কালো বাক্সের রহস্য- ফকিরের বুজরুকি

কালো বাক্সের রহস্য- ফকিরের বুজরুকি

লিটনগঞ্জে পৌঁছে কর্নেল কিন্তু শংকরবাবুর সঙ্গে ন্যাড়াদের বাড়ি গেলেন না। বললেন—এখানকার পুলিশ সুপার অজিতেশ আমার পরিচিত। আমি ওঁর সাহায্যে সরকারি ডাকবাংলোতেই থাকার জায়গা করে নেব। আপনি ভাববেন না শংকরবাবু।

সরকারি আপিস এলাকায় পুলিশ সুপারের বাংলো। শংকরবাবুর গাড়ি তার গেটে দাঁড়াল। কর্নেল গেট খুলে ভেতরে গেলেন।

একটু পরে শংকরবাবু দেখলেন, পুলিশ সুপার আর কর্নেল কথা বলতে বলতে আসছেন গেটের দিকে।

কর্নেল পরিচয় করিয়ে দিতে যাচ্ছিলেন। তার আগেই পুলিশ সুপার অজিতেশ বলে উঠলেন—আরে তুমি শংকর না?

শংকরবাবুও লাফিয়ে উঠলেন—অজু! তুমি! কী আশ্চর্য! তুমি যে আমার জামাইবাবুর এলাকায় পুলিশের বড়কর্তা সেজে বসে আছ, স্বপ্নেও ভাবিনি! তুমি সেই বালুরঘাটে না কোথায় ছিলে না। এখানে বদলি হলে কবে?

অজিতেশ বললেন—সবে দু সপ্তাহ। যা গে চলে এস। এ বেলা আর জামাইবাবুর বাড়ি গিয়ে কাজ নেই। কী বলেন কর্নেল?

কর্নেল এতক্ষণ হাঁ করে চেয়েছিলেন। এবার বললেন—ডার্লিং অজিতেশ! শংকরবাবু—থুড়ি, শ্রীমান শংকর নিশ্চয় তোমার সহপাঠী ছিল ছাত্রজীবনে?

অজিতেশ বললেন—হা কর্নেল। আমরা দুজনে প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়তুম।

যা গে। তাহলে শংকরকে তুমি বললে, দোষ হবে না। কর্নেল সকৌতুকে বললেন। তারপর অভ্যাসবশে দাড়িতে ও টাকে একবার করে হাত বুলিয়ে নিলেন।

গাড়ি বাংলার গেটের পাশে রেখে তিনজনে সুরকি-বিছানো লন পেরিয়ে বাংলোর বারান্দায় উঠলেন। সেখানে বসে কর্নেল ও শংকর মোটামুটি ঘটনাটা পুলিশ সুপার অজিতেশের কাছে বর্ণনা করলেন।

সবটা শুনে অজিতেশ বললেন—আমার ধারণা, শংকরের ভাগনেকে চুরি করে ওরা কলকাতাতেই কোথাও রেখেছে। কাজেই ওকে উদ্ধার করার ব্যাপারে সেখানকার পুলিশ দফতরেই যোগাযোগ করা দরকার। আর কর্নেল সাহেব তো এ ব্যাপারে সিদ্ধহস্ত। লালবাজারের পুলিশকর্তাদের সঙ্গে ওঁর প্রচণ্ড খাতির। তাছাড়া ওঁর নিজের ক্ষমতা ও বুদ্ধিও সামান্য নয়। তবে স্টেশনের ওপারে পোডড়া মাঠের জঙ্গলে মাটির তলায় যে কবরের কথা শুনলাম, তা পাহারার দায়িত্ব আমার রইল।

একদল সাদা পোশাকের সশস্ত্র পুলিশ ওখানে আনাচে-কানাচে চব্বিশঘণ্টা ওত পেতে থাকবে। কাকেও বটতলায় গিয়ে কিছু করতে দেখলেই পাকড়াও করবে।

কর্নেল হাসতে হাসতে বললেন—কিন্তু আমি আর শংকর যে ওখানে গিয়ে হানা দিতে চাই। আমাদের ওপর তোমার লোকেরা, হামলা করলেই তো মুশকিল।

অজিতেশ বললেন—সে ব্যবস্থা করে রাখব। কর্নেল, আপনার চেহারা তো একেবারে সাহেবের মতো। আর শংকর আপনার সঙ্গে থাকবে। আমার লোকেদের সেটা বলে রাখব। কর্নেলকে চিনতে তাদের ভুল হবে না। তার উপর মাথায় টাক, মুখে দাড়ি।

আবার তিনজনে হেসে উঠলেন। ততক্ষণে ট্রে ভর্তি খাবার ও কফি এল। দুপুরে খাওয়া পথেই সেরে নিয়েছিলেন। কথা বলতে-বলতে বিকেল হয়েছে। শীতও বেড়েছে। কফি খেয়ে চাঙ্গা হবার পর শংকর বিদায় নিলেন। উনি জামাইবাবুর বাড়ি থাকবেন। ইতিমধ্যে ফোন করে অজিতেশ কর্নেলের জন্য নদীর ধারে সুদৃশ্য বাংলোর ব্যবস্থা করে ফেললেন।

কিছুক্ষণ পরে অজিতেশ তার জিপে করে কর্নেলকে সেই বাংলোয় পৌঁছে দিয়ে এলেন।

বাংলোয় দুটো ঘর। পাশের ঘরে এক সরকারি অফিসার এসেছেন। কর্নেলের ঘরটা দক্ষিণ-পূর্ব কোণে। নিচে নদী। নদীর ওপারে ঘন বাঁশবনে ঢাকা একটা গ্রাম। রেললাইনটা বাংলোর পূর্বে। পুবের বারান্দায় দাঁড়ালে স্টেশনের ওধারে সেই পোডড়া মাঠের শেষে জঙ্গল ও বটগাছটা দেখা যায়।

শীতের দিন শিগগির ফুরিয়ে এল। কর্নেল বাইনোকুলারে চোখ রেখে সেই দূরের বটগাছটা দেখছিলেন। কুয়াশা ও আঁধারে সেটা ঢাকা পড়লে বাইনোকুলার রেখে এলেন ঘরে। শংকরের এখনই এসে পড়ার কথা।

আনমনে লনে পায়চারি করতে করতে গেটের কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন কর্নেল। মাথায় টুপি, পরনে ওভারকোট এবং হাতে ছড়ি নিয়েছেন। লিটনগঞ্জে শীতটা বড্ড বেশি পড়েছে এবার।

শংকর আসতে দেরি করছেন কেন? কর্নেল উদবিগ্ন হয়ে ঘড়ি দেখলেন। সওয়া ছটা বেজে গেল। ছটায় আসার কথা।

গেট খুলে রাস্তায় গিয়ে দাঁড়ালেন। সেই সময় একটু তফাতে কে চিৎকার উঠল—ইয়া পির মুশকিল আসান। যাঁহা মুশকিল তাহা আসান। তারপরই এক ঝলক আলো জ্বলে উঠল।

কর্নেল চমকে উঠেছিলেন। পকেটে টর্চ আছে। কিন্তু জ্বাললেন না। দ্রুত আলো লক্ষ করে এগিয়ে গেলেন। কিন্তু আলোটা রাস্তার ধারে জ্বলছে না। রাস্তার পাশে ঘন ঝোপঝাড়। তার ভেতর দেখা যাচ্ছে। তখন পায়ের কাছে টর্চের আলো ফেলে সাবধানে এগিয়ে গেলেন।

যেখানে আলোটা জ্বলছে, সেখানটা একটা পিরের মাজার বলেই মনে হল। উঁচু চৌকানো পাথরে বাঁধানো বেদির মতো একটা চত্বর রয়েছে। তার পাশে একটা প্রকাণ্ড কাঠমল্লিকা গাছ। গাছের তলায় আগুনের কুণ্ড জ্বেলে বসে আছে এক ফকির।

ফকিরের পরনে কালো আলখেল্লা। গলায় অজস্র পাথরের মালা। মাথায় কালো পাগড়ি। তার কোলে একটা প্রকাণ্ড লোহার চিমটে রয়েছে। ফকির চোখ বুজে বসে বিড়বিড় করে কী মন্তর আওড়াচ্ছে আর আগুনে ধুনো ছড়াচ্ছে। তখন আগুনটা হু হু করে জ্বলে উঠছে।

কর্নেল গিয়ে সামনে দাঁড়ালে ফকির চোখ খুলল। তারপর নিষ্পলক চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। তখন কর্নেল বললেন—সেলাম ফকিরসায়েব।

ফকির এবার মৃদু হেসে সামনে বসতে ইশারা করল।

কর্নেল বললেন—ফকিরসায়েব কি এই পিরের মাজারের (সমাধির) সেবক?

ফকির জবাব দিল, হ্যাঁ বেটা। লেকিন তুম কঁহাসে আয়া? চেহারা দেখে মালুম হচ্ছে কি, তুমলোক আংরেজ সাহাব আছ। লেকিন বাংলায় বাত ভি বলছ। তাজ্জব!

আমি ইংরেজ পুরো নই, ফকিরসাহেব। অর্থেক ইংরেজ, অর্ধেক বাঙালি।

তাজ্জব! ক্যায়সে?

আমার বাবা বাঙালি ছিলেন। মা ইংরেজ ছিলেন।

ফকির হেসে উঠল। তব্‌ বেটা, তুম অ্যাংলো-ইন্ডিয়েন আছে, তো ঠিক হ্যায়! বোলো, ক্যা মাংতা মেরা পাস? হামার কাছে কী চাও?

কর্নেল পকেট থেকে একটা দশ টাকার নোট বের করে ফকিরের পায়ের কাছে রাখলেন। ফকির অমনি খপ করে সেটা তুলে নিয়ে আলখাল্লার ভেতর ঢুকিয়ে ফেলল। তার চোখে লোভের আনন্দ চকচক করছিল। ফিসফিস করে বলল—বোলো বেটা, ক্যা মাংতা তুম?

কর্নেল একটু ভেবে নিয়ে বললেন-ফকিরসায়েব, আপনি তো সিদ্ধপুরুষ। বলুন তো জায়গিরদার মুইনুদ্দিন শাহ-আল-তামাসের ছেলে আজিমুদ্দিনের কবর কোথায় আছে।

অমনি ফকির নড়ে উঠল। তার চোখে আগুন ঠিকরে বেরুতে থাকল যেন। সেই দশ টাকার নোটটা বের করে বলল—ইয়ে লো তুমহারা রূপেয়া! নিকাল যাও হিয়াসে! আভি নিকাল যাও!

কর্নেল ব্যস্তভাবে বললেন, সে কী ফকিরসায়েব! চটে যাচ্ছেন কেন?

ফকির ক্রুদ্ধস্বরে বলল—দেখো, ইয়ে টাউনকা কমলাবাবুনে বহত দফে হামার কাছে এসেছে ঔর এহি বাত পুছেছে। হামি বোলে নাই। কিসিকো হাম ইয়ে ছুপা বাত (গুপ্ত) বলবে না। কমলাবাবু হামাকে খুন করতে ভি এসেছিল। তো আমি এইসা জাদুকা খেল জানে, কমলা জান লিয়ে ভেগে গিয়েছিল। বলে ফকির হিংস্র মুখে ক্রুর হাসি হাসল।

কর্নেল বললেন, কিন্তু কমলাক্ষবাবু তো আজিমুদ্দিনের কবরের খোঁজ পেয়ে গেছে। তা জানেন?

ফকির চমকে উঠে বলল—সাচ্ বাত?

হাঁ ফকিরসায়েব। এমনকী সে আজিমুদ্দিনের কবরের সেই কালো বাকসোটাও হাতিয়ে নিয়েছে।

ফকির ফের ক্রুর হেসে বলল-ফয়েদা হবে না। ও বাক্সের চাবি কঁহা সে মিলেগা?

কেন? আজিমুদ্দিনের মমিকরা লাশে—মানে তার চুলের মধ্যে লুকোনো আছে।

ফকির জোরে মাথা নেড়ে বলল—কবর ছুঁড়ে আমি দেখেছে। আজিমুদ্দিনের লাশের মাথা নেই। কৌন ডাকু কাট লিয়া।

কর্নেল চমকে উঠলেন। বলেন কী ফকিরসায়েব!

ফকির এবার শান্তভাবে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল—আজিমুদ্দিনকা শির যিকা পাস হ্যায়, চাবিভি উসকা পাস হ্যায়।

বলে ফকির ফের চোখ বুজল। তার ঠোঁট কাঁপতে থাকল। তারপর সে আলখেল্লার ভেতর থেকে একমুঠো ধুনো বের করে আগুনে ছড়ালে। আগুনটা দপকে উঠল। তখন ফকির হঠাৎ গর্জে বলে উঠল—চলা যাও হিয়াসে! আভি নিকাল যাও!

কর্নেল সবে উঠে দাঁড়িয়েছেন, ফকির ফের আরেক মুঠো ধুনোর মতো কী জিনিস আগুনে ফেলল। কিন্তু এবার এক বিস্ময়কর ঘটনা ঘটে গেল।

আগুনের কুণ্ড থেকে মুহূর্তে হু হু করে সাদা ঘন একরাশ ধোঁয়া উঠতে শুরু করল। তার উৎকট গন্ধে কর্নেল তক্ষুনি পিছিয়ে এলেন। ওদিকে সেই ধোঁয়া বেশ কিছুক্ষণ হু-হু করে আকাশে ওঠার পর আস্তে আস্তে মিলিয়ে গেল। আগুনটাও নিভে গেছে ইতিমধ্যে। কর্নেল টর্চ জ্বেলে দেখলেন, ফকির অদৃশ্য।

এখানে ওখানে টর্চ জ্বেলে সমাধি এলাকা তন্নতন্ন করে খুঁজে আর ফকিরকে দেখতে পেলেন

কর্নেল। তখন বিস্মিত মনে ফিরে এলেন রাস্তায়।

বাংলোয় ফিরে দেখলেন, গেটে শংকরবাবুর গাড়ি রয়েছে। শংকর তার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। কর্নেলকে দেখে শংকর একটু অবাক হয়ে বললেন- আপনাকে অমন দেখাচ্ছে। কেন? কী হয়েছে কর্নেল?

কর্নেল বললেন—বলছি। আগে চৌকিদারকে কফি করতে বলো, শংকর। বলে ঘরের দরজা খুলে আরামকেদারায় এলিয়ে পড়লেন। তাকে খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছিল।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত