তুমি তাহলে যাবেই? জানতে চাইল সাঈদ।
এ আবার কি ধরনের প্রশ্ন! স্যুটকেসে দুটো শাড়ি ভরল ঝর্ণা, মুখ তুলে স্বামীর দিকে তাকাল। আমার যাবার কথা তো বেশ কদিন আগেই ঠিক হয়েছে।
তুমি খুব ভাল করেই জানো যে এটা তোমার স্বাভাবিক বেড়াতে যাওয়া নয়। বলছ বটে ঢাকায় বান্ধবীর বাড়িতে উঠবে, কিন্তু হাসি সিদ্দিকী তোমাকে দুএকদিনের বেশি ধরে রাখতে পারবে না। কোলকাতা হয়ে দিঘায় চলে যাবে তুমি, সেই মধুরিমার কাছে। কিনা কি দেখেছে, শোনার পর থেকে এক মুহূর্তের জন্যেও শান্তি নেই তোমার মনে।
তাহলে তো দিন কতকের জন্যে আমাকে চোখের সামনে থেকে দূর করতে পারলে খুশি হবার কথা তোমার।
একটা ভূতকে জ্যান্ত করে কি লাভ, বলতে পারো আমাকে?
কে বলল জ্যান্ত করতে চাইছি? আমি আসলে ঘাড় থেকে নামাতে চাইছি ওটাকে। দীর্ঘশ্বাস চাপল ঝর্ণা।
যদি জানতাম…যদি বুঝতাম যে..তোমার সিকি ভাগও আমার কপালে জুটবে না, তাহলে…।
সব মিলিয়ে আমি যা, এমন বহু মানুষ আছে যারা আমার আট ভাগের এক ভাগ পেলেও ধন্য হয়ে যেত, বলল ঝর্ণা, কৌতুক ঝিক করে উঠল তার চোখের তারায়।
তোমার ভেতর আসলে কোন নীতিবোধ নেই, ঝর্ণা। মাঝে মধ্যে তোমাকে আমি এত ঘৃণা করি। আমাকে যখন বিয়ে করলে, তখনও তোমার মাথার এক কোণে আশরাফ ছিল। বিয়ের পর এই যে এক বছর আমরা একসঙ্গে আছি, আমার সন্দেহ প্রতিটি দিন তুমি তার কথা ভেবেছ।
যদি ভেবেও থাকি, তুমি চিৎকার করলে সেটা বন্ধ হবে না। কেন চিল্কার করছ তাও বুঝি-কাজের বুয়াকে শোনাচ্ছ।
চোখ-মুখ লাল হয়ে উঠল সাঈদের। ঝর্ণা, তোমাকে আমি বহুবার বলেছি, উনি আমাদের কাজের বুয়া নন। ভুলে যেয়ো না, আয়েশা আন্টি বি. এ. পাস, এককালে তিনি স্কুল মিসট্রেস ছিলেন। অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে নিল সে, তারপর আবার বলল, উনি মিনিট খানেক হলো চলে গেছেন, দরজা বন্ধ হবার আওয়াজ পেয়েছি আমি।
তবু, তোমার এই চিৎকার-চেঁচামেচি আমার ভাল লাগছে না। সব যদি যুক্তি দিয়ে বিচার করতে পারতে, এই অশান্তি সৃষ্টিই হত না। আমাদের বিয়ের আগে আমার মনের অবস্থা কি ছিল, তুমি জানতে। আমি তোমাকে সাবধানও করেছি, কিন্তু আমার কোন কথাই তুমি শোনোনি। ঝুঁকিটা সেই নিলেই।
জানি। আমি বোধহয় আবারও তা নেব, স্বীকার করল সাঈদ, তবে শুধু যদি নিশ্চিত হতে পারি যে আমাকেই তুমি চাও।
সম্ভবত এই অনিশ্চয়তা বোধটুকুই আমার প্রতি তোমার আকর্ষণের কারণ—অন্তত আংশিক। তারপর ঠোঁটের কোণ কামড়ে কি যেন চিন্তা করল ঝর্ণা, বলল, এবার থামো তো, অনেক হয়েছে। আমার যাবার কথা, আমি যাচ্ছি। তোমারও তো সিলেট যাবার কথা, ইচ্ছে হলে যাও। আর না গেলে এখানে বসে লেখাটা শেষ করো।
লেখাটা ভাল হচ্ছে না, বলল সাঈদ।
শান্তাও তাই বলছিল বটে। সে তত তোমার অন্ধ ভক্ত। প্রিয় লেখকের লেখার মান ভাল না হলে চিন্তায় মরে যায়।
শান্তা খুব ভাল মেয়ে।
একটু বেশি নরম। তোমাকে ভালবেসে ফেলছে, যদিও নিজে তা রোঝে না এখনও। সুটকেস বন্ধ করে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল ঝর্ণা। তোমাকে নিয়ে সমস্যা হলো, সাঈদ, মেয়েদের সম্পর্কে খুব কম জানো তুমি। হালকাভাবে নিয়ো না, তোমার আসলে সত্যিকার একটা লাভ অ্যাফেয়ার দরকার।
আবার চোখ-মুখ লালচে আর গরম হয়ে উঠল সাঈদে তেতো একটা লাভ অ্যাফেয়ার তো চলছেই তোমার সঙ্গে আমার, তারপর আরও একটা?
হ্যাঁ, বড় বেশি তেতো। তোমাকে আমি খেপিয়ে তুলেছি, বোধহয় রশি দিয়ে বেঁধেও রেখেছি। তুমি আর তোমার কাজ, দুটোর স্বার্থেই ভাল হবে যদি শান্তার দিকে ঝেকো তুমি, এমনকি প্রয়োজনে নিজের ওপর জোর খাটিয়ে হলেও…।
স্থির পাথর হয়ে গেল সাঈদ, চোখ দুটো থেকে আগুন ঝরছে। এমন কুৎসিত কথা তুমি বলতে পারলে? আমার জন্যে যদি নাও থাকে, শান্তার জন্যে তোমার কোন মায়া বা দরদ নেই? সে না তোমার খালাতো বোন?
হাসি পেলেও হাসল না ঝর্ণা। এতে তারও কোন ক্ষতি হবে, বলল সে। বড় বেশি নরম, বলেছি না? একটু ছ্যাকা লাগার দরকার আছে। বাইশে পা দিয়েছে, কিন্তু আমার সন্দেহ এ-সব ব্যাপারে তার কোন অভিজ্ঞতা হয়নি এখনও। তোমার কাছ থেকে প্রথম স্বাদ পেলে তার জন্যেও ভালই হবে।
ছি, তুমি এত নোংরা! এসব কথা কোন স্ত্রী তার স্বামীকে বলে? নিরীহ, লক্ষ্মী একটা মেয়ের সঙ্গে নিজের স্বামীকে তুমি মিছিমিছি জড়াতে চাইছ …!
হয়তো ভাল কিছু পাবার আশায় চাইছি, বলল ঝর্ণা। মনে করো, তোমাদের উপকারী বন্ধু হতে ইচ্ছে হয়েছে আমার। অভিজ্ঞতাটা থেকে তোমরা দুজনেই উপকৃত হবে। মেয়েদের সম্পর্কে আনকোরা নতুন কিছু শিখবে তুমি, আর শান্তার ভেতর সচেতনতা সৃষ্টি হবে, বলা যায় তার ঘুম ভাঙবে—অবশ্যই তোমার __রা, তবে তোমার কাছে বাঁধা পড়বে না সে, অন্তত ব্যাপারটা স্থায়ী হবে না। এক সময় তার গ্রহণ ক্ষমতা এতটাই বাড়বে, তখন আর অন্য কারও আকর্ষণে সাড়া দিতে দ্বিধা করবে না।
স্ত্রীর কাছাকাছি চলে এল সাঈদ। তার চেহারার মায়াভরা ভাবটুকু অদৃশ্য হয়েছে, রাগে জ্বলজ্বল করছে চোখ দুটো, দৃষ্টিতেও আশ্চর্য ধরনের একটা নিষ্ঠুরতা ফুটে উঠেছে। হঠাৎ একটু ভয় লাগল ঝর্ণার, শিরশির করে উঠল তার শরীর।
ধ্যেত, তুমি দেখছি বড় বেশি সিরিয়াসলি নিচ্ছ, তার গলায় ধৈর্য হারানোর সুর।
যখন তুমি দুজনের জীবনই নষ্ট করার হুমকি দাও, আমার সিরিয়াস না হয়ে উপায় কি! তুমি একটা শয়তান মেয়েলোক…কোন্ দিন না সীমা ছাড়িয়ে যাও!
ঠিক আছে, ঠিক আছে, আমার কথা যদি এতই খারাপ লাগে তোমার, এখন থেকে আর কোন ভাল পরামর্শ দেব না।
এরইমধ্যে অনেক বেশি বলে ফেলেছ। তোমাকে আমি ভালবাসি, কিন্তু কোন কোন সময়, এই যেমন এখন, মনে হয় তোমাকে খুন করতে পারলে দারুণ একটা তৃপ্তি পেতাম। কারণ বুঝতে পারি, একমাত্র শুধু তখনই তোমাকে পুরোপুরি পাওয়া হবে আমার।
এ তোমার পাগলামি, বলল ঝর্ণা। সরো তো, সুটকেসটা বন্ধ করতে দাও। নিহত স্ত্রীর ভূমিকায় অভিনয় করার কোন ইচ্ছে আমার নেই।
তুমি তো চিরকালই তা-ই, অভিনেত্রী, বলল সাঈদ। আমি ভালবাসলে কি হবে, আমার প্রতি তোমার ভালবাসাটা নির্জলা অভিনয়। কিন্তু এখন যেটা ঘটছে সেটা অভিনয় নয়, ঝর্ণা। একমাত্র মৃত্যুর মাধ্যমেই তোমাকে আমি আপন করে পেতে পারি…।
সাঈদ, এরকম সাহিত্যের ভাষায় আমার সঙ্গে কথা বোলো না তো! প্রায় চিৎকার করে উঠল ঝর্ণা। সে কিছু বোঝার আগেই সাঈদ তার একটা হাত ধরে সজোরে মোচড় দিল, হ্যাঁচকা টানে নিয়ে গেল পিঠের দিকে। স্বামীর গায়ে এত শক্তি, আজই যেন প্রথম উপলব্ধি করতে পারল ঝর্ণা। ছাড়ো আমাকে! রাগে আবার চিৎকার করে উঠল, তবে এবার সত্যি সত্যি ভয় পেয়েছে।
কেন ছাড়ব? তার হাতে তোমাকে তুলে দেয়ার জন্যে? বলো তো কেমন লাগে সেই লোকের, যে তার স্ত্রীকে একটা বছর যতবার বুকে নিয়ে শুয়েছে ততবার তার মনেহয়েছে, স্ত্রী অন্য এক পুরুষের কথা ভাবছে? প্রতিটি আদরে সাড়া দিয়েছ তুমি আমাকে সে মনে করে, আমাকে আমি মনে করে নয়।
তুমি প্রলাপ বকছ! হাঁপিয়ে উঠল ঝর্ণা, ব্যথায় নীলচে হয়ে গেছে চেহারা।
যা সত্যি তাই বলছি। স্বীকার করো তুমিও জানো এ-সব সত্যি !
সাঈদের শক্ত বাঁধনের ভেতর মোড় খাচ্ছে ঝর্ণা। ছাড়ো আমাকে! আমার লাগছে…সাঈদ…সাঈদ…, আর্তনাদ করে উঠল সে।
ঝর্ণাকে বিছানায় ফেলে দিয়ে তার ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ল সাঈদ, আর্তনাদটা অকস্মাৎ থেমে গেল। ঘরের ভেতর জমাট বাঁধল নিস্তব্ধতা।
কাজ সেরে চলে যাবার আগে লাইব্রেরি রুমের দরজা দিয়ে ভেতরে মাথা গলালেন আয়েশা বেগম, শান্তাকে জিজ্ঞেস করলেন তার কিছু লাগবে কিনা বা আর কোন কাজ করতে হবে কিনা। টাইপরাইটার থেকে একবার মুখ তুলে শান্তা শুধু মাথা নাড়ল। তারপরও দোরগোড়া থেকে নড়লেন না আয়েশা বেগম, বললেন, এই বয়েসে মেয়েদের ঘরের কোণে বসে কাজ করা ঠিক নয়। তোমরা যদি সচেতন না হও, এই যে নারীজাতির বিরুদ্ধে দেশজুড়ে ষড়যন্ত্র চলছে, তা ঠেকাবে কে? তোমাদের আসলে বেরিয়ে পড়া উচিত। মাঠে-ময়দানে, রাস্তা-ঘাটে বক্তৃতা দাও, মেয়েদের এক করো। এই যে ওরা কামড়ে-আঁচড়ে কচি মেয়েটাকে রক্তাক্ত করল, তারপর কবর দিল জ্যান্ত, সে তত তোমারই বোন, নয় কি? তার জন্যে তোমরা কিছু করবে না? আজ যদি তার জন্যে কিছু না করো, কাল তোমার অবস্থাও তো তার মত হবে। তখন?,
জ্বী করব, এবার আর কাজ থেকে মুখ তুলল না শান্তা। তবে ভাবছে সে। আয়েশা আন্টি এমন সুরে কথাগুলো বলেন, তার মেয়েকে যেন সম্প্রতি জ্যান্ত কবর দেয়া হয়েছে। অথচ একাত্তর সালে, স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়কার ঘটনা সেটা। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল সে। আয়েশা আন্টির কাছে ঘটনাটা হয়তো এখনও পুরানো হয়নি।
ভুলে যেয়ো না, এই বন্দীদশা থেকে নিজেদের চেষ্টায় মুক্তি পেতে হবে আমাদের। চোখ রাঙিয়ে বললেন আয়েশা বেগম।
না, ভুলব না।
আমি তাহলে যাই, ওদেরকে তৈরি হতে বলি।
জী, ঠিক আছে।
চলে গেলেন আয়েশা বেগম। তিনি চলে যাবার পর নিঃসঙ্গবোধটা আঁকিয়ে বসল শান্তার মনে। এর আগে প্রায়ই আশা ভিলা-য় সারাদিন কাজ করেছে সে, সময়ের হিসাব মনে থাকেনি বা নিঃসঙ্গও লাগেনি। আজ তাহলে একা লাগার কারণ কি? একটা কারণ হতে পারে, সাঈদ হাসান এবার যে উপন্যাসটা লিখছেন, পড়ে একটুও মজা পাচ্ছে না সে।
ময়মনসিংহ খুবই ছোট শহর, চারপাশে গ্রাম আর নদীর বেড়, সেই বেড়েরই এক প্রান্তে গাছগাছালির ভেতর ছোট্ট বাড়িটা। এখানে পাখির কল-কাকলি, নদীর কলকলানি, গাছের পাতায় বাতাসের ফিসফিসানি শোনা যায়, একজন লেখকের জন্যে এই প্রায় নির্জন পরিবেশ খুবই দরকার। তবে তার ঝর্ণা আপা যে প্রায়ই এখান থেকে চলে যেতে চায়, সেজন্যে অবাক হয় না শান্তা। এরকম ছোট শহরের পাশে বসবাস করার মত মানসিকতা তার হবারও নয়। তবে গত এক বছরে প্রতিবেশী অনেকের সঙ্গেই ওদের সুসম্পর্ক তৈরি হয়েছে। এবারের ঢাকায় বেড়ানোটা তার ঝর্ণা আপা নিশ্চয়ই দারুণ উপভোগ করছে। এর আগেরবার একা যায়নি, তাকেও সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিল। ঢাকায় গেলে সব সময় হাসি সিদ্দিকীদের বাড়িতে ওঠে ঝর্ণা আপা, হাসি সিদ্দিকীও তার স্বামীকে নিয়ে এখান থেকে একবার বেড়িয়ে গেছেন, সঙ্গে ঝর্ণা আপার ফ্যান সোহানাও এসেছিল। সন্দেহ নেই, ঢাকায় পা দিয়েই নাচ-গান নিয়ে মেতে উঠেছেন ঝর্ণা আপা, রোজ রাতে বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে চাইনীজ খাচ্ছেন, নাটক বা রিহার্সেল দেখতে বেইলী রোডেও যাচ্ছেন।
তবে হাসান ভাইয়ের উচিত ছিল আপার সঙ্গে থাকা। তারপর শান্তা ভাবল, কিন্তু না, তা সম্ভব নয়। ঝর্ণার আপার বন্ধু-বান্ধবরা। সবাই ফ্যাশন জগতের রত্ন, নয়ত পারফর্মিং আর্টস-এর তারকা। তাদের সঙ্গে চুটিয়ে আড্ডা দিচ্ছেন হাসান ভাই, এ চিন্তাই করা যায় না। তিনি বরং যেখানে গেছেন সেখানেই তাকে সবচেয়ে বেশি মানায়। সিলেটের বিপিনবিহারী কলেজে। ওখানে বাংলার এক অধ্যাপক তাঁর পুরানো বন্ধু। হাতের কাজ শেষ করে মুক্তিযুদ্ধের ওপর নতুন যে উপন্যাসটা লিখবেন বলে ভাবছেন, দুই বন্ধু মিলে ঘন্টার পর ঘণ্টা লাইব্রেরিতে বসে তারই উপাদান ও উপাত্ত সংগ্রহ করছেন।
টাইপরাইটারের চৌকো বোতামগুলোর ওপর অলস পড়ে আছে শান্তার আঙুল, সে তার প্রিয় লেখকের কথা ভাবছে, ভাবছে নিজের কথাও। ঝর্ণা আপার সঙ্গে বিয়ে হবার পর নয়, তারও তিনচার বছর আগে থেকে সাঈদ হাসানের ভক্ত সে। ইতিমধ্যে পনেরো-ষােলোটা উপন্যাস আর বিশ-পঁচিশটা গল্প লিখেছেন তিনি, সবগুলো তিন-চারবার করে পড়া হয়ে গেছে শান্তার। তার মত ভাগ্যবতী ফ্যান গোটা দেশে বোধহয় আর একজনও নেই। প্রিয় লেখকের কাছাকাছি থাকার, তার কাজ করার সুযোগ পেয়েছে সে। সেজন্যে সে তার ঝর্ণা আপার প্রতি কৃতজ্ঞ, কারণ হাসান ভাই লেখার পরিবেশ পাবেন মনে করে সেই প্রায় জোর করে এখানে তাকে টেনে আনে। আসার পর হাসান ভাই জায়গাটার প্রেমে পড়ে গেছেন, যদিও ঝর্ণা আপা পালাতে পারলেই যেন বাঁচে।
তিনি একজন স্বাপ্নিক, তার হাসান ভাই। আদর্শপ্রিয় মানুষ। লম্বা ও সরু মুখ, চোখ দুটো একটু গভীরে, সামান্য অন্যমনস্ক যদি হনও, চেহারায় মায়া মায়া ভাবটুকু বড় বেশি টানে। দেখে ঠিক ঔপন্যাসিক নয়, কবি বলে মনে হবে। হাসান ভাইয়ের উপন্যাস বাজারে মন্দ চলে না, তবে শান্তার দুঃখ এই যে দেশ জুড়ে হৈ-চৈ পড়ে যাবে এমন ঘটনা এখনও ঘটছে না। তিনি যদি একটা বেস্ট সেলার লিখতে পারতেন; শান্তা আর কিছু চাইত না। কিন্তু তা কোনদিন সম্ভব হবে কিনা জানা নেই তার। খুব ভাল একটা উপন্যাস লিখতে হলে লেখকের মনে শান্তি থাকা দরকার। কিন্তু ওদের দুজনের জীবনে শান্তি বলে বোধহয় কিছুই নেই। কথায় কথায় পরস্পরের বিরুদ্ধে শুধু অভিযোগ। কেউ কারও চেয়ে কম যায় না। প্রতিটি পর্ব শেষ হয় তুমুল ঝগড়ার মধ্যে দিয়ে। ওদের বোধহয় জোড়া মেলেনি, ভাবল শান্তা, তবে এটা তাকে অনিচ্ছা সত্ত্বেও স্বীকার করতে হলো-কারণ সে তার ঝর্ণা আপারও ভক্ত, তার ব্যক্তিত্বকে শ্রদ্ধা করে।
তার হাসান ভাইয়ের মাত্র একটা উপন্যাসই নাটকে রূপান্তর করে দেখানো হয়েছে টিভিতে, মূল নায়িকা চরিত্রে অভিনয় করেছিল ঝর্ণা আপা। সেবারই সত্যিকার বড় সুযোগ পায় সে, তার আগে বেলী রোডের নাটকগুলোয় ছোটখাট চরিত্রে অভিনয় করত। টিভি নাটকটায় খারাপ করেছিল, তা বলা যাবে না, তার অভিনয় মোটামুটি প্রশংসাই পেয়েছিল সবার। তবে শু্যটিঙের শেষ দিকে একেবারে ভেঙে পড়েছিল ঝর্ণা আপা। তার এই ব্রেক-ডাউনের জন্যে শুধু শুধু নিজেকে দায়ী করেন হাসান ভাই। এই ব্রেকডাউনের কারণেই ঝর্ণা আপার চোখের অসুখটা দেখা দেয়। ডাক্তাররা দায়ী করেছেন নার্ভাস ডিসঅর্ডারকে, কিন্তু ঝর্ণা আপার কথা হলো শু্যটিঙের সময় সেটে চোখ ধাঁধানো আলো থাকায় তার এই ক্ষতি হয়েছে। সেই থেকে আজও রঙিন সানগ্লাস পরতে হয় তাকে। ফলে তার সৌন্দর্য খানিকটা তো ঢাকা পড়েছেই, সেই সঙ্গে বেঁচে থাকতে হচ্ছে আধাে অন্ধকার একটা জগতে।
জানতে ইচ্ছে করে ঝর্ণা আপার্কে হাসান ভাই বিয়ে করলেন ভালবেসে, নাকি করুণাবশত? বোধহয় দুটোরই অবদান আছে। স্নায়ু তাকে যতই ভোগাক বা বিধ্বস্ত করুক, একহারা গড়ন আর অস্থির হাবভাব নিয়ে আজও ঝর্ণা আপা আশ্চর্য সুন্দরী। সবচেয়ে বেশি আকৃষ্ট করে তার এই কঠিন এই কোমল মেজাজ। গায়ের রঙে হলদেটে মাখনের মত একটা ভাব আছে, চকচকে আবলুস কাঠের মত চুল, ঠোঁট আর নাক সুগঠিত, চলনে-বলনে আভিজাত্য আর ব্যক্তিত্ব। শুদ্ধ উচ্চারণে, সুরেলা গলায় কথা বলে যখন, মুগ্ধ হয়ে শুনতে হয়।
লেখক সাঈদ হাসানের টাইপিস্ট হিসেবে চাকরি পাবে শান্তা, এটা যেন তার ভাগ্যেই লেখা ছিল। ইন্টারমিডিয়েট পাস করে ঘরে বসে আছে সে, হঠাৎ বাবা মারা যাওয়ায় লেখাপড়া বন্ধ, সে-ও মায়ের মত প্রাইমারী কোন স্কুলে চাকরি নেবে কিনা ভাবছে, এই সময় হঠাৎ ঝর্ণা আপার চিঠি এল, লেখক সাঈদ হাসানকে বিয়ে করেছে সে, স্বামীকে নিয়ে নিজেদের বাড়িতে বেড়াতে আসছে। ভিটা আর বাগান নিয়ে ছয় বিঘা জমি, পাকা দেয়াল আর টিনের চাল দিয়ে বানানো তিনটে ঘর। শান্তার খালু চিরকাল ঢাকাতেই চাকরি করে কাটিয়েছেন, সেখানে তিনি একটা ফ্ল্যাটও কিনেছেন, তবে ইচ্ছে ছিল অবসর জীবনটা দেশের বাড়িতে এসে কাটাবেন। সে-কথা ভেবেই মাটির ঘরগুলো ভেঙে নতুন এই তিনটে কামরা বানিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু তাঁর আর আসা হয়নি। স্ট্রোকে মারা গেছেন বছর তিনেক আগে। বাবা মারা যাবার তিন বছর আগে থেকে লেখাপড়া ও অভিনয়, দুটো একসঙ্গে চলছিল ঝর্ণা আপার। তারপর বিয়ে করলেন, ঢাকার ফ্ল্যাট ভাড়াটে বসিয়ে চলে এলেন আশা ভিলায়। আশা ছিল শান্তার খালাম্মার নাম, তিনি আজ সাতআট বছর হলো মারা গেছেন। হাসান ভাইকে নিয়ে ঝর্ণা আপা মসার আগে বাড়িটা শান্তারাই দেখেশুনে রেখেছিল। আশা ভিলার পাশের বাড়িটাই ওদের। ওদেরও জমিজমা খুব সামান্য, তবে ঝর্ণা আপার মত ওরও আর কোন ভাই-বোন নেই। মা ও মেয়ের ছোট্ট সংসার। ঢাকা থেকে তারা আসার পর প্রথম কদিন শান্তার মা ঝর্ণাকে রান্নাবান্না করতে দেননি। তারপর জানা গেল, বেড়াতে নয়, এখানে বসবাস করতে এসেছে ওরা। শুধু তাই নয়, হাসান ভাইয়ের একজন টাইপিস্টও দরকার। নিজের লেখা অসম্ভব কাটাকাটি করেন তিনি, কম্পিউটর অপারেটররা তার হাতের লেখা পড়তে পারে না, তিনি নিজেও টাইপ করতে পছন্দ করেন না। কাটাকাটি করার পর আবার নতুন করে কপি করবেন, সে সময়ও তাঁর নেই। এসব যখন আলোচনা হচ্ছে, শান্তা মনে মনে শুধু ভাবছে, ঝর্ণা আপা আমার কথা তুলছে না কেন? যে-কোন বেতনে আমার একটা চাকরি দরকার, সেজন্যে আমি. ইংরেজি আর বাংলা দুরকম টাইপ করাও শিখেছি, তাছাড়া প্রিয় লেখকের কাজ করার সুযোগ পেলে আর কি চাই আমার। কিন্তু প্রথম এক মাস লিখতেই বসলেন না হাসান ভাই, তাই টাইপিস্ট রাখার কথাও, আর উঠল না। ইতিমধ্যে ময়মনসিংহেই ছোট একটা চাকরি পেয়ে গেল শান্তা।
নতুন চাকরি করছে সে এক মাসও হয়নি, এই সময় ঝর্ণা আপা মাকে ধরল। হঠাৎ করে লেখার এমন ঝোক দেখা দিয়েছে হাসান ভাইয়ের, প্রতিদিন দশ-বারো পৃষ্ঠা লিখে ফেলছেন, আর সেগুলো টাইপ করতে হিমশিম খেয়ে যাচ্ছে ঝর্ণা আপা। স্বামীর গল্প-উপন্যাস পড়তে তার ভালই লাগে, কিন্তু টাইপ করাটা তার দুচোখের বিষ। প্রস্তাবটা শুনেই রাজি হয়ে গেল শান্তা, এমনকি বেতন কত না জেনেই।
তবে শান্তার মা, ফানুনী ইসলাম, মৃদু হলেও আপত্তি করেছিলেন। তাঁর আপত্তি করার সঙ্গত কারণও ছিল। ঝর্ণার এখানে কতদিন থাকবে তার ঠিক নেই, ওরা চলে গেলে আবার তত বেকার ঘরে বসে থাকতে হবে শান্তাকে। বেতনও এমন কিছু বেশি নয়। লইয়ারের অফিসে বারোশো টাকা পাচ্ছিল শান্তা, ঝর্ণা আপা দিতে চাইল পনেরোশো। শান্তার মায়ের যুক্তি ছিল, এক আইন ব্যবসায়ী ধীরে ধীরে তার ব্যবসা গড়ে তোলে, সেখানে যারা চাকরি করে তাদের ভবিষ্যৎ আছে। সাইফুল ইসলামের ওখানে মেয়ে চাকরি পাওয়ায় খুব খুশি হয়েছিলেন তিনি, ভেবেছিলেন মেয়েকে আইন পড়াতে পারলে তার বিয়ের জন্যে আর চিন্তা করতে হবে না। এসব কথা ভেবে একটা সিঙ্গার মেশিন কিনেছেন তিনি, স্কুলের বেতন ছাড়াও বাড়তি কিছু আয় করার জন্যে।
কিন্তু শান্তার আগ্রহ আর ঝর্ণার আবদার তিনি এড়াতে পারেননি।
তরুণ অ্যাডভোকেট সাইফুল ইসলাম, যার অফিসে চাকরি করছিল শান্তা, ব্যাপারটা মেনে নেয়। শান্তা অবশ্য জানে না, সে চাকরি ছাড়ায় মনে মনে খুশিই হয় সাইফুল, যদিও ফারুনী ইসলামকে আশ্বস্ত করার জন্যে শান্তাকে প্রতিশ্রুতি দেয় যে সাঈদ হাসান ঢাকায় ফিরে গেলে তার অফিসে আবার শান্তা কাজ করার সুযোগ পাবে।
শান্তাকে চাকরি দিয়ে বিপদেই পড়ে গিয়েছিল সাইফুল। মেয়েটার মধ্যে কি আছে কে জানে, শুধু তার উপস্থিতিই কাজে, অমনোযোগী করে তোলে সাইফুলকে। ভেতরের চেম্বারে বসে ক্লায়েন্টদের সঙ্গে কথা বলার সময় নিজের অজান্তেই কান পাতে সে, সামনের ঘর থেকে ভেসে আসছে শান্তার টাইপ করার আওয়াজ। সারাদিনে পাঁচ-সাতবার শান্তার টেবিল ঘেঁষে আসাযাওয়া করতে হয় তাকে, প্রতিবার দেখে গভীর মনোযোগের সঙ্গে কাজ করছে শান্তা, হাঁটার গতি কমে আসে তার, অপলক হয়ে ওঠে চোখের দৃষ্টি, সব ভুলে হাঁ করে তাকিয়ে থাকে। ব্যাপারটা কিভাবে যেন টের পেয়ে যায় শান্তা, সে-ও মুখ তুলে তাকায়। চোখাচোখি হয় দুজনের। নিজের চেম্বারে ফিরে পায়চারি শুরু করে সাইফুল, কাজে মন বসাতে পারছে না দেখে রেগে যায় নিজের ওপর।
নারী সংক্রান্ত ব্যাপারে খুব সাবধান সাইফুল, বিশেষ করে নিজের অফিসের কোন মেয়েকে নিয়ে তার নামে কিছু রটলে লজ্জায় আর কাউকে মুখই দেখাতে পারবে না সে। তবে এখন, শান্তা যখন আর তার অফিসে চাকরি করছে না, মেয়েটার প্রতি নিজের আগ্রহ প্রকাশ করতে কোন বাধা অনুভব করে না সে। কাউকে ভাল লাগলে সেটা স্বীকার করতে দোষের কি আছে। সেই থেকে মাঝে মধ্যেই শান্তাদের বাড়িতে আসা-যাওয়া করছে। সাইফুল। ফানুনী ইসলাম অত্যন্ত স্নেহ করেন তাকে। ছুটির দিনগুলোয় শান্তাকে নিয়ে বাইরে কোথাও বেড়াবার অনুমতিও দেয়া হয়েছে তাকে।
সাইফুল প্রতিটি কাজ সম্মান বজায় রেখে করতে চায়। এবং কোন কাজে তাড়াহুড়ো করারও পক্ষপাতী নয় সে। প্রেমে পড়েছে ঠিকই, তবে সাতাশ বছর বয়েসে এসে শিখে নিয়েছে কিভাবে মাথা ঠাণ্ডা রাখতে হয়। পরিষ্কার বোঝে সে, শান্তা তার প্রেমে পড়েনি। তবে আশার কথা হলো; তাকে অপছন্দ করে না মেয়েটা, অন্তত বন্ধু ও শুভানুধ্যায়ী হিসেবে গ্রহণ করেছে। সাইফুলের ধারণা, লক্ষণটা শুভ। তার আরও ধারণা, শেষ পর্যন্ত শান্তা তাকে ভাল না বেসে পারবে না। হয়তো একটু সময় নেবে, তা নিক। ধৈর্য ধরবে সে, অপেক্ষায় থাকবে।
শুরুতে আশা ভিলায় কি ঘটছে না ঘটছে শান্তার কাছে জানতে চেয়েছে সাইফুল। কিন্তু শান্তা খুব বেশি কিছু তাকে জানায়নি। শুধু বলেছে, ঝর্ণা আপা নার্ভাস ব্রেক-ডাউনের শিকার, রোগটা এখনও পুরোপুরি সারেনি তার। আর হাসান ভাই খানিকটা খেয়ালি মানুষ, অনুপ্রাণিত না হলে লিখতে পারেন না। তবে দুজনেই তারা অত্যন্ত ভাল ব্যবহার করে শান্তার সঙ্গে। স্বামী-স্ত্রীতে যে প্রায়ই তুমুল ঝগড়া হয়, সে-কথা তাকে আভাসেও বলেনিশান্তা।
আয়েশা আন্টি শান্তাকে আজ বলেছে, কালও নাকি স্বামী-স্ত্রীতে খুব এক চোট হয়ে গেছে। এসব শুনতে চায় না শান্তা, কিন্তু কার সাধ্য আয়েশা আন্টির মুখ বন্ধ করে। তিনি তাকে শোনালেন, ওদের ঝগড়া যখন তুঙ্গে, এই সময় বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান তিনি। যাবার আগে আড়াল থেকে দেখে গেছেন, দুজনেই যে যার স্যুটকেস, গুছাচ্ছে। তখনই তিনি গৃহকর্তাকে বলতে শোনেন, আশরাফকে ভুলতে না পারলে আমাকে তুমি সুখী করতে পারবে না।
শান্তাকে তিনি জিজ্ঞেস করেছেন, এই আশরাফটা কে বল তো, মা?
শান্তা বলেছে, আমি জানি না।
শান্তা আজ সকালে টাইপ করতে এসে বুঝতে পারে, ঝর্ণা আপাকে স্টেশনে পৌঁছে দিয়ে হাসান ভাই সরাসরি সিলেট রওনা হননি, আবার তিনি আশা ভিলায় ফিরে এসেছিলেন। ডাইনিং টেবিলে একটা কাপ ও প্লেট দেখেছে সে, দেখেছে কাদা মাখা একজোড়া বুট। এ-সবই আয়েশা আন্টি ধােবেন, এই আশায় রেখে যাওয়া হয়েছে। বুটে কাদা দেখে শান্তা ধরে নেয়, সিলেট রওনা হবার আগে বাগানে কিছুক্ষণ কাজ করেছেন হাসান ভাই।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে টাইপরাইটারে কাভার লাগাল শান্তা, এই সময় ড্রইংরুমে ফোন বেজে উঠল। প্রায় ছুটে এসে রিসিভার তুলল সে। হ্যালো?
ও, তুই, শান্তা…, খসখসে একটা গলা শুনতে পেল শান্তা, চিনতে পারল না। আমি ঝর্ণা রে। ভয় হচ্ছিল কাজ শেষ করে তুই। আবার ফিরে গেছিস কিনা। তোর ভাই বাড়িতে?।
কি ব্যাপার, ঝর্ণা আপা? কি হয়েছে তোমার?
কি বলছিস! আমার আবার কি হবে!
না, মানে, তোমার গলা কেমন যেন শোনাচ্ছে…আমি তো চিনতেই পারছি না।
ঢাকায় খুব শীত পড়েছে, বুঝলি। কাল সারারাত টো টো করে ঘুরেছি তো, তাই খুব ঠাণ্ডা লেগে গেছে। শোন, সোমবারে আমি ফিরব না বলার জন্যে ফোন করছি। ভেবেছিলাম তোর ভাইকে পাব। ঠিক আছে, তুইই তাকে জানিয়ে দিস, কেমন?
ঠিক আছে, ফিরলে জানাব। কেন ফিরবে না, বা আর কিছু বলতে হবে, নাকি সোমবারে আবার তুমি ফোন করবে?
শান্তার মনে হলো, কার সঙ্গে যেন ফিসফিস করে আলাপ করল ঝর্ণা আপা, চাপা হাসির আওয়াজও বোধহয় শুনতে পেল। না, আমি আর ফোন করব না। তাকে শুধু বলবি আমি ফিরছি না…।
কিন্তু ঝর্ণা আপা…, শান্তা তার কথা শেষ করতে পারল না, ওদিকে রিসিভার নামিয়ে রেখেছে ঝর্ণা।
একটা সোফায় বসে গালে হাত দিল শান্তা। তারমানে এবারের ঝগড়াটা আগেরগুলোর মত নয়, আরও অনেক সিরিয়াস। এর মানে কি ওদের বিয়েটা ভেঙে যাচ্ছে? না, অসম্ভব, ঝর্ণা আপা এরকম একটা অন্যায় হাসান ভাইয়ের ওপর করতে পারে না। যত ঝগড়াই হোক, স্ত্রীকে সত্যি ভালবাসেন হাসান ভাই। আপাটা যে কি না! আপন মনে বিড়বিড় করল সে। মনে মনে সান্ত্বনা পাবার চেষ্টা করল এই ভেবে যে সোমবারের আগে হাসান ভাই সিলেট থেকে ফিরছেন না, কাজেই আগামী দুদিন ব্যাপারটা নিয়ে দুশ্চিন্তায় ভুগতে হবে না তাকে। তবে তিক্ত দায়িত্ব শান্তাকেই পালন করতে হবে। স্ত্রী ফিরছে না শুনে তার মনের অবস্থা কি হবে কে জানে।
…রেখেছ বাঙালী করে মানুষ করোনি, রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন। সাইফুলের সঙ্গে টাউন হলে নাটক দেখতে যাবার পথে ভাবছে শান্তা। রবীন্দ্রনাথ বিধাতার ওপর দোষ চাপিয়ে ছিলেন, তখনকার রীতি অনুসারে। কিন্তু সময় পাল্টেছে, শিক্ষিত মানুষ এখন বোঝে কি থেকে কি হয়, তারা বিধাতার ওপর দোষ না চাপিয়ে দায়ী করেন রাজনীতিকদের, যারা দেশের মঙ্গল করার সোল এজেন্সী নিয়ে যোলো আনা সফল হন শুধু নিজেদের মঙ্গল সাধনে। বাংলাদেশে তাদের কৃতিত্ব এই যে আমাদেরকে তারা বাঙালী করে রাখেননি, পাইকারী হারে রিকশাঅলা বানিয়ে ছাড়ছেন। শুধু ঢাকা না, দেশের সব কটা ছোট বড় শহরই এখন রিকশার দখলে চলে গেছে। আইএ বিএ পাস করেও যুবকরা এখন রিকশা চালাচ্ছে। তার মন্তব্যে সায় দিয়ে সাইফুল বলল, কোটি কোটি মানুষকে বেকার করে রাখতে পারলে বড় রাজনৈতিক দলগুলোর লাভ, দেশে গরীব মানুষ না-থাকলে তাদের মীটিং-মিছিলে পাঁচ লাখ দশ লাখ লোক হবে কিভাবে!
ময়মনসিংহে দেখার মত ভাল সিনেমা বোধহয় কোন কালেই আসেনি, কাজেই সে পথ না মাড়িয়ে টাউন হলে নাটক দেখতে এসেছে ওরা। এখানকার ছেলেমেয়েরাই অভিনয় করছে, গ্রুপও অনেকগুলো। আজ নতুন ও তরুণ এক নাট্যকারের লেখা নাটক মঞ্চস্থ হচ্ছে, নাটকটার বক্তব্যও সম্পূর্ণ নতুন ধরনের। নাটকের নাম, এলোমেলো করে দে মা, লুটেপুটে খাই। মঞ্চে দুই ডাইনীর দোর্দণ্ড প্রতাপ, প্রত্যেকের দুপাশে কুৎসিত চেহারার রাক্ষসরা দাঁড়িয়ে। মাথায় টুপি আর চিবুকে কয়েক গাছি কাঁচাপাকা দাড়ি নিয়ে একজন ওঝাও আছে। মঞ্চের মাঝখানে পড়ে আছে হীরেজহরত, আর মনি-মানিক্যের একটা স্থূপ, আকৃতি দেখে মনে হবে বাংলাদেশের ম্যাপ। দুই ডাইনীর মধ্যে যুদ্ধ চলছে, উদ্দেশ্য হীরেজহরতগুলোকে রাক্ষসদের দিয়ে লুঠ করানো। এই যুদ্ধে ওঝা একবার এক নম্বর ডাইনীর পক্ষ নিচ্ছে, একবার দুই নম্বরের। আর আছে কিছু পুতুল, ডাইনী দুজনের পায়ের তলায় চিড়ে-চ্যাপ্টা হচ্ছে। তারা, ব্যথায় ফোঁপাচ্ছে।
মাথা ধরেছে, বলে বিরতির আগেই হল থেকে বেরিয়ে এল শান্তা। সাইফুল উদ্বেগ প্রকাশ করতে তাকে জানাল, শরীরটা এমনিতেও আজ আমার ভাল নেই। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত একটানা টাইপ করেছি তো।
তাহলে চলো, এক কাপ চা খেলে মাথা ব্যথাটা বোধহয় ছেড়ে যাবে। টাউন হলের সঙ্গেই রেস্তোরা, শান্তাকে নিয়ে ভেতরে ঢুকল সাইফুল। বসার পর ওয়েটারকে ডেকে চা দিতে বলল সে, তারপর শান্তাকে জিজ্ঞেস করল, নাটকটা তোমার ভাল লাগছে না?
এ বক্তব্যের সঙ্গে সবাই একমত হবে না, বলল শান্তা।
কি বলতে চায়, তুমি তাহলে বুঝতে পেরেছ?..
সেটা তো পরিষ্কারই বোঝা যায়; বলল শান্তা। ওদের। ব্যক্তিগত হিংসা আর বিদ্বেষ দেশের মানুষকে জিম্মি করে রেখেছে। একটু থেমে চিন্তা করল সে, তারপর আবার বলল, যদিও ডাইনী দুটোর প্রতি আমার খানিকটা দুর্বলতা আছে, স্বভাবতই আমি মেয়ে বলে।
ওদের দ্বারা ভাল কিছু হবার আশা নেই জানার পরও?
যার দ্বারা-ভাল কিছু হবে সে না আসা পর্যন্ত থাক না ওরা, বলল শান্তা। খামচাখামচি করছে করুক, একজন তো জিতবে, তখন সে হয়তো আর ডাইনী থাকবে না, অন্তত মন্দের ভাল কিছু একটা করলেও করতে পারে।
ধন্য আশা কুহকিনী, বলে হেসে উঠল সাইফুল। তোমার কথা শুনে আর কেউ খুশি না হোক, তোমাদের আয়েশা আন্টি অবশ্যই খুশি হবেন। কথাটা কি সত্যি, উনি তোমার মায়ের সঙ্গে একই স্কুলে মাস্টারি করতেন?
ওয়েটার চা দিয়ে গেল।
সত্যি, বলল শান্তা। শুধু তাই নয়, মা আর আয়েশা আন্টি একই কলেজ থেকে বিএ পাস করেছিলেন।
পুরো ঘটনাটা আমার জানা নেই…।
পাকিস্তানী আর্মি আয়েশা আন্টি, মকবুল আংকেল আর ওদের একমাত্র মেয়ে অনুপমাকে ক্যাম্পে ধরে নিয়ে যায়। আন্টির সামনে জবাই করা হয় মকবুল আংকেলকে। ভাগ্যবানই বলতে হবে, কিশোরী মেয়ের দুর্দশা তাঁকে দেখতে হয়নি। দুর্ভাগ্য আয়েশা আন্টির, তার সামনেই ওরা তিন দিন তিন রাত খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মারে মেয়েটাকে। তারপরও বেঁচে ছিল অনুপমা। তিন দিন পর ক্যাম্পের সামনে জ্যান্ত কবর দেয়া হয় তাকে। দেশ স্বাধীন হবার পর ক্যাম্প থেকে মুক্তিযোদ্ধারা আয়েশা আন্টিকে উদ্ধার করে।
তারপর?
তারপর আর কি, মাথায় গোলমাল দেখা দেয়। প্রথম প্রথম কাউকে চিনতে পারতেন না। কিছু দিন তাঁকে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখতেও হয়েছে। বছরখানেক পর খানিকটা সুস্থ হন। আত্মীয়স্বজন কেউ কোথাও নেই, এর বাড়ি তার বাড়ি থাকতেন। একসময় ভিটায় উঠলেন, স্কুলে গিয়ে আগের চাকরিটাও ফেরত চাইলেন। নতুন করে অ্যাপয়েন্টমেন্ট দেয়া হলো। পড়াবার সময় ধরা পড়ল ব্যাপারটা।
কি?
পুরোপুরি সুস্থ হননি। বাংলা আর ইংরেজি ক্লাস নেবেন, কিন্তু বই না ছুঁয়ে ক্লাসের মেয়েদের উদ্দেশ্যে বক্তৃতা দিতে শুরু করেন। বলেন, দেশ জুড়ে মেয়েদের বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্র চলছে, ঠেকাতে হলে মেয়েদেরকে এক হতে হবে, হাতে অস্ত্র তুলে নিতে হবে। আমরা সবাই সুস্থ মানুষ, একটা পাগলকে কিভাবে পাগলামি করতে দিই। চাকরিটা গেল। সেই থেকে যখন যাকে ভাল লাগে তার বাড়িতে হাজির হন, সংসারের সব কাজ করে দেন, বাকি সময় নিজের ঘরে বসে বা রাস্তায় দাঁড়িয়ে মেয়েদের উদ্দেশ্যে বক্তৃতা দেন। আমাদের সয়ে গেছে। কেউ তাকে কিছু বলি না।
কয়েক চুমুকে চায়ের কাপ খালি করে ফেলল শান্তা। এই সময় রেস্তোরায় ঢুকলেন ওদের প্রতিবেশী আজমল সাহেব, স্ত্রীকে নিয়ে। ভদ্রলোক ঠিকাদারী করেন, বেশ ধনী। তার স্ত্রী, ইসমত আরা, ঢাকার মেয়ে, পরচর্চার একনিষ্ঠ ভক্ত। এই যে, শান্তা, তোমরাও বুঝি নাটক দেখতে এসেছ? ভালই হলো। সাইফুল, কেমন আছ? শোনো, শান্তা, ঝর্ণার বরকে আজ বিকেলে ফোন করতে যাচ্ছিলাম, কিন্তু শুনলাম ওরা কেউ বাড়িতে নেই। কোথায় গেছে জানো,
বলতে পারো কবে ফিরবে?
হাসান ভাই সম্ভবত সোমবারে ফিরবেন, ইসমত আপা, বলল শান্তা। তবে ঝর্ণা,আপা কবে ফিরবে বলতে পারছি না।
লাল, ভাঙাচোরা ফিয়াট গাড়িটা তো আমাদের লেখক জামাইয়ের, তাই না? শুক্রবার সন্ধের দিকে দেখলাম আমাদের বাড়ির সামনে দিয়ে ঝড়ের বেগে ছুটে গেল। ব্যাপারটা কি বলো
তো?
কি জানি, এড়িয়ে যাবার সুরে বলল শান্তা
তারমানে স্বামী-স্ত্রীতে আবার ঝগড়া হয়েছে, বললেন ইসমত আরা। আয়েশা বুড়ির মুখে শুনলাম একজন গেছে, সিলেট, আরেকজন গেছে ঢাকা। আবার তুমি এখন বলছ, আমাদের লেখক জামাই সোমবারে ফিরবে, কিন্তু তার বউ কবে ফিরবে কেউ জানে না! ঝর্ণার সাহস আছে বলতে হবে, কি বলো? স্বামীর পাঁজরে খোচা মারলেন তিনি। শালী বাড়িতে রোজ টাইপ করতে আসবে জেনেও স্বামীকে একা রেখে চলে গেল।
চোখ-মুখ লাল হয়ে উঠল শান্তার। অনেক কষ্টে নিজেকে শান্ত রাখল সে, বলল, টাইপ করি ঠিকই, তবে হাসান ভাইয়ের সঙ্গে প্রায় দিনই আমার কোন কথা হয় না। যে যার কাজে ব্যস্ত থাকি আমরা।
তাই? তবে কথা না বললেই বা কি ! অনেক সময় কথা বরং আসল কাজে বাধা সৃষ্টি করে। তাছাড়া, লেখকরা কেমন হয় সবাই তা জানে। সাবধান গো মেয়ে, সাবধান! খিলখিল করে হেসে উঠে রেস্তোরার ভেতর দিকে এগিয়ে গেলেন ইসমত আরা।
চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল শান্তা, মাথা নিচু করে বেরিয়ে এল রেস্তোরা থেকে। সাইফুলকে বলল, নাটক দেখতে ইচ্ছে করছে না আর। আপনি আমাকে বাড়ি পৌঁছে দিন।
সাইফুল বলল, এখন মনে হচ্ছে অফিস থেকে তোমাকে ছেড়ে দিয়ে কাজটা বোধহয় ভাল করিনি আমি। আজ হঠাৎ একটা তাগাদা অনুভব করছে সে। বেশি দিন দেরি করলে শান্তা না তার হাতছাড়া হয়ে যায়। শান্তা হয়তো এখনও তাকে ভালবাসতে পারছে না, কিন্তু সে যে ভালবাসে এটা অন্তত ওকে জানানো দরকার। সাঈদ হাসান নামে এক বিবাহিত লেখকের প্রেমে পড়ে যাবে মেয়েটা, এ-ধরনের একটা ঝুঁকি কেন সে নেবে? কিন্তু কিভাবে প্রেম নিবেদন করতে হয় জানা নেই তার। এমনিতে সে লাজুক মানুষ, কি বলবে ভাবতে গিয়ে ঘেমে যাচ্ছে।
রিকশা নিয়ে ফিরছে ওরা, সাইফুলকে অস্থির লাগছে দেখে শান্তা বলল, আপনি সম্ভবত ইসমত আপার কথা শুনে ঘাবড়ে গেছেন?
হ্যাঁ, না, মানে…উনি কেমন মানুষ সবাই আমরা জানি। তবু বিব্রতকর তো বটেই।
আমি মোটেও বিব্রত হইনি, মিথ্যে কথা বলল শান্তা : এধরনের মানুষের কথায় গুরুত্ব দিলে জীবনটা দুর্বিষহ হয়ে উঠবে। চেহারা গভীর করল সাইফুল; ইচ্ছে হচ্ছিল ল্যাং মেরে ফেলে দিই…।
হেসে ফেলল শান্তা। দিলেন না কেন, দেখার মত একটা ব্যাপার হত।
অধিকার পেলে ওই মহিলাকে আমি একটা জুসই জবাব দিতে চাই, বলল সাইফুল। কিন্তু সে অধিকার কি আমি পাব, শান্তা?
ঝট করে সাইফুলের দিকে ফিরল শান্তা। কথাগুলো বলার পর অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছে সাইফুল। পাশ থেকে আজ তাকে অত্যন্ত সুদর্শন আর ভালমানুষ লাগছে দেখতে। যদিও উত্তরে কি বলবে ভেবে পেল না শান্তা।
আমি কি বলতে চাইছি তুমি বুঝতে পারছ? একটু পর জিজ্ঞেস করল সাইফুল।
হ্যাঁ, বোধহয় পারছি।
তোমাকে আমি সাংঘাতিক ভালবাসি, শান্তা। তুমি বোঝে? তবে আমার ইচ্ছে নয় তোমাকে বিরক্ত বা অস্থির করে তুলি…।
কি বলতে চাইছেন সাইফুল ভাই? প্রথমে শান্তা ভাবল, তার বোধহয় চুপ করে থাকাই উচিত। কিন্তু কৌতুক ও কৌতূহলরোধ দমন করতে পারল না। জিজ্ঞেস করল, ঠিক কি বলতে চাইছেন বলুন তো? & আমার ভালবাসায় কোনরকম জোর-জবরদস্তি নেই, শান্তা। প্রায় অসহায় সুরে কথা বলছ সাইফুল। কারণ আমি ভালবাসলেও তুমি-তোবাসো না। তাই ভেবেছি, বন্ধুত্বটা যদি ধরে রাখতে পারি, এক সময় সেটাই তোমাকে আমার ওপর দুর্বল করে তুলবে। বলবে তুমি, শান্তা, আমার কি সত্যি কোন আশা আছে? আমার কথা তুমি বিবেচনা করে দেখবে?
কিছুক্ষণ কথা বলল না শান্তা। তারপর যা বলল, শুনে তাকে পাবার জন্যে একেবারে যেন পাগল হয়ে উঠল সাইফুলের মন। আপনি খুব সুন্দর মানুষ, সাইফুল, ভাই। আপনি আমার কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একজন মানুষও বটেন। আপনার মত আদর্শবান পুরুষ আমার জীবনে আরেকজন আসবে বলে মনে হয় না। অবশ্যই আপনার কথা বিবেচনা করব আমি। কিন্তু, সাইফুল ভাই, প্রেমভালবাসা জিনিসটা আরও অনেক জটিল। আপনার প্রেমে পড়তে চাই আমি, কারণ এরচেয়ে ভাল আর কিছু হতে পারে না। কিন্তু, সাইফুল ভাই, ভাল বলে উপলব্ধি করলেই প্রেম হয় না।
প্রেম হয়নি, অথচ তুমি আমাকে বিয়ে করলে, এ আমিও চাই না, শান্তা, নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধে কথাগুলো বলল সাইফুল।
আমি জানি আপনি তা চাইবেন না, কারণ নিজের কাছে আপনার একটা মূল্য ও মর্যাদা আছে, একটা মেয়ের সবচেয়ে ভালটুকু আপনি প্রত্যাশা করতে পারেন। সত্যি কথা বলতে কি, সেই মেয়েটি যদি আমি না হয়ে অন্য কেউ হয়, তাকে আমি সহ্য করতে পারব না।
এখন তাহলে কি হবে? শান্তার দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকাল সাইফুল।
বন্ধুত্বটা তো থাকছেই। তবে এখন যখন আমার প্রতি আপনার অনুভূতি সম্পর্কে জানি আমি, আমার কাজ হবে নিজের অনুভূতি কি বলে তা ভাল করে বোঝার চেষ্টা করা। আমি কিন্তু ঠিক বুঝতে পারিনি, সাইফুল ভাই। সবাই আজকাল হিসাব কষে প্রেমে পড়ে, সে হিসেবে প্রতিষ্ঠিত একজন আইন ব্যবসায়ী শান্তার মত অতি সাধারণ একটা মেয়ের প্রেমে পড়বে না, এই ছিল আমার ধারণা। ভেবেছিলাম, আপনি শুধুই ভাল একটা সম্পর্ক রাখতে চান আমার সঙ্গে। এখন আপনাকে আমি অন্য দৃষ্টিতে দেখছি।
মনে হচ্ছিল বলতে দেরি করলে তোমাকে না হারাতে হয়। ভাল যখন বেসেছি, তোমাকে আমার পাবার চেষ্টাও তো করতে হবে। এখন থেকে সে চেষ্টাই করব আমি।
আমি আপনার সাফল্য কামনা করি, ফিসফিস করে বলল শান্তা, তার ঠোঁটে অস্পষ্ট হাসি লেগে রয়েছে।
সোমবার সকাল এগারোটার দিকে ফিরল হাসান, বাড়িতে তখন শান্তা ও আয়েশা বেগম যে যার কাজে ব্যস্ত। কাপড়চোপড় পাল্টেই লাইব্রেরিতে চলে এল সে, তার হাতে সিগারেট দেখে মনে মনে অবাক হলো শান্তা। কি ব্যাপার, আগে তো তাকে কখনও সিগারেট খেতে দেখা যায়নি। যে দুএকটা প্রশ্ন করল শান্তা, দায়সারা গোছের জবাব দিল সে।তারপর নিজে থেকেই বলল, শুক্রবারে বাগানে কিছুক্ষণ কাজ করেছি; আজও করব—এত আগাছা জমেছে, আগে খেয়াল করিনি।
হ্যাঁ, বলল শান্তা। শনিবারে এসে দেখি আপনার বুটে কাদা লেগে রয়েছে। সাফ করার সময় গজগজ করছিলেন আয়েশা আন্টি।
কি দরকার ছিল সাফ করার, শুধু তো বাগানে কাজ করার সময় পরি। তোমার টাইপ কি রকম এগোচ্ছে, শান্তা?
প্রায় শেষ করে এনেছি। আপনার আর রিভাইজ না দিলেও চলবে বোধহয়।
সোফা ছেড়ে ডেস্কের সামনে চলে এল হাসান, টাইপ করা পাণ্ডুলিপিটা নিয়ে জানালার সামনে এসে দাঁড়াল। পাতাগুলো উল্টে দেখছে, ট্রে-তে দুকাপ চা নিয়ে ভেতরে ঢুকলেন আয়েশা বেগম। আজ বিকেলে আমাকে ছুটি দিতে হবে, সন্ধে পর্যন্ত থাকতে পারব না–মীটিঙ আছে তো, বক্তৃতা দিতে হবে। তোমার বাবা কোন অসুবিধে হবে না তো? আমি অবশ্য তোমাদের দুজনের মত রান্না করে রেখেই যাব।
না, ঠিক আছে। রান্না…ঠিক আছে, আন্টি। ঝর্ণা কখন ফিরবে তা অবশ্য আমার জানা নেই। বোধহয় ফোন করবে।
আয়েশা বেগম কামরা থেকে বেরিয়ে না যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করল শান্তা, তারপর হাসানের হাতে তার চায়ের কাপটা ধরিয়ে দিয়ে বলল, আপনাকে আগেই বলা উচিত ছিল, কিন্তু ভুলে গিয়েছিলাম। শনিবারে ফোন করেছিল ঝর্ণা, আপা। ভেবেছিল আপনি তখনও এখানে আছেন।
আচ্ছা! শান্তার দিকে সরাসরি তাকাল হার্সান। যে চোখ জোড়ায় স্বপ্নের ঘোর লেগে থাকতে দেখে শান্তা, এই মুহূর্তে সেখানে তীক্ষ্ণ প্রশ্ন, হুল ফোটাতে চাইবে বলে মনে হলো। আসলে আমিই ওকে বলেছিলাম, সিলেটে নাও যেতে পারি। তখন আমার মন-মেজাজ ভাল ছিল না।
আপা ফিরবে না বলেছে, স্পষ্ট করে বলল শান্তা।
আজ?
হাতের কাপটা নিচু তোপয়ের ওপর নামিয়ে রাখল শান্তা, খুব সাবধানে বলল, ঝর্ণা আপা কেমন যেন অদ্ভুত আচরণ করল। প্রথমে আমি তো তার গলা চিনতেই পারিনি। বলল, তার নাকি প্রচণ্ড ঠাণ্ডা লেগেছে, তাই গলা ভেঙে গেছে।
গলা ব্যথা আর সর্দি তো সারা বছরই লেগে আছে তার। তা কবে ফিরবে, বলেছে কিছু?
না। মাথা নাড়ল শান্তা। শুধু বলল খবরটা যেন আমি আপনাকে জানাই। আবার টেলিফোন করবে কিনা জিজ্ঞেস করতে হাসল, তারপর বলল, তাকে শুধু বলবি আমি ফিরছি না। আমাকে আর কিছু বলতে না দিয়ে রেখে দিল রিসিভার।
কথাগুলো বলতে পেরে নিজেকে হালকা লাগছে শান্তার। তার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকল হাসান, যতক্ষণ না কেঁপে উঠল শান্তার চোখের পাতা। দৃষ্টি ফিরিয়ে ট্রের দিকে হাত বাড়াল শান্তা বিস্কিট নেয়ার জন্যে। তোমার কাছে ব্যাপারটা অদ্ভুত মনে হয়েছে? জিজ্ঞেস করল হাসান।
হবে না! শুধু অদ্ভুত মনে হয়নি, আমার খুব দুশ্চিন্তাও হচ্ছিল। আসলে খবরটা দিতে ভুলে যাইনি, আপনাকে জানাতে ইচ্ছে করছিল না।
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে হাসান বলল, ঠিক বুঝতে পারছি না ঝর্ণা সিরিয়াস কিছু মীন করেছে কিনা। শুক্রবারে তার সঙ্গে আমার। খুব এক চোট ঝগড়া হয়ে গেছে।
সিরিয়াস কিছু? মানে এত খারাপ যে…যে…।
কতটা সিরিয়াসলি নিয়েছে সে-ই জানে। স্টেশনে পৌঁছে দেয়ার সময় আমার সঙ্গে কথা বলেনি।
খানিক ইতস্তত করে শান্তা বলল, আপনাদের ব্যাপারে আমার নাক গলানো উচিত নয়। তবু না বলে পারি না, আপনারা এভাবে ঝগড়া না করলে ভাল হত। দুজনেরই বোঝ উচিত, এতে আপনার কাজের ক্ষতি হয়। সবই আপনাদের ভাল, শুধু..।
সত্যি কি তাই? সবই আমাদের ভাল? মান হাসল হাসান। তুমি আসলে খুব সরল, শান্তা। তবে না, আমাদের ব্যাপার নিয়ে তুমি শুধু শুধু দুশ্চিন্তা করবে না। বিবাহিত জীবন সবারই খুব জটিল, বুঝলে। যা-ই ঘটুক না কেন, আবার সব ঠিক হয়ে যায়।
এরকম ঝগড়া করতে দেখেছি আমার মা-বাবাকে। সব কিন্তু ঠিক হয়ে যায়নি, হাসান ভাই। দ্বিতীয় বিয়ে করে বাবা চলে গেলেন শহরে, দুবছর পর মারা গেলেন, অথচ আমরা খবর পেলাম এক হপ্তা পর। তখন আমার বয়েস মাত্র বারো কি তেরো।
সবার কেস এক রকম নয়, স্বীকার করছি। তবে আমার নার্ভ ইস্পাতের মত শক্ত। তুমি বিশ্বাস করো?
মাথা নাড়ল শান্তা। না, করি না। হাসছে সে।
অপেক্ষা করো, দেখে অবাক হয়ে যাবে। সে যাই হোক, একটা কথা জেনে রাখখা, তোমার আপা ফিরছে না জেনেও আজ অন্তত আমার নার্ভের কোন ক্ষতি হবে না। আরও কদিন দেখব, না ফিরলে টেলিফোন করা যাবে। সে না থাকায় শান্তিতে কাজ করার একটা সুযোগ পাওয়া গেছে।
ব্যাপারটাকে হাসান হালকাভাবে নেয়ায় খুশি হলো শান্তা।
হাতঘড়ির ওপর চোখ রাখল হাসান। পাতা দুয়েক ডিকটেট করার সময় এখনও আছে। তারপর তোমার টাইপ করা পৃষ্ঠাগুলো একবার রিভাইজও দেব। হেসে ফেলল সে। এমন নিখুঁত টাইপ করা লেখা কাটাকাটি করতে সত্যি খুব খারাপই লাগে আমার।
টাইপিস্টের টাইপিং সুন্দর বলে লেখক তাঁর লেখা কাটাকাটি করবেন না, লোকে শুনলে পাগল ভাববে। কিন্তু কাটাকাটি করতে হবে কেন বলুন তো?
তমার চরিত্রটা ঠিক ফুটছে না। মামুনের আচরণ যতই অদ্ভুত। বা অযৌক্তিক হোক, তার ওপর তমার বিশ্বাস থাকা দরকার।
হ্যাঁ, তাহলে আরও বাস্তব হবে চরিত্রটা।
তোমার প্রতিক্রিয়াও কি তাই হত, তুমি যদি কারও প্রেমে পড়তে?
এক মুহূর্ত ইতস্তত করে শান্তা বলল, বোধহয়। হাসান ব্যক্তিগত উদাহরণ টানায় অস্বস্তিবোধ করছে সে।
তাহলে কিছু দূর অন্তত তোমাকেই মডেল ধরে লিখে যাই।
আমাকে মডেল ধরে? কিন্তু আপনি তো আমার চরিত্র সম্পর্কে কিছুই জানেন না।
হাসান হাসল না। ঝর্ণাও বলছিল, মেয়েদের সম্পর্কে আমার নাকি কোন ধারণাই নেই। বিশেষ করে আধুনিক মেয়েদের সম্পর্কে। আমার একমাত্র অজুহাত হলো, বছরের পর বছর এমন মারাত্মক আর্থিক সংকট গেছে, সবচেয়ে কম আবদার করে এমন মেয়েকেও ভয় পেতাম আমি। তারপর লিখে টাকা কামাতে শুরু করলাম যখন, দেখা হলো ঝর্ণার সঙ্গে। আর তাকে বুঝতে পারাটা হিল, একটা হোল-টাইম জব। এমনকি এখনও আমি তার গভীরে পৌঁছুতে পারিনি।
আমরা, মেয়েরা, স্রেফ হিউম্যান বীংস, হাসান ভাই, নরম সুরে বলল শান্তা। পুরুষদের চেয়ে খুব একটা আলাদা নই। বলতে চাচ্ছি, পুরুষরা আমাদের চেয়ে খুব একটা আলাদা নয়।
জনপ্রিয় উপন্যাসগুলোয় তা কিন্তু বলা হয় না। লেখকরা মেয়েদেরকে রহস্যময়ী দেখাতে পছন্দ করেন।
তা পছন্দ করতে পারেন, কিন্তু আসলে ব্যাপারটা সত্যি নয়।
তারমানে নিজেকে তুমি রহস্যময়ী বলে মনে করো না? অবশ্যই না।
খোলা একটা বই? তুমি যা ভাবো তাই বলো, আর তোমার ভাবনাগুলো স্বচ্ছ। তমার চরিত্র সম্পর্কে যা বলেছ, আন্তরিকতার সঙ্গেই বলেছ। তুমি যদি কাউকে ভালবাস, তাকে তুমি বিশ্বাস করবে, তার পাশে দাঁড়াবে, পরিস্থিতি যা-ই হোক না কেন?
হ্যাঁ, থাকব তার পাশে, যদি তাকে আমি ভালবাসি। ভালবাসার প্রশ্ন বাদ দিন, শুধু যদি তাকে পছন্দও করি, তবু তার ওপর আমার বিশ্বাস থাকবে।
তোমাকে পরীক্ষায় ফেলা গেলে খুব ইন্টারেস্টিং একটা ব্যাপার হত।
কৃত্রিম একটা দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করল শান্তা। আমার সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়ার কথা ভুলে গিয়ে হাতের কাজটা শেষ করলে হত না?
তোমাকে আমি অস্বস্তির মধ্যে ফেলে দিচ্ছি। কিংবা হয়তো বিরক্ত করছি-সেটা আরও খারাপ। টাইপ করা কাগজগুলো আবার ওল্টাতে শুরু করল হাসান। শোনো, বাহান্ন পৃষ্ঠা পর্যন্ত ঠিক আছে সব, পরবর্তী পরিচ্ছেদে তমার চরিত্র খানিক বদলাতে হবে। তুমি তৈরি থাকলে আমি ডিকটেট করতে পারি।
শুরু করুন, বলে টাইপরাইটারের সামনে গিয়ে বসল শান্তা। গল্পগুজব বন্ধ হওয়ায় স্বস্তিবোধ করছে সে।
ধীরে ধীরে পার হয়ে যাচ্ছে হপ্তাটা। রোজই ডিকটেট করে হাসান, নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত টাইপ করে শান্তা, কাজ শেষে টাইপরাইটারে কাভার লাগিয়ে বাড়ি ফিরে যায়।
ঝর্ণার কথা প্রায় তোলেই না হাসান, তবে তার অনুপস্থিতিতে দিনে দিনে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠছে শান্তা। এর আগেও ঢাকায় গিয়ে থেকেছে সে, এমনকি এবারের চেয়ে বেশি দিন, তবে প্রতিবারই জানা ছিল কবে সে ফিরে আসবে। এবারের ব্যাপারটা সেরকম নয়। হপ্তার শেষ দিকে একদিন আশা ভিলায় ঢুকে শান্তা দেখল, টেলিফোনের সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে হাসান। কথা শেষ করে রিসিভার রেখে দিল সে, ফিরল শান্তার দিকে। তার চেহারায় দুশ্চিন্তার রেখা দেখতে পেল শান্তা। এইমাত্র হাসি সিদ্দিকীর সঙ্গে কথা হলো, বলল হাসান।
ঢাকায় ওঁদের বাড়িতেই তো উঠেছে আপা, তাই না?
আমি তাই ভেবেছিলাম, বলল হাসান। কিন্তু দেখা যাচ্ছে আমার ধারণা ভুল।
ভুল মানে? আপা ওখানে ওঠেনি? কিন্তু আমাকেও তো বলেছিল যে ঢাকায় গেলে ওখানে থাকবে!
যায়নি ওখানে। তারমানে সিদ্ধান্ত পাল্টেছে। হাসি সিদ্দিকী বলছেন, শুক্রবারে ঝর্ণা তাকে ফোন করেছিল, সন্ধের দিকে। ফোন করে বলে, তার ঠাণ্ডা লেগেছে, তাই রওনা হতে পারছে না।
কোত্থেকে ফোন করেছিল? এখান থেকে? হাসি সিদ্দিকী তা জানেন না, ঝর্ণাকে তিনি জিজ্ঞেস করেননি। ধরে নিয়েছিলেন এখান থেকেই কথা বলছে সে। তবে বোধহয় ঢাকা থেকেই করেছিল। নিশ্চয় তাই।
কিন্তু কেন?
কি করে বলব বলো। ওখানে যায়নি শুনে বুকে রীতিমত একটা ধাক্কা খেলাম। হাসি সিদ্দিকী কি না কি ভেবে বসেন, তাড়াতাড়ি
একটা গল্প বানিয়ে বলতে হলো।
আপা ঢাকায় গেল অথচ হাসি সিদ্দিকীর সঙ্গে দেখা করল না, এরকম তো হবার কথা নয়। আমাকে বলছিল, দুমাসের জন্যে স্বামীর সঙ্গে আমেরিকায় বেড়াতে চলে যাচ্ছে হাসি, যাই একবার দেখা করে আসি। উনিই তো আপার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বান্ধবী, তাই না?
হ্যাঁ। খুবই আশ্চর্য লাগছে আমার। তবে কোন পরিস্থিতিতে কি ঘটেছে, জানি না আমরা। ঢাকায় তোমার আপার আরও তো বন্ধুবান্ধব আছে, হয়তো তাদের সঙ্গে ঢাকার বাইরে কোথাও বেড়াতে চলে গেছে। দেশের বাইরেও যেতে পারে।
দেশের বাইরে? আপা কি সঙ্গে করে পাসপোর্টও নিয়ে গেছেন?
কোথাও গেলে পাসপোর্ট সঙ্গেই রাখে সে। ওর একার পাসপোর্ট ওটা, বিয়ের আগে করা।
চুপ করে থাকল শান্তা। এই প্রথম ঝর্ণা আপার ওপর রাগ হচ্ছে তার। এক সময় মন্তব্য করল, কাজটা আপা ভাল করেননি। এর মানে হলো আপনাকে কষ্ট দেয়া।
ঠিক বলেছ। তবে তোমার আপা বরাবরই একটু নিষ্ঠুর ট্রাইপৈর। কথাটা এভাবে বলা যায়, সে সদয় হবার ভান কখনোই করে না। কোমলতা জিনিসটা তার দৃষ্টিতে দুর্বলতা।
কিন্তু আমার সঙ্গে সব সময় আপা নরম ব্যবহার করে, বলল শান্তা।
শান্তার দিকে ফিরল হাসান, তার চেহারায় মায়া মায়া ভাবটা হঠাৎ পুরোপুরি ফিরে এল। তাতে আশ্চর্য হবার কিছু নেই। আমি এ-কথা বলিনি যে ঝর্ণা মানুষকে পছন্দ করে না। আর তোমাকে তো বিশেষভাবে পছন্দ করে। কেই-বা তোমাকে অপছন্দ করবে। তুমি খুব মিষ্টি মেয়ে।
লজ্জা পেল শান্তা, তাড়াতাড়ি বলল, সবাই আপনার সঙ্গে একমত হবে না। একটু থেমে আবার বলল, সত্যি আপনার জন্যে আমার খুব খারাপ লাগছে। আপাটা যে কি না, শুধু শুধু আপনাকে দুশ্চিন্তায় ফেলে দিয়ে মজা পায়।
সে চাইছে বটে আমি দুশ্চিন্তা করি, তবে তার আশা আমি পূরণ করছি না, বলল হাসান। এসো, তার কথা আমরা বরং ভুলে থাকি। তুমি জানো না, কিছু দিন ধরে কি অশান্তির মধ্যে রেখেছিল আমাকে সে। বাড়িটা এখন শান্ত হয়েছে, আমিও শান্তিতে আছি। অনেক দিন পর কাজ করার একটা পরিবেশ পাওয়া গেছে। এবার বইটা ভালভাবে লেখা যাবে।
হ্যাঁ, আধুনিক প্রেমের ওপর এটাই আপনার প্রথম উপন্যাস। পটভূমিটা আমার খুব পছন্দ। কিন্তু, হাসান ভাই, আপার খোঁজখবর নেয়া দরকার না?
কি করার আছে আমার বলো? ঢাকার সবাইকে ফোন করে লোক হাসাক তার মানে হবে ঢাক-ঢোল পিটিয়ে সবাইকে জানানো যে আমরা সুখী নই।
হ্যাঁ, কিন্তু…।
বলো তুমি কি ভাবছ। শান্তার দিকে কৌতূহলী দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল হাসান।
আমি ভাবছি…না, মানে, কোন দুর্ঘটনা ঘটেনি তো?
সেরকম কিছু ঘটলে জানা যেত। ঢাকার কাগজ দিনেরটাই তো পাচ্ছি, হাসপাতাল থেকে ফোন আসতে পারত…।
হ্যাঁ, তা-ও ঠিক। হাসান ভাই…।
উঃ?
এসব হয়তো আমার ছেলেমানুষি, আমি হয়তো একটু বেশি রোমান্টিক, তবে যতই ঝগড়াঝাটি করুন আপনারা, আমার ভাবতে ইচ্ছে করে আপনারা পরস্পরকে প্রচণ্ড ভালবাসেন। জানি আপা খুব মেজাজী মানুষ, হার মানতে একদম রাজি নয়, কিন্তু তারপরও যত দেখি ততই মুগ্ধ হই, কি আছে বলতে পারব না অকালেই ভাল লাগে, কথা বললে শুধু শুনতেই ইচ্ছে করে। আপনিও তো আপার সমস্ত জেদ বেশিরভাগ সময় মেনেই নেন। আপনি যে তাকে সত্যি ভালবাসেন…।
সব জিনিসেরই একটা সীমা আছে, শান্তা, মান গলায় বলল হাসান। ভালবাসা থাকলে অত্যাচার সহ্য করা যায় ঠিকই, কিন্তু কতদিন?
হ্যাঁ, তা ঠিক। যাই হোক, এ-সব আপনাকে আমার বলা উচিত হলো না। টাইপরাইটারের দিকে ঘুরল শান্তা, কিন্তু হঠাৎ অনুভব করল পিছন থেকে তার কাঁধে হাত রাখল হাসান।
শান্তাকে নিজের দিকে ফেরাল সে। আজ লেখালেখি বাদ দিই এসো। আমার ভাল লাগছে না।
তাহলে বাগানে গিয়ে মাটি কোপান, কিংবা কোথাও থেকে খানিক হেঁটে আসুন।
না। তোমার সঙ্গে গল্প করব। তুমি খুব বুদ্ধিমতী, তোমার পরিমিতি বোধও দারুণ। কেউ তোমাকে ব্যক্তিগত কোন কথা বললে সেটা গোপন থাকবে। তোমার আপার জীবনের কোন কথা বললে সেটা গোপন থাকবে। তোমার আপার জীবনের কোন কথা নয়, আমার নিজের কথা বলব তোমাকে। তাহলে তুমি ব্যাপারটা বুঝতে পারবে।
কিন্তু…কিন্তু সেটা কি উচিত হবে? পরে হয়তো পস্তাবেন আপনি।
জানি কি বলতে চাইছ। মানুষ ঝোঁকের মাথায় এমন সব কথা বলে ফেলে যা বলা উচিত নয়। তবে আমার ব্যাপারটা অন্যরকম। গত আট-দশ মাসে আমাদের দুজনেরই খুব কাছাকাছি চলে এসেছ তুমি। যদিও তুমি ঝর্ণার বোন, তার সঙ্গে তোমার রক্তের সম্পর্ক, তাসত্ত্বেও আমার ভাবতে ভাল লাগে তুমি তার চেয়ে আমারই বেশি আপন। তুমি আমার কাজের অংশীদার।
যদিও কোন অবদান রাখতে পারি না, বলল শান্তা।
অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছ। তোমার সাজেশনকে আমি মূল্য দিই। শান্তা, নিজেকে এভাবে গুটিয়ে রাখতে চেয়ো না, আমার ওপর তাহলে অন্যায় করা হবে।
হাসান ভাই, এসব কি বলছেন আপনি! অস্থির, দিশেহারা বোধ করছে শান্তা। তার ভয় লাগছে, একটা যোতের মধ্যে হাসান ভাইয়ের সঙ্গে সে-ও না ভেসে যায়। আবার নিরাপদ তীরে দাড়িয়ে থাকতে আরও বেশি ভয় পাচ্ছে, হাসান ভাই না তার কাছ থেকে চিরকালের জন্যে হারিয়ে যান। উনি কি বলতে চান শোনা দরকার তার।
বলার খুব বেশি কিছু নেই, বলল হাসান, সামান্য তিক্ত হাসি ফুটল তার ঠোঁটে। ঝর্ণাকে আমি পাগলের মত ভালবেসেছিলাম, এখন তারই খেসারত দিতে হচ্ছে আমাকে। ভুলে গিয়েছিলাম আমি একজন লেখক, সেই সঙ্গে আমি একজন পুরুষও তো। নিজের অহম থেকে ভাল কিছু উদ্ধার করতে পারে শুধু একজন লেখক, তবে তার জন্যে সময় আর পরিবেশ থাকা চাই। ঝর্ণার সঙ্গে জীবন। কাটাতে হলে এ-সব আমি কোনদিনই পাব না। ইদানীং ব্যাপারটা সমস্ত সহ্যসীমার বাইরে চলে গেছে। শুক্রবারে তাকে আমি বলেছি, আমি আর তার মেজাজ সহ্য করতে রাজি নই। অত্যাচার যদি করতেই চায়, অন্য কাউকে খুঁজে নিতে হবে।
হাসান ভাই, আপাকে আপনি ভুল বুঝছেন। প্রতিবাদ করল শান্তা। তার শুধু মেজাজটা দেখছেন আপনি, ভাল দিকগুলো…
ভাল দিক যদি কিছু থাকে তা সম্ভবত অন্য কোন লোকের জন্যে তুলে রেখেছে সে, আমার জন্যে নয়। এ-কথা বলাতেই। আমার ওপর খেপে দূরে সরে গেছে। এবার একটা পরীক্ষা হয়ে যাবে, শান্তা। মনের গভীরে সত্যি যদি আমার প্রতি তার কোন টান থাকে, ফিরে আসবে সে, ফিরে আসবে সম্পূর্ণ নতুন একজন ঝর্ণা হয়ে।
মানুষ কি চাইলেই নিজেকে বদলাতে পারে?
চেষ্টা করতে পারে, প্রমাণ করতে পারে চেষ্টা করছে।
আর যদি আপনার ধারণা ভুল হয়, হাসান ভাই? ধরুন আপাকে আপনি যেমন চিনেছেন সেটাই তার আসল রূপ?
সেক্ষেত্রে তার আর ফিরে না আসাই ভাল। আমি হাঁপিয়ে উঠেছি।
নিজেকে আমার অসুখী লাগছে, মনের অবস্থা সরল ভাষায়, প্রকাশ করল শান্তা। এত ভাল লাগত আপার প্রতি আপনার…নিষ্ঠা। ভাবতাম, এ-সব সহ্য করার ফল একদিন অবশ্যই আপনি পাবেন, আপা সুস্থ হয়ে গেলে ঠিকই আপনার দিকে খেয়াল দেবে।
সুস্থ হয়ে গেলে মানে? তার চোখে তো আসলে কিছুই হয়নি।
তা জানি। আপাও তা জানে। আমাকে বলেছে, রোগটা আসলে হয়েছে স্নায়ুর ওপর চাপ পড়ায়।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল হাসান। তুমি আমাকে শুধু ঝর্ণার স্বামী হিসেবে না দেখলে খুশি হতাম, তার গলায় খানিকটা অসন্তোষ।
তা কেন দেখব। আপনি মানুষ হিসেবে আমার আদর্শ। আপনি খুব উঁচুদরের একজন লেখকও বটেন। আপাও তা জানে। তার মেজাজ বা অত্যাচার সম্পর্কে যা বললেন তা আংশিক সত্যি হতে পারে…।
শান্তাকে থামিয়ে দিয়ে হিসহিস করে উঠল হাসান, তাকে তুমি চেনো না তাই এ-কথা বলছ। তোমার আপা সাংঘাতিক আত্মসচেতন মেয়ে, শুধু নিজের কথা ভাবে। এমনকি…এমনকি আমাদের ঘনিষ্ঠ সময়গুলোয়ও নিজের কথা ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারে না।
প্লীজ, চুপ করুন! নিজের অজান্তেই প্রায় চেঁচিয়ে উঠল শান্তা।
হাসানের হাত দুটো এখনও শান্তার কাঁধে। এবার একটা হাত অনাবৃত ঘাড়ের ওপর চলে এল। এক মুহূর্ত নরম নগ্ন চামড়ার ওপর স্থির হয়ে থাকল আঙুলগুলো, তারপর হাতটা তুলে নিল সে। স্বস্তিবোধ করল শান্তা; কিন্তু তার সঙ্গে যেন মিশে রয়েছে বঞ্চিত হবার একটা অস্পষ্ট বেদনা।
আমার ভুল হয়েছে, বিষন্ন সুরে বলল হাসান। বিশ্বাস করো, ঝর্ণার বিরুদ্ধে তোমার মনটাকে আমি বিষিয়ে তুলতে চাই না।
তোলেনওনি। আমি মেয়ে বলেই বোধহয় আপাকে বোঝ আমার পক্ষে সহজ। গোটা ব্যাপারটা অবশ্য খুবই দুঃখজনক।
পিছনে দাঁড়িয়ে থাকায় হাসানের চোখের তারায় ঝিক করে ওঠা কৌতুক দেখতে পেল না শান্তা। তবে শুনতে পেল সে বলছে, আরও হপ্তাখানেক চুপ করে থেকে দেখি না কি করে। ফিরে যদি না-ও আসে, অন্তত একটা চিঠি তো লিখবে।
প্রায় এক মাস হতে চলল অথচ মেয়েটা ফিরছে না, গজ গজ করছেন আয়েশা বেগম। জিজ্ঞেস করলেই তোর দুলাভাই বলে কবে ফিরবে তার জানা নেই। কিন্তু এ তো আর মেনে নেয়া যায় না, শান্তা। তুই যা-ই বলিস বাপু, এর মধ্যে নিশ্চয়ই গভীর কোন ষড়যন্ত্র আছে। তার কিছু না হলে অন্তত একটা চিঠি তো লিখত!
আপনি জানলেন কিভাবে লিখেছে কিনা? জিজ্ঞেস করল শান্তা।
লিখলে তোর দুলাভাই তোকে অন্তত বলত। বলেছে কি?
না। কিন্তু আমাকে কেন বলতে যাবে?
শান্তার দিকে আড়চোখে তাকিয়ে আয়েশা বেগম বললেন, এবাড়িতে মেয়েদের প্রতি যে গভীর চক্রান্ত শুরু হয়েছে, তোকেও তাতে জড়ানো হবে বলে আমার ধারণা।
আপনার ধারণা নিয়ে থাকুন আপনি। শুধু দয়া করে এসব কথা হাসান ভাইয়ের সামনে বলবেন না। ঝর্ণা আপা এখান থেকে গিয়ে পরদিনই আমাকে টেলিফোন করেছিল, বলেছে ফিরতে তার দেরি হবে।
কিন্তু বেশিদিন থাকতে হলে তো সঙ্গে করে বেশি করে কাপড়চোপড় নিয়ে যাবে। তা তো নিয়ে যায়নি। আমি তাকে ছোট্ট একটা স্যুটকেস গোছাতে দেখেছি। শাড়ি নিয়ে গেছে মাত্র দুটো। বেশ ঠাণ্ডা পড়েছে, অথচ গরম শাল বা কোট কিছুই তো নেয়নি।
ঢাকা থেকে হয়তো কিনে নেবে, বলল শান্তা।
বাড়িতে এ-সব থাকা সত্ত্বেও শুধু শুধু পয়সা খরচ করবে?
কিংবা হয়তো কিনবে না, বান্ধবীদের কাছ থেকে চেয়ে নেবে।
দরজা খুলে গেল, ভেতরে ঢুকল হাসান। মাথায় ঘোমটা টেনে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে গেলেন আয়েশা বেগম। মনে হলো তোমরা
যেন গোপন কিছু আলাপ করছিলে? জিজ্ঞেস করল হাসান।
না, আন্টি বলছিলেন হঠাৎ খুব ঠাণ্ডা পড়েছে, কোট বা শাল নেয়নি বলে আপা খুব কষ্ট পাবে।
দেখো দেখি কাণ্ড, কি ভুলো মন আমার! বাম হাতের তালুতে ডান হাত দিয়ে ঘুসি মারল হাসান। কাল সন্ধের দিকে ঝর্ণা ফোন করেছিল আমাকে, বলল তার কাপড়চোপড়গুলো যেন পাঠিয়ে দিই। বিশেষ করে নতুন ঘাগরা সেটটা।
খুশিতে নেচে উঠল শান্তার চোখ। সত্যি? আপা ফোন করেছিল? কি বলল? কেমন আছে আপা? ইস, আমার কি যে ভাল লাগছে! শান্তা অনুভব করল তার কাঁধ থেকে যেন ভারি একটা বোঝা নেমে গেছে।
ভাল লাগছে ঠাণ্ডায় কষ্ট পাচ্ছে বলে তো? আমারও। এরকম একটু কষ্ট পাওয়াই দরকার তার। হেসে উঠল হাসান।
হাসান ভাই, আপনি জানেন আমি তা বোঝাতে চাইনি। আমি খুশি হয়েছি আপা যোগাযোগ করায়। আপনিও নিশ্চয় খুব দুশ্চিন্তায় ছিলেন। কবে আসছে আপা?
কি জানি। এ-সব যখন পাঠাতে বলছে, তাড়াতাড়ি ফিরবে বলে মনে হয় না। শান্তার দিকে একদৃষ্টে কয়েক সেকেণ্ড তাকিয়ে থাকল হাসান, তারপর জানতে চাইল, তুমি কি সত্যি চাও তাড়াতাড়ি এখানে আবার ফিরে আসুক সে?
কি বলছেন! অবশ্যই চাই! হাসানের দৃষ্টি এড়াবার জন্যে অন্য দিকে তাকাল শান্তা।
অথচ সে না থাকায় এখানে আমরা ভালই সময় কাটাচ্ছি, তাই? কাজও খুব ভাল এগোচ্ছে। বিলে পাখি শিকার করতে যাব আমি, তুমিও আমার সঙ্গে যাবে বলে কথা দিয়েছ। নাকি ভুলে গেছ?
না, ভুলব কেন।তাড়াতাড়ি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল শান্তা, অনুভব করছে হঠাৎ আড়ষ্ট হয়ে উঠেছে পরিবেশটা। কি কি চেয়েছে আপা বলুন, স্যুটকেসে ভরে দিই, কিভাবে পাঠাবেন?
পাঠাব না, কাল আমি নিজেই ঢাকায় নিয়ে যাব। কথা হয়েছে, সালাম রোড ট্রান্সপোের্ট-এর অফিসে দেখা হবে আমাদের। তোমার আপা বোধহয় কোলকাতায় যাবে, তার কজন বন্ধুর সঙ্গে। ওদের কাউকে আমি চিনি না, তবে তার নাকি খুব ঘনিষ্ঠ তারা।
ও।
তারপর হাসান বলল, আমার আসলে সব কথা খুলে বলা দরকার। ঠিক কোথায় যাচ্ছে সে, আমি আসলে সঠিক জানি না, কোথায় আছে তা-ও জানি না। বলেছে ট্রান্সপোর্ট অফিসে দেখা করার চেষ্টা করবে, আবার এ-কথাও বলেছে যে দেখা না হলে আমি যেন স্যুটকেসটা ওই অফিসেই জমা রেখে আসি। টিকেটটা রমনা পোস্টাপিসের একটা পোস্ট-বক্সে পাঠিয়ে দিলেই হবে।
আশ্চর্য! এর মানে কি? হতভম্ব দেখাল শান্তাকে।
সে যদি দেখা করতে না চায়, ঠিকানা দিতে না চায়, আমি কি করতে পারি, বলো?।
তারমানে কি আপা আর…আপনাদের মধ্যে এ কি ঘটছে বলুন তো!।
কাঁধ ঝাকিয়ে অসহায় ভঙ্গি করল হাসান। তুমি যেখানে আমিও সেখানে। ফোনে ঝর্ণা আমার কোন প্রশ্নেরই উত্তর দেয়নি।
কিন্তু তাই বলে আপনি কিছু করবেন না? গত এক মাসে নিশ্চয়ই কেউ না কেউ তাকে দেখেছে। সেই যে মেয়েটা, আপার ভক্ত, সব সময় যাকে সাহায্য করে.সোহানা। ফেরত পাবে না জেনেও প্রায়ই যাকে টাকা ধার দেয়। প্রতি হপ্তায় পরস্পরকে চিঠি লেখে ওরা। আপা ঢাকায় গেলে তার সঙ্গে তো যোগাযোগ করবেই।
মাথা ঝাঁকাল হাসান।
তার ঠিকানা তো আমাদের কাছে আছেই, বলল শান্তা।
তা আছে। বেশ, কাল তোমার আপার সঙ্গে দেখা না হলে সোহানার বাড়িতে যাব আমি। তুমি ঠিকই বলেছ, শান্তা। সত্যি এবার একটা কিছু করা দরকার আমার। ব্যাপারটা আর এভাবে পুলিয়ে রাখা যায় না।
শান্তা উপলব্ধি করল, বলার মত কিছু নেই তার। খুব ভয় করছে, মনে হচ্ছে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিচ্ছেদের যে করুণ ঘণ্টা বাজছে, তার মধ্যে ওরও সূক্ষ্ম একটা ভূমিকা রয়েছে। সবচেয়ে ভীতিকর ব্যাপার হলো, হাসান ভাইয়ের প্রতি নির্লিপ্ত থাকতে পারছে না সে। এখান থেকে চলে যাওয়া উচিত আমার, ভাবল সে। আপা নেই, কাজেই হাসান ভাইয়ের কাছাকাছি আমারও থাকা উচিত নয়। কিন্তু কিভাবে সরব আমি? কোথায় যাব? শান্তা কোন উত্তর খুঁজে পাচ্ছে না।
বৃহস্পতিবার খুব সকালে ঢাকায় চলে গেল হাসান। সন্ধের দিকে নিজেদের বাড়িতে রয়েছে শান্তা, কয়েকটা ব্লাউজের কাপড় নিয়ে হাজির হলেন ইসমত আরা, ফারুনী ইসলামকে, দিয়ে সেলাই করাবেন। মা ও মেয়ে, দুজনেই তখন রান্নাঘরে। ব্লাউজের মাপ দেয়ার সময় বক বক শুরু করলেন তিনি। এক মাসের বেশি হয়ে গেল ঝর্ণা নিখোঁজ। মেয়েটা মারা গেছে কিনা তাই বা কে বলবে?
পরশুদিন তো বেঁচে ছিল, ঠাণ্ডা সুরে বলল শান্তা। চুলোর দিকে পিছন ফিরে বসে চুল শুকাচ্ছে সে, অনেক দিন পর আজ শ্যাম্পু দিয়েছে মাথায়। ফোন করে কিছু কাপড়চোপড় চেয়েছে। বিশেষ করে লাল-সোনালি কাজ করা ঘাগরা সেটটা। কথাটা বলল শান্তা একটা ঘটনার কথা মনে পড়ে যাওয়ায়। ঘাগরার ডিজাইন এত সুন্দর, যে দেখবে তারই লোভ হবে। ইসমত আরার বয়েস পঁয়ত্রিশের কম নয়, তিনিও ঝর্ণার কাছে জানতে চেয়েছিলেন কোথেকে ওটা বানানো হয়েছে। কিন্তু মহিলাকে সম্ভবত পছন্দ করে না বলেই টেইলারিং শপের নামটা তাকে বলেনি ঝর্ণা। হাসান ভাই আজ সকালে ওগুলো নিয়ে গেছেন।
ইসমত আরা হতাশ হলেন। যা শুনছি সবই তাহলে গুজব? ওদের ছাড়াছাড়ি হচ্ছে না? আমি ভাবলাম আবার বোধহয় ভাঙল ঘর।
আবার ঘর ভাঙল মানে? জিজ্ঞেস করল শান্তা, এবার ফাল্গুনী ইসলামও হাতের কাজ বন্ধ করে মুখ তুলে তাকালেন। হেসে, উঠলেন ইসমত আরা। আপনারা জানেন না? হঠাৎ ব্যথা পেয়ে চিৎকার করে উঠলেন তিনি। খালাম্মা, আপনার হাতে সুঁই নাকি? বিধছে তো!
ও, হ্যাঁ, ছি-ছি! দেখতে পাইনি, মা! বললেন বটে, তবে ফাল্গুনী ইসলামের চেহারায় সহানুভূতি ফোটেনি।
আপনাদের না জানাটা খুব অদ্ভুত, ইসমত আরা বললেন। ঝর্ণার প্রথম বিয়েটা হয়েছিল পাঁচ বছর আগে। কিন্তু সে বিয়েও সুখের হয়নি। ছেলেটা টিভিতে অভিনয় করত, তবে নাম করতে পারেনি। কি কারণে জানি না, ঝর্ণাকে ছেড়ে চলে যায় সে। স্বামী ত্যাগ করায় সাংঘাতিক মুষড়ে পড়েছিল ঝর্ণা। এই ঘটনার কয়েক হপ্তা পর ভারত থেকে খবর আসে, পশ্চিমবঙ্গের দিঘা থেকে, সাগরে ডুবে মারা গেছে সে। সে-সময় একটা সিনেমায় কাজ করছিল ঝর্ণা, স্বামীর মৃত্যু সংবাদ পেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ে, ফলে ছবিটা আর করতে পারেনি। বাপ টাকা রেখে গেছে, নাচ-গান জানা শিক্ষিত মেয়ে, ঢাকা ও কোলকাতার শিল্পীদের সঙ্গে খাতির আছে; ক্যারিয়ার গড়ে তুলতে না পারলেও অসুবিধে হয়নি। আমার জানা মতে, কোলকাতায় বা দিঘায় এক বান্ধবীর বাড়িতে বেশ কয়েক মাস ছিল সে। আরও পরে আমাদের লেখক সাহেবের লেখা একটা নাটকে অভিনয় করার জন্যে ডাকা হয় তাকে অভিনয় খারাপ করেনি, তবে, আবার অসুস্থ হয়ে পড়ে ঝর্ণা। তারপর কি হলো আমরা সবাই তা জানি।
কোন মন্তব্য না করে বিস্ময়কর খবরটা শুনে গেল মা ও মেয়ে। তবে প্রিয় লেখক সাঈদ হাসানের প্রতি শান্তার শ্রদ্ধা আরও যেন বেড়ে গেল। তার ঝর্ণা আপার প্রতি হাসান ভাই কতটা সদয়। ঝর্ণা আপার ক্ষতবিক্ষত জীবনটা মেরামত করার জন্যে সাধ্যমত চেষ্টা করেছেন তিনি, সে যাতে আবার নতুন করে গড়ে তুলতে পারে সুখের ঘর। অথচ বিনিময়ে ঝর্ণা আপা তার সঙ্গে কি আচরণটাই না করছে।
বিদায় নেয়ার আগে ইসমত আরা বললেন, হয়তো সত্যিই ঝর্ণা ফোন করেছে। হয়তো জামাই তার সঙ্গে দেখা করার জন্যেই ঢাকায় গেছে। তবে আবার এ-ও হতে পারে যে ঝর্ণা হয়তো তার স্মৃতিশক্তি হারিয়ে ফেলেছে, কিংবা তার মাথায় কোন গোলমাল দেখা দিয়েছে। খোঁজ নিলে হয়তো দেখা যাবে গোটা ব্যাপারটাই তার স্বামীর একটা চাল। আজকাল কিছুই বলা যায় না।
হ্যাঁ, তোমার ঝর্ণা আপার সঙ্গে দেখা হলো। আগের চেয়ে অনেক ভাল দেখলাম তাকে। বিশ্বাস করবে, গত এক মাস ধরে চশমাটাও আর তাকে পরতে হচ্ছে না। লক্ষণ দেখে মনে হচ্ছে খুব তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠবে।
ইস, কি ভাল যে লাগছে আমার! অন্তর থেকে বলল শান্তা।
হাসানের চোখের দৃষ্টি তীক্ষ হলো। কিন্তু তোমার কি হয়েছে বলো তো? এমন ম্লান দেখাচ্ছে কেন?
কাল রাতে ঘুম হয়নি ভাল, বলল শান্তা। বোধহয় ঠাণ্ডা লেগেছে। কাল সন্ধের দিকে মাথায় শ্যাম্পু দিয়েছিলাম, কিন্তু ভাল করে চুল শুকানো হয়নি। ইসমত আপা এমন একটা খবর শোনালেন। না! সে যাকগে, আপনি আমাকে আপার কথা বলুন।
বললাম তো, খুব ভাল আছে সে। তার কয়েকজন বান্ধবীর সঙ্গে কাল রাতে, কোলকাতা রওনা হয়ে গেছে। এখনও পৌছোয়নি, কার নিয়ে গেছে। বলল, মাসদেড়েক থাকতে পারে।
তারপর ফিরে আসবে এখানে? আমার অন্তত তাই আশা। তবে এই জায়গা তার একেবারেই পছন্দ নয়। বলল, এখানে আর ফিরতে না হলেই খুশি হয় সে। ঠিক কোন প্ল্যান করা হয়নি, তবে আমাকে বোধহয় ঢাকায় একটা ফ্ল্যাট ভাড়া করতে হবে। তোমার আপা বলছে বটে ভাড়াটে তুলে দিয়ে নিজের ফ্ল্যাটে উঠতে চায়…।
তারমানে এবার সত্যি সত্যি এখান থেকে আপনারা চলে পাবেন?
শান্তার দিকে একটু ঝুঁকল হাসান। তুমি দেখছি খুব ভেঙে পড়ছ!
মুখ ঘুরিয়ে অন্য দিকে তাকাল শান্তা, নিচু গলায় বিড়বিড় করল, কই, না।
দূর বোকা, বলল হাসান। এখনও তো কিছু ঠিক হয়নি। আমার তো একেবারেই ইচ্ছে নয় এই জায়গা ছেড়ে কোথাও যাই।
টাইপরাইটারের দিকে ঘুরে বসল শান্তা। আজ কি আপনি ডিকটেট করবেন? না করলে বাকি লেখাগুলো টাইপ করে ফেলি : আমি।
না, ডিকটেট করার আগে চিন্তা-ভাবনার দরকার আছে। গল্পটা আরও জমজমাট হওয়া দরকার।
এমনিতেও গল্পটা দারুণ ইন্টারেস্টিং হচ্ছে এখন, মন্তব্য করল শান্তা।
তা যদি হয়, তাতে তোমারও খানিকটা অবদান আছে। বলা যায় না, তোমার সাহায্য নিয়ে আমি হয়তো এবার একটা বেস্ট সেলারই লিখে ফেলছি।
আবার সেই কথা! শান্তার চেহারায় কৃত্রিম রাগ। আপনি কি এখনও এই বলে নিজেকে ধোকা দিচ্ছেন যে তমার সঙ্গে আমার চরিত্রের মিল আছে?
শান্তার কাছ থেকে সরে গেল হাসান, লাইব্রেরির মেঝেতে পায়চারি শুরু করল। ভেবে দেখো ব্যাপারটা, বলল সে। বইটার শুরুতে তমা আর মামুন যে পরিস্থিতির মধ্যে পড়েছে, আমাদের পরিস্থিতি তারচেয়ে খুব একটা আলাদা কি? মামুনের স্ত্রী মারা গেছে, এবং সবাই জানে বিবাহিত জীবনে তারা কেউ সুখী ছিল না। লোকে তাদের ঝগড়াঝাটি, স্ত্রীর রগচটা স্বভাব নিয়ে ফিসফাস করে। আর যেহেতু তার স্ত্রী অল্পবয়েসে হঠাৎ মারা গেছে, পাড়া-প্রতিবেশীরা মামুনের বিরুদ্ধে একটা কেস দাঁড় করাতে চাইছে। মামুনের অন্ধ ভক্ত বলা যায় তমাকে, তার বিশ্বাস মামুনের দ্বারা কোন অন্যায় কাজ হতে পারে না, যদিও ঘটনা আর পরিস্থিতি দিনে দিনে মামুনের বিরুদ্ধে চলে যাচ্ছে। তমার অন্ধ ভক্তি ক্রমশ অন্ধ প্রেমে রূপ নিল। যখন এমনকি স্ত্রীকে হত্যার অভিযোগে মামুনের পিছনে পুলিশ লাগল, তখনও মামুনকে অবিশ্বাস করতে রাজি নয় তমা।
দুটো পরিস্থিতির মধ্যে আমি তো কোন মিল দেখতে পাচ্ছি না। কেন আপনি একথা বলছেন?।
না, এক অর্থে অমিলটাই বেশি। যেমন, শান্তা, তুমি আমার ততটা অন্ধ ভক্ত নও, তমা যতটা মামুনের। আর ঝর্ণাও বহাল তবিয়তে বেঁচে আছে—তার সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে, কথাও হয়েছে, তুমিও কথা বলেছ ফোনে। তবে স্যাডিস্টিক ধরনের একটা কৌতূহল আমার আছে বটে, জানতে ইচ্ছে করে কুৎসাপ্রিয় প্রতিবেশীরা গোপন ও মর্মান্তিক কোন ঘটনার সঙ্গে আমাকে জড়িত করছে কিনা।
চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল শান্তা, হাত-পা কাঁপছে তার। এসব কথা আমার ভাল লাগছে না, বলল সে।
হাসান হাসল, সেটাকে মজা পেয়ে বিদ্রুপাত্মক হাসি বলা যায়। খুব খুশি হতাম, বুঝলে শান্তা, যদি দেখতে পেতাম আমার জন্যে খানিকটা দরদ আছে তোমার।
হাসানের চোখে এমন বিহ্বল দৃষ্টিতে তাকাল শান্তা, ওগুলো যেন সম্মােহিত করে রেখেছে তাকে। হাসান যখন এগিয়ে এসে তার হাত ধরল, সে কোন কথা বলতে পারল না, এমনকি বাধা দেয়ারও কোন ইচ্ছে হলো না। গায়ে হাত পড়লে মেয়েরা নাকি নেতিয়ে পড়ে, কথাটা যে সত্যি আজ তার প্রমাণ পেল হাসান। হাতটা খুব জোরে চেপে ধরায় কজিতে ব্যথা অনুভব করছে শান্তা, কিন্তু নিজেকে ছাড়িয়ে নেয়ার কোন চেষ্টা করছে না। তার শরীর ঝিমঝিম করছে, ব্যথা পাবার একটা তীব্র আকাঙ্ক্ষা জাগছে শিরায় শিরায়। শুধু অসহ্য লাগছে বুকের ব্যথাটা, মনে হচ্ছে খাচার ভেতর ফেটে যাবে হৃৎপিণ্ড। একবার মনে হচ্ছে তার নারীত্বকে শ্রদ্ধা ও সম্মান জানাতে চাইছে একজন পুরুষ, পরমুহূর্তে মনে হচ্ছে অপমানিত করা হচ্ছে তাকে। শরীর ও মন, দুটো আলাদা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে, দুটোর কোনটারই নিয়ন্ত্রণ শান্তার হাতে নেই। আশ্চর্য! ভাবছে সে। এই মানুষটাকে আমি চিনি না! কোনদিনই চিনতে পারিনি!
শান্তাকে নিজের বুকে টেনে নিল হাসান। চুমো খাবার জন্যে ঝুঁকছে সে। জানতাম, আমি জানতাম! আমার প্রতি তোমার মায়া আছে, আমাকে তুমি ভালবাসো! একজন বিজয়ীর সুরে কথা বলছে সে।
এরপর দশ-পনেরো সেকেণ্ড যা ঘটল, সে-কথা ভাবলেই কেঁপে উঠবে শান্তার শরীর, ভুলে থাকতে চাইবে সব।
তারপর কথা বলার শক্তি ফিরে পেল শান্তা। মুখটা অন্য দিকে ঘুরিয়ে নিল সে, বলল, কি জানি…একেই কি মায়া করা বলে? কিংবা ভালবাসা?
আমি তোমাকে কাছে ধরে রাখায় তোমার ভাল লাগছে না?
তোমাকে আমি কত ভালবাসি বোঝার পর নিজেকে তোমার সুখী লাগছে না? কিছুই কি তুমি অনুভব করছ না?
শরীরের কথা বাদ দিন, তার অন্যরকম চাহিদাও থাকতে পারে, নিচু, তবে স্পষ্ট সুরে বলল শান্তা। কিন্তু অলসা তো মনের ব্যাপার, হাসান ভাই। নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে চেষ্টা করল সে। আপনি আমাকে মায়া করায় আমি বাধা দিতে পারিনি, তার মানেই কি আপনাকে আমি ভালবাসি?
হঠাৎ যেন আগুনের ছ্যাকা খেয়েছে, প্রায় ছিটকে শান্তার কাছ থেকে সরে এল হাসান। তারমানে তুমি…!
আমাকে ভাল লাগা আপনার উচিত নয়, হাসান ভাই, বিড়বিড় করে বলল শান্তা।
কিন্তু কার কি ক্ষতি করছি আমরা? ঝর্ণা আমাকে এক ফোঁটা ভালবাসে না। তুমি মুক্ত, সময় হলে আমিও নিজেকে মুক্ত করে নিতে পারি। আমার দিকে ফেরো, শান্তা, তাকাও। স্বীকার করো, তোমার সম্পর্কে আমি যা বিশ্বাস করি সব সত্যি। পরিস্থিতি যা-ই। হোক, তুমি কি আমার পাশে দাঁড়াবে না? গোটা দুনিয়া যদি আমার বিরুদ্ধে চলে যায়, তুমিও কি আমার ওপর বিশ্বাস হারাবে?
না, বলল শান্তা। আমি আপনার সঙ্গে থাকব।
জানতাম এ-কথাই বলবে তুমি! আবার এগিয়ে আসতে গিয়েও নিজেকে সামলে নিল হাসান। জানি, অন্যায় সুযোগ নিতে খাচ্ছিলাম। তুমি অত্যন্ত নরম আর মিষ্টি মেয়ে, তোমাকে সাংঘাতিক কঠিন একটা পরীক্ষায় ফেলে দিচ্ছি। আমরা কেউ তো জানি না আমাদের জন্যে কি আছে ভবিষ্যতে। তারপর নিজেকে আর ধরে শাখতে পারল না সে। এগিয়ে এসে আবার শান্তার একটা হাত গল। চুমো খাবার জন্যে আবার ঝুঁকল।
হাসান ভাই, প্লীজ, আমাকে যেতে দিন, কোন রকমে বলল শতা, মনে হলো কেঁদে ফেলবে।
শান্তাকে বরং অবাক করে দিয়ে আবারও হাতটা ছেড়ে দিল হাসান। ধপ করে চেয়ারটায় বসে পড়ল শান্তা, মুখ ঢাকল দুহাতে। নিঃশব্দে কাঁদছে সে। আমার…আমার অসুস্থ লাগছে!
এখন আমি তোমার সম্পর্কে নিশ্চিত, শান্তা, বলল হাসান, তার মাথায় একটা হাত রাখল। কথা দিচ্ছি, তোমাকে আর কষ্ট দেব না। শুধু একটা কথা মনে রাখতে বলব, আমি তোমাকে বিশ্বাস করি। প্রয়োজনে বিশ্বাস করে নিজের জীবনটাও আমি তোমার হাতে তুলে দিতে পারি। কোনদিন ভুলো না কথাটা।
শান্তা ভাবছে, কি অদ্ভুত সব কথা বলছেন হাসান ভাই! দিশেহারা ভাবটা এখনও অস্থির করে রেখেছে তাকে।
আজ কোন কাজ করবে না তুমি, আবার বলল হাসান। তুমি একা বিশ্রাম নাও, আমি একটু ঘুরে আসি। একা থাকলে চিন্তাভাবনা করার সুযোগ পাবে। ভবিষ্যৎ নিয়ে কথা বলার আরও অনেক সময় পাওয়া যাবে।
হাসান বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাবার খানিক পর রান্নাঘরে চলে এল শান্তা। আয়েশা বেগম চুলোয় তরকারি বসিয়ে, হাসানের স্যুটটা টেবিলে ফেলে ইস্ত্রি করছেন। মুখ ফিরিয়ে তাকিয়েই চমকে উঠলেন। কি হয়েছে, শান্তা? তোকে অমন দেখাচ্ছে কেন?
একটা মোড়া টেনে চুলোর কাছে বসল শান্তা, তার শীত করছে। ঠাণ্ডা লেগেছে, আন্টি। মাথাটাও ধরেছে। আজ আর কাজ করব না, বাড়ি ফিরে যাচ্ছি। হাসান ভাই বাইরে গেছেন, উনি ফিরলে আপনি যাবেন, কেমন? আপনার কাছে এলাম এক কাপ চা খাব বলে।
তরকারির পাতিল নামিয়ে চা চড়ালেন আয়েশা বেগম। হ্যাঁ চালিয়ে কাজ করছেন তিনি, ট্রাউজারটা ইস্ত্রি করা হয়ে গেল শান্তাকে চা দিয়ে টেবিলের ওপর কোটটা ফেললেন, বললেন, কোটের একটা বোম দেখছি নেই।
চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছে শান্তা, তাকিয়ে আছে সাদা দেয়ালের দিকে। টেবিল থেকে কোটটা তুলে একবার ঝাড়া দিলেন আয়েশা বেগম। কি পড়ল!
তার কথা শুনে তাকাল শান্তা, দেখল কোট ঝাড়া দেয়ায় একটা কাগজ পড়ে গেছে মেঝেতে। হাত বাড়িয়ে সেটা তুলে নিলেন আয়েশা বেগম। কাগজের ওপর লেখাটা পড়লেন তিনি, সালাম রোড ট্রান্সপোর্ট, আরমানিটোলা, ঢাকা। মুখ তুলে শান্তার দিকে তাকালেন। ব্যাপার কি বল তো? তোর দুলাভাই আমাকে বলল, স্যুটকেসটা দিয়ে এসেছে ঝর্ণাকে, অথচ এখানে দেখা যাচ্ছে সেটা জমা রাখা হয়েছে ট্রান্সপোর্ট কোম্পানীর অফিসে। এর মানে কি?
মানে যা-ই হোক, আমাদের মাথা ঘামানোর দরকার কি।
তা ঠিক। কিন্তু অত সুন্দর ঘাগরা, শাল, কোট, সবই যদি ট্রান্সপোর্ট অফিসে পড়ে থাকবে, তাহলে ওগুলো ঢাকায় নিয়ে যাবার কি দরকার ছিল? এই রসিদ ছাড়া তো স্যুটকেসটা ওদের কাছ থেকে চাইতে পারবে না ঝর্ণা।
আন্টি, এ-সবের নিশ্চয়ই কোন ব্যাখ্যা আছে।
কি, শোনা আমাকে। গত এক মাস ধরে ভাল-মন্দ কত চিন্তা আসা-যাওয়া করছে আমার মাথায়। মেয়েটা এভাবে চলে গেল, তারপর তার আর কোন খবর নেই। এর ভেতর কিছু একটা রহস্য অবশ্যই আছে। চারদিকে মেয়েদের বিরুদ্ধে যা শুরু হয়েছে…।
আয়েশা বেগমের হাত থেকে রসিদটা তুলে নিল শান্তা। তুমি থামো, তো। থাক এটা আমার কাছে, দেখা হলে হাসান ভাইকে দেব।
জানতেও চাইবি, আসলে কি ঘটেছে। ব্যাপারটাকে এখন আর হালকা করে দেখার উপায় নেই। চারপাশে লোকজন কি বলে বেড়াচ্ছে শুনবি?
না, আমার শোনার দরকার নেই, বলে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এল শান্তা।
পরদিন ঠাণ্ডাটা আরও পেয়ে বসল শান্তাকে, ফারুনী ইসলাম মেয়েকে বিছানা থেকে উঠতেই দিলেন না। কিভাবে যেন খবর পেয়ে গেছে সাইফুল, কোর্ট থেকে ফেরার পথে এক ঝুড়ি ফল, কয়েকটা সাপ্তাহিক ম্যাগাজিন আর রজনীগন্ধার কয়েকটা উঁটা নিয়ে হাজির হলো সন্ধের দিকে। সে আসতেই ওদের দুজনকে একা রেখে রান্নাঘরে গিয়ে ঢুকলেন ফাল্গুনী ইসলাম, তারপর আর বেরুবার নাম নেই। স্বভাবতই শান্তার মনে হলো সাইফুলকে একটা সুযোগ দিচ্ছেন তার মা। সাইফুলও সুযোগটা পুরোপুরি কাজে লাগাল।
অসুস্থ শান্তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিল সাইফুল, হাতে হাত রাখল, তারপর ফিসফিস করে বলল, হাসান সাহেবের চাকরিটা তোমার ছাড়া উচিত। বড় বেশি পরিশ্রম করতে হয়।
জানি, এরপর আপনি আমাকে আপনার অফিসে ফিরে যেতে বলবেন,মান হেসে বলল শান্তা।
আরও বলব, তুমি আমাকে বিয়ে করো, তোমাকে সুখী করার একটা সুযোগ দাও আমাকে।
চাদরটা বুকের ওপর টেনে কাত হলো শান্তা, সরাসরি সাইফুলের দিকে তাকাল। আচ্ছা, সত্যি করে বলুন তো, আমার মধ্যে কি দেখেছেন আপনি? আমি তো খুব সাধারণ একটা মেয়ে। আর আপনার যে পসার, যে গুণ, যে-কোন বড়লোকের সুন্দরী একটা মেয়েকে অনায়াসে স্ত্রী হিসেবে পেতে পারেন। আমাকে বিয়ে করলে আপনি তো কিছুই পাবেন না। তারচেয়ে ধনী কোন পরিবারে বিয়ে করলে…।
আমি চাইও ঠিক তাই, শিক্ষিত পরিবারের অতি সাধারণ একটা মেয়ে। কেন তা চাই শুনলে তুমি হয়তো অবাক হবে। তুমি জানো, আমি খুব গরীব পরিবারের ছেলে, লেখাপড়া শিখে অনেক কষ্টে মানুষ হয়েছি। তবে বড় বা ধনী লোকদের ওপর আমার কোন রাগ নেই, কারণ ধনী হওয়া এমন একটা অপরাধ যা আমরা সবাই করতে চাই। এ এমন একটা অপরাধ, যে যত বেশি করতে পারে, সমাজ তাকে তত বেশি সম্মান দেয়। আইনের প্যাচ কষে আমিও প্রচুর কামাব বলে আশা রাখি, শান্তা। সমাজ যে অনিশ্চয়তা উপহার দিচ্ছে, তা থেকে বাচার জন্যেই এই পাপ আমাকে করতে হবে। সেজন্যেই খুব সাধারণ, শিক্ষিত পরিবারের একটা মেয়ে চাই আমার, ঠিক তোমার মত, যে আমার ছেলেমেয়েকে আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে তুলবে।
ভারি অদ্ভুত কথা শোনালেন তো। আপনি আমাকে বিয়ে করতে চাইছেন নিজের ছেলেমেয়েদের রক্ষা করার জন্যে। তারমানে ধরে নিচ্ছেন নিজে আপনি বিপথগামী হবেনই, কেউ আপনাকে রক্ষা করতে পারবে না?
তা তো জানি না, তোমার অত শক্তি আছে কিনা। আমারও যদি লাগাম টেনে ধরে রাখতে পারো তুমি, সেটাকে উপরি পাওনা বলে মনে করব। তবে এ-কথা ঠিক যে নিজের ব্যাপারে অতটা উদ্বিগ্ন আমি নই যতটা ছেলেমেয়েদের ব্যাপারে। শুনলে তুমি লজ্জা পাবে, তবু কথাটা বলতেই হবে আমাকে। যাকে বিয়ে করতে চাইছি তার সঙ্গে সত্যি যদি আমার বিয়ে হয়, আমি চাইব আমাদের ছেলেমেয়ে হবে কম করেও এক ডজন-বারোটা। কেন জানো? কারণ, আমার বিশ্বাস, এই মেয়েটির হাতে পড়লে বাচ্চাগুলো মানুষের মত মানুষ হবে। এবার তোমার প্রশ্নের উত্তর পেলে? বুঝতে পারছ, কেন আমি ধনী কোন সুন্দরী মেয়েকে বিয়ে করতে চেয়ে তোমাকে বউ করতে চাইছি?
আপনি অনেক বদলে গেছেন, সাইফুল ভাই, সে থামার পর বলল শান্তা। আপনার এ-সব কথা শোনার পর আপনাকে বিয়ে না করতে পারাটা আমার জন্যে অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক হবে। কিন্তু এই মুহূর্তে বিয়ের কথা আমি ভাবছি না। সাইফুল ভাই, আমাকে আরও সময় দিতে হবে।
চেহারা মান হয়ে গেলেও, জোর করে হাসল সাইফুল। আমাকে তুমি এড়িয়ে যেতে পারবে না। সাধারণ মেয়েরাও যে দুর্লভ হয়, আমি জানি। আমি ধৈর্য ধরতে রাজি আছি।
সেদিন অনেক রাত পর্যন্ত শান্তাদের বাড়িতে থাকল সাইফুল, ফাল্গুনী ইসলাম তাকে না খাইয়ে ছাড়লেন না।
কাজে বুয়া আসেনি, তার ছেলের হাম না কি যেন হয়েছে, কাজেই খবর দিয়ে আয়েশা বেগমকে আনিয়েছেন ইসমত আরা। বুড়ি মানুষ, অন্তত হালকা কয়েকটা কাজ করে দিয়ে যাবেন। এক ঢিলে দুই পাখি মারছেন আসলে ইসমত আরা। ঝর্ণা আর তার স্বামীর ভেতরের খবর পেতে হলে আয়েশা বেগমকেই দরকার তাঁর।
প্রসঙ্গটা তুলতেই আয়েশা বেগম চোখ বড় বড় করে বললেন, আমাদের ঝর্ণা সত্যি বেঁচে আছে কিনা সে-ব্যাপারে আমার সন্দেহ আছে। জামাই বলছে বটে টেলিফোনে কথা হয়েছে তার সঙ্গে, ঢাকায় গিয়ে দেখাও করে এসেছে, কিন্তু কে প্রমাণ করবে? তারপর তিনি ট্রান্সপোর্ট কোম্পানীর রসিদ পাবার ঘটনাও সবিস্তারে বর্ণনা করলেন।
ইসমত আরা বললেন, কি সাংঘাতিক! তা খালা, রসিদটার। কথা ঝর্ণার স্বামীকে তুমি জিজ্ঞেস করোনি?
রসিদটা তো শান্তার কাছে, আমাকে বলল সে-ই তার দুলাভাইকে জিজ্ঞেস করবে। কিন্তু দেখা হলে তো জিজ্ঞেস করবে, অসুস্থ হয়ে বিছানায় পড়ে আছে।
শান্তা হঠাৎ অসুস্থই বা হলো কেন? আশপাশে কেউ নেই, তবু ফিসফিস করে কথা বলছেন ইসমত আরা। খালা, এর মধ্যে অন্য কিছু নেই তো আবার? খালি বাড়িতে একটা পুরুষ আর একটা যুবতী মেয়ে সারাদিন একা থাকে, কত কিছুই তো ঘটতে পারে, তাই না?
আমিও তো সে কথা বলি, পুরুষরা হলো কাল সাপ! ওদেরকে বিশ্বাস করেছ কি মরেছ। যখনই দেখি, দুজন শুধু ফিসফিস করছে।
আর কি দেখেছ, খালা? মানে, ভয় পাবার মত কিছু চোখে, পড়েছে তোমার? বললে কিনা ঝর্ণা বেঁচে নেই বলে সন্দেহ হচ্ছে তাই জিজ্ঞেস করছি।
দেখব না কেন, অবশ্যই দেখেছি। ওদের সব ষড়যন্ত্র আমার কাছে ফাঁস হয়ে যায়।
কি দেখেছ খালা?
বলা হচ্ছে ঝর্ণা ঢাকায় গেছে শুক্রবারে। শনিবার সকালে আশা ভিলায় কাজ করতে গিয়ে দেখি বারান্দায় জামাইয়ের কাদা মাখা বুট পড়ে রয়েছে। তারমানে ঝর্ণাকে স্টেশনে পৌঁছে দিয়ে বাড়িতে ফিরে এসেছিল জামাই, ফিরে এসে বাগানে কিছুক্ষণ কাজ করে, তারপর সিলেটে চলে যায়।
ঝর্ণাকে ট্রেনে তুলে দিয়ে সরাসরি কেন সিলেটে যায়নি? স্বগতোক্তি করছেন ইসমত আরা। আমি তাকে গাড়ি চালিয়ে স্টেশনের দিক থেকে বাড়ি ফিরতে দেখেছি, একা…।
তা হয়তো ফিরছিল লোককে এ-কথা বোঝাবার জন্যে যে ঝর্ণাকে সে ট্রেনে তুলে দিয়ে এল।
তারমানে তুমি ভাবছ বাগানে ঝর্ণাকে…? চোখ দুটো বিস্ফারিত হয়ে গেছে ইসমত আরার। কী সাংঘাতিক! এ তো আর গোপন রাখা উচিত নয়। আজই তোমাদের জামাইকে বলব আমি। আমরা প্রতিবেশী, ঝর্ণা আমাদের পাড়ার মেয়ে, আমাদের একটা দায়িত্ব আছে…।
এক সময় দরজায় কয়েকজন প্রতিবেশীর সাড়া পাওয়া গেল, ইসমত আরার সঙ্গে গল্প করতে এসেছে তারা। আয়েশা বেগমকে কাজে লাগিয়ে দিয়ে মেহমানদের নিয়ে বৈঠকখানায় বসলেন তিনি। শুরু হলো গল্প, বিষয় ঝর্ণার নিখোঁজ রহস্য।
সোমবারে সুস্থ বোধ করায় সকালেই আশা ভিলায় চলে এল শান্তা। ভেতরে ঢুকে রান্নাঘরে উঁকি দিল সে, দেখল আপনমনে কাজ করছেন আয়েশা বেগম। লাইব্রেরিতে ঢুকতেই ডেস্ক থেকে মুখ তুলে তাকাল হাসান, শান্তাকে দেখে হাসল। ভেব না তুমি না আসায় আমি কাজে ফাঁকি দিচ্ছি। নতুন একটা পরিচ্ছেদ শুরু করেছি, বুঝলে! তোমার সর্দি কেমন আছে?
প্রায় সেরে গেছে। বিছানায় পড়ে থাকা কি যে কষ্ট আর একঘেয়ে। হাসান ভাই, আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করব…।
জানি, সেদিন তোমাকে ধরেছিলাম বলে আমার ওপর সাংঘাতিক খেপে আছ তুমি…।
প্লীজ, হাসান ভাই, ব্যাপারটা ভুলে যান! আমি আপনাকে অন্য প্রসঙ্গে…।
বুঝতে পারছি, আমার কাজটা ছেড়ে দিয়ে অন্য কোথাও চাকরি নেবে তুমি, এই তো?
আমার বোধহয় তা-ই করা উচিত, তবে এখনও কিছু ঠিক করিনি। আমি জানতে চাইছি…, হাতব্যাগ খুলে ভেতর থেকে ট্রান্সপোর্ট কোম্পানীর রসিদটা বের করল শান্তা। আপনার কোটের পকেট থেকে আয়েশা আন্টি পেয়েছেন এটা।
ও। তো? হাসানের গলার সুর একদম স্বাভাবিক।
রসিদটা আপনার কাছে থাকলে ঝর্ণা আপা স্যুটকেসটা পাবেন কিভাবে?
গাড়ি করে কোলকাতা যাচ্ছে, অত বড় স্যুটকেস নেবে কিভাবে? ওটা খুলে যা যা দরকার ছিল বের করে নিল, তারপর রসিদটা আমার কাছে রেখে দিতে বলল, তার কাছে থাকলে নাকি হারিয়ে ফেলবে।
ব্যাখ্যাটা এত সহজ আর বিশ্বাসযোগ্য, স্বস্তিতে হেসে ফেলল শান্তা। উফ, আমি যা ভয় পেয়েছিলাম না!
হাসানের চোখে কৌতূহল। ভয় পেয়েছিলে? কিসের ভয়?
না, মানে, ভেবেছিলাম আসলে বোধহয় ঝর্ণা আপার সঙ্গে আপনার দেখা হয়নি। আপনি মুখ রক্ষার জন্যে বানিয়ে বলেছেন। শান্তা উপলব্ধি করল, এর বেশি কিছু বলা তার পক্ষে সম্ভব নয়।
দেখা হয়েছে, সে ভালও আছে, বলল হাসান। তাকে নিয়ে দুশ্চিন্তা করার কোন কারণ বা দরকার নেই তোমার।
দরকারও নেই?
সে এখানে ফিরে আসবে কিনা সন্দেহ আছে আমার। একসঙ্গে বাস করতে হলে, তার কথামত আমাকে ঢাকায় থাকতে হবে। কিন্তু ঢাকায় আমি থাকব কিনা তা এখনও ঠিক করিনি। যদি থাকি, তুমিও কি আমাদের সঙ্গে ওখানে থাকবে, শান্তা? তখনও তো আমার একজন টাইপিস্ট দরকার হবে, তাই না?
এটা একটা প্রশ্ন হলো? মা আমাকে ছাড়বে? আমিই বা কেন আপনাদের সঙ্গে থাকতে রাজি হব?
হ্যাঁ, তাই তো। তবে, এখনও কোন সিদ্ধান্ত হয়নি। ঝর্ণার সঙ্গে ঢাকায় আমি থাকতে রাজি না-ও হতে পারি। তা যদি না থাকি, এই বাড়িটাও আমাকে ছেড়ে দিতে হবে, কারণ এটাও তো তোমার আপারই বাড়ি। সেক্ষেত্রে আশপাশে ভাল কোন বাড়ি ভাড়া পাওয়া যায় কিনা দেখতে হবে।
আপাকে ছেড়ে আপনি থাকতে পারবেন? নিচু গলায় জিজ্ঞেস করল শান্তা।
শান্তা, তোমার আপা আমাকে ছেড়ে থাকছে, আমি নই। যদি ছাড়াছাড়ি হয়েই যায়, দায়ী থাকবে সে একা। আমি তো ভয় পাচ্ছি। ঝর্ণা আমাকে হঠাৎ ডিভোর্সও করতে পারে।
কি বলছেন?
চেয়ার ছেড়ে উঠল হাসান, শান্তার সামনে এসে দাঁড়াল। তুমি কি আমার জন্যে অপেক্ষা করবে, শান্তা? ডিভোর্স না হওয়া পর্যন্ত? সত্যি যদি আমাকে ভালবাস তুমি, অপেক্ষা করতে বলাটা অন্যায় কোন দাবি নয়।
হাসান ভাই, প্রথম কথা আপনাকে ভালবাসা আমার উচিত নয়, গলাটা কেমন ভেঙে ভেঙে গেল শান্তার। তাছাড়া আমি জানিও না আপনাকে ভালবাসি কিনা।
সেদিন যখন তোমাকে আমি আদর করলাম, তখন বোঝানি?
সেটা কি ভালবাসা ছিল? উচ্চারণ তো করলই, প্রশ্নটা শান্তার মনকেও অস্থির করে তুলেছে। এই সময় তার একটা হাত ধরে নিজের দিকে আকর্ষণ করল হাসান। না, হাসান ভাই…প্লীজ। পিছিয়ে এল শান্তা। আপনার কাছে এলেই আমার সব কেমন যেন ওলটপালট হয়ে যাচ্ছে। আমাকে চিন্তা করতে হবে। আমাদের মধ্যে যে ছোঁয়াছুঁয়ি হয়ে গেছে, সেটা যথেষ্ট নয়, হাসান ভাই। তার সঙ্গে বিশ্বাস, নিশ্চয়তা আর শ্রদ্ধাবোধও থাকতে হবে।
আমি তোমাকে বলেছি, তোমার ওপর আমার পুরোপুরি। বিশ্বাস আছে। যা কিছু ভাল, সুন্দর আর মিষ্টি, তোমাকে আমার সে-সবের আধার মনে হয়। কসম খেয়ে বলছি, শান্তা, আমার ওপর তুমি ভরসা রাখতে পারো। তোমাকে ছুঁয়ে অন্যায় করেছি আমি, তবে নিশ্চিত হওয়াটা জরুরী ছিল আমার জন্যে।
কি বলতে চান বুঝলাম না।
তোমাকে যখন ছুঁলাম তখন যদি আমাকে তুমি ঘৃণা করতে, আমাদের সম্পর্কটা ওখানেই শেষ হয়ে যেত। কিন্তু তা তুমি করোনি। তুমি সাড়া দিয়েছ। আমি চাই, ওই মুহূর্তগুলো চিরকাল মনে রাখবে তুমি। ঝর্ণার কাছ থেকে মুক্তি পেয়ে আমি যখন তোমাকে বিয়ের প্রস্তাব দেব, উত্তর দেয়ার সময় আমি চাই ওই মুহূর্তগুলোর কথা মনে থাকবে তোমার। ওই স্মৃতি আসলে জাদুর একটা কাঠির মত, শান্তা। পরস্পরকে আমরা স্বীকৃতি দিয়েছি। যতদিন ঘটনাটা মনে থাকবে, অন্য কোন পুরুষের হাতে নিজেকে তুমি তুলে দিতে পারবে না। বলতে পারো, তোমার ভবিষ্যৎ বন্ধক রাখা হয়েছে।
হাসানের চোখ দুটো শান্তাকে যেন সম্মােহিত করে রেখেছে। বেশ কয়েক সেকেণ্ড কোন কথা বলতে পারল না সে, শুধু অপলক তাকিয়ে থাকল। তারপর বলল, কোন মেয়ে কি এভাবে সব কিছু দান করতে পারে? প্রশ্নটা যেন একা হাসানকে নয়, নিজেকেও করছে সে। তার গোটা জীবন, সম্পূর্ণ ভবিষ্যৎ-কোন নিরাপত্তা ছাড়াই?
শান্তা, ভালবাসায় নিরাপত্তা বলে কিছু থাকে কি?
কিছু কিছু লোকের বেলায় থাকে বলেই আমার ধারণা, কিন্তু আপনার আর আমার বেলায়…নাহ্, হাসান ভাই, জিনিসটা আমরা চোরাবালির ওপর দাঁড় করাবার চেষ্টা করছি। এ-ধরনের কিছু করার অধিকার আমরা রাখি না। আপনি ঝর্ণা আপার, ঝর্ণা আপা আপনার।
ঝর্ণা আমাকে ত্যাগ করবে। কি আশ্চর্য, আমিই কি প্রথম লোক নাকি যে অত্যাচারী স্ত্রীর কাছ থেকে ডিভোর্স পেয়ে প্রেমিকাকে বিয়ে করতে চাইছে? শান্তা, আমার অন্তত এই কথাটা বোঝার চেষ্টা করো—তোমার কাছে আমি শান্তি পাব।
আচ্ছা ধরুন ব্যাপারটা ঘটল, ঝর্ণা আপা ডিভোর্স দেয়ার পর আপনি আমাকে বিয়ে করলেন, কিন্তু আপনার কাছে কি পাব আমি?
বিশ্বস্ত একজন স্বামী পাবে, শ্রদ্ধা ও ভালবাসতে পারো এমন একজন মানুষ পাবে। তার সাফল্যেরও ভাগ পাবে তুমি, কারণ তার জন্যে তুমি একটা প্রেরণা। শোনো, এ-সব কথা যে অক্ষরে অক্ষরে সত্যি তা প্রমাণ করার জন্যে খোদার কসম খেয়ে বলছি, তোমাকে আর আমি ভুলেও স্পর্শ করব না, যতদিন না সে অধিকার আমি পাই। ছোঁয়াছুঁয়ির ব্যাপারটাকে তুমি অন্যায় বলে মনে করছ, তোমার এই নীতিবোধ আমি শ্রদ্ধা করি। আমি শুধু তোমাকে আমার জন্যে অপেক্ষা করতে বলছি, অনুরোধ করছি আমার ওপর বিশ্বাস না হারাতে। খুব বেশি কিছু চাওয়া হয়ে যাচ্ছে?
বুঝতে পারছি না, হাসান ভাই…শুধু বুঝতে পারছি, আপনার কাজ আমার ছেড়ে দেয়া উচিত। যা ঘটে গেছে তারপর আর এবাড়িতে কাজ করা আমার উচিত নয়।
আমি প্রতিজ্ঞা করছি আর কখনও তোমাকে ছোঁব না, তারপরও? কথা দিচ্ছি, তোমাকে দাদী-নানীদের মত সম্মান করব, তারপরও…!
না, কারণ নিজেকে আমি আপনার দাদী-নানী বলে মনে করতে পারছি না।
হেসে ফেলল হাসান। বলা উচিত ছিল, আমার মেয়ের মত। ঠিক আছে, শান্তা, যেতেই যখন চাও, ঈদের পর চলে যেয়ো। উপন্যাসটা মাঝপথে রয়েছে, এখন তুমি চলে গেলে বিপদে পড়ে যাব। লেখাটা শেষ করার জন্যে তোমাকে আমার দরকার।
এ আপনি অদ্ভুত কথা বলছেন, বলল শান্তা, তার দুই ভুরুর মাঝখানটা কুঁচকে উঠল।
অদ্ভুত বলছ কেন? তোমাকে বলিনি, তুমি আমার প্রেরণা? তোমার উপস্থিতি আমাকে অনুপ্রাণিত করে? তমার সঙ্গে তোমার এত মিল, লেখার সময় ভুলে যাই তোমাদের দুজনের মধ্যে কোন পার্থক্য আছে কিনা।
এর কোন মানে হয় না। ব্যাপারটা শুধুই আপনার কল্পনা। হাসান ভাই; আজ আমি বুঝতে পারছি, আপনার লেখার ব্যাপারে নাক গলানো উচিত হয়নি আমার, উচিত হয়নি তমা চরিত্রটিকে আরও বাস্তব করার কথা বলা।
কেন বলছ এ-কথা? তুমি নিজেই স্বীকার করেছ, লেখাটা দারুণ ভাল হচ্ছে। আমারও আশা, বইটা বেস্ট-সেলার হতেও পারে। শান্তা চুপ করে আছে দেখে আবার বলল হাসান, তোমার বোধহয় ধারণা, তোমার আত্মা আর হৃদয়ের খানিকটা চুরি করে তমাকে আমি দিয়ে দিয়েছি।
এ-সব বন্ধ করুন, প্লীজ। এসব ফ্যান্টাসী আমাকে ভয় পাইয়ে দিচ্ছে। আমাদের আগের সম্পর্কটাই ঠিক ছিল…আপনি শুধুই আমার প্রিয় লেখক ছিলেন, আপনার কাজ করে তৃপ্তি পেতাম আমি …।
কিন্তু সময়ের কাঁটা তো ঘুরিয়ে দেয়া যায় না, খানিকটা হতাশ সুরে বলল হাসান, ম্লান হয়ে উঠল তার চেহারা। তোমার কিন্তু অনেক কাজ জমে গেছে, যদি চাও তো এখুনি শুরু করতে পারি আমরা।
অনুগত ভঙ্গিতে টাইপরাইটারের সামনে চেয়ারটায় বসল শান্তা, হাতে লেখা পাণ্ডুলিপির পাতা ওল্টাতে শুরু করল। হাসান হঠাৎ আগ্রহ হারিয়ে ফেলায়, তার ঠাণ্ডা ও নির্লিপ্ত গলা শুনে, মনটা খারাপ হয়ে গেছে। আবার একই সঙ্গে খানিকটা স্বস্তিবোধও করছে।
বিকেলে হাসান বাইরে বেরুতেই শান্তাকে ধরলেন আয়েশা বেগম। রসিদটা দেখিয়েছিস? কি বলল তোর দুলাভাই?
আপনাকে তো আগেই বলেছি, নিশ্চয়ই এর কোন ব্যাখ্যা আছে। ঝর্ণা আপা স্যুটকেস থেকে যা নেয়ার নিয়ে ট্রান্সপোর্ট অফিসেই রেখে গেছে ওটা। ওদেরকে বলা আছে, কোথাও পাঠাতে হবে না, পরে এক সময় রসিদ দেখিয়ে চেয়ে নেয়া হবে। ঠিক হয়েছে প্রতিদিন পাঁচ টাকা করে চার্জ করবে ওরা। অত বড় সুটকেস, কোলকাতায় নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। রসিদটা আপা নিজের কাছে রাখেনি হারিয়ে ফেলার ভয়ে।
অবিশ্বাসে মাথায় হাত দিলেন আয়েশা বেগম। তুই এই গল্প বিশ্বাস করলি?
গল্প বলছেন কেন? যা সত্যি তাই বলেছেন হাসান ভাই।
মাথা নাড়লেন আয়েশা বেগম। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, তোর আসলে কি হয়েছে বল তো? তুই তো এত বোকা কখনও ছিলিস না!
বিশ্বাস না হয় আপনি নিজেই হাসান ভাইকে জিজ্ঞেস করুন। তার মন-মেজাজের যে অবস্থা, ধমক দিলে আমি কিছু জানি না।
কি যেন লুকাচ্ছিস তুই। কিছু একটা হয়েছে তোর! বলতে বলতে বিদায় নিলেন আয়েশা বেগম।
ঘণ্টাখানেক পর ফিরে এল হাসান। এবার বাড়ি যাবে শান্তা। দরজা খুলে বাইরে বেরুবে, এই সময় নক হলো দরজায়। কবাট খুলে শান্তা দেখল, ছাই রঙের স্যুট পরা মধ্যবয়স্ক এক ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে রয়েছেন। সে কিছু বলার আগে ভদ্রলোকই জিজ্ঞেস করলেন, হাসান সাহেব কি বাড়িতে আছেন?
আছেন, বলল শান্তা। কি বলব তাকে? আপনার পরিচয়?
আমি থানা থেকে এসেছি। বলুন ইন্সপেক্টর সোহেল চৌধুরী কথা বলতে চান। কিন্তু আপনার পরিচয়?
হাঁ হয়ে গেল শান্তা। বলল, আমি শান্তা ইসলাম, সাঈদ হাসান আমার দুলাভাই। ভদ্রলোককে বৈঠকখানায় বসিয়ে রেখে প্রায় ছুটে চলে এল লাইব্রেরিতে। হাসান ভাই, থানা থেকে সাদা পোশাকে একজন পুলিশ অফিসার এসেছেন। ইন্সপেক্টর সোহেল চৌধুরী, আপনাকে ডাকছেন।
পুলিশ কেন আসবে? কি চায়?
আমি কি করে বলব! আমার কেমন যেন লাগছে!
চলো তো দেখি, বলে লাইব্রেরি থেকে বেরিয়ে এল হাসান।
বৈঠকখানায় ওরা ঢুকতেই সোফা ছেড়ে দাঁড়ালেন ইন্সপেক্টর সোহেল চৌধুরী, হ্যাণ্ডসেকের জন্যে হাসানের দিকে বাড়িয়ে দিলেন হাতটা। আপনি বিখ্যাত লেখক, পরিচিত হয়ে খুশি হলাম। বসুন, প্লীজ।
সিঙ্গেল একটা সোফায় বসল হাসান। সোফাটার পিছনে দাঁড়িয়ে থাকল শান্তা, তার হাতের তালু এরইমধ্যে,ঘামতে শুরু করেছে। কি ব্যাপার বলুন তো, ইন্সপেক্টর সাহেব? জিজ্ঞেস করল হাসান।
না, তেমন কিছু না। প্রতিবেশীদের মধ্যে কিছু গুজব ছড়িয়েছে..ইয়ে মানে, আপনার স্ত্রীকে নিয়ে। আমি শুধু কয়েকটা প্রশ্ন করব আপনাকে।
শিরদাঁড়া খাড়া হয়ে গেল হাসানের। কোন দুঃসংবাদ, ইন্সপেক্টর? তার কোন খারাপ খবর পেয়েছেন আপনারা?
না…না, আমি বরং এই প্রশ্নটাই আপনাকে করতে এসেছি, হাসান সাহেব। আমার মনে হয়, আপনার স্ত্রীর সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ করিয়ে দিলে গোটা ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে যায়। এই মুহুর্তে কোথায় আছেন তিনি?
ঠিক এখনি যোগাযোগকরিয়ে দেয়া সম্ভব নয়, বলল হাসান। – আমার স্ত্রী তার কয়েকজন বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে গাড়ি নিয়ে কোলকাতা গেছেন, ছয় থেকে আট হপ্তা থাকার কথা সেখানে। তিনি তাঁর বন্ধু-বান্ধবদের নাম আমাকে বলেছিলেন বটে, তবে…, মাথায় একটা টোকা মারল সে, …একদম ভুলে গেছি। না, তাদের আমি চিনি না।
ও। তাহলে তো ব্যাপারটা জটিল হয়ে গেল, তাই না? তিনি আপনাকে কোন চিঠিও লেখেননি?
চিঠি লেখার অভ্যাস তার নেই। তবে ফোন করেছিলেন গত হপ্তায়, তারপর ঢাকায় আমি তার সঙ্গে দেখা করতেও যাই।
বলবেন কি, কোথায় আপনাদের দেখা হলো?
হেসে উঠল হাসান। দেখা হয়েছে আরমানিটোলায়, একটা ট্রান্সপোর্ট কোম্পানীর অফিসে। কিন্তু, ইন্সপেক্টর, আমাকে এসব প্রশ্ন করার কারণটা কি বলুন তো?
কারণটা হলো, আপনার প্রতিবেশীদের কেউ কেউ মিসেস ঝর্ণার কথা ভেবে উদ্বিগ্ন বোধ করছেন। কাউকে কিছু না বলে এখান থেকে চলে গেছেন তিনি, যাবার সময় কেউ তাঁকে দেখেওনি, তারপর এক মাসের বেশি হয়ে গেল ফিরছেন না…।
বুঝেছি।আবার হাসল হাসান। তা এ-ব্যাপারে আমি কি করতে পারি?
সেটাই দেখতে হবে, হাসান সাহেব। আপনি কি তাঁর সঙ্গে একা দেখা করেছিলেন?
অবশ্যই। তখন মনে হয়নি দেখা করার সময় একজন সাক্ষী রাখা দরকার। ঝর্ণার, শুভানুধ্যায়ীরা ঠিক কি ভাবছেন আমাকে বলবেন, ইন্সপেক্টর? তারা কি ভাবছেন আমি ওকে খুন করে লাশটা লুকিয়ে রেখেছি?
হাসানের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকলেন ইন্সপেক্টর। তারপর বললেন, কেন আপনার মনে হলো, তারা এরকম অস্বাভাবিক কিছু একটা ভাবতে পারেন?
বোঝাই যাচ্ছে আমাকে সন্দেহ করা হচ্ছে। রেগে যাচ্ছে হাসান। এখানকার মানুষ কারও পিছনে লাগতে পারলে আর কিছু চায় না। গুজব ছড়াতে খুব ভালবাসে।
গুজব যখন একটা ছড়িয়েছে, আপনার স্বার্থেই প্রমাণ হওয়া দরকার সেটা মিথ্যে, বললেন ইন্সপেক্টর। অন্তত আমাদেরকে আপনি সাহায্য করতে পারেন। বলবেন কি, আপনার স্ত্রী যেদিন এখান থেকে রওনা হলেন, কেউ তাকে যেতে দেখেনি কেন? এখানে বা স্টেশনে?
এখানে কেউ দেখেনি কেন তা আমি বলতে পারব না, জানাল হাসান। সন্ধের একটু আগে ওকে নিয়ে বেরুই আমি। কেউ যদি না দেখে বা দেখেও অস্বীকার করে, আমার কিছু করার নেই। আর স্টেশনে অনেকে আমাদেরকে দেখলেও, ভাল করে হয়তো খেয়াল করেনি। তাছাড়া কজনই বা আমাদেরকে চেনে বলুন? খোঁজ নিয়ে দেখতে পারেন, সালাম ট্রান্সপোর্ট অফিসে আমি একটা স্যুটকেস জমা রেখে এসেছি। আমার স্ত্রী ফোনে কিছু কাপড়-চোপড় চেয়েছিলেন, সেগুলো নিয়ে গিয়েছিলাম সুটকেসটায় ভরে। দুএকটা কাপড় বের করে নেন তিনি, স্যুটকেসটা ওখানেই রাখার সিদ্ধান্ত হয়। বলা যায় না, ওখানকার স্টাফরা ওঁকে হয়তো মনে রেখেছে।
নোটবুক বের করে কয়েকটা পয়েন্ট লিখে নিচ্ছেন ইন্সপেক্টর। তাঁকে দেখাবার জন্যে ট্রান্সপোর্ট কোম্পানীর রসিদটাও দেরাজ থেকে বের করে আনতে হলো হাসানকে। রসিদটা নিজের কাছে দিন কয়েক রাখতে চাইলেন তিনি। তারপর বললেন, উনি যখন এখানে রয়েছেন, ওনাকেও দুএকটা প্রশ্ন করতে চাই। উনি কি এখানেই থাকেন? উনি কি আপনার স্ত্রীর আপন বোন?
শান্তা এখানে থাকে না, বলল হাসান। আমার স্ত্রীর খালাতো বোন ও। বলতে পারেন, এখানে আমার চাকরি করে সে। টাইপিস্ট।
টেলিফোনের ব্যাপারটা, মিস শান্তা, বললেন ইন্সপেক্টর। মিসেস ঝর্ণা ফোন করেছিলেন, রিসিভার তোলেন আপনি। সম্ভবত উনি যেদিন এখান থেকে গেলেন তার পরদিন, তাই না? মাথা ঝকাল শান্তা। আপনি কি তাঁর গলার আওয়াজ চিনতে পেরেছিলেন? মানে কোন সন্দেহ নেই তো যে মিসেস ঝর্ণাই ফোন করেছিলেন?
কোন সন্দেহ নেই, জোরের সঙ্গে জবাব দিল শান্তা। আপার সঙ্গে অনেক্ষণ কথা হয় আমার। একবারও কিছু সন্দেহ হয়নি। আমাকে বলল, তোর ভাইকে বলবি ফিরতে আমার দেরি হবে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, কবে ফিরবে? আপা বলল, ঠিক বলতে পারছি না।
অবাক হননি আপনি? তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন ইন্সপেক্টর। .
না। এর আগেও আপা দুদিনের কথা বলে পাঁচ-সাতদিন থেকে গেছে।
হাসান সাহেব, স্ত্রীকে ট্রেনে তুলে দিয়ে কি করলেন আপনি, বলবেন?
বাড়ি ফিরে আসি। সরাসরি সিলেট যাবার কথা ছিল, কিন্তু বাড়িতে কিছু কাজ থাকায়…।
যেমন? কি কাজ?
কিছু কাগজ-পত্র গোছগাছ করার দরকার ছিল।
আপনার তো বাগান করার শখ আছে, তাই না, হাসান সাহেব?
তা আছে। উপন্যাসের প্লট মাঝে মধ্যে জট পাকিয়ে যায়, তখন সমস্যাটা কিছুক্ষণের জন্যে ভুলে থাকা দরকার হয় বাগানের আগাছা পরিষ্কার করলে বা শুধু মাটি কোপালে ভাল ফল পাই আমি।
কাজেই সেদিন বাড়ি ফিরে আপনি বাগানে মাটি কোপান, তারপর গাড়ি নিয়ে সিলেট রওনা হন। বাড়িতে আপনি কতক্ষণ ছিলেন?
ঘণ্টা দুয়েক হতে পারে।
তার মানে সিলেটে আপনি বেশ রাত করে পৌঁছান। তা ওখানে কোথায় উঠেছিলেন আপনি?
সিলেটের বিপিনবিহারী কলেজের কোয়ার্টার নম্বর আর অধ্যাপক বন্ধুর নাম বলল হাসান।
আর শুধু একটা প্রশ্ন, বললেন ইন্সপেক্টর। ইদানীং স্ত্রীর সঙ্গে আপনার বনিবনা কেমন? আপনি কি আশা করেন এখানে তিনি ফিরে আসবেন?
মাথার চুলে আঙুল চালাল হাসান, শান্তা জানে এটা তার অসহায় বোধ করার লক্ষণ। তার মানে আপনার কানে গেছে যে আমরা প্রায়ই ঝগড়াঝাটি করি, তাই না?
জ্বী, উল্লেখ করা হয়েছে।
দেখুন, স্বামী-স্ত্রীতে ঝগড়া হয়ই। সব মিলিয়ে আমি বলব, তবু আমরা সুখী। এ-কথা সত্যি যে আমার স্ত্রী এখানে বসবাস করতে চান না। তিনি ঢাকায় থাকার ব্যাপারে জেদ করছেন।
আপনার স্ত্রীর কোন খবর পেলে আমাদেরকে অবশ্যই জানাবেন, হাসান সাহেব, বলে সোফা ছেড়ে দাঁড়ালেন ইন্সপেক্টর সোহেল চৌধুরী। আপনার অনেক মূল্যবান সময় নষ্ট করলাম…।
দাঁড়াল হাসানও। জানাব না মানে? সঙ্গে সঙ্গে জানাব। আমার তো ভয় হচ্ছিল আপনি না আমাকে গ্রেফতার করে থানায় নিয়ে যান। সঙ্গে করে আপনি সার্চ ওয়ারেন্ট আনেননি দেখে অবাকই হয়েছি। সে প্রশ্ন যদি ওঠে, বাড়ির সবখানে তল্লাশি চালাবার পূর্ণ স্বাধীনতা আছে আপনাদের…মানে যদি চান আর কি।
আপাতত তার কোন দরকার নেই, ধন্যবাদ, ঠাণ্ডা সুরে বললেন ইন্সপেক্টর, ঘুরে দাঁড়িয়ে পা বাড়ালেন দরজার দিকে। তাকে সদর দরজা পর্যন্ত পৌঁছে দিল হাসান।
বৈঠকখানায় ফিরে নিঃশব্দে শান্তার দিকে তাকালসে। তারপর একটা সিগারেট ধরাল। শান্তা লক্ষ করল, হাসানের হাত দুটো কাঁপছে। টেলিফোনের ব্যাপারে তুমি যা বললে, শুনে নরম হয়ে গেলেন ভদ্রলোক। তা না হলে বোধহয় ঠিকই গোটা বাড়ি তল্লাশি করতেন।
আমি সত্যি কথা বলিনি, ফিসফিস করছে শান্তা। সত্যি কথাটা হলো, ঝর্ণা আপার গলা আমি চিনতে পারিনি।
এটাকে ঠিক মিথ্যে কথা বলে না।
বলার সময় এসব কিছু ভাবিনি আমি। আমার ধারণা, এসবের জন্যে দায়ী হলেন আয়েশা আন্টি। তিনি তো সবকিছুর মধ্যে শুধু ষড়যন্ত্র দেখতে পান। সন্দেহ নেই, প্রতিবেশীদের মাথা তিনিই গরম করেছেন।
যাক, ইন্সপেক্টর ভদ্রলোক আপনার ব্যাখ্যা মেনে নিয়েছে। বলেই মনে হলো। স্বস্তিবোধ করছে শান্তা, কারণ তার হাসান ভাই গোটা ব্যাপারটাকে হালকাভাবেই নিচ্ছেন।
তবে পুলিশ যদি বাগানটা খোঁড়াখুঁড়ি করে, একটুও আশ্চর্য হব আমি।
কি বলছেন! কেন?
তোমার ধারণা ঠিক নয়, শান্তা। ইন্সপেক্টর আমার ব্যাখ্যা পুরোপুরি বিশ্বাস করেননি। কারণটাও পরিষ্কার, আমি তাঁকে ঝর্ণার হদিস জানাতে ব্যর্থ হয়েছি। তাঁর চোখের সামনে আছেই মাত্র একটা জিনিস-বাড়ির পিছনের বাগানটা।
আপনার কথা শুনে আমার ভয় করছে।
কেন? ওরা বাগানটা খুঁড়লে আমার বরং মজাই লাগবে। ওখানে ওরা তাকে কোনদিনই পাবে না?
হাসান ভাই! শান্তার গলা চিরে প্রায় আর্তনাদ বেরিয়ে এল।
অবাক হয়ে তার দিকে তাকাল হাসান, চেহারায় সম্পূর্ণ নিরীহ ভাব। কেন, কি বললাম আমি?
আপনার বলার ভঙ্গিটা দেখে মনে হলো, আপা…আপা যেন মারা গেছে। আপনি য়েন বলতে চাইলেন-বাগানে আপা না থাকলেও অন্য কোথাও আছে।
অবশ্যই অন্য কোথাও আছে-কোলকাতায়। বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে রীতিমত হৈ-হুল্লোড় করে সময় কাটাচ্ছে। অন্তত এ-ব্যাপারে আমার কোন সন্দেহ নেই।
কি জানি…আমারই হয়তো বোঝার ভুল হয়েছে, কথা বলার সময় রীতিমত কাঁপছে শান্তা। হাসান ভাই, আমি এখন বাড়ি যাব।
তোমাকে অসুস্থ লাগছে, শান্তা। একটু বরং বিশ্রাম নিয়ে যাও। বললে আমি তোমাকে পৌঁছে দিয়ে আসব।
অসুস্থ যদি লাগে সেজন্যে আপনি দায়ী। আপনাকে আমি বুঝতে পারছি না। আপনি এত ভাল মানুষ, এত নরম…অথচ মাঝে মধ্যে এত নিষ্ঠুর মনে হয় যে…।
এর কারণ অমায়িক যে ভদ্রলোক তোমার পিছনে লেগেছেন তিনি তোমাকে বিরক্ত করেন না, কিন্তু আমি করি। ভদ্রলোক শিক্ষিত হলেও, খানিকটা সেকেলে, নিজের অধিকার কিভাবে আদায় করতে হয় জানেন না। আমি ঠিক তার উল্টো।
সাইফুল ভাই সেকেলে নন, কথাগুলো বলার সময় শান্তার চেহারায় অসহায় একটা ভাব ফুটে উঠল। অত্যন্ত ভদ্র তিনি, কিছু করার আগে প্রথমেই চিন্তা করেন আত্মসম্মানের কথা। সেদিন ওইসব করার সময় আমার উচিত ছিল আপনাকে বাধা দেয়া, যদিও এখন মনে হচ্ছে ঘটনাটার আসলে কোন গুরুত্ব নেই, কারণ আমার ধারণা আপনি মনে মনে হাসছিলেন…।
প্রেমে পড়লে মানুষ হাসবে না?
দ্রুত মাথা নাড়ল শান্তা। আপনি ঠিকই বুঝতে পারছেন আমি কি বলতে চাইছি। আপনি আসলে সিরিয়াস হতে চান না। বাদ দিন এ-সর্ব, ভুলে যান। বলে আর দাঁড়াল না সে, গরম চাদরটা কাধে জড়িয়ে বেরিয়ে গেল।
ভেবেছিলাম বাগানটা খোড়া হবে, সার্চ ওয়ারেন্ট নিয়ে এসে গোটা বাড়িতে তল্লাশি চালাবে পুলিশ, থানায় নিয়ে গিয়ে আটকে রাখবে আমাকে। কিন্তু কই! বাইরে বেরুলে লোকজন শুধু আড়চোখে তাকাচ্ছে আমার দিকে। এমনকি আয়েশা আন্টিও নিয়মিত কাজে আসছেন। আশ্চর্যই বলতে হবে।
কেন, আন্টি কাজে আসবেন না কেন?
ওনার প্রতিক্রিয়া কি হবে আমি ঠিক আন্দাজ করতে পারিনি। যেখানে ষড়যন্ত্র হচ্ছে সেখানে তাঁর তো না মাসাই উচিত। তাঁর দৃষ্টিতে আমি তো একজন নিষ্ঠুর খুনী, তাই না?
এসব আপনার লেখক সুলভ কল্পনা, বলল শান্তা; সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে কোনভাবে বিচলিত হবেন না।
আমার এসব কথাবার্তা তোমার ভাল লাগছে না, লাগছে। কি?
আপনার কোন কথাই আজকাল বিশেষ ভাল লাগে না আমার, বলল শান্তা। মানুষকে মুগ্ধ করতে পারেন আপনি, এই শক্তিটাকে বড় বেশি মূল্য দেন। কিন্তু একটা মেয়ে শুধু এই জিনিসটা দেখতে চায় না। সব মিলিয়ে একটা মানুষ যে চরিত্র, আমার কাছে সেটারই বেশি গুরুত্ব। একটা দীর্ঘশ্বাস চাপল শান্তা। হাসান ভাইয়ের প্রেমে পড়ার একটা ঝোক তাকে কাহিল করে রেখেছে, অস্বীকার করে লাভ নেই। গত কদিন ধরে মনের কোণে রঙিন একটা স্বপ্ন উঁকি দিচ্ছে বলেই বিষয়টা নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনা করতে হচ্ছে তাকে। হাসান ভাইয়ের সব ঠিক আছে, অথচ তারপরও কোথায় যেন একটা অসঙ্গতি রয়ে গেছে। কি সেটা? শান্তা চায়, হাসান ভাই আরও একটু দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিন। গোটা ব্যাপারটাকে তিনি যেন বড় বেশি হালকাভাবে দেখছেন। যা-ই তিনি করছেন বা বলছেন সব কিছুর মধ্যে বিদ্বেষ ভরা একটা কৌতুকবোধ যেন থেকেই যাচ্ছে।
প্রিয় শান্তা, হেসে উঠে বলল হাসান, অন্তত কিছুটা সময় আমার অত্যাচার থেকে বাঁচবে তুমি। প্রকাশকের দেখা করার জন্যে ঢাকায় যাচ্ছি আমি, ফিরব হয়তো কাল সন্ধের দিকেএই সময়টা তোমাকে অবশ্য অনেক কাজ করতে হবে। আর মাত্র দুটো পরিচ্ছেদ লিখলেই বইটা শেষ হয়ে যাবে।
কাহিনী খুব দ্রুতই এগিয়েছে বলতে হবে, বলল শান্তা। শেষটা কি রকম হবে আমি আন্দাজও করতে পারছি না।
ফিরে এসে কাহিনী জোড়া লাগাবার কাজটা ধরব, দুই পরিচ্ছেদের মধ্যেই সারতে পারব বলে আশা করি। বইটা শেষ হয়ে যাচ্ছে বলে একরকম খারাপই লাগছে। তমার সঙ্গে খুব ঘনিষ্ঠ হয়ে পড়েছিলাম তো। খুবই মিষ্টি একটা মেয়ে সে।
এত বেশি মিষ্টি যে অবাস্তব বলে মনে হয়।
সত্যি বলছি, কিছুই তোমার মনমত হয় না। শুরুতে চরিত্রটা বদলেছিলাম শুধু তোমাকে খুশি করার জন্যে।
তা বোধহয় আপনার উচিত হয়নি। সমালোচনা করাটা আমার ভুল হয়েছে, তবে নিজের ধ্যান-ধারণার ওপর আপনার আস্থা থাকা উচিত ছিল।
সে সময়কার ধ্যানধারণা অন্য রকম ছিল আমার। তুমি আমাকে উপলব্ধি করাতে পেরেছিলে একটা মেয়ে কত সুন্দর হতে পারে; কি কোমল, বিশ্বস্ত আর প্রাণচঞ্চল হতে পারে; যখন সে একজন পুরুষকে ভালবাসে তখন নিজের বিশ্বাসে কেমন অটল থাকতে পারে।
আমি তার মত না-কখখনো নই। আপনার মুখে বারবার এই এক কথা শুনে আমার বিরক্ত ধরে গেছে। জঘন্য এই উপন্যাসটা শেষ হলে আমি বাঁচি।
শান্তা, তুমি খুব ভাল করেই জানো বইটা ভাল হয়েছে।
তারপরও ওটাকে আমি ঘৃণা করতে শুরু করেছি।
কেন বলছ না আমাকেও তুমি ঘৃণা করতে শুরু করেছ? মনে যখন এত সন্দেহ আর ভয়, পুলিশের কাছেই বা যাচ্ছ না কেন? তুমি গেলে ইন্সপেক্টর সোহেল চৌধুরী সাংঘাতিক খুশি হবেন।
হাসান ভাই! কাতর গলায় বলল শান্তা। এসব কি বলছেন আপনি! এমনকি আমি যদি আপনাকে…যদিও আমি তা করি না…অবশ্যই আপনাকে আমি সন্দেহ করি না।
করো না? তবু তর্কের খাতিরে, মনে করো যে তুমি আমাকে সন্দেহ করো, তাহলে?
এ ধরনের কিছু আমি মনে করতে পারব না…।
পারবে না কেন, না পারার কি আছে। পরিস্থিতিটা কি? ভাব, ল্পনা করো। মনে করো…যেভাবেই হোক ঝর্ণাকে আমি সরিয়ে নিয়েছি, আমার এখন সাংঘাতিক বিপদ। এই পরিস্থিতিতে কি করবে
তুমি?
না, এ-সব আমি ভাবতে চাই না। হাসান ভাই, আমাকে আর কষ্ট দেবেন না। শান্তার দৃষ্টিতে কাতর অনুনয়।
শান্তার মাথায় একটা হাত রাখল হাসান, কোমল সহানুভূতির স্পর্শ। ঠিক আছে, দেব না। তুমি সত্যি খুব নরম…এত ভাল যে আমি তোমার উপযুক্ত নই, যদিও তোমাকে আমি ভালবেসে ফেলেছি।
আশা ভিলায় একা থাকলে শান্তিতে কাজ করা যায়, কিন্তু শান্তাকে বিরক্ত করার কোন সুযোগই ছাড়তে রাজি নন আয়েশা বেগম। এবাড়িতে আর বেশিদিন কাজ করতে পারব বলে মনে হয় না, বিকেলের চা দিতে এসে বললেন তিনি। তুই কিছু বুঝতে পারছিস না? ঝড়ের আগে পরিবেশ যেমন থমথম করে, সেরকম লাগছে?
ইচ্ছে করেই ভুল বোঝার ভান করল শান্তা। জানালা দিয়ে বাইরে তাকান, দেখুন বাতাসে কেমন দুলছে পিয়ারা গাছের পাতাগুলো।
খবরদার! হঠাৎ চোখ রাঙালেন আয়েশা বেগম। আর কক্ষনও তুই আমাকে বাগানের দিকে তাকাতে বলবি না। ওদিকে তাকালেই কেন যেন মনে হয় ওখানে কাউকে জ্যান্ত কবর দেয়া হয়েছে। সেদিন দেখি খুব যত্ন করে তোর দুলাভাই গোলাপ চারা। পুঁতছে। দেখে মনে হলো, যেন একটা কবরের ওপর ফুলের চাষ করতে চায়। দেখ শান্তা, আমার দিকে ওভাবে তাকাবি না। কঠিন প্রহসন হলো, মেয়েদেরকেই বিশ্বাস করানো যায় না যে তাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হচ্ছে। প্রমাণের কথা যদি বলিস, বাগান খুঁড়লে তবে তো প্রমাণ পাওয়া যাবে। কিন্তু পুলিশ তা খুঁড়বে কেন? তারাও তো পুরুষমানুষ।
আপনি চুপ করুন। এ-সব আমি শুনতে চাই না।
কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে আয়েশা বেগম জিজ্ঞেস করলেন, জানতে পারি, কোথায় গেছে সে?
ঢাকায়। প্রকাশকের সঙ্গে দেখা করার জন্যে।
হে-হে, হে-হে।
হাসছেন কেন?
আজ সকালে তোর দুলাভাই ব্যাংকে গিয়েছিল, সে খবর রাখিস? ফিরে এসে টেবিলের ওপর টাকার এই মোটা একটা বাণ্ডিল রাখল। আমার মনে বলছে, ব্যাংক থেকে সব টাকা তুলে ফেলেছে। পালাতে চাইলে সবাই তা-ই করে।
মানে? আপনার ধারণা হাসান ভাই পালিয়ে গেছেন?
তাহলে আমাকে বল, মাত্র এক রাত বাইরে থাকার জন্যে অত বড় একটা সুটকেস নিয়ে যাবে কেন সে?
ঢাকায় তার অনেক বন্ধু-বান্ধব আছেন, নামী-দামী লোকজনের
সঙ্গে দেখা করতে হবে।
তাই বলে, ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলেন আয়েশা বেগম, চার চারটে আণ্ডারঅয়্যার নিয়ে যাবে?
শরীর রী রী করে উঠল শান্তার। অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে নিল সে, বলল, ও-সব আপনাকে দেখিয়ে সুটকেসে ভরার কারণটা কি জানেন? আপনি যাতে লোকজনকে বলতে পারেন।
কি বলতে পারি?
আন্টি, আপনি যে তার পিছনে লেগেছেন, তিনি তা জানেন। আপনার মুখ থেকে প্রতিবেশীরা জেনেছে, তাদের কাছ থেকে পুলিশ। হাসান ভাই বাগানে মাটি কোপান, ফুল গাছ লাগান, সবই আপনাকে দেখাবার জন্যে, কারণ তিনি জানেন আড়াল থেকে তাঁকে আপনি লক্ষ করেন।
কিছুক্ষণ হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থাকলেন আয়েশা বেগম। তারপর বললেন, তা যদি সত্যি হয়, বলতে হবে তোর দুলাভাই খুব বাজে লোক। আমার মত একটা বুড়ি মানুষকে এভাবে ঠকাবার কোন মানে হয় না। এতে আমি তার কোন দোষ দেখি না, হেসে উঠে বলল শান্তা।
দেখা যাচ্ছে তোর চোখে ভালই ধুলো দিয়ে রেখেছে সে।
আন্টি শুনুন, ভাববেন না যে আপনার মত সবাই তাকে সন্দেহ করে। মার কথা ধরুন, সন্দেহ করলে এখানে আমাকে কাজ করতে দিত না। কিংবা সাইফুল ভাইয়ের কথা ধরুন।
এ-সবের সঙ্গে একজন অ্যাডভোকেটের কি সম্পর্ক? চেয়ারম্যান আমাকে গমচুরণী বলায় মানহানির মামলা করব বলে একজন অ্যাডভোকেটের কাছে গিয়েছিলাম আমি, কিন্তু আমার কেস নিতে রাজি হয়নি সে।
রাজি হননি কেসে আপনি হেরে যাবেন, এই ভয়ে, বলল শান্তা। কারণ রিলিফের সের পাচেক গম সত্যি আপনি চুরি করেছিলেন। শুধু গম নয়, সরকারী হাসপাতাল থেকে ওষুধ আর তুলোও চুরি করেছিলেন।
কে বলল? থতমত খেয়ে গেলেন আয়েশা বেগম। তুই কি করে জানলি?
আমি একা না, সবাই জানে, আন্টি, বলল শান্তা, মায়ের মত শ্রদ্ধা করলেও মহিলার প্রতি আজ খেপে আছে সে।
সবাই জানে। কি জানে সবাই? আয়েশা বেগমকে বিচলিত দেখাল।
শুনুন, আন্টি, নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলছে শান্তা, যে-বাড়িতেই আপনি কাজ করুন, তারা আপনাকে খেতে দেয়, কিন্তু আপনার মেয়েকে দেয় না। তারা আপনার মেয়ের ওষুধ কেনার পয়সাও দেয় না।
হঠাৎ এক পা পিছিয়ে গেলেন আয়েশা বেগম। বোবাদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলেন শান্তার দিকে। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, কি বলতে চাস তুই?
সবাই জানে, আন্টি। যে-বাড়িতেই আপনি কাজ করেন, সেখান থেকে কিছু না কিছু রোজই চুরি করেন-ভাত, তরকারি, রুটি-বিস্কিট, ওষুধ-পত্র, যখন যা হাতের কাছে পান। এ-সব আপনি আপনার মেয়ের কবরে, মাটির তলায় পুঁতে দিয়ে আসেন।
তোর মাথায় ঠাঠা পড়ুক। তুই মর মর মর। একটা মাত্র মেয়ে আমার, বিনা চিকিৎসায় না খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ছে, তা-ও তোরা হিংসা করবি? কেঁদে ফেললেন আয়েশা বেগম, ফোঁপাতে কোপাতে বেরিয়ে গেলেন বাড়ি থেকে।
নিজের ওপর রাগ ও ঘৃণায় থরথর করে কাঁপছে শান্তা।
পরদিন আশা ভিলায় কাজ করতে এলেন ঠিকই, তবে শান্তার সঙ্গে কোন কথা বললেন না আয়েশা বেগম। তাঁর শান্ত স্বাভাবিক বিভাব লক্ষ করে শান্তার অপরাধ বোধ খানিকটা হালকা হলো। কিন্তু সে জানত না যে আজকের দিনটা তার জীবনে একটা অভিশাপ হয়ে দেখা দেবে, শুরু হবে নরক যন্ত্রণায় দিন যাপন।
ঢাকা থেকে মাত্র তিন ঘণ্টার পথ, বেলা দশটার দিকেই দৈনিকগুলো পৌঁছে যায়। প্রথম পৃষ্ঠার হেডিংগুলোয়-চোখ বুলিয়ে কাগজের মাঝখানের পাতাটা মেলে ধরল শান্তা। চলচ্চিত্র, থিয়েটার আর টিভি নাটকের খবর গোগ্রাসে গেলে সে। পাতা ওল্টাতেই রঙিন একটা ছবি তার সমস্ত মনোযোগ কেড়ে নিল। একটা মেয়ের ছবি…মেয়েটাকে চেনে শান্তা…সোহানা। টিভির নাটকে ছোটখাট ভূমিকায় অভিনয় করে, ঝর্ণা আপার সাংঘাতিক ভক্ত। সোহানাকে নয়, শান্তার দম বন্ধ হয়ে এল তার পরনের ঘাগরা দেখে। এত সুন্দর সেট একটাই আছে, বিশেষভাবে অর্ডার দিয়ে বানিয়েছে তার ঝর্ণা আপা। যে ঘাগরা তার হাসান ভাই ঢাকায় গিয়ে পৌঁছে দিয়ে এসেছেন ঝর্ণা আপাকে। সেই ঘাগরা সৌহানা কোত্থেকে পেল?
খবরটাও রুদ্ধশ্বাসে পড়ে ফেলল শান্তা। টিভিতে নতুন একটা ধারাবাহিক নাটক শুরু হতে যাচ্ছে। মূল নায়িকা চরিত্রে অভিনয় করার কথা শ্রাবণী আহমেদের। কিন্তু তিনি হঠাৎ গুরুতর অ্যাক্সিডেন্ট করায় অভিনয় করতে পারবেন না বলে জানিয়েছেন, তার বদলে চরিত্রটি করার জন্যে প্রস্তাব দেয়া হয়েছে সোহানা চৌধুরীকে। এত বড় সুযোগ এই প্রথম পাচ্ছেন তিনি…
মাথাটা ঘুরছে শান্তার। ঝর্ণা আপা এই ঘাগরা তো কাউকে পরতে দেবে না! তাহলে?
চেয়ার ছেড়ে অস্থিরভাবে পায়চারি শুরু করল সে। আসল সত্য তাকে জানতেই হবে। হাসান ভাই তাহলে ঢাকায় গিয়ে কাকে দিয়ে এলেন সুটকেসটা? ঘাগরাটা কোত্থেকে পেল সোহানা চৌধুরী?
তিন ঘণ্টার পথ, যেতে আসতে ছয় ঘণ্টা। কোচ ধরে এখুনি রওনা হলে সন্ধের আগে ফিরে আসতে পারবে সে। সোহানার ঠিকানা তার জানা আছে…না, হাসান ভাই বলেছেন সোহানা বাড়ি বদল করায় তার সঙ্গে তিনি দেখা করতে পারেননি। তাতে কি, রামপুরায় গেলে তার সঙ্গে ঠিকই দেখা করতে পারবে সে। খবরে বলা হয়েছে, ইতিমধ্যে শুরু হয়ে গেছে শু্যটিং।
নিজেকে খুব বেশি চিন্তা-ভাবনা করার সময় দিল না শান্তা, আয়েশা বেগমকে কিছু না বলেই বেরিয়ে পড়ল। বেরুবার আগে খবরের কাগজটা লুকিয়ে রাখল।
টিভি স্টেশনে পৌঁছে শান্তার মনে হলো, ঝোঁকের মাথায় বোধহয় ভুলই করে ফেলেছে সে। সিকিউরিটি গার্ডরা তাকে পাস খাড়া ভেতরে ঢুকতে দেবে না, একটা স্লিপ লিখে পাঠাতে হলো ভেতরে। আধ ঘণ্টা পেরিয়ে যাচ্ছে, কিছু ঘটছে না। আজ হঠাৎ উপলব্ধি করল শান্তা, পুলিশের কনস্টেবল থেকে শুরু করে অফিসাররা পর্যন্ত একা কোন মেয়েকে দেখলে এমন দৃষ্টিতে তাকায়, তাদের যেন কোন মা-বোন নেই। এই অমার্জিত অন্যায় মেনে নিতে কষ্ট হলো তার। মনে হলো, বাইরে না বেরুলে বোঝা যায় না নরকের চেয়েও খারাপ একটা জায়গায় বসবাস করতে হচ্ছে তাদেরকে। আয়েশা আন্টির কথা মনে পড়ল। ঠিকই বলেন তিনি, গাটা দেশে মেয়েদের বিরুদ্ধে নোংরা ষড়যন্ত্র চলছে। কুৎসিত মানুষে ভরে গেছে দেশ, আরেকটা যুদ্ধ কখনও যদি বাধে এরাই এখন রাজাকার হবে, যে রাজাকাররা আয়েশা আন্টির স্বামী ও একমাত্র কিশোরী মেয়েকে পাকিস্তানী হানাদারদের হাতে তুলে দিয়েছিল।
হাতে টেলিফোনের রিসিভার, গার্ডরুমের দরজা থেকে উঁকি দয়ে বাইরে তাকালেন একজন অফিসার। রুণই বলা যায়, চেহারায় মার্জিত ভাবটুকু সহজেই চোখে পড়ে, সরাসরি শান্তার দিকে তাকিয়ে জানতে চাইলেন, আপনি শান্তা ইসলাম, সোহানা চৌধুরীর সঙ্গে কথা বলবেন?
জ্বী, ছোট্ট করে জবাব দিল শান্তা।
প্লীজ, ভেতরে আসুন, বলে পথ ছেড়ে দিলেন অফিসার। আড়ষ্ট ভঙ্গিতে ভেতরে ঢুকল শান্তা। ওর হাতে রিসিভার ধরিয়ে দিয়ে অফিসার বললেন, আপনি কথা বলুন, আমি বাইরে অপেক্ষা করছি। শান্তা লক্ষ করল, বাইরে যারা দাঁড়িয়ে রয়েছে তাদের মত এই ভদ্রলোকের দৃষ্টি তার শরীরের ওপর হুল ফোটাল না। কামরা থেকে তিনি বেরিয়ে যেতে কৃতজ্ঞবোধ করল সে। মনে মনে ভাবল এত হতাশ হবার সত্যি বোধহয় কোন কারণ নেই, সবাই কুৎসিত হয়ে যায়নি।
রিসিভারে সোহানার সাড়া পেয়ে শান্তা প্রথমে তাকে নিজের পরিচয় দিয়ে জিজ্ঞেস করল, সে তাকে চিনতে পারছে কিনা। হেসে উঠে সোহানা বলল, ঝর্ণা আপার বোন তুমি, বেড়াতে গিয়ে তোমাদের বাড়ির পেয়ারা গাছ থেকে পড়ে গিয়েছিলাম, সেকি ভোলার কথা!
শান্তা স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল, আজকের কাগজে তোমায় ছবি দেখলাম…।
হ্যাঁ, পত্রিকায় ওই ছবি দেয়ার জন্যেই তো ঝর্ণা আপার ঘাগর সেটটা পরতে হলো আমাকে। আজ সময় পাইনি, ঝর্ণা আপাকে কথাটা জানাবার জন্যে কাল ফোন করব ভাবছি…।
কোন নম্বরে?
অপরপ্রান্তে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল সোহানা, তারপর বলল, শু্যটিং নিয়ে এত ব্যস্ত আছি, কিছুই মনে থাকে না। ভুলে গেছি সে ঝর্ণা আপা দেশে নেই। এখনও নিশ্চয়ই ফেরেননি, ফিরলে শা আর ঘাগরাটা অবশ্যই ফেরত চাইতেন…।
শোনো, সোহানা, ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করতে পারছি না, তবে আমার জানাটা খুব গুরুত্বপূর্ণঝর্ণা আপার শাল আর ঘাগরা কে দিল তোমাকে?
দরকার হলেই ঝর্ণা আপার কাপড়চোপড় চেয়ে নিয়ে পরি আমি, বলল সোহানা। এত বড় সুযোগ পেয়েছি, পত্রিকায় ছবি দিতে হবে, ঝর্ণা আপার সেটটার কথা মনে পড়তে ময়মনসিংহে ফোন করলাম আমি। হাসান ভাই বললেন, উনি বাড়িতে নেই। তখন তাঁকেই আমি ঘাগরা আর শালটার কথা বললাম। উনি বললেন, আমি যেন পরদিন আরমানিটোলায় সালাম ট্রান্সপোর্ট কোম্পানীতে চলে আসি। কেন বলো তো, এ নিয়ে কিছু ঘটেছে নাকি? ঝর্ণা আপা বুঝি রাগ করেছেন হাসান ভাইকে?
আরে না, সে-সব কিছু না। হাসান ভাইও তো বাড়িতে নেই। পত্রিকায় তোমার ছবি দেখে ভাবলাম তাহলে কি ঝর্ণা আপা দেশে ফিরে এসেছে। আসলে আপার সঙ্গে আমার দেখা হওয়াটা সাংঘাতিক জরুরী, বুঝলে। হাসান ভাই যদি আমাকে জানাতেন যে তিনিই তোমাকে ওটা দিয়েছেন তাহলে আমাকে আর ঢাকায় আসতে হত না…।
আরও কিছুক্ষণ কথা বলে বিদায় চাইল শান্তা, রাস্তায় বেরিয়ে এসে কোচ ধরার জন্যে একটা রিকশা নিল। সাংঘাতিক একটা আতঙ্ক অসাড় করে ফেলছে তাকে। ভয় একটা সাপ, কুণ্ডলী পাকিয়ে রয়েছে তার বুকের ভেতর। ঝর্ণা আপার জন্যে এতদিন উদ্বিগ্ন ছিল সে। এখন উদ্বিগ্ন হয়ে কোন লাভ নেই। তার ঝর্ণা আপা মারা গেছে, মারা গেছে হিংস্র আক্রোশের শিকার হয়ে। ঠিক কিভাবে ঘটনাটা ঘটেছে তা জানার উপায় নেই। শুধু জানে যে ঘটেছে। কোচে চড়ে ফেরার পথে খুনটার চেয়ে শান্তাকে বেশি বিচলিত করল ঝর্ণা আপা নিখোঁজ হবার পর থেকে হাসান ভাইয়ের আচরণ। শোকে কাতর হওয়া তো দূরের কথা, এমনকি ভয়ও পাননি তিনি, বরং হৃদয়হীন পাষাণের মত প্রেম-প্রেম খেলা। খেলেছেন তার সঙ্গে। একটা মানুষ নিজের স্ত্রীকে খুন করার পরপরই কিভাবে আরেকটা মেয়ের মন জয় করার জন্যে উঠেপড়ে লাগে? নির্লজ্জের মত হাত দিয়েছেন তার গায়ে, বোঝাতে চেয়েছেন তাকে তিনি কত ভালবাসেন।
তারপর নিজেকে যুক্তির পথে আনতে চেষ্টা করল শান্তা। এভাবে হাসান ভাইকে দোষী ভাবা কি ঠিক হচ্ছে তার? অন্তত আত্মপক্ষ সমর্থনের একটা সুযোগ তাকে দেয়া উচিত। ঝর্ণা আপা। যেদিন খুন হন সেদিন ঠিক কি ঘটেছিল তার জানা নেই, তবে সেই সঙ্গে যে তার হাসান ভাইও শেষ হয়ে গেছেন তাতে কোন সন্দেহ নেই। তার প্রমাণ, নিজের সমস্ত সুন্দর বৈশিষ্ট্য হারিয়ে অন্য একটা মানুষে পরিণত হয়েছেন তিনি, যে মানুষটিকে শান্তা চেনে না বা শ্রদ্ধা করে না।
হঠাৎ একটা সিদ্ধান্ত নিল শান্তা। হাসান ভাই বলেছেন, তিনি তাকে বিশ্বাস করেন। সত্যি কিনা প্রমাণ হওয়া দরকার। সে যে তাঁর গোপন অপরাধের কথাটা জানে, এটা জানাবে.তাঁকে, একই সঙ্গে বলবে এখনও তাকে শ্রদ্ধাভাজন বন্ধু বলে মনে করে। তারপর জিজ্ঞেস করবে, ঠিক কি ঘটেছিল সব আমাকে খুলে বলুন। সব। শোনার পর দুজন মিলে বুদ্ধি করা যাবে। হাসান ভাই যদি তাকে বিশ্বাস করে সব কথা স্বীকার করেন, তাহলে সে বিশ্বাসের মর্যাদা শান্তা রাখবে বৈকি। গোপন কথাটা কোনদিন কাউকে জানাবে না সে জানাবে তো নাই-ই, হাসান ভাই যাতে কোন বিপদে না পড়েন সেদিকটাও দেখবে।
লাইব্রেরি রুমে আলো জ্বলছে, যদিও এখনও পুরোপুরি সন্ধে হয়নি। শান্তা ভেতরে ঢুকতেই ডেস্ক থেকে মুখ তুলে তাকাল হাসান। এই যে, বলল সে, কোথায় গিয়েছিলে বলো তো? ফিরে দেখি আন্টি তখনও রয়েছেন, বললেন, তোমার নামে অভিযোগ করবেন খালাম্মার কাছে। তুমি নাকি তাকে কিছু না বলেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেছ।
তাতে তাঁর কি? বেসুরো গলায় বলল শান্তা, অসম্ভব নার্ভাস বোধ করছে সে। ..
কেমন অদ্ভুত দৃষ্টিতে তার দিকে তাকাল হাসান। না, তার হয়তো কিছু না, তবে হঠাৎ কেউ গায়েব হয়ে গেলে দুশ্চিন্তা তো হতেই পারে, তাই না?
আমার মনে ছিল না। একটা চেয়ারে ধপ করে বসে পড়ল শান্তা।
তোমাকে খুব কাহিল দেখাচ্ছে, বলল হাসান। যদিও কাহিল হবার কথা আমার। বইটা শেষ হয়ে গেছে।
এত তাড়াতাড়ি কিভাবে শেষ হলো?
কাল সারা রাত লিখেছি, বলল হাসান, বলার ভঙ্গিটা দেখে মনে হতে পারে সে যেন রাজ্য জয় করেছে, চেহারায় শিশুসুলভ সরলতা। এখানে আসার পর সম্পাদনাও করেছি। এখন তুমি টাইপ করে ফেললেই হয়।
যাক, আপনার মাথা থেকে একটা বোঝা নামল।
হ্যাঁ, সেজন্যেই ভাবছি কোথাও বেড়াতে যাব কিনা। তোমাদের এই জায়গাটা কেমন যেন দৃষিত লাগছে আমার। কোথাও যদি যাই, নমি কি আমার সঙ্গে যাবে, শান্তা?
আপনি খুব ভাল করেই জানেন যে তা সম্ভব নয়।
মানলাম, জানি। কিন্তু যদি সম্ভব হত, ব্যাপারটা তুমি উপভোগ করতে না? তুমি সঙ্গে থাকলে কোথায় না যেতে ইচ্ছে করবে আমার। আমার খুব ইচ্ছে বাংলাদেশের প্রতিটি দ্বীপে যাই, জেলেদের সঙ্গে রাত কাটাই সাগরে, সুন্দরবনে ঢুকে বাঘ দেখি। প্রেমিকা হতে যদি আপত্তি করো তুমি, তোমাকে আমি ছোট্ট আদরের বোনটি মনে করে হাত ধরে বেড়াই…।
আর তখন যদি ঝর্ণা আপা ফিরে আসে, আমরা যখন বনেবাদাড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি? জিজ্ঞেস করল শান্তা।
সে ফিরবে না।
মাথা তুলে তার দিকে তাকাল শান্তা। না…আপা আর কোনদিন ফিরবে না, সায় দেয়ার সুরে বলল সে।
পরস্পরের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে ওরা, নীরবতা দীর্ঘ হচ্ছে। তারপর ডেস্কের পিছন থেকে উঠে দাঁড়াল হাসান, এগিয়ে এসে শান্তার মুখোমুখি একটা চেয়ারে বসল। কি ঘটেছে বলো তো? শান্ত সুরে জানতে চাইল সে।
আমি ঢাকায় গিয়েছিলাম, বলল শান্তা।
তো?
সোহানার সঙ্গে দেখা করলাম। আজ সকালের কাগজে তার ছবি দেখার পর ওর সঙ্গে দেখা করার সিদ্ধান্ত নিই। কথা শেষ করে হাতব্যাগ থেকে ভাঁজ করা কাগজটা বের করল শান্তা, ধরিয়ে দিল হাসানের হাতে।
কাগটা খুলে ছবিটার ওপর চোখ বুলাল হাসান। কিছুক্ষণ চুপচাপ চিন্তা করল সে, তারপর বলল, ঘাগরাটা তুমি চিনতে পারো, তাই না?
হ্যাঁ, কিন্তু সেটা আমার অপরাধ নয়। যদিও ভয় পাবার কে। কারণ নেই। অন্তত আমি কোন বিপদের ভয় দেখছি না। ঘাগরাটা আপা এখানে একবারই মাত্র পরেছিল, ইসমত আপা ছাড়া আর কেউ মনে রেখেছে বলে মনে হয় না। ছবিটা তার চোখে না-ও পড়তে পারে। তাছাড়া, ঝর্ণা আপার সঙ্গে সোহানার পরিচয় আছে এ-কথা কজনই বা জানে।
সোহানা তাহলে সব কথাই ফাঁস করে দিয়েছে? জিজ্ঞেস করল হাসান।
ইচ্ছে করে যে, তা নয়। কিছু গোপন করার আছে কিনা তা-ও তার জানা ছিল না। এখনও কিছু জানে না সে। আমাকে আপনি মিথ্যে কথা না বললেও পারতেন। বলেছিলেন আপনি আমাকে বিশ্বাস করেন।
তোমাকে একটা গল্প বানিয়ে বলার দরকার ছিল, বলল হাসান। তারপর, ইন্সপেক্টরকে ধোকা দেয়ার সময় বুঝতে পারি, গল্পটা দারুণ বানিয়েছি। এখন আর সে গল্প কাউকে বিশ্বাস করাবার উপায় নেই।
কিন্তু কাজটা আপনি সচেতনভাবে করেছেন, ইচ্ছে করে, বলল শান্ত। আপনি ঝর্ণা আপার কাপড়চোপড় নিয়ে যান, কারণ জানতেন প্রতিবেশীরা নানা আজেবাজে কথা ভাবছে, বিশেষ করে আয়েশা আন্টি। আরমানিটোলার ট্রান্সপোর্ট কোম্পানীর অফিসে সোহানাকে নিয়ে অনেকক্ষণ ছিলেন, যাতে তদন্ত হলে ওখানকার কর্মচারীরা চিনতে পারে। গোটা ব্যাপারটাই একটা : পরিকল্পনার অংশ, হাসান ভাই। এত সব ঝামেলার মধ্যে না গিয়ে আপনি তো বললেই পারতেন যে ঝর্ণা আপা আপনাকে ছেড়ে চলে গেছে।
কারও স্ত্রী যখন অন্য কোন পুরুষের সঙ্গে পালায়, সে কি তার প্রিয় শখের কাপড়চোপড় ফেলে রেখে যায়? ঝর্ণা তার ওই ঘাগরা আর শালটা খুব পছন্দ করত, কাজেই ওগুলো চেয়ে ফোন করাটা স্বাভাবিক বলেই মনে হবে। সে কথা ভেবেই গল্পটা বানাই আমি, একেবারে শান্ত সুরে কথা বলছে সে, চোখ কুঁচকে লক্ষ করছে শান্তাকে। তার চোখে কোন ভয় দেখতে পেল না শান্তা, শুধু কৌতূহল রয়েছে সেখানে।
শান্তা চিন্তিত সুরে বলল, কিছু কিছু কাজ হয়তো আপনি নিজের নিরাপত্তার কথা ভেবে করেছেন, তবে কিছু কাজ করেছেন মানুষকে মানসিক যন্ত্রণা দেয়ার জন্যে বা উত্ত্যক্ত করার জন্যে। ভাল করেননি। বিশাল একটা স্যুটকেস নিয়ে যাওয়ায়, ব্যাংক থেকে তোলা টাকা তাঁকে দেখানোয়, আন্টি তো ধরেই নিয়েছেন যে আপনি পালিয়েছেন। তার মুখে আপাতত কোন রকমে হাত চাপা দিয়ে রাখতে পারলেও, বেশিদিন পারব বলে মনে হয় না। আবার যদি পুলিশ আসে, সেটা কি আপনার জন্যে ভাল হবে?
হাসল হাসান, কথা বলল না।
এরপর আপনি কি করবেন? জিজ্ঞেস করল শান্তা। এখন যদি আপনি ঢাকায় গিয়ে বসবাস করতে শুরু করেন, আমার ধারণা তারপরও আপনার ওপর নজর রাখবে পুলিশ। আপা ফিরে না এলে আরও অনেক প্রশ্ন উঠবে। পুলিশ হয়তো জেনে ফেলবে আরমানিটোলায় সোহানার সঙ্গে দেখা হয়েছে আপনার, ঘাগরাটা আপনি তাকে দিয়েছেন।
হ্যাঁ, সে সম্ভাবনা আছে বৈকি।
তখন মিথ্যেগুলো বলার পিছনে কি অজুহাত দেখাবেন?
আগে সে পরিস্থিতি সৃষ্টি হোক, তখন দেখা যাবে।
অবাক লাগছে আপনি আমাকে কেন মিথ্যে কথা বলতে গেলেন। এই আমাকে আপনার বিশ্বাস করার নমুনা?
বাহ্, কী অদ্ভুত! স্ত্রীকে খুন করার অপরাধ তুমি ক্ষমা করতে পারো, কিন্তু অপমানিত বোধ করবে সব কথা তোমাকে খুলে বলিনি ভেবে। বোকা মেয়ে, এ-ধরনের একটা পরিস্থিতিতে যে তোমাকে ভালবাসে সে তোমাকে রক্ষা করতে চাইবে না? তুমি যত কম জানো ততই ভাল, তোমারই স্বার্থে।
আপনি কি সত্যি আমাকে ভালবাসেন? জিজ্ঞেস করল শান্তা, তীক্ষ্ণ অনুসন্ধানী দৃষ্টি স্থির হয়ে আছে হাসানের মুখে।
তোমাকে আমি ছোঁব না বলে কথা দিয়েছি। এই প্রতিজ্ঞা থেকে আমাকে তুমি মুক্তি দাও, তা না হলে কিভাবে আমি তোমাকে বিশ্বাস করাব?
আমাকে ছুঁলেই আপনাকে আমি বিশ্বাস করব, এ-কথা কেন ভাবছেন আপনি? ছুঁতে আপনি আমাকে অনায়াসেই পারেন, পরীক্ষা করার জন্যে আমার কি প্রতিক্রিয়া হয় দেখার জন্যে। তাতে আপনার অতি সামান্য অংশই ভালবাসায় অংশগ্রহণ করবে, বাকি গুরুত্বপূর্ণ অংশগুলো সরে দাঁড়াবে এক পাশে, নজর রাখবে আগ্রহের সঙ্গে।
নিজেদের সম্পর্কে অনেক কিছু শিখছি আমরা, মন্তব্য করল হাসান। কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর বলল, সোহানার সঙ্গে কথা বলে কি লাভ হবে বলে ভেবেছিলে তুমি? বোঝাই যায়, আমাকে সাহায্য করার জন্যে কাজটা তুমি করোনি। তার সঙ্গে দেখা করায় তার বরং সন্দেহ হবার কথা।
তা হয়নি, আমার ব্যাখ্যা সে বিশ্বাস করেছে।
তারমানে স্রেফ কৌতূহলবশত তার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলে?
তা-ও বলতে পারেন। মনে হয়েছিল আসলে কি ঘটেছে আমার জানা দরকার।
মানে তোমার ঝর্ণা আপা বেঁচে আছে কিনা? এ-কথাও ভেবেছিলাম যে আপনাকে সাহায্য করব। এখনও সে ইচ্ছে আছে আমার…যদিও আমার কি করা উচিত বুঝতে পারছি না। ঝর্ণা আপার আত্মীয়-স্বজন কেউ তেমন না থাকলেও বন্ধু-বান্ধব কম নয়, তার কোন খবর না পাওয়া গেলে সবাই খোঁজ শুরু করবে।
মনে হয় না। বেশিরভাগ বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গেই কালে-ভদ্রে যোগাযোগ হয় তার, তা-ও সে যখন ঢাকায় যায়। আমি যদি এই বাড়ি ছেড়ে দিয়ে দূরে কোথাও সরে যাই, কিছুদিনের মধ্যেই আমাদের কথা ভুলে যাবে মানুষ, ঝর্ণার কথাও।
কিন্তু আপনার লেখালেখি?
অন্য নামে, মানে-ছদ্মনামে লিখব। বেশ কিছুদিন চলার মত টাকা আমার কাছে আছে।
মাথা নাড়ল শান্তা। ব্যাপারটা এত সহজ হবে বলে আমি বিশ্বাস করি না। কত রকম জটিলতা দেখা দিতে পারে। তাছাড়া, আপাকে যদি পাওয়া যায়?
তার লাশ? কোন সম্ভাবনা নেই।
এতটা নিশ্চিত হন কিভাবে? তারপর হঠাৎ কেঁদে ফেলল স্তা। আপনি আমাকে সব কথা বলছেন না কেন? আর কত কষ্ট দেবেন!
তোমার ভালর জন্যেই সব কথা তোমাকে বলা সম্ভব নয়, শান্তা। তাছাড়া একদিন হয়তো তুমি তোমার বিবেকের দংশন সহ্য করতে না পেরে পুলিশের কাছে ছুটে যাবে। এখন গেলে কিছু সে যায় না, কারণ তেমন কিছু বলার নেই তোমার।
দুহাতে মুখ ঢেকে কাঁদতেই থাকল শান্তা। কিছুক্ষণ পর দুই কাঁধে হাসানের ভারি হাত অনুভব করল সে। একটা হাত মৃদু চাপ দিল, অপর হাতটা উঠে গিয়ে জড়িয়ে ধরল কোমর। তারপর, কি ঘটছে ভাল করে বুঝে ওঠার আগেই, তাকে ধরে বুকে তুলে নিল হাসান, নামাল লম্বা একটা সোফার ওপর। আমি ঠিক তা বোঝাতে চাইনি, শান্তা, তার মুখে মুখ রেখে নরম সুরে ফিসফিস করল হাসান। আমি জানি, নিজের শরীরে আগুন ধরিয়ে দেবে তুমি, তবু আমার সঙ্গে বেঈমানী করবে না। তবে একটা কথা না বলে পারছি না যে তুমি আমাকে খুব অবাক করছ। এত কিছুর পরও আমার আর তোমার মায়া থাকে কি করে, সেটা একটা রহস্য। তবে আমি কসম খেয়ে বলছি, যদিও এই কদিন অনেক কষ্ট দিয়েছি, সম্ভব হলে কালই তোমাকে আমি বিয়ে করব।
আপনি চলে গেলে কোনদিন আর আপনার দেখা পাব না, ফুপিয়ে উঠে বলল শান্তা।
আমি যদি চলেও যাই, তোমার একটা ব্যবস্থা না করে যাব, কথা দিল হাসান। সঙ্গে যদি যেতে না পারো; দুদিন পর আমার সঙ্গে দেখা হবে তোমার। ঠিক দুদিন হয়তো নয়, যতদিন না পরিবেশটা ঠাণ্ডা হয় আর কি। মানুষ সব একসময় ভুলে যাবে। আমাদের দেখা হবে দূরে কোথাও, যেখানে চিরকাল আমরা একসঙ্গে থাকব।
তা যদি যাই আমি, যাব শুধু আমাকে আপনার প্রয়োজন মনে করে—যদি বুঝি মার যতটা দরকার আমাকে, তারচেয়ে বেশি দরকার আপনার।
একজন লেখকের জীবনে প্রেরণাটাই সবচেয়ে বড় কথা, বলল হাসান। তুমি আমার কাছে সেই অমূল্য সম্পদ।
ব্যাপারটা কিভাবে ঘটল—আপনার আর ঝর্ণা আপার ব্যাপারটা? কিছুক্ষণ পর জানতে চাইল শান্তা। অন্তত এটুকু আপনি আমাকে বলতে পারেন। অনেক আগে থেকে, ঠাণ্ডা মাথায়, ভেবে রেখেছিলেন, তা হতে পারে না। নিশ্চয়ই দুর্ঘটনা। আবার বোধ। ঝগড়া হয়েছিল?
হ্যাঁ, হয়েছিল। সে…আমি…অতীতে আমাদের মধ্যে অনেক কিছু ঘটে গেছে যা তুমি জানো না। ঝর্ণা আমাকে ছাগল বানিয়ে রেখেছিল, ফলে তার কপালে যা ঘটার কথা তাই ঘটেছে। এ বেশি আর কিছু তোমাকে আমার বলার নেই।
আর সেই টেলিফোনটা? আমি যেটা রিসিভ করলাম?
তুমি নিজেই তো বলেছ, গলাটা চিনতে পারোনি, মনে করিয়ে দিল হাসান।
তবু গলাটা তো একটা মেয়েরই ছিল। আপনার গলা নয়। হাসান ভাই, মনে হচ্ছে…মনে হচ্ছে আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি! এর মধ্যে কি অন্য কেউ আছে? তৃতীয় একজন? যার কথা আমি কিছু জানি না?
শান্তা! আঁতকে মত উঠল হাসান, এই প্রথম যেন শান্তা তাকে যাবড়ে দিতে পেরেছে। এরকম বোকার মত কথা বলো না!
কিন্তু ফোনটা আপনি করেননি, আমি জানি! শান্তার গলায় জেদ। সেদিন একটা মেয়ে কথা বলেছিল আমার সঙ্গে, ঝর্ণা আপার এত পরিচিত যে তার গলা নকল করতে কোন অসুবিধে হয়নি। কি যেন একটা আমি বুঝতে পারছি না, ভয়ঙ্কর কিছু একটা-ঝগড়ার মধ্যে আপার খুন হয়ে যাবার চেয়ে মারাত্মক সেটা। দুর্ঘটনাবশত, রাগের মাথায় হঠাৎ খুন করে ফেলা আর ঠাণ্ডা মাথায় মেরে ফেলার মধ্যে পার্থক্য আছে, হাসান ভাই। বুঝতে পারছি, এখানে আর আমার থাকা উচিত নয়। আমি বাড়ি চলে যাচ্ছি।
শান্তা এই মুহূর্তে সম্পূর্ণ শান্ত, কিন্তু হাসান উপলব্ধি করল তার এই শান্ত ভাবের মধ্যে ভীতিকর কি যেন একটা আছে, যা দেখে শঙ্কিত হয়ে উঠল সে। পাশ কাটিয়ে এমন ভঙ্গিতে হেঁটে গেল শান্তা, তাকে যেন দেখতেই পায়নি। এক ঘর থেকে আরেক ঘরে, তারপর দরজা খুলে বাড়ির সামনে বাগানে, সেখান থেকে সদর, দরজার দিকে হাঁটছে সে। শান্তা শুনতে পেল পিছন থেকে তাকে ডাকছে হাসান, কিন্তু সে থামল না। সদর দরজা খুলতে যাবে, একটা গাড়ির আওয়াজ পেল। কালো আর হলুদ রঙ দেখে বোঝা গেল ট্যাক্সি ওটা। প্রথমে শান্তা ভাবল, তার খোঁজে এসে বাড়িতে পায়নি, তাই আশা ভিলায় চলে এসেছে সাইফুল ভাই। গত এক হপ্তা হলো প্রতিদিনই তাকে দেখতে আসেন তিনি। দরজা খুলে দাঁড়িয়েই থাকল সে, নড়তে পারল না। কয়েক সেকেণ্ড পর ভুলটা ভাঙল তার। সাইফুল ভাই তো ট্যাক্সি নিয়ে আসবেন না। শান্তা আরও উপলব্ধি করল, তার পিছনে এসে দাঁড়িয়েছেন হাসান ভাই। কে যেন ট্যাক্সি থেকে নামল, এগিয়ে আসছে তার দিকে। না, সাইফুল ভাই নন, একটা মেয়ে। কিন্তু এ কেমন মেয়ে? এত সাদা কেন মুখ? চারদিক অন্ধকার হয়ে আসছে, ভাল করে দেখতে পাচ্ছে না শান্তা। তার নাম ধরে কথা বলল মেয়েটা। আরে শান্তা, তুই এখনও এখানে! তোরা কেমন আছিস রে?
তারপর নিস্তব্ধতা জমাট বাঁধল। একটু পর বিষম খাওয়ার মত একটা আওয়াজ বেরিয়ে এল শান্তার গলা থেকে। অনুভব করল, পড়ে যাচ্ছে সে। অন্ধকার পাতালে তার পতন ঘটছে।
কতক্ষণ পর বলতে পারবে না শান্তা, খেয়াল হলো কে যেন তার চোখে-মুখে পানি ছিটাচ্ছে আর নরম সুরে আদর করছে। খসখসে মেয়েলি গলা। চিন্তা করবি না, ভাই। কিছুই হয়নি তোর। আমি রে, আমি, ভয় পাবার কোন কারণ নেই। আমাকে এভাবে দেখে ঘাবড়ে যাবারই কথা অবশ্য, কিন্তু তাই বলে একেবারে জ্ঞান হারিয়ে ফেলবি…!
বিপুল ইচ্ছাশক্তির জোরে, অনিচ্ছাসত্ত্বেও, চোখ দুটো খুলল শান্তা। মেয়েটা পিছিয়ে গেল, বলল, তুমি ওর সঙ্গে কথা বলো, হাসান। আমার এই ব্যাণ্ডেজ ঢাকা অবস্থা দেখে আবার না ভয় পায় ও।
মেয়েটার শেষ কথাটা শুনে ভয় মেশানো কৌতূহল জাগল শান্তার মনে। ধীরে ধীরে মাথাটা ঘোরাল সে। নিজেকে দেখল বৈঠকখানার লম্বা একটা সোফায় শুয়ে রয়েছে, হাসান ভাই আঙুল দিয়ে ধরে রেখেছে তার একটা কজি। হাসান ভাইয়ের পিছনে ড়িয়ে রয়েছে মেয়েটা, এতক্ষণ যে তার সঙ্গে কথা বলছিল। মেয়েটার মাথা স্কার্ফ দিয়ে ঢাকা। স্কার্ফের সামান্যই দেখা যাচ্ছে, কারণ গোটা মুখ আর মাথা সাদা ব্যাণ্ডেজ দিয়ে মোড়া। শুধু মাথা আর মুখই নয়, তার ডান হাতটাও তাই, একটা স্লিং-এর সঙ্গে সুলছে।
সুস্থ হয়ে গেছিস তুই, বলল ঝর্ণা। ব্যাণ্ডেজের আড়ালে আমাকে চিনতে পারা একটু কঠিনই বটে, তবে আমি তোর সেই আদি ও অকৃত্রিম ঝর্ণা আপাই, তার প্রেতাত্মা নই। অন্তত আমার গলা তো চিনতে পারছিস?
কি ঘটেছে? দুর্বল গলায় জিজ্ঞেস করল শান্তা, ঝর্ণার দিকে ভয়ে ভয়ে তাকিয়ে আছে।
রোড অ্যাক্সিডেন্ট, কোলকাতায়। এখন থাক, সে অনেক কথা, পরে শুনিস।
কিন্তু তুমি তো মারা গেছ, গলা চড়িয়ে বলল শান্তা।
অস্বস্তিকর হয়ে উঠল পরিবেশটা, কেউ কিছুক্ষণ কথা বলল না। তারপর হেসে উঠল ঝর্ণা। দূর বোকা, মরব কেন! বলতে পারিস মরতে মরতে বেঁচে গেছি। আঘাতটা আরও সিরিয়াস হতে পারত। গত তিন হপ্তা একটা নার্সিং হোমে ছিলাম। ডাক্তাররা তো বলছেন, সব ঘা শুকিয়ে গেলে দাগ প্রায় থাকবেই না, কিন্তু আমার ঠিক বিশ্বাস হচ্ছে না। হাতটা ভাঙেনি, তবে ফেটে গেছে হাড়। খুবই ভাগ্যের জোর রে, শান্তা। বাঁচার কোন কথা ছিল না।
হাসান ভাই বলেছেন তুমি মারা গেছ, শান্তার সেই একই কথা।
মাথা নাড়ল হাসান। শান্তা, আমি তা বলিনি-চিন্তা করে দেখো। এ-ধরনের কিছু আগেও বলিনি, আজ সন্ধের সময়ও বলিনি। লোকের ধারণা যে আমি…আমি…থাক, এ-সব কথা এখন আর তুলব না। আমি শুধু তোমাকে একটা কথাই বলেছি, বলেছি যে ঝর্ণা আর ফেরত আসবে না। ও যে ফেরত এসেছে, বিশ্বাস করো এটা আমার কাছে বিরাট একটা চমক।
এখানে সাংঘাতিক সব ব্যাপার ঘটে গেছে, বলল শান্তা, ভাব দেখে মনে হলো এখনও তার ঘোর কাটেনি।
অত্যন্ত দুর্বল লাগছে নিজেকে, ঝিম ঝিম করছে মাথাটা, তবু সোফার ওপর উঠে বসার চেষ্টা করল। তাড়াতাড়ি হাত বাড়িয়ে তাকে ধরে ফেলল হাসান। আমি তোমার সঙ্গে নিষ্ঠুর আচরণ করেছি। লক্ষ্মী সোনা, আমি আসলে বুঝতে পারিনি…বলতে পারো গোটা ব্যাপারটাই আমার এক ধরনের পাগলামি বা শয়তানি ছিল, কিংবা বলতে পারো একটা ছেলেমানুষি খেলা ছিল। আমি মনে খুব আঘাত পেয়েছিলাম, প্রচণ্ড রাগে আগুন জ্বলছিল আমার সারা শরীরে, অন্তত কিছুটা সময়। সেজন্যেই মানুষকে নিয়ে এই খেলাটা খেলে আমি এক ধরনের তৃপ্তি পেয়েছি।
আপনি কিন্তু আমাকে বোকা বানাতে পারেননি, বলল শান্তা।
জানি। কাল পর্যন্ত আমার কথা বিশ্বাস করেছ তুমি। কিন্তু প্রমাণগুলো একের পর এক আমার বিরুদ্ধে জমা হতে থাকায় তোমার বিশ্বাসের ভিত নড়ে যায়। সেজন্যে আমি তোমাকে দোষ, দিতে পারি না।
আপনি এখনও আমাকে বোকা বানাতে পারছেন না, বলল শান্তা।
এখন আর কাউকে বোকা বানাবার দরকার নেই, লক্ষ্মী সানা। খেলাটা শেষ হয়ে গেছে। এতদিন ভাল মানুষের পো যারা আমাকে জঘন্য অপরাধী ভেবে এসেছে তাদেরকে এখন হতভম্ব দেখাবে। তুমি এখন তাদেরকে বলতে পারবে ওদের সন্দেহ যে মিথ্যে তা তুমি প্রথম থেকেই জানতে।
ঝর্ণা বলল, তোমাদের এসব কথার অর্থ কিছুই আমি বুঝতে পারছি না। তবে আগে আমার লক্ষ্মী বোনটি সুস্থ হোক, সব কথা পরে শুনলেও চলবে আমার।
এসো, প্রথমে আমরা শান্তাকে ওদের বাড়িতে দিয়ে আসি। বেচারা খুব বড় একটা ধাক্কা খেয়েছে। তবে, লক্ষ্মী সোনা, দুএকটা কথা অবশ্যই তোমাকে বিশ্বাস করতে হবে। দুজন একসঙ্গে যাবার কথা যেটা বলেছি, সেটা মিথ্যে নয়। তোমাকে সত্যি আমি ভালবাসি।
হাসান! বিস্ময়ে আঁতকে উঠল ঝর্ণা।
কেন, এটাই তো তুমি চেয়েছিলে, ঠাণ্ডা সুরে বলল হাসান। ভুলে গেছ? মনে করে দেখো, আমাকে তুমি বলোনি—সত্যিকারের একটা লাভ অ্যাফেয়ার দরকার আমার? বললানি, আমার উচিত শান্তার দিকে ঝুঁকে পড়া, প্রয়োজনে নিজের ওপর জোর খাটিয়ে হলেও?
উত্তরে ঝর্ণা কিছু বলার আগেই মটরসাইকেলের আওয়াজ ভেসে এল।
বোধহয় সাইফুল ভাই এসেছেন, কোন রকমে বলল শান্তা, তবে তার চেহারায় খানিকটা স্বস্তির ভাব ফুটে উঠল।
পিছনে লেগে থাকা পাণিপ্রার্থী? হ্যাঁ, বোধহয় সে-ই। যাই দেখি, কি চায় সে।
না, আমি যাই, সোফা ছেড়ে দাঁড়িয়ে পড়ল শান্তা। সাইফুল ভাই আমাকে নিতে এসেছেন।
তুই কি এই অবস্থায় যেতে পারবি? উদ্বেগে বোনের দিকে ঝুঁকে পড়ল ঝর্ণা।
মনে হয় পারব, হ্যাঁ পারব।
শান্তা কামরা থেকে বেরিয়ে যেতে ঝর্ণা আর হাসান পরস্পরের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকল।
তোমার আঘাত কি খুব গুরুতর? অবশেষে মুখ খুলল হাসান, চেহারায় বিব্রত ভাব।
প্রথমে মনে হয়েছিল যে চেহারা নিয়ে এত গর্ব আমার, সেটা গেছে। কোলকাতায় প্লাস্টিক সার্জারি বেশ ভালই করে ওরা, তবে প্রচুর সময় লাগে আর খুব কষ্টও। বলল, ব্যাণ্ডেজ খোলার পর সব ঠিক হয়ে যাবে। আরও ছহপ্তা খোলা নিষেধ। সার্জেন ভদ্রলোক নার্সিং হোম থেকে ছাড়তে চাননি আমাকে, এক রকম জোর করেই চলে এলাম। বাড়ি ফেরার জন্যে হঠাৎ উতলা হয়ে পড়েছিলাম। আসার পর মনে হচ্ছে, আরও দেরি করলে ক্ষতি হয়ে যেত।
আমাকে না হোক, আর কাউকে একটা চিঠি লেখার কথাও তোমার মনে হলো না? তিক্তস্বরে জিজ্ঞেস করল হাসান।
প্রথমদিকে এত অসুস্থ ছিলাম যে চিঠি লেখা সম্ভব ছিল না। আমার সঙ্গে মধুরিমা আর তার স্বামী কাজী মহসীন ছিল, আমরা ওদের গাড়ি নিয়ে দিঘায় যাচ্ছিলাম। ওরা দুজনও আহত হয়েছে, তবে তেমন সিরিয়াস কিছু না। তোমার আমার কথা যদি বলো, এমন অদ্ভুত শর্তে বিচ্ছিন্ন হই আমরা যে ভাবলাম চিঠি না লিখে কথা যা হওয়া দরকার সব সামনাসামনি বসে। তাই চলে এলাম।
তবু চিঠি লিখলে বা ফোন করলে এদিকে আমি কিছুটা শান্তি পেতাম। বিশ্বাস করো, এখানে সবাই ধরে নিয়েছিল আমি তোমাকে খুন করে লাশটা লুকিয়ে রেখেছি বাগানে। পিছনের বাগানটা এখনও যে খোড়া হয়নি, সেটা স্রেফ ভাগ্য।
চোখে অবিশ্বাস, ঝর্ণা বলল, যাহ্, তুমি বাড়িয়ে বলছ!
দুএকদিন থাকো, এর তার সঙ্গে দেখা হোক, তখন বুঝতে পারবে বাড়িয়ে বলছি কিনা। যাবার সময় বলে গেলে জীবনে আর কোনদিন ফিরে আসবে না। যখন দেখলাম দিনের পর দিন কেটে যাচ্ছে, তুমি ফিরছ না, আমি ধরে নিলাম হারানো সুখ খুঁজে পেয়েছে তুমি, ভুলে গেছ আমাকে। বুঝলাম, আশরাফকে খুঁজে পেয়েছ তুমি, তার সঙ্গে আমেরিকা বা আর কোথাও চলে গেছ।
আশরাফ মারা গেছে। প্রথম যে খবরটা পাই আর সেটাই সত্যি ছিল। সাগরে ডুবে মারা গেছে সে। তীরে যে লাশটা ভেসে আসে সেটা তারই লাশ ছিল। আমি যেমন ভেবেছিলাম অন্য কারও লাশ, তা নয়। তুমি জানো, আমার এরকম ভাবার পিছনে যথেষ্ট সঙ্গত কারণও ছিল। মধুরিমা চিঠি লিখে জানিয়েছিল, কোলকাতায় আশরাফকে দেখেছে সে। কিন্তু না, ভুল দেখেছিল। যাকে দেখে এই ভুল বোঝাবুঝি তাকেও আমি কোলকাতায় দেখেছি। হ্যাঁ, আশরাফের সঙ্গে তার চেহারার অনেক মিল আছে, মধুরিমার ভুল হওয়াটা স্বাভাবিক। ভদ্রলোক একজন আর্টিস্ট, বাঙালী, তবে হিন্দু। বিবাহিত তিনি, দুটো বাচ্চাও আছে। ওখানকার একটা সিকিউরিটি এজেন্সির সাহায্য নিই আমরা। দিঘার যে গ্রামটায় লাশটা ভেসে আসে সেখানকার লোক বেশিরভাগই জেলে, তাদের সঙ্গে কথা বলে এজেন্সির লোকজন। লাশের ভাঙা হাতঘড়িও উদ্ধার করা হয়েছে। আমার দেয়া উপহার ছিল ওটা, ডায়ালের পিছনে আশরাফের নাম লেখা, চিনতে অসুবিধে হয়নি।
তাহলে ওদিকটা পরিষ্কার হয়ে গেছে, তোমার মনে এখন আর কোন সংশয় নেই, তাই না? কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে আবার হাসান বলল, সত্যি আমি দুঃখিত। ব্যাপারটা তোমার জন্যে নিশ্চয়ই বিরাট একটা আঘাত। তবে এ-ও বোধহয় সত্যি যে সন্দেহটা দূর হওয়ায় তোমার মন থেকে বিরাট একটা বোঝা নেমে গেছে।
ওগো…এ যে কি পরম স্বস্তি, ঝর্ণা খসখসে গলায়, নরম সুরে, বলল, কি করে বোঝাব তোমাকে! সে বেঁচে আছে কিনা জানার জন্যে রওনা হবার পর বুঝতে পারি, নিজেরই স্বার্থে আশরাফকে জীবিত অবস্থায় খুঁজে পেতে চাই না আমি। এখান থেকে চলে যাবার পর উপলব্ধি করি কী অবাস্তব একটা জগতে বাস করছিলাম, কী ভয়ঙ্কর একটা দুঃস্বপ্নের ভেতর আমার জীবন কাটছিল। তোমাকে কত কষ্ট দিয়েছি ভেবে মরে যেতে ইচ্ছে করছিল আমার।
বুঝতে একটু দেরি করে ফেলেছ বলে মনে হচ্ছে, গভীর সুরে বলল হাসান।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সোফায় ডুবে গেল ঝণী। আমি খুব ক্লান্ত। সেই বেনাপোল থেকে আসছি, সারাটা দিন গাড়িতে, বলল সে। এক কাপ চা খেলে হয়তো মাথাটা ছেড়ে যেত।
ইতস্তত করল হাসান, তবে তা মাত্র পলকের জন্যে, তারপর বৈঠকখানা ছেড়ে বেরিয়ে গেল। রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে চা বানাচ্ছে সে, পায়ের আওয়াজ শুনে বুঝল বৈঠকখানা থেকে শোবার ঘরে চলে এসেছে ঝর্ণা।
দুকাপ চা নিয়ে ভেতরে ঢুকে হাসান দেখল, বিছানার ওপর বালিশে হেলান দিয়ে বসে রয়েছে সে, চোখ দুটো বন্ধ। তারপর চোখ খুলল, হাসানের হাত থেকে একটা কাপ নিয়ে সিধে হয়ে বসল। ঠিক কি ঘটেছে বলো এবার আমাকে, বলল ঝর্ণা। এখানকার পরিস্থিতি জটিল হয়ে ওঠায় আমাকে দেখে স্বস্তি পেয়েছ, এটুকু বোঝা যাচ্ছে। তবে এ-ও বোঝা যাচ্ছে, শুধু এই কারণটা ছাড়া আমাকে দেখে খুশি হওনি তুমি.। ব্যক্তিগতভাবে আমার আর কোন মূল্য নেই তোমার কাছে। তুমি কি সত্যি শান্তার সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছ? তা যদি সত্যি হয়, দোষ আমি নিজেকেই দেব। আমিই ওর দিকে ঠেলে দিয়েছিলাম তোমাকে।
হ্যাঁ, ওকে আমি ভালবাসি, কিন্তু ও তা বিশ্বাস করে না, বলল হাসান। এক অর্থে অত্যন্ত খারাপ আচরণ করেছি আমি ওর সঙ্গে। যে উপন্যাসটা শেষ করলাম ওটার একটা চরিত্রের সঙ্গে ওকে আমি এক করে ফেলি। একবার হয়তো ওই নারী চরিত্রটিকে ভেঙেচুরে শান্তার মত আদল দেয়ার চেষ্টা করি, তারপর আবার বিশেষ একটা পরিস্থিতির মধ্যে ঠেলে দিয়ে দেখতে চেষ্টা করি নায়িকা যে আচরণ করবে বলে আমার ধারণা শান্তাও সেই আচরণ করে কিনা। তারপর ধরো, আগেই বলেছি, এখানকার লোকজন ভাবতে শুরু করে তোমাকে আমি খুন করে লুকিয়ে রেখেছি লাশ। বলতে পারো, একথা ভাবতে ওদেরকে আমি প্ররোচিত করি। সত্যি কথা বলতে কি, আমার খুব মজা লাগে, বিশেষ করে থানা থেকে একজন ইন্সপেক্টর। তদন্ত করতে আসার পর। বিশ্বাস করো, রীতিমত একটা নাটক হয়ে গেছে এখানে। আমাকে বাঁচাবার জন্যে অস্থির হয়ে ওঠে বেচারি শান্তা। কি যে মজা পেয়েছি, সে তুমি কল্পনা করতে পারবে না।
পারব, শুধু আমার পক্ষেই পারা সম্ভব, বলল ঝর্ণা। কারণ একা শুধু আমিই তোমার জটিল মানসিকতা কমবেশি বুঝতে পারি।
শারীরিক অর্থে আমি ওর কোন ক্ষতি করিনি, বলল হাসান। একবারই শুধু ওর কাঁধে হাত রেখে নিজের দিকে টেনেছিলাম, তবে তারপর আর ছুঁইনি। না, একটু ভুল হলো, আমি ওকে…মানে ওর কপালে চুমো খেয়েছিলাম। মেয়েটা আসলে কি যে ভাল…এত মিষ্টি আর সরল। এটুকুই লাভ বা নিজের কৃতিত্ব আমার যে শান্তাকে আমি চিনতে পেরেছি। আমাকে বিশ্বাসও করেছে, অন্তত কাল পর্যন্ত। অথচ তার কানে আমার বিরুদ্ধে বিষ ঢালার কম চেষ্টা করা হয়নি। কিন্তু আজ সকালের কাগজে তোমার সেই ঘাগরা পরা সোহানার ছবি দেখে এমন এক বিষম ধাক্কা খেয়েছে, এখনও সামলে উঠতে পারছে না। সোহানার সঙ্গে দেখা করার জন্যে আজ সকালে ঢাকায় চলে গিয়েছিল সে।
ঝর্ণার ঘাগরা সোহানার কাছে কিভাবে গেল, ধীরে ধীরে ব্যাখ্যা করল হাসান।
চুপচাপ শুনল ঝর্ণা, হাসান থামতে সে বলল, আমার অত সুন্দর ঘাগরা আর শাল তুমি…কাজটা ভাল করোনি?
এরপর ঢাকায় গেলে চেয়ে নিয়ে তুমি, বলল হাসান।
কিন্তু এ-সব তুমি করেছ শুধু কুৎসাপ্রিয় প্রতিবেশীদের বোকা রানাবার জন্যে? অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল ঝর্ণা।
হেসে ফেলল হাসান। সব না হলেও, কিছু কিছু। সোহানা অনেকটাই তোমার মত দেখতে, ভাবলাম প্রশ্ন করা হলে ট্রান্সপোর্ট কোম্পানীর লোকেরা যদি বলে তোমার মত দেখতে একটা মেয়ের সঙ্গে আমাকে দেখেছে তারা তাহলে হয়তো আমার ওপর থেকে সন্দেহ খানিকটা কমবে। ঠিকই ভেবেছিলাম আমি, কারণ পুলিশ আর আমাকে বিরক্ত করেনি। তবে এখনও তারা দূর থেকে নজর রাখছে বলে মনে হয়।
যাক, এখন থেকে আর রাখবে না।
হ্যাঁ, তুমি ফিরে আসায়। কিন্তু শান্তাকে বোঝানো সহজ হবে না।
কেন? আমাকে তুমি খুন করেছ, এ-কথা তো কখনোই ওকে বললানি।
ঝর্ণার দৃষ্টির সামনে অস্বস্তিবোধ করায় চোখ নামিয়ে নিল হাসান, স্নান গলায় বলল, তা সত্যি, তবে অনেক সময় কোন কথা এমন ভঙ্গিতে অস্বীকার করা যায়, শুনে মনে হবে স্বীকার করা হচ্ছে। ইচ্ছে করেই সব আমি অস্পষ্ট করে রেখেছিলাম। আমাকে দেখে রহস্যময় মনে হয়েছে, মনে হয়েছে ভয়ে ভয়ে আছি। তুমি আমাকে বলে গিয়েছিলে বটে যে শান্তা আমার প্রেমে পড়েছে, কিন্তু তুমি চলে যাবার পর শুরুতে আমি ওর দিকে মোটেও ঝুঁকিনি। ওর বিশ্বাস ওকে কতদূর নিয়ে যায়, এটা দেখার খুব ইচ্ছে ছিল আমার। খোর ইচ্ছে ছিল আমার নায়িকা আর শান্তা একই টাইপের কিনা।
এ তুমি ভারি অন্যায় করেছ।
এ-সব জঞ্জাল আমি সাফ করতে পারব, বলল হাসান, তার চেহারায় ব্যাকুল একটা ভাব ফুটে উঠল। তুমি ফিরে আসায় এখন ওকে বিশ্বাস করতে হবে যে সত্যি আমি ওকে ভালবাসি। ওকে আমি বিয়ে করতে চাই, ঝর্ণা; কাজেই তোমার কাছ থেকে ডিভোর্স। চাই আমি। তুমি আমার সঙ্গে যে আচরণ করেছ; মুক্তি আমি চাইতেই পারি।
হ্যাঁ, তা চাইতে পারো, স্বীকার করল ঝর্ণা।
ঝর্ণার মুখ আংশিক ঢাকা পড়ে আছে ব্যাণ্ডেজে, খুব বেশি দেখতে পাচ্ছে না হাসান, তবে মাথাটা নত করে রেখেছে সে, আর ঠোঁট দুটো পরস্পরের সঙ্গে শক্তভাবে সেঁটে আছে। তিক্ত হাসি ফুটল হাসানের মুখে, বলল, অন্য কেউ হলে বোধহয় গালাগাল দিত তোমাকে, কিংবা হয়তো মারধর করত। আজ আমি বুঝতে পারছি, সে-ধরনের কিছু করার মানসিকতা আমারও থাকা উচিত ছিল। আরও অনেক আগে যদি কড়া শাসন করতে পারতাম তোমাকে, আজ বোধহয় এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হত না। বিয়েটা হয়তো শেষ পর্যন্ত টিকত।
বিয়ের পর এক বছর ধরে আমাকে তুমি কম অপমান করোনি, তোমার কি ধারণা তাতে আমার উপকার হয়েছে?
আমি নই, অপমান করেছ তুমি আমাকে, বারবার। তুমি যে অত্যাচার আমার ওপর করেছ, কোন স্বামী তা সহ্য করবে না। ঘর করেছ আমার সঙ্গে, কিন্তু সারাক্ষণ ভেবেছ অন্য একজনের কথা। তুমি যদি অপমানিত বোধ করে থাকো, তার জন্যে দায়ী তোমার বদমেজাজ।
মনে হত তোমাকে আমি কোনদিন ক্ষমা করতে পারব না, নিচু গলায় বলল ঝর্ণা। তবে আজ বুঝি, সত্যি তোমার ওপর অত্যাচার হয়েছে।
কী সৌভাগ্য আমার, এ-সব কথা শোনার জন্যে আজও আমি বঁচে আছি! চোখ তুলে বলল হাসান।
আমার কি হলো না হলো সে-কথা ভেবে ভয় লাগেনি তোমার? আমার জন্যে তোমার দুশ্চিন্তা হয়নি?
প্রথম দিকে, হ্যাঁ। কিন্তু তারপর তুমি ফিরে আসছ না দেখে, আমাকে বিপদে ফেলে দিয়ে মজা পাচ্ছ বুঝতে পেরে, তোমার ওপর খুব রাগ হয় আমার।
নরম সুরে জিজ্ঞেস করল ঝর্ণা, লেখাটা কেমন হলো?
মনে হয় খুবই ভাল।
তাহলে তো ক্ষতিপূরণ হয়েই গেছে, বলা চলে। তোমার কাছে তো সবকিছুর আগে লেখা।
কথাটা সত্যি নয়। একটা সময় ছিল যখন আমি তোমাকে ছাড়া বাচতাম না।
আর এখন তুমি শান্তাকে ছাড়া বাঁচো না?
তাকে অসুখী করে বেঁচে থাকার কোন ইচ্ছে নেই আমার। কি ভাবো তুমি, ওর সঙ্গে এত কিছু করার পর, ওই নিষ্প্রাণ সাইফুলের হাতে তুলে দেব ওকে?
তার সম্পর্কে আমি যতটুকু জানি, সাইফুল নিষ্প্রাণ নয়। তার ব্যক্তিত্বে নিজেকে জাহির করার প্রবণতা নেই, আর সেটাই তোমার অপছন্দ,বলল ঝর্ণা। আসলে তোমার ভেতর একটা খেপামি রোগ আছে, মাঝে মধ্যে সেটা খুব বাড়াবাড়ি করে, এই যেমন এখন। এই মুহূর্তে শান্তা ছাড়া বাকি সবাই তোমার ওই খেপামির শিকার। খুব ভাল করেই বুঝতে পারছ যে শান্তার ওপর তুমি অন্যায় করেছ। তার সঙ্গে আবার তুমি সম্পর্কটা স্বাভাবিক করে নিতে পারবে বলে ভাবছ বটে, তবে আমার মনে হয় না কাজটা অত সহজ হবে। তাছাড়া, খালাম্মা চাইবেন না যে আমাকে ছেড়ে দিয়ে শান্তাকে তুমি বিয়ে করো। ..
শান্তা তার মাকে ভালবাসে, তৰে আমাকে আরও বেশি ভালবাসে, জোর দিয়ে বলল হাসান।
সেটা দেখার বিষয়। হাসান, তুমি আসলে বোকার মত আচরণ করেছ। সত্যি যদি প্রমাণ করতে চাইতে যে আমি বেঁচে আছি, ঢাকায় আমার ব্যাংকের ম্যানেজারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে তুমি। কোলকাতায় যেতে হলে টাকা লাগবে আমার, কিন্তু এখান থেকে যাবার সময় তুমি আমাকে টাকা দাওনি। ব্যাংকের ম্যানেজার তোমাকে বা পুলিশকে জানাতে পারতেন যে কোলকাতায় যাবার আগে আমার অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা তুলেছি আমি।
কথাটা আমার মনে পড়েনি, বলল হাসান।
দীর্ঘশ্বাস ফেলল ঝর্ণা। থাক, তোমার সমালোচনা করা আমার উচিত নয়। প্রথম যখন দেখা হলো তোমার সঙ্গে, মনে হয়েছিল তুমি একটা আদর্শ পুরুষ। মনে হয়েছিল, খোদা তোমাকে শুধু আমার জন্যেই তৈরি করেছেন। বিয়ের পর আমি যতটা সুখী হলাম, আর কোন মেয়ে অতটা সুখী হয় কিনা জানা নেই আমার। এ-কথা অস্বীকার করলে পাপ হবে যে তুমি আমার সঙ্গে ভাল ব্যবহার করোনি। কিন্তু তারপর, সম্পূর্ণ ভুল বুঝতে শুরু করলে আমাকে। একটু থামল সে, তারপর বলল, থাক এ-সব, যা ঘটার তা তো ঘটেই গেছে। শুধু একটা কথা বলি, সব কিছুর জন্যে সত্যি আমি দুঃখিত।
হ্যাঁ, এখন আর কিছু করার নেই, বলল হাসান। তবে আমিও সে-কথা বুঝি যে খুব অশান্তির মধ্যে ছিলে তুমি। আশরাফ তোমার একটা অবসেসন হয়ে ওঠে। বিয়েতে তোমাকে আমি জোর করে রাজি করাই, সেটাই বোধহয় ভুল হয়ে গেছে।
তুমি বিয়ে করতে চাওয়ায় নিজেকে মনে হয়েছিল ভাগ্যবতী, বলল ঝর্ণা। দেখে ভাল লেগেছিল, এক অর্থে ভালও বেসে ফেলেছিলাম, কিন্তু তখনও ভাবিনি যে তুমি আমাকে চাইবে। আসলে দ্বিতীয়বার বিয়ে করলে সুখী না-ও হতে পারি, এ-ধরনের একটা ভয় ছিল মনে। কিন্তু বিয়ের পর বুঝলাম, ভয়টা মিথ্যে। যদিও পরে, বোধহয় নিজেকে এত সুখী হতে দেখে, এক ধরনের মানসিক অশান্তি শুরু হয় আমার। সব সময় মনে হত, আশরাফ বেঁচে আছে। আর তারপরই মধুরিমা চিঠি লিখে জানাল, কোলকাতায় ভিড়ের মধ্যে আশরাফকে দেখেছে সে। শুনে আমার যেন মাথা খারাপ হয়ে গেল। আমাদের, মানে তোমার আর আমার জীবনে এই অশান্তি ডেকে আনার জন্যে মধুরিমাকে খুব বকাঝকা করেছে মহসীন। তারপর আমার মনে পড়ল, তোমাকে বিয়ে করার পর মধুরিমাই আমার মনে সন্দেহটা ঢুকিয়ে দেয়। তবে, আমি জানি, খারাপ কোন উদ্দেশ্য নিয়ে এ-সব করেনি সে। এখান থেকে আমি রাগ করে চলে এসেছি শুনে মহসীনই প্রস্তাব দেয়, নিশ্চিতভাবে জানা দরকার আশরাফ সত্যি বেঁচে আছে কিনা। পথে যে দুর্ঘটনা হলো, সেজন্যেও নিজেদেরকে দায়ী করল ওরা। আমাকে একটা পয়সা খরচ করতে দেয়নি…সার্জেন ভদ্রলোককে নিজেদের প্রায় অর্ধেক সঞ্চয় দিয়ে ফেলেছে। আমার কাছে খুব বেশি টাকা ছিলও না। কোলকাতায় ওদের বাড়িতে উঠি, আর দিঘায় ছিলাম ওদের এক বন্ধুর বাড়িতে।
ঠিক আছে, মহসীন ঢাকায় এলে তার ঋণ শোধ করা যাবে, বলল হাসান।
তখন সেটা তোমার দায় থাকবে না। তুমি যদি ডিভোর্সই চাও, তখন আমি তোমার স্ত্রী থাকব না।
হ্যাঁ, তাই তো, বিড়বিড় করল হাসান, যেন হঠাৎ এই বাস্তবতার মুখোমুখি হয়ে হকচকিয়ে গেছে সে।
তবে এখানের যে পরিবেশ, অন্তত কিছুদিন এমন ভাব দেখাতে হবে যে আমাদের মধ্যে যেন কিছুই হয়নি, সব আগের মত আছে। তারপর একদিন চুপিসাড়ে ঢাকায় চলে যাব আমরা, উকিলের সঙ্গে পরামর্শ করে ছাড়িয়ে নেব নিজেদের। তুমি যখন চাইছ আমি ডিভোর্সের জন্যে অ্যাপ্লাই করব, ঠিক আছে, তাই হবে।
তুমি দেখছি আমার সঙ্গে খুব নরম ব্যবহার করছ।
হাসান, তুমি যদি আমাকে আর না চাও, ভালবাসো অন্য একটা মেয়েকে, তোমাকে বেঁধে রাখার কোন ইচ্ছেই নেই আমার, এতক্ষণ পর এই প্রথম আবার সেই পুরানো জেদ প্রকাশ পেল ঝর্ণার কথায়।
বুঝেছি।
আসলে, কাজী মহসীন খুব বড় একটা সুযোগ দিচ্ছে আমাকে। নাম করা একজন সাহিত্যিকের লেখা উপন্যাস নাটকে রূপান্তর করছে সে, টিভির জন্যে ধারাবাহিক। মহসীনের ধারণা, নায়িকা চরিত্রে আমাকে ছাড়া আর কাউকে মানাবে না, অবশ্য যদি ব্যাণ্ডেজ খোলার পর দেখা যায় যে আমার মুখে কোন দাগ নেই। সে আমার জন্যে অপেক্ষা করতে রাজি আছে। ঘাড় থেকে আশরাফের ভূত নেমে যাবার পর ভাবলাম বাড়ি ফিরে আসি, এ-ব্যাপারে তুমি কি বলো জিজ্ঞেস করি। তবে এখন আর কারও অনুমতি নেয়ার দরকার হচ্ছে না।
না, তার আর দরকার নেই। কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল হাসান, চারপর আবার বলল, আমি তোমাকে বহুবার বলেছি, অভিনয়বাদ দেয়া উচিত হয়নি তোমার। আবার তুমি কাজ করতে রাজি হয়েছ গুনে ভাল লাগছে আমার।
হ্যাঁ, অনেক বদলে গেছি আমি, বলল ঝর্ণা। এখন আমি সেই আগের ঝর্ণা, যাকে দেখে ভাল লেগেছিল তোমার। তখন আমার মেজাজ ছিল না, কথায় কথায় তোমার সঙ্গে ঝগড়া করতাম না। কি, মিথ্যে বলছি? না। খুব শান্ত ছিলে তুমি। বিষন্ন। তোমার শান্ত উদাস ভাবটুকুই সাংঘাতিক ভাল লেগে যায় আমার।
অমূল্য একটা সম্পদ অবহেলায় হারিয়ে বসেছি। কি বোকামি, কি সাংঘাতিক বোকামিই না হয়ে গেছে, তিক্ত, মান গলায় বিড়বিড় করল ঝর্ণা। কিন্তু এখন দুঃখ করে লাভ কি।
হ্যাঁ, অনেক দেরি হয়ে গেছে, নির্লিপ্ত স্বরে প্রতিধ্বনি তুলল হাসান।
তিন দিন ধরে চেষ্টা করেও শান্তার সঙ্গে দেখা করতে পারল না ঝর্ণা, বা হাসান। ফাল্গুনী ইসলামের সঙ্গে রোজ দেখা করে শান্তার অসুস্থতার সব খবরই অবশ্য পাচ্ছে। শহরের সবচেয়ে নামকরা ডাক্তার চিকিৎসা করছেন তার, যদিও রোগটা এখনও তিনি ঠিকমত ধরতে পারেননি। বলেছেন, শান্তার মনের ভেতর আজেবাজে অনেক চিন্তা জট পাকিয়ে গেছে, সব আবার ঠিক হতে সময় নেবে। দিন কয়েক কারও সঙ্গে দেখা করতে বা কথা বলতে নিষেধ করে দিয়েছেন তিনি, কারণ এই অবস্থায় অস্থির বা উত্তেজিত হলে অবস্থা আরও খারাপের দিকে চলে যাবে।
কিন্তু এদিকে খুব অস্থির হয়ে উঠেছে হাসান। মুখ ফুটে কিছু বলছে না বটে, তবে বোঝা যায় যে বেশি সময় নষ্ট না করে ঝর্ণার সঙ্গে সম্পর্ক চুকিয়ে শান্তাকে আপন করে নেয়ার জন্যে ব্যাকুল হয়ে আছে সে। মুশকিল হলো, সারা দিন নিজের ঘরের দরজা বন্ধ করে রেখেছে শান্তা, পরিচয় না জেনে ভেতরে কাউকে ঢুকতে দিচ্ছে না।
আজ এত বেশি তাগাদা দিতে শুরু করল হাসান, তাকে নিয়ে আবার শান্তাদের বাড়িতে চলে এল ঝর্ণা। ফাল্গুনী ইসলাম স্কুলে, বাড়িতে শান্তা ছাড়া আর শুধু রয়েছেন আয়েশা বেগম। ওদেরকে দেখেই তিনি বললেন, শান্তা আজ একটু ভাল, তবে বলে দিয়েছে কারও সঙ্গে দেখা হবে না।
কথা না বলে শান্তার ঘরের সামনে চলে এল ওরা। ঝর্ণা বলল, শান্তা, দরজা খোল। আমার সঙ্গে তোর হাসান ভাইও এসেছে।
তিন-চারবার ডাকাডাকির পর ভেতর থেকে সাড়া দিল শান্তা। ওঁকে তুমি চলে যেতে বলো।
আমার সঙ্গে একা কথা বলবি?
হ্যাঁ।
হাসানের দিকে ফিরল ঝর্ণা, দেখল তার চেহারা কালো হয়ে গেছে। চিন্তা কোরো না, হাসানকে বলল সে। কথা দিচ্ছি, কোন কারচুপি হবে না। যদি ভেবে থাকো তোমার বিরুদ্ধে ওর মনটাকে বিষিয়ে তোলার চেষ্টা করব আমি, ভুল করবে। আমি আমার নিয়তিকে মেনে নিয়েছি।
এক ঘণ্টা পর ঝর্ণাকে নিতে আসবে বলে ফিরে গেল হাসান।
তারপর দরজা খুলল শান্তা, ঝর্ণা ভেতরে ঢুকতে দরজাটা সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ করে দিল। ঝর্ণাকে একটা চেয়ার দেখিয়ে বিছানায় কসল সে, হেলান দিল বালিশে। ঝর্ণার মুখ এখনও ব্যান্ডেজে ঢাকা, মাথায় স্কার্ফ জড়ানো, সেদিকে অপলক চোখে তাকিয়ে থাকল।
শান্তা, হাসান আমাকে সব বলেছে, বলল ঝর্ণা। তুইও মন খুলে সব কথা বলতে পারিস আমাকে। তার আগে বলে রাখি, তোদের ওপর রাগ বলিস ঘৃণা বলিস কিছুই নেই আমার। – আচ্ছা! তাই? ঠোঁট বাঁকা করে হাসল শান্তা, যেন ব্যঙ্গ করল।
হাসান তোর ওপর কিছু কিছু অন্যায় করেছে, তবে সেজন্যে তার চেয়ে বরং আমিই বেশি দায়ী। সে যাই হোক, ঠিক হয়েছে আমরা আর একসঙ্গে থাকব না—আমি হাসানকে ডিভোর্স দিচ্ছি। তারপর সে…তারপর সে যা খুশি করুক, আমার কোন মাথাব্যথা নেই।
তার ডিভোর্সের কোন দরকার নেই, শান্তার গলা ভেঙে গেল।
পাগলামি করিস না। বললামই তো, যা কিছু ঘটেছে, সব আমার দোষে। আমি যদি টেলিফোন না করে সোমবারে ফিরে আসতাম ঢাকা থেকে, সব আবার ঠিক হয়ে যেত। এখন আর…।
ফোনটা তাহলে তুমিই করেছিলে?
হতভম্ব দেখাল ঝর্ণাকে। আমি ছাড়া আর কে করবে?
প্রশ্নটা নিয়ে অনেক ভেবেছি আমি। প্রথমে মাঝে মধ্যে, তারপর দিন রাত চব্বিশ ঘণ্টা। তবে এখন বুঝতে পারছি, বোধহয় তুমিই করেছিলে-তোমার গলা অনেকটা তার মতই।
কার মত? অবাক হয়ে জানতে চাইল ঝর্ণা।
ঝর্ণা আপার মত।
ঘরের ভেতর নিস্তব্ধতা জমাট বাঁধল, নিজেকে সামলে নেয়ার চেষ্টা করছে ঝর্ণা। তারপর সে বলল, তোর কি মাথা খারাপ হলো? ধ্যেত, এ-সব কি প্রলাপ বকছিস! ভাল করেই জানিস যে আমি ঝর্ণা।
না, তুমি ঝর্ণা হতে পারো না। ঝর্ণা আপা মারা গেছে।
ঝট করে চেয়ার ছাড়ল ঝর্ণা, দরজা পর্যন্ত হেঁটে গেল, তারপর এক সেকেণ্ড দাঁড়াল, ঘুরে ফিরে এল আবার বিছানার পাশে। এক হতে পারে যে তোর মাথায় গোলমাল দেখা দিয়েছে, কিন্তু আমি তা বিশ্বাস করি না, বলল সে। আমি যদি ঝর্ণা না হই, তাহলে কে? কি কারণে নিজেকে আমি ঝর্ণা বলে দাবি করছি?
উত্তর খুব সহজ, ঠাণ্ডা, কঠিন সুরে বলল শান্তা। হাসান ভাই এখান থেকে দূরে কোথাও পালাতে চান, পালাবার আগে তাঁর প্রমাণ করা দরকার ঝর্ণা আপা এখনও বেঁচে আছে। তাহলে আর মানুষ কোন প্রশ্ন বা সন্দেহ করবে না। তোমাকে হয়তো অনেক দিন থেকে চেনেন তিনি, কিংবা টাকা দিয়ে ভাড়া করেছেন, ঝর্ণা আপার ভূমিকায় অভিনয় করানোর জন্যে। সেজন্যেই হাতে আর মুখে ব্যাণ্ডেজ। হাতে ব্যাণ্ডেজ থাকায় তুমি লিখতে পারবে না, অর্থাৎ ঝর্ণা আপার হাতের লেখার সঙ্গে তোমার হাতের লেখা মেলানো যাবে না।
কিছুক্ষণ হাঁ করে তাকিয়ে থাকল ঝর্ণা, তারপর জানতে চাইল, কেন তোর মনে হচ্ছে আমি মারা গেছি?
কারণ তুমি বেঁচে থাকলে কোন না কোনভাবে হাসান ভাই তা প্রমাণ করতেন। তিনি আসলে সেভাবে চেষ্টাই করেননি। চেষ্টা করেছেন শুধু যাতে মনে হয় ঝর্ণা আপার নিখোঁজ হওয়াটা স্বাভাবিক। একটা পর্যায় পর্যন্ত তার ওপর আমার বিশ্বাস ছিল, কিন্তু তারপর আর অত্যাচারটা সহ্য হচ্ছিল না।
কিন্তু হাসান আমাকে ডিভোর্স দিতে চাইছে! আমি যদি ঝর্ণা না হই, আমার যদি কোন অস্তিত্বই না থাকে, তাহলে সে ডিভোর্স দেবে কাকে?
লোককে দেখানোর জন্যে তোমাকেই ডিভোর্স দেবে। ভেবেছ এই সহজ কথাটা আমার মাথায় ঢুকবে না? পাল্টা প্রশ্ন করল শান্তা।
ব্যাপারটা এমনিতেই জটিল, তুই সেটাকে আরও শতগুণ জটিল করে তুলছিস! রেগে যাচ্ছে ঝর্ণা।
এ নিয়ে আমি তোমার সঙ্গে আর কোন কথা বলতে চাই না, লল শান্তা। তুমি চলে যাও।
শোন, শান্তা, একটু সুস্থভাবে চিন্তা কর। আমিই ঝর্ণা। শোন, তোকে আমি পুরো গল্পটা শোনাই, বুঝতে তোর সুবিধে বে। এর আগে আমার একবার বিয়ে হয়েছিল। তাকে আমি ভালবেসে বিয়ে করেছিলাম, বিবাহিত জীবনে অত্যন্ত সুখীও ছিলাম আমরা। তারপর আমার স্বামী দিঘায় বেড়াতে গিয়ে সাগরে ডুবে মারা যায়। কয়েকদিন তার কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি, তারপর যখন লাশটা ভেসে এল তখন তাকে চেনার উপায় ছিল না। অন্তত আমি চিনতে পারিনি। তবে কোলকাতায় তাকে যারা চিনত, তাদের চোখে অনেক মিল ধরা পড়ে। সে-সময় আমি অত্যন্ত অসুস্থ ছিলাম, ওদের কথায় মেনে নিই আশরাফ মারা গেছে। সুস্থ হতে অনেকদিন লেগে যায় আমার। তারপর ঢাকায় ফিরে আসি। তারও কিছুদিন পর তোর হাসান ভাই তার লেখা একটা টিভি নাটকে অভিনয় করার অনুরোধ করে আমাকে। অভিনয় খুব খারাপ করিনি, তবে শু্যটিং করতে গিয়ে আবার আমি অসুস্থ হয়ে পড়ি-স্নায়ুর রোগ, ডাক্তাররা বললেন। ইতিমধ্যে তোর হাসান ভাই আমার প্রেমে পড়ে গেছে। সে আমাকে বিয়ে করার জন্যে অস্থির হয়ে উঠল। আমি রাজি হলাম শুধু একটা কারণে, তাকে আমার অসম্ভব ভাল লেগে গিয়েছিল। যদিও আবার বিয়ে করে সুখী হতে পারব কিনা সেসন্দেহ আমার মনে ছিল। সন্দেহ ছিল, কারণ নিজেকে তো চিনি-আশরাফকে তখনও আমি ভুলতে পারিনি। তবে বিয়ের পর দেখা গেল হাসান আমাকে অসম্ভব সুখে রেখেছে। কিন্তু সে সুখ আমার সইল না। নতুন করে আশরাফ একটা অবসেসন হয়ে উঠল আমার জন্যে। আর তারপরই শুনতে পেলাম, আশরাফ বেঁচে আছে। বলতে পারিস, প্রায় উন্মাদ হয়ে গেলাম আমি। ভেবে দেখ, আশরাফ বেঁচে থাকলে তোর হাসান ভাইয়ের সঙ্গে আমার বিয়েটা বৈধ থাকে না, থাকে কি? এই নিয়ে তোর হাসান ভাইয়ের সঙ্গে শুরু হলো ঝগড়া-ঝাটি। হাসান চাইল, আশরাফের কথা আমি ভুলে যাই, কিন্তু আমার পক্ষে তা সম্ভব ছিল না। আমার প্রথম স্বামী, যাকে আমি ভালবাসতাম, সে যদি বেঁচে থাকে, তাহলে হাসানের সঙ্গে কিভাবে আমি ঘর করি, বল? এরপর সে আমার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার শুরু করল। সেজন্যে দায়ী অবশ্য নিজেকেই করি আমি। যাই হোক, শেষ পর্যন্ত তাকে ছেড়ে ঢাকায় চলে গেলাম আমি, বলে গেলাম আর কোন দিন ফিরব না…।
ঝর্ণা আপা ময়মনসিংহ ছেড়ে কোথাও যায়নি, জেদের সুরে বলল-শান্তা। কেউ তাকে যেতে দেখেনি।
তার কারণ, ট্রেন ধরব বলে আমি একাই রওনা হয়েছিলাম বাড়ি থেকে, বলল ঝর্ণা। তোর ভাই আমাকে রাস্তা থেকে গাড়িতে তুলে নেয়। মাঠের ওপর দিয়ে হেঁটে গেছি অনেকটা পথ, তাই প্রতিবেশীরা কেউ আমাকে দেখেনি।
গল্প তোমরা দেখছি ভালই বানিয়েছ, হিস হিস করে উঠল শান্তা।
দেখ শান্তা, যথেষ্ট হয়েছে, এবার সুস্থ মানুষের মত কথা বল…।
এ-সব কথা বলার জন্যে হাসান ভাই তোমাকে শিখিয়ে দিয়েছে। ঝর্ণা আপা খুন হয়ে গেছে, এটা জানাজানি হয়ে গেলে ফাসি হয়ে যাবে তাঁর। সেজন্যেই তাঁকে প্রমাণ করতে হবে যে ঝর্ণা আপা মরেনি। হাসান ভাইকে আমি তো বলেইছি, তার সঙ্গে আমি বেঈমানী করব না…অন্তত চেষ্টা করব তাঁর যেন কোন বিপদ না হয়, যদিও মাঝে মধ্যে এত বেশি জটিল লাগে সব কিছু, এত বেশি দিশেহারা বোধ করি, কি বলছি নিজেও ভাল বুঝি না। হাসান ভাইকে যে ঝর্ণা আপা ডিভোর্স দেবে, সেই ঝর্ণা আপা এখানে বসে আমার সঙ্গে নরম সুরে কথা বলবে, এ কোনদিন হয়? তার তো আমার ওপর ঘৃণা আর আক্রোশই শুধু হবার কথা। অবশ্য, তোমার কথা মত, হাসান ভাই কোনদিনই ঝর্ণা আপার স্বামী ছিলেন না।
না, হাসান আমার স্বামী ছিল, এখনও আছে। আমার প্রথম স্বামী মারা গেছে। তবে এখন যে আমাদের ছাড়াছাড়ি হয়ে যাচ্ছে, সেজন্যে ওকে আমি দোষ দিই না। লেখকরা একটু উদ্ভট টাইপের তো হয়ই, আমি ওকে বিদঘুটে একটা এক্সপেরিমেন্ট করার সুযোেগ করে দিই। সেজন্যেই তোর আজ এই অবস্থা। তবে সমাধানও আছে। তোর হাসান ভাইকে আমি ডিভোর্স দেয়ার পর তোদের ব্যাপারটা তোরা যা ভাল বুঝবি করবি।
তোমার কিছু কিছু কথা হয়তো সত্যি, অনেকক্ষণ চুপ করে থাকার পর বলল শান্তা। বাকি সব তোমার বানানো।
তোর সঙ্গে সময় নষ্ট করে লাভ নেই। আমি যাই, চিন্তা করে দেখি কি করা যায়। তুই তোর হাসান ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করতে চাইলি না কেন?
করার কাজ একটাই আছে তোমার,বলল শান্তা। এখুনি তুমি ময়মনসিংহ ছেড়ে চলে যাও। কখন আমার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যাবে বলতে পারি না, সব কথা ফাঁস করে দিতে পারি। ঝর্ণা আপার লাশ কোথাও না কোথাও লুকিয়ে রাখা হয়েছে। এতদিন ব্যাপারটাকে অত গুরুত্ব দিইনি, কিন্তু এখন মনে হচ্ছে সে আমার বোেন, তার সঙ্গে আমার রক্তের সম্পর্ক…আমার এভাবে চুপ করে থাকা উচিত হচ্ছে না। হাসান ভাইয়ের সঙ্গে কেন দেখা করতে চাইনি? তা আমি তোমাকে কেন বলতে যাব!
তোকে আসলে ধরে মার লাগানো দরকার, রেগে গিয়ে বলল, ঝর্ণা। বারবার বলছি আমিই ঝর্ণা।
তাহলে ব্যাণ্ডেজ খোললা, চেহারা দেখাও, চ্যালেঞ্জ করল শান্তা।
ঝর্ণার কপাল আর চোখের চারপাশ থেকে রক্ত নেমে গেল। তা সম্ভব নয়, বিড়বিড় করে বলল সে।
সর্বনাশ, কি বলছ! শুনে আঁতকে উঠল হাসান। তারমানে কি মেয়েটাকে আমি পাগল বানিয়ে ছেড়েছি?
নিজেদের বৈঠকখানায়, সোফার এক কোণে, ভঁজ করা পা তুলে কুণ্ডলী পাকিয়ে বসেছে ঝর্ণা, এটা তার প্রিয়.রসার ভঙ্গি। হাসছে সে বলল, এত চিন্তার কিছু নেই। আমি যে ঝর্ণা, এটা প্রমাণ করার অনেক উপায় আছে। আমার পায়ে কাটা দাগ আছে। ডেন্টিস্টকে ডেকে সাক্ষ্য দিতে বলা যায়।
চিন্তা করতে নিষেধ করছ…কিন্তু আমি নিজের কথা ভাবছি, ভাবছি শান্তার কথা।
ও সম্পূর্ণ সুস্থ, শুধু একটা ভুল ধারণা ঝেড়ে ফেলতে পারছে না। আমার মনে হয়, সাইফুলকে ডেকে সব কথা বলা দরকার, সে হয়তো শান্তার এই ভুল ধারণা ভাঙতে পারবে।
তাকে এর মধ্যে জড়াবার দরকার কি!
কারণ সাইফুলকে ভাল জানে শান্তা। শান্তার পাণিপ্রার্থীও বটে সে।
সে পরে দেখা যাবে। তবে তাকে তোমার পাণিপ্রার্থী বলা উচিত হচ্ছে না।
তুমিই তো বলেছ।
বলেছিলাম শান্তার সঙ্গে ঠাট্টা করার জন্যে।
তোমার ঠাট্টাগুলো দেখা যাচ্ছে বারবার শুধু সীমা ছাড়ায়, কষ্ট দেয় মানুষকে।
আমাকে এভাবে খোচা না দিয়ে পারো না? স্নান গলায় বলল হাসান।
ব্রাউনিং কি বলে গেছেন ভুলে গেছ? ইটস অ ডেঞ্জারাস থিং টু প্লে উইথ সোলস, মন্তব্য করল ঝর্ণা।
আমি কি তাই করেছি? কাতর কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল হাসান।
নিজেকে প্রশ্ন করো। তবে বুঝি, আমিও সে দায়িত্ব এড়াতে পারি না। এ-ব্যাপারে আমরা অংশীদার, অন্য ব্যাপারে অংশীদারিত্ব ছিন্ন করলেও।
ঠিক আছে, সাইফুলের সঙ্গে কথা বলা যাক। কিন্তু সে-ও যদি শান্তার ভুল ভাঙতে না পারে, তখন কি হবে?
আমি তো যে-কোন সময় শান্তার ভুল ভেঙে দিতে পারি, ব্যাণ্ডেজটা খুলে, বলল ঝর্ণা। কিন্তু এখন ব্যাণ্ডেজ খুললে দাগগুলো চিরকাল থেকে যাবে মুখে। কাল ডাক্তার তরফদারের সঙ্গে কথা বলেছি, তিনিও তাই বললেন।
মাথা নাড়ল হাসান। তোমার এত সুন্দর চেহারা…না, অসম্ভব! তা আমি তোমাকে করতে দেব না।
তুমি দাও বা না দাও, কাজটা আমি করতে পারি। শান্তার স্বার্থে। ওর এই মানসিক কষ্ট আমার সহ্য হচ্ছে না।
এ তো দেখছি সাংঘাতিক একটা পরিস্থিতি! একবারও মনে হয়নি, শান্তার কোন ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে! বুঝতে পারলে এ-সব আমি করতে যাই! ঝর্ণা, আমার কেন যেন মনে হচ্ছে শান্তার সঙ্গে আমার একবার দেখা হওয়া দরকার। আমি হয়তো তার ভুল ভাঙাতে পারব।
যাও তাহলে, চেষ্টা করে দেখো, একটা দীর্ঘশ্বাস চেপে বলল ঝর্ণা।
তুমি আমার সঙ্গে দেখা করতে চাওনি কেন? উদ্বিগ্ন হাসানের প্রথম প্রশ্ন।
শান্তা বলল, আপনার সঙ্গে ওই মেয়েলোকটা ছিল, তাই। আপনি সব সময় একা আসবেন।
শান্তার সঙ্গে দেখা করার সুযোগ হলো হাসানের পরদিন। ঝর্ণাকে দেখে ভয় পেয়েছিল শান্তা, তার ওপর একটা আক্রোশ অনুভব করছিল, তবে হাসানকে দেখে খুশিই হলো সে। কিন্তু খুশি হলে কি হবে, হাসানের যুক্তিও সে কানে তুলল না।
হাসান ভাই, এখনও আপনি আমাকে বোকা বানাতে চেষ্টা করবেন! শান্তার বলার, সুরে অভিমান উথলে উঠল। এখনও বোধহয় সময় আছে, আপনি সত্যি কথাটা বললে আমি সুস্থ হয়ে উঠতে পারি। অপরাধ যত বড়ই হোক, আপনাকে আমি ক্ষমা করতে পারব। আমাকে না আপনি ভালবাসেন? একবার বিশ্বাস করে দেখুনই না। মাঝে মধ্যে মাথার ভেতরটা কেমন যেন করতে থাকে, মনে হয় চিৎকার করি। ভয় হয়, চিৎকারটা শুরু হলে তা আর থামাতে পারব না।
প্লীজ, লক্ষ্মীসোনা, ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করো। গোটা ব্যাপারটাই তোমার কল্পনা। ঝর্ণা বেঁচে আছে। আমি কখনোই তার কোন ক্ষতি করিনি। আমাদের মধ্যে তুমুল একটা ঝগড়া হয়েছিল, আমি হুঁশ-জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলাম…সেদিনই প্রথম আমি তোমার আপার গায়ে হাত তুলি। এটা সে আমার কাছ থেকে একেবারেই আশা করেনি। মার খেয়ে প্রচণ্ড অপমানবোধ করে সে। সেজন্যেই আমাকে ক্ষমা করতে পারেনি, আমাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিল…।
শব্দ করে দীর্ঘশ্বাস ফেলল শান্তা, এমন সুরে শুরু করল, হাসানের কথা যেন সে শুনতেই পায়নি, যদি জানতাম ঝর্ণা আপা কোথায় আছে, তাকে নিয়ে কি করেছেন আপনি, আবার আমি শান্তিতে ঘুমাতে পারতাম। ঘুম আসে, কিন্তু দুঃস্বপ্ন আমাকে জাগিয়ে দেয়। দেখি ঝর্ণা আপা চিৎকার করে আমাকে ডাকছে। মাঝে মধ্যে তাকে আমি নদী বা কুয়োর তলায় পড়ে থাকতে দেখি, মারা গেছে।
শান্তা, আল্লার কিরে বলছি…।
না, কিরে-কসম খাবেন না। আপনি যা-ই বলুন, আপনার কথা আমি বিশ্বাস করব না।
যদি বলি, ঠিক আছে, যাও, পুলিশকে গিয়ে সব কথা বলো তুমি—তাহলেও বিশ্বাস করবে না? তোমার যা খুশি তাই করতে পারো, শান্তা, আমার তাতে কোনই ক্ষতি হবে না।
নিজের বিপদ সম্পর্কে কখনোই আপনাকে আমি ভয় পেতে দেখিনি। সব সময় ভেবে এসেছেন, পুলিশকে বোকা বানানো আপনার পক্ষে পানির মত সহজ। তার কারণটাও স্পষ্ট। আপনি জানেন, এমন জায়গাতেই লুকিয়ে রেখেছেন যে ঝর্ণা আপার লাশ কেউ কোনদিন খুঁজে পাবে না।
তোমাকে নিয়ে দেখছি বিপদেই পড়া গেল। আরে বোকা, পুলিশ যদি চায়…।
হাসান ভাই, আপনি এখনও আমাকে নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করছেন। আপনাকে ইতিমধ্যে খুব চিনে ফেলেছি আমি, তবু ব্যাপারটা আমাকে অবাক করছে। কারণ উপন্যাসটা তো শেষ হয়ে গেছে, হতভাগিনী তমাকে আপনি শেষ পর্যন্ত অনুগতই দেখিয়েছেন—যদিও নিজেকে অনুগত প্রমাণ করার জন্যে আত্মহত্যা করতে হলো বেচারিকে। নিশ্চয়ই আপনি চান না যে তার মত আমিও ওই কাজ করি? ভবিষ্যতে আপনার অপরাধের কথা যাতে ফাঁস করে না দিই?
এবার রেগে গেল হাসান। এই প্রথম এমন একটা অনুভূতি হলো তার, প্রায় হতাশাই বলা চলে। শান্তা, উপন্যাসের কথা ভুলে যাও, ভুলে যাও তমার কথা। এটা বাস্তব দুনিয়া। আমি তোমাকে ভালবাসি, তোমাকে সুখী করতে চাই। ঝর্ণার সঙ্গে আমার ছাড়াছাড়ি হয়ে যাবে, তারপর আমরা বিয়ে করতে পারব। এখন বলল, তুমি কি এখন আর আমাকে আগের মত মায়া করো না?
কি জানি, বুঝতে পারি না…প্রশ্নটা নিজেকেও তো বারবার করছি, কিন্তু কোন উত্তর পাই না।
তবে আমি জানি তুমি আমাকে ভালবাস, বলল হাসান। তুমি আমার জীবনে একটা প্রেরণা হয়ে দেখা দিয়েছ। আনি এ-ও জানি যে আমার যে-কোন বিপদে আর কাউকে না পেলেও তোমাকে আমি ঠিকই পাশে পাব।
হ্যাঁ, পাবেন, যদি আপনি আমাকে বিশ্বাস করেন।
কেন ভাবছ তোমাকে আমি বিশ্বাস করি না? তোমার মত বিশ্বাস আর কাউকে আমি করি না।
না, যা কিছু করেছেন সব নিজের বুদ্ধিতে করেছেন আপনি, আমাকে কিছু জানাননি। করার পর সব কথা লুকিয়ে রেখেছেন নিজের ভেতর। আপনার বুদ্ধি আর শক্তি এত বেশি, একা শুধু নিজের ওপর আস্থা রাখেন। শান্তার বুক ঠেলে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল। চোখ বুজল সে। হাসান ভাই, আমি খুব ক্লান্ত। এত ক্লান্ত যে বলার নয়। আপনি বরং এখন যান।
সাইফুল বলল, দেখো শান্তা, বুঝতে পারছি যে তুমি ঠিক সুস্থবোধ করছ না, কিন্তু তোমার সঙ্গে আমার কথা হওয়াটা খুব জরুরী। এসো, স্পষ্ট করে, সরাসরি আলোচনা করি, কেমন?
এত ভূমিকারও দরকার নেই, আর এত আড়ষ্ট বোধ করারও প্রয়োজন নেই, বলল শান্তা। নিজেকে আমি সামলে নিয়েছি, এখন আমি পুরোপুরি সুস্থ।
তাহলে তো খুব ভাল। শোনো, এইমাত্র তোমার হাসান ভাইয়ের সঙ্গে কথা হয়েছে আমার। তিনি আমাকে সব কথাই বলেছেন।
তা সম্ভব নয়, জবাব দিল শান্তা। হাসান ভাই ওই মেয়েটাকে ঝর্ণা আপা বলে চালাবার চেষ্টা করছেন, তাই না? হেসে উঠল সে।
মুখ শুকিয়ে গেল সাইফুলের। কিন্তু শান্তা, উনি তো তোমার ঝর্ণা আপাই!
কি করে বুঝলেন আপনি? ঝর্ণা আপাকে আপনি তো ভাল করে চিনবেনই না।
যে-কোন মানুষের পরিচয় অনেক ভাবে প্রমাণ করা যায় শান্তা। তোমার ঝর্ণা আপার সঙ্গেও কাল কথা হয়েছে আমার। তিনি প্রমাণ করতে রাজি আছেন।
ওরা খুব চালাক-দুজনেই। চিন্তা-ভাবনা করে নিশ্চয়ই কিছু বুদ্ধি বের করেছে।
কি আশ্চর্য! কেন তোমার মনে হচ্ছে ভদ্রলোক খুনী?
আমি…আমি কি তা-ই বলেছি? শান্তার মুখে কথা বেঁধে গেল,
চেহারায় হতভম্ব ভাব। – না বললে কি হবে, অর্থটা তো তাই দাঁড়ায়। অন্য এক মহিলাকে নিজের স্ত্রী বলে চালাবার চেষ্টা তিনি কখন করবেন? যখন তোমার ঝর্ণা আপাকে হাজির করতে পারবেন না, যখন তিনি জানেন তাঁর স্ত্রী মারা গেছেন।
হ্যাঁ, কোন সন্দেহ নেই, ঝর্ণা আপা মারা গেছে। নিজের কপালে হাত বুলাল শান্তা, যেন চিন্তা করতে কষ্ট হচ্ছে তার। আমি হাসান ভাইয়ের অপরাধের কথা ফাঁস করতে চাইনি, সাইফুল ভাই। আমি তার সঙ্গে বেঈমানী করব না বলে কথা দিয়েছি। তবে আপনাকে বলায় কোন ক্ষতি হয়নি। আমি জানি, আপনি কাউকে বিলবেন না।
তুমি ভুল জানো, শান্তা। তোমার হাসান ভাইয়ের ওপর আমার কোন সহানুভূতি নেই। তিনি আমাকে চ্যালেঞ্জ করেছেন, বলেছেন তোমাকে নাকি আমি তার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিতে পারব না। কেউ যদি মিথ্যে অপবাদের শিকার হয় তাহলে আলাদা কথা, অবশ্যই আমি তার পাশে দাঁড়াব। কিন্তু কেউ যদি খুনী হয় তাকে আমি জেল খাটিয়ে ছাড়ব, মনে রেখো।
সাইফুল ভাই, না! চিৎকার করে উঠল শান্তা।
তুমি কি তাকে ভালবাসো, শান্তা? ভয় পেয়োনা বা সংকোচ করো না, সত্যি কথা বলো। আমার কাছে তুমি কোনভাবে ঋণী নও। আমাকে তুমি কোন প্রতিশ্রুতি দাওনি। যা সত্যি তাই বলো। বাসো?
অন্য প্রসঙ্গে বলতে শুরু করল শান্তা, তমা, হাসান ভাইয়ের উপন্যাসের নায়িকা, মামুনকে ভালবাসত। হাসান ভাই তমাকে আমার মত করে দেখাতে চেয়েছেন। কিন্তু বইটার শেষ দিকটায় তমার আচরণ আমার ভাল লাগেনি। আমি তার মত নই, কোন দিন তার মত হব না। সে একটা বোকা মেয়ে..গায়ে আগুন দিয়ে আত্মহত্যা করল। শুধু বাস্তবের মুখোমুখি হতে পারবে না ভেবে। আমি তার মত দুর্বল নই, আমার সাহস আরও অনেক বেশি। আমি ঠাণ্ডা মাথায় সব চিন্তা করতে পারছি, আমার মরারও কোন ইচ্ছে। নেই।
তোমার এত কথার মানে কি এই যে খুনী বলে মনে করা সত্ত্বেও হাসান সাহেবকে তুমি ভালবাসো?
খুনটা হাসান ভাই ইচ্ছা করে করেননি। আমি জানি, ব্যাপারটা স্রেফ দুর্ঘটনা ছিল। যা ঘটে গেছে তার জন্যে আমি তাকে দায়ী করি না, সাইফুল ভাই। শুধু দুঃখ এই যে তিনি আমাকে বিশ্বাস করতে পারছেন না। আর সবাইকে বোকা বানাচ্ছেন বানান, কিন্তু আমাকে কেন বোকা বানাতে চাইবেন!.
এ তোমার এক ধরনের অশুভ গর্ব, অন্যায় অহংকার, কঠিন সুরে বলল সাইফুল।
চোখ মিট মিট করে তার দিকে তাকিয়ে থাকল শান্তা, ভাব দেখে মনে হলো দিশেহারা বোধ করছে সে।
কিংবা হয়তো তুমি সাংঘাতিক ভীতু, আরও নির্দয় হলো সাইফুল। একটা কাউয়ার্ড।
পরম স্বস্তির সঙ্গে সে লক্ষ করল, রাগে জ্বলে উঠল শান্তার চোখ দুটো। কিসের জন্যে আপনি আমার সঙ্গে এভাবে কথা বলছেন? কি করেছি আমি?
শান্তা রেগে যাওয়ায় মনে মনে খুশি হলো সাইফুল। তার জানা আছে রাগ হলো সুস্থ মানুষের স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া। বলা যায় শক ট্রিটমেন্ট-এর আশ্রয় নিচ্ছে সে, কল্পনার জগৎ থেকে শান্তাকে বাস্তব জগতে ফিরিয়ে আনার জন্যে। কি করেছ শুনবে? তুমি আসলে নিজের বিবেককে ফাঁকি দেয়ার চেষ্টা করছ। বিবাহিত এক লোকের সঙ্গে জড়িয়ে ফেলেছ নিজেকে, এটা তুমি দুর্বল সুরে স্বীকার করছ। তারপর, এখন চেষ্টা করছ একটা অজুহাত খাড়া করতে। কারণ আরেক মহিলার স্বামীকে ফাদে ফেলে ভাগিয়ে আনছ, এটা ভাবতে পারছ না। সেজন্যেই, নিজের বিবেকের কাছে পরিষ্কার থাকার জন্যে, নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে বিশ্বাস করতে চাইছ যে তোমার ঝর্ণা আপা মারা গেছেন। তোমার অহংকারেও আঘাত লেগেছে, কারণ তোমার ধারণা ওই ভদ্রলোক তোমাকে পুরোপরি ভালবাসেন না যেটুকু ভালবাসেন তা-ও তোমাকে উপন্যাসের ওই মেয়েটার মডেল মনে করে। ভদ্রলোককে তো ভাল বলিই না, তোমাকেও ভাল বলার মত তেমন কিছু দেখছি না।
শান্তার চোখে পানি এসে গেল। আপনি যে এত নিষ্ঠুর হতে পারেন আমার জানা ছিল না!
কারণ আমি তোমাকে একটা বিবর থেকে বের করে আনতে চাইছি। সত্যের মুখোমুখি হও, শান্তা। তোমার হাসান ভাই প্রথম থেকেই জানতেন যে তার স্ত্রী বেঁচে আছেন, অন্তত তিনি তার কোন ক্ষতি করেননি। প্রতিবেশীরা তাঁকে রাগিয়ে দেয়ায়, তার মনে লেখক সুলভ শয়তানি কাজ করায়, স্ত্রীকে খুঁজে বের করার কোন চেষ্টা তিনি করেননি। বরং প্রতিবেশী আর পুলিশকে আরও সন্দিহান করে তুলেছেন। আবার একই সঙ্গে তোমাকে বুঝতে দিয়েছেন যে গুরুতর কোন অপরাধ ঢাকা দেয়ার চেষ্টা করছেন তিনি। প্রথম দিকে তুমি বুঝতে পারোনি ঠিক কি বিশ্বাস করা উচিত। আমার ধারণা, তাঁর চরিত্রে কিছু গুণ আছে, কিছু জাদু আছে, সেগুলোর সাহায্যে উনি তোমাকে সম্মােহিত করে ফেলেন। একথা ঠিক যে ওদের দুজনের মধ্যে ছাড়াছাড়ি হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু তুমি কি করবে সেটা তোমার ব্যাপার। ভুলে যেয়ো না ঝর্ণা আপা তোমার খালাতো বোন, তার ডিভোর্স করা স্বামীর সঙ্গে তোমার মা তোমার বিয়েতে রাজি হবে কিনা সেটাও ভেবে দেখতে হবে। তবে তুমি সাবালিকা, কারও বাধা তুমি না শুনলেও পারো।
কিন্তু উনি…কিন্তু আমি…আপনি নিশ্চয়ই ভাবছেন না যে কাজটা আমরা অন্যায় করেছি?
হেসে উঠল সাইফুল। কেন আমি তা ভাবতে যাব। কেউ তা ভাববে না। আমরা সভ্য মানুষ, শান্তা, যুগটা আধুনিক। যে-কেউ যে-কাউকে ভালবাসতে পারে, সেটাকে অন্যায় বলে মনে করার দিন এখন কি আর আছে! তোমার ঝর্ণা আপা ডিভোর্স দিলেই হাসান সাহেবকে বিয়ে করতে পারো তুমি।
আবার সেই পুরানো প্রসঙ্গে ফিরে এল শান্তা, ওই মেয়েলোকটা ঝর্ণা আপা নয়।
ভেজানো দরজা খুলে ভেতরে ঢুকল ঝর্ণা, থমথম করছে তার চেহারা। তুমি ভাই যথেষ্ট করেছ, কিন্তু পাজি মেয়েটা কারও কথা শুনবে না। তুমি বাইরে যাও, আমি একবার শেষ চেষ্টা করে দেখি।
মাথা নিচু করে কামরা থেকে বেরিয়ে গেল সাইফুল। সে চলে যেতে ঝর্ণা বলল, স্কুলে খবর পাঠিয়েছি, খালাম্মা আসছেন। তিনি যদি আমাকে ঝর্ণা বলে মেনে নেন, তখন তুই কি বলবি? মাথা নাড়ল শান্তা। আমি জানি তুমি ঝর্ণা নও।
তোর সঙ্গে দেখছি খোদা নেমে এলেও পারবে না। হাল ছেড়ে দেয়ার সুরে বলল ঝর্ণা। আমি আর কি করতে পারি!
অন্তত একটা কাজ করতে পারো। মুখের ব্যাণ্ডেজ খুলে ফেলো।
শান্তার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকল ঝর্ণা। কিছুক্ষণ পর বলল, ব্যাণ্ডেজ খুললেই বা কি, ওটার ভেতর স্ট্র্যাপ ছাড়াও আরও কি সব যেন আছে। সব যদি খুলতে হয় দাগগুলো চিরকালের জন্যে থেকে যাবে আমার মুখে। তুই কি তাই চাস?
শান্তা বলল, তুমি সত্যি ঝর্ণা আপা হলে চাইতাম না।
হাতের মুঠো খুলে দেখাল ঝর্ণা। কি এনেছি দেখ। তার হাতের মুঠোয় ছোট্ট একটা কঁচি দেখা গেল। জানি আমার চেহারা না দেখা পর্যন্ত বিশ্বাস করবি না তুই, তাই তৈরি হয়েই এসেছি। ব্যাণ্ডেজটা খুললে আমার সাংঘাতিক একটা ক্ষতি হয়ে যাবে, কিন্তু তোর ভুল না ভাঙলে ক্ষতিটা হবে আরও অনেক বড়। কথা বলার মধ্যেই কাঁচি দিয়ে কেটে ব্যাণ্ডেজের প্যাচ খুলতে শুরু করেছে সে।
সেদিকে অপলক তাকিয়ে রয়েছে শান্তা, ঠোঁটের কোণে বাঁকা হাসির রেখা।
খুব ব্যথা পাব রে, শান্ত সুরে বলল ঝর্ণা। বিশেষ করে স্ট্র্যাপগুলো খোলার সময় জান বেরিয়ে যাবে। ক্লিনিকে বা হাসপাতালে সম্ভবত ব্যথামুক্ত কোন পদ্ধতি আছে। তার কপালের একটা পাশে শুধু ব্যাণ্ডেজ নেই। কপালটাই তোকে আগে দেখাই। সবচেয়ে বেশি আঘাত পেয়েছি ডানদিকের গালে, ওদিকের স্ট্র্যাপ খুলতে হলে আমি বোধহয় অজ্ঞান হয়ে যাব। কপাল থেকে ছাড়িয়ে নেয়া ব্যাণ্ডেজ তার কাঁধে স্থূপ হয়ে উঠছে। ব্যথায় কুঁচকে উঠল চেহারা, উহ-আহ করছে। ব্যাণ্ডেজ খোলার পর টান দিয়ে কপাল থেকে তুলে ফেলল প্লাস্টার, তারপর ভুরুর ওপর থেকে। ঝর্ণার কপালটা চওড়া। কপালের ওপরে চুলের যে রেখা, সেই রেখার ঠিক মাঝখানটা ছোট্ট গুলতি আকৃতির। তারপর ভুরু থেকে প্লাস্টার তোলা হলো। জোড়া ভুরু তার। তার এই ভুরুর সৌন্দর্য নিয়ে এক সময় কত আলোচনা করেছে শান্তা।
হঠাৎ সে আর্ত কণ্ঠে চেঁচিয়ে উঠল, না! ঝর্ণা আপা, না!
দাঁতে দাঁত চেপে রয়েছে ঝর্ণা, ব্যথায় কথা বলতে কষ্ট হলো, শুরু যখন করেছি, সবটাই দেখ তুই…।
না! আঁতকে উঠে ঝর্ণার হাতটা খপ করে চেপে ধরল শান্তা। আমি একটা শয়তান মেয়ে, আমার মাথায় ভূত চেপেছিল… আমাকে মারো তুমি…! ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল, ঝাঁপিয়ে পড়ল ঝর্ণার বুকে।
ফোঁপানোর মত শব্দ করে দুজন একসঙ্গে নিঃশ্বাস ফেলছে ওরা। ঠাণ্ডা সুরে, যদিও শান্তাকে বাঁ হাতে জড়িয়ে ধরে রেখেছে, জিজ্ঞেস করল ঝর্ণা, এখন তুই বিশ্বাস করিস তো?
আপা, আমার মুখটা তুমি খামচে দিচ্ছ না কেন? টেনে ছিড়ে ফেলছ না কেন আমার চুল? বিশ্বাস করি…আপা, এখন আমার মনে হচ্ছে অনেক আগে থেকেই আমি জানতাম যে তুমিই…।
তোর মনের একটা অংশ জানত, নরম সুরে বলল ঝর্ণা। শোন, অস্থির হবি না। আসলে কারুরই কোন ক্ষতি হয়নি। আমার কথা তুই ভুলে যাস, ভাই। আমি চাই সুখী হতোরা…।
কি বলতে চাইছ? ঝট করে নিজেকে ছাড়িয়ে নিল শান্তা।
আমাদের তো ছাড়াছাড়ি হয়েই যাচ্ছে, বলল ঝর্ণা। তবে, মনে রাখিস, সেজন্যে তুই দায়ী না। দায়ী আমি, হাসানকে সুখী করতে পারিনি। এক অর্থে তোকে সে বিয়ে করলে আমি খুশিই হব রে শান্তা। তুই খুব লক্ষ্মী মেয়ে, বিয়েটা হলে মনে মনে অন্তত এটুকু জেনে সান্ত্বনা পাব যে হাসান ভাল একটা মেয়ের হাতে পড়েছে…।
ঝর্ণার মুখে হাতচাপা দিল শান্তা। ফের যদি এ-কথা মুখে আনো, আমি কিন্তু বিষ খাব।
শোন, শান্তা, হাসাঁন বাইরে দাঁড়িয়ে আছে…।
তুমি শোনো, ঝর্ণা আপা! আমাকে যদি সারাজীবন কুমারীও থাকতে হয়, তবু হাসান ভাইকে বিয়ে করব না। এতদিন তাঁকে আমি ভালও বেসেছি ঘৃণাও করেছি, কিন্তু এখন শুধুই ঘৃণা করি। উনি অত্যন্ত স্বার্থপর মানুষ, এই ঘটনাটাকে পুঁজি করে একদিন হয়তো নাটকীয় একটা উপন্যাস লিখে ফেলবেন। তুমি হয়তো বোঝানি আপা, তার কাছে গোটা ব্যাপারটাই ছিল একটা নিষ্ঠুর এক্সপেরিমেন্ট। এখন আমার আরও মনে হচ্ছে, উনি অত্যন্ত দায়িত্বজ্ঞানহীনও বটে। জেনেশুনে কিভাবে উনি এত বড় ঝুঁকি নিতে দিলেন তোমাকে? এখনও তো তোমাদের ছাড়াছাড়ি হয়নি, তোমার ওপর তার কি এতটুকু মায়া নেই?
না রে, তা নয়, বলল ঝর্ণা। সে আমাকে বাধা দিতে কম করেনি। কিন্তু আমি দেখলাম ভুলটা ভাঙাতে না পারলে তুই হয়তো পাগলই হয়ে যাবি। সত্যি আমার খুব ভয় করছিল। ভাবলাম, আমার চেহারা বড় না বোন বড়।
আমাকে তাঁর মারা উচিত ছিল, চোখ-মুখ লাল করে বলল শান্তা। দুএকটা চড়-চাপড় খেলে ঠিকই আমার চোখ খুলে যেত। গোটা দুনিয়ায় তাঁর মত স্বার্থপর, আত্মকেন্দ্রিক মানুষ আর বোধহয় একটাও নেই। আপা, তুমি তাকে বলে দিয়ো, আমি তার চাকরি ছেড়ে দিয়েছি। তিনি যেন আমার সঙ্গে দেখা না করেন। আর আপা, তুমি আমাকে মাফ করে দিয়ো…।
পাগলামি করিস না তো। চোখে পানি, ঝুকে শান্তাকে চুমো খেলো ঝর্ণা।
সাত দিন আগেই মায়ের সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিয়েছে শান্তা, কুষ্টিয়ায় মামা-মামীর কাছে বেড়াতে যাবে। সম্ভব হলে সেখানে থেকেই আবার পড়াশোনা শুরু করবে সে।
রওনা হবার জন্যে তৈরি হচ্ছে, ফানুনী ইসলাম আরেকবার সাইফুলের প্রসঙ্গটা তুললেন, কাজটা কি ঠিক হচ্ছে, শান্তা? ছেলেটার সঙ্গে একবার অন্তত দেখা করে যাবি না?
না, মা, জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে বিষন্ন সুরে বলল শান্তা। তার কাছে আমার আর কোন মূল্য নেই। এত কিছু ঘটে যাবার পর বলতে পারো তার সামনে কোন মুখ নিয়ে দাঁড়াব আমি? শুধু শুধু তাকে বিব্রত করে কি লাভ!
না, আমি বলতে চাইছি, সে হয়তো কিছু মনে করেনি…।
চলেই যখন যাচ্ছি, নিজেকে আর কোন লোভের ফঁাদে ফেলতে চাই না, মা। আয়েশা বেগমের দিকে তাকাল শান্তা। আন্টি, দেখুন না পাড়ার কোন ছেলে-ছোকরাকে পান কিনা, একটা রিকশা ডেকে আনুক।
আয়েশা বেগম কামরা ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন। ফাল্গনী ইসলাম বললেন, দাঁড়া, কাসুন্দির বয়েমটা তোর সুটকেসে ভরে দিই…, বলতে বলতে তিনিও বেরিয়ে গেলেন। আর ঠিক তখনই আরেক দরজায় দেখা গেল সাইফুলকে।
পরস্পরের দিকে নিঃশব্দে তাকিয়ে থাকল ওরা। তারপর সাইফুলই প্রথম কথা বলল, অনেক দিন পর তোমাকে দেখে ভাল লাগছে। কেমন আছ, শান্তা?
সত্যি কি তাই? মন গলায় বলল শান্তা। কিন্তু গত সাতদিনে একবারও তো আপনাকে এ-বাড়িতে দেখা যায়নি।
আসিনি ভয়ে। আমি এলে তুমি কি খুশি হতে, শান্তা? মনে হচ্ছিল, যে আচরণ তোমার সঙ্গে করেছি, এখানে আসার আমার কোন অধিকার নেই আর। তবে আসিনি বলাটা ভুল হচ্ছে। দুতিন দিন এসেছি, খালাম্মার মুখে শুনে গেছি কেমন আছ তুমি। তোমার সঙ্গে দেখা করিনি ভয়ে…।
মা তো আমাকে কিছু বলেনি!
আমিই বারণ করেছিলাম। মনে হচ্ছিল, তোমাকে বিরক্ত করা ঠিক হবে না। খালাম্মাকে আমি এ-ও বলে গিয়েছিলাম, হাসান সাহেবও যেন তোমাকে বিরক্ত না করেন।
চেষ্টা করেননি তা নয়, তবে আমি তাঁর সঙ্গে দেখা করিনি, বলল শান্তা। তাকে আমি আর কোনদিনই দেখতে চাই না।
এই তো বুদ্ধিমতীর মত কথা বলছ। আমার মন বলছে, ওরা দুজন সম্ভবত পরস্পরের সঙ্গে আবার অ্যাডজাস্ট করে নেবেন। দুজনই ওরা শিক্ষিত মানুষ, পরস্পরকে বোঝেন।
আমিও তাই চাই, বলল শান্তা। সেই ছোটবেলা থেকে ঝর্ণা আপাকে ভালবাসি আমি। তারপর ইদানীং যা ঘটে গেল, তার প্রতি আমি চিরকাল কৃতজ্ঞ থাকব।
শান্তার মুখে চোখ বুলিয়ে হাসল সাইফুল। তার চোখে আজকের মত সুন্দর কখনোই লাগেনি শান্তাকে। আমাকে তুমি বসতে বলবে না? ব্যস্ত হয়ে উঠল শান্তা। ছি-ছি, আমি যে কি! আসুন, সাইফুল ভাই, বসুন…যদিও আয়েশা আন্টি রিকশা আনতে গেছেন…।
কোথাও যাচ্ছ তুমি, শান্তার কাপড়চোপড়ের ওপর চোখ বুলাল সাইফুল।
সাইফুল একটা চেয়ার টেনে বসার পর শান্তা বলল, হ্যাঁ, কুষ্টিয়ায়, মামার ওখানে। ভাবছি ওখানে থেকেই আবার পড়াশোনা শুরু করব।
সত্যি পড়াশোনা শুরু করবে? তাহলে তো খুবই ভাল কথা, বলল সাইফুল। কিন্তু যাবার আগে বলে যাবে না, আমাকে তুমি ক্ষমা করেছ কিনা?
আপনি আমাকে লজ্জা দিচ্ছেন, বলল শান্তা। ক্ষমা চাওয়ার কথা আমার, আপনার নয়। সাইফুলের দিকে তাকাতে পারল না সে।
সেদিন যা বলেছি, আসলে তা আমি বোঝাতে চাইনি, শান্তা। তখন সত্যি তোমার শক ট্রিটমেন্ট দরকার ছিল।
জানি, এখন সব বুঝতে পারি, বলল শান্তা। সাইফুল ভাই, আপনি নিজেকে দায়ী করলে আমার অপরাধের মাত্রা আরও বরং বাড়বে।
কিন্তু তুমি চলে যাচ্ছ কেন? মানে, সত্যি কি তোমার যেতে মন ইছে?
হ্যাঁ। এখানে আমার জন্যে আর কিছু নেই।‘
কথাটা সত্যি নয়, শান্তা।
মানে?
এখানে তোমার জন্যে ভালবাসা আছে, আর তুমি তা জানোও, বলল সাইফুল।
সাইফুলের দিকে যেন অনন্তকাল ধরে তাকিয়ে আছে শান্তা। তারপর সে বলল, তারমানে এখনও আমাকে চান আপনি?
না চাওয়ার কোন কারণ ঘটেছে বলে তো আমার অন্তত জানা নই।
আমি ভেবেছিলাম, ব্যাপারটা শেষ হয়ে গেছে, নিচু গলায় লল শান্তা। মা বলছিল, আপনার সঙ্গে অন্যায় আচরণ করেছি আমি। তাছাড়া, এমনও নয় যে হাসান ভাই আমাকে স্পর্শ করেননি। একবার তিনি আমার হাত ধরে টান দিয়েছিলেন।
আরেকবার তিনি আমার কপালে…আমার কপালে…।
চেয়ার ছেড়ে উঠে এল সাইফুল। এমন বোকা মেয়ে তো জীবনে দেখিনি! চুপ, একদম চুপ! আমি খুব ভাল করেই জানি, তোমার জন্যে গোটা ব্যাপারটাই ছিল একটা দুঃস্বপ্নের মত। তোমার হাসান ভাই কি করেছে, শুনতে আমার ভাল লাগার কথা নয়, কারণ ওই কাজ করা উচিত ছিল আমার। সেটা অবশ্য আমি পুষিয়ে নিতে পারব…, বলে শান্তার একটা হাত ধরে মৃদু টান দিল সাইফুল। কথা দাও, শান্তা, কোথাও তুমি যাবে না?
কিন্তু সাইফুল ভাই…।
আমি একটা সুযোগ চাই, শান্তা। আমাকে প্রমাণ করতে দাও, তোমার মত মেয়েকে একা শুধু আমার মত একটা ছেলে সুখী করতে পারে।
দরজায় আয়েশা বেগমকে দেখা গেল। শান্তা, তোর রিকশা।
সাইফুলের দিকে একদৃষ্টে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর আয়েশা বেগমের দিকে ফিরল শান্তা। আন্টি, মার কাছ থেকে দুটো টাকা নিয়ে রিকশাঅলাকে বিদায় করে দিন। আমি কোথাও যাচ্ছি না।
এতদিন পর সত্যি আজ আমার নার্ভাস লাগছে, বলল ঝর্ণা। ডেসিং খোলর পর যদি দেখা যায় কুৎসিত হয়ে গেছে চেহারাটা?
ডাক্তার সাহেব বলেছেন, ভয় বার কোন কারণ নেই, মনে করিয়ে দিল হাসান।
তা বলেছেন বটে, তবে আশ্বাস দেয়াই তার অভ্যাস। নিশ্চিতভাবে তিনিও কিছু জানেন না।
মানতে পারলাম না। আশ্বাস দেন তিনি সারাজীবনের অভিজ্ঞতা থেকে। তাছাড়া, কোলকাতার সার্জেন ভদ্রলোকের সঙ্গে কথা বলার পর তোমাকে ভরসা দিয়েছেন তিনি।
দেখা যাক, স্নান গলায় বলল ঝর্ণা, টেবিল থেকে তুলে নিল চায়ের কাপটা।
শোনো, ঝর্ণা, বলল হাসান। তোমার ব্যাণ্ডেজ খোলার আগে কথাটা বলতে চাই। আমি চাই না আমাদের ছাড়াছাড়ি হয়ে যাক।
চাও না? চায়ের কাপটা টেবিলে নামিয়ে রাখল ঝর্ণা, তার হাতটা একটু একটু কাঁপছে।
মানে তুমি যদি মুক্তি না চাও আর কি।
আমি তো তা কোনদিন চাইনি, সহজ সুরে বলল ঝর্ণা। এমনকি যখন আমি ভাবতাম আশরাফ বেঁচে আছে কিনা তখনও চাইনি। সন্দেহটা মনে জাগায় আমার শুধু মনে হত তোমার সঙ্গে বিয়েটা ঠিক বৈধ নয়।
তখনও তুমি আমাকে মায়া করতে, আমি জানতাম, স্বীকার করল হাসান। তবে আমি যেমন পাগলের মত ভালবাসতাম, তুমি তেমন বাসতে না। তারপর থেকে আমার ওপর যে-টুকু মায়া তোমার ছিল সে-টুকুও নষ্ট করার জন্যে যা যা দরকার সবই করেছি আমি।
এ তোমার ভুল ধারণা। তুমি যা-ই করে থাকো, তার প্রভাব আমার ও অত প্রবল হয়নি। তোমার আচরণ বরং আমার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে যে আমাকে তোমার দরকার, তোমার দেখাশোনা করার জন্যে। এত কিছু ঘটে যাবার পরও গত কয়েকটা হপ্তা একসঙ্গে খুব ভালই তো কাটল আমাদের সময়। আমার একটা ভয় ছিল। শান্তার বিয়ে হয়ে গেছে শুনে তোমার না আবার কি প্রতিক্রিয়া হয়। অন্য কিছু ভেব না, আমার ভয় হচ্ছিল তুমি না আবার ভেবে বসো সাইফুল শান্তাকে সুখী করতে পারবে না। কিন্তু দেখলাম, তুমি খুব শান্তভাবেই ব্যাপারটা মেনে নিলে।
খবরটা পেয়ে আসলে অসম্ভব হালকা লাগছিল নিজেকে, মনে হলো কঠিন একটা সমস্যা আপনাআপনি সমাধান হয়ে গেছে। বিয়েটা প্রমাণ করল, শান্তার সত্যি কোন ক্ষতি আমার দ্বারা হয়নি,
আমি ওর জীবনটা নষ্ট করে দিইনি।
তোমাকে বলা হয়নি, ওদের বিয়েতে আমি গিয়েছিলাম, বলল ঝর্ণা। আমার কাছে টাকা ছিল না, তোমার কাছ থেকে চাইতেও সংকোচ হচ্ছিল, তাই…তাই আমি আমার একটা চেইন প্রেজেন্ট করেছি ওকে। তুমি কিছু মনে করলে? ওটা গত বছর তুমি আমাকে কিনে দিয়েছিলে..।
কিছুই মনে করিনি। ঝর্ণার একটা হাত ধরল হাসান। তবে এসো, আপাতত ওদের কথা ভুলে যাই আমরা। ঝর্ণা, তুমি ভাল করেই জানো আমি কি বলতে চাইছি। আমি বলতে চাইছি, দেখতে তুমি কুৎসিত হলেও আমার কিছু আসে যায় না। যদিও তোমার কথা চিন্তা করে আমি চাই, আগের চেহারা যেন ফিরে পাও তুমি। আমার আসলে তোমাকে দরকার, তোমার চেহারাটা নয়। জানি আমার বোকামির কোন শেষ নেই, তবে কথা দিচ্ছি এখন থেকে সাবধান হব। তুমি কি থাকবে আমার সঙ্গে?
আমি তো তোমার সঙ্গেই আছি, হাসান। জিজ্ঞেস করো, চলে যাব কিনা?
মুহূর্তের জন্যে হলেও হকচকিয়ে গেল হাসান, তারপর হাসল সে, জিজ্ঞেস করল, তুমি কি আমাকে ছেড়ে চলে যেতে চাও, ঝর্ণা?
কোথায় যাব গো? তুমি ছাড়া কে আছে আমার?
আর কাজী মহসীন অভিনয় করার যে প্রস্তাবটা দিয়েছে। তোমাকে, তার কি হবে?
তুমি যদি না চাও, করব না। সত্যি কথা বলতে কি, ঢাকা ছেড়ে কোথাও আমার যেতে ইচ্ছে করে না। মানে বলতে চাইছি কোলকাতায়ও যেতে ইচ্ছে করে না, এখানেও থাকতে ইচ্ছে করে না। বিশেষ করে এই জায়গাটার ওপর থেকে মন আমার একেবারেই উঠে গেছে।
আমারও.। আমরা তাহলে ঢাকাতেই থাকব, কি বলো? শোনো, সত্যি আমি চাই আবার তুমি অভিনয় করো। তবে নিজের দেশে সুযোগ থাকতে বিদেশে কেন? আর পুরোপুরি পেশাদার হয়ে যাও, এও আমি চাইব না। ভাল লাগলে করবে। আসলে সুখী একটা সংসার দরকার আমাদের, আর বাড়িতে বাচ্চাকাচ্চা না থাকলে সুখ জিনিসটা পরিপূর্ণ হয় না। আমাকে তুমি কথা দাও, ঝর্ণা-রাগ করে কোনদিন আর চলে যাবে না।
যাব না, যদি এমনকি…।
জীবনে কোনদিন আর তোমার গায়ে হাত তুলব না, যতই আমাকে তুমি রাগিয়ে দাও।
শাস্তিটা আমার পাওনাই হয়েছিল, বলল ঝর্ণা। কিন্তু অপমানটা খুব লেগেছিল আমার। আমি তো বিশ্বাসই করতে পারছিলাম না যে আমার গায়ে হাত তুলছ তুমি। অমন হেসো না
তো, কসাইটা!
এবার হো হো করে হেসে উঠল হাসান, এক মুহূর্ত পর অনিচ্ছাসত্ত্বেও তার সঙ্গে হাসতে লাগল ঝর্ণা। সত্যি আমি দুঃখিত, ঝর্ণা। মাফ চাই। শোনো, ব্যাপারটা ঝুলিয়ে রেখে লাভ নেই, চলো এখুনি গিয়ে ব্যাণ্ডেজ খোলার জন্যে ডাক্তার সাহেবকে বলি। আচ্ছা, বউকে চুমো না খেয়ে একটা মানুষ কতদিন থাকতে পারে?
এক ঘণ্টা পর, একটা ক্লিনিকে, ডাক্তারের চেম্বারে বসে থাকতে দেখা গেল ওদেরকে। আয়নায় চোখ রেখে নিজেকে দেখছে ঝর্ণা। তার দিকে সকৌতুকে তাকিয়ে রয়েছে হাসান ও ডাক্তার তরফদার।
আরে, কি সুন্দর আমি!
চিরকালই তাই ছিলে, বলল হাসান। নিজেও তা ভাল করে জানো।
কিন্তু হাসান, আমি ভুলে গিয়েছিলাম। সত্যি বলছি, আগে কি রকম দেখতে ছিলাম মনে করতে পারছি না। মুখটা সত্যি সুন্দর, তাই না? কেন বলো তো, সম্পূর্ণ নতুন আর অচেনা মনে হচ্ছে কেন? দেখো না, চোখ দুটো কি বড় বড়। কোনদিন ভুরু প্লাক করিনি বলে খুশি লাগছে আমার। আর চোখের পাতাগুলো খেয়াল করো, সিকি ইঞ্চির চেয়ে বেশি লম্বা। আর নাকটা? এমন খাড়া নাক কারও দেখেছ, হাসান?
দেখেছি, বলল হাসান। শুধু তোমার। ডাক্তার তরফদার হাসছেন, হাসছে হাসানও।
তারপর ডাক্তার সাহেব বললেন, নাকের পাশের দাগগুলো আবছাভাবে দেখা যাচ্ছে, আপাতত পাউডার ব্যবহার করলে চাপা পড়ে যাবে, তবে এক সময় ওগুলো আর থাকবে না। আপনার কপালের দাগটা একটু বেশি গভীর, কারণটা হলো সময়ের আগে ড্রেসিং খুলে ফেলেছিলেন আপনি, তবে ওটাও একটু দেরিতে মিলিয়ে যাবে।
যতদিন না যায়, চুল নামিয়ে ওটা ঢেকে রাখব, হাসিমুখে বলল ঝর্ণা। সব মিলিয়ে, আগের চেয়ে আমার মুখের বয়স কমে গেছে, কারও মায়া এসে গেছে চেহারায়। নাকের মাথায় যে তিলগুলো ছিল তার একটাও এখন নেই। হাসান, বাড়ি নিয়ে চলো আমাকে। iজ সারাটা দিন আমি ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে থাকব।
চেম্বার থেকে বেরিয়ে আসছে ওরা, ডাক্তার সাহেব তৃপ্তিভরা চোখে তাকিয়ে আছেন। মনে মনে ভাবছেন, খুব সুখী দম্পতি ওঁরা, পরস্পরকে সাংঘাতিক ভালবাসেন।
আমাকে তোমার পছন্দ হয়? তোবড়ানো ফিয়াটে চড়ে শহর থেকে বাড়ি ফিরছে ওরা। মানে আমার এই নতুন চেহারা?
তোমাকে আমার চেহারার জন্যে সুন্দর লাগছে না, সত্যি কথাই বলল হাসান, সুন্দর লাগছে এখন তোমাকে সুখী একটা মেয়ে দেখাচ্ছে বলে। ঝর্ণা, আমরা দুজনেই আসলে ভাগ্যবান। যতটুকু আমাদের প্রাপ্য তারচেয়ে অনেক বেশি পাচ্ছি।
জানি গো, জানি, স্বামীর কাঁধে মাথা রাখল ঝর্ণা। আমি তা কোনদিন ভুলব না।