কালো বাক্সের রহস্য-শ্রীমান ন্যাড়ার অন্তর্ধান

কালো বাক্সের রহস্য-শ্রীমান ন্যাড়ার অন্তর্ধান

কলকাতার ইলিয়ট রোডে কর্নেল নীলাদ্রি সরকারের ফ্ল্যাটটি ড়ো ঘুঘুর বাসা বলে পরিচিত। বুড়ো ঘুঘু বলতে কর্নেলকেই বোঝায়। ধুরন্ধর লোককেই ঘুঘু বলা হয়। তবে কদর্থে। কিন্তু কর্নেলের বেলায় এই ঘুঘু-নাম সদর্থে। এই বুড়োর মতো বিচক্ষণ ও ক্ষুরধার বুদ্ধির গোয়েন্দা কদাচিৎ দেখা যায়। লোকে বলে, তার টাক পড়ার কারণ বুদ্ধির তেজে চুল উঠে গেছে। আর সেইসব চুলই নাকি সাদা দাড়ি হয়ে গজিয়েছে।

যাই হোক, সেদিন শীতের সকালে কর্নেল তাঁর ড্রইং রুমে বসে খুব মনোযোগ দিয়ে এক ভদ্রলোকের কথা শুনছিলেন।

এই ভদ্রলোক আর কেউ নন, শংকরবাবু। লিটনগঞ্জের শ্রীমান ন্যাড়ার সেই ছোটমামা।

কর্নেল চোখ বুজে শুনছিলেন। সেই অবস্থায় বললেন—হুম। তারপর কী হল বলুন।

শংকরবাবু বললেন—বাকসোটা খোলার বহু চেষ্টা করেও খুলতে পারলুম না, বাকসোটা ইস্পাতের পাতে তৈরি মনে হল। তাই পরদিন ওটা গোপনে সঙ্গে নিয়ে কলকাতা চলে এলুম। আমার এক বন্ধুর ছোট্ট মেশিনটুলসের কারখানা আছে। তার ওখানেই খোলার ব্যবস্থা করব ভেবেছিলুম। কিন্তু বন্ধুও হার মানলেন। বললেন, এটা কোনওভাবে খোলা সম্ভব নয়। বিদেশে একরকম ইলেকট্রনিক করাত আছে, তা দিয়ে কাটা যেতে পারে। শুনে তো ভারি দমে গেলুম। বাকসোটা ফেরত নিয়ে সবে বাড়ি ফিরেছি, দেখি লিটনগঞ্জ থেকে আমার জামাইবাবু অর্থাৎ শ্রীমান ন্যাড়ার বাবা অসীমবাবু হাজির। ব্যাপার কী? না—ন্যাড়ার খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। আমার কাছে আসেনি শুনে তো উনি ভেঙে পড়লেন। তখন …

কর্নেল বাধা দিয়ে বললেন—অসীমবাবু বাকসোর ব্যাপার জানেন?

না। কাকেও বলিনি। আমার বন্ধু জগন্ময়কেও বলিনি, কীভাবে কোথায় ওটা পাওয়া গেছে।

হুম। তারপর?

তারপর বুঝিয়ে-সুঝিয়ে জামাইবাবুকে তো লিটনগঞ্জ পাঠালুম। লালবাজার মিসিং স্কোয়াডে ন্যাড়ার ছবি দিয়ে নিখোঁজের খবরও দেওয়া হয়েছে। ইতিমধ্যে যা আঁচ করেছিলুম, তাই ঘটেছে। আমার কাছে কাল হঠাৎ একটা বেনামী চিঠি এসে হাজির। তাতে লেখা আছে : তোমার ভাগনেবাবাজি শ্রীমান ন্যাড়া আমাদের হাতে। যদি ওকে ফেরত চাও, তাহলে পত্রপাঠ আমাদের বাকসোটি এই ঠিকানায় রেখে এসো। মনে রেখো, দু-দিনের বেশি অপেক্ষা করতে রাজি নই।…

কোনও নাম নেই চিঠিতে?

আজ্ঞে না।

চিঠিটা সঙ্গে এনেছেন?

হ্যাঁ। এই যে। শংকরবাবু একটা খাম বার করে এগিয়ে দিলেন।

কর্নেল চিঠিটা খুলে পড়ার পর বললেন—হুম! বি টি রোডের ধারে জায়গাটা। একটা বাগানবাড়ি আছে ওখানে। পেছনে গঙ্গার ধারে সায়েবি আমলের কবরখানা। বাকসোটা ওখানে পৌঁছে দিতে হবে! আচ্ছা শংকরবাবু, বাকসোটা এখন কোথায় রেখেছেন?

শংকরবাবু চাপা গলায় বললেন—আমার বেডরুমে। তবে এমনভাবে রেখেছি, কেউ টের পাবে না।

কীভাবে, শুনি?

আমরা বনেদি পরিবার কলকাতার। আমার ঠাকুরদা স্বর্গত ঈশানচন্দ্র ঘোষের নাম শুনে থাকবেন। উনি প্রখ্যাত শিকারি ছিলেন। আমার বাবা বারীন্দ্রনাথ নামকরা শিকারি ছিলেন। তিনি কবছর আগে মারা গেছেন। আমাদের বাড়িটা পুরোনো আমলের। দেয়ালে অনেক জায়গায় গুপ্ত আলমারি রয়েছে। বাইরে থেকে এতটুকু ধরা যাবে না। আমার বেডরুমে একপাশের দেয়ালে ওইরকম একটা গুপ্ত আলমারি আছে। তার মধ্যে রেখেছি বাকসোটা।

কর্নেল চিঠিটা মুড়ে খামে ঢুকিয়ে বললেন—এটা আমার কাছে রইল। আপত্তি নেই তো?

শংকরবাবু ব্যস্তভাবে বললেন—মোটেও না, মোটেও না। এমনকি, বাকসোটাও আপনার জিম্মায় রাখবার কথা ভেবেছি, কর্নেল! এতকাল ধরে আপনার কত সব কীর্তির কথা কাগজে পড়েছি। মনে মনে কতবার ভেবেছি, আপনার সঙ্গে আলাপ করে আসব। সময় হয় না। বিশেষ করে শুনেছি, একসময় আপনারও আমার মতো দেশ-বিদেশে অ্যাডভেঞ্চারের নেশা ছিল!

এখনও আছে। বলে কর্নেল হাসতে হাসতে উঠে দাঁড়ালেন। যাকগে চলুন শংকরবাবু, আগে সেই বাকসোটা দেখে আসি। তারপর শ্রীমান ন্যাড়ার উদ্ধারের কথা ভাবা যাবে।

একটু পরে শংকরবাবুর নীল রঙের মোটরগাড়িটি ছুটে চলল উত্তর কলকাতার দিকে। শ্যামবাজার ছাড়িয়ে গিয়ে বি টি রোডে পৌঁছে শংকরবাবু বললেন—এটাই আশ্চর্য লাগছে। যেখানে ওরা বাকসোটা ফেরত দিতে বলেছে, সে জায়গাটা আমাদের বাড়ি থেকে সামান্য দূরে।

কর্নেল চোখ বুজে কী ভাবছিলেন। শুধু বললেন—হুম!

ডানলপ ব্রিজ ছাড়িয়ে আরও দু-কিলোমিটার এগিয়ে বাঁদিকে একটা ছোট রাস্তায় গাড়ি মোড় নিল। তারপর সামনে একটা গেট দেখা গেল। ওটা শংকরবাবুর পৈতৃক বাড়ি, অমর নিকেতন।

গঙ্গার ধারে বিশাল এলাকা জুড়ে এই বাড়ি। বাগান রয়েছে। ফুল বাগিচা আছে। আগের আমলে বনেদি বড়লোকের বাড়ি যেমন ছিল তেমনি। গাড়ি গেটের সামনে দাঁড়াল।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত