কালো বাক্সের রহস্য-মুণ্ডহীন মমি

কালো বাক্সের রহস্য-মুণ্ডহীন মমি

কিছুক্ষণ পরে কফি খেয়ে চাঙ্গা হয়ে কর্নেল চুরুট ধরালেন। তখন শংকর বললেন—কী হয়েছিল, বলবেন কর্নেল?

কর্নেল বললেন—বিষাক্ত গ্যাসের ঝঝে মাথা ঘুরছিল।

শংকর অবাক হয়ে বললেন—বিষাক্ত গ্যাস। কোথায় ছিল?

তখন কর্নেল এক ফকিরের সঙ্গে আচমকা দেখা হওয়া এবং যা যা ঘটেছে, সব বললেন। শেষে বললেন—বলতে পারো, ফকিরের সঙ্গে আজিমুদ্দিনের কবরের সম্পর্ক আছে, জানলুম কী করে? ওটা নেহাত আন্দাজে ঢিল ছোঁড়ার মতো। কারণ কী জানো শংকর? আমি বরাবর দেখেছি, পিরের দরগার ফকিররা বংশানুক্রমেই ফকির এবং এলাকার প্রাচীন মুসলমান শাসকদের ইতিহাস তাদের মুখস্থ থাকে। তাই ওখানে জঙ্গলের মধ্যে পিরের দরগায় ওই ফকিরকে দেখে আমি আন্দাজে ঢিল ছোঁড়ার মতো আজিমুদ্দিনের কবরের কথা জিগ্যেস করলুম। ফলও পেলুম হাতে নাতে। তবে এই ফকিরবাবাজি দেখছি সাংঘাতিক লোক। ওর কাছে একরকম পাউডার আছে। তা আগুনে ছুঁড়লে মারাত্মক গ্যাস সৃষ্টি হয়। প্রাচীন হেকিমি শাস্ত্রে এই অদ্ভুত জিনিসটার কথা পড়েছিলুম! এবার স্বচক্ষে দেখলুম।

শংকর বললেন—একটা কথা বুঝতে পারছি না। আজিমুদ্দিনের মৃতদেহ যে মমি করা, তা জানলেন কী ভাবে?

অতি সাধারণ বুদ্ধিতে। কর্নেল একটু হাসলেন। দ্যাখো শংকর, মানুষের মৃত্যুর পর কয়েকদিনের মধ্যে চুল খসে যায়। কাজেই চুলের মধ্যে চাবি লুকিয়ে রাখার প্রশ্ন ওঠে তখন, যখন কি না চুল খসে পড়ার উপায় থাকে না। অর্থাৎ চুলসুদ্ধ মৃতদেহ মমি করা হলে, তবেই চুলের মধ্যে চিরকালের জন্যে চাবি লুকিয়ে রাখা যায়।

শংকর বিস্মিতভাবে বললেন—কিন্তু মমি করার প্রথা তো সেই মিশরের লোকেরা তিন-চার হাজার বছর আগে জানত! ১৫৮০ খ্রিস্টাব্দে এদেশে মমি করার কথা তো শুনিনি!

কর্নেল বললেন-না শংকর। ওই প্রচলিত ধারণা একেবারে ভুল। আমাদের দেশে হিন্দুরা মৃতদেহ পুড়িয়ে ফেলে। কিন্তু মুসলমান ও খ্রিস্টানরা কবরে রাখে। প্রাচীন আমল থেকেই অনেক অভিজাতবংশীয় মুসলমান কিংবা রাজাবাদশাদের মৃতদেহ কবরে দেওয়ার আগে একরকম মশলা মাখানো হত। এক শ্রেণির লোক এই বিদ্যা জানত। তবে মিশরের মমির মতো এসব মমি হাজার হাজার বছর টিকত না। সচরাচর দুই থেকে পাঁচশো বছর অন্তত অক্ষত থাকত। কাজেই আজিমুদ্দিনের মৃতদেহ যে মমি করা হয়েছিল, তা স্বাভাবিক।

শংকর বললেন—পুলিশ সুপার অজিতেশের সাহায্যে আমরা প্রকাশ্যে ওই কবর খুঁড়ে দেখতে পারি, ফকিরের কথা সত্যি কি না। কর্নেল, কালই ব্যাপারটা দেখা যাক।

কর্নেল জোরে মাথা দুলিয়ে বললেন—না শংকর। কবর প্রকাশ্যে খুঁড়তে গেলে এলাকার মুসলমানরা তাতে প্রবল আপত্তি করবেন। স্বধর্মীয়ের মৃতদেহ তারা অন্যধর্মের লোকেদের হাত ছোঁয়াতে দেবেন না। কাজেই ব্যাপারটা আজ রাতেই গোপনে সেরে ফেলতে হবে।

বাংলোয় ফোন রয়েছে। কর্নেল পুলিশ সুপারকে ফোনে কথাটা জানালেন। তারপর ফোন রেখে শংকরকে বললেন—অজিতেশ ঘণ্টাখানেক পরেই এসে পড়বে। তা শংকর, শ্রীমান ন্যাড়ার বাবা-মা নিশ্চয় ভীষণ দুশ্চিন্তায় রয়েছেন।

শংকর বললেন-তা আর বলতে!

তুমি কি ওদের সব কথা বলেছ?

না। তাহলে তো দিদি-জামাইবাবুকে সামলানো কঠিন হবে। কেউ ন্যাড়াকে আটকে রেখেছে কিংবা আমি সেই উড়ো চিঠি পেয়েছি—এসব কোনও কথা ঘুণাক্ষরে ওঁদের বলিনি। বলেছি—নিশ্চয় কলকাতা বেড়াতে গেছে একা। ও যা খেয়ালি ছেলে। একবার কিন্তু একা কলকাতা পালিয়েছিল, জানেন?

তাই বুঝি?

হ্যাঁ তবে বড় বুদ্ধিমান ছেলে। খুঁজে খুঁজে আমাদের বাড়িতে হাজির হয়েছিল। অথচ কবে সেই দু বছরের বাচ্চা যখন, তখন মায়ের কোলে চেপে এসেছিল।

কর্নেলের কান ছিল শংকরের কথায়, কিন্তু দৃষ্টি ছিল সামনে ফুলবাগিচার দিকে। হঠাৎ তিনি এক ধাক্কায় শংকরকে চেয়ার থেকে ফেলে দিলেন এবং নিজেও শুয়ে পড়লেন। পরক্ষণে প্রচণ্ড শব্দ শোনা গেল গুলি ছোঁড়ার। ঘরের দেয়ালে প্রাকৃতিক দৃশ্যের ছবির কাচ ঝনঝন শব্দে ভেঙে পড়ল। বারুদের কটু গন্ধ ছড়িয়ে পড়ল। বাইরে চৌকিদার চিৎকার করে উঠল—ডাকাত পড়েছে! ডাকাত পড়েছে!

এক লাফে কর্নেল উঠে দাঁড়ালেন এবং জানালার পাশে নিজেকে আড়াল করে টর্চ জ্বাললেন। তার অন্য হাতে গুলিভরা রিভলভার দেখা গেল।

কিন্তু তখনই ফের স্তব্ধতা ঘনিয়ে এসেছে। ফুলবাগিচার ওদিকে কেউ নেই। চৌকিদার বোধ করি চেঁচিয়ে ওঠার পরই আতঙ্কে চুপ করে গেছে।

শংকর মেঝে থেকে উঠে বললেন—আমি কৃতজ্ঞ, কর্নেল। আপনি আমাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলে গুলিটা আমার মাথায় লাগত। পেছনের ছবিটা চূর্ণ হওয়া দেখেই তা টের পাচ্ছি। কিন্তু ওদের এত সাহস হল কীভাবে?

কর্নেল একটু হেসে বললেন—দুবৃত্তদের পক্ষে এমনটা স্বাভাবিক শংকর। কিন্তু আমি একটা কথা ভেবে অবাক হচ্ছি। আততায়ীর গুলির লক্ষ্য ছিলে তুমি। অথচ ন্যাড়াকে যারা চুরি করেছে, তারা তোমাকে খুন করতে চাইবে কেন? তোমাকে মেরে ফেললে তো বাকসোটা পাবার আশাই আর থাকবে না। কাজেই মনে হচ্ছে, এই বাকসো-রহস্যের পেছনে আরও একটা দল রয়েছে।

শংকর অবাক হয়ে বললেন-তারা আবার কারা।

শিগগির সেটা খুঁজে বের করব। এখন বরং ওই খোলা জানলাটা বন্ধ করে দিই। এই শীতে ওটা খুলে রেখেছিলুম, বাইরের দিকটায় লক্ষ রাখার জন্য। এখন বুঝতে পারছি, কাজটা ঠিক করিনি। তাছাড়া এখন থেকে আমাদের পদে পদে আরও সতর্ক থাকতে হবে।

বলে জানলাটা বন্ধ করে দিয়ে কর্নেল আরাম কেদারায় বসলেন। শংকর বারবার ভয়ে ভয়ে খোলা দরজার পর্দার দিকে তাকাচ্ছিলেন। তা দেখে কর্নেল একটু হেসে বললেন—না শংকর। আততায়ী যেই হোক, দরজা দিয়ে হামলা করার সাহস তার নেই। থাকলে সে দূর থেকে গুলি না ছুঁড়ে সোজা দরজা দিয়ে ঘরে ঢুকেই হামলা করত।

কিছুক্ষণ পরে পুলিশ সুপার অজিতেশ তার দলবল নিয়ে এসে পড়লেন। সব শুনে। বললেন—আমারই ভুল হয়েছে। বাংলোটা পাহারার ব্যবস্থা করা জরুরি ছিল। যাই হোক, সে-ব্যবস্থা করছি। এখন চলুন, বেরিয়ে পড়া যাক।

রাতের অন্ধকারে সবাই মিলে চুপিচুপি বেরিয়ে পড়লেন। সঙ্গে সশস্ত্র পুলিশদল সতর্কভাবে চলল।

রেললাইন পেরিয়ে সেই পোড়ো মাঠে কিছুটা এগিয়ে ওঁরা জঙ্গলে ঢুকলেন। তখনও কেউ টর্চ জ্বালেননি। কৃষ্ণপক্ষের রাত। তাতে প্রচণ্ড শীত। কুয়াশার মধ্যে আকাশের নক্ষত্র মিটমিট করে জ্বলছে। স্টেশনের দিকটা ঘন কুয়াশায় ঢাকা। বাতিগুলো আবছা জ্বলছে।

বটতলার কাছে গিয়ে কর্নেল থমকে দাঁড়ালেন। দেখাদেখি সবাই দাঁড়িয়ে গেলেন। কর্নেল ফিসফিস করে বললেন—কী একটা শব্দ হচ্ছে যেন।

শংকর ও অজিতেশ কান পেতে শুনে বললেন—হ্যাঁ।

কর্নেল কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে তেমনি চাপা গলায় বললেন—একসঙ্গে সবগুলো টর্চ জ্বালতে হবে। রেডি। ওয়ান-টু-থ্রি।

একসঙ্গে প্রায় একডজন টর্চের আলো জ্বলে উঠল। সামনে দেখা গেল তিনটি মূর্তি দাঁড়িয়ে আছে। আলো জ্বালার সঙ্গে সঙ্গে একমুহূর্ত হতচকিত হয়ে গিয়েছিল তারা। তারপর দৌড়ে অন্ধকার জঙ্গলের দিকে পালিয়ে গেল।

গুপ্ত কবরের পাথরের ঢাকনা সরানো হয়েছে। এবার গর্তের ভিতর থেকে এক লাফে একটা লোক প্রায় ডিগবাজি খেয়ে অন্ধকার জঙ্গলে গিয়ে ঢুকল।

অজিতেশের নির্দেশে সেপাইরা সেই মুহূর্তেই তাদের পিছনে ধাওয়া করেছে।

ওদিকে জঙ্গলে বারবার টর্চের ঝলক, বন্দুকের আওয়াজ কয়েকবার, তারপর পাকড়ো পাকড়ো চেঁচামেচি শোনা গেল।

কর্নেলরা কবরের কাছে দৌড়ে এলেন। এসে টর্চের আলোয় দেখলেন, গর্তের মধ্যে মৃতদেহের কফিনটা টেনে এনে রেখেছে। কফিনের ঢাকনা খোলা! তার ভেতরে একটা পোশাকপরা মৃতদেহ রয়েছে। বালকেরই মৃতদেহ। কিন্তু তার মুণ্ড নেই। কবন্ধ মৃতদেহটা মমি করা।

কর্নেল, শংকর আর অজিতেশ তিনজনেই কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থাকার পর একসঙ্গে বলে উঠলেন, তাই তো।

তারপর কর্নেল গর্তে নামলেন। বহুক্ষণ ধরে মমিটা পরীক্ষা করতে থাকলেন। তারপর বললেন—ফকির ঠিকই বলেছিল দেখছি। কে বা কারা মুণ্ডু কেটে নিয়ে গেছে, কিন্তু একথা ঠিক যে মুণ্ডুটা কাটা হয়েছে গত কয়েকদিনের মধ্যেই।

অজিতেশ বললেন—কীভাবে বুঝলেন?

কর্নেল হাসলেন। বললেন-খুব সোজা যুক্তি। শংকরবাবু বাকসোটা নিয়ে যাবার আগে মুণ্ডু কাটা হয়নি। তাহলে যে মুণ্ডু কেটেছে, সে কি বাকসোটা ফেলে রেখে যেত? কাজেই শংকরবাবু বাকসো নিয়ে যাবার পরই কাজটা করা হয়েছে।

অজিতেশ ও শংকর সায় দিয়ে বললেন—ঠিক, ঠিক।

কর্নেল বললেন-মুণ্ডু যে কেটেছে সে জানে বাকসো যেই হাতাক্, চাবি এই মুণ্ডের চুলের মধ্যে আছে। কাজেই তার উদ্দেশ্য হল, কাটা মুণ্ডুর চুল খুঁজে চাবি বের করা এবং বাকসোটা উদ্ধার করা।

শংকর বললেন—তাহলে একাজ কমলাক্ষেরই।

কর্নেল আনমনে বললেন—বলা কঠিন। দেখা যাক। তবে এস, মৃতদেহটা আমরা যথাস্থানে রেখে আগের মতো সমাধিস্থ করি। আর অজিতেশ, তুমি তোমার কথামতো আপাতত কিছুদিন এখানে পুলিশ পাহারার ব্যবস্থা করো।

অজিতেশ বললেন—তা আর বলতে। তবে আমারই ভুল। ভেবেছিলুম, কাল সকাল থেকে পাহারার ব্যবস্থা করব। বুঝতে পারিনি, আজ রাতেই কেউ কবরে হামলা করবে।

গুপ্ত কবর আগের মতো ঢেকে দেওয়ার একটু পরে সেপাইরা ফিরে এসে জানাল—ওদের পাকড়াও করা যায়নি। হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে যেন।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত