চোখ খুলে কয়েক সেকেন্ড কিছু বুঝতে পারলুম না। তারপর মনে হল, রুবি দ্বীপে আমাদের হোটেলেই শুয়ে আছি। কিন্তু এত আলো কেন? না—আলো নয়, রোদ ঝলমল করছে উজ্জ্বল রোদ। আমার পিঠের নিচে বালি। মাথার ওপর ঝকঝকে নীল আকাশ। আমি এখানে শুয়ে আছি কেন?
সঙ্গে সঙ্গে উঠে বসে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলুম কিছুক্ষণ। আমি কি স্বপ্ন দেখছি? নিশ্চয় একা টানা অদ্ভুত ধরনের স্বপ্নের মধ্যে কাটাচ্ছি। বাঁদিকে নারকেল বন আর ঘন আগাছার জঙ্গল। ডানদিকে উঁচু বাঁধের মতো ন্যাড়া টিলা। সামনে ছোট্ট একটা হ্রদ। তারপর পেছনে তাকিয়ে প্রিয়বর্ধনকে দেখামাত্র আগাগোড়া সবটাই মনে পড়ে গেল।
প্রিয়বর্ধন একটা গাছের তলায় আগুন জ্বেলে কী একটা করছিল আমাকে উঠতে দেখে সে মুখ ফেরাল। তার মুখে কেমন একটা মিষ্টি-মিষ্টি হাসি। হ্যালো মিস্টার! শরীর ঠিক তো?
জবাব দিলাম না। এই লোকটা আমার জঘন্য শত্রু। সে ক্যারিবোর স্কুনারে আমাকে খুন করতে চেয়েছিল। অথচ তারই সঙ্গে একই বেলায় অথৈ সমুদ্রে আমাকে ভাসতে হয়েছিল। ভাগ্যের তামাশা আর কাকে বলে? আমি অবাক হয়ে তাকে দেখছিলুম। ভাবছিলুম, ইচ্ছে করলেই সে আমাকে সমুদ্রে ফেলে দিতে পারত। কেন তা করেনি?
প্রিয়বর্ধন আমার হাবভাব দেখে হয়তো অবাক হল। বলল, কী হল? চলে এস এখানে। তোমার জন্য কিছু ব্রেকফাস্টের আয়োজন করেছি।
বলে সে হাসতে হাসতে একটা পোড়া মাছ দেখাল। সঙ্গে সঙ্গে আমার খিদে চনমন করে উঠল। তার সম্পর্কে রাগ আর শত্রুতার ভাবটাও কেটে গেল। তার কাছে গিয়ে বসে পড়লুম। সে একরাশ কাঠকুটো জড়ো করে আগুন জ্বেলেছে। আগুনের কুণ্ডের পাশে কয়েকটা পোড়া আর কয়েকটা তাজা মাছ। মাছগুলো দেখতে বাচ্চা ইলিশের মতো। আমার হাতে একটা পোড়া মাছ গুঁজে দিয়ে প্রিয়বর্ধন নিজেও একটা চিবুতে শুরু করল। চিবোতে চিবোতে বলল, তুমি অবাক হচ্ছ না মিস্টার?
বললুম, নিশ্চয় হচ্ছি। কারণ এতক্ষণে আমাদের হাঙরের পেটে থাকার কথা।
প্রিয়বর্ধন আরও জোরে হেসে বলল, বরাত জোরে এ যাত্রা জোর বেঁচে গেছি। আসলে কী জানো? ওই রবারের ভেলাগুলো খুব মজবুত এবং বিশেষ ধরনে তৈরি। যত ঢেউ থাক, কিছুতেই ওল্টাবে না। তাছাড়া আমি হলুম সমুদ্রের বাচ্চা। আজীবন সমুদ্রের মানুষ হয়েছি।
বাধা দিয়ে বললুম, কিন্তু এখানে এলুম কী ভাবে?
যেভাবে আসা উচিত। প্রিয়বর্ধন আগুনে আরেকটা মাছ রেখে বলল। সারা রাত আমরা ভেলায় কাটিয়েছি। তুমি তো ভিরমি খেয়ে পড়ে ছিলে ভয়ের চোটে। অগত্যা তুমি যাতে ভেলা থেকে ছিটকে হাঙরের পেটে ঢুকে না যাও, আমি তোমার পেটের ওপর পা চাপিয়ে ঠেসে রেখেছিলুম।
নচ্ছার লোকটা আমার পেটের ওপর পা চাপিয়েছিল ক্যারিববার মতো, ভাবতেই গা জ্বালা করে। কিন্তু লোকটাকে যতটা খারাপ মনে করেছিলুম, ততটা খারাপ নয়। বললুম, তারপর এখানে কীভাবে এলুম?
প্রিয়বর্ধন বলল, ভোর নাগাদ ভেলামশাই নিজের ইচ্ছে মতো এনে ফেলল এই সৃষ্টিছাড়া দ্বীপে। আমি কি নিজের ইচ্ছেয় এসেছি? ওই যে বাঁধের মতো টিলা পাহাড় দেখছ, তার নিচে সমুদ্র। বাপস! কিনারা জুড়ে ড়ুবো পাথরে ভর্তি—ভেলাটার সঙ্গে ঠোক্কর লাগলে দুজনেই গুড়ো হয়ে যেতুম। বুঝলে মিস্টার? ভেলাটাকে পুজো করা উচিত। ওই দেখ, ওকে গাছে টাঙিয়ে রেখেছি।
গাছের গুঁড়ির মাথায় চুপসে যাওয়া প্রকাণ্ড টায়ারের মতো ভেলাটাকে দেখতে পেলুম। বললুম, আমি তাহলে সারারাত অজ্ঞান ছিলুম?
হুঁ, ছিলে। কাজেই তোমার ঠ্যাং দুটো ধরে টানতে টানতে বিচে নামাতে হল। তারপর একবার ভাবলুম, তোমাকে বিচেই ফেলে রাখি। কিন্তু এই জঘন্য দ্বীপে যা শকুনের উপদ্রব! তোমাকে একা ফেলে যে ক্ষিদে মেটাতে আসব, উপায় নেই। তবে তার চেয়ে বড় কথা, আমি নারকোল গাছে চড়তে পারিনে। সমুদ্রের বাচ্চা তো! তাই ভাবলাম, তোমাকে বাঁচিয়ে রাখা দরকার। তুমি নিশ্চয় নারকোল গাছে চড়তে পারো?
মোটেও পারি না।
প্রিয়বর্ধন লাফিয়ে উঠল। পারো না? তাহলে কেন তোমাকে কাঁধে করে এই নিরাপদ জায়গায় নিয়ে এলুম?
বুঝতে পারছিলুম, লোকটি খুব আমুদে প্রকৃতির। সে আমাকে বয়ে এনে এখানে শুইয়ে রেখেছে। তারপর হ্রদের জলে পাথর ছুড়ে একগাদা মাছ মেরে এনেছে। কিন্তু আগুন কোথায় পেল? জিগ্যেস করলে তার বুদ্ধির পরিচয়ও পেলুম। দুটো শুকনো কাঠে ঘষাঘষি করে শুকনো পাতা উলাই করে গুলতি বানিয়ে ফুঁ দিতেই আগুন জ্বলে উঠেছে। ব্যাপারটা ভারি সোজা। প্রথমে কাঠ দুটো জ্বলে উঠবে। তখন গুঁড়ো পাতার গুলতিটা ধরিয়ে নিলেই হল।
রোদে শুয়ে থাকার ফলে আমার ভিজে পোশাক যেমন শুকিয়ে গেছে তেমনি সারা রাতের সমুদ্র জলের হিমটাও গেছে ঘুচে। সূর্য মানুষের শরীরকে শক্তি জোগায়। আমি এখন সম্পূর্ণ ফিট হয়ে গেছি। একটুও দুর্বলতা টের পাচ্ছি না।
হ্রদটা ছোট। সমুদ্রের সঙ্গে তার যোগ নেই; বৃষ্টিজলের হ্রদ। তাই জলটা পান করা যায়। খুব স্বচ্ছ সেই জলে মাছের ঝাক দেখে তাক লেগে গেল।
জল খেয়ে সেই গাছের তলায় ফিরে প্রিয়বর্ধন বলল, একেই বলে বরাত। কাল সন্ধ্যার আগে পর্যন্ত আমরা ছিলুম শত্রু। এখন হয়েছি বন্ধু। যাক্ গে, তোমার নামটা কী বলছিলে যেন কাল?
জয়ন্ত চৌধুরি।
জয়ন্ত, আমরা কোথায় এসে পড়েছি জানো? বলে সে ভয়ের চোখে চারদিক দেখে নিল। আমার খালি সন্দেহ হচ্ছে, এ যেন সেই ডাইনির দ্বীপ।
ডাইনির দ্বীপ মানে?
ছেলেবেলা থেকে নাবিকদের কাছে ডাইনির দ্বীপের ভয়ঙ্কর সব গল্প শুনেছি। থাগে, ওসব বলতে নেই। বললেই বিপদ হবে শুনেছি। আমাদের কাছে অস্ত্রশস্ত্রও নেই। তোমার পকেটে একটা রিভলভার ছিল। সেটা কাছে রেখেছি। কিন্তু জলে ভিজে অকেজো হয়ে গেছে। গুলিগুলো পর্যন্ত বের করা গেল না।
আমার রিভলভার নিয়েছ কেন? ফেরত দাও।
মুচকি হেসে প্রিয়বর্ধন পকেট থেকে আমার অস্ত্রটা বের করে দিল। পরীক্ষা করে দেখলুম, সত্যি ওটা অকেজো হয়ে গেছে। প্রিয়বর্ধন বলল, আমার স্টেনগানটা কখন সমুদ্রে ছিটকে পড়েছে টের পাইনি। যাক দুটো লাঠি ভেঙে নিই গাছের ডাল থেকে। তারপর সমুদ্রের ধারে গিয়ে বসব—যদি দৈবাৎ কোন জাহাজ চোখে পড়ে। নিদেনপক্ষে ভেলাটা তো রইলই। গায়ে জোর ফিরে পেলেই ভেসে পড়া যাবে।
সমুদ্রতীরে যাওয়ার সময় নারকোল বনের ভেতর অসংখ্য শুকনো নারকোল পড়ে থাকতে দেখলুম। কিন্তু প্রিয়বর্ধনের শুকনো নারকোল নাকি মুখে রোচে না। গাছের ডগায় ঝুলন্ত নরম নারকোল শাঁসের কথা বলতে তার জিভে জল এসে গেল। আমাকে গাছে চড়ানোর জন্য সাধাসাধি করেও যখন রাজি হলুম না, তখন তার মুখটা বেজার হয়ে উঠল। কিন্তু আমি জানি, এই দ্বীপ থেকে উদ্ধার না পেলে শুকনো নারকোলই খেতে হবে। কাহাতক মাছ পোড়া খেতে ভাল লাগবে ওর? আমি পাথরে আছাড় মেরে কয়েকটা নারকোল ভেঙে ফেললুম। তারপর টুকরো শাসগুলো জামা ও প্যান্টের পকেটে বোঝাই করলুম। ন্যাড়া পাথরের বাঁটে বসে যখন সেগুলো চিবোচ্ছি, তখন প্রিয়বর্ধন হাত বাড়িয়ে বলল, দেখি একটুখানি!
কিছু চিবিয়েই সে ফেলে দিল। তবে একথাও সত্যি এমন স্বাদ গন্ধহীন নারকোল জীবনে কখনও খাইনি। রুবিদ্বীপের নারকোল খেকো চিংড়িগুলোর কথা মনে পড়ছিল। আহা, সেই সুস্বাদু চিংড়ি সমুদ্র থেকে যদি ধরা যায়। লোভী চোখে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে রইলুম।
ড়ুবো পাথরে বহুদুর পর্যন্ত সমুদ্রের নীল জলে কালো কালো ছোপ পড়ে আছে। যেন অসংখ্য দানবের মাথা। কোনওটা হাতির মতো দেখাচ্ছে। পাথরগুলো ড়ুবে যাচ্ছে, আবার ভেসে উঠছে। সাদা ফেনার পুঞ্জ জমছে। জলের শব্দও প্রচণ্ড। ওই সব পাথরের ভেতর দিয়ে ঠোক্কর খেতে খেতে রবারের ভেলাটা ভদ্রলোকের মতো আমাদের তীরে পৌঁছে দিয়েছে। সত্যি, ভেলাবাবাজির পুজো দেওয়া উচিত।
দিগন্তে মাঝে মাঝে কালো রেখা ভেসে উঠেছিল। নিশ্চয় আর একটা দ্বীপ। কিন্তু দূরের দিকে কোনো জাহাজ বা নৌকো চোখে পড়ছিল না। প্রিয়বর্ধন ঠোঁট কামড়ে ধরে সমুদ্র দেখছিল। কিছুক্ষণ পরে ফেঁস করে শ্বাস ছেড়ে বলল, শয়তান ক্যারিববাকে যদি এখন পেতুম! ওর মুণ্ডুটা কচকচ করে খেয়ে খিদে মেটাতুম!
ক্যারিববা তোমাকে ফেলে পালিয়ে গেল কেন প্রিয়বর্ধন?
আমার প্রশ্ন শুনে প্রিয়বর্ধন চুপচাপ পাথরে লাঠিটা দিয়ে আঁচড় কাটবার ব্যর্থ চেষ্টা করল। তারপর বলল, কিয়াংকে ও ভীষণ ভয় পায়। কিয়াং কোটিপতি লোক। ওর দলবল বিরাট। ক্যারিববা তো এক সময় কিয়াংয়েরই ডান হাত ছিল।
দুজনের বিবাদের কারণ কী?
রোমিলার বাবা রাজাকোর ঘর থেকে যে দেবীমূর্তিটা চুরি করে এনে ক্যারিববাকে দিয়েছি, বিবাদ ওইটে নিয়ে। জিনিসটার আসল মালিক হল কিয়াং। ক্যারিববা ওটা কিয়াংয়ের বাড়ি থেকে চুরি করে রাজাকোকে বেচেছিল। কিয়াং ক্যারিবোকেই সন্দেহ করেছিল। তাই তাকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করেছিল। ক্যারিববা রাজাকোর সেই টাকায় স্কুনার কিনেছিল। তারপর যেভাবেই হোক, সে জানতে পেরেছিল, মূর্তিটার ভেতর কিওটা দ্বীপের সন্ধান লেখা আছে।
চমকে উঠলুম। কিওটা দ্বীপের? মানে—যে দ্বীপে গাছপালা কথা বলে?
প্রিয়বর্ধন হাসল। আমার ভুল শুধরে দেওয়ার ভঙ্গিতে বলল, উঁহু—গান গায়।
বেশ। তারপর?
তারপর আর কী? ক্যারিবো আমাকে টাকার লোভ দেখাল। তাছাড়া প্রতিজ্ঞা করে বলল, আমাকে ও কিওটা দ্বীপে নিয়ে যাবে। আমি শয়তানটার কথায় পড়ে রোমিলার মতো ভাল মেয়ের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে ফেললুম। ওঃ! নরকে আমার জায়গা হবে না জয়ন্ত!
অনুতাপে সে চুল আঁকড়ে ধরল। বললুম, যাক গে, যা হওয়ার হয়ে গেছে। এখন আর বলে লাভ নেই। কিন্তু কাল সন্ধ্যায় কিয়াংয়ের দলই কি ক্যারিবোর স্কুনারে হামলা করেছিল? কেন?
কিয়াং নিশ্চয় টের পেয়েছে, মূর্তিটা এতদিন রাজাকোর কাছে ছিল এবং আবার সেটা ক্যারিববার কাছে ফিরে এসেছে। কিয়াংয়ের চারদিকে চর।
তাহলে কি রাজাকোকে খুন করেছে কিয়াংয়েরই লোক?
তা আর বলতে?
এসব কথা শুনে মনমরা হয়ে বললুম, তাহলে এতক্ষণে ক্যারিবো কিওটা দ্বীপের দিকে রওনা হয়েছে। হয়তো পৌঁছেও গেছে।
প্রিয়বর্ধন জোরে মাথা নেড়ে বলল, অত সহজ নয়। মোটরবোট নিয়ে কিওটা যাবে! আমার মনিব রাজাকো একদিন নেশার ঘোরে আমাকে বলেছিলেন, কিওটা নামে একটা দ্বীপ আছে—তার চারদিকে পাহারা দেয় জলের ডাইনিরা। কাজেই বুঝতে পারছ, এতক্ষণে ক্যারিববার মাংস ডাইনিরা ছিঁড়ে খাচ্ছে।
কিন্তু প্রিয়বর্ধন, গান করে এমন সব গাছ দেখাতেই বা এত আগ্রহ কেন ক্যারিববার? কেন সেখানে কিয়াংই বা যেতে চায়?
প্রিয়বর্ধন চাপা গলায় বলল, ওই দ্বীপে নাকি প্রাচীন যুগের জলদস্যুদের বিস্তর ধনরত্ন লুকানো আছে।
হেসে ফেললুম।সেই চিরকেলে গল্প! গুপ্তধন আর গুপ্তধন! প্রিয়বর্ধন, গুপ্তধনের গল্প কখনও সত্য হয় না।
প্রিয়বর্ধন আমার পরিহাসে কান করল না। বলল, তুমি জানো না জয়ন্ত, কোকেস আইল্যান্ড কেন, সারা তল্লাটে যেখানে যাবে, তুমি কিওটা দ্বীপের অদ্ভুত অদ্ভুত গল্প শুনতে পাবে। সেখানকার গাছপালা গান গেয়ে সেই গুপ্তধনের খোঁজ দেয়। গানের সুরে বলে, আয়, তোকে রাজা করে দিই!
প্রিয়বর্ধন কিওটা দ্বীপের বিচিত্র সব গল্প বলতে থাকল।
আমি ক্রমশ হতাশ হয়ে পড়ছিলুম। এতদিন কর্নেল নীলাদ্রি সরকারের সঙ্গে কত অ্যাডভেঞ্চারে গিয়ে কত না বিপদে পড়েছি। কিন্তু চরম মুহূর্তে উনি ত্রাণকর্তার মতো আমার উদ্ধারে হঠাৎ যেন মাটি খুঁড়ে হাজির হয়ে সহাস্যে সম্ভাষণ করেছেন, হ্যাল্লো ডার্লিং! এই দ্বীপে নির্বাসিত হয়েও তার আশা করতে দোষ কী?…
কিন্তু দিনটাই বৃথা কেটে গেল। উদ্ধার হওয়ার কোনও লক্ষণ দেখলুম না। দুপুরে দুজনে হ্রদের জলে স্নান করলুম। আবার সেই পোড়ামাছের লাঞ্চ। আবার জাহাজের আশায় সমুদ্রের ধারে গিয়ে বসে থাকা। তারপর দিন ফুরিয়ে আসছে দেখে রাতের আশ্রয়ের কথা ভাবতে হল দুজনকে। কাল সকালে বরং ভেলায় ভেসে পাড়ি জমানোর কথা ভাবা যাবে।
এই দ্বীপটা খুবই ছোট। উঁচু জায়গায় দাঁড়িয়ে সেটা বুঝতে পেরেছিলুম। হ্রদের অন্যদিকটায় জঙ্গলের ভেতর কালো পাথরের কয়েকটা পাহাড় দেখা যাচ্ছিল। ওখানে আমরা আরামে রাত কাটানোর মতো একটা গুহা আবিষ্কার করে ফেললাম।
সারাদিন কোনও জনমানুষ দেখিনি। প্রাণী বলতে কয়েকটা গিরগিটি দেখেছি আর এক দঙ্গল শকুন! তারা কী খেয়ে বেঁচে থাকে কে জানে! গুহার ভেতর ঢুকে আগুন জ্বালিয়ে ঠাণ্ডার হাত থেকে বাঁচা গেল। এখানকার শুকনো কাঠগুলোর আশ্চর্য গুণ। একটু ঘষলেই ধোঁয়া উড়তে থাকে। সহজে আগুন ধরে যায়।
গুহার ভেতরটা বেশ মসৃণ। দরজাটা বড়। দরজার কাছে বসে প্রিয়বর্ধন লাঠি হাতে পাহারা দিচ্ছিল। একরাশ কাঁচা পাতা আর ঘাস ছিঁড়ে এনে বিছানা করেছে। ক্লান্তিতে ঘুম এসে গিয়েছিল। আমার ঘড়িটা ভাগ্যিস অক্ষত আছে। প্রিয়বর্ধনের ঘড়িটাও অটুট, দিব্যি সময় দিচ্ছে। পালাক্রমে দুজনে ঘুমোব এবং পাহারা দেব।
সবে চোখ বুজেছি। বাইরে অন্ধকার ঘন হয়েছে। গুহার ভেতর আগুনটা ধিকিধিকি জ্বলছে এবং প্রিয়বর্ধন গুনগুন করে কী গান গাইছে অজানা ভাষায়। হঠাৎ তার গান থেমে গেল। চাপা গলায় সে বলে উঠল জয়ন্ত! জয়ন্ত! ঘুমলে নাকি?
চমক খেয়ে উঠে বসে বললম, কী হয়েছে?
ঝটপট আগুনটা নিভিয়ে ফেলো। এদিকে একটা আলো এগিয়ে আসছে।
প্রিয়বর্ধনের গলার স্বর কঁপছিল। আমি আগুনের কুণ্ডে একরাশ কঁচা পাতা চাপিয়ে দিয়ে দরজায় উঁকি দিলুম। নিচে হ্রদের ধারে সত্যি একটা আলো। তবে আলোটা এগিয়ে আসছে না। থেমে আছে।