এপ্রিলের এক ঝরঝরে বৃষ্টিধোয়া বিকেলে কোকোসের ৭২নং দ্বীপ রুবি আইল্যান্ডে পৌঁছে মনে হচ্ছিল একি স্বর্গে এলাম? এ দ্বীপ যেন প্রকৃতি নিজের হাতে যত্ন করে সাজিয়ে গুছিয়ে রেখেছেন। কত ফুল কত পাখি কত প্রজাপতি!
কর্নেলের আবার প্রজাপতির পেছনে ছুটোছুটির বাতিক আছে। কিন্তু আশ্বস্ত হয়ে লক্ষ্য করলাম, উনি জর্জ ব্যুগেনভিলির সঙ্গে নিচু গলায় কথা বলতে ব্যস্ত। সামোয়া এই দোতলা হোটেলের নাম। দক্ষিণের ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করছিলাম। অদূরে সাদা বালিতে ঢাকা বেলাভূমি। ভারত মহাসাগরের ব্যাকওয়াটার এখানে বেশ শান্ত ও ভদ্র। কারণ মাইলখানেক দূরে দ্বীপটাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে রয়েছে কোরাল রিফ বা প্রবাল-পাঁচিল। পাঁচিলে জায়গায় জায়গায় ভাঙন আছে। সেই ভাঙন দিয়ে সমুদ্রের জল গর্জন করতে করতে ব্যাকওয়াটারে ঢোকামাত্র শান্ত হয়ে যাচ্ছে।
দীর্ঘ জার্নিতে আমি ক্লান্ত। কলকাতা থেকে বিমানে জাকার্তা। জাকার্তা থেকে সামরিক বাহিনীর ছোট্ট একটা বিমানে এই রুবি দ্বীপে পৌঁছেছি। সরকার কিওটা-রহস্য নিয়ে বরাবর মাথা ঘামান। তাই সবরকম সাহায্য তাদের কাছে পাওয়া যাবে।
কফি এবং একজাতীয় সামুদ্রিক মাছের কেক খাওয়ার পর কর্নেল জয়ঢাক সায়েবকে নিয়ে কোথায় যেন বেরুলেন। বলে গেলেন, ঘন্টা দুই পরে ফিরব। তুমি ইচ্ছে করলে বিচে ঘোরাঘুরি করতে পারো—কোনও ভয় নেই। রুবি খুব নিরাপদ জায়গা।
আমার আঁতে লাগল। আমি বুঝি ভীতু মানুষ? ওঁরা সরকারি স্টেশনওয়াগন গাড়িতে রওনা হয়ে গেলে আমিও বেরিয়ে পড়লাম। উঁচু-নিচু সুন্দর পাহাড়ি রাস্তায় ওঁদের গাড়িটা গাছপালার
আড়ালে চলে গেল। একানড়ের মতো নিচে গিয়ে দাঁড়ালাম।
বিচে মানুষজন খুবই কম। নারকেল বীথির পাশে দাঁড়িয়ে আছি। তারপর দেখি, একটা বোর্ডে কয়েকটি ভাষায় লেখা আছে, সাবধান! সামনে বিপদ। আর এগোবেন না।
আমি তো হকচকিয়ে গেছি। বিপদ! কিসের বিপদ? হঠাৎ আমার কয়েক ইঞ্চি তফাতে গদাম করে একটা নারকেল পড়ল। ওমনি বিপদটা টের পেয়ে গেলাম। ওই প্রকাণ্ড ঝুনো নারকেল আমার মাথায় পড়লে এখনই অক্কা পেতে হত!
রাগ হল। কর্নেল যে বলে গেলেন, খুব নিরাপদ জায়গা! নারকেল গাছগুলো থেকে অনেকটা দূরে গিয়ে বিচে বসে পড়লাম। সামনে সূর্য অস্ত যাচ্ছে। দূরের প্রবাল-পাঁচিলটা ঝলমল করছে। আদিবাসীদের নৌকা কালো হয়ে ভেসে আছে কোথাও। ওরা হয়তো বেলা শেষে মাছ ধরতে বেরিয়েছে!
পায়ের শব্দে ঘুরে দেখি, একজন বুড়োমানুষ। তোবড়ানো গাল, চিনাদের মতো মুখ বেঁটে—কিন্তু কাঠামোটি চওড়া। তার মাথায় নীল টুপি দেখেই বুঝলাম, লোকটা জাহাজি। একটু হেসে সে বলল, স্পিক ইংলিশ?
কিছুক্ষণের মধ্যে আলাপ হয়ে গেল। বুড়ো একজন প্রাক্তন তিমিশিকারি। নাম রাজাকো। বাড়ি ছিল একসময় বান্দুং-এর ওদিকে একটা ছোট্ট শহরে। এখানে এখন সে স্থায়ী বাসিন্দা। বুড়ো হয়ে আর তিমিশিকারে যেতে পারে না। কাছাকাছি সমুদ্রে আজকাল তিমি মেলে না এবং শিকারেও কড়াকড়ি আছে। তিমি শিকারে যেতে হলে সুদূর দক্ষিণে আন্টার্কটিকার তুষার অঞ্চলে পাড়ি জমাতে হবে। অগত্যা সে মাছের কারবারে মন দিয়েছে।
রাজাকো বুড়োকে আমার খুব ভাল লাগছিল। আলাপী মানুষ। তিমিশিকারের মারাত্মক সব গল্প বলল। শেষে বলল, তুমি বুঝি বেড়াতে এসেছ এদেশে?
বললাম, হ্যাঁ। কতকটা তাই তবে…
আমাকে হঠাৎ থামতে দেখে রাজাকো বলল, ব্যবসা-ট্যবসা করারও ইচ্ছে আছে বুঝি? সে তো ভালই। তোমার মতো জোয়ান ছেলের কি শুধু টো টো করে দেশবিদেশ ঘুরে বেড়ালে চলে?
এই দেখো না! আমার যদি তোমার মতো একটা ছেলে থাকত, তাকে আমি এক্ষুনি আমার মাছধরা জাহাজে চাপিয়ে দক্ষিণ সাগরে তিমি মারতে পাঠাতাম। একটা ছোটখাটো তিমি মারতে পারলেই রাজা। প্রচুর চর্বি আর হাড় বেচে একদিনেই সে ধনী হয়ে যেত।
রাজাকোর বেশি কথা বলার বাতিক আছে। বললাম, না না। ব্যবসা আমার পোষাবে না। আমি এসেছি সরকারের একটা কাজে।
রাজাকো ভড়কে গিয়ে বলল, ওরে বাবা! তুমি সরকারি লোক? তা হলে তো তোমার সঙ্গে আমার বনবে না। সরকারি লোকেরা বড্ড বাজে।
বলেই সে উঠে দাঁড়াল। তারপর হনহন করে চলতে শুরু করল! অদ্ভুত বেয়াড়া লোক তো!
সন্ধ্যার ধূসরতা ঘনিয়েছে ততক্ষণে! একটু-একটু করে শীত করছে। প্রবাল-পাঁচিল ঘিরে কুয়াশা জমে উঠেছে। নারকেল বনটার পাশ দিয়ে রাজাকো হনহন করে হেঁটে যাচ্ছে। আমিও উঠে দাঁড়ালাম। ভাবলাম, ওর ভুলটা ভাঙিয়ে দেওয়া দরকার।
কিন্তু কয়েক পা এগোতেই একটা সাংঘাতিক ঘটনা ঘটে গেল। নারকেল বনের ভেতর থেকে দুটো নোক এসে রাজাকোর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। তারপর দেখলাম রাজাকো পড়ে গেল। আমি চেঁচিয়ে উঠলাম মাতৃভাষায় এই! এই! খবর্দার!
লোক দুটো আমাকে দেখামাত্র নারকেল গাছের ভেতর দিয়ে পালিয়ে গেল। দৌড়ে রাজাকোর কাছে গিয়ে দেখি, সে মুখ খুঁজে পড়ে রয়েছে। তাকে চিত করে দিতেই আমার সারা শরীর আতঙ্কে হিম হয়ে গেল। তার পেটে ছোরা মেরেছে আততায়ীরা। রক্তে জামাপ্যান্ট ভেসে যাচ্ছে।
বিচ এখন একেবারে জনহীন। আমার সবচেয়ে আতঙ্ক হল এই ভেবে যে, এখন এ অবস্থায় আমাকে কেউ দেখলে আমাকেই খুনি ঠাওরাবে। পুলিশের হাঙ্গামায় পড়তে হবে। অতএব এখনই কেটে পড়া দরকার। বরং হোটেলে গিয়ে ম্যানেজারকে খবর দেওয়া ভাল যে বিচে একটা রক্তাক্ত লাশ পড়ে থাকতে দেখেছি। তারপর ওরা যা হয় করবে।
উঠে পঁড়িয়েছি, সেই সময় রাজাকো ঘড়ঘড়ে গলায় অতিকষ্টে উচ্চারণ করল, কাত্তি! কাত্তি! তারপর একটা ঝাঁকুনি দিয়ে ওর শরীরটা স্থির হয়ে গেল।
কী বলল কে জানে! কাত্তি! কী? আমি আর এক মুহূর্তও দাঁড়ালাম না। এমন হতে পারে, ওর দুই খুনিই এতক্ষণে খবর দিয়েছে যে একজন বিদেশি টাকা ছিনতাইয়ের লোভে রাজাকোকে খুন করেছে।
আমি পা বাড়াতেই শক্ত কিছুতে পা পড়ল। দেখি রাজাকোবুড়োর সেই নীল টুপিটা ছিটকে পড়ে রয়েছে। কিন্তু টুপিটা এত শক্ত ঠেকল কেন? হেট হয়ে টুপিটা তুলে নিলাম। তারপর অবাক হয়ে গেলাম। এতটুকু একটা চুপির ওজন এত। নিশ্চয় এর ভেতর কোনও ভারী ধাতব জিনিস আছে।
টুপিটা সঙ্গে সঙ্গে প্যান্টের পকেটে ঢুকিয়ে ফেললাম। তারপর অনেকটা ঘুরে বিচ এলাকা। পেরিয়ে হোটেলে পৌঁছলাম। রিসেপশনের ইন্দোনেশীয় মেয়েটি মিষ্টি হেসে বলল, কেমন লাগল আমাদের মিস রুবিকে?
সে এই রুবি দ্বীপের প্রশংসা শুনতে চাইছিল। কিন্তু এ অবস্থায় হাসিতামাশা করা অসম্ভব। বললাম, দেখুন, এইমাত্র বিচ থেকে আসছি। বিচে একটা লোক পড়ে আছে দেখলাম। ডাকলাম সাড়া দিল না। অন্ধকারে কিছু বোঝা গেল না। মনে হল…
নিশ্চয় কোনও মাতাল ট্যুরিস্ট।
তবু একটু খোঁজ নেওয়া দরকার নয় কি?
মেয়েটি হাসতে হাসতে বলল, আপনি ভাববেন না মিস্টার! বিচে এমন মাতাল পড়ে থাকা খুব স্বাভাবিক ঘটনা। আমাদের গা সওয়া। লোকটা যদি ট্যুরিস্ট না হয় তা হলে নিশ্চয় কোনও নাবিক। নাবিক যদি হয়, তা হলে আগামীকাল সূর্য ওঠার আগে ওর নেশা কাটবে না। ওকে ওঠানোও যাবে না।
আমার বিবেকে বাধছিল। বললাম, বরং পুলিশে খবর দিন না মিস…
আমার নাম তোতিলাবতী ত্রিসত্যজায়া।
এ যে ভারতীয় নাম!
ইন্দোনেশিয়া অঞ্চলে আপনাদের সংস্কৃত ভাষার ছড়াছড়ি মিস্টার।…
আমার নাম জয়ন্ত চৌধুরি।
মিঃ চৌড্রি, আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন।
অদ্ভুত ব্যাপার তো! তেতিলাবতী ধরেই নিয়েছে আমি একটা বেহুঁশ মাতালকে দেখেছি। অগত্যা আর না বলে পারলাম না। মিস তোতিলাবতী…
আমায় তোতি বলে ডাকলে খুশি হব।
মিস তোতি! লোকটার গায়ে রক্ত আছে মনে হল। ওকে কেউ ছুরি মেরেছে!
তোতি এবার চোখ বন্ধ করে বলল, তাই বুঝি! তা হলে তো আগে কাউকে দেখতে পাঠাতে হয় ; তা না হলে পুলিশে খবর দিয়ে ঝামেলা হবে। বলে সে হোটেলের একজন লোককে ডেকে নিজের ভাষায় কিছু বলল। লোকটা আর একজনকে ডেকে নিয়ে টর্চ হাতে বেরিয়ে গেল।
ওপরে আমাদের ঘরে এসে টুপিটা বের করলাম। তারপর একটা ব্লেড দিয়ে চিরতেই বেরিয়ে পড়ল একটুকরো সঁাতলাধরা তামার ফলক। ফলকটা চাপরাসের মতো গোলাকার! তার ওপর আঁকাবাঁকা আঁচড় কেটে দুর্বোধ্য অক্ষরে কী সব লেখা রয়েছে। কিন্তু সবচেয়ে আকৃষ্ট করল ফলকের ঠিক মাঝখানে একটা অদ্ভুত গড়নের গাছ। গাছটার ডালে-ডালে ইংরেজিতে এ বি সি ডি এইসব অক্ষর আঁকা।
মাথামুণ্ডু কিছু বুঝতে পারছিলাম না। কতক্ষণ পরে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। তারপর কর্নেল ও ব্যুগেনভিলি ফিরলেন। ঘরে ঢুকে কর্নেল বললেন, বিচে একটা রক্তাক্ত লাশ পেয়েছে পুলিশ। জয়ন্তকে আমি বলেছিলাম দ্বীপটা নিরাপদ। কথাটা খাটল না দেখছি। বলেই কর্নেলের চোখ পড়ল আমার হাতের ফলকটার দিকে। শ্বাসরুদ্ধ গলায় বললেন, এ তো দেখছি কাত্তি। কাত্তি তুমি কোথায় পেলে জয়ন্ত?
ব্যুগেনভিলি লাফিয়ে উঠলেন। কী আশ্চর্য! এ যে দেখছি একটা কাত্তি!