ঝমঝম করে বৃষ্টি পড়ছে। বর্ষাকালে বৃষ্টি হবে এটাইতো স্বাভাবিক। তবে, নাবিলের কাছে এই বৃষ্টিটা অস্বাভাবিক মনে হচ্ছে। কেনো মনে হচ্ছে তা সেও হয়তো জানে না! এই বৃষ্টিতে নাবিলের সারা শরীর ভিজে একাকার হয়ে গেছে। হাটছে আর চপ চপ করে আওয়াজ হচ্ছে তার জুতো থেকে। পকেটে মোবাইলটা ভিজে গেছে কিনা কে জানে!
এক সপ্তাহও হয়নি মোবাইলটা কেনা। এর আগের মোবাইলটা ছিনতাই হয়েছে। আর এই নতুন মোবাইলটা যদি বৃষ্টির পানিতে ভিজে নষ্ট হয় তাইলে তো শেষ!! মানি ব্যাগে রাখা টাকাগুলোও হয়তো ভিজে গেছে। মুনিয়া বিশহাজার টাকা চেয়েছে। সেই টাকার কিছু অংশ মানি ব্যাগে আর কিছু অংশ প্যান্টের পকেটে। সেই টাকাগুলোও ভিজে গেছে নাকি কে জানে! মুনিয়া! মুনিয়া নাবিলের স্কুল জীবনের বন্ধু।
একদম ঘনিষ্ঠ বন্ধু যাকে বলে। নাবিল প্রায়ই বলে, ওয়ান্স আপন এ টাইম শি ওয়াজ মাই বেষ্ট ফ্রেন্ড। তবে কোনো একটা কারণে, মুনিয়া নাবিলকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে। অনেক বছর পর মুনিয়া প্রবাশ থেকে এসে নাবিলের সাথে যোগাযোগ শুরু করেছে। এতো বছর পর আবার তাদের সম্পর্কটা স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে। তারপরও! একটা ডিস্টেন্স তো থেকেই যায়।
তারা দুজনই অনেক চেষ্টা করে সেই দূরত্বটাকে কমানোর; কিন্তু তা কিছুতেই দূর হতে চায় না। বৃষ্টিটা মনে হয় আস্তে আস্তে একটু কমেছে। একটা হালকা বাতাস বইছে। একটু ঠান্ডা ঠান্ডা লাগছে। নাবিলের একটু শীত লাগছে। জ্বরটা মনে আজ পাকাপাকি করে চলেই আসবে। বৃষ্টিতে আসলে নাবিলের ইচ্ছে করেই ভেজা। ইচ্ছে করেই সে শুধু শুধু বৃষ্টিতে এতোটা পথ হেটেছে।
কারণ, বৃষ্টিতে অনেকদিন তার ভেজা হয় না। অনেক আগেই তা বন্ধ হয়ে গেছে। আসলে সেই স্টুডেন্ট লাইফটাই অসাধারণ। জীবনের সব সখ মেটানোর সময়তো ঐ একটাই। জীবনের সব রোমাঞ্চকর ঘটনা ঘটে সেই লাইফটাতেই। কিন্তু এই চাকরী জীবন হচ্ছে রোবটিক লাইফ। একটা বোরিং লাইফ। স্কুল-কলেজ-ভার্সিটি কত্ত মজার মজার সময় পার হয়েছে। সবাই বলবে এই জীবনটার কথা। ইমোশনাল লাইফ। উপভোগ করবার একটি লাইফ। প্রেমময় লাইফ। হুমম….প্রেম!
যে এই লাইফে প্রেম করে সময় নষ্ট করেনি সেতো লাইফের আসল উত্তেজনাকর মুহূর্তের মুখোমুখি হয়নি। তার জীবনটাইতো বৃথা। তাই বলে নাবিলের জীবনও বৃথা নয়। প্রেমতো জীবনে তার এসেছে বারবার। হাস্যকর! কিন্তু জীবনটা কিন্তু এমনই। বহুবার প্রেমে পড়েনি এমন পুরুষের সংখ্যা খুব কম। কেউ অকপটে স্বীকার করবে আর কেউ একটি ভালোবাসার গল্পই সারাজীবন করে যাবে। পার্থক্যটা এখানেই। নাবিল সেই স্বীকারকরা লোকদের দলে। সে অকপটেই বলে, তার প্রেমের কথা। কত্ত ছেকা সে খেয়েছে সেসব গল্পও ভেসে আসে মাঝে মাঝে। তবে কোনো অপরাধবোধ তাকে কুরে কুরে খেতে পারেনা।
কারণ, জীবনের স্বরণীয় মুহূর্ত তার কাছে এগুলোই। সেই হইহুল্লুর জীবন সে আজও মিস করে। সব অতীত। সেই আগেকার মতো মেয়েদের পেছনে সময় নষ্ট করার মতো সময় এখন আর নেই। সব কিছু এই বয়সে সিলি মনে হয়। যেমন, এই যে, এখন সে বৃষ্টিতে ভিজছে। আগে যখন বৃষ্টিতে ভিজতো তখন ভিজতে গেলেই মনটা উদাস হয়ে যেতো। কেমন যেনো বুকটা ফাকা হয়ে যেতো। বৃষ্টির পানি যেনো কষ্টের মতো শরীরটাকে জড়িয়ে ধরতো। বৃষ্টি কেমন যেনো নিজেকে একা করে দিতো। তার মনে হতো, যদি কেউ একজন পাশে হাতটা শক্ত করে ধরে রাখতো! তবে এখন কিন্তু মোটেও তেমন কিছু ফিল হচ্ছে না। তার মনে হচ্ছে, কেউ পাশে থাকলে হয়তো আমি একা এই ভেজার আনন্দটুকু পতো না। মুনিয়ার বাসার সামনে চলে এসেছে নাবিল। মুনিয়ারা পাঁচ তলায় থাকে। উঠতে উঠতে তার পানির পিপাসা পেয়ে গেছে। এটা নাবিলের পুরোণ অভ্যাস। আগেও মুনিয়ার বাসার সিড়ি বেয়ে সে সমানে হাঁপাতো।
মুনিয়াদের বাসার দরজায় সেই পুরোণ স্টিকারটা দেখে নাবিল একটা মুচকি হাসি দিলো। যেখানে লেখা, আঁতেলদের প্রবেশ নিষেধ। কি আশ্চর্য! এখনও আছে এই স্টিকার! কত্তকিছু পরিবর্তন হলো; অথচ স্টিকারটার কোনো বিকার নেই। কনিংবেল চাপতে চাপতে নাবিল এসব ভাবছিল। মুনিয়া দরজা খুলেই অবাক হয়ে প্রশ্ন, কিরে! তোর না স্বন্ধ্যায় আসার কথা? নাবিল বাইরে দাড়িয়েই উত্তর দিলো, আসলে, অফিস থেকে আজ একটু তাড়াতাড়ি বের হয়ে গেলাম। এবার মুনিয়া হেসে উঠলো, কেনো? বৃষ্টিতে ভেজার জন্য? এই পুরানো রোগ এখনো আছে? হা হা..
– ঢুকতে দিবি? নাবিল বলল।
– ওহ্ সরি দোস্তো। আয়…আয়… নাবিল ভেতরে ঢুকলো। জুতার চপ চপ আওয়াজ শুনে মুনিয়া বলল, কিরে ভালোই তো ভিজেছিস। দারা, তোরে টাওয়েল দেই। তখন একটি গান চলছিল। অসাধারণ একটি গান। আমার সারাটাদিন মেঘলা আকাশ বৃষ্টি তোমাকে দিলাম। গানটা অনেকদিন পর শুনলো নাবিল। জুতা খুলে সোফায় বসতে বসতে মুনিয়া টাওয়েল দিলো। নাবিলের যখন মাথা মোছা শেষ হলো তখন মুনিয়া এক কাপ চা নিয়ে দাড়িয়ে।
– নে, চা খা। বৃষ্টিতে ভিজে চা খাওয়ার আলাদা মজা আছে। এই থিউরিটা নাবিলই মুনিয়াকে শিখিয়েছে। ওরা যখন খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল। সেটা প্রায় এস.এস.সি পরীক্ষার সময়কার ঘটনা। তারা তখন প্রায় রিক্সা দিয়ে ঘুরতো। একদিন হঠাৎ করে মেঘ করে বৃষ্টি নামলো। তারা আর রিক্সার হুট ওঠায়নি নি। বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতেই তারা রিক্সা করে ঘুরছে। মুনিয়া সেদিন ঠিক এই গানটাই মিন মিন গাইছিল। হঠাৎ একটি রাস্তায় একটি টং-এর চা দোকান দেখে নাবিল রিক্সা থামিয়ে বলল, চা খাবি? অবাক হয়ে মুনিয়া বলল, তুই কি পাগল হয়েছিস? এই চুপচুপা শরীর নিয়ে আমি এখন ঐ চা দোকানে দাড়াবো! মাথা খারাপ!!
– এতো দিক চিন্তা করে তুই র্ম । বৃষ্টিতে ভিজে চা খাওয়ার একটা আলাদা মজা আছে। সেই শেষ বিকেলে; বৃষ্টিভেজা বিকেলে তারা দুজন রাস্তার চা দোকানে চা খেলো।
– কিরে? কি ভাবছিস? হঠাৎ ভাবনার মাঝখানে মুনিয়ার এই উপস্থিতি নাবিলকে একটু অপ্রস্তুত করে তুলল।
– না না…কিছু ভাবছি না। তোর টাকাটা নে। টাকাটা নিতে নিতে মুনিয়া বলল, তোর টাকাটা আমি কবে শোধ করতে পারবো আমি জানি না। তবে তুই নিজ থেকে চাইস না। আমি যখন পারবো তোকে শোধ করে দেবো।
নাবিল একটু লজ্জিত হয়ে বলে, আরে ধুর। কি বলিস। তোর যখন মন চায় তুই শোধ করিস। আর আমি এখন যাই। প্রচন্ড ঘুম পাচ্ছে। বাসায় গিয়ে একটা জটিল ঘুম দিতে হবে। মুনিয়া নাবিলের দিকে তাকিয়ে বলল, ঠিকাছে দোস্তো। তোকে অনেক ধন্যবাদ। টাকাটা আমার খুব জরুরী ছিল। নাবিল উঠে বের হলো। আকাশ তখন পরিস্কার। একটা ঠান্ডা হাওয়া চারদিকে। বিকেল গড়িয়ে সূর্যটা হারিয়ে গেছে। আবছা অন্ধকারে নাবিল হেটে মুনিয়া বাসার গলি থেকে বের হচ্ছে। আর মুনিয়া তার বাসার জানালা দিয়ে তাকিয়ে আছে তাদের গলিটির দিকে। খুজছে নাবিলকে। যে নাবিল সব-সময় তার পাশে ছিল। নাবিল খুব ভালো বন্ধু মুনিয়ার।