সবুজ বনের ভয়ংকর- স্টপ ইট! স্টপ ইট!

সবুজ বনের ভয়ংকর- স্টপ ইট! স্টপ ইট!

একটু পরেই বুঝতে পারলুম ওটা এক স্পটলাইট। প্রিয়বর্ধনকে সেকথা বললে সে কিছুতেই বিশ্বাস করল না। ভয় পাওয়া গলায় বলল, ডাইনির দ্বীপে এমন আলো দেখা যায় শুনেছি। জয়ন্ত, চলো আমরা এ গুহা থেকে পালিয়ে পাহাড়ের পেছনে কোথাও লুকিয়ে পড়ি। ডাইনিটা ঠিকই আমাদের গন্ধ পেয়ে যাবে। শুনেছি, সে নাকি জলজ্যান্ত মানুষ পুড়িয়ে খায়।

সে কাঁপতে কাঁপতে উঠে দাঁড়াল। আমার কোনও কথা আমল দিল না। বরং সে পালিয়ে নিরাপদ জায়গায় যাওয়ার জন্য আমার হাত ধরে টানাটানি শুরু করল।

লোকটা এত কুসংস্কারের ডিপো, ভাবা যায় না! আলোটা যখন বৈদ্যুতিক, তখন আলোর মালিক অবশ্যই সভ্য জগতের মানুষ। শক্ৰমিত্র যেই হোক, মানুষ তো বটে। তাছাড়া এমনও হতে পারে, কোনও মোটরবোট অথবা জাহাজ এসে এই দ্বীপের কাছে ভিড়েছে। উদ্ধার পাওয়ার এমন সুযোগ ছাড়া নয়।

নিজেকে ওর হাত থেকে জোর করে ছাড়িয়ে নিয়ে ঢালু পাহাড়ের গা বেয়ে নামতে থাকলুম। প্রিয়বর্ধন পেছনে চাপা গলায় আমাকে যাচ্ছেতাই গালমন্দ দিতে লাগল। আতঙ্কে লোকটার মাথায় গণ্ডগোল হয়ে গেছে হয়তো।

অন্ধকারে চোখের দৃষ্টি স্বচ্ছ হতে পারত, কিন্তু স্পটলাইটটা চোখ ধাঁধিয়ে দিচ্ছিল। তাই বারবার হোঁচট খাচ্ছিলুম পাথরে। আছাড় খেতেও হল বারকতক। শেষে এমন আছাড় খেলুম যে গড়াতে গড়াতে একেবারে নিচের ঝোপঝাড়ে পড়ে পোশাক ছিঁড়ে ফর্দাফাই হল। কাটায় শরীরের

অনেক জায়গা ছেড়ে গেল। জ্বালা করছিল ভীষণ।

কিন্তু আমি মরিয়া। ফাঁকা জায়গায় পৌঁছে দেখি, আলোটা যত কাছে ভেবেছিলুম, তত কাছে নয়। একটা পাথরের ওপর আলোটা রাখা আছে। কিন্তু জনমানুষ নেই। থমকে দাঁড়াতে হল। ওটা কি সত্যি স্পটলাইট?

হ্যাঁ, তাতে তো কোনও ভুল নেই। কারণ আলোর ছটা একটা দিকেই পড়েছে—যেদিক থেকে যাচ্ছি, সেদিকে। আমি এখন কিছুটা বাঁদিকে দাঁড়িয়ে আছি বলে আলোর নাগালে নেই। এবার সাড়া দেওয়া উচিত ভেবে যেই ঠোঁট ফাঁক করেছি, সেই মুহূর্তে হেঁড়ে গলায় কেউ গান গেয়ে উঠল।

তারপর গানটা দুকলি গাওয়া হয়েছে, কেউ তেমনি দুর্বোধ্য ভাষায় তেড়ে ধমক দিল। সঙ্গে সঙ্গে গানটা থেমে গেল। তারপর অনেকগুলো গলায় কারা হেসে উঠল।

তাহলে আলোটার ওপাশে পাথরের পেছনে একদঙ্গল মানুষ আছে। কারা তারা? একটু দোনামোনা হচ্ছিল আমার। ক্যারিবো কিংবা কিয়াংয়ের দলবল নয় তো? গিয়ে ওদের পাল্লায় পড়লে আমার ভাগ্য আবার অনিশ্চিত হয়ে পড়তে পারে।

প্রায় বুকে ভর করে, কখনও হামাগুড়ি দিয়ে পাথরটার পেছনে গেলুম। তারপর কান পেতে রইলুম। ওরা চাপা গলায় কথা বলছে। একবর্ণও বুঝতে পারছি না। পাথরের ফাঁক দিয়ে ওদের আবছা মূর্তিগুলো চোখে পড়ল। ওরা ছায়ায় হাত পা ছড়িয়ে কেউ বসে বা শুয়ে আছে। কী করা উচিত ভাবছি, আর দরদর করে ঘামছি উত্তেজনায়।

হঠাৎ পেছনে অস্পষ্ট একটা শব্দ শুনে চমকে উঠলুম। ঝটপট ঘুরে বসতেই প্রিয়বর্ধন ফিসফিস করে বলল, চুপ!

লোকটাকে ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না। ভেবেছিলুম ডাইনির ভয়ে লেজ তুলে পালিয়ে গেছে। গুহা থেকে। অথচ সে দিব্যি আমার পেছন পেছন চুপিচুপি এসে হাজির। ঘাপটি মেরে বসে কিছুক্ষণ কান পেতে কথাবার্তা শোনার পর আমার কানে কানে ফিসফিস করে বলল, শয়তান ক্যারিবো!

তাহলে ঠিকই অনুমান করেছিলুম। ভাগ্যিস, হুড়মুড় করে ওদের সামনে গিয়ে হাজির হইনি। আরও কিছুক্ষণ কথাবার্তা শোনার পর প্রিয়বর্ধন আমাকে অনেকটা দূরে নিয়ে গেল। হ্রদের ধারে হাঁটতে হাঁটতে চাপা গলায় বলল, শাপে বর হয়েছে, জয়ন্ত! ক্যারিববা মোটরবোট নিয়ে এখানে হাজির হয়েছে। ঠিক বুঝতে পারলুম না কী একটা গণ্ডগোল ঘটেছে। যতদূর মনে হল, ওরা কিওটা দ্বীপের হদিশ করতে পারছে না। তাই হতাশ হয়ে ঢকঢক করে মদ গিলে মাতাল হচ্ছে।

বললুম, কিন্তু আমরা কোথায় যাচ্ছি?

প্রিয়বর্ধন বলল, স্টেনগানটা থাকলে ক্যারিবো আর তার তিনজন সঙ্গীকে ওখানেই যমের বাড়ি পাঠিয়ে দিতুম। তারপর দেবী মূর্তিটা উদ্ধার করে ওর মোটরবোট নিয়ে কিওটা অভিযানে পাড়ি জমাতুম! যাক্ গে, চুপচাপ এস। কী করি দেখো না।

হ্রদ্র ঘুরে পুবদিকে গিয়ে ক্যারিবো তার দলবলকে এড়িয়ে প্রিয়বর্ধন আমাকে সমুদ্রের ধারে নিয়ে গেল। তখনও টের পাইনি ওর উদ্দেশ্য। একটু পরে সেটা জানলুম।

এদিকটায় সমুদ্রের খাড়ি। খাড়ির এককোণে মোটরববাটটা আবিষ্কার করতে দেরি হল না। মোটরববাটে কেউ পাহারা দিচ্ছে না। প্রিয়বর্ধন বলল, স্টার্ট দেওয়ার উপায় নেই। ক্যারিবোর পকেটে চাবি। কাজেই এসো, এটাকে আমরা কোথাও লুকিয়ে রেখে আসি। ওটার মধ্যে বৈঠা আছে। অসুবিধে হবে না। শিগগির!

খাড়ির জলটা অপেক্ষাকৃত শান্ত। দক্ষিণ ঘুরে আমরা মোটরবোটটা সেই গুহাওয়ালা পাহাড়ের পেছন দিকে নিয়ে গেলুম। তারপর সংকীর্ণ আরেকটা খাড়ির ভেতর পাহাড়ের তলার দিকে চওড়া ফাটলের ভেতর লুকিয়ে রাখলুম। প্রিয়বর্ধন মোটরবোটের অন্ধিসন্ধি খুঁজে নিরাশ হয়ে বলল, ব্যাটারা বৈঠাগুলো বাদে কিচ্ছু রেখে যায়নি। না অস্ত্রশস্ত্র না খাবার-দাবার! মহাধড়িবাজ লোক ওই ক্যারিবো।

অন্ধকারে এবার আমার দৃষ্টি স্বচ্ছ হয়েছে। বাঁদিকে পাহাড় ভাঙা চাঙড়ের ওপর দিয়ে উঠে যেতে অসুবিধা হল না। পাহাড়টা শদুয়েক ফুটের বেশি উঁচু নয়। এখানে পেছন দিকটা চমৎকার গড়ানে আবার হ্রদের দিকে পৌঁছে প্রিয়বর্ধন একটা প্ল্যান বাতলে দিল।

প্ল্যানটা মারাত্মক। কিন্তু প্রিয়বর্ধনের বুদ্ধিসুদ্ধির ওপর এখন আমার প্রচুর আস্থা জন্মে গেছে। স্পটলাইটটা তেমনি জ্বলছে। আমি চুপিচুপি তখনকার মতো ওটার কাছে এগিয়ে গেলুম। প্রিয়বর্ধন গেল বাঁদিকে হ্রদের কিনারা দিয়ে ঘুরে।

যে পাথরে আলোটা রাখা আছে, তার আড়ালে বসে রইলুম। ক্যারিববারা এখন চুপচাপ। তাদের নাক ডাকা শুরু হতে আরও ঘন্টাখানেক অপেক্ষা করতে হল। তারপর হাত বাড়িয়ে আলোর সুইচ অফ করে দিলুম এবং স্পটলাইটটা বাগিয়ে ফেললুম।

তারপর গুঁড়ি মেরে অন্য পাশে গিয়ে প্রিয়বর্ধনের শিসের অপেক্ষা করতে হল। একটু পরেই সেই শিস কানে এল। পাল্টা শিস দিলুম। তখন প্রিয়বর্ধন এসে হাজির হল। ফিসফিস করে বলল, মদের নেশায় কাহিল ব্যাটারা। আগে এই মালপত্রগুলো ধরো। তারপর অন্য কথা।

জিগ্যেস করলুম, চাবি হাতাতে পেরেছ তো?

হুঁউ। অনেক কিছুই। আমরা এখন রাজা হতে চলেছি!…

তখন রাত এগারোটা বেজে চল্লিশ মিনিট। আমাদের মোটরহোট ছুটেছে অকূল সমুদ্রে। প্রিয়বর্ধন যা সব হাতিয়ে এনেছে, তা হল : একটা স্টেনগান, একটা কিটব্যাগ, কিটব্যাগের ভেতর শতিনেক প্যাকেট করা কার্তুজ আর সেই চুরি যাওয়া দেবীমূর্তি। হ্যাঁ, আরও একটা জিনিস হাতিয়ে এনেছে প্রিয়বর্ধন। একটা খাদ্যদ্রব্যের প্রকাণ্ড প্যাকেট। তার ভেতর জ্যাম, জেলি, সসেজ, ফ্রায়েড ফিশের টুকরো, পাঁউরুটি পর্যন্ত। প্রিয়বর্ধন তবু পস্তাচ্ছিল। কেন যে ছাই ওদের কফির ফ্লাস্কুটা নিয়ে এলুম না। আহা, সমুদ্রের বুকে কফি খাওয়ার চেয়ে আনন্দ আর কিছুতে নেই!

এক সময় জিগ্যেস করলুম, কিন্তু এভাবে আমরা যাচ্ছি কোথায়? একসময় জ্বালানি ফুরিয়ে যাবে, তখন মোটরবোট অচল হয়ে যাবে না?

প্রিয়বর্ধনের আনন্দের ঘোরটা এককথায় যেন কেটে গেল। ঝুঁকে পড়ে মোটরবোটের কম্পাস দেখে নিয়ে বলল, সর্বনাশ! উত্তরে যেতে গিয়ে যে দক্ষিণে চলেছি। জ্বালানি যা আছে, আর অন্তত ঘন্টা তিনেক চলবে।

সে মোটরবোটের মুখ ঘুরিয়ে দিল। কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার, সমুদ্রের এই এলাকায় তীব্র স্রোত আর ঢেউগুলোও রুখে দাঁড়াচ্ছে। যতবার মোড় নেওয়ার চেষ্টা করে মোটরবোট উল্টে যাওয়ার তালে থাকে। তাই হাল ছেড়ে দিয়ে প্রিয়বর্ধন বলল, যেখানে খুশি যাক্। আর কিছু করার নেই।

আসন্ন বিপদের মুখে আমার বুদ্ধি খুলে গেল। স্পটলাইটটা জ্বেলে দিয়ে বললুম, প্রিয়বর্ধন, তুমি বলছিলে মূর্তিটার ভেতর কিওটা দ্বীপে যাওয়ার নক্সা আছে। একবার সেটা দেখলে হত না? যদি জ্বালানি থাকতে-থাকতেই আমরা সেখানে পৌঁছে যেতে পারতুম।

প্রিয়বর্ধন মুখ বেজার করে বলল, দেখতে পারো। তবে ক্যারিবোর মতো ঘুঘু যখন হুদিশ করতে পারেনি, তুমি পারবে বলে মনে হয় না।

মূর্তিটা সত্যি অপরূপ। অবিকল আমাদের দেবী সরস্বতীর মতো। হাতে বীণাও রয়েছে। মূর্তিটা পরীক্ষা করে উলটে পালটে দেখেও বুঝতে পারছিলুম না, ওর ভেতরে কিছু থাকতে পারে কি না। সাবধানে মোচড় দিয়ে দেখলুমও প্যাঁচ থাকলে যদি খোলা যায়। কিন্তু মূর্তিটা নিরেট।

হঠাৎ চোখ পড়ল ওটার মাথার পেছনে। একটা পেরেকের মতো। ওটাতে যেই চাপ দিয়েছি, তলার দিকের একটা জায়গা ঢাকনার মতো খুলে গেল। আর ঠকাস করে কী একটা পড়ল নিচের পাটাতনে। কুড়িয়ে দেখি, একটা কাত্তি!

অবিকল একই কাত্তি—যেমনটি রাজাকোর টুপির ভেতর পেয়েছিলুম। একই নকশা। প্রিয়বর্ধন বাঁ হাত বাড়িয়ে কাত্তিটা নিয়ে উলটেপালটে দেখে ফেরত দিল। বুঝলুম, কাত্তি জিনিসটা কী ও জানে না।

কাত্তিটাকে খুঁটিয়ে দেখতে দেখতে আবিষ্কার করলুম, নকশাগুলো একদিকে নেমে গিয়ে যেন হঠাৎ শেষ হয়ে গেছে বেখাপচাভাবে। মাঝখানে একটা তেমনি গাছ আছে, কিন্তু শেকড়গুলো কিনারায় হঠাৎ শেষ হওয়ায় মনে হল, জায়গার অভাবে পুরোটা আঁকা হয়নি, নাকি এটা আঁকিয়ের খেয়াল? ইংরেজি এ বি সি ডি ই এফের পর জিয়ের আধখানা কাটা।

তাহলে কি এটা অন্য একটা কাত্তির সঙ্গে মিলিয়ে নেওয়ার জন্য? অর্থাৎ রাজাকোর টুপির ভেতর পাওয়া কাত্তিটা না পেলে এটার রহস্য উদ্ধার করা যাবে না?

উলটো পিঠটা দেখামাত্র আমার সংশয় ঘুচে গেল। উলটো পিঠে গাছটা নেই শেকড়গুলো আছে। এ বি সি ডি ই এফ নেই, জি এইচ আই জে কে এল আছে। রাজাকোর কাত্তির উলটো পিঠটা ভাল করে লক্ষ্য করিনি। এর মানে দাঁড়াল : দুটো কাত্তি পরপর মিলিয়ে রাখলে দুপিঠে দুটো শেকড়ওলা গাছ দেখা যাবে এবং বারোটা রোমান হরফ দেখা যাবে চক্রকারে সাজানো।

প্রিয়বর্ধনকে ব্যাপারটা বুঝিয়ে দিলে সে আরও হতাশ হয়ে পড়ল!…

ভোর চারটেয় আমাদের মোটবোটের জ্বালানি ফুরিয়ে গেল। বৈঠা টানা নিরর্থক। তীব্র সমুদ্রস্রোত আর পেছনের ঢেউয়ের ধাক্কায় বোট গতিহারা হতে পারছে না।

দেখতে দেখতে দিনের আলো ফুটে উঠেছিল। সেই ধূসর আলোয় আমাদের এতক্ষণে চোখে পড়ল সামনে দীর্ঘ একটা কালো রেখা যেন। প্রিয়বর্ধন চেঁচিয়ে উঠল আনন্দে, মাটি! মাটি! আমরা মাটির দিকে চলেছি!

সমুদ্রের চারদিকে চাপচাপ লাল রং। প্রথম সূর্যের আভা ঝলমলিয়ে উঠেছে। প্রিয়বর্ধন মোটরববাটের সামনের ড্রয়ার খুঁজে একটা বাইনোকুলার পেয়ে গেল। দূরবীক্ষণ যন্ত্রটাতে চোখ রেখে সেই কালো রেখাটা দেখার পর সে গম্ভীর মুখে বলল, আর কিছুক্ষণের মধ্যে আমাদের মৃত্যু হবে জয়ন্ত! ঈশ্বরের নাম জপ করো! ওই মাটি কবরের মাটি।

ঝটপট ওর হাত থেকে বাইনোকুলারটা নিয়ে চোখে রাখলুম। দীর্ঘ আলো, রেখাটা প্রবাল বলয়। খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সমুদ্রের ওপর। ডানদিকে অনেকটা জায়গা ভাঙা। আর ভেতর দিয়ে একটা দ্বীপ দেখা যাচ্ছে। দ্বীপের বুকে ঘন জঙ্গল। প্রথম আলোয় সবুজের জেল্লাও চোখে পড়ছিল।

প্রিয়বর্ধন করুণ মুখে বলল, আমদের বোট কোরাল রিফে গিয়ে প্রচণ্ড ধাক্কা খেয়ে গুঁড়ো হয়ে যাবে। কী তীব্র স্রোত দেখতে পাচ্ছ না জয়ন্ত?

বললুম, ওই ভাঙা জায়গায় বোট নিয়ে গেলে বেঁচে যাব। এস প্রিয়বর্ধন, বৈঠা নাও!

প্রিয়বর্ধন অনিচ্ছাসত্ত্বেও বৈঠা নিল। দুজনে প্রাণপণে বৈঠা টেনে বোটের মুখ প্রবাল পাঁচিলের ভাঙা অংশটার দিকে ঘুরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলুম। যত এগিয়ে যাচ্ছি, তত প্রবাল পাঁচিলটা উঁচু মনে হচ্ছে। আন্দাজ শদুই মিটার দূরত্বে পৌঁছে যেন একটা বিস্ফোরণ ঘটে গেল। ছিটকে গিয়ে সমুদ্রে পড়লুম। জলে না পড়লে গুড়ো হয়ে যেত এই মরদেহ।

সাঁতার কেটে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিলুম ভাঙা অংশটার দিকে। ভেসে থেকে প্রিয়বর্ধনকে খুঁজছিলুম। দেখি, সেও আমার মতো সাঁতার কাটছে। বুঝলুম ড়ুবো পাথরে ধাক্কা লেগে বোটটা ভেঙে-চুরে গেছে। ওলটপালট খেতে কাঠের বড় বড় ফালি ফেনার ভেতর মাছের মতো ভেসে চলেছে প্রবাল পাঁচিলের দিকে। ঢেউ ভাঙার গর্জন, ফেনা, জলোচ্ছ্বাস—চারদিকে যেন প্রলয় চলছে।

তারপর পায়ে শক্ত পাথর ঠেকল। সিধে হয়ে দাঁড়িয়ে প্রিবর্ধনকে আর দেখতে পেলুম না। কিন্তু তার কথা ভাবতে গেলে নিজের প্রাণ বাঁচানো সংশয়তাছাড়া যাকে দেখতে পাচ্ছি না, তাকে উদ্ধার করব কী ভাবে? জলের ধাক্কায় পিছলে যাচ্ছি বারবার। হাঁচড়-পাঁচড় করে জল ভাঙা অংশটা পেরিয়ে গেলুম। এবার জলটা শান্ত-নিস্তরঙ্গ। সাঁতার কেটে বিচের দিকে এগিয়ে যেতে আর অসুবিধা হল না। মাথা ঘুরছিল। তখন পা ছড়িয়ে চিত হয়ে শুয়ে রইলুম।

আচ্ছন্ন অবস্থায় কতক্ষণ শুয়ে ছিলুম জানি না, এক সময় মনে হল কোথায় যেন অনেক দূরে চাপা গম্ভীর অর্কেস্ট্রা বাজছে। নিশ্চয় এই দ্বীপে কোনও গির্জা আছে। সেখানে এক প্রার্থনা সঙ্গীতের আয়োজন বুঝি। আশ্রয় পাব। খাদ্য পাব। দেশে ফিরে যাব। আনন্দে মন ভরে গেল।

খুব আশা ও উত্তেজনায় উঠে দাঁড়ালুম। বেলাভূমির ওপর দিকে ঘন বনের ভেতর থেকে সেই চাপা গম্ভীর অর্কেস্ট্রাধ্বনি ভেসে আসছে। কিন্তু যেই কয়েক পা এগিয়ে গেছি, কেউ খ্যানখেনে গলায় চেঁচিয়ে বলল, স্টপ ইট! স্টপ ইট! আই সে-স্টপ ইট!

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত