মশী বুঝতে পারছে মায়ের দাঁতের ব্যথা ক্রমেই বাড়ছে। ব্যথার কষ্টটা যত বাড়ছে আম্মার আ আ উ উ তো বাড়ছেই সঙ্গে সঙ্গে অদ্ভুত সব শব্দ মা আওড়াচ্ছে। বলে যাচ্ছে তো যাচ্ছেই। এই যেমন, এখন খাটে শুয়ে শুয়ে বলছে, ‘অরণ্যে রোদন করছি, বিনা চিকিৎসায় মারা যেতে হবে, ফিরেও তাকাবে না কেও আমার দিকে’।
মশী যে বার বার ফিরে তাকাচ্ছে আম্মা সেটা আমলেই নিচ্ছে না! তাকিয়েই দেখছে না এদিকে। তাহলে কি সে এখন এক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকবে চোখের পাতা না ফেলে?
বকুল’পার সঙ্গে প্রায়ই খেলাটা খেলতে হয়। কে কতক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারে একজন আরেকজনের দিকে। নিষ্পলক চাহনী। এই কঠিন শব্দটাও বকুল’পা তাকে শিখিয়েছে। যদিও সে সব সময় এই খেলায় হারে, তারপরও খেলে। আর হারে। আবার খেলে। ‘হারু পার্টি’ ডেকে বকুল’পা তার গালটাও টিপে দেয় মাঝে মাঝে। আবার বলেও, ‘কী আদুরে বাচ্চা একটা রে তুই!’
কথাটা অবশ্যই মশীর পছন্দ হয় না।
একটু সুযোগ পেলেই যে বকুল’পা তাকে বাচ্চা-কাচ্চাদের দলে ফেলে দেয় সেটা সে বেশ বুঝতে পারে। পাঁচ-বছর বয়স কি কম নাকি? কেন যে কম মনে হচ্ছে বকুল’পার! নিজে যেন কতবড় আর কি? ভাইয়ার সমান হবে? না, না, ভাইয়ার থেকে এক ক্লাস বড়। ইশ তাতেই ভাবখানা যেন সে কতবড়। এ আর এমন কি বড়। একদিন বলেই না হয় দেবে, যত বড় ভাবছো ততবড় মোটেও তুমি না। আমি এখনই তোমার কোমর পর্যন্ত পৌঁছে গেছি। ভাইয়া তো তোমার মাথার কাছাকাছি পৌঁছে গেছে প্রায়ই। আর অল্প একটু, একটু বাকী। তারপরে দুজনেই সমান।
থাক কিছুই সে বলবে না, বড়দের সঙ্গে তর্ক করতে নেই। মা বলেছে, বড়দের মুখে মুখে কথা বলতে হয় না। হুজুরও বলেছেন, ‘গুনাহ হবে বড়দের মনে কষ্ট দিলে, লম্বায় খাটো হয়ে যাবি এক ইঞ্চি।’
তাই শুনে মশী মনে মনে ভাবে আগে লম্বা তো হয়েনি। বকুল’পার থেকেও লম্বা, তারপরে না হয় বলা যাবে।
আম্মা প্রায়ই বলে, ভাইয়া আরো লম্বা হবে। লম্বা হতে হতে বকুল’পার মাথাও ছাড়িয়ে যাবে। বকুল’পা আর হয়েছে লম্বা। যেটুকু হয়েছে ঐটুকুই।
আম্মা শিওর। খুবই শিওর এ ব্যাপারে। ছেলেরা দেরীতে লম্বা হয়। যখন হওয়া শুরু হয় আর কেও থামাতে পারে না। হতেই থাকে হতেই থাকে। ই-য়ে-স। ইয়েস, বাবা অবশ্য তাই শুনে আম্মাকে বলেছেন, ‘তুমি কি কোন মই জোগাড় করেছো যেটাতে উঠে উপর দিয়ে বকুলের মাথাটা দুই হাতে ধরে রাখবে যাতে করে সে আর উপরের দিকে বাড়তে না পারে!’
আম্মার তো তখন দাঁতের ব্যথাটা ছিল না। তাই আম্মাও শুনে চুপচাপ থাকেন নি। শুনিয়ে দিয়েছে এত্ত এত্ত কথা। কিলবিল করে অনেক কথা বেরিয়েছে আম্মার মুখ দিয়ে।
এত্তগুলো কথা তার এক কান দিয়ে ঢুকতে ঢুকতেই আরেক কান দিয়ে বের হয়ে যাচ্ছিল। ধরে রাখতে পারছিল না বকুল’পাকে বলবার জন্য। তবে যেটুকু বলেছে তাতেই বকুল’পা চোখ মুখ কুঁচকে যেভাবে চেয়েছিল মাগো দেখেই ভয় পেতে হয়। পেয়েও ছিল সে। ভাবছিল তখন কেন যে কথাগুলো বলতে গেল।
তবে বকুল’পা বলেছে, তোর বাবার কথাই ঠিক। ঐ যে বাবা বলেছিলেন তোকে কোলে নিয়ে মায়ের রুম থেকে বের হয়ে যেতে যেতে, ‘বড় হয় কর্মে, লম্বায় না। সুন্দর তো থাকে মনে, গায়ে না। মাকাল ফল কেউ পছন্দ করে না’ ঠিকই বলেছেন।
ইশ কেন যে বাবার এই কথাগুলোও বকুল’পাকে সে বলে দিতে গিয়েছিল!
তবে মাকাল ফলটা আবার কি? জানা দরকার। বকুল’পাকে জিজ্ঞেস করতেও সাহস হয়নি, সেদিন যা মুখ কুঁচকে রেখেছিল মা তাকে বেটে বলেছে বলে। নাহ্ এটা আম্মা কি করলো, বকুল’পাকে বেটে বললো! মা তো সারাক্ষণই বলেন, কালোকে কালো বলতে নেই। বেটেকে বেটে না। নাক বোচাকে নাক বোচা না। এই যাহ্, বকুল’পা যে সারাক্ষণ তাকে নাক বোচা বলে তখন যে সে কষ্ট পায় সেটা কি বকুল’পা বুঝতে পারছে এখন? নিজের যাতে কষ্ট হয় তা তো অন্যকেও বললে অন্যও কষ্ট পাবে।
মা তো বাবার সাথে ঝগড়া করতে করতে ঐসব বাবাকে বলেছে, বকুল’পাকে কষ্ট দিতে না। নাহ্ ঘরের কথা কখনোই বাইরে এসে বলতে নেই।
বকুল’পা মুখটা থমথম করে দাঁড়িয়ে আছে। তাড়াতাড়ি বাবার বলা শেষ কথাটাই সে বললো, ‘সবাই সব কিছু দেখতে পায় না। দেখার চোখ থাকে না। যে যা দেখে না সেটা তারই ব্যর্থতা।’
বকুল’পা হেসে ফেললো, এই রে বকুল’পা বুঝলো কি করে যে সে বাবার কথা কপি করেছে। হেসে হেসে বলছে, ‘কপি পেস্ট কোথাকার! বাবাকে নকল করিস না! পাজী কোথাকার।
যাই হোক হাসি যে ফুটেছে সেটাই বড় কথা।
মুখেও কথা ফুটেছে, বলছে, ‘দেখতেও জানতে হয়, দেখাতেও জানতে হয়। দেখাদেখি যেমন তেমন বিষয় না। তবে আমি আমার মতন করেই এগিয়ে যাব লেফট রাইট করে। বল বীর বল চির উন্নত মম শির।’ বলতে বলতে বকুল’পা মাথার উপর দুই হাত তুলে শ্লোগানের ভঙ্গী করলো।
বাহ্ বাহ্ দারুণ দারুণ। খুশিতে মশী হাততালি দিয়ে উঠলো।
তবে বকুল’পার কথা কঠিন। মশীর এখন মনে হচ্ছে বকুল’পার সারা বছরই দাঁতের ব্যথা থাকে। আর তাই সারাক্ষণই অসম্ভব সব কঠিন কঠিন শব্দ বলে বেড়ায়। যদিও উহ আহ করে না। আম্মা তো করেই চলেছে। যতই আম্মার উহ আহ্ বাড়ছে, আম্মার কথাগুলো ততই কঠিন হয়ে যাচ্ছে। এই যেমন এখন বললো, আমি ‘অগ্যস্ত যাত্রা’ করলে সবাই বাঁচে।
আম্মা যেন কোথায় যেতে চাইছে, ওটা তো নানার বাড়ির না। আম্মা তো প্রায়ই নানার বাড়ি যায় তাকে নিয়ে। নানার বাড়িতে সব পুকুরেই তার বন্ধু আছে। বিভিন্ন ধরনের মাছ তার বন্ধু, কত কথা বলে মাছেরা তার সাথে। যখন ছোট ছিল সে নানার বাড়িতে গেলেই মাছগুলো খুশিতে নেচে উঠতো। কত রকমের গল্প যে করতো তারা। একদম কালো একটা মাছ আছে, রাক্ষুসী মাছ নাম দিয়েছে সবাই। কিন্তু সেই মাছের মনে যে কত কষ্ট, আহা তাকে দেখলেই মাছটি কত কাঁদে। লাল মাছগুলোরও অনেকদিন খবর পায় না সে। যেতে হবে সহসা নানার বাড়ি। ‘ইশ মা কবে যাবে নানার বাড়ি? নানার বাড়ি পদ্ম পুকুর গলায় গলায় জল’ বলতে বলতে সে মায়ের খাটের একদম পাশে এসে বললো, ‘মা কোথায় যাবে, নানার বাড়ি?’
মা চেঁচিয়ে বললেন, ‘না আমি অগ্যস্ত যাত্রা করবো।’
মশী এ কথার কিছু না বুঝে বাবার দিকে অবাক হয়ে চেয়ে থাকলো। বাবা বললেন, তোর মা মারা যেতে চাইছেন। সেটাই অগ্যস্ত যাত্রা। তবে দাঁতের ব্যথায় কেও মারা যায় না।
মশী নিশ্চিত হলো, মা সহসা মারা যাচ্ছে না। মা মারা গেলে তার আবার খুবই অসুবিধা। এখনও রাতে মায়ের গলা জড়িয়ে ঘুমায় সে। বাবা বিরক্ত হন। বলেন এই ছেলে মানুষ হবে না। আম্মাও সাথে সাথে উত্তর দেয়, ক্লাস ওয়ানে পড়ে, সে মা-র সাথে শোবে না তো কে শোবে। আম্মা তাকে আরো কাছে টেনে নেন। মা’র বুকে সে আর ভাইয়া পাশের রুমে লম্বা খাটে শুয়ে একাকী। কী মজা কী মজা! যদিও ভাইয়ার পাশে তার জন্যও ছোট একটা খাট দেওয়া আছে। তবে ওটা খালি থাকে। পাশে একটা পড়ার টেবিলও আছে। ভাইয়া দিনরাত ঐ টেবিলে বসে অনেক পড়ে। ভাইয়া অনেক জানে সব কিছু। ক্লাস ফাইভের পড়া অনেক পড়া। ভাইয়ার অনেক জ্ঞান অনেক বুদ্ধি।
আম্মা প্রায়ই বলেন বড়টার এত বুদ্ধি আর ছোটটা কেন যে এত বোকা হলো!
বুদ্ধি এত কম কেন যে হলো। তারও তখন খুব চিন্তা করতে ইচ্ছে হয় কিন্তু কিভাবে কি চিন্তা করবে বুঝে উঠতে পারে না।
মা কেন যে এই কথাটা বলে! রাক্ষুসী মাছটা বলেছে তাকেও তার মা এই বলতো, তাই সে রাক্ষুসী হয়ে গেছে। না না সে রাক্ষুসী হবে না, রাক্ষুসী মাছটার কত দুঃখ, কত দুঃখী সে। সে রাজা মাছ হবে। খালের পানিতে সে একটা লাল রংয়ের রাজা মাছ দেখেছে। ভাইয়া বলেছে ওটা রাজা তাই লাল, ওর পেছনে অনেক সৈন্য সামন্তও আছে, ছোট ছোট সুইয়ের মত তীর ছিল সব কটা সৈন্যের মুখে, লম্বা লম্বা, রাজার কাছে গেলেই দেবে ঘচাং করে তরবারী দিয়ে কেটে। তারপর কেটে কেটে ছোট টুকরা করে ফেলবে।
কাল সে স্কুলে সবকটা পাতায় মাছ এঁকে দিয়ে এসেছে। ক খ গ কে লিখবে। মাছগুলোর নাম ক খ গ ভেবে নিয়ে সুন্দর সুন্দর মাছ একে দিয়ে এসেছে। ক মাছের মুখে একটা তীর, খ মাছের মুখে দুইটা আর গ মাছের মুখে তিনটা। হা হা। রোজী ম্যাডাম বলেছে মা’কে নিয়ে যেতে স্কুলে। হায় হায় খাতাটা তো মাকে দেখাতে সে ভুলে গেছে। মায়ের যা দাঁতের ব্যথা, মা কি দেখতে চাইবে? রোজী ম্যাডাম খুব ক্ষেপে বলেছে, ‘তুমি কি গো বাছা, বলেছি একটা, করছো আরেকটা। বাসার থেকে অ আ পুরাটা লিখে আনতে বলেছি, তুমি এনেছো শুধু অ লিখে খাতা জুড়ে। মন থাকে কোথায়?
পাশ থেকে কি যেন নাম ছেলেটার, এই যা, নামটা ভুলে গেছে সে। সেই ছেলেটা বলেছে ও হচ্ছে হাদারাম। ইশ, মা-র কথাটা সেই ছেলেও জেনে গেছে। জানলো যেমন করে যে মা তাকে হাদারাম ডাকে। ভালই হয়েছে ছেলেটার নামটা সে ভুলে গেছে। বাকী ছেলেগুলোর নামও তার মনে পড়ছে না কেন? অনেক ছেলে ক্লাশে। মেয়েও আছে কিছু। মাঝে মাঝে সবাইকে তার এক রকম মনে হয়। মনে হয় সবাই যেন মেঘে ভাসছে। কারো কথাই সে বুঝতে পারছে না। সবাই যেন বহুদূরে চলে গেছে। ভেসে ভেসে চলে যাচ্ছে ওদের কথাগুলোও সে ধরতেও পারছে না। সে আকাশে তখন বাসা করে মনে মনে আকাশে থাকে। তারা গোনে। চাঁদের সাথে কথা বলে। মাঝে মাঝে কিছু পাখি আসে উড়ে তার দিকে, তখন সে ওদের পিঠে চড়ে নেমে আসে মায়ের কাছে। মা তখন চিল্লায়ে চিল্লায়ে কি যে কি বলে তাকে। কি এত কথা বলে মা? মা সারাক্ষণই কিছু বলছে চিৎকার করে। মা-র চিৎকারে তার উল্টো মাঝে মাঝে ঘুমিয়ে পড়তে ইচ্ছে করে। আবার চিৎকারেই জেগে উঠে। উঠে দেখে মা খুব মায়া ভরে তার দিকে চেয়ে আছে। বুকে নিয়ে আদর করছে।
বাবা প্রায়ই বলে, ওর সমস্যাটা বুঝতে হবে। ও আর সব বাচ্চার মত না, ডাক্তার যে বলেছে কথাটা মনে কেন রাখ না? ও হচ্ছে স্পেশাল চাইল্ড।
হ্যাঁ, বাবা বলেছে সে আরো দশটা বাচ্চার মত সাধারণ সাদামাটা নয়, সে হচ্ছে বিশেষ বাচ্চা। হাজারে একটা। হ্যাঁ, হ্যাঁ, খুব ভালো তো।
বাবা আরো মা’কে বলে, তুলনা করবে না ভাইয়ে ভাইয়ে। এতে সম্পর্ক নষ্ট হয়। আর এ কত ছোট বড়টার থেকে। বড়টার সাথে তুলনা করলে চলবে! ভাইয়াও বলে, ‘এখানেই ধরাটা খেয়ে গেলাম।’ কপাল চাপড়ে প্রায়ই বলে, ক্লাস ফাইভে না পড়লে সেও মায়ের সাথে ঘুমাতে পারতো। বাট নাউ হি ইজ এ বিগ বয়। আহারে। বড় হওয়াতে ভাইয়ার কত দুঃখ।
ভাইয়া অবশ্য দুঃখ করে বলে, ঢাকা শহরের ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়লে এতদিনে বেশি হলে থ্রিতে পড়তো। নার্সারি, কিন্ডার গার্ন, কেজি ওয়ান, ওয়ান এটা ওটা সেটা করতে করতে টু বা থ্রি তে পড়তো। তাহলে তো ভাইয়াও ছোট থাকতে পারতো। মাঝে মাঝে ভাইয়ার জন্য মায়াও লাগে। মায়ের বুকে ঘুমানোর কত ইচ্ছে তারও। আহা। বলতেও গিয়েছিল ভাইয়াকে আরো দূরে ছোট মামার দেশে বিলাতে জন্মালে নিশ্চয়ই কি আরো ভাল হতো। ওরা তো পুরাই ইংলিশ। আরো ছোট ক্লাশে পড়তো ভাইয়া।
ভাইয়া অবাক হয়ে বললো, মামা বিলাতে থাকেন বলে কি ওটা কে তোর মামার বাড়ি ভাবছিস নাকি রে! সবচেয়ে ভাল নিজের দেশ। সবার থেকে খাঁটি। নিজের মায়ের চেয়ে কি তোর কখনো মনে হবে বকুল’পার মাকে বেশি ভাল?
তাই তো। সে খুব ভাবনাতে পড়ে গিয়েছিল। আরো ভাবনাতে পড়ে গিয়েছিল, ভাইয়া যখন বললো, জন্মাতিস আমেরিকাতে তবে একদিন বয়স থেকেই একা একা পাশের ঘরে আমার ঐ লম্বা খাটে চিৎপাট হয়ে শুয়ে থাকতে হতো। একদম একা। বুঝতি তখন। ছোট মামা অবশ্য সেটা শুনে হেসে বলেছেন, আরে না, টিভির মতন মনিটর বসানো থাকে বাচ্চাদের রুমে। শব্দ, কথা সব পাশের রুম থেকে বাবা মায়েরা শুনতে দেখতে পায়। শোনা যায় সব কিছু। বাবা-মা সব সময়ই সব দেশে বাচ্চার যত্ন নেয়। বিভিন্ন জন বিভিন্ন ভাবে। বাবা-মা সব সময়ই ভাল। মা শুনেই বলেছেন, এটা কোন ভাল হলো? বাবা অবশ্য বলেছেন, খুবই ভাল। ছোট বেলা থেকেই স্বাবলম্বী হতে পারবে। এ কথা শুনে আম্মা মুখ বাকিয়ে বাবাকে বলেছে, ‘ভূষণ্ডির কাক’।
বাবাকে এত খারাপ বললো? কাক বললো বাবাকে? বাবাকে বললো নাকি আমেরিকাকে! না, তা কেন হবে? একটা দেশকে বা বাবাকে, আম্মা কাক কেন ভাবতে চাইছে! তাও যেমন তেমন কাক না ‘ভূষণ্ডিব কাক ’। বাবাকে জিজ্ঞেস করতেই বাবা বললেন, ‘অল্প বিদ্যা ভয়ংকরী।’
কি কঠিন কঠিন কথা বলছে ওরা।
বাবারও কি দাঁতের ব্যথা ছিল সেদিন? সে চেয়ে আছে দেখে কিনা কে জানে নাকি আম্মাকে শুনিয়ে বাবা বলল, ‘তোর মা আমাকে শক্ত কিছু বলতে চাচ্ছিলো। পাষণ্ড, নির্দয়, নিষ্ঠুর এইসব। আরো শক্ত কিছু খুঁজছিল। না পেয়ে যা আছে শেখা ঐ ঝুড়িতে তাই বলেছে। অথচ এটার মানে হচ্ছে যে অনেক দিন বেঁচে আছে। আমি মরলে মনে হয় তোর মায়ের শান্তি হয়। আর শব্দটা হচ্ছে ‘কাক ভূষণ্ডী’। মা উঠে ধুপ ধাপ করে চলে গিয়েছিলেন।
মশীর সেদিনও খুব কান্না পেয়েছিল। কেন এত মরার কথা বলছে বাবা।
বকুল’পার নানী মারা যাবার পর কত কেঁদেছে বকুল’পা। পাশে বসে সে আর ভাইয়াও কেঁদেছে। অনেক কেঁদেছে। বকুল’পা এসে বলেছিল, তোর খালার, আর আমার মায়ের মা মারা গেছেন। সম্পর্কটা বুঝতেই বহুক্ষণ লেগে গিয়েছিল। এত প্যাঁচ কি ধরা যায় সহজে। সোজা নানী বললেই তো হত। সে যাই হোক অনেক কাঁদতে কাঁদতে মা’কেও জিজ্ঞেস করেছিল, তোমার মা মারা গেলে কি আমাদের এর থেকেও বেশি কাঁদতে হবে? আম্মা ঠাস করে একটা চড় বসিয়ে দিয়েছিলেন। কান্না ভুলে বকুলপাও যে ফিক করে একটু হেসে ভাইয়ার পিছনে মুখ লুকিয়েছিল সেটাও পরিষ্কার দেখেছে। ভাইয়া তাকে আদর করে কাছে টেনে নিয়ে বললো চুপ করে থাক, সবাই এখন কান্নাকাটি করছে। কান্নাকাটির কথা শুনে সে আবার কাঁদতে থাকলো, কেও কাদলে তারও খুব কান্না পায়। সে ফুপিয়ে কাঁদতে থাকলো। এনা দেখে, কে যেন ছেলেটা, সে যেই হোক সে বললো, ‘তুই এত গাধা কেন রে? সবাই কাঁদছে দেখে তুইও কাদছিস!’
তাকে গাধা বলছে! গাধা তো একটা এনিমেল। আয়নায় দেখেছে সে মোটেও গাধার মতন দেখতে নয়।
আরে ভাইয়া তো দেখি প্রতিবাদ করে বলছে, আমার ভাইকে গাধা বলবি না, খবরদার। তারপর ছড়া কেটে বললো, গাধা কহিল ঘোড়ারে তুই বড় গাধারে, ঘোড়াও ছাড়িল না তাহারে, কহিল গাধারে, তুমি বুঝিয়াছ ঘোড়ার ডিম।
মশী খুব আনন্দে ভাইয়ের গায়ের সাথে গা লাগিয়ে বসলো। পারলে আজকের মিলাদের সব মিষ্টি সে ভাইয়াকে দিয়ে দেবে, না হয় তার মিলাদের প্যাকেট ভাইয়াকে দিয়ে দেবে। কী যে ভাল ভাই তার। বাহ্ বাহ্।
আহ মা যদি শুনতো একটু। মা তো প্রায়ই তাকে গাধা ডাকে। বাবা আম্মাকে বকা দিয়ে বলেন, এই করে করে তুমি ছেলেটাকে গাধাই বানিয়ে ফেলবে। মাও সাথে সাথে বললেন, ‘ইশ, এত সোজা নাকি, আমি যখন ওকে আকাশের চাঁদ বলে আদর করি তখন কি ও ছুটে আকাশে গিয়ে চাঁদ হয়ে বসে যায়?’
তাই তো, মা অনেক কথা জানে। বাবা মায়ের সাথে কোনদিনও কথায় পারে না। সেদিনও পারেনি। তাকে কোলে করে নিয়ে বের হয়ে চলে এসেছিল। পিঠে নিয়ে ঘুম পাড়াতে চাইছিল।
মশীর মনে হলো- বাবা যেন তাকে মা’র কথাগুলো না শোনানোর জন্যই বেব করে নিয়ে এলো। ঐ যে মা বলছিল, ‘তোমার ছেলের যে বুদ্ধি কম সেটা তো ডাক্তারই বলেছে। লেখাপড়া শিখতে তার অনেক ঝামেলা হবে। ওর মামা বলেনি ওকে বিদেশে হলে Special স্কুলে দিতে হতো। ওর কথাবার্তা চালচলন হাঁটাচলা সব কিছু স্লো। আস্তে আস্তে বুঝে সে, সব কিছুতে স্লো।
বাবা মা’কে জোরে একটা ধমক দিলো। বললো, চুপ কর। ছেলেকে শুনিয়ে বকাবকি করো না। সে কি বঝুতে পারছে না?
কিসের কথা মা বলেছে? মার কথাগুলো হঠাৎ যেন অনেক দূরে চলে গেল। সে শুনতেও পাচ্ছে না যেন। দেখতে পাচ্ছে মা’র মুখ চলছে কিন্তু কই সে তো শুনতে পারছে না। অচেনা মানুষজন দেখলেও তার এই হয়। দেখে ওরা কি যেন কি বলছে। কিন্তু সে শুনতে পায় না। মনে হয় পানিতে ডুব দিয়েছে। মাছের সাথে দেখা মিলে। মাছগুলো শুধু তার কথা বুঝতে পারে। তার কানের উপর যেন একটা পানির পর্দা দাঁড়িয়ে থাকে। সে আর কারও কোন কিছু শুনতে বুঝতে পারে না, শুধু চেয়ে থাকে।
পিঠের উপর একটা চাপর পড়াতে হঠাৎ মনে হলো কেউ যেন তাকে এক টানে পানি থেকে টেনে তুললো।
ওহ্ বাবা, বাবার কোলে সে, বাবা পিঠে চাপা দিয়ে তাকে ঘুম পাড়ানোর চেষ্টা করছে। ভূষণ্ডির কাকের গল্পটা বলছে। কি ঠান্ডা নীরব জোস্নাভরা রাত। বাবার কাঁধে মাথা দিয়ে সে ঘুমাতে চাইছে। কোন এক কালের সেই পৌরাণিক আমলের বহু আগের যুগের এক কাক, নাম তার কাক ভূষণ্ডী। বেঁচেই আছে। আর মরে না। সব ঘটনা জানে এই পৃথিবীর।
ঘুমে চোখ বুজে আসতে গিয়েও চেষ্টা করে এই রাতের বেলা কোথাও কোন কাক দেখা যায় কিনা। কালকে সকাল থেকেই তার বন্ধু কাকদের সে জিজ্ঞেস করবে, খোঁজ নিয়ে আসতে বলবে এই মহা বুড়ো কাকের।
বলেছেও। পরে বহুবার বলেছে কাকদের।
কিন্তু কোন খবর সে পায়নি আজ অবধি। আচ্ছা মা তো আজ ব্যথায় শুয়ে আছে বিছানায়। মা-কে কি বলবে জানালা দিয়ে ঐ যে কাকটা উড়ে গেলো তাকে যেন মা একটা চিঠি লিখে দেয় যেন ঐ থুরথুরা বুড়া কাকটা একবারে আসে তাদের বাড়িতে। সে খুব আস্তে আস্তে হেঁটে মায়ের কাছে গিয়ে বললো, ‘মা, তুমি কি জান ভূষণ্ডী একটা কাকের নাম। কা কা কাকের নাম।’
মা বালিশ থেকে মুখ তুলে বললো, ‘এত অকাল কুষ্মান্ড যে কি করে হলো এই ছেলে?’
এতদিন বলতো ‘মানী’। সানীর ভাই মানী। মানী মানে অনেক টাকা। সে তার মায়ের অনেক টাকা। সাত রাজার ধন। মা বলেছে কখনো তাদের যদি বোন হয় তার নাম রাখবে ‘পয়সা’ হা হা কি ফানি নামটা। মা অবশ্য মাঝে মাঝে তাকেও ফানি বলে ডাকে। বলে সে নাকি অনেক ফানি ধরনের কাজ করে।
সানীর ভাই ফানি।
ফানি মানে তো হাসির কিছু। কিন্তু পাসের বাসায় বকুল’পা যখনই বললো, ফানি নামে ডাকলেই তার নাকি মশীকে গোপাল ভাঁড় বলে মনে হয়, সেই থেকে সে আর নামটা পছন্দ করতে পারছে না। ওই নামে মা তাকে ডাকলেই তার মনে হয় বিশাল একটা ভুড়ি নিয়ে সে দাঁড়িয়ে আছে। ওটা এখন বাবার আছে। মাকে একদিন বলেও ছিল বাবাকে ফানি ডাকতে, তাকে না। মা শুনেই বলেছে, যা ভাগ। বকুল’পাকে তা বলতেই বকুল’পা বলেছে হানি ডাকলে ঠিক ছিল, ফানি না। মা’কে আবার তা জানাতেই মা দিয়েছে একটা থাপ্পর। বলেছে বেশি ইঁচড়ে পাকা হয়েছো, না? কিন্তু হানি মানে তো মধু, খারাপ কি বলেছে সে। আর কথাটা যে বকুল’পার বলা সেটা তো বলতেই পারলো না। কেও রেগে গেছে দেখলেই সে আর কোন কথা শেষ করতে পারে না। কাঁদছে দেখে বাবা এসে কোলে তুলে বাহিরে নিয়ে যেতেই সে বলে দিল কথাটা বাবাকে। বাবা তো চড় মারলোই না উল্টো হেসে বললো ‘তোর মা অত মর্ডান না।’ বেশ, বেশ, বেশ ভাল কথা, ছুটে সে দু মিনিটের মধ্যেই মাকেও জানিয়ে দিয়েছিল কথাটা।
আর কি, মা-কে বলতেই মা দুইদিন ধরে আছড়ে পড়ে কেঁদেছে। সবার টিভি দেখা বন্ধ করে দিয়েছিলে। ওটা দেখেই নাকি সবার চোখ গেলো রোগ হচ্ছে। কী জানি কি এটা। তবে তাকেও ফানি বলে ডাকে না আর। এতেই সে খুশি। বন্ধুদের হাসিও বন্ধ। কাক মাছ, বিড়াল, কাটাবড়ালী সবাই চুপ করেছে। কেও আর হাসে না। বকুল’পা তো নয়ই।
এখন আম্মা শুয়ে শুয়ে ডাকলেন ‘অকাল কুষ্মাণ্ড’। এটা আবার শুনে না ফেললেই হয় কেও। সকালেও বলেছিল। ভাইয়া তখন বলেছে আম্মার ব্যথা চলে গেলে আম্মা আর এইসব বলবে না। এটা বললে ব্যথা কমে। কথাটা ঠিক না মনে হয়। একটু আগে মাঠে খেলতে গিয়ে পড়ে সে ব্যথা পেয়েছিল তখন তো সেও কয়েকবার বলেছে ‘অকাল কুষ্মাণ্ড কই ব্যাথা তো কমেনি। পা-টা ফুলেই আছে। মা-কে কাছে গিয়ে দেখাবে কি? ব্যথা পেলেই যে তার মাকে দেখাতে ইচ্ছে করে। বকুল’পাকে জিজ্ঞেস করলে বুঝা যেত অকাল কুষ্মাণ্ডর মানে কি? ওনার মা রাস্তার শেষ মাথায় মেয়েদের যে স্কুলটা আছে সেখানে বাংলা পড়ান। শুধু বাংলা না বাংলা ব্যাকরণও। বড় হয়ে তাকেও ওটা পড়তে হবে বলেছে ভাইয়া। ভাইয়া বলেছে খুব দরকারী কঠিন একটা বিষয় ওটা। নিজের ভাষা হলেও বাংলা খুব কঠিন একটা ভাষা। ব্যাপক। বানান কঠিন। এর এত্তো এত্তো বর্ণমালা রয়েছে। পৃথিবীতে বাংলা ভাষায় কথা বলে যারা তাদের যোগ করলে এই ভাষায় লোক বলের সংখ্যা হবে পাঁচ নম্বরে। বাপরে! ঘাড় উঁচিয়ে সে বহুবার দেখার চেষ্টা করেছে এত মানুষ কোথায়। বেশি দূর দেখতে পায় না। পাইলট হলে প্লেনে করে ঘুরে ঘুরে দেখতে পেত।
ভাইয়ে শুনে হো হো করে হেসেছে। বলেছে উপর থেকে মানুষ দেখবি। ভাষা জাতি বর্ণ এইসব তখন বুঝবি না। সবই একই রকম লাগবে। মনে হবে ‘সবার উপর মানুষ সত্য।’ কথাটা বড় বড় করে রুমে ভাইয়া লিখেও রেখেছে। যদিও সে নিজ থেকে কথাটা এখনও পড়তে পারে না তবে জানে এটাই লেখা রয়েছে। বকুল’পার মা একদিন বাসায় এসে ওটা দেখে বলেছেন ‘ওমা এতো স্বামী বিবেকানন্দের কথা। তোমার ছেলের তো অনেক জ্ঞান।’
মা অবশ্য জানতে চাচ্ছিলো, কার স্বামী গো’, বকুল’পার মা খুব বিরক্ত হয়ে চলে যেতে চেয়েছিলেন।
উনি এখন আম্মার টিচার। সারাক্ষণ আম্মাকে শেখাচ্ছেন। সব কঠিন কঠিন শব্দ উনিই তো আম্মাকে শিখাচ্ছেন। আম্মার নাকি উনি এখন BF। বেস্ট ফ্রেন্ড। ভাইয়া বলেছে ফেসবুক যদি আম্মার থাকতো তাহলে আম্মার নাকি অনেক ফ্রেন্ড থাকতো। বেস্ট ফেইবুক ফ্রেন্ড। ফেসবুকটা আবার কী? তা তো জানি না। ভাইয়া বলেছে তা বুঝতে হলে ১৪-১৬ বছর বয়স পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। সে খুব তাড়াতাড়ি বড় হতে চায়, দৌড়ে দৌড়ে। কিন্তু সবাই যে বলে সে নাকি আস্তে আস্তে ধীরে ধীরে বড় হবে। `সে কি তাহলে সবার শেষে বড় হবে? ভাইয়া বলেছে, ‘আমার একমাত্র ভাইটি ছোট যতদিন থাকে ততই ভাল।’
আম্মা তাই শুনে মাথায় হাত দিয়ে কাঁদতে থাকলেন। বললেন, শরীরে বড় হবে মগজে হবে না। মগজটা কোথায় যেন। মাথার ভেতরে। ওটা নকি মাথার ভেতরে থাকে। ওটা তাহলে ওখানে বড় হবে কিভবে। মাথাটা ফাটিয়ে দিলে কি সেটা বের হয়ে এসে বড় হতে পারে? আম্মাকে জিজ্ঞেস করেছিল। আম্মা আরো কাঁদতে কাঁদতে বলেছে, তোর ঘিলু বলে কি কিছুই নেইরে বাবা। এটা আবার কি জিনিস? বাবাকে জিজ্ঞেস করতেই বাবা আম্মাকে ধমকে দিয়ে আবার তাকে কোলে করে নিয়ে চলে গেলেন। বললেন, ভুল করেও যেন মাথা না ফাটাই। ওতে একটা ফড়িং এর জান আছে। কোন ফড়িং কে জানে! বকুল পা অবশ্য বলেছে, ‘ফড়িংটা হচ্ছিল তুই নিজে’। কথাটা শুনে মশীর অবশ্য অনেক হাসি পেয়েছে। হা হা সে ফড়িং হতে যাবে কেন। ভাইয়া বলেছে ফড়িংটা নাকি আম্মাই। হা হা। আরো জোরে জোরে হাসতে ইচ্ছে করেছে। হা হা আম্মা ফড়িং আর তার জান তার মাথার ভেতর, হয় কখনো এমন?
‘তুই সে বুঝবি না’-বলেছে ভাইয়া।
সবাই ভাবে সে কিছু বুঝে না, বুঝবে না।
এ কারণেই হয়তো বা আম্মা দরজা বন্ধ করে দিয়ে তার সামনে বসে বসেই বকুল’পার আম্মার থেকে সব কঠিন কঠিন শব্দ শেখে। ওদের কঠিন কঠিন শব্দ শুনতে শুনতে তার ঘুম পেতে থাকে। ভাইয়া বলে বাবাকে টাসকী লাগাতে চায়। মর্ডান হয়েছে দেখাতে চায়। বাবা যে বলেছে আম্মা সেকেলে তারই শোধ তুলতে চায়। কি দরকার ছিল আম্মার মর্ডান হতে চাওয়ার। সব সময় কঠিন শব্দ বলে আজকাল। ভাতকে বলে অন্ন। ঘরকে বলে আলয়, নিলয় আরো কতটি। ভাইয়াকে তো সেদিন বকুল’পা বলেছেই মর্ডান মেয়েরা এইসব শব্দ বলেই না। তারা পারলে এক্কেবারে গ্রামীণ ভাষায় কথা শুরু করেছে আজকাল। ওটা নাকি পুরোপুরি গ্রামীণও না, গাজাখুরে একটা ভাষা। ভাইয়া বলেছে জঘন্য ভাষা। আর আম্মা এখন নাকি শরৎচন্দ্রের যুগের মানুষের ভাষায় কথা বলছে। তাদের মতন শব্দ ব্যবহার করছে।
বকুল’পাও বলেছে। বকুল পা অনেক জানে। সব জানে। আম্মা নাকি তাকেও বলেছে ‘দীঘির শীতল জলে নাইতে যেও না মেয়ে’। আম্মার এই কথায় বকুল’পার নাকি গা শির শির করে উঠেছিল। বকুল’পা নাকি ভয় পেয়ে দৌড়ে পালিয়েছিল। বলবে সোজা কথা পুকুরে গোসল করতে যেও না। তা না বলে এই রঙ কাব্য কেন করতে গেল আম্মা তা নিয়ে ভাইয়া আর বকুল’পা অনেক ভেবেছে। নাহ্ উত্তর খুজে পায় নি, আম্মার দাতের ব্যথাও তখন ছিল না। তারপরও অমন কথা বলেছে। সে জিজ্ঞেস করেছে কাব্য কি গো? বলেছে বড় হলে বুঝবি। সব কিছুই সে বুঝবে বড় হলে। কিন্তু তার যে বড় হতে নাকি বহুদিন বাকী।
রোজ সকালে যখন মেঠো পথে হেঁটে হেঁটে স্কুলে যায় তখন সে অনেক কথা শুনে বকুল’পা আর বন্ধুদের অথবা ভাইয়া আর তার বন্ধুদের কিন্তু বুঝে উঠতে পারে না অনেক কিছুই। তবে পথে যেতে যেতে পুকুরের দিকে প্যাক প্যাক করে ছুটে যাওয়া হাসগুলোর ভাষা সে বুঝে। নদীর মাছগুলো তো তার খুবই দোস্ত। পথের শেষ ধারে যে ডোবাটা আছে তাতে প্রচুর ব্যাঙ আছে। ব্যাঙ এর মা-টাকে সে দেখেনি কখনো। মা-টা নাকি বেশী বেশী অহংকার দেখাতো।
সে পেট ফুলাতে পারে, আরো বড় করতে পারে, সবচেয়ে বেশী পারে, এই করে করে শেষে একদিন পেট ফেটে সে মারাই গেল। ঠাস করে পেটটা ব্লাস্ট করলো। আম্মা বলেছে গল্পটা। বলেছে এই কারণে কখনোই কোন কিছু নিয়ে অহংকার করতে নেই। বড়াই করতে নেই। অহংকার পতনের মূল। পতন কি? আম্মা তাকে স্লিপারের উপরে বসিয়ে দিয়ে ছেড়ে দিয়েছে, সে সুরুত করে নিচে নেমে এসেছে, এটাই পতন, তাই বলেছে আম্মা। কিন্তু এতো মজারই। কি সুন্দর স্লিপ কেটে নিচে নেমে গেল। বকুল’পা হেসে বলেছে গাছে তুলে ছেড়ে দেন খালাম্মা তখন বুঝবে পতন কাকে বলে। ঐ যে বড় গাছটা ওটার যে ডালটা পুকুরের উপর গিয়ে পড়েছে ওটা থেকে যদি ছেড়ে দেয় তবে সোজা পানিতে। দারুণ হবে। মাছগুলোর সাথে কিছুটা সময় খেলতে পারবে। সাঁতার তো সে ভালই পারে। ওদের সাথে সাঁতরাবে। খাবেদাবে, ঘুরবে মাছের সাথে।
আগে সে স্কুলের সবটুকু টিফিনই মাছগুলোকে দিয়ে দিত। পুরো বক্স খালি করে পানিতে ফেলে দিত। কিন্তু ভাইয়া যেদিন তা দেখে ফেললো সেদিন যখন ভাইয়া তাকে বললো তখন সে জানতে পারলো মাছগুলো তার উপর রাগ করেছে। হ্যাঁ ভীষণ রাগ করেছে। ভাইয়াকে বলেছে তারা। ভাইয়ার সাথে তারা নাকি টেলিফোনে কথা বলে। তার সাথে কখনো বলেনি কথা। বাবার মোবাইল আছে একটা। কিন্তু বাজারে মিষ্টির দোকানে যে ফোনটা আছে ওটাতে নাকি তারা ভাইয়াকে ফোন করে বলেছে তারা স্কুলের বাচ্চাদের টিফিন খায় না। শুধু একটা বিস্কুট দিতে চাইলে দিতে পারে। ভাইয়া মাকে বলেওছিল, তাকে যেন একটা করে বিস্কুট বেশি দেয়া হয় টিফিনে মাছদের জন্য। আম্মা শুনেই বলেছে এক থাপ্পর দেব। মাছের মায়ের পুত্র শোক। মা কেন ভাবছে ওরা দুইজন মাছের মা। এ কেমন কথা! আম্মা ক’টা বিস্কুটের জন্য এমন রেগে গেলো যে তাকে আর জিজ্ঞেসই করা গেল না কিছু। ঝন ঝন করে উঠে চলে গেলো।
কিন্তু এরপর থেকে প্রতিদিনই আবার দুটো বিস্কুট দেন আলাদা করে মাছগুলোর জন্য। আর প্রতিবারই তা দিতে গিয়ে বলেন, মাছের মায়ের পুত্র শোক। মা যে কি? নাহ্ মার কথাবার্তা আর বোঝা গোল না। তবে মাছগুলো বিস্কুট পেয়ে খুব খুশি। ওরা ভাইয়াকেও লাভ করে খুব, খুব ভালবাসে। বলেছে ওরা তাকে। ভাইয়া তাই শুনে বলেছে, খুব ভাল কথা। এইমাত্র এই পৃথিবীতে একজন মৎস ভাষাবিদ পাওয়া গেল, একমাত্র মৎস গবেষক। ভাইয়াটাও না মাঝে মাঝে আম্মার মতন কঠিন কঠিন শব্দ কেন যে বলে? তবে ভাইয়া তাকে সব কিছু খুব সুন্দর করে বুঝিয়ে বলতে পারে। ঐ যে সে মাছ খেতো না। ছোট ছোট মাছগুলো খেতে তার বড় প্রাণ কাঁদতো। ভাইয়া বলেছে ওটাই মাছের গোল। মানুষের পেটে যেতে পারলেই তো তার গোল দেওয়া হবে। না হলে তো জল রাক্ষসী, হাঙ্গর বা পাতাল রাজা তাদের বন্দি করে রাখবে। ফাঁসি দেবে। তাই সে এখন মাছ দিয়ে ভাত খেতে ভালবাসে। মাছগুলো তার মগজে শক্তি দেবে। বুদ্ধি বাড়বে তার অনেক অনেক। বাহ্ বাহ্ ভাইয়া বলে মাছে ভাতে বাঙালি। বাহ্ বাহ্ দারুণ তো। সে মাছ খায় এখন। বিশেষ করে পোনা মাছ। গুড়ি গুড়ি মাছ। ছুটে ছুটে তার ছোট পেটে গোল দেয়। তার সাথেই মিশে যায়। তার সাথেই ঘুমায়। আহ্ আহ্, বাহ্ বাহ্।
আম্মার আহ্ আহ্ তে আবার তার চমক ভাঙে। কখন যে আম্মার পাশে শুয়ে শুয়েই পুকুরের পানিতে ডুব দিয়েছিল বুঝতেই পারেনি সে। বাবা এসে বলছে মাকে, গাড়ি ঠিক হয়েছে, ঢাকায় যেতে হবে, জলদী তৈরি হয়ে নাও। সন্ধ্যায় ডাক্তার দেখানো হবে। বাহ! ঢাকায় যাওয়া হবে। ঢাকায় ছোট চাচা আছেন না? বাবা প্রায়ই যান। ক’দিন আগে সবাইকে নিয়ে গেছিল। কিন্তু এসে দেখেছে মাছগুলো না খেয়ে রয়েছে। খালি পেট। নাহ্ নাহ্ সে ওদের ছেড়ে যাবে না কিছুতেই। সে তো বুড়ো কাকটাও খবর পায়নি এখনও। মা বলছেন, ভালই হয়েছে, গাড়ি ঠিক করেছো। নৌকা বা স্টীমারে করে গেলে তো তোমার ছোট ছেলে লাফ মেরে নেমে গিয়ে নদীতে নেমে মাছদের বাড়ীতে গিয়ে উঠতো।
করেছে সে কখনো ওটা! নাহ।
তারপরও সবাই ভাবছে সে একদিন মাছগুলোর সাথে ভেগে যেন যাবে।
সে কিছু বলার আগেই মা বলছে, তোর মাছগুলো সব নদীতে, পুকুরে, ক্ষেতে ভাল থাকবে। বকুল দেখে রাখবে। তোর চিন্তার কোন কারণ নেই।
মা তার মনের সব কথা বুঝতে পারে। নাহ্ তারপরও সে যেতে চায় না। ঢাকা শহরে শুধু বাড়ি আর বাড়ি, কোন পুকুর নেই। যাবে না সে। গতবার গিয়ে কত খুঁজেছে মনে মনে, পায়নি। যাবে না। বেকে বসে থাকলো। ঘাড় বাকিয়ে অন্য দিকে চেয়ে বসে থাকলো।
মা বললো, কিরে নিচের দিকে চেয়ে কি করছিস, পিঁপড়ার সাথে কথা বলছিস। আরো ছোট থাকতে তো তুই ওদের বুকে নিয়ে ঈদ মোবারক করতে চাইতি। একবার মাছের সাথে করতে গিয়ে পানিতেই পড়ে গিয়েছিলি। মাছের মায়ের পুত্র শোক একেই বলে বোধ হয়। যা যা, রেডি হতে হবে।
তার চোখ থেকে পানি পড়ছে দেখে আম্মা কি একটু চুপ করলো। সে কাঁদছে দেখলেই আম্মা সাথে সাথে নরম হয়ে যায়। বললো, এই নে পাঁচ টাকা। বিস্কুট কিনে এনে মাছগুলোকে দিয়ে দে। ওরা তাহলে না খেয়ে থাকবে না। মনটা এই না শুনে খুশিতে নেচে উঠলো , তা তা থৈ থৈ। কিন্তু তার তো পায়ে ব্যথা করছে।
ভাইয়ার রুমে এসে দেখলো ভাইয়া যাবার জন্য জিনিসপত্র গুছাচ্ছে। টাকাটা সে ভাইয়ার দিকে বাড়িয়ে দিল শুধু। সে কি চায় এত কথা বলতে তার খুব কান্তি লাগছে। তার কথা বলতে ভাল লাগে না। ওরাই বলে, সে বেশির ভাগ সময় হ্যাঁ না বা মাথা দোলায়। ভাইয়া জানতে চাইছে কি করবে টাকা দিয়ে।
‘তুই যে বাঁশীটা কিনতে চাইতি দোকান থেকে সেটা চাস?’
মাথা দুলিয়ে মশী বলে, না।
‘বেলুন?’
আবারও মাথা নাড়ালো, চায় না।
‘লুডুর বোর্ড?’
‘নাহ্।’
‘বাহ্, এই তো কথার জবাব দিচ্ছিস। সব সময় মুখে কথা বলতে পারিস না?’
আবার মাথা নাড়িয়ে ভাবলো বলবে নাহ্ কিন্তু ডুব দিতে মন চাইলো মাছদের দেশে। হঠাৎ কা কা শব্দে ফিরে চাইলো বড় গাছটার দিকে।
তারপর নীল আকাশে। সেই কাকটা কি এসেছে? বুড়ো কাক।
ভাইয়া ধাক্কা দিচ্ছে কেন তাকে? কি বলছে ভাইয়া। ভাইয়া কিছু বলছে তাকে। ও আচ্ছা মাছদের কথাই তো জানতে চাইছে। তোর মাছগুলোকে দিতে হবে টাকাটা?
বাহ্ বাহ্ ভাইয়া তার কথা বুঝে গেছে। মাছগুলোকে টাকাটা পৌঁছে দিলেই তো তারা কিনে নিতে পারবে যা মন চায় তাদের।
ভাইয়া এটা কি বলছে, পানির নিচে কোন দোকান নেই? ভাইয়া বলছে, আগেও তাকে নাকি বলেছে, মনে নেই কেন তার! কোন বাজারও নেই। ওদের টাকা দিয়ে লাভ হবে না। তাহলে এখন কি হবে? সে অবাক হয়ে ভাইয়ার দিকে চেয়ে থাকে। ভাইয়া বলছে, ‘চিন্তার কারণ নেই। আমি বিস্কুট কিনে তোর বুকলপার কাছে রেখে যাচ্ছি সে প্রতিদিন দিয়ে দেবে।’
এত্ত ভাল কেন ভাইটা তার। সে খুশী মনে দৌড়ে মার ঘরে ফিরে এলো। সে একটা সাদা ঘুড়ি দেখেছিল মুদীর দোকানে। অনেক টাকা দাম। ওটা আর পাবে না কখনোই। ভাইয়াকে সে একদিন বলেছিল ঘুড়ির কথাটা, সাদা রংয়ের ঘুড়িটা কত বড়। দাম যেন কত, ২৫ টাকা মনে হয়। আগেও মা যা টাকা দিয়েছিল সবই তো ভাইয়াকে দিয়ে দিয়েছে মাছগুলোকে দেবার জন্য।
মা-র রুমে এসে দেখে বকুল‘পার মা বসে আছেন। মা-কে সাহায্য করছেন সব গুছাতে। খালা দুঃখ করছে একটা সপ্তাহ পুরো পিছিয়ে যাবে পড়াতে। পরীক্ষা তো এসেই গেল। কি পরীক্ষার কথা বলছে খালা। খালা তাকে দেখে চুপ করে গেলেন। মা বললো, ও কিছু বুঝবে না। বলেই বা ক`টা কথা। ওর জন্যই তো পড়াশুনা। ওকে তো আমাকেই দেখতে হবে হয়তোবা। আমি যে মট্রিক পরীক্ষা দিতে যাচ্ছি এটা দু’কান এই ছেলে করতে পারবে না। আহ্ আগে যদি মন দিয়ে পড়তাম, স্কুলে যেতাম, তাহলে আজকে লুকিয়ে এত কিছু শিখতে হতো না। বাগধারা তো আমার মনেই থাকে না। সারাক্ষণই আওড়াই। মেয়েদের লেখাপড়া শেখা যে কত জরুরি আগে যদি বুঝতাম।
আম্মা তাহলে এ জন্যই কঠিন কঠিন শব্দ উচ্চারণ করছে দিন রাত। লেখাপড়া শিখছে। ভাল ভাল খুব ভাল তো।
‘এই তোর টাকাটা কি করেছিস?’
সে হাত দিয়ে ভাইয়ার রুমটা দেখিয়ে দিল।
‘ভাইকে দিয়ে এসেছিস। কেন?’
বললো শুধু- মাছ।
‘মাছদের জন্য? ফাজলামো নাকি। তোর ভাইও সেটা নিয়ে চম্পট দিয়েছে। দাড়া দেখাচ্ছি মজা।’- ভাইয়াকে মা খুঁজতে গেলো। পাচ্ছে না।
হঠাৎ দেখলো ভাইয়া দৌড়ে এলো কোথেকে যেন, হাতে সেই সাদা ঘুড়িটা। হেসে হেসে বলছে, এই যে মাছেরা তোর জন্য পাঠিয়েছে। তুই যেন খুশী মনে ঢাকায় যাস তাই।
এত্তো খুশি, এত্তো খুশি, খুশিতে ময়ূর হতে ইচ্ছে করলো যেন তার। পেখম মেলবার আগেই দেখলো মা এসে ঠাস করে একটা চড় বসালো ভাইয়ার গালে।
বলছে, ভাইটাকে বুদ্ধু পেয়ে ওর পয়সা মেরে খাস?
মা এসব কি বলছে ভাইয়াকে। তার এত ভাল ভাইটাকে কেন মারছে আম্মা? দাঁতের ব্যথা কি এতই খারাপ। ছুটে গিয়ে সে ভাইকে জড়িয়ে ধরলো, তার ভাইকে সে কিছুতেই মার খেতে দেবে না। আম্মা বলছে, ওর টাকা মেরে দিয়ে নিজের জন্য ঘুড়ি কিনে এনেছো।
‘না, মাছেরা ওর জন্য পাঠিয়েছে। গিফট। ও ঢাকায় যাবে তাই ফেয়ার ওয়েল গিফট।’
আম্মা এবার হঠাৎ চুপ করে গেলো। খালা পেছন থেকে বললেন, আহা, ভাইয়ের জন্য ভাইয়ের কি দরদ। আম্মা মনে হয় পছন্দ করছে না মাছেরা তার জন্য গিফট পাঠিয়েছে এ ব্যাপারটা।
আম্মা বলছে, ‘এই বুদ্ধু ছেলে তো সবখানে যেয়ে যেয়ে বলবে এবার, মাছেরা পাঠিয়েছে ঘুড়ি, লোকে হাসবে তখন।’
ভাইয়া বলছে, ‘ও বলেইবা কটা কথা যে বলে বেড়াবে।’
খালাও বললেন, ‘ঠিকই তো বলেছে সানী।’
আম্মা হঠাৎ ভাইয়াকে আর তাকে জড়িয়ে ধরে বুকে টেনে নিলেন। মাঝে মাঝে কেঁপে কেঁপে উঠছেন। দাঁতের ব্যথায় আহ্ আহ্ করছেন না কাঁদছেন সে ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না। তার মুখটা সে শুধু তার মায়ের পেটের ভেতর গুজে রাখলো। আহা কি যে শান্তি লাগে এভাবে থাকতে মশীর।
আম্মাকেই তার আজ মাছদেরও মা মা মনে হচ্ছে। তার মাছগুলো এখন আর একা নয়। অনেকে আছে।
খালা তার মাথায় হাত রেখে বলছেন, তুমি যদি ভালবাস, তুমিও ভালবাসা পাবে। তুমি করলে সেও করবে। কিছুই বিফলে যায় না সোনা। দেখছো না মাছগুলো কত ভালবেসে উপহার পাঠিয়েছে।