমনই চওড়া। মাথায় বাবরি চুল, নাকের নীচে শেয়ালের লেজের মতন মোটা গোঁফ। একটা ঝলমলে দড়ি বসানো কোট পরা, কোমরে ঝুলছে তলোয়ার।

কাকাবাবু দেখামাত্র সেই লোকটিকে চিনতে পারলেন। অস্ফুট স্বরে বললেন, মোহন সিং।

তারপর মহিলাটির দিকে তাকিয়ে বললেন, এবার তোমাকেও চিনতে পেরেছি। সিনেমার নায়িকা! তোমাদের মুখের চেহারা আর সাজপোশাক এত বদলে যায় যে, চেনা মুশকিল। আমি তো সিনেমাটিনেমাও বিশেষ দেখি না। তোমার সঙ্গে সেই বিজয়নগরে দেখা হয়েছিল, তাই না? কী যেন তোমার নাম?

মোহন সিং একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসে বলল, কস্তুরীকে চিনতে পারোনি? ও এখন হিন্দি ফিমের দুনম্বর নায়িকা।

কস্তুরী বলল, দুনম্বর না, এক নম্বর!

মোহন সিং বলল, হ্যাঁ, এই নতুন ফিটা রিলিজ করলে তুমি নিশ্চিত এক নম্বর হবে! যাকগে, আসল কথায় আসা যাক। রাজা রায়চৌধুরী, তোমাকে কস্তুরী বেশি বেশি ভয় দেখাচ্ছিল। অবশ্য ওর অত রাগ হওয়াই স্বাভাবিক। তুমি তো আমাদের কম ক্ষতি করোনি! তবু তোমাকে আর একবার বাঁচার চান্স দেব।

কাকাবাবু নিজেও এবার একটা সোফায় বসে পড়ে হাঁফ ছেড়ে বললেন, যাক এবারে নিশ্চিন্ত হওয়া গেল। এতক্ষণ ধাঁধার মধ্যে ছিলাম। কারা আমাদের ধরে এনেছে, কেন আমার ওপর এত রাগ, কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। তোমরাই ভাস্কো দা গামার ভূতের ধোঁকা দিয়ে আমাকে কালিকটে টেনে এনেছ?

মোহন সিং হা-হা করে হেসে উঠে বলল, কেমন ফাঁদ পেতেছি, বলো! এর আগেও অনেকবার তোমাকে টেনে আনার চেষ্টা করেছি। একবার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল, মুম্বইয়ে একটা খুনের তদন্ত করে দিলে তোমাকে পাঁচ লাখ টাকা দেওয়া হবে, তুমি আসোনি। রাজস্থানের একটা মন্দিরের মূর্তি চুরি যাওয়ার কথা জানালেও তুমি পাত্তা দাওনি। তারপর ভাস্কো দা গামা বিষয়ে তোমার প্রবন্ধটা ছাপা হওয়ার পর একজন আমাকে বুদ্ধি দিল, ওই ভূতের গুজবটা আস্তে আস্তে ছড়াও, বড় বড় লোকেদের নাম করে ফোন করাও, চিঠি লেখাও, তাতে ও টোপ গিলতে পারে। সেই বুদ্ধিটা ঠিক কাজে লেগে গেল!

কাকাবাবু বললেন, অন্যের বুদ্ধি! তোমার অত বড় মোটা মাথা থেকে যে এই সূক্ষ্ম বুদ্ধি বেরবে না, তা বোঝাই যায়। প্রথম রাউন্ডে আমি হেরে গেছি, ধরা পড়ে গেছি। এবার কী হবে বলো!

মোহন সিং বলল, তোমাকে আমরা ছেড়ে দিতে পারি, তুমি আমাদের বিজয়নগরের হিরেটা ফেরত দাও!

কাকাবাবু বললেন, বিজয়নগরের হিরেটা তোমাদের হল কী করে? যে-কোনও ঐতিহাসিক জিনিসই ভারত সরকারের সম্পত্তি।

মোহন সিং বলল, ওই হিরেটা উদ্ধার করার জন্য আমরা প্রায় কুড়ি লাখ টাকা খরচ করেছি।

কস্তুরী চিৎকার করে বলল, শুধু টাকা! কত অপমান সয়েছি। এই পাজি, শয়তান, খোঁড়া লোকটা আমাকে নদীর জলে চুবিয়ে আমার কাছ থেকে হিরেটা কেড়ে নিয়েছে। ওই হিরে আমার চাই—চাই—চাই! যেমন করে হোক!

কাকাবাবু হেসে বললেন, অত হিরের লোভ ভাল নয়। শোনো, ওই হিরেটা তোমাদের নয়, আমারও নয়। হিরেটা উদ্ধার করেছি আমি, কিন্তু নিজের কাছে তো রাখিনি। ভারত সরকারের কাছে জমা দিয়েছি। দিল্লিতে একটা মিউজিয়ামে কড়া পাহারা দিয়ে রাখা আছে। ওই বিশ্ববিখ্যাত হিরেটা দেখতে বহু লোক যায়। তোমরাও গিয়ে দেখে আসতে পারো।

মোহন সিং বলল, ওসব আমরা জানি। ছেলেদুটোকে জামিন রেখে তোমাকে আমরা ছেড়ে দেব। তুমি দিল্লিতে গিয়ে ওই হিরেটা আমাদের জন্য নিয়ে আসবে।

কাকাবাবু বললেন, আমি দিল্লিতে গেলেও হিরেটা আমাকে ফেরত দেবে কেন?

মোহন সিং বলল, তোমার অনেক খাতির, তুমি হিরেটা এক সময় দেখতে চাইবে। তারপর ওখানে একটা নকল ঠিক ওইরকম হিরে বসিয়ে আসলটা নিয়ে চলে আসবে। খুব সোজা।

কাকাবাবু বললেন, তার মানে আমাকে চুরি করতে বলছ? তোমাদের কি মাথাখারাপ হয়েছে! তোমাদের জন্য আমি হিরে চুরি করতে যাব কেন? আমাকে ছেড়ে দিলেই তো আমি পুলিশ সঙ্গে এনে সন্তু আর জোজোকে উদ্ধার করব। তোমাদেরও ধরিয়ে দেব।

মোহন সিং বলল, আমরা কি এতই বোকা? তোমার ওপর নজর রাখা হবে। তুমি পুলিশের কাছে গেলেই আমরা ওই ছেলেদুটোর গলা কেটে সমুদ্রে ভাসিয়ে দিয়ে হাত ধুয়ে ফেলব! পুলিশ এলেই বা কী হবে? আমরা যে তোমাদের ধরে এনেছি তার কোনও প্রমাণ আছে? আমরা তো এখানে সিনেমার শুটিং করতে এসেছি।

কাকাবাবু বললেন, সন্তু আর জোজোকে যদি কেউ মারে, তা হলে সে পৃথিবীর কোনও জায়গাতেই লুকোতে পারবে না, আমি ঠিক তাকে খুঁজে বার করব, নিজের হাতে তার গলা টিপে মারব।

কস্তুরী চেয়ার ছেড়ে নেমে এসে রাগে কাঁপতে কাঁপতে বলল, কী, তোর এত সাহস, এখনও আমাদের ভয় দেখাচ্ছিস? তোকে এখনই যদি মেরে ফেলি, তুই কী করবি?

সে খুব জোরে কাকাবাবুর দুগালে দুটো চড় কষাল।

চড় খেয়েও কাকাবাবু একটুও নড়লেন না। প্রায় এক মিনিট স্থির চোখে তাকিয়ে রইলেন কস্তুরীর মুখের দিকে।

তারপর ঠাণ্ডা গলায় বললেন, ছিঃ, এভাবে কাউকে মারতে নেই। কাউকে মারলে তুমি নিজেও যে কখনও এরকম মার খেতে পারো, সে-কথা ভাব না কেন?

মোহন সিং ফস করে একটা রিভলভার বার করে বলল, সাবধান কস্তুরী। ওর কাছ থেকে সরে এসো। ও লোকটা খোঁড়া হলেও ওর গায়ে অসম্ভব জোর। ও তোমাকে একবার ধরলে ছিঁড়ে ফেলতে পারে।

কাকাবাবু মোহন সিংয়ের দিকে ঘৃণার দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন, আমি মেয়েদের গায়ে হাত তুলি না, তাই ও বেঁচে গেল!

কস্তুরী সত্যি যেন ভয় পেয়ে পিছিয়ে গেল খানিকটা।

মোহন সিং বলল, রাজা রায়চৌধুরী, তুমি আমার দিকে এগোবার চেষ্টা করলেই আমি গুলি করব। এখানে আরও পাঁচজন পাহারাদার আছে। তুমি পালাতে পারবে না কিছুতেই। এর পরেও তুমি আমাদের কথা শুনবে না?

কাকাবাবু বললেন, বিজয়নগরের হিরেটা পাওয়ার আশা ত্যাগ করো। ওটা জাতীয় সম্পত্তি। আমাদের আটকে রেখে তোমাদের কোনও লাভ নেই।

কস্তুরী দাঁতে দাঁত চেপে বলল, হিরেটা যদি না পাই, তা হলে তোমাকে আমি পুড়িয়ে মারব। তাতেও আমার শান্তি হবে।

কাকাবাবু বললেন, একবার বলছে কুকুর দিয়ে খাওয়াবে, একবার বলছে পুড়িয়ে মারবে। এর দেখছি মন স্থির নেই!

মোহন সিং বলল, আমি ব্যবসাদার লোক। কুড়ি লাখ টাকা খরচ করেছি, সে টাকা আমি উশুল করবই। রাজা রায়চৌধুরী, তুমি আমার প্রস্তাবে রাজি না হলে কী ভুল করবে, পরে বুঝবে!

তারপর সে চিৎকার করে ডাকল, প্রসাদ! প্রসাদ!

সঙ্গে সঙ্গে প্রসাদ আর দুজন লোককে নিয়ে ঘরে ঢুকল।

মোহন সিং বলল, প্রসাদ, একে নিয়ে যাও। তিনজনেরই হাত বেঁধে রাখবে। কস্তুরী বলল, এদের কিছু খেতে দেবে না। কিচ্ছু না। জলও দেবে না।

প্রসাদের হাতে রিভলভার, অন্য দুজনের হাতে লোহার ডাণ্ডা। তারা ঠেলতে ঠেলতে কাকাবাবুকে নিয়ে চলল।

আগের ঘরটায় ঢুকিয়ে বন্ধ করে দিল দরজা। সন্তু আর জোজো উদগ্রীব হয়ে বসে ছিল।

কাকাবাবু বললেন, একটা ব্যাপারে অন্তত নিশ্চিত হওয়া গেছে। কারা আমাদের ধরে এনেছে, সেটা জানা গেল। শত্রুপক্ষকে চিনতে না পারলে লড়াইয়ের পদ্ধতিটা ঠিক করা যায় না।

সন্তু জিজ্ঞেস করল, এরা কারা?

কাকাবাবু বললেন, তোদের সেই বিজয়নগরের কথা মনে আছে? মোহন সিং, কস্তুরী, ওরা সিনেমা তোলার ছুতোয় বিজয়নগরের বিশ্ববিখ্যাত হিরেটা খুঁজে বার করার চেষ্টা করেছিল?

জোজো বলল, হ্যাঁ মনে, আছে। সেবারে রিঙ্কুদি আর রঞ্জনদা সঙ্গে ছিল। ওরা পারেনি, বিজয়নগরের হিরে আমারই উদ্ধার করেছিলাম।

কাকাবাবু বললেন, ওদের মুখের গ্রাস আমরা কেড়ে নিয়েছি। ওদের চোখে ধুলো দিয়ে হিরেটা আমরা নিয়ে গিয়েছিলাম। সেই রাগ ওরা পুষে রেখেছে।

সন্তু বলল, সেইজন্য প্রতিশোধ নিতে আমাদের ধরে রেখেছে?

কাকাবাবু বললেন, শুধু প্রতিশোধ নয়। ওরা হিরেটা ফেরত চায়। কিন্তু সেটা আমি দেব কী করে? সেটা তো আমি গভর্নমেন্টের কাছে জমা দিয়ে দিয়েছি।

জোজো জিজ্ঞেস করল, তা হলে ওরা এখন কী করবে?

কাকাবাবু বললেন, সেটাই তো বোঝা যাচ্ছে না। তবে জোজো, তোমার জন্য একটা ভাল খবর আছে। তোমাকে আর ভিণ্ডি মানে ঢ্যাঁড়সের ঘ্যাঁট খেতে হবে না।

জোজো খানিকটা উৎসাহিত হয়ে বলল, তা হলে কী দেবে? ভাল খাবার

দেবে?

কাকাবাবু বললেন, কিছুই দেবে না। খাবার বন্ধ।

জোজো ভুরু তুলে বলল, কাকাবাবু, এটাকে আপনি ভাল খবর বলছেন।?

কাকাবাবু হাসতে হাসতে বললেন, জলও দেবে না বলেছে। তবে বাথরুমের কলের জল আছে, তা দিয়ে তেষ্টা মেটানো যেতে পারে।

জোজো বলল, এইরকম সময়েও আপনি হাসছেন কী করে বলুন তো?

কাকাবাবু বললেন, হাসির বদলে মুখ ব্যাজার করে থাকলে কি কোনও লাভ হবে?

সন্তু বলল, এইজন্যই তো তোকে বলেছিলাম, বন্দি অবস্থায় যে-কোনও খাবার পেলেই চট করে খেয়ে নিতে হয়।

জোজো বলল, রাখ তো খাওয়ার কথা! আমি উপোস করতে মোটেই ভয় পাই না। কিন্তু এখান থেকে উদ্ধার পাব কী করে? আমাদের কাছে কোনও কিছু অস্ত্রও নেই। ইস, হোটেল থেকে খানিকটা শুকনো লঙ্কার গুঁড়ো যদি আনতাম! সেবারে খুব কাজে লেগেছিল!

কাকাবাবু বললেন, অস্ত্র নেই কে বলল? একটা অস্ত্র তো সব সময়ই আমাদের সঙ্গে থাকে।

জোজো অবাক হয়ে বলল, তার মানে? কী অস্ত্র আছে?

কাকাবাবু বললেন, তুমি এত বুদ্ধিমান, এটা বুঝলে না?

কাকাবাবু নিজের মাথায় টোকা দিয়ে বললেন, এই যে অস্ত্র!
সত্যিই, সারাদিনে আর কোনও খাবার দিল না।

বেচারি জোজো খিদের জ্বালায় কাহিল। উপুড় হয়ে শুয়ে আছে আর মাঝে মাঝে উঃ-উঃ করছে। কাকাবাবু বসে আছেন এক দিকের দেওয়ালে ঠেসান দিয়ে। চোখ বোজা।

সন্তু দাঁড়িয়ে আছে জানলার কাছে। গান গাইছে গুনগুন করে।

জোজো উঠে গিয়ে বাথরুমের কলে জল খেয়ে এল। এই পাঁচবার।

সন্তু মুখ ফিরিয়ে বলল, অত জল খাচ্ছিস কেন? জল খেলে খিদে যায় না!

জোজো বলল, আমি মোটেই খিদে গ্রাহ্য করি না। এত গরমে যা ঘাম হচ্ছে, জল না খেলে শরীরে জল কমে যাবে।

সন্তু বলল, সারাক্ষণ চুপচাপ থাকার কোনও মানে হয় না। আয় জোজো, কবিতা মুখস্থ বলার কম্পিটিশন দিবি?

জোজো মুখ ঝামটা দিয়ে বলল, ধ্যাত! এখন কবিতা টবিতা কিচ্ছু ভাল লাগছে না।

কাকাবাবু চোখ বুজেই বললেন, খিদের রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়, তাই না? পূর্ণিমা চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি! চাঁদ উঠেছে নাকি রে সন্তু?

সন্তু বলল, আকাশ মেঘলা। কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, আকাশে কি টক-টক গন্ধ?

সন্তু বলল, মনে হচ্ছে এক্ষুনি বৃষ্টি নামবে। তখন সব মিষ্টি হয়ে যাবে।

বৃষ্টি নামল না। একটু পরেই মীচে একটা কুকুরের ডাক শোনা গেল। খুব জোরালো হিংস্র মতন ডাক।

কাকাবাবু নড়েচড়ে বসে বললেন, এইবার মনে হচ্ছে একটা কিছু শুরু হবে। কস্তুরী বোধ হয় মন ঠিক করে ফেলেছে।

জোজো বলল, তার মানে?

কাকাবাবু বললেন, ওই কুন্তী নামের নায়িকাটি একবার বলেছিল, কুকুর দিয়ে আমার মাংস ছিঁড়ে খাওয়াবে। তারপর বলল, আগুনে পোড়াবে। আবার বলল, না খাইয়ে মারবে। এখন বোধ হয় ঠিক করেছে, কুকুর দিয়েই খাওয়াবে।

জোজো অবাক হয়ে কাকাবাবুর মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।

সন্তু বলল, এই সবকিছুর জন্য ওই ভাস্কো দা গামা নামে লোকটাই দায়ী। সেই সময় আমাদের দেশের অনেক ক্ষতি করেছে। এই পাঁচশো বছর পরেও ওর ভূতের জন্য আমাদের এই জ্বালাতন সহ্য করতে হচ্ছে। কাকাবাবু, তুমি ওকে নিয়ে প্রবন্ধ লিখতে গেলে কেন?

কাকাবাবু বললেন, তখন কি জানি, তার ফল এই হবে? খুব বুদ্ধি খাটিয়ে এরা

আমাদের কালিকটে টেনে এনেছে!

জোজো বলল, এর চেয়ে চেরাপুঞ্জি বেড়াতে গেলে কত ভাল হত?

দড়াম করে দরজা খুলে গেল। এবারে পাঁচজন লোক। প্রসাদ রিভলভার দোলাতে-দোলাতে বলল, তোমাদের হাত বাঁধা হবে। কেউ নড়াচড়া করলেই মাথা ফাটবে!

কাকাবাবু বললেন, অনেকক্ষণ আগেই তো হাত বাঁধার কথা ছিল। ভুলে গিয়েছিলে বুঝি?

প্রসাদ বলল, শাট আপ!

কাকাবাবু বললেন, ওই এক কথা শুনতে-শুনতে কান ঝালাপালা হয়ে গেল। শোনো, আমার হাত বাঁধার দরকার নেই। আমি পালাব না। হাত বাঁধা থাকলে আমি ক্রাচ নিয়ে হাঁটব কী করে?

দুজন লোক দুদিক থেকে এসে কাকাবাবুর হাত চেপে ধরল। তাদের একজন বলল, তোমার আর ক্রাচ দরকার হবে না।

কাকাবাবু সন্তুদের দিকে তাকিয়ে বললেন, এরা দেখছি ভারী অভদ্র। সারাদিন খেতে দেয় না, খোঁড়া মানুষকে ক্রাচ নিতে দেয় না!

ওদের তিনজনকে ঠেলতে-ঠেলতে নিয়ে যাওয়া হল ঘরের বাইরে। ক্রাচ ছাড়া কাকাবাবুকে এক পায়ে লাফাতে হচ্ছে।

গেটের বাইরে একটা বড় ভ্যান গাড়ি। বাগানে একটা মস্ত বড় কুকুরের চেন ধরে দাঁড়িয়ে আছে কস্তুরী, কুকুরটা ডেকেই চলেছে।

কস্তুরী বলল, এইবার, রায়চৌধুরী? আমার কুকুরটা দুদিন না খেয়ে আছে। আমি চেন ছেড়ে দিলেই তোমার মাংস খুবলে খুবলে খাবে।

কাকাবাবু বললেন, তাই নাকি! অত সোজা? রাজা রায়চৌধুরী একটা সামান্য কুকুরের কামড় খেয়ে মরবার জন্য জন্মেছে? নাঃ, তা বোধ হয় ঠিক নয়। কুকুরটাকে ছেড়ে দাও তো, দেখি কী হয়?

বাড়ির ভেতর থেকে মোহন সিং এই সময় বেরিয়ে এসে বলল, না, না, কস্তুরী, কুকুরটা ধরে রাখো। রায়চৌধুরীকে…

কস্তুরী তবু হি-হি করে হেসে হাতের চেন খুলে দিল। কুকুরটা ধারালো দাঁত বার করে ঘাউ-ঘাউ করে ডেকে তেড়ে গেল কাকাবাবুর দিকে।

জোজো ভয়ে চোখ বুজে ফেলল।

কাকাবাবু কুকুরটার চোখের দিকে একদৃষ্টিতে চেয়ে থেকে আস্তে-আস্তে শিস দিতে লাগলেন। খুব মিষ্টি সুর।

কুকুরটা কাকাবাবুর খুব কাছে এসে থেমে গেল। এখনও জোরে-জোরে ডাকছে, কিন্তু কাকাবাবুর চোখ থেকে চোখ সরাতে পারছে না। কাকাবাবু শিস দিয়েই চলেছেন।

ক্রমে কুকুরটার লাফালাফি কমে এল, হঠাৎ ডাক বন্ধ হয়ে গেল। শুয়ে পড়ল। কাকাবাবুর পায়ের কাছে।

কাকাবাবু বললেন, কুকুর খুব ভাল প্রাণী। শুধু-শুধু মানুষকে কামড়াবে কেন? কই হে কস্তুরী, তোমার আরও কুকুর থাকে তো নিয়ে এসো!

কস্তুরী চোখ গোল গোল করে বলল, এই লোকটা জাদু জানে!

কাকাবাবু বললেন, আমি আরও অনেক কিছু জানি। এখনও আমাকে চিনতে তোমাদের ঢের বাকি আছে।

মোহন সিং কাছে এসে বলল, ওরকম ভেলকি আমি অনেক দেখেছি। যাও রায়চৌধুরী, ওই গাড়িতে গিয়ে ওঠো!

কাকাবাবু বললেন, আমার ক্রাচদুটো এনে দিতে বলো!

মোহন সিং ধমক দিয়ে বলল, ক্রাচ-ফ্রাচ পাবে না। ওঠো গাড়িতে।

কাকাবাবু আরও জোরে ধমক দিয়ে বললেন, আগে আমার ক্রাচ আনো, নইলে আমি কিছুতেই গাড়িতে উঠব না।

সন্তু-জোজোর দিকে তাকিয়ে বললেন, তোরাও উঠবি না।

মোহন সিং বলল, ছেলেমানুষি কোরো না রায়চৌধুরী, তোমার দিকে তিনটে রিভলভার তাক করা আছে। এক্ষুনি ছুঁড়ে দিতে পারি।

কাকাবাবু বললেন, চালাও গুলি!

মোহন সিং নিজের নিজের রিভলভার তুলে কাকাবাবুর কপালের দিকে। তাক করল। কিন্তু সঙ্গে-সঙ্গে গুলি চালাল না। মুহূর্তের পর মুহূর্ত কেটে যেতে লাগল।

একটু পরেই সে অন্য কিছু ভেবে একজনকে বলল, এই, ওর ক্রাচদুটো নিয়ে আয়!

একজন দৌড়ে গিয়ে ক্রাচ আনার পর সবাইকে গাড়িতে তোলা হল। মোহন সিং আর কস্তুরী উঠল না।

গাড়িটা চলতে শুরু করার পর জোজো বলল, সন্তু, সত্যি করে বল তো, কুকুরটা যখন কাকাবাবুর দিকে তেড়ে এল, তুই ভয় পাসনি?

সন্তু বলল, তা একটু ভয় পেয়েছিলাম ঠিকই। তবে আমি রেডি ছিলাম। কুকুরটা কাকাবাবুকে কামড়াবার জন্য লাফ দিলেই আমি লাথি কষাতাম ওর পেটে!

জোজো জিজ্ঞেস করল, কাকাবাবু, আপনি বুঝি মন্ত্র পড়ে কুকুরটাকে ঘুম পাড়িয়ে দিলেন?

কাকাবাবু বললেন, না, মন্ত্র-টন্ত্র তো আমি জানি না। অন্য একটা উপায় আছে। লক্ষ করোনি, কুকুরটা আমার চোখ থেকে চোখ সরাতে পারছিল না? আর ওই যে শিস দিচ্ছিলাম, ওটা শুনলেই ওদের ঘুম পায়।

জোজো বলল, আপনি মোহন সিংকে কী করে বললেন গুলি চালাতে? যদি সত্যিই গুলি চালিয়ে দিত? ওরা যেরকম নিষ্ঠুর লোক!

কাকাবাবু বললেন, আমি জানতুম, ও গুলি চালাবে না। ওর আগের কথাটা লক্ষ করোনি? ও কস্তুরীকে কুকুরটা ছাড়তে বারণ করছিল। তার মানে, আমাকে এখন মারতে চায় না, ওর অন্য মতলব আছে।

জোজো বলল, আমাদের এখন কোথায় নিয়ে যাচ্ছে!

দরজার ধারে দুজন বন্দুকধারী পাহারাদার বসে আছে। তাদের দিকে তাকিয়ে কাকাবাবু বললেন, এদের তো জিজ্ঞেস করলেই বলবে শাট আপ। ওরা কিছু বলতে জানে না। দেখাই যাক, কোথায় নিয়ে যায়!

গাড়িটা চলছে তো চলছেই। প্রায় ঘণ্টাচারেক বাদে থামল এক জায়গায়। সেখানে নামতে হল।

ঘুটঘুটে অন্ধকার রাত। টিপিটিপি বৃষ্টি পড়ছে। ছায়ামূর্তির মতন কয়েকজন লোক সেখানে দাঁড়িয়ে। তারা কাকাবাবুদের হাঁটিয়ে নিয়ে চলল। গাড়িটা ফিরে গেল।

অন্ধকারে কিছুই দেখা যায় না। একটা লোক মাঝে-মাঝে টর্চ জ্বেলে পথ দেখাচ্ছে। বোঝা যাচ্ছে, চারপাশে নিবিড় জঙ্গল। আগের লোকগুলো কাকাবাবুর ক্রাচদুটো ছুড়ে দিয়ে গেছে, কিন্তু কাকাবাবুর হাত বাঁধা বলে তা ব্যবহার করতে পারছেন না। লাফিয়ে লাফিয়ে যেতে তাঁর খুবই অসুবিধে হচ্ছে। একবার হোঁচট খেয়ে পড়ে যেতেই সেই টর্চধারী কাছে এসে কাকাবাবুকে দেখল। তারপর তাঁর হাতের বাঁধন খুলে দিল।

কাকাবাবু বললেন, থ্যাঙ্ক ইউ।

প্রায় আধঘণ্টা হাঁটার পর একটা ফাঁকা জায়গায় সবাই থামল। সেখান থেকেও। খানিকটা দূরে এক জায়গায় কয়েকটা মশাল জ্বলছে, মনে হয় প্রায় কুড়ি-পঁচিশজন লোক গোল হয়ে বসে আছে।

একটা মশাল তুলে এনে কাকাবাবুদের দিকে এগিয়ে এল দুজন লোক।

কাছে আসতে দেখা গেল, তাদের একজনের চেহারা মোহন সিংয়ের মতনই লম্বা-চওড়া। কিন্তু সে মোহন সিং নয়, তার মুখোনা বাঘের মতন, মোটা জুলপি নেমে এসেছে প্রায় চিবুক পর্যন্ত, মোটা গোঁফ মিশে গেছে দুপাশের জুলপিতে। কপালে লম্বা-লম্বা তিনখানা চন্দনের দাগ। টকটকে লাল রঙের একটা আলখাল্লা পরে আছে।

লোকটি কাকাবাবুদের দিকে কয়েকবার চোখ বুলিয়ে দেখল।

কাকাবাবু ইংরিজিতে বললেন, শুভ সন্ধ্যা। আমার নাম রাজা রায়চৌধুরী। আপনার নাম জানতে পারি?

লোকটি তার কোনও উত্তর না দিয়ে পাশের একজনকে কী একটা ভাষায় যেন কিছু নির্দেশ দিল। তারপর পায়ের আওয়াজে মাটি কাঁপিয়ে ফিরে গেল আগের জায়গায়।

অন্য একজন লোক সন্তু আর জোজোর হাতের বাঁধন খুলে দিয়ে তিনজনকেই নিয়ে গেল কাছাকাছি একটা কুঁড়েঘরে। ঘরের বেড়া গাছের ডালপাতা দিয়ে তৈরি, মেঝেতে খড় পাতা। একটা হ্যারিকেনও রয়েছে।

একটু পরেই আরও দুজন লোক এসে একগোছা রুটি, একটা ডেকচি ভর্তি গরম মুরগির মাংস রেখে গেল। সঙ্গে এক জাগ জল। মাংস থেকে এখনও ধোঁয়া বেরোচ্ছে।

জোজো বলল, এরা আবার কারা? এত খাতির?

সন্তু বলল, যারাই হোক, খুব খিদে পেয়েছে। আয়, আগে খেয়ে নিই।

কাকাবাবু বললেন, মনে হচ্ছে, এরা একটা অন্য দল। যে ভাষায় কথা বলল, খুব সম্ভবত সেটা তেলুগু। এরা বেশ ভদ্র বলতে হবে। দ্যাখ, হাত বাঁধেনি, ভাল খাবার দিয়েছে। দরজাটাও খোলা। খোলা মানে কী, এ ঘরের দেখছি দরজাই। নেই!

জোজো বলল, জঙ্গলের ডাকাত!

কাকাবাবু খানিকটা রুটি ছিঁড়ে নিয়ে খেতে-খেতে বললেন, কাপালিকও হতে পারে। হয়তো আমাদের নরবলি দেবে। শুনেছি কোথাও কোথাও এখনও নরবলি হয়। বলি দেওয়ার আগে আমাদের ভাল করে খাইয়ে নিচ্ছে।

জোজো বলল, কাকাবাবু, আপনি আমাকে ভয় দেখাচ্ছেন? আমি কি অতই ছেলেমানুষ?

কাকাবাবু বললেন, না, না, ভয় দেখাচ্ছি না। ওই লোকটি লাল রঙের আলখাল্লা পরে আছে কিনা, তাই কাপালিক বলে মনে হল।

সন্তু তাড়াতাড়ি খাওয়া সেরে নিয়ে হাত ধুয়ে ফেলল। তারপর দরজার খোলা জায়গাটার কাছে গিয়ে উঁকি মারল বাইরে।

ঘরটার দরজা বন্ধ করার ব্যবস্থা নেই। বাইরে কোনও পাহারাদারও নেই।

দূরে যেখানে মশালগুলো জ্বলছে, সেখানে এখনও বসে আছে অনেক লোক। মৃদু হল্লা শুনে মনে হয়, ওরা খাওয়াদাওয়া করছে।

জোজো সন্তুর পাশে এসে বাইরেটা দেখে নিয়ে বলল, এখান থেকে পালানো তো সোজা।

সন্তু বলল, নিশ্চয়ই কাছাকাছি কেউ আড়াল থেকে আমাদের ওপর নজর রাখছে।

জোজো বলল, আমরা যদি চট করে জঙ্গলের মধ্যে সটকে পড়ি, তা হলে আমাদের আর ধরতে পারবে?

সন্তু জিজ্ঞেস করল, একটা গন্ধ পাচ্ছিস? জোজো জিজ্ঞেস করল, কীসের গন্ধ?

সন্তু বলল, ঘোড়া-ঘোড়া গন্ধ। আমি দুএকবার ফররফ-র-র করে ঘোড়ার নিশ্বাস ফেলারও শব্দ শুনেছি। এদের ঘোড়া আছে। ঘোড়া ছুটিয়ে আমাদের

অনায়াসে ধরে ফেলবে।

জোজো বলল, আমি ঘোড়ার চেয়েও জোরে ছুটতে পারি ইচ্ছে করলে, কিন্তু মুশকিল হচ্ছে কাকাবাবু তো দৌড়োতে পারবেন না?

কাকাবাবু বললেন, যদি ঘরের দরজা খোলা থাকে, আর কাছাকাছি কোনও পাহারাদার না থাকে, তা হলে সেখান থেকে কক্ষনও পালাবার চেষ্টা করতে নেই। এরা তো বোকা নয়। নিশ্চয়ই কোনও ফাঁদ পাতা আছে। পালাতে গেলে আরও বিপদ হবে।

জোজো তবু ঘর ছেড়ে দু-একবার বাইরে গিয়ে দাঁড়াল। চারদিকে তাকিয়েও কিছু দেখতে পেল না।

সন্তুকে সে বলল, তবু তো খোলা হাওয়ায় খানিকটা নিশ্বাস নেওয়া যাচ্ছে। এতক্ষণে বেশ স্বাধীন স্বাধীন মনে হচ্ছে।

কাছাকাছি কীসের একটা খসখস শব্দ হতেই সে তড়াক করে এক লাফ দিয়ে ঢুকে এল ঘরের মধ্যে।

কাকাবাবু বললেন, ওরা পাহারা না দিলেও আমাদের কিন্তু পালা করে রাত জেগে পাহারা দিতে হবে।

জোজো জিজ্ঞেস করল, কেন?

কাকাবাবু বললেন, যদি রাত্তিরবেলা ওদের কেউ এসে কিছু করতে চায়? সেজন্য সাবধান থাকা দরকার। জন্তু-জানোয়ারও আসতে পারে। সাপ আসতে পারে। এই গরমের সময় খুব সাপ বেরোয়। তোমরা এখন ঘুমিয়ে নাও, আমি জাগছি। পরে এক সময় তোমাদের একজনকে ডেকে দেব।

জোজো বলল, না, না, শেষ রাত্তিরে জাগতে আমার খুব কষ্ট হয়। আমি প্রথমে জাগছি। আপনারা শুয়ে পড়ুন।

সন্তু আর কাকাবাবু শুয়ে পড়লেন।

জোজো বলল, একখানা গল্পের বই থাকলে ভাল হত। এরা বোধ হয় বইটই পড়ে না!

কাকাবাবু বললেন, তুমিই মনে মনে গল্প বানাও না!

আধঘণ্টা ঘুমিয়েই চোখ মেললেন কাকাবাবু। জোজো এর মধ্যেই বসে বসে ঘুমে ঢুলছে। কাকাবাবু উঠে এসে আস্তে আস্তে তাকে শুইয়ে দিলেন। তারপর নিজেই জেগে কাটিয়ে দিলেন সারারাত।
সকালবেলার খাবারও বেশ লোভনীয়। হাতে-গড়া রুটি, কলা, ডিম সেদ্ধ আর কফি।

হাত-মুখ ধুয়ে, সেসব খেয়ে তিনজনেই বাইরে এসে দাঁড়াল, কাছাকাছি কোনও পাহারাদার নেই।

এবার জায়গাটা ভাল করে দেখা গেল।

চারপাশে বড় বড় গাছের ঘন জঙ্গল, মাঝখানে খানিকটা ফাঁকা জায়গা। যেঘরটায় কাকাবাবুরা রাত কাটালেন, সেরকম আরও কয়েকটা ঘর রয়েছে এদিকেওদিকে। দেখলেই বোঝা যায়, ঘরগুলো সব নতুন বানানো হয়েছে। বেশ কিছু বড় বড় গাছ কাটা হয়েছে, মাটিতে ছড়ানো রয়েছে গাছের গুঁড়ি। একটু দূরেও গাছ কাটার শব্দ শোনা যাচ্ছে।

কয়েকজন লোককেও দেখা গেল মাটিতে পড়ে থাকা গাছগুলোর ডাল-পাতা ছাঁটার কাজে ব্যস্ত, তারা কেউ কাকাবাবুদের দিকে ভ্রুক্ষেপও করল না।

এক জায়গায় একটা উনুন জ্বলছে, সেখানে কিছু রান্না করছে দুটি মেয়ে। মনে হয় যেন, একদল যাযাবর অস্থায়ী আস্তানা গেড়েছে এই জঙ্গলে।

সন্তু জিজ্ঞেস করল, কাকাবাবু, আমরা এই জঙ্গলের মধ্যে একটু ঘুরে দেখে আসব?

কাকাবাবু বললেন, যা, না। আস্তে আস্তে হাঁটবি। কেউ বারণ করলে ফিরে আসবি। আমাদের এখানে কেন নিয়ে এল, তাও তো বোঝা যাচ্ছে না।

সন্তু আর জোজো জঙ্গলে ঢুকে পড়ল। কাকাবাবু ক্রাচদুটো নামিয়ে রেখে খানিকক্ষণ ফ্রি হ্যান্ড ব্যায়াম করলেন। মাটিতে শুয়ে পড়ে কোমর বেঁকিয়ে উঠতে গিয়ে দেখলেন পাশে একটা ছায়া পড়েছে। একজন লোক এসে দাঁড়িয়েছে।

লোকটির সারা মুখে দাড়ি, মাথায় জটলা চুল। খালি গা, কিন্তু প্যান্ট পরা, কোমরের বেল্টে রিভলভার, সে কাকাবাবুকে তার সঙ্গে যাওয়ার জন্য ইঙ্গিত করল।

কাকাবাবু বিনা বাক্যব্যয়ে অনুসরণ করলেন তাকে। জঙ্গলের আর-একদিকে কিছুটা ঢুকে দেখা গেল, দুটো বড় গাছের মধ্যে একটা দোলনা টাঙানো হয়েছে। সেই দোলনায় শুয়ে আছে লাল আলখাল্লা পরা সেই বিশাল চেহারার লোকটি, গড়গড়ার নল মুখে দিয়ে তামাক টানছে। তার পাশেই

একটা মোড়ায় বসে আছে একজন ছোট্টখাট্টো মানুষ, মাথা ভর্তি টাক।

অন্য লোকটি কাকাবাবুকে সেখানে পৌঁছে দিয়ে চলে গেল।

কাকাবাবু লাল আলখাল্লা পরা লোকটির দিকে চেয়ে ইংরেজিতে বললেন, নমস্কার। আপনার আতিথেয়তার জন্য ধন্যবাদ। আপনার নামটি এখনও জানা হয়নি। আমার নাম কালকেই বলেছি, রাজা রায়চৌধুরী।

সেই লোকটি কাকাবাবুর কথার কোনও উত্তর না দিয়ে তেলুগু ভাষায় বেঁটে লোকটিকে কিছু বলল।

বেঁটে লোকটি চোস্ত ইংরেজিতে বলল, মিস্টার রায়চৌধুরী, আমাদের লিডার ইংরেজি জানেন না। আপনার যা বলবার আমাকে বলুন। আপনি কি এঁকে চেনেন?

কাকাবাবু বললেন, না, এঁর সঙ্গে আমার আগে দেখা বা পরিচয়ের সৌভাগ্য হয়নি।

বেঁটে লোকটি জিজ্ঞেস করল, আপনি বিক্রম ওসমানের নাম শোনেননি?

কাকাবাবু চমকে গিয়ে বললেন, বিক্রম ওসমান? হ্যাঁ, এ নাম অবশ্যই শুনেছি। মানে, চন্দনদস্যু বিক্রম ওসমান?

লোকটি বলল, দস্যু বলছেন কেন? খবরের কাগজের লোকরা মিথ্যেমিথ্যি দস্যু বলে লেখে। আমরা ব্যবসায়ী। চন্দন কাঠের ব্যবসা করি।

কাকাবাবু বললেন, তার মানে এই যে গাছগুলো কাটা রয়েছে, এগুলো চন্দন গাছ? এটা চন্দনের বন?

লোকটি বলল, সব নয়। তবে এই বনে অনেক চন্দনগাছ আছে, তা ঠিক। বিক্রম ওসমান গম্ভীর গলায় বেঁটে লোকটিকে কিছু একটা আদেশ দিল।

সে বলল, হ্যাঁ, এবারে কাজের কথা হোক। আমার নাম ভুড়ু। আমি পুরো নাম কাউকে জানাই না। আমি ওসমান সাহেবের সেক্রেটারির কাজ করি। শুনুন মিস্টার রায়চৌধুরী, আপনার সঙ্গে আমাদের কোনও শত্রুতা নেই। আপনারা এখানে ভালভাবে থাকবেন, খাবেন, কাছাকাছি বেড়াতেও পারেন। আপনাদের এখানে নিয়ে আসা হয়েছে নিছক ব্যবসায়িক কারণে। আপনাকে একটা চিঠি লিখতে হবে।

কাকাবাবু বললেন, চিঠি? কার কাছে?

এই সময় একটি পঁচিশ-ছাব্বিশ বছরের তরুণী ছুটতে ছুটতে সেখানে এল। সে পরে আছে একটা রঙিন ঘাঘরা আর কাঁচুলি, মুখোনি বেশ সুন্দর।

সে উর্দু ভাষায় বলল, আস্সালামু আলাইকুম সর্দার। আপ্পা রাওকে তুমি বারণ করো। সে আমার কোনও কথা শোনে না।

ওসমান জিজ্ঞেস করল, আপ্পা রাও আবার কী করেছে?

মেয়েটি বলল, এই বাবুটির সঙ্গে যে ছেলে দুটি এসেছে, আপ্পা রাও তাদের

ধরে বেঁধে রেখেছে। আমি বললাম, ছেড়ে দাও, ছেড়ে দাও, তো সে আমাকে ধমকে বলল, তুমি বলার কে?

কাকাবাবু উর্দু ভাষা বেশ ভালই জানেন, সব বুঝতে পারছেন, তিনি বললেন, ছেলে দুটিকে বেঁধে রাখবে কেন? ওরা তো পালাবার চেষ্টা করেনি।

ভুড়ু বলল, আপনি কী করে বুঝলেন, ওরা পালাবার চেষ্টা করেনি?

কাকাবাবু বললেন, আমাকে ছেড়ে ওরা কিছুতেই পালাবে না। ভুড়ু বলল, এখানে অনেকটা জায়গা আমাদের লোক দিয়ে ঘেরা আছে। ওসমান সাহেবের হুকুম ছাড়া কেউ ঢুকতেও পারবে না, বেরুতেও পারবে না।

ওসমান তরুণীটিকে বলল, ঠিক আছে কুলসম, তুমি যাও। আমি আপ্পা রাওয়ের সঙ্গে পরে কথা বলব। আমরা এখন কাজে ব্যস্ত আছি।

কুলসম মাথা নেড়ে বলল, না, এখনই বলে দাও। ছোট ছেলেদের বেঁধে রাখা আমি একদম পছন্দ করি না। ওরা কি জানোয়ার নাকি?

ওসমান বলল, আচ্ছা, আপ্পা রাওকে আমার নাম করে বলো ওদের ছেড়ে দিতে। যেন চোখে-চোখে রাখে।

কুলসম ঝুঁকে পড়ে ওসমানের হাতে একটা চুমু খেয়ে আবার ছুটে চলে গেল। ভুড়ু বলল, রায়চৌধুরী, তা হলে চিঠিটা লিখে ফেলুন! কাগজ-কলম দিচ্ছি।

কাকাবাবু বললেন, কীসের চিঠি, কাকে লিখব, সেটা আগে বলবে তো!

ভুড়ু বলল, আগেই বলেছি, এটা ব্যবসার ব্যাপার। মোহন সিং কুড়ি লাখ টাকার জামিনে আপনাকে পাঠিয়েছে। আমরা পঞ্চাশ লাখ পেয়ে গেলেই আপনাকে ছেড়ে দেব। আপনি চিঠি লিখে পঞ্চাশ লাখ টাকা আনিয়ে নিন।

কাকাবাবু হো হো করে হেসে উঠলেন।

ওদের দুজনের ভুরু কুঁচকে গেল।

কাকাবাবু বললেন, তোমরা মোহন সিং-কে কুড়ি লাখ টাকা আগেই দিয়ে দিয়েছ নাকি? এই রে, খুব ঠকে গেছ! তোমাদের নকল জিনিস গছিয়ে গেছে!

ভুড়ু বলল, নকল মানে? তুমি রাজা রায়চৌধুরী নও?

কাকাবাবু বললেন, আমি আসল রাজা রায়চৌধুরী ঠিকই। কিন্তু আমার জন্য পঞ্চাশ লাখ টাকা কে দেবে?

কেন, তুমি ভারত সরকারের বড় অফিসার।

বড় অফিসার ছিলাম, এখন নই। পা ভাঙার জন্য আগেই রিটায়ার করে গেছি। জানোই তো, যতই বড় অফিসার হোক, রিটায়ার করার পর আর কেউ পাত্তা দেয় না। আমি মরি কি বাঁচি, তা নিয়ে গভর্নমেন্ট মাথা ঘামাতে যাবে কেন?

তা হলে তোমার বাড়ির লোককে লেখো!

বাড়ির লোক মানে, আমি আমার দাদার বাড়িতে থাকি। দাদা সাধারণ মধ্যবিত্ত। পঞ্চাশ লাখ তো দূরের কথা, পাঁচ লাখও দিতে পারবে না।

তবে যে শুনেছি, তুমি পশ্চিমবাংলায় খুব নামকরা লোক?

নাম আছে, দাম নেই। আমার জন্য কেউ অত টাকা দেবে না।

কাকাবাবু এবার ওসমানের দিকে তাকিয়ে উর্দুতে বললেন, বিক্রম ওসমান, আপনি খুব ঠকে গেছেন। মোহন সিং ধাপ্পা দিয়েছে। কোনও বড় কোম্পানির মালিক কিংবা কোনও মন্ত্রীর ছেলেকে ধরে আনলে টাকা আদায় করতে পারবেন।

ওসমান ধড়মড় করে উঠে বসে বলল, কী? মোহন সিং আমাদের ধোঁকা দিয়েছে? তার কল্জেটা ছিঁড়ে নেব তা হলে!

কাকাবাবু বললেন, তাই করুন। মোহন সিংকে ধরে আনুন, আমাকে ধরে রেখে কোনও লাভ নেই।

ভুড়ু বলল, কিন্তু একটা মুশকিল হল, তোমাকে নিয়ে এখন কী করা যায়? তোমাকে তো এমনি এমনি ছেড়ে দেওয়া যায় না।

কাকাবাবু বললেন, টাকা না পেয়েও যদি আমাদের বসিয়ে বসিয়ে খাওয়াতে চাও, তাতে আমার কোনও আপত্তি নেই। এই চন্দনের বনে কয়েকটা দিন কাটিয়ে যেতে আমার ভালই লাগবে!

ভুড়ু বলল, খাওয়ানোর প্রশ্ন নয়। তোমার মুণ্ডুটা যে কেটে ফেলতেই হবে।

কাকাবাবু বললেন, ছি ছি, এ কী কথা! কারও সামনে তার মুণ্ডুটা কেটে ফেলার কথা কেউ বলে? সত্যজিৎ রায়ের একটা গান আছে, মুণ্ডু গেলে খাবটা কী, মুণ্ডু ছাড়া বাঁচব না কি, বাঘারে…, তোমরা বোধ হয় গানটা শোনোনি?

ভুড়ু বলল, কেন তোমার মুণ্ডু কাটতে হবে, বুঝিয়ে দিচ্ছি। বাজারে আমাদের একটা সুনাম আছে, আমরা কথায় যা বলি, কাজেও তা করি। কোনও একজনকে ধরে এনে তার জন্য টাকা চেয়ে চিঠি পাঠাই। টাকা না পেলে দশ দিনের মধ্যে মেরে ফেলা হবে, তা জানিয়ে দিই। সেই ভয়ে তারা টাকা দিয়ে দেয়। তোমাকে যে ধরে আনা হয়েছে, তা এ-লাইনের অনেকেই জেনে যাবে। তোমাকে এমনি এমনি ছেড়ে দিলে সবাই ভাববে, আমরা নরম হয়ে গেছি। আর আমাদের ভয় পাবে না। সেইজন্যই তোমার মুণ্ডুটা কেটে জঙ্গলের বাইরে ফেলে রাখতে হবে।

কাকাবাবু বললেন, তোমরা শুধু চন্দনগাছ কাটো না, মানুষ গুম করাও তোমাদের ব্যবসা?

ভুড়ু বলল, এটা আমাদের সাইড ব্যবসা। আমরা নিজেরা মানুষ ধরে আনি, অন্যরা ধরে এনে আমাদের কাছে কম দামে বিক্রি করে দেয়, আমরা বেশি টাকা আদায় করি, আমাদের খরচও তো কম নয়, গ্রামের লোকদের টাকা দিতে হয়, যাতে পুলিশ আসবার আগেই তারা আমাদের খবর দিয়ে দেয়।

কাকাবাবু বললেন, টাকা পাওয়া যায়নি, এজন্য আগে কারও মুণ্ডু কেটেছ?

ভুড়ু বলল, হ্যাঁ। তিনজনের মুণ্ডু কাটা গেছে।

কাকাবাবু বললেন, আমার জন্যও টাকা পাওয়ার কোনও আশাই নেই। সুতরাং আমারও মুণ্ডুটা কাটতেই হবে?

ভুড়ু হাসতে হাসতে বলল, উপায় কী বলো, ব্যবসার খাতিরে কাটতেই হচ্ছে। তুমি নিজে না লিখতে চাও, আমরাই সরকারের কাছে পঞ্চাশ লাখ টাকা চেয়ে চিঠি পাঠাচ্ছি। দশ দিনের মধ্যে টাকাটা না এলে—

কাকাবাবু হঠাৎ বজ্রমুষ্টিতে ভুড়ুর ঘাড়টা চেপে ধরে বেঁকিয়ে দিলেন। যে যন্ত্রণায় আঁ আঁ করে উঠল।

কাকাবাবু বললেন, তুমি হাসতে হাসতে মানুষের মুণ্ডু কাটার কথা বলছ। নিজের মুণ্ডুটা কাটা গেলে কেমন লাগে তা ভাবো না? এক্ষুনি আমি তোমার ঘাড় মটকে দিতে পারি।

বিক্রম ওসমান রেগে ওঠার বদলে মহাবিস্ময়ে কাকাবাবুর দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর হেসে উঠল বাতাস কাঁপিয়ে। মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে এমন হাসতে লাগল যে, মনে হল যেন দোলনা থেকে পড়েই যাবে।

কাকাবাবু ভুড়ুর গলাটা ছেড়ে দিয়ে দুহাত ঝাড়লেন।

ভুড়ু কাকাবাবুর বদলে ওসমানের দিকে হতভম্বের মতন তাকিয়ে রইল।

হাসি থামিয়ে ওসমান বলল, আরে ভুডিয়া, তোর মুখোনা কী মজার দেখাচ্ছিল! হাসি সামলাতে পারিনি।

তারপর কাকাবাবুকে বলল, শাবাশ বাবুজি! আমার সামনে আমার কোনও শাগরেদের গায়ে কেউ হাত তোলে, এ আমি আগে কখনও দেখিনি। তুমি এত সাহস দেখালে কী করে? আমি যদি সঙ্গে সঙ্গে তোমায় গুলি করতাম?

কাকাবাবু হালকাভাবে বললেন, গুলি খেলেও আমি মরি না। আমি গুলি হজম করে ফেলতে পারি।

ওসমান বলল, পরখ করে দেখব নাকি? দেখি তো কেমন গুলি হজম করতে পারো।

ওসমান কোমর থেকে রিভলভার বার করতেই কাকাবাবু একটা ক্রাচ তুলে বিদ্যুতের মতন বেগে সেই হাতটার ওপর মারলেন। রিভলভারটা ছিটকে দূরে পড়ে গেল।

ওসমান এবারও রাগ না করে ভুরু তুলে বলল, হ্যাঁ বাবুজি, তোমার খুব এলেম আছে। কিন্তু এই করেও তো তুমি বাঁচতে পারবে না। তুমি খোঁড়া মানুষ, দৌড়বার ক্ষমতা নেই। আমি হাঁক দিলে দশজন লোক ছুটে আসবে, তোমাকে শেষ করে দেবে। তুমি এখান থেকে পালাতে পারবে না।

কাকাবাবু বললেন, আমি পালাতে চাইলে দৌড়বার দরকার হয় না। তোমরা

আমার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার না করলে আমার এখন পালাবার ইচ্ছেও নেই।

মাটিতে পড়ে-থাকা রিভলভারটা তুলে নিয়ে সেটা দোলাতে দোলাতে কাকাবাবু বললেন, এটা যদি আমি এখন তোমার বুকের ওপর চেপে ধরি, তা হলে তোমার দশজন লোক ছুটে এসেও কি আমার গায়ে হাত দিতে সাহস করবে?

ওসমান বলল, হ্যাঁ। তাতেও তোমার কোনও লাভ হবে না। আমি জানের পরোয়া করি না। আমার পরে কে সর্দার হবে, তা ঠিক করাই আছে। আমার হুকুম দেওয়া আছে, আমাকে যদি কেউ কখনও ধরেও ফেলে, তা হলেও ওরা গুলি চালাবে। আমাকে বাঁচাবার জন্য দলের ক্ষতি করা যাবে না!

কাকাবাবু রিভলভারটা লক করে ওসমানের কোলের ওপর ছুড়ে দিয়ে বলল, এই নাও, আমি শুধু শুধু কাউকে ভয় দেখাই না। তবে, আমার হাতে রিভলভার থাকলে দশজন লোকও আমাকে আটকাতে পারবে না। আমি দৌড়তে পারি না, কিন্তু ঘোড়া চালাতে জানি।

রিভলভারটা হাতে নিয়ে ওসমান কাকাবাবুর দিকে একটুক্ষণ বিস্মিত ভাবে চেয়ে রইল। তারপর বলল, তুমি একটা অদ্ভুত মানুষ বটে। পিস্তলটা পেয়েও ফেরত দিলে? এরকম আগে দেখিনি। কিন্তু বাবুজি, ভুড়ু কিছু ভুল বলেনি। আমরা এমনি এমনি কাউকে ছেড়ে দিই না। তুমি সরকারকে চিঠি লিখে দেখেই না, টাকাটা দিয়ে দিতেও পারে।

কাকাবাবু বললেন, না। আমি নিজের জন্য কারও কাছেই টাকা চাইব না।

ওসমান বলল, ঠিক আছে, আমরাই চিঠি পাঠাচ্ছি। দশ দিনের মধ্যে টাকা না পেলে তখন একটা কিছু ব্যবস্থা নিতেই হবে। এই দশ দিন তোমার ছুটি। খাও দাও, মজা করো। তুমি দাবা খেলতে জানো?

কাকাবাবু বললেন, তা বেশ ভালই জানি। ওসমান বলল, ঠিক আছে, পরে তোমার সঙ্গে দাবা খেলব।

ভুড়ু এতক্ষণ গলায় হাত বুলোতে বুলাতে হাঁ করে তাকিয়ে ছিল। এবারে সে বলল, ওসমানজি, এই রায়চৌধুরীকে বাঁচিয়ে রাখার একটাই উপায় আছে। ও আমাদের দলে যোগ দিক। লোকটার বুদ্ধিও আছে, গায়ের জোরও আছে। দলের অনেক কাজে লাগবে। কী রায়চৌধুরী, তুমি থাকবে এই দলে?

কাকাবাবু বললেন, ভুড়ু, তুমি আমাকে পুরোপুরি চিনতে পারোনি। এখনও অনেক বাকি আছে।
চালাঘরটায় ফিরে এসে কাকাবাবু দেখলেন, সন্তু আর জোজো বসে বসে একবাটি করে ক্ষীর খাচ্ছে।

কাকাবাবু বললেন, এ আবার কোথায় পেলি?

জোজো বলল, কুলসম দিয়ে গেল। খুব ভাল মেয়ে। আপনার জন্যও নিয়ে আসবে।

কাকাবাবু বললেন, কুলসুমকে আমিও দেখেছি। দেখলেই মনে হয়, মেয়েটির বেশ দয়ামায়া আছে। হাঁ রে সন্তু, তোদের নাকি বেঁধে রেখেছিল? হঠাৎ শুধু শুধু বাঁধতে গেল কেন?

জোজো বলল, শুধু শুধু? সন্তু যা কাণ্ড করেছিল!

কাকাবাবু সন্তুর দিকে চেয়ে রইলেন। সন্তু লাজুকভাবে বলল, সেরকম কিছু করিনি। আমরা জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে হাঁটছি, এই সময় কে যেন আমাদের চেঁচিয়ে কী বলল। লোকটাকে দেখতে পাচ্ছি না, ভাষাও বুঝতে পারছি না। আর একটু এগোতেই একটা লোক একটা ঝোপ থেকে বেরিয়ে এল, তারপর আমার গালে একটা চড় মারল। অমনই আমার রাগ হয়ে গেল, আমিও সঙ্গে সঙ্গে ওকে তুলে একটা আছাড় দিলাম!

জোজো বলল, অতবড় চেহারার লোকটাকে যে সন্তু তুলে ফেলে আছাড় দেবে, তা ও কল্পনাই করেনি। একেবারে কুংফু স্টাইল। তারপর আরও চারপাঁচজন লোক এসে ঘিরে ফেলে আমাদের হাত-পা বেঁধে ফেলল।

কাকাবাবু বললেন, বাকিটা আমি জানি। তোদের বেশিক্ষণ বাঁধা থাকতে হয়নি। কুলসম নামের ওই মেয়েটি এসে ছাড়িয়ে দিল।

জোজো বলল, কাকাবাবু আপনাকে আমি বলেছিলাম না, এরা জঙ্গলের ডাকাত? ঠিক তাই। এরা ডাকাতি করে আর চন্দনগাছ সব কেটে কেটে সাবাড় করে দিচ্ছে।

কাকাবাবু বললেন, শুধু তাই-ই নয়। এরা এক ধরনের মানুষ কেনাবেচার ব্যবসা করে। মোহন সিং আমাদের কুড়ি লাখ টাকায় বিক্রি করে দিয়ে গেছে। এরা এখন তার বদলে পঞ্চাশ লাখ টাকা আদায় করতে চায়।

সন্তু বলল, পঞ্চাশ লাখ টাকা? কে দেবে?

কাকাবাবু বললেন, কেউ দেবে না!

জোজো বলল, বাবাকে চিঠি লিখব? বাবা নেপালের রাজাকে বলে দিলে তিনি এককথায় দিয়ে দেবেন!

কাকাবাবু বললেন, খবরদার, ওরকম কথা উচ্চারণও কোরো না। নেপালের রাজার নাম শুনলেই এরা পঞ্চাশ লাখের বদলে পঞ্চাশ কোটি টাকা চাইবে!

সন্তু বলল, জোজো, তাদের সঙ্গে ইংল্যান্ডের রানি এলিজাবেথের চেনা নেই?

জোজো বলল, তিনবার দেখা হয়েছে। বাকিংহাম প্যালেসে ডিনার খেয়েছি। কাকাবাবু, এক কাজ করলে হয় না? নেপালের রাজা কিংবা ইংল্যান্ডের রানির কাছে টাকা চেয়ে চিঠি লেখা যাক। ওঁরা টাকা পাঠান বা না পাঠান, মাঝখানে কয়েকদিন সময় তো পাওয়া যাবে। সেই সুযোগে আমরা এখান থেকে পালাব!

কাকাবাবু বললেন, এটা গভীর জঙ্গল। এখান থেকে পালানো খুব সহজ হবে না।

একজন লোক কাকাবাবুর জন্য একবাটি ক্ষীর নিয়ে এল। এক চামচ মুখে দিয়ে কাকাবাবু বললেন, বাঃ, চমৎকার খেতে। অনেকদিন ক্ষীর খাইনি, খাওয়ার কথা মনেও পড়ে না। এরা যদি এত ভাল ভাল খাবার দেয়, তা হলে এখান থেকে। পালাবার দরকারটাই বা কী? দিব্যি আছি।

দুপুরবেলাও এল রুটি, মাংস আর দই।

বিকেলবেলা কফির সঙ্গে তিনরকম বিস্কুট।

সন্ধেবেলা অন্ধকারে ওরা তিনজন বাইরে বসে আছে একটা গাছের গুঁড়ির ওপর। একটা হ্যারিকেন নিয়ে এল কুলসম। ঘাঘরার বদলে সে এখন একটা কালো শাড়ি পরেছে।

কাকাবাবুর পাশে দাঁড়িয়ে সে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল, বাবুজি, তুমি উর্দু বোঝো?

কাকাবাবু ঘাড় নাড়তে সে বলল, কাল খুব ভোরবেলা সূর্য ওঠার আগে তোমরা তৈরি থাকবে। আমি দুটো ঘোড়া জোগাড় করে আনব, তাইতে তোমরা পালাবে। সূর্য দেখেই তোমরা চিনতে পারবে পুব দিক। সোজা পুব দিকে ঘোড়া ছোটালে তোমরা পৌঁছে যাবে জঙ্গলের বাইরে।

কাকাবাবু খানিকটা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি আমাদের পালাবার ব্যবস্থা করে দেবে? কেন?

কুলসম বলল, তুমি জানো না, এরা সাঙ্ঘাতিক লোক। যখন-তখন মানুষ খুন করতে পারে। আমি শুনেছি, টাকা না পেলে এরা তোমায় খতম করে দেবে।

কাকাবাবু বললেন, আমায় যদি খতম করে দেয়, তাতে তোমার আপত্তি হবে কেন? তুমিও তো এই দলেরই।

কুলসম কাতরভাবে বলল, না, বাবুজি, আমার খুব কষ্ট হয়। আমার তো আর কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। সর্দার আমাকে কোথাও যেতে দেবে না। তাই আমাকে এখানে থাকতেই হবে। তোমরা পালাও!

কাকাবাবু বললেন, তুমি আমাদের পালাতে সাহায্য করছ, এটা জানতে পারলে এরা তোমায় শাস্তি দেবে না?

কুলসম বলল, জানতে পারবে না। জানলেও সর্দার বড়জোর বকুনি দেবে, কিন্তু আমায় প্রাণে মারবে না। আমি সর্দারের তৃতীয় পক্ষের বউ!

কাকাবাবু সন্তুকে জিজ্ঞেস করলেন, কী রে, সন্তু, পালাবি নাকি?

সন্তু বলল, আমি জোজোকে আমার ঘোড়ায় তুলে নিতে পারি।

কাকাবাবু বললেন, ঠিক আছে, কাকভোরে তোরা তৈরি হয়ে থাকিস। আমি যাচ্ছি না। আমার এখানে এখনও কিছু কাজ আছে।

জোজো বলল, কাজ আছে? এখানে আপনার কী কাজ?

কাকাবাবু মুচকি হেসে বললেন, আছে আছে, পরে জানতে পারবে। তোমরা কালিকটের হোটেলে গিয়ে বিশ্রাম নাও।

সন্তু বলল, তা হলে আমরাও এখান থেকে যাচ্ছি না।

কাকাবাবু কুলসমকে বললেন, কালকেই দরকার নেই, বুঝলে। দু-তিনদিন পরে আমরা তোমাকে জানাব।

কুলসম খানিকটা নিরাশ হয়ে ফিরে গেল।

এর পর কেটে গেল দুদিন। কিছুই তেমন ঘটল না। দিব্যি তিনবেলা খাওয়া আর ঘুমনো। মাঝে মাঝে কাকাবাবু সন্তু আর জোজোকে নিয়ে বেড়াতে যান জঙ্গলে। কেউ কিছু বলে না। কোনও লোকও দেখা যায় না। জঙ্গলের মধ্যে একটা ছোট্ট নদী আছে, জল খুব কম, পায়ে হেঁটেই পার হওয়া যায়। সকালবেলা সন্তু সেই নদীতে নামতেই কোথা থেকে একটা লোক এসে হাজির হল। তার হাতে একটা বর্শা।

সে কাকাবাবুকে বলল, ওই ছেলেটি জলে নেমেছে নামুক। স্নানও করতে পারে। কিন্তু নদীর ওপারে যেন না যায়। আপনি দেখছেন। আপনি দায়ী রইলেন।

লোকটির ব্যবহার রুক্ষ নয়। নরমভাবে এই কথা বলে আবার একটা ঝোপের আড়ালে অদৃশ্য হয়ে গেল।

বিক্রম ওসমানকে এই দুদিন দেখতে পাওয়া যায়নি। তোকজনও কিছু কম। শুধু জঙ্গলের চন্দন গাছ কাটা চলছেই। রাত্তিরবেলা কারা যেন গাছগুলো নিয়েও চলে যাচ্ছে।

তৃতীয় দিন দুপুরবেলা একজন লোক এসে কাকাবাবুকে ডেকে নিয়ে গেল।

আজ আর দোলনা নয়। দুটো কাটা গাছের গুঁড়ির ওপর তক্তা পেতে টেবিল বানানো হয়েছে, তারা ওপর দাবার ছক পাতা। বিক্রম ওসমান সেই লাল আলখাল্লাটার বদলে এখন পরে আছে জিন্স আর টি শার্ট। কোমরে রিভলভার।

সে বলল, এসো বাঙালিবাবু, দেখা যাক তুমি কেমন দাবা খেলতে জানো।

কাকাবাবু বসে পড়লেন একদিকে। প্রথম চাল দিয়ে বললেন, তোমাদের এই জায়গাটা ভারী সুন্দর। শুধু গাছ কাটার শব্দে কান ঝালাপালা হয়ে যায়। এত যে গাছ কাটা হচ্ছে, এগুলো কেনে কারা?

ওসমান বলল, শহরের ব্যবসায়ীরা কেনে।

কাকাবাবু বললেন, এইসব গাছ কাটা বেআইনি জেনেও তারা কেনে?

ওসমান ফুঁসে উঠে বলল, কীসের বেআইনি? সরকারের জঙ্গল নিয়ে আইন বানাবার কী এক্তিয়ার আছে? সৃষ্টিকর্তা যেমন মানুষ সৃষ্টি করেছেন, সেইরকম গাছপালাও সৃষ্টি করেছেন। মানুষ তার প্রয়োজনে গাছ কাটবে। ব্যস!

কাকাবাবু বললেন, সৃষ্টিকর্তা এত গাছপালার সৃষ্টি করেছেন তো মানুষেরই প্রয়োজনে। গাছ কেটে ফেললে তো মানুষেরই ক্ষতি হবে!

ওসমান বলল, তার মানে? মানুষের কী ক্ষতি হবে?

কাকাবাবু বললেন, পৃথিবী থেকে সব গাছপালা যদি শেষ হয়ে যায়, তা হলে মানুষও আর বাঁচবে না।

কেন?

আমরা এই যে শ্বাস নিচ্ছি, তাতে অক্সিজেন থাকে। সেই জন্যই আমরা বেঁচে থাকি। গাছপালাই অক্সিজেন তৈরি করে দেয়। গাছপালা শেষ হয়ে গেলে অক্সিজেনও ফুরিয়ে যাবে, মানুষরা সব দমবন্ধ হয়ে মরবে!

ওসব তোমাদের বই পড়া কথা, আমি বিশ্বাস করি না।

আমাদের দেশে এমনিতেই অনেক গাছ কমে গেছে। তুমি তার ওপর এইসব বড় বড় গাছ কেটে সারা দেশের ক্ষতি করছ!

বাজে কথা রাখো। চাল দাও, তোমার রাজাকে সামলাও!

সেই দানটায় ওসমান বাজিমাত করে দিল, কাকাবাবু হারলেন।

আবার ঘুটি সাজানো হল।

ওসমান বলল, তিন দান খেলা হবে, তুমি প্রত্যেকবার হারবে। আমার সঙ্গে দাবা খেলায় কেউ পারে না।

কাকাবাবু একটু খেলার পর জিজ্ঞেস করলেন, ওসমানসাহেব, তুমি মোহন সিংকে কতদিন চেনো?

ওসমান বলল, অনেকদিন। দশ বছর হবে। আমার সঙ্গে অনেকবার কারবার করেছে।

লোক ধরে এনে তোমার কাছে বিক্রি করে দেয়?

আমরা নিজেরা কাউকে ধরি না। মোহন সিংয়ের মতন আরও লোক আছে। তারাই ধরে আনে।

মোহন সিং আগে যাদের বিক্রি করে গেছে, তোমরা তাদের জন্য বেশি টাকা পেয়েছ?

প্রত্যেকবার। ও যে-দামে বিক্রি করে, আমরা তার অন্তত তিনগুণ টাকা আদায় করি।

আমাদের জন্য মোহন সিংকে কুড়ি লাখ টাকা দিয়ে দিয়েছ?

দশ লাখ দিয়েছি, আর দশ লাখ পরে পাবে। আমরা কথার খেলাপ করি না।

তার মানে ওই দশ লাখ টাকাই তোমাদের লোকসান। আমাদের জন্য তোমরা তো এক পয়সাও পাবে না। মোহন সিং জেনেশুনেই তোমাদের ঠকিয়ে গেছে।

জেনেশুনে? তা হতে পারে না। আমাদের এই কারবারে কেউ বেইমানি করে না।

শোনো ওসমান সর্দার। তোমাকে একটা কথা বলি। একেবারে খাঁটি সত্যি কথা। মোহন সিংয়ের খুব রাগ আছে আমার ওপরে। ও আমাকে খুন করতে চেয়েছিল। তার বদলে তোমাকে দিয়ে খুন করাবে বলে এখানে পাঠিয়ে দিয়েছে। দশ লাখ টাকাও পেয়ে গেল, ওর হাতে রক্তও লাগল না। আমি খুন হলে পুলিশ এলে তোমাকেই এসে ধরবে, মোহন সিংকে কেউ সন্দেহও করবে না।

কোনও পুলিশের সাধ্য নেই আমাকে ছোঁয়।

সেকথা হচ্ছে না। দোষটা তোমার ঘাড়েই চেপে থাকবে। মোহন সিং তোমার মাথায় কাঁঠাল ভাঙল। তুমি তাকে কিছুই করতে পারবে না।

মোহন সিংকে আমি ডেকে জিজ্ঞেস করতে পারি, তুমি যা বলছ তা সত্যি কি!

তুমি ডাকলেই মোহন সিং আসবে? সে আর ধরাছোঁয়া দেবে না। তোমাকে দশ লাখ টাকা ঠকিয়ে গেল, এটা তো সত্যি? আমার মুণ্ডু কাটো আর যাই-ই করো, টাকাটা তো ফেরত পাচ্ছ না!

টাকা ফেরত দেবে না মানে? আলবাত ফেরত দেবে!

সে একবার মুম্বই চলে গেলে তারপর তুমি আর তাকে ছুঁতেও পারবে না।

আমি ইচ্ছে করলে তাকে মুম্বই থেকেও এখানে টেনে আনতে পারি।

এটা আমি বিশ্বাস করি না, ওসমানসাহেব। তুমি জঙ্গলের রাজা হতে পারো। কিন্তু মুম্বইয়ের মতন বড় শহরে তোমার জারিজুরি খাটবে না। মোহন সিংয়ের অনেক দলবল আছে।

তুমি কি ভাবছ, আমি জঙ্গলে থাকি বলে শহরের সঙ্গে আমার যোগাযোগ নেই? অনেক বড় বড় ব্যবসায়ী, পুলিশ অফিসার, মন্ত্রী পর্যন্ত আমায় খাতির করে। আমি ইচ্ছে করলেই মোহন সিংকে নাকে দড়ি দিয়ে টেনে আনতে পারি।

কিন্তু আমি যা দেখেছি, তোমার চেয়ে মোহন সিংয়ের ক্ষমতা অনেক বেশি!

বাঙালিবাবু, আমি তোমার চোখের সামনে এই জঙ্গলে মোহন সিংকে এনে হাজির করালে তুমি বিশ্বাস করবে, কার ক্ষমতা বেশি? খালি কথাই তো বলে যাচ্ছ, মন দিয়ে খেলো!

খেলছি, খেলছি! তবে, মুখে তুমি যতই বড়াই করো, মোহন সিংকে এখানে ধরে আনা তোমার ক্ষমতায় কুলোবে না, আমি জোর দিয়ে বলতে পারি!

ওসমান এবার রেগে গিয়ে বলল, ফের ওই এক কথা? তুমি খেলবে কি না বলো?

এর পর কাকাবাবু কিছুক্ষণ মন দিয়ে খেললেন, আবার হেরে গেলেন। তিনি বললেন, তুমি তো সত্যি বেশ ভাল খেলতে পারো দেখছি?

ওসমানের মুখে জয়ের হাসি ফুটে উঠল। গর্বের সঙ্গে বলল, দাবা খেলায় কেউ আমার সঙ্গে পারে না। আরও খেলার সাহস আছে?

কাকাবাবু বললেন, আর এক দান খেলে দেখি, তোমায় হারাতে পারি কি না!

কিন্তু সে খেলাটা আর হল না। দু-এক দান দিতে-না-দিতেই একজন লোক। ঘোড়া ছুটিয়ে এদিকে চলে এল। এক লাফ দিয়ে ঘোড়া থেকে নেমে ওসমানের কাছে এসে কানে কানে কিছু বলতে লাগল উত্তেজিতভাবে।

ওসমানও চঞ্চল হয়ে দাবার ছক গুটিয়ে ফেলে বলল, চলো বাঙালিবাবু, এ-জায়গা ছেড়ে এক্ষুনি চলে যেতে হবে। একটা বড় পুলিশবাহিনী আসছে, তুমি ঘোড়া চালাতে জানেনা বলেছিলে। ঘোড়ায় চেপে যেতে হবে।

কাকাবাবু বললেন, আমার সঙ্গের ছেলেদুটো? ওসমান বলল, ওদের ব্যবস্থা হবে। চিন্তা কোরো না।

সবাই ছোটাছুটি করে জিনিসপত্র গুছিয়ে নিতে লাগল। ভেঙে ফেলা হল কুঁড়েঘরগুলো।

কাকাবাবু চাপলেন একটা ঘোড়ায়। যতজন লোক তত ঘোড়া নেই, তাই এক ঘোড়ায় দুজন করে যেতে হবে। কাকাবাবুর ঘোড়ায় উঠে পড়ল ভুড়ু।

বনের মধ্যে ছুটল ঘোড়া। কাকাবাবুর পাশে পাশে আরও তিনটি ঘোড়া, তারাই রাস্তা দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে পার হতে হচ্ছে ছোট ছোট নদী, তারপর

পাহাড়ি রাস্তায় এসে ঘোড়ার গতি কমে এল।

ভুড়ু নিজে ঘোড়া চালাতে জানে না। সে সামনে খানিকটা সিঁটিয়ে বসে আছে।

কাকাবাবু এক সময় তাকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার নাম ভুড়ু কেন?

ভুড়ু বলল, ওটা মোটেই আমার নাম নয়। আমার আসল নাম কাউকে বলি না।

কাকাবাবু বললেন, তোমার ইংরেজি শুনলে মনে হয়, তুমি বেশ লেখাপড়া জানো। তুমি এই ডাকাতের দলে ভিড়লে কেন?

ভুড়ু বলল, ডাকাত কী বলছেন মশাই। বড় বড় ব্যবসাদারদের মতন এরাও ব্যবসা করে। আমি এদের কাছে চাকরি করি।

কাকাবাবু বললেন, কিন্তু তুমি নিশ্চয়ই জানো, এইসব চন্দনগাছ কাটা বেআইনি। এরা মানুষ কেনা-বেচা করে। মানুষ খুনও করে।

ভুড়ু বলল, সেসব আমি কী জানি! আমি নিজের হাতে গাছও কাটি না, মানুষও খুন করি না। আমার কোনও দায় নেই।

বাঃ, বেশ কথা। কিন্তু যখন এরা পুলিশের হাতে ধরা পড়বে, তখন এদের দলের লোক হিসেবে তুমিও শাস্তি পাবে।

এরা কখনও ধরা পড়বে না। কিছু পুলিশকে টাকা খাওয়ানো আছে। তারাই আগে থেকে খবর দিয়ে দেয়।

তা হলে এখন পালাতে হচ্ছে কেন?

মাঝে মাঝে এরকম চোর-পুলিশ খেলা হয়। খবরের কাগজে লেখা হবে যে, পুলিশ কত চেষ্টা করছে ওসমানের দলকে ধরবার!

তবু এরকম দল বেশিদিন টিকতে পারে না। তুমি রবিন হুডের নাম শুনেছ?

শুনব না কেন? সিনেমাও দেখেছি।

রবিন হুডকেও দল ভেঙে দিতে হয়েছিল। তুমি শিক্ষিত লোক হয়ে এই খুনিদের সঙ্গে ভিড়ে আছ, তোমার লজ্জা করে না?

রায়চৌধুরীবাবু, তুমি আমাকে ধমকাচ্ছ? তুমি নিজের প্রাণটা আগে বাঁচাও। এখান থেকে তোমার পালাবার কোনও উপায় নেই। এরা হাসতে হাসতে মানুষ খুন করে। তুমি ভাবছ, ওসমান তোমার সঙ্গে দাবা খেলছে বলে তোমাকে দয়া করছে? মোটেই না। ঠিক দশদিন পর, লোককে দেখাবার জন্য সে এক কোপে তোমার মুণ্ডুটা কেটে ফেলবে। তিনদিন কেটে গেছে, মনে রেখো!

তুমি এর আগে কারও গলা ওইভাবে কাটতে দেখেছ?

হ্যাঁ। দুবার। ওসমানের যা হাতের জোর, এক কোপের বেশি দু কোপ লাগে।

আমার কী ইচ্ছে হচ্ছে জানো? এক ধাক্কা দিয়ে তোমাকে ঘোড়া থেকে ফেলে দিই, তারপর তোমার বুকের ওপর দিয়ে ঘোড়া চালিয়ে দিই।

তাতে কোনও লাভ নেই। অন্য ঘোড়সওয়াররা চাবুক মেরে মেরে তোমাকে তক্ষুনি শেষ করে দেবে।

একটা পাহাড়ের মাঝামাঝি জায়গায় সব ঘোড়া থামল।

এ-পাহাড়ে গাছ বেশি নেই। তবে পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে লুকোবার অনেক জায়গা। ওদের দলের সবাই এখনও এসে পৌঁছয়নি। ওসমানকে দেখা যাচ্ছে না। কাকাবাবু ঘোড়া থেকে নেমে সন্তু আর জোজোর জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন।

খানিক পরে ওসমান এল কুলসমকে নিয়ে। সন্তু আর জোজোকে দেখা গেল না। আরও অনেকে আসেনি মনে হল।

তিনি ভুভুকে জিজ্ঞেস করলেন, বাকি লোকরা কোথায় গেল?

ভুড়ু বলল, সবাই একসঙ্গে আসে না। নানাদিকে ছড়িয়ে যায়। একটা দল পুলিশকে ধোঁকা দেওয়ার জন্য অন্যদিকে নিয়ে যায়। একজন নতুন লোক পুলিশের বড়কর্তা হয়েছে, তাকে এখনও ঘুষ খাওয়ানো যায়নি। কয়েকদিন পরেই ঠাণ্ডা হয়ে যাবে।

কাকাবাবু ওসমানের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, আমার সঙ্গের ছেলেদুটি কোথায় গেল?

ওসমান তার সহচরদের কিছু নির্দেশ দিচ্ছিল, সংক্ষিপ্তভাবে উত্তর দিল, ওদের পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।

কাকাবাবু বললেন, পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে মানে? কোথায়? ওসমান বলল, ওরা কালিকট পৌঁছে যাবে। কোনও চিন্তা নেই। কাকাবাবু রেগে গিয়ে বললেন, তার মানে? আমাকে কিছু না জানিয়ে ওদের পাঠিয়ে দিলে কেন?

ওসমান এবার চোখ গরম করে বলল, আমি কী করব না করব, তার জন্য তোমার অনুমতি নিতে হবে নাকি? ছোট ছেলেদের সঙ্গে নিয়ে ঘোরায় অনেক ঝামেলা!

কাকাবাবু বললেন, ওরা মোটেই ছোট নয়!

ওসমান বলল, মোহন সিং তোমাকে বিক্রি করে গেছে। ওই ছেলেদুটি ফাতু। ওদের আমি রাখতে যাব কেন?

কাকাবাবু বললেন, ওরা যদি আবার মোহন সিংয়ের খপ্পরে গিয়ে পড়ে? আমাকে কষ্ট দেওয়ার জন্য মোহন সিং ওদের ওপর অত্যাচার করবে। ওসমান সাহেব, তুমি এটা কী করলে? মোহন সিংকে ধরার ক্ষমতা তোমার নেই, তুমি আমার ছেলেদুটোকে ওর দিকে ঠেলে দিলে?

রাগে চোখ-মুখ লাল করে ওসমান বলল, বাঙালিবাবু, তুমি আমাকে ওই কথা বারবার বলবে না। আমি যা করেছি, বেশ করেছি!

কুলসম কাকাবাবুর কাছে এসে ব্যাকুলভাবে বলল, বাবুজি, আপনার ওই ছেলেদুটোর কোনও ক্ষতি হবে না। ওরা ভালভাবে পৌঁছে যাবে, আপনি বিশ্বাস করুন! আপনাকে ছেড়ে দেওয়ার কথা আমি সর্দারকে বলতে পারি না। সেটা ওদের ব্যবসার ব্যাপার। কিন্তু ওরা তো কোনও দোষ করেনি। এখানে থাকলে ওদের অনেক অসুবিধে হত। আমি কসম খেয়ে বলছি, ওদের নিরাপদ জায়গায় পৌঁছে দেওয়া হবে।

কাকাবাবু একদৃষ্টিতে কুলসমের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন।
জোজো আর সন্তু বসে ছিল জঙ্গলের মধ্যে ছোট নদীটার ধারে। ছোট ছোট মাছ আছে নদীতে, মাঝে মাঝে ঝিলিক দিয়ে যাচ্ছে।

জোজো জলে হাত ড়ুবিয়ে সেই মাছ ধরার চেষ্টা করছে, একটাও ধরা যাচ্ছে।

এক সময় সে জিজ্ঞেস করল, হ্যাঁ রে সন্তু, এখনও কি কেউ ঝোপের আড়ালে বসে আমাদের ওপর নজর রাখছে?

সন্তু বলল, হতেও পারে। এদের ব্যবস্থাটা বেশ ভাল। আমাদের এরা আটকে রেখেছে বটে, কিন্তু মোটেই বন্দি বন্দি লাগে না। বেশ খোলামেলা জায়গায় ঘুরে বেড়ানো যায়।

জোজো বলল, তা হলেও এইভাবে কতদিন থাকব? যতই ভাল খেতে দিক। – কাকাবাবু এখান থেকে পালাবার কোনও উপায় বার করছেন না কেন রে?

সন্তু বলল, বোধ হয় এখনও সময় হয়নি।

পেছনে ঘোড়ার পায়ের আওয়াজ হতেই ওরা ফিরে তাকাল।

ঘোড়ায় চেপে তিনজন লোক আসছে। এরা এই দলেরই লোক, মুখ চেনা।

একজন কী একটা ভাষায় কিছু বলল, ওরা বুঝল না। অন্য একজন ভাঙা ভাঙা হিন্দিতে বলল, আমাদের এখান থেকে চলে যেতে হবে। ঘোড়ায় উঠুন।

সন্তুও ভাঙা হিন্দিতে জিজ্ঞেস করল, চলে যেতে হবে মানে, কোথায় যাব?

সে বলল, এখানকার ডেরা তুলে দিতে হচ্ছে। পুলিশ আসছে।

সন্তু বলল, কাকাবাবু?

লোকটি বলল, তিনিও যাবেন। সবাই চলে যাবে। এখানে কিছু থাকবে না।

ওদের দুজনের কাঁধে রাইফেল, একজনের কোমরে রিভলভার। কথা বলার ভঙ্গিটা রুক্ষ নয়।

সন্তু বলল, ঠিক আছে। আমি আর আমার বন্ধু এক ঘোড়ায় যেতে পারি।

সেই লোকটি বলল, আর ঘোড়া নেই। আপনারা দুজন দুটো ঘোড়ায় উঠুন।

সন্তু আর জোজো ঘোড়ায় চড়ে বসার পর সেই লোকটি বলল, আমাদের ওপর হুকুম আছে, আপনাদের চোখ বেঁধে নিতে হবে।

জোজো বলল, কেন, চোখ বাঁধতে হবে কেন?

লোকটি বলল, সেইরকমই হুকুম।

তর্ক করে লাভ নেই। কালো কাপড় দিয়ে ওদের দুজনের চোখ বেঁধে দেওয়া হল।

ঘোড়াগুলো চলতে শুরু করার পর জোজো জিজ্ঞেস করল, কী রে সন্তু, কিছু দেখতে পাচ্ছিস?

সন্তু বলল, না, সব অন্ধকার।

জোজো বলল, এরা ডাকাত বলে মনেই হয় না। কোনও ডাকাত আপনিআপনি বলে কথা বলে? সেইজন্যই তো চোখ বাঁধতে রাজি হয়ে গেলাম।

সন্তু বলল, তুই, তুই বললে কী করতি?

জোজো বলল, আমিও তুই বলতাম। একবার কী হয়েছিল জানিস, বাবার সঙ্গে আমাজন নদীর জঙ্গলে গিয়েছিলাম। হঠাৎ একদিন ডাকাত ঝাঁপিয়ে পড়ে আমাকে তুলে নিয়ে গেল। এইরকম ভাবে চোখ বেঁধে ঘোড়ায় চড়ে পালাচ্ছিল। যে ডাকাতটা আমায় ঘোড়ায় তুলেছিল, সে প্রথম থেকেই আমাকে তুই-তুই করছিল। আমিও তাকে তুই বলতে লাগলাম। তাতে সে খুব রেগে গেল। আমি তাকে আরও রাগিয়ে দিচ্ছিলাম।

সন্তু জিজ্ঞেস করল, কী ভাষায় কথা হচ্ছিল?

জোজো বলল, স্প্যানিশ ভাষায়। তুই যেমন একটু-একটু হিন্দি জানিস, আমিও তেমনই একটু-একটু স্প্যানিশ জানতাম। মানে, ওখানে গিয়ে শিখে নিয়েছিলাম আর কী! এখন ভুলে গেছি। তারপর শোন না, ডাকাতটা তো রেগে দাঁত কিড়মিড় করছিল। তখন আমি ঘোড়াটাকে একটা রাম চিমটি কাটলাম। ঘোড়াটা অমনই লাফিয়ে উঠল। ঘোড়াটা হঠাৎ লাফিয়ে উঠতেই ডাকাতটা তাল সামলাতে না পেরে নীচে পড়ে গেল। আমি তখন ঘোড়াটাকে চালিয়ে ভোঁ ভাঁ!

তুই এখন ঘোড়াকে চিমটি কাটবি নাকি?

এদের কাছে যে রাইফেল আছে। গুলি করবে। হ্যাঁ রে সন্তু, এরা বাংলা বোঝে না তো?

মনে হয়, না।

তুই এদের কাছ থেকে একটা রাইফেল কেড়ে নিতে পারবি না?

চোখ বাঁধা অবস্থায় রাইফেল কাড়ব কী করে?

তাও তো বটে। এর আগে তো কক্ষনও চোখ বাঁধেনি। পুলিশের ভয়ে এরা পালাচ্ছে। আমরা যদি তখন চেঁচিয়ে পুলিশ ডাকতাম–

জোজো, পুলিশ কথাটা ওরা বুঝতে পারবে। সব কথা বাংলায় বল।

পু… মানে, ওই কথাটার বাংলা কী?

সরকারি প্রহরী বলতে পারিস।

হ্যাঁ, ইয়ে, মানে, আমাদের উচিত ছিল সরকারি প্রহরীদের সাহায্য নেওয়া।

কাকাবাবু অন্য জায়গায় ছিলেন, তাঁর সঙ্গে দেখা হল না, আমরা নিজেরা ঠিক করব কী করে?

পাশাপাশি দুটো ঘোড়া চলছে। বোঝাই যায় যে জঙ্গলের পথ, তাই জোরে ছুটতে পারছে না। জোজো আর সন্তু দিব্যি গল্প করতে করতে যেতে লাগল। যারা ওদের নিয়ে যাচ্ছে, তারা বাধাও দিল না, নিজেরাও কিছু বলছে না।

যাচ্ছে তো যাচ্ছেই, কতটা সময় যে কেটে গেল তা বোঝা যায় না। দু-আড়াই ঘণ্টা তো হবেই। ঝোপঝাড় ভেদ করে যেতে হচ্ছে, ওদের গায়ে লাগছে গাছের ডালপালা।

একটা সময় থামল ঘোড়া। সন্তু জোজোকে নামিয়ে দেওয়া হল। ওরা কিছু বোঝবার আগেই বেঁধে দেওয়া হল ওদের হাত।

জোজো জিজ্ঞেস করল, এ কী, হাত বাঁধলেন কেন! আমরা তো চোখের বাঁধন খোলার চেষ্টা করিনি!

কেউ উত্তর দিল না। ঘোড়র পায়ের শব্দ শুনে বোঝা গেল, ওদের দুজনকে রেখে ঘোড়াগুলো দূরে সরে যাচ্ছে।

তারপর আর কোনও সাড়াশব্দ নেই।

জোজো বলল, এ কী ব্যাপার হল রে সন্তু?

সন্তু বলল, আমাদের নামিয়ে নিয়ে চলে গেল। কী ব্যাপার বুঝতে পারছি না।

জোজো বলল, এ জায়গাটাই বা কীরকম?

চোখ বাঁধা, হাত বাঁধা, জোজো একটু এদিক-ওদিক যাওয়ার চেষ্টা করতেই গুঁতো খেল একটা গাছে। সে উঃ করে উঠল।

সন্তু হাতদুটো মুখের কাছে এনে বাঁধন খোলার চেষ্টা করল। খুব শক্ত বাঁধন। নাইলনের দড়িতে দাঁতও বসানো যাচ্ছে না।

সন্তু বলল, জোজো, আগে চোখের বাঁধনটা খোলা দরকার। কাপড়ের গিট খোলা শক্ত হবে না। তুই আমার পেছনে এসে দাঁড়া। আমার বাঁধনটা খোলার চেষ্টা কর।

জোজো বলল, তুই কোথায়?

সন্তু বলল, এই তো এখানে। গলার আওয়াজ শুনে বুঝতে পারছিস না?

জোজো সন্তুর কাছে আসতে গিয়ে আরও দুবার গাছে গুঁতো খেল। তারপর ধাক্কা খেল সন্তুর সঙ্গে।

সন্তু বলল, এবার আস্তে-আস্তে আমার পেছনে চলে আয়। জোজো পেছনে গিয়ে গিট খোলার চেষ্টা করল।

সন্তু বলল, এ কী রে, তুই আমার কান কামড়ে দিচ্ছিস কেন?

জোজো হেসে ফেলে বলল, দুর ছাই, কোনটা কান আর কোনটা গিট, বুঝব কী করে!

জোজো আরও কিছুক্ষণ চেষ্টা করেও পারল না।

সন্তু অস্থির হয়ে বলল, তোর দ্বারা কিছু হয় না। তুই আমার সামনে আয়, আমি তোরটা খুলে দিচ্ছি।

এই সময় বেশ কাছেই গুলির আওয়াজ হল পরপর দুবার। ওরা চমকে গিয়ে থেমে গেল। এরপর মনে হল যেন একটা গাড়ির আওয়াজ শোনা যাচ্ছে।

জোজো বলল, কারা যেন আসছে।

সন্তু বলল, আসুক। তুই এসে দাঁড়া, তাড়াতাড়ি কর, তোর বাঁধনটা খুলে দিই, তারপর তুই দেখে দেখে…

সে সময় আর পাওয়া গেল না। কাছেই একটা গাড়ি থামল, তার থেকে কয়েকটি লোক নেমে দৌড়ে ওদের ঘিরে দাঁড়াল।

প্রথমে একজন কিছু একটা জিজ্ঞেস করল, সে ভাষা বোঝা গেল না।

সন্তু বলল, প্লিজ স্পিক ইন ইংলিশ। অর ইন হিন্দি।

জোজো বলল, অথবা বাংলায়। এবার একজন ইংরেজিতে জিজ্ঞেস করল। তোমরা কে? প্রশ্ন শুনেই সন্তু বুঝতে পারল, এরা ডাকাত নয়।

সে বলল, আগে আমাদের বাঁধন খুলে দিন, সব বুঝিয়ে বলছি! লোকগুলো ওদের শুধু চোখের বাঁধন খুলে দিল, হাত খুলল না।

সন্তু দেখল, ওরা চারজন লোক। তিনজন খাকি হাফপ্যান্ট ও হাফশার্ট পরা। আর একজন ফুলপ্যান্ট। এরা ফরেস্ট গার্ড, একজন অফিসার।

সন্তু বলল, বিক্রম ওসমানের নাম জানেন নিশ্চয়ই। আমাদের আটকে রেখেছিল। হঠাৎ এখানে কেন ছেড়ে দিয়ে গেল জানি না।

জোজো বলল, বিক্রম ওসমান সাঙ্ঘাতিক ডাকাত। চন্দনগাছ কেটে বিক্রি করে, মানুষ খুন করে।

ফরেস্ট গার্ডরা নিজেদের মধ্যে চোখাচোখি করল। তাদের মুখে ভয়ের ছাপ ফুটে উঠেছে।

অফিসারটি বললেন তারা তোমাদের ধরে নিয়ে গিয়েও ছেড়ে দিল কেন?

জোজো বলল, সেটা তো আমরাও বুঝতে পারছি না।

সন্তু বলল, আমাদের কাকাবাবু এখনও ওদের সঙ্গে আছেন। নিশ্চয়ই তাঁকে ছাড়েনি।

একজন গার্ড অফিসারটিকে কী যেন বলল। অফিসারটি সন্তুকে বললেন, কাছেই আমাদের বনবিভাগের চেক পোস্ট। সেখানে চলো, তারপর তোমাদের সব কথা ভাল করে শুনব।

সন্তু বলল, কিন্তু কাকাবাবু… ওখানে রয়ে গেছেন, তাঁকে খুঁজতে যেতে হবে। আপনি আমাদের সাহায্য করবেন?

অফিসারটি বললেন, তাকে খুঁজতে বিক্রম ওসমানের ডেরায় যাব? মাথা খারাপ নাকি? আমরা এই কজন গিয়ে মরব নাকি? পুলিশবাহিনীকেই বিক্রম ওসমান গ্রাহ্য করে না। আমাদের কাছে তো তেমন কিছু অস্ত্রই নেই। ওদের কাছে সাব মেশিনগান পর্যন্ত আছে।

সন্তু বলল, আপনারা সাহায্য করবেন না? তা হলে আমরা দুজনেই আবার ফিরে যাব!

অফিসারটি মাথা নেড়ে বললেন, উঁহু! তা চলবে না। আমরা তোমাদের দুজনকে পুলিশের হাতে তুলে দেব। তারপর তারা যা ভাল বোঝে করবে। আমাদের কোনও দায়িত্ব নেই।

সন্তু চিৎকার করে বলল, কাকাবাবুকে ছেড়ে আমি কিছুতেই যাব না। আপনাদের সাহায্যের কোনও দরকার নেই।

সে দৌড়ে জঙ্গলের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করতেই দুজন গার্ড ছুটে গিয়ে তাকে। চেপে ধরল। হাত বাঁধা অবস্থায় সন্তু ধস্তাধস্তি করেও নিজেকে ছাড়াতে পারল না।

ওদের দুজনকে জোর করে চাপিয়ে দেওয়া হল একটা জিপ গাড়িতে।

জোজো বলল, সন্তু, আমরা শুধু দুজনে ফিরে গিয়ে কিছুই করতে পারব না। পুলিশের কাছে সব জানিয়েই দেখা যাক না!

সন্তু তবু রাগে ফুসছে, আর কামড়ে কামড়ে হাতের বাঁধন খোলার চেষ্টা করছে।

চেকপোস্টের কাছে একটুখানি থেমে জিপটা আবার ছুটল। কিছুক্ষণ পরে শেষ হয়ে গেল জঙ্গল। একটা থানায় সন্তু আর জোজোকে জমা করে দিয়ে গেল বন বিভাগের লোকেরা।

থানাটা বেশ ছোট। সন্তুদের সব কথা শুনে সেখানকার দারোগা বললেন, আমরা ওই জঙ্গলে ঢুকতে পারব না। কিছুদিন আগেই আমাদের একজন কনস্টেবল খুন হয়েছেন ওই ডাকাতদের হাতে। তোমাদের আমরা শহরে পৌঁছে দিচ্ছি।

ওঠা হল আর একটা জিপে। তারপর আরও দু ঘণ্টা পরে সেই জিপ শহরে পৌঁছল। সন্তু-জোজো দুজনেই চিনতে পারল, সেই শহরটা কালিকট।

এই পুলিশের গাড়িটা ওদের নিয়ে এল বড় একটা থানায়। এখনও দুজনের হাত বাঁধা। পাঁচ-ছদিন ধরে একই পোশাক পরে আছে বলে সেগুলো একেবারে ননাংরা হয়ে আছে। মাথার চুলে চিরুনি পড়েনি এই কদিন। ওদের অদ্ভুত দেখাচ্ছে।

প্রথমে এই থানার একজন পুলিশ ওদের ঘটনা শুনল সংক্ষেপে। তারপর সে নিয়ে গেল বড় অফিসারের ঘরে।

সেখানে অফিসারের সামনে আর একজন লোক বসা। তাকে দেখে সন্তু আর জোজো দুজনেই একসঙ্গে বলে উঠল, অমলদা?

অমল দারুণ অবাক হয়ে প্রায় লাফিয়ে উঠে বলল, এ কী অবস্থা হয়েছে তোমাদের! আমি হঠাৎ কয়েকদিন ছুটি পেয়ে ভাবলাম এখানে এসে পড়ে তোমাদের চমকে দেব! কিন্তু তোমাদের পাত্তাই পাই না। কোনও হোটেল কিছু বলতে পারে না। শেষকালে একটা হোটেলে গিয়ে শুনলাম, তোমরা সেখানে উঠেছিলে। কিন্তু জিনিসপত্র সব ফেলে রেখে কোথাও উধাও হয়ে গেছ! তারপর এলাম এই থানায়। ইনি মিস্টার রফিক আলম, এঁর কাছে শুনলাম, কাকাবাবু এখানে এসেছিলেন। ভাস্কো দা গামার ভূত দেখার কথা কী যেন বলেছিলেন। আসলে কী হয়েছিল বলো তো?

রফিক আলম বললেন, আহা আগে ওদের বসতে দিন। মুখ শুকিয়ে গেছে। মনে হচ্ছে অনেকক্ষণ জলটলও খায়নি।

জোজো ধপাস করে একটা চেয়ারে বসে পড়ে বলল, তেষ্টায় গলা শুকিয়ে গেছে!

এর মধ্যেই থানার সব জায়গায় রটে গেছে যে, বিক্রম ওসমানের খপ্পর থেকে কোনওরকমে পালিয়ে এসেছে দুটি হাত বাঁধা ছেলে। বাঘের মুখ থেকেও কেউ কখনও নিস্তার পেতে পারে, কিন্তু বিক্রম ওসমানের গ্রাস থেকে কেউ এমনি এমনি ছাড়া পেয়েছে, এটা আগে কক্ষনও শোনা যায়নি।

অনেকে ভিড় করে দেখতে এল ওদের। যেন দারুণ দুই বীরপুরুষ। একজন একটা ছুরি এনে ওদের হাতের বাঁধন কেটে দিল।

জোজো দারুণ জমিয়ে ঘটনাটা বলতে শুরু করল।

সন্তু তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, অমলদা, সবটা বলতে অনেক সময় লাগবে। আসল কথা হল, কাকাবাবু এখনও ওদের ওখানে রয়ে গেছেন। তাঁকে সাহায্য করার জন্য আমাদের এক্ষুনি ওখানে ফিরে যাওয়ার দরকার।

অমল বলল, এই তো আলমসাহেব রয়েছেন। ইনি নিশ্চয়ই সাহায্য করবেন।

আলমসাহেব আস্তে আস্তে দুদিকে মাথা নেড়ে বললেন, আমরা কী সাহায্য করব? ওই জঙ্গল আমার থানার এলাকার মধ্যে পড়ে না। এখান থেকে অনেক দূরে।

অমল বলল, সে কী মশাই! একজন মানুষ এত বিপদে পড়েছে শুনেও আপনারা কোনও সাহায্য করবেন না? এটাই তো পুলিশের কাজ।

আলম বললেন, বিক্রম ওসমানের দলের বিরুদ্ধে পুলিশ অনেকবার অনেক অভিযান চালিয়েও কিছু করতে পারেনি। ওরা জঙ্গলের ঘাঁতঘোঁত সব জানে। জঙ্গলে ঢুকলে ওদের গুলিতেই পুলিশ মারা পড়ে।

সন্তু বলল, তার মানে কী, কাকাবাবু ওদের কাছেই আটকে থাকবেন? ওরা যদি…

আলম বললেন, বিক্রম ওসমানের বিরুদ্ধে অভিযান চালাতে গেলে বড় বড় কর্তাদের, এমনকী চিফ মিনিস্টারেরও অনুমতি লাগে। আমি হেড কোয়ার্টারে খবর পাঠাব, তারপর দেখা যাক ওঁরা কী বলেন। দু-তিনদিনের আগে কিছু হবে না।

সন্তু আঁতকে উঠে বলল, দু-তিনদিন! তার মধ্যে কত কিছু ঘটে যেতে পারে!

আলম চেয়ারে হেলান দিয়ে বললেন, আমার আর তো কিছু করার নেই!

সন্তুদের দিকে চেয়ে অমল বলল, চলো, এখন আমরা হোটেলে যাই। তোমাদের একটু বিশ্রাম দরকার। এক্ষুনি তো কিছু করা যাচ্ছে না। ভেবেচিন্তে একটা কিছু উপায় বার করতে হবে।

জোজো এর মধ্যেই ঘুমে ঢুলে পড়ছিল। তাকে টেনে তোলা হল।

ওরা ফিরে এল আগেকার হোটেলে। কাকাবাবুদের সব জিনিসপত্র বার করে নিয়ে সে ঘর ভাড়া দেওয়া হয়ে গেছে। আর একটা বড় ঘর অবশ্য পাওয়া গেল।

অমল বলল, তোমরা স্নানটান করে পোশাক পালটে নাও, ততক্ষণে আমি কিছু খাবার নিয়ে আসি।

জোজো স্নান করতে গেল, সন্তু বসে রইল মুখ নিচু করে। অমল ফিরে এসে দেখল, সন্তু একই ভাবে বসে আছে।

অমল বলল, আগে কিছু খেয়ে নাও সন্তু। খিদে পেয়েছে নিশ্চয়ই।

সন্তু বলল, আমি কিছু খাব না। কাকাবাবু ওদের হাতে আটকা পড়ে আছেন। আমরা রয়েছি এখানে, এটা আমি কিছুতেই সহ্য করতে পারছি না।

অমল বলল, বিক্রম ওসমানের খবর প্রায়ই কাগজে বেরোয়। সাঙ্ঘাতিক লোক। পুলিশ অনেক চেষ্টা করেও ওদের ধরতে পারেনি। এত বড় জঙ্গলের মধ্যে কোথায় যে কখন লুকিয়ে থাকে!

সন্তু বলল, ওরা আমাদের দূরে পাঠিয়ে দিল কেন? নিশ্চয়ই এবার কাকাবাবুর ওপর অত্যাচার করবে।

জোজো বলল, পুলিশ যদি ধরতে না পারে, তা হলে মিলিটারি লাগাতে হবে। যদি পাঁচশোজন আর্মি একসঙ্গে জঙ্গলটা সার্চ করে

অমল বলল, আর্মি তো ভারত সরকারের। এখানকার পুলিশ তো কোনও সাহায্যই করতে চাইল না। আমাদের কথায় তো আর্মি নামবে না। একটা উপায় বার করা যেতে পারে। পুরো ঘটনাটা আগে আমাকে বলো তো!

জোজো মহা উৎসাহে বলতে শুরু করল! সন্তু মাঝে মাঝে তাকে থামিয়ে দিয়ে সংক্ষিপ্ত করতে লাগল অনেকটা।

সব শুনে অমল বলল, অনেক বড় বড় বিপদ থেকে কাকাবাবু বেরিয়ে আসেন, সেইজন্য আমাদের খুব বেশি দুশ্চিন্তা করার দরকার নেই। আবার এটাও ঠিক, বিক্রম ওসমানের মতন হিংস্র লোকের পাল্লায় তো কাকাবাবু আগে পড়েননি! একটা কাজ করা যেতে পারে, বড় বড় খবরের কাগজে খবরটা ছাপিয়ে দিলে সরকারের টনক নড়বে। মুম্বইয়ের কয়েকজন সাংবাদিকের সঙ্গে আমার চেনা আছে। তাদের আমি ফোন করে জানিয়ে দিচ্ছি।

সন্তু বলল, কাকাবাবু কিন্তু খবরের কাগজ-টাগজে নিজের নাম ছাপা পছন্দ করেন না।

অমল বলল, কাকাবাবু পছন্দ না করলে কী হবে, এইটাই একমাত্র উপায়। কাগজে বেরুলে পুলিশ অ্যাকশন নিতে বাধ্য হবে।

জোজো বলল, আরে সন্তু, বুঝতে পারছিস না! এটা পাবলিসিটির যুগ! কাগজে বেরলেই কাজ হবে।

অমল টেলিফোনের কাছে বসল। কিন্তু এখান থেকে মুম্বইয়ের লাইন পাওয়া মুশকিল। বারবার চেষ্টা করেও বিরক্ত হয়ে অমল টেলিফোনটা একবার বেশ জোরে রেখে দিতেই দরজায় ঠক ঠক শব্দ হল।

দরজাটা খোলার পর সন্তু যাকে দেখল, তাকে একেবারেই আশা করেনি। সন্তু অবাক হয়ে চেয়ে রইল।

পুলিশ অফিসার রফিক আলম। মুখোনা গম্ভীর। তিনি ভেতরে এসে বললেন, আমি কোনও খারাপ খবরও আনিনি, ভাল খবরও আনিনি। পুলিশ হিসেবেও আসিনি। আমি কয়েকটা কথা বলতে চাই।

অমল বলল, হ্যাঁ, হ্যাঁ, বসুন, বসুন!

আলম বললেন, মিস্টার রায়চৌধুরীকে বিক্রম ওসমান ধরে রেখেছে শুনেও আমি কোনও সাহায্য করতে পারব না বলেছি। তা শুনে নিশ্চয়ই আপনারা আমাকে খুব বাজে লোক ভেবেছেন। সত্যিই বিশ্বাস করুন, একাজ আমার এক্তিয়ারের বাইরে। আমাদের থানার কোনও ক্ষমতা নেই।

অমল বলল, কিন্তু রাজা রায়চৌধুরী এই কালিকটেই ছিলেন। সেখান থেকে তাঁকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। আপনারা তাঁর খোঁজ করার দায়িত্ব নেবেন না কেন?

আলম বললেন, ওই যে মোহন সিং না কে, ফিলমের লোক, সে যদি ধরে রাখত, তা হলে আমি নিশ্চয়ই পুলিশ পার্টি পাঠাতাম। কিন্তু বিক্রম ওসমানকে নিয়ে এখানকার দু-তিনটে রাজ্য ব্যতিব্যস্ত। সে মুখ্যমন্ত্রীদেরও হুমকি দেয়। সাধারণ পুলিশ তার চুলও ছুঁতে পারবে না!

সন্তু বিরক্ত ভঙ্গিতে বলল, বাঃ! সে যাকে-তাকে ধরে রাখবে, আর পুলিশ কিছুই করবে না, এমন কথা কখনও শুনিনি!

আলম সন্তুর চোখের দিকে কয়েক পলক স্থিরভাবে তাকিয়ে থেকে বললেন, তুমি খুব তেজি ছেলে! আমি এখানে কেন এসেছি, সেটা বলি?

অমল বলল, হ্যাঁ, বলুন, বলুন!

আলম সন্তুর দিকেই তাকিয়ে থেকে বললেন, বিক্রম ওসমানের ডেরাটা তুমি চিনিয়ে দিতে পারবে? আমি একা সেখানে যেতে চাই। বিক্রম ওসমানের সঙ্গে আমার নিজস্ব একটা ব্যাপার আছে।

অমল অবাক হয়ে বলল, আপনি একা যাবেন?

আলম বললেন, হ্যাঁ। থানায় কিছু বলিনি। কারণ, আমার ধারণা, প্রত্যেক থানাতেই ওই লোকটার কিছু গুপ্তচর আছে। কিছু পুলিশকে ও নিয়মিত টাকা দেয়। আমরা যখনই কোনও অ্যাকশন নেওয়ার কথা ঠিক করি, তখনই কেউ না কেউ আগে থেকে ওকে খবরটা পৌঁছে দেয়। সেইজন্য ওকে ধরা যায় না।

অমল বলল, কিন্তু আপনি একা গিয়ে কী করবেন?

আলম বললেন, আমি একবার তার মুখোমুখি দাঁড়াতে চাই। তারপর যা হওয়ার তা হবে। তোমরা কি আমাকে জায়গাটা চিনিয়ে দিতে পারবে?

জোজো বলল, সে নাকি বারবার জায়গা বদলায়। পুলিশ এসেছে শুনেই তো আগের জায়গাটা ছাড়তে হল। সেই পুলিশ কারা?

আলম বললেন, তা আমি জানি না। ওরকম অনেক খেলা চলে। আগের জায়গাটা দেখিয়ে দিলেই চলবে। ও নিশ্চয়ই ওখানে আবার ফিরে আসবে।

জোজো বলল, আমাদের চোখ বেঁধে এনেছিল। জঙ্গলের রাস্তাটা তো আমরা চিনতে পারব না।

সন্তু বলল, যেখানে আমাদের ছেড়ে দিয়েছিল, সেখানে গেলে নিশ্চয়ই ঘোড়া চলার পথের একটা চিহ্ন পাওয়া যাবে। অনেক গাছের ডালপালা ভেঙেছে।

আলম সন্তুকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি আমাকে সেখানে নিয়ে যেতে পারবে? তুমি শুধু দূর থেকে আমাকে জায়গাটা দেখিয়ে দেবে। তারপর আর তোমাকে থাকতে হবে না।

সন্তু বলল, নিশ্চয়ই! চলুন, কখন যাবেন?

আলম বললেন, সন্ধে হয়ে গেছে। এখন যাত্রা করে কোনও লাভ নেই। কাল ভোরের আলো ফুটতেনা-ফুটতেই—

অমল বলল, সন্তু একা যাবে নাকি? আমিও যেতে চাই। এরকম অ্যাডভেঞ্চারের সুযোগ তো জীবনে পাব না। তাতে যদি আমার প্রাণটা চলে যায়, কুছ পরোয়া নেই!

জোজো বলল, আর আমি বুঝি একা একা এই হোটেলে বসে থাকব? তা হলে পরে সন্তু আমায় ভীরু, কাপুরুষ, কাওয়ার্ড কত কী বলবে। কাকাবাবু আর কখনও আমাকে সঙ্গে নেবেন না। আমিও যাব!
একটা গাছের তলায় শুয়ে ছিলেন কাকাবাবু। ফুরফুরে হাওয়া, নানারকম পাখির ডাক। ওপরের আকাশ দেখতে দেখতে কাকাবাবুর ঘুম এসে গেল।

খানিক বাদে ভুড়ু এসে ডাকল তাঁকে।

কাকাবাবু ধড়মড় করে উঠে বসতেই ভুড়ু বলল, আমার সঙ্গে আসুন, একটা মজার জিনিস দেখাব।

কাকাবাবু ভুড়ুর সঙ্গে হাঁটতে লাগলেন।

দুটো ছোট পাহাড়ের মাঝখানে খানিকটা উপত্যকা। সেখানে এর মধ্যেই কয়েকটা চালাঘর বানানো হয়েছে। মাঝখানটা ফাঁকা। সেখানে একটা লম্বা খুঁটি পুঁতে একজন মানুষকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রাখা হয়েছে।

কাছে গিয়ে কাকাবাবু লোকটিকে চিনতে পারলেন। মোহন সিং।

কাকাবাবু মুচকি মুচকি হাসতে লাগলেন।

আজ বিক্রম ওসমানের পোশাক অন্যরকম। সে পরে আছে শেরওয়ানি। কোমরে ঝুলছে তলোয়ার। মাথায় একটা পালক বসানো নীল পাগড়ি।

সে গর্বিতভাবে বলল, কী বাঙালিবাবু, এবার বুঝলে তো, মোহন সিংকে ধরে আনার ক্ষমতা আমার আছে কি না!

কাকাবাবু বললেন, হ্যাঁ, তোমার ক্ষমতা আছে দেখছি!

ওসমান বলল, এবার দ্যাখো, ওকে আমি কী শাস্তি দিই!

মোহন সিংয়ের সারা গায়ে জল কাদা মাখা, জামা ছিঁড়ে গেছে। বোঝা যায় যে, ধরে আনার সময় তাকে বেশ চড়-চাপড়ও মারা হয়েছে।

কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, কোথা থেকে একে ধরে আনলে?

ওসমান বলল, সমুদ্রের ধারে সিনেমার শুটিং করছিল। সেখান থেকে তুলে এনেছি। এবার একটা একটা করে ওর হাত আর পা আমি কেটে ফেলব নিজের হাতে। আমার সঙ্গে বেইমানি!

সে খাপ থেকে সড়ত করে তলোয়ারটা টেনে বার করল।

কাকাবাবু বললেন, ওকে মেরে ফেলবে? তোমাদের সঙ্গে এতকালের সম্পর্ক। একটা মোটে ভুল করে ফেলেছে। না, না, মেরে ফেলাটা ঠিক হবে না!

মোহন সিংয়ের চোখ রাগে জ্বলজ্বল করছিল, এবার সে অবাক হয়ে কাকাবাবুর দিকে তাকাল। এই লোকটা তাকে বাঁচাতে চাইছে?

ওসমান ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, এর ওপর তোমার দয়া হল কেন? এই লোকটাই তো তোমাকে বেচে দিয়েছিল আমার কাছে।

কাকাবাবু বললেন, তা হোক। তবু ওকে বাঁচিয়ে রাখলেই তোমাদের লাভ হবে।

ভুড়ু বলল, ঠিক বলেছেন। ও আমাদের দশ লাখ টাকা ঠকিয়েছে। ওর কাছ থেকে বিশ লাখ টাকা আদায় করতে হবে।

এ-কথা শোনামাত্র মোহন সিং বলল, আমি বিশ লাখ টাকা দিয়ে দিচ্ছি। আমাকে ছেড়ে দাও! শুটিং নষ্ট হচ্ছে, অনেক টাকার ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে। একটা চিঠি লিখে দিচ্ছি, গেলেই ওই টাকাটা পেয়ে যাবে।

কাকাবাবু ভুড়ুর দিকে মুখ ফিরিয়ে ভুরু তুলে একটা ইঙ্গিত করে বললেন, মাত্র কুড়ি লাখ?

ভুড়ু বলল, ঠিক ঠিক। আপনার জন্য পঞ্চাশ লাখ টাকা ধরা হয়েছিল, সেই টাকাটা ওর কাছ থেকেই আদায় করা উচিত।

ওসমান বলল, ওর কাছ থেকে পঞ্চাশ লাখ টাকার চিঠি লিখিয়ে নে।

কাকাবাবু এবার ওসমানের দিকে ফিরে বললেন, ওরা হিন্দি সিনেমা বানায়। ওদের কাছে পঞ্চাশ লাখ টাকাও কিছুই না। অন্তত এক কোটি টাকা চাও!

ওসমান বলল, হ্যাঁ, এটাই ঠিক কথা। পঞ্চাশ লাখ ওর মুণ্ডুর দাম, আর পঞ্চাশ লাখ ফাইন!

মোহন সিং একটু আগে ভেবেছিল কাকাবাবু ওর জীবন বাঁচিয়ে দিচ্ছে। এবার রেগে কটমট করে তাকাল। তারপর ওসমানকে বলল, ভাইসাব, তোমার সঙ্গে আমার এতকালের কারবার, এখন তুমি ওই শয়তান রায়চৌধুরীটার কথা শুনছ?

ওসমান একটা আঙুল দেখিয়ে বলল, এক কোটি! নইলে মুণ্ডু ঘ্যাচাং!

মোহন সিং বলল, এক কোটি টাকা জোগাড় করা কি সোজা কথা? অনেক সময় লাগবে।

ওসমান বলল, যতদিন না টাকাটা আসে, ততদিন তুই এই ভাবে থাকবি বেইমানের এই শাস্তি!

তলোয়ারটা খাপে ভরে ওসমান হা হা করে একটা অট্টহাসি দিল।

কুলসম বলল, এই লোকটাকে আমার কোনওদিনই ভাল লাগে না। একে কিছু খেতে দেওয়াও উচিত না।

ওসমান বলল, কিছু খেতে দিবি না। শুধু জল চাইলে জল দিবি।

তারপর কাকাবাবুর দিকে ফিরে বলল, আজ মেজাজটা বেশ খুশ আছে। চলো বাঙালিবাবু, তোমার সঙ্গে দাবা খেলি?

ওসমান ভিড়ের মধ্যে দাবা খেলা পছন্দ করে না। তাই বেশ খানিকটা দূরে গিয়ে একটা নিরিবিলি জায়গায়, গাছের ছায়ায় খেলতে বসা হল।

ওসমান বলল, তুমি ভাল বুদ্ধি দিয়েছ। আমার এত রাগ হয়েছিল, আমি আর একটু হলে মোহন সিংকে কেটেই ফেলতাম। তা হলে আর এক কোটি টাকা পাওয়া যেত না।

কাকাবাবু বললেন, মানুষকে কেটে ফেললে কী পাওয়া যায় জানো? জেল কিংবা ফাঁসি।

ওসমান ঠোঁট উলটে বলল, ওসব আমি পরোয়া করি না। আমাকে কে ধরবে?

কাকাবাবু বললেন, তোমার রাজা সামলাও। এই কিস্তি দিলাম!

ওসমান দাবার গুটিগুলোর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে মহাবিস্ময়ের সঙ্গে বলল, তুমি আমাকে এত সহজে হারিয়ে দিলে? অ্যাঁ? এর আগে তুমি বারবার হেরেছ!

কাকাবাবু বললেন, তখন তো ইচ্ছে করে হেরেছি।

ওসমান বলল, কেন, ইচ্ছে করে হেরেছ কেন?

কাকাবাবু বললেন, তোমাকে খুশি করার জন্য। নইলে, দাবা খেলায় তুমি আমার কাছে ছেলেমানুষ!

ওসমান বলল, বাজে কথা। আমি অন্যমনস্ক ছিলাম, তাই তুমি জোচ্চুরি করে এই দানটা জিতেছ। আর এক দান খেলে দ্যাখো!

আবার ছক সাজানো হল। এবার কাকাবাবু আরও তাড়াতাড়ি ওসমানকে হারিয়ে দিলেন।

ওসমান হাঁ করে কাকাবাবুর দিকে তাকিয়ে রইল। কাকাবাবু একগাল হেসে বললেন, তোমার খেলা দেখেই বুঝেছি। তুমি আমাকে একবারও হারাতে পারবে না।

ওসমান বলল, আমি দাবায় চ্যাম্পিয়ান। আমায় কেউ কখনও দাবা খেলায় হারাতে পারেনি।

কাকাবাবু বললেন, আমাদের বাংলায় একটা কথা আছে। বন-গাঁয়ে শিয়াল রাজা। তুমি হচ্ছ তাই। তুমি তো খেলো শুধু তোমার দলের লোকদের সঙ্গে। বাইরের লোকদের সঙ্গে তো খেলোনি!

হঠাৎ ওসমানের চোখদুটো জ্বলে উঠল। দাঁতে দাঁত চিবিয়ে সে বলল, তোমাকে আর বাঁচিয়ে রাখা যায় না। এক্ষুনি মেরে ফেলতে হবে।

কাকাবাবু বললেন, আরে আরে, অত রেগে যাচ্ছ কেন? খেলায় তো হার-জিত আছেই!

ওসমান তবু দুহাত বাড়িয়ে এল কাকাবাবুর গলা টিপে ধরার জন্য।

কাকাবাবু সেই হাতদুটো ধরে ফেলে ঝটকা টান দিয়ে তাকে শূন্যে তুলে ছুড়ে দিলেন দূরে!

তারপর বললেন, এখন যাকে কুংফু ক্যারাটে বলে, আমাদের সময় সেটাকে বলা হত যুযুৎসু! সেটা আমি ভালই জানি। এক জাপানির কাছে শিখেছিলাম।

ওসমান রাগে কাঁপতে কাঁপতে উঠে দাঁড়াল। খাপ থেকে তলোয়ারটা বার করে বলল, এবার?

কাকাবাবুও উঠে দাঁড়িয়ে একটা ক্রাচ ফেলে দিয়ে আর একটা ক্রাচ তুলে বললেন, ওতেও তুমি খুব সুবিধে করতে পারবে না। আমি এটা দিয়ে লড়ব।

ওসমান বলল, তুমি একটা বেওকুফ। তোমার পা খোঁড়া, ওই একটা লাঠি দিয়ে তুমি আমার তলোয়ারের সঙ্গে লড়বে? এবার তুমি মরবে। আমার সামনে কেউ দাঁড়াতে পারে না।

কাকাবাবু বললেন, খোঁড়া পায়ের জন্য খানিকটা অসুবিধে হয় বটে, কিন্তু তাতেও অনেকেই হেরে যায়। চেষ্টা করে দ্যাখো।

ওসমান তলোয়ার চালাতে শুরু করলে কাকাবাবু প্রথম কয়েকবার ঠুক ঠুক। করে আটকালেন শুধু। তারপর হঠাৎ যেন খেপে উঠে নিজে এগিয়ে এসে দড়াম দড়াম করে মারতে লাগলেন। একবার লাফিয়ে উঠে ওসমানের হাতে এত জোর মারলেন যে, তার হাত থেকে তলোয়ারটা ছিটকে পড়ে গেল।

ওসমান কয়েক মুহূর্ত হতভম্বের মতন দাঁড়িয়ে রইল। তারপর দূরে একজন লোককে দেখে চেঁচিয়ে ডাকল, আপ্পা রাও! আপ্পা রাও!

কাকাবাবু বললেন, এবার তোমার লোকজন ডাকবে? অনেক লোক ঘিরে ফেললে কিছু করতে পারব না, আমি দৌড়তে পারি না যে! আর বন্দুক পিস্তলের বিরুদ্ধেও খালি হাতে লড়তে পারব না। কিন্তু তুমি আমাকে মারবার জন্য এত ব্যস্ত হয়ে উঠলে কেন?

আপ্পা রাও ছুটতে ছুটতে কাছে এসে দাঁড়াল।

ওসমান বলল, একটা ঘোড়া নিয়ে এসো। চোখ বাঁধার কাপড় আর দড়িও আনবে।

আপ্পা রাও দৌড়ে ফিরে গেল।

ওসমান বলল, বাঙালিবাবু, আমি তোমার সম্পর্কে মত বদলে ফেলেছি। তোমায় মারব না। তোমায় মুক্তি দিয়ে দিচ্ছি, তুমি বাড়ি ফিরে যাও।

কাকাবাবু বেশ অবাক হয়ে বললেন, সে কী! এমনি এমনি মুক্তি দিয়ে দেবে?

ওসমান বলল, হ্যাঁ। মোহন সিংয়ের কাছ থেকে এক কোটি টাকা পেলে তোমার টাকাটাও ওতেই উশুল হয়ে যাচ্ছে। তোমাকে আর ধরে রাখার কারণ নেই। শুধু একটা শর্ত আছে। আমি যে তোমার কাছে দাবা আর তলোয়ারে হেরেছি, এ কথা কাউকে বলতে পারবে না।

কাকাবাবু হেসে বললেন, ঠিক আছে, সে কথা কাউকে বলব না। কিন্তু আমি এখন মুক্তি পেতে চাই না।

ওসমান চোখ কপালে তুলে বলল, তুমি মুক্তি চাও না? কেন?

কাকাবাবু চারপাশে তাকিয়ে নিয়ে বললেন, এই জায়গাটা আমার বেশ লাগছে। আরও কিছুদিন থেকে যেতে চাই!

ওসমান বলল, তোমার মাথা খারাপ? কখন রাগের চোটে আমি তোমাকে মেরে বসব তার ঠিক আছে? ছেড়ে দিচ্ছি, পালাও।

কাকাবাবু বললেন, পালাবার আমার একটুও ইচ্ছে নেই। বেশ আছি!

ওসমান বলল, এরকম কথা কোনও বন্দির মুখে আমি আগে কখনও শুনিনি। তোমাকে দেখছি জোর করে তাড়াতে হবে।

আপ্পা রাও একটা ঘোড়ায় চড়ে ফিরে এল।

আপ্পা রাওয়ের কাছে রিভলভার আছে, সুতরাং গায়ের জোর দেখিয়ে লাভ নেই। ওরা যখন তাঁর হাত ও চোখ বাঁধল, তিনি প্রতিবাদ করলেন না।

ওসমান বলল, আপ্পা রাও, তুমি এই বাঙালিবাবুকে হলদিঝোরা পর্যন্ত নিয়ে যাও। ওকে আমরা ছেড়ে দিচ্ছি। দেখো যেন, কোনও অসুবিধে না হয়। গাড়ির রাস্তায় পৌঁছে যায়।

আপ্পা রাও বেশ অবাক হলেও কোনও কথা না বলে কাকাবাবুকে ঘোড়ায় তুলে নিল।

খানিক দূর যাওয়ার পর সে জিজ্ঞেস করল, আমাদের সর্দার তোমাকে এমনি এমনি ছেড়ে দিল কেন?

কাকাবাবু বললেন, তা তো জানি না। আপ্পা রাও বলল, আমি হলে তোমাকে কিছুতেই ছাড়তাম না। টাকা আদায় হলে তোমাকে দিয়ে চাকরবাকরের কাজ করাতাম।

কাকাবাবু বললেন, তা হলে তুমি আমাকে ফিরিয়ে নিয়ে চলো!

আপ্পা রাও বলল, সর্দারের হুকুম। তার ওপরে কথা বলা যায় না।

হঠাৎ কাকাবাবুর মাথায় একটা জোরে ঘুসি মেরে সে বলল, সোজা হয়ে বোসো! আমার গায়ে হেলান দিচ্ছ কেন?

কাকাবাবু মোটেই হেলান দেননি। আপ্পা রাওয়ের কথা শুনলেই বোঝা যায়, রাগে তার হাত নিশপিশ করছে!

খানিক বাদে সে আবার একটা ঘুসি মেরে বলল, এই হারামজাদা, ঘুমোচ্ছিস কেন রে? সোজা হয়ে বসে থাক। না হলে গুলি করে তোকে মেরে সর্দারকে গিয়ে বলব, তুই পালাবার চেষ্টা করছিলি!

কাকাবাবু ঘুমোননি। কোনও উত্তরও দিলেন না। প্রায় এক ঘণ্টা চলার পর ঘোড়াটা এক জায়গায় থামল।

আপ্পা রাও বলল, তোমাকে এখানে ছেড়ে দিয়ে যাব। ঝরনাটার ওপারে একটুখানি গেলেই একটা পাকা রাস্তা দেখতে পাবে। ওখান দিয়ে মাঝে মাঝে গাড়ি যায়। কোনও গাড়ি থামিয়ে উঠে পড়ার চেষ্টা করবে। একদিন লাগতে পারে, দুদিনও লাগতে পারে।

সে কাকাবাবুর চোখের বাঁধন, হাতের বাঁধন খুলে দিয়ে বলল, নেমে পড়ো!

কাকাবাবু ঘোড়া থেকে নামার বদলে ঘুমন্ত মানুষের মতন উলটে পড়ে গেলেন। আর উঠলেন না।

আপ্পা রাও নিজের মনেই বলল, লোকটার কী হল? মরেই গেল নাকি? সে নিজে ঘোড়া থেকে নেমে কাকাবাবুকে টেনে তুলতে গেল।

কাকাবাবু ওসমানের মতন একেও ধরে তুলে এক আছাড় মারলেন। সঙ্গে সঙ্গে ওর বুকের ওপর চেপে বসে গলা টিপে ধরে বললেন, তুমি আমাকে অকারণে ঘুসি মেরেছ, গুলি করে মারতে চেয়েছিলে। এবার দ্যাখো, কেমন লাগে।

আপ্পা রাও আঁ আঁ করে শব্দ করতে লাগল, চোখদুটো যেন ঠেলে বেরিয়ে আসবে। কাকাবাবু আরও জোরে চাপ দিলেন। ক্রমে আপ্পা রাওয়ের গোঙানি থেমে চোখ বুজে এল।

কাকাবাবু এবারে তার গলা ছেড়ে দিয়ে নাকের কাছে হাত নিয়ে বুঝলেন নিশ্বাস পড়ছে। মরেনি, অজ্ঞান হয়ে গেছে।

ওর রিভলভারটা নিজের পকেটে পুরলেন কাকাবাবু। দড়ি দিয়ে হাত আর পা বাঁধলেন। তারপর টানতে টানতে নিয়ে চললেন রাস্তার ধারে।

এর মধ্যে আপ্পা রাওয়ের জ্ঞান ফিরে এসেছে।

কাকাবাবু বললেন, এবারে তুমিই কোনও গাড়ি দেখলে চেঁচিয়ে উদ্ধার পাওয়ার চেষ্টা করো। বিদায়!

কাকাবাবু ঘোড়াটায় চেপে ফেরার পথ ধরলেন। চোখ বাঁধা ছিল, তিনি পথ চেনেন না। কিন্তু তিনি জানেন, ঘোড়াকে অন্য দিকে না চালালে সে নিজে নিজে ঠিক ডেরাতে ফিরে যায়। তিনি রাশটা আলগা করে ধরে রইলেন।

ঘোড়াটা ঠিকই এক সময় সেই পাহাড়ের কাছে এসে পৌঁছল। এর মধ্যে সন্ধে হয়ে গেছে। কাকাবাবু উপত্যকা পর্যন্ত গেলেন না। এক জায়গায় একটা ছোট্ট জলাশয় আছে, তার পাশে ঘন জঙ্গল, সেখানে থামলেন। ঘোড়াটাকে এক জায়গায় বেঁধে অপেক্ষা করলেন সারারাত।

ভোরবেলা আর-একটা ঘোড়ার আওয়াজ শুনে কাকাবাবু ধড়মড় করে উঠে বসলেন। আগের দিন সকালেই তিনি দেখেছিলেন, বিক্রম ওসমান এই সময় এই নির্জন জায়গাটায় এসে প্রার্থনা করে।

কাকাবাবু একটা ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে রইলেন।

বিক্রম ওসমান ঘোড়া থেকে নেমে জলাশয়ে হাত-মুখ ধুয়ে নিল। তারপর হাঁটু মুড়ে নমাজে বসল।

কাকাবাবু অপেক্ষা করে রইলেন। নমাজ শেষ হওয়ার পর বিক্রম ওসমান উঠে দাঁড়াতেই তিনি ঝোপ থেকে বেরিয়ে এসে বললেন, এই যে, সুপ্রভাত?

মুখ ঘুরিয়ে ভূত দেখার মতন চমকে উঠে ওসমান বলল, তুমি! ফিরে এসেছ? কেন?

কাকাবাবু বললেন, ইচ্ছে হল, তোমাকেও সঙ্গে নিয়ে যাই।

ওসমান বলল, তোমার দেখছি সত্যিই মাথা খারাপ হয়ে গেছে। আমাকে কোথায় নিয়ে যাবে?

কাকাবাবু বললেন, আমি যেখানে যাব, সেখানে!
ওসমান বলল, তুমি নিতে চাইলেই বা আমি যাব কেন? কাল তোমাকে মেরে ফেলিনি, এটাই তোমার পরম ভাগ্য। আজ তোমাকে শেষ করে দিতেই হবে! তুমি খুব জ্বালাচ্ছ।

কাকাবাবু রিভলভারটা দেখিয়ে বললেন, আজ যে আমার সঙ্গে এটা আছে?

ওসমান বলল, ওটা থাকলেই বা কী হবে? আমি হাঁক দিলেই আমার দলের লোক ছুটে আসবে।

কাকাবাবু বললেন, তার আগেই যদি আমি গুলি চালিয়ে দিই?

ওসমান বলল, তোমাকে আগেই বলেছি, আমার মৃত্যুভয় নেই। আমি মরলে পরের নেতা কে হবে, তাও ঠিক করা আছে। আমাকে মারলে আমার দলের লোক এসে তোমাকে ছিঁড়ে কুটি কুটি করে ফেলবে!

কাকাবাবু বললেন, মৃত্যুভয় নেই? দ্যাখো তো এটা কেমন লাগে।

তিনি একটা গুলি চালালেন। সেটা ওসমানের ডান কানের সামান্য একটু অংশ ছিঁড়ে নিয়ে গেল। ঝরঝর করে রক্ত পড়তে লাগল সেখান থেকে।

ওসমানের মুখটা বিবর্ণ হয়ে গেল। কানটা চেপে ধরে সে বলল, তুমি সত্যি গুলি চালালে? নির্বোধ! গুলির শব্দ শুনে কয়েকজন ছুটে আসবেই।

কাকাবাবু বললেন, তাদের আসতে দেখলে আমার এখনও ঘোড়া নিয়ে ছুটে পালাবার সুযোগ আছে। কিংবা ধরা পড়লেও কিছু আসে যায় না। কিন্তু তার আগে কী করব জানো? আমি একটা গুলিতে তোমার ডান হাতের বুড়ো আঙুলটা থেঁতলে দেব। যাতে তুমি জীবনে আর কখনও এই হাতে তলোয়ার বন্দুক ধরতে না পারো। আর-একটা গুলিতে একটা হাঁটু গুঁড়িয়ে দেব, যাতে চিরকালের মতন খোঁড়া হয়ে থাকবে। তুমি বেঁচে থাকবে বটে, কিন্তু ডাকাত দলের সর্দারি করা ঘুচে যাবে। আমার যে কথা, সেই কাজ। এখন বলল, তুমি আমার সঙ্গে যেতে চাও, না ওইভাবে বাঁচতে চাও? আমি পাঁচ পর্যন্ত গুনব। এক-দুই-তিন—

ওসমান চেঁচিয়ে বলে উঠল, না, না, গুলি কোরো না!

কাকাবাবু বললেন, সকলেই ভয় পায়। নাও, এবার ঘোড়ায় উঠে পড়ে ঠিক পথে চলো। কাল ফেরার সময় আমি পথ অনেকটা দেখে রেখেছি, আমায় ঠকাতে পারবে না।

কাকাবাবু নিজেও ঘোড়ায় চড়ে ওসমানের পাশাপাশি চলতে চলতে বললেন, তুমি নিশ্চয়ই একবার খুব জোরে ঘোড়া ছুটিয়ে কিংবা হঠাৎ অন্যদিকে বেঁকে গিয়ে আমার চোখে ধূলো দেওয়ার চেষ্টা করবে? তার ফল কী হবে জানো?

ওসমান বলল, কী?

কাকাবাবু বললেন, আমার হাতের টিপ খুব ভাল। পালাতে গেলেই আমি তোমার পায়ে গুলি করব। এ-ফোঁড় ওফোঁড় করে দেব। তারপর তোমার ডান হাতের বুড়ো আঙুলটা একেবারে থেঁতলে দেব ঠিকই। সুতরাং ও-চেষ্টা কোরো না।

ওসমান বলল, বাঙালিবাবু, আমি তোমার সঙ্গে ভাল ব্যবহার করেছি।

এমনকী তোমাকে ছেড়েও দিয়েছিলাম, তবু তুমি কেন আমায় ধরিয়ে দিচ্ছ?

কাকাবাবু বললেন, তুমি আমাকে ভাল খাইয়েছ-দাইয়েছ ঠিকই। কিন্তু কাল হঠাৎ রেগে গিয়ে আমায় খুন করতে গিয়েছিলে। আমার বদলে অন্য মানুষ হলে মরেই যেত। সে জন্যও নয়। তুমি মানুষ খুন করো। জঙ্গল ধ্বংস করে তুমি সারা দেশের ক্ষতি করছ, এজন্য তোমাকে শাস্তি পেতেই হবে।

ওসমান বলল, আমার রাগটা বেশি। যখন-তখন রাগ হয়ে গেলে আর নিজেকে সামলাতে পারি না।

কাকাবাবু বললেন, রাগের বশেই হোক বা যে-জন্যই হোক, যে তোক মানুষ খুন করে, তার কোনও ক্ষমা নেই!

ওসমান বলল, আমাকে পুলিশের হাতে ধরিয়ে দিয়ো না। এখানেই গুলি করে মেরে রেখে যাও। এই অনুরোধটা অন্তত রাখো।

কাকাবাবু বললেন, মানুষ মারা আমার কাজ নয়। তবে তোমার একটু সুবিধে করে দিতে পারি। তোমার অপরাধের জন্য তোমার ফাঁসি হওয়ারই কথা। তবে, আমি যদি না বলি যে তোমাকে ধরে এনেছি, তুমি যদি বলো যে তুমি নিজে থেকে ধরা দিতে এসেছ, আত্মসমর্পণ যাকে বলে, তা হলে তোমার শাস্তি কমে যেতে পারে। ফাঁসির বদলে জেল হবে।

ওসমান বলল, সারাজীবন জেলে কাটাতে হবে?

কাকাবাবু বললেন, আজকাল সারাজীবন কাটাতে হয় না। বড়জোর চোদ্দো বছর। ফুলন দেবীও তো ছাড়া পেয়ে গেছে। তুমিও একসময় ছাড়া পাবে!

ওসমান বলল, আমি ধরা দিলে আমার দলের লোকদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করা হবে না?

কাকাবাবু বললেন, ওদেরও ধরা দিতে হবে। নইলে ওরা নিজেদের মধ্যে মারামারি করে মরবে।

পাহাড় ছেড়ে ঘোড়াদুটো ঢুকে গেল গভীর জঙ্গলে।

কাকাবাবু বললেন, তোমার দলের লোকরা আওয়াজ শুনতে পায়নি, কেউ তো তাড়া করে এল না।

এর পর আর কোনও কথা হল না অনেকক্ষণ। এক সময় সেই পাকা রাস্তাটা দেখা গেল।

কাকাবাবু বললেন, ওসমান, তুমি ঘোড়াসুদ্ধ মাঝরাস্তায় দাঁড়াও। কোনও গাড়ি এলে থামতে বাধ্য হবে।

মিনিটদশেক পরেই একটা গাড়ি এল। তাতে শুধু একজন ড্রাইভার।

কাকাবাবু তাকে বললেন, আমাদের একটু লিফ্ট দাও, সামনের শহর পর্যন্ত।

লোকটি বলল, হবে না, হবে না!

কাকাবাবু রিভলভারটা দেখালেন।

লোকটি বিনা বাক্যব্যয়ে দরজা খুলে দিল। ঘোড়াদুটো ছেড়ে দিয়ে কাকাবাবু ওসমানকে বসালেন ড্রাইভারের পাশে। নিজে বসলেন জানলার দিকে।

একটু গাড়ি চলার পর ওসমান ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করল, তুমি আমায় চেনো না?

লোকটি বলল, না। ওসমান বলল, বিক্রম ওসমানকে চেনে না, এই তল্লাটে এমন কেউ আছে?

লোকটি এমনই ভয় পেয়ে গেল যে, হাত থেকে স্টিয়ারিং ছেড়ে যাওয়ার উপক্রম। সে বলল, ওরে বাবা রে, বাবা রে! আপনি বিক্রম ওসমান? আপনাকে এই লোকটা পিস্তল দেখিয়ে ধরে নিয়ে যাচ্ছে? আমি নিয়ে যেতে পারব না।

কাকাবাবু কঠোরভাবে বললেন, ঠিক করে গাড়ি চালাও!

লোকটি কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল, আমায় মাপ করুন স্যার। এর পর ওঁর দলের লোক আমাকেই খতম করে দেবে। আমি গাড়ি থামাচ্ছি।

কাকাবাবু বললেন, গাড়ি থামালে আমি যে তোমার মাথার খুলি উড়িয়ে দেব, সেটার কী হবে?

লোকটি বলল, ওরে বাবা, এ যে দেখছি মহাবিপদ! হয় আপনার হাতে মরতে হবে, না হয় ওঁর দলের হাতে।

কাকাবাবু বললেন, ওর দলকে ভয় পাওয়ার আর দরকার নেই। আর দুদিনেই ওর দল ভেঙে যাবে!

জঙ্গল ফুরোবার পর আর দুএকটা গাড়ি দেখা যেতে লাগল রাস্তায়। ড্রাইভার বলল, কতদূর যেতে হবে সার?

কাকাবাবু বললেন, সামনে যেখানে বড় থানা আছে, সেখানে গাড়ি ঢোকাবে।

ওসমান বলল, এদিককার কোনও থানা আমাকে আটকে রাখতে পারবে না।

কাকাবাবু বললেন, দেখা যাক।

আরও কিছুক্ষণ পরে উলটো দিক থেকে একটা গাড়ি পাশ দিয়ে চলে যেতে দেখে কাকাবাবু চমকে উঠলেন। মনে হল, সেই গাড়িতে সন্তুও কাকাবাবুকে দেখতে পেয়েছে। তাদের গাড়ি থেমে গেল। সবাই এদিকে দৌড়ে এল।

কাকাবাবু ওসমানকেও নামালেন। তারপর সন্তু, জোজোর সঙ্গে অমল আর রফিক আলমকে দেখতে পেয়ে খুশি হয়ে বললেন, আলমসাহেব, আপনিও এসে গেছেন? এই নিন আপনার উপহার। বিক্রম ওসমানকে কিন্তু আমি জোর করে ধরে আনিনি। সে নিজে থেকে ধরা দিতে যাচ্ছে।

আলমের চোখ-মুখ হঠাৎ কঠিন হয়ে গেল। ফস করে পকেট থেকে রিভলভার বার করে বিকৃত গলায় চেঁচিয়ে বলল, মিস্টার রায়চৌধুরী, আপনি সরে দাঁড়ান।

ওই নরকের কুত্তাটাকে আমি নিজের হাতে শেষ করব!

কাকাবাবু বললেন, সে কী! আপননি মারবেন কেন? ওর বিচার হবে, তাতেই শাস্তি পাবে।

আলম বলল, বিচার-টিচারের দরকার নেই। আমিই ওকে শাস্তি দেব। ওকে গুলি করে খতম করে রিপোর্ট দেব যে, ও পালাবার চেষ্টা করেছিল।

কাকাবাবু বললেন, তা আমি হতে দেব না। আইন আপনি নিজের হাতে নিতে পারেন না।

আলম বলল, ও কী করেছে জানেন? আমার ভাই, সেও পুলিশ অফিসার ছিল, তাকে এই শয়তানটা মেরেছে। বিক্রম ওসমান, তোমার মনে নেই, তুমি গত

বছর পুলিশ অফিসার হাসানকে গুলি করে মেরেছ?

কাকাবাবু ওসমানকে আড়াল করে দাঁড়ালেন।

আলম বলল, আপনি সরে যান। নইলে আমি আপনার ওপরেও গুলি চালাতে বাধ্য হব!

কাকাবাবু বললেন, সন্তু!

সঙ্গে-সঙ্গে সন্তু পেছন থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ে আলমের গলা চেপে ধরল। তার হাত থেকে রিভলভারটা খসে পড়তেই ওসমান কাকাবাবুকে ঠেলে দিয়ে সেটা তুলতে গেল। তার আগেই জোজো এক লাথি দিয়ে সেটাকে সরিয়ে দিল দূরে।

অমল সেটা হাতে নিয়ে বলল, আমিও কিন্তু গুলি চালাতে জানি!

কাকাবাবু আলমের কাছে গিয়ে বললেন, ছিঃ, অত মাথা গরম করতে নেই।

আলম এবার কেঁদে ফেলে বলল, ও আমার ছোট ভাইকে মেরেছে। হাসানকে আমি এত ভালবাসতাম, নতুন বিয়ে হয়েছিল।

কাকাবাবু বললেন, সেজন্য ওসমানকে শাস্তি পেতেই হবে।
মুম্বইয়ে অমলের ফ্ল্যাটে সকাল থেকে আড্ডা জমেছে খুব। চা খাওয়া হয়েছে। দুবার, এখন অমল লুচি ভাজছে।

টেবিলের ওপর অনেক খবরের কাগজ ছড়ানো। জোজো একটা কাগজ দেখতে দেখতে বলল, কাকাবাবু, সব খবরের কাগজেই বিক্রম ওসমানের খবর আর ছবি ছাপা হয়েছে। আপনার ছবি কোথাও বেরোয়নি কেন?

কাকাবাবু বললেন, আমি আর কী করেছি? আমি শুধু ওকে ভুলিয়ে-ভালিয়ে আত্মসমর্পণ করতে রাজি করিয়েছি।

জোজো বলল, আপ্পা রাওটাও ধরা পড়েছে। তাতে আমি আরও খুশি হয়েছি।

কাকাবাবু বললেন, একবার দাও তো কাগজটা?

উলটোদিকের পাতায় একটি সুন্দরী মেয়ের খুব বড় ছবি। সেটা দেখতে দেখতে কাকাকবাবু রান্নাঘরে গিয়ে অমলকে জিজ্ঞেস করলেন, একে তুমি চেনো?

অমল বলল, বাঃ, চিনব না? বিখ্যাত নায়িকা। অনেক ফিল্‌মে দেখেছি।

কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, এর বাড়ি কোথায় জানো?

অমল বলল, সবাই চেনে। এখান থেকে বেশি দূরে নয়।

কাকাবাবু বললেন, লুচি ভাজা এখন থাক। আমাকে একবার সেখানে নিয়ে চলো তো!

অমল বলল, দেখা তো করতে পারবেন না। আগে ওর সেক্রেটারির সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করতে হয়। তাও বড় বড় প্রোডিউসার ছাড়া কেউ দেখা পায় না।

কাকাবাবু বললেন, আমার সঙ্গে দেখা করবে। চেনা আছে।

জোজো আর সন্তুকে কিছু না বলে কাকাবাবু অমলকে নিয়ে বেরিয়ে এলেন।

কস্তুরীর বাড়ির সামনে পৌঁছে তিনি বললেন, অমল, তুমি এখানেই অপেক্ষা করো, আমি কয়েক মিনিটের মধ্যেই আসছি।

গেটে দুজন বন্দুকধারী দরোয়ান। কাকাবাবু নিজের ঘড়ি দেখিয়ে বললেন, ঠিক সাড়ে নটায় সেক্রেটারির সঙ্গে আমার দেখা করার কথা আছে।

তারা গেট খুলে দিল।

মোরাম বিছানো রাস্তা, একপাশে বাগান। বারান্দায় সারি সারি ঘর। একটা ঘরের দরজায় সেক্রেটারির নাম লেখা। দূরের একটা ঘর থেকে নাচের শব্দ শোনা যাচ্ছে। কাকাবাবু সেই দিকে এগিয়ে গেলেন।

একটা লোক কোথা থেকে এসে বিশ্রীভাবে বলল, এই বুড়ো, ওদিকে কোথায় যাচ্ছ? কে তুমি?

কাকাবাবু উগ্র মূর্তি ধারণ করে ক্রাচ দিয়ে লোকটিকে এক বাড়ি মেরে বললেন, সরো, হঠ যাও!

দপদপিয়ে তিনি ঢুকে পড়লেন নাচের ঘরে। সেখানে তবলা, সারেঙ্গি, আরও অনেক বাদ্যযন্ত্র নিয়ে কস্তুরী নাচের রেওয়াজ করছে। আর কয়েকটি মেয়েও রয়েছে তার পাশে।

কাকাবাবুকে দেখে কস্তুরী নাচ থামিয়ে পাথরের মূর্তি হয়ে গেল। মুখোনা একেবারে ফ্যাকাসে।

কাকাবাবু ঝট করে ঘরের দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে পকেট থেকে রিভলভারটা বার করলেন। অন্যদের বললেন, কেউ নড়বে না, যেমন আছ, বসে থাকো।

কস্তুরীকে বললেন, আমাকে চড় মেরেছিলে, মনে আছে? কুকুর দিয়ে খাওয়াবে, না আরও কীসব করবে বলেছিলে? আমার গায়ে কেউ হাত তুললে আমি প্রতিশোধ না নিয়ে ছাড়ি না। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে, মেয়েদের গায়েও আমি হাত তুলতে পারি না। কিন্তু শাস্তি তোমায় পেতেই হবে। এখন দুটো উপায় আছে। আমি পকেটে এক শিশি অ্যাসিড এনেছি। সেটা তোমার মুখে ছুড়ে দিলে মুখোনা পুড়ে সারাজীবনের মতন কালো হয়ে যাবে। আর কখনও অভিনয় করতে পারবে না। অথবা, তুমি ক্ষমা চেয়ে মাটিতে নাকখত দাও যদি—

কস্তুরী বিনা বাক্যব্যয়ে বসে পড়ে। মাটিতে নাক ঠেকিয়ে বলল, ক্ষমা চাইছি!

কাকাবাবু বললেন, ওই কথাটা দশবার বলো, আর এদিক থেকে ওদিক পর্যন্ত নাকখত দাও। কানদুটো ধরে থাকো!

কস্তুরী ঠিক তাই-ই করতে লাগল। ঘরের অন্য সবাই ভয়ে কাঠ হয়ে দেখছে।

বাইরের দরজায় দুম দুম আওয়াজ হচ্ছে। যেন ভেঙেই ফেলবে।

কাকাবাবুর মুখটা রাগে লালচে হয়ে গিয়েছিল। এখন হাসি ফুটল। তিনি কস্তুরীকে বললেন, ব্যস, যথেষ্ট হয়েছে। আর বেশি করলে তোমার নাক ছোট হয়ে যাবে। কেউ নায়িকার পার্ট দেবে না! উঠে পড়ো৷

কাকাবাবু দরজাটা খুলে দিতেই হুড়মুড় করে কয়েকজন ঢুকে পড়ল। দুজন বন্দুকধারী চেপে ধরল কাকাবাবুকে!

কাকাবাবু কস্তুরীর দিকে ফিরে বললেন, আবার নতুন করে এসব খেলা শুরু হবে নাকি? আমাকে ধরে রাখতে পারবে?

কস্তুরী সঙ্গে-সঙ্গে বলে উঠল, না, না। ওকে ছেড়ে দাও। একে কেউ কিছু বলবে না। রাস্তা ছাড়ো, ওকে যেতে দাও!

কাকাবাবু গট গট করে এমনভাবে বেরিয়ে এলেন, যেন কিছু হয়নি।

অমল জিজ্ঞেস করল, কী কাকাবাবু, কস্তুরীকে দিয়ে সিনেমা করাবেন নাকি? বাংলা বই?

কাকাবাবু বললেন, নাঃ! ও আমাকে দিয়েই একটা পার্ট করাতে চাইছিল।

আমি পারব না বলে এলাম। চলো, এবার লুচি খাওয়া যাক!

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত