কর্নেলের গোয়েন্দাগিরি ছাড়াও এক বিচিত্র নেশা আছে। পাখি, প্রজাপতি বা পোকামাকড়ের জীবন সম্পর্কে তাঁর কৌতূহল অসামান্য। দুপুরে খাওয়ার পর রোদুরে লনে চেয়ার পেতে বসেছিলেন, হঠাৎ নদীর ধারে কোনও গাছ থেকে কী একটা পাখির ডাক শুনে নড়ে বসলেন।
তারপর ঘর থেকে তক্ষুনি বাইনোকুলারটা এনে চোখে রেখে পাখিটাকে খুঁজতে থাকলেন।
হ্যাঁ, ওই তো গাবগাছের ডালে ছোট্ট রঙিন পাখিটা মনের সুখে গান গাইছে।
কর্নেল একটু অবাক হলেন। এমন পাখি তো এর আগে কখনও দেখেননি। কেতাবে পড়েছিলেন বটে। এই দুর্লভ প্রজাতির পাখির একটা ছবি তুলে রাখা দরকার। দৌড়ে ঘরে গেলেন ফের ক্যামেরা আনতে।
কিন্তু সেই সময় ফোন বেজে উঠল ক্রিরিরিরিরিং! ক্রিরিরিরিরিং।
কী আপদ! বিরক্ত হয়ে ফোন তুলে বললেন-হ্যালো! কর্নেল নীলাদ্রি সরকার বলছি। এক্সচেঞ্জ অফিস থেকে সাড়া এল—ধরুন। কলকাতা থেকে ট্রাঙ্ককল আছে।
কর্নেল সঙ্গে সঙ্গে পাখির কথা ভুলে গেলেন। শংকর ছাড়া আর কে ফোন করবে কলকাতা থেকে? কোনও গণ্ডগোল হয়নি তো?
একটু পরে শংকরের কণ্ঠস্বর শোনা গেল—কর্নেল! কর্নেল! যা বলছিলেন, তাই হয়েছে! বাকসো উধাও!
কর্নেল চমকে উঠে বললেন—সে কী!
হ্যাঁ কর্নেল! এইমাত্র পোঁছে আবিষ্কার করলুম, দেয়ালের ছবিটা সরিয়ে কে গুপ্ত আলমারি থেকে বাকসোটা হাতিয়েছে। হারাধন কান্নাকাটি করছে। সে কিছু জানে না।
হুম্। বাড়ি থেকে তোমার কোনও লোক উধাও হয়নি তো?
হ্যাঁ হয়েছে। বাজার সরকার মদনবাবু থলে হাতে সকালে বাজার করতে গিয়েছিলেন, আর ফেরেননি। এখন বেলা প্রায় দুটো বাজে।
পুলিশকে জানিয়েছ নাকি?
না। এই তো সবে ঘরে ঢুকে সব দেখে তারপর আপনাকে ফোন করছি।
ঠিক আছে। তুমি লোকাল থানায় খবর দাও। তবে বাকসোর কথা বলো না। বললা যে টাকাকড়ি চুরি করে ভদ্রলোক কেটে পড়েছেন। একটা ফোটো আছে কি মদনবাবুর?
আছে। বাবার মৃত্যুর সময় গ্রুপ ফোটো তোলা হয়েছিল। তার মধ্যে…
ভালো। ফোটোটা পুলিশকে দাও।
কিন্তু ন্যাড়াকে তাহলে হয়তো আর বাঁচানো যাবে না কর্নেল!
ভেব না শংকর। বরং বাকসোটা যখন ওরা মদনবাবুর সাহায্যে হাতিয়েছে, তখন ন্যাড়াকে ধরে রাখার দরকার হবে না। দেখবে, ওকে ওরা ছেড়ে দেবে। এসব ক্ষেত্রে খুনখারাপি করলে ওদেরই বিপদের ঝুঁকি আছে। কাজেই নিশ্চিন্ত থাকো।
আপনি শিগগির চলে আসুন, কর্নেল! বাকসোটা…
বাকসো যদি কমলাক্ষ হাতিয়ে থাকেন, আমার কলকাতা ফেরার দরকার দেখি না। বরং তুমিই চলে এস লিটনগঞ্জে।
বাস্। আবার একশো কিলোমিটার মোটরজার্নি?
পারবে না?
এক মুহূর্ত পরে শংকর বললেন-ঠিক আছে। পারব।
পেটপুরে খেয়ে তবে বেরিও কিন্তু। তার আগে থানায় খবরটা দাও।
আচ্ছা। ছাড়ছি!
আচ্ছা।
কর্নেল ফোন রেখে কয়েক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে রইলেন। তারপর হঠাৎ মনে পড়ে গেল পাখিটার কথা। অমনি ক্যামেরা আর বাইনোকুলার নিয়ে দৌড়ে বেরুলেন।
চৌকিদার তার ঘরের বারান্দা থেকে বুড়ো কর্নেলকে ওইভাবে দৌড়তে দেখে হকচকিয়ে উঠেছিল।
কিন্তু কর্নেল নদীর ধারে গাবগাছের নিচে দাঁড়িয়ে ক্যামেরা তাক করছেন দেখে সে আপন মনে হাসতে লাগল। এই বুড়োসাহেব বড় খামখেয়ালি মানুষ!
ওদিকে শাটার টেপার আগেই পাখিটা ফুড়ুৎ করে উড়ে চোখের আড়ালে কোথায় উধাও। কর্নেল অপ্রস্তুত।
বাইনোকুলার চোখে রেখে তন্নতন্ন খুঁজেও আর দেখতে পেলেন না। দুঃখিত মনে দাঁড়িয়ে রইলেন। তারপর আনমনে একটা চুরুট ধরালেন।
তারপর গাছের তলায় বসে চুরুটটা টানতে থাকলেন। নিচে নদীর বুকে কোথাও সোনালি বালির চড়া পড়েছে। কোথাও স্বচ্ছ নীল জল তিরতির করে বয়ে যাচ্ছে। জায়গাটার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অতুলনীয়। কর্নেলের চোখ প্রকৃতির দিকে, কিন্তু কান পাখপাখালির ডাক শুনছে। তন্ময় হয়ে রয়েছে। মনে ক্ষীণ আশা, সেই ছোট্ট সুন্দর পাখিটা আবার যদি ডেকে ওঠে।