লিটনগঞ্জের ডাকবাংলোয় তখন কর্নেল, শংকর, অজিতেশ গম্ভীর মুখে আলোচনা করছিলেন। ন্যাড়াকে বাঁচাতে হলে আজই রাতে বি. টি. রোডের ধারে খ্রিস্টান কবরখানার কাছে কালো বাকসোটা রেখে আসতে হবে। একটু আগে শংকরের কাছে কলকাতা থেকে হারাধন ট্রাঙ্কক করেছে। শংকর তাকে জানিয়েছিলেন, কোনও নতুন ঘটনা ঘটলে যেন তক্ষুনি লিটনগঞ্জের ডাকবাংলোয় ফোন করে। হারাধন জানিয়েছে, কিছুক্ষণ আগে একটা উড়ো চিঠি কেউ গেটের লেটারবক্সে রেখে গেছে। চিঠিটা শ্ৰীমান ন্যাড়াই লিখেছে।
অজিতেশ পরামর্শ দিলেন, লালবাজার থেকে পুলিশ বাহিনী নিয়ে কবরখানাটা ঘিরে ফেলার ব্যবস্থা করতে হবে। উনি ফোন করে লালবাজার গোয়েন্দা বিভাগে সে কথা জানাবেন। তাছাড়া কর্নেলেরও প্রভাব আছে পুলিশ মহলে।
কিন্তু শংকরের তাতে ঘোর আপত্তি। কারণ ওরা অতি ধূর্ত। পুলিশ ওত পেতেছে টের পেলে ন্যাড়াকে খুন করে ফেলতে পারে।
কর্নেল গুম হয়ে বসে কী ভাবছিলেন। কতক্ষণ পরে বললেন—হুম্! এক কাজ করা যাক। শংকর, তুমি এখনই কলকাতা ফিরে যাও।
শংকর বললেন—আর আপনি?
আমি বরং বিকেলের ট্রেনে ফিরব। ততক্ষণে একটা কাজ সেরে নিতে চাই এখানে।
কিন্তু …
কর্নেল বাধা দিয়ে একটা হাত তুলে শংকরকে আশ্বস্ত করার ভঙ্গিতে বললেন—আশঙ্কার কারণ নেই। আমার এখনও ধারণা, ন্যাড়াবাবাজিকে ওরা প্রাণে মারবে না। কারণ তাহলে বাকসো পাবার কোনও আশাই থাকবে না। তাই বলছি, তুমি ফিরে গিয়ে তোমার শোবার ঘরে ওই রহস্যময় জিনিসটি পাহারা দাও। আমি ঠিক সময়ে ফিরব এবং তোমাকে দর্শন দেব।
শংকর একটু চমকে উঠে বললেন—তাহলে আপনি কি সন্দেহ করছেন, আমার বেডরুমে ওরা হানা দিতে পারে?
বিচিত্র নয়।
শংকর একটু হেসে বললেন—ওই গুপ্তস্থানের হদিশ আমি ছাড়া কেউ জানে না।
কর্নেল গম্ভীর মুখে বললেন—তবু সাবধানের মার নেই। ওরা ক্রমশ মরিয়া হয়ে উঠবে। তোমার লোকেদের হাত করার চেষ্টা করবে হয়তো।
কর্নেল! আমার লোকেরা খুবই বিশ্বাসী।
শংকর! টাকা এমন জিনিস অসম্ভবকে সম্ভব করে। তাছাড়া আজকাল মানুষের নৈতিক চরিত্র ঠুনকো হয়ে যাচ্ছে দিনে দিনে। লোভ মানুষের আত্মাকে গ্রাস করছে। তাই বলছি, তোমার এখনই বাড়ি ফেরা উচিত।
অজিতেশ সায় দিয়ে বললেন-কর্নেল ঠিকই বলেছেন শংকর। বরং তুমি চাইলে কলকাতায় লালবাজার গোয়েন্দা বিভাগকে তোমার বাড়ির দিকে নজর রাখতেও অনুরোধ করতে পারি।
শংকর কিছু বলার আগেই কর্নেল বললেন—ঠিক, ঠিক। অজিতেশ, তুমি এখনই সে ব্যবস্থা করো বরং। শংকর পৌঁছবার আগেই গোয়েন্দা পুলিশ ছদ্মবেশে শংকরের বাড়ি পাহারা দিক। তুমি ওদের বলে দাও, সন্দেহজনক কোনও জিনিস বাড়ি থেকে কেউ নিয়ে বেরুলেই যেন তাকে পাকড়াও করা হয়।
শংকর তক্ষুনি বেরিয়ে গেলেন। ন্যাড়াদের বাড়ি গিয়ে তাদের আশ্বাস দিয়ে কলকাতা রওনা হবেন। মোটর গাড়িতে পৌঁছোতে ঘণ্টা চারেক লাগবে বড়জোর।
একটু পরে অজিতেশও চলে গেলেন।
কর্নেল বারান্দায় এসে বসলেন একা। আজিমুদ্দিনের মমির কথা ভাবছিলেন তিনি। হতভাগ্য বালক! তার নির্বোধ জায়গিরদার পিতা ভদ্রলোক যদি না অত্যাশ্চর্য বহুমূল্য রত্ন তার কবরে রাখতেন, তার মৃতদেহের এই অসম্মান ঘটত না! না জানি কত স্নেহে লালিত হয়েছিল ওই বালক! জীবিত অবস্থায় তার গায়ে এতটুকু আঘাত করার ক্ষমতা কারও ছিল না। মৃত্যুর পর তার মাথাটাই কাটা গেল! মানুষের লোভ এত পৈশাচিক হতে পারে যে মৃতদেহেও আঘাতে তার হাত কাঁপে না।
কর্নেল মনশ্চক্ষে বালক আজিমুদ্দিনকে দেখছিলেন। মন মমতায় কোমল হয়ে উঠছিল। কে জানে, কোন দুরারোগ্য ব্যাধিতে ভুগে পাঁচশো বছর আগে ছেলেটি অকালে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছিল। বয়স কত হতে পারে তার? কর্নেল মমিটা দেখে অনুমান করেছেন, দশ থেকে বারো বছরের বেশি নয়। বাকশোর গায়ে সে কথা লেখাও আছে বটে।
হ্যাঁ, ঠিক এমনি এক বালকের মমিকরা মৃতদেহ নিয়ে গত শতাব্দীতে বিশ্বজুড়ে হইচই উঠেছিল। মিশরের কিশোর ফারাও তুতেনখামেনের মমি। আশ্চর্য, তুতেনখামেনের মমির অভিশাপের কথা ইতিহাসে লেখা আছে। যাঁরা তুতেনখামেনের কবর খুঁড়ে তার মমি আবিষ্কার করেছিলেন, তারা একে একে সবাই রহস্যময়ভাবে মারা পড়েন।
আজিমুদ্দিনের মমির কি তেমন কোনও অভিশাপ আছে?
জরুর!
কর্নেল চমকে উঠে তাকালেন। সবিস্ময়ে দেখলেন, কখন সেই কালো আলখেল্লা পরা ফকির এসে বাংলোর বারান্দায় তার সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে।
ফকির কি অলৌকিক শক্তিধর? জাদুকর সে? সে কি অদৃশ্য থেকে দৃশ্য হতে পারে?
আর কর্নেলের মনের কথাই বা জানতে পারল কী ভাবে? কর্নেল অবাক চোখে তাকিয়ে বললেন—আসুন ফকির সাহেব! আপনার সঙ্গে দেখা করব বলেই আমি এখনও এখানে রয়ে গেছি।
ফকির মৃদু হেসে বলল—বেটা তুমি শোচ করছিলে কী, আজিমুদ্দিনের লাশে কোন লানৎ (অভিশাপ) আছে কি না। তাই তো?
হ্যাঁ। কিন্তু আপনি কি মনের কথা বুঝতে পারেন ফকির সায়েব?
বেটা! মানুষের মনের কথা তার মুখে ফুটে ওঠে।
বসুন ফকির সায়েব। আপনার সঙ্গে আমার অনেক কথা আছে।
কথা আমারও আছে। তবে এখানে নয়, ঘরে চলো। গোপনে বলব।
দুজনে ঘরে গিয়ে ঢুকলেন।
ফকির কিছুক্ষণ চোখ বুজে কী যেন ভাবতে থাকল। কর্নেল তাঁর দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর ফকির চোখ খুলল। এদিক ওদিক তাকিয়ে চাপা গলায় বলল—আমি সংসারবিরাগী ফকির। ধনের লোভ আমার নেই, বেটা। যারা আজিমুদ্দিনের লাশের মাথা কেটেছে, তাদের শাস্তি খোদা দেবেন। বললুম না? আজিমুদ্দিনের আত্মার অভিশাপ লাগবেই তাদের। তাই তোমাদের বলি, যদি অভিশাপ থেকে বাঁচতে চাও, বাকসোটা ফেরত দাও। কবরের মধ্যে রেখে এস।
কর্নেল চমকে উঠে বললেন—বাকসোটা আমাদের কাছে আছে, কে বলল আপনাকে?
ফকির হাসল। আমি জানি। মিথ্যা বলে লাভ নেই বেটা।
কর্নেল কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর বললেন—ঠিক আছে। বাকসো ফের কবরে রাখা হবে। কিন্তু আজিমুদ্দিনের কাটা মাথার হদিশ জানতে চাই। আপনি আমার সাহায্য করুন তাহলে।
ফকির বলল—জরুর। বলো, কী সাহায্য চাও?
আপনি কোন কোন লোককে এ পর্যন্ত আজিমুদ্দিনের কবরের ওই বাকসো এবং তার চাবির কথা বলেছেন? আগে এসব কথা জানতে চাই।
ফকির অনুশোচনার ভঙ্গিতে মাথা দোলাল একটুখানি। তারপর উর্দুমেশানো বাংলায় যা বলল, তা হল এই :
কমলাক্ষবাবু কোনও ইংরেজি কেতাবে জায়গিরদার ও তার অকালমৃত ছেলের কাহিনি পড়েছিলেন। এই ফকির বংশানুক্রমে এলাকার ইতিহাস জানে। তাই কমলাক্ষ বারবার তার কাছে। এসে কবরের হদিশ জানতে চাইতেন। তিনি বলতেন—এলাকার পুরাকীর্তি এবং প্রত্নদ্রব্য সংরক্ষণ করাই তার ব্রত—যাতে ওগুলো ধ্বংস না হয়ে যায়। ফকিরের পা ছুঁয়ে তিনি প্রতিজ্ঞাও করেছিলেন, গুপ্ত কবরের খোঁজ দিলে সেখানে সরকারি সাহায্যে একটা দরগা বানিয়ে দেবেন এবং ফকিরকেই তার রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব দেবেন।
শেষপর্যন্ত ফকির তাঁর কথায় রাজি হয়ে গুপ্ত কবরের হদিশ দিয়েছিল। কিন্তু কমলাক্ষের মনে। যে এমন শয়তানি লোভ আছে, ভাবেনি।
একথা শোনার পর কর্নেল জিগ্যেস করলেন—কমলাক্ষবাবু ছাড়া আর কাকেও কি গুপ্ত কবরের কথা বলেননি ফকিরসায়েব? মনে করে দেখুন তো?
ফকির চোখ বুজে ভাবতে থাকল। তারপর সে নড়ে বসল। বলল—না, আর কাকেও বলিনি। তবে …
তবে? বলে কর্নেল আগ্রহের সঙ্গে তার দিকে তাকালেন!
ফকির বলল—আমার মনে হছে, আরেকজনের পক্ষে ব্যাপারটা জানা সম্ভব।
কে? কে সে?
সেই জায়গিদারের বংশধর বলে দাবি করে একটা লোক। তার নাম লতিফ খাঁ।
কোথায় থাকে সে?
লিটনগঞ্জেই। লোকটা হেকিমি চিকিৎসা করে। তোপখানার কাছে তার হেকিমি দাওয়াখানা আছে। লোকটা কিন্তু পাজির পাঝাড়া। যেমনি তিরিক্ষি মেজাজ, তেমনি কুচুটে। আমার সঙ্গে তার বনিবনা নেই।
কর্নেল বললেন—ঠিক আছে। আপনি ভাববেন না ফকির সাহেব। বাকসোটা আমরা কবরেই ফেরত দেব এবং ওখনে যাতে স্থায়ী রক্ষণাবেক্ষণের ব্যবস্থা হয়, কেন্দ্রীয় সরকারের পুরাতত্ত্ব দফতরকে সেজন্য অনুরোধ জানাব। তবে তার আগে আমি মমিমুণ্ডটা উদ্ধার করতে চাই।
ফকির হাত তুলে বলল-খোদার দয়ায় তুমি সফল হও বেটা।
তারপর সে দ্রুত উঠে দাঁড়াল এবং বেরিয়ে গেল। কর্নেল তাঁর পিছনে-পিছনে বেরুলেন। কিন্তু বেরিয়েই হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন।
ফকিরকে দেখতে পেলেন না। এ ফকির কি সত্যি অলৌকিক শক্তিধর কোনও সিদ্ধপুরুষ? কর্নেল ভারী একটা নিশ্বাস ফেলে ভাবলেন—মানুষ এই বিস্ময়কর বিশ্বের কতটুকুই বা জানতে পেরেছে? কত আশ্চর্য শক্তি বিজ্ঞানের আয়ত্তের বাইরে তো এখনও রয়ে গেছে!