হ্যাঁ, আবার পাখিটা ডেকে উঠল। প্রায় এক ঘণ্টা পরে। প্রকৃতি যাকে কণ্ঠস্বর দিয়েছে, সে কি গান না গেয়ে পারে? কর্নেল কান পাতলেন। এবার কিন্তু ডাকটা ভেসে আসছে অনেক দূর থেকে।
কতক্ষণ ঠাহর করার পর বুঝলেন, কখন পাখিটা নদী পেরিয়ে ওপারে চলে গেছে। ওপারে ঘন বাঁশবন। বাঁশবনের ভেতর সে নিরিবিলিতে মনের সুখে গান ধরেছে।
কর্নেল বাইনোকুলার চোখে রেখে নদীতে নামলেন। এসব সময় তার পা কোথায় পড়ছে, খেয়াল থাকে না। জায়গায় জায়গায় সোনালি বালির চড়া, আবার কোথাও ঝিরঝিরে কাজল জলের স্রোত। কোথাও আবার ডোবার মতো জল জমে রয়েছে। আচমকা কর্নেল তেমনি একটি ডোবামতো জায়গায় হুড়মুড় করে পড়লেন। কোমর অব্দি ড়ুবে গেল।
এই শীতের ঋতুতে ব্যাপারটা আরামদায়ক নয় মোটেও। ঠকঠক করে কাঁপতে কাঁপতে উঠে পড়লেন বটে, কিন্তু চোখে বাইনোকুলারটা রয়ে গেল।
এমনি করে ওপারে পৌঁছে কাঁটাঝোপের ভেতর দিয়ে বাঁশবনে গিয়ে ঢুকলেন। তারপর ক্যামেরা তাক করে পাখিটার ছবি তুললেন। পরপর কয়েকটা।
তারপরই পাখিটা যেন টের পেল, তার ছবি তোলা হচ্ছে। অমনি সে ফুড়ুৎ করে উড়ে গেল বাঁশবনের ওপর দিয়ে। তাকে লক্ষ করতে গিয়ে কর্নেলের চোখে পড়ল, একটু তফাতে ঝোপের মধ্যে এইমাত্র কেউ হেঁট হল। তার মাথার একটা কিস্তুত গড়নের ছুঁচলো টুপি রয়েছে। টুপি পরে ঝোপের মধ্যে হেট হওয়াটা স্বাভাবিক ব্যাপার মোটেও নয়। তাই কর্নেল পা টিপে টিপে বাঁশবনের ভেতর ঝোপঝাড়ের আড়ালে চলতে থাকলেন।
ভেজা প্যান্ট শার্ট কোর্টে কোমর অব্দি হিমে জমে অবশ হয়ে গেছে। কিন্তু কর্নেল এ বয়সেও হাড়ে প্রচুর তাকত রাখেন। গ্রাহ্য করলেন না।
বাঁশবনের শেষে একটা আগাছার জঙ্গল। তার ওপাশটা মুসলিমদের গোরস্থান বলে মনে হল। একটা উঁচু ও চওড়া ঝোপের পাশে উঁকি মেরে বসে পড়ে কর্নেল।
একটা ঢ্যাঙা রোগা গড়নের লোক হাঁটু দুমড়ে বসে একটা কিছু করছে। তার মাথার ছুঁচোলো টুপিটার মতোই চেহারাও বিদঘুটে। যেন হাড়গিলে শকুন। নাকটা বেজায় লম্বা! গাল বলতে কিছু নেই। চিবুক থেকে লম্বা এক চিলতে ছাগল দাড়ি এসে বুকে নেমেছে। তার পরনে ময়লা জোকারের মতো জামা আর চুস্ত পাজামা। পায়ে নাগরা জুতো। কাঁধে একটা ব্যাগ ঝুলছে।
দু হাতে একটা খুরপি ধরে সে মাটি কোপাচ্ছে।
কর্নেল সামান্য একটু মাথা উঁচু করে যা দেখলেন, তাতে যত অবাক হলেন, তত আতঙ্কে শিউরে উঠলেন।
লোকটা যেখানটায় কোপাচ্ছে, সেখানটা একটা মাটির কবরের অংশ। কবরটা গ্রামের কোনও সাধারণ মানুষেরই কবর। তত বেশি পুরোনো নয়। কবর খুঁড়ছে কেন লোকটা? ও কি কঙ্কালটা চুরি করতে চায়? কঙ্কাল বিক্রি হয় গোপনে। চিকিৎসাবিদ্যার প্রয়োজনে কঙ্কাল লাগে। চোরাবাজারে তাই দেশবিদেশের কঙ্কাল বিক্রি হয় মোটা টাকায়।
এরপর লোকটা বসে পড়ল। কর্নেল শুধু তার মাথার পেছনটা আর কাধের কিছু অংশ দেখতে পাচ্ছিলেন। সে কী করছে পুরোটা দেখতে গেলে অনেকটা ঘুরে ওপাশে যেতে হয়। কিন্তু তা করতে গেলে তার চোখে পড়ার সম্ভাবনা।
একটু পরে লোকটা উঠে দাঁড়াল।
তার হাতে একটা বাঁকাচোরা শেকড় দেখতে পেলেন কর্নেল। তখন কর্নেল মনে মনে হেসে ফেললেন।
না, লোকটা কঙ্কাল চুরি করছিল না। নেহাত একটা গাছের শেকড় সংগ্রহ করছিল। গাছটা কবরে গজিয়েছিল নিশ্চয়।
হুম, এই লোকটাই তাহলে লিটনগঞ্জের সেই হেকিম লতিফ খাঁ নয় তো? কর্নেল চমকে উঠে দেখলেন, সর্বনাশ! লোকটা হন হন করে তার ঝোপটার দিকেই এগিয়ে আসছে যে!
সরে পড়ার ফুরসত পেলেন না কর্নেল। সে ঝোপ ঠেলে হুড়মুড় করে এসে একেবারে তার গায়ের ওপর পড়ল এবং ভয়ে কিংবা রাগে চেঁচিয়ে উঠল—অ্যাই বাপ!
কর্নেল অপ্রস্তুত হেসে উঠে দাঁড়ালেন। তারপর আদাব ঠুকে সসম্ভ্রমে বললেন—সেলাম হেকিমসাহেব! সেলাম, বহুৎ সেলাম!
হ্যাঁ লোকটা হেকিম লতিফ খাঁ-ই বটে। ভুরু কুঁচকে বলল—আপনি কে আছেন? এই জঙ্গলে কী করছেন?
কর্নেল বাইনোকুলার ও ক্যামেরা দেখিয়ে বিনীতভাবে বললেন—আমি পাখপাখালির ছবি তুলতে বেরিয়েছি হেকিমসাহেব। ওই ডালে একটা পাখি বসে ছিল। তার ছবি তুলছিলাম। আপনি তো বুঝতেই পারছেন, পাখির ছবি তুলতে হলে চুপিচুপি এইভাবে গা ঢাকা দিয়ে বসতে হয়।
হেকিম এবার দাঁত বের করে হাসল। হাঁ, হাঁ। আপনারা ইউরোপিয়ান সাহাব আদমির এইসা খ্যাল আছে বটে। একবার এক সাহাবলোকএসে ঠিক এমনি করে জঙ্গলে ঘুরে বেড়াত। হামি দেখেছে। তবে আপকা মাফিক বাংলা বোলি সে বলতে পারত না।
কর্নেল বুঝলেন, তার চেহারা দেখে হেকিম খাঁটি ইউরোপবাসী বলে ভুল করেছে। এটা স্বাভাবিক। এ ভুল তাকে দেখে সবাই করে। যাই হোক, এ সুযোগে তিনি ইউরোপীয় হয়ে গেলেই মঙ্গল। বললেন—জি হাঁ হেকিমসায়েব। আমি বাংলা মুল্লুকে অনেক বছর আছি কিনা। তবে উর্দুও বলতে পারি।
এরপর দুর্জন উর্দুভাষায় কথা বলতে বলতে নদীতে নামলেন। সে-সব কথাবার্তা হল এই :
আমি যে হেকিম, তা কীভাবে বুঝলেন?
কেন? আপনার হাতে গাছের শেকড় আর ওই খুরপি।
ঠিক, ঠিক।
তাছাড়া এখানে এসে আপনার কত নাম শুনেছি। আপনার দাওয়াই খেলে মড়াও নাকি উঠে বসে।
তা মা বাবা আর খোদার দয়ায় ওকাজটা আমি ভালোই পারি।
দেখুন হেকিমসায়েব, আমার কোমরে প্রায়ই খুব ব্যথা হয়। দাওয়াই দেবেন?
নিশ্চয় দেব। ওই তো আমার কাজ। তবে আমার দাওয়া-খানায় যেতে হবে।
তাই যাব। তবে দয়া করে আসুন, ওই বাংলোয় আমি যাচ্ছি। একটু চা খেয়ে যাবেন।
বেশ তো চলুন।
নদী পেরিয়ে দুজনে বাংলোয় পৌঁছলেন। কর্নেল চৌকিদারকে চায়ের আদেশ দিলেন। তারপর ঘরে ঢুকে মুখোমুখি বসলেন।
ফকির বলেছিল, হেকিম লতিফ খাঁ বদমেজাজি লোক। কিন্তু তাকে মোটেও তেমন মনে হল না কর্নেলের। লোকটি যে ভদ্রবংশীয় ত তার আদবকায়দা আর কথার ভঙ্গিতেই বোঝা যাচ্ছে।
কথায়-কথায় কর্নেল একসময় বলল—আচ্ছা হেকিমসায়েব, শুনেছি এখানে নাকি এক মস্তো জায়গিরদার ছিলেন। আপনি তারই বংশধর?
লতিফ খাঁ মাথা উঁচু করে বলল—আপনি ঠিকই শুনেছেন।
আচ্ছা খা-সাহেব, ইতিহাসের কেতাবে পড়েছিলাম এখানে আপনার পূর্বপুরুষদের আমলে কেউ মারা গেলে তার মৃতদেহ মমি করা হত। তা কি সত্যি?
হেকিম দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল—কিছুটা সত্যি। আপনি বিদেশি। আজ আছেন, কাল নেই। তাই সে গোপন কাহিনি আপনাকে বলছি।
বলে হেকিম লতিফ খাঁ এই কাহিনি শোনাল :
আজ থেকে প্রায় পাঁচশো বছর আগের কথা। জায়গিরদার মুইনুদ্দিন শাহ তাল-তমাসের মনে সুখ ছিল না। কারণ তার কোনও পুত্রসন্তান নেই। তাই তিনি আরব ও পারস্যের নানা মুসলিম তীর্থে ফকির ও অলৌকিক শক্তিধর সাধকের কাছে পুত্র কামনায় হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন। অবশেষে খোঁজ পেলেন, মিশরদেশের এক সাধক আজম শাহের কাছে গেলে তার মনস্কামনা পূর্ণ হতে পারে।
মুইনুদ্দিন তখনই মিশরে গিয়ে সেই সাধকের শরণাপন্ন হলেন। অনেক কাকুতি-মিনতির পর আজম শাহ বললেন—ঠিক আছে। আজ রাতদুপুরে তুমি আমার আস্তানায় একা এসো। তোমাকে আমি একটা অত্যাশ্চর্য জিনিস দেব। সেটা নিয়ে গিয়ে তুমি ও তোমার স্ত্রী ধুয়ে জল খাবে। তাহলে তোমাদের পুত্রলাভ হবে। কিন্তু সাবধান, এই জিনিসটি অপার্থিব একটি রত্নবিশেষ। একটি কৃষ্ণবর্ণ ধাতুনির্মিত ছোট পেটিকার মধ্যে এটা রেখে দেবে। আর দেখ মানুষ মরণশীল প্রাণী। তোমার পুত্রও একদিন মারা যাবে। তার যখনই মৃত্যু হোক, তার কবরের মধ্যে ওই রত্নসমন্বিত পেটিকাটিও অবশ্য সমাহিত করতে হবে। নতুবা সাংঘাতিক বিপদ ঘটবে।
মুইনুদ্দিন সেই অত্যাশ্চর্য কৃষ্ণবর্ণ রত্নপেটিকা নিয়ে দেশে ফিরলেন। সাধক তাকে পেটিকার চাবি দিয়েছিলেন। চাবির সাহায্যে পেটিকা খুলে রত্নটি বের করে ধুয়ে স্বামী-স্ত্রী মিলে সেই জল পান করলেন।
পরবৎসর তাঁর পুত্রলাভ হল। সাধকের নাম অনুসারে তার নাম রাখলেন আজিমুদ্দিন।
কিন্তু দুঃখের কথা, বারো বছর বয়সে সেই সুন্দর ছেলেটি এক অজ্ঞাত ব্যাধিতে মারা পড়ল। শোকে ভেঙে পড়লেন মুইনুদ্দিন।
তিনি মিশরে গিয়ে ওইসময় একজন কারিগরের খোঁজ পেয়েছিলেন—যে মৃতদেহ মমি করতে জানত। তাকে তিনি খেয়ালবশে সঙ্গে করে এনেছিলেন।
আজিমুদ্দিনের মৃতদেহ মমি করার ইচ্ছা হল হতভাগ্য পিতার। মিশরবাসী সেই লোকটি তার আদেশ পালন করল। কিন্তু সাধক আজমশাহের নির্দেশে সেই রত্নপেটিকা কবরে রাখতে হবে। সাধারণ কবরে রাখলে তা চুরি যাবার আশঙ্কা ছিল! কারণ এই আজব পেটিকা ও রত্নের কথা ততদিনে রটে গিয়েছিল।
তাই ভূগর্ভে গোপন কবর দেওয়া হল আজিমুদ্দিনকে। রত্নপেটিকাটিও তার কবরের মধ্যে রাখা হল।….
হেকিম লতিফ খাঁ চুপ করলে কর্নেল বললেন–তারপর?
আর কী?
সেই গুপ্ত কবরের সন্ধান। নিশ্চয় আপনি রাখেন?
মুহূর্তে হেকিমের মেজাজ বদলে গেল। বিকৃতমুখে বললেন—না। আপনাকে যে কাহিনি বললুম, তা আমার বাবার কাছে শোনা। কিন্তু এই গাঁজাখুরি গল্পে আমার একটুও বিশ্বাস নেই।
চৌকিদার ইতিমধ্যে চা এনে দিয়েছিল। হেকিম চায়ে শেষ চুমুক দিয়ে তেমনি বিকৃতমুখে হেসে ফের বলল—দয়া করে এ সম্পর্কে আমায় আর কোনও প্রশ্ন করবেন না সায়েব! যদি কোমরের বেমারির দাওয়াই চান, আমার সঙ্গে আসতে পারেন।
কর্নেল ঘড়ি দেখে বললেন—এক ভদ্রলোক দেখা করতে আসবেন। তাই এখন যাওয়ার অসুবিধা আছে। সন্ধ্যায় যাবখন।
আচ্ছা আদাব। বলে হেকিম লতিফ খা বেরিয়ে গেল।
কর্নেল অবাক হয়ে বসে রইলেন। মমি করার ব্যাপারটা হেকিম কিছুটা সত্যি বলে স্বীকার করল। কিন্তু বাকিটা গাঁজাখুরি বলে উড়িয়ে দিল কেন?
অথচ আজিমুদ্দিনের কবরে সত্যি একটা অদ্ভুত ধাতুতে তৈরি কালো পেটিকা পাওয়া গেছে। এবং সেটা কর্নেল স্বচক্ষে দেখেছেন। কর্নেল আগাগোড়া ব্যাপারটা ভাবতে থাকলেন। ঘণ্টা দুই পরে ফোন বাজল। কর্নেল ফোন তুলে বললেন—হ্যালো। কর্নেল বলছি।
কর্নেল, আমি অজিতেশ।
কী খবর ডার্লিং?
খবর সাংঘাতিক! একটু আগে তোপখানার কাছে পোড়ো একটা বাড়িতে একটা লাশ পাওয়া গেছে। টাটকা খুন। তাকে ছোরা মেরে পালিয়েছে কেউ। নিহত লোকটা…
কে, কে অজিতেশ?
শংকরবাবুর সেই বাজার সরকার। কারণ তার পকেটে তার নাম ঠিকানা লেখা একটা পোস্টকার্ড পাওয়া গেছে। ঠিকানায় কেয়ার অফ শংকরবাবুর নাম রয়েছে।
আমি যাচ্ছি! বলে কর্নেল ফোন রেখে দিলেন।