তোপখানার এদিকটায় মুসলমানপাড়া। এলাকা জুড়ে প্রাচীন ঐতিহাসিক ধ্বংসস্তুপ ছড়িয়ে রয়েছে। সেইসব ধ্বংসস্তুপে আগাছার জঙ্গলও গজিয়েছে। একপাশে মিউনিসিপ্যালিটির রাস্তা আর কয়েকটা ল্যাম্পপোস্ট দূরে দূরে দাঁড়িয়ে রয়েছে। শীতের বেলা ফুরিয়ে গেছে। বাতি জ্বলেছে। সবে। কর্নেল ওই রাস্তায় ভিড় দেখতে পাচ্ছিলেন। একদল পুলিশ সেই ভিড় ঠেকিয়ে রেখেছে। পুলিশের জিপ, ভ্যান আর একটা অ্যাম্বুলেন্স গাড়ি দাঁড়িয়ে রয়েছে।
অজিতেশ কর্নেলকে দেখে এগিয়ে এলেন। কর্নেল বললেন—লাশ কোথায়?
ওই যে, ওখানে পোডড়াবাড়ির মধ্যে।
বলে অজিতেশ কর্নেলকে নিয়ে রাস্তার পাশে আগাছার জঙ্গল ঠেলে ঢুকলেন। পোড়ো বাড়িটা আসলে কোনও একটা নবাবি অতিথিশালার একটা অংশ। ভেঙেচুরে একাকার। শুধু একটা ঘর কোনওক্রমে টিকে আছে। একটা হ্যাসাগ রাখা হয়েছে লাশের কাছে। লাশটা সেই ঘরের মেঝেয় উপুড় হয়ে পড়ে আছে। পিঠে কাধের কাছে একটা ছোরা তখনও বিঁধে রয়েছে। তাই বেশি রক্ত বেরুতে পারেনি।
হাসপাতালের ডাক্তারবাবু পুলিশ সুপারের নির্দেশের অপেক্ষা করছিলেন। ইশারা পেয়ে ছোরাটা টেনে বের করলেন। এক ঝলক জমাট রক্ত বেরিয়ে এল। কর্নেল মুখ ফিরিয়ে নিলেন।
আরও সব পুলিশ অফিসার লাশ ঘিরে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তারা ততক্ষণে মোটামুটি তদন্ত করে ফেলেছেন ঘটনাটার। কিন্তু কর্নেলের ব্যাপার-স্যাপার অন্যরকম।
কর্নেল হেঁট হয়ে ঘরের মেঝে পরীক্ষা করতে থাকলেন। তারপর ঘর থেকে বেরিয়ে বারান্দায় এলেন। বারান্দা থেকে উঠোনে টর্চের আলো ফেলে কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করলেন। পুলিশ অফিসাররা তাই দেখে বাঁকা মুখে হেসে পরস্পর তাকাতাকি করছিলেন। এ বুড়ো আবার কে—বেমক্কা নাক গলাতে এসেছে এবং পুলিশ সুপার তাকে এত খাতির করছেন!
কর্নেল উঠোনের কোনা থেকে কী একটা কুড়িয়ে পকেটে রাখলেন।
ওদিকে লাশ ধরাধরি করে হাসপাতালের লোকেরা অ্যাম্বুলেন্সে তুলল। মর্গে নিয়ে গিয়ে পোস্টমর্টেম করা হবে। ডাক্তারবাবুও চলে গেলেন।
অজিতেশ এতক্ষণে কর্নেলের কাছে এসে বললেন-কী বুঝলেন কর্নেল?
কর্নেল বললেন—আপাতদৃষ্টে মনে হচ্ছে, মদনবাবু কারুর কথামতো সেই কালো বাকসোটা কলকাতা থেকে এনে এই পোড়ো বাড়িতে অপেক্ষা করছিলেন। আচমকা তাকে পিছন থেকে ছোরা মেরে খুনি বাকসোটা নিয়ে ভেগেছে। ছোরাটা তুলে নেওয়ার সময় পায়নি বলেই মনে হচ্ছে।
কেন সময় পায়নি, অনুমান করতে পারছেন?
সম্ভবত কেউ এসে পড়েছিল।
কোনও সূত্র খুঁজে পেলেন কি কর্নেল?
কিছু পেয়েছি বইকি। বলে কর্নেল একটু হাসলেন।
বলতে আপত্তি আছে?
কর্নেল বললেন—তোমায় বলতে আপত্তি কীসের? প্রথম সূত্র—ঘরের ভেতর ভাঙা কড়িকাঠ স্কুপের আড়ালে সুরকির গুঁড়োয় জুতোর ছাপ আছে দেখলুম। কেউ মদনবাবুর জন্যে আগে থেকেই ওখানে লুকিয়ে অপেক্ষা করছিল। তবে সে ছোরা মারেনি। যে মেরেছে, সে বাইরে থেকে আচমকা ঢুকে মেরেছে এবং সম্ভবত এক-ঝটকায় মদনবাবুর ব্যাগটা হাতিয়ে নিয়ে পালিয়েছে।
বলে কর্নেল পকেট থেকে একটুকরো বাঁকাচোরা শেকড় বের করলেন।
অজিতেশ অবাক হয়ে বললেন—ওটা কী? কোথায় পেলেন?
উঠোনের কোনায়। খুনি পালাবার সময় এটা তার হাত থেকে পড়ে গেছে।
ওটা একটা শেকড় না?
হ্যাঁ শেকড়। আর এই দ্যাখো, এতে একটু রক্ত লেগে রয়েছে।
অজিতেশ অবাক হয়ে বলল—খুনির হাতে এই শেকড় ছিল? কেন?
কর্নেল একটু হেসে বলল—অজিতেশ! খুনি কে আমি বুঝতে পেরেছি। কিন্তু তাকে সম্ভবত এখন বাড়িতে পাওয়া যাবে না। তবু চেষ্টা করতে দোষ কী?
অজিতেশ ব্যস্তভাবে বললেন—দোহাই কর্নেল! দয়া করে আর হেঁয়ালি করবেন না। বলুন, কে সে? এখনই তাকে গ্রেফতারের জন্য পুলিশবাহিনী পাঠাব।
কর্নেল আনমনে বললেন—আমারই বুদ্ধির ভুল! আঃ তখনই যদি…
কর্নেল! আবার হেঁয়ালি করছেন আপনি!
কর্নেল স্থিরদৃষ্টে পুলিশ সুপারের দিকে তাকিয়ে বললেন-অজিতেশ! জনা চার-পাঁচ বুদ্ধিমান এবং অভিজ্ঞ অফিসার নিয়ে তুমি এখনই আমার সঙ্গে এস। আমার ধারণা, বড্ড দেরি হয়ে গেছে! তবু চেষ্টা করতে দোষ কী?
অজিতেশ তক্ষুনি পুলিশ অফিসারদের ডেকে জিপে উঠতে বললেন। তারপর কর্নেলকে ডেকে বললেন—আমরা রেডি। চলে আসুন কর্নেল।
কর্নেল জিপের সামনে অজিতেশের পাশে বসে বললেন—সোজা আমার বাংলোয় চলো। ওখানে জিপ রেখে আমরা যথাস্থানে রওনা দেব।
জিপ প্রচণ্ড বেগে ছুটল। আলো আর ভিড়েভরা বাজার এলাকা ছাড়িয়ে জিপ নদীর ধারে সরকারি বাংলোয় পৌঁছোল। কর্নেল বললেন—সবাই আমার সঙ্গে আসুন। কোনও শব্দ করবেন না টর্চ রেডি রাখুন। কেউ যেন গুলি ছুঁড়বেন না। সাবধান! যদি কেউ আক্রমণ করে, তাহলে অবশ্য ভিন্ন কথা। তবে কেউ আক্রমণ করবে বলে মনে হয় না!
অজিতেশ ও পুলিশ অফিসাররা কর্নেলকে অনুসরণ করলেন।
কর্নেল অন্ধকারে নদীর দিকে হাঁটছিলেন। সেই গাবতলায় পৌঁছে একটু দাঁড়ালেন। তারপর ফিসফিস করে বললেন—নদীর ওপারে যেতে হবে আমাদের। দেখবেন, কেউ যেন জলে না
পড়েন।
কুয়াশার মধ্যে মিটমিটে নক্ষত্রের আলো নদীর জলে কোথাও কোথাও ঝিকমিক করছে। সাবধানে বালির চড়া পেরিয়ে সবাই ওপারে পৌঁছলেন।
সামনে বাঁশবন নিঃঝুম হয়ে দাঁড়িয়ে আছে অন্ধকারে। বাঁশের পাতা থেকে শিশির পড়ার টুপটাপ শব্দ শোনা যাচ্ছে। একবার পাচা ডেকে উঠল বিশ্রী শব্দে। তারপর গোরস্থানের ওদিকে
শেয়াল ডাকতে লাগল।
কর্নেল আগে, পুলিশ অফিসাররা পেছনে। কাঁটাঝোপে বারবার কাপড় আটকে যাচ্ছে। আছাড় খেতে হচ্ছে। শুকনো পাতা শিশিরে ভিজে গেছে বলে জুতোর শব্দ হচ্ছে না। কিছুটা চলার পর কর্নেল দাঁড়ালেন। কান পেতে কী যেন শোনার চেষ্টা করলেন।
কিন্তু কোনও শব্দ শোনা গেল না। আবার কিছুটা এগিয়ে কর্নেল ফিসফিস্ করে বললেন—রেডি! টর্চ জ্বালাতে হবে। ওয়ান টু থ্রি…
সঙ্গে সঙ্গে সাতটা টর্চ জ্বলে উঠল।
সেই উজ্জ্বল আলোয় দেখা গেল, জায়গাটা একটা গোরস্থান। আর সেখানে একদঙ্গল শেয়াল মাটি শুকছে একটা সদ্যখোঁড়া কবরের কাছে। তাদের চোখগুলো নীল।
হঠাৎ আলোয় তারা ভড়কে গিয়ে চোখের পলকে গা ঢাকা দিল। কর্নেল সদ্যখোঁড়া কবরটার কাছে গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়লেন।
অজিতেশ বলে উঠল—কী ব্যাপার কর্নেল? এর মাথামুণ্ডু কিছু যে বুঝতে পারছি না।
কর্নেল মাটির কবরের গর্তে আলো ফেলে হতাশস্বরে বললেন-দেরি হয়ে গেছে! আজিমুদ্দিনের মমি-মুণ্ডু এখানেই লুকিয়ে রেখেছিল সে। মদনবাবুকে খুন করে বাকসোটা হাতিয়ে সোজা এখানে এসেছিল। তারপর মমি-মুণ্ডুটা তুলে নিয়ে গোপন জায়গায় চলে গেছে। এতক্ষণে নিশ্চয় সে মুণ্ডু থেকে চাবি খুঁজে বের করেছে এবং বাকসো খুলে রত্নটিও পেয়ে গেছে।
অজিতেশ উত্তেজিত ভাবে বললেন—কর্নেল! কর্নেল! কী সব বলছেন আপনি? কার কথা বলছেন?
কর্নেল উঠে দাঁড়িয়ে জবাব দিতে যাচ্ছেন, হঠাৎ গোরস্থানের অন্যপ্রান্ত থেকে কার বিকট চিৎকার শোনা গেল—ইয়া পির মুশকিল আসান! যাহা মুশকিল তাহা আসান!
টর্চের আলো গিয়ে পড়ল ওদিকে। দেখা গেল সেই কালো আলখেল্লা ও কালো টুপিরা ফকির হাসতে হাসতে এগিয়ে আসছে।
অজিতেশ অবাক হয়ে বললেন, আরে! এ তো দেখছি পিরের মাজারের সেই পাগলা ফকির! এ আবার এখানে জুটল কেন?
কর্নেল বললেন–চুপ। ফকির কী বলে আগে শোনা যাক।
ফকির নির্ভয়ে গটগট করে চলে এল সামনে। তারপর বলল—বাবালোক! সরকারের টর্চের ব্যাটারি কি খুব সস্তা হয়ে গেছে? না কি কোম্পানিকা মাল, দরিয়ামে ডাল! কর্নেলসাহাব! ওনাদের বলুন, বেফায়দা আলো জ্বেলে লাভ কী? এটা গোরস্থান। এখানে পিদিমের আলোই মানায়।
বলে সে তার হাতের লণ্ঠনটি রেখে আলখেল্লার ভেতর থেকে দেশলাই বের করে জ্বালল। কর্নেল বললেন—টর্চ নিভিয়ে ফেলুন আপনারা!
তারপর ফকিরকে বললেন—ফকির সায়েব! আপনার কথাই সত্যি হল। হেকিম লতিফ খাঁ সত্যি আজিমুদ্দিনের মুণ্ডু চুরি করে এনে এই কবরে লুকিয়ে রেখেছিল। তারপর …
বাধা দিয়ে ফকির বলল—তারপর বাকসো চোরকে খুন করে বাকসোও হাতিয়েছে। এই তো?
কর্নেল বললেন—আপনি তাহলে সবই জানেন দেখছি!
বেটা আমি সর্বচর। সব জায়গায় ঘুরে বেড়াই। তো সেলাম পুলিশসায়েব! আপনিও এসেছেন। দেখছি। লেকিন লতিফ খাঁকে আর ছুঁড়ে বের করতে পারবেন? সে এখন হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে!
অজিতেশ কী বলতে যাচ্ছিলেন, কর্নেল তাকে থামিয়ে বললেন— ফকিরসায়েব! আপনার অজানা কিছুই নেই। লতিফ খাঁ এখন কোথায়, আপনি নিশ্চয় জানেন!
ফকিরের মুখ বিকৃত হয়ে গেল। সে বলল—তাকে ধরে ফেলব বলে আমিও তার পিছু নিয়েছিলাম। কিন্তু ব্যাটা খুব ধূর্ত। অন্ধকারে ঘুরপথে এগিয়ে আমাকে বোকা বানিয়ে দিয়েছে। তবে যেখানেই লুকিয়ে বাকসো খুলে আজব মণি বের করুক, তাকে আমি পাকড়ে ফেলব।
বলেই ফকির গতকাল সন্ধ্যার মতো আলখেল্লার ভেতর থেকে কী একটা বের করে লণ্ঠনের ওপর ছড়িয়ে দিল।
সঙ্গে সঙ্গে দুর্গ সাদা একরাশ ধোঁয়ায় সারা গোরস্থান ঢেকে গেল। কর্নেল চেঁচিয়ে উঠলেন—সরে আসুন! সরে আসুন সবাই। বিষাক্ত গ্যাসে মারা পড়বেন।
সবাই এক দৌড়ে অনেকটা তফাতে সরে গেলেন। একটু পরে ধোঁয়া মিলিয়ে গেলে টর্চের আলোয় দেখা গেল, গোরস্থান নির্জন। ফকির অদৃশ্য হয়েছে।
অজিতেশ গম্ভীর মুখে বললেন—তাহলে কী করা যাবে কর্নেল?
কর্নেল বললেন-কিছু মাথায় আসছে না। লতিফ খাঁ হেকিমকে খুঁজে বের করা আর খড়ের গাদা থেকে হারানো ছুঁচ উদ্ধার করা একই ব্যাপার। বিশেষ করে এই রাত্রিবেলার অন্ধকারে এ কাজ অসম্ভব!
আমার অসহ্য লাগছে কর্নেল! ব্যাটা খুনি তো বটেই, তার ওপর আজিমুদ্দিনের কবরের বহুমূল্য রত্ন নিয়ে নির্বিবাদে ভেগে পড়বে?
কর্নেল পা বাড়িয়ে বললেন—সকাল হোক তারপর দেখা যাবে। বরং তুমি এ রাতে তোমার গোয়েন্দাবাহিনীকে কাছে গাও, অজিতেশ! যদি তারা কোনও হদিশ দৈবাৎ পেয়ে যায়, ভালোই।
সবাই মিলে নদীর দিকে পা বাড়ালেন। নদী পেরিয়ে বাংলোয় পৌঁছে কর্নেল বললেন—তাহলে এলো অজিতেশ। আমি বড্ড ক্লান্ত। বিশ্রাম করতে চাই।
পুলিশ সুপার সদলবলে জিপে চেপে গেলেন।
কর্নেল গেট পেরিয়ে লনে পা বাড়াতেই দেখলেন, বারান্দায় শংকর বসে আছেন। কর্নেল বললেন—শংকর যে! কখন এলে!
এইমাত্র। এসে তো সব শুনে ভীষণ ঘাবড়ে গেছি!
হ্যাঁ, তোমার বাজার সরকার ভদ্রলোক বেঘোরে খুন হয়ে গেছেন।
পাপের প্রতিফল, কী বলব? কিন্তু কর্নেল, শ্রীমান ন্যাড়ার জন্যে আর যে মন মানছে না! খালি মনে হচ্ছে, তাকে ওরা মেরে ফেলেছে। ওদিকে ওর বাবা-মার অবস্থা শোচনীয়। সব কথা খুলে বলিনি বটে, কিন্তু কতক্ষণ চেপে রাখব আর?
কর্নেল চেয়ারে ধুপ করে বসে বললেন—হ্যাঁ, বাকসো হাতছাড়া হয়ে গিয়ে কমলাক্ষ খেপে গেছে নিশ্চয়। কিন্তু না—আমার বিশ্বাস, ন্যাড়াবাবাজীবনকে সে মেরে ফেলবে না। কারণ তাতে তার আর এখন কোনও লাভই হবে না। তুমি ভেব না শংকর। বরং আমাকে ভাবতে দাও।… বলে কর্নেল চোখ বুজে কী যেন ভাবতে থাকলেন।