ন্যাড়া স্বভাবে যাকে বলে আপনভোলা ছেলে। খানিকটা খেয়ালিও বটে। তারপর কতদিন স্টেশনের ওপারে সেই মাঠে ঘুড়ি ওড়াতে বা বন্ধুদের সঙ্গে ফুটবল খেলতেও গেছে। কিন্তু বটতলার সেই রহস্যময় ঘটনার কথা নিয়ে আর গা করেনি। বন্ধুরাও হয়তো তাকে মিথ্যুক বলে বসবে।
তাছাড়া বটগাছটার এমন ভূতুড়ে চেহারা যে দিনদুপুরে ওখানে যেতেই বুক কাঁপে।
ঘুড়িটা কয়েকদিনের মধ্যেই বাতাসের চোটে ফাটাফুটি হয়ে শুধু কঙ্কালটুকু আটকে রয়েছে।
কিছুদিন পরে কলকাতা থেকে ন্যাড়ার ছোটমামা শংকরবাবু এলেন বেড়াতে। বড়দিনের ছুটি কাটাতে ফি বছর তিনি লিটনগঞ্জে দিদির বাড়িই আসেন। এ শহরটা ভারি ছিমছাম আর সুন্দর। একটা নদীও বয়ে গেছে পাশ দিয়ে। জলবায়ু মোটামুটি স্বাস্থ্যকর।
শংকরবাবু নানা দেশ ঘুরেছেন। চমৎকার গল্প করতে পারেন। ছোটমামা এলে ন্যাড়া তো আহ্লাদে আটখানা হয়। সব সময় ছায়ার মতো ওঁর সঙ্গে ঘোরে।
বিকেলে শংকরবাবু বেড়াতে বেরিয়েছেন, সঙ্গে শ্রীমান ন্যাড়া।
শংকরবাবু সম্প্রতি আফ্রিকার চাঁদ রাজ্যে বেড়াতে গিয়েছিলেন। সেখানে একটা বিশাল হ্রদ আছে। তার ওপর আছে ভাসমান দ্বীপ। সেইসব দ্বীপে একটা করে বসতি রয়েছে। মজার কথা, দ্বীপগুলো সারাদিন হ্রদে একখান থেকে আরেকখানে ভেসে বেড়ায়। আর বসতিগুলো যেন জাহাজ। সেইসব গল্প বলছিলেন শংকরবাবু।
শেষে কথায়-কথায় বললেন—তবে সব দেশের চেহারাই দিনে-দিনে বদলে যাচ্ছে। খালি তোদের লিটনগঞ্জ দেখছি, বরাবর একইরকম রয়ে গেল!
ন্যাড়া বলল—আচ্ছা ছোটমামা, সেবার কোথায় যেন গিয়েছিলে—সেই যে সুড়ঙ্গের মধ্যে লোকেরা বাস করে। বাইরে বেরুবার দরকার হয় না। সেটা কী দেশ ছোটমামা?
ও। সে তো দক্ষিণ মেরুতে। আন্টার্কটিকায়। বলে শংকরবাবু একচোট হাসলেন। কিন্তু তারা তো বিজ্ঞানী। পৃথিবীর নানা দেশ থেকে গিয়ে আন্টার্কটিকায় বরফ খুঁড়ে পাতালনগরী বানিয়ে বাস করছেন। কতরকম পরীক্ষা করছেন। সে আসলে তাদের গবেষণাকেন্দ্র। বুঝলি?
ন্যাড়া লাজুক হেসে বলল—আমার বড্ড ভুলো মন, ছোটমামা। তুমি তাই বলেছিলে বটে। এই দ্যাখো না, সুড়ঙ্গ বলতেই মনে পড়ে গেল…
বলে হঠাৎ চুপ করে গেল সে। শংকরবাবু বললেন—কী রে? থামলি যে?
ন্যাড়া ওঁর একটা হাত চেপে ধরে বলল-ছোটমামা, আমার সঙ্গে এক জায়গায় যাবে?
শংকরবাবু অবাক হয়ে বললেন—কোথায় রে?
আহা। এসো না! তোমাকে আমি সুড়ঙ্গ দেখাব।
বলে ন্যাড়া শংকরবাবুকে টানতে টানতে নিয়ে চলল। শংকরবাবু জানেন, তার এই ভাগনেবাবাজি বরাবর বড় খামখেয়ালি ছেলে। অদ্ভুত স্বভাবচরিত্র। মাঝে মাঝে যা সব করে, পাগলামি বলেই মনে হয়। তার ওপর বড় জেদিও বটে।
তাই চুপচাপ হাসিমুখে ওর সঙ্গে চললেন। চলা তো নয়, যেন গাড়িতে যাওয়া। ন্যাড়া তাকে প্রায় দৌড় করিয়ে নিয়ে চলেছে। স্টেশনে গিয়েও থামল না! ওভারব্রিজ পেরিয়ে একেবারে সেই পোড়ো মাঠে হাজির করল। সেখান থেকে জঙ্গলের মধ্যে বটতলায়।
বটতলায় ন্যাড়া হাত ছেড়ে দিয়ে কী যেন খুঁজছে দেখে শংকরবাবু বললেন—ব্যাপারটা কী বলবি তো বাঁদর ছেলে। এতখানি পথ আমায় দৌড় করালি। বাস। এবয়সে এত ধকল বরদাস্ত হয়? দম বেরিয়ে গেছে একেবারে।
ন্যাড়া একবার ওপর দিকে বটগাছের ডালপালার দিকে তাকাল। তারপর নিচের দিকে তাকাল। দৌড়ে গিয়ে শুকনো পাতা সরাতে আরম্ভ করল।
শংকরবাবু বললেন—ও কী রে! ও কী করছিস?
ন্যাড়া ব্যস্তভাবে বলল—সুড়ঙ্গের কথা বললুম না। সেই সুড়ঙ্গটা এখানেই আছে।
অ্যা। বলিস কী! বলে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন শংকরবাবু।
শুকনো পাতার তলায় মাটির চাঙড় সরাচ্ছিল ন্যাড়া। একটু পরেই সে চেঁচিয়ে উঠল—ছোটমামা! ছোটমামা! কাম অন! পেয়ে গেছি।
শংকরবাবু হেঁট হয়ে দেখলেন, একটা চৌকো পাথর রয়েছে এবং তার মধ্যিখানে একটা লোহার মজবুত আংটা। বললেন—তাজ্জব ব্যাপার! এ কী রে ন্যাড়া!
সুড়ঙ্গের দরজা ছোটমামা।
তুই টের পেলি কীভাবে? পরে বলব।
আগে এটা ওঠাও না!
দুজনে আংটা ধরে পাথরটা তুলে একপাশে রাখল। নিচে কবরের মতো একটা গর্ত দেখা গেল। এখনও দিনের আলো প্রচুর। শংকরবাবু গর্তে লাফ দিয়ে নামলেন। তারপর অস্ফুট কণ্ঠে বিস্ময় প্রকাশ করে বললেন—এ কী!
ন্যাড়া হাঁটু গেড়ে গর্তের মাথার দিকে বসে রয়েছে। বলল—সুড়ঙ্গের ভেতরে একটা কালো বাকসো দেখতে পাবে। ওর মধ্যে গুপ্তধন আছে।
বলিস কী! বলে শংকরবাবু সুড়ঙ্গের দরজাটা টেনে খুললেন। ভেতরে ঘন অন্ধকার। পকেট থেকে সিগারেট-লাইটার বের করে জ্বাললেন। তারপর ভেতরে ঢুকে গেলেন। কয়েক পা এগিয়ে টের পেলেন, এটা একটা ছোট ঘর। মাটির নিচে পাথরের দেয়াল ও ওপরে ছাদ রয়েছে। আর ঘরের মধ্যিখানে একটা কালো পাথরের ছোট্ট কবর। কবরের গায়ে ফারসি ভাষায় লেখা একটা ফলক আছে। এটা সম্ভবত কোনো শিশুর কবর। শংকরবাবুর মনে পড়ল, কয়েকশো বছর আগে এখানে বাংলার তুর্কি সুলতানদের রাজধানী ছিল। এই মাটির তলায় গোপন কবর নিশ্চয় কোনা সুলতানবংশীয় শিশুর। পাছে শত্রুপক্ষ সুলতানবংশীয় শিশুর মৃতদেহের অসম্মান করে, তাই হয়তো গোপনে এভাবে ভূগর্ভে কবর দেওয়া হয়েছিল।
কিন্তু তার চেয়ে অবাক কাণ্ড, কবরের ওপর সত্যি একটা কালো বাকসো রয়েছে। বাকসোটা ছোট্ট। শংকরবাবু সেটা তুলে নিলেন। বিশেষ ভারী নয়।
ওপর থেকে ন্যাড়ার চাপা গলার আওয়াজ ভেসে এল—শিগগির ছোটমামা! শিগগির! বাকসো নিয়ে চলে এসো। কারা যেন আসছে!
শংকরবাবু বাকসোটা নিয়ে বেরিয়ে বললেন—ন্যাড়া, ধর এটা। আমি দরজা এঁটে দিই।
ন্যাড়া কালো বাকসোটা নিয়ে বলল—মনে হচ্ছে, সেই লোকদুটো আসছে ছোটমামা! শিগগির!
শংকরবাবু ঝটপট গর্ত থেকে উঠলেন। তারপর আংটা লাগানো পাথরটা আগের মতো চাপা দিয়ে তার ওপর মাটির চাঙড়গুলো বসিয়ে দিলেন। শুকনো পাতা ছড়ালেন। একেবারে আগের মতো স্বাভাবিক দেখাল জায়গাটা।
ন্যাড়া আঙুল তুলে ওপাশের মাঠে দুজন লোককে দেখিয়ে বলল—ওরা আসছে। কেটে পড়া যাক ছোটমামা! ওদের কাছে বন্দুক আছে কিন্তু।
লোকদুটো ওদের দেখতে পাচ্ছিল না। কারণ বটগাছটার ঝুরি আছে অজস্র। তা ছাড়া ওপাশে ঝোপঝাড়ও রয়েছে। শংকরবাবু বাকসোটা বগলদাবা করে বললেন—চলে আয় ন্যাড়া।
দুজনে উলটো দিকের জঙ্গলে ঢুকে গেলেন।
তারপর অনেকখানি জঙ্গলের আড়ালে এগিয়ে ঘুরপথে নদীর ব্রিজে পৌঁছোলেন। সেখান থেকে রেললাইন ডিঙিয়ে একেবারে সোজা বাড়ির পথে।