কালো বাক্সের রহস্য- ন্যাড়ার বাড়ি ফেরা

কালো বাক্সের রহস্য- ন্যাড়ার বাড়ি ফেরা

ন্যাড়া দুপুরবেলায় মাঝগাঙে বুড়ো জেলের নৌকোয় ইলিশ মাছের ঝোল দিয়ে মনের সুখে পেট ভরে ভাত খেয়েছে। বন্দিদশায় কি খেতে ভালো লাগে? তাই খিদেয় নাড়ি চো চো করছিল। তার ওপর টাটকা ধরা গঙ্গার ইলিশ।

ন্যাড়াকে দেখে বুড়ো জেলে আর তার জোয়ান ছেলের খুব মায়ামমতা জেগেছিল মনে। আহা, ভদ্দর লোকের সুন্দর ছেলেটা—বয়স কতই বা হয়েছে? দশ বারো বই নয়। তাকে কিনা ছেলে ধরা ডাকুরা চুরি করে এনেছিল। তবে বুড়ো জেলে হেসে খুন হয়েছিল।—খুব নবডংকাটি দেখিয়ে কেটে পড়েছে বাবা। ওরা যেমন বুনো ওল, তুমি তেমনি বাঘা তেঁতুল! এবারে ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে যাও। চলো, তোমায় আমরা স্টেশনে পৌঁছে দিয়ে আসি। রেলগাড়ি করে চলে যাবে।

বুড়ো বিকেলে তাই করেছে। বাপ-ব্যাটা মিলে ইছাপুর রেলস্টেশনে পৌঁছে দিয়েছে। ন্যাড়াকে। ঘাটে নৌকো বেঁধে রেখে এসেছে।

তারপর লিটনগঞ্জের টিকিট কেটে দিয়েছে। ন্যাড়া তার সঙ্গে দাদু পাতিয়েছে। বলেছে—ও দাদু! তোমার ঠিকানা বলো লিখে নিচ্ছি। টিকিটের টাকাটা পাঠিয়ে দিতে বলব বাবাকে।

জেলেবুড়ো জিভ কেটে বলেছে—ছি, ছি! ও কী কথা নাতি ভাই! ও টাকা ফেরত নেব না। বরং বাপ বেটা মিলে নৌকো নিয়ে আমরা উজানে যাব যখন, তখন তোমাদের লিটনগঞ্জে গিয়ে উঠবখন। তখন তোমার মায়ের কাছে দু-মুঠো খেয়ে আসব। ওতেই সব শোধ!

ন্যাড়া বলেছে—কবে যাবে জেলেদাদু!

-এখন তো শীত। বর্ষায় যাব। ঠিক যাব। আমরা তো জলচরা মানুষ ভাই। ট্রেন এসে গেছে। তখন ন্যাড়াকে তুলে নিয়ে বুড়ো জানালার পাশে দাঁড়িয়ে চাপা গলায় সাবধান করে দিয়েছে। আর যেন বদমাশদের পাল্লায় না পড়ে ন্যাড়া! ট্রেন ছেড়ে দিলে কয়েক পা সঙ্গে সঙ্গে এগিয়েছে জেলে বুড়ো। তারপর হঠাৎ তার খেয়াল হয়েছে—এই গো, সারাদিন সঙ্গে রইলে। নামটা তো জানা হল না ছেলের।

ন্যাড়া চলন্ত ট্রেনের জানালায় মুখ বাড়িয়ে চেঁচিয়ে বলেছে—স্বপনকুমার রায়। ওখানে সবাই আমায় ন্যাড়া বলে ডাকে—এ-এ-এ!

ট্রেনে বড় ভিড় ছিল। দিনটা শনিবার। তাই শহুরে বাবুর দল রবিবারের ছুটি কাটাতে যে-যার দেশের বাড়ি চলেছে।

তবু ন্যাড়া খুব সাবধানে নজর রেখে বসে রইল। কমলাক্ষ বা মেধো গুন্ডা যদি তার খোঁজে দৈবাৎ এ ট্রেনে উঠে থাকে!

প্রতি স্টেশনে লোকেরা উঠল-নামল। কিন্তু ওদের দেখা না পেয়ে ন্যাড়া আশ্বস্ত হল। লিটনগঞ্জ প্রায় চার ঘণ্টা লেগে গেল পৌঁছতে। চেনা স্টেশনে নামল যখন, তখন ঘড়িতে কাঁটায় কাঁটায় রাত সাড়ে আটটা বাজে। বেশ শীত করছে। গায়ে মোটে একটা শার্ট, পরনে হাফ প্যান্ট। পায়ের জুতো সেই ঘরে পড়ে আছে।

প্ল্যাটফর্মের ভিড়ে ন্যাড়া ভয়েভয়ে ফের চারদিকে তাকিয়ে কমলাক্ষদের খুঁজল। তারপর গেটে টিকিট দিয়ে রাস্তায় হনহন করে এগোল। স্টেশন রোডে ল্যাম্পপোস্ট থেকে যে আলো ছড়াচ্ছে, তা কুয়াশায় ম্লান। ন্যাড়া শীতে ঠকঠক করে কেঁপে প্রায় দৌড়ুচ্ছিল। বাস রিকশো আর পায়েচলা লোকের সঙ্গে দেখা অবশ্য হচ্ছে। কিন্তু একটু পরে বাঁদিকে মোড় নিয়ে যে রাস্তার তাদের পাড়ায় ঢুকতে হবে, সেটা বেশ নির্জন। নাকি বাজার ঘুরে অন্যপথে বাড়ি ঢুকবে?

এই লিটনগঞ্জেই ন্যাড়ার জন্ম। এর নাড়িনক্ষত্র এ বয়সেই তার জানা। অথচ তার জীবনে এমন একটা ভয়ংকর ঘটনা ঘটেছে যে, এখন এই রাতেরবেলা চিরচেনা লিটনগঞ্জ তার কাছে অজানা এক রহস্যময় আর বিভীষিকায় ভরা শহর হয়ে উঠেছে।

খালি মনে হচ্ছে, সামনের ওই লোকটাই বদমাশ কমলকাকু কিংবা মেধো গুন্ডা। কখনও মনে হচ্ছে, অন্ধকার জায়গাগুলো থেকে ওরা তার দিকে নজর রেখেছে। এখনই ঝাঁপিয়ে পড়বে। আবার তাকে ধরে নিয়ে গিয়ে আটকে রাখবে।

মোড়ে এসে ন্যাড়া একটু দাঁড়াল। বাজার ঘুরে অন্য রাস্তায় বাড়ি যাবে, নাকি এই রাস্তায় শর্টকাটে পৌঁছুবে? এ রাস্তার দুধারে ফাঁকায় একটা করে বাড়ি আর মাঝেমাঝে ফুলফলের বাগিচা। এ পাড়াটা খুব নির্জন। এটা হাউসিং কলোনি একটা। সবখানে এখনও বাড়ি তৈরির কাজ শেষ হয়নি। আগাছার জঙ্গল বা গাছপালাও রয়ে গেছে।

মোড়ে যেখানে ন্যাড়া দাঁড়িয়েছে, সেখানে শহরের জলের ট্যাংক। উঁচু লোহার ফ্রেমের মাথায় বসানো। হঠাৎ ন্যাড়া দেখল, ওই উঁচুতে রাখা বিশাল ট্যাংকের পেছন দিকে ঘন ছায়ায় ভেতর থেকে একটা লোক সাঁৎ করে বেরিয়ে এল।

লোকটা বেজায় ঢ্যাঙা। মাথায় চুঁচলো একটা টুপি রয়েছে। তার কাঁধে একটা ভারী ব্যাগ ঝুলছে। ব্যাগটা এক হাতে চেপে সে কুঁজো হয়ে এদিক-ওদিক চাইতে-চাইতে উলটোদিকের ইট ও টালিভাটার মধ্যে ঢুকে পড়ল।

ন্যাড়া লোকটিকে তক্ষুনি চিনতে পেরেছে। আরে। এ তো সেই মুসলমান পাড়ার হেকিমসায়েব!

রাস্তায় ওকে দেখলেই ন্যাড়া তার বন্ধুরা পেছনে লাগে। সুর ধরে চেঁচায়- ও খা-সায়েব! ও খা-সায়েব! একটু দাওয়াই দেবে?

হেকিম বড় বদমেজাজি আর পাগলাটে স্বভাবের লোক। দাঁতমুখ খিঁচিয়ে তাড়া করে ওদের। ন্যাড়ারা তখন হাসতে হাসতে পিছু হটে।

হেকিমসায়েব এমন করে চুপিচুপি ভাটার দিকে কোথায় গেল? ন্যাড়া হাঁ করে তাকিয়ে রইল। বাড়ি যাবার কথা, কমলাক্ষ বা মেধো গুন্ডার কথা—সব ভুলে গেল।

ইট ও টালিভাটাটা এখন পোড়ো হয়ে গেছে। বিশাল এলাকা জুড়ে বড় বড় পুকুরের মতো গর্ত বা খাল আর ঢিবি রয়েছে। ঢিবিতে জঙ্গল গজিয়েছে। সতুবাবুরা একসময় রোডস ডিপার্টমেন্টের জন্য ইট ও টালি সাপ্লাই দিতে ওখানে ভাটা বানিয়েছিলেন। দুটো মস্তো চিমনি রয়ে গেছে।

হেকিমসায়েব ওখানে ঢুকল কেন? আর ওর ব্যাগে কী এমন ভারী জিনিস আছে যে অমন করে কুঁজো হয়ে পা ফেলছিল সে?

ন্যাড়ার মাথায় এই এক রোগ। তার খেয়াল চড়লে আর জ্ঞানগম্যি থাকে না। সে দৌড়ে রাস্তার ওপাশে গিয়ে দেখার চেষ্টা করল, হেকিমসায়েব যাচ্ছেটা কোথায়? কিন্তু ওদিকটা ঘন অন্ধকার। কিছু দেখা যাচ্ছে না।

কিছুক্ষণ হতাশভাবে দাঁড়িয়ে থাকার পর ন্যাড়ার সম্বিৎ ফিরল। এদিকটা শীতটাও বেজায় বেড়ে গেছে। দাঁতে দাঁত ঠেকে কাঁপুনিতে অস্থির। ন্যাড়া ওখান থেকে মোড়ে ফিরে এল। তারপর প্রায় চোখ বুজে নির্জন রাস্তা দিয়ে দৌড় লাগাল।

এক দৌড়ে পরের মোড়ে এসে সে ডান দিকে ঘুরল। তারপর গলিরাস্তায়, আরেক দৌড়ে একেবারে বাড়ির দরজায় পৌঁছোল।

রোয়াকে উঠেই সে চেঁচিয়ে উঠল—মা! ওমা!

সঙ্গে সঙ্গে ভেতর থেকে তার মায়ের গলা ভেসে এল—কে রে?

ন্যাড়া ভয়েভয়ে বলল—আমি।

সুনন্দা দরজা খুলেই আনন্দে চেঁচিয়ে উঠলেন—ওগো! ন্যাড়া এসেছে! ন্যাড়া! তারপর ছেলেকে দু হাতে বুকে জড়িয়ে হাউমাউ করে কেঁদে ফেললেন।

ভেতরে রমেনবাবু-ন্যাড়ার বাবা চুপচাপ বসেছিলেন। শুনতে পেয়ে লাফিয়ে উঠে গর্জে বললেন—ওরে হতভাগা! আয়, মজা দেখাচ্ছি তোর!

ন্যাড়া মায়ের বুকে মিশে আছে। নির্ঘাত বাবা একচোট চড়থাপ্পড় আগে মেরে বসবেন—ব্যাপারটা কত সাংঘাতিক তা বুঝতেই চাইবেন না হয়তো।

কিন্তু শেষ পর্যন্ত দেখা গেল, রমেনবাবুরও চোখে জল। ধরা গলায় বললেন—অমন করে বাড়িপালানো অভ্যাস করলে তুই কি মানুষ হতে পারবি খোকা? দেখো দিকি কাণ্ড। আজ দুদিন ধরে বাড়িতে রান্নখাওয়া বন্ধ!

যাক্, বাবাও কেঁদে ফেলেছেন। ন্যাড়া নিশ্চিন্ত। বাড়িতে খুব সাড়া পড়ে গেছে। দিদি অমিতা ওর গালে চিমটি কেটে গরম জল করতে গেল। বাবা একটা গরম চাদরে ন্যাড়াকে জড়িয়ে ফেললেন। সুনন্দা ছুটোছুটি করে বেড়াচ্ছেন বাড়িময়।

সেই হট্টগোলের সময় হঠাৎ কোত্থেকে শংকরবাবু হাজির।

বাড়ি ঢুকে ন্যাড়াকে দেখে তিনি কয়েকমুহূর্ত হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারলেন না।

ন্যাড়া মিটিমিটি হাসছিল।

শংকরবাবুর মুখে কথা ফুটল অবশেষে। বলে ফেললেন—তোকে ওরা ছেড়ে দিল তাহলে? ন্যাড়া বলল—হুঁ, তাই বুঝি? আমি বুদ্ধি করে পালিয়ে এসেছি।

রমেনবাবু ও সুনন্দা অবাক হয়ে বললেন—অ্যাঁ! সে কী কথা!

শংকরবাবু বললেন—সব বলছি। সে এক সাংঘাতিক ব্যাপার। ন্যাড়া যে প্রাণে বেঁচে পালিঃ আসতে পেরেছে, এজন্যে ওকে পুরস্কার দেওয়া দরকার।

রমেনবাবু বললেন—আহা! বলবে তো কী হয়েছিল?

শংকরবাবু জবাব দিতে যাচ্ছেন, হঠাৎ ন্যাড়া বলে উঠল—ছোটমামা! একটা কথা শোনো। আমি স্টেশন থেকে আসছি, তখন সতুবাবুদের ভাটার মধ্যে মুসলমানপাড়ার হেকিম লোকটা ভারী ঝোলা কাঁধে নিয়ে চুপিচুপি ঢুকে পড়ল। তারপর…

শংকরবাবু সঙ্গে সঙ্গে চমকে উঠেছিলেন। বললেন—জামাইবাবু! আমি একটু পরে আসছি। বলে সবাইকে অবাক করে বেরিয়ে গেলেন। তারপর…

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত