কালো বাক্সের রহস্য-কমলাক্ষের শয়তানি

কালো বাক্সের রহস্য-কমলাক্ষের শয়তানি

ন্যাড়া মোটামুটি বুদ্ধিমান ছেলে। কিন্তু সে ভারি সরল। সেটাই তার বিপদ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। পরদিন সকালে ছোটমামু শংকরবাবু বাকসোটা নিয়ে কলকাতা চলে গিয়েছিলেন। ন্যাড়া স্টেশনে তাঁকে পৌঁছে দিয়ে ফিরে আসছে, পথে কমলাক্ষবাবুর সঙ্গে দেখা। উনি হন হন করে আসছিলেন। পাড়াসম্পর্কে কাকা বলে ন্যাড়া। তাই বলেছিল—ও কাকু। ট্রেন যে এইমাত্তর ছেড়ে গেল!

কমলাক্ষ থমকে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন-যাঃ! তাহলে আর কী হবে? ওবেলা যাবখন। আয় বাবা নেড়ু তোর সঙ্গে গল্প করতে করতে যাই।

সেই সময় হঠাৎ ন্যাড়ার মনে চমক খেলেছিল। সেদিন সন্ধ্যায় যে দুটো লোক মাটির তলার ওই কবর খুঁড়তে গিয়েছিল তাদের একজনের গলার স্বর অবিকল কমলাক্ষের মতো না? ন্যাড়া বলেছিল—হা কাকু, তোমার জাদুঘরে যেসব জিনিস রেখেছ, সেসব কোথায় পেয়েছ গো?

কমলাক্ষ বলেছিলেন—ওসব খুঁজে বের করতে হয় রে। অনেক মেহনতের কাজ। ধরু, অনেক সময় মাটির তলাতেও পাওয়া যায়।

ন্যাড়া বলে উঠেছিল—ও কাকু, তাহলে সেদিন সন্ধেবেলা স্টেশনের ওপারে বটতলায়…

অমনি কমলাক্ষ তার মুখে হাত চাপা দিয়ে বলেছিলেন—চুপ, চুপ। কাকেও বলিস নে। তা হা রে, তুই কীভাবে জানলি?

ন্যাড়া ফিক করে হেসে বলেছিল—বা রে! তখন আমি গাছের ডালে আটকানো ঘুড়ি পাড়ছিলুম না? তোমাদের কাছে বন্দুক ছিল। তাছাড়া চিনতেও পারিনি। তাই সাড়া দিইনি!

সর্বনাশ! কমলাক্ষ বলেছিলেন। তা এখন চিনলি কী করে?

তোমার গলার স্বরে।

তুই ভারি বুদ্ধিমান ছেলে, নেড়ু। তা হা রে, কাকেও বলেছিলি নাকি কথাটা?

হুঁউ। ছোটমামাকে।

তারপর, তারপর?

সরলমনা খামখেয়ালি ছেলে ন্যাড়া ছোটমামার নিষেধ ভুলে সব কথা বলে ফেলল। কিন্তু ধূর্ত কমলাক্ষের এটা নিতান্ত ছল। আগের দিন সন্ধেবেলা জঙ্গলে বাকসো নিয়ে পালানোর সময় আবছা একপলক তিনি দেখেছিলেন, দুটো লোক জঙ্গলের ভেতর অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে এবং তাদের একজন বয়সে বাচ্চা। কিন্তু সে যে ন্যাড়া হতে পারে, ভাবেননি তখন। পরে, ওই মাঠে যেসব ছেলে খেলা করতে যায়, তাদের প্রত্যেকের কাছে খোঁজ নিয়েছিলেন, একটা বয়স্ক লোক আর একটা কমবয়সি ছেলেকে কাল সন্ধ্যার আগে ওখানে কেউ দেখেছিল নাকি। হরিহর উকিলের ছেলে সতু বলেছিল, ন্যাড়া হতে পারে। ন্যাড়ার ঘুড়ি প্রায় আটকে যায় বটগাছটায়। আর হা, কাল তার সঙ্গে কে একজন অচেনা লোকও ছিল।

কমলাক্ষের সঙ্গীর নাম মাধব। লিটনগঞ্জে লোকে তাকে বলে মেধোগুন্ডা। কমলাক্ষ তার সংগ্রহশালা বা জাদুঘরের অছিলায় প্রাচীনকালের ঐতিহাসিক বা পুরাতাত্ত্বিক মূর্তি সংগ্রহ করেন এবং মাধবের সাহায্যে তা বিদেশে বিক্রি করেন। আজকাল ওসব পুরনো মূর্তি বা জিনিসের চোরাচালানি কারবার চলছে দেশ বিদেশে। কাজটা বেআইনি। হংকং শহরে এক ব্যবসায়ী এই কারবার করে। তার এজেন্ট আছে কলকাতায়। মাধবের সঙ্গে সেই এজেন্টের যোগাযোগ আছে। এভাবে কমলাক্ষ কত প্রত্নদ্রব্য যে মাধবের সাহায্যে পাচার করেছেন, ইয়ত্তা নেই। কমলাক্ষ ও মাধব সেই টাকা আধাআধি ভাগ করে নেন। পুলিশ টের পায় না। কারণ ওই সংগ্রহশালা! সারা দেশের পণ্ডিতরা কমলাক্ষের ব্যক্তিগত চেষ্টায় গড়ে তোলা জাদুঘরের কত প্রশংসা করেন। মন্ত্রীরাও কতবার দেখে যান। কিন্তু তার জাদুঘরে নেহাত মামুলি কিছু পুরোনো দলিলপত্তর, কিছু পোড়ামাটির মূর্তি বা মুদ্রা ছাড়া তত দামি কিছু নেই। যা দামি, তা তো পাচার হয়ে যায়। আসলে কমলাক্ষের চোরাচালানি কারবারের একটা অজুহাত হল ওই জাদুঘর।

যাই হোক, কমলাক্ষ ও মাধব আগের দিন সন্ধ্যায় মাটির তলার কবরে কালো বাকসোটা আর দেখতে পাননি। এখন ন্যাড়ার মুখে সব জেনে তিনি তো মনে মনে রেগে আগুন। কিন্তু সেটা প্রকাশ করলেন না।

ন্যাড়া বলেছিল—হ্যাঁ কাকু, কালো বাকসোটা তোমরা ওখানে লুকিয়ে রেখেছিলে কেন গো?

কমলাক্ষ চেপে গেলেন। আসলে ব্যাপারটা হয়েছিল এই : লিটনগঞ্জে পিরের দরবারে ফকিরের কাছে কিছু টাকার বিনিময়ে এমন ঘটনার আভাস পেয়েছিলেন কমলাক্ষ। সেই সূত্র ধরে আজিমুদ্দিনের কবর খুঁজে বের করেছিলেন। বাকসোটাও পেয়েছিলেন, কিন্তু বাকসোটা কিছুতেই। খুলতে বা ভাঙতে পারেননি। মাধবও অনেক চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছিল। শেষে দুজনে ঠিক করেছিলেন, আপাতত যেখানে বাকসোটা ছিল সেখানে থাক। ইতিমধ্যে বিদেশি কোনও ধাতুবিদ্যা বিশারদের সঙ্গে যোগাযোগ করা যাক। তারপর একদিন বাকসোটা তার কাছে নিয়ে যাওয়া যাবে

কিন্তু হঠাৎ ন্যাড়ার ছোটমামার পাল্লায় পড়ে সেটা বেহাত হয়ে গেল।

এ সেদিন ন্যাড়া তাদের বাড়ি ঢুকলে কমলাক্ষ গেলেন মাধবের কাছে। মাধব সব শুনে খেপে গেল। সে বলল—এক কাজ করা যাক্ কমলদা। ওই ক্ষুদে বজ্জাতটাকে আমরা চুরি করে লুকিয়ে রাখি। তারপর বেনামী চিঠি দিই হারামজাদা শংকরচন্দ্রটাকে।

বাধা দিয়ে কমলাক্ষ বলেছিলেন—উঁহু ন্যাড়ার বাবাকেই উড়ো চিঠি দিতে হবে। ছেলের জন্য মমতা বাবারই বেশি হবে। বুঝলে না?

এরপর দুজনে চক্রান্ত করে ন্যাড়াকে চুরির ফিকিরে বেরিয়েছিল।

আপনভোলা ছেলে ন্যাড়া সন্ধ্যার আগে ঘুড়ি উড়িয়ে ফিরে আসছে, তার সামনে একটা জিপগাড়ি দাঁড়াল। মাধবের চোখে কালো চশমা। শীতের সময় বলে টুপিতে মুখের ও মাথার অনেকটা ঢাকা। সে ড্রাইভ করছিল। কমলাক্ষ ডাকলেন—নেড়ু! বাড়ি চললি বুঝি? আয়, জিপে করে পৌঁছে দিই।

ন্যাড়া জিপে উঠতেই কমলাক্ষ তার নাকের সামনে রুমাল চেপে ধরল। উগ্র কী এক ঝাঝালো গন্ধ টের পেল ন্যাড়া। তারপর তার আর কিছু মনে নেই।

যখন তার জ্ঞান ফিরল, সে দেখল একটা অচেনা ঘরে শুয়ে আছে। পাশে বসে আছেন কমলাক্ষ। মুখে অমায়িক হাসি।

ন্যাড়া ওঠার চেষ্টা করতেই বললেন—উঁহু, উঠো না! উঠো না!

ন্যাড়া বলল—কেন? আমার কী হয়েছে?

অ্যাকসিডেন্ট! কমলাক্ষ বললেন। তোমাকে জিপে করে বাড়ি পৌঁছে দিতে যাচ্ছিলুম, মনে পড়ছে?

ন্যাড়া বলল—হ্যাঁ, হ্যাঁ।

পথে আমাদের জিপ উলটে যায়। ভাগ্যিস, আমি ছিটকে পড়েছিলুম। বেঁচে গেছি। তুমিও বেঁচে গেছ। তবে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলে!

আমি তো ভালো আছি। আমার কিছু হয়নি!

হয়েছে। চুপ করে শুয়ে থাকো।

ন্যাড়া উঠে বসে বলল—না। আমি বাড়ি যাব।

অমনি কমলাক্ষ আচমকা একটা ছুরি বের করে বললেন—চুপ টু শব্দ করলে মুণ্ডু কেটে ফেলম। চুপ করে শুয়ে থাকো।

কমলাক্ষের হিংস্র চেহারা দেখে ন্যাড়া ভয়ে অবশ হয়ে গেল। এই সময় মাধব ঘরে ঢুকে বলল—কথা না শুনলে ওর হাত-পা বেঁধে রাখতে হবে কমলদা।

কমলাক্ষ নিষ্ঠুর হেসে বললেন—দরকার হবে না। নেড়ু বড় ভালো ছেলে। আর নড়াচড়া করলে ওকে শ্রীমান ডালকুত্তার জিম্মায় রেখে দেব। কই হে মাধব, তোমার প্রিয় ডালকুত্তা জনকে একবার নিয়ে এস।

ন্যাড়া আতঙ্কে তাকিয়ে দেখল, মাধব কোনার দিক থেকে একটা ভয়ংকর চেহারার ডালকুত্তাকে এনে তার বিছানার খাটের একটা পায়ার সঙ্গে বেঁধে রাখল। ডালকুত্তাটা কুৎসিত জিভ বের করে কুতকুতে হিংস্র চোখে ন্যাড়ার দিকে তাকিয়ে রইল।

মাধব বলল—একটু নড়তে চেষ্টা করলে জন তোমার গলায় দাঁত বসাবে। সাবধান।

কমলাক্ষ বললেন-ঠিক আছে। এবার আমরা নিজের কাজে বেরিয়ে পড়ি, চলো মাধব!

দুজনে বেরিয়ে গেল। বাইরে দরজায় তালা আটকানোর শব্দ শুনল ন্যাড়া। সে নিস্পন্দ হয়ে শুয়ে রইল। পায়ের দিকে রাক্ষুসে প্রাণীটা নিষ্পলক চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে। যেন একটু নড়লেই গর্জন করে টুটি কামড়ে ধরবে।

কমলাক্ষকাকু যে এমন শয়তান, ন্যাড়া কোনওদিন কল্পনাও করেনি।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত