সেদিন দুপুর অব্দি প্রিয়বর্ধন স্বপ্ন স্বপ্ন করেই কাটাল! তার পাগলামি দেখে হাসি পাচ্ছিল। সে এই উৎকট স্বপ্ন ভাঙিয়ে দেওয়ার জন্য আমাকে তার গায়ে চিমটি কাটতে বলেছিল। নিজেও চেষ্টা করছিল স্বপ্নটা যাতে ভাঙে। নিজের মাথায় চাঁটি মেরে, কখনও ডিগবাজি খেয়ে, কখনও বা গাছের গুড়িতে ঢু মেরে সে একসময় বাচ্চা ছেলের মতো ভ্যা করে কেঁদেও ফেলল।
তখন আর চুপ করে থাকতে পারলাম না। হাসতে হাসতে বললাম, প্রিয়বর্ধন, তুমি কি এখনও টের পাচ্ছ না যে ব্যাপারটা স্বপ্ন নয় বাস্তব।
প্রিয়বর্ধন চোখ মুছে নাক ঝেড়ে বলল, অসম্ভব! জয়ন্ত, আমরা হয়তো আসলে কোনও ডাইনির দ্বীপে এসে পড়েছি। এসবই তার জাদুর খেলা। এরপর মন্ত্রবলে ডাইনিটা হয়তো আমাদের ওইরকম গাছপালা করে ফেলবে। আমাদের আর মানুষ হয়ে দেশে ফেরা হবে না।
প্রিয়বর্ধন, তুমি কান করে শোনো তো! বেহালার মতো সুর শুনতে পাচ্ছ না?
প্রিয়বর্ধন শুনতে শুনতে বলল, তা তো পাচ্ছি! ওই তো ডাইনির জাদু।
সকালে বনের ভেতর অর্কেস্ট্রার সুর শুনে তুমি গির্জা খুঁজতে গিয়েছিলে। গম্ভীরভাবে বললুম—বোকা কোথাকার! এখনও কি তুমি বুঝতে পারছে না এটা কোন দ্বীপ?
প্রিয়বর্ধন আমার মুখের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। তারপর নড়ে বসল। তার মুখটা কেমন যেন জ্বলে উঠল কী আভায়। দম আটকানো গলায় সে বলে উঠল, জয়ন্ত, জয়ন্ত! তবে কি এই সেই কোহাও রঙ্গো-রঙ্গো? আমরা কি তাহলে সত্যি কিওটা দ্বীপে বসে আছি?
হ্যাঁ, প্রিয়বর্ধন।
প্রিয়বর্ধনের পাগলামি ঘুচে গেল সঙ্গে সঙ্গে। উত্তেজনা দমন করে সে আমার হাত ধরে টানল। চাপা গলায় বলল, তাহলে আর দেরি না করে এস, আমারা রোজারিওর গুপ্তধন খুঁজে বের করি। চুপচাপ বসে থাকার মানে হয় না, জয়ন্ত। তাছাড়া যা শুনেছি, এই ভূতুড়ে দ্বীপে বেশিদিন মানুষ বাঁচতে পারে না। সবুজ রোগে মারা যায়।
সবুজ রোগ কী?
সে এক সাংঘাতিক অসুখ। সারা শরীর সবুজ হয়ে যায়।
অমনি আমার মনে পড়ে গেল, রুবিদ্বীপের জেলেদের গায়ে সবুজ অ্যালার্জি হওয়ার কথা শুনেছিলুম। এবার বুক কেঁপে উঠল। প্রিয়বর্ধন আমাকে টানতে টানতে নিয়ে যাচ্ছিল। বললুম, কোথায় যাচ্ছ এমন করে?
প্রিয়বর্ধন তেমনি চাপা স্বরে বলল, এবেলা থেকেই কাজ শুরু করা যাক। প্রথমে সারা দ্বীপের চৌহদ্দি দেখে নিই এস। চারদিক ঘুরে একটা ম্যাপ তৈরি করা দরকার। তারপর…
বাধা দিয়ে বললুম, ম্যাপ আঁকবে কিসে? কাগজ কলম তো নেই।
মাটির ওপর বা বালিতে আঁকব। সে তুমি ভেবো না। প্রিয়বর্ধন উৎসাহের সঙ্গে বলল। তারপর শুরু হবে তন্নতন্ন খোঁজা। এক ইঞ্চি জায়গা বাদ রাখব না।
আমার অবাক লাগছিল ভেবে, পৃথিবীতে কতরকম মানুষ আছে তাহলে! এই এক আশ্চর্য জনমানুষহীন দ্বীপ, যেখানে গাছপালা গান গায়, যেখানে গাছপালা প্রাণীদের মতো সজাগ, মানুষের মতোই তার দয়ালু এবং ফল তুলে দেয় ক্ষুধার্তের ঠোঁটে—এমন বিচিত্র এক ভূখণ্ডের বিস্ময়কর ঘটনাবলীর দিকে প্রিয়বর্ধনের বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। সে লুকানো সোনাদানার প্রচণ্ড লোভে অস্থির হয়ে উঠেছে। বিড়বিড় করছে, রোজারিওর গুপ্তধন! রোজারিওর গুপ্তধন!
ঝাঁকে ঝাঁকে ব্যুমেরাং গড়নের কাঠপোকা বা কেঠো পোকা সবুজ ঘাসের মাঠে বসে ছিল। আমরা তাদের মধ্যে গিয়ে পড়তেই তারা লাফাতে লাফাতে কে কোথায় লুকিয়ে পড়ল। প্রিয়বর্ধনের চোখ সেদিকে নেই। মুখেচোখে ধূর্ততা ঠিকরে পড়ছে। মাঝে মাঝে বলছে, আমরা রাজা হয়ে যাব, জয়ন্ত! রোজারিওর ধনরত্ন পেলে আর পরোয়া নেই।
রোজারিও কে, সেকথা কয়েকবার জিগ্যেস করেও জবাব পেলুম না। তখন ভাবলুম, নিশ্চয় কোনও প্রাচীন জলদস্যু হবে। রাজাকো, ক্যারিবো, কিয়াং—সবাই তাহলে এই জলদস্যু পুঁতে রাখা গুপ্তধনের জন্য হন্যে হয়ে পরস্পর লড়াই করেছে। রাজাকোর প্রাণ গেছে। ক্যারিববা আর কিয়াং এখনও জীবিত। এখন কোথায় তারা কে জানে? ক্যারিববার সঙ্গে ডাইনির দ্বীপে আমাদের দেখা হয়েছে। তার মোটরবোট চুরি করে আমরা পালিয়ে এসেছি। ক্যারিববার দশা কী হয়েছে, তাও বলা কঠিন।
তারপর মনে পড়ল কর্নেল নীলাদ্রি সরকারের কথা। ডঃ বিকর্ণ, কাপ্তেন ঝুগেনভিলি, আর রোমিলার কথা। মন অমনি খারাপ হয়ে গেল। নৌবাহিনীর সাহায্যে তাঁরা কি রুবি দ্বীপের চারপাশের সমুদ্রে আমার মৃতদেহ খুঁজে বেড়াচ্ছেন এখনও? আচ্ছা, কাপ্তেন ঝুগনভিলি তো এ-দ্বীপে এসে পড়েছিলেন। তার কি পথের কথা মনে নেই একটুও?
কিওটো যে ছোট্ট দ্বীপ, সেটা ক্রমশ বুঝতে পারছিলুম। উত্তর থেকে সোজা দক্ষিণে দু-মাইল গিয়েই আবার সমুদ্র দেখা গেল। তারপর পশ্চিমে এগিয়ে গেলুম আমরা। পশ্চিম এলাকাটা ছোট-বড় পাহাড়ে দুর্গম হয়ে আছে। একেবারে ন্যাড়া পাথুরে পাহাড়। কিন্তু কী বিচিত্র রঙ তাদের। কোনওটা কালো, কোনওটা লাল, হলুদ, নীল। একটা সবুজ রঙের পাহাড়ও দেখতে পেলুম। এদিকে গাছপালা নেই বললেই চলে। একটা লাল টিলার ওপর পৌঁছে দ্বীপটা পুরো চোখে পড়ল।
দ্বীপটার গড়ন তিনকোনা। মধ্যিখানে বিরাট সবুজ ফঁকা মাঠ। মাঠ জুড়ে টুকরো পাথর পড়ে আছে। উত্তর ও দক্ষিণে ঘন বন। পুবে কিছুটা ফাঁকা। কিন্তু তিনকোনা দ্বীপটাকে ঘিরে রেখেছে প্রায় গোলাকার প্রবাল পাঁচিল। এটাকে বলয় দ্বীপ বলা যায়। প্রবাল পাঁচিলটা শুধু পুবের দিকে এক জায়গায় ভাঙা এবং সেটাই এই দ্বীপে ঢোকার গেট যেন। ওই গেট দিয়ে আমরা আসতে পেরেছি। বাকি সমস্ত বলয় উঁচু হয়ে ঘিরে রেখেছে পাঁচিলের মতো। তার গায়ে ধাক্কা দিচ্ছে মহাসাগরের প্রচণ্ড সব ঢেউ। আছড়ে পড়ে ধুয়ে দিচ্ছে পাঁচিলকে। এতক্ষণে সামুদ্রিক পাখির ওড়াউড়ি চোখে পড়ল প্রবাল বলয়ের কাছে।
প্রিয়বর্ধন বলল, তাহলে মোটামুটি একটা ম্যাপ পাওয়া গেল। এবার জয়ন্ত, আমরা কিছু সূত্র খুঁজব।
কিসের সূত্র?
প্রিয়বর্ধন হাসল। রোজারিও যখন এ দ্বীপে ধনরত্ন পুঁততে এসেছিল, তখন নিশ্চয় কিছু চিহ্ন রেখেছিল। ধরো, জাহাজের একটুকরো কাঠ, কিংবা পেরেক। অথবা একটা হাতুড়ি।…… যাই হোক, খুঁজলে নিশ্চয় পেয়ে যাব কিছু। এখান থেকেই খুঁজতে শুরু করি।
প্রিয়বর্ধন, এ-দ্বীপে যেই এসেছে, তাকে আসতে হয়েছে পুবের ওই ভাঙা জায়গাটা দিয়ে। কাজেই….
আমার কথা কেড়ে প্রিয়বর্ধন বলল, ওহে বোকারাম! যেখান দিয়েই আসুক, গুপ্তধন লুকানোর জন্য দুর্গম জায়গা সে বেছে নেবে কি না?
তা ঠিক।
দুর্গম জায়গা বলতে দেখছি, এই পাহাড়ি এলাকা আর ওই ঘন জঙ্গল। এখান থেকেই শুরু করি। এস। বলে প্রবল উৎসাহে সে টিলা থেকে নামতে থাকল।
তাকে অনুসরণ করলুম। দুপুর গড়িয়ে গেছে। এত ঘোরাঘুরি করছি, অথচ একটুও ক্লান্তি লাগছে না। নিশ্চয় সেই ফলের গুণ। টিলার নিচে পৌঁছে একটা পাহাড়ি খাদের দিকে পা বাড়াল প্রিয়বর্ধন। ডান দিকে এক ছিপছিপে চেহারার গাছ দাঁড়িয়ে রয়েছে। সেই গাছটা হঠাৎ পিয়ানোর বাজনা বাজাতে শুরু করল। কী মনমাতানো সে সুর! আমি দাঁড়িয়ে পড়লুম।প্রিয়বর্ধন! শোনো, শোনো! বলে ডাকলুম। কিন্তু সে দাঁত মুখ খিচিয়ে বলল, কী শুনব? আমার এক খুড়ো ওর চেয়ে ভাল পিয়ানো বাজাতে পারে! দেখছ না? বাতাস বইছে বলেই গাছটা এমন বিচ্ছিরি ভূতুড়ে শব্দ করছে। চলে এস।
বেরসিক প্রিয়বর্ধনের টানে এগিয়ে যেতে হল। খাদটা ক্রমশ ঢালু হয়ে নেমে গেছে। খাদের দুধারে রঙিন পাহাড় দেয়ালের মতো দাঁড়িয়ে আছে। কয়েক পা এগিয়ে প্রিয়বর্ধন হঠাৎ বসে পড়ল। তারপর উত্তেজিতভাবে বলল, পাওয়া গেছে! পাওয়া গেছে!
গিয়ে দেখি, একটা মরচে ধরা লোহার রড মাটির ভেতর কাত হয়ে ঢুকে রয়েছে। সেটা টানাটানি করতেই খানিকটা চাবড়া উঠে গেল মাটির। তারপর যা দেখলুম, ভয়ে বিস্ময়ে শিউরে উঠলুম। ওটা রড নয় আসলে একটা তলোয়ারের বাঁট। আর চাবড়ার তলায় একটা মানুষের কঙ্কাল দেখা যাচ্ছে। তালোয়ারটা কঙ্কালের ভেতর বিধে রয়েছে। রুদ্ধশ্বাসে বললুম, প্রিয়বর্ধন! কেউ এই মানুষটাকে তালোয়ার বিধিয়ে খুন করেছিল। সেই অবস্থায় পড়ে ছিল মৃতদেহটা। বছরের পর বছর বৃষ্টিতে মাটি ধুয়ে ঢালু খাদে এসে জমেছে আর ওকে ঢেকে ফেলেছে।
প্রিয়বর্ধন বলল, এ তাহলে নিশ্চয় রোজারিওর দলের লোক। এস, এগিয়ে গেলে আমরা আরও সূত্র পাব।
আরও কিছুটা এগিয়ে গিয়ে থমকে দাঁড়ালুম। খাদে বিকেলের গাঢ় ছায়া জমে আছে। আর এখানে ওখানে পড়ে আছে আরও কয়েকটা নরকঙ্কাল। কোনওটা মুণ্ডুহীন। মুণ্ডটা পড়ে আছে। আলাদা হয়ে। কালো ছায়ায় কঙ্কাল আর খুলিগুলো ধপধপে সাদা দেখাচ্ছে। দেখলে আতঙ্কে শরীর হিম হয়ে যায়।
তারপর হঠাৎ আগে শোনা সেই চিৎকার বা গর্জন শুনতে পেলুম।স্টপ ইট! স্টপ ইট! আই সে স্টপ ইট! দু-ধারের পাহাড়ে গম গম করে প্রতিধ্বনি উঠল। কানে তালা ধরে যাচ্ছিল। সেই সময় দেখলুম প্রিয়বর্ধন আতঙ্কে পাগলের মতো যে পথে এসেছি, সেই পথে দৌড়তে শুরু করেছে। আমি তাকে অনুসরণ করলুম।
শব্দগুলো যেন সারা দ্বীপ জুড়ে ছড়িয়ে যাচ্ছে ধ্বনি-প্রতিধ্বনিতে। তারপর শোনা গেল, আই মাস্ট কিল ইউ!…কিল ইউ… কিল..কিল! তারপর আর্তনাদ! হেল্প! হেল্প! হেল্প! সেই সঙ্গে
অন্তিম আর্তনাদের পর আর্তনাদ!
প্রিয়বর্ধন জঙ্গলের ভেতর উদ্ভন্তের মতো দৌড়ুচ্ছিল। তার ধরে ফেললুম। বললুম, ও কিছু নয়, প্রিয়বর্ধন! অতীতের প্রতিধ্বনি মাত্র। অত ভয় পাওয়ার কিছু নেই।
প্রিয়বর্ধন ধুপ করে ঘাসে বসে পড়ল। তারপর ভয়ার্ত মুখে বলল, রোজারিওর ভূত, জয়ন্ত! শুধু একা নয় ওর দলের সবাই ভূত হয়ে গেছে। আমাদের বরাত বড় মন্দ। তুমি বুঝতে পারছ না? ভূত হয়ে গেছে। ওরা ভূত হয়ে গুপ্তধন পাহারা দিচ্ছে।
ওকে টেনে ওঠালুম। কাল সকাল থেকে খোঁজা যাবে। আমরা পুব দিকের বিচে যাই। বেলা পড়ে আসছে। অচেনা জায়গার চেয়ে চেনা জায়গায় রাত কাটানোই ভালো।
দুজনে বাঁ দিকে ঘুরে কঁকা মাঠের দিকে এগিয়ে গেলুম। বনের ভেতর কোথাও ক্ষীণ সুরে বাঁশি বাজছিল। ক্রমশ সেই সুর চাপা দিয়ে গম্ভীর অর্কেস্ট্রা শুরু হল। প্রিয়বর্ধন ভয় পেয়ে লম্বা পায়ে হাঁটতে থাকল।
কিন্তু ফাঁকা মাঠের ধারে পৌঁছতেই এক বিচিত্র দৃশ্য চোখে পড়ল।
ক্যাকটাস জাতীয় একটা অদ্ভুত গড়নের প্রাণী কিংবা নিছক গাছ আস্তেসুস্থে হেঁটে যাচ্ছে। প্রিয়বর্ধন বলে উঠল, ও কী জয়ন্ত! ওটা গাছ, না কোনও জন্তু?
অবাক হয়ে বললুম, আশ্চর্য! ওটা যে দেখছি একটা ক্যাকটাস! চলো, তো দেখি।
প্রিয়বর্ধন আমার পিছনে কুণ্ঠিতভাবে এগুলো। সেই বিচিত্র চলমান ক্যাকটাসের হাত দশেক দূরে পৌঁছলে সেটা থেমে গেল। তারপর আরও অবাক হয়ে দেখলুম, ওটার নিচের দিক থেকে একরাশ শেকড় কেঁচোর মতো নেমে মাটিতে ঢুকে গেল।
সাহস করে কাছে গেলুম। সত্যি ক্যাকটাসই বটে। এমন বিদঘুটে চলমান ক্যাকটাস দেখে আমি হতবুদ্ধি হয়ে দাঁড়িয়ে রইলুম কিছুক্ষণ।
প্রিয়বর্ধনের তাড়ায় এগিয়ে যেতে হল। কিছু দূরে গিয়ে একবার পিছু ফিরে দেখলুম, অদ্ভুত ক্যাকটাস জীবটি আবার চলতে শুরু করেছে। বললুম, প্রিয়বর্ধন! তাহলে দেখা যাচ্ছে চলমান উদ্ভিদও পৃথিবীতে আছে। কে জানে এই সৃষ্টিছাড়া দ্বীপে আরও কত বিচিত্র উদ্ভিদ দেখতে পাব।
প্রিয়বর্ধন সে কথায় কান না করে একটু হেসে বলল, আবার কিন্তু খিদে পেয়েছে!
মাঠের ভেলভেটের মতো নরম সবুজ ঘাসের ওপর সেই পিচ জাতীয় ফলের গাছ আরও অনেক আছে। একটা গাছের দিকে পা বাড়িয়েছি, সেই সময় প্রিয়বর্ধন বলে উঠল, জয়ন্ত! জয়ন্ত! ওটা কী দেখ তো?
ওর দৃষ্টি অনুসরণ করে দেখি, শেষ বিকেলের সমুদ্রের প্রবাল পাঁচিলের সেই ভাঙা অংশটার কাছে সাদা কী একটা ঢেউয়ে ভেসে উঠছে আবার যেন তলিয়ে যাচ্ছে। ভাল করে দেখে বুঝলুম, ওটা একটা মোটরবোটই বটে!
আনন্দে চিৎকার করে দৌড়ুতে যাচ্ছিলুম, হঠাৎ বাঁ পাশে পড়ে থাকা কয়েকটা পাথরের আড়াল থেকে তিনটে মূর্তি উঠে দাঁড়িয়ে বলল, হ্যান্ডস্ আপ!
মূৰ্তিত্রয় এ-দ্বীপের কোনও আজব গাছ-মানুষ, না আমাদের মতো মানুষ লক্ষ্য করতে গিয়ে চোখে পড়ল, তাদের হাতে রিভলভার আর বন্দুকও আছে। সঙ্গে সঙ্গে দুহাত তুলে দাঁড়িয়ে গেলুম।
তারপর প্রিয়বর্ধন দুহাত তুলে ফিসফিস করে উঠল, শয়তান ক্যারিববা!
এবার চিনতে পারলুম ক্যারিবোকে। সে এগিয়ে এসেই প্রিয়বর্ধনের চোয়ালে রিভলভারের বাঁট দিয়ে মারল। প্রিয়বর্ধন পড়ে গেল। তারপর ক্যারিবো আমার দিকে ঘুরে কুৎসিত হেসে বলল, এই যে কলকাতাওয়ালা বাঙালিবাবু। মোটর বোট চুরির শাস্তি কত ভয়ঙ্কর, একটু-একটু করে টের পাবে এবার। ফুতাং! একে বিচে নিয়ে চল্! আর উংচু, তুই ওই দোআঁশলা বদমাশটাকে তুলে নিয়ে আয়।
গরিলার মতো চেহারা—সম্ভবত মালয়ের লোক, সেই ফুতাং এসে আমার ঘাড় ধরল। ওর অন্য হাতে বন্দুক। কিছু করার নেই। উংচু নামে বেঁটে হিংস্র চেহারার লোকটার গায়ে যেন দৈত্যের বল। সে প্রিয়বর্ধনকে পুতুলের মতো কাঁধে তুলে নিয়ে চলল পুবের বিচের দিকে। প্রিয়বর্ধন অজ্ঞান হয়ে গেছে। কষায় রক্ত গড়াচ্ছে।
বিচের বালিতে আমাকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিল ফুতাং। ক্যারিববা বিকট হেসে বলল, তারপর বাঙালিবাবু! প্রথমে বলো তো গুপ্তধনের হদিশ কতটা পেলে? তারপর অন্যকথা।