কালো বাক্সের রহস্য- নক্ষত্রলোকে প্রত্যাবর্তন

কালো বাক্সের রহস্য- নক্ষত্রলোকে প্রত্যাবর্তন

লিটনগঞ্জের বাজার এলাকা বাদে রাত নটা না বাজতে বাজতেই এই শীতে সবগুলো পাড়া নিশুতি নিঃঝুম হয়ে পড়ে। বাজারেও অবশ্যি খাঁ খাঁ অবস্থা। কিছু কিছু দোকান খোলা এবং লোকেরা আড্ডা দিচ্ছে। ল্যাম্পপোস্টের টিমটিমে বাতি কুয়াশায় ঢাকা পড়ে যাচ্ছে মাঝে-মাঝে। এই নির্জন নিঃঝুম রাস্তায় পুলিশ সুপারের জিপ এগিয়ে চলেছে স্টেশনরোডের দিকে। একটু পেছনে চলেছে। একটা মস্তো পুলিশভ্যান। তাতে বসে রয়েছেন সশস্ত্র পুলিশবাহিনীর কয়েকজন অফিসার।

জিপে আছেন পুলিশ সুপার অজিতেশ, কর্নেল আর শংকর।

শংকরের মুখে খবর পেয়েই এই অভিযান। সতুবালাদের পোড়ো ইটভাটার দিকে ঘুরপণে এগিয়ে চলেছেন ওঁরা।

জলের ট্যাংকের কাছে পৌঁছে কথামতো পুলিশভ্যান থামল। সশস্ত্র সেপাইরা আর অফিসাররা নিঃশব্দে ইটভাটার চারদিক ঘিরে ফেলতে এগিয়ে গেলেন অন্ধকারে। ঝোপে জঙ্গলে গা ঢাকা দিয়ে শিকারি বাঘের মতো ওরা পা বাড়ালেন।

জিপটা একটু তফাতে রেখে কলে, শংকর আর অজিতেশ দ্রুত এগিয়ে চললেন ভাটার দিকে।

বিশাল পোড়োভাটায় খানাখন্দ, ঢিবি, আর চিমনির কথা আগেই বলা হয়েছে। পুরো এলাকা ঘন অন্ধকারে ঢাকা। তার ওপর কুয়াশা।

ভাটায় ঢোকার জন্য সরু একফালি পথ আছে। সে-পথে ইতিমধ্যে ঘাস ও জঙ্গল গজিয়েছে। কিন্তু পথটায় খোয়া বিছানো থাকায় চলতে অসুবিধা হচ্ছিল না। কিছুটা এগিয়ে কর্নেল থমকে

দাঁড়ালেন।

ফিসফিস করে বললেন—এই ভাটার নিশ্চয় একটা অফিসঘর ছিল। সেটা কাছাকাছি থাকা উচিত।

অজিতেশ বললেন—হা। দিনে এখান দিয়ে যেতে চোখে পড়েছে বটে। মনে হচ্ছে সামনে ঢিবিমতো জায়গায় দরমার বেড়ার কয়েকটা ঘর আছে।

শংকর বললেন—টর্চ জ্বেলে দেখে নিলে হত।

কর্নেল বললেন—মাথা খারাপ? অন্ধকারেই এগুতে হবে। এ ব্যাপারে আমার অবশ্যি অসুবিধে হয় না। কেন না, বনেজঙ্গলে বহুবার রাতবিরেতে জন্তু জানোয়ারের ছবি তুলতে যাওয়ার অভ্যাস আছে আমার। তোমরা আমার পেছনে-পেছনে এস।

এসব কথা ফিসফিস করেই বলাবলি করছিলেন তিনজনে। খানিকটা এগিয়ে অন্ধকারে আবছা একটা উঁচু জায়গা নজরে এল। খোয়াবসানো পথটা সোজা সেখানে উঠে গেছে। হ্যাঁ, ওই তো ভাটার সেই অফিসগুলো সারবেঁধে দাঁড়িয়ে আছে।

হঠাৎ তিনজনেই থমকে দাঁড়ালেন। একটা আলো জ্বলে উঠল কোথাও। হয়তো ওই ঘরের মধ্যেই দরমাবেড়ার দেয়ালের কোনও ফাটল দিয়েই আলোটা দেখা যাচ্ছে বুঝি।

পা টিপে টিপে তিনজনে আলোটা লক্ষ করে এগুতে থাকলেন। সেই সময় কী একটা জন্তু দৌড়ে পালিয়ে গেল ঝোপঝাড় ভেঙে। শেয়াল-টেয়াল হেবে। দরমাবেড়ার ঘরগুলোর পেছনে ঘন ঝোপ গজিয়েছে। সেই ঝোপে ঢুকে একটা ফাটলে কর্নেল উঁকি মারতে যাচ্ছেন, এমন সময় ঘরের ভেতর চাপা গলায় কে কথা বলে উঠল-লতিফ খা! তোমায় এখনও সাবধান করে দিচ্ছি, পবিত্র ওই মণি তোমার পাপের হাতে ছোঁবার চেষ্টা কোরো না। সর্বনাশ হবে!

কী অবাক! এ তো সেই পিরের মাজারের জাদুকর ফকিরের গলা!

দরমাবেড়ার দেয়ালের অবস্থা আঁঝরা। এখন তিনজনে তিনটে ফাটলে চোখ রেখেছেন। ভেতরে এক বিচিত্র দৃশ্য দেখতে পাচ্ছেন।

কালো আলখাল্লাধারী ফকির দাঁড়িয়ে আছে মেঝেয়। তার সামনে উবু হয়ে বসে আছে হেকিম লতিফ খাঁ। তার চোখেমুখে একটা ক্রুর ভঙ্গি। তার হাতের কাছে সেই ঐতিহাসিক কালো পেটিকা বা ছোট্ট বাকসোটা রয়েছে।

আর তার চেয়েও সাংঘাতিক, পেটিকার পাশে আজিমুদ্দিনের মমি-মুণ্ডুটা রয়েছে।

হেকিমের হাতে একটা সুচের মতো সূক্ষ্ম মিহি জিনিস। সে ফকিরের কথার জবাবে অদ্ভুত ভঙ্গিতে খ্যাক খ্যাক করে হেসে উঠল। –এ আমার বংশের সম্পদ। আমারই প্রাপ্য; ওসব ভয় আমায় দেখিও না। তাছাড়া তুমি তো বাপু সংসারত্যাগী ফকির, তোমার এসব বাজে ব্যাপারে নাক গলানোর দরকারটা কী? যাও! এক্ষুনি এখান থেকে চলে যাও! নৈলে তোমাকেও জবাই করে ফেলব!

বলে লতিফ খাঁ বাঁ হাতে একটা মস্ত ছোরা বের করে উঁচিয়ে ধরল।

ফকির এক পা পিছিয়ে গিয়ে বলল—আমি জানি তুমি তা পারবে। তুমি ছদ্মবেশী শয়তান! জায়গিরদার বংশের কলঙ্ক তুমি! কিন্তু এখনও সাবধান করে দিচ্ছি লতিফ খাঁ, ওই মণি স্বর্গের বস্তু। মিশরের সাধক আজমশাহ কঠোর সাধনায় ওই রত্ন আশীর্বাদ স্বরূপ পেয়েছিলেন এক দেবদূতের কাছে। দোহাই তোমার, যদি বাঁচতে চাও-পেটিকা খুলো না!

লতিফ খাঁ বাঁকা হেসে বলল—এটার মধ্যে নিছক একটা নীলকান্ত মণি আছে—পুরুষানুক্রমে আমরা শুনে আসছি। কিন্তু কেউ আজিমুদ্দিনের কবরের খোঁজ পায়নি বলেই মণিটা হাতাতে পারেনি! এতদিনে আমার পূর্বপুরুষের সম্পদ আমি হাতিয়েছি। তুমি…

বাধা দিয়ে ফকির বলল—কিন্তু কবরের সন্ধান আমিই তোমায় দিয়েছিলুম লতিফ খাঁ! ওঃ! কী ভুলই না করেছিলুম!

লতিফ খাঁ বলল—কীসের ভুল? তুমি ঠিকই করেছিলে! কিন্তু মাঝখানে ব্যাটা কমলাক্ষ কী ভাবে টের পেয়ে বাগড়া দিয়েছিল। তাকে তো এবার পুলিশ ধরবেই! ইতিমধ্যে মণিটা নিয়ে আমি ইরানে পালিয়ে যাব। তুমি যদি আমার সঙ্গে যেতে চাও, বলো। হা—তোমাকে আমি এই মণিবেচার টাকার কিছু ভাগ দিতে রাজি আছি।

ফকির বলল-লতিফ খাঁ! বাচালতা কোরো না। আবার বলছি, তুমি ওই মমি-মুণ্ডু আর বাকসো কবরে রেখে এস গে। ওঠো, আমি তোমাকে সাহায্য করব। কবরের ওখানে পুলিশ সারাক্ষণ–পাহারা দিচ্ছে। কিন্তু তুমি তো জানো, আমি এরকম বিষাক্ত ধোঁয়া তৈরি করতে জানি। সেই ধোঁয়ার দাপটে পুলিশ দূরে সরে যাবে। সেই সুযোগে ঝটপট দুজনে কবরের মধ্যে এগুলো রেখে আসব।

লতিফ খাঁ তেমনি বিদঘুটে খ্যাক খ্যাক হাসি হেসে হেসে বলল—চুপ! এই দেখো, তোমার সামনেই আমি পেটিকা খুলছি। আমার পূর্বপুরুষের ঐশ্বর্য দেখে চোখ দুটো সার্থক করো, ফকিরসায়েব!

বলে সে সুচের মতো চাবিটা বাক্সের একস্থানে চেপে ধরল। ফকির দু হাত তুলে প্রায় আর্তনাদ করে উঠল—লতিফ খা! সাবধান!

কর্নেল, অজিতেশ ও শংকর নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে আছেন। অবাক হয়ে এবার দেখলেন, কালো পেটিকার ওপরের অংশ আস্তে আস্তে ঠেলে উঠছে। তার এক বিচিত্র ব্যাপার ঘটতে থাকল।

পেটিকার ফাঁক দিয়ে অত্যুজ্জ্বল নীল আভা ঠিকরে বেরুতে লাগল। ঘরের ভেতর নীল তীব্র আলো পড়তে থাকল।

আবার ফকিরের চিৎকার শোনা গেল—হুঁশিয়ার লতিফ খাঁ! পালিয়ে এস! পালিয়ে এস!

তারপর ফকির এক লাফে বাইরে গিয়ে পড়ল। আর পেটিকার ওপরের অংশ খাড়া হয়ে ওঠার পর দেখা গেল, গোলাকার একটুকরো নীল উজ্জ্বল বস্তু রয়েছে ভেতরে এবং ঘরের ভেতরে সুতীব্র নীল আলোর ঝলকানি। লতিফ খাঁ দুচোখে আতঙ্ক ঠিকরে পড়ছে। সে স্থির হয়ে গেছে।

তারপর ঘটল এক বিস্ময়কর ঘটনা। নীল মণিটা একটু করে শূন্যে ভেসে উঠতে থাকল। কিন্তু লতিফ খাঁ তেমনি স্থির। যেন নীলরঙের একটা মমি হয়ে গেছে সে।

নীল মণিটা এবার শূন্যে ভেসে দরজার দিকে চলল। বাইরে ফকিরের চিৎকার শোনা গেল ফের—হুশিয়ার! হুশিয়ার!

কর্নেল, অজিতেশ আর শংকর একলাফে ঘরের সামনের দিকটায় চলে গেলেন। তারপর দেখলেন, নীলবর্ণ উজ্জ্বল সেই মণি নক্ষত্রের মতো ভেসে চলেছে ভাটার ওপর। সারা এলাকা তীব্র নীল বৈদ্যুতিক আলোয় ভরে গেছে।

তারপর হঠাৎ মণির গতিবেগ বাড়ল। হু হু করে আকাশে উঠে পড়ল। তারপর প্রচণ্ড বেগে নক্ষত্রের দিকে উড়ে চলল। দেখতে দেখতে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে সেটা আকাশের নক্ষত্রলোকে মিলিয়ে গেল। আবার অন্ধকারে ঢেকে গেল চারদিক।

তিনজনে হতবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলেন। এবার কর্নেল বলে উঠলেন— লতিফ খাঁর সাড়া নেই কেন? বলে টর্চ জ্বেলে ঘরের ভেতর আলো ফেললেন।

লতিফ খাঁ তেমনি হাঁটু দুমড়ে স্থির হয়ে বসে আছে। কর্নেল ঘরে ঢুকে বলে উঠলেন—লতিফ খাঁ! লতিফ খাঁ! তার দুপাশে শংকর ও অজিতেশ এসে দাঁড়ালেন।

পেছন থেকে ফকিরের গলা শোনা গেল—লতিফ খাঁ পুড়ে ছাই হয়ে গেছে কর্নেল সায়েব!

ফকির দৌড়ে এসে তার লম্বা চিমটেটা লতিফ খাঁয়ের গায়ে ঠেকাতেই সবাই স্তম্ভিত হয়ে দেখলেন গুঁড়ো গুঁড়ো একরাশ জমাট ছাই ছাড়া ওই দেহটা আর কিছুই নয়। ফকির কালো পেটিকা আর মমি-মুণ্ডটা দু হাতে তুলে নিয়ে বলল—আর কী? চলুন সবাই এগুলোকে আজিমুদ্দিনের কবরে রেখে আসি।…

দরমাবেড়ার ঘরের মধ্যে লোভী লতিফ খায়ের ভস্মীভূত মৃতদেহ পড়ে রইল। ওঁরা সবাই ভাটা থেকে রাস্তায় গিয়ে পৌঁছলেন।

অজিতেশ এবার হুইসল বাজিয়ে পুলিশ বাহিনীকে ফেরার সংকেত দিলেন। ভাটার চারদিক। ঝোপের আড়ালে বসে সেই বিস্ময়কর দৃশ্য সবাই দেখেছে! এবার নিঃশব্দে একে একে ফিরে আসছিল।

এবার জিপ ও ভ্যান এগিয়ে চলল স্টেশনের ওধারে সেই পোড়ড়া জমিতে বটতলার দিকে—যেখানে বালক আজিমুদ্দিনের কবর আছে। ফকির জিপের সামনে কর্নেলের পাশে বসে আছে। তার কোলের ওপর মমি-মুণ্ড আর কালো পেটিকা।

যেতে-যেতে কর্নেল একবার শুধু বলে উঠলেন—এই বিরাট পৃথিবীতে এখনও কত রহস্য রয়েছে, বিজ্ঞান তার সীমানায় যেতে পারেনি। তবে যাই বলি না কেন, এত রহস্য আছে বলেই জীবনটা এত লোভনীয় এবং বরণীয়।

ফকির অস্পষ্টস্বরে বিড়বিড় করে কী মন্ত্রপাঠ করতে থাকল। আর কেউ কোনও কথা বললেন না।….

তখন ন্যাড়া মায়ের পাশে শুয়ে গভীর ঘুমে তলিয়ে গেছে। ঘুমের মধ্যে সে একটা আশ্চর্য স্বপ্ন দেখছিল।

আকাশ থেকে একটা নীলরঙের উজ্জ্বল নক্ষত্র খসে পড়ল। স্টেশনের ওপাশের মাঠে দাঁড়িয়ে আছে সে। দৌড়ে যেই নক্ষত্রটা কুড়োতে গেছে, অমনি ফের সেটা উড়ে চলেছে। দুঃখিত মনে ন্যাড়া দাঁড়িয়ে রইল। তারপর নীল নক্ষত্রটা আকাশে ভেসে গিয়ে একস্থানে আটকে যেতেই ন্যাড়া

ভঁা করে কেঁদে ফেলল।

সুনন্দা ডাকছিলেন—ন্যাড়া! ও নেড়ু! কঁদছিস কেন? স্বপ্ন দেখছিলি বুঝি! ন্যাড়া জেগে উঠেছে! জবাব না দিয়ে মায়ের বুকে মাথা গুঁজে দিল। আজ রাতে শীতটাও বড্ড পড়েছে। কুঁকড়ে আরামে শুয়ে রইল। কিন্তু স্বপ্নটা তার মন খারাপ করে দিয়েছে।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত