আমার বৃদ্ধ বন্ধুকে ইদানীং ক্যাকটাস এবং অর্কিড-জাতীয় উদ্ভিদ নিয়ে কী সব বিদঘুটে ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে দেখতাম। একদিন গিয়ে দেখি, হেড-ফোন মাথায় এঁটে বসে আছেন এবং একটা অ্যামপ্লিফায়ার যন্ত্রের নব ঘোরাচ্ছেন। একটা অদ্ভুত আকৃতির নধর ক্যাকটাসের গায়ে পিন ফুটিয়ে রেখেছেন। পিনের মাথায় সূক্ষ্ম তামার তার বাঁধা। তারটা আরও একটা ক্ষুদে যন্ত্রের ভেতর দিয়ে এসে অ্যামপ্লিফায়ারে পৌঁছেছে। ক্ষুদে যন্ত্রটা জারে তরলপদার্থের ওপর ভাসছে। তারপর অবাক হয়ে দেখি, উনি চোখ বুজে থিরথির করে কাঁপতে লাগলেন। অমনি ভাবলাম, এই রে! বুড়ো নির্ঘাৎ তড়িতাহত হয়ে পড়েছেন।
যেই না মনে হওয়া, দৌড়ে গিয়ে মেন সুইচ অফ করে দিলাম। হাঁফাতে হাঁফাতে ফিরে এসে রুদ্ধশ্বাসে বললাম, কর্নেল! কর্নেল! আপনি সুস্থ তো?
কর্নেল নীলাদ্রি সরকার গর্জন করে উঠলেন, শাট আপ ইউ ফুল!
কস্মিনকালে ওঁর কাছে এমন ধমক খাইনি। আমি তো থ! একটু পরে অভিমান দেখিয়ে বললাম, বা! এই আপনার কৃতজ্ঞতাবোধের নমুনা! ইলেকট্রিক শক খেয়ে থিরথির করে কঁপছিলেন। এতক্ষণে অক্কা পেয়ে যেতেন। বাঁচিয়ে দেওয়াটা বুঝি অন্যায় হল? ঠিক আছে এবার খাবি খেতে দেখলেও মুখ ফিরিয়ে দাঁড়িয়ে থাকব-তবে না আমার নাম জয়ন্ত!
কর্নেল তখন ফিক করে হেসে ফেললেন। উত্তেজিত হয়ো না ডার্লিং! তোমার কোনও দোষ নেই। ষষ্ঠীচরণ! ও ষষ্ঠি! ভৃত্য ষষ্ঠীচরণ পর্দা তুলে মুখ বের করলে বললেন, মেন সুইচটা অন করে দাও। আর শোনো, ঝটপট আমার তরুণ বন্ধুর জন্যে কড়া করে কফি বানাও।আমিও খাব।
শান্ত হয়ে বসলে বললেন, জয়ন্ত! ওই মেক্সিকান ক্যাকটাসের সঙ্গে আমি একটু বাতচিত করছিলাম।
অবাক হয়ে বললাম, বলেন কী!
হ্যাঁ ডার্লিং! আচার্য জগদীশ বোসের যুগান্তকারী আবিষ্কারের পর অনেকগুলো দশক কেটে গেল। এখন বিজ্ঞানীরা জানতে পেরেছেন, উদ্ভিদের শুধু সুখদুঃখের অনুভুতি নয়, সাড়া দেওয়ার শক্তি আছে। সেই সাড়া দেওয়াটাকেই বলব উদ্ভিদের ভাষা। ভাষাটা কিন্তু শব্দ দিয়ে নয়, কম্পন দিয়ে তৈরি। বিভিন্ন স্তরে সূক্ষ্ম-অতিসূক্ষ্ম কম্পনে তার কথা প্রকাশ পায়। এই ক্যাকটাসটা সবে কথা বলতে শুরু করেছিল এবং আমিও তার ভাষায় জবাব দিচ্ছিলাম—হঠাৎ তুমি এসে সবটাই ভেস্তে দিলে।
হাসতে হাসতে বললাম, আপনাকে হিস্টিরিয়া রোগীর মতো কঁপতে দেখছিলাম। কী আশ্চর্য! ওভাবেই বুঝি গাছপালার সঙ্গে কথা বলতে হয়?
কর্নেল জারে ভাসমান ক্ষুদে যন্ত্রটা দেখিয়ে বললেন এটা একটা গ্যালভানোমিটার। তুমি লাই-ডিটেক্টর যন্ত্রের কথা জানো—যা অপরাধী সত্য বলছে, না মিথ্যে বলছে, ধরিয়ে দিতে পারে। এটা তারই একটা অংশ। এর ভেতর একটুকরো গ্র্যাফ-পেপার আছে এবং একটা সূক্ষ্ম পেন্সিলের শিস আছে। গত শতকের শেষভাগে ভিয়েনার এক ধমর্যাজক ফাদার ম্যাক্সিলিয়ান হেল এর উদ্ভাবক। পরে ইতালীয় বিজ্ঞানী লুইজি গ্যালভানি প্রাণীজ বিদ্যুৎ আবিষ্কার করে যন্ত্রটা আরও উন্নত করেন। তাঁর নামে যন্ত্রটার নাম দেওয়া হয় গ্যালভানোমিটার। আরও পরে ইংরেজ বিজ্ঞানী স্যার চার্লস হুইটস্টোনের আবিষ্কৃত বিদ্যুৎ সার্কিট হুইটস্টোন ব্রিজ পদ্ধতি কাজে লাগানো হয়েছে। তবে…?
বাধা দিয়ে বললাম, কিচ্ছু বুঝব না। আমি বিজ্ঞানের ছাত্র ছিলাম না।
তা হলে গাছের পাতা নিয়ে ব্যাকস্টার নামে এক বিজ্ঞানীর পরীক্ষার কথা শোনো! তিনি অসংখ্য পরীক্ষার পর বলেছিলেন, উদ্ভিদেরা চক্ষু ছাড়াই দেখতে পায়—মানুষ যতটা দেখতে পায়, তারও বেশি। উদ্ভিদের যেন মন আছে। কিন্তু তার চেয়েও বড় কথা, সে এই বিশাল প্রাণীজগতের অন্যতম শরিক এবং সে সব প্রাণীর মনের কথা টের পায়।
সেই ব্যাকস্টার সায়েব বলেছেন এ কথা? আমি হাঁদারামের মতো তাকিয়ে বললাম। সর্বনাশ! যখন আপনার বাসায় আসি, ওইসব বিদঘুটে গড়নের উদ্ভিদগুলোকে দেখে মনে মনে কত হাসি এমনকী, একদিন আপনার পরীক্ষিত ওই অষ্টাবক্র ক্ষুদে উদ্ভিদটিকে দেখিয়ে যেদিন ষষ্ঠীচরণকে বলছিলাম, ব্যাটা যেন সার্কাসের ক্লাউন! ওরে বাবা! তা হলে তো ও বেজায় রাগ করছিল আমায় ওপর!
কর্নেল মুচকি হেসে বললেন, এই যে এখন তুমি এসেছ এবং তার কথাবার্তায় বাধা দিয়েছ, এতে ও কি ক্রুদ্ধ না হয়ে পারে?
কাছে গেলে প্যাঁক করে কাটা ফুটিয়ে দেবে বুঝি?
তা হয়তো দেবে না। কিন্তু তুমি ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে ইলেকট্রোড থেকে বিকিরণ বেড়ে গিয়েছিল এবং গ্যালভানোমিটার কাপছিল। একমিনিট। গ্রাফটা বের করি।
কর্নেল ক্ষুদে যন্ত্র থেকে একটুকরো কাজ বের করে দেখালেন। অসংখ্য আঁকাবাঁকা রেখা জটিল হয়ে আছে দেখলাম। বললাম, এই বুঝি ওর রাগের ভাষা?
কর্নেল আমার তামাশায় কান না দিয়ে বললেন, এই কাগজটার নাম পলিগ্রাফ। বিখ্যাত ব্যাকিস্টার এক্সপেরিমেন্টের সূত্র ধরে আমি এই জটিল রেখাগুলোকে বিশ্লেষণ করতে পারি। এগুলো কোড ল্যাঙ্গেয়েজ অর্থাৎ সাংকেতিক ভাষা। কোডগুলোকে শ্ৰেণীবদ্ধ করে অর্থোদ্ধার করা সম্ভব। যাই হোক, আপাতত কফি খাও। তারপর দুই বিজ্ঞানী স্যাক্স রোমার এবং বুলওয়ার লিটনের পরীক্ষার গল্প বলব। সে আরও বিচিত্র ঘটনা। তারা আমেরিকার নিউ জার্সিতে একটা কারখানার কাছে খুন হওয়া একটি মেয়ের খুনিকে ধরিয়ে দিতে পেরেছিলেন!
আপনার মতো তারা শখের গোয়েন্দাও ছিলেন বুঝি?
না, জয়ন্ত। ওঁরা নিছক বিজ্ঞানী। পদার্থ এবং জীববিদ্যার চর্চা করতেন। যেখানে মেয়েটি খুন হয়েছিল সেখানে ছিল একটা বুনো আপেল গাছ। গাছটাই ধরিয়ে দিয়েছিল খুনিকে।
চেঁচিয়ে বলেছিল পাকড়ো! পাকড়ো!
তামাশা নয়, ডার্লিং! এটা বাস্তব ঘটনা। একটুকরো পলিগ্রাফ আর একটা গ্যালভানোমিটার, একটা ইলেকট্রোড—ব্যস! এ তিনটি জিনিস গাছটার সঙ্গে জুড়ে দিয়ে লোক জড়ো করা হয়েছিল গাছটার সামনে। একবার করে পাতা ছুঁয়ে যেতে বলা হয়েছিল প্রত্যেককে। তারপর দেখা গেল, একজনের ছোঁয়ার পর পলিগ্রাফে গাছটা তীব্রভাবে সাড়া দিয়েছে। কম্পনরেখা বিশ্লেষণ করে বোঝা গেল, সেই লোকটাই খুনি।
সেদিন কর্নেল সারাবেলা এইসব উদ্ভুট্টে কথাবর্তা বলেছিলেন। তারপর বলেছিলেন, জয়ন্ত, তুমি ই এস পি কথাটা কি শুনেছ?
শুনেছি। এক্সট্রা সেনসরি পার্সেপসন। অর্থাৎ অতিরিন্দ্রিয় অনুভূতি।
উদ্ভিদের মধ্যে ই এস পি অধুনা সুপ্রমাণিত। তারা এমন জিনিস দেখতে পায় এবং বুঝতে বা জানতে পারে—যা আমরা দেখতে পাই না ও জানি না। ডার্লিং! আচার্য জগদীশ বসু যেখানে শুরু করেছিলেন, সেখান থেকে একালের সব উদ্ভিদ বিজ্ঞানীর হাতেখড়ি। তোমার এত বেশি অবাক হওয়ার কারণ নেই। তামাশা করাও শোভা পায় না। আচার্য জগদীশচন্দ্র এই কলকাতারই মানুষ ছিলেন। তুমি কি তার পরীক্ষা-নিরীক্ষার কথা শোনোনি?
এই সব শোনার পর থেকে কর্নেলের বাসায় যখনই গেছি, ওঁর লালিত-পালিত উদ্ভিদ মশাইদের প্রতি সসম্ভ্রমে দৃষ্টিপাত করেছি। এমনকী একটা ক্যাকটাসকেও বলেছি, হ্যাল্লো, লিটলবয়! হাউ ড়ু ইউ ড়ু!
কর্নেলের সঙ্গে গল্প করতে করতে হঠাৎ চোখ গেছে ড্রয়িং রুমের কোনায় রাখা কয়েকটা টবের গাছের দিকে। অমনি বুকটা ধড়াস করে উঠেছে, যেন ক্যাটক্যাট করে তাকিয়ে আমাকে দেখছে –
মনের ভেতর কী যেন পেঁচানো মতলব পোষা!
স্বীকার করছি, গাছপালা অর্থাৎ উদ্ভিদ সম্পর্কে বুড়ো ভদ্রলোকটি আমার দৃষ্টিভঙ্গি আমূল বদলে দিয়েছিলেন যেন। রাস্তায় যেতে যেতে গাড়ি থামিয়ে কোনও বিশাল গাছের দিকে তাকিয়ে থেকেছি অবাক চোখে। তারপর মনে মনে বলেছি, হ্যাল্লো জেন্টলম্যান! ভাল আছেন তো? যেন মনে হত, বৃক্ষভদ্রলোক একটু করুণ হেসে বলছেন, খুব ভাল নয় মশাই! সি এম ডি এর হালচাল দেখে বড় তটস্থ আছি। কিছু বলা যায় না।
ঠিক এমনি করে চৌরঙ্গীতে টাটা বিল্ডিংয়ের সামনে একটা সুন্দর নাদুসনুদুস গড়নের বৃক্ষভদ্রলোক আমাকে ফিসফিসিয়ে বলেছিলেন, দিনকাল ভাল না। আজ আছি, কাল নেই অবস্থা।
সে কী! কেন বলুন তো?
ওরা আসছে। পায়ের শব্দ শুনতে পাচ্ছি। হাতে হাতে কুড়ুল। পেছনে পেল্লায় আর্থ এক্সক্যাভেটার গাড়ি!
কারা? কারা?
আবার কারা? পাতাল রেলের লোকেরা। আপনাদের মানুষ জাতটার ঠেলায় আমরা মশাই চিরকাল অস্থির। কোণঠাসা করতে করতে আমাদের শেষ করে ফেললেন প্রায়। বুঝবেন শেষে ঠ্যালাটা—যখন দেশটা মরুভূমি হয়ে যাবে।
সেই রবিবার কর্নেলের ঘরে জর্জ ব্যুগেনভিলির সঙ্গে পরিচয় হওয়ার পর এই সব কথা মনে পড়ে গিয়েছিল। কোকোস দ্বীপপুঞ্জের অন্তর্গত কিওটা দ্বীপের উদ্ভিদরহস্য আমাকে প্রচণ্ড নাড়া দিয়েছিল। কোহাও রঙ্গে রঙ্গো—কথা বলা বন তা হলে সত্যি আছে পৃথিবীতে?
তা হলে সেখানে যেতে এতদিন বাধা কী ছিল বিজ্ঞানীদের? দ্বীপটা যখন সবাই চেনে তখন যায়নি কেন কেউ? আমার এসব প্রশ্ন শুনে ব্যুগেনভিলি বলেছিলেন, সমস্যা হল দ্বীপটা ঠিক কোথায় কেউ জানে না। কোকোস দ্বীপপুঞ্জের অন্তর্গত দ্বীপ বলা হয় বটে, কিন্তু যতবারই ওখানে
অভিযাত্রীদল গেছে, দুই দ্বীপপুঞ্জে তেমন কোনও অদ্ভুত দ্বীপ দেখতে পায়নি।
কিন্তু আপনি গিয়েছিলেন!
হ্যাঁ। কিন্তু সে তো ভাসতে ভাসতে দৈবাৎ গিয়ে পড়েছিলাম। উদ্ধার পাওয়ার পর জাহাজ নিয়ে গিয়ে তন্নতন্ন করে খুঁজে সেটাকে আর আবিষ্কার করতে পারিনি। এটাই আসল রহস্য।
তা হলে কোকোস দ্বীপপুঞ্জের অন্তর্গত বলা হয় কেন? ওখানকার আদিম অধিবাসীরা দাবি করে, কিওটা তাদেরই প্রতিবেশী। প্রাচীন যুগে তাদের রাজার রাজধানী ছিল ওই দ্বীপে। কিন্তু মুশকিল হল, ৮০° দ্রাঘিমাংশ এবং ২০° অক্ষাংশে ছোটবড় দ্বীপের সংখ্যা প্রায় এক হাজারেরও বেশি। বারো হাজার বর্গমাইল জুড়ে ছড়িয়ে আছে তারা। মাত্র দুটো দ্বীপে বসতি আছে—বাকিগুলো জনহীন। কারণ সব দ্বীপই মানুষের বসবাসের অযোগ্য। অস্বাস্থ্যকর এবং মারাত্মক পোকামাকড়ের ডিপো। সে সব দ্বীপে যে যাবে, সাংঘাতিক ভাইরাসে সে সংক্রামিত হয়ে জটিল অসুখে মারা যাবে।
আপনি কি কর্নেলকে নিয়ে কিওটা দ্বীপ খুঁজতে বেরুনোর উদ্দেশ্যেই এসেছেন?
জয়ঢাক সায়েব হাসির মাঝে ঘর কাঁপিয়ে বললেন, তা ছাড়া আর কী?
কর্নেল সরকার আমার পুরনো বন্ধু! উদ্ভিদের গোপন কথা নামে ওঁর একটা প্রবন্ধ পেয়েই ছুটে এসেছি কলকাতায়।