কর্নেলের এই স্বভাব বরাবর দেখে আসছি। একসময় ঝানু শখের গোয়েন্দা হিসেবে নামডাক ছিল। খুনি আর অপরাধীর পেছন পেছন ছুটতে পেলে আর কোনওদিকে ফিরে তাকাতেন না। পরিচিত মহলে ওঁকে জনান্তিকে বলা হত বুড়ো ঘুঘু। ইদানীংকালে পোকামাকড়-গাছপালা অর্থাৎ প্রকৃতিচর্চায় মেতে থাকলেও গোয়েন্দাগিরির সুযোগ পেলে ছাড়তে রাজি নন।
রাজাকো-হত্যার রহস্য নিয়ে যে মেতে উঠবেন, জানাই ছিল। আমার কাছে ঘটনাটা জেনে নিয়ে সেই যে বেরিয়ে গেলেন, রাত দশটা বাজতে চলল—ফেরার নাম নেই। বৃষ্টিটা হঠাৎ এসে হঠাৎ চলে গেছে। এ তল্লাটের আবহাওয়াই এরকম।
জর্জ ব্যুগেনভিলির সঙ্গে কথা বলছিলাম। তার কাছে জানা গেল, কাত্তি কথাটার মানে ফলক। পর্তুগিজ ভাষার শব্দ এটা। কিন্তু কাত্তি কথাটার মানে ফলক বোঝায় না। এর পেছনে আছে একটা খুব পুরনো রোমাঞ্চকর ইতিহাস। প্রাচীন যুগে যে-সব পর্তুগিজ জলদস্যুনেতা একশোটা বাণিজ্য জাহাজ লুঠের গৌরব অর্জন করত, তারা এই তামার গোলাকার ফলকে নিজের নাম লিখে ঝুলিয়ে রাখত। কিন্তু তার রোমাঞ্চকর অংশটা হল এই :
দস্যুনেতা লুণ্ঠিত ধনরত্নের যে মোটা ভাগ পেত, তা গোপনে কোথাও লুকিয়ে রাখত। সেই গুপ্তধনের সন্ধান সাংকেতিক চিহ্নে খোদাই করে রাখত ফলকে। মৃত্যুর সময় সে ফলকটা দলের পরবর্তী নেতার হাতে তুলে দিত। কিন্তু সাংকেতিক চিহ্নের অর্থ ফাঁস করত না। তার মানে তুমি যখন নতুন নেতা হচ্ছ, তখন তুমিই ওর অর্থ উদ্ধার করে গুপ্তধনের মালিক হও।
জলদস্যুদের অনেকরকম কুসংস্কার ছিল। ফলকটাকে তারা খুব পরিত্র মনে করত। একশোটি জাহাজ যে লুঠ করতে পারেনি, তার সাহস হত না ওটা গলায় পরতে। তাদের বিশ্বাস ছিল, অনধিকারী ওই পবিত্র ফলক পরলে তার সর্বনাশ হবে।
দেখা যাচ্ছে, রাজাকোবুড়ো কোথাও এই রহস্যময় ফলক পেয়ে গিয়েছিল। তাকে খুন করার পিছনে ফলকঘটিত কোনও উদ্দেশ্য আছে কি না কে জানে। এর মধ্যে নাকি সতেরো শতকের দুর্ধর্ষ এক পর্তুগিজ জলদসনে আর্ভেলার নাম রয়েছে। ব্যুগেনভিলি পর্তুগিজ ভাষা জানেন। কিন্তু সাংকেতিক চিহ্নগুলির অর্থ উদ্ধার করতে পারেননি।
ব্যুগেনভিলি বললেন, বিবর্তনবাদের প্রবক্তা চার্লস ডারউইন এই কোকোস দ্বীপপুঞ্জের উৎপত্তি সম্পর্কে ভারি অদ্ভুত কথা লিখে গেছেন। এটা নাকি লক্ষ বছর আগে ছিল আগ্নেয়গিরি। কালক্রমে জলের তলায় বসে যায়। তারপর অসংখ্য ক্রেটার বা জ্বালামুখ ঘিরে জলের তলায় জমতে থাকে। প্রবালকীট। মরা প্রবালকীট আরও লক্ষ বছরে গড়ে তোলে এই সব দ্বীপ। এগুলো আসলে প্রবালদ্বীপ। যাই হোক, এখন সমস্যা হল আদিবাসীদের কিংবদন্তিখ্যাত সেই কিওটা দ্বীপটা কোথায়? হাজারটা ছোট-বড় দ্বীপের সবই কোনও না কোনও সময় অভিযাত্রীরা খুঁজে হন্যে হয়েছেন। শেষে আমিও দৈবাৎ তার সন্ধান পেয়ে হারিয়ে ফেললাম। এই ফলকটা পেয়ে এখন মনে হচ্ছে, তা হলে রাজাকো কি ওটার খোঁজ রাখত?
ব্যুগেনভিলি তুম্বো মুখে পাইপ ধরালেন। আমার মনটা বেজায় খারাপ। কী চমৎকার একজন আলাপী মানুষের সঙ্গে চেনাজানা হল এবং নিজের বুদ্ধির দোষেই হয়তো তাকে এভাবে চিরকালের মতো হারিয়ে ফেললাম। যদি আমার সঙ্গেই সে থাকত, তা হলে তাকে আততায়ীরা
আক্রমণের সাহসই পেত না। তা ছাড়া পকেটে আমার গুলিভরা রিভলভারও ছিল।
ব্যুগেনভিলি পাইপের ধোঁয়া ছেড়ে বললেন, কাত্তিটার মাঝখানে একটা গাছ আঁকা আছে। কিওটা দ্বীপে অবিকল এইরকম গাছের জঙ্গল দেখেছিলাম।
জিজ্ঞেস করলাম, সেই গাছগুলোই কি আপনার সঙ্গে কথা বলেছিল?
না, না! আমি কি কখনও বলেছি যে আমার সঙ্গে কিওটা দ্বীপের গাছপালার কোনও কথাবার্তা হয়েছে? আসলে আমি তখন একনাগাড়ে জলের ঝাঁপটা খেয়ে ভীষণ ক্লান্ত। গাছগুলো কথা বললেও জবাব দেওয়ার ক্ষমতা ছিল না। গলার স্বর ভেঙে গিয়েছিল। সে এক সাংঘাতিক অবস্থা।
তা হলে কি করে বুঝেছিলেন যে সেটাই কিওটা দ্বীপ? জর্জ ব্যুগেনভিলি একটু হাসলেন। সাতরাত্রি দ্বীপে ছিলাম। বেলাভূমির ওপরে একটা পাহাড়ি গুহায় ছিল আমার ডেরা। অনেক রাত্রে হঠাৎ কানে আসত আশেপাশের জঙ্গলে অদ্ভুত সব শনশন শব্দ হচ্ছে। প্রথমে ভাবতাম ঝড়। পরে টের পেলাম, ঝড় নয়—যেন গাছপালা থেকে বাতাসের গলায় কারা কথা বলছে। গিয়ে পরীক্ষা করার সাহস হত না।
আপনার কানের ভুলও তো হতে পারে।
ভুল নয়। কেন তা বলি শুনুন। নিভে যাওয়া পাইপ আবার লাইটার জ্বেলে ধরিয়ে ব্যুগেনভিলি বললেন, কিওটাও এমনি প্রবালপাঁচিলে ঘেরা। তা ছাড়া ওটার মাঝখানে একটা ছোট্ট লেক আছে। লেকটা কিন্তু মিঠে জলের। একদিন ব্রেডফুড বা পিঠে-ফল খেয়েছিলাম পেট ভরে। অনেক রাতে জলতেষ্টা পেল প্রচণ্ড। তখন লেকে জল খেতে গেলাম। জল খেয়ে অন্ধকারে ফিরে আসছি, হঠাৎ কেউ কোখেকে ফিসফিস করে বলে উঠল, অ্যানজেলো! অ্যানজেলো! আমি হকচকিয়ে গেলাম। তারপর শুনি একসঙ্গে অনেকগুলো কণ্ঠস্বর! অ্যানজেলো! অ্যানজেলো! অ্যানজেলো!
তারপর?
সাড়া দিয়ে বললাম, কে তোমরা? অ্যানজেলো বলে কাকে ডাকছ? আমার নাম জর্জ ব্যুগেনভিলি! বেশ চেঁচিয়ে কথাটা বলেছিলাম। অমনি সব চুপ করে গেল, তখন আমার অবস্থা শোচনীয়। এ নিশ্চয় ভূতপ্রেতের কাণ্ড! এই অভিশপ্ত দ্বীপ থেকে পালাতেই হবে। সারা রাত আর ঘুম হল না। পরদিন দ্বীপের প্রায় সবটাই খুঁজলাম যদি কেউ আমার সঙ্গে রসিকতা করে থাকে। কিন্তু কোথাও কোনও জনপ্রাণীটি নেই। পাখি বলতে হাঁস আর সারসজাতীয় পাখি আছে। কিন্তু তারা রাত্রিবেলা অমন শব্দ করবে কেন? করলে তো দিনেও করবে—তাই না?
ঠিকই বলেছেন।
ব্যুগেনভিলি একটু চুপ করে থাকার পর বললেন, প্রবালপাঁচিলে ঘিরে থাকায় সমুদ্রে কোনও জাহাজ গেলেও দেখতে পেতাম না। ধরে নিয়েছিলাম ওখানেই রবিসন ক্রুশোর মতো নির্বাসিত জীবন কাটাতে হবে। লাইফবোটটা ফেঁসে গিয়েছিল। একদিন ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ একখানে একটা মরচেধরা কুড়ুল কুড়িয়ে পেলাম। এসব কুড়ুলকে বলে, সেলার্স এক্স। এগুলি নিরাপত্তার জন্য সব জাহাজে থাকে। জাহাজড়ুবির সময় দৈবাৎ কোনও কামরায় কেউ আটকে পড়লে দরজা বা দেওয়াল কেটে তাকে বের করতে এই কুড়ুল কাজে লাগে। কুড়ুলটা পেয়ে বুঝলাম দ্বীপে কোনও নাবিক আশ্রয় নিয়েছিল কোনওকালে। যাই হোক, কুড়ুল দিয়ে গাছ কেটে ভেলা তৈরি করে পাড়ি দিয়েছিলাম।
কিওটার গাছপালার যদি মানুষের মতো চেতনা থাকে, তাহলে কুড়ুল হাতে দেখামাত্র আপত্তি করা উচিত ছিল।
আমার মন্তব্য শুনে ব্যুগেনভিলি গম্ভীর হয়ে গেলেন। বললেন, তা করেনি। কিন্তু একটা ব্যাপার সত্যি ঘটেছিল। গাছের গায়ে কোপ দেওয়ামাত্র প্রচণ্ড ঝড় উঠেছিল। কিন্তু আমি তো তখন মরিয়া হয়ে উঠেছি। একটা গাছ কুড়ুলের ঘায়ে ধরাশায়ী হওয়ার পর ঝড়টা থেমে গিয়েছিল। তারপর জানেন? যতক্ষণ ধরে ভেলা তৈরি করলাম, মনে হচ্ছিল—সারা বন যেন দীর্ঘশ্বাস ফেলছে। এবং যেন মাঝেমাঝে শোকসঙ্গীত গাইছে। অবশ্য ঝিঝি পোকাদের ডাকও হতে পারে। একজন মরিয়া মানুষের পক্ষে ও ব্যাপারে কোনও কৌতূহল থাকে কি?
আমরা কথা বলতে বলতে কর্নেল ফিরে এলেন। রেনকোট খুলে রেখে বললেন, এখানকার পুলিশের কাজকর্ম ভারি অদ্ভুত! বলে কী এরকম হয়েই থাকে জুয়াড়িদের মধ্যে। রাজাকো লোকটা ছিল পাকা জুয়াড়ি। তা ছাড়া এ বৃষ্টির মধ্যে খুনির খোঁজে বেরিয়ে পড়তে তারা রাজি নয়। সকালে দেখা যাবে।
ব্যুগেনভিলি বললেন, এতক্ষণ কি থানায় বসেছিলেন আপনি?
মোটেই না। ড্রাইভারকে বললাম, চলো তো বাছা, আবার একবার ডক্টর বিকর্ণের বাড়ি।
নাম শুনে বললাম, ভারতীয় নাম মনে হচ্ছে। এখানে তা হলে ভারতের লোকও বাস করে?
মোটেই না। উনি ইন্দোনেশীয় উদ্ভিদবিজ্ঞানী। তবে তুমি ঠিকই ধরেছ। নামটা সংস্কৃত ভাষায়। ইন্দোনেশীর উচ্চারণে বিয়েকার্নো। প্রাচীনযুগে হিন্দু-সংস্কৃতি সারা দক্ষিণ এশিয়া জুড়ে প্রভুত্ব করত। একথা তোমার জানা উচিত ছিল, জয়ন্ত।
ব্যুগেনভিলি বললেন, ডঃ বিকর্ণের বক্তব্য কী?
কর্নেল একটু হেসে বললেন, রাজাকোকে উনি চেনেন। কাত্তির কথা শুনে খুব উত্তেজিত হয়ে উঠলেন। এক্ষুনি আসতে চান আমার সঙ্গে। বললাম, এই বৃষ্টির মধ্যে কষ্ট করা কেন। সকালে আমরা কাত্তি নিয়ে আপনার কাছে আসছি।
রাতের খাবার টেবিলে ঢাকা দেওয়া ছিল। তিনজনে খেতে বসলাম। প্রকাণ্ড সামুদ্রিক চিংড়ির খোসা ছাড়িয়ে কর্নেল বললেন, বলো তো জয়ন্ত, ভেতরের এই সাদা জিনিসটা কী?
একটু খেয়ে দেখে বললাম, নারকেলের দেশ। ভেতরে নারকেলের পুর ভরে দিয়েছে।
হল না ডার্লিং। এগুলো চিংড়িরই মাংস!
বাজি রাখছি। এ হচ্ছে খাঁটি নারকেল শাঁস।
কর্নেল হাসতে লাগলেন। ব্যুগেনভিলি বললেন, বিচের ধারে গাছ থেকে নারকেল পড়ে অনেক সময় ভেঙে যায়। জোয়ারে সমুদ্র সেগুলো টেনে নেয়। তখন চিংড়িগুলো নারকেল শাঁস খেয়ে ফেলে। তাই এসব চিংড়ির মাংসে নারকেলের স্বাদ।
সেই অপূর্ব চিংড়ি-নারকেলের স্বাদের তুলনা নেই। তারিয়ে তারিয়ে খেতে দেখে কর্নেল মুচকি হেসে মন্তব্য করলেন, শোওয়ার সময় কিন্তু হজমি ট্যাবলেট খাওয়া দরকার… এ উপদেশ কানে না নেওয়ার ফলটা এ রাতে ভালই ভুগতে হল। শেষ রাতে ব্যুগেনভিলি একটা জব্বর ফরাসি ট্যাবলেট না খাওয়ালে কী ঘটত বলা কঠিন। সকালে যখন ওঁরা দুজনে ডঃ বিকর্নের বাড়ি গেলেন, তখন আমি শয্যাশায়ী। মন খারাপ হয়ে গেল। নটা নাগাদ উঠে দেখি, শরীর একেবারে ঘায়েল। এমন সময় নিচে থেকে মিস তোতি ফোন করে জানাল, একটি মেয়ে আপনার সঙ্গে দেখা করতে চায়। খুব অবাক হয়ে গেলাম। বললাম, পাঠিয়ে দিন।
একটু পরে বছর কুড়ি-বাইশের টুকটুকে ফর্সা একটি মেয়ে এসে ভারতীয় প্রথায় নমস্কার করে বলল, আমি রোমিলা। মিঃ রাজাকোর মেয়ে।