স্টপ ইট! স্টপ ইট! আই সে-স্টপ ইট!
একবার নয়, বারবার কেউ ভূতুড়ে গলায় ধমক দিতে থাকল। সেই কণ্ঠস্বর যে মানুষের নয়, আমি হলফ করে বলতে পারতুম। থমকে দাঁড়িয়ে গেছি এবং ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছি। স্টপ ইট! স্টপ ইট! আই সে-স্টপ ইট-ঝাঁকুনি খেতে খেতে শব্দগুলো ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ছে। চারদিকে প্রতিধ্বনির মতো। তারপর তাদের তীব্রতা ক্ষয়ে যাচ্ছে। হেঁপা রোগীর মতো শ্বাস-প্রশ্বাস জড়ানো গলায় মাথাকুটে নিষেধ করার ভঙ্গিতে কেউ কাউকে কিছু করতে বারণ করছে। তারপর শব্দগুলো শ্বাস-প্রশ্বাসে মিশে যেতে থাকল। স্টপ ইট! স্টপ ইট! আই সে-স্টপ ইট! তারপর যেন বাতাসের সঙ্গে মিলিয়ে গেল।
সেই চাপা গম্ভীর অর্কেস্ট্রার বাজনার দিকে কান গেল এবার। বাজনাটাও ততক্ষণে ক্ষীণ হয়ে এসেছে। মনে হল, যেন আমার মাথার ভেতরই সেই আশ্চর্য সুন্দর সঙ্গীত শুনছি…অসংখ্য ঝিল্লির ডাকের মতো, অতি মৃদু, শ্রুতিপারের সেই ধ্বনি।
তারপর তাও একইভাবে মিলিয়ে গেল। মুহূর্তের জন্য আমার মনে কী এক অনুভূতি ঝিলিক দিল। এ আমি কোথায় এসে পড়েছি তাহলে? আমার বিস্মিত দৃষ্টির সামনে সকাল-বেলার শান্ত নরম রোদে সবুজ বনভূমি ঝলমল করছে। উঁচু ও নিচু, ছোট এবং বড়, স্থূল এবং শীর্ণ নানা আকৃতির উদ্ভিদ। তাদের অনেকেই থরে থরে ফুলে ফুলে সাজানো। মাটির ঘাসে ফলের গয়না পরে পরীদের মতো পা ছড়িয়ে বসে আছে কেউ কেউ। সুগন্ধে বাতাস মউমউ করছে। চারদিকে এখন যেন শব্দহীন হাসি, যেদিকে তাকাই সেদিকেই বালক-বালিকারা খুশিখুশি মুখে এক বিদেশি অতিথিকে বরণ করার জন্য দাঁড়িয়ে আছে বলে ভুল হয়। কোথাও দেখি সারবদ্ধ ঋজু বৃক্ষ প্রাজ্ঞ মানুষের গাম্ভীর্য নিয়ে আমাকে নিরীক্ষণ করছে। কোনও-কোনও বৃক্ষ যেন ভ্রু কুঞ্চিত করেছে—সন্দেহকুটিল সংশয়ান্বিত ভঙ্গি। ফলভারে নুয়ে পড়া এক বৃক্ষ বুঝি জননীর স্নেহে আমাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে। তরুণ বৃক্ষেরা তাদের বলিষ্ঠ পেশল বাহু বাড়িয়ে হয়তো আমাকে আলিঙ্গন করতে চাইছে। এ আমি কোথায় এলুম? প্রতিটি ঝোপঝাড়, গাছ, ঘাসের শব্দহীন ভাষা যেন আমার বোধের ভেতর স্পষ্ট হয়ে উঠছে। লক্ষ লক্ষ কথা নিঃশব্দে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে আমার মস্তিষ্কে—মস্তিষ্ক থেকে মনে সেই সব দুজ্ঞেয় কথা স্পন্দনের হ্রস্ব-দীর্ঘ তরঙ্গিত রেখায় বিচিত্র কোডের মতো জমে উঠছে আমার মস্তিষ্ককোষে। এ বুঝি এক অদৃশ্য বেতার তরঙ্গ। কিন্তু ডি-কোডিং পদ্ধতি আমার জানা নেই বলে অর্থ নিষ্কাশন করতে পারছি না। অসহায় ব্যর্থ বিষণ্ণ এক মানুষ ঘটনাচক্রে এসে পড়েছি এক বিরাট মৌন চেতনার দরজায়। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছি আর তাকিয়ে আছি।
হঠাৎ আমার তন্ময়তা কেটে গেল। স্বপ্নবৎ আচ্ছন্নতা ঘুচে গেল। মুহূর্তের মধ্যে ঝিলিক দিয়ে উঠল একটা জ্ঞান—যা এতক্ষণ আমার নাগালেই ছিল, অথচ গ্রাহ্য করিনি। আর সেই জ্ঞান আমাকে কিছুক্ষণের জন্য উত্তেজনায় আনন্দে বদ্ধ উন্মাদে পরিণত করে ফেলল। আমি বিজ্ঞানী
আর্কিমিডিসের ইউরেকা বলে চিৎকার করে ছোটাছুটি করার ভঙ্গিতে কিওটা! কিওটা! বলে। চেঁচাতে চেঁচাতে এবং দুহাত তুলে লম্ফঝম্ফ করতে করতে দৌড়ে গেলুম। অপেক্ষাকৃত ফাঁকা তংশ দিয়ে ঢুকে একটা খোলামেলা সবুজ মাঠের ওপর ধপাস করে পড়ে বারকতক গড়াগড়ি খেলুম। তারপর আবার দৌড়ুতে শুরু করলুম। আমি সত্যি সত্যি বদ্ধ পাগলের মতো চিঙ্কার করছিলুম, কিওটা! কিওটা! কিওটা!
হ্যাঁ, এই সেই আশ্চর্য দ্বীপ কিটা। কোথাও রঙ্গো-রঙ্গো পুঁথিতে বর্ণিত স্পিকিং উডস—কথা বলা বনের দেশ। এই সেই প্রাচীনযুগের নাবিকদের কিংবদন্তির দ্বীপ সঙ্গীতকারী বৃক্ষের বাসস্থান কিওটা!
ঘাসের ভেতর লুকিয়ে থাকা পাথরে ঠোক্কর খেয়ে ছিটকে পড়লুম। সঙ্গে সঙ্গে উন্মাদনাটা কেটে গেল। হাঁপাতে হাঁপাতে উঠে দাঁড়ালুম। নিজের পাগলামির কথা ভেবে খারাপ লাগল। এবার আমার সবচেয়ে জরুরি জিনিস হল মানসিক সুস্থতা।
ঘাসের মাঠটা বিশাল। এখানে-ওখানে উজ্জ্বল নানা রঙের পাথর ছড়িয়ে আছে। কোথাও একলা কোনও গাছ বা ঝোপ, কোথাও নিবিড় উঁচু ঘাস। একটা নিচু ঝাকড়া গাছে আপেলের মতো ফল ধরে আছে দেখে সেদিকেই এগিয়ে গেলুম। ওগুলো ব্রেডক্রুট বলে মনে হচ্ছিল। কয়েক পা যেতেই এক অবাক কাণ্ড ঘটল। রুবিদ্বীপে রাজাকোর জাদুঘরে ব্যুমেরাং-আকৃতির যে জ্যান্ত জিনিসটা দেখেছিলুম, কর্নেলকথিত সেই কাঠকার-এর একটা ঝক ঘাসের ভেতর থেকে লাফিয়ে উঠল। তারপর দল বেঁধে লাফাতে লাফাতে উঁচু ঘাসবনের ভেতর গিয়ে ঢুকল।
ফলের গাছটার তলায় চওড়া বেদির মতো পাথর। সেটাতে চড়ে একটা ফল ভাঙতে হাত বাড়িয়েছি, একটা হাতে ডাল ধরে নুইয়ে রেখেছি, অমনি ডালটা আমার হাত ছাড়িয়ে সটান সোজা হয়ে গেল। নাগাল পেলুম না। তারপর যে ডালটা ধরতে যাই, একই কাণ্ড। গাছটা প্রাণীর মতো জ্যান্ত এবং অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সঞ্চালনে সক্ষম দেখে হতবাক হয়ে গেলুম। একটু পরে গাছটার সবগুলো ডাল সোজা হয়ে গেল। প্রকাণ্ড এবং বেঁটে তালগাছের মতো দেখাল গাছটাকে। আমি তার দিকে চেয়ে কাকুতিমিনতি করে বললুম, লক্ষ্মী ভাইটি! বড্ড খিদে পেয়েছে। অমন কোরো না।
আমার দুর্ভাগ্য, মানুষের ভাষা ওকে কিছুতেই বোঝাতে পারলুম না। ইশারা-ইঙ্গিত করে বোঝাবার চেষ্টা করলুম যে সত্যি আমার ভীষণ খিদে পেয়েছে। কিন্তু হতচ্ছাড়া গাছটা তেমনি সাধুর মতো ঊর্ধ্ববাহু হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। লোভনীয় রঙিন ফলগুলি আমার নাগালের বাইরে উঁচুতে দুলতে থাকল।
এতক্ষণে আমার মাথায় এল, এর মধ্যে হয়তো আজগুবি ব্যাপার নেই। লজ্জাবতী লতার মতো কোনও প্রকৃতিক নিয়মেই গাছটার মধ্যে সংকোচন ঘটেছে আমার ছোঁয়ায়। গাছটার খুঁড়িতে খোঁচাখোঁচা কাটাও রয়েছে। একটু তফাতে সরে গিয়ে একটুকরো পাথর কুড়িয়ে নিলুম। পাথরটা ছুঁড়তে যাচ্ছি, হাতের তালু ছ্যাক করে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে পাথরটা ফেলে দিলুম। তারপর দেখি, ও হরি! ওটা আদতে পাথরই নয়—ধূসর রঙের একটা প্রজাপতি। ডানা গুটিয়ে পড়েছিল ঘাসের ফাঁকে। ভারি অদ্ভুত প্রজাপতি তো!
এবার কালো রঙের সত্যিকার একটা পাথর কুড়িয়ে নিলুম। পাথরটা ফল লক্ষ্য করে ছুড়ে মারলুম। কিন্তু লক্ষ্যভ্রষ্ট হল। ফলগুলোও যেন অসম্ভব ধূর্ত। পাথরের লক্ষ্যপথ থেকে কেমন ঝটপট সরে যাচ্ছে।
অনেকক্ষণ চেষ্টার পর হাল ছেড়ে দিয়ে জঙ্গলের দিকে এগিয়ে গেলুম। এতক্ষণে আবিষ্কার করা গেল, এই দ্বীপে নারকোল গাছ নেই। শুধু তাই নয়, এখানকার সব গাছ—সমস্ত উদ্ভিদ যেন অন্যরকমের। কোনওটাই আমি এর আগে দেখিনি কোথাও। এমনকী যে ঘাসগুলো আমি মাড়িয়ে এলুম, সেগুলোও আমার অচেনা। যত রকমের ঘাস আজীবন দেখেছি, তার সঙ্গে কোনও মিল নেই এ ঘাসের। ভেলভেটে বোনা পুরু এবং নকশাদার এই ঘাসের সৌন্দর্য বিস্ময়কর। লক্ষ্য করে দেখলাম, কোথাও রুগ্ণ, হাড়জিরজিরে কোনও গাছ নেই। প্রত্যেকটি সবল, নিটোল, বর্ণাঢ্য—যেন ছবিতে যত্ন করে আঁকা।
একটা প্রকাণ্ড গাছের গায়ে হাত রেখেই চমকে উঠলুম। কোনো প্রাণীর গায়ে হাত রাখলে যে। অনুভূতি অবিকল। বৃক্ষের প্রাণ আছে সে তো জানি। কিন্তু এত প্রাণ! এত তীব্র চেতনা! আমার দিকে তাকিয়ে আছে তীব্র চেতনাসম্পন্ন উদ্ভিদরূপী প্রাণীশূথ যেন।
একটা ঝোপে আঙুরের গুচ্ছ গুচ্ছ ফল দেখে সেদিকে ব্যস্তভাবে ছুটে গেলুম। গোলাপি রঙের সুন্দর ফলগুলি রসে টলটল করছিল। কিন্তু হাত বাড়াতে গিয়ে হঠাৎ মনে হল, কে যেন নিষেধ করছে।
কোনও কণ্ঠস্বর শুনিনি অস্বাভাবিক নির্জনতা ছমছম করছে চারদিকে। অথচ আমার মনে হল, আমার মাথার ভেতর ঝিঝি পোকার মতো শ্রুতিপারে এক অনুভূতিময় সুর একটা নিষেধাজ্ঞা শোনা যাচ্ছে। কে যেন বলছে, ওই সুন্দর ফলগুলো বিষাক্ত।
মন থেকে ধারণাটা ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা করলুম না। একি আমার ষষ্ঠেন্দ্রিয়ের বোধ? সঠিক বলা কঠিন। যে বোধ মানুষকে অনেক সময় বিপদের পূর্বাভাস দিয়ে সতর্ক করতে চায়, এ কি সেই বোধ? প্রাণীদের মধ্যে এই বোধ এখনও লুপ্ত হয়নি – প্রাগৈতিহাসিক যুগের মানুষও হয়তো এই ক্ষমতার অধিকারী ছিল। কিন্তু সেই বোধ আমার মতো একজন সভ্য জগতের আধুনিক মানুষের মধ্যে টিকে আছে—নাকি কিওটা দ্বীপে পৌঁছনোর পর কোনও প্রকৃতিক নিয়মে তা ফিরে এসেছে। আমার মধ্যে?
ব্যাপারটা যাই হোক, ফলের ঝোপটার সঙ্গে আমার যেন একটা টেলিপ্যাথিক যোগাযোগ ঘটছিল। আমি সেখান থেকে হতাশ হয়ে সরে গেলুম অন্যখানে।
খাদ্যের সন্ধান আমাকে করতেই হবে। বরং সমুদ্রের ধারে গিয়ে দেখি, যদি মাছ মারতে পারি।
গাছপালার ফাঁক দিয়ে সমুদ্র দেখা যাচ্ছিল। এদিকটায় জঙ্গল খুব ঘন। অসংখ্য গাছ বুড়ো হয়ে ভেঙে পড়েছে কালক্রমে। তার ওপর আবার গাছের চারা গজিয়েছে। এতক্ষণে পাখির ডাক কানে এল। তাহলে কিওটাতে প্রাণীও আছে! মনে হল, দ্বীপের পাখিরা আমার মতো এক আগন্তুককে দেখে যেন ভয় পেয়ে এতক্ষণ আড়ালে সরে গিয়েছিল। ক্রমশ সাহস পেয়ে তারা একে একে বেরিয়ে আসছে এবং মন খুলে গান গাইতে শুরু করেছে। কিন্তু চেষ্টা করেও একটা পাখি আমার চোখে পড়ল না।
তারপর একটা ময়াল জাতীয় প্রকাণ্ড সাপকে একটা গাছের ডালে ঝুলতে দেখলুম! হ্যাঁ—সাপও আছে। কিওটা তাহলে মানুষের পক্ষে একটা নিরাপদ জায়গা নয়। এক দৌড়ে সমুদ্রের ধারে গিয়ে হাজির হলুম। এবার সাপের কথা ভেবে বুক ঢিপঢিপ করছিল।
সূর্যের অবস্থান দেখে বুঝতে পারলুম এদিকটা উত্তর দিক। আমি দ্বীপে এসেছি পূর্বদিক থেকে। সামনে বিস্তীর্ণ জলের পর প্রবাল পাঁচিল কালো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমার বাঁদিকে টানা বিচ। ক্রমশ ঘুরে গেছে দক্ষিণে। বিচের বাঁকের মুখে পাহাড়ি খাড়ি। এখানে জলটা তত পরিষ্কার নয়। ঢেউয়ের চোটে বালি ভেসে উঠেছে। চাপচাপ শ্যাওলা জাতীয় গাছ আছে জলের ভেতর। তাই ভাবলুম, খাড়ির জলটা পরিষ্কার হতে পারে। ওখানে পাথরের ফাঁকে নিশ্চয় মাছের ঝাঁক চোখে পড়বে।
যেতে যেতে বাঁদিকে জঙ্গলের ভেতর বেহালার বাজনা শুনে থমকে দাঁড়ালুম। সত্যি বাজছে, নাকি কানের ভুল, ঠিক করতে পারলুম না। কিন্তু বড় করুণ সুর সেই অলীক বেহালার। এ এক আশ্চর্য মায়াজগৎ যেন, যেখানে যখন তখন বেজে ওঠে গম্ভীর, অর্কেস্ট্রাধ্বনি কিংবা বেহালা সুর। বিচিত্র অনুভূতি জেগে ওঠে মনে। আবেগে হৃদয় দুলতে থাকে। সুরটা শুনতে শুনতে আমার চোখে জল এসে গেল।
কিন্তু সব মিথ্যা পেট সত্য। বহুকাল আগেই পথের ধারে এক দেহাতী ম্যাজিশিয়ানের মুখে খেলার শেষে শুনেছিলুম এই পরম সত্য কথাটা। খিদে আর তেষ্টার কথা সম্ভবত যত ভাবা যায়, তত বেড়ে ওঠে। ক্যারিববার রুটি-জ্যাম-সসেজ সেই মধ্যরাতে সমুদ্রের বুকে সাবাড় করেছি। এখন সেকথা ভেবে জিভে জল আসছিল। অদৃশ্য বেহালাবাদক সেটা টের পেয়েই যেন হঠাৎ বাজনা বন্ধ করে দিল।
বাঁকের মুখে খাড়ির ধারে এসেই মন নেচে উঠল। পাহাড়ের মাথায় একখানে সাদা একটা রেখা দেখে থমকে দাঁড়িয়েছিলুম। না—চোখের ভুল নয়। ওটা একটা ঝরনা। সরু ফিতের মতো নেমে এসে লোনা খাড়ির জলে ঝরঝর করে ঝরে পড়ছে।
এরপর নিজের তৎপরতায় নিজেরই অবাক লাগছিল। খাড়িতে বড় বড় পাথর পড়ে আছে। তার ফাঁকে অতি স্বচ্ছ জলে ম্যাকারেল জাতীয় মাছের ঝাঁক খেলা করছিল। পাথর মেরে একটাকে বধ করতে দেরি হল না। মাছটার ওজন কমপক্ষে শদুই আড়াই গ্রাম না হয়ে যায় না।
প্রিয়বর্ধনের পদ্ধতিতে দু- টুকরো শুকনো কাঠ ঘষে আগুন জ্বেলে মাছটা পুড়িয়ে রাক্ষসের মতো খেলুম বিচে বসে। তারপর পাহাড়ে চড়া শুরু হল। মাউন্টেনিয়ারিং ট্রেনিং নেওয়াটা এভাবে কত জায়গায় কাজে লেগেছে বলার নয়। ঝরনার কাছ ঘেঁষে একটা চাতাল মতো জায়গা দেখতে পেলুম। সেখানে পৌঁছে প্রাণ ভরে জল খেয়ে দ্বীপের দিকে ঘুরে দাঁড়ালুম।
আগের দ্বীপটার চেয়ে এই দ্বীপটা বহুগুণে বড়। উঁচু থেকে ভূ-প্রকৃতি ঠাহর হচ্ছিল। মাঝে মাঝে ভোলা মাঠ, আবার বিস্তীর্ণ সবুজ ঘাসের জমি। পাখির ঝাক চোখে পড়ছিল। এই তাহলে সেই আশ্চর্য দ্বীপ কিওটা।
এবার একটু ভাবনায় পড়ে গেলুম। আমি হয়তো চেষ্টা করলে জর্জ ব্যুগেনভিলির মতো ভেলা তৈরি করে সমুদ্রে ভাসতে পারি—কোনও জাহাজ দৈবাৎ আমাকে দেখে উদ্ধার করলেও করতে পারে, নয়তো হাঙরের পেটে হজম হয়ে যেতে পারি। এই আশ্চর্য আবিষ্কার আমি লাগাতে পারব না। আমি বিজ্ঞানী নই। কর্নেল নীলাদ্রি সরকারের মতো সাধারণ বিজ্ঞান সম্পর্কেও আমার তত বোধবুদ্ধি নেই। তাহলে এই অবিষ্কার মানুষের অতীতকালের এক কিংবদন্তিকে পুষ্ট করা ছাড়া আর কী কাজে লাগবে?
হতাশা পেয়ে বসল ক্রমশ। কর্নেলের কথা ভাবতে থাকলুম। ধুরন্ধর প্রাজ্ঞ বৃদ্ধ ভদ্রলোকটি এখন কোথায়? আমার নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়া নিয়ে হয়তো সূত্র ছুঁড়ে ছুঁড়ে হন্যে হচ্ছেন রুবিদ্বীপে। কিওটা পৌঁছনোর যত চেষ্টা করুন, দ্বিতীয় কাত্তিটার অভাবে পথ খুঁজে পাবেন না—এটা নিশ্চিত।
শুধু একটাই আশা। কর্নেল চিরদিন রহস্যময় অজানার সন্ধানে পাড়ি জমাতে পিছপা হননি। অসাধারণ তাঁর বুদ্ধির চাতুর্য। তাঁর মেধা তুলনাহীন।
ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলুম কখন সেই চাতালে। ঘুম ভেঙে দেখি, বিকেল হয়ে গেছে। কী লম্বা ঘুম না ঘুমিয়েছি তাহলে। মাছটা দেখছি খিদে মেটাতে অদ্বিতীয়। কী মাছ কে জানে, মনে হচ্ছে খিদে জিনিসটা চিরকালের মতো শেষ হয়ে গেছে। শরীর ঝরঝরে লাগছে। স্ফূর্তিতে পেশি, চনমন করছে! চাতাল বেয়ে সমুদ্রের বিচে নামতে থাকলুম। কেউ আমাকে দেখলে পাগল ভাবতে পারত। ফর্দাফাই পোশাক, খালি পা, রুক্ষ চিটচিটে চুল।
নিচে বড় বড় পাথরের টুকরোর ভেতর গাছপালা আর ঝোপ গজিয়ে রয়েছে। সেখানে যেই পৌঁছেছি, ডান দিকে জঙ্গলের ভেতর কেউ চেরা গলায় আর্তনাদ করে উঠল—ও ডোন্ট কিল মি! তারপরই কেউ গর্জন করে বলল, মাস্ট কিল ইউ! কিল ইউ…কিল ইউ.এবং আর্তনাদের পর আর্তনাদ-হেল্প! হেল্প! হেল্প!
সারা বনভূমি জুড়ে কিল এবং হেল্প কথা দুটো জড়িয়ে যেতে যেতে প্রতিধ্বনিত হতে হতে ছড়িয়ে পড়ছে। উত্তেজনায় আবার সেই উন্মাদনা আমাকে পেয়ে বসল। একটা পাথর কুড়িয়ে নিয়ে জঙ্গলের ভেতর দৌড়ুতে শুরু করলুম। লোকটাকে বাঁচানোর জন্য আমি মরিয়া।