কাকাবাবু ও আশ্চর্য দ্বীপ

কাকাবাবু ও আশ্চর্য দ্বীপ

দুহাত ছড়িয়ে কাকাবাবু বললেন, আঃ, কী আরাম! চোখ একেবারে জুড়িয়ে গেল। মাথার মধ্যেও কী শান্তি। জানিস সন্তু, এমন সুন্দর দৃশ্যও তেমন ভাল লাগে, যদি মনের মধ্যে কোনও দুশ্চিন্তা থাকে। এবারে সব ঝামেলা চুকে গেছে, আর কোথাও দৌড়োদৌড়ি করতে হবে না!

সন্তুও মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে সামনের দিকে। এক-একটা জায়গায় এসে মনে হয়, এমন চমৎকার দৃশ্য যেন পৃথিবীর আর কোথাও নেই। পাহাড়ের চূড়ায় লাইট হাউজ, আর ঠিক যেন পায়ের নীচেই সমুদ্র। পাহাড় এখানে- খাড়া নেমে গেছে। সমুদ্র এখানে একেবারে গাঢ় নীল, যতদূর দেখা যায় আকাশ আর সমুদ্র, শুধু অনেক দূরে একটা সাদা রঙের জাহাজ, এখান থেকে দেখাচ্ছে ছোট্ট, খেলনার মতন।

জোজো বসে আছে একটা পাথরের ওপর। তার বেশ শীত করছে। শহরের মধ্যে এখন বেশ গরম, কিন্তু এখানে হুহু করছে হাওয়া, তাতে কাঁপুনি লাগে। জোজো এমনিতেই শীতকাতুরে, তার এখন সমুদ্র দেখার মন নেই। সে ভাবছে, কতক্ষণে হোটেলে ফিরে যাবে।

এই লাইট হাউজ পাহাড়ে প্রত্যেকদিন সাধারণ মানুষদের আসতে দেওয়া হয়। কাকাবাবুর জন্য বিশেষ অনুমতি দেওয়া হয়েছে। বেশি লোকজন এসে হল্লা। করলে এমন সুন্দর জায়গাটা এত ভাল লাগত না।

কাকাবাবু বললেন, বিশাখাপত্তনম জায়গাটা এইজন্য আমার খুব পছন্দ, এখানে পাহাড় আর সমুদ্র একসঙ্গে দেখা যায়। ভারতে এরকম জায়গা আর নেই।

সন্তু বলল, এত উঁচু থেকে আগে কখনও সমুদ্র দেখিনি। ঠিক যেন প্লেন থেকে দেখা।

কাকাবাবু জোজোর দিকে তাকিয়ে বললেন, আমাদের জোজো এত চুপচাপ কেন?

সন্তু জিজ্ঞেস করল, কী রে জোজো, তুই এরকম পাহাড়ের ওপর থেকে সমুদ্র দেখেছিস আগে?

জোজো বলল, অনেকবার।

জোজো এত সংক্ষেপে কোনও প্রশ্নের উত্তর দেয় না। সন্তু ভেবেছিল, জোজো বোধ হয় কামস্কাটকা কিংবা উলান বাতোর এই ধরনের কোনও জায়গার নাম বলবে। সে একটু অবাক হল।

কাকাবাবু বললেন, আমরা এখন ভূগোল পড়ে জেনে গেছি, পৃথিবীতে কত সমুদ্র আছে, কোন্ সমুদ্র কত বড়। তবু, এরকম। সমুদ্রের ধারে দাড়ালে মনে হয়, এর যেন শেষ নেই। আদিকালের মানুষদের তো গোটা পৃথিবী সম্পর্কে কোনও ধারণাই ছিল না। কলের জাহাজও আবিষ্কার হয়নি, তখনও যারা নৌকোয় চেপে সমুদ্রে ভেসে পড়েছিল, তারা কত সাহসী ছিল।

সন্তু জিজ্ঞেস করল, কাকাবাবু, রামায়ণে যে পুষ্পক রথের কথা আছে, সেটা নিশ্চয়ই কল্পনা?

কাকাবাবু বললেন, কল্পনা তো নিশ্চয়ই। পুষ্পক রথ মানে তো এরোপ্লেন। তার আবিষ্কার হয়েছে বলতে গেলে এই তো সেদিন! তার আগে আকাশে ওড়ার কোনও উপায়ই মানুষের জানা ছিল না। তবে কল্পনায় সব সময়েই মানুষ যেখানে ইচ্ছে উড়ে যেতে পারে।

সন্তু বলল, তা হলে বাল্মীকি কী করে আকাশ থেকে সমুদ্র দেখার বর্ণনা লিখলেন?

কাকাবাবু বললেন, বড় বড় কবিরা কল্পনায় অনেক কিছু দেখতে পান। সত্যি, রাম যখন লঙ্কা থেকে সীতাকে নিয়ে পুষ্পক রথে ফিরছেন, তখন আকাশ থেকে সমুদ্রের যা বর্ণনা দিয়েছেন, তাতে সত্যিই যেন মনে হয়, তিনি নিজের চোখে দেখেছেন।

জোজো উঠে দাড়িয়ে বলল, সন্তু, দ্যাখ তো আমার জ্বর এসেছে কি না।

সন্তু জোজোর কপালে হাত দিল, বুকে হাত দিল। তারপর বলল, কই, না তো?

জোজো বলল, তবে আমার এত শীত করছে কেন? সন্তু বলল, তোর শীত করছে? বাতাস একটু ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা, আমার তো চমৎকার লাগছে। জুড়িয়ে যাচ্ছে শরীর।

জোজো বলল, তা হলে বোধ হয় আমার খুব খিদে পেয়েছে।

কাকাবাবু হেসে বললেন, বোধ হয়। আমাদের খিদের সময়। সত্যি সত্যি খিদে পায়। আর জোজোর বোধ হয়’ খিদে পায়। তা হলে চলো, ফেরা যাক। সন্ধেও হয়ে আসছে।

সন্তু বলল, একটু আগেই তো আমরা চারখানা করে কচুরি ও জিলিপি খেলাম।

কাকাবাবু বললেন, সমুদ্রের হাওয়ায় তাড়াতাড়ি হজম হয়ে যায়।

তারপর তিনি সামনের দিকে তাকিয়ে আপন মনে বললেন :

দুদিকে ছড়িয়ে আছে দুই কালো সাগরের ঢেউ
মাঝখানে আজ এই সময়ের ক্ষণিকের আলো…

দ্যাখ নীল সমুদ্রের রং এর মধ্যেই কীরকম কালো হয়ে আসছে। আর সেই জাহাজটা, এখন ঝলমল করছে আলোয়।

সন্তু জিজ্ঞেস করল, এটা কার কবিতা?

কাকাবাবু বললেন, জীবনানন্দ দাশ। তোরা পড়িসনি বোধ হয়। পড়ে দেখিস, তোদের এই বয়েসটাই তো কবিতা পড়ার সময়।

লাইট হাউজের কর্মচারীদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে কাকাবাবু ফেরার পথ ধরলেন।।

রাস্তাটা পাহাড়ের গা দিয়ে ঘুরে ঘুরে গেছে। এক দিকে। আলো-অলা শহর, অন্যদিকে অন্ধকার সমুদ্র।

কাকাবাবু বললেন, আমাদের জোজোসাহেবের মেজাজ খারাপ, সত্যিই খুব খিদে পেয়েছে বুঝতে পারছি। রাত্তিরে প্রোফেসর ভার্গবের বাড়িতে নেমন্তন্ন, ভালই খাওয়াবে মনে হয়।

সন্তু বলল, নিরামিষ?

কাকাবাবু একটু চিন্তা করে বললেন, হ্যাঁ, আমি আগে দু’বার খেয়েছি, ওরা মাছ-মাংস খায় না। তা নিরামিষই বা খারাপ কী? নিরামিষেও অনেক ভাল খাবার হয়, অনেকরকম মিষ্টি!

সন্তু বলল, যতই ভাল ভাল নিরামিষ খাবার থাকুক, একটু মাছ বা মাংস না থাকলে ঠিক যেন জিভের স্বাদ মেটে না।

কাকাবাবু বললেন, ওসব নিছক অভ্যেসের ব্যাপার। ইচ্ছে। করলেই অভ্যেস বদলানাে যায়। এখন থেকে আমি শুধু নিরামিষই। খাব ভাবছি।

হঠাৎ কাকাবাবু হোঁচট খেয়ে পড়ে যাচ্ছিলেন, জোজো তাকে ধরে ফেলল। ক্রাচ নিয়ে পাহাড়ের ওপরে ওঠা যেমন শক্ত, নামাও মোটেই সহজ নয়। অবশ্য পুরোটা নামতে হবে না, কাছেই একটা সমতল জায়গায় গাড়ি রাখা আছে।

কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, সন্তু টর্চ আনিসনি?

সন্তু বলল, এই রে, সেই সকালবেলা বেরিয়েছি, টর্চ আনার কথা। মনে পড়েনি।

ঠিক তখনই সামনের দিকে দুটি জোরালো টর্চ জ্বলে উঠল।

একজন কেউ বলে উঠল, হল্‌ট। রেইজ ইয়োর হ্যান্ডস!

কাকাবাবু বললেন, এ আবার কে?

যার হাতে টর্চ থাকে তাকে দেখা যায় না। শুধু একটা কালো। ছায়ামূর্তি। সে কয়েক পা এগিয়ে এসে ইংরিজিতে বলল, মিস্টার রাজা রায়চৌধুরী, মাথার ওপর হাত তুলে দাঁড়াও। তোমার সঙ্গের ছেলে দুটিকেও তাই করতে বলো!

কাকাবাবু বললেন, কেন, হাত তুলে গৌরাঙ্গ হতে হবে কেন? আমি ক্রাচ নিয়ে চলি। দুহাত তুললে ক্রাচ ধরব কী করে?

লোকটি এবার ধমকের সুরে বলল, ক্রাচ ফেলে দিয়ে এক পায়ে দাঁড়াও। তোমার দিকে রিভলভার তাক করা আছে। যা বলছি চটপট শোনো!

কাকাবাবু বিরক্তির সঙ্গে বললেন, এ কী উটকো ঝামেলা! তুমি কে? তোমার সঙ্গে আমার কীসের শত্রুতা?

লোকটি বলল, হাত তুলতে আর দেরি করলে আমি গুলি চালাব।

কাকাবাবু বললেন, সন্তু, জোজো, হাত তুলেই ফেল! এত করে যখন বলছে!

তিনি ক্রাচ দুটো মাটিতে ফেলে দিলেন।

লোকটি বলল, রাজা রায়চৌধুরী, আমি তোমাদের এখনই কোনও ক্ষতি করব না। তবে তোমাকে একটি কাজ করতে হবে। পিন্টু ডিমেলোকে পুলিশের হাত থেকে তোমাকে ছাড়িয়ে আনতে হবে।

কাকাবাবু যেন আকাশ থেকে পড়লেন। দারুণ অবাক হয়ে বললেন, পিন্টু ডিমেলো? সে আবার কে? এইরকম কারুকে আমি চিনি না, নামও শুনিনি!

লোকটি বলল, তুমি তার নাম শোনোনি? তুমি ধুমল কোলকে তো জানো? তুমি তাকে অ্যারেস্ট করে জেলে ভরিয়ে দিয়েছ। সেই সূত্রে কাল পিন্টু ডিমেলোও ধরা পড়েছে।

কাকাবাবু বললেন, আমি কারুকে অ্যারেস্ট করব কী করে? আমি কি পুলিশ নাকি? ধুমল কোল… মানে যে লোকটা মুঘল বাদশাহদের আমলের টাকা জাল করে? এক-একটা টাকার দাম দশ-পনেরো লাখ টাকা, এটা একটা দারুণ বড় ব্যবসা! আমি জাল টাকাগুলো ধরে ফেলে ধুমল কোলের ডেরার সন্ধান দিয়ে দিয়েছি সরকারকে। তারপর পুলিশের কাজ পুলিশ করেছে। ধুমলের দলে কে যে ছিল, আমি তা জানব কী করে?

লোকটি বলল, ধুমলটা একটা বাজে লোক। ওকে সারাজীবন জেলে ভরে রাখো কিংবা ফাসি দাও, যা খুশি করো। কিন্তু পিন্টু ডিমেলোকে ছেড়ে দিতেই হবে। আর সে দায়িত্ব নিতে হবে তোমাকে।

কাকাবাবু বললেন, আমি দায়িত্ব নেব? আমি ছেড়ে দিতে বললেও পুলিশ ছাড়বে কেন?

লোকটি বলল, কেসটা তো টাকা জাল করার। তুমি বলবে, ডিমেলোর নামে কোনও চার্জ নেই। ওসব বাজে কাজ ডিমেলো করে না। ডিমেলো ইচ্ছে করলে ওরকম পাঁচটা ধুমলকে কিনে আবার বিক্রি করে দিতে পারে। ধুমলটা নিজের দোষ ঢাকার জন্য ডিমেলোর নাম বলে দিয়েছে। পুলিশ যখন আসে তখন ডিমেলো ঘুমিয়ে ছিল, তাই পালাতে পারেনি।

কাকাবাবু বললেন, খুবই আপশোশের কথা। পুলিশের আগে থেকে খবর দিয়ে আসা উচিত ছিল।

লোকটা বলল, পুলিশ এর আগেও একবার হঠাৎ ডিমেলোকে ধরেছিল। সেবার ওর নামে পাঁচটা খুনের চার্জ দিয়েছিল। একেবারে ফল্স চার্জ। আমাদের লাইনে সবাই জানে। ডিমেলো এ-পর্যন্ত নিজের হাতে মাত্র দুটো মার্ডার করেছে। পাঁচটা হতে এখনও দেরি আছে। পুলিশ সে দুটোরও প্রমাণ পায়নি।

কাকাবাবু বললেন, দুটো মার্ডার তো অতি সামান্য ব্যাপার। অন্তত পাঁচটা না হলে শাস্তির প্রশ্নই ওঠে না!

জোজো আর সন্তু চুপ করে সব শুনছে, এই সময় জোজো হুহু করে হেসে উঠল।

লোকটি তার দিকে ফিরে বলল, শাট আপ!

কাকাবাবু বললেন, আমি তো চোর-ডাকাত কিংবা খুনিদের নিয়ে কারবার করি না। ওসব আমার এক্তিয়ারের বাইরে। তুমি ডিমেলোকে ছাড়াবার জন্য আমার কাছে এসেছ কেন? বরং কোনও মন্ত্রীর কাছে গেলে—

লোকটি বলল, এখন অন্য পার্টির সরকার। মন্ত্রীটন্ত্রিতে সুবিধে হবে না। পুলিশের বড়কর্তারা সবাই তোমার কথা শোনে। এখনও কেস ওঠেনি, তুমি বললে ছেড়ে দেবে। আমরা ওকে চুপচাপ ছাড়িয়ে নিতে চাই।

কাকাবাবু বললেন, প্রথম কথা, পুলিশের কর্তারা আমার এ অন্যায় অনুরোধ শুনবেন না। দ্বিতীয় কথা, আমি এরকম অন্যায় অনুরোধ করতে যাবই বা কেন?

লোকটি বলল, অন্যায় আবার কী? টাকা জাল করার কেসের সঙ্গে ডিমেলোর কোনও সম্পর্ক নেই। ধুমল কোল ইচ্ছে করে তাকে জড়িয়েছে। তুমি টাকা জাল করার ব্যাপারটা ধরতে এসেছ। তুমি বলবে, ডিমেলো তোমার কেসের বাইরে।

কাকাবাবু বললেন, এসব কোর্টেই প্রমাণ হবে, তোমার বা আমার মুখের কথার কোনও মূল্য নেই।

লোকটি এবার বিরক্তভাবে বলল, বললাম না, কেসটা কোর্টে ওঠার আগেই সব ব্যবস্থা করতে হবে। কালকের মধ্যেই..

তারপর সে হাঁক পাড়ল, ভিকো, ভিকো…

এবার দেখা গেল অন্ধকারে আর একটি লোক দাঁড়িয়ে আছে। সে এগিয়ে এল।

এরই মধ্যে একটু একটু চাঁদের আলো ফুটেছে। তাতে দেখা যাচ্ছে, যার হাতে টর্চ আর রিভলভার, সে লম্বা ছিপছিপে। আর ভিকো নামে লোকটি গাঁট্টাগোট্টা।

লম্বা লোকটি বলল, রায়চৌধুরী, তোমার সঙ্গের একটি ছেলেকে আমি সঙ্গে নিয়ে যাব। ডিমেলো ছাড়া না পেলে সে মুক্তি পাবে না। তবে ওর ক্ষতি করা হবে না।

কাকাবাবু এখনও হালকাভাবে বললেন, ওদের একজনকে নিয়ে যাবে? সর্বনাশ! ওরা দারুণ বিচ্ছু ছেলে। তোমাকে একেবারে জ্বালাতন করে মারবে।

লোকটি কোনও রসিকতার ধার ধারে না। গম্ভীরভাবে বলল, সে আমি বুঝব। ভিকো, এই ছেলেটাকে ধরো।

সে টর্চের আলো ফেলল জোজোর মুখে।

সন্তু সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠল, ওকে নয়, ওকে নয়, ওর বদলে আমাকে নিন।

জোজো বলল, না, না, আমাকে বলেছে।

সন্তু বলল, না, জোজো, উনি দুজনের একজনকে বলেছেন, আমিই যাচ্ছি…

জোজো বলল, তুই অত হিংসুটেপনা করছিস কেন রে। আমার কথা আগে বলেছে, আমার ফার্স্ট চান্স।

সন্তু বলল, তুই খিদে সহ্য করে থাকতে পারবি না!

জোজো বলল, কে বলেছে পারব না? আমি একবার রকি অ্যান্ডিজে আটকা পড়ে তেরো দিন না খেয়ে ছিলাম। দরকার হলে আমি সব পারি।

লম্বা লোকটি বলল, অত কথা কীসের। ভিকো, ওই ছেলেটাকেই ধরে নিয়ে চলো।

ভিকো জোজোর কাধে হাত দিয়ে জামার কলারটা খিমচে ধরল।

এইবার কাকাবাবু গর্জে উঠে বললেন, খবরদার, ওর গায়ে হাত দেবে না। আমার সঙ্গে এখনও কথা শেষ হয়নি।

তিনি জোজোকে আড়াল করার জন্য এগিয়ে আসতে গেলেন। আবার একটা পাথরে পা লেগে আছাড় খেয়ে পড়লেন। খুব জোরে মাথা ঠুকে গেল।

তারপর তিনি আর কোনও শব্দও করলেন না, উঠেও বসলেন না।

লম্বা লোকটি টর্চ ফেলল কাকাবাবুর মুখে। কাকাবাবু চিত হয়ে পড়ে আছেন হাত-পা ছড়িয়ে। চোখের পাতা খোলা, চোখের মণি স্থির।

সন্তু হাঁটু গেড়ে পাশে বসে পড়ে ডাকতে লাগল, কাকাবাবু, কাকাবাবু!

কোনও সাড়া নেই। সন্তু কাকাবাবুর বুকে মাথা রেখে হৃৎস্পন্দন শোনার চেষ্টা করল।

লম্বা লোকটি জিজ্ঞেস করল, কী হল? অজ্ঞান হয়ে গেছে?

সন্তু অদ্ভুত ফ্যাকাসে গলায় বলল, বুঝতে পারছি না। মনে হচ্ছে, হার্ট বিট নেই।

জোজো চেঁচিয়ে বলল, কী বলছিস সন্তু! নাকের কাছে হাত নিয়ে দ্যাখ।

লম্বা লোকটি বলল, হার্ট বিট নেই মানে? বললেই হল! একটা আছাড় খেয়েই. ওসব ভড়ং আমার কাছে খাটবে না। তুমি সরে যাও, আমি দেখছি?

সে টর্চটা ভিকোর হাতে দিয়ে হাঁটু গেড়ে বসল কাকাবাবুর পাশে।

তারপর কড়া গলায় বলল, রায়চৌধুরী, আমার সঙ্গে চালাকি করে লাভ নেই। উঠে বোসো!

কাকাবাবু একইভাবে পড়ে রইলেন।

লোকটি কাকাবাবুর দুগালে ছোট ছোট থাপ্পড় মারতে লাগল। নাকের তলায় আঙুল রেখে দেখল, দুতিনবার চাপ দিল বুকে।

রীতিমতন ঘাবড়ে গিয়ে সে বলল, মাই গড! সত্যি মরে গেল নাকি লোকটা? কিছুই তো পাওয়া যাচ্ছে না। আমার বসদের কী কৈফিয়ত দেব? তারা ভাববে, আমিই মেরে ফেলেছি।

পাশে দাড়ানো সন্তুকে সে জিজ্ঞেস করল, এর হার্টের অসুখ ছিল?

সন্তু মুখ নিচু করে চোখ মুছছে। মাথা নেড়ে জানাল, না।

লোকটি কাকাবাবুর বুকে কান ঠেকিয়ে শব্দ শোনার চেষ্টা করল। আর তক্ষুনি মৃত কাকাবাবু বেঁচে উঠলেন। লোহার মতন দুহাতের মুঠোয় লোকটির গলা চেপে ধরলেন প্রচণ্ড শক্তিতে। লোকটা শুধু একবার শব্দ করল, আঁক!

সন্তু সঙ্গে সঙ্গে লোকটির রিভলভার ধরা হাতটায় একটা ক্যারাটের লাথি কষাল।

রিভলভারটা উঠে গেল শূন্যে, জোজো আর ভিকো দুজনেই ছুটে গেল সেটা ধরতে। জোজোর পাতলা চেহারা। সে উঁচুতে লাফিয়ে ক্যাচ করে ফেলল। সেটা সে নিজের কাছে না রেখে সঙ্গে সঙ্গে ছুড়ে দিল সন্তুর দিকে।

সন্তু সেটা লুফে নিয়েই ভিকোকে বলল, পিছু হঠো, পিছু হঠো।

লম্বা লোকটা এর মধ্যে অজ্ঞান হয়ে গেছে।

কাকাবাবু তাকে পাশে নামিয়ে রেখে নিজে উঠে বসলেন। কোটের ধুলো ঝাড়তে ঝাড়তে বললেন, রাবিশ! আজকালকার গুন্ডা বদমাশগুলো কোনও ট্রেনিং নেয় না। ভাবে যে হাতে একটা রিভলভার পেলেই সব কিছু জয় করে ফেলবে। রিভলভার ধরাটাও তো শিখতে হয়। ওর উচিত ছিল, রিভলভারটা আমার কপালে ঠেকিয়ে তারপর আমাকে পরীক্ষা করে দেখা।

সন্তু বলল, কাকাবাবু, তোমার হার্ট বিট বন্ধ হয়ে গিয়েছিল?

কাকাবাবু বললেন, দূর পাগল। হার্ট বিট বন্ধ হয়ে গেলে কি মানুষ বাঁচে নাকি? বড় জোর তিরিশ সেকেন্ড। ইচ্ছে করলে, মানে শিখলে, কয়েক মিনিট নিশ্বাস বন্ধ করে থাকা যায়।

সন্তু বলল, আমি তোমার বুকে কোনও শব্দ পাইনি।

কাকাবাবু হেসে ফেলে বললেন, তুই ভয় পেয়ে গিয়েছিলি নাকি রে? আমি তো ভেবেছিলাম, তুই অভিনয় করছিস।

জোজো বলল, আমি ভয় পাইনি। আমি জানতুম, তুমি কিছু একটা ম্যাজিক দেখাচ্ছ।

কাকাবাবু বললেন, ঠিক ম্যাজিক নয়। যোগব্যায়াম করে এটা শিখেছি। মাঝেমাঝে হৃৎপিণ্ডটাকে একটু বিশ্রাম দেবার জন্য আস্তে করে দেওয়া যায়। তখনও চলে ঠিকই, তবে আস্তে। ঘুমের মধ্যে যেমন হয়। বাইরে থেকে সহজে বোঝা যায় না।

জোজো বলল, আমি রিভলভারটা কীরকম ক্যাচ ধরলুম দেখলেন? ওটা যদি এই ভিকো ধরে নিত, তা হলে সবকিছু আবার অন্যরকম হয়ে যেত, তাই না?

কাকাবাবু বললেন, ততক্ষণে আমি আমারটা বার করে ফেলতাম। তবু যা হোক, তুমি দারুণ ক্যাচ ধরেছ ঠিকই।

জোজো বলল, আমি ক্রিকেটে উইকেট কিপার হয়ে খেলেছি।

কাকাবাবু বললেন, তুমি অনায়াসে রঞ্জি ট্রফিতে খেলতে পারো।

জোজো তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলল, মোহনবাগান ক্লাব থেকে আমাকে কতবার ডেকেছে। কিন্তু আমি ক্রিকেট খেলা ছেড়ে দিয়েছি, এখন পিয়ানো শিখছি।

সন্তু রিভলভারটা তাক করে আছে ভিকোর দিকে। সে দুহাত তুলে আছে। এ পর্যন্ত সে একটাও কথা বলেনি। বোবা কি না কে জানে!

কাকাবাবু লম্বা লোকটার গলায় হাত বুলিয়ে বললেন, বেশ ফুলে গেছে। তবে ওর জ্ঞান ফিরে আসবে একটু বাদেই। কিন্তু ততক্ষণ কি আমরা এখানে বসে থাকব?

ভিকোর দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন, ওহে, একে নিয়ে যাও। নীচে গিয়ে মুখে জলের ছিটেটিটে দাও।

ভিকো এগিয়ে এসে লম্বা লোকটাকে কাঁধে তুলে নেওয়ার চেষ্টা করতেই সে উঃ আঃ করে উঠল। তার জ্ঞান ফিরে আসছে।

সে আচ্ছন্নভাবে বলল, কেয়া হুয়া?

জোজো বলল, হুক্কা হুয়া!

কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, তুমি আমার নাম ধরে ডাকছিলে, তুমি আমাকে চেন?

লোকটি কোনও উত্তর দিল না। কাকাবাবু আবার জিজ্ঞেস করলেন, তোমার নামটা কী, তা তো জানা হল না।

লোকটি তার উত্তর না দিয়ে জিজ্ঞেস করল, মাই গান, হোয়ার ইজ মাই গান?

কাকাবাবু বললেন, ওটা তুমি ফেরত পাবে না। পুলিশের কাছে জমা দেব। যদি তোমার লাইসেন্স থাকে, সেখান থেকে ফেরত নিয়ে!

লোকটি এবার বলল, রাজা রায়চৌধুরী, এর শাস্তি তুমি পাবে। তোমাকে এমন শাস্তি দেওয়া হবে—

কাকাবাবু তাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, যাও যাও, এখন বাড়ি যাও! গলায় গরম গরম সেঁক দাও, না হলে আরও ফুলে যাবে।

এবারে ভিকো তাকে টানতে টানতে নিয়ে গেল। ওরা অন্ধকারে মিলিয়ে যাবার পর কাকাবাবু উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, চল, আমাদের হোটেলে ফিরতে হবে তাড়াতাড়ি। জামাটামা বদলে বেরুতে হবে আবার। রাত্তিরে নেমন্তন্ন আছে না?
অধ্যাপক ভার্গবের বাড়িটি একটি টিলার ওপরে। এখান থেকেও সমুদ্র দেখা যায়। বাড়ির সামনে অনেকখানি বাগান, গেটের সামনে দুজন বন্ধুকধারী গার্ড। একবার অধ্যাপক ভার্গবের ওপর গুন্ডারা হামলা করেছিল। তারপর থেকেই এরকম পাহারার ব্যবস্থা হয়েছে।

কাকাবাবুদের গাড়িটা থামতেই একজন গার্ড এগিয়ে এল পরিচয় জানবার জন্য। কিন্তু কাকাবাবুকে দেখেই চিনতে পেরে সে স্যালুট দিয়ে বলল, আসুন স্যার।

গাড়ি থেকে নেমে জোজো বলল, কী সুন্দর জায়গায় বাড়িটা। ইতালিতে এরকম একটা বাড়িতে আমি থেকেছি।

সন্তু জিজ্ঞেস করল, সেটা কার বাড়ি ছিল?

জোজো বলল, এক সময় সে বাড়ি ছিল লিওনার্দো দা ভিঞ্চির। নাম শুনেছিস তো? তারপর সেই বাড়িটা নিয়ে নেয় মুসোলিনি। এর নাম শুনেছিস?

সন্তু দুবারই মাথা নাড়ল দেখে জোজো বলল, খুব তো মাথা নেড়ে যাচ্ছিস। সত্যি সত্যি চিনিস? বল তো—

সন্তু বলল, মোনালিসা নামের বিখ্যাত ছবিটা এঁকেছিলেন মুসোলিনি, আর লিওনার্দো দা ভিঞ্চি ছিলেন হিটলারের চামচে!

কাকাবাবু হেসে ফেললেন।

জোজো বলল, ইয়ার্কি হচ্ছে আমার সঙ্গে?

সন্তু বলল, আমি ভুল বললে তুই ঠিক করে দিবি কী করে? সেইজন্য উলটে দিয়েছি।

কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, জোজো, তুই যখন বাড়িটাতে ছিলি, তখন তার মালিক কে?

জোজো বলল, কাউন্ট কুইজারলিং। আপনি এর নাম শুনেছেন?

কাকাবাবু বললেন, কাউন্ট কুইজারলিং? না, এ নাম তো শুনিনি!

জোজো বলল, ইনি তিমি মাছের গান রেকর্ড করে বিখ্যাত হয়েছেন। আমার বাবার শিষ্য ছিলেন।

কাকাবাবু সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে বললেন, হ্যাঁ, তিমিও গান গায়, কোথায় যেন পড়েছি। তুই শুনেছিস সেই গানের রেকর্ড?

জোজো বলল, অনেকবার। তিমি মাছের গলার আওয়াজ অনেকটা ভীমসেন। যোশীর মতন। ওই বাড়িটাতে আবার ভূত ছিল। খুব জ্বালাতন করত।

সন্তু বলল, তাই নাকি? তুই ভূতও দেখেছিস?

জোজো বলল, সবাই দেখেছে। খাবার টেবিলের পাশে দাঁড়িয়ে থাকত হ্যাংলার মতন। কার ভূত জানিস? মুসোলিনির। সেই ভূত তাড়াবার জন্যই তো বাবাকে ডেকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।

সন্তু বলল, উনি কী করে ভূত তাড়ালেন?

জোজো বলল, বাবা তিব্বত থেকে একটা মন্ত্র শিখে এসেছিলেন, যাতে ভূতদের ছোট করে ফেলা যায়। মনে কর, ভূতটার সাইজ ছ ফুট, সেটা হয়ে গেল ছ ইঞ্চি। তারপর বাবা সেই ছ ইঞ্চি ভূতটাকে পুরে ফেললেন একটা কাচের বোতলে। ভূতরা জানিস তো দেওয়াল ভেদ করে চলে যেতে পারে, লোহার দরজাও ভেদ করে যেতে পারে, কিন্তু কাচকে ভয় পায়। নিজের ছায়া দেখতে পায় তো!

কাকাবাবু বললেন, এটাও একটা নতুন খবর। ভূতরা যে কাচের দেওয়াল ভেদ করতে পারে না, এটা আগে জানা ছিল না।

সন্তু জিজ্ঞেস করল, তারপর সেই বোতলটা কী হল?

জোজো বলল, সেটা রোমের ন্যাশনাল মিউজিয়ামে রাখা আছে। যে কেউ গিয়ে দেখে আসতে পারে।

কাকাবাবু বললেন, একবার গিয়ে দেখতে হবে তো। জোজোর কাছ থেকে কত কিছু শেখা যায়।

সন্তু বলল, মুসোলিনির ভূত নাম দিয়ে তুই একটা গল্প লিখে ফেললে

পারিস!

জোজো বলল, লিখব, লিখব। যেদিন আমি লিখতে শুরু করব, দেখবি তখন অন্য সব লেখকরা ফ্ল্যাট হয়ে যাবে!

কাকাবাবু দরজায় বেল টিপলেন। স্বয়ং প্রফেসর ভার্গব খুলে দিলেন দরজা।

প্রফেসর ভার্গবের ছোট্টখাট্টো চেহারা। মাথায় টাক, মুখে সাদা দাড়ি। হলুদ রঙের একটা সিল্কের আলখাল্লা পরে আছেন। কাকাবাবুকে দেখেই তিনি উচ্ছ্বসিতভাবে বললেন, আসুন, আসুন, ওঃ, রায়চৌধুরী, এই নিয়ে দুবার আপনি আমাকে বাঁচালেন। আমার মানসম্মান সব যেতে বসেছিল।

কাকাবাবু বললেন, আরে না, না, আমি আর এমন কী করেছি!

প্রফেসর ভার্গব কাকাবাবুকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললেন।

ঘরের মধ্যে অনেক পুরনো আমলের পাথরের মূর্তি সাজানো রয়েছে। দেওয়ালের গায়ে কাচের আলমারিতেও বিভিন্ন যুগের মাটির বাসনপত্র আর ছোটখাটো জিনিস। যেন মিউজিয়ামের একখানা ঘর।

অবশ্য সোফাসেট আর চেয়ারও আছে। তাতে বসে আছেন আরও পাঁচ-ছজন। মানুষ। এঁরাও নিমন্ত্রিত। একজনকে কাকাবাবু চিনলেন। পুলিশ কমিশনার পদ্মনাভন। অন্য সবাই ইতিহাসের পণ্ডিত।

আর একজন লম্বা, ছিপছিপে লোক এদিকে পেছন ফিরে দেওয়ালের আলমারির জিনিসগুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছিলেন। তিনি এবার মুখ ফিরিয়ে বললেন, আমার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিলেন না?

কাকাবাবু খুব অবাক হয়ে বললেন, আরে নরেন্দ্র, তুমি হঠাৎ এখানে এলে কী করে?

নরেন্দ্র ভার্মা হেসে বললেন, কেন, তুমি নেমন্তন্ন পেতে পারো, আর আমাকে বুঝি প্রফেসর ভার্গব নেমন্তন্ন করতে পারেন না?

কাকাবাবু বললেন, কিন্তু তুমি এ-সময় ভাইজাগে এসেছ, সেটাই তো জানি না। সুকুমার রায়ের লেখা তো পড়োনি, পড়লে তোমায় বলতাম, গেছো দাদা! কখন যে কোথায় থাকো, তার ঠিক নেই!

নরেন্দ্র ভার্মা বললেন, হায়দরাবাদে এসেছিলাম একটা কাজে। খবরের কাগজে দেখলাম, তুমি এই শহরে আছ। তাই চলে এলাম তোমাকে একটা সারপ্রাইজ দিতে! এখানে এসে পড়েছি গেট ক্র্যাশ করে।

প্রফেসর ভার্গব বললেন, নরেন্দ্রজি, এবার মিস্টার রাজা রায়চৌধুরী কীভাবে আমাকে বাঁচিয়েছেন, তা সবটা শুনেছেন?

নরেন্দ্র ভার্মা বললেন, খবরের কাগজে যেটুকু পড়েছি।

নিমন্ত্রিতদের মধ্যে একজন ইতিহাসের অধ্যাপক বললেন, আমরাও সবটা জানি না। বলুন না, শুনি, শুনি?

প্রফেসর ভার্গব বিস্তারিতভাবে বলতে শুরু করলেন। ভার্গব এক সময় ইতিহাসের অধ্যাপক ছিলেন, রিটায়ার করেছেন অনেক দিন আগে। এখনও তিনি বহু মূর্তি সংগ্রহ করেন, বহু পুরনো আমলের ছবি, মুদ্রা, অস্ত্রও আছে তার কাছে। এসবের কিছু কিছু তিনি মাঝে-মাঝে বিক্রিও করেন। মাসখানেক আগে একজন খুব বড় ব্যবসায়ী তার কাছ থেকে সম্রাট শাহজাহানের আমলের পাঁচটি স্বর্ণমুদ্রা কিনেছিলেন সাড়ে সাত লক্ষ টাকা দিয়ে। কয়েকদিন পরেই সেই ব্যবসায়ীটি থানায় ডায়েরি করলেন যে, ওই পাঁচটা কয়েনই নকল, প্রফেসর ভার্গব জেনেশুনে তাঁকে জাল জিনিস বিক্রি করেছেন।

পুলিশ যখন খোঁজ নিতে এল, তখন প্রফেসর ভার্গব তো খুবই অবাক হলেন। তিনি ওই কয়েনগুলো সংগ্রহ করেছিলেন রাজস্থানের এক রাজার বংশধরের কাছ থেকে। তিনি নিজে একজন বিশেষজ্ঞ, কেনার সময় তিনি ভাল করে পরীক্ষা করে দেখে নিয়েছিলেন, ওগুলো জাল হতেই পারে না।

সেই ব্যবসায়ীটির কাছ থেকে পাঁচখানা মুদ্রা নিয়ে যাচাই করতে দেওয়া হল। তারা তিনজনই জানালেন যে, মুদ্রাগুলি সত্যিই জাল, শাহজাহানের আমল তো দূরের কথা, ওগুলো বানানো হয়েছে হাল আমলে। প্রফেসর ভার্গব রাজস্থানের যে রাজার নাম বলেছিলেন, পুলিশ খোঁজ নিয়ে দেখল, রাজস্থানে ওই নামে কোনও রাজা বা রাজকুমার কখনও ছিল না, সে নামটাও জাল।

এর মধ্যেই আর একজন ব্যবসায়ী থানায় অভিযোেগ জানাল যে সেও প্রফেসর ভার্গবের কাছ থেকে তিনটি আকবরি মোহর কিনেছিল, সেগুলোও জাল।

এর পর প্রফেসর ভার্গবকে গ্রেফতার করা ছাড়া পুলিশের আর কোনও উপায় নেই।

ইতিহাসের অধ্যাপক সুভাষ রাও বললেন, আমরা খুব অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। প্রফেসর ভার্গব এতবড় পণ্ডিত, তিনি মুদ্রাগুলো আসল না নকল তা চিনবেন না, এমন তো হতে পারে না। অথচ তার কাছ থেকেই লোকে এগুলো কিনেছে।

পুলিশ কমিশনার পদ্মনাভন বললেন, আমি ভার্গবকে অনেকদিন ধরে চিনি, শ্রদ্ধা করি। অথচ আমারই আদেশ নিয়ে ওকে গ্রেফতার করতে হল। অবশ্য কোর্টে ওর জামিন পাওয়া নিয়ে আমরা আপত্তি করিনি।

ভার্গব বললেন, জামিনে ছাড়া পেলাম তো বটে, কিন্তু তারপর মামলা চলবে। আমার দারুণ বদনাম রটে গেল। কেউ আমার কথা বিশ্বাস করে না। আমার তখন দিশাহারার মতন অবস্থা। তাই একদিন রায়চৌধুরীকে ফোন করে পরামর্শ চাইলাম।

পদ্মনাভন বললেন, রায়চৌধুরী, এর পরের অংশটা আপনি বলুন!

কাকাবাবু বললেন, অপরাধ জগৎ নিয়ে তো আমার কারবার নয়। আমি রহস্যসন্ধানী। ভার্গব আমার অনেক দিনের বন্ধু, আমিও ইতিহাসের ভক্ত। পুরনো আমলের মুদ্রা নিয়ে কিছু নাড়াচাড়া করেছি এক সময়। যাদের আমি বন্ধু বলে মেনে নিই, তাদের আমি একশো ভাগ বিশ্বাস করি। সুতরাং আমি ধরেই নিলাম, ভার্গবের পক্ষে জাল মুদ্রা বিক্রি করা একেবারেই সম্ভব নয়। নিশ্চয়ই এর মধ্যে কোনও ষড়যন্ত্র আছে।

পদ্মনাভন বললেন, এমনিতে পঞ্চাশ টাকা—একশো টাকার নোট কেউ কেউ জাল করে, ধরাও পড়ে যায়। কিন্তু ইতিহাসের আমলের কয়েনও যে জাল হয়, সে কথা আগে শুনিনি।

কাকাবাবু বললেন, এটা একটা খুব লাভজনক ব্যবসা, সারা পৃথিবীতেই চলে। ভার্গবের ফোন পেয়ে ভাবলাম, গিয়ে দেখাই যাক ব্যাপারটা। ভার্গবকে বললাম, আমি ভাইজাগ যাচ্ছি, কিন্তু তোমার বাড়িতে উঠব না। আমার কথা কখনও জানাবারও দরকার নেই। তাই আমার দুই চেলা, সন্তু আর জোজোকে নিয়ে এসে উঠলাম একটা হোটেলে, যেন বেড়াতে এসেছি।

ভার্গব বলল, আশ্চর্য ব্যাপার, মাত্র তিনদিনের মধ্যে রায়চৌধুরী ওদের ধরিয়ে দিতে পারলেন!

পদ্মনাভন বললেন, সত্যি, আপনি আমাদেরও তাক লাগিয়ে দিয়েছেন।

কাকাবাবু বললেন, ব্যাপারটা তো খুব সোজা। আপনারা যদি দৃঢ় ভাবে বিশ্বাস করতেন যে ভার্গবের পক্ষে এ কাজ করা সম্ভবই নয়, তা হলেই উলটো দিকটা দেখতে পেতেন। তা নয়, আপনারা ভেবেছিলেন, হলেও হতে পারে। মানুষকে চেনা শক্ত। ভার্গবকে দেখে ভাল মানুষটি মনে হয়, কিন্তু সেই গোপনে দুনম্বর কারবার করে।

ইতিহাসের অধ্যাপকরা মাথা নিচু করলেন। পদ্মনাভন বললেন, সত্যিই আমাদের তাই মনে হয়েছিল। সেজন্য আমি ক্ষমা চাইছি।

কাকাবাবু বললেন, উলটো দিকটা হচ্ছে এই, কিছু লোক এসে ভার্গবের কাছ থেকে অনেক টাকা দিয়ে কিছু দুর্লভ মুদ্রা কিনে নিয়ে গেছে। তারপর সেগুলোকে চটপট জাল করে সেই জাল টাকাই জমা দিয়েছে থানায়। দোষ চাপিয়েছে। ভার্গবের ঘাড়ে। এবার তারা ভার্গবের কাছ থেকে টাকা ফেরত আদায় করবে, আর আসল মুদ্রাগুলো বিক্রি করে দেবে অন্য জায়গায়। যদি বিদেশে চালান করে দিতে পারে, তাতে অনেক বেশি লাভ!

জোজো বলল, এবারেই প্রথম কাকাবাবুকে ছদ্মবেশ ধরতে দেখেছি।

কাকাবাবু হেসে বললেন, আমি খোঁড়া মানুষ, আমার পক্ষে ছদ্মবেশ ধরা বেশ শক্ত। আমার চেহারাটা অনেকেই চেনে, আর খোঁড়া পা-টা তো লুকোতে পারব না। তাই একটা হুইল চেয়ার ভাড়া করে আরও বুড়ো সাজলাম। থুথুড়ে বুড়ো আর দুটো পা-ই অচল। সেই হুইল চেয়ার নিয়ে ঘোরাঘুরি করতে লাগলাম কয়েকটা

দোকানে। প্রত্যেক শহরেই কিছু অ্যান্টিক জিনিসপত্রের দোকান থাকে। মূর্তি, ভাস, কয়েন, ছবি এইসব পাওয়া যায়। বিখ্যাত জিনিসগুলো এদেশের কোথায়, কার কাছে আছে, ওরা সব খবর রাখে। আমার পরিচয় হল পাতিয়ালার মহারাজার কাকা। পাতিয়ালার মহারাজের সত্যিই একজন কাকা আছেন, যাঁর শখ হচ্ছে খুব দামি দামি পুরনো জিনিস সংগ্রহ করা। এখানে একটা বড় অ্যান্টিকের দোকানে গিয়ে বললাম, আমার কয়েকখানা আকবরি মোহর চাই, যত টাকা লাগে দেব। প্রথমে ওরা বলল, ওদের স্টকে ওরকম জিনিস নেই। দ্বিতীয় দিন গিয়ে বললাম, যেখান থেকে পারো জোগাড় করে দাও। এক-একটা মোহরের দাম দেব দশ লাখ টাকা। অত টাকার লোভ ওরা সামলাতে পারল না। এক দোকানদার বলল, আপনি সন্ধের পর আসুন। গেলাম সাড়ে সাতটার সময়। এবারে প্রথম থেকেই সন্তুকে সঙ্গে নিইনি, ওকেও কেউ কেউ চিনে ফেলতে পারে, শুধু জোজো আমার হুইল চেয়ার ঠেলে নিয়ে যায়। অবশ্য ওকেও দাড়ি-গোঁফ লাগিয়ে বয়স্ক সাজিয়ে ছিলাম।

জোজো বলল, বাকিটা আমি বলব? দোকানদারটা আমাদের নিয়ে গেল ডলফিনস নোজ পাহাড়ের কাছে একটা বাড়িতে। সে বাড়ির মাটির তলায় ঘর আছে। দুজন লোক বসে ছিল সেখানে, তাদের একজন বলল, আপনি আকবরি মোহর খুঁজছেন? দিতে পারি, ক্যাশ টাকা এনেছেন?

কাকাবাবু বললেন, লাখ লাখ টাকা কি সঙ্গে আনা যায়? সে তো বিরাট বোঝ। আমার কাছে ডলার আছে। ডলার শুনে ওদের লোভ আরও বেড়ে গেল। তারপর কাকাবাবু বললেন, আমি বুড়ো হয়েছি বলে আমার চোখকে ফাঁকি দিতে পারবে না। নকল চালাবার চেষ্টা কোরো না। প্রত্যেকটা কয়েন আমি পরীক্ষা করে দেখে নেব। এবার ওরা একটা ভেলভেটের বাক্স নিয়ে এল, তার মধ্যে রয়েছে সেই তিনটে সোনার টাকা। কাকাবাবু বললেন, মোটে তিনটে? আর নেই?

ওরা আরও তিনটে এনে দিল।

কাকাবাবু দুখানা মোহরই ডান হাতের তালুতে রেখে পরীক্ষা করতে লাগলেন, তারপর সেগুলোর মধ্য থেকে তিনখানা বেছে নিয়ে মাটিতে ফেলে দিয়ে বললেন, এগুলো ঝুটো মাল! শোনো, সারা পৃথিবীর যারা কয়েন এক্সপার্ট তারা আমাকে চেনে। আজ পর্যন্ত আমাকে কেউ ঠকাতে পারেনি। আসল মাল মোটে তিনটের বেশি নেই, তা বললেই পারতে!

ওদের একজন বলল, আমরা তো স্যার এত বুঝি না। দালালদের কাছ থেকে কিনি। মুঘল আমলের অন্য কয়েন চলবে? শাজাহানের মোহর।

কাকাবাবু বললেন, শাজাহানের আমলের মোহর আমার নিজের কালেকশানে বেশ কয়েকটা আছে। তবু নিয়ে এসো তো দেখি।

এবার ওরা নিয়ে এল আরও কয়েকটা ভেলভেটের বাক্স। তার একটা খুলেই কাকাবাবু আমার দিকে ফিরে বললেন, মোহন সিং, এখন কটা বাজে? ঠিক নটার মধ্যে আমাকে ডিনার খাওয়ার জন্য ফিরে যেতে হবে।

এই কটা বাজে ছিল আমাদের আগে থেকে ঠিক করা কোড। আমি ঘড়ি দেখে সময় বলে দিয়ে ওদের জিজ্ঞেস করলুম বাথরুমটা কোথায়? আমার আজ দুপুর থেকে পেট খারাপ।

আমি পেটটা চেপে ধরতেই ওরা আমাকে একটা বাথরুম দেখিয়ে দিল। তার ভেতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে আমি মোবাইল ফোনে খবর দিলুম পুলিশ কমিশনারের অফিসে। সেটাও কাকাবাবু আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছিলেন। দশ মিনিটের মধ্যে কাছাকাছি থানা থেকে পুলিশ এসে গেল। তখনও কাকাবাবু ম্যাগনিফাইং গ্লাস দিয়ে মোহরগুলো পরীক্ষা করছেন।

কাকাবাবু বললেন, এতে বোঝা গেল মোবাইল ফোনের উপকারিতা। গোপনে খবর দেওয়ার খুব সুবিধে। পুরো দলটাই ধরা পড়ে গেল।

প্রোফেসর ভার্গব বললেন, আসল কয়েনগুলো উদ্ধার হল বলেই আমি বেঁচে গেলাম।

সুভাষ রাও বললেন, রোমহর্ষক কাহিনী। তবু একটা কথা জিজ্ঞেস করব রায়চৌধুরীসাহেব? আপনি বুড়ো মানুষ, সঙ্গে মাত্র এই ছেলেটি। ওই গুন্ডাদের ডেরায় ঢুকেছিলেন, যদি আপনাদের খুন করে সব টাকা পয়সা কেড়ে নিত! ওরা নিশ্চয়ই ভেবেছিল, আপনার কাছে অনেক ডলার আছে। এখানে তো যখন-তখন খুন হয়।

কাকাবাবু বললেন, অপরাধ জগতেও নানারকম শ্রেণী ভেদ আছে। যারা জালিয়াত, তারা সাধারণত খুনজখমের মধ্যে যায় না। স্মাগ্‌লাররা যেমন ডাকাতি করে না। তা ছাড়া, একজন সাধারণ লোককে খুন করতে পারে, কিন্তু পাতিয়ালার মহারাজার কাকাকে খুন করলে যে খুব হইচই পড়ে যাবে, তা ওরা জানে। আর আমি বুড়ো সাজলেও তেমন বুড়ো তো নই, আমার একখানা থাপ্পড় অনেকেই সহ্য করতে পারে না। তা ছাড়া আমার কাছে রিভলভার ছিল, একবার সেটা হাতে নিলে অন্তত দু-চারজন লোক সামনে দাঁড়াতে পারবে না।

সুভাষ রাও বললেন, তবু আপনার সাহস আছে বটে। বাপ রে!

জোজো বলল, আজকেই তো সন্ধের সময়…

পদ্মনাভন বললেন, আজ আবার সন্ধেবেলা কী হয়েছিল?

কাকাবাবু তার উত্তর না দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, পিন্টু ডিমেলো কে বলুন তো?

পদ্মনাভন বললেন, আরে সে এক মজার ব্যাপার। এই মুদ্রা জালিয়াতির যে প্রধান পাণ্ডা তার নাম ধুমল কোল। রায়চৌধুরী, আপনি তো তাকে ধরিয়ে দিলেন। তারপর তাকে জেরা করতে করতে সে এক সময় ওদের দলের একজন হিসেবে পিন্টু ডিমেলোর নাম ধাম বলে দিল। এই ডিমেলো লোকটা অনেক বড় ক্রিমিনাল, ওকে আমরা অনেকদিন থেকে খুঁজছি, বেশ কয়েকবার আমাদের হাত পিছলে পালিয়েছে। এবার ও ধরা পড়ে গেল, এটা বিনা ক্যাচ বলা যেতে পারে। ধুমলের সঙ্গে বোধহয় ওর শত্রুতা আছে। সে ওকে ইচ্ছে করে ধরিয়ে দিয়েছে।

কাকাবাবু বললেন, সাবধান, ও যেন পালিয়ে না যায়। আজ সন্ধেবেলাতেই সে রকম একটা চেষ্টা হয়েছিল। জোজোই ঘটনাটা বলুক। না থাক, জোজো বেশি লম্বা করে ফেলবে। এখন খেতে হবে। সন্তু বলুক।

সন্তু সংক্ষেপে ঘটনাটা জানাল।

প্রোফেসর ভার্গব বললেন, উঃ বাপ রে বাবা। আবার আজই এরকম কাণ্ড। হয়েছে। রায়চৌধুরী, আপনাকে আমি যত দেখি ততই অবাক হয়ে যাই। আপনার তো যে-কোনও সময় সাংঘাতিক একটা কিছু হয়ে যেতে পারে।

কাকাবাবু বললেন, এটা এক ধরনের খেলা। একদিন-না-একদিন তো মরতেই হবে। আমি মৃত্যু নিয়ে খেলা করতে ভালবাসি। এপর্যন্ত তো এ খেলায় হারিনি।

পদ্মনাভন বললেন, ওরা ধরা পড়লেও সব ব্যাপারটা এখনও মেটেনি বোঝা যাচ্ছে। আরও অনেক কিছু ঘটবে। ডিমেলোর দল সহজে ছাড়বে না।

কাকাবাবু বললেন, সেসব সামলাবার দায়িত্ব আপনাদের পুলিশের ব্যাপার। আমি আর এর মধ্যে নেই। আমি প্রোফেসর ভার্গবকে যথাসাধ্য সাহায্য করেছি মাত্র। এখন খাবার দেওয়া হবে না?

এবার সবাইকে যেতে হল পাশের লম্বা হল ঘরে।

সেখানে বড় টেবিলের ওপর অনেকরকম খাবার সাজানো। মাছ-মাংস নেই বটে। কিন্তু নিরামিষ পদই তেরো-চোদ্দোরকম। আর পাঁচরকমের মিষ্টি।

নরেন্দ্র ভার্মা মুদ্রা-জালিয়াতি বিষয়ে কোনও আগ্রহ দেখাননি। এতক্ষণ একটা প্রশ্নও করেননি। এখন খাবারের প্লেট নিয়ে কাকাবাবুর পাশে এসে দাঁড়িয়ে বললেন নরেন্দ্র, তুমি তো ভার্গবের কেসটা মিটিয়ে দিয়েছ, এখন কী করবে? ফিরে যাবে কলকাতায়?

কাকাবাবু বললেন, হ্যাঁ, ফিরে যাব। আমাদের পশ্চিম বাংলায় এর মধ্যে বর্ষা শুরু হয়ে গেছে। এই সময় শান্তিনিকেতনে থাকতে খুব ভাল লাগে।

নরেন্দ্র ভার্মা বললেন, হ্যাঁ, আমিও একবার শান্তিনিকেতনের বর্ষা দেখতে যাব। তুমি এখানে আরও দিনসাতেক থেকে যাও না। দুজনে মিলে সমুদ্রে সাঁতার কাটব। এক সময় গোয়ার বিচে দুজনে অনেক সাঁতার কেটেছি মনে আছে?

কাকাবাবু বললেন, তখন আমার পা খোঁড়া ছিল না। তখন কমপিটিশানে তুমি আমার সঙ্গে পারতে না।

নরেন্দ্র ভার্মা বললেন, সাঁতারের সঙ্গে খোঁড়া পায়ের কী সম্পর্ক? মাসুদুর রহমান নামে একটি ছেলের দুটো পা-ই কাটা। সেও তো সাঁতারে ইংলিশ চ্যানেল ক্রস করেছে। এসো, আবার তোমার সঙ্গে একবার কমপিটিশানে নামা যাক।

কাকাবাবু বললেন, ভাইজাগের সমুদ্রে তো সাঁতার কাটাই যায় না শুনেছি।

নরেন্দ্র ভার্মা বললেন, এখানে অনেক ড়ুবো পাথর আছে, তাই বিপজ্জনক। তবে এখান থেকে খানিকটা দূরে ঋষিকোণ্ডা নামে একটা জায়গা আছে। ভারী চমকার, নিরিবিলি, আর সাঁতারও কাটা যায়। ছেলে দুটিকে কলকাতায় পাঠিয়ে দিয়ে, তুমি আরও সাতদিন থেকে যাও।

সন্তু কাছেই দাঁড়িয়ে খাবার খাচ্ছে। সে শুনতে পেয়ে বলল, মোটেই আমরা ফিরে যেতে চাই না। আমাদের এখন ছুটি।

নরেন্দ্র ভার্মা জিজ্ঞেস বলেন, তুমি সাঁতার জানো, সন্তু?

সন্তু বলল, মোটামুটি জানি।

কাকাবাবু বললেন, আছে নরেন্দ্র, তুমি জানো না, সন্তু তো সাঁতারে চাম্পিয়ন। অনেক পুরস্কার-টুরস্কার পেয়েছে।

নরেন্দ্র বললেন, ও, তাই বুঝি? আর জোজো?

এই একটা ব্যাপারে বাক্যবাগীশ জোজো একেবারে চুপ করে যায়। সে জলকে ভয় পায়। সন্তু অনেক চেষ্টা করেও জোজোকে সাঁতার শেখাতে পারেনি।
ঋষিকোণ্ডায় যে গেস্ট হাউজে নরেন্দ্র ভার্মা থাকার ব্যবস্থা করেছেন, তার কাছাকাছি আর কোনও বাড়ি নেই। বেলাভূমি একেবারে ফাঁকা। সমুদ্র আর আকাশ ছাড়া এখানে আর কিছু নেই। া, কিছু সি-গাল পাখি আছে। এখানে বালির রং হলুদ, আকাশ আর সমুদ্র গাঢ় নীল, আর পাখিগুলো ধপধপে সাদা।

কাকাবাবু, নরেন্দ্র ভার্মা আর সন্তু সকালবেলা অনেকক্ষণ সাঁতার কাটল সমুদ্রে, প্রায় এক ঘণ্টারও বেশি। জোজো বসে রইল পাড়ে। নরেন্দ্র ভার্মা অনেকবার বলেছিলেন, খানিকটা নামমা, আমরা তোমাকে ধরে থাকব, কোনও ভয় নেই। জোজো কিছুতেই রাজি হয়নি।

এখানে বাতাস বেশ স্নিগ্ধ, শীতও নেই, গরমও নেই। জোজো দেখল, বড় বড় ঢেউ ভাঙতে ভাঙতে সন্তু অনেকটা এগিয়ে গেছে, তাকে ছোট্ট একটা বিন্দুর মতন দেখাচ্ছে। সেদিকে তাকাতেই জোজোর বুকটা শিরশির করে ওঠে, যদি সন্তু আর ফিরে আসতে না পারে?

কত সময় যে কেটে যাচ্ছে, তা ওদের খেয়ালই নেই। জলের মধ্যে থাকতে মানুষের এত ভাল লাগে?

জোজো মনে মনে কবিতা বানাবার চেষ্টা করতে লাগল।

আকাশের কোনও সীমানা থাকে না
সমুদ্র অতলান্ত…

এবার অতলান্তের সঙ্গে কী মিল দেওয়া যায়? শান্ত, ভ্রান্ত, না ক্লান্ত? আরও হতে পারে, আন তো, জানত ক্ষান্ত…। কবিতা কি আগে থেকে এরকম মিলের তালিকা করে রাখে? অবশ্য আর একরকম কবিতাও লেখা হয়, তাতে মিল থাকে না।

পরের লাইন আর কিছুতেই মাথায় আসছে না। জোজো বিড়বিড় করতে লাগল, আকাশের কোনও সীমানা থাকে না, সমুদ্র অতলান্ত, মানুষের তবু ভয়ডর নেই, মানুষের তবু ভয়ডর নেই, এমনই সে দুর্দান্ত!

জোজো নিজেই নিজের কাধ চাপড়ে দিল। অতলান্ত-এর সঙ্গে দুর্দান্ত, এই মিল ভাল হয়নি? দুর্দান্ত! এটা সন্তুকে শোনাতে হবে। সন্তু অবশ্য ভাববে, আমি অন্য কারও লেখা থেকে মুখস্থ বলছি। ও আমার কোনও কথাই বিশ্বাস করতে চায় না।

হঠাৎ ডানদিকে চোখ পড়তেই জোজো চমকে উঠল। সেদিকে একটা বালির প, তার আড়াল থেকে একটা জুতো পরা মানুষের পা দেখা যাচ্ছে।

প্রথমে জোজো ভাবল, ওখানে কি কোনও মৃতদেহ পড়ে আছে?

তারপর ভাবল, অনেক লোক সমুদ্রের ধারে বালির ওপর চিৎপাত হয়ে রোদ পোহায়, সেরকমও কেউ হতে পারে। কিন্তু এদিকে তো কোনও লোককে আসতে দেখা যায়নি, আর গেস্ট হাউজেও অন্য কোনও অতিথি নেই।

আর একটা কথা ভেবে ভয়ে সন্তুর বুক কেঁপে উঠল। যদি কোনও শত্রুপক্ষের লোক হয়? ডিমেলোর দলের সেই লম্বা লোকটা বসেছিল, সন্তু কিংবা তাকে ধরে নিয়ে গিয়ে আটকে রাখবে।

এখন যদি জোজোকে ধরে নিয়ে যেতে চায়, তা হলে তো কাকাবাবুরা টেরও পাবেন না। জোজো একা বাধা দেবে কী করে? এমন যে বিপদ হতে পারে, সে কথা কাকাবাবুর মনে পড়েনি।

ওরা তিনজন সাঁতার কাটছে, ওদের কাছে কোনও অস্ত্রশস্ত্র নেই। যখন ওপরে উঠে আসবে, তখন যদি কেউ গুলি করে? সাবধান করে দেওয়াও তো জোজোর পক্ষে সম্ভব নয়।

জোজো কি একদৌড়ে গেস্ট হাউজে চলে যাবে? কিন্তু ওই লোকটা যদি গুলি করতে চায়, জোজো দৌড়ে পালাতে পারবে না।

বালিয়াড়ির আড়াল থেকে শুধু একটা জুতো পরা পা-ই দেখা যাচ্ছে। যদি জোজোকে ধরে নিয়ে যাওয়ার মতলব থাকে, তা হলে এতক্ষণ অপেক্ষা করবে কেন?

এক-একসময় মানুষ হঠাৎ সাহসী হয়ে ওঠে। ওখানে কে লুকিয়ে আছে, তা জোজোকে দেখতেই হবে।

সে বালির ওপর পা টিপে টিপে এগিয়ে গেল। তারপর উঁকি মেরে আরও

অবাক হল।

একটা খুব গাঁট্টাগোট্টা চেহারার লোক, তার মুখ ভরতি দাড়ি, বসে আছে। সেখানে পা ছড়িয়ে। তার পাশে একটা রাইফেল। লোকটি ঘুমে ঢুলে ঢুলে পড়ছে।

একটুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর জোজোর ঠোঁটে হাসির ঝিলিক খেলে গেল। এইবার সে বুঝেছে। যারা গুন্ডা-বদমাশ, তারা কখনও কাজে এসে ঘুমোয় না। ঘুমোয় কারা? যারা পাহারা দেয়। পুলিশ ঘুমোয়, কারখানার দারোয়ান ঘুমোয়। কয়েকদিন আগেই তো কলকাতায় একটা ব্যাঙ্কের এক বন্দুকধারী গার্ড ঝিমোচ্ছিল, কয়েকটা বাচ্চা বাচ্চা ডাকাত তার বন্দুকটা কেড়ে নেয়।

এই লোকটাকে তা হলে পাহারা দেওয়ার জন্যই রাখা হয়েছে। জোজো ভাবল, এর রাইফেলটাও সরিয়ে রাখলে কেমন হয়!

লোকটির ঘুম একেবারে কুম্ভকর্ণের মতন। জোজো কাছে গিয়ে রাইফেলটা তুলে নিল, এমনকী একবার গলা খাঁকারি দিল, তবু সে জাগল না।

জোজো কখনও রাইফেল চালায়নি। সন্তু রিভলভার চালাতে ভালই পারে, কিন্তু সেও রাইফেল শেখেনি। হাতে এত বড় একটা অস্ত্র থাকলে নিজেকে খুব হিরো হিরো মনে হয়। জোজো এমনভাবে রাইফেলটাকে তাক করল, যেন তার সামনে রয়েছে একদল শত্ৰু, সে সবাইকে খতম করে দিচ্ছে। র্যাট-ট্যাট-ট্যাটট্যাট-ট্যাট…

সেফ্‌টি ক্যাচ সরে যেতেই দারুণ শব্দে একটা গুলি বেরিয়ে গেল। ভাগ্যিস, রাইফেলের নলটা ছিল আকাশের দিকে। ভালভাবে ধরতে জানে না বলে বাঁটের পেছন দিকটায় একটা ধাক্কা লাগল জোজোর বুকে।

এবার দাড়ি-গোঁফওয়ালা লোকটির ঘুম ভাঙতে বাধ্য। সে জোজোর হাতে রাইফেল দেখে এমনই ঘাবড়ে গেল যে, কী একটা দুর্বোধ্য চিৎকার করে দাঁড়িয়ে পড়ল মাথার ওপর হাত তুলে।

হঠাৎ গুলি বেরিয়ে যাওয়ায় জোজোও বেশ ঘাবড়ে গেছে। কিন্তু লোকটির ভয় পাওয়া মুখ দেখে হাসিও পেল তার। এই নাকি পাহারাদার?

গুলির শব্দ সন্তুরাও শুনতে পেয়েছে। তিনজনই উঠে এল পাড়ে। নরেন্দ্র ভার্মা আগে দৌড়ে এসে জিজ্ঞেস করলেন, কী ব্যাপার জোজো? এ লোকটা কে?

জোজো বলল, আপনি ওকে পাহারা দেওয়ার জন্য রেখে গিয়েছিলেন, আর ও নাক ডাকিয়ে ঘুমোচ্ছিল।

নরেন্দ্র ভার্মা বললেন, আমি তো পাহারাদার রাখিনি।

জোজো বলল, তাই বলুন! আমারও প্রথম থেকেই সন্দেহ হয়েছিল। ও নিশ্চয়ই কাকাবাবুকে মারতে এসেছে। তাই আমি ওর রাইফেলটা কেড়ে নিয়েছি। ওর গায়ের জোর বেশি হতে পারে, কিন্তু আমি এমন একটা ক্যারাটের প্যাচ মারলুম…

এর মধ্যে কাকাবাবু এসে গেলেন এক পায়ে লাফাতে লাফাতে। ক্রাচ দুটো তুলে নেওয়ার পর বললেন, একে তো দেখেই বোঝা যাচ্ছে পুলিশ। পুলিশদের চেহারা দেখলেই চেনা যায়।

লোকটি এবার দুদিকে মাথা নাড়তে নাড়তে বলল, পুলিশ, পুলিশ!

লোকটি ইংরিজি কিংবা হিন্দি জানে না। নরেন্দ্র ভার্মা ওর সঙ্গে তেলুগু ভাষায় কয়েকটা কথা বলার পর কাকাবাবুর দিকে ফিরে বললেন, তুমি ঠিকই ধরেছ, রাজা। পুলিশ কমিশনার পদ্মনাভন ওকে পাঠিয়েছেন আমাদের দেখাশুনো করার জন্য। এ যা দেখছি, একেই পাহারা দেওয়া দরকার।

কাকাবাবু বললেন, আহা বেচারা, ঘুমিয়ে পড়েছিল। নিশ্চয়ই রাত্তিরে ঘুম হয়নি। ওকে বকাঝকা কোরো না।

সন্তু জিজ্ঞেস করল, হ্যাঁ রে জোজো, তুই সত্যিই ওর কাছ থেকে রাইফেলটা কেড়ে নিয়েছিস?

জোজো বলল, ম্যাজিক, ম্যাজিক! আমি হুকুম করলুম, অমনি রাইফেলটা ওর হাত থেকে চলে এল আমার হাতে।

গেস্ট হাউজের দিকে ফিরে যেতে যেতে নরেন্দ্র ভার্মা বললেন, আমরা এতক্ষণ মজা করে সমুদ্রে সাঁতার কাটলাম, আর জোজো বেচারা একা একা তীরে বসে রইল। ওকে একটা কিছু প্রাইজ দেওয়া দরকার।

কাকাবাবু বললেন, জোজো, তুই এবার একটু কষ্ট করে সাঁতারটা শিখে নে।

জোজো বলল, এবারে পুজোর ছুটির সময় বাবার সঙ্গে ব্রাজিল যাচ্ছি, ওখানে ঠিক সাঁতার শিখে নেব।

সন্তু বলল, সাঁতার শেখার জন্য ব্রাজিল যেতে হবে? কেন, এ দেশে সাঁতার শেখা যায় না?

জোজো বলল, বাঃ, ব্রাজিলের জল খুব হালকা। সাঁতার শিখতে মাত্র দুদিন লাগে, তুই জানিস না?

সন্তু তবু বলল, জল আবার হালকা আর ভারী হয় নাকি?

জোজো বলল, বাঃ, হয় না? সব সমুদ্রের জল কি একরকম? এমন সমুদ্রও আছে যাতে মানুষ পড়ে গেলেও ড়ুববে না! ব্ল্যাক সি?

নরেন্দ্র ভার্মা বললেন, তা ঠিকই বলেছে। জোজো অনেক কিছু জানে। শোনো জোজো, আজ খাওয়াদাওয়ার পর তোমাকে এমন একটা জিনিস দেখাব, যা তুমি সারা জীবনেও ভুলবে না।

সন্তু জিজ্ঞেস করল, শুধু জোজোকে দেখাবেন?

নরেন্দ্র ভার্মা মুচকি হেসে বললেন, হ্যাঁ।

খাওয়ার পর একটুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে আবার বেরিয়ে পড়া হল। রাইফেলধারী পুলিশটিকে ছুটি দেওয়া হলেও সে ছুটি নিতে চায় না। বারবার কান মুলে বলতে লাগল, সে আর ঘুমোবে না।

তবু নরেন্দ্র ভার্মা তাকে বোঝালেন যে তার নামে নালিশ করা হবে না। এখন সত্যিই তাকে দরকার নেই।

নরেন্দ্র ভার্মাকে সমুদ্রের দিকেই এগোতে দেখে জোজো সন্দিগ্ধভাবে বলল, আপনি আমাকে কী যেন দেখাবেন বললেন, তা হলে সমুদ্রের দিকে যাচ্ছেন কেন?

নরেন্দ্র ভার্মা বললেন, কেন, সমুদ্রে বুঝি কিছু দেখার নেই?

জোজো থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে বলল, আমি জলে নামব না।

নরেন্দ্র ভার্মা তার কাঁধে হাত দিয়ে বললেন, তোমাকে জলে নামতে হবে না। জলে পা না ভিজিয়েও তো সমুদ্রে ঘোরা যায়।

ওরা বেলাভূমিতে এসে দাড়াতেই দূর থেকে ভটভট শব্দ করতে করতে একটা মোটরবোট এসে গেল কাছে।

তাতে উঠতে উঠতে কাকাবাবু বললেন, আজ সমুদ্র বেশ শান্ত।

নরেন্দ্র ভার্মা বললেন, আমরা খুব লাকি। যা দেখতে যাচ্ছি, এইসব দিনেই তা দেখা যায় ভাল করে।

মোটরবোটে একজন চালক রয়েছে। তার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেওয়া হল, তার নাম ফ্রেড। তিরিশের কাছাকাছি বয়েস, জিনসের প্যান্টশার্ট পরা, থুতনিতে অল্প দাড়ি।

বোটটা চলতে লাগল বেশ জোরে। চারদিকেই সমুদ্র। জোজো মনে মনে ভাবল, সমুদ্র তো একই রকম, এতে বিশেষ কিছু দেখবার কী থাকতে পারে? কিছু সিন্ধুসারস বা সি-গাল পাখি ওড়াউড়ি করছে, আর শুধু ছোট ছোট ঢেউ। প্রায় আধঘণ্টা চলার পর দেখা গেল, সমুদ্রের বুকে কিছু গাছপালা।

কাকাবাবু বললেন, ওখানে বুঝি একটা দ্বীপ আছে?

নরেন্দ্র ভার্মা বললেন, হ্যাঁ, ওখানেই আমরা যাব।

ফ্রেডের কাছ থেকে একটা দূরবিন চেয়ে নিয়ে তিনি দ্বীপটা দেখতে লাগলেন। সেটা ক্রমশ কাছে এগিয়ে এল, গাছপালাগুলো বড় হয়ে গেল। মনে হতে লাগল যেন সেই দ্বীপে একটা ভাঙাচোরা বাড়িও রয়েছে।

সন্তু জিজ্ঞেস করল, এই দ্বীপটার নাম কী?

নরেন্দ্র ভার্মা বললেন, ম্যাপে এই দ্বীপের নাম নেই। খুবই ছোট, অনেকখানি আবার জোয়ারের সময় ড়ুবে যায়। যারা সমুদ্রে মাছ ধরে, তারা ছাড়া আর বিশেষ কেউ এই দ্বীপের কথা জানে না। সেই জেলেরা বলে রাবার দ্বীপ। রাবার আয়ল্যান্ড!

সন্তু বলল, রাবার? এরকম অদ্ভুত নাম কেন?

নরেন্দ্র ভার্মা বললেন, লোকের মুখে মুখে নাম বদলে যায়। রবার্ট নামে এক সাহেব এই দ্বীপে একটা বাড়ি বানিয়েছিল অনেক কাল আগে। সেই রবার্ট সাহেবের দ্বীপ হিসেবে এর নাম ছিল রবার্টস আয়ল্যান্ড। তাই থেকে এখন রাবার দ্বীপ।

কাকাবাবু বললেন, হ্যাঁ, এরকম বদলায়। রবীন্দ্রনাথদের জমিদারি ছিল যে শিলাইদহে, সেই শিলাই আসলে শেলি নামে একজন সাহেবের নাম থেকে হয়েছে।

নরেন্দ্র ভার্মা কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কবি শেলি? তিনি বেঙ্গলে এসেছিলেন নাকি?

কাকাবাবু বললেন, না, না, এ অন্য শেলি। বোধহয় নীলকর সাহেব। বোটটা কিন্তু দ্বীপটার তীর পর্যন্ত গেল না, একটু দূরে থেমে গেল।

নরেন্দ্র ভার্মা বললেন, এবার সবাই পা তুলে বসো। নীচের দিকে তাকিয়ে দ্যাখো!

সন্তু দারুণ অবাক হয়ে বলল, আরেঃ!

এতক্ষণ বোঝা যায়নি, এখন দেখা গেল বোটের তলার দিকটা এক ধরনের স্বচ্ছ কাচের তৈরি। জলের নীচে অনেকখানি দেখা যায়।

সেখান দিয়ে দেখা যাচ্ছে অসংখ্য রঙিন মাছ। ছোট, বড়, নানা ধরনের।

কাকাবাবু বললেন, গ্লাস বটম বোট! এটা কি কোরাল রিফ?

নরেন্দ্র ভার্মা বললেন, হ্যাঁ, তলার পাথরগুলো দ্যাখো। কত রং, ওর মধ্যে কিছু কিছু পাথর কিন্তু জ্যান্ত!

সন্তু বলল, অপূর্ব দৃশ্য! ডিসকভারি চ্যানেলেই শুধু এরকম প্রবাল দ্বীপ দেখেছি। এত কাছ থেকে, নিজের চোখে দেখা।

সবাই মুগ্ধ হয়ে দেখল কিছুক্ষণ।

এক সময় মুখ তুলে সন্তু জিজ্ঞেস করল, নরেনকাকা, তুমি তখন বললে, শুধু জোজোকেই অপূর্ব কিছু দেখাবে। এখন তো আমরা সবাই দেখছি।

নরেন্দ্র ভার্মা বললেন, তুমি আর রাজা নিজেরাই দেখতে পারো। ইচ্ছে করলে জলে নেমে গিয়ে একেবারে কাছ থেকে। জোজো তো তা পারবে না, ওকে দেখাতে হবে।

জোজো বলল, এই তো আমি নিজে নিজেই দেখছি।

যেন তার কথা শুনতেই পেলেন না, এইভাবে নরেন্দ্র ভার্মা সন্তুকে বললেন, তোমরা সাঁতার জানো, তোমরা স্কুবা ডাইভিং করতে পারো, সব জিনিসপত্র রেডি আছে। একেবারে নীচে গিয়ে হাত দিয়ে অনুভব না করলে এর সৌন্দর্য অনেকটা অনুভব করা যায় না।

কাকাবাবু এর মধ্যেই কোট খুলে ফেলেছেন। প্যান্টও খুলতে খুলতে বললেন, জলে তো নামব নিশ্চয়ই।

নরেন্দ্র ভার্মা বললেন, তোমরা আগে নামো। তারপর আমি আর জোজো নামব একসঙ্গে।

জোজো চেঁচিয়ে উঠে বলল, না, না, আমি জলে নামব না! আমি এখান থেকেই ভাল দেখতে পাচ্ছি।

নরেন্দ্র ভার্মা বললেন, শোনো, ওরা করবে স্কুবা ডাইভিং, আর আমরা করব স্নারকেলিং। তাতে সাঁতার না জানলেও চলে। তোমার কোনও ভয় নেই, আমি তোমায় ধরে থাকব।

জোজো তবু চেঁচিয়ে বলল, না, না, আমার কোনও দরকার নেই!

নরেন্দ্র ভার্মা বোটের চালককে জিজ্ঞেস করলেন, ফ্রেড, তোমার কাছে রকেলিং-এর জন্য চশমা আর মুখোশ-টুখোশ আছে তো?

ফ্রেড বলল, ইয়েস স্যার।

নরেন্দ্র ভার্মা জোজোকে বললেন, তুমি জামা-প্যান্ট খুলবে? না সবকিছু ভেজাবে? ভেতরে জাঙিয়া আছে নিশ্চয়ই।

জোজো বলল, বলছি তো আমি জলে নামব না। কেন বারবার বলছেন?

কাকাবাবু বললেন, সন্তু, তোর বন্ধুকে ধাক্কা দিয়ে জলে ফেলে দে তো!নইলে ওর জলের ভয় কাটবে না। স্নারকেলিং-এ তো ইচ্ছে করলেও ড়ুবতে পারবে না। রবারের টায়ার ওকে বাঁচিয়ে রাখবে!

জোজোর মুখের চেহারা একেবারে কাঁদো কাঁদো হয়ে গেল।

সন্তু বলল, জামা খুলে ফেল জোজো। স্পিড বোটের পাটাতনের নীচে অনেক কিছু রাখা আছে। ফ্রেড সেখান থেকে বার করে আনল অনেক সরঞ্জাম।

নরেন্দ্র ভার্মা জোজোকে বুঝিয়ে দিলেন, এই দ্যাখো, এই রবারের বেলুনের মতন জামা তোমাকে পরিয়ে দেব, তুমি কিছুতেই ড়ুববে না। আর এই মুখোশের মতন জিনিসটা থেকে একটা নল বেরিয়ে থাকবে জলের ওপরে, তার থেকে হাওয়া আসবে। তুমি নিশ্বাস নিতে পারবে, আর এই যে বড় বড় গলসের মতন চশমা, এদিয়ে জলের মধ্যেও স্পষ্ট দেখা যায়।

ওইসব জিনিস জোজোকে পরাতে সাহায্য করল সন্তু। সে নিজে আগেই পিঠে অক্সিজেন সিলিন্ডার বেঁধে নিয়েছে।

নরেন্দ্র ভার্মা জোজোর হাত ধরে বললেন, শোনো জোজোবাবু, এর পরেও যদি ভয় করে, আমার হাত ছাড়বে না। আমার লাইফ সেভিং সার্টিফিকেট আছে।

জোজোকে নিয়ে তিনি ঝাপ দিলেন সমুদ্রে।

কাকাবাবু আর সন্তু নেমে গেল অনেক নীচে। জোজো আর নরেন্দ্র ভার্মা ভাসতে লাগল, চোখ জলের মধ্যে। জল এখানে পাতলা নীল রঙের আর খুব পরিষ্কার, দেখা যাচ্ছে অসংখ্য রঙিন মাছ। ছোটগুলো ঝক ঝক, আর কয়েকটা বেশ বড়ও আছে।

কোরাল রিফ বা প্রবালের দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে আর চোখ ফেরানো যায় না। কী অপূর্ব তার গড়ন, কোথাও অনেকটা ছড়ানো ফুলের মতন, কোথাও যেন গাছ, কোথাও যেন ঝাড়লণ্ঠন, কোথাও পাথরের ছবি। কতরকম রং আর সেসব রঙই খুব স্নিগ্ধ। চোখ জুড়িয়ে যায়। যেন স্বর্গের কোনও দৃশ্য। জলের নীচে যে এমন একটা জগৎ আছে, তা চোখে না দেখলে বিশ্বাসই হত না।

এক-একবার নরেন্দ্র ভার্মা জোজোকে একটু টান মেরে খানিকটা ড়ুবিয়ে দিচ্ছেন জোর করে। জোজো ভয় পেয়ে আঁকুপাকু করে উঠতেই তিনি আবার ভেসে উঠে বললেন, ভয় পেয়ো না। তোমার নাকের সঙ্গে যে নলটা লাগানো আছে, সেটা বেশি ড়ুবে গেলে সেটা থেকে হাওয়া আসার বদলে জল ঢুকে যাবে। তাই আমি তোমাকে একটুখানি নীচে নিয়ে যাচ্ছি। ভয় পাওয়ার বদলে তুমি কোরালগুলোকে একটু হাত দিয়ে ছুঁয়ে দ্যাখো।

বিস্ময়ের পর বিস্ময়! যে রঙিন জিনিসগুলো মনে হচ্ছিল পাথরের তৈরি, সেগুলোর গায়ে হাত ছোঁয়াতেই এক-একটা খানিকটা গুটিয়ে যাচ্ছে। অর্থাৎ ওরা জীবন্ত! কিন্তু ভয়ের কিছু নেই। ওরা কামড়ায় না। এমনকী যে মাছগুলো গা ঘেঁষে চলে যাচ্ছে, তারাও মানুষকে গ্রাহ্যও করে না।

এক সময় নরেন্দ্র ভার্মা বললেন, এবার উঠতে হবে। তখন জোজোই বলল, না, না, এখন উঠতে ইচ্ছে করছে না! আর একটু থাকব।

আকাশে মেঘ ঘনিয়ে এসেছে। সমুদ্রের সব কিছুই আকাশের ওপর নির্ভর করে। আকাশ মেঘলা হলে সমুদ্রের জলও ঘোলাটে হয়ে যায়। আকাশে ঝড় উঠলে সমুদ্রও উত্তাল হয়।

মেঘের জন্য বিকেল ফুরিয়ে গেল। এখন আর কিছু দেখা যাবে না। সন্তু আর কাকাবাবু ফিরে এলেন। ফ্রেড এতক্ষণ একলা বসে অনবরত চুরুট টেনে যাচ্ছিল, এবার সে বলল, উই শুড গো ব্যাক নাউ।

সে কয়েকখানা শুকনো তোয়ালে দিল সবার গা মোছার জন্য।

জোজো বলল, কাকাবাবু, তুমি ভাগ্যিস আমাকে বললে! আমার জলের ভয় কেটে গেছে। ওঃ, কী দৃশ্য দেখলুম, জন্ম-জন্মান্তরেও ভুলব না!

সন্তু বলল, একেবারে নীচে গেলে, বুঝলি জোজো, মনে হবে যেন পৃথিবীর বাইরে অন্য কোথাও এসেছি। এরকম রঙের গোলা আগে কখনও দেখিনি। আমি কোরাল রিফ ধরে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে চলে গিয়েছিলুম।

জোজো বলল, আমি কলকাতা ফিরেই সাঁতারের ক্লাসে ভরতি হব। ব্রাজিল যাওয়ার তো অনেক দেরি আছে।

নরেন্দ্র ভার্মা বোটচালককে বললেন, ফ্রেড, তুমি ফ্লাস্কে কফি আনোনি? একটু একটু শীত করছে, এখন একটু কফি পেলে মন্দ হত না।

ফ্রেড বলল, স্যার, আমার কাছে স্পিরিট ল্যাম্প, কফিটফি সবই আছে। তবে আমার মনে হয়, এখন আমাদের ফিরে যাওয়াই উচিত।

নরেন্দ্র ভার্মা বললেন, একটু কফি খেয়ে নিই। এক্ষুনি ফিরতে ইচ্ছে করছে না।

কাকাবাবু ভিজে পোশাক বদলে ফেলেছেন, কিন্তু এতক্ষণ একটা কথাও বলেননি। তার ভুরু দুটো কোঁচকানো, কী যেন চিন্তা করছেন।

নরেন্দ্র ভার্মা বললেন, রাজা, তোমার কী ব্যাপার, গম্ভীর হয়ে আছ? তোমার ভাল লাগেনি? তুমি বোধ হয় স্কুবা ডাইভিং আগেও করেছ?

কাকাবাবু বললেন, ভাল লাগবে না কেন? ফ্যানটাস্টিক! আগে এরকম দেখেছি আন্দামানে, তবে এখানে কোরাল রিফ যেন আরও বড়। খালি একটা ব্যাপারে খটকা লাগছে, নরেন্দ্র কীসের সঙ্গে যেন আমার একবার ধাক্কা লাগল। খুব জোরে। জলের মধ্যে কোনও আঘাতই জোর হয় না। কিন্তু আমার মাথাটা ঝিমঝিম করে উঠেছিল।

নরেন্দ্র ভার্মা বললেন, রাজা, সমুদ্রের তলায় সাঁতার কাটতে গেলে খুব সাবধানে থাকতে হয়। কত রকমের ড়ুবো পাথর থাকে, বোঝাই যায় না। তা ছাড়া হাঙর এসে পড়তে পারে। অবশ্য সাধারণত হাঙররা …

কাকাবাবু একটু রেগে গিয়ে বললেন, তুমি আমাকে উপদেশ দিচ্ছ নরেন্দ্র। তোমার থেকে বোধহয় অনেক বেশিবার আমি সমুদ্রের তলায় স্কুবা ডাইভিং করেছি একসময়। আমি সাবধানই ছিলাম। দ্বীপটিপের এত কাছে হাঙর আসে না। পাথরও ছিল না! কিছুই দেখতে পাইনি।

তারপরই নিজেকে সামলে নিয়ে কাকাবাবু বললেন, আই অ্যাম সরি নরেন্দ্র। হয়তো আমারই ভুল। তুমি এই জায়গাটায় আমাদের নিয়ে এলে, সেজন্য তোমাকে ধন্যবাদ।

নরেন্দ্র ভার্মা মিটিমিটি হাসছেন। তিনি কাকাবাবুর এমনই বন্ধু যে বকুনি খেলেও রাগ করেন না। অবশ্য তিনিও অন্য সময় বকুনি দিতে ছাড়েন না।

কাকাবাবু বললেন, বেশ লাগছে। আমাকে আর একটু কফি দাও তো, আছে?

ফ্রেড কাকাবাবুর কাপে আর একটু কফি ঢেলে দিল। আকাশে মেঘ ঘোরাফেরা শুরু করেছে। বাতাসও ফিনফিনে।

কাকাবাবু বললেন, দ্বীপের মধ্যে ওই যে বাড়িটা, ওখানে একবার যাওয়া যায় না? নরেন্দ্র, তুমি কখনও ওই বাড়িটার মধ্যে গিয়ে দেখেছ?

নরেন্দ্র ভার্মা বললেন, এখান থেকে দ্বীপে ওঠার ব্যবস্থা নেই। খানিকটা ঘুরে যেতে হবে।

তিনি বোটচালককে জিজ্ঞেস করলেন, ফ্রেড, চলো, আমরা আয়ল্যান্ডটা একবার ঘুরে যাই।

ফ্রেড বলল, দ্যাট ইজ ইমপসিবল স্যার!

নরেন্দ্র ভার্মা বললেন, কেন ইমপসিবল? ওদিকে জেটি আছে।

ফ্রেড বলল, একটু পরেই সন্ধে হয়ে যাবে। তারপর ওখানে যাওয়ার কোনও প্রশ্নই ওঠে না, তা আপনি স্যার ভালই জানেন। আমাকে এখন ফিরতে হবেই।

নরেন্দ্র ভার্মা বললেন, ফ্রেড, তোমাকে যদি ফিরতেই হয়, তুমি আমাদের ওখানে নামিয়ে দাও। আমরা আজকের রাতটা অ্যাডভেঞ্চার করি। তুমি কাল সকালে এসে আমাদের ফেরত নিয়ে যেয়ো।

ফ্রেড কয়েক মুহূর্ত রাগ-রাগ চোখে তাকিয়ে রইল নরেন্দ্র ভার্মার দিকে।

তারপর তিক্ত গলায় বলল, স্যার আপনি যা বলছেন, তা আমার পক্ষে মানা সম্ভব নয়।

নরেন্দ্র ভার্মা বললেন, ফ্রেড, এই বোটটা আমি ভাড়া নিয়েছি। আমি যা অর্ডার করেছি, তা মানতে তুমি বাধ্য।

ফ্রেড দুকাঁধ ঝাকাল।

তারপর সে চালু করে দিল ইঞ্জিন। একটু পরেই বোঝা গেল, সে নরেন্দ্র ভার্মার হুকুম একেবারে অগ্রাহ্য করেছে।

বোটটা ক্রমশ চলে যাচ্ছে দ্বীপ থেকে অনেক দূরে।
রাত্তিরে খাওয়া-দাওয়ার পর সবাই বসেছে অতিথি ভবনের ছাদে।

সন্ধেবেলা আকাশে অত মেঘ ঘনিয়ে এলেও তেমন ঝড়-বৃষ্টি হয়নি। তবে এখনও এদিকে ফিনফিনে বাতাস বইছে।

এখান থেকে সমুদ্র দেখা যায়, ঢেউয়ের শব্দও শোনা যায়। সমুদ্র এখন কালো। আকাশে চাঁদের সঙ্গে মেঘের লুকোচুরি খেলা চলছে।

কাকাবাবু এখনও গম্ভীর হয়ে আছেন। কেমন যেন অন্যমনস্ক।

এর মধ্যে জোজো একটা লম্বা, রোমহর্ষক গল্প শোনাল, তাতেও কাকাবাবু কোনও মন্তব্য করলেন না।

নরেন্দ্র ভার্মা কৌতূহলী চোখে লক্ষ করছেন কাকাবাবুকে। এক সময় তিনি বললেন, রাজা, তুমি কী চিন্তা করছ জানি না। তোমাকে একটা খুব সরল, সাধারণ প্রশ্ন করতে পারি?

কাকাবাবু বললেন, তোমার আবার প্রশ্ন করার জন্য অনুমতি লাগে নাকি? বলে ফেলো!

নরেন্দ্র ভার্মা বললেন, তুমি ভূত বিশ্বাস করো?

কাকাবাবু হঠাৎ রেগে গিয়ে ধমক দিয়ে বললেন, নরেন্দ্র, তুমি আমার সঙ্গে এতদিন ধরে মিশছ, তবু তুমি আমাকে চেনো না? এটা কি একটা প্রশ্ন হল? ছেলেমানুষি করছ আমার সঙ্গে?

নরেন্দ্র ভার্মা বললেন, এইজন্যই ভয় পাচ্ছিলাম। এ সম্পর্কে তোমার মত আমি জানি। কিন্তু বয়েসের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের কিছু-কিছু মত তো বদলায়।

তা বলে বিজ্ঞানের প্রতিষ্ঠিত সত্য বদলে যাবে নাকি?

তাও কিছু কিছু বদলায়। একটা সহজ উদাহরণ দিচ্ছি। আগে ডাক্তাররা বলতেন, ছোট ছোট মাছ খাবে। বড় বড় চর্বিওয়ালা মাছ শরীরের পক্ষে ক্ষতিকর। এখন সেই মতটা উলটে গেছে। সব ডাক্তার বলছেন, মাছের চর্বিই আসলে খুব উপকারী। তেলালো মাছ, চর্বিওয়ালা মাছই খেতে হবে। তাতে নাকি মনও ভাল হয়ে যায়।

জোজো বলল, সেইজন্যই তো ইলিশ মাছ খেতে এত ভাল লাগে। পুঁটিমাছ। ভাল লাগে না।

কাকাবাবু তবু রাগ রাগ ভাব করে বললেন, কী আজেবাজে কথা বলছ। নরেন্দ্র? একবার বলছ ভূত, একবার বলছ মাছ …

নরেন্দ্র ভার্মা বললেন, আহা, রাগ করছ কেন? আমি তোমার সঙ্গে মজা করছি না। বিশেষ কারণ আছে। ফ্রেড নামের বোটচালকটি আমার আদেশ অগ্রাহ্য করেও কেন দ্বীপটি ছেড়ে চলে এল জানো?

কাকাবাবু বললেন, সন্ধে হয়ে আসছিল। রাত্তিরে ও বোট চালাতে রাজি নয়। তা ছাড়া ঝড়বৃষ্টি …

আমি তো বলেছিলাম, আমাদের নামিয়ে দিয়ে ও চলে আসতে পারে।

তাতে আমাদের বিপদের আশঙ্কা ছিল। ও ঝুঁকি নিতে চায়নি।

সেটাও আসল কারণ নয়। ওর ধারণা, দ্বীপের মধ্যে ওই বাড়িটা ভূতের বাড়ি।

ওঃ, কোনও ফাঁকা মাঠের মধ্যে পুরনো ভাঙাচোরা বাড়ি দেখলেই অনেকে বলে ভূতের বাড়ি। আসলে সেগুলো চোর-ডাকাতের আড্ডা। তারাই ভয় দেখায়।

পাঁচজন বৈজ্ঞানিকের একটা টিম ওই বাড়িতে রাত কাটিয়ে এসেছেন। তারা ভূত দেখতে পাননি বটে, কিন্তু কিছু ছবি তুলে এনেছেন, যার কোনও ব্যাখ্যা পাওয়া যাচ্ছে না। সেই ছবিগুলো আমার কাছে আছে। দেখবে? চলো, নীচে আমার ঘরে চলো-।

নরেন্দ্র, তুমি থাকো দিল্লিতে। তোমার বাড়ি আম্বালায়। তুমি এই দক্ষিণ ভারতের সমুদ্রে একটা নগণ্য দ্বীপের পোড়োবাড়ি নিয়ে এত মাথা ঘামাচ্ছ কেন বলো তো?

দিল্লি থেকে আমাকে ওই বাড়িটার ব্যাপারেই পাঠানো হয়েছে। ওখানে একটা কিছু ঘটছে। এর মধ্যে তোমাকেও জড়িয়ে নিতে চাই। তোমাদের যে কোরাল রিফ দেখাতে নিয়ে গেলাম, তা কি এমনি এমনি? যদি বলতাম, চলো একটা ভূতের বাড়ি দেখে আসি, তা হলে তুমি মোটেই যেতে রাজি হতে না।

ও জায়গাটায় আমার আবার যাবার ইচ্ছে আছে।

সন্তু আর জোজো বলে উঠল, আমরাও আবার যাব।

কাকাবাবু বললেন, ভূতের বাড়ির যদি ব্যাপার হয়, তা হলে জোজোকে বলো। ও ভূতের এক্সপার্ট। এমনকী, ভূত ধরে বোতলে বন্দি করেও রাখতে পারে।

ছাদ থেকে নেমে এসে বসা হল নরেন্দ্র ভার্মার ঘরে। তিনি একটা অ্যাটাচি কেস খুলে একটা খালি খাম বার করলেন। তার মধ্যে চারখানা ছবি। বেশ বড় বড় প্রিন্ট, খাতার পাতার মতন।

নরেন্দ্র ভার্মা বললেন, যে বিজ্ঞানীদের টিমটা ওখানে গিয়েছিল, তারা সন্দেহজনক কিছু দেখতে পাননি, কোনও আওয়াজ শোনেননি, চোর-ডাকাতদেরও আড্ডা হওয়ার কোনও চিহ্ন নেই। শুধু এই ব্যাপারটা দেখেছেন।

প্রথম ছবিটা রাত্তিরবেলা তোলা। পুরোটাই অন্ধকার, শুধু মাঝখানে তিনটে সাদা ছোপ।

দ্বিতীয় ছবিটাও প্রায় একই, তবে সাদা ছোপ তিনটের জায়গায় চারটে। কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, এগুলো কী? মশাল?

নরেন্দ্র ভার্মা বললেন, তা হতেও পারে। বৈজ্ঞানিকরা তাদের রিপোর্টে বলেছেন, রাত্তিরবেলা অনেক দূরে তারা জানলা দিয়ে এগুলো দেখেছেন। মশালের মতনই মনে হয়। তবে দাউ দাউ করে জ্বলেনি।

কাকাবাবু বললেন, কোথায় দেখেছে, জলের ওপর?

নরেন্দ্র ভার্মা বললেন, তা ঠিক বলা যায় না। ওই বাড়িটার পেছন দিকে অনেকখানি জায়গা পড়ে আছে, সেখানে কোনও গাছপালা নেই, জোয়ারের সময় জল উঠে আসে, অন্য সময় কাদা কাদা হয়ে থাকে। সে সময় জোয়ার ছিল কি না, তা বোঝা যায়নি!

ওঁরা কাছে গিয়ে দেখলেন না কেন? এ ছবি তো মনে হচ্ছে টেলিফোটো লেন্সে অনেক দূর থেকে তোলা।

রাত্তিরবেলা ওঁরা বাইরে বেরুবেন না, এটা আগে থেকেই ঠিক করা ছিল। বিপদটিপদের কথাও তো চিন্তা করতে হবে। ওঁদের সঙ্গে অবশ্য আর্মড গার্ড ছিল।

তা ঠিক, বিপদের কথা চিন্তা করতেই হবে। অত নির্জন জায়গা। ওই আলোগুলো দেখা গেছে মাত্র কয়েক মিনিট। তারপর আবার সব অন্ধকার।

জোজো জিজ্ঞেস করল, কারা ওই মশাল নিয়ে যাচ্ছিল?

নরেন্দ্র ভার্মা বললেন, দ্যাট ইজ আ মিলিয়ন ডলার কোয়েশ্চেন। ছবিগুলো ভাল করে দ্যাখো, কোনও মানুষ দেখা যাচ্ছে না। যতই অন্ধকার হোক, মশালের আলোতে মানুষের অস্পষ্ট চেহারা তো অন্তত ফুটে উঠবে? ওঁদের ক্যামেরায় খুব শক্তিশালী লেন্স, এরকম ছবি তুলেছেন প্রায় পঞ্চাশ-ষাটটা। সবই প্রায় একই রকম বলে আমি মাত্র চারটে এনেছি।

সন্তু বলল, যদি কেউ সম্পূর্ণ কালো পোশাক পরে থাকে, আর মুখেও কালো রং মাখে, তা হলে রাত্তিরবেলা তার ছবি উঠবে না।

জোজো বলল, সকালবেলা সেই জায়গাটায় গিয়ে কারও পায়ের চিহ্নটিহ্ন দেখা যায়নি?

নরেন্দ্র ভার্মা বললেন, রোজই সকালবেলা সেখানে জোয়ারের জল আসে। তখন কিছুই বোঝার উপায় নেই।

কাকাবাবু বললেন, আর কোনও রহস্যময় ব্যাপার সেখানে ছিল না? শুধু গভীর রাতে কয়েকটা মশালের মতন আলো, কোনও লোক দেখা যাচ্ছে না। এর একটা সহজ ব্যাখ্যা দেওয়া যেতে পারে, তবে নিজের চোখে না দেখে কিছু বলা উচিত নয়।

নরেন্দ্র ভার্মা বললেন, চতুর্থ ছবিটা দ্যাখো। এটা দিনের বেলা তোলা। এখানেও দুটো মশাল দেখা যাচ্ছে, কিন্তু কোনও লোক নেই। ঠিক যেন শূন্যে ঝুলছে।

কাকাবাবু ভুরু কুঁচকে আপন মনে বললেন, দিনের বেলা মশাল?

নরেন্দ্র ভার্মা বললেন, প্রশ্ন তিনটে। কেন শুধু শুধু মশাল জ্বলে। কেন একটাও লোক দেখা যায় না। মশাল জ্বাললে মানুষ থাকবেই, তারা কোথায় লুকোয়? তাদের কেন ছবি ওঠে না?

কাকাবাবু বললেন, আমার তা হলে এখুনি কলকাতায় ফেরা হবে না। ওই দ্বীপে গিয়ে ঘাঁটি গাড়তে হবে।

নরেন্দ্র ভার্মা একগাল হেসে বললেন, আমিও তো সেটাই ভেবে এসেছি। অন্তত দুটো রাত যদি থাকা যায়।

কাকাবাবু বললেন, কিন্তু কী করে যাওয়া হবে। তোমার ওই অবাধ্য বোটচালককে দিয়ে কাজ চলবে না।

নরেন্দ্র ভার্মা বললেন, না, না, অন্য বোট জোগাড় করতে হবে। সঙ্গে খাবারদাবারের বন্দোবস্ত থাকবে।

শেষ রাত থেকেই তুমুল বৃষ্টি নামল।

পরদিন অনেক বেলা পর্যন্ত চলল সেই বৃষ্টি একটানা। এর মধ্যে বেরোবার কোনও উপায় নেই। কোনও বোটচালকই এসব দুর্যোগের মধ্যে সমুদ্রে বোট চালাতে রাজি হবে না।

সেই রাইফেলধারী পাহারাদারকে নেওয়া হবে কি হবে না?

নরেন্দ্র ভার্মা বললেন, আমরা চারজন, বোটচালককে ধরলে পাঁচ, এর পর ওকে নিলে চাপাচাপি হয়ে যাবে।

কাকাবাবু বললেন, দ্বীপে একজন অতিরিক্ত লোক কাজে লাগতে পারে। ও বেচারা পাহারা দিতে এসেছে।

নরেন্দ্র ভার্মা বললেন, ওই দ্বীপে পাহারা দেওয়ার দরকার হবে না। বিজ্ঞানীরা বলেছেন, ওখানে কিছু অদ্ভুত ব্যাপার ঘটলেও বিপদের নামগন্ধ নেই। তা ছাড়া, তোমার আর আমার কাছে অস্ত্র থাকছে।

কাকাবাবু বললেন, আচ্ছা, ওর সঙ্গে কথা বলে দেখা যাক।

পুলিশটির নাম লছমন রাও। সে আর রাইফেলটা হাতছাড়া করে না। সব সময় কাঁধে রাখে।

সে আসবার পর কাকাবাবু হিন্দিতে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার বাড়ি কোথায় ভাই?

সে নরেন্দ্র ভার্মার মুখের দিকে তাকাল। সে তো হিন্দি বোঝে না।

কাকাবাবু বললেন, এই তো মুশকিল, নরেন্দ্র, তুমিই ওর বাড়ির খোঁজখবর নাও। তারপর জিজ্ঞেস করো, ও রান্না করতে জানে কি না।

শেষ প্রশ্নটা শুনে লোকটি জোরে জোরে দুদিকে মাথা দোলাতে লাগল। আমরা মাথা নেড়ে যেভাবে না বলি, সেটাই ওদের হ্যাঁ।

কাকাবাবু বললেন, নরেন্দ্র, জিজ্ঞেস করো, কী কী রাঁধতে পারে।

লছমন রাও বলল, ইডলি, ধোসা, সম্ভরম।

কাকাবাবু বললেন, বাঃ, সে তো খুবই ভাল। সাধারণ ভাত, রুটি বানাতে পারো না?

লছমন রাও জানাল যে, সে ওসবও পারে। এমনকী ঢ্যাঁড়স সেদ্ধ, আলু ভাজাও পারে।

কাকাবাবু বললেন, তা হলে ওকে নিয়ে যাওয়া হোক, পাহারা দেওয়ার দরকার নেই, দুবেলা রান্নার কাজ তো অন্তত করে দিতে পারবে!

সে চলে যাওয়ার পর নরেন্দ্র ভার্মা বললেন, রাজা, ওকে যে নিয়ে যাচ্ছ, ওর চেহারাটা দেখেছ? ও নিজেই তো আমাদের চেয়ে অনেক বেশি খেয়ে নেবে।

কাকাবাবু বললেন, আহা, তাতে আর কী হবে! বেশি করে চাল-ডাল নিয়ে নেবে।

বৃষ্টির বেগ একটু কমল বিকেলের দিকে। একটু পরেই সন্ধে হয়ে যাবে। আজ আর বেরোবার কোনও মানে হয় না। একটা দিন নষ্ট। নরেন্দ্র ভার্মা একটার পর একটা ফোন করে সময় কাটালেন।

পরদিন সকালবেলা তিনি বললেন, সবাই তৈরি হয়ে নাও। আমি সব ব্যবস্থা করে ফেলেছি, ঠিক দশটার সময় বোট আসবে। চাল-ডাল, খাবার-দাবার সে-ই হিসেব করে নিয়ে আসবে। এখানে তো কোনও দোকান নেই।

সন্তু আর জোজো দশটা বাজার অনেক আগেই রেডি।

সন্তু বলল, আমার ভূতটুত নিয়ে কোনও আগ্রহ নেই। আমি গিয়েই জলে নামব।

জোজো বলল, ভূত যদি থাকে, তাতে কোনও প্রবলেম নেই। আমি একটা খালি কাচের বোতল নিয়ে যাচ্ছি। ওর মধ্যে ভূতটাকে ঠিক ঢুকিয়ে দেব। মন্ত্রটাও মনে পড়ে গেছে।

সন্তু বলল, একটা মোটে বোতল নিচ্ছিস? যদি অনেক ভূত থাকে?

জোজো অবজ্ঞার সঙ্গে ঠোঁট উলটে বলল, একগাদা ভূত নিয়ে কী করব? একটাকে ধরলেই অন্যগুলো পালাবে ভয় পেয়ে।

সন্তু বলল, ভূতরাও মানুষকে ভয় পায়?

জোজো বলল, তেমন তেমন মানুষের পাল্লায় পড়লে হাউ মাউ করে কাঁদে। মুসোলিনির ভূতটা তো আমার বাবার পা ধরে ক্ষমা চেয়েছিল।

সন্তু বলল, ভূতরা তো আসলে মানুষকে ভয় দেখাতে চায়। সেটাই তাদের একমাত্র কাজ। কিন্তু ওই নির্জন দ্বীপে, যেখানে জনমনুষ্য নেই, সহজে কেউ যেতেও চায় না, সেখানে ভূতেরা কী করে?

জোজো বলল, সেটা আমি ওদের এক ব্যাটাকে ধরে জেরা করে সব জেনে নেব।

সন্তু বলল, তুই ওসব করিস। আমি যতক্ষণ পারি সমুদ্রে ড়ুব দিয়ে কোরাল রিফ দেখব। আঃ, অপূর্ব, অপূর্ব! জলের তলায় কী করে এত রকম রং থাকে?

জোজো বলল, দিনের বেলায় আমিও দেখব। জলে নামার ভয় আমার কেটে গেছে।

আজ বৃষ্টি পড়ছে না বটে, কিন্তু আকাশ মেঘলা। বোটটা চলে এল ঠিক সময়। এটা কালকের চেয়ে একটু বড়। মাঝখানে একটা ছোট ঘর আছে, বৃষ্টি পড়লে ওটার মধ্যে আশ্রয় নেওয়া যাবে।

আজকের বোটচালকের নাম সিরাজুদ্দিন তারিক। মাঝবয়েসি মানুষ, চোখে চশমা, কুর্তা-পাজামা পরা।

নরেন্দ্র ভার্মা জিজ্ঞেস করলেন, তারিকসাহেব, সব জিনিসপত্র এনেছেন তো?

তারিক বললেন, হ্যাঁ, স্যার। অর্কিড লজের ম্যানেজারকে আপনি ফোন করেছিলেন, তিনদিনের জন্য খাবার-দাবার যা লাগতে পারে, সব গুছিয়ে দিয়েছেন।

কাকাবাবু বললেন, আমরা দুদিনের বেশি থাকব না। ওতেই হয়ে যাবে। তারিকসাহেব, আপনি রবার্ট আয়ল্যান্ডে গেছেন আগে?

তারিক বললেন, পাশ দিয়ে গেছি কয়েকবার। তবে দ্বীপে নামিনি কখনও।

কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, আপনি ওই দ্বীপটা সম্পর্কে শুনেছেন কিছু?

তারিক বললেন, লোকে তো নানারকম কথাই বলে। ভূত-প্রেত আছে নাকি!

আপনি ওই দ্বীপে কখনও নামেননি কেন?

শুধু শুধু নামতে যাব কেন? ওই দ্বীপে তো একটা সেকেলে ভাঙা বাড়ি ছাড়া আর কিছুই নেই। সাপটাপ থাকতে পারে।

আপনি ভূত-প্রেতের ভয় পান?

না, স্যার। আমি ওসব নিয়ে মাথা ঘামাই না। বিশ্বাসই যদি না থাকে, তা হলে আর ভয় পাব কেন?.

ঠিক বলেছেন। আচ্ছা তারিকসাহেব, আপনি কি আমাদের পৌঁছে দিয়ে ফিরে আসবেন, আবার দুদিন পর আসবেন? নাকি এই দুদিন থাকবেন আমাদের সঙ্গে। থাকলে ভাল হয়। হয়তো আমরা এদিক-ওদিক যেতে পারি।

না, না, আমি থেকে যাব। সেরকমই বলা হয়েছে। আপনাদের সঙ্গে দুটো দিন কাটাব, এ তো আমার সৌভাগ্য। আমি আপনার কথা শুনেছি স্যার। অর্কিড লজের ম্যানেজার বললেন, রাজা রায়চৌধুরী ইজ আ ভেরি ফেমাস ম্যান! আমি স্যার ভাল রান্না করতে পারি, আপনাদের বেঁধে খাওয়াব, আলাদা মশলা এনেছি।

নরেন্দ্র ভার্মা বললেন, আঃ, তা হলে তো পিকনিক বেশ ভালই জমবে মনে হচ্ছে! চলো, সবাই উঠে পড়ো।

বোটে উঠে সন্তু জোজোকে ফিসফিস করে বলল, আমাদের এই অভিযানটা নিয়ে যদি একটা গল্প লেখা যায়, তবে তার নাম হওয়া উচিত, ভূতের সঙ্গে পিকনিক।

জোজো বলল, গল্প লেখার আগেই নাম দিতে নেই। দ্যাখ, আগে ওখানে কত কী ঘটে। হয়তো ভূতের বদলে দেখা গেল জলদানব।

সন্তু বলল, কিংবা এমনও হতে পারে, আজ গিয়ে দেখা গেল দ্বীপটা ওখানে নেই। জলের তলায় চলে গেছে!

জোজো বলল, কিংবা সেখানে একটা মস্ত বড় জাহাজ দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু

তার সব লোক অজ্ঞান।

এইরকম গল্পে গল্পে সময় কাটতে লাগল।

আজ বেশ ঢেউ আছে, বোটটা লাফিয়ে উঠছে মাঝে-মাঝে।

সিরাজুদ্দিন তারিক অল্পবয়েসি দুজনের দিকে হাত তুলে বললেন, ভয় নেই, এ বোট কখনও ডোবে না।

নরেন্দ্র ভার্মা বললেন, দূরে আর একটা বোট দেখা যাচ্ছে।

সিরাজুদ্দিন তারিক বললেন, অনেক সময় মাছ ধরার বোট দেখা যায়।

সেই বোটটা ক্রমশ কাছে আসছে। দেখা গেল, দুজন লোক দাঁড়িয়ে আছে, তাদের গায়ে খাকি পোশাক।

নরেন্দ্র ভার্মা ভুরু কুঁচকে বললেন, পুলিশের বোট নাকি? সেরকমই মনে হচ্ছে।

কাকাবাবু বললেন, পদ্মনাভন আমাদের পাহারা দেওয়ার জন্য এদেরও পাঠিয়ে দিয়েছে নাকি? সেটা বড় বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে। অধিক সন্ন্যাসীতে গাজন নষ্ট?

নরেন্দ্র ভার্মা বললেন, সেরকম হলে আমি ওদের জোর করে ফিরিয়ে দেব!

অন্য বোটটা একেবারে এই বোটের গায়ে গায়ে লাগল। একজন তারিকের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর গলায় বলল, আমরা পুলিশ। তোমার স্টার্ট বন্ধ করে দাও।

নরেন্দ্র ভার্মা জিজ্ঞেস করলেন, আপনাদের কে পাঠিয়েছে?

পুলিশটি নরেন্দ্র ভার্মাকে বলল, আপনার কোনও প্রশ্ন করার রাইট নেই। আমরা যা জিজ্ঞেস করব, তার উত্তর দেবেন। এই বোটে গাঁজা আছে?

নরেন্দ্র ভার্মা হাসিমুখে বললেন, এ আবার কী ব্যাপার? না, এখানকার কেউ গাঁজা খায় না।

পুলিশটি বলল, আমাদের কাছে খবর আছে, এই বোটে গাঁজা স্মাল করা হচ্ছে।

নরেন্দ্র ভার্মা বললেন, কী অদ্ভুত কথা! আমরা আমাদের পরিচয় দিচ্ছি, আমার নাম নরেন্দ্র ভার্মা, দিল্লির সি বি আই-এর জয়েন্ট ডিরেক্টর, আর উনি রাজা রায়চৌধুরী, সরকারি মহলে সবাই ওঁকে চেনে।

জোজো সন্তুকে চুপিচুপি বলল, গাঁজাখুরি ব্যাপার!

পুলিশটি গোঁয়ারের মতন নরেন্দ্র ভার্মার কথা গ্রাহ্যই করল না। সে আবার বলল, আমরা এ বোট সার্চ করে দেখব।

দুজনেই চলে এল এই বোটে।

লছমন রাও-ও যদিও পুলিশ, কিন্তু তার সাদা পোশাক। সে নিজের ভাষায় কিছু বলল, তার উত্তরে ওদের একজন বলল, শাট আপ!

নরেন্দ্র ভার্মা এবার রেগে গিয়ে বললেন, আপনারা এ কীরকম ব্যবহার করছেন! আপনাদের আইডেনটিটি দেখান!

এই যে দেখাচ্ছি, বলেই ওদের একজন একটা রিভলবার বার করে সোজা গুলি চালাল নরেন্দ্র ভার্মার দিকে।

আর একজন একটা রিভলভার ঠেকাল কাকাবাবুর কপালে।

অন্য বোটের তলার দিকে আর একজন লুকিয়েছিল। সে এবার উঠে দাঁড়িয়ে বলল, রাজা রায়চৌধুরী, আর একটা অস্ত্রও তোমার দিকে তাক করা আছে। চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকো, একদম নড়বে না।

এ সেই ডিমেলোর সহচর লম্বা লোকটি। সন্তুরা তাকে দেখামাত্র চিনে গেল।

যে-লোকটি নরেন্দ্র ভার্মাকে গুলি করেছে, সে রিভলভার উঁচিয়ে লছমান রাওয়ের রাইফেলটা কেড়ে নিয়ে ফেলে দিল সমুদ্রের জলে। তারপর সে তাকাল

সন্তু আর জোজোর দিকে।

চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করল, হুইচ ওয়ান?

লম্বা লোকটিও সন্তু আর জোজোর দিকে দ্রুত চোখ বুলিয়ে জোজোকেই বেছে নিল। সে নির্দেশ দিল, দ্যাট ওয়ান উইথ ইয়েলো শার্ট!

কাকাবাবু নিজের রিভলভার বার করার সময়ই পাননি। তিনি ভাবছেন নরেন্দ্র ভার্মার কথা। তিনি গুলি লাগার পর কোনও সাড়াশব্দই করলেন না। মরেই গেলেন নাকি? তা কি সম্ভব? কাকাবাবুর সঙ্গে তিনি কতবার কত জায়গায় গেছেন, এর চেয়েও অনেক বেশি বিপদে পড়েছেন, প্রত্যেকবার বেঁচে গেছেন। আর এখন এমন সামান্য কারণে প্রাণ দেবেন?

নরেন্দ্র ভার্মার চিন্তায় তিনি আর অত কিছুই ভাবতে পারছেন না।

লম্বা লোকটি বলল, রাজা রায়চৌধুরী, তোমাকে আমরা মারব না। এই ছেলেটিকে নিয়ে যাচ্ছি। যেমনভাবে পারো, ডিমেলোকে পুলিশের কাছ থেকে ছাড়াবার ব্যবস্থা করো, ঠিক তিনদিন সময়, তার মধ্যে আমাদের কথা মতন কাজ

হলে, এ ছেলেটির মৃতদেহ তোমার দরজার কাছে পৌঁছে দেব। তারপর তুমি যাবে!

ওরা জোজোর কলার চেপে নিজেদের বোটে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতেই সন্তু বলল, আমিও যাব, আমিও যাব।

একজন রিভলভারের বাঁট দিয়ে মারল সন্তুর মাথায়। সে ঢলে পড়ে গেল জ্ঞান হারিয়ে।
ওরা অন্য বোটে জোজোকে নিয়ে এসেই তার চোখ বেঁধে ফেলল। তারপর তাকে নীচে শুইয়ে ফেলে একজন তার দুটো পা চাপিয়ে রাখল জোজোর বুকের ওপর।

এদের এত সাংঘাতিক নিষ্ঠুরতা দেখে জোজো একেবারে হতবাক হয়ে গেছে। নরেন্দ্র আংকলকে মেরেই ফেলল? কাকাবাবু অনেক সময় গুন্ডা-বদমাশদের সামনেও ঠাট্টা ইয়ার্কি করে, কিন্তু এ একেবারে জীবন-মরণের ব্যাপার।

জোজো ভাবল, এরা হয়তো তাকেও মেরে ফেলবে। কাকাবাবু যদ্দিন ডিমেলোকে ছেড়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করতে না পারেন … এরা তিনদিন সময় দিয়েছে। তা হলে আর তিনদিন অন্তত জোজোর আয়ু আছে। তিনদিন মানে বাহাত্তর ঘণ্টা, এর মধ্যে জোজো একটুও ঘুমোবে না। তার আয়ুর একটা মিনিটও সে নষ্ট করতে চায় না।

লোকগুলো নিজেদের মধ্যে যে-ভাষায় কথা বলছে, তা কিছুই বুঝতে পারছে

জোজো। কতক্ষণ ধরে বোটটা চলছে, তাও সে আন্দাজ করতে পারছে না। এইরকম সময়ে এক-একটা মুহূর্তকেও খুব লম্বা মনে হয়।

সে মনে মনে এক, দুই গুনতে লাগল। গুনতে গুনতে এক হাজার হয়ে গেল। তার মানে মোলো মিনিট, চল্লিশ সেকেন্ড। এখনও বোট চলছে। সে আবার গুনতে শুরু করল এক থেকে। এইভাবে সময় কাটবে। আর ওরা তাকে কতটা দূরে নিয়ে যাবে, তাও আন্দাজ করা যাবে।

তার বুকের ওপর পা রেখেছে, ক্রমশই তা বিষম ভারী লাগছে। এরা যদি তিনদিন বাদে খুন করেই ফেলতে চায়, তা হলে কীভাবে মারবে? গুলি করে, না গলা টিপে? গুলিই ভাল, তাতে বেশি ব্যথা লাগবে না, তারপরই সে মনে মনে আর্তনাদ করে উঠল, না, না, না, আমি মরতে চাই না। কিছুতেই মরব না। আমাকে পালাতে হবে। সন্তু আর কাকাবাবু নিশ্চয়ই আমাকে বাঁচিয়ে দেবেন।

সে আবার এক, দুই গুনতে শুরু করল। প্রায় আড়াই হাজার গোনার পর বোটটা থেমে গেল। জোজো ভাবল, এবার তাদের নামতে হবে।

কিন্তু নামার কোনও লক্ষণ দেখা গেল না। লোকগুলো উত্তেজিতভাবে কী যেন বলাবলি করছে।

বোটটা থেমে থাকলে তো সময়ের দূরত্ব বোঝা যাবে না। আর গুনে লাভ নেই।

খানিক বাদে বোটটা আবার চলতে শুরু করল। বোধহয় ওরা দিক ভুল করেছিল।

আরও প্রায় আধঘণ্টা বাদে বোটটা থামল আবার। এবার ওদের একজন। জোজোর জামার কলার ধরে দাড় করিয়ে দিয়েই মাথার ওপর দিয়ে একটা প্লাস্টিকের থলে গলিয়ে দিল।

জোজো কিছুই দেখতে পাবে না।

বোট থেকে যেখানে নামতে হল, সেখানে হাঁটুজল। জোজোর জুতো আর প্যান্ট ভিজে গেল খানিকটা।

খানিকটা জল ভেঙে পাড়ে উঠে আবার হাঁটতে হল কয়েক মিনিট। জোজো অন্ধের মতন হাঁটছে, একজন তার কাধ ধরে আছে।

এক জায়গায় তার মাথা ঠুকে গেল। সেটা কোনও গাছের সঙ্গে না কীসের সঙ্গে, তা বোঝা গেল না।

তারপর এক জায়গায় থেমে জোজোর মাথা থেকে প্ল্যাস্টিকের ব্যাগটা তুলে নেওয়া হল।

আগের দিন দেখা সেই লম্বা লোকটিই সম্ভবত এদের মধ্যে মোটামুটি ইংরিজি জানে।

সে জোজোকে বলল, ওরে ছেলে, তুমি এই ঘরে থাকবে, তোমার হাত ও মুখ বাঁধা থাকবে। খাওয়ার সময় খুলে দেওয়া হবে। এ বাড়ির বাইরে দুটো ডোবারম্যান কুকুর ছাড়া থাকে। পালাবার চেষ্টা করলে টুকরো টুকরো হয়ে যাবে।

সবাই বেরিয়ে গিয়ে দরজাটা বন্ধ করে দিল বাইরে থেকে।

প্রথমেই একটা ব্যাপারে জোজো নিশ্চিন্ত হল। এরা খাবার খেতে দেবে। সে খিদে সহ্য করতে পারে না। খুব ভাল করে ব্রেকফাস্ট খেয়ে বেরুনো হয়েছিল, এখনও অবশ্য তার খিদে পায়নি।

ঘরটাও খারাপ নয়।

সাধারণত অন্ধকার কুঠুরিতে বন্দিদের আটকে রাখা হয়। এ ঘরে বেশ আলোহাওয়া আছে। পুরনো আমলের বাড়ি, ওপরের দিকে রয়েছে স্কাইলাইট। একটা

জানলা খোলা। সেটা দিয়ে দেখা যাচ্ছে বড় বড় গাছ। নারকোল গাছই বেশি।

জোজো একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবল, এই ঘরেই তাকে থাকতে হবে কিছুদিন। সন্তুও আসতে চেয়েছিল, ইস, কেন যে ওরা সন্তুকে আসতে দিল না। দুজনে থাকলে বেশ সময় কেটে যেত।

ঘরের মধ্যে একটা খাট আছে, আলমারি আছে। কিন্তু চেয়ার-টেবিল নেই। জোজো খোলা জানলাটার কাছে দাঁড়িয়ে রইল। আরও দুটো জানলা আছে। বন্ধ। বাইরে কুকুরের গম্ভীর ডাক শোনা গেল একবার, কিন্তু কুকুরটাকে দেখা গেল না।

গাছগুলোর তলায় অনেক শুকনো পাতা খসে পড়ে আছে, অনেকদিন পরিষ্কার করা হয়নি। তাই দেখে জোজোর মনে হল, ওটা বাগান, না জঙ্গল? যদি বাগান। হয়, তা হলে কেউ ব্যবহার করে না।

এবার সে ঘরটার চারদিকে চোখ বুলিয়ে দেখল, ওপরের দিকে কোণে কোণে ঝুল জমে আছে। বিছানায় যে চাদরটা পাতা, তার ওপরেও ধুলো। এ ঘরটাতেও কেউ অনেকদিন থাকেনি।

তা হলে কি এটা একটা খালি বাড়ি?

অন্য দুটো জানলার ছিটকিনি এত টাইট হয়ে আছে যে, জোজো অনেক চেষ্টা করেও খুলতে পারল না। তার হাত বাঁধা, বেশি জোর দিতেও পারছে না। সরু লোহার চেন দিয়ে হাত বেঁধেছে, কুকুরের গলার চেনের মতন।

দাঁত দিয়ে সেই বাঁধন খোলার চেষ্টা করেও বুঝল, লাভ নেই। একটা ছোট্ট তালা লাগানো আছে।

কখন খেতে দেবে? বাইরের দিকে রোদের রং দেখলে মনে হয়, একটা-দেড়টা বাজে। এতক্ষণে তাদের রাবার দ্বীপে পৌঁছে যাওয়ার কথা ছিল। লছমন রাও আর তারিক আলি মিলে অনেক কিছু রান্না করত।

কাঠের আলমারিটায় তালা নেই, একটু টানাটানি করতেই সেটা খুলে গেল। ভেতরে প্রায় কিছুই নেই। তলার দুটো তাকে কয়েকটা কম্বল আর বালিশ, ওপরে দিকে কয়েকটা গেলাস আর প্লাস্টিকের থালা আর খালি সোডার বোতল।

একটাও বই নেই? কাউকে আটকে রাখতে অন্তত কয়েকখানা বই পড়তে দেওয়া উচিত। জোজো শুনেছে, জেলের কয়েদিদেরও পড়ার জন্য বই দেওয়া হয়। কেউ কেউ তো জেলে থাকতে থাকতেই পরীক্ষায় পাশ করে।

একটা গাড়ির আওয়াজ পেতেই জোজো ছুটে গেল জানলার কাছে।

জঙ্গলের ভেতর দিয়ে একটা নীল রঙের মারুতি ভ্যান এই দিকেই আসছে। এ বাড়ির কাছাকাছি এসে থামল।

সে গাড়ি থেকে প্রথমে নামলেন একজন বৃদ্ধ লোক, তারপর যোলো-সতেরো বছর বয়েসি একটি মেয়ে। বৃদ্ধটি সুটপরা, চোখে কালো চশমা। আর মেয়েটির মাথায় কোঁকড়া কোঁকড়া চুল, পরে আছে শালোয়ার-কামিজ।

ওদের দুজনকে দেখলে গুন্ডা-ডাকাতদের দলের লোক বলে মনেই হয় না। জোজো জানলার গ্রিলে মুখটা চেপে ধরল। তার তো শব্দ করার উপায় নেই, জানলার বাইরে হাত বার করতেও পারবে না।

যদি ওরা তাকে দেখতে পায়।

মেয়েটি এদিকে তাকাল না, বৃদ্ধটির সঙ্গে কথা বলতে বলতে এগিয়ে গেল।

হাত বাঁধার চেয়েও মুখ বাঁধার জন্য জোজোর কষ্ট হচ্ছে বেশি। কতক্ষণ সে একটাও কথা বলতে পারেনি। কথা বলার সঙ্গী না পেলেও সে গুন গুন করে গান গাইতে তো পারত।

সারাটা দুপুর কেটে গেল, তবু খাবার এল না। এখন জোজোর পেটের মধ্যে যেন আগুন জ্বলছে। এ কী, লম্বা লোকটা যে বলে গেল, খাবার সময় হাত আর মুখ খুলে দেবে? ভুলে গেল নাকি!

খাটটা ছাড়া আর বসার কোনও জায়গা নেই। এক সময় জোজো বসল, খিদেতে অবসন্ন হয়ে তার শুয়ে পড়তে ইচ্ছে হল।

জোজো এক মিনিটও ঘুমোবে না ভেবেছিল, এরই মধ্যে ঘুম এসে গেল তার।

কুকুরের ডাকে তার ঘুম ভাঙল। ধড়মড় করে উঠে বসে জানলা দিয়ে দেখল, বাইরে অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছে। সন্ধে হয়ে এল, অর্থাৎ সারাদিন সে খায়নি। খিদেটা বেড়ে গেল আরও।

কুকুরের ডাকটা কাছে এগিয়ে আসছে। এবার কেউ চাবি দিয়ে দরজা খুলল।

লোকটিকে চিনতে পারল জোজো। এ সেই ভিকো। লম্বা লোকটির সঙ্গে ছিল। তবে এ লোকটি কোনও কথা বলে না।

ভিকোর হাতে কোনও অস্ত্র নেই। একটা বড় বাটি আর জলের বোতল। কুকুরটাকে বসিয়ে রাখল ঠিক দরজার পাশে।

জোজো এমনিতেই কুকুরকে ভয় পায়। এই কুকুরটার হিংস্র মুখ দেখেই ভয়ে তার বুক ঢিপ ঢিপ করতে লাগল। কুকুরটা গ-র-র-গ-র-র শব্দ করল দুবার।

ভিকো ঘরের মধ্যে বাটি আর জলের বোতল মেঝেতে নামিয়ে রেখে

জোজোর একটা হাত আর মুখের বাঁধন খুলে দিল।

মুখটা খোলার সঙ্গে সঙ্গে জোজো বলল, উঃ বাঁচলুম। থ্যাঙ্ক ইউ, থ্যাঙ্ক ইউ!

ভাই, তোমরা তো এ ঘরের দরজাই বন্ধ করে রাখছ, তা হলে শুধু শুধু হাত আর মুখ বাঁধার দরকার কী?

ভিকো তার কথা বুঝল কি না কে জানে, একটুক্ষণ জোজোর দিকে তাকিয়ে থেকে আঙুল দিয়ে বাটিটা দেখাল।

তার মানে, জোজোকে ওর সামনেই এখুনি খেয়ে নিতে হবে। তারপর সে বাটিটা নিয়ে যাবে। আবার হাত, মুখ বাঁধবে বোধহয়।

জোজো বলল, বাথরুম! একবার বাথরুম যাব। লোকটি সে কথাও গ্রাহ্য না করে আবার আঙুল দেখাল বাটিটার দিকে।

জোজো বলল, হাত না ধুয়ে খাব কী করে? তা ছাড়া খুব হিসি পেয়েছে!

এবারও ভিকো তার কথায় পাত্তা দিল না দেখে জোজো পেট ধরে উঃ উঃ শব্দ করল। হাত দিয়ে বাইরেটা দেখাল।

এবার ভিকো বুঝল। জোজোর এক হাতে তখনও চেন বাঁধা, সেটা ধরে টেনে জোজোকে ঘরের বাইরে নিয়ে এল। কুকুরটার পাশ দিয়েই বেরোতে হল জোজোকে, সেটা গর গ-র-র গ-র-র করে উঠল আবার। ভয়ে চোখ বুজে ফেলল জোজো।

পালাবার চেষ্টা করার কোনও প্রশ্নই ওঠে না। কুকুরটা এক মিনিটের মধ্যে তাকে কামড়ে দিয়ে শেষ করে দিতে পারে। আর ভিকোর যা চেহারা সে তুলে আছাড় দিতে পারে জোজোকে।

বাইরে একটা লম্বা বারান্দা। পাশে একটা উঠোন, সেখানে অনেকগুলো টবে আগে ফুলগাছ ছিল, এখন সব কটা গাছ মরে গেছে।

বারান্দার মাঝখান দিয়ে একটা সিঁড়ি উঠে গেছে দোতলায়, সেখানে একটা আলো জ্বলছে।

বারান্দায় শেষ প্রান্তে বাথরুম। তার মধ্যে জোজোকে ঢুকিয়ে দিয়ে ভিকো দাঁড়িয়ে রইল বাইরে।

বাথরুমটা বেশি বড় নয়, একটা মাত্র জানলা। এ জানলায় গ্রিল নেই, বহু পুরনো আমলের মোটা মোটা গরাদ। জোজো হাত দিয়ে দেখল, কোনও সাধারণ মানুষ সে গরাদ ভাঙতে পারবে না। এখান থেকেও পালাবার সাধ্য তার নেই।

একটু দেরি হতেই দরজায় ধাক্কা দিতে লাগল ভিকো।

বেরিয়ে আসার পর ঘরের দিকে যেতেই পায়ের শব্দ শোনা গেল সিঁড়িতে। সেই বৃদ্ধ আর কিশোরী মেয়েটি নেমে আসছে। ওরা এ বাড়িতেই থাকে নাকি?

এবার মেয়েটির সঙ্গে চোখাচোখি হল জোজোর। মেয়েটির চোখে যেন অবাক অবাক ভাব। বৃদ্ধটিও থমকে দাঁড়িয়ে জোজোকে দেখতে লাগলেন।

ওরা কি জানে না যে জোজোর মতন একজনকে বন্দি করে রাখা হয়েছে এ বাড়িতে? গুন্ডাদের সঙ্গে এদের কী সম্পর্ক?

জোজো হঠাৎ চেঁচিয়ে নিজের নামটা জানাতে গেল। কিন্তু মাই নেম ইজ বলার পরেই সে কাঁধের ওপর একটা বিরাট রদ্দা খেয়ে চুপ করে গেল। দুপা গিয়ে আবার সে চিৎকার করল, আই অ্যাম আ প্রি- আবার রদ্দা।

এবারের রদ্দায় চোখে সর্ষে ফুল দেখে জোজো মাথা ঘুরে পড়েই যাচ্ছিল, ভিকো তাকে টানতে টানতে নিয়ে এল ঘরের মধ্যে। ভেজিয়ে দিল দরজাটা।

এরপর সে জোজোকে জোর করে বসিয়ে দিল বাটিটার সামনে।

অর্থাৎ এখন খেতেই হবে।

বাটিটা অ্যালুমিনিয়াম ফয়েল দিয়ে মোড়া। সেটা খুলতে দেখা গেল, তার মধ্যে রয়েছে ছখানা হাতে গড়া রুটি আর খানিকটা উঁড়সের ঘাট আর কয়েকখানা আলু ভাজার মতন কিছু। সেগুলো মোটাসোটা, আসলে আলু নয়, কাচকলা ভাজা।

ব্যস, এই খাবার? এরা এত কৃপণ কেন? গুন্ডামি-ডাকাতি করে তো অনেক টাকা রোজগার করে, বন্দিদের একটু ভাল খেতে দিতে পারে না?

সে ভিকোর দিকে একবার তাকাল। একে কিছু বলে লাভ নেই। কোনও উত্তর দেবে না। সত্যিই বোবা কি না কে জানে!

কাকাবাবু অনেকবার বলেছেন, হাতের সামনে খাবার পেলে অবহেলা করবে

। যা খাবারই হোক পেট ভরে খেয়ে নিতে হয়। কেন না, পরে আবার কিছু খাওয়া যাবে কি না কে জানে!

সাড়ে চারখানা রুটির বেশি খেতে পারল না জোজো। উঁড়সের তরকারির স্বাদটা টকটক, খেতে মন্দ নয়, কিন্তু কঁচকলা ভাজা মোটেই মুখে রুচল না জোজোর।

বোতলের একটু জল খরচ করে সে হাত ধুয়ে নিল। ভিকো আবার তার মুখ ও হাত বেঁধে দিল আগের মতন। কুকুরটা সব দেখছে।

আবার দরজা বন্ধ হওয়ার পর জোজো দৌড়ে গিয়ে দরজায় কান পেতে শোনার চেষ্টা করল, কেউ কিছু বলছে কি না।

সেই বৃদ্ধ আর কিশোরী মেয়েটি তাকে দেখেও কোনও সাড়াশব্দ করল না। তার হাত চেন দিয়ে বাঁধা, দৈত্যের মতন চেহারা ভিকোর, তার কাধে অত জোরে ঘুসি মারল, তবু বাধা দিল না একটুও। তার মানে, ওরাও এই দলেরই।

বৃদ্ধটির বেশ ব্যক্তিত্ব আছে, মনে হয় সমাজের উঁচু মহলের মানুষ। আর মেয়েটি কী সুন্দর, ফরসা মুখোনিতে সারল্য মাখা, এরাও গুন্ডা-বদমাশদের সঙ্গে যুক্ত থাকে? ছিঃ!

এরকম সন্ধেবেলা খাবার আনার মানেটাও জোজোর কাছে স্পষ্ট হয়ে গেল। রাত্তিরে আর কিছু দেবে না। সারাদিনে একবেলা খাবার। সত্যি, এরা এত কৃপণ! নিজেরা নিশ্চয়ই দুবেলাই খায়।

আচ্ছা, এখানে তার বদলে যদি সন্তু থাকত, তা হলে সে কী করত?

সন্তু আগেও কয়েকবার বন্দি হয়েছে, নিজে নিজেই ঠিক বেরিয়ে এসেছে। কাকাবাবু বলেন, সন্তুকে ধরে রাখার সাধ্য কারুর নেই।

এখান থেকে কী ভাবে বেরোত সন্তু?

সন্তু অবশ্য কুকুর দেখলে ভয় পায় না। তা হলেও, এরা কুকুরদের ট্রেনিং দিয়ে রাখে, কারুর দিকে লেলিয়ে দিলে কুকুর তো তাকে কামড়াবেই।

খাওয়ার সময়ই একমাত্র দরজা খোলে। এই দরজা কিংবা জানলা ভাঙার ক্ষমতা সন্তুরও হত না। তা হলে?

সন্তু কিছু-না-কিছু চেষ্টা করতই।

সন্তু ক্যারাটে জানে। ভিকো নামের লোকটার গায়ে যতই জোর থাক, আচমকা ক্যারাটের প্যাঁচ মারলে ভিকোও ঘায়েল হয়ে যাবে। আর কুকুরটার দিকে যদি খাবারের বাটিটা এগিয়ে দেওয়া হয়? কুকুরটা তখন খাবার খেতেই ব্যস্ত থাকবে। ডোবারম্যান কুকুর কি নিরামিষ খায়? সেই না কথায় আছে, খিদে পেলে বাঘেও ঘাস খায়। সুতরাং কুকুরটার কতটা খিদে পেটে থাকে, তার ওপর অনেক কিছু নির্ভর করছে।

জোজো সন্তুর মতন ক্যারাটে জানে না বটে, কিন্তু জোজোর জলের বোতলটা দিয়ে ভিকোর মাথায় মারলে নিশ্চয়ই সে অজ্ঞান হয়ে যাবে।

তারপরেই তার খেয়াল হল, জলের বোতলটা কাচের নয়, প্লাস্টিকের। এটা দিয়ে মারলে এমন কিছু লাগবে না।

নাঃ, অপেক্ষা করা ছাড়া জোজোর আর কিছুই করার নেই।

চুপ করে বসে বসে আর কতক্ষণ অপেক্ষা করা যায়? জোজো কখন ঘুমিয়ে পড়ল তার খেয়াল নেই।

তার ঘুম ভাঙল মেঘের ডাক শুনে।

রাত্রে নিশ্চয়ই বৃষ্টি হয়েছে, জানলা দিয়ে জলের ছাট এসে পড়েছে মেঝেতে। তাতেও জোজোর ঘুম ভাঙেনি। এখন আবার বৃষ্টি নামবে মনে হয়।

খাট থেকে নেমে জোজো জানলার কাছে গিয়ে একবার দেখল। বাইরে গাড়িটা এখনও দাঁড়িয়ে আছে।

জোজোর মনে পড়ল, একটা দিন খরচ হয়ে গেল। আর মাত্র দুদিন। তারপর কী হবে?

এরা সকালে কিছু খেতে দেবে না? জলও তো লাগবে, এক বোতল মাত্র জল, কাল রাত্রেই ফুরিয়ে গেছে। তা ছাড়া হিসিটিসি কোথায় করবে? এ কী অন্যায় কথা। কাউকে বন্দি করে রাখবে বলে কি সাধারণ সুযোগ-সুবিধেগুলোও দেবে না।

জোজো গিয়ে দরজার গায়ে জোরে জোরে ধাক্কা মারতে লাগল। প্রথমে কোনও সাড়াশব্দই পাওয়া গেল না। যেন কাছাকাছি আর কেউ নেই। কিন্তু ডাকতে তো হবেই। ধাক্কা দিতে দিতে জোজোর কাধ ব্যথা হয়ে গেল।

মিনিটদশেক বাদে খুলে গেল দরজাটা। সেখানে দাঁড়িয়ে আছে সেই সুন্দরী কিশোরীটি। কোঁকড়া কোঁকড়া চুল ঘেরা তার ফরসা মুখোনিতে তখনও যেন ঘুম মাখা।

সে জোজোর দিকে তাকিয়ে তেলুগু ভাষায় কী যেন বলে গেল, জোজো তার এক বর্ণ বুঝল না।

বুঝলেও তো সে উত্তর দিতে পারত না।

মেয়েটি এবার ইংরেজিতে জিজ্ঞেস করল, হু আর ইউ!

রাগে জোজোর গা জ্বলে গেল। তার যে মুখ বাঁধা, তা দেখতে পাচ্ছে না মেয়েটা? ন্যাকা না হাবাগোবা? মনে মনে সে বলল, আমি যে জন্তু নয়, একজন মানুষ, তাও বুঝতে পারছ না?

এরপর মেয়েটি পরিষ্কার বাংলায় বলল, তোমাকে দেখে বাঙালি মনে হচ্ছে!

মেয়েটির মুখে বাংলা কথা শুনে দারুণ চমকে উঠল জোজো। এই শত্ৰুপুরীতে বাংলা বলা?

তারপরই জোজোর বুকের মধ্যে যেন লাফিয়ে উঠল হৃৎপিণ্ডটা। আরে, এ তো রাধা! আগেরবার দেখা হয়েছিল। ও বাঙালি নয়, কিন্তু বাংলা জানে। এই দু তিন বছরের মধ্যে ও অনেকটা বড় হয়ে গেছে, তাই ঠিক চিনতে পারেনি।

রাধাও তাকে চিনতে পারছে না কেন? একদিন অনেকক্ষণ কথা হয়েছিল। অবশ্য রাত্তিরবেলা। এর মধ্যে জোজোর চেহারার কি কিছু পরিবর্তন হয়েছে? শুধু নাকের নীচে গোঁফের আভাস দেখা দিয়েছে, সেও কাকাবাবুর মতন গোঁফ রাখবে ঠিক করেছে।

মেয়েটির সঙ্গে কথা বলার উপায় নেই। সে মনে মনে চিৎকার করে বলতে লাগল, রাধা, রাধা, তুমি আমায় চিনতে পারছ না? আমি জোজো, সেই যে কাকাবাবুর সঙ্গে, সমুদ্রের ধারে—

বড় হয়ে এ মেয়েটি ডাকাতদের দলে যোগ দিয়েছে? নইলে ও জোজোর মুখের বাঁধন খুলে দিচ্ছে না কেন?

রাধাও শেষ পর্যন্ত ডাকাত? ছি ছি ছি ছি।

এই সময় আবার কুকুরের ডাক শোনা গেল। কুকুরের চেন ধরে নিয়ে আসছে। ভিকো। তার আগেই আর একজন মহিলা চলে এলেন। এর বয়েস অনেক বেশি, অন্তত পঞ্চাশ তো হবেই, সকালবেলাতেই খুব সাজগোজ করা, ঠোঁটে লিপস্টিক।

সেই মহিলা এসে নিজেদের ভাষায় কী যেন বকুনি দিল রাধাকে। রাধাও উত্তর দিল তেড়েফুঁড়ে। শুরু হয়ে গেল দুজনের ঝগড়া।

কুকুরটা স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে আছে জোজোর দিকে। জোজো এক পাও এগোতে সাহস করল না।

হঠাৎ ঝগড়া থামিয়ে মহিলাটি ভিকোকে কী যেন আদেশ করলেন।

ভিকো অমনি জোজোর কাধ ধরে টানতে টানতে নিয়ে চলল। এক জায়গায় নামতে হল সিঁড়ি দিয়ে। মাটির তলাতেও ঘর আছে মনে হয়। একটা সুড়ঙ্গের মধ্য দিয়ে অনেকখানি টেনে নিয়ে গিয়ে ভিকো ওকে ঠেলে দিল একটা ছোট্ট ঘরের মধ্যে।

এ জায়গাটা একেবারে ঘুটঘুটে অন্ধকার। ঠিক আসল বন্দিশালার মতন।
এরকম আগে কখনও হয়নি যে, কাকাবাবুর সামনেই কেউ গুলি চালাল, অথচ কোনও বাধা দিতে পারলেন না। জোজোকে ধরে নিয়ে গেল, অথচ সন্তু আটকাবার কোনও চেষ্টাই করতে পারল না, এরকমও আগে হয়নি।

নরেন্দ্র ভার্মার গায়ে গুলি লাগার পর তিনি মারা গেছেন কি না, এই চিন্তাই তখন কাকাবাবুর কাছে প্রধান। তিনি দেখলেন, নরেন্দ্র ভার্মা কাত হয়ে পড়ে আছেন, তাঁর সারা বুক রক্তে ভেসে যাচ্ছে। সন্তুও অজ্ঞান।

অন্য বোটটা জোজোকে নিয়ে চলে যাচ্ছে, কাকাবাবু সেদিকে দেখলেনই না। তিনি সঙ্গে সঙ্গে গিয়ে নরেন্দ্র ভার্মার পাশে বসে পড়ে সিরাজুদ্দিনকে বললেন, শিগগির চলুন। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব, হাসপাতালে, কোনও ডাক্তারের কাছে…

বিশাখাপত্তনমে একটা নার্সিং হোম একেবারে শ্রীরামকৃষ্ণ বিচের ওপরেই। সেখানে পৌঁছতে পঞ্চাশ মিনিট লেগে গেল। এর মধ্যে সন্তুর জ্ঞান ফিরে এসেছে, কিন্তু নরেন্দ্র ভার্মার শরীরে কোনও সাড় নেই, বেঁচে আছেন কি না বোঝা যাচ্ছে না।

কাকাবাবু বারবার ডাকছেন, নরেন্দ্র, নরেন্দ্র! আর হাউ হাউ করে কাঁদছেন ছেলেমানুষের মতন।

নার্সিংহোমের ডাক্তার বললেন, অনেক রক্ত বেরিয়ে গেছে, আর বেশি দেরি হলে বাঁচানো যেত না। দু বোতল রক্ত দিতে হবে।

কাকাবাবু ডাক্তারের হাত জড়িয়ে ধরে বললেন, আমি রক্ত দেব। সন্তু রক্ত দেবে, যে-কোনও উপায়ে হোক, আমার বন্ধুকে বাঁচান।

ডাক্তার কাকাবাবুকে বললেন, আপনি অত বিচলিত হবেন না। সবার রক্ত তো নেওয়া যায় না। ব্লাড গ্রুপ পরীক্ষা করে দেখছি। আপনি শান্ত হয়ে বসুন। আমরা ওঁকে অপারেশন টেবিলে নিয়ে যাচ্ছি।

এর মধ্যে খবর পেয়ে চলে এলেন পুলিশ কমিশনার ও আরও অনেকে।

নরেন্দ্র ভার্মার ভাগ্যটা ভাল বলতে হবে। দুটো গুলিই লেগেছে তার বাঁ কাঁধের ঠিক নীচে। আরও একটু নীচে লাগলে আর চিকিৎসার কোনও সুযোগই পাওয়া

যেত না।

অপারেশন করে গুলি দুটো বার করা গেল, কিন্তু জ্ঞান ফিরে না-আসা পর্যন্ত বিপদ কাটে না। কাকাবাবু সর্বক্ষণ বসে রইলেন সে নার্সিং হোমে, তিনি কিছু খেলেন না, কিছুতেই তাঁকে বিশ্রাম নিতে পাঠানো গেল না।

সন্তুর মাথাতেও অনেকখানি গর্ত হয়ে গেছে, সেলাই করতে হল চারটে, তাকে একটা বেডে শুইয়ে রাখা হল প্রায় জোর করে।

রাত দেড়টায় নরেন্দ্র ভার্মার জ্ঞান ফিরল, তিনি জল খেতে চাইলেন। এখনও তাঁর সঙ্গে অন্য কারও কথা বলা নিষেধ, কাকাবাবু শুধু ক্যাবিনের দরজার কাছে দাঁড়িয়ে দেখলেন বন্ধুকে। দুজনের চোখাচোখি হল।

অত রাতে কাকাবাবু পুলিশ কমিশনার পদ্মনাভনকে ফোন করে জিজ্ঞেস করলেন, আমি কি এখন আপনার বাড়িতে গিয়ে এক কাপ কফি খেতে পারি?

পদ্মনাভন বললেন, হ্যাঁ, অবশ্যই আসতে পারেন। আমার বাড়িতে সারা রাতই কফির ব্যবস্থা থাকে। তবে, ট্যাক্সি করে আসবেন না। নার্সিংহোমের বাইরে

একটা পুলিশের গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে, সেই গাড়ি আপনাকে পৌঁছে দেবে।

সন্তু এর মধ্যে ঘুমিয়ে পড়েছে, তাকে আর ডাকলেন না কাকাবাবু।

পদ্মনাভনের বাড়ির সামনে ও ভেতরে জ্বলছে অনেক আলো, ঘোরাফেরা করছে কিছু লোক, এত রাত বলে মনেই হয় না।

কাকাবাবুকে দোতলায় নিয়ে বসিয়ে পদ্মনাভন বললেন, আমি জানি, সারাদিন আপনার পেটে একটা দানাও পড়েনি। কফির সঙ্গে গরম গরম দুটো চিংড়ির কাটলেট খান।

কাকাবাবু বললেন, এত রাতে গরম গরম চিংড়ির কাটলেট? আপনার ঘুম নষ্ট করার জন্য আমার আসতে লজ্জা করছিল। কিন্তু আমার হাতে বেশি সময়

নেই—

পদ্মনাভন বললেন, আপনার লজ্জা পাবার কোনও কারণ নেই। প্রায় প্রতি রাত্রে আমাদের বাড়িতে এই রকম চলে।

সে কী? আপনার স্ত্রী আপত্তি করেন না?

আমার স্ত্রী তো এখানে থাকেন না। তিনি হায়দরাবাদের একটা কলেজে পড়ান। তবে এখানে থাকলেও আপত্তি করতেন না। তিনি আমার স্বভাব জানেন। অফিসে তো সর্বক্ষণ বাইরের লোক আসে কিংবা মিনিস্টারদের ফোনের কথা শুনতে হয়। আমার অফিসারদের সঙ্গে সব জরুরি কাজের কথা হয় এই সময়ে।

আপনি ঘুমোন কখন?

পুলিশের লোকদের কম ঘুমোনো শিখতে হয়। আমি ঘুমোই ঠিক রাত সাড়ে তিনটে থেকে সকালে সাড়ে সাতটা। ওই সময়টাতে দেখবেন, পৃথিবীতে কেউ ডিস্টার্ব করে না।

মাত্র চার ঘণ্টা ঘুম? ব্যস?

নেপোলিয়নও শুনেছি চার ঘণ্টা ঘুমোতেন। তবে তিনি নাকি ঘোড়ার পিঠে যেতে যেতেও ঘুমিয়ে নিতেন। সেটা আমি পারি না।

আমি কেন এত রাতে এসেছি বুঝতে পারছেন? প্রত্যেকটি ঘণ্টা মূল্যবান। ওরা মাত্র তিন দিন সময় দিয়েছে। তার মধ্যে ডিমোলোকে মুক্তি না দিলে ওরা জোজোর মুণ্ডু কেটে আমার দোরগোড়ায় রেখে যাবে বলেছে।

পদ্মনাভন গম্ভীর হয়ে গিয়ে নিজের চিবুক চুলকোতে লাগলেন।

কাকাবাবু কফির কাপ হাতে নিয়ে ভুলে গেলেন চুমুক দিতে।

একটু পরে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে পদ্মনাভন বললেন, আমি সব শুনেছি। কিন্তু রায়চৌধুরী সাহেব, আমাদের হাত-পা যে বাঁধা। কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশ আছে, অপহরণকারীদের কোনও দাবিই মানা হবে না। না হলে দিন দিন ওদের দাবি বেড়েই চলবে। অপহরণও দিন দিন বেড়েই চলেছে। যেমন করে তোক, ওদের ঠান্ডা করতেই হবে!

কাকাবাবু বললেন, অপহরণ করে তো খুনও হচ্ছে। ওদের দাবি না মানলে ওরা জোজোকে খুন করে ফেলতে পারে।

পদ্মনাভন বললেন, তা অসম্ভব নয়। এরা অতি নৃশংস। ডিমেলোকে ধরার জন্য হইচই পড়ে গেছে। অনেকগুলো কেস আছে তার নামে। আমরা খবর নিয়েছি, যে-লম্বা লোকটির কথা আপনি বলেছেন, তার নাম রকেট। ওই নামেই সবাই তাকে জানে। এই রকেট হচ্ছে ডিমেলোর ডান হাত। ওদের দলে একজন মহিলাও আছে, তার আর রকেটের ক্ষমতা প্রায় সমান সমান। পুলিশ ওদের খুঁজে পাচ্ছে না কিছুতেই।

কাকাবাবু সামনের কাচের টেবিলে প্রচণ্ড জোরে একটা কিল মেরে চিৎকার করে বললেন, আপনি ভেবেছেন কী? আমরা এখানে বসে অকারণ কথা বলে যাব, আর ওরা জোজোকে খুন করে ফেলবে? কিছুতেই না, কিছুতেই না। একটা ব্যবস্থা করতেই হবে।

কাচের টেবিলটা ফেটে গেছে। কাকাবাবুর চিৎকার শুনে পাশের ঘর থেকে কয়েকজন ছুটে এল।

পদ্মনাভন বললেন, রায়চৌধুরী সাহেব, আপনি শান্ত হন। আমরা সবরকম চেষ্টা করবই।

অন্য একজনের দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন, বেংকট, তুমি তো কেসটা সব জানো। ডিমেলোকে ছেড়ে দেওয়ার কোনও উপায় আছে?

বেংকট বলল, একমাত্র মুখ্যমন্ত্রী ছাড়া আর কেউ সে অর্ডার দিতে পারেন।

কাকাবাবুর উত্তেজনা এখনও কমেনি। তিনি আবার চেঁচিয়ে বললেন, আমি মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে যাব। এক্ষুনি!

বেংকট বলল, স্যার, মুখ্যমন্ত্রী জাপান গেছেন। চারদিন পরে ফিরবেন। ওই ডিমেলোর দলবলের ডেরা খুঁজে বার করা ছাড়া উপায় নেই।

পদ্মনাভন বললেন, মুশকিল হচ্ছে, ওরা ঘন ঘন ডেরা বদলায়। আর এখানে সমুদ্রে অনেক ছোট ছোট দ্বীপ আছে, তার কোনও একটায় যদি লুকিয়ে থাকে… সবগুলো দ্বীপ খুঁজতে অনেক সময় লেগে যাবে—

বেংকট বলল, ওই ডিমেলোকে যদি আরও জেরা করা যায়, সে হয়তো জানবে।

কাকাবাবু উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, চলুন, আমি ডিমেলোকে নিজে জেরা করব। চলুন, চলুন।

পদ্মনাভন বললেন, এত রাতে কি জেলখানায় যাওয়া সম্ভব? আপনি একটু ঘুমিয়ে নিন। হয়তো ঘুম আসবে না, তবু শুয়ে থাকুন, তাতেও বিশ্রাম হবে। ঠিক সকাল নটায় আমি আপনাকে নিয়ে যাব।

জেলের মধ্যে গিয়ে কারও সঙ্গে দেখা করা সহজ নয়, অনেক নিয়মকানুন মানতে হয়। কারামন্ত্রী নিরঞ্জন ওসমানের সঙ্গে যোগাযোগ করে পদ্মনাভন সে ব্যবস্থা করে ফেললেন।

পদ্মনাভন ঠিকই বলেছিলেন, হোটেলের বিছানায় শুয়ে এক মিনিটও ঘুমোতে পারেননি কাকাবাবু। সন্তুকে ওরা ধরে নিয়ে গেলে তিনি এত চিন্তা করতেন না।

সকাল হতেই স্নানটান সেরে নিয়ে কাকাবাবু চলে এলেন নার্সিং হোমে। সন্তু দাঁড়িয়ে আছে বাইরে। তার মাথায় সেলাই হয়েছে বটে, কিন্তু তার জন্য সে শুয়ে থাকতে চায় না। এর মধ্যেই অস্থির হয়ে উঠেছে।

নরেন্দ্র ভার্মার কঁধ আর বুক জোড়া মস্ত বড় ব্যান্ডেজ। তাঁর বিপদ কেটে গেছে। বটে কিন্তু এখনও কথা বলা নিষেধ।

একজন নার্স তাকে চা খাইয়ে দিচ্ছে। কাকাবাবু তাঁর পাশে এসে বললেন, নরেন্দ্র, তোমাকে কথা বলতে হবে না। এখানকার পুলিশ আমাকে সবরকম সাহায্য করছে। একটু পরেই আমি ডিমেলোর সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছি জেলখানায়। আবার দুপুরে আসব তোমার কাছে।

ডাক্তারের নির্দেশ অগ্রাহ্য করে নরেন্দ্র ভার্মা বললেন, তা হলে এবারেও আমি বেঁচে গেলাম, কী বলো?

কাকাবাবু বললেন, হ্যাঁ, আর কোনও ভয় নেই। তবে, আমি প্রথমে খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।

নরেন্দ্র ভার্মা বললেন, রাজা, তুমি নাকি কাঁদছিলে? অ্যাঁ? বলো কী, তুমি কাদতে পারো? আমি তো আর পারি না।

নার্সটি বললেন, আপনি কথা বলবেন না প্লিজ!

নরেন্দ্র ভার্মা সে কথাও না শুনে সন্তুকে জিজ্ঞেস করলেন, জোজো কোথায়?

সন্তু আমতা আমতা করে বলল, আছে, জোজো ভাল আছে।

নরেন্দ্র ভার্মা বললেন, ওরা পুলিশ সেজে এসেছিল বলে আমরা প্রথমে কিছু সন্দেহ করিনি। কিন্তু উচিত ছিল, প্রথম থেকেই আমাদের সতর্ক থাকা উচিত ছিল।

কাকাবাবু বললেন, ঠিক আছে নরেন্দ্র। আমরা এখন আসছি।

নরেন্দ্র ভার্মা বললেন, আমাদের আর সেই দ্বীপে ভূত দেখতে যাওয়া হল না। তবে যাব, ঠিকই যাব, একটু সেরে উঠি।

কাকাবাবু ঝুঁকে নরেন্দ্র ভার্মার কপালে একটু হাত রেখে বললেন, নিশ্চয়ই যাব!

পদ্মনাভন গাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছেন, তার সঙ্গে দেখা হল জেলের গেটের কাছে। কারামন্ত্রী নিরঞ্জন ওসমান নিজেও সেখানে উপস্থিত হয়েছেন।

তিনি কাকাবাবুর হাতে হাত মিলিয়ে বললেন, আমি আপনার কথা জানি। সেই যে আগে একবার আরাকু ভ্যালিতে একটা সাংঘাতিক স্মাগলারদের গ্যাংকে ধরিয়ে দিয়েছিলেন।

কাকাবাবু বললেন, তাতে আমার বিশেষ কিছু কৃতিত্ব ছিল না। যা কিছু এই ছেলেটিই করেছে। হ্যান্ড গ্রেনেডগুলি সব ধ্বংস করে দিয়েছিল।

তিনি সন্তুর কাঁধে হাত দিলেন।

সন্তু লজ্জায় মুখ নিচু করে ফেলল।

ওসমান বললেন, আপনার ডিমেলোকে জেরা করে দেখুন, কিছু বার করতে পারেন কি না। এর মধ্যে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে আমার টেলিফোনে কথা হয়েছে। তিনি আপনাদের জানাতে বলেছেন যে ডিমেলোকে তো একেবারে মুক্তি দেওয়া যাবে না, তবে বাবা-মায়ের অসুখ বা মেয়ের বিয়ের নামে দু-এক দিনের জন্য ছেড়ে দেওয়া যেতে পারে। অবশ্য জামিন রাখতে হবে।

এই জেলটি অনেক পুরনো আমলের। আগাগোড়া পাথরের তৈরি। বাইরের থেকে দুর্গ বলে মনে হয়।

সুপারের ঘরটি সুন্দরভাবে সাজানো-গোছানো। একটা টেবিলকে ঘিরে অনেকগুলি চামড়ামোড়া চেয়ার। দেওয়ালে গাঁধীজি, নেতাজি, নেহরুজি, রাষ্ট্রপতি রাধাকৃষ্ণন এরকম অনেকের ছবি।

ডিমেলোকে আনা হল সেই ঘরে।

প্রায় ছফুট লম্বা, মাথার চুল খুব ছোট করে ছাটা। মুখোনা চৌকো ধরনের, চোখ দুটো ছোট ছোট। কয়েদির পোশাক নয়, সাধারণ প্যান্ট-শার্ট পরা।

ঘরে ঢুকেই সে বলল, আমি আপনাদের সঙ্গে কোনও কথাই বলব না। আমার একজন উকিল চাই।

জেল সুপার অরবিন্দন বললেন, উকিল পরে হবে। এখন আমরা যা বলতে চাই, শোনো।

কাকাবাবু অরবিন্দনকে বললেন, ওকে বসতে বলুন।

অরবিন্দন বললেন, কয়েদিদের বসবার নিয়ম নেই। দাঁড়িয়েই থাকুক।

কাকাবাবু বললেন, ইনি তো এখনও কয়েদি নন। বিচার হয়নি। আদালত থেকে ওঁকে জেল কাস্টোডিতে রাখতে বলা হয়েছে। বিচারের শাস্তি না হলে অপরাধী বলা যায় না।

ডিমেলো কাকাবাবুর দিকে মুখ ফিরিয়ে তাকাল। তারপর নিজেই বসে পড়ল একটা চেয়ার টেনে।

কাকাবাবু তাকে বললেন, মিস্টার ডিমেলো, পুলিশ আপনাকে সন্দেহের বশে গ্রেফতার করেছে। বিচারে যদি আপনাকে দোষী প্রমাণিত না করা যায়, তা হলেই আপনি মুক্তি পাবেন। তার আগেই আপনি ছাড়া পেতে চাইছেন, আপনি অনেকদিন এ লাইনে আছেন, তা যে সম্ভব নয়, তা কি আপনি জানেন না?

ডিমেলো বলল, কে বলল সম্ভব নয়? জামিনে ছেড়ে দেওয়া যায়। টাকা নকল করার কাজে আমি মোটেই যুক্ত নই, তা পুলিশ ভালভাবেই জানে। ওই স্কাউড্রেল ধুমলটা বদমাইশি করে আমাকে ধরিয়ে দিয়েছে।

পদ্মনাভন বললেন, তোমার নামে আরও তিনটে বড় বড় কেস আছে। তখন তোমাকে ধরা যায়নি।

ডিমেলো বলল, ওসব কথা বাদ দিন। টাকা জাল করার কেসে ধরেছেন, সে কাজ আমি করিনি, তা হলে কেন ধরে রাখবেন?

পদ্মনাভন বললেন, এ তো অদ্ভুত কথা। ছিচকে চুরির অভিযোগে একজনকে ধরা হল। তারপর ইনভেস্টিগেশানে দেখা গেল, ওই চুরিটা সে করেনি বটে, কিন্তু আগে দুটো খুন আর ডাকাতি করেছে। তবু তাকে ছেড়ে দেওয়া হবে?

ডিমেলো বলল, হ্যাঁ। এই কেসটা ফল্স, সে জন্য আমাকে ছেড়ে দিতে হবে। পুরনো কেসগুলোর জন্য যদি আপনাদের হিম্মত থাকে আমাকে আবার ধরার চেষ্টা করুন।

কাকাবাবু বললেন, এ যে দেখছি চোর-পুলিশ খেলা। এর মধ্যে আমাদের জড়াচ্ছেন কেন? একটা ছোট ছেলেকে ধরে রেখেছেন।

ডিমেলো বলল, হ্যাঁ, বদলা নেওয়ার ভয় তো দেখাতেই হবে। নইলে পুলিশ কি এমনি এমনি আমাকে ছাড়বে নাকি? তিন দিনের মধ্যে আমি মুক্তি না পেলে, শুধু ভয় দেখানো নয়, সত্যি ওই ছেলেটি খুন হয়ে যাবে। তারপর ধরা হবে আর একজনকে।

কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, খুন হয়ে যাবে?

ডিমেলো দুকাঁধ ঝাকিয়ে বলল, একেবারে হান্ড্রেড পার্সেন্ট সত্যি!

কাকাবাবু এতক্ষণ শান্তভাবে কথা বলছিলেন, এবার ঠান্ডা, কঠিন গলায় বললেন, শোনো ডিমেলো, ওই জোজো নামের ছেলেটির জীবনের দাম আমার চেয়েও বেশি। আমার অনেক বয়েস হয়ে গেছে, ওই জোজোর যদি কোনও ক্ষতি হয়, তা হলে আমি নিজে তোমাকে গুলি করে মারব। তারপর আমার ফঁসি হয় তো হবে!

ডিমেলো বলল, আমাকে ওসব ভয় দেখিয়ে কোনও লাভ নেই। আমাকে একবার জেল থেকে বেরুতেই হবে।

পদ্মনাভনের পকেটে সেল ফোন বেজে উঠল।

তিনি উঠে গিয়ে একটু দূরে দাঁড়িয়ে সেটাতে কথা বলতে বলতে কাকাবাবুকে হাতছানি দিয়ে কাছে ডাকলেন।

কাকাবাবু যেতেই তিনি বললেন, মিস্টার রায়চৌধুরী, আমার অফিস থেকে ফোন করছে। একজন মহিলা বার বার ফোনে আপনার ঠিকানা জানতে চাইছে। তিনি বললেন, তাঁর খুব জরুরি দরকার।

কাকাবাবু ভুরু কুঁচকে বললেন, একজন মহিলা? আমার তো এখানে সে রকম কেউ চেনা নেই।

পদ্মনাভন বললেন, তিনি তার নাম জানাতে চান না। তিনি আজই আপনার সঙ্গে কোনও কারণে দেখা করতে চান। আপনার হোটেলের নাম তো হুট করে সবাইকে এখন জানানো যায় না! কার কী মতলব থাকে কে জানে।

কাকাবাবু বললেন, শেষ পর্যন্ত কি একজন মহিলাকেও ভয় পেতে হবে নাকি?

পদ্মনাভন বললেন, আপনি জানেন না, আজকাল মেয়েরাও কত দুঃসাহসের কাজ করে। এই ডিমেলোর মতন লোকদের দলে সব সময় দুতিনজন নারীও থাকে।

কাকাবাবু বললেন, মহিলাটি যদি আবার ফোন করে, তাকে জানিয়ে দেওয়া হোক, আপনার অফিসে এসে দেখা করতে। সেখানে আমি থাকব।

পদ্মনাভন বললেন, সে কথা জানানো হয়েছিল। মহিলাটি থানায় আসতে রাজি নয়। সে একা একা আপনার সঙ্গে দেখা করে কিছু বলবে।

কাকাবাবু বললেন, আমার কৌতূহল হচ্ছে। তা হলে আমার হোটেলের নামই জানিয়ে দিন। দুপুরবেলা বারোটা থেকে একটা পর্যন্ত আমি সেখানে থাকব। কী আর হবে।

পদ্মনাভন বললেন, ডিমেলোর পেট থেকে কোনও কথা বার করা যাবে বলে মনে হয় না। মুশকিল হচ্ছে, অনেক চেষ্টা করেও ওর আস্তানাগুলো আমরা কিছুতেই খুঁজে বার করতে পারিনি।

কাকাবাবু বললেন, ওকে যদি আজই ছেড়ে দেওয়া হয়। ও কোথায় যাবে?

পদ্মনাভন বললেন, আমার ধারণা, ও সোজা কোনও হোটেলে গিয়ে উঠবে। সেখান থেকে আমাদের চোখে ধুলো দিয়ে পালাবে। জোজোকে যেখানে লুকিয়ে রেখেছে, সে জায়গাটা নিশ্চয়ই আমাদের দেখিয়ে দেবে না। এই কিডন্যাপিং-এর কেসগুলোয় পুলিশ প্রায় অসহায়।

চেয়ারে ফিরে এসে কাকাবাবু সোজা ডিমেলার চোখের দিকে তাকিয়ে রইলেন, ডিমেলোও চোখ সরিয়ে নিল না। খানিক বাদে কাকাবাবু বললেন, জোজোকে যদি ছেড়ে দাও, তা হলে আমরা ভাইজাগ ছেড়ে চলে যাব কলকাতায়। তোমাদের কোনও ব্যাপারে মাথা গলাব না। আর যদি জোজোকে না ছাড়তে চাও, তা হলে আমি তোমার নামে যত অভিযোগ আছে, তার সব প্রমাণ জোগাড় করে দেব। তোমাদের দলের সর্বনাশ করে দেব, কেউ বাইরে থাকবে না।

ডিমেলো বলল, ঠিক আছে, চ্যালেঞ্জ রইল। আমাকে বিনা শর্তে মুক্তি না দিলে ওই ছেলেটি বাঁচবে না, এই আমার শেষ কথা।

জেলখানা থেকে বেরিয়ে এসে পদ্মনাভন বললেন, দেখলেন তো, হার্ড নাট টু ক্র্যাক। ডিমেলোকে মারধর করলেও ওর পেট থেকে কোনও কথা বার করা। যাবে না।

কাকাবাবু বললেন, পেট থেকে না বেরুলেও মাথা থেকে বার করার উপায় আছে। আজকের দিনটা অন্যভাবে চেষ্টা করা যাক। যদি জোজোর খোঁজ না পাই, তা হলে কাল এসে আমি ডিমেলোকে আমার দায়িত্বে জেলের বাইরে নিয়ে যাব।

সন্তু বলল, কাকাবাবু, আমাদের বোট যিনি চালাচ্ছিলেন, তার নাম সিরাজুদ্দিন তারিক। তিনি হয়তো অন্য বোটটার চালককে চিনতে পারেন। যদি তাকে খুঁজে বার করা যায়।

পদ্মনাভন বললেন, তারিককে কালই জেরা করা হয়েছে। অন্য বোটের চালককে সে চেনে না। তবে আবার দেখলে চিনতে পারবে।

কাকাবাবু বললেন, এদিকে যতগুলি মোটর বোট আছে, তাদের মালিক আর চালকদের তালিকা করুন। বিকেলের মধ্যে তাদের সকলের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে। ফ্রেড নামে একজন চালকের সঙ্গে অবশ্যই কথা বলতে হবে। তার আগে এই মহিলাটি আমাকে কী জানাতে চায়, সেটা দেখা দরকার।
পদ্মনাভন ফিরে গেলেন তাঁর অফিসে। সন্তু আর কাকাবাবু হোটেলে এসে ঘরে

গিয়ে নীচের লবিতেই বসে রইলেন।

ঘড়িতে ঠিক বারোটা বাজে। অনেক লোক যাচ্ছে, আসছে। বারোটায় অনেকে হোটেল ছেড়ে চলে যায়। এই হোটেলের এক তলায় একটা রেস্তরাঁ আছে, অনেক বাইরের লোকও খেতে আসে সেখানে।

হঠাৎ সন্তু এক সময় বলে উঠল, রাধা!

কাকাবাবু বললেন, রাধা? কোন রাধা? কোথায়?

সন্তু বলল, বাঃ, তোমার মনে নেই, অন্ধ্রের মেয়ে, এক সময় কলকাতায় থাকত। বাংলা জানে, আগেরবার দেখা হয়েছিল।

কাকাবাবু বললেন, রাধা, মানে সেই রাধা, রাধা গোমেজ। পিটার গোমেজের মেয়ে? সে কোথায়?

সন্তু বলল, এইমাত্র এসে কাউন্টারে দাঁড়াল। দ্যাখো।

কাউন্টারে দাঁড়িয়ে আছে শাড়িপরা একটি ছিপছিপে চেহারার মেয়ে। মাথায় ফুল গোঁজা, চোখে কালো রোদচশমা।

কাকাবাবু ভুরু কুঁচকে বললেন, এই সেই রাধা? এত বড় হয়ে গেছে? দু-তিন বছর আগে যাকে দেখেছি। সে তো ছিল একটা বাচ্চা মেয়ে?

সন্তু বলল, যারা ছোট থাকে, তারা কি বড় হয় না, আমিও তো বড় হয়েছি। ও বোধহয় আমাদের দেখতে পায়নি।

উঠে গিয়ে কাউন্টারের কাছে গিয়ে ইংরিজিতে বলল, যদি ভুল হয়, মাপ করবেন, আপনি কি রাধা গোমেজ?

মেয়েটি সন্তুর দিকে মুখ না ফিরিয়ে কাঁপা গলায় বলল, সন্তুদাদা, আমি তোমাদের সঙ্গেই দেখা করতে এসেছি। কিন্তু এখানে কথা বলা যাবে না। তোমরা নিজেদের ঘরে চলে যাও, আমি একটু পরে যাচ্ছি।

সন্তু কাউন্টার থেকে চাবি চেয়ে নিয়ে ইঙ্গিত করল কাকাবাবুর দিকে। তারপর লিফটের কাছে গিয়ে দাঁড়াল।

রাধা এসে পৌঁছল ঠিক পাঁচ মিনিট পরে।

নিজেই ঘরের দরজা বন্ধ করে দিয়ে রাধা বলল, আমি ওদের চোখে ধুলো দিয়ে অনেক ঘোরাপথে এসেছি। তবু বলা যায় না। যদি টের পায় যে আমি তোমাদের কাছে এসেছি, তা হলে আমার মা আমাকে মেরে ফেলবে।

কাকাবাবু বললেন, আগে বোসো। জল খাও। সন্তু জল দে। কেন রাধা, তোমার মা তোমাকে মেরে ফেলবে কেন? মা কি কখনও মেয়েকে মেরে ফেলে?

রাধা বলল, কাকাবাবু, তোমার মনে নেই আমার মায়ের কথা? আমার নিজের মা নয়। নতুন মা, সবাই যাকে মঞ্চাম্মা বলে। তোমাকেও তো সে মেরে ফেলতে গিয়েছিল সেবার।

কাকাবাবু বললেন, হ্যাঁ, এবার মনে পড়েছে। খুব দুর্দান্ত মহিলা। পুলিশ অবশ্য ওর বিরুদ্ধে কিছু প্রমাণ করতে পারেনি। তোমার বাবা তো জেল খাটছে, নাকি জেল থেকে পালিয়েছে।

রাধা বলল, না, না, পালায়নি। দশ বছরের জেল। ভাল হয়েছে জেল খাটছে। আমার বাবা খুব খারাপ হয়ে গিয়েছিল। স্মাগলিং-এর দল তৈরি করেছিল, মানুষ মারত। আমি শুধু আপনাকে অনুরোধ করেছিলাম, যাতে ফাঁসি না হয়।

কাকাবাবু বললেন, পিটার গোমেজ মানুষটা একেবারে নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। তোমার মতন এমন একটা সুন্দর মেয়ের বাবা হয়ে…তোমার মা নিশ্চয়ই খুব ভাল ছিলেন।

রাধা বলল, আমার মা ছিলেন, আপনারা বাংলায় যেমন বলেন, লক্ষ্মী।

সন্তু বলল, তোমার বাবা জেলে, তুমি কোথায় থাকো?

রাধা বলল, আমার তো সতেরো বছর বয়েস, তাই আমি একলা থাকতে পারি। আমার এক মামা আমার গার্জেন, তাঁর কাছেই থাকি। আমার মামা খুব নামকরা লোক, এক সময় হাইকোর্টের জজ ছিলেন।

কাকাবাবু খানিকটা অস্থিরভাবে বললেন, রাধা, তোমার বাকি সব কথা পরে শুনব। এখন বলো তো, তুমি আমাদের কী খবর দিতে এসেছ?

রাধা বলল, জোজোদা কোথায়? সে কি এবারে আপনাদের সঙ্গে আসেনি?

সন্তু বলল, জোজোকে একদল গুন্ডা ধরে নিয়ে গেছে। আর দুদিনের মধ্যে তাকে খুঁজে বার করতেই হবে!

রাধা বলল, আমি তাকে দেখেছি। প্রথমে আমিও তাকে চিনতে পারিনি। বড় বড় চুল রেখেছে, অনেকটা লম্বা হয়ে গেছে। তারপর মুখটা দেখে মনে হল–

কাকাবাবু জিজ্ঞেস করল, তুমি জোজোকে কোথায় দেখলে?

রাধা বলল, আমাদের বাড়িতে।

কাকাবাবু আর সন্তু একসঙ্গে বলে উঠল, তোমাদের বাড়িতে?

রাধা বলল, হ্যাঁ। আমি তার সঙ্গে কথা বলার চেষ্টাও করেছি। পারিনি। আমার বাবা তো জেলে, আমার মা কিন্তু এখনও বদমাশ লোকদের সঙ্গে কাজকর্ম চালিয়ে যাচ্ছে। আমাদের বাড়িটাকে করে ফেলেছে ডাকাতদের আড্ডা। ওই বাড়িটাতে তো আমারও ভাগ আছে, আমার এই মা আমাকে বঞ্চিত করার চেষ্টা করেছিল। আমার মামা চেপে ধরেছেন। আমার মামাকে অনেকেই ভয় পায়। মামাই বলেছেন, মাঝে-মাঝে আমরা ওই বাড়ি দেখতে যাব। কয়েকখানা ঘরে তালা দিয়ে রাখব, টাকা-পয়সার হিসেব নেব। কালকে গিয়ে দেখি–

কাকাবাবু চেঁচিয়ে বলে উঠলেন, কী দেখলে? জোজোকে ওরা মেরেছে? রাধা বলল, তা বুঝতে পারিনি। তবে মুখ বাঁধা ছিল!

কাকাবাবু উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, চলো, এক্ষুনি সেখানে যেতে হবে। একদম সময় নষ্ট করা যাবে না।

তিনি সন্তুর দিকে তাকিয়ে বললেন, তোর মাথায় সেলাই করা হয়েছে। তোর যাওয়ার দরকার নেই। তোকে বিশ্রাম নিতে হবে।

সন্তু বলল, আমার একটুও ব্যথা নেই। আমি জোজোর কাছে যাব।

কাকাবাবু কোট পরে নিতে নিতে রাধাকে জিজ্ঞেস করলেন, জোজোকে পাহারা দিচ্ছে কজন? শুধু ওই মঞ্চাম্মা?

রাধা বলল, আমাদের কয়েকজন পুরনো কাজের লোক আছে। তারা মঞ্চাম্মার ভয়ে চুপ করে থাকে। মঞ্চাম্মার বন্ধু হয়েছে রকেট নামে একটা লোক, সে ডিমেলোর দলের একজন পাণ্ডা। ওরা প্রায়ই আসে। চার-পাঁচজন।

কাকাবাবু কোটের ভেতরের পকেটে রিভলভারটা একবার দেখে নিয়ে সন্তুকে বললেন, কী রে, ওরা যদি চার-পাঁচজন হয়, তা হলে তুই আর আমি সামলাতে পারব?

সন্তু রাধার দিকে ফিরে বলল, তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করব? তুমি নিজের থেকে আমাদের কাছে এসেছ, না কেউ তোমাকে পাঠিয়েছে?

রাধা খুব অবাক হয়ে বলল, আমাকে কে পাঠাবে? আমি যে তোমাদের কাছে এসেছি, তাই তো কেউ জানে না।

সন্তু বলল, বলা তো যায় না। কেউ হয়তো তোমার মামাকে আটকে রেখেছে। তারপর তোমাকে এখানে পাঠিয়েছে, আমাদের ডেকে নিয়ে গিয়ে ফাঁদে ফেলতে চায়।

রাধা হঠাৎ দুহাতে মুখ চাপা দিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল।

কাকাবাবু বললেন, যাঃ, তুই কী বলছিস সন্তু! রাধা খুব সরল আর ভাল মেয়ে। ও কখনও এমন কাজ করতে পারে?

তিনি উঠে এসে রাধার পিঠে হাত দিয়ে নরম গলায় বললেন, তুমি কিছু মনে কোরো না! আসলে ব্যাপার কী জানো, জোজোকে হারিয়ে আমার মাথা খারাপ হওয়ার উপক্রম। কিন্তু তোমাকে আমরা মোটেই অবিশ্বাস করি না। কেঁদো না লক্ষ্মীটি!

রাধা তার ব্যাগ খুলে একটা ছোট্ট রুমাল দিয়ে চোখ মুছে বলল, কাকাবাবু, জোজোর যদি কোনও ক্ষতি হয়, তা হলে আপনারা আমাকে মেরে ফেলবেন। মঞ্চাম্মা এমনিতেই আর আমাকে বাঁচতে দেবে না।

কাকাবাবু বললেন, তোমার মঞ্চাম্মা যদি জোজোকে আটকে রাখার জন্য দায়ী হয়। তবে তাতেও এবার জেল খাটতে হবে। চলো, চলো, তোমাদের সেই বাড়িটা কোথায়?

রাধা বলল, ঋষিকোণ্ডার কাছেই। পর্তুগিজদের একটা পুরনো বাড়ি, বাবা সারিয়ে নিয়েছিল। অনেক ঘর।

কাকাবাবু বললেন, চলো, বেরিয়ে পড়ি। পদ্মনাভনকে বোধহয় একবার জানিয়ে রাখা দরকার।

তিনি পুলিশ কমিশনারকে ফোন করলেন।

তিনি খবর শুনে উত্তেজিত হয়ে বললেন, পিটার গোমেজের বাড়ি? সে জেলে আছে বলে ওবাড়ি আমরা সার্চ করার কথা চিন্তা করিনি। রাজাবাবু, আপনি কিছুতেই সেখানে একলা যাবেন না। শহরের বাইরে আমার এলাকা নয়। না হলে আমি নিজেই আপনার সঙ্গে যেতাম। আমি ডি জি সাহেবকে জানাচ্ছি। বাছাই করা একগাড়ি পুলিশ আপনার সঙ্গে যাবে। আপনি আধঘণ্টা অপেক্ষা করুন প্লিজ।

আধঘণ্টাও লাগল না, পঁচিশ মিনিটের মধ্যে এসে গেল পুলিশ। একটা বড় স্টেশন ওয়াগান এনেছে, দেখতে পুলিশের গাড়ি বলে মনে হয় না।

সবাই একসঙ্গে উঠে বসল সেই গাড়িতে।

আজ সকাল থেকেই আকাশ মেঘলা, রোদ ওঠেইনি। শহর ছাড়িয়ে খানিকটা বাদেই চলতে লাগল সমুদ্রের ধার দিয়ে। দুদিকের দৃশ্য ভারী সুন্দর, কিন্তু তা দেখার মন নেই, কাকাবাবু ও সন্তু দুজনেই বসে আছে চুপ করে।

এক সময় গাড়িটা ঢুকে পড়ল জঙ্গলের মধ্যে। জঙ্গল মানে শুধুই নারকোল গাছ। তার মধ্যেও রাস্তা আছে। একটা জায়গায় জেলেদের গ্রাম, সেখানে শুটকি মাছের তীব্র গন্ধ।

গাড়িটা এসে থামল একটি বাড়ির সামনে।

গেটের কাছে দাঁড়িয়ে আছে একজন খাকি পোশাক পরা পাহারাদার। তার কোমরে রিভলভার।

রাধা ফিসফিস করে কাকাবাবুকে বলল, এইরকম পাহারাদার কিন্তু আগে ছিল না।

পুলিশ বাহিনীর নেতৃত্ব দিচ্ছেন সেলিম নামে একজন অফিসার। তিনি গাড়ি থেকে নেমেই পাহারাদারটির কাছে গিয়ে নিজের ব্যাজ দেখিয়ে বললেন, পুলিশ, আমরা এই বাড়ি সার্চ করব।

লোকটির কোমর থেকে রিভলভারটি তুলে নিয়ে সেলিম বললেন, এটা আপাতত আমায় কাছে রইল, পরে ফেরত দেব।

গাড়ি থেকে আরও পুলিশদের নামতে দেখে লোকটি বাধা দেওয়ার কোনও চেষ্টা করল না।

বাড়ির থেকে টুং টাং পিয়ানোর আওয়াজ ভেসে আসছে। কেউ তার সঙ্গে গান গাইছে খুব চাপা গলায়।

দরজা খুলে দিল একজন বৃদ্ধ কাজের লোক।

রাধা তাকে নিজেদের ভাষায় কিছু বলল, লোকটি উত্তর দিল না।

বারান্দার পাশে বসবার ঘরের দরজাটা খোলা। পিয়ানোর আওয়াজ আসছে। সেখানে থেকেই।

কাকাবাবুরা ঘরে ঢুকে দেখলেন, এক কোণে পিয়ানোর সামনে বসে আছেন এক মাঝবয়েসি মহিলা। তার পরনে লাল-পাড় সাদা শাড়ি। চুল খোলা পিঠের ওপরে। হাতে কিংবা কানে কোনও গয়না নেই।

কাকাবাবু চিনতে পারলেন, এই সেই ডাকাত দলের নেত্রী মঞ্চাম্মা। অতি নিষ্ঠুর, একবার কাকাবাবুকে গুলি করে খুন করতে চেয়েছিল ঠান্ডা মাথায়। এখন দেখে মনে হচ্ছে যেন খুবই ভক্তিমতী মহিলা। জীবনে কখনও বন্দুক-পিস্তল দেখেইনি।

এই দলটিকে দেখে বাজনা থামিয়ে জিজ্ঞেস করল, আপনারা কে?

সেলিম বললেন, আমরা পুলিশ থেকে আসছি।

মঞ্চাম্মা বলল, আবার পুলিশ? আমার কাছে? আপনারা অন্যায়ভাবে আমার স্বামীকে জেলে দশ বছরের শাস্তি দিয়েছেন। এখন আমি একা একা থাকি, আপনমনে গান বাজনা করি, তাও আবার আপনারা আমাকে জ্বালাতে এসেছেন?

সেলিম বললেন, আমাদের কাছে খবর আছে, জোজো নামে একটি ছেলেকে আটকে রাখা হয়েছে।

মঞ্চাম্মা বলল, এখানে আমি কাউকে আটকে রাখব কেন? আমার নিজেরই এখন রান্নার লোক নেই। কে আপনাদের এই আজগুবি খবর দিয়েছে।

রাধা এক পা এগিয়ে জোর দিয়ে বলল আমি! আজ ভোরবেলাই আমি ছেলেটিকে দেখে গেছি!

মঞ্চাম্মা কাকাবাবুর দিকে তাকালই না। সেলিমকে বলল, আপনারা এর কথায় বিশ্বাস করে এতদূর ছুটে এসেছেন? জানেন না, এর মাথা খারাপ? এই মেয়েই তো ওর বাবাকে পুলিশের হাতে ধরিয়ে দিয়েছে।

সেলিম তাকাল কাকাবাবুর দিকে।

কাকাবাবু বললেন, বাজে কথা। ও মোটেই ওর বাবাকে ধরিয়ে দেয়নি, সে ধরা পড়েছে নিজের দোষে। রাধার জন্যই ওর বাবা ফাঁসির দড়ি থেকে বেঁচে গেছে। এই মহিলাটিরই আসলে মাথা খারাপ। নইলে, একবারে শিক্ষা হয়নি। আমার ডিমেলোর দলে যোগ দিয়ে এইসব কাজ করছে।

মঞ্চাম্মা বলল ডিমেলো আবার কে? কখনও তার নামই শুনিনি।

কাকাবাবু বললেন, আমরা এই বাড়িটা সার্চ করব।

মঞ্চাম্মা বলল, আপনাদের কী অধিকার আছে? সার্চ ওয়ারেন্ট এনেছেন?

কাকাবাবু রেগে গিয়ে বললেন, সার্চ ওয়ারেন্টের নিকুচি করেছে। সেলিমসাহেব, আর দেরি করে লাভ কী?

একতলায় যে-ঘরে জোজো ছিল, সেখানে কেউ নেই। দোতলার সব কটি ঘর ফাঁকা।

রাধা বলল, এ বাড়িতে একটা সুড়ঙ্গ আছে, আমি জানি। সেখানেই নিশ্চয়ই লুকিয়ে রেখেছে।

মঞ্চাম্মা হা-হা করে হেসে উঠল।

সুড়ঙ্গের মধ্যে একটি মাত্র ঘর। শেষে কঠিন পাথরের দেওয়াল। সেই ঘরটিতেও জোজোর কোনও চিহ্ন পাওয়া গেল না।

সেলিমসাহেব বললেন, পাখি উড়ে গেছে। কিংবা, এই মেয়েটি যে খবর দিয়েছে তা কি পাকা খবর?

রাধা বলল, আমি নিজের চোখে দেখেছি।

সন্তু বলল, এই ঘরে কিছুক্ষণ আগেও কেউ ছিল, তার প্রমাণ আছে।

সেলিম জিজ্ঞেস করলেন, কী প্রমাণ? ঘরের এককোণ থেকে একটা বাটি তুলে এনে সন্তু বলল, এতে একটু একটু তরকারির ঝোল লেগে আছে। হাত দিয়ে দেখুন, টাটকা।

সেলিম বলল, বাপ রে! তুমি দেখছি শার্লক হোমসের মতন! সত্যিই তো, গতকালের হলে শুকিয়ে যেত!

কাকাবাবুর দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করলেন,এবার কী করা হবে?

কাকাবাবু বললেন, এখানে দেরি করে আর লাভ নেই। জোজোকে ওরা আজই সরিয়ে নিয়ে গেছে, হয়তো খুব দূরে যেতে পারেনি।

সেলিমের পকেটের সেল ফোনে সারে জাঁহা সে আচ্ছা, গানের সুর বেজে উঠল।

সেলিম সেটা কানের কাছে নিয়ে ভাল শুনতে না পেয়ে অ্যা অ্যাঁ অ্যাঁ কী বলতে বলতে দৌড়ে বেরিয়ে গেলেন সুড়ঙ্গ থেকে।

কাকাবাবুও বেরিয়ে এলেন সন্তুকে নিয়ে। তাঁর মুখোনা বিরক্তিতে ভরা। এত দূরে এসেও, জোজোকে পাওয়া গেল না! আর একটু আগে যদি আসা যেত।

জোজোকে কোথায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে, তা এই মঞ্চাম্মা খুব সম্ভবত জানে। কিন্তু এ অতি কঠিন মহিলা, এর পেট থেকে কথা বার করা শক্ত।

সেলিম ফোন বন্ধ করে বললেন, পুলিশ কমিশনার জানতে চাইছিলেন, এখানে ছেলেটিকে পাওয়া গেল কি না।

কাকাবাবু মুখোনা গোমড়া করে রইলেন।

সেলিম আবার বললেন, এখানে আমরা ব্যর্থ হয়েছি জেনে উনি বললেন, এখুনি ফিরে গিয়ে ওঁর সঙ্গে দেখা করতে। উনি একজন বোটচালকের সন্ধান পেয়েছেন।

কাকাবাবু বললেন, তা হলে চলুন, চলুন।

নিজেই আগে আগে ক্রাচ নিয়ে খানিকটা এগিয়ে আবার থেমে গিয়ে বললেন, আমার কারুকে অ্যারেস্ট করার অধিকার নেই। কিন্তু সেলিমসাহেব, আপনি কি এই মহিলাকে থানায় নিয়ে যেতে পারেন? ওকে অন্তত একদিন আটকে রাখা দরকার। জোজোর নিরাপত্তার জন্য এই মহিলাটিকেও আটক রাখা দরকার।

সেলিম বলল, হ্যাঁ পারব না কেন?

মঞ্চাম্মার দিকে সে ফিরে বললেন, আপনাকে আমাদের সঙ্গে যেতে হবে। আপনি যদি জিনিসপত্র গুছিয়ে নিতে চান, খুব তাড়াতাড়ি–

মঞ্চাম্মা মুখে তাচ্ছিল্যের হাসি ফুটে উঠল। দুদিকে মাথা নেড়ে বলল, আমি যাব না!

সেলিম বললেন, আপনাকে যেতেই হবে।

মঞ্চাম্মার বলল, অত সহজ? অ্যারেস্ট ওয়ারেন্ট কোথায়? আমার বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগের প্রমাণ নেই।

সেলিম বললেন,প্রমাণ আছে কি নেই, সে আমরা বুঝব। কারুর ওপর সন্দেহ হলেও তাকে থানায় নিয়ে গিয়ে জেরা করা যেতে পারে।

মঞ্চাম্মা বলল, আমি যাব না, ব্যস! জোর করে ধরে নিয়ে যাবেন? মেয়ে-পুলিশ কোথায়? পুরুষ-পুলিশ আমার গায়ে হাত দিলে আমি কেস করে দেব!

সেলিম একটু অসহায়ভাবে তাকালেন কাকাবাবুর দিকে। বললেন, মহিলাদের গায়ে হাত দেবার নিয়ম নেই আমাদের। এই রাধা কি পারবে; রাধা যদি জোর করে ওকে টেনে নিয়ে একবার গাড়িতে তুলতে পারে—

জোজোকে পাওয়া যায়নি বলে রাধা একেবারে ম্রিয়মাণ হয়ে গেছে। মুখ নিচু করে আছে।

কাকাবাবু বললেন, না থাক। মেয়েকে দিয়ে তার মাকে ধরে নিয়ে যাওয়া মোটেই উচিত নয়। নিজের মা না হোক, তবু তো সম্পর্কে মা!

সেলিম বললেন, দুজন পুলিশকে এখানে বাইরে পাহারায় রেখে যাচ্ছি, পরে মেয়ে-পুলিশ পাঠব।

আবার গাড়িতে ওঠার পর সেলিম বললেন, এ মহিলার সাংঘাতিক মনের জোর, পুলিশ দেখে একটুও ঘাবড়ায়নি। রাধা, তুমি এর সঙ্গে থাকো কী করে?

রাধা বলল, আমি এখানে থাকি না। মামার বাড়িতে থাকি।

কাকাবাবু বললেন, এই মঞ্চাম্মার কিছুতেই শিক্ষা হয় না। আগেরবারই ওকে জেলে পাঠানো যেত, আমাকে গুলি করে মারতে চেয়েছিল, কিন্তু আমি কোনও অভিযোগ করিনি। এখন ভালভাবে বাঁচতে পারত, তা নয়, আবার খারাপ লোকেদের সঙ্গে মিশে এই সব কাজ করছে!

সেলিম বললেন, এবার জেলে ভরে দিতে হবে।

বিশাখাপত্তনমে ফিরে এবার পুলিশ কমিশনারের অফিসের বদলে যাওয়া হল সুরেশ নাইড়ুর অফিসে। তিনি জল-পুলিশের একজন বড় কর্তা।

তিনি বললেন, আমি পদ্মনাভনের কাছ থেকে সব শুনেছি। আমাদের এই এলাকায় যতগুলো মোটর বোট আছে তার চালকদের ছবি আর পরিচয়পত্র আমাদের কাছে থাকে। তারিককে সেইসব ছবি দেখাবার পর সে একজনকে চিনতে পেরেছে। সে হলফ করে বলেছে যে, জোজোকে ধরে নিয়ে গিয়ে যেবোটে তোলা হয়, সেই বোট চালাচ্ছিল এই লোকটি। এর নাম ফ্রেড।

কাকাবাবু বললেন, ফ্রেড? আমাদের একদিন একটা বোটে করে একটা দ্বীপে নিয়ে গিয়েছিল, সেই চালকের নামও ছিল ফ্রেড। একই লোক হতে পারে?

সুরেশ নাইড়ু বললেন, হতেও পারে, নাও হতে পারে। ফ্রেড খুব কমন নাম। আর নাম শুনে কিন্তু বোঝা যাবে না, এরা ক্রিশ্চান না হিন্দু। এ লোকটির পুরো নাম ফ্রেড গোয়েল।

কাকাবাবু বললেন, আমি ছবিটা একবার দেখতে পারি?

সুরেশ নাইড়ু বেল টিপে একজনকে আনতে বললেন ছবিগুলো। তারপর বললেন, এর মধ্যে আমরা ফ্রেডের বাড়িতেও খোঁজ করেছি। মোটর বোটের মালিকও সে নিজেই। আজ সকালেই সে বেরিয়ে গেছে বোট নিয়ে। কোথায় গেছে, তা অবশ্য তার বাড়ির লোক জানে না।

কাকাবাবু বললেন, জানলেও বলবে না। জোজোকে যদি অন্য কোনও বাড়িতে সরিয়ে ফেলতে চায়, তা হলে গাড়িতেই নিতে পারত। মোটর বোটে যদি নিয়ে যায়, তা হলে কি কোনও দ্বীপে নিয়ে গেছে?

সুরেশ নাইড়ু বললেন, হতেও পারে। কিংবা সমুদ্রের ধারেই যদি অন্য কোনও দূরের শহরে নিয়ে যেতে চায়, তা হলে মোটর বোটেই সুবিধে, কেউ সহজে পিছু তাড়া করতে পারবে না।

একজন কর্মচারী ছবির ফাইলগুলো নিয়ে এলেন। কাকাবাবু আর সন্তু ফ্রেডের ছবিটা দেখামাত্র চিনতে পেরে বললেন, এই তো!

কাকাবাবু বললেন, যে-কোনও উপায়ে হোক, এই ফ্রেডকে এখন খুঁজে বার করা দরকার। সে রকেট নামে লম্বা লোকটাকে চেনে। ফ্রেডের কাছ থেকে রকেটের সন্ধান পাওয়া যেতে পারে।

সুরেশ নাইড়ু বললেন, রকেট হায়দরাবাদি? সেও এর মধ্যে আছে নাকি? তাকে একবার আমরা প্রায় ধরে ফেলেছিলাম, একটা দ্বীপে পালিয়ে ছিল, সেখান থেকে নিয়ে আসার সময় লঞ্চ থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ল। আর খুঁজে পাওয়া গেল না। আমরা ধরেই নিয়েছিলাম, সে আর বেঁচে নেই।

কাকাবাবু সোজা হয়ে বসে বললেন, দ্বীপ? কোন দ্বীপ? এখানকার দ্বীপগুলোতে লুকিয়ে থাকা যায়? আপনাদের কাছে দ্বীপগুলোর ম্যাপ আছে।

সুরেশ নাইড়ু বললেন, তা অবশ্যই আছে। কিছু ছোট ছোট দ্বীপ কিছুদিন দেখা যায়, আবার জল বাড়লে ড়ুবে যায়। বুঝতেই পারছেন, সেগুলোতে কোনও গাছপালাও জন্মাতে পারে না। মোট চারটে দ্বীপ আছে, কিছুটা বড়। তার মধ্যে দুটোতে কোনও কনস্ট্রাকশান নেই, মানে বাড়ি-ঘর কিছু নেই। একেবারে ন্যাড়া। সেখানে কেউ বেশিক্ষণ থাকতে পারবে না। বিশেষত এখন ঝড় বৃষ্টির সময়, কখনও টানা চব্বিশ ঘণ্টাও বৃষ্টি হয়। আর দুটো দ্বীপের নাম রবার্টস আয়ল্যান্ড আর কিউকাম্বার কোভ। এই দুটোতে সাহেবি আমলের ভাঙাচোরা বাড়ি আছে। এর মধ্যে কিউকাম্বার কোভ দ্বীপটার আকৃতি শশার মতন, তাই লোকে বলে শশা দ্বীপ, রবার্টস সাহেবের নামের দ্বীপটা হয়েছে রাবার দ্বীপ। কিছু লোকের ধারণা, ওই রবার্টস আয়ল্যান্ডে ভূত আছে। আমি নিজে সেখানে গেছি। কিছু দেখিনি। কিছুদিন আগে একদল বৈজ্ঞানিক গিয়েছিলেন, তাঁরাও কিছু আবিষ্কার করতে পারেননি।

সন্তু কিছু বলতে যাচ্ছিল, কাকাবাবু তাকে চাপা দিয়ে বললেন, খুনে-গুন্ডারা ভূতের ভয় পায় না। তারা ওই রাবার দ্বীপে আড্ডা গাড়তে পারে না? এক হিসেবে তাদের পক্ষে ভালই, অন্য কেউ সেখানে ভয়ে যাবে না।

সুরেশ নাইড়ু বললেন, আপনি ঠিকই বলেছেন। গুন্ডাশ্রেণীর লোকেরা ভূতের ভয় পায় না। কিন্তু যে-কোনও কারণেই হোক, এই রবার্টস আয়ল্যান্ড তারা এড়িয়ে যায়। আমাদের লঞ্চ ওখানে গিয়ে নিয়মিত চেক করে, কারুর থাকার প্রমাণ পাওয়া যায়নি। কিউকাম্বার কোভের কাছের দিকটায় মাঝে-মাঝে পিকনিক পার্টি যায়। আর একেবারে শেষ প্রান্তে আছে একটা টালির বাড়ি।

কাকাবাবু বললেন, আমার মনে হয়, জোজোকে ওরা খুব দূরে নিয়ে যাবে না। তিনদিন মাত্র সময়। তার মধ্যে প্রায় দেড় দিন তো কেটেই গেল! চলুন, আমরা

ওই দ্বীপ দুটোই আগে গিয়ে দেখি।

সুরেশ নাইড়ু বললেন, চলুন। আমাদের ঢাকা লঞ্চ আছে। বৃষ্টি হলে অসুবিধে হবে না। আমিও যাব আপনাদের সঙ্গে।

এই বোটটা বেশ বড় আর সুসজ্জিত। বসবার জায়গা বেশ আরামদায়ক আর ঠাণ্ডা, একটা ছোট রান্নাঘরও আছে।

সকাল থেকে প্রায় কিছুই খাওয়া হয়নি। যাত্রা করার সময় কিছু পাউরুটি, ডিম আর কফি তুলে নেওয়া হয়েছে। সন্তু আর রাধা দুজনে মিলে টোস্ট আর ডিমসেদ্ধ বানিয়ে ফেলল, তবু খাওয়াটা ঠিক জমল না। এই মিনি কিচেনে নুন নেই, নুন আনার কথাও কারুর মনে পড়েনি। নুন ছাড়া ডিমে কি স্বাদ হয়!

কফিতে চুমুক দিতে দিতে কাকাবাবু সুরেশ নাইড়ুকে জিজ্ঞেস করলেন, নাইড়ুসাহেব আপনি রবার্টস আয়ল্যান্ডে ভূতের ব্যাপারে কী শুনেছেন?

নাইড়ু বললেন, শোেনা যায় তো অনেকরকম গল্প। একবার কোনও গল্প ছড়াতে শুরু করলে তাতে নানারকম রং চড়তে থাকে। দেখুন, শুধু অফিসে বসে কাজ করতে আমার ভাল লাগে না। আমি এই বোটে কিংবা আরও বড় লঞ্চে প্রায়ই সমুদ্রের বুকে ঘুরে বেড়াই। এদিকে তো খুব স্মাগলারদের উপদ্রব, তাই টহল-দেওয়াটাও আমাদের কাজ। ওই দ্বীপে আমি নিজে অন্তত তিনবার গেছি, কিছুই দেখিনি।

সেলিম বললেন, স্যার, আমিও একবার আপনাদের সঙ্গে এসেছি, আপনার মনে আছে?

নাইড়ু বললেন, হ্যাঁ। সেবারে শুধু একটা কচ্ছপ ধরা পড়েছিল, তাই না? অতবড় কচ্ছপ আমি আগে দেখিনি।

সন্তু জিজ্ঞেস করল, সেই কচ্ছপের মাংস আপনারা খেয়ে ফেললেন? খেতে কেমন?

নাইড়ু বললেন, না, না, সেটাকে আমরা আবার জলে ছেড়ে দিলাম। কচ্ছপ মারা এখন নিষেধ। তবে, ছোটবেলায় আমি কচ্ছপের মাংস খেয়েছি, খুবই ভাল স্বাদ। সেলিম, তুমি খেয়েছ?

সেলিম বলল, না, আমাদের পরিবারে কেউ কচ্ছপ খায়নি কখনও। তবে ছোটবেলায় আমিও দেখেছি, বাজারে কচ্ছপ বিক্রি হত।

কাকাবাবু বললেন, সমুদ্রে খুব বড় বড় কচ্ছপ থাকে। তবে প্রকৃতি ওদের ওপর বড্ড অবিচার করেছে। ও রকম একটা শক্তপোক্ত প্রাণী, কিন্তু ওদের মারা কত সহজ। একবার ধরে উলটে দিতে পারলেই হয়, আর পালাতে পারে না।

রাধা জিজ্ঞেস করল, কচ্ছপ কী?

কাকাবাবুরা কথা বলছেন ইংরিজিতে। ওঁরা তো কচ্ছপ বলেননি, বলেছেন টরটস, রাধা তাও বুঝতে পারেনি।

নাইড়ু বললেন, তুমি দ্যাখোনি কখনও? জ্যান্ত না দেখলেও ছবিতে? সেই যে কচ্ছপ আর খরগোশের দৌড় প্রতিযোগিতার গল্প আছে?

রাধা বলল, ও টারটুল! পিঠটা খুব শক্ত…।

কাকাবাবু বললেন, ঠিক, আমরা পুরনো ইংরিজি বলি। এখন টারই বলে, বিশেষত সমুদ্রের কচ্ছপকে। যাই হোক সেই কচ্ছপ ছাড়া আর কিছু দেখেননি? রাত্তিরেও ছিলেন?

সেলিম বললেন, হ্যাঁ, এক রাত কাটিয়েছি। তবে এত চমৎকার হাওয়া দেয়। সন্ধে হতে না হতেই ঘুমে চোখ টেনে আসে। এক ঘুমে রাত কাবার। সারা রাত কোনও শব্দ হয়নি। ভূতেরা তাণ্ডব করে ঘুম ভাঙায়নি। আমার মতে, ওই দ্বীপে খুব ভাল টুরিস্ট সেন্টার হতে পারে।

নাইড়ু বললেন, তা সম্ভব নয়। দশ-বারো বছর আগে পুরো দ্বীপটা ড়ুবে গিয়েছিল কয়েক দিনের মতো। সেরকম আবার হতে পারে যে-কোনও সময়। যে রবার্ট সাহেব ওই দ্বীপে বাড়ি বানিয়েছিলেন, তিনি নাকি জলে ড়ুবেই মারা যান। সে অনেকদিন আগেকার কথা। তবু, জেলেরা কেউ কেউ নাকি মাঝে মাঝে রবার্ট সাহেবকে দেখেছে। তিনি জলের ওপর দিয়ে হেঁটে যান। বিশাল চেহারা।

সন্তু বললেন, জলে ড়ুবে মারা যাবার পর ভূত হয়ে জলের ওপর দিয়ে হাঁটতে শিখলেন!

রাধা বলল, ভূতদের তো ওজন থাকে না!

সন্তু জিজ্ঞেস করল, রাধা তুমি কখনও ভূত দেখেছ?

রাধা সঙ্গে সঙ্গে বলল, হ্যাঁ, দেখেছি। অনেকবার। সিনেমায়।

সবাই হেসে উঠল।

সন্তু বলল, দূরে একটা লঞ্চ দেখা যাচ্ছে।

নাইড়ু একটা দূরবিন বার করে দেখতে দেখতে বললেন, মনে হচ্ছে মাছ ধরা ট্রলার। তবু আমরা চেক করব, পাশ দিয়ে যাব।

এই বোটচালকের পাশে চারজন কমান্ডো বসে আছে। তিনজনের কাছে। অটোমেটিক রাইফেল আর একজনের হাতে সাব মেশিনগান। যে-কোনও ডাকাতের দলের সঙ্গেই ওরা মোকাবিলা করতে পারবে।

কাছে গিয়ে দেখা গেল, সেটা সত্যিই মাছ ধরার ট্রলার। অনেক মাছ পেয়েছে। বেশির ভাগই ম্যাকারেল আর পমফ্রেট। একটা বড় মাছ খুব অদ্ভুত ধরনের। সেটার কেউ নাম জানে না।

আর একটু যাওয়ার পর চোখে পড়ল দু-একটা গাছ। নাইড়ু বললেন, ওই যে শশা দ্বীপ।

এর মধ্যে বিকেল হয়ে এসেছে। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি পড়ছে বলে আলোও কম। দ্বীপটার কাছের দিকে কেউ নেই।

নাইড়ু বললেন, মাঝে-মাঝে এখানে পিকনিক পার্টি আসে, আজ কেউ আসেনি। অবশ্য কেউই সন্ধে পর্যন্ত থাকে না।

দ্বীপের অন্য অংশের দিকে যেতেই দেখা গেল, সেখানে আগুন জ্বলছে, কয়েকজন লোকও ঘোরাফেরা করছে।

নাইড়ু কমান্ডোদের সতর্ক হতে বলে রাধা সন্তুকে বললেন, তোমরা শুয়ে পড়ো। ওরা যদি ডাকাত হয়, গুলি চালাতে পারে।

ঠিক তাই, এই বোটটা আর একটু কাছে যেতেই পর পর দুটো গুলির আওয়াজ শোনা গেল।

কাকাবাবু উত্তেজিতভাবে বললেন, ওরা আমাদের ভয় দেখাচ্ছে? ওরা কজন হতে পারে? আমাদের চারজন কমান্ডো, আর আমরা তিনজন, সবাই দ্বীপে নেমে ওদের ঘিরে ধরব।

নাইড়ু বললেন, দাঁড়ান, ব্যস্ত হবেন না। কোনও পিকনিক পার্টি এত দূর চলে এলে গুলির আওয়াজ শুনলেই ভয়ে পালিয়ে যাবে। ওরা বোধহয় সেইরকমই ভেবেছে। দাঁড়ান, আগে ব্যাপারটা বুঝে নিই।

তিনি মিলিটারি কমান্ডারের ভঙ্গিতে কমান্ডো চারজনকে বললেন, ফায়ার!

তারা ঠিক চার রাউন্ড গুলি চালাবার পরই তিনি হাত তুলে বললেন, স্টপ!

তারপর লাউড স্পিকারের চোঙা তুলে নিয়ে তিনি বলতে লাগলেন, পুলিশ। আমরা দ্বীপটা সার্চ করতে এসেছি। তোমরা যে-ই হও, সারেন্ডার করো। তোমরা লড়াই করার চেষ্টা করলে কেউ বাঁচবে না। সারেন্ডার!

ওদিক থেকে কোনও সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না।

নাইড়ু এবার যে কমান্ডোর হাতে সাব মেশিনগান, শুধু তাকে বললেন, ফায়ার!

সে একঝাঁক গুলি চালিয়ে দিল।

এবার ওদের একজন এগিয়ে এল জলের ধারে। তার হাতের বন্দুকটা মাথার ওপর তোলা।

নাইড়ু হুকুম দিলেন, ড্রপ দা গান।

সে অস্ত্রটা ফেলে দিল মাটিতে।

নাইড়ু বললেন, আর কজন আছে? সবাই জলের ধারে এসে লাইন করে পঁড়াও!

মোট চারজন এসে দাঁড়াল। আরও একজনের হাতে বন্দুক।

কাকাবাবু বললেন, এদের বোট কোথায়? সেটা তো দেখা যাচ্ছে না।

সেলিম বলল, এদের নামিয়ে দিয়ে হয়তো কিছু জিনিসপত্র আনতে গেছে। নাইড়ু এ বোটটা কাছে নিয়ে যেতে বললেন। এখানে একটা জেটিও করা আছে।

বোটটা জেটিতে লাগবার আগেই সন্তু এক লাফে নেমে পড়ে ছুটে গেল একটা ঘরের দিকে।

শুধু একটা টালির চালের ঘর। আর কিছু নেই। ঠেলা দিয়ে ঘরের দরজাটা খুলে ফেলে সন্তু চেঁচিয়ে উঠল। জোজো!

ঘরের মধ্যে কেউ নেই।

ঘরে একটা খাটিয়া ছাড়া আর কোনও আসবাবও নেই। সন্তু খাটিয়ার তলায় উঁকি মেরে দেখল, সেখানে গোটাচারেক কচ্ছপ বেঁধে রাখা রয়েছে।

ঘর থেকে বেরিয়ে দারুণ হতাশায় সন্তু আকাশ ফাটিয়ে চিৎকার করে উঠল, কাকাবাবু, জোজো এখানে নেই।

বাইরে আরও কয়েকটা কচ্ছপকে উলটে রাখা রয়েছে, তাদের পাশে পড়ে আছে অনেকগুলো ডিম।

কাকাবাবুরাও নীচে নেমে এসে সব দেখলেন।

সেলিম বলল, কচ্ছপরা এখানে ডিম পাড়তে আসে। এই লোকগুলো ঠিক সময় বুঝে এসে সেগুলোকে ধরে। এই সব কচ্ছপ বিদেশে চালান দেয় লুকিয়ে লুকিয়ে।

কাকাবাবুও হতাশা লুকোতে পারলেন না। মাথা নাড়তে নাড়তে বললেন, ইস, এখানেও জোজোকে পাওয়া গেল না? এরা তো পেটি ক্রিমিনাল, এরাও বন্দুক রাখে?

নাইড়ু বললেন, এখন সবাই বন্দুক-পিস্তল রাখে। বেশ শস্তায় কিনতে পাওয়া যায়।

কাকাবাবু বললেন, এখন এদের নিয়ে কী করবেন? আমাদের বোটে তো এত লোকের জায়গা হবে না।

নাইড়ু বললেন, নাঃ, এদের নিয়ে যাওয়া যাবে না। আপাতত বন্দুক দুটো বাজেয়াপ্ত করা যাক।

তিনি সেই চারজনকেই হুকুম করলেন, সব কটা কচ্ছপকে বাঁধন খুলে জলে ছেড়ে দাও! এক্ষুনি, আমার সামনে। আমি কাল আবার আসব, তখনও যদি তোমাদের এখানে দেখি, একেবারে জেলে ভরে দেব!

লোকগুলোর মুখে কোনও কথা নেই। এক এক করে সব কটা কচ্ছপকে ছেড়ে দিল সমুদ্রে। তারপর তাদের দাঁড় করিয়ে রেখে পুলিশের বোটটা আবার স্টার্ট দিল।

নাইড়ু বললেন, সন্ধে হয়ে আসছে। এখন কি আর রবার্টস আয়ল্যান্ডে যাবেন?

কাকাবাবু বললেন, যাব না মানে? সে জায়গাটা চেক করে দেখতেই হবে। একটুও সময় নষ্ট করার উপায় নেই।

নাইড়ু বললেন, সন্ধের পর আমরা সাধারণত সমুদ্রে থাকি না। বোট চালাতে অসুবিধে হয়, মাঝে-মাঝে উঁচু পাথর আছে।

সেলিম বললেন, স্যার, তা হলেও ওই দ্বীপটা একবার দেখে যাওয়া দরকার। এতদূর যখন এসেছি, আর বড় জোর আধঘণ্টা যেতে হবে। সেখানেও পাওয়া না গেলে বুঝতে হবে, সমুদ্রে ওরা নেই। খুঁজতে হবে পাড় ধরে ধরে।

নাইড়ু বললেন, চলুন তা হলে!

রাধা বলল, ওই লোকগুলো রাত্তিরবেলা দ্বীপে থাকবে, ওদের যদি হাঙরে খেয়ে ফেলে?

নাইড়ু বললেন, হাঙর তো পাড়ে ওঠে না। হাঙরের ঝাঁক আসে বটে মাঝে-মাঝে। কুমির থাকলে ওপরে উঠে আসতে পারত, কিন্তু এ সমুদ্রে কুমির দেখা যায় না।

রাধা বলল, আর সাপ?

সেলিম বললেন, সাপ আছে, খুবই বিষধর, তবে সাপ তো মানুষকে তেড়ে এসে কামড়ায় না। মানুষ সাপের খাদ্য নয়।

সন্তু আর কাকাবাবু কোনও কথা বলছেন না। এর পরের দ্বীপটাতেও জোজোকে পাওয়া না গেলে আর কোথায় খোঁজা হবে? রাত্তিরবেলা আর কোথাও যাওয়া যাবে না। ওরা মাত্র তিনদিন সময় দিয়েছে, বাকি থাকবে শুধু কালকের দিনটা।

রাধা বলল, আমার একটা দ্বীপে থাকতে ইচ্ছে করে।

সেলিম বললেন, তোমাকে রাবার দ্বীপে আমরা রেখে আসব। তুমি একা থাকতে পারবে?

রাধা অনেকখানি ঘাড় হেলিয়ে বলল, হ্যাঁ।

সন্তু বলল, যখন খিদে পাবে, তখন কী করবে? রাধা একটু চিন্তা করে বলল, একটা না একটা জাহাজ তো যাবে পাশ দিয়ে, সেই জাহাজকে ডাকব।

নাইড়ু বললেন, জাহাজের লোকগুলো ভাববে, আকাশ থেকে একটা পরী নেমে এসেছে এই দ্বীপে।

হঠাৎ রাধা বলল, দূরে ওটা কী? তিমি মাছ?

চোখে দূরবিন লাগিয়ে নাইড়ু বললেন, না ওটাই সেই রবার্টস আয়ল্যান্ড।

আরও কাছে যাওয়ার পর দ্বীপটাকে ভাল করে দেখা গেল। আকাশের একদিক এর মধ্যে অন্ধকার হয়ে গেছে, অন্যদিকে আগুনের মতন লাল রেখা।

দ্বীপের কাছেই রয়েছে একটা বোট, সেটা ঢেউ লেগে দুলছে। বোটের মাঝখানে অস্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে দুজন লোককে। নাইড়ু নিজেদের বোটটা থামিয়ে দিতে বললেন।

কাকাবাবু রিভলভার বার করে বললেন, খুব সাবধানে এগোতে হবে। ওরা চোখের নিমেষে গুলি চালিয়ে দেয়। নিশ্চয়ই আমাদের বোট দেখতে পেয়েছে।

কমান্ডোরা অস্ত্র হাতে নিয়ে তৈরি হয়ে নিল।

নাইড়ু লাউড স্পিকারের চোঙাটা নিয়ে ঘোষণা করলেন, আমরা পুলিশ থেকে বলছি। পুলিশ। বোটটা একবার সার্চ করে দেখব!

কাকাবাবু আপন মনে বললেন, জোজোকে যখন ধরে নিয়ে যায়, তখন নকল পুলিশ সেজে ওরাই এই কথা বলেছিল।

নাইড়ুর দুবারের ঘোষণাতেও কোনও সাড়া পাওয়া গেল না।

সেলিম বললেন, স্যার, খুব জোর হাওয়া বইছে, আমাদের বোটটাও অনেকটা দূরে, ওরা বোধহয় শুনতে পাচ্ছে না।

নাইড়ু চালককে বললেন, আরও একটু এগিয়ে চলো তো। বেশি না। সন্তু আর রাধা, তোমরা শুয়ে পড়ো, নইলে গুলি লাগতে পারে।

বোটটা খানিকটা এগিয়ে গিয়ে থামল। খুব তাড়াতাড়ি আকাশের আলো মিলিয়ে যাচ্ছে, তবু অস্পষ্ট হলেও বোঝা গেল, অন্য বোটটাতে মানুষ রয়েছে।

কাকাবাবু দ্বীপটার দিকে দেখলেন ভাল করে। সেখানে কোনও মানুষজন দেখা যাচ্ছে না।

নাইড়ু আরও তিনবার একই ভাবে মুখে চোঙা দিয়ে ঘোষণা করলেন। কোনও সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না।

তিনি আবার বললেন, বোটের চালককে বলছি, মাথার ওপর হাত তুলে উঠে দাড়াও।

কেউ উঠে দাঁড়াল না।

এবার এই বোটের জোরালো সার্চ লাইট ফেলা হল অন্য বোটে।

এবার দেখা গেল, কয়েকজন লোক পাশাপাশি শুয়ে আছে। মনে হয় যেন ঘুমন্ত। এই সন্ধেবেলা সবাই মিলে ঘুমিয়ে পড়বে, তাও তো বিশ্বাসযোগ্য মনে হয় না।

সেলিম বলল, মটকা মেরে শুয়ে আছে। নিশ্চয়ই কোনও মতলব আছে। নাইড়ু একজন কমান্ডোকে শূন্যে একবার গুলি চালাতে বললেন।

সেই গুলির আওয়াজে, ওদিক থেকে সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না। সবাই শুয়ে রইল একভাবে।

সেলিম বললেন, আরও একটু কাছে গিয়ে দেখা হবে?

কাকাবাবু চিন্তিতভাবে বললেন, খানিকটা অপেক্ষা করে দেখা যাক। ওরা নিশ্চয়ই চাইছে আমরা আরও কাছে যাই। তারপর একটা কিছু করবে। আমি একা ওদের বোটের কাছে যেতে পারলে ভাল হত। কিন্তু তার তো উপায় নেই।

নাইড়ু বিস্মিতভাবে বললেন, কেন, আপনি একা যেতে চাইছেন কেন? ওরা এত সাঙ্ঘাতিক লোক…

কাকাবাবু বললেন, ওরা তো আমাকে মারবে না। আমাকে দিয়েই তো ডিমেলোকে ছাড়াতে চাইছে। আমাকে মারলে ওদের কোনও লাভ হবে না।

হঠাৎ জলে একটা শব্দ হল। জুতো আর প্যান্ট খুলে সন্তু সমুদ্রে নেমে পড়েছে।

নাইড়ু চেঁচিয়ে উঠলেন, এ কী, এ কী! ততক্ষণে সন্তু ড়ুবসাঁতার দিয়েছে?

কাকাবাবু বললেন, সন্তু খুব ভাল সাঁতার জানে। ও অন্ধকারের সুযোগ নিয়ে চুপিচুপি ওই বোটের কাছে গিয়ে দেখতে চায় আসল ব্যাপারটা।

সেলিম বললেন, এটা তো ডেঞ্জারাস। ওরা নিশ্চয়ই নজর রাখছে।

কাকাবাবু বললেন, সন্তুকে বারণ করেও লাভ হত না। ও জোজোকে এত ভালবাসে।

সবাই ব্যগ্রভাবে তাকিয়ে রইলেন।

এখানে বেশি ঢেউ নেই। তবে বাতাসে ছলচ্ছল শব্দ হচ্ছে। সন্তু এক-একবার মাথা তুলছে, আবার ড়ুবে যাচ্ছে। একটু পরেই তাকে আর দেখা গেল না।

কাকাবাবু নাইড়ুকে বললেন, সার্চ লাইটটা অফ করে দিন।

নাইড়ু চোখে দূরবিন লাগিয়ে দেখার চেষ্টা করলেন। কিন্তু অন্ধকারে সবই কালো হয়ে গেছে।

একটু বাদে রাধা প্রথমে বলল, কীসের একটা আওয়াজ শোনা গেল না ও মানুষের গলা!

সেলিম বললেন, হ্যাঁ। কেউ আর্ত চিৎকার করছে। সন্তু ধরা পড়ে গেছে? কাকাবাবু বোটচালককে বললেন, শিগগির ওই বোটের কাছে চলো।

আবার জ্বালানো হল সার্চ লাইট। ওই বোটের ওপর দেখা গেল সন্তুকে। আর একটু কাছে যেতে শোনা গেল তার কথা। সে চেঁচিয়ে ডাকছে, কাকাবাবু, কাকাবাবু, এদিকে চলে এসো।

অন্য বোটের কাছে পৌঁছতেই কাকাবাবুর বুকটা ধস করে উঠল।

এখানে-সেখানে শুয়ে আছে চারজন। তাদের মধ্যে জোজোও আছে, কেউ নড়ছে না।

সবাই মরে গেছে?

সেলিম এক লাফে অন্য বোটটায় গিয়ে বসলেন, সবাই কী করে একসঙ্গে মরে গেল?

সন্তু বলল, একজনও মরেনি। আমি জোজোর নাকের কাছে হাত দিয়ে দেখেছি, নিশ্বাস পড়ছে।

এর পর নাইড়ু আর কাকাবাবুও চলে এলেন এই বোটে। প্রত্যেককেই পরীক্ষা করে দেখা হল। কেউই মৃত নয়। অজ্ঞান হয়ে আছে।

নাইড়ু বললেন, এ তো ভারী আশ্চর্যের ব্যাপার। কারুর গায়ে আঘাতের চিহ্ন নেই। মারামারি হয়নি বোঝা যাচ্ছে। তবু অজ্ঞান হল কী করে?

কাকাবাবু বললেন, এটা আমিও বুঝতে পারছি না।

সেলিম বললেন, আমরা আশঙ্কা করছিলাম গোলাগুলি চলবে। তার কিছুই হল না। জোজোকেও খুঁজে পাওয়া গেছে। বাকি লোকগুলোকেও হাতকড়া পরিয়ে ধরে নিয়ে যেতে পারি। এত সহজে সব হয়ে গেল?

কাকাবাবু বললেন, ঘুমন্ত অবস্থায় কারুর হাত বাঁধা কি উচিত। দেখুন না চেষ্টা করে, এদের জাগানো যায় কি না!

সন্তু এর মধ্যে জোজোর হাত আর মুখের বাঁধন খুলে দিয়েছে। তার গালে ছোট ছোট চাপড় মেরে ডাকতে লাগল, জোজো, এই জোজো!

একটু বাদেই জোজো চোখ মেলে চাইল। ধড়মড় করে উঠে বসে বলল, সন্তু কখন এলি?

সন্তু বলল, এই তো এক্ষুনি। তোর কী হয়েছিল?

জোজো বলল, কিছু হয়নি তো। ঘাড় ঘুরিয়ে অন্যদের দেখে বলল, জানিস সন্তু, এই লম্বা লোকটার নাম রকেট। আর ও হচ্ছে ভিকো। অতি খারাপ লোক। আর বোট চালাচ্ছে, আমাদের সেই ফ্রেড।

কাকাবাবু বললেন, জোজো, এরা সবাই এই সন্ধেবেলা ঘুমিয়ে আছে কেন?

জোজো বলল, তা তো জানি না। আমার খুব ঘুম পেয়েছিল। মুখ বাঁধা। থাকলে কথা বলা যায় না, তখন তো জেগে থাকার বদলে ঘুমিয়ে পড়াই ভাল।

নাইড়ু সেলিমকে বললেন, এই বোট থেকে সব অস্ত্রগুলো সরিয়ে ফেলুন। আগে।

তারপর তিনি রকেট হায়দরাবাদির গালে চাপড় মারতে লাগলেন।

সেও জেগে গেল একটু পরেই।

নাইড়ু তার কপালে রিভলভার ঠেকিয়ে বললেন, রকেট হায়দরাবাদি, তোমাকে গ্রেফতার করা হল। বাধা দেবার চেষ্টা করে লাভ নেই।

রকেটের দুচোখে হাজার বিস্ময়।

সে আমতা আমতা করে বলল, আপনারা… আপনারা কখন এলেন? আমাদের কী হয়েছিল?

নাইড়ু বললেন, তোমরা ধরা দেবার জন্য অপেক্ষা করে করে ঘুমিয়ে পড়েছিলে ক্লান্ত হয়ে।

খপ করে তার হাত দুটি ধরে হ্যান্ডকাপ পরিয়ে দেওয়া হল। সে এমন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছে যে, আর কোনও কথা বলতে পারছে না।

সেলিম বললেন, আমি এত বছর পুলিশে চাকরি করছি, কখনও এমন অভিজ্ঞতা হয়নি। কালপ্রিটরা ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে ধরা দিল! আমাদের কিছুই করতে হল না?

কাকাবাবু বললেন, এরকম অভিজ্ঞতা আমারও প্রথম হল।

অন্যদের একই রকমভাবে জাগিয়ে হাতকড়া পড়িয়ে দিলেন নাইড়ু।

ভিকো শুধু প্রথমে জোরাজুরি করার চেষ্টা করল, সেলিম তার দিকে রিভলভার তুলে বললেন, গুলি খেয়ে মরতে চাও?

ভিকো তখন উঠে দাঁড়িয়ে হু-আ-হা-হা, হু-আ-হা-হা করে চিৎকার করে উঠল। আকাশ ফাটিয়ে।

জোজো বলল, কী করছে? কারুকে ডাকছে নাকি!

সন্তু বলল, এখানে কে ওর ডাক শুনতে পাবে?

সেলিম বললেন, এটা ওর কান্না। এমনি এমনি ধরা পড়েছে তো তাই ওর অপমান হয়েছে।

সত্যিই ভিকোর দুচোখ দিয়ে জল পড়ছে। রকেট বসে আছে হাঁটুতে মাথা গুঁজে।

নাইড়ু বললেন, আর দেরি করে লাভ কী? এবার গেলেই হয়। কিন্তু একটা মুশকিল হচ্ছে, এই বোটটা চালাবে কে? এ লোকটাকে বিশ্বাস করা যায় না।

ফ্রেড বলল, আমি কী দোষ করেছি? আমার বোট কেউ ভাড়া নিলে সে যেখানে যেতে বলবে, সেখানে যাব।

সেলিম বললেন, চোপ! তুমি একটাও কথা বলবে না।

নাইড়ু বললেন, আমাদের একটা বোটে তো এত লোক ধরবে না। সেলিম, তুমি বোট চালাতে জানো?

সেলিম বললেন, না স্যার।

কাকাবাবু বললেন, আমি জানি। কিন্তু আমি একটা অন্য কথা ভাবছি। এ বোটটা আপাতত এখানে থাক। আমি আর সন্তু এই দ্বীপে থেকে যাচ্ছি, আপনারা ওদের নিয়ে একটা বোটে চলে যান।

নাইড়ু অবিশ্বাসের সুরে বললেন, আপনারা এই দ্বীপে থেকে যাবেন মানে? কেন?

কাকাবাবু বললেন, এখন তো আর কোনও বিপদের ভয় নেই। আমরা তো এই দ্বীপে রাত কাটাব বলেই যাত্রা করেছিলাম।

নাইড়ু বললেন, না, না। এখন তার দরকার নেই। সবাই মিলে গাদাগাদি করে হয়ে যাবে। মিস্টার রায়চৌধুরী, ফিরে চলুন।

কাকাবাবু বললেন, আপনি চিন্তা করবেন না। আমি এখানে থাকব বলেই ঠিক করেছি।

কাকাবাবুর গলার আওয়াজ শুনেই বোঝা যায়, তিনি মত বদলাবেন না।

জোজো বলল, আমিও থাকব।

কাকাবাবু বললেন, তোর ওপর এত ধকল গেছে। তুই বরং শহরে গিয়ে বিশ্রাম নে। যদি ডাক্তার দেখাতে হয়…

জোজো বলল, মোটেই ডাক্তার দেখাতে হবে না। এক ঘণ্টা ধ্যান করব, তাতেই সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু কাকাবাবু, আমরা রাত্তিরে কী খাব?

কাকাবাবু বললেন, সে একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে। আমাদের বোটে ডিম আর পাউরুটি আছে, সেগুলো রেখে দেব। এই বোটে কিছু আছে কি না দ্যাখ তো!

এই বোটেও রয়েছে কিছু ডিম আর পাউরুটি, আর দুপ্যাকেট খেজুর আর পেস্তাবাদাম। কফি আর গুঁড়ো দুধ।

কাকাবাবু বললেন, বাঃ, চমৎকার খাওয়া হবে।

সন্তু বলল, এই জোজো, দ্যাখ তো নুন আছে কি না। নুন ছাড়া ডিম খাওয়া যায় না।

শুধু নুন নয়, পাওয়া গেল গোলমরিচের গুঁড়োও।

নাইড়ু বললেন, মিস্টার রায়চৌধুরী, আপনি সত্যি থেকে যাবেন, এই ছোট ছেলেদুটিকে নিয়ে?

সেলিম বললেন, আমারও থেকে যেতে ইচ্ছে করছে। আমিও তা হলে থাকি স্যার?

নাইড়ু বললেন, সেলিম, তুমিও পাগল হলে নাকি?

সেলিম বললেন, এই দ্বীপটা সম্পর্কে কতরকম গল্প শুনেছি। খুব কৌতূহল। হচ্ছে।

রাধা এবার বলল, আর আমি কী করব?

নাইড়ু বললেন, তুমি তো অবশ্যই আমাদের সঙ্গে ফিরে যাবে। তোমার থাকার প্রশ্নই ওঠে না।

রাধা বলল, মোটেই না, মোটেই না। আমি কাকাবাবুর সঙ্গে থাকব।

অনেক চেষ্টা করেও রাধাকে বোঝানো গেল না। সে কাকাবাবুর কোটটা চেপে ধরে রইল।

শেষ পর্যন্ত কাকাবাবুর দলটা বেশ বড়ই হয়ে গেল।

সন্ত, জোজো, রাধা, সেলিম আর একজন কমান্ডো। নাইড়ু জোর করে রাখতে চাইলেন তাকে। তার হাতে লাইট মেশিনগান।

বন্দিদের অন্য বোটে তোলবার পর নাইড়ু বললেন, আমাকে তো আজই ওদের নিয়ে গিয়ে থানায় জমা দিতে হবে। কাল দুপুরের মধ্যেই আমি আপনাদের এখানে ফিরে আসছি।

সেলিম বললেন, সেই ভাল স্যার। আসবার সময় বেশি করে খাবার নিয়ে আসবেন।

জোজো বলল, মশলা বোসা আনতে পারবেন না? ডিম-পাউরুটি আর কতবার খাওয়া যায়?

নাইড়ুদের লঞ্চটা ছেড়ে যাওয়ার পর কাকাবাবু এই লঞ্চটার চালকের আসনে বসলেন।

অনেকদিন অভ্যেস নেই, বেশ কয়েক মিনিট স্টার্ট দিতে অসুবিধে হল।

কাকাবাবু সন্তুর দিকে তাকিয়ে বললেন, কী রে, এটা চলবে না নাকি?

সঙ্গে সঙ্গে ধক ধক শব্দ করে উঠল ইঞ্জিন।
সন্ধের একটু পরেই আকাশের অন্ধকার কাটিয়ে চাঁদ উঠল। এখন আর মেঘও নেই। ফুরফুরে হাওয়ায় ঠান্ডা হবে।

এই দ্বীপের জেটিটা একেবারে ভাঙা। কাকাবাবু খুব কায়দা করে বোটটা সেখানে ভেড়ালেন। তবু খানিকটা জলে পা দিয়েই নামতে হল।

ওপরে এসেই রাধা জিজ্ঞেস করল, এখানে কচ্ছপ নেই?

সেলিম বললেন, খুঁজে দেখতে হবে। তবে সব জায়গায় কচ্ছপ আসে না। ওদের স্বভাবই হচ্ছে, প্রতি বছর ঠিক এক জায়গায় ডিম পাড়তে আসে।

সন্তু জিজ্ঞেস করল, কচ্ছপের ডিম খাওয়াও কি নিষেধ?

কাকাবাবু বললেন, সঙ্গে এত হাঁস-মুরগির ডিম আছে, এর ওপর আবার কচ্ছপের ডিম খেতে চাস?

জোজো বলল, আমি একটা টেস্ট করে দেখব। কচ্ছপের ডিম পিং পং বলের মতন, তাই নয়?

জিনিসপত্রগুলো সব নামানো হল বোট থেকে। মোট দুটো চর্চও আছে দলটির সঙ্গে।

কমান্ডোটির নাম প্রসন্ন। সেলিম তাকে আগে আগে যেতে বললেন।

ওপরের মাটি ভিজে ভিজে। কাকাবাবু টর্চ জ্বেলে দেখতে লাগলেন মাটি। কারুর পায়ের ছাপ কিংবা কোনও কিছু টেনে নিয়ে যাওয়ার দাগ নেই।

ভাঙা বাড়িটার কাছে পৌঁছতে বেশিক্ষণ লাগল না।

বাইরে দাঁড়িয়ে সেলিম চিৎকার করে বললেন, আমরা পুলিশের লোক। ভেতরে কেউ থাকলে বেরিয়ে এসো।

এরকম তিনবার বলার পরেও কোনও সাড়া পাওয়া গেল না।

সেলিম এবার সামনের দরজাটা জোরে ঠেলতেই সেটা খুলে গেল। ভেতরে টর্চ ফেলে বললেন, কেউ নেই। মেঝেতে ধুলো জমে আছে। কোনও জীবজন্তু ঢোকেনি।

এবার সবাই ঢুকে পড়লেন ভেতরে।

বাড়িটি একসময় দোতলা ছিল, কিন্তু ওপরের ঘরগুলো এখন একেবারেই ভাঙা। কোনওটার ছাদ নেই, কোনওটার দেওয়াল ধসে গেছে। তবে নীচে প্রায় চারখানা ঘর ব্যবহার করা যায়।

কাকাবাবু বললেন, মেজেতেই শুতে হবে। ধুলোটুলোর কথা চিন্তা করলে চলবে না।

সন্তু বলল, এখানে গরমও নেই। ঠান্ডাও নেই। আমরা বাইরে মাঠে শুতে পারি না?

সেলিম বললেন, তোমার দেখছি খুব সাহস। তবে প্রথম রাতটাতেই বাইরে শোওয়া ঠিক হবে না।

কাকাবাবু বললেন, যখন-তখন বৃষ্টি আসতে পারে। সেইজন্যই ঘরে শুতে হবে। রবার্টসাহেব বাড়িটা বেশ যত্ন করেই বানিয়েছিলেন। বড় বড় জানলা, সব কাচ ভেঙে গেছে অবশ্য।

সেলিম বললেন, নিশ্চয়ই পাগলাটে লোক ছিলেন। নইলে এরকম নির্জন দ্বীপে এত খরচ করে কেউ বাড়ি বানায়? তাও বাড়িসুদ্ধ পুরো দ্বীপটাই যে চলে যেতে পারে জলের তলায়, সে কথাও ভাবেননি। এ বাড়িটা যে একবার ড়ুবে গিয়েছিল, তার প্রমাণ দেখুন না, দেওয়ালে শ্যাওলা লেগে আছে।

রাধা বলল, আজ রাত্তিরে যদি আবার ড়ুবে যায়?

কাকাবাবু বললেন, তা তো যেতেই পারে। তুমি একটা দ্বীপে থাকতে চেয়েছিলে। অনেক দ্বীপই ড়ুবে যায়। তুমি সাঁতার জানো?

রাধা বলল, হ্যাঁ, খুব ভাল জানি।

সন্তু বলল, জোজোকে নিয়েই মুশকিল হবে। জোজো সাঁতার শেখেনি।

জোজো বলল, তাতে মুশকিলের কী আছে। জল আসছে দেখলেই দৌড়ে গিয়ে বোটে উঠে পড়ব। বোট তো আর ড়ুবছে না। তোমাদের খিদে পায়নি?

কাকাবাবু বললেন, হ্যাঁ, খাওয়ার ব্যাপারটা তাড়াতাড়িই সেরে নেওয়া যাক।

সেলিম বললেন, একটা খুব বোকামি হয়ে গেছে। আমাদের সঙ্গে মাত্র দুবোতল জল আছে। এতে আর কতক্ষণ চলবে এতগুলো মানুষের? চারদিকে। এত বড় সমুদ্র, কিন্তু তার জল তো খাওয়া যায় না। সেই যে কোলরিজের কবিতা আছে, Water, water every where, not a drop to drink.

জোজো বলল, আমাদের বোটে অনেক খাবার জল আছে। অন্তত এক ডজন বোতল।

কাকাবাবু বললেন, খানিকবাদে বোট থেকে জল নিয়ে আসতে হবে। এখন

তো চলুন।

সেলিম বললেন, ডিম তো কাঁচা খাওয়া যাবে না। সেদ্ধ বা ভাজা করতে হবে। তা কী করে হবে?

কাকাবাবু বললেন, এ বাড়িতে তো রীতিমতন রান্নাঘর আছে। একসময় একটা বিজ্ঞানীর দল এসে এখানে থেকেছে, তারা নিশ্চয়ই রান্না করে খেয়েছে।

চলো, সেটা দেখা যাক।

জোজো বললেন, আমি কাঁচা ডিমও খেতে পারি। একবার বালাতেন লেকের ধারে ভূমিকম্পে আটকা পড়ে গিয়েছিলুম। তখন চারদিন শুধু কাঁচা ডিম খেয়ে কাটিয়েছি।

রাধা জিজ্ঞেস করল, বালাতোন লেক কোথায়?

জোজো বলল, হাঙারিতে। তাও জানো না?

সন্তু খুব অবাক হবার ভান করে জিজ্ঞেস করল, ভূমিকম্পে আটকা পড়ে গিয়েছিলি? অনেক বাড়িঘর ভেঙে গিয়েছিল?

জোজো বলল, অনেক, অনেক। আমরা একটা ভাঙা বাড়ির তলায় আটকা পড়ে গিয়েছিলাম, দুবছর আগে ওখানে কী দারুণ ভূমিকম্প হয়েছিল, কাগজে পড়িসনি?

সন্তু বলল, অত বাড়িঘর ভাঙল, আর ডিমগুলো ভাঙল না।

হো হো করে হেসে উঠলেন সেলিম। কাকাবাবুও মুচকি হাসলেন।

জোজো এতে দমবার পাত্র নয়। সে জোর দিয়ে সন্তুকে বললেন, ভাঙবে না কেন? কয়েক হাজার ডিম ভেঙে নষ্ট হয়ে গিয়েছিল, তার মধ্যেও কিছু আস্ত ছিল, সেগুলো বেছে বেছে তুলতে হয়েছে। সে বাড়িটা কী ছিল জানিস? একটা হাঁসমুরগির ফার্ম! হাঁসগুলো সব লেকের জলে ঝাঁপ দিয়েছিল আর মুরগিগুলো পালিয়ে গিয়েছিল জঙ্গলে।

রান্নাঘরে এসে দেখা গেল একটা পাথরের তৈরি উনুন বানানো আছে আর এককোণে পড়ে আছে কিছু কাঠকুটো। সেগুলো একটু ভিজে ভিজে। তবু সেগুলো দিয়েই অতি কষ্টে ধরানো হল উনুন, চায়ের কেটলিতে ফুটিয়ে নেওয়া হল কয়েকটা ডিম।

তারপর ডিম-পাউরুটি আর খেজুর-বাদাম দিয়ে বেশ ভালই খাওয়া হল।

কোনও ঘরেই কোনও খাট কিংবা চেয়ার নেই। তবে জানলাগুলোর সঙ্গে অনেকটা জায়গা, সেখানে উঠে বসা যায়।

কাকাবাবু একটা জানলার ধারে বসে তাকিয়ে আছেন বাইরের দিকে। এবাড়িটা সমুদ্রের বেশ কাছে, তারপরে অনেকখানি খোলা জায়গা। দ্বীপের অন্য প্রান্তটা দেখা যায় না।

কাকাবাবু একসময় বললেন, অশান্ত সমুদ্রের আওয়াজ ছাড়া আর কোনও শব্দ নেই।

নাইড়ুর দূরবিনটা সেলিম রেখে দিয়েছেন, সেটা দিয়ে দেখতে দেখতে বললেন, দূরে কিছু একটা দেখা যাচ্ছে। রায়চৌধুরী সাহেব, আপনি দেখবেন?

কাকাবাবু দূরবিনটা তার কাছ থেকে নিয়ে চোখে লাগালেন। কয়েক মিনিট ধরে দেখে তিনি বললেন, হ্যাঁ, দেখতে পাচ্ছি। ওটা কী বলে মনে হয় আপনার?

সেলিম বললেন, মশাল হতে পারে না?

কাকাবাবু বললেন, ওটা এক জায়গায় নেই। সরে সরে যাচ্ছে।

সেলিম বললেন, মশাল হাতে নিয়ে যদি কেউ দৌড়ায়, তা হলে ওই রকমই। মনে হতে পারে।

আর একটু দেখে কাকাবাবু বললেন, মশাল নিয়ে কে দৌড়বে? কেন দৌড়বে?

সন্তু বলল, আমি ওখানে গিয়ে দেখে আসব?

সেলিম বললেন, না। প্রথম রাত্তিরটা বাইরে বেরুবার দরকার নেই। আগে সব কিছু বুঝে নেওয়া যাক। পালা করে রাত জেগে পাহারাও দিতে হবে।

রাধা এরই মধ্যে ঘুমিয়ে পড়েছে। জোজোরও চোখ জুড়ে আসছে।

কাকাবাবু বললেন, ওই অস্পষ্ট আলোটা যদি মশাল হয়, তা হলে কেউ একটা ছোট্ট জায়গায় ওটা নিয়ে একবার এদিক একবার ওদিক যাচ্ছে। ব্যায়াম করছে নাকি?

সেলিম বললেন, একটা আলো তো দেখা যাচ্ছে ঠিকই।

কাকাবাবু বললেন, অন্ধকার রাত্তিরে যদি সমুদ্রের ধারে বসে থাকেন, তা হলে দেখতে পাবেন, একসময় দূরের ঢেউগুলোর ওপর আলো রয়েছে। ঠিক যেন আলোর মালা।

সেলিম বলল, জানি, ওগুলো ফসফরাস। সমুদ্রের জলে খুব বেশি থাকে, অন্ধকারে জ্বলজ্বল করে। কিন্তু এটা তো জলে নয়, মাটিতে, একটু উঁচুতে।

কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, আপনি উইল-ও-দা-উইল্প কাকে বলে জানেন? কিংবা জ্যাক-ও-ল্যানটার্ন?

সেলিম বললেন, না, জানি না তো?

কাকাবাবু বললেন, আমরা বাংলায় একে বলি আলেয়া। অগভীর জলাভূমি, যেখানে মানুষজন বেশি যায় না, সেখানে এই আলেয়া দেখা যায়। নির্জন মাঠের মধ্যে অনেকে এই দেখে ভূতের ভয় পায়। কেউ ভাবে ঘোমটা দেওয়া পেত্নি, কেউ ভাবে মানুষ নেই, তবু শূন্যে মশাল জ্বলছে। কেউ বা সাহস করে ওটাকে ধরতে যায়। কিন্তু ওটাকে ধরা তো যায়ই না। ওর দিকে এগোলেই দূরে সরে যায়। যেমন সমুদ্রের ঢেউয়ের মাথায় ফসফরাসের আলো কি ধরা যায়? এই আলোও আসলে ফসফরাস, তার সঙ্গে হাইড্রোজেন মিশে যে গ্যাস হয়, সেই গ্যাসটাকেই এক-এক সময় আলোর মতন মনে হয়। সেই আলোটা লাফায়, ঠিক যেন মনে হয় নাচছে, কিংবা মানুষের মতন দৌড়োচ্ছ। নির্জন রাত্রিতে তা দেখে ভয় লাগতেই পারে। প্রকৃতির কত বিচিত্র রূপ।

দূরবিন দিয়ে আর একবার দেখে নিয়ে কাকাবাবু আবার বললেন, অবশ্য এই আলোটা আলেয়া নাও হতে পারে। কাল দিনের বেলা জায়গাটা পরীক্ষা করে দেখতে হবে। আপনি আর আমি যাব।

সেলিমের কাছ থেকে কোনও সাড়াশব্দ না পেয়ে কাকাবাবু তাকিয়ে দেখলেন। সেলিম দেওয়ালে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছেন। সন্তু জোজো সবাই শুয়ে পড়েছে মাটিতে।

কাকাবাবুর একবার হাই উঠল।

তিনি অবাক হয়ে ভাবলেন, এত তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ল সবাই? রাত তো বেশি হয়নি।

হাওয়ার তেজ বেড়েছে, শোঁ শোঁ শব্দ হচ্ছে।

কমান্ডোটি বাইরে বসে আছে। কাকাবাবু একবার ভাবলেন, তার সঙ্গে কথা বলবেন।

কিন্তু তাঁরও খুব ক্লান্ত লাগল। সারাদিন কম ধকল তো যায়নি। তা ছাড়া দুশ্চিন্তা ছিল খুব। সেসব মিটে গেছে বলেই শরীরটা বিশ্রাম নিতে চাইছে।

কাকাবাবু ভাবলেন, কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে নেওয়া যাক। প্রতি রাত্তিরেই তাঁর দু-তিনবার ঘুম ভাঙে। মাঝরাতে উঠে কমান্ডোকে ছুটি দিয়ে তিনি পাহারা দেবেন।

সেই জানালার রেলিং-এ হেলান দিয়েই ঘুমিয়ে পড়লেন কাকাবাবু।

সকালের আলো চোখে লাগবার পর তাঁর ঘুম ভাঙল।

প্রথমেই তাঁর লজ্জা হল। রাত্তিরে একবারও জাগেননি, কমান্ডোকে ছুটি দেওয়া হয়নি।

সন্তুরা সবাই এখনও ঘুমিয়ে আছে।

কাকাবাবু তাড়াতাড়ি বাইরে এসে দেখলেন, অস্ত্রটা পাশে রেখে কমান্ডোও দিব্যি ঘুমোচ্ছে নাক ডাকিয়ে। এই তার পাহারা দেওয়ার ছিরি।

রাত্তিরে অবশ্য কিছুই ঘটেনি। দিনের আলোয় পুরো দ্বীপটা খালি পড়ে আছে, কোনও জনপ্রাণীর চিহ্ন নেই। দূরে দেখা যাচ্ছে সমুদ্র।

ঘরে এসে কাকাবাবু সন্তুর নাম ধরে ডাকতেই সে উঠে বলল। দুহাতে চোখ মুছতে মুছতে বলল, এ কী, সকাল হয়ে গেছে!

কাকাবাবু বললেন, খুব ঘুমিয়েছিস!

সন্তু বলল, কখন যে ঘুমিয়ে পড়লুম, টেরই পাইনি। সন্তু ডেকে তুলল জোজোকে, একে একে সবাই উঠল।

সেলিমও খুব লজ্জা পেয়ে গেছেন। ক্ষমা চাইবার ভঙ্গিতে কাকাবাবুকে বললেন, ছি ছি ছি, আমারও পাহারা দেবার কথা ছিল, শরীরটা যে এত ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল, বুঝতে পারিনি। আপনি অনেকক্ষণ জেগেছিলেন, তাই না?

কাকাবাবু বললেন, আমিও একটানা ঘুমিয়েছি। আপনার লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই।

সেলিম চলে গেলেন চা বানাতে। অন্যরাও রান্নাঘরে গিয়ে ভিড় করল, শুধু কাকাবাবু বসে রইলেন জানালার বেদিতে। তাঁর কপাল কুঁচকে গেছে।

চা এল কাগজের গেলাসে। তাতে চুমুক দিতে দিতে সেলিম বললেন, যাই বলুন, এমন চমৎকার গাঢ় ঘুম বহুদিন হয়নি। শরীরটা বেশ ঝরঝরে লাগছে।

কাকাবাবু বললেন, ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমোবার মতন, তাই না?

সেলিম বললেন, ঠিক বলেছেন। প্রায় অজ্ঞান হওয়ার মতন ঘুম।

কাকাবাবু গম্ভীরভাবে বললেন, অথচ আমরা কেউই ঘুমের ওষুধ খাইনি। সবাই মিলে একসঙ্গে ঘুমিয়ে পড়াটা মোটেই স্বাভাবিক নয়। যতই ক্লান্তি থাক, আমি কখনও সারা রাত একটানা ঘুমোতে পারি না। অথচ কাল একবারও জাগিনি। এটা জোজোদের বোটের মতন ব্যাপার নয়।

সেলিম বিস্মিতভাবে বললেন, সবাই একসঙ্গে একটানা ঘুমিয়েছি? কী করে এমন হল?

কাকাবাবু বললেন, তা আমিও জানি না।

সন্তু জিজ্ঞেস করল, কাকাবাবু, তুমি একটা বাঁশির আওয়াজ শুনেছিলে?

কাকাবাবু বললেন, বাঁশির আওয়াজ? না শুনিনি।

সন্তু বলল, সত্যি শুনেছি, না স্বপ্ন দেখেছি, তা জানি না। তবে মনে হচ্ছিল, হাওয়ার শব্দের সঙ্গে খুব মৃদুভাবে বাঁশির মতন একটা কিছু বাজছে।

রাধা বলল, আমিও শুনেছি বাঁশির আওয়াজ।

সন্তু বলল, দুজনে একই জিনিস শুনলে তো তা স্বপ্ন হতে পারে না।

কাকাবাবু বললেন, কে বাঁশি বাজাবে? কেউ তো ছিল না?

জোজো বলল, অনেকে মনে করে, ভূতেরা বাঁশি বাজাতে পারে না। কিন্তু জার্মানিতে একটা ভূতের বাড়িতে আমি নিজের কানে শুনেছি। সে বাঁশি শুনলেই ঘুম পায়।

জোজোর কথায় পাত্তা না দিয়ে সেলিম বললেন, বাঁশি বাজুক আর না বাজুক আমরা একসঙ্গে ঘুমিয়ে পড়েছি, এটা একটা রহস্যময় ব্যাপার। চলুন, কাকাবাবু, আগে আমরা কাল রাতের সেই আলেয়ার জায়গাটা দেখে আসি।

মুখটুখ ধুয়ে তৈরি হয়ে সবাই মিলে গোটা দ্বীপটাই ঘুরে দেখা হল। কোথাও মানুষ থাকার কোনও চিহ্ন নেই। এক জায়গায় কিছু গাছপালা আছে, সেখানে কিছু কিছু পুরনো গাছের ডাল মাটিতে পড়ে পচেছে। সেখানকার মাটি বেশ ভিজে ও মাঝে-মাঝে গর্ত, সেই গর্তে জল ভরতি, অর্থাৎ দ্বীপের এই দিকটায় মাঝে-মাঝেই সমুদ্রের জল উঠে আসে। কয়েকটা মরা মাছও দেখা

গেল।

নরম মাটিতে কাকাবাবুর ক্রাচ গেঁথে গেঁথে যাচ্ছে। তাঁর অসুবিধে হচ্ছে হাঁটা-চলায়।

সন্তু বলল, কাকাবাবু, আমি আর জোজো একটু এগিয়ে যাব। সমুদ্রে স্নান করে আসব।

কাকাবাবু বললেন, যা, জোজোর হাত ধরে থাকিস। তবে, সেই চশমা তো নেই, স্নরকেলিং করার সুবিধে হবে না।

রাধাও চলে গেল ওদের সঙ্গে।

সেলিম বললেন, এই ঘুমের ব্যাপারটা বেশ ভাবিয়ে তুলল। যদি কেউ আমাদের ঘুম পাড়িয়ে থাকে, তবে তার উদ্দেশ্য কী? আমাদের তো কোনও ক্ষতি করেনি।

কোনও মন্তব্য না করে কাকাবাবু বললেন, হুঁ।

সেলিম বললেন, এমনও হতে পারে। এখানকার বাতাসে কোনও জীবাণু বা বীজাণু আছে, কোনও ভাইরাস, তাতে বেশিক্ষণ নিশ্বাস নিলেই ঘুম পায়।

কাকাবাবু বললেন, এমন কোনও ভাইরাসের কথা আমি কখনও শুনিনি।

সেলিম বললেন, হয়তো আর কোথাও নেই, শুধু এখানেই আছে। এই কথাটা একবার রটে গেলে এখানে ঝাঁকে ঝাঁকে টুরিস্ট ছুটে আসবে। শুধু ভাল করে ঘুমোবার জন্য।

কাকাবাবু বললেন, সেটা খুব ভাল হবে না। এখানে কোরাল রিফ আছে। আপনি জানেন? বেশি লোক এলে তা নষ্ট হয়ে যাবে!

সেলিম বললেন, কোরাল রিফের কথা শুনিনি তো?

কাকাবাবু বললেন, দুপুরের দিকে আমিও সমুদ্রে নামব। তখন আপনাকে দেখাব।

বাড়িটাতে ফিরে এসে কাকাবাবু বললেন, আর একবার চা কিংবা কফি খেলে হয় না? এবার আপনি বসুন, আমি বানিয়ে আনছি।

সেলিম বললেন, না, না, রান্নাটা আমার দায়িত্ব। আপনি বসুন। আকাশ পরিষ্কার ছিল, হঠাৎ ঘনিয়ে এল মেঘ। তারপরই ঝড় উঠল। সমুদ্রে এরকম যখন তখন ঝড়বৃষ্টি হয়। কিন্তু এখানে মেঘ যেন দৌড়োচ্ছে, এক এক জায়গায় মেঘের মধ্যে ঝড়ের তোলপাড় হচ্ছে, এ দৃশ্য সব সময় দেখা যায় না।

একবারও মেঘের গর্জনও শোনা গেল না, দেখা গেল না বিদ্যুতের ঝলক।

এরকম ঝড় বোধহয় শুধু সমুদ্রের মধ্যে কোনও দ্বীপে বসেই দেখা যায়।

কাকাবাবু সন্তুদের জন্য চিন্তিত হয়ে পড়লেন। ওরা এখনও জলের মধ্যে থাকলে এই ঝড় ওদের অনেক দূরে টেনে নিয়ে যেতে পারে। তিনি জানলার দিকে চেয়ে রইলেন।

সেলিমও বললেন, ছেলে-মেয়েরা সমুদ্রে গেল..এই ঝড়ের মধ্যে…

সন্তুরা প্রায় তখনই ফিরে এল দৌড়াতে দৌড়োতে।

কাকাবাবু স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন।

রাধা বলল, আকাশের অবস্থা দেখে আমি কিন্তু জলে নামিইনি।

জোজো বলল, ঝড়ের সময় সমুদ্রে স্রোত খুব বেড়ে যায়। আমাদের আর একটু হলে স্রোতের টানে ভেসে যেতে হত। আমি এর মধ্যেই অনেকটা সাঁতার শিখে গেছি।

সন্তু একেবারে গম্ভীর। কোনও কথাই বলছে না।

একটু পরে কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, তোর কী হয়েছে রে সন্তু?

সন্তু কেমন যেন ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল। তারপর আস্তে আস্তে বলল, কাকাবাবু, আমি তোমাকে একটা কথা বলব। এখানে না। তুমি একটু পাশের ঘরে আসবে?

কাকাবাবু একটু অবাক হয়ে বললেন, কেন, পাশের ঘরে যেতে হবে কেন? যা বলবার, এখানে বল না!

সন্তু তবু চুপ করে রইল।

কাকাবাবু সেলিমের দিকে তাকিয়ে বললেন, লোকজনের সামনে কানে কানে কথা বলা কিংবা একপাশে ডেকে গোপন কথা বলা খুবই অভদ্রতা। আমি একদম পছন্দ করি না। সন্তু তা জানে। তবু যখন ও জোর করছে, নিশ্চয়ই কোনও কারণ আছে। কিছু মনে করবেন না।

তিনি সন্তুকে নিয়ে পাশের ঘরে চলে গেলেন।

সন্তু মুখ নিচু করে বলল, ওদের সামনে কিছু বলতে চাইনি, কেউ বিশ্বাস করবে না, শুনে হয়তো হাসবে। তুমিও বিশ্বাস করবে কি না জানি না!

কাকাবাবু সন্তুর কাঁধে হাত দিয়ে নরম গলায় বললেন, আমি কি তোর কোনও কথায় অবিশ্বাস করতে পারি?

সন্তু বলল, আমি জলে ড়ুব দিয়ে কোরালগুলো দেখছিলাম, হঠাৎ একটা ব্যাপার হল। আমি তার কোনও মানেই বুঝতে পারছি না। ড়ুবসাঁতার কাটছি, এক জায়গায় কীসের সঙ্গে যেন খুব জোরে আমার মাথা ঠুকে গেল। অথচ সেখানে কিছু নেই। পাথর নেই, এমনকী কোনও মাছও নেই, শুধু জল। সেই জলই যেন পাথরের মতন কঠিন। আমি আবার সেখানটায় যেতেই আবার ধাক্কা, এবার ছিটকে গেলাম দূরে, মাথায় বেশ লেগেছে। যেন একটা পাথরের দেওয়ালের সঙ্গে…অথচ দেওয়াল-টেওয়াল কিছু নেই।

সন্তু কপালের এক পাশে হাত দিয়ে দেখিয়ে বলল, এইখানটায় খুব লেগেছে!

কাকাবাবু দেখলেন, সন্তুর কপালের সেইখানটা ফুলে গেছে, রক্ত জমে কালচে দেখাচ্ছে।

সন্তু জিজ্ঞেস করল, জল তো পাথরের মতন শক্ত হতে পারে না। তবে কি আমার মনের ভুল?

কাকাবাবু বললেন, মনের ভুল হলে কপাল ফুলে যায় না। শোন সন্তু, আমারও ঠিক এইরকম হয়েছিল। আগের দিন, জলের নীচে কিছুর সঙ্গে আমারও জোর ধাক্কা লেগেছিল, কিন্তু সেখানে পাথরটাথর কিছু ছিল না। শুধু জল। আমারও একবার খটকা লেগেছিল। জল যদি বরফ হয়ে জমে যায়, তাতে ধাক্কা লাগতে পারে, বরফ অনেক সময় পাথরের মতনই শক্ত হয়, কিন্তু বরফরফ কিছু ছিল না।

সন্তু যেন খানিকটা স্বস্তি পেয়ে বলল, তোমারও এরকম হয়েছিল। সত্যি? কী করে হয় এমন?

কাকাবাবু বললেন, আমিও বুঝতে পারছি না। সেদিন থেকে ভেবে চলেছি। আবার ঠিক ওই জায়গাটায় নেমে দেখতে হবে।

সন্তু বলল, কাকাবাবু, দ্বিতীয়বার আমার মনে হয়েছিল, শুধু ধাক্কা লাগেনি। কেউ বা কিছু আমাকে ঠেলে দিল। জ্যান্ত কিছু। অথচ দেখা যাচ্ছে না। অদৃশ্য কোনও প্রাণী হতে পারে?

কাকাবাবু বললেন, পৃথিবীতে অদৃশ্য কোনও প্রাণী আছে বলে তো শোনা যায়নি। অদৃশ্য শক্তি আছে। যেমন ধর ইলেকট্রিসিটি। যেমন মাধ্যাকর্ষণ। চুম্বকের টানও এইরকম। জলের মধ্যে ইলেকট্রিক ফিল্ড তৈরি হতে পারে কিনা, তা জানি না। কোনও বিজ্ঞানীকে জিজ্ঞেস করতে হবে। তার আগে আমি ওই জায়গাটায় গিয়ে দেখব।

সন্তুর হাত ধরে সামনের ঘরে নিয়ে এসে কাকাবাবু বললেন, সেলিমসাহেব, সন্তু আপনাদের সামনে কথাটা বলতে চায়নি, কারণ আপনারা হয়তো বিশ্বাস করতেন না। তবু আপনাদের জানা উচিত। জলের অনেকটা নীচে সন্তুর গায়ে কোনও একটা কঠিন জিনিসের সঙ্গে ধাক্কা লেগেছিল, অথচ সেখানে কিছুই ছিল না, জল ছাড়া। সন্তু এটা বানায়নি। এরকম অভিজ্ঞতা আমারও হয়েছে।

জোজো বলল, ও বুঝেছি। ইলেকট্রিক ফিশ। এক ধরনের ইল মাছ। কাছাকাছি গেলেই কারেন্ট মারে।

সন্তু বলল, সেখানে কোনও মাছই ছিল না। ইল মাছ কি অদৃশ্য হতে পারে নাকি?

জোজো বলল, হ্যাঁ, পারে। ইল মাছ নিজেই নিজের শক খেয়ে মাঝে মাঝে অদৃশ্য হয়ে যায়। একবার বারমুডা ট্রায়াঙ্গলের কাছে পাঁচজন নাবিক ইলেকট্রিক শক খেয়ে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল, অথচ সেখানে কিছুই ছিল না। পরে, জানা গেল, ওটা অদৃশ্য ইল মাছের কাণ্ড।

রাধা দুদিকে মাথা দুলিয়ে বলল, না, ভাই, আমি বইতে পড়েছি, ইল মাছ নিজে কখনও শক খায় না। মাকড়সা যেমন নিজের জালের আঠায় আটকা পড়ে না। আর শক খেলেও কেউ অদৃশ্য হতে পারে না। কোনও প্রাণীর পক্ষে সম্ভব নয়।

জোজো বলল, হ্যাঁ, সম্ভব। অনেক প্রাণীই অদৃশ্য হতে পারে। যেমন জোনাকি, যেমন মশা, যেমন চোখ গেল পাখি, আর ভূত হলে তো কথাই নেই। মাছেরাও, মানে খুব বড় মাছও মরে গেলে ভূত হয়। একবার সিডনিতে…

সন্তু বলল, বারমুডা ট্রায়াঙ্গলের সব গল্পই বানানো। আর জোজো, তোর মাছভূতের গল্পও আমরা এখন শুনতে চাই না। এটা সিরিয়াস ব্যাপার।

সেলিম মুগ্ধ দৃষ্টিতে জোজোর দিকে তাকিয়ে বললেন, এ ছেলেটির তো দারুণ ক্ষমতা। চোখের নিমেষে গল্প বানাতে পারে।

কাকাবাবু বললেন, ঝড় থামলে আমি ওখানকার জলে নেমে দেখব।

সেলিম বাইরের দিকে তাকিয়ে বললেন, এ ঝড় থামবার তো কোনও লক্ষণই নেই।

কাকাবাবু বললেন, তবু কমে আসছে।

সন্তু বলল, কারা যেন আসছে এদিকে।

দরজার বাইরে দাঁড়ানো কমান্ডোটিও বলল, কিছু লোক আসছে। ফায়ার করব?

কাকাবাবু বললেন, না, না, আগেই গুলি ছুড়ো না। কাছে আসুক একটু।

ঝড়ের মধ্যে কোনওরকম মাথা ঢাকা দিয়ে দুলে দুলে আসছে দুজন। তাদের মুখ দেখা যাচ্ছে না।

কাকাবাবু আর সেলিমও রিভলভার বার করে জানলাটার দুপাশে দাঁড়িয়ে পড়লেন।

আর একটু কাছে আসার পর সেই আগন্তুকদের একজন চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করল, এনিবডি হোম? এনিবডি?

কাকাবাবু অবাক হয়ে বললেন, এ কী, এ তো আমার বন্ধু নরেন্দ্র ভার্মার গলা।

সে দারুণ অসুস্থ, সে আসবে কী করে?

জোজো বলল, অন্য কেউ নরেন্দ্রকাকার গলা নকল করতে পারে। আমি তো আমাদের প্রধানমন্ত্রীরও গলা নকল করতে পারি।

কাকাবাবুও চেঁচিয়ে বললেন, আপনারা কে? মাথার ওপর হাত তুলে এগিয়ে আসুন।

ওদের একজন বলল, আমি দুঃখিত। আমার পক্ষে হাত তোলা সম্ভব নয়!

তারপর হেসে উঠল হা-হা করে।

এবার দেখা গেল, সত্যিই নরেন্দ্র ভার্মা আর তাঁর সঙ্গে নাইড়ু। নরেন্দ্র ভার্মার একটা হাত নিয়ে কাঁধ ও বুকজোড়া মস্ত ব্যান্ডেজ। নাইড়ুর হাতে একটা রাইফেল।

কাকাবাবু এখনই অবিশ্বাসের সুরে বললেন, নরেন্দ্র, তুমি! এই অবস্থায় এলে কী করে?

নরেন্দ্র ঘরের মধ্যে এসে বললেন, কেমন আছ তোমরা সবাই দেখতে এলাম। রাজা, আমার হাতে গুলি লেগেছে। পায়ে তো কিছু হয়নি। আর বাঁ হাত দিয়েও

আমি রিভলভার চালাতে পারি।

কাকাবাবু নাইড়ুর দিকে তাকিয়ে বললেন, এই ঝড়ের মধ্যে আপনারা বোট চালিয়ে এলেন কী করে?

নাইড়ু বললেন, একটা অদ্ভুত ব্যাপার ঘটছে। আমরা এতখানি বোট চালিয়ে এলাম, সমুদ্রে কোথাও ঝড়-বৃষ্টি নেই। শুধু এত ঝড় এই দ্বীপটায়। এটা কী করে সম্ভব?

নরেন্দ্র বললেন, হতে পারে। প্রকৃতির মধ্যে এখনও এমন অনেক কিছু হয়, যার আমরা ব্যাখ্যা জানি না। রাজা, শোনো, একটা ভাল খবর আছে। তোমরা রকেট হায়দরাবাদি আর অন্যদের গ্রেফতার করেছ, দারুণ সাহস দেখিয়েছ।

কাকাবাবু বললেন, আমরা কিছুই করিনি। ওরা ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে ধরা দিয়েছে।

নরেন্দ্র বললেন, শোনোই না। ওদের আসল উদ্দেশ্য ছিল অন্য। জোজোকে তুলে নিয়ে গিয়ে ওরা আমাদের দৃষ্টি এদিকে ফিরিয়ে রাখতে চেয়েছিল। আর দলের অন্য লোক প্ল্যান করেছিল, জেল থেকে ডিমেলোকে উদ্ধার করে নিয়ে যাবে। এটা একটা পুরনো কায়দা। অনেক জায়গাতেই ক্রিমিনালরা একদিকে নজর ঘুরিয়ে রেখে অন্য দিকে একটা বড় কাণ্ড করে। সেইটা আঁচ করে কাল একটা ফাঁদ পাতা হয়েছিল। ডিমেলোকে জেল থেকে কোর্টে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল, একটা গাড়িতে, সঙ্গে একজন মাত্র গার্ড। ঠিক এক জায়গায় অন্য একটা গাড়ি এসে পাঁচজন বন্দুকধারী ডিমেলোকে উদ্ধার করতে গেল। পুলিশ কমিশনার দুগাড়ি পুলিশ নিয়ে তৈরি ছিলেন, সব কটাকে জালে তোলা হয়েছে। ওদের পুরো দলটাই এখন শেষ! রাজা, এর জন্য তোমার কৃতিত্ব অনেকখানি!

কাকাবাবু বিরক্তভাবে বললেন, ধ্যাত। লোকে শুনে বিশ্বাস করবে যে কয়েকটা সাংঘাতিক ক্রিমিনাল সন্ধে হতেনা-হতেই ঘুমিয়ে পড়েছিল, আর আমরা তাদের হাতে হাতকড়া পরিয়ে দিয়েছি। একথা শুনলে লোকে হাসবে। আসল রহস্যটা কিছুই বোঝা যাচ্ছে না।

নরেন্দ্র বললেন, তোমরা কাল রাত্তিরে কী দেখলে বলল। নতুন কিছু ঘটেছে?

সেলিম বললেন, আমরা দূরে কয়েকটা আলো দেখেছি মাত্র। আর কিছুই না। কোনও শব্দ শুনিনি। কেউ আমাদের ঘুমের ব্যাঘাত করেনি।

কাকাবাবু বললেন, কেন আমরা সাত তাড়াতাড়ি এক সঙ্গে ঘুমিয়ে পড়লাম, সেটা বলুন! সেটা মোটেই স্বাভাবিক নয়।

রাধা বলল, আর সেই বাঁশির শব্দ?

নরেন্দ্র বললেন, বাঁশি? বাঁশি কে বাজাল?

কাকাবাবু বললেন, তা জানি না। ঝড়ের শব্দও হতে পারে। তা ছাড়া, এখানে জলের তলাতেও এমন কিছু ঘটেছে—

নাইড়ু এবার বললেন, মিস্টার রায়চৌধুরী, ওসব কথা পরে শুনব। আমাদের মন্ত্রীমশাই আমার ওপর খুব রাগ করেছেন। দুটি অল্পবয়েসি ছেলে, একটি মেয়ে, তা ছাড়া আপনি, মানে, আপনার একটা পা ভাঙা, আপনাদের আমি এই দ্বীপে রেখে গেছি শুধু সেলিমের ভরসায়, এটা খুবই অন্যায় হয়েছে। যদি আপনাদের কোনও বিপদ হয়, তা হলে সবাই আমাদের সরকারকে দোষ দেবে। তাই আমার ওপর অর্ডার হয়েছে, আপনাদের যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ফিরিয়ে নিয়ে যেতে হবে। তৈরি হয়ে নিন, আমরা এক্ষুনি যাব।

কাকাবাবু বললেন, বিপদ তো কিছু হয়নি। এত ভয়ের কী আছে?

নাইড়ু বললেন, বিপদ হলে তো মুখ দেখাবার উপায় থাকবে না? এখানে যা যা ঘটছে, তা তো স্বাভাবিক নয় মোটেই! আমাকে গভর্নমেন্টের অর্ডার মানতেই হবে।

কাকাবাবু বললেন, এই ঝড়ের মধ্যে যাবে কী করে। এখন বোট চালানোও তো বিপজ্জনক।

নরেন্দ্র ভার্মা বললেন, এই ঝড়টাও তো অদ্ভুত। বোটে চেপে একটুখানি গেলেই আর ঝড় নেই।

কাকাবাবু বললেন, আমার এখন যাবার ইচ্ছে নেই!

নরেন্দ্র বললেন, রাজা, তুমি না গেলে সন্তু আর জোজোও যেতে চাইবে না। আমি জানি। শোনো, তুমি আর আমি বিপদ নিয়ে খেলা করতে পারি। কিন্তু ওদের জীবনের ঝুঁকি নেওয়া চলে না। বিশেষত যে বিপদকে চোখে দেখা যাচ্ছে না।

কাকাবাবু বুঝলেন, আর তর্ক করে লাভ নেই।

সব জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়ে কয়েক মিনিটের মধ্যেই বেরিয়ে পড়া গেল। ঝড় এখনও চলছে। সঙ্গে সামান্য বৃষ্টি, তবে বড় বড় ফোঁটা। মেঘের কোনও শব্দ নেই।

ওঁরা লাইন বেঁধে এগোচ্ছেন বোটের দিকে, একেবারে সামনে কমান্ডো আর পেছনে সেলিম।

হঠাৎ এক জায়গায় দপ করে আলো জ্বলে উঠল। খুব বেশি দূরে নয়। এত ঝড়ের মধ্যেও মশালের মতন আলো। একটু একটু কাঁপছে মাত্র। সাধারণ মশাল হলে নিভে যেত। আবার একটা আলো জ্বলে উঠল। আরও একটা।

সব মিলিয়ে প্রায় নদশটা মশালের মতন। কারা যেন হাতে নিয়ে চলেছে, অথচ কাউকেই দেখা যাচ্ছে না।

এই দলটি থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল।

সেলিম ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল, কাকাবাবু, এই কি আপনার সেই আলেয়া হতে পারে?

কাকাবাবু দুদিকে মাথা নেড়ে বললেন, না। অন্য কিছু। নাইড়ু বলে উঠলেন, স্ট্রেঞ্জ! স্ট্রেঞ্জ! ওদিকে দেখুন।

সেই আলোগুলো পর পর নেমে গেল সমুদ্রে, আবার সমুদ্র থেকে উঠে আসতে লাগল আলো।

নরেন্দ্র বললেন, এ আলোতে আগুন নেই। জলেও নেভে না।

জল থেকে উঠে এসে কয়েকটা আলো পরপর সার বেঁধে দাঁড়িয়ে গেল। মাটি থেকে খানিকটা উঁচুতে। ঠিক যেন মনে হয়, কয়েকজন সেই মশাল ধরে আছে।

নরেন্দ্র বললেন, আমার কেমন যেন অনুভূতি হচ্ছে যে কয়েকজন মানুষ আমাদের দেখছে। অথচ আমরা দেখতে পাচ্ছি না। রাজা, কোনও মানুষ কি সত্যিই অদৃশ্য হতে পারে?

কাকাবাবু আস্তে-আস্তে মাথা নেড়ে বললেন, না। আমরা দেখতে না পেলেও তাকে অদৃশ্য বলা যায় না। যেমন জলের রঙের মধ্যে সাতটা রং লুকিয়ে থাকে, তা কি আমরা সব সময় দেখতে পাই? রামধনু উঠলে দেখি। তেমনি অন্য কোনও রঙের মধ্য দিয়ে দেখলে হয়তো দেখা যেত। ওখানে সত্যিই কিছু মানুষ কিংবা

অন্য কোনও প্রাণী ওই মশাল ধরে দাঁড়িয়ে আছে।

নরেন্দ্র বললেন, তোমারও মনে হচ্ছে কেউ দাঁড়িয়ে আছে? আমাদের দেখছে?

কাকাবাবু বললেন, হ্যাঁ। কিন্তু কোনও শব্দ করছে না। রাধা কাকাবাবুর গা ঘেঁষে দাঁড়াল। তার মুখে ভয়ের ছাপ।

জোজো বলল, আমি দেখতে পাচ্ছি। অন্য গ্রহের প্রাণী। অনেকটা মানুষেরই মতন।

নরেন্দ্র বললেন, জোজো, এখন চুপ করো। হঠাৎ সন্তু ছুটে গেল সেই মশালগুলোর দিকে। নরেন্দ্র চেঁচিয়ে বললেন, এই সন্তু, যেয়ো না, যেয়ো না! সন্তু শুনল না। সে দৌড়ে গিয়ে একটা মশাল ধরতে গেল। সঙ্গে সঙ্গে মশালটা উঠে গেল একটু ওপরে। সন্তু লাফিয়ে লাফিয়ে সেটাকে ধরার চেষ্টা করল। তারপরই কে যেন এক ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিল সন্তুকে। সে মাটিতে ছিটকে পড়ে গেল।

নরেন্দ্র বললেন, রাজা আমার কোটের ডান পকেটে একটা সান গ্লাস আছে। সেটা বার করে দেখো তো। কোনও সুবিধে হয় কি না।

কাকাবাবু নরেন্দ্রর সান গ্লাসটা চোখে লাগিয়েই উত্তেজিতভাবে বললেন, হ্যাঁ, দেখতে পাচ্ছি, খুবই অস্পষ্ট। অন্য কোনও রঙের কাচ হলে আরও সুবিধে হত বোধহয়। এখন যা দেখছি, ঠিক যেন কোনও আকার নেই, ঠিক জলের মতন, বরফ না হয়েও যেন জল জমে গেছে, চোখমুখ বোঝা যাচ্ছে না। নরেন্দ্র বললেন, দেখি, দেখি আমাকে একবার দাও তো।

তিনি নেওয়ার আগেই জোজো একটা কাণ্ড করল। সে দুপা সরে গিয়ে মুখ দিয়ে বিকট শব্দ করতে লাগল আর খুব জোরে জোরে ঝাঁকাতে লাগল মাথা। যেন সে পাগল হয়ে গেছে!

নরেন্দ্র বিরক্ত হয়ে বললেন, এখন জোজোর এই সব দুষ্টুমি আমার মোটেই ভাল লাগছে না!

জোজো এত জোরে মাথা ঝাঁকাচ্ছে, যেন তার মাথাটা ছিঁড়ে যাবে। আর এমন সব অদ্ভুত আওয়াজ করছে, টিভির চ্যানেল গোলমাল হলে যেমন আওয়াজ হয়, সেইরকম।

সন্তু উঠে এসে জোজোকে ধরতে যেতে যেতে বলল, এই জোজো। এখন কী ছেলেমানুষি করছিস?

জোজো সরে গেল আরও খানিকটা। কাকাবাবু তার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বললেন, ওকে ছেড়ে দে সন্তু!

জোজো এবার গলা দিয়ে একবার ঘড়ঘড় শব্দ করেই একেবারে স্বাভাবিক গলায় বলল, আমরা তোমাদের কোনও ক্ষতি করব না।

জোজো এই কথাটাই বলতে লাগল বারবার। কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, আপনারা কে? কোথা থেকে আসছেন?

জোজো বলল, আমরা আকাশে অনেক দূরে থাকি। আমরা আকাশে অনেক দুরে থাকি। আমরা আকাশে অনেক দূরে থাকি। তোমাদের ভাষা জানি না। তাই এই ছেলেটির মনের মধ্যে ঢুকে কথা বলছি। আমরা এখান থেকে কিছু কিছু জিনিসের নমুনা নিতে এসেছি। জলের তলায় এখানে অনেক কিছু থাকে, আমাদের ওখানে সেসব নেই।

কাকাবাবু বললেন, আপনাদের পরিচয় আর একটু ভাল করে বলবেন?

জোজো বলল, বিদায়, বিদায়, বিদায়। সঙ্গে সঙ্গে শোনা গেল খুব হালকা একটা বাঁশির শব্দ। ভারী মিষ্টি আওয়াজ। কয়েক মুহূর্তের মধ্যে এরা ধপাধপ শুয়ে পড়তে লাগল মাটিতে। তারপরই ঘুমে আচ্ছন্ন।

কাকাবাবুও মাটিতে পড়ে গিয়ে অতি কষ্টে চোখ খুলে দেখতে চাইলেন। দেখলেন, মশালের মতন আলোগুলো ক্রমেই উঠে যাচ্ছে ওপরে।

তারপর ঘুমিয়ে পড়লেন তিনি।

সবারই প্রায় ঘুম ভাঙল একসঙ্গে। বিকেলের দিকে। ঝড় থেমে গেছে। আকাশ পরিষ্কার, ঝকঝকে নীল।

একে একে উঠে বসলেন, কাকাবাবু, নরেন্দ্র, সেলিমরা।

কাকাবাবু প্রথমেই বললেন, জোজোর কোনও ক্ষতি হয়নি তো। জোজো, শোনো—

জোজো খুব স্বাভাবিক গলায় বলল, কেন ক্ষতি হবে?

সন্তু বলল, কাকাবাবু, জোজো যা করছিল, তা কি সত্যি? জোজো নানা রকম অভিনয় করতে পারে!

জোজো বলল, কী অভিনয় করেছি রে সন্তু আমার কিছু মনে পড়ছে না কেন?

নাইড়ু বলল, এরকম একটা অভিজ্ঞতা, জীবনে ভুলব না। কী যে ব্যাপার হল। হঠাৎ ঘুমিয়ে পড়লাম কেন?

সেলিম বলল, স্যার, সব ব্যাপারটাই রহস্যময়। কিন্তু এমন চমৎকার ঘুম কিন্তু আমার কখনও হয়নি। শরীরটা খুব ঝরঝরে আর মনটা ফুরফুরে লাগছে।

নাইড়ু বললেন, তা ঠিক। জোজো উঠে দাঁড়িয়ে বলল, তোমাদের কারুর খিদে পায়নি? সবচেয়ে রহস্যময় ব্যাপার কী জানিস সন্তু, ঠিক সময়ে কেন খিদে পায়? আর পাউরুটি নেই? আগে তো খানিকটা খেয়ে নিই, তারপর অন্য রহস্যের কথা ভাবা যাবে।

সে কাঁধের ব্যাগ খুলে বলল, আরে, গোটাকতক খেজুরও রয়ে গেছে। চমৎকার।

সে টপাটপ খেজুর খেতে লাগল।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত