সবুজ বনের ভয়ংকর- কথা বলা বন

সবুজ বনের ভয়ংকর- কথা বলা বন

মার্চের এক রবিবারের সকালে কর্নেল নীলাদ্রি সরকারের ফ্ল্যাটে অভ্যাসমতো আড্ডা দিতে গিয়ে দেখি, বৃদ্ধ ঘুঘুমশাই অফিসের বড়কর্তার মতো একটা ফাইল খুলে গোমড়ামুখে বসে আছেন। কাছাকাছি বসে ফাইলের বিষয়বস্তু আন্দাজ করার চেষ্টা করলাম। কিন্তু কিছু ঠাহর করা গেল না। আমার উপস্থিতিও যেন উনি টের পেলেন না।

একটু পরে ওঁর মুখ দিয়ে কী একটা কথা বেরুল। মনে হল বঙ্গভঙ্গ কিংবা এরকম কিছু। কথাটা উনি বিড়বিড় করে আওড়াতে শুরু করলে আর চুপ করে থাকা গেল না। বললাম, বঙ্গভঙ্গ ততো ১৯৪৭ সালে হয়ে গেছে। এতকাল বাদে ও নিয়ে দুঃখ করার কী আছে?

কর্নেল আমার দিকে তাকিয়ে একটু হাসলেন এবার। ও তুমি এসে গেছ দেখছি ডার্লিং। তোমার কথাই ভাবছিলাম। একটু অপেক্ষা করো। কিছুক্ষণের মধ্যে এক ভদ্রলোক আসবেন এবং তোমার দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকার জন্য কিছু মালমশলা তার কাছে পেয়ে যাবে।

একটু বিরক্ত হয়ে বললাম, আজ আমার ছুটির দিন। খবরের কাগজের জন্য আজ আমার এতটুকু মাথাব্যথা নেই। কিন্তু আপনি হঠাৎ বঙ্গভঙ্গ নিয়ে বিড়বিড় করে মরাকান্নার মতো শোকপ্রকাশ করছিলেন কেন?

বঙ্গভঙ্গ? কর্নেল ভুরু কুঁচকে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন কয়েক সেকেন্ড। তারপর জোরে হেসে বললেন, না জয়ন্ত। রঙ্গো রঙ্গে। কোহাও রঙ্গে রঙ্গো।

তার মানে?

স্পিকিং উডস। কথা বলা বন। প্রশান্ত মহাসাগরের পলিনেশীয় এলাকার ছোট্ট দ্বীপ ইস্টার আইল্যান্ডের লুপ্ত ভাষায় কোহাও রঙ্গো রঙ্গো মানে যে বন কথা বলতে পারত।

এই সময় ষষ্ঠীচরণ এসে খবর দিল, এক সায়েব এসেছেন। তাঁকে সাদর অভ্যর্থনা করে নিয়ে এলেন কর্নেল। তারপর পরিচয় করিয়ে দিলেন আমার সঙ্গে। সায়েবের নাম কাপ্তেন জর্জ ব্যুগেনভিলি। সওদাগরী জাহাজে সারা পৃথিবী চক্কর মেরেছেন। নামটা শুনে বললাম, আপনার নামের সঙ্গে কি বুগানভিলিয়া ফুলের কোনও সম্পর্ক আছে?

সায়েব আমুদে স্বভাবের মানুষ। গড়ন প্রকাণ্ড কুমড়োর মতো। উঁড়ি দুলিয়ে হাসতে হাসতে বললেন, আলবৎ আছে। বুগানভিলিয়া ফুল আসলে পলিনেশীয়। ১৭৬৮ সালে আমার মতো এক কাপ্তেন আঁতোয়াঁ দ্য বুগেভিলি ওই এলাকার একটা দ্বীপে এ ফুল আবিষ্কার করেন। ইউরোপে নিয়ে যান। তার নামেই ফুলের নাম চালু হয়।

কর্নেল যোগান দিলেন, উষ্ণ নিরক্ষরেখা অঞ্চলের উদ্ভিদ। নিস্টাজিনিসিয়া গোত্রের প্রজাতি।

মুচকি হেসে বললাম, কির্নেল, আপনার কোহাও রঙ্গো রঙ্গোর সঙ্গে বুগানভিলিয়া ফুল এবং মাননীয় অতিথি কাপ্তেন সায়েবের নামের এই যোগাযোগ সম্ভবত আকস্মিক নয়। তাই না?

কর্নেল সেই ফাইলটা আমার দিকে এগিয়ে দিলেন। কাপ্তেন ঝুগেনভিলি সেটার দিকে চোখ। বুলিয়ে বললেন, রাতারাতি জেরক্স কপি তৈরি দেখছি! কর্নেল, আপনার এই উৎসাহ দেখে আমার আশা হচ্ছে, এতদিনে কিওটা দ্বীপের বৃক্ষরহস্য ফাঁস করাটা আর কঠিন হবে না।

ষষ্ঠীচরণ ট্রেতে কফি রেখে গেল। ওঁরা কফি খেতে খেতে কথা বলছিলেন। আমি ফাইলে চোখ রাখলাম। তারপর যত পাতা ওল্টাই, তত চমক জাগে। একি সত্যি, না নিছক গালগল্প?

…তিন বছর আগে তাহিতি থেকে অস্ট্রেলিয়া হয়ে ফেরার সময় ইচ্ছা ছিল কিওটা দ্বীপ সম্পর্কে খোঁজখবর নেব। কিন্তু কোকোস দ্বীপপুঞ্জ এলাকা যেন গোলকধাঁধা। তার ওপর উল্টো বাতাস। এগোনো অসম্ভব হয়ে উঠেছিল। এ দ্বীপপুঞ্জের অবস্থান ভারত মহাসাগরে। অক্ষাংশ ২০ ডিগ্রি, দ্রাঘিমাংশ ৮০ ডিগ্রি। পঞ্চাশ নটিকাল মাইল দূরত্বে পৌঁছতেই হঠাৎ প্রবল দক্ষিণগামী বাতাস আমার জাহাজ এনডেভার কে ঠেলে দিল বিপরীত পথে। চাগোস দ্বীপপুঞ্জে গিয়ে পৌঁছলাম। সেখান থেকে মরিশাস হয়ে কেপটাউন। তারপর ঘরের ছেলে ঘরে ফিরলাম। লন্ডনে পৌঁছে কিছুকাল মিউজিয়াম এবং লাইব্রেরি ছুঁড়ে কিওটা দ্বীপের রহস্য নিয়ে মাথা ঘামালাম…

সিঙ্গি ট্রিজ! সঙ্গীতকারী বৃক্ষ! কী অদ্ভুত কথা! অসংখ্য নাবিক এই উদ্ভট গল্পে বিশ্বাস করে। নিশ্চয় কানের ভুল। গাছপালার ফাঁক দিয়ে বাতাস বইলে অনেক সময় গানের সুর বলে ভুল হতে পারে। কিন্তু ঐতিহাসিক দলিলপত্রে দেখলাম, কিওটার গাছগুলো নাকি কথাও বলতে পারে।

আমার এবারকার অভিযান আন্টার্কটিকায়। নাবিকদের অনিচ্ছা সত্ত্বেও চাগোেস থেকে দক্ষিণে। না এগিয়ে উত্তর-পূর্ব দিকে কোকোসের দিকে এগিয়েছিলাম। কাল সন্ধ্যায় কিওটার একমাইল দূরে নোঙ্গর বেঁধেছি আমার রেজিলিউশান জাহাজকে। ২৪ নভেম্বর কেপটাউন ছেড়েছি। আজ ১২ ডিসেম্বর। আবহাওয়া চমৎকার নাতিশীতোষ্ণ এখানে। সকালে একটা বোট নিয়ে তিনজন দ্বীপের দিকে এগিয়ে গেলাম। চমৎকার বেলাভূমি। ডাঙায় পৌঁছেই আমার যা অভ্যাস—বক ছুড়লাম একবার। তারপর ইউনিয়ন জ্যাক পুঁতে দিলাম। সমুদ্রপাখিরা কলরব করে উড়ে গেল। নিশ্চয় দ্বীপটাতে মানুষ বাস করে না। তাহলে বন্দুকের শব্দ শুনে তারা ছুটে এসে ভিড় করত। ডাক্তার স্মিথকে বললাম, চলুন তা হলে। ডাঃ স্মিথ কান খাড়া করে কী শুনছিলেন। বললেন, কে যেন চিৎকার করে কিছু বলল। হাসতে হাসতে উঁচু জায়গাটাতে উঠে গেলাম। আমার পেছনে ডাঃ স্মিথ আর দুজন সশস্ত্র নাবিক। সামনে ঘন জঙ্গল। বিশাল উঁচু সব অপরিচিত গাছ। স্বীকার করছি, গাছগুলো দেখে কেমন গা ছমছম করছিল। যেন তারা প্রাণীর মতো সচেতন এবং আমাদের নিঃশব্দে লক্ষ্য করছে। সেই গাছপালার ভেতর দিয়ে কয়েক পা এগিয়েছি, ঠিক যেন বাতাসের শব্দে শনশন করে কোথায় একদল মানুষ ইংরেজি ভাষায় গর্জন করে উঠল স্টপ ইট!… স্টপ ইট।

নিশ্চয় কানের ভুল। তারপর আর কোনও ভূতুড়ে আওয়াজ আমি শুনিনি। কিন্তু নাবিকরা আর এক পা বাড়াতে রাজি নয়। তারা আমাকে অগ্রাহ্য করে বোটে গিয়ে বসে রইল। ডাঃ স্মিথ আর আমি সতর্কভাবে ছোট্ট দ্বীপটা দুপুর পর্যন্ত ঘুরলাম। জনপ্রাণীটি নেই। ফেরার সময় ডাঃ স্মিথ বললেন, একবার যেন কাদের অস্পষ্ট ফিসফিস কথাবার্তা শুনেছেন। ভদ্রলোক বড় কল্পনাপ্রবণ।…

এখন রাত দশটা। রেজিলিউশন দক্ষিণ মহসাগরে ভেসে চলেছে আন্টার্কটিকার দিকে। কিওটা দ্বীপের ব্যাপারটা গাছপালার মর্মরধ্বনি ছাড়া আর কিছু নয়। আমার ধারণা, স্টপ ইট কথাটা কানের ভুল, সম্ভবত কাঠঠোকরা জাতীয় পাখি শুকনো কাঠে ঠোকরাচ্ছিল এবং তা থেকেই ওই আওয়াজ। বিদ্রোহী নাবিক দুজনকে শাস্তি দিয়েছি। পাঁচ ঘা বেত এবং ২৪ ঘন্টা অনাহারের শাস্তি। ডাঃ স্মিথ একটু আগে বলে গেলেন, ওদের গায়ে নাকি সবুজ রঙের অদ্ভুত অ্যালার্জি বেরিয়েছে। সবকাজেই ওঁর বাড়াবাড়ি।–ক্যাপ্টেন টমাস কুকের লগবুক। 12. 12. 1772

কীলিং (Keeling) দ্বীপপুঞ্জে প্রাগৈতিহাসিক জন্তুর ফসিল খুঁজতে যাওয়ার সময় দ্বীপের এক বৃদ্ধ আমাকে কিওটা নামে অদ্ভুত একটা দ্বীপের কথা বলে। সেটা নাকি মাইল ষাটেক দক্ষিণে। সেই দ্বীপের গাছগুলো নাকি কথা বলে। অবান্তর ব্যাপার। সেখানে যাওয়ার ইচ্ছা ছিল। কিন্তু বিগল জাহাজের ক্যাপ্টেন রবার্ট ফিরয় বদরাগী মানুষ। এমনিতেই আমার কাণ্ডকারখানা দেখে ক্রুদ্ধ হয়ে আছেন। তাকে যদি বা রাজি করাতে পারি, নাবিকদের পারব না। কিওটার কথা শুনেই তারা বলেছে, ওই ভূতের দ্বীপ অসম্ভব। শেষ পর্যন্ত তাই কিওটা যাওয়া হল না। মনে ক্ষোভ রয়ে গেল।

— চার্লস ডারউইন, এইচ এম এস বিগল 23, 2, 1835

উদ্ধারপ্রাপ্ত নাবিকের নাম জন হিক্স। তাকে মানসিক হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সে ভারত মহাসাগরে জাহাজ ড়ুবি হয়ে একটা দ্বীপে আশ্রয় নিয়েছিল। সেখানে গাছপালা কথা বলে। তাকে খাদ্য দিয়ে বাঁচিয়ে রেখেছিল একটা গাছ। হিক্সের বিবৃতির সময় প্রখ্যাত বিজ্ঞানী রিচার্ড হোম উপস্থিত ছিলেন। তিনি কোনও মন্তব্য করেননি। হিক্স আরও একটা অদ্ভুত কথা বলে। একটা গাছের সঙ্গে তার নাকি বিয়েও হয়েছিল। ডাক্তারদের মতে লোকটি উন্মাদ রোগগ্রস্ত হয়ে পড়ছে। তবে ব্রিটিশ জাদুঘরের কিউরেটারে ডঃ ফক্স বলেছেন, খ্রিস্টপূর্ব একহাজার অব্দে ফিনিসীয় নাবিকদের প্যাপিরাসে লেখা যে লগবুক আবিষ্কৃত হয়েছে, তাতে গর্জনকারী গাছের কথা আছে। কোনও সমুদ্রে একটি দ্বীপের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় তারা সেই ভৌতিক গর্জন শুনতে পেত। তাই দ্বীপে নামার সাহস পেত না। ডঃ ফক্স আরও বলেছেন, খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে লেখা গ্রিক ঐতিহাসিক হিরোডোটাস সঙ্গীতকারী বৃক্ষের কথা বলেছেন। চৌদ্দ শতকে বিখ্যাত পর্যটক মার্কো পোলো লিখেছেন, ভারত মহাসাগরের একটি দ্বীপের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় গভীর রাত্রে তারা সেখানে কোলাহল শুনতে পান। জাহাজ দ্বীপের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। সারারাত আশ্চর্য সব শব্দ শোনেন। সকালে পোললা বোটে করে দ্বীপটিতে পৌঁছন। কিন্তু আর একপা এগোতে পারেননি। প্রচণ্ড ঝড় শুরু হয় এবং হাজার হাজার মানুষ যেন তাঁকে গর্জন করে এগোতে নিষেধ করে। পোললা লিখেছেন, গাছগুলো থেকেই ওই গর্জন ভেসে আসছিল। বোটে ফিরে গেলে, আশ্চর্য ব্যাপার ঝড়টা তক্ষুনি থেমে যায়।…

—দি ইভনিং স্ট্যান্ডার্ড, লন্ডন 7.9. 1981

…কোহাও রঙ্গে রঙ্গো। কথা বলা বন। প্রশান্ত মহাসাগরের পলিনেশীয় এলাকার ছোট্ট দ্বীপ ইস্টার আইল্যান্ডে বিশপ জোসেন নামে এক খ্রিস্টীয় যাজক গত শতকে একটি পুঁথি আবিষ্কার করেন। তাঁর লিপির সঙ্গে সিন্ধুসভ্যতার লিপির আশ্চর্য মিল। মেতেরো নামে তার স্থানীয় এক ভৃত্য পুঁথিটি পড়ে অনুবাদ করে দেয়। এই পুঁথির নাম কোহাও রঙ্গে রঙ্গো। এটি ইস্টার দ্বীপের আদিম অধিবাসীদের ধর্মীয় পুরাণ। এতে আছে এক অদ্ভুত বনের কাহিনী—যার গাছগুলো কথা বলতে পারত। তাদের উপাস্য দেবতার নাম ছিল রাঙ্গেতিয়া। তিনি আকাশের দেবতা। তার আশীর্বাদে গাছপালা কথা বলত মানুষের ভাষায়। বিশপ জোসেনের ধারণা, সেই কথা বলা বন বহু বছর আগে নির্মূল হয়ে গেছে কোনো কারণে।

-ইস্টার আইল্যান্ডের রহস্য : ই ডলফার, পৃষ্ঠা 5

প্যারিস ২০ জানুয়ারি—সম্প্রতি প্রখ্যাত অভিযাত্রী ক্যাপ্টেন জর্জ ব্যুগেনভিলি তার সপ্তদশ নৌ অভিযানে আন্টার্কটিকা যাওয়ার সময় ঝড়ের মুখে পড়েন। জাহাজ ড়ুবে যায়। লাইফবোটের সাহায্যে ভাসতে ভাসতে সাত দিন পরে কোকোস দ্বীপপুঞ্জের একটি দ্বীপে ওঠেন। ক্যাপ্টেন ব্যুগেনভিলি জনহীন দ্বীপ থেকে গাছ কেটে ভেলা তৈরি করে সমুদ্র পাড়ি দেন। একমাস পরে কীলার দ্বীপে পৌঁছন। তিনি সেই নির্জন দ্বীপ সম্পর্কে এক অদ্ভুত বিবরণ দিয়েছেন। সেখানে নাকি গাছপালা মানুষের মতো কথা বলতে পারে।…

–রয়টার

ফাইল থেকে মুখ তুলে জর্জ ব্যুগেনভিলির দিকে তাকালাম। সায়েব মিটিমিটি হাসছিলেন।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত