সবুজ বনের ভয়ংকর- এনজেলো! এনজেলো!

সবুজ বনের ভয়ংকর- এনজেলো! এনজেলো!

প্রিয়বর্ধন আমার সঙ্গে এল না। বলল, শয়তান ক্যারিবো আর ওই দুই ওরাংওটাংকে উদ্ধারের একটুও ইচ্ছা আমার নেই জয়ন্ত! ওরা উচিত শাস্তি পেয়েছে। বরং ততক্ষণ আমি মোটরবোটটা মেরামত করতে থাকি।

আমার মন বলছিল, এ দ্বীপে আমি নিরাপদ। এই বিচিত্র সুন্দর বনভূমি আমার অসংখ্য বন্ধুতে ভরা। তারা মানুষের মতো করে কথা না বলতে পারলেও নিজেদের মতো করে কথা বলে। আমার চেতনায় অনুরণিত হচ্ছে তাদের মনের কথা। প্রতি মুহূর্তে টের পাচ্ছি, ওরা বলতে চাইছে, তুমি আমাদের বন্ধু, তুমি আমাদের প্রিয় অতিথি।

এক বিশাল গাছের সামনে দাঁড়িয়ে তার পায়ে হাত রাখলুম। আবার চমকে উঠলুম। যেন কোনও প্রাণীর শরীর। মনে মনে বললুম, আমি কোনও ক্ষতি করতে আসিনি তোমাদের। আমার মনে রোজারিওর গুপ্তধনের বিন্দুমাত্র লোভ নেই।

আশ্চর্য, আমার চেতনায় কী একটা বোধ সঞ্চারিত হল তখনই। যেন এই বৃদ্ধ প্রপিতামহ বৃক্ষের সস্নেহ কিছু আশীর্বাদ বাক্য অস্পষ্টভাবে অনুভব করলুম। তারপর গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে এগিয়ে চললুম বনের ভেতর দিয়ে। আমার সাহস চতুগুণ বেড়ে গেল।

কিছুক্ষণ পরে কেউ সামনের দিক থেকে হঠাৎ খুব চাপা গলায় ফিসফিস করে বলে উঠল, এনজেলো! এনজেলো অমনি থমকে দাঁড়ালুম। কিন্তু কাউকে দেখতে পেলুম না।

সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ে গেল, কাপ্তেন জর্জ ব্যুগেনভিলিও ঠিক এই ডাক শুনেছিলেন কিওটা দ্বীপে। তাহলে এও প্রাচীন যুগের সম্ভবত কোনও নাবিকেরই কণ্ঠস্বরের ভূতুড়ে প্রতিধ্বনি। একটু হাসিও পেল। এক রাজার কান দুটো দেবতার অভিশাপে গাধার কানে পরিণত হয়েছিল। নাপিত ব্যাপারটা টের পেয়েছিল। কিন্তু কাউকে বললেই তো গর্দান যাবে। শেষে মাঠের মধ্যে গর্ত খুঁড়ে ফিসফিস করে বলেছিল, রাজার কান দুটো গাধার! কিছুকাল পরে সেখানে গজালো একটা নলখাগড়ার ঝোপ। আর বাতাস বইলেই সেই ঝোপ থেকে ফিসফিস করে উচ্চারিত হত, রাজার কান দুটো গাধার! প্রাচীন এশিয়া মাইনরের হিটাইট দেশের মিতান্নি গোষ্ঠীর রাজা মিদাসের গল্প এটা। কিং মিদাস হ্যাজ অ্যাসেস ইয়ারস! নলখাগড়ার ঝোপটা ফিসফিস করে বাতাসের সুরে ঘোষণা করত।

তাহলে বোঝা যাচ্ছে, উদ্ভিদের এই বেয়াড়া স্বভাবের কথা যেন প্রাচীন যুগের মানুষরাও অন্তত আঁচ করতে পেরেছিল।

কিন্তু আরও কিছুটা এগিয়ে আবার সামনে থেকে কেউ ফিসফিসিয়ে উঠল, এনজেলো! এনজেলো। কাম অন! কাম অন!

আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল, কে তুমি ডাকছ এনজেলো বলে? আমি এনজেলো নই।

এনজেলো! ফলো মি।

কেউ এনজেলোকে বলছে, আমাকে অনুসরণ করো। আমি অবাক হয়ে হাঁটতে থাকলুম। কথাগুলো ক্রমশ আমার আগে-আগে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে কিছুক্ষণ অন্তর-অন্তর। মন্ত্রমুগ্ধের মতো চলেছি। একটু পরে টিলা পাহাড়ের কাছে পৌঁছলুম। সামনে একটা ফাটল। ফাটলের দুধারে কেয়াগাছের মতো দেখতে একরকম গাছ সারবেঁধে দাঁড়িয়ে আছে। মনে হল, ওই গাছগুলোর ভেতর থেকে এনজেলো বলে ডাক ভেসে আসছে। এবার গা ছমছম করতে থাকল। এ যেন শেষ পর্যন্ত ভৌতিক ঘটনা হয়ে যাচ্ছে। কোনও অশরীরী মানুষ যেন আমাকে এনজেলো ভেবে কোথায় ডেকে নিয়ে চলেছে।

আবার ইংরেজিতে সেই অশরীরী ফিসফিসিয়ে বলে উঠল : এনজেলো, আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করছি। চলে এসো!

পেছন ফিরে বনভূমির দিকে তাকালুম। মনে বললুম, খাব কী? আগের মতোই আমার চেতনার ভেতর সূক্ষ্ম তরঙ্গের মতো এক বোধ সঞ্চারিত হল। ঠিক বুঝিয়ে বলতে পারব না,

শুধু বুঝলুম, আমাকে যেতে হবে! তখন হনহন করে সেই ফাটলের ভেতর দিয়ে চলতে শুরু করলুম।

আন্দাজ কুড়ি-পঁচিশ মিটার পরে দেখি একটা গুহার মুখ। মুখের ওপর ঘন লাতাপাতার ঝালর পর্দার মতো ঝুলছে। অসংখ্য ফুল ফুটে রয়েছে নানা রঙের। সুগন্ধে মউ মউ করছে। এ জায়গাটা বেশ চওড়া। একটা ঝাকড়া গাছ যেন সূকুটি-কুটিল অজস্র চোখ দিয়ে আমাকে দেখছে। সাবধানে এগিয়ে ঝালরগুলো দুহাতে সারালুম। গুহার ভেতর ঘন অন্ধকার থমথম করছে। ভূতগ্রস্তের মতো আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল, আমি এসেছি—আমি এনজেলো দস সান্তোস!

পরক্ষণে চমকে উঠলুম। এ আমি কী বলছি? আমার মুখ দিয়ে কার হয়তো পুরো নাম বেরিয়ে গেল—যাকে আমি চিনি না। জানি না। তার সঙ্গে আমার যুগের ব্যবধানও বিরাট। অথচ এনজেলো দস সান্তোস নামে সম্ভবত কোনও পর্তুগিজ নাবিকের নাম আমি উচ্চারণ করে ফেলেছি। কিন্তু এও বুঝতে পারছি যে এনজেলোকে ডেকে এখানে আনতে চাইছিল, সে ইংরেজ। কে সে?

এরপর আমার চেতনা যেন দুটো ভাগে ভাগ হয়ে গেল। একই শরীরে জয়ন্ত এবং এনজেলো কী করছে। ঠিক এভাবেই ব্যপারটা ব্যাখ্যা করা যায়।

হলফ করে বলতে পারি। ওই অন্ধকার গুহায় আমি কিছুতেই ঢুকতে পারতুম না। কিন্তু আমার আত্মায় এনজেলোর আত্মা ভর করেছে। আমি ঢুকে গেলুম ভেতরে। একটু পরে দৃষ্টি পরিষ্কার হল। ওদিকে কোনও ফাটল দিয়ে আলো আসছিল। প্রথমেই চোখে পড়ল দুটো গাছের ডাল আড়াআড়ি বেঁধে ক্রস গড়া হয়েছে এবং সেটা পোঁতা আছে গুহার মেঝেতে। নিশ্চয় একটা কবর। কবরের ওপর আবছা আলো এসে পড়েছে সরু ফাটল থেকে। তাই এক টুকরো তক্তা নজরে পড়ছিল। সেটা কবরে ক্রসের সঙ্গে ঠেস দিয়ে দাঁড় করানো আছে। তাতে খোদাই করা আছে বড় বড় আঁকাবাঁকা হরফে :

ক্যাপ্টেন রোজারিও এনড্রস স্মিথ
মৃত্যু ১৬ জুন, ১৫৯১

ফলকটা তুলে ধরে পড়ছিলুম। সেই সময়, গুহায় যে দিক থেকে ঢুকেছি, তার উল্টোদিকে ফাটল থেকে আসা আলোয় একঝাক ব্যুমেরাং গড়নের সেই কাঠপোকাগুলোকে লাফিয়ে লাফিয়ে আসতে দেখলুম। আমার পায়ের কাছ দিয়ে ওরা লাফাতে লাফাতে গুহার দরজার দিকে চলে গেল। তারপর টের পেলুম ওদের পালিয়ে আসার কারণ। সঙ্গে সঙ্গে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে গেলুম।

হনহন করে এগিয়ে আসছিল কেউ। ফাটলের আলোর কাছে সেও দাঁড়িয়ে গেল। কিন্তু ও কি মানুষ?

হ্যাঁ, মানুষই বটে। কারণ, আমার মতোই তার একটা মাথা, দুটো হাত, দুটো পা আছে। কিন্তু পরনে মাছের প্রকাণ্ড আঁশের মতো পাতার পোশাক যেন—পাতাবাহারের লাল-হলুদ চকরাবকরা রং ওই পাতাগুলোর। গলার কাছ থেকে পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত এই বিচিত্র পোশাক। দুটো বাহু এবং পা খালি। সবচেয়ে অদ্ভুত ওর গায়ের রং। খসখসে সবুজ।

মুখটাও সবুজ। ভুরু ও চোখের পাতা খয়েরি রঙের। চোখের তারা লালচে, বাকি অংশ ছাই রঙের। তার মাথার ঝাঁকড়া চুলগুলো অবিকল উদ্ভিদের গুচ্ছ মূল যেন, —চুলের রং মেটে।

সেই অদ্ভুত মানুষটা নিষ্পলক তাকিয়ে আমাকে দেখছে।

আমি হতবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলুম। তারপর মুখে হাসি ফুটিয়ে সম্ভাষণের ভঙ্গিতে একটু হাসলুম। তখন তার মুখেও হাসি ফুটে উঠল। সেও মাথাটা একটু দোলাল।

এবার আমি আমার জানা কয়েকটা ভাষায় তাকে জিগ্যেস করলুম, কে তুমি? কিন্তু মনে হল, আমার কথা সে বুঝতে পারছে না। অথবা সে বোবা।

তারপর সে আমাকে হাতের ইশারায় তার সঙ্গে যেতে বলে যেদিক থেকে এসেছে, সেইদিকে পা বাড়াল। মনে অস্বস্তি নিয়ে তাকে অনুসরণ করলুম। একটু এগিয়ে গুহার অন্য মুখে পৌঁছলুম। এ মুখটা বেশ বড়। দেখলুম, মুখের ওপর যে লতার ঝালর ছিল, তা দুপাশে সরিয়ে আটকে রাখা হয়েছে! হয়তো এই সবুজ মানুষটাই এ কাজ করেছে। বাইরে বেরিয়ে জায়গাটা চিনতে পারলুম। কাল আমি ও প্রিয়বর্ধন এই পাহাড়ি-খাতেই এসেছিলুম। অনেক নরকঙ্কাল পড়ে আছে এখানে-ওখানে। কিন্তু কালকের মতো কোনও চেঁচামেচি প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল না। ভীষণ স্তব্ধ হয়ে আছে পরিবেশ। সবুজ মানুষ আমাকে ইশারা করল ডাইনে খুব সংকীর্ণ একটা খাতের ভেতর যেতে।

সেই খাতের ভেতর কিছুটা যাওয়ার পর এক অভাবিত দৃশ্য চোখে পড়ল।

আমাদের সামনে নিচে চওড়া অর্ধবৃত্তাকার একটা বেলাভূমি। সেখানে একদল এমনি রঙিন পাতার পোশাকপরা সবুজ মানুষ কী যেন করছে। তাদের হাতে গাছের ডাল। একটা প্রকাণ্ড পাতাশূন্য ডাল মাঝখানে পোঁতা আছে।

তারপরেই চোখে পড়ল জলের ধারে চার-পাঁচখানা ছিপ নৌকা।

সঙ্গে সঙ্গে আমার মাথা পরিষ্কার হয়ে গেল। বুঝতে পারলুম, এই সবুজ মানুষরা আসলে আমার মতোই মানুষ। তারা গায়ে রং মেখে চোখ-ভুরু এঁকে এই দ্বীপে এসেছে কোনও উৎসব বা পুজোআচ্চা করতে। এরা কোনও দ্বীপের অধিবাসী তাতে সন্দেহ নেই। ওই নৌকায় চেপেই ওরা এসেছে।

এটা কিওটার উত্তর-পশ্চিম দিক। দূরে খাড়া দাঁড়িয়ে আছে প্রবাল পাঁচিল। তাহলে এরা ঢুকল কোন্ পথে? পুবদিকের প্রবাল বলয়ের ভাঙা জায়গাটা ছাড়া এ-দ্বীপে আসার পথ তো নেই।

আমার প্রশ্নের জবাব তখনই মিলে গেল। ঢোলের শব্দ ভেসে এল এবং তারপর আতঙ্কে চেয়ে, দেখলুম, ডানদিকের পাহাড়ে সেই ঝরনার পাশ দিয়ে ধাপে ধাপে আরও একদল সবুজ রং মাখা মানুষ কাকে বেঁধে কাঁধে বয়ে আনছে। বিচে নামার সঙ্গে সঙ্গে চিনতে পারলুম বেচারা প্রিয়বর্ধনকে।

আমার প্রথম প্রতিক্রিয়া হল পালিয়ে যাওয়ার। কিন্তু আমার সঙ্গী সেটা আঁচ করেই আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। লোকটার গায়ে অসম্ভব শক্তি। কিন্তু উৎকট দুর্গন্ধেই কাবু হয়ে গেলুম। ওর গায়ের দুর্গন্ধটা নিশ্চয় রঙের কড়া ঝঝ। সে আমাকে মাটিতে পেড়ে দুর্বোধ্য ভাষায় চেঁচিয়ে উঠল। অমনি নিচের বিচ থেকে কয়েকজন ছুটে এল। অসহায় হয়ে ভাগ্যের হাতে নিজেকে সঁপে দিলুম।

প্রিয়বর্ধন চোখ বুজে পড়েছিল পোঁতা ডালটার সামনে। লতা দিয়ে তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে ততক্ষণে বেঁধে ফেলেছে এরা। সে চোখ খুলে আমাকেও একই দশায় দেখে ভীষণ বিপদের মধ্যে করুণ হাসল। তারপর ফিসফিস করে বলল, অন্যদিকে ঘুরে বোট সারাচ্ছি, ব্যাটাচ্ছেলেরা কখন পেছন থেকে এসে…

একটা লোকের মাথায় ফুলের মুকুট। তার হাতে একটা চওড়া কাস্তের মতো বাঁকানো চকচকে অস্ত্র। সে হুমহাম করে গর্জন করে অস্ত্রটা নাড়তেই প্রিয়বর্ধন চুপ করে গেল।

বালির ওপর অসংখ্য ফুল ছড়ানো আছে। সবুজ রং মাখা লোকগুলো বিকট নাচতে লাগল তার ওপর। ঢোল বাজছিল। সেটা দ্বিগুণ জোরে বাজতে লাগল। তারপর ওরা দুর্বোধ্য ভাষায় গান গাইতে শুরু করল।

মাথার ওপর সূর্য। বালি তেতে উঠছিল ক্রমশ। অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছিল—লতা দিয়ে এমন শক্ত করে আমাদের বেঁধেছে যে রক্তস্রোত বন্ধ হয়ে গেছে যেন।

তাদের নাচগানবাজনা ক্রমশ চরমে পৌঁছল। মাঝেমাঝে জ্ঞান হারিয়ে ফেলছিলুম। এইভাবে কতক্ষণ কাটল জানি না, একসময় দেখি, ওরা আমাকে আর প্রিয়বর্ধনকে বয়ে নিয়ে চলেছে। ঠাহর করে বুঝলুম, সেই পাহাড়ি খাতের ভেতর দিয়ে আমাদের নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।

সেই গুহার প্রকাণ্ড মুখের সামনে ওরা আমাদের নামিয়ে দিল। তারপর দুজনকেই উপুড় করে শোওয়াল। বেশ বুঝলুম, এবার আমাদের মাথাটা কাটা হবে। আমরা কিওটা দ্বীপের বৃক্ষদেবতার বলি হব। ভাবলুম, প্রিয়বর্ধনকে মৃত্যুর মুহূর্তে শেষ বিদায় জানাই। কিন্তু কথা বেরুল না। তালু শুকিয়ে গেছে। কথা বলার শক্তিটুকুও আর নেই। তখন চিন্তা করলুম,

ওই কাস্তের মতো বাঁকা অস্ত্রটা দিয়ে নিশ্চয় পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে গলাটা কাটবে ওরা, যন্ত্রণাটা কতখানি হতে পারে।

এখন কিন্তু ঢাক বাজছে না। কেউ কথা বলছে না। আড়চোখে যতটা দেখা যায়, লোকগুলোর হাবভাবে চঞ্চলতা আঁচ করা যাচ্ছিল। একজন আমার এবং আরেকজন প্রিয়বর্ধনের পাশে বসে পড়ল।

হঠাৎ আমার মস্তিষ্কে বিদ্যুতের গতিতে একটা বোধ দেখা দিল। এ-দ্বীপের কৃষকবন্ধুদের এ বিপদে ডাকছি না কেন? সেই মুহূর্তে তখনকার মতোই আমার আচ্ছন্ন চেতনা থেকেই যেন সাড়া এল। অনেক কষ্টে ফিসফিস করে বলে উঠলুম, আমি এনজেলো দস সান্তোস! আমাকে বাঁচাও?

অমনি গুহার দিক থেকে ঝড়বাতাসের শব্দের মতো শব্দে উচ্চারিত হল : এনজেলো! এনজেলো! এনজেলো!

আমাদের পাশে বসে থাকা লোকদুটো তড়াক করে উঠে দাঁড়াল সঙ্গে সঙ্গে। এনজেলো শব্দটা ক্রমশ বাড়ছিল। মনে হচ্ছিল ঝড় বইতে শুরু করেছে এনজেলো শব্দের।

তারপর শোনা গেল সেই প্রতিধ্বনি : স্টপ ইট! স্টপ ইট! আই সে স্টপ ইট! উঁচু পাহাড়ের দেওয়ালে সেই ভীষণ চিৎকার বিকট প্রতিধ্বনি তুলল। আই কিল ইউ। কিল…কিল…কিল! তারপর হেল্প! হেল্প! হেল্প!

দড়বড় দড়বড় শব্দ করে সবুজ রং মাখা পাতার পোশাক-পরা আদিম লোকগুলো ততক্ষণে উধাও। চেঁচামেচি থামলে মুখ অতিকষ্টে ঘুরিয়ে দেখি, জনপ্রাণীটি নেই। আর সামান্য তফাতে সেই কাস্তের মতো বাঁকা অস্ত্রটা পড়ে আছে। বুঝলুম, দেবতা বলি খেতে চায়নি বলে কিংবা ঘাতকের চোটে ব্যাটাচ্ছেলেরা অস্ত্রটা ফেলেই পালিয়ে গেছে। আমার গলায় এতক্ষণে জোর ফিরে এল। শরীরেও।

কিন্তু প্রিয়বর্ধনকে ডেকে সাড়া পেলুম না। গড়াতে গড়াতে অস্ত্রটার কাছে গেলাম। তারপর ওটার বাঁট কামড়ে চিত করে দুটো পাথরের মাঝখানে বসালুম। ঠোঁট কেটে গেল একটু। এবার কাত হয়ে অস্ত্রটার ডগায় হাতের বাঁধনটা ঘষতে থাকলুম। বাঁধন কেটে গেল। এবার আর অসুবিধে হল না।

একটু পরে প্রিয়বর্ধনের বাঁধন কেটে তাকে চিত করে দিলুম। সে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে বলল, আমি বেঁচে আছি, মরে গেছি?

বেঁচে আছে। ওঠো। প্রিয়বর্ধন তবু সন্দিগ্ধভাবে বলল, আমার ধড়টা কোথায়? যথাস্থানে আছে। উঠে পড়ো। আমার খিদে পেয়েছে।

ওকে টেনে ওঠালুম। ও কিছুক্ষণ হাত-পা ছোড়াছুড়ি করে এবং লাফালাফি করে রক্ত চলাচল ঠিক করে নিল। তারপর একটু হেসে বলল, তুমি তো জয়ন্ত। কেন বলছিলে আই অ্যাম এনজেলো দস সান্তোস? এনজেলো শুনেছি কাপ্তেন রোজারিওর ছেলের নাম ছিল। ওর বউ ছিল পর্তুগিজ।

বললুম, ওসব পরে শুনব। এখন চলো, খিদে পেয়েছে।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত