এই যে শুনছেন, সাবধান! আমার মা কিন্তু খুব চটে রয়েছেন। ইয়েস, আপনার উপর।
অভয় অবাক হয়। পিছন ফিরে দেখে একটি মেয়ে সিঁড়ির বাঁকে দাঁড়িয়ে আছে। পরনে হলুদ রঙের সালোয়ার কামিজ। লম্বা চুল, রং শ্যামলা। হাত নেড়ে নেড়ে খুব দ্রুত মুখ চালাচ্ছে। হাতে প্রচুর কাচের চুড়ি। শব্দ তুলছে টুং টাং।
আপনার চুলগুলো নাকি ঘোড়ার লেজের মতন, যখনই আপনি হাঁটেন ঘাড়ের উপর ঝপাঝপ লাফিয়ে পড়ে।
জি-ইইই? কী বলছেন?
জি হ্যাঁ। শুধু তাই না, নাপিতের জন্যে খোঁজ পাঠানো হয়েছে, নেড়ামুণ্ড করেই তবে ভদ্রমহিলা আপনাকে ছাড়বেন।
এসব কী বলছেন আপনি! আমি তো…
অভয় বির্মূত। কথা শেষ করতে পারে না। কী যে বলা উচিত তাই বুঝে উঠতে পারছে না। এই মাত্র ফিরেছে। ভর দুপুর। বেরিয়েছে সেই ভোরে । ছাদের দরজাটা খোলা মাত্র পেছন থেকে এই আক্রমণ। কী অদ্ভুত সব কথাবার্তা। মেয়েটি আবারও আক্রমণ করলো, শুনুন, আপনি এক্ষুনি গিয়ে আর্মি ছাট দিয়ে আসুন। নতুবা ভদ্রমহিলা যা বলেছেন তাই করে ছাড়বেন।
অভয় বিব্রতবোধ করে। এ সে কোথায় এলো? মাত্র ক’টা দিন হয়েছে এখানে এসে উঠেছে। ভার্সিটি জীবন শেষ। হল ছেড়েছে। পত্রিকা অফিসের ওই কাজটা পাওয়াতে গ্রামের বাড়িতেও বসে থাকা সম্ভব না। সাংবাদিক হবে। অথচ শুরুতেই এই এক ঝামেলা। বুঝতে পারছে ভালবাসার মতনই প্রয়োজনীয় বিষয় ভালো একটি বাসা। নিদেন পক্ষে বাসা।
তবে এ বাসায় এসে সে বেশ খুশিই হয়ে উঠেছিল। পাহাড়ের উপর দোতলা বাড়ি। বিশাল ছাদের এক কোণায় ওই চিলেকোঠা। চিলেকোঠা না বলে একে ‘জুগ্গী’ বলাই ভালো। উপরে টিন শেড। পাশে বেড়া। বাথরুম অবশ্য নিচে। ছাদে একটা পানির কল আছে। কেন যে এই জুগ্গীটা তৈরি করা হয়েছিল এখনও জানা হয়নি। বরাবরই নাকি পরিত্যক্ত, কেও থাকেনি কখনও। প্রথম বাসিন্দা সে। তারই জন্যে কি তৈরি হয়েছিল এই ঘরটি! অনেক উপর থেকে এক ঝলকেই দেখা যায় পুরো শহর। শহরের শেষে সমুদ্রের সীমানাও ঝিলিক দেয়। ছাদে পায় বৃষ্টির টাপুর টুপুর, মেঘ যেন ছুঁয়ে দিতে চায় তাকে। মাতাল করা দামাল হাওয়া। অপেক্ষায় আছে সে, কোনো এক পূর্ণিমার রাতে এই খোলা ছাদে দাঁড়িয়ে স্রষ্টাকে অসম্ভব সুন্দর কোনো সম্ভাষণ জানাবে। বলবে না হয় শুধুই ভালবাসার কোনো গল্প, কথায় বা কবিতায়। চেঁচিয়ে উঠবে প্রচণ্ড আনন্দে অপূর্ব সুন্দর পৃথিবীর মায়া মমতায়।
এমনিতেও এই আবাসটি তার কখনওই মনে হয় না চট্টগ্রামের কোথাও, মনে হয়, এ যেন বিন্দাবন। তার জুগ্নীটি একটি কুঠুরি, নিলয়।
এখন ঐ এক বিপদ। অযথাই বকবক করছে। হাবলার মতন কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবে। বিপুল বিক্রমে জিজ্ঞেস করলো, কে আপনি?
মেয়েটিও সাথে সাথে জবাব দিল, আরে কী বোকা! এতক্ষণেও বোঝেন নি?
জি না।
বাড়িওয়ালী। যাকে সবাই ভয় পায় আমি তার মেয়ে।
মিসেস হায়দার?
জি, যাকে সবাই আড়ালে বলে একটু এ্যাবনরম্যাল, আমি তারই মেয়ে।
এভাবে কথা বলায় অভয় প্রথমে ভীষণ অবাক হং। ভ্রু-কুচকে চেয়ে থাকে কিছুক্ষণ, তারপর বলে, Plese leave me alone.
কম্পিউটারের যুগে কম্পিউটারেরই ভালো করার চিন্তা করা উচিত, মানুষের না। বলেই মেয়েটি হাত দু’টো ভাঁজ করে ঝপাঝপ দুই লাফ দিয়ে মুখ ঘুরিয়ে নিল। আবার আড়চোখে তাকে দেখছে। অল্পবয়সী মেয়েদের ভাবসাব আসলেই বোঝা দায়। মেয়েটির বয়স কত হবে- ১৮ বা ১৯। মেয়েটি আবারও এবং আবারও কানা চোখে চাইছে। তার হাবভাব বোঝার চেষ্টা করছে।
অভয়ের হাসি পেয়ে যায়। কিন্তু হাসে না, চেয়ে থাকে ভ্রু-কুচকে।
মনে পড়েছে গতকালই তো, নাকি পরশু, বেশ রাতে প্রাচীর টপকে ঢুকছিল। হঠাৎ পেছন থেকে শব্দ। দারোয়ান না চোর ভাবতে ভাবতে ফিরতেই দেখে একটা মেয়ে, মাথায় ঘোমটা, বেশ চিকন স্বরে বললো, আপনার এই শার্টটা দয়া করে আর পরবেন না।
অভয়ের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েছিল। লেডি হাইজ্যাকার! ভদ্রতা করে বলা হচ্ছে পরবেন না, তার মানে কি দিয়ে দাও?
দারোয়ান ব্যাটা থাকে কোথায়? হাঁক ছাড়ার আগেই আবার লেডি হাইজ্যাকার মুখ খুলেছিল- আমার ভাই যুদ্ধে মারা গেছেন। সে সব সময় এই ধরনের শার্ট পরতো। আপনাকে দেখলেই তাই মায়ের কষ্ট হয়।
বলেই লাজুকলতার ভঙ্গীতে অবগুণ্ঠিতা একতলায় ঢুকে পড়েছিল।
গতকাল কি আপনিই শার্টের জন্য…
দেখুন আমি আপনার ভালোর জন্যই বলছি। একেবারে বেল হওয়ার চেয়ে তো অন্তত কিছু চুল থাকুক।
অভয় বিরক্ত কণ্ঠে বললো, আপনার প্রবলেমটা কী?
মেয়েটি একটু ঘাবড়েছে কি! আরো ঘাবড়িয়ে দিতেই অভয় বললো, আপনারও কি মাথায় গণ্ডগোল আছে?
কাজ হয়েছে তাতে। মেয়েটি চলে যাচ্ছে। যেতে যেতে কি মুখটাও বাকালো কয়েকবার! তাই তো, তা বাকাক। চলে যে যাচ্ছে সেই ঢের। মেয়েটির পায়ের নুপুরের শব্দ শুনতে পাচ্ছে। নেমে যাচ্ছে। শব্দ মিলিয়ে যাচ্ছে। শেষ শব্দটা পর্যন্ত দাঁড়িয়ে থেকে অভয় শুনলো- রিনঝিন, রিনঝিন। ওটা কি কোনো সুর তুলেছে? অভয় ভাবতে ভাবতেই সিঁড়ির দরজা ছেড়ে মেলানো বিশাল এক ছাদে নামলো। প্রচণ্ড রোদ। রোদ পেরিয়ে ছায়া শীতল কুঠির দরজায় দাঁড়িয়ে আবারও একবার পিছন ফিরলো। মেয়েটি কি আবারও এসে দাঁড়াবে। নতুন কোনো বক্তব্য নিয়ে। মনে মনে নিজের অজান্তেই কি সে এমন কিছু প্রত্যশা করছে? মেয়েটির ফিরে আসা কি জরুরি! তার কোনো কবিতার জন্য বা কবিতা হয়ে উঠতে, নাহ্ No need. একেবারে না। তারপরও একবার পিছন ফিরলো। না, কেও এলো না, সেই ভালো। অভয় ভেতরে ঢুকে পড়লো।
ঢুকেই অবাক! বিশাল পোস্টার পরেছে ঘরের ভেতরে। ‘ভূত হইতে সাবধান’। মানে কি এ-সবের? ভাগ্যিস আরেকটা চাবি নিচে আছে তাই তাকে সাবধান করা গেল। অভয় হেসে দিল। টেনে ছিড়ে ফেলতে গিয়েও থমকে গেল। থাক, বড় কষ্টে আর যত্নে তৈরি করা হয়েছে এটা। অনেক ভূত প্রেতের ছবি আছে। এতে অদেখা একটা জিনিসের ছবিও তো দেখা হলো।
ভাতের ডেকচির দিকে চোখ পড়লো। তাড়াতাড়ি ঢাকনা তুলে দেখলো। না, আজ ভাতই আছে। ক’দিন আগে দুপুরে এসে দেখেছিল ভাত সব খিচুড়ী হয়ে গেছে। প্রতিদিনই সে বেরুনোর আগে ভাত রাঁধে। নজরুল ইসলাম অবশ্য ব্যাপারটাকে ভূতের কীর্তি বলেই বিশ্বাস করেছে। নজরুল ইসলাম নিচের তলায় বাড়িওয়ালার বাসায় কাজ করে। তবে তার সামনে ভাব করে বড় কর্তার।
অভয় লম্বা হয়ে শুয়ে পড়লো বিছানায়। আজ তাকে বাড়ি যেতে হবে। বিকেলে ট্রেন। বাবার জরুরি তলব। বিশাল এক মানুষ। যেন হিমালয়। স্বাধীনতার জন্য একটা ছবির বই কিনেছে। ভাবীর জন্য কিছু নেওয়া হলো না। কী-ই বা নেবে। এখন তার পছন্দ কি হবে অভয় বুঝতে পারে না। বাংলাদেশের গ্রামগুলোতে প্রচুর বিধবা আর স্বামী পরিত্যাক্ত মেয়ে রয়েছে। অভয় প্রায় ভাবে সে এদের নিয়ে কিছু লিখবে। যেদিন থেকে ভাবী বিধবা হয়েছেন সেদিন থেকেই সে এই কথাটি ভাবছে। অসাধারণ একটা কিছু সে লিখবে। কিন্তু কখন? জানা নেই।
ভাবতে ভাবতেই অভয়ের চোখ লেগে আসে, একটু ঘুম তার বড় দরকার। সারাটা দিন রাস্তায় রাস্তায় প্রচুর দৌড়ঝাপ করেছে। হঠাৎ দেখে, গুচ্ছগুচ্ছ মেয়ে সাদা শাড়ি আর কালো পতাকা হাতে তার দিকে ধেয়ে আসছে। ওরা তাকে আক্রমণ করতে চায়। অভয় ছুটতে শুরু করে, দেশ থেকে মহাদেশে। চেঁচিয়ে বলে, ‘আমি তোমাদের বন্ধু, আমি তোমাদের ভালো চাই।’
এ কথা শুনে মেয়েগুলো খিলখিল করে হেসে উঠে বলে, ‘কবিতা লিখে আমাদের ভালো করবে, বেশ বেশ তো।’ মেয়েগুলো আবারও হেসে ওঠে, আবারও এবং আবারও।
হঠাৎ চোখের সামনে টিন, একি? ওহ্ ওটা ছাদ। ঘুম ভেঙে গেছে। ঘুমের মাঝে স্বপ্ন দেখছিল সে! ঘাড়ে, গলায় জবজবে ঘাম। অভয় নড়েচড়ে চোখ বন্ধ করে। ফিসফাস শব্দ। হাসির শব্দ। মেয়েলী কণ্ঠ। কারা? অভয় উঠে বসে। দরজাটা ভেতর থেকে বন্ধ। জানালাগুলো খোলা। পাহাড় আর জংলা ঝোঁপ ঝাড়ের উপর পড়ন্ত বিকেলের রোদ ঢেউ খেলে যাচ্ছে। সামনে থাকা ছাদের কোনো দৃশ্যই এই জানালাগুলো দিয়ে দেখা যায় না। হাসির শব্দ কানে আসছে। ফিসফাসানী।
কী হচ্ছে এসব?
হঠাৎ করেই লেখক হিসেবে বেশ খ্যাতি পেয়েছে অভয়, বিশেষ করে কবিতায়। নিরিবিলি শান্ত পরিবেশে এখন শুধু তার লিখে যাওয়া দরকার। অথচ ক’টা দিন থেকে বিবিধ উপদ্রব।
চোখে পড়লো বেড়ার নিচের দিকে একটা ফুটো তৈরি হচ্ছে। অভয় বিছানা ছেড়ে উঠে দাড়ায়। কাছাকাছি যেতেই দেখে ফুটোটা গজাচ্ছে। বড় হচ্ছে। কেরামতি দেখে সে থমকে দাঁড়ায় মুহূর্তের জন্য। তারপর এগিয়ে গিয়ে ফুটোর সামনে হাঁটু গেড়ে বসে।
ছিদ্রতে চোখ রাখা মাত্রই চোখাচোখি। টানাটানা সাগরের মত গভীর একটা চোখ। আর সাথে সাথে চিৎকার করে ছিটকে গেল চোখটি। একটি মেয়ের পুরো অবয়ব। সেই সিঁড়ির মেয়েটি। সীমাহীন নীলাকাশ আর সাদা মেঘের পটভূমিতে ঘুম জড়ানো চোখে অভয়ের মনে হলো বড় মায়াভরা একটি মুখশ্রী। মেয়েটিকে ঘিরে যেন বসন্ত উৎসব চলছে। ওহ্, পরনে সেই হলুদ পোশাক। তাই মনে হচ্ছে বসন্ত কি? বুদ্ধি মনে হচ্ছে গুলিয়ে যাচ্ছে।
অভয় বড় মুগ্ধ চোখে চেয়ে থাকে।
মেয়েগুলো পড়িমড়ি করে ছুটলো। ৪-৫টা মেয়ে। অভয় ওদের করে দেওয়া ফুটোতে চোখ রেখে বসে রইল।
অভয় উঠেছে প্রায় ছুটন্ত ট্রেনে। ধরেই নিয়েছিল আজ আর যেতে পারছে না। ট্রেন পাবে না। তবুও পেয়ে গেল। ভাগ্য ভালো। টিকিট ছাড়াই সে ছুটে ট্রেনে উঠে বসে। চেকার পেলে টিকেট নেবে।
তলবটা জরুরি। জরুরি না হলেও তাকে যেতে হতো। বাবার ডাকে সাড়া না দিয়ে উপায় নেই। বাবার জন্য যে অনুভূতিটা তার সবচেয়ে বেশি কাজ করে সেটা হচ্ছে ভয়। সেই ছোটবেলা থেকেই বাবাকে তার বড় ভয়। অথচ নাম তার অভয়। আম্মা বা ফুপু যখন দৈত্য-দানবের গল্প বলতেন, দৈত্যগুলো অনেক উঁচু, লম্বা লম্বা হাত, অভয় তখন অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করতো বাবার মত? বাবাকে তার কেন যেন এমন মনে হতো কে জানে? এখনও তার বাবাকে প্রচণ্ড ভয়। প্রতিবারই বাড়ি যাওয়ার আগে রীতিমত মানসিক প্রস্তুতি নেয়। বাবার সামনে দাঁড়াতে হবে। প্রয়োজনীয় অপ্রয়োজনীয় প্রচুর জবাবদিহি করতে হবে। কিন্তু এবার সব এলোমেলো। সে যেন হুটহাট করেই ছুটে যাচ্ছে জরুরি তলব পেয়ে। সমন জারী হয়েছে যেতে হবে, যাচ্ছে সে। কী ঘটনা তার জন্য ওখানে ওঁৎপেতে আছে কে জানে। এখানে তো এদিকে কেবল ঘটনাই ঘটে চলেছে। মেলোড্রামা। নিজের কাছেই ঘটনাগুলো পরিষ্কার ছিল না, কি চায় মেয়েটি, মেয়েগুলো, যতক্ষণ পর্যন্ত না নজরুল ইসলাম ফাস করে দিল ঘটনাটা।
মেয়েদের ব্যাটেলিয়ান চলে যাওয়ার পর পরই সে দ্রুত গুছিয়ে নিয়েছিল জামাকাপড়। আবার বুড়ী বা খুকী কারও পাল্লায় পড়ার আগেই সে বেরুতে চায়। তার মাঝে হঠাৎ ডাকাডাকি। ‘স্যার স্যার।’ নজরুল ইসলামের গলা। ছেলেটা চেঁচাতেও পারে প্রচণ্ড জোরে। আশপাশের সবাই বোধ হয় সারাক্ষণই এর গলা শুনতে পায়। একটানে দরজাটা খুললো। ঘরটাও বোধ হয় একটু নড়ে উঠলো। অভয় জানতে চাইলো, কী চাই?
তরকারির প্লেট চাই।
অভয় অবাক হয়ে এদিক ওদিক চায়। কোথায় প্লেট?
ঐ যে, ঢাকনা দেওয়া।
ল্যান্ডলেডী পাঠিয়েছিলেন?
হ্যাঁ, কোনো অসুবিধা?
চোখ ঘুরিয়ে নজরুল ইসলাম যেভাবে উত্তরটা দিয়েছিল অভয়ের যথার্থই মনে হয়েছিল এ ছেলে তো বহুরূপী। বহুভাষায় বহুভাবে কথা বলে আর কথা পাচারও করে।
খাবার ঢাকা। অথচ সে জানে না। সারাটা দিন উপোস। বুড়ীটা এত ভালো হলো কি করে। মেয়ে যা বলেছে তার সাথে তো মিলছে না।
কোথায় উনি, ক’দিনের জন্য বাড়ি যাচ্ছি, বলে যাওয়া দরকার।
নাই, না না আছে আছে। এইমাত্র বাসায় ঢুকলেন। সেই সকালে অফিস গিয়েছেন। এখন ফিরলেন। যাওয়ার আগে আমাকে বলেছেন দুপুরে যেন উপরে খাবার দিয়ে যাই।
তার মানে! তবে যে মেয়েটা বললো নাপিত নেড়ামুণ্ডু এসব! সব বানানো কথা কি তাহলে? অভয়ের বিস্ময়ের সীমা থাকে না।
হঠাৎ করে নজরুল ইসলামকে জিজ্ঞেস করে বসলো, তোমাদের বেগম সাহেবের মাথায় কি ছিট আছে?
ছি ছি তওবা তওবা কি কন এসব?
নজরুল দ্রুত তার নিজের নাকে কয়েকটা থাপ্পর মারে। প্রথম দিন থেকেই অভয় খেয়াল করেছে এই ছেলের কথায় কথায় নিজের নাকে থাপ্পর মারার অভ্যাস আছে। ব্যথাও পায় না নাকি?
তাড়াতাড়ি সামাল দিতে গিয়ে অভয় বললো, না, মানে ওনার মেয়ের মুখেই তো শুনলাম।
আমার কথা যদি শোনেন তো বলি আপার মাথাতেই দোষ আছে।
ফিসফিসিয়ে নিচুলয়ে মহা গোপনীয় সংবাদই যেন সে দিল, তবে কথাটা অভয়ের মনে ধরে গেল।
মাথা নেড়ে হেসে প্রশ্রয় দিতেই নজরুলের উৎসাহ বাড়লো। বললো, জানেন না তো স্যার, আজ হয়েছেটা কী?
কী হয়েছে?
এত্ত বড় পাইপটা পড়লো উপর থ্যাইক্যা নিচে ধাম কইরা, আমি নিজে ছাদে আনি দিলাম। সে কি ওজন! আপা বড় ম্যাডামকে কয়কি কাকে ফেলছে। উপরেও বলে কাকে আনছিল। হে হে আমি কি কাক, আপনিই বলেন?
তাই, তাই বলেছে?
জুঁই’পা তো সেরকমই ভাব করলো।
ও বলেনি। ভাব করলো, তাতেই তুমি বুঝে গেলে সব, মাই ডিয়ার নজরুল ইসলাম।
জি।
আপার নাম বুঝি জুঁই?
নজরুল ইসলাম সাথে সাথে মুখটা ঘুরিয়ে নিল।
ভাবখানা আপা’র নামে আপনার কি কাম। আপার জন্য দরদ আছে দেখা যাচ্ছে।
প্রথম দিনেই এই বাড়িতে আসামাত্র দারোয়ান চাচা তাকে জানিয়ে দিয়েছিল, নজরুলকে ‘নজরুল ইসলাম’ পুরো নামেই ডাকতে হবে। নাম ছোট করা যাবে না, ‘নজরুইল্যা’ তো নয়ই। এই শর্তেই সে এ বাড়িতে কাজে এসেছে। ‘নজরুইল্যা’ জাতীয় কিছু শুনলেই তার ছোট বুকটা লাফ মেরে ওঠে। কথাটা বলেই দারোয়ান চাচা বাঁ দিকে মুখ করে হাসলেন কতক্ষণ। সেই থেকে সে পারলে প্রতি ডাকেই পুরোটাই ডাকে- নজরুল ইসলাম। মাঝে মাঝে সামনে বিশেষণও যোগ করে প্রিয়, সুবোধ, করিৎকর্মা ইত্যাদি। যাইহোক, প্রিয় নজরুল ইসলাম বলে যাচ্ছে, জি, ওনার থেকে তফাতে থাকিয়েন। সাংঘাতিক!
তার বলার ভঙ্গীতে অভয় হেসে উঠেছিল। তার ভালো চাওয়ার মানুষের অভাব নেই। তবে তার মনে হলো, তার থেকে জুঁই’পাকে যেন সরিয়ে রাখা, প্রটেক্ট করা এই ছেলে তার দায়িত্বের মাঝে ফেলে রেখেছে। তবে সুযোগ পেয়েই নজরুল ইসলাম আরেকটু পাণ্ডিত্য দেখাতে গিয়ে আসল কথাটাই বলে দিয়েছিল।
ছুটন্ত ট্রেনের খোলা হাওয়ায় কথাটা মনে পড়ায় অভয়ের হাসি পেয়ে যায়। নজরুল ইসলামের বক্তব্য অনুযায়ী সে ঐ ঘরের বাসিন্দা না হলে ঐ ঘরটা এত দিনে পত্রিকা অফিস হয়ে যেত। তাকে দয়া দেখিয়ে আরো বলেছিল নজরুল ইসলাম, জানেন না তো কিছুই। আপাগুলা তো সারাটাদিন ঐ নিয়া ফুসফুস, গুজগুজ করে। পত্রিকা বার করবো। হে-য়-য়।
যে ভঙ্গীতে নজরুল ইসলাম মতামত দিলো যেনো খুব ফালতু ময়লা কাগজ বের করবে ঐ আপাগুলান। হা হা। অভয় আপন মনেই হাসতে থাকে।
তাকে বের করার জন্যই নতুন নতুন নাটক তৈরি করছে মেয়েগুলো। পাইপটা এনেছিল বেড়ার ফুটো দিয়ে পাইপটা ঢুকিয়ে ঘরময় পানিতে সয়লাব করে দেবে। ছাদে বন্যা। এই করে ভাগাবে তাকে। বড়ই অপরিপক্ক মগজ মেয়েগুলোর।
১৮-১৯ বছরের আধ-পাগলা মাথা। তবে কলেজের ম্যাগাজিন বের করবে এটা তার ভালো লেগেছে। নামটা জানা গেলে ভালো হতো। তাকে বললে তো সে অনেক সাহায্য করতে পারে। পৃথিবীটাকে হঠাৎ তার যেন বড় রঙিন মনে হচ্ছে। রুমঝুম শব্দ তুলে কে-ও কি আসছে তার জীবনে। বাড়িওয়ালীর পাগলী মেয়েটাকে কি ভালো লাগছে! আপন মনেই হাসে অভয়। ছুটন্ত ট্রেনের ঠাণ্ডা বাতাসটাও তার সুরভীত মনে হচ্ছে । চারদিকে সবুজ বনানীর সমারোহ অথচ হঠাৎ তার মনে হচ্ছে গাছে গাছে পাতায় পাতায় হলুদ ফুল ফুটে আছে। আশ্চর্য নুপুরের শব্দও যেন সে পাচ্ছে। তাইবা কি করে হয়। শব্দ এত দূর আসবে কীভাবে?
উরুতে ধাক্কা খেয়ে পাশে তাকাল অভয়। বাপের কোলে বসা দু’বছরের বাচ্চাটি ধাক্কা মারছে, তার পায়ে নুপুর। পা দিয়ে তাকে ধাক্কা দিচ্ছে, প্রতি ধাক্কায় নুপুর শব্দ করে উঠছে। বাপটি সরি মরি জাতীয় কিছু বলছে কিন্তু তার ভালো লাগছে এই ধাক্কা, নিক্কন, জুঁই ফুলের সুবাস যেন বিশ্বময়। কাকতালীয় কি এই নুপুরের রিনিঝিনি শব্দ তরঙ্গ। হঠাৎ এই সময়ে এই ভাবে তাকে কেন তাল দিচ্ছে প্রকৃতি। আপন মনেই বলে, আচ্ছা যদি প্রেম হয় তোমার সাথে আমার তবে তোমাকে ডাকবো ‘নুপুর’। নাহ রিনিঝিনি। নাকি রিমিঝিমি, হ্যাঁ রিমিঝিমি, হ্যাঁ রিমিঝিমি-ই ভালো হবে । কী ভীষণ দুর্দান্ত সুখময় এই পৃথিবী।
অভয় হঠাৎ প্রচণ্ড জোরে কেঁপে উঠে হুমড়ি খেয়ে পড়লো সামনে। তারপরই দুমড়ে মুচড়ে এদিক ওদিক বহুদিকে ধাক্কা খেল। কী হচ্ছে? একসিডেন্ট! ট্রেন একসিডেন্ট করেছে কি? চিৎকার করছে কি সে নিজেই? পাশের বাচ্চাটি কেমন আছে! উফ, মাগো, চিৎকার, কান্না, ধুলা, প্রচণ্ড আওয়াজ, ভয়াবহ বিবিধ শব্দ, আগুনও দেখা যাচ্ছে। আগুন ধরেছে পাশে কোথাও। পেট্রোল বোমা। কারা যেন তাই বলে চিল্লাচ্ছে। সে কি ছিটকে দূরে কোথাও এসে পড়েছে। শরীর অবশ হয়ে যাচ্ছে। মাথা আর কাজ করছে না। শ্বাস বুঝি গেল। সব নিঃশ্বাস বুঝি শেষ। শেষ নিঃশ্বাস ছাড়তে যাচ্ছে কি? এত গরম এত তাপ এত ঝাপসা কেন চারদিক? এটাই কি কেয়ামত? বাবার মুখ মনে পড়ছে। বাবা কেন ডেকে পাঠিয়েছিলেন তা তো জানা হলো না। বাবা নিশ্চয়ই রাগ করবেন। আহ বাবা, বড় কষ্ট বাবা। চারদিকে কি সে পাচ্ছে ফুলের সুবাস? জুঁইয়ের সুবাস কি এমন হয়? সে কি জুঁই ফোটা কোনো এক কাদামাটিতে পড়ে আছে?
আজ সুন্দর একটি প্রেমের গল্প হয়তো মাত্র শুরু হতে যাচ্ছিল। মাত্র শুরু। শুরুও হতে পারেনি পুরোপুরি। তার আগেই কি সব শেষ হয়ে যাচ্ছে? কি বিশাল একটা দিন ছিল, জগৎ ছিল, কতকিছু করবার ছিল, কিছুই হলো না তো তার করা। জুঁই কি ভাববে ছাদের সেই ছেলেটি গেল কোথায়? সে তো নামও জানে না তার। সে যদি দেখে তার ছবি পত্রিকার পাতায় তাহলে হয়তো বুঝবে ছাদের সেই ছেলেটি ট্রেনে করে দেশে ফিরতে গিয়ে পেট্রোল বোমায় বেঘোরে জীবন দিয়েছে। এত অর্থহীনভাবে সব শেষ হয়ে যাওয়া মেনে নেওয়া যায় না। কি বিশাল আকাশ ছিল! আজ সকালেও তার ছাদের উপর সেই জুগ্গীতে কত ঘটনা ছিল। কী অপূর্ব এই পৃথিবী, মায়াময়, মোহময়। মরে যেতে তার একটুও মন চাইছে না। কিন্তু চোখ আপনা আপনি বুজে আসছে যেন। প্রচণ্ড পানির তৃষ্ণা। দম নেবার বাতাসও নেই যেন। তারপরও প্রচণ্ড ভালবাসায় আকড়ে ধরলো ধরনীর ধুলামাটি। মুঠো ভরে যেন নিয়ে রাখলো দেশের মাটি।