ক্যারিববার চোখের ভেতর হিংসা যেমন, তেমনি লোভও ঝকমক করতে দেখছিলুম। সে আমাদের মেরে ফেলবে ঠিকই, কিন্তু তার আগে জেনে নিতে চায়, আমারা গুপ্তধনের খোঁজ পেয়েছি কি না। পেয়ে থাকলে ওকে আর কষ্ট করতে হবে না এবং আমরা সেখানে তাকে পৌঁছে দেওয়া পর্যন্ত সে আমাদের বাঁচিয়ে রাখবে।
তাই একটু হেসে বললুম, ক্যারিবো রোজারিওর গুপ্তধন যেখানে পোঁতা আছে, সেখানে যাওয়ার অনেক বিপদ।
ক্যারিবো আমার পাশে হাঁটু দুমড়ে বসে হিস হিস করে বলল, বাজে কথা রাখো। খোঁজ পেয়েছ কি না জানতে চাই। যদি পেয়ে থাকো, তোমার অন্তত বাঁচার আশা আছে। তবে ওই নচ্ছার বিশ্বাসঘাতকটাকে মেরে ফেলব। ডাইনির দ্বীপের একটা গাছে রবারের ভেলা টাঙানো আছে। দেখেই বুঝেছিলুম, কে আমাদের মোটরবোট চুরি করে পালিয়েছে। যাই হোক, সে-সব কথায় লাভ নেই। বলো, গুপ্তধনের খবর কী?
বললুম তো! সেখানে কোনও মানুষ যেতে পারে না।
কেন?
রোজারিও আর তার স্যাঙাতদের আত্মা সেই ধন পাহারা দিচ্ছে। তুমি কি এই দ্বীপে পৌঁছে তাদের চিৎকার শোনোনি?
ক্যারিবো একবার ভয়ের চোখে বিচের ওপরদিকটা দেখে নিয়ে বলল, শুনেছি। কিন্তু ভয় পাইনি। কারণ তখনই দেখতে পেলুম, তোমরা দুজনে দিব্যি আস্তেসুস্থে হেঁটে আসছ। তোমাদের যখন বিপদ হচ্ছে না, তখন আমাদেরও হবে না ভাবলুম।
তারপর আমাদের ঢিট করার জন্য পাথরের আড়ালে লুকিয়ে রইলে!
ক্যারিববা ধমক দিয়ে বলল, ন্যাকামি ছাড়ো। চলো কোথায় আছে রোজারিওর সোনাদানা? হাসতে হাসতে বললুম, কিন্তু এখন তো দিন ফুরিয়ে গেল। রাতে সেখানে যাবে কেমন করে? সকাল হতে দাও, তবে তো।
ক্যারিবো কথাটা তলিয়ে দেখে বলল, ঠিক আছে। সকালেই যাব। কিন্তু জায়গাটা কতদূর?
পশ্চিম প্রান্তে। পাহাড়ি খাদের ভেতর। সেখানে অজস্র নরকঙ্কাল আর খুলি পড়ে আছে। তারা কিন্তু জীবন্ত মানুষ দেখলেই—
আমার কথা শেষ হবার আগেই উংচু ভয়ার্ত স্বরে বলে উঠল, কর্তা! কর্তা! ওই শুনুন কে বাজনা বাজাচ্ছে আবার!
ক্যারিববা তাকে ধমক দিয়ে বলল, তুই জানিস না ব্যাটা, কিওটা দ্বীপের গাছপালা গান গায় আর বাজনা বাজায়?
ফুতাং ফিক করে হেসে বলল, শুনেছি, ওরা ধেই ধেই করে নাচেও।
ক্যারিবো আমাকে বলল, কী হে বাঙালিবাবু? গাছের নাচ দেখতে পাওনি?
বললুম, দেখিনি। তবে অসম্ভব নয়। একটা ক্যাকটাসকে তখন হেঁটে বেড়াতে দেখেছিলুম। কাজেই নাচতেও অসুবিধে কিসের? যাই হোক, ক্যারিববা! গুপ্তধনের জায়গায় তোমাকে নিয়ে যাব বলেছি—ঠিকই নিয়ে যাব। কিন্তু তার বদলে এই কি তোমার অতিথি সৎকারের নমুনা? আমাদের অন্তত এককাপ করে কফি খাওয়াও।
ক্যারিবো অচৈতন্য প্রিয়বর্ধনের দিকে তাকিয়ে বলল, হতচ্ছাড়াটা তো দেখছি ভিরমি খেয়ে পড়ে রইল। ওহে ফুতাং বেঁচে আছে তো?
ফুতাং বলল, আছে কর্তা। পিট পিট করে তাকাচ্ছে!
ক্যারিবো উঠে দাঁড়াল। উংচু, ফুতাং! তোরা এবার বোটটা এখানে টেনে নিয়ে আয়। খাবার দাবার, তাঁবু সব কিছু ওতে রয়ে গেছে। এখানে না আনলে মেরামত করব কেমন করে?
ওরা দুজনে পোশাক খুলে সাঁতারু সেজে জলে নামল। গোধূলির আলো তখনও ফুরিয়ে যায়নি। প্রবাল পাঁচিলের দিকে ওরা সাঁতার কেটে এগিয়ে গেল।
ক্যারিবো প্রিয়বর্ধনের ঘাড় ধরে টেনে বসিয়ে দিল। প্রিয়বর্ধন ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল আমার ও ক্যারিবোর দিকে। ওর কাছে গিয়ে বললুম, যা হওয়ার হয়ে গেছে। ক্যারিবোর সঙ্গে মিটমাট করে নাও। তোমাকে গুপ্তধনের জায়গায় পৌঁছে দিলে আমাদের ছেড়ে দেবে ক্যারিবো?
প্রিয়বর্ধনকে চোখের ইশারা করতেই সে বুঝে নিল ব্যাপারটা। বলল, ঠিক আছে।
ক্যারিবো খুশির ভাব দেখিয়ে বলল, হ্যাঁ—পৌঁছে দিলেই তোমাদের ছুটি। শুধু তাই নয়, কিছু ভাগও পাবে। এমনকী, রুবি দ্বীপে পৌঁছেও দেব।
আমি যেমন জানি, তেমনি প্রিয়বর্ধনও টের পেল, ক্যারিবো আমাদের কী দশা করবে শেষ পর্যন্ত। বুদ্ধিমান প্রিয়বর্ধন মাতৃভাষায় কথা বলতে শুরু করল ক্যারিববার সঙ্গে। বুঝতে পারছিলুম, সে অনুনয়-বিনয় করে ক্ষমা চাইছে।
অনেক দেরি করে ফিরল ফুতাং ও উংচু। ততক্ষণে এক ফালি চাঁদ উঠেছে। সমুদ্রে ওপর ক্ষীণ জ্যোৎস্না খেলছে। বিচের ওপর সেই বেহালা বাজিয়ে গাছটা মাঝে মাঝে যেন বেহালার ছড়া টেনে করুণ সুর বাজাচ্ছে আবার থেমে যাচ্ছে। মোটরবোটটা টেনে বালিতে তুলল ওরা। ক্যারিবো রিভলভার হাতে নিয়ে আমাদের পাহারা দিচ্ছে। জিনিসপত্র নামিয়ে আনতে হুকুম দিল সে।
একটু পরে বিচের মাথায় উঁচু জায়গায় একটা তাঁবু খাটানো হল। তারপর স্টোভ জ্বেলে কফি বানাল ওরা। ফুতাং রাতের খাবার তৈরি করতে ব্যস্ত হল। বুঝলুম, রীতিমতো তৈরি হয়েই এসেছে। কিন্তু কিওটা দ্বীপের সন্ধান কীভাবে পেল, বুঝতে পারলুম না।
তাই বললুম, ক্যারিবো, কফির জন্য ধন্যবাদ। এবার বলো, কেমন করে তোমরা এ-দ্বীপের খোঁজ পেলে?
ক্যারিবো ধূর্তের হাসি হেসে বলল, তোমরা যেভাবে পেয়েছিলে!
আমরা দৈবাৎ এখানে ভেসে এসেছি, ক্যারিবো। বিশ্বাস করো।
করছি না। কারণ আমি জানি, তোমরা সেই ছোট্ট মূর্তির ভেতর লুকিয়ে রাখা কাত্তির সংকেত সূত্র উদ্ধার করতে পেরেছ। ওতে কিওটা দ্বীপের অক্ষাংশ-দ্রাঘিমাংশ লেখা আছে। তোমরা ভেবেছিলে আমি ভীষণ বোকা। জানো না যে আমি আগেই কাত্তিটার সব চিহ্ন কাগজে কপি করে রেখেছিলুম।
কিন্তু সংকেত সূত্রগুলো তো অর্ধেক মনে হয়েছিল। অন্য কাত্তিটা না পেলে…
আমার কথা কেড়ে ক্যারিবো বলল, না হে বোকারাম! তা নয়। রাজাকো আসল কাত্তিটার একটা নকল বানিয়েছিল। যদি দৈবাৎ একটা খোয়া যায়, অন্যটা থাকবে। ওর টুপির ভেতরকার কাত্তিটা নকল। আসলটা ছিল মূর্তিটার ভেতরে। কাত্তিতে যে চিহ্নগুলো আছে, তার অর্থ কেবলমাত্র জানে অভিজ্ঞ নাবিকরা। কিয়াংয়ের মতো অভিজ্ঞ সমুদ্রচর লোক, কিংবা এই দেখছ আমাকে—আমার মতোও যারা সমুদ্রে ঘোরে এবং অভিজ্ঞ নাবিকদের শাগরেদি করে বড় হয়েছে, তারা সবাই ওইসব চিহ্নের অর্থ বোঝে। কিন্তু বরাত মন্দ, পৌঁছুলুম বটে কিওটায়, মোটরবোটটা কোরাল রিবে (Coral Reeb) ধাক্কা খেয়ে বিগড়ে গেল। দেখা যাক, সারাতে পারি নাকি। তবে তার আগে রোজারিওর গুপ্তধন তো আগে হাতাই। তারপর দেখা যাবে।…
রোজারিওর গুপ্তধনের লোভে ক্যারিবো আমাদের এ-রাতে এত খাতির করছিল কহতব্য নয়। খাবারের ভাগ দিয়ে তো বটেই, আরও খিদে আছে কি না জিগ্যেস করে আতিথেয়তার চূড়ান্ত করল।
আমাকে ও প্রিয়বর্ধনকে দক্ষিণী মহাসাগর এলাকার নাবিকদের প্রিয় কড়া সিগারেটের প্যাকেট পর্যন্ত উপহার দিল। কিন্তু আমরা দুজনেই জানি, শয়তানটার মনে কী ক্রুর মতলব খেলা করছে।
প্রবাল বলয়ের দিকটা জ্যোৎস্নায় কালো পাঁচিলের মতো দেখাচ্ছিল। দূর থেকে আছড়ে পড়া জলের চাপা গর্জন কানে আসছিল। আমাদের পেছনে কোথায় সেই বেহালা বাজিয়ে গাছটা ঘুমঘুম সুরে বেহালা বাজাচ্ছিল। ক্যারিববা আমাদের দুজনকে ফুতাং ও উংচুর কড়া পাহারায় রেখে ছোট্ট তাঁবুর ভেতর ক্যাম্পখাটে নাক ডাকিয়ে ঘুমোচ্ছিল। আমার চোখে ঘুম নেই। প্রিয়বর্ধনেরও নেই। দুজনে পাশাপাশি চিত হয়ে তাঁবুটার সামনে বালির ওপর শুয়েছিলুম। আমাদের দুপাশে দুই প্রহরী বসে সেই বিচ্ছিরি কড়া সিগারেট টানছিল আর চাপা গলায় নিজেদের মাতৃভাষায় কথা বলছিল।
এমন সময় কী একটা শব্দ হল। খসখস শব্দ। মুখটা সাবধানে ঘুরিয়ে দেখি, ক্যারিববার তাঁবুর পাশে কালো ঝোপ মতো—কোনও জন্তু নয় তো? কিওটায় এ পর্যন্ত ময়াল সাপ ছাড়া কোনও জন্তু দেখিনি। নাকি সত্যি একটা ঝোপ?
কিন্তু কাছাকাছি কোথাও ঝোপও তো দেখিনি। জায়গাটা অনেকটা খোলামেলা। তাহলে ওটা কী হতে পারে! নিশ্চয় কোনও জন্তু। প্রহরীরা আপন কথায় ড়ুবে আছে। একটু পরে দেখলুম, কালো জিনিসটা নড়ে উঠল এবং এগিয়ে আসতে থাকল। জ্যোৎস্না এতক্ষণে পরিষ্কার হয়েছে। এবার স্পষ্ট দেখতে পেলুম, দিনে যে ক্যাকটাসকে হেঁটে বেড়াতে দেখেছি, এটা সেই চলমান উদ্ভিদই বটে। খসখস শব্দে প্রহরীদের চমক জাগল। তারা যেই ঘুরেছে, অমনি সেই ক্যাকটাস-জন্তু (!) অক্টোপাসের অথবা মাকড়সার মতো একগুচ্ছের শুড় বাড়িয়ে উঁচু ও ফুতাংকে জড়িয়ে ধরল। দুজনেই বিকট শব্দে চেঁচিয়ে উঠল। ক্যারিবোর ঘুম ভেঙে গেল। সে লাফ দিয়ে বেরিয়ে এল। তার হাতে টর্চ ছিল। টর্চের আলোয় দেখল, অদ্ভুত ক্যাকটাস-মাকড়সা উংচু ও ফুংকে নিয়ে খসখস আওয়াজ করতে করতে এগিয়ে চলেছে। ক্যারিবো বিস্ময়ে আতঙ্কে এমন হকচকিয়ে গেল যে টর্চ জ্বেলে দাঁড়িয়ে আছে তো আছেই।
আমি ও প্রিয়বর্ধন উঠে বসেছিলুম। প্রিয়বর্ধন কী বলে চেঁচিয়ে উঠল। নিশ্চয় গুলি ছুড়তে বলল ক্যারিবোকে। কারণ তারপরই ক্যারিববা রিভলভার উঁচিয়ে গুলি ছুড়তে ছুড়তে তাড়া করল।
কিন্তু আশ্চর্য, ক্যাকটাস-মাকড়সার গায়ে যেন গুলি বিধছে না। ক্যারিববার টর্চটা উত্তেজনার ফলে হাত থেকে পড়ে গিয়ে নিবে গেছে। প্রিয়বর্ধন দৌড়ে গিয়ে টর্চটা তুলে নিল। কিন্তু সেই মুহূর্তে কোথা থেকে আরও কয়েকটা ক্যাকটাস-মাকড়সা খসখস শব্দ করতে করতে ক্যারিববাকে ঘিরে ফেলল। তারপর আর ক্যারিববাকে দেখতে পেলুম না। বিচিত্র উদ্ভিদ-প্রাণীর দল ব্যুহের ভেতর ঘিরে ওকে নিয়ে চলেছে। সেই দৃশ্য দেখে প্রিয়বর্ধনের হাতে টর্চ নিভে গেল এবং সে ঠক ঠক করে কাঁপতে কাঁপতে বলল, জয়ন্ত! জয়ন্ত! ডাইনিরা ওদের ধরে নিয়ে গেল।
বললুম, তাহলে এবার আশা করি, তুমি বুঝতে পেরেছ, গুপ্তধনের ললাভের শাস্তি পেল ওরা।
প্রিয়বর্ধন দিব্যি কেটে বলল, তুমি ঠিকই বলেছ জয়ন্ত! আমার আর গুপ্তধনের লোভ করা উচিত নয়।
তাঁবুর কাছে ফিরে এসে বললুম, যাক গে। কিওটা থেকে ফেরার আর চিন্তা রইল না। মোটরবোটটা যদি তুমি মেরামত করতে পারো, আমরা সমুদ্র পাড়ি দেব।
তাঁবুর সামনে স্টোভ জ্বেলে আমরা আবার কফি তৈরি করলুম। কফি খেতে খেতে জ্যোৎস্নাভরা বনভূমির দিকে তাকিয়ে দেখলুম, একটু আগের সেই বিভীষিকার কোনও আভাস নেই। বেহালা বাজিয়ে গাছটা একলা দাঁড়িয়ে কোথায় আপন মনে বেহালা বাজাচ্ছে। চারদিকে ঘুমঘুম আচ্ছন্নতা। কফি খেয়ে প্রিয়বর্ধন ভয়মাখানো গলায় বলল, জয়ন্ত, আমরা বরং পালা করে পাহারা দিই। যদি ওই ভূতুড়ে ক্যাকটাসগুলো আমাদেরও বন্দি করে নিয়ে যায়?
ওকে অশ্বাস দিয়ে বললুম, প্রিয়বর্ধন, কিওটার উদ্ভিদেরা মানুষের মনের কথা যেন টের পায়। আমাদের মস্তিষ্কের চিন্তাতরঙ্গ হয়তো ওদের স্নায়ুতে প্রতিধ্বনি তোলে। আমরা যদি এ-দ্বীপে কোনও খারাপ মতলব না আঁটি, ওরা আমাদের ক্ষতি করবে না। এস, আমরা আরাম করে ঘুমোই।…
এরাতে কোনও বিপদ ঘটল না। কখন একবার কিছুক্ষণের জন্য ঘুম ভেঙে কানে এসেছিল, কারা যেন দূরে মধুর সুরে গান গাইছে। এমন অপার্থিব সঙ্গীত পৃথিবীর মানুষের কণ্ঠে শোনা অসম্ভব। জ্যোৎস্নারাতে কিওটার বনভূমিতে বিশ্বপ্রকৃতি নিজের হৃদয় খুলে দিয়েছে যেন।
শেষ রাতে একবার যেন শুনলুম, কে কোথায় খিলখিল করে হেসে উঠল—যেন মেয়েদেরই হাসি। স্বপ্নও হতে পারে। বাস্তবও হতে পারে। পুরুষ উদ্ভিদের মতো মেয়ে উদ্ভিদও তো আছে।
সকালে ক্যারিবোরা প্রচুর খাদ্যদ্রব্য, দড়িদড়া, শাবল, হাতুড়ি, এমনকী একটা বেতার ট্রান্সমিশন সেট পর্যন্ত নিয়ে এসেছে দেখে খুব আনন্দ হচ্ছিল। প্রিয়বর্ধন যতক্ষণ ব্রেকফাস্ট তৈরি করছিল, ততক্ষণ আমি ওই বেতার যন্ত্রটাকে চালু করার চেষ্টা করছিলুম। চালু হতেই রিসিভিং কেন্দ্রে অস্পষ্টভাবে দুর্বোধ্য ভাষায় কোন কেন্দ্রের ব্রডকাস্টিং ভেসে এল। প্রিয়বর্ধন নেচে উঠল তার মাতৃভাষা শুনে। বলল, সিঙ্গাপুর কেন্দ্রে খবর হচ্ছে। নব ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে একটা করে কেন্দ্রের সাড়া পায় আর সে চেঁচিয়ে ওঠে উত্তেজনায়। মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া বা দক্ষিণ এশিয়ার বহু ভাষা সে জানে। কিছুক্ষণ পরে সে কোন্ কেন্দ্র থেকে কান করে কিছু শোনার পর দম আটকানো গলায় বলে উঠল, জয়ন্ত জয়ন্ত! তোমার খবর হচ্ছে। রুবি আইল্যান্ডের নৌবাহিনীর ব্রডকাস্টিং সেন্টার থেকে জাহাজগুলোকে জানিয়ে দিচ্ছে তোমার নিরুদ্দেশের খবর। কিন্তু আমার কথা তো কেউ বলছে না!
এই বলে সে ফ্যাচ করে নাক ঝেড়ে কেঁদে ফেলল। তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বললুম, ভেবো না প্রিয়বর্ধন। আমার উদ্ধার হলে তোমারও হবে। তাছাড়া মোটরবোটটা তো আছেই। বরং এবারে ট্রান্সমিশন চালু করে আমরা খবর পাঠাই বিভিন্ন ওয়েভলেন্থে। কোনও-না-কোনও কেন্দ্রে তা ধরা পড়বেই।
এদিন দুপুর পর্যন্ত ওই নিয়ে ব্যস্ত থাকলুম দুজনে। কখনও আমি ইংরেজিতে, কখনও প্রিয়বর্ধন বিভিন্ন ভাষায় বিভিন্ন ওয়েভলেন্থে জানাতে থাকলুম, আমরা জয়ন্ত চৌধুরি আর পিওবেদেনে এই দুজন লোক কিওটা দ্বীপে আছি। অক্ষাংশ-দ্রাঘিমাংশ জানা নেই। তবে ডাইনির দ্বীপ থেকে আন্দাজ সাতশো নটিক্যাল মাইল দক্ষিণ-পশ্চিমে এটা একটা বলয়দ্বীপ। আমাদের উদ্ধার করো।
কোনও জবাব পাচ্ছিলাম না। মাত্র একবার সম্ভবত কোনও এমেচার বা শৌখিন বেতার ট্রান্সমিশন যন্ত্রের মালিক বলে উঠল, কিওটা? ফকুরি করা হচ্ছে? শোনো, ওই রসিকতা আমিও করে ভীষণ বিপদে পড়েছিলুম। নৌবাহিনীর গোয়েন্দারা এসে আমাকে ধরে বেদম ঠেঙিয়েছিল। সাবধান!
তাকে ব্যাকুলভাবে বোঝানোর চেষ্টা করলেও কাজ হল না। সরকারি কেন্দ্রের ওয়েভলেন্থে আমরা ধরতে পারছিলুম না। কিন্তু ধরতে পারলে তারাও হয়তো মস্করা ভেবে উড়িয়ে দেবে। শেষে হতাশ হয়ে বললুম, যাক গে। চলো প্রিয়বর্ধন, ক্যারিবো বেচারাদের খোঁজে বেরোই। হাজার হোক, ওরা মানুষ তো!