সবুজ বনের ভয়ংকর- রাজাকোর ঘরে হানা

সবুজ বনের ভয়ংকর- রাজাকোর ঘরে হানা

রোমিলার পোশাকও একেবারে ভারতীয় মেয়েদের মতো। শাড়ি ও ব্লাউজপরা। শুধু খোঁপাটা মাথার মাঝখানে চুড়ো করে বসানো প্রাচীন যুগের মুনিকন্যাদের মতো। গলায় সেইরকম রুদ্রাক্ষের মালা।

আমি হাঁ করে তাকিয়ে আছি দেখে ইংরাজিতে সে বলল, আপনি নিশ্চয় অবাক হয়েছেন। আমার হতভাগ্য বাবার নাম রাজাকো বাদান, কাল যাঁকে নৃশংসভাবে খুন করা হয়েছে আপনারই সামনে!

দুঃখিতভাবে বললাম, কথাটা ঠিকই মিস রোমিলা! কিন্তু আমার কিছু করার ছিল না। দুজনের মধ্যে তখন প্রায় অড়াইশো গজ দূরত্ব। তা ছাড়া সন্ধ্যা হয়ে এসেছিল। আমি দৌড়ে যেতে যেতে খুনিরা পালিয়ে যায়।

রোমিলা বলল, না মিঃ চৌড্রি! আমি কোনও অভিযোগ নিয়ে আপনার কাছে আসিনি। এ সামোয়া হোটেলের রিসেপশনিস্ট তোতিলাবতী আমার বন্ধু। তার কাছেই আপনার কথা কাল রাতে শুনেছি। তোতিও খুব পস্তাচ্ছে। সে প্রথমে নাকি আপনার কথায় গুরুত্ব দেয়নি। আসলে বাবার খুবই বদনাম ছিল এখানে।

আগে আপনি বসুন প্লিজ।

রোমিলা বসে বলল, আপনার সঙ্গী ভদ্রলোকেরা নিশ্চয় ডঃ বিকর্ণের বাড়ি গেছেন?

আপনি কীভাবে জানলেন?

রোমিলা একটু হাসল। ডঃ বিকর্ণ যখন জাকার্তার বিশ্ববিদ্যালয়ে উদ্ভিদবিদ্যার প্রধান অধ্যাপক ছিলেন, তখন আমি তার ছাত্রী ছিলাম। উনি আমাকে খুব স্নেহ করতেন। সত্যি বলতে কী, আমারই তাগিদে উনি কোকোসে এসে স্থায়ীভাবে বাড়ি করে বাস করছেন। ওঁকে বলেছিলাম, আমাদের এসব দ্বীপে উদ্ভিদ নিয়ে গবেষণার প্রচুর সুযোগ আছে। আমি ওঁকে সাহায্য করতে পারি।

খুব আগ্রহ জাগল রোমিলা সম্পর্কে। বললাম, আপনি এখন কী করেন?

রোমিলা বলল, আমার দুর্ভাগ্য মিঃ চৌড্রি! জাকার্তা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় মা মারা যান। বাবা অসহায় হয়ে পড়েন। তাই বাধ্য হয়ে পড়াশুনো ছেড়ে ফিরে আসি এখানে। বাবার একমাত্র সন্তান আমি। ওঁর মাছের কারবার দেখাশোনা করছি এই একটা বছর। এর মধ্যে ডঃ বিকর্ণ রিটায়ার করে চলে আসেন আমার কথামতো। কিন্তু আমি ওঁর কোনও কাজে লাগবার সময়ই আর পাইনি। বাবা উড়নচণ্ডী মানুষ। খালি টো টো করে ঘুরে বেড়াতেন। তাই আমাকে সব দেখাশুনো করতে হয়েছে।

রোমিলার কণ্ঠস্বর সুমিষ্ট এবং আচরণ খুব নম্র। বললাম, আপনার সঙ্গে আলাপ হয়ে ভাল লাগল রোমিলা! বিশ্বাস করুন, আপনার বাবার ব্যাপারটাতে…

কথা কেড়ে রোমিলা বলল, বুঝতে পারছি। কিন্তু কীভাবে বাবাকে ওরা খুন করল, আপনার মুখ থেকে জানার জন্যেই এসেছি মিঃ চৌড্রি। রুবি দ্বীপের পুলিশ মাথা ঘামাবে না জানি। বিশেষ করে আমার বাবার জুয়াড়ি মাতাল বলে ভীষণ বদনাম ছিল। আপনি কি দয়া করে কী ঘটেছিল বলবেন?

পুরো ঘটনা সবিস্তারে বললাম। শোনার পর রোমিলা চাপা একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল,

কাত্তি শব্দটা বাবার মুখে শুনেছি। ঘুমের ঘোরে উচ্চারণ করতেন। পরে জিজ্ঞেস করলে বলতেন ও কিছু না। তা হলে দেখছি, মৃত্যুর মুহূর্তে বাবা কাত্তি শব্দটা উচ্চারণ করেছিলেন! আচ্ছা মিঃ চৌড্রি, কাত্তি জিনিসটা কী?

ওকে বলিনি যে, রাজাকোর টুপি আমি কুড়িয়ে এনেছিলাম এবং টুপির ভেতরে সত্যি কাত্তি পেয়েছি। বললাম, শুনেছি কাত্তি হল প্রাচীন পর্তুগিজ জলদস্যুনেতার তামার পদক। ফলকও বলতে পারেন। যে দস্যুনেতা একশো জাহাজ লুঠ করতে পারত, সে ওই পদক গলায় ঝুলিয়ে রাখত।

রোমিলার জন্যে ফোনে নিচের ক্যান্টিনে কফির অর্ডার দিলাম। রোমিলা অন্যমনস্ক রইল কিছুক্ষণ তারপর ফের চাপা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, বাবা মারা গেছেন। তাই আপনাকে জানাতে বাধা নেই। ছোটবেলায় মায়ের কাছে শুনেছি, বাবা জলদস্যুদের দলে ছিলেন একসময়।

উত্তেজনা চেপে রেখে বললাম, তাই বুঝি? আমাকে বলছিলেন, তিমিশিকার করে বেড়াতেন আন্টার্কটিকায়।

সে অনেক পরে। রোমিলা হঠাৎ আমার চোখে চোখ রেখে বলল, মিঃ চৌড্রি কি বলবেন আপনাদের এখানে আসার উদ্দেশ্য নিছক বেড়ানো—নাকি অন্য কিছু?

কেন এ প্রশ্ন?

আপনার সঙ্গীরা কাল বিকেলে ডঃ বিকর্ণের বাড়ি গিয়েছিলেন মিলিটারি গাড়িতে। সকালেও ফের গেলেন দেখলাম। তাই সন্দেহ জাগছে।

কিসের সন্দেহ?

আমাদের সরকার ডঃ বিকর্ণকে বহুদিন আগে কিওটা নামে এক ভূতুড়ে দ্বীপের স্পিকিং উডস অর্থাৎ কথা বলা বনের রহস্য উন্মোচনের দায়িত্ব দিয়েছেন। ডঃ বিকর্ণ নিজেই আমাকে বলেছেন একথা। উনি সরকারি অর্থসাহায্যে এ নিয়ে রিসার্চ করছেন। আমাকে ওঁর অ্যাসিন্ট্যান্ট হওয়ার কথা দিয়েছিলেন। কিন্তু প্রথম কথা, আমার যোগ্যতা কম। দ্বিতীয় কথা, বাবার মাছের কারবার নিয়ে আমি ভীষণ জড়িয়ে আছি।

একটু ইতস্তত করে বললাম, আপনি বুদ্ধিমতী শিক্ষিতা মেয়ে রোমিলা। আপনাকে বলতে দ্বিধার কারণ দেখি না, আমরা এসেছি কিওটা দ্বীপের খোঁজে।

রোমিলা ম্লান হাসল। কিওটা রূপকথা বা নিছক কিংবদন্তি হতেও তো পারে। ছোটবেলা থেকে শুনে আসছি এই ভূতুড়ে দ্বীপের কথা। এখানকার আদিবাসীদের লোককথায় কিওটা দ্বীপের গল্প আছে। ওরা তা বিশ্বাসও করে। দুদিন পরে শুক্লপক্ষ আসছে। চাঁদ দেখা গেলেই ওরা ফুলের পোশাক পরে বন-দেবতার পূজায় মেতে উঠবে। নিছক ধর্মীয় সংস্কার মিঃ চৌড্রি!

কিন্তু আপনাদের সরকার তা হলে কেন ডঃ বিকর্ণকে কিওটার রহস্য উন্মোচনের দায়িত্ব দিয়েছেন—যদি এর মধ্যে কোনও সত্য নাই থাকবে?

সত্যটুকু কী, বলি শুনুন। বছর দুই আগে একদল জেলে সমুদ্রে মাছ ধরতে গিয়েছিল! তারা যখন ফিরে এল, তখন দেখা গেল, তারা এক অদ্ভুত রোগে ভুগছে। গায়ের চামড়ার জায়গায় জায়গায় সবুজ অ্যালার্জির মতো চিহ্ন। অবিকল গাছের পাতা আঁকা যেন। হাসপাতালে তাদের ভর্তি করা হল। কিন্তু একে একে সবাই মারা পড়ল। মৃত্যুর পর দেখা গেল প্রত্যেকটি লাশ ঘন সবুজ হয়ে গেছে। সেই থেকে আমাদের সরকার ব্যাপারটা নিয়ে উদ্বিগ্ন।

আশ্চর্য! আঠারো শতকে টমাস কুকের জাহাজি লগবুকে সবুজ অ্যালার্জির কথা আছে।

পরিচারক ট্রেতে কফি রেখে গেল। দুজনে কফি খেতে থাকলাম। তারপর রোমিলা বলল, বাবা ওদের দেখতে গিয়েছিলেন। বাবার কাছে শুনেছি, কখনও-কখনও এ অঞ্চলে জেলেদের এই অদ্ভুত অসুখ হয়। কেউ বাঁচে না। বাবাও খুব কুসংস্কারগ্রস্ত মানুষ ছিলেন। বলতেন ওরা নিশ্চয় কিওটা দ্বীপে গিয়ে পড়েছিল।

তা হলে আপনার বাবাও বিশ্বাস করতেন একথা?

বাবার কথা ছেড়ে দিন। নিরলস মানুষ ছিলেন। চিরজীবন সমুদ্রচর। সমুদ্রে যারা ঘোরে, তারা অসংখ্য আজগুবি ব্যাপার বিশ্বাস করে।

আচ্ছা রোমিলা, আপনার বাবা কি কখনও কিওটা দ্বীপ খোঁজার চেষ্টা করেছিলেন?

হ্যাঁ। বললাম তো, বাবা ছিলেন বেয়াড়া আর বাতিকগ্রস্ত মানুষ। একবার আমাদের জেলেরা মাছ ধরে আনল ট্রলারে। বাবা সেবার সঙ্গে যাননি। হঠাৎ দেখা গেল, একটা মাছের রং সবুজ। বাবার অমনি বাতিক চাড়া দিল। বেরিয়ে পড়লেন ট্রলার নিয়ে সেই এলাকায়। কদিন পরে হন্যে হয়ে ফিরে এলেন। সেই সবুজ মাছটা আমি ডঃ বিকর্ণকে দিয়ে এসেছিলাম। ওটা এখনও ওঁর জারে জিয়ানো আছে।

রোমিলার সঙ্গে গল্প করতে করতে দশটা বেজে গেল। রোমিলাকে বিদায় দিতে দরজার বাইরে গেছি, হঠাৎ সে বলল, সময় থাকলে আসুন না আমার ওখানে। না-না। মাছের আড়তে যেতে বলছি না আপনাকে। সে একটু হাসল। আড়তে মাছের গন্ধে টিকতে পারবেন না এক মুহূর্ত। আমার বাড়িতে আসুন। অবশ্য যদি আপত্তি না থাকে!

কোনও আপত্তি নেই। বলে তাকে নিচে রিসেপশনে অপেক্ষা করতে বলে ঝটপট সেজে নিলাম। পকেটে রিভলভার নিতে ভুললাম না।

রোমিলা হাল্কা নীল রঙের একটা টুসিটার ছোট্ট মোটরগাড়ি এনেছিল। হোটেল এলাকা ছাড়িয়ে সমুদ্রের ধারে ধারে সুন্দর রাস্তা দিয়ে এগোল গাড়িটা। যেদিকে তাকাই, রংবেরঙের ফুল। বড় বড় ব্রেডফুডের গাছে তরমুজের মতো ফল ঝুলছে। পামগাছে বাহারি অর্কিডের ঝালর। সমুদ্র ডাইনে রেখে অনেক সবুজ টিলার গা ঘেঁষে এবং চড়াইউতরাই ভেঙে রোমিলাদের বাড়ি পৌঁছলাম। বাড়ি একটা টিলার মাথায়। রাজাকো যে পয়সাওলা লোক ছিল, বোঝা যাচ্ছিল এবার। বাড়িটা ছোট হলেও বড় সুন্দর। ফলবাগান আর বিচিত্র সব গাছপালার ভেতর ছবির মতো রঙিন বাড়িটা দেখে মনে হল, এর পেছনে যেন শিল্পীর স্বপ্ন রয়ে গেছে। কে সেই শিল্পী—রাজাকো, না তার মেয়ে?

গেটের কাছে গিয়েই রোমিলা বলে উঠল, বাড়িতে অতিথি এসেছেন মনে হচ্ছে।

দেখি, সেই মিলিটারি স্টেশনওয়াগনটা দাঁড়িয়ে রয়েছে লনের পাশে। ড্রইং রুমে ঢুকে রোমিলা বলল, কী সৌভাগ্য, কী সৌভাগ্য! আমার ঘরে এত সব গণ্যমান্য অতিথি। আর আমি কি না বাইরে কাটাচ্ছিলাম!

কর্নেল, ব্যুগেনভিলি এবং একজন অতিবৃদ্ধ ভদ্রলোক কফির পেয়ালা হাতে বসে রয়েছেন। রোমিলা বলল, মিঃ চৌড্রি, ইনিই আমার প্রফেসর ডঃ বিকর্ণ, আর এঁরা নিশ্চয় আপনার সঙ্গী!

ডঃ বিকর্ণ কর্নেল ও ব্যুগেনভিলির পরিচয় করিয়ে দিলেন। পরস্পর আনুষ্ঠানিক পরিচয়পর্ব শেষ হলে ডঃ বিকর্ণ বললেন, রোমি! এঁদের তোমার কাছে নিয়ে এলাম একটা জরুরি দরকারে। তা ছাড়া তোমার বাবার শেষকৃত্যে পৌঁছতে পারিনি—একটা কৈফিয়ত দেওয়ারও প্রয়োজন ছিল।

রোমিলা মৃদু স্বরে বলল, আপনাকে আসতে তো নিষেধ করেছিলাম রাত্রে!

বললাম, শেষকৃত্য কি রাতেই হয়ে গেছে?

ডঃ বিকর্ণ বললেন, হ্যাঁ। একানকার পুলিশের ব্যাপার এরকম। মর্গে পর্যন্ত নেয়নি বডি।

সে কী!

কর্নেল বললেন, যস্মিন দেশে যদাচার। তো জয়ন্ত, তোমার শরীর নিশ্চয় যথেষ্ট সুস্থ?

রোমিলা ভেতরে চলে গেল। বললাম, সুস্থ না হলে এলাম কী করে? মিস রোমিলা গিয়েছিলেন ওঁর বাবার হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে জানতে। তারপর ওঁর সঙ্গে চলে এলাম।

একটু পরে রোমিলা ব্যস্তভাবে এসে বলল, একটা অদ্ভুত ব্যাপার ঘটেছে। এইমাত্র হঠাৎ চোখে পড়ল—পেছনের একটা ছোট্ট ঘরে পুরনো আমলের কিছু জিনিসপত্র বাবা রাখতেন। সেই ঘরের দরজার সেফটি লক ভাঙা। আমার পরিচারিকা এবং অন্য কর্মচারী দুজন আছে, তারা কেউ কিছু বলতে পারছে না। তাছাড়া বাইরে থেকে বোঝাও যায় না দরজার লক ভাঙা হয়েছে। আমার কুকুর পাঞ্চো দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কপাটে আঁচড় কাটছিল। তাই সন্দেহ হল। তখন ঠেলে দেখি, খুলে গেল দরজা। কিছু হারিয়েছে কি না তাও বুঝতে পারছি না।

ডঃ বিকর্ণ, কর্নেল এবং ব্যুগেনভিলি উঠে দাঁড়ালেন উত্তেজিতভাবে। কর্নেল বললেন, চলুন তো দেখি।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত