অনেক ভেবে চিন্তে অবশেষে সিদ্ধান্ত নিল নুমা। এলোমেলো সব কিছু কে আবার গুছাবে,আর তার শুরুটা এভাবেই হবে। আজকে কেন জানি খুব অভিযোগ করতে ইচ্ছে করছে ওর,খুব ইচ্ছে করছে কিন্তু কার কাছে করবে?…নিজের কাছে? হ্যা,এত গুলো দিন ধরে তো এটাই করে আসছে।সব রাগ,সব ক্ষোভ,সব অভিযোগ নিজের কাছেই জমা রাখছে।সামনে থাকা ছাইয়ের স্তুপের দিকে আবারো তাকালো,অনেকক্ষন ধরে তাকিয়ে থাকল সেদিকে…এই তো সেদিনের কথা,নিশাত এসে বলল, ”দোস্ত,তুই কি জানিস কেউ তোর জন্য দুনিয়া এক করে ফেলতে পারে?”!
আরেকদিন এসে নিশাত বলল, ‘তুই তো সব সময় বলিস এমন কাউকেই সঙ্গী করবি যার কাছে তুই একদিকে আর সারা দুনিয়া এক দিকে তোর কি মনে হয় না এমন কেউ ই সে…” তারপর…তারপরের দিন গুলো যেন ছিল স্বপ্নের মতো,আর এখন মনে হয়,তখন বুঝি আবেগ অনুভুতি সব ভোঁতা হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু যাই হোক,সেই সময় গুলো,অনুভুতি গুলো আজ ও সুখ স্মৃতি হয়ে আছে…অনেক অনেক গল্প,ছোট ছোট অভিমান,রাগ ভাঙ্গানোর চেষ্টা আর স্বপ্ন দেখা…যেন অচিন দেশের রাজকুমারের প্রতিক্ষায় স্বপ্নের জাল বুনে যাচ্ছে রাজকুমারী,ময়ূরপঙ্খী ঘোড়ায় চরে আসবে কবে সেই রাজপুত্র…সোনার কাঠি আর রুপোর কাঠির ছোঁয়ায় স্বপ্ন ঘুমের অবসান করবে…কতশত ছেলে মানুষি চিন্তাই না করতো নুমা… অনেক রাত হয়ে এলো,নুমা জানালা দিয়ে বাহিরে তাকালো,নিকষ কালো আঁধার চারপাশে,যদিও শহুরে বাড়ির আলোয় অন্ধকারের গভীরতা খুব একটা বোঝা যায় না তবু সময় বলে দিচ্ছে রাতের গভীরতা কতখানি।নুমার মনে হয় আজকের রাতের মতোই ছিল সে রাতটা…সব কাজ শেষ করে নুমা অপেক্ষায় ছিল রাফির ফোনের।
ঘড়ির কাঁটা ১২টা পেড়িয়ে যায় কিন্তু রাফির ফোন আসেনা। অস্থির হয়ে উঠে নুমা…এমনতো হবার কথা না!সময় পেড়িয়ে ঘড়িতে যখন ১.৩০টা বাজে তখন সাইলেন্ট করা মোবাইলের স্ক্রিনে রাফির নাম্বারটা ভেসে উঠল।নুমার মনে হল এতক্ষনে ও নিঃশ্বাস নিতে পারছে…দ্রুত ফোন রিসিভ করল।কেন রিসিভ করেছিল ফোনটা…? না করলেই তো মনে হয় ভালো হতো…! নুমার চোখটা আবারো ভিজে উঠে। চোখের জল যেনো বাঁধ মানেনা…নুমা আসলে অনেক চেষ্টা করেও নিজের কান্না আটকে রাখতে পারে না। মাঝে মাঝে মনে হয় কান্না চেপে রাখতে রাখতে ওর বুকটা ভীষন ভারী হয়ে আছে…! কেমন করে সেদিন পেরেছিল রাফি? ওদের তিন বছরের সম্পর্কটাকে গলা টিপে মেরে ফেলতে…!! কেমন করে পেরেছিল?…আবারো ডুকরে কেঁদে উঠে নুমা।
ভার্সিটি এডমিশন টেস্টের কোচিং এ নুমার পরিচয় হয়েছিল বান্ধবি নিশাতের মামাতো ভাই রাফির সাথে।ওর দু’বছরের সিনিয়র ছিল,ওদের কোচিং এর পাশেই একটা স্কুল কোচিং সেন্টারে ক্লাস নিতেন,সে জন্যই ওদের সাথে দেখাটা বেশি হতো। নুমা এমনিতে বান্ধবিদের সাথে অনেক কথা বললেও সহজে সবার সাথে কথা বলতো না খুব,কিন্তু মেধাবি আর অমায়িক ব্যাবহারের কারনে সবার চোখেই ও ভালো মেয়ে ছিল। নিশাতের মা ও নুমাকে খুব আদর করতেন।আস্তে আস্তে নিশাতের পরিবারের সাথে ভালো সম্পর্ক হয়ে যায় নুমার এবং নুমার পরিবারের।নিশাতের যেহেতু কোন বড় ভাই ছিল না সে জন্য নুমা খুব একটা সংকোচ বোধ করতো না। এডমিশন টেস্ট শেষে দু’জন দু’দিকে চলে যায়,নিশাত সিলেটে আর নুমা জগন্নাথে। ফোনের আর ইন্টারনেটে যোগাযোগ ছিল দু’জনেরই। ভার্সিটিতে ক্লাস শুরুর কয়েকদিন পরেই নীলখেতে দেখা হয় রাফির সাথে নুমার।
রাফির একের পর এক প্রশ্ন করে যাওয়া দেখে খুব অবাক হয়েছিল নুমা,যেন অনেকদিন পর পাগলের মতো খুঁজতে থাকা কোন আপনজনকে খুজে পেয়েছে সে! এরপর থেকে প্রায়ই রাফি আসতো নুমার ভার্সিটিতে। ধীরে ধীরে বেশ ভালো সম্পর্ক গড়ে উঠে দু’জনের। নুমার প্রায়ই মনে হতো রাফির চোখের ভাষা ওকে অন্য কিছু বলে,রাফির বলতে বলতে থেমে যাওয়া কথা গুলোর মানে নুমা মনে হয় বুঝতে পারে…কিন্তু কিছুই প্রকাশ করে না নুমা। আসলে নুমা নিজেও মনে মনে রাফিকে পছন্দ করতে শুরু করেছে,রাফির ব্যাক্তিত্ব,চিন্তা,আগ্রহ সব কিছুই অন্যরকম ভালো লাগার অনুভূতি দেয় নুমাকে…মনের অজান্তেই স্বপ্ন দেখে নুমা… কিন্তু নিজেকে সামলে রাখে নুমা। বান্ধবিদের অনেক গল্পই তো দেখেছে সে,নাহ,কোন বিশ্বাস নেই। তাই নিজের অনুভূতি গুলোর সাথে সাথে রাফির অনুভূতি গুলোকেও এভোয়েড করতে লাগল। কিন্তু রাফি শেষ পর্যন্ত নিশাতকে দিয়ে রিকোয়েষ্ট করলো।কেন জানি নিজেকে আর আটকে রাখতে পারেনি নুমা।ভালোবাসা তো মনের ভেতর আটকে রাখার কিছু না…নুমাই বা কেমন করে তা করবে…! লাল রঙের ডায়েরিটা আবারো হাতে নিল নুমা।
এই ডায়েরিটার প্রায় সব গুলো পাতা জুড়ে ওর আর রাফির কথা লেখা…দিন শেষে অনেক আবেগ আর আগ্রহ নিয়ে লিখতো নুমা।আস্তে আস্তে পাতা উল্টাতে থাকে… ” আজ রাফির সাথে বই মেলায় গিয়েছিলাম।অদ্ভুত একটা মানুষ!পাঠ্যপুস্তক ছাড়া আর কোন বইয়ের দিকে তার কোন আগ্রহই তেমন নাই!আর আমি যাও কিনতে যাই খালি বাঁধা দেয়!বলে,এই বই কি পড়বা,ফালতু বই ইত্যাদি ইত্যাদি! উফফ…! নিজেতো পড়ে না আরেকজনকেও পড়তে দেয় না!তবে হ্যাঁ সে থাকাতে অনেক উপকার হয়েছে আজ,অন্যপ্রকাশে এত ভীড় ঠেলা আমাকে ঢুকতে হয়নি,ও নিজে ঢুকে ক্যাটালগ এনে দিয়েছে,বই কিনেছে…পাগল একটা!হিহিহি।” ”আজ প্রথম শাড়ি পড়ে রাফির সাথে ঘুরতে বের হয়েছিলাম। অনেক নার্ভাস লাগছিল! একে তো এই প্রথম শাড়ি পড়ে একা বের হয়েছি তার উপর সাথে রাফি! বাট রাফির মুগ্ধ দৃষ্টি দেখে সব ভয় কেটে গেছে…যাক,মানুষটার দেখার চোখ আছে তাহলে!”
”আজ অনেক অসাধারন একটা দিন…! রাফি,আজ আমার জন্য আমার পছন্দের লাল চুড়ি নিয়ে এসেছিল,সেই সাথে একটা পায়েল। জিনিস গুলো দেখে মনে হচ্ছিল চিৎকার করে রাফিকে বলি,ভালবাসি ভালোবাসি ভালোবাসি…”
”কাল রাফি অষ্ট্রেলিয়া চলে যাবে,গত একমাস ধরে মানুষটার সেকি ব্যাস্ততা! তার সারা জীবনের স্বপ্ন সত্যি হতে চলেছে,কিন্তু একটা বারও আমার চোখের দিকে ভালো করে তাকিয়ে দেখেনি।তাকালে দেখতে পেতো তাকে ছাড়া থাকার কষ্ট কতোটা কাঁদাচ্ছে আমাকে…কেমন যেনো স্বার্থপর মনে হচ্ছে ওকে!একবারো আমার হাতটা ধরে স্বান্তনা দিচ্ছে না,বলছে না,’প্লিজ মন খারাপ করো না,আমি যত দূরেই যাই না কেন,তোমার পাশেই থাকবো’।
” আর পড়তে ইচ্ছে করেনা নুমার,ডায়েরিটা একপাশে ছুড়ে ফেলে দেয়।নুমার আশংকাই সত্যি হয়েছিল।সিডনি যাওয়ার একবছরের মধ্যেই অনেক বদলে গিয়েছিল রাফি,নুমা কোনভাবেই রাফিকে চিনতে পারছিল না!আস্তে আস্তে সম্পর্কে দূরত্ব বাড়তে থাকে,এক সময় এসে সব শেষ… নুমার লাল ডায়েরিটার সব পাতা লেখা শেষ হওয়ার আগেই রাফি আর নুমার ভালোবাসার গল্পের মৃত্যু হয়।তার পর কেটে গেছে আরো এক বছর,নুমা আর নিশাতের সাথে কোন যোগাযোগ করেনি।নতুন করে একা একাই নিজের জীবনটা কে সাজিয়েছে…কিন্তু ভাগ্য বোধহয় অন্যরকম ছিল নুমার। একটা সেমিনারে এটেন্ড করার জন্য ডিপার্টমেন্ট থেকে পাঁচ জনের একটা গ্রুপের টিম লীডার হিসেবে চিটাগাং যায় নুমা। সেমিনারটা তিনদিনের ছিল,সেখানে দেশের বাইরে থেকে আর দেশের সরকারী ভার্সিটিগুলো থেকেও অনেক গুলো প্রুপ এসেছিল। সিলেট থেকে আসা একটা গ্রুপের প্রতিনিধির সাথে ওর পরিচয় হয় ওয়ার্কশপ করতে যেয়ে। মেয়েটার নাম লিরা। বেশ মিশুক আর হেল্পফুল। লাঞ্চব্রেকে অনেক গল্প হয় ওদের মধ্যে,নুমা নিজের সম্পর্কেও অনেক কথা বলে,হঠাৎ কি মনে করে যেন নিশাতের কথা তোলে ও।ডিপার্টমেন্ট,ইয়ার বলতেই লীরা বলে উঠে,
–আরে নিশাত এর কথা বলছ,ঢাকার মেয়ে? হ্যাঁ চিনিতো ওকে,এ বছর বিয়ে হয়েছে। কথাটা শুনে একটু অবাক হয় নুমা! নিশাত একটা বারের জন্য জানালোও না!
–তাই নাকি?কি করে ওর বর?
–বাইরে থাকে,ওরই মামাতো ভাই,কি যেনো নাম…!ও হ্যাঁ,রাফি। নুমার মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠে!!কি শুনছে এসব ও…!
–কি বল?লিরা?রাফির সাথে বিয়ে হয়েছে নিশাতের?!!!
–হ্যাঁ,ওদের তো লাভ ম্যারিজ,কেন? তুমি জানতে না?অবশ্য অনেকদিনের না,রাফি ভাই অস্ট্রেলিয়া যাবার পর ওদের রিলেশন হয়,এ বছর এসে বিয়ে করল,খুব সম্ভবত মাস্টার্স করে নিশাত চলে যাবে!
সেমিনারে এটেন্ড করার কথা,বাট এসেছে কি না জানিনা… আরো কি কি যেন বলছিল লিরা,কিন্তু নুমার কানে আর কিছু ঢুকলো না…খাওয়া শেষ না করেই ক্যান্টিন থেকে পাগলের মতো বেরিয়ে এলো, ওর পেছনে পেছনে লিরাও বের হলো আর ডাকতে লাগল,কিন্তু নুমা কিছুই শুনতে পেল না…একটা সময় চারপাশ অন্ধকার হয়ে আসছে মনে হলো নুমার… চোখ মেলে দেখলো,বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল চেম্বারের আছে সে।পাশে লিরা আর ওর গ্রুপের মেম্বাররা।
ডাক্তার বলল,’তেমন ভয়ের কিছু নেই,হঠাৎ কোন শক্ত মানুসিক আঘাতের কারনে জ্ঞান হারিয়েছিলেন,রেস্ট নিলে ঠিক হয়ে যাবে।’লিরা ভালোভাবেই বুঝতে পেরেছে খুব সম্ভবত রাফিকে নুমা পছন্দ করতো,আর তাই ওর বিয়ের খবর শুনে শকড হয়েছে,কোন না কোন বড় ঘটনা আছে এখানে…কিন্তু বেশি আর ঘাটালো না। নুমা অসূস্থতার অজুহাত দেখিয়ে সেদিনই ঢাকার পথে রওনা হলো। বাসায় ফিরে হাত মুখ ধুয়েই ওর প্রিয় লাল ডায়েরিটা বের করল,সাথে রাফিকে লেখা,নিশাতকে লেখা চিঠি,গিফট গুলো ও রাখল।তারপর রান্না ঘর থেকে ম্যাচ নিয়ে এসে আগুন জ্বালিয়ে দিল জিনিস গুলোতে……নুমা দেখতে পেল,ওর চোখের সামনে রাফির পাশে বধূ বেশে বসে আছে নিশাত…আর দূরে দাঁড়িয়ে আছে নুমা,হাতে লাল ডায়েরিটা। যার শেষ পাতায় লেখা ছিল, ”নিশাত,আমার ভালোবাসা তোকে আমি দান করে দিলাম, আজ থেকে এ ভালোবাসা তোর…রাফি, আজ থেকে তোমাকে মুক্তি দিলাম,মুক্ত হলাম তোমার মিথ্যে বন্ধন থেকে। কিন্তু মনে রেখ,এ ভালোবাসা তোমাদের সুখ দিবে না…কারন এর প্রতিটা কোনায় জড়িয়ে থাকব আমি…আমার আবেগ…হাজার চেষ্টা করলেও পারবে না আমাকে সরাতে…বিবেকের আয়নায় আমি সারা জীবন থাকবো তোমাদের পাশে…”
[উৎসর্গঃপ্রিয় রিজু’পু কে।পৃথিবীতে যেমন এই গল্পের নিশাতদের মতো কিছু স্বার্থপর মানুষ আছে তেমনি নুমার মতো কিছু উদার মানুষ ও আছে…ভালোবাসার মর্যাদা এরাই বুঝতে পারে,নিশাতরা না…]