আচায্যিপাড়ার স্বপন কবে তার জ্যাঠামশায়ের শ্রাদ্ধে ন্যাড়া হয়েছিল সেই থেকে ওর নাম ন্যাড়া হয়ে গেছে। প্রথম প্রথম ন্যাড়া বললে ভারি রেগে যেত। আজকাল সয়ে গেছে। বাড়িতেও সবাই তাকে ন্যাড়া বলে।
তা ন্যাড়াই ব্যাপারটা দেখেছিল।
এই মহকুমা শহরের পাশ ঘেঁষে গেছে রেললাইন। স্টেশনের ওধারে রেলইয়ার্ড হবে বলে প্রায় এক বর্গকিলোমিটার জায়গা রেলদফতর দখল করে রেখেছেন। সেখানে আগাছার জঙ্গল, হাজামজা একটা ঝিল আর ঘাসেভরা মাঠ আছে। সেই মাঠে অনেক ছেলে গিয়ে ঘুড়ি ওড়ায় কিংবা খেলাধুলা করে। ন্যাড়া গিয়েছিল ঘুড়ি ওড়াতে।
শীতের বিকেল। কনকনে উত্তুরে হাওয়া বইছিল। ন্যাড়ার ঘুড়ি একটা গোত্তা খেয়ে গাছের ডগায় সুতো জড়িয়ে গণ্ডগোল বাধিয়েছিল। ন্যাড়া গাছে চড়তে তত পটু নয়। আর গাছটাও মস্তো ঝকড়া বট। অগুনতি ঝুরি। তলাটা ততক্ষণে বেশ আঁধার দেখাচ্ছিল।
ন্যাড়া এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখেছিল, কেউ কোথাও নেই। যেসব ছেলে তার মতো ঘুড়ি ওড়াতে এসেছিল বা ক্রিকেট খেলছিল, কখন একে একে চলে গেছে।
ন্যাড়ার মনে শুধু ভূতের ভয়। এমন নিরিবিলি জায়গা, তার ওপর আসন্ন সন্ধ্যা আর এমন বটগাছের মতো আশ্রয়। ভূতেরা কি এমন জায়গা ছেড়ে থাকতে চায়?
কিন্তু অমন সুন্দর ঘুড়িটাও এখন একটুও ফেঁসে যায়নি। শান্তভাবে আটকে আছে। অনেকখানি সুতোও রয়েছে। ন্যাড়া শেষ পর্যন্ত সাহস করে বটগাছে উঠেছিল। মোটা ছড়ানো একটা ডালে। কয়েক-পা এগোলেই মাথার ওপর হাত বাড়িয়ে ঘুড়িটা ছাড়ানো যায়।
সে সবে ঘুড়িটা ছাড়িয়েছে, হঠাৎ নিচে কোথাও শুকনো পাতায় মচমচ শব্দ হল। ডালপালার ফাঁক দিয়ে সে দেখল, দুজন লোক সবে এসে দাঁড়িয়েছে এবং চাপা গলায় কী বলাবলি করছে। একজনের চেহারা একেবারে জল্লাদের মতো। গোঁফ, গালপাট্টা তো আছেই। চোখ দুটো যেন জ্বলছে। পরনে কালো পাতলুন আর কালো গেঞ্জি। একজনের হাতে বন্দুক, অন্যজনের হাতে পিস্তল। তার পরনে ধুতি-পাঞ্জাবি। গায়ে চাদর। তাদের পায়ের কাছে একটা কালো রঙের ছোট্ট বাকসো রয়েছে। বাকসোটা তারা বয়ে এনেছে বোঝাই যায়। কিন্তু লোক দুটোকে যেন এর আগে কোথাও দেখেছে। পিস্তলধারী মুখটা চাদরে ঢেকে রেখেছে বলে চেনা যাচ্ছে না।
ন্যাড়া বিশেষ করে বন্দুক-পিস্তল দেখে ভীষণ ভয় পেয়ে গিয়েছিল। লোকদুটো নিশ্চয় ডাকাত-গুন্ডা না হয়ে যায় না। পাছে ন্যাড়াকে তারা মেরে ফেলে, ন্যাড়া টু শব্দটি করেনি। সে চুপচাপ গিরগিটির মতো ডালের সঙ্গে নিজেকে আটকে রেখে ব্যাপারটি দেখছিল।
আলো ক্রমে মরে যাচ্ছিল। আবছা আঁধারে লোক দুটো তারপর অদ্ভুত কাণ্ড শুরু করেছিল। তারা বটতলায় জুতোর ঠোক্কর মেরে যেন একটা অদৃশ্য ফুটবল নিয়ে খেলা করছিল। খানিক পরে একজন বলে উঠেছিল—এসো, হাত লাগাও।
তারপর দুজনে হাঁটু দুমড়ে বসে মস্তো দুটো ছোরা বের করেছিল। সেই ছোরা দিয়ে মাটি খুঁড়ে একটা আংটা বেরুতেই সেটা দুজনে মিলে জোর টানাটানি করেছিল। ততক্ষণে বটতলায় আঁধার ঘন হয়েছে। ন্যাড়া স্পষ্ট কিছু দেখতে পাচ্ছিল না। শুধু টের পেয়েছিল। কালো বাকসোটা দুজনে বয়ে এনে তারপর কিছুক্ষণ যেন বেমালুম নিপাত্তা হয়ে গেল। আর কোনও সাড়া-শব্দই নেই।
সেই শীতে ন্যাড়া তো জমে হিম হয়ে গেছে। অথচ সাহস করে নেমে আসতে পারছে না। ঘুড়ির মায়া আর নেই তখন। প্রাণ বাঁচিয়ে পালিয়ে আসাটাই বড় কথা। কিন্তু নামলেই যদি গুন্ডা দুটোর সামনে পড়ে?
অথচ ওরা গেল কোথায়? বেমালুম অদৃশ্য হয়ে গেল নাকি?
না। একটু পরে টর্চের আলো জ্বলল নিচে। সেই আলোয় ন্যাড়া যা দেখল, তাতে হতবাক হয়ে বসে রইল। একটা চৌকো গর্তের ধারে একজন বসে গর্তের ভেতর আলো ফেলেছে। আরেকজন সেই গর্তে নেমে কী একটা টানাটানি করছে। কালো বাকসোটা তার পায়ের কাছে গর্তের মধ্যেই রয়েছে। গর্তটা কিন্তু নিছক গর্ত নয়, চৌকো পাথরে বাঁধানো চৌবাচ্চা যেন।
গর্তের লোকটা হঠাৎ বলে উঠল—পাওয়া গেছে।
ওপরকার লোকটা বলল—খুলে ফ্যালো।
ফের বিষাক্ত গ্যাস বেরুতে পারে আগের মতো।
পরীক্ষা করে দ্যাখো তাহলে। আগের বার নিশ্চয় সব বেরিয়ে গেছে।
ফের কিছুক্ষণ চুপচাপ। গর্তের লোকটা কী একটা যন্ত্র বের করে নাড়াচাড়া করল কিছুক্ষণ। তারপর বলল—নেই।
তাহলে ভেতরে ঢুকে যাও। আমি টর্চ নেভাচ্ছি। কেউ দেখে ফেলতে পারে। ঠিক আছে! আমার কাছে টর্চ আছে।
গর্তের ওপরকার টর্চ নিভে গেল। গর্তের ভেতর টর্চ জ্বলল। লোকটা সেই কালো বাকসোটা নিয়ে হুমড়ি খেয়ে বসল। তারপর আর তাকে দেখা গেল না।
বটতলার নিচে তখন ঘন অন্ধকার। এত শীতেও ন্যাড়ার গায়ে যেন ঘাম জমছিল। সে বুঝতে পারছিল না, এটা একটা স্বপ্ন না বাস্তব ঘটনা। কে ওরা? ওই বাকসোতে কী আছে? আর এই পোড়ো জঙ্গুলে জায়গায় কি তাহলে মাটির নিচে কোনও গোপন ঘর আছে—যেখানে লোকটা বাকসোটা লুকোতে নিয়ে গেল।
সময় কাটতে চায় না। ঝিলের ওদিকে শেয়াল ডাকছিল। মাথার ওপর পাচা ডেকে উঠছিল। ভাগ্যিস নিচের লোকটা প্যাচাটা দেখার জন্য টর্চ জ্বালেনি। তাহলেই ন্যাড়াকে দেখতে পেত এবং নিশ্চয় গুলি করে মারত। কিন্তু সেই সময় হঠাৎ ন্যাড়ার মনে হল, ওদের গলার স্বর যেন চেনা।
কতক্ষণ পরে নিচে ফের আলোর ঝলক। তারপর দুজনের কথাবার্তা শোনা গিয়েছিল।
সব ঠিক আছে। হুম।
উঠে এসো ঝটপট। সব ঢাকাটুকি দেওয়া যাক।
অলো জ্বালার দরকার নেই। এসো, হাত লাগাও।
নিচে অস্পষ্ট একটা ভারী শব্দ হল। তারপর অনেক রকম বিদঘুটে খসখস, ধুপধাপ শব্দ হতে থাকল। তারপর ন্যাড়া টের পেল, ওরা চলে গেল। বটতলায় তখন ঘন আঁধার আর নীরবতা। আর হিম।
একটু পরে ঠকঠক করে কাঁপতে কাঁপতে ঘুড়ির মায়া ছেড়ে ন্যাড়া গাছ থেকে নেমে এসেছিল। তারপর এক দৌড়ে স্টেশন। স্টেশন থেকে সটান বাড়ি।
সে-রাতে ভালো ঘুম হয়নি তার। কিন্তু ঘটনাটা বাবা-মা কিংবা আর কাউকে বলেনি—পাছে ওঁরা ওকে গাছে ওঠার জন্য বকাবকি করেন। তাছাড়া এই বিদঘুটে ব্যাপারটা তারা যে বিশ্বাস করবেন না, ন্যাড়া তা জানত। উলটে মিথ্যে বলার জন্য তাকে মার খেতে হবে বরং।