সবুজ বনের ভয়ংকর- মহাশ্মশানের বেহালাবাদক

সবুজ বনের ভয়ংকর- মহাশ্মশানের বেহালাবাদক

কিয়াং প্রিয়বর্ধনের কথা শুনে আরও হেসে বলল, রোজারিওর কবর আবিষ্কার করেছে, আর তার গুপ্তধন আবিষ্কার করতে পারোনি? আমি জানি, ওর কবরের তলায় সব ধনরত্ন পোঁতা আছে। চলো, সেই গুহাটা দেখিয়ে দাও।

প্রিয়বর্ধন আমাকে চোখের ইশারায় কী যেন বলে খুব উৎসাহ দেখিয়ে পা বাড়াল। কিন্তু ব্যাপারটা আমার ভাল মনে হল না। মাকড়সা ক্যাকটাসের হাতে খামোকা আবার এতগুলো লোকের মৃত্যু হওয়াটা কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলুম না। তাই বললুম, মিঃ কিয়াং, শুনুন। ক্যারিববা আর তার দুই সঙ্গী এই দ্বীপে এসেছিল। তারা…

কথা কেড়ে কিয়াং বলল, সর্বনাশ! তাহলে তারাই সব হাতিয়ে কেটে পড়েছে।

বললুম, না। তারা এই দ্বীপের সাংঘাতিক মাকড়সা-ক্যাকটাসের পাল্লায় পড়ে মারা গেছে।

কিয়াং হাসল। জানি, জানি। সেবার ওদের পাল্লায় পড়ে আমার দলেরও পাঁচটা লোকের প্রাণ গেছে। তাই এবার আমি তৈরি হয়েই এসেছি।

মিঃ কিয়াং! ওদের গায়ে গুলি বেঁধে না!

কিয়াং তার কাঁধের ব্যাগ খুলে রিভলভারের মতো একটা জিনিস বের করে বলল, এটা কি জিনিস বুঝেছ? লেসার অস্ত্র। যে-কোনও সজীব পদার্থকে এক সেকেন্ডে ছাই করে ফেলবে। শুধু তাই নয়; পাথরের মতো নির্জীব পদার্থকেও গুঁড়ো করে দেবে। এর নল থেকে সাংঘাতিক লেসার রশ্মি বেরোয়। শুধু তাই নয়, ওই যে কামানের মতো জিনিসটা দেখতে পাচ্ছ, ওটা আরও শক্তিশালী লেসার বিম ছুড়ে মারে। কি, চলো প্রিয়বর্ধন! রুবি আইল্যান্ডের ঘুঘুগুলো হেলিকপ্টার নিয়ে সবসময় ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমার জাহাজ দেখে তাদের সন্দেহ হতে পারে। ঝটপট কাজ সেরে ফিরে যাব। তার আগে অবশ্য ভূতুড়ে গাছপালাগুলোকে জ্বালিয়ে খতম করে দিয়ে যাব।

আমি দম আটকানো গলায় বলে উঠলুম, দোহাই মিঃ কিয়াং! কথা শুনুন—এই দ্বীপ বিজ্ঞানের এক ল্যাবরেটরি!

রাখো তোমার ল্যাবরেটরি! কিয়াং বিকট হাসল। আমি এবার এসেছি কিওটার ভূতগুলোকে খতম করতে। ওরা আমাকে খুব ভুগিয়েছে। আমার অনেক লোক মারা পড়েছে ওদের হাতে। আমি প্রতিশোধ নেবই।

বলে সে তার দলবল নিয়ে হাঁটতে শুরু করল। প্রিয়বর্ধনকে ঠেলে নিয়ে চলল সে। কিন্তু আমার দিকে ঘুরেও তাকাল না।

একটু পরে শুরু হল কিয়াংয়ের পৈশাচিক কীর্তিকলাপ। যথারীতি স্টপ ইট! স্ট ইট চিৎকার প্রতিধ্বনিত হতেই দেখলুম, তার এক সঙ্গী যেদিক থেকে চিৎকারটা আসছিল, সেইদিক লক্ষ্য করে লেসার কামান বসাল। তারপর দেখলুম, ডানদিকের জঙ্গল দাউ দাউ করে জ্বলে উঠছে। আমি দৌড়ে গিয়ে চেচিয়ে বললুম, স্টপ ইট! স্ট ইট! ওর এক অনুচর আমাকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিল।

কিয়াংয়ের মুখে পৈশাচিক হাসি। সে হুকুম দিল, এক চিলতে ঘাস পর্যন্ত আস্ত রাখবে না। ডাইনে-বাঁয়ে সব দিকের ওই ভূতুড়ে গাছপালাগুলোকে খতম করে দাও।

অসহায় চোখে দেখতে থাকলুম সে হত্যাকাণ্ড। লেসার কামানের মারাত্মক রশ্মিপুঞ্জ দেখতে। পাচ্ছি না—শুধু হিস হিস শব্দ হচ্ছে কামানটা থেকে আর ক্রমাগত আগুন ধরে যাচ্ছে গাছপালায়, ঝোপঝাড়ে। প্রকৃতির লক্ষ লক্ষ বছরের সাজানো সুন্দর উদ্যান জ্বলে ছাই হয়ে যাচ্ছে। খোলা মাঠের সামনের দিকে সেই প্রাণী ক্যাকটাসের ঝক পাঁচিলের মতো এগিয়ে আসছিল। তারাও দাউদাউ জ্বলে কালো ছাই হয়ে ঘাসে মিশে গেল। ঘাসেও আগুন ধরে গেল। কালো চাপ-চাপ ধোঁয়ায় আকাশ কালো হয়ে গেল। বাতাসে কটু গন্ধ ছড়াল। সভ্যতার ভয়ঙ্কর মরণশক্তি চারপাশে তাজা সুন্দর সবুজ জীবনকে ধ্বংস করে চলল। লেসারকামান ঘুরে-ঘুরে হিস হিস শব্দে বিষের আগুন ওগরাচ্ছে। আর চোখের পলকে উজ্জ্বল আগুনের চোখ ধাঁধানো শিখা ছড়িয়ে পড়ছে।

আমার চোখে জল এসে গিয়েছিল। চোখের সামনে এই বিরাট ধ্বংসলীলা দেখেও আমার কিছু করার নেই। পাশে একটা ছিপছিপে তরুণ গাছ বুঝি দুঃখে কাতর হয়ে করুণ সুর বাজাতে শুরু করেছিল, নিষ্ঠুর কিয়াং তাকে লক্ষ্য করে লেসার পিস্তলের ট্রিগার টিপল। চোখের পলকে গাছটা কালো হয়ে খুঁড়িয়ে পড়ল এবং বাতাসে কয়েক মুঠো ছাই উড়ে যেতে দেখলুম। ধ্বংসের নেশায় কিয়াং মাতাল হয়ে উঠেছে।

কিছুক্ষণের মধ্যে যেদিকে তাকাই, সেদিকেই শুধু কালো ছাই। ছোট্ট দ্বীপের সব সবুজ, কালো ভস্মস্তুপে পরিণত। এক বিশাল শ্মশানভূমিতে একদল নিষ্ঠুর পিশাচের কাছে দাঁড়িয়ে আছি।

এতক্ষণে প্রিয়বর্ধন ধরা গলায় বলে উঠল, কাজটা কি ঠিক হল স্যার? কিয়াং তার মাথায় গাঁট্টা মেরে বলল, চল ব্যাটা ছুঁচো, কোথায় রোজারিওর কবর, দেখি।

প্রিয়বর্ধন কাঁদোকাঁদো মুখে বলল, ছাইগুলোতে পা পুড়ে যাচ্ছে স্যার!

তোর পায়ে জুতো নেই দেখছি। ওহে রিংপো, ওকে তোমার জুতোজোড়া দাও বরং। আর তুমি বোটের কাছে গিয়ে পাহারা দাও।

প্রিয়বর্ধনের পায়ে জুতো দুটো ফিট করছিল না। বেঢপ রকমের প্রকাণ্ড জুতো পরে বেচারা থপ থপ করে এগিয়ে গেল ওদের সঙ্গে। রিংপো নামে লোকটা মুচকি হেসে বলল, এখানে একলা কান্নাকাটি করে কী হবে স্যাঙাত? এস—আমরা বরং বিচে গিয়ে গপ্পসপ্প করি।

বিচের ধারে একলা সেই বেহালা বাজিয়ে গাছটা করুণ চেহারায় দাঁড়িয়ে আছে। চারদিকে তাকিয়ে দেখে বুঝলুম, শুধু এই ছোট গাছটাই বেঁচে আছে। পেছনদিকে পাথরের আড়ালে বিচের মাথায় আছে বলেই তার দিক চোখ পড়েনি কিয়াংয়ের। কিন্তু কেন সে বেহালা বাজাচ্ছে না? শোকে মূক হয়ে গেছে কি?

কাল রাতে তাহলে কিয়াংয়ের জাহাজ এসে পৌঁছনোর পর কিওটার উদ্ভিদ চেতনায় ওই উত্তেজনার সঞ্চার ঘটেছিল। পূর্ণিমার জ্যোৎস্নায় তাহলে আমি শোকসঙ্গীতই শুনেছিলুম।

রিংপো লোকটির মেজাজ ভাল। সে আমাকে ফ্লাস্ক থেকে কফি ঢেলে দিয়ে বলল, নাও, খেয়ে ফেলো। দুঃখ করে কী হবে? গাছপালা বৈ তো নয়! তবে কি জানো। আমাদের কর্তাটি একেবারে শয়তানের অবতার। রোখ চাপলে আর ভালমন্দ জ্ঞানগম্যি থাকে না।

কফি খেতে ইচ্ছে করছিল না। তবু খেতে হল। ওর সঙ্গে ভাব জমানোর চেষ্টা করলুম। রিংপো রুবি দ্বীপেরই লোক। বউ ছেলেপুলে আছে। কিয়াংয়ের মাছের আর পুঁটকির মস্ত কারবার আছে। রিংপো অবশ্য মাছ ধরার কাজেই থাকে। তবে সে জানে, কর্তা বহুদিন আগে থেকে কিওটা দ্বীপের খোঁজ রাখে। রাজাকোর সঙ্গে একসময় তার খুব বন্ধু ছিল। রাজাকোও জানত সব। কিন্তু যতবারই ওরা কিওটা এসেছে, ভয়ঙ্কর কী বিপদ ঘটেছে। কোনওক্রমে প্রাণ নিয়ে ফিরে গেছে। তাই এবার সেজেগুজে মারাত্মক অস্ত্র সংগ্রহ করে এ-দ্বীপে পাড়ি জমিয়েছে।

কথায়-কথায় রিংপো বলল, এবার তোমার আর প্রিয়বর্ধনের ব্যপারটা বলো, শুনি। কীভাবে তোমরা এ-দ্বীপের খোঁজ পেয়েছিলে?

একে সংক্ষেপে সব কাহিনী শোনালুম। তারপর বললুম, রোমিলার খবর কিছু জানো? রিংপো বলল, জানি না। তবে শুনেছি, তুমি যাদের সঙ্গে রুবি দ্বীপে এসেছিলে, তারা তোমার মরা খুঁজে বেড়াচ্ছে সমুদ্রে।

বলে সে উঠে দাঁড়িয়ে চারদিক দেখে নিল। তারপর চাপা গলায় ফের বলল, তোমার কথাবার্তা শুনে ভাল লোক বলে মনে হচ্ছে। তাই বলছি শোনো। বাইরের কেউ রোজারিওর গুপ্তধনের সাক্ষী থাক, সেটা সম্ভবত পছন্দ করবেন না কর্তামশাই। কাজেই তোমাকেও বাঁচিয়ে রাখবেন বলে মনে হয় না। অবশ্য প্রিয়বর্ধনের কথা আলাদা। সে রুবি দ্বীপেরই বাসিন্দা। তাকে দলে ভিড়িয়ে নিতেও পারেন। কিন্তু তোমার বাঁচোয়া নেই।

তার কথা শুনে শিউরে উঠে বললুম, তাহলে কী করতে বলছ আমাকে?

রিংপো একটু ভেবে বলল, জঙ্গলগুলো থাকলে লুকিয়ে থাকতে। কিন্তু কর্তামশাই তো সব ছাই করে ফেলেছেন। তুমি বরং এই সুযোগে সাঁতার কেটে দক্ষিণের প্রবাল পাঁচিলের কাছে চলে যাও। ওই পাঁচিলে অনেক গুহা আছে। লুকিয়ে থাকো গে। রুবি দ্বীপে ফিরে গিয়ে গোপনে আমি রোমিলাকে তোমার খবর দেব। সে তোমাকে উদ্ধারের ব্যবস্থা করবে।

দক্ষিণের প্রবল পাঁচিলে পৌঁছনো অসম্ভব রিংপো।

কেন? সাঁতার কাটতে পারো না?

পারি। কিন্তু স্বচক্ষে দেখেছি, ওদিকে বলয়সাগরের জলে ভয়ঙ্কর একটা জন্তু আছে।

তাহলে উত্তরের পাঁচিলে চলে যাও।

তার চেয়ে এ-দ্বীপের পশ্চিমে ওই পাহাড়গুলোর ভেতর গিয়ে লুকিয়ে পড়ছি বরং।

রিংপো লাফিয়ে উঠে বলল, কখনো না। কর্তার নজরে পড়ে যাবে। রোজারিওর কবরের তলায় যদি গুপ্তধন সত্যি সত্যি না থাকে, কর্তা সব জায়গা ডিনামাইট দিয়ে উড়িয়ে খুঁজবে। কী দরকার ঝুঁকি নিয়ে? আমার ধারণা, উত্তরের দিকটায় জল কম। আমি সারা জীবন জলে ঘুরছি। জল দেখে তার গভীরতা বলে দিতে পারি। তুমি কেটে পড়ো।

আমার জন্য তোমার ক্ষতি হবে না তো রিংপো?

রিংপো চটে গিয়ে বলল, নিজে বাঁচলে বাপের নাম। সাধুগিরি ফলিও না তো বাপু। কর্তা কি আমাকে বলে গেছে তোমাকে পাহারা দিতে? সোজা বলে দেব, কেটে পড়েছে। কিংবা জঙ্গলদানবের পেটে গেছে।

একটু ইতস্তত করে বললুম, উপকার যদি করতে চাও, একটু বেশি করেই না হয় করলে ভাই রিংপো। তিনটে মোটরবোট এনেছ। একটায় চাপিয়ে আমাকে ওখানে পৌঁছে দিয়ে এস।

রিংপো পশ্চিম দিকটা ভাল করে দেখে নিয়ে বলল, পারতুম। কিন্তু যে কোনও মুহূর্তে কর্তা এসে পড়বে। তখন আমার প্রাণটাও যাবে।

অগত্যা জলে গিয়ে নামলুম। পুবের ভাঙন দিয়ে মহাসাগরের ঢেউ এসে ঢুকছে। তাই এদিকটায় ঢেউ আছে। কিন্তু উত্তরদিকটায় তত ঢেউ নেই। বাতাস বইছে দক্ষিণ-পশ্চিম কোণ থেকে। পোড়া দ্বীপের ছাই এসে পড়ছে জলে। কটু গন্ধ ঝাঁপটা মারছে নাকে। কোনাকুনি মাইলটাক সাঁতার কেটে কখনও ড়ুবো পাথরে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিলুম। প্রতি মুহূর্তে ভয় হচ্ছিল, এখনই জলদানব ভেঁস করে মাথা তুলে আমাকে তেড়ে আসবে। কিন্তু প্রবাল পাঁচিলে পৌঁছনো পর্যন্ত নিরাপদ রইলুম।

একটা চাতালে উঠে আবার কিছুক্ষণ বিশ্রাম করলুম। তারপর অনেক কষ্টে পাঁচিলের মাথা পেরিয়ে ওপাশে গিয়ে আরেকটা চাতাল পাওয়া গেল। ঝাকে ঝুঁকে পাখি এখানে বসে আছে। উড়ে বেড়াচ্ছে। আমাকে দেখে ওরা গ্রাহ্য করল না। চাতালের একপাশে একটা ছোট্ট গুহাও পাওয়া গেল। এতক্ষণে ভাবনা হল, কবে ওদের জাহাজ ফিরে যাবে রুবি দ্বীপে, তারপর রিংপো খবর দেবে রোমিলাকে। ততদিন আমি বেঁচে থাকব তো? কী খেয়ে বাঁচব?

হ্যাঁ, এখানে পাখির ডিম প্রচুর। সমুদ্রের স্বচ্ছ জলে মাছও দেখা যাচ্ছে। কিন্তু কঁচা খাব কেমন করে? একটু পরে ভাবলুম, বরং ওদের জাহাজ চলে গেল আবার সাঁতার কেটে দ্বীপে ফিরে যাব। ক্যারিবোদের জিনিসপত্র কাল রাতের ঝড়ে উড়ে কোথাও পড়ে আছে। ওর ভেতর যদি একটা সিগারেট লাইটার পেয়ে যাই, তাহলে অন্তত মাছের রোস্ট খেয়েও বেঁচে থাকতে পারব।

কিন্তু দ্বীপে তো সব পুড়ে ছাই। আগুন জ্বালাব কিসে? আমার মনটা দমে গেল। এদিকে খিদেও পেয়েছে। একটা ডিম ভেঙে চোখ বুজে চোঁ-চোঁ করে গিলে ফেললুম। খিদের মুখে অমৃত লাগল। আরও গোটা তিনেক ডিম গিলে খিদেটা যদি বা দূর হল জলের তেষ্টা মেটাব কেমন করে? ঝরনা আছে কিওটা দ্বীপের পাহাড়ে। এখানে প্রবাল বলয়ের দুধারে নোনা জল।

চাতালের ওপর ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ মনে হল, কোনও গর্তে বৃষ্টির জল কি জমে নেই? মাউন্টেনিয়ারিং-এ ট্রেনিং নেওয়াটা এতকাল পরে দারুণ কাজে লাগল। অনেক খুঁজে একখানে গর্তের ভেতর জল পাওয়া গেল। জলটা চেখে একটু ঝাঁঝালো স্বাদ পেলুম। বিষাক্ত নয় তো? ভয় পেয়ে মুখে দিলুম না। প্রবাল অশোধিত অবস্থায় বিষাক্ত বলে শুনেছি। তবে এই পাঁচিল প্রবালকীট জমে তৈরি হলেও এর বয়স হাজার-হাজার বছর। এখন পাথরে পরিণত হয়েছে। কাজেই এখানে। প্রবালের বিষ না থাকাই সম্ভব। তবু মনে সন্দেহ এসেছে যখন না খাওয়াই ভাল। অগত্যা বৃষ্টি-মেঘের আশায় তাকিয়ে রইলুম।

বৃষ্টি এল বিকেল নাগাদ। তুমুল বৃষ্টি। ছেড়া জামা নিংড়ে জল খেলুম। সেই গুহার ভেতর কাটিয়ে দিলুম একটা রাত। পরদিন সকালে পাঁচিলের ওপর দিয়ে উঁকি মেরে দেখি, দ্বীপের বিচে। মোটরবোটগুলো নেই। দূরের সমুদ্রে কিয়াংয়ের জাহাজটাকেও দেখতে পেলুম না। ওরা তাহলে গুপ্তধন উদ্ধার করে কখন ফিরে গেছে।

সাঁতার কেটে দ্বীপে ফিরে এলুম আবার।

দ্বীপ নয়, শ্মশান। ক্লান্ত, দুঃখিতভাবে দাঁড়িয়ে আছি। এমন সময় বেহালা বেজে উঠল। সেই একলা বেহালা-বাজিয়ে গাছটা বেঁচে আছে শুধু। করুণ সুরে একলা বেহালা বাজাচ্ছে। তার কাছে। গিয়ে দাঁড়ালুম। কিওটার শ্মশানে দাঁড়িয়ে সে শোকসঙ্গীত বাজিয়ে চলেছে একা। তার কাছে বসে রইলুম।

আরও দুটো দিন কেটে গেল এই শ্মশানভূমিতে। ক্যারিববার কোনও জিনিস খুঁজে পাইনি। হয় ওরা কুড়িয়ে নিয়ে গেছে, নয়তো পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। ছাই হাতড়ে আমার চেহারা হয়েছিল ভূতের মতো। নোনা জলে ছাইগুলো ধুয়ে যাওয়া দূরের কথা, আরও চটচটে হয়ে এঁটে গিয়েছিল। পাথর ছুড়ে মাছ মেরেছি আর কাঁচা চিবিয়ে খেয়েছি। তৃতীয় দিনে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলুম। একেবার চলচ্ছক্তিহীন অবস্থা। অতি কষ্টে সেই বেহালাবাদকের কাছে গিয়ে শুয়ে পড়লুম, বুঝতে পারছিলুম, মৃত্যুর দেরি নেই। আমার শিয়রে দাঁড়িয়ে পরম বন্ধুর মতো বেহালাবাদক গাছটি করুণ সুরে বেহালা বাজাচ্ছিল। তারপর আর বিশেষ কিছু মনে নেই। শুধু এটুকু মনে আছে, আমার চেতনার সঙ্গে ওই সুর একাকার হয়ে যখন গভীর অন্ধকারে তলিয়ে যাচ্ছিল, তখন কে যেন ডাকছিল, এনজেলো! এনজেলো! মাই সন! আমার সাড়া দিতে ইচ্ছে করছিল, এই তো আমি।…

চোখ মেলে কিছুক্ষণ বুঝতে পারলুম না কিছু। তারপর ভেসে উঠল পরিচিত একটা মুখ। সেই মুখে একরাশ সাদা দাড়ি আর স্নেহ। জয়ন্ত! ডার্লিং!

কর্নেল! আমি চমকে উঠে সাড়া দিলুম। আমি কোথায়? কর্নেল নীলাদ্রি সরকার আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন, রুবি আইল্যান্ডের মেরিন হসপিটালে। আশা করি, শিগগির শরীর সেরে যাবে। ভেবো না।

রোমিলাকে দেখতে পেলুম এতক্ষণে। সে একটু হেসে বলল, রিংপোর কাছে সব খবর পেয়ে কর্নেলকে জানিয়েছিলুম। আমরা ধরেই নিয়েছিলুম তোমাকে ওরা মেরে সমুদ্রে ফেলে দিয়েছে। যাই হোক, কর্নেল তক্ষুণি মিলিটারি হেলিকপ্টারে রওনা দিলেন। ওদিকে কিয়াংয়ের জাহাজকেও নেভির লোকেরা আটক করল। কিয়াং এখন জেলে।

কর্নেল বললে, কিওটার কালো রং দেখে আর চিনতে অসুবিধে হয়নি। কিন্তু বেহালার সুর শুনে যদি না ওদিকে এগিয়ে যেতাম, তোমাকে দেখতেই পেতুম না। যাই হোক, অন্তত একটা গাছ বেঁচে আছে ওখানে। ডঃ বিকর্ণ আর ক্যাপ্টেন ব্যুগেনভিলি ওখানে ক্যাম্প করে আছেন। ডঃ বিকর্ণের গবেষণার সুবিধে হবে।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত