আমার কুকুর জিমকে নিয়ে জ্বালায় পড়েছি দেখছি। এমন নয় যে তাকে কখনও বনজঙ্গল পাহাড় পর্বতে আনিনি। এই তো মাস তিনেক আগে তাকে নিয়ে কাশ্মীরের বরফে ঢাকা পাহাড়ি মুল্লুকে ঘুরছি। কিন্তু জিমের এমন পালাই-পালাই ভাবভঙ্গি তো কখনও দেখি না।
প্রথমে ভেবেছিলাম, একেবারে বিদেশ-বিভুই জায়গায় এসে ওর বুঝি অসুখ-বিসুখ করেছে। আমাদের সঙ্গে আছেন ভাগ্যক্রমে প্রাণীবিজ্ঞানী ডক্টর মুরলীধর প্রসাদ। নৈনিতালের লোক। তিনি জিমকে ভালভাবে পরীক্ষা করে বলেছেন, জিম ইজ অলরাইট। ওর কিস্যু হয়নি। তবে কী জানেন জয়ন্তবাবু? মানুষের যেমন, তেমনি সব প্রাণীরই এই একটা ব্যাপার আছে। সব জায়গায় মন টেকে না।
ভেবে পাইনি, এমন সুন্দর জায়গায় মন না টেকার কারণ কী থাকতে পারে? চারদিকে নীল সাগরে ঘেরা এই দ্বীপের প্রাকৃতিক দৃশ্য মনোরম।.আমাদের ক্যাম্পের সামনে সবুজ ঘাসে ঢাকা একটা সমতল মাঠ। সেখানে নির্ভয়ে হরিণের পাল চরে বেড়ায়। কখনও লুকোচুরি খেলতে আসে সাদা রঙের দু-একটা খরগোশ। পাখিও কম নেই। ঋক বেঁধে মাঠে নেমে তারা পোকামাকড় খুঁজে খায়। কিন্তু আশ্চর্য, জিমকে ছেড়ে দিয়ে দেখেছি, সে অভ্যাসমত পশুপাখিদের মিছেমিছি ভয় দেখিয়ে বা তাড়া করে মজা লুটতে ছোটে না।
এমন কী, তার প্রায় নাকের ডগায় কোন পাখি বা খরগোশ বেয়াদপি করতে গেলেও জিম মুখেও ধমকায় না। খালি মুখ তুলে বোবার মতো তাকিয়ে থাকে। তার শরীর কেমন যেন থরথর করে কাঁপে।
সবচেয়ে অদ্ভুত লাগে তার আচরণ, সন্ধের দিকে। ক্যাম্পের সামনে খোলামেলায় আগুন জ্বেলে আমরা যখন বসে গল্পসল্প করি, জিম আমার কোলে বসে মুখের ভেতর কী একটা অস্পষ্ট শব্দ করে। মাঝে মাঝে যেন সে ভীষণ চমকে ওঠে।
সারারাত যতবার ঘুম ভাঙে, শুনতে পাই জিমের ওই বোবার মতো চাপা অদ্ভুত আওয়াজ। রাতের দিকে বেশ ঠাণ্ডা বলে তার গায়ে একটুকরো কম্বল জড়ানো থাকে। দেখেছি, জিম কম্বলের ভেতর মুখটাও ঢুকিয়ে তালগোল পাকানো শরীরে পুঁটিলির মতো গুটিয়ে রয়েছে। ভয়েই কি? কিসের ভয়? এখানে ভয় পাওয়ার মতো কিছু দেখছি না তো!
আজ তিন দিন হল আমরা এই দ্বীপে এসেছি। আমরা মানে, ওই ডঃ মুরলীধর প্রসাদ, আমি এবং আমাদের প্রখ্যাত বুড়ো ঘুঘু কর্নেল নীলাদ্রি সরকার মহোদয়। আর একজন সঙ্গীও অবশ্য আছে। সে কর্নেলের পুরাতন ভৃত্য শ্রীযুক্ত ষষ্ঠীচরণ। তাকে না আনলে এ অখাদ্য দ্বীপে না খেয়ে মরতে হত। তবে শুধু রান্নাবান্না নয়, ষষ্ঠীচরণ প্রহরী হিসেবেও বড় কড়া লোক। খুব চালাকচতুর এবং এই প্রৌঢ় বয়সে তার গায়ের জোরের পরিচয় অনেকবার পেয়েছি।
আজও কর্নেল তোরবেলা ডঃ প্রসাদকে নিয়ে বেরিয়ে গেছেন। সামনের মাঠের ওপারে উঁচু পাঁচিলের মতো বিশাল পাহাড় দ্বীপের একদিক থেকে অন্যদিক পর্যন্ত চলে গেছে। দ্বীপটাকে নাকি দুভাগে ভাগ করেছে পাহাড়টা। কর্নেলরা যান ওই পাহাড়ে।
এ দ্বীপের নাম ভেগা আইল্যান্ড। আর ওই পাহাড়টার নাম ওয়াকিমো মাউন্টেন। ওয়াকিমো কথাটার মানে নাকি বদরাগী। পাহাড়টার এমন বিশ্রী নাম কেন? শুনেছি এ সমুদ্রে যারা মাছ। ধরতে আসে, তাদের বিশ্বাস; ওখানে একটা বেজায় বদরাগী দানে বাস করে। তাই মাছধরা জাহাজ এই দ্বীপের ছায়া মাড়ায় না।
কর্নেল কি দানোটাকে জব্দ করতে এসেছেন তাহলে? মোটেও না। কর্নেল যা বলেছেন, শুনে তাক লেগে যায়। ওয়াকিমো পাহাড়ে এক বিচিত্র প্রাণীর বাস। প্রাণীটা নেকড়ে এবং কুকুরের মাঝামাঝি। পনেরো হাজার বছর আগে গুহাবাসী আদিম মানুষেরা জন্তু শিকার করে এনে গুহার ভেতর বসে মহানন্দে খেত। আর হাড়গোড় ফেলে দিত বাইরে। নেকড়েরা সেই ললাভে গুহার কাছে জড়ো হত। কালক্রমে এই উচ্ছিষ্ট খাদ্য খেতে খেতে তারা শিকার করাই ভুলে গেল। মানুষ-ঘেঁষা হয়ে পড়ল। তারপর মানুষ তাদের বশ করে ফেলল। তারাই গৃহপালিত কুকুরের পূর্বপুরুষ।
কিন্তু মানুষের ভেতর যেমন, তেমনি জন্তুদের ভেতরও কিছু বেয়াড়া জীব থাকে। তেমন কিছু বেয়াড়া নেকড়ে মানুষের পোষ মানল না, অথচ শিকারের ক্ষমতাও হারিয়ে ফেলেছে। তারা কী করল তখন? তারা অগত্যা পেটের জ্বালায় বাঁদর-হনুমানদের মতো উদ্ভিদভোজী—যাকে ইংরেজিতে বলে ভেজেটারিয়্যান হয়ে গেল। গাছের পাতা, ফলমূল—এসব খেয়েই বেঁচে রইল।
প্রাণীবিজ্ঞানীদের ধারণা, এইসব জাত-খোয়ানো নেকড়ের বংশধর এখনও কোথাও টিকে থাকতে পারে। কর্নেল কোন সূত্রে খবর পেয়েছেন, ভেগা দ্বীপের পাহাড়ে নাকি সেই আজব নেকড়ে-কুকুর এখনও আছে। তাই প্রাণীবিজ্ঞানী ডঃ প্রসাদকে নিয়ে এখানে হাজির হয়েছেন।
আর আমি তো কর্নেল বুড়োর ছায়াসঙ্গী। যাকে বলে ন্যাওটা। তাই আমাকেও আসতে হয়েছে। পোর্টব্লেয়ার থেকে হেলিকপ্টারে আসতে ঘন্টা পাঁচেক লেগেছে। কিন্তু একটুও ক্লান্তি বা বিরক্তি জাগেনি। জিমকে সঙ্গে আনার কারণ, সেই আজব নেকড়ে-কুকুর বা কর্নেলের ভাষায় নেকুর যদি একটা পাকড়াও করতে পারেন, পোষা কুকুরের সামনে তার আচরণ কেমনধারা হবে, পরীক্ষা করে দেখবেন। তাছাড়া জিমের জন্য একটা জরুরি কাজও আছে। জিমকে দেখিয়ে নেকুরদের ফাঁদে ফেলার মতলব ছিল কর্নেলের। পোষা ঘুঘু পাখির সাহায্যে ব্যাধরা যেভাবে বুনো ঘুঘু পাখি ডেকে এনে ফাঁদে ফেলে, ঠিক সেইভাবে।
কিন্তু দ্বীপে এসে জিমের হাবভাব দেখে কর্নেল আপাতত সে মতলব কাজে লাগাচ্ছেন না। লাগাতে চাইলে আমিও আপত্তি করতুম।
আজ তিন দিনের দিন একটা সন্দেহ জেগেছে। জিম কি তাহলে নেকুরের ভয়ে এমন অস্থির?
কর্নেলের কাছে কথাটা তুলতে হবে। তবে জিম শক্তিমান অ্যালসেশিয়ান। তার গায়ের রং কুচকুচে কালো। দশাসই গতর। একবার একজন খুনে গুণ্ডাকে প্রায় মেরে ফেলার উপক্রম করেছিল। জিমের মতো সাহসী দুর্দান্ত কুকুর শাকপাতা খেকো নেকুরকে ভয় পাবে বলে মনে হতো হয় না।
কিন্তু কিছু বলাও যায় না। গরিলাও তো মাংসাশী প্রাণী নয়। অথচ গরিলাকে সিংহও ভয় পায়।
এইসব সাত-পাঁচ ভাবতে-ভাবতে সকালে ক্যাম্পের সামনে চেয়ার পেতে বসে কফি খাচ্ছি। ষষ্ঠীচরণ তার কিচেন-তাঁবুর সামনে খোলামেলায় পিকনিকের উনুনের মতো উনুন বানাতে ব্যস্ত রয়েছে, কারণ কেরোসিন তত বেশি সঙ্গে আনা হয়নি এবং কতদিন এখানে থাকতে হবে তার ঠিক নেই। জিম আমার চেয়ারের পায়া ঘেঁষে বসে আছে—মুখটা বেজায় বিষণ্ণ। হঠাৎ ষষ্ঠীচরণ কাজ ফেলে আমার কাছে এসে কাচুমাচু মুখে একটু হেসে বলল, ছোট সাহেব যদি কিছু মনে না করেন, একটা কথা বলি।
বললুম, অত বিনয়ের অবতার তো তোমায় কোনওদিন দেখিনি ষষ্ঠী। ব্যাপারটা কী?
ষষ্ঠীচরণের হাসিটুকু মিলিয়ে গেল। সে গম্ভীর হয়ে চাপা গলায় বলল, আজ্ঞে, আমার বড্ড গা বাজছে।
অবাক হয়ে বললুম, সে কী হে ষষ্ঠী! তুমি অমন ডানপিটে সাহসী মানুষ। তোমার গা বাজছে মানে?
ষষ্ঠীচরণ আরও গলা চেপে বলল, এ দ্বীপটায় অমানুষ থাকে আজ্ঞে।
অমানুষ মানে? হাসতে হাসতে বললুম। ও ষষ্ঠী। তুমি কি ভূতের ভয় পেয়েছ?
ষষ্ঠীচরণ এবার বসল। চারদিকটা দেখে নিয়ে ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে ফিসফিস করে বলল, এইমাত্তর আমার ওপর টুপটুপ করে ঢিল পড়ছিল। আপনার দিব্যি ছোটসাহেব। মিথ্যে কথা আমায় কখনও বলতে শুনেছেন?
মার্চ মাসের উজ্জ্বল সকালবেলা। আকাশে মেঘের কুটোটিও নেই। তাঁবুর পেছনে অবশ্য একটু তফাতে ঝোপঝাড় আর গাছপালা আছে। কিন্তু সামনেটা ফাঁকা। সবুজ ঘাসের মাঠ ওয়াকিমো পাহাড় পর্যন্ত ছড়ানো। এই ফাঁকা জায়গায় দিনদুপুরে ষষ্ঠীকে ভূতেরা ঢিল ছুড়ে নাকাল করেছে, ভাবতেই হাসি পায়। আমি হো-হো করে হেসে বললুম, কই, চলো তো দেখি—ভূতের কেমন সাহস!
ষষ্ঠীচরণ বলল, বন্দুকটাও সঙ্গে নিন স্যার।
পা বাড়িয়ে বললুম, ভূতের গায়ে বন্দুকের গুলি বেঁধে না। কই, চলো দেখি। আয় জিম!
জিম যেন অনিচ্ছাসত্ত্বেও ওই আমার সঙ্গে এগোল। মাত্র তিরিশ হাত তফাতে ষষ্ঠীচরণের কিচেন তাঁবু। ঠিক মাঝামাঝি পৌঁছেছি, হঠাৎ আমার গায়ে টুপটুপ করে কী যেন পড়ল কয়েকবার। ঠাহর করে দেখি, সেগুলো খুদে মার্বেলের মতো গড়নের গোল ঢিল। চারদিকে তীক্ষ্ণদৃষ্টে তাকিয়ে কাউকে দেখতে পেলুম না। দৌড়ে ওই তাঁবুর পেছনে গেলুম। কেউ কোথাও নেই। ওদিকটা প্রায় পঁচিশ গজ অব্দি ফাঁকা। তারপর জঙ্গল। জঙ্গল থেকে ঢিল ছুড়েছে কি? তারা কারা?
জিম আমার পেছন-পেছন এসে মুখ তুলে দাঁড়িয়ে আছে। জঙ্গলের দিকে আঙুল তুলে তাকে ইশারা করলুম। কিন্তু জিম কথা মানল না। শুধু লেজটা গুটিয়ে কেমন চাপা শব্দ করতে লাগল।
ষষ্ঠীচরণ এগিয়ে এসে বলল, ঢিলটা পরখ করে দেখুন তো স্যার! এ তো ঢিল বলে মনে হচ্ছে না।
হাতের তালুতে রেখে দেখলুম, খুব হালকা ধূসর রঙের ঘুটি। ঘুটিটা শুকনো ঘাস দিয়ে তৈরি। সাধুবাবারা গাঁজা খাওয়ার জন্য নারকোল ছোবড়ার যেমন খুদে ঘুলতি বানায়, ঠিক তেমনি। কিন্তু এগুলো আরও ছোট। ওজনে হালকা হলেও দৈবাৎ চোখে লাগলে বিপদ হতে পারে।
ততক্ষণে ষষ্ঠীচরণ আরও কয়েকটা ভূতের ঢিল খুঁজে পেয়েছে। সেগুলো সে একটা কাগজের মোড়কে রেখে বলল, বড় সাহেবকে দেখাতে হবে। কী বলেন স্যার?
ভূত-পেরেতে আমার বিশ্বাস নেই। নিশ্চয় এভাবে ভূতুড়ে ঢিল ছুড়ে কারা আমাদের ভয় দেখাচ্ছে কোনও উদ্দেশ্যে। ব্যাপারটা দেখতে হয়।
দৌড়ে আমার তাঁবু থেকে রাইফেল নিয়ে বেরলুম। জিম অনিচ্ছাসত্ত্বেও আমাকে অনুসরণ করল। ষষ্ঠীচরণ ব্যাপার দেখে আরও ভয় পেয়ে বলল, ওরে বাবা! আমার কী হবে?
কিছু হবে না। ভুতেরা ছুড়লে, তুমিও ঢিল ছুঁড়বে। বলে যেদিক থেকে ঢিলগুলো এসেছিল সেইদিকে এগিয়ে গেলুম।
কিন্তু আর ঢিল ছুড়ল না কেউ। ঝোপজঙ্গল দুর্ভেদ্য বললেই হয়। ভেতরে ঢোকার কোনও উপায় নেই! চোখে পড়ল, বড় বড় পাথরও রয়েছে জঙ্গল জুড়ে। প্রকাণ্ড একটা পাথর জঙ্গলের বাইরে অব্দি ছড়িয়ে রয়েছে দেখে সেখানে গেলুম। প্রথমে জিমকে তুলে দিলুম পাথরটার ওপর। তারপর আমি উঠলুম।
জঙ্গলের মাটিটা ক্রমশ ওদিকে ঢালু হয়ে নেমে গেছে বোঝা যাচ্ছিল। হঠাৎ মনে একটা অদ্ভুত অস্বস্তির সৃষ্টি হল। ওই ঘন সবুজ জঙ্গলের ভেতর থেকে কে বা কারা যেন আমাকে দেখছে। তাদের দেখতে পাচ্ছি না, অথচ তারা আমাকে দেখছে—অস্বস্তিটার কারণ এই।
কিন্তু ভাল করে খুঁটিয়ে দেখেও কিছু সন্দেহজনক চোখে পড়ছিল না।
তবু হলফ করে বলতে পারি, একদল অদৃশ্য আজব প্রাণী যেন আড়াল থেকে আমার ওপর লক্ষ্য রেখেছে। কিছুতেই এ অনুভূতি মন থেকে তাড়াতে পারলুম না।
তারপর জিম একটা অদ্ভুত কাণ্ড করল। আমাকে ফেলে রেখে লাফ দিয়ে পাথর থেকে নামল। তারপর লেজ গুটিয়ে গলার ভেতর অদ্ভুত আওয়াজ করতে করতে ভোলা ঘাসজমির উপর দিয়ে তাঁবুর দিকে দৌড়ল। আমি রেগেমেগে চিৎকার করে ডাকলুম, জিম! জিম! কী হচ্ছে!
জিম কান করল না। কিচেন-তাঁবুর পাশে ষষ্ঠীচরণ দাঁড়িয়ে আছে দেখলুম। তার হাতে একটা বল্লম কিংবা লাঠি। এতদূর থেকে বোঝা যাচ্ছে না। জিম সটান গিয়ে আমার তাঁবুতে ঢুকে পড়ল।
পেছনে ঘুরেছিলুম জিমের জন্য। এবার জঙ্গলের দিকে ঘুরেই চমকে উঠলুম। আন্দাজ গজ বিশেক দূরে নিচে এমনি একটা পাথরের পাশে তিনটে বিদঘুটে প্রাণী দাঁড়িয়ে আছে। তাদের ওপর রোদুর পড়েছে বলে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি।
তারা মানুষের ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে। গায়ের রং কালো কুচকুচে। গলা কাঠির মতো। মাথা তেকোনা এবং প্রকাণ্ড। নিচের ধড়টা ঝোপের ভেতর বলে বোঝা যাচ্ছে না কেমন। সবচেয়ে অদ্ভুত ওদের চোখ। তেকোনা মাথায় দুটো গোল রঙিন কাচের মতো মস্ত চোখের রং কখনও লাল, কখনও নীল, কখনও হলুদ হয়ে উঠছে।
আমার মাথায় পলকে ভেসে এল, ওরা যেন অতিকায় পিঁপড়ে। কিন্তু পিঁপড়েরা কি অমন খাড়া দাঁড়াতে পারে মানুষের মতো?
ভয় হল, ওরা আমাকে আক্রমণ করবে না তো? তাই রাইফেল তাক করলুম।
অমনি প্রাণীগুলো গা ঢাকা দিল পাথরের আড়ালে। বুঝলুম, জিম কেন ভয় পেয়েছে এও বুঝলুম, ঘাসের গুলতিগুলোও কারা ছুড়ছিল।
বেলা দুটোয় কর্নেল এবং ডঃ প্রসাদ ঘেমে-তেতে ফিরলেন। নেকুরের লেজের ডগাটুকুও দেখতে পাননি। তবে ওয়াকিমো পাহাড়ে অনেকটা চিনে ফেলেছেন। পাহাড়টা যত দুর্গম দেখায়, তত কিছু নয়। সহজে ওঠা যায়, এবং যতদূর খুশি ঘোরাঘুরি করা যায়।
ঘাসের গুলতি আর পিঁপড়ে-মানুষের কথা শুনে প্রাণীবিজ্ঞানী ডঃ প্রসাদ তো ভীষণ উত্তেজিত। কর্নেল বললেন, বোঝা গেল, কেন ভেগা দ্বীপ ভূতুড়ে দ্বীপ বলে বিখ্যাত অথবা কুখ্যাত হয়েছে। কবছর আগে এক জাহাজের কাপ্তেন আমাকে এখানকার পিঁপড়ে-মানুষের কথা বলেছিলেন, বিশ্বাস করিনি। এখন দেখা যাচ্ছে কথাটা সত্যি।
ডঃ প্রসাদ বললেন, কর্নেল! নেকুর থাক। বরং আমরা পিঁপড়ে-মানুষের দিকে মন দিই।
আমি বললুম, একটা কথা আমি বুঝতে পারছি না। এই ঘাসের গুলতির রহস্যটা কী?
কর্নেল বললেন, এগুলো পিঁপড়ে- মানুষদের অস্ত্র। পোকামাকড় ওদের খাদ্য। এই গুলতি ছুঁড়ে ওরা পোকামাকড়কে কাবু করে। বুঝলে?
হাসতে হাসতে বললুম, ব্যাটারা আমাদেরও গুলতি ছুঁড়ে কাবু করবে ভেবেছে। একটা মানুষের মাংসে ওদের বছর চলে যাবে কি না!
ষষ্ঠীচরণ একটু তফাতে দাঁড়িয়ে কান খাড়া করে কথা শুনছিল। আতঙ্কে সে বলে উঠল, ওরে বাবা!
কর্নেল সকৌতুকে বললেন, ষষ্ঠী। তোমার গা-গতর দেখে ওদের বেজায় লোভ হয়েছে মনে হচ্ছে। নইলে প্রথম তোমার ওপর গুলতি ছুড়ল কেন ওরা?
ষষ্ঠীচরণ আরও ভয় পেয়ে করুণ স্বরে শুধু বলল, ওরে বাবা।
কিছুক্ষণ পরে কর্নেল আর ডঃ প্রসাদ একটা ফাঁদ নিয়ে বেরুলেন। যেখানে আমি পিঁপড়ে-মানুষদের দেখেছি, সেখানে কোথাও ফাদটা পেতে রাখবেন। সঙ্গে ষষ্ঠীচরণকেও নিয়ে
গেলেন। সে দা দিয়ে কুপিয়ে জঙ্গল সাফ করে চলার রাস্তা বানাবে। দুর্গম জঙ্গল!
আমি রইলুম তাঁবুর পাহারায়। জিম সেই যে তাঁবুর ভেতর খাটের তলায় ঢুকেছে, আর বেরুনোর নাম করে না। তার ওপর রাগ হচ্ছিল। খুব বকাবকি করলুম তাকে ভীতু বলে। শাসালুম, কলকাতায় ফিরে বেচে দেব ব্যাটাচ্ছেলেকে। জিম গ্রাহ্য করল না। শুধু গলার ভেতর সেই চাপা কান্নার মতো আওয়াজ করল। এ বিকেল নেমেছে। গুলিভরা রাইফেল কাঁধে রেখে সতর্ক দৃষ্টে চারপাশে লক্ষ্য রেখে সান্ত্রীর মতো পায়চারি করছিলুম।
দূরে একপাল হরিণ চরছিল! মাথার ওপর ঝাঁকে ঝাঁকে সামুদ্রিক পাখি উড়ে যাচ্ছিল। একসময় উত্তরদিকে জঙ্গলের মাথার ওপর একটা প্রকাণ্ড বেলুন দেখতে পেলুম। হলুদ রঙের বেলুনটা নিঃশব্দে ওদিকে কোথাও আস্তে আস্তে নামছে।
অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলুম। বেলুনটা গাছপালার আড়ালে অদৃশ্য হলে ব্যস্ত হয়ে উঠলুম। এই নির্জন আজব দ্বীপে বেলুন নামাটা বড় রহস্যময়।
তাঁবুর দরজায় পর্দা শক্ত করে বেঁধে তক্ষুণি বেরিয়ে পড়লুম ব্যাপারটা দেখতে। যেদিকে পিঁপড়ে-মানুষ দেখেছিলুম, এটা তার উল্টো দিক। ওদিক দিয়েই আমরা এ দ্বীপে ঢুকেছি। আমাদের হেলিকপ্টার ওদিকে সমুদ্রতীরে বালির বিচে নেমেছিল। যখন আমাদের দ্বীপ ছেড়ে যাওয়ার সময় হবে, তাঁবুর ভেতর রাখা বেতার যন্ত্রে খবর পাঠাবেন কর্নেল। তাহলে ওঁর বন্ধু এক সামরিক অফিসার হেলিকপ্টারটা নিয়ে আসবেন দ্বীপে।
জিমকে নাড়ানো যাবে না। তা না হলে ওকে সঙ্গে নিয়ে যেতুম।
জঙ্গলের ভেতর দৌড়ে চললুম। একটু পরেই জঙ্গলের ওধারে ঢালু পাহাড়ি জমি নিচে সমুদ্রের বিচে গিয়ে মিশেছে। সেখানে দাঁড়িয়ে দেখি, বেলুনটা চুপসে বালির ওপর পড়ে রয়েছে। বেলুনের তলায় দড়িদড়া থেকে ঝুলন্ত প্রকাণ্ড বাস্কেটের মতো আসন। একটা বেঁটে গাব্দা মোটা লোক সবে বেরুচ্ছে। তার চেহারা চিনাদের মতো। কোমরে বাঁধা একটা লম্বাটে রিভলভার। লোকটাকে দেখে পছন্দ হল না। কেমন খুনেমার্কা চেহারা।
বেলুন সেভাবেই পড়ে রইল। লোকটা এদিকে ঘুরে ঢালু জমিটা বেয়ে উঠতে থাকল। তখন আমি ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে পড়লুম।
সে জঙ্গলে ঢুকে পশ্চিমে এসে গেল। তাকে অনুসরণ করতে থাকলুম। ফাঁকা মাঠের দিকে না। গিয়ে সে সমুদ্রের সমান্তরালে জঙ্গলের ভেতরে চলেছে। কিছুক্ষণ পরে সে দাঁড়াল। এদিক-ওদিক তাকিয়ে পাথরের ওপর উঠল। তারপর তিনবার হাততালি দিল।
জঙ্গলের ভেতর ছায়া ততক্ষণে আরও ঘন হয়েছে। তবু স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি ওর ক্রিয়াকলাপ। মিনিটখানেক পরে যা দেখলুম, আমার তো চক্ষু চড়কগাছ। এ কি স্বপ্ন না সত্যি সত্যি ঘটছে!
পাথরের ওপাশ থেকে একদঙ্গল পিঁপড়ে মানুষের আবির্ভাব ঘটেছে।
লোকটা প্যান্টের পকেট থেকে মুঠো মুঠো কী সব জিনিস ছড়িয়ে দিল। আর পিঁপড়ে-মানুষগুলো কাড়াকাড়ি করে তা কুড়িয়ে খেতে থাকল। একটু পরে লোকটাকে দেখলুম ওদের সঙ্গে চলেছে। আমি আড়ালে-আড়ালে কিছুটা এগিয়ে গেলুম। কিন্তু পাথরের কাছে এসে ওদের হারিয়ে ফেললুম। ওরা যেন বেমালুম উবে গেছে।
এদিক-ওদিক সাবধানে খোঁজাখুঁজি করেও ওদের পাত্তা পেলুম না। ততক্ষণে পশ্চিমে ওয়াকিমো পাহাড়ের আড়ালে চলে গেছে সূর্য। জঙ্গল থেকে দক্ষিণে এগিয়ে ফাঁকা মাঠটায় পৌঁছলুম। তাঁবুর দিকে প্রায় দৌড়ে চললুম। জিমের জন্য ভাবনা হচ্ছিল।
আমার তাঁবুর সামনে গিয়ে থমকে দাঁড়াতে হল। দরজার পর্দা ছেড়া। শুধু ছেড়া নয়, কুটিকুটি করে কেটে কেউ বা কারা ছড়িয়ে রেখেছে।
ভেতরে ঢুকে চেঁচিয়ে ডাকলুম, জিম! জিম!
জিমের সাড়া নেই। ক্যাম্প-খাটের তলা ফাঁকা; টর্চ জ্বেলে তাঁবুর ভেতরটা ভাল করে দেখে নিলুম। জিম নেই।
রাগে দুঃখে বাইরে বেরিয়েছি। কর্নেলদের সাড়া পাওয়া গেল। সন্ধ্যার আবছা আলোয় ওঁদের দেখা যাচ্ছিল। কথা বলতে বলতে হেঁটে আসছেন তাঁবুর দিকে।
কর্নেল তাঁর ধুরন্ধর গোয়েন্দাবুদ্ধি প্রয়োগ করে সিদ্ধান্তে এসেছেন, পিঁপড়ে-মানুষরাই জিমকে চুরি করে নিয়ে গেছে। তাকে উদ্ধার করতে হলে পিঁপড়ে-মানুষদের ডেরা খুঁজে বের করতে হবে। কর্নেলের ধারণা, জিমকে মেরে ফেলা ওদের উদ্দেশ্য নয়। অন্য কোনও উদ্দেশ্য আছে। আপাতত সেটা বোঝা যাচ্ছে না।
এ রাতেও জ্যোৎস্না ছিল। আমরা চুপিচুপি একটা কাজ সেরে ফেললুম। সমুদ্রতীরের সেই বেলুনটা গুটিয়ে ধরাধরি করে নিয়ে এলুম তাঁবুতে। তারপর পালাক্রমে রাইফেল হাতে পাহারা দিলুম। কিন্তু রাতে কোনো ঘটনা ঘটল না।
ভোরবেলা কর্নেল একা বেরিয়েছিলেন। ফিরে এসে জানালেন, ব্যাটাচ্ছেলেরা ফঁদটাকে কুটিকুটি করে কেটেছে। তবে লুকিয়ে রাখা ক্যামেরায় ছবিগুলো উঠেছে। কর্নেলের ক্যামেরার কীর্তিকলাপ আমার জানা। অন্ধকারেও ছবি তুলতে ওস্তাদ।
ছবিগুলো প্রিন্ট করে দেখালেন। পিঁপড়ে-মানুষেরা ফাঁদ কীভাবে দাঁত দিয়ে কাটছে, তার পরিষ্কার ছবি উঠেছে।
ব্রেকফাস্ট সেরে আমি, কর্নেল ও ডঃ প্রসাদ বেরিয়ে পড়লুম উত্তরদিকের জঙ্গলে—যেখানে কাল সন্ধ্যায় বেলুনের লোকটাকে অদৃশ্য হতে দেখেছি।
সেই পাথরের কাছে গিয়ে দিনের আলোয় একটা ব্যাপার দেখতে পেলুম। পাথরের গায়ে সাদা আঁকিবুকি রয়েছে। পিঁপড়ে-মানুষদের ছবি আঁকার শখ? নাকি ওতে কিছু লেখা রয়েছে? তাহলে স্বীকার করতে হয়, ওরা মানুষের মতো লেখাপড়াও করে।
প্রাণীবিজ্ঞানী ডঃ প্রসাদ হেসে উড়িয়ে দিলেন। কর্নেল হাঁটু গেড়ে প্রায় হামাগুড়ি দিয়ে মাটিতে ও ঘাসে কিছু খুঁজছিলেন। ওই অবস্থায় বাঁ দিকে এগিয়ে আরও একটা বড় পাথরের কাছে গিয়ে চাপা গলায় বলে উঠলেন, পেয়েছি! পেয়েছি!
ডঃ প্রসাদ বললেন, কী পেয়েছেন কর্নেল?
কর্নেল কোনও জবাব না দিয়ে পাথরটার ওপর উঠতে শুরু করলেন। তারপর দেখি, উনি হঠাৎ উপুড় হয়ে শুয়ে পড়লেন। কিছুক্ষণ কী দেখার পর ইশারায় আমাদের ডাকলেন, ডঃ প্রসাদ আর আমি পাথরে উঠে ওঁর মতো উপুড় হতেই এক বিচিত্র দৃশ্য দেখতে পেলুম।
পাথরের ওদিকে ঢালু হয়ে মাটিটা নেমে গেছে এবং একটা বিশাল গর্তের মতো সমতল জায়গায় অসংখ্য প্রকাণ্ড উইঢিবির মতো রয়েছে। ঢিবির দরজা আছে এবং জানালায় মতো ফোকরও আছে কয়েকটা, একখানে ভিড় করে দাঁড়িয়ে আছে একদল পিঁপড়ে-মানুষ। মধ্যিখানে একটা বেদিমতো উঁচু জায়গা। সেখানে দাঁড়িয়ে আছে একটা লাল পিঁপড়ে-মানুষ। ওর মাথায় ঘাসের মুকুট। মুকুটে রঙিন পালক গোঁজা এবং একটা উজ্জ্বল মণির মতো কী জিনিস—তা থেকে সূর্যের আলো ঠিকরে পড়ে চোখে ধাঁধিয়ে দিচ্ছে।
তার চেয়েও আশ্চর্য ব্যাপার, বেদির নীচে ঘাসের মোটা দাঁড়িতে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা অবস্থায় পড়ে আছে বেলুনের লোকটা।
আমরা দম আটকানো ভঙ্গিতে উপুড় হয়ে শুয়ে ওই আজব দৃশ্য দেখতে থাকলুম। তারপর কানে এল, পিঁপড়ে-মানুষেরা পোকামাকড়ের ডাকের মতো চাপা ক্ষীণ শব্দে কথাবার্তা বলছে। সে শব্দ এত চাপা যে মনে হচ্ছে, অনেক দূরে কোথাও হাজার হাজার পোকামাকড় ডাকছে।
তারপর যা দেখলুম, আমি লাফিয়ে উঠতে যাচ্ছিলুম আর কী কর্নেল টেনে ধরে ফের শুইয়ে দিলেন।
সামনেকার একটা ঢিবিঘর বেশ বড়ো—প্রায় ফুট ছয়েক উঁচু এবং ফুট তিনেক চওড়া। সেটার রঙ পাটকেলে। সেটা নিশ্চয় রাজার বাড়ি। সেখান থেকে চ্যাংদোলা করে পিঁপড়ে-রক্ষীরা আমার জিমকে বের করে আনছিল।
পেছনে আরেকটা লাল পিঁপড়ে-মানুষ। নিশ্চয় রানি। কিন্তু জিম যেন মরা। টুকটুক করে তাকাচ্ছে। নির্জীব অবস্থা।
রানি বেদিতে উঠে রাজার পাশে দাঁড়াল। জিমকে পিঁপড়ে রক্ষীরা তাদের পায়ের কাছে বেদির ওপর শুইয়ে দিল। কিন্তু আশ্চর্য, জিম ছাড়া পেয়েও তেমনি নির্জীব হয়ে পড়ে রইল।
এবার রানিকে দেখলুম দুহাত তুলে জোরে নাড়ছে। তারপর ঢিবি রাজবাড়ির দরজা দিয়ে বেরিয়ে এল একটা অদ্ভুত প্রাণী। ধূসর-রঙের হায়েনার মতো দেখতে। কিন্তু অত কুৎসিত নয়। বরং নেকড়ে বলে মনে হল। পিঁপড়ে রানির মাথাতেও মুকুট আছে। মুকুটে ফুল গোঁজা। রানি একটা ফুল মুকুট থেকে নিয়ে একটু ঝুঁকে দাঁড়াল। প্রাণীটা বেদিতে উঠে খপ করে ফুলটা মুখে পুরল। চিবুতে থাকল। তারপর জিমের গা শুকতে শুরু করল।
ডঃ প্রসাদ উত্তেজিতভাবে ফিসফিস করে বললেন, নেকুর! নেকুর!
নেকুর তাহলে পিঁপড়ে-মানুষদের কাছে পোষ মেনেছে! আবাক হয়ে নেকুর দেখতে থাকলুম। জন্তুটা জিমকে যেন আদর করছে। জিম তেমনি নিঃসাড়।
জিমের চারপাশে ঘুরে নেকুরটা খেলা করতে থাকল। সবাই এবার ভিড় করে খেলা দেখছিল। ঢিবিঘরগুলো থেকে ছোটবড় সব পিঁপড়ে-মানুষ ভিড় জমিয়েছে ততক্ষণে। এইসময় কর্নেল ফিসফিস করে বললেন, সাবধানে নেমে এস তোমরা। ঢিবিঘরগুলোর পেছনে গিয়ে লুকিয়ে থাকো। তারপর কী করতে হবে, বলে দেবখন।
সাবধানে তিনজনে পাথরের টুকরো আর খাঁজের অড়ালে নিচে নেমে গেলুম। বুঝলাম এই সমতল বিশাল গর্তমতো জায়গাটা কোনও যুগের আগ্নেয়গিরির ক্রেটার। ঢিবিঘরের পেছনে ঝোপের আড়ালে তিনজনে বসে পড়লুম।
তারপর দেখি, কখন ওদের অজান্তে বেলুনের লোকটা দড়ির বাঁধন খুলে ফেলেছে। সে উঠে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাক করে বেমক্কা রিভলভার থেকে গুলি ছুড়ল পরপর দুবার।
পলকের মধ্যে হুলস্থুল পড়ে গেল। পিঁপড়ে মানুষেরা পিলপিল করে এদিকে ওদিকে ক্রেটারের কিনারায় ঢালু পাড়া বেয়ে উঠল এবং পালিয়ে গেল। রাজা ও রানি যেন হতভম্ব! স্থির দাঁড়িয়ে রয়েছে। লোকটা বেদির ওপর লাফ দিয়ে উঠল এবং রাজার মুকুট ধরে টানাটানি শুরু করল।
নেকুরটা জিমকে নিয়েই ব্যস্ত ছিল। এবার আকমকা গর্জন করে ঝাঁপিয়ে পড়ল নোকটার ওপর। রিভলভার ছিটকে পড়ল নীচে। নেকুরটা ওর গলা কামড়ে ধরেছে! লোকটা বিকট আর্তনাদ করে হাত-পা ছুড়ছে।
কর্নেল বলে উঠলেন—চলে এস সবাই!
আমরা যেই দৌড়ে গেছি, রাজা-রানি তীরের মতো ছুটল উল্টোদিকে। বেদির কাছাকাছি পৌঁছনোর সঙ্গে সঙ্গে নেকুরটাও দৌড়ে পালিয়ে গেল। কর্নেল বেলুনের লোকটার কাছে হাঁটু দুমড়ে বসলেন। ওর গলাটা ফাঁক হয়ে গেছে। গলগল করে রক্ত বেরোচ্ছে। ওকে বাঁচানোর উপায় ছিল না। এক মিনিটের মধ্যে হাত-পা খিচিয়ে ওর দেহটা শক্ত হয়ে গেল। সেই বীভৎস দৃশ্য থেকে চোখ ফিরিয়ে নিলুম।
জিম আমাকে দেখে এতক্ষণে ওঠার চেষ্টা করল। পারল না। ওকে দুহাতে বুকের কাছে তুলে নিলুম। ওর শরীর থরথর করে কাঁপছিল।
কর্নেল লোকটার পকেট হাতড়ে একটা নোটবই পেলেন। চিনা ভাষায় কী সব লেখা আছে। নোটবইটা নিজের পকেটে ঢুকিয়ে কর্নেল বললেন, আসুন ডঃ প্রসাদ, আমরা এখান থেকে কেটে পড়ি। বেচারি পিঁপড়ে-মানুষদের বিব্রত করে লাভ কী? ওদের কচি বাচ্চারা নিশ্চয় ঘরে আছে। ওরা না ফিরলে না খেয়ে মারা পড়বে।
ঠিক তাই। ঢিবিঘরের দরজায় খুদে পিঁপড়ে-মানুষেরা উঁকি দিচ্ছিল। দেখে মায়া হয়। আমরা চলে এলে ওদের মা-বাবা ফিরে এসে খেতে দেবে। এ-বেলা হয়তো বেলুনের লোকটার মাংস দিয়েই পিঁপড়েপুরীতে বড়রকমের একটা ভোজ হবে।
তাঁবুতে ফিরে দেখি আরেক কাণ্ড। ষষ্ঠীচরণ বন্দী। কিচেন-তাঁবুর ভেতর তার ক্যাম্পখাটে ওকে কারা আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছে। যা দিয়ে বেঁধেছে, তা শক্ত ঘাসের দড়ি। ও ফ্যালফ্যাল করে তাকচ্ছে। মুখে কথা নেই।
কর্নেল একটা ছুরি দিয়ে বাঁধন কেটে ওকে মুক্ত করলেন। তখন ষষ্ঠীচরণ উঠে দাঁড়িয়ে আড়মোড়া ভাঙল এবং জব্বর একটা হাই তুলল।
বললুম, ব্যাপার কী ষষ্ঠী?
ষষ্ঠীচরণ বলল, খুব ঘুম পেয়েছিল স্যার!
তার জবাব শুনে অবাক হয়ে বললুম, কিন্তু তোমায় এমন করে বেঁধেছিল কারা?
এতক্ষণে ষষ্ঠীচরণের যেন খেয়াল হল। কাটা দড়িগুলো দেখে নিয়ে বলল, তাহলে আমাকে সত্যি সত্যি বেঁধেছিল ব্যাটাচ্ছেলেরা? আমি ভাবছি, স্বপ্ন দেখছিলুন। ওরে বাবা! এ কী বিদঘুটে জায়গায় এসে পড়েছি।
কর্নেল হাসতে হাসতে বললেন, তুমি নিশ্চয় আরাম করে খাটে শুয়েছিলে?
ষষ্ঠীচরণ জিভ কেটে বলল, অন্যায় হয়ে গেছে স্যার। মাফ করে দিন। আপনারা যাওয়ার পর ঢুলুনি পেয়েছিল। ভাবলুম একটু শুয়ে নিই। রাত্তিরে তরাসে ঘুম হয় না কিনা!
কর্নেল বললেন, ভাগ্যিস, তোমাকে পিঁপড়ে-মানুষেরা ধরাধরি করে জিমের মতো বয়ে নিয়ে যায়নি! তাহলে আজ দুপুরের খাওয়া-দাওয়া আর জুটত না আমাদের।
ষষ্ঠীচরণ ভয় পেয়ে বলল, ওরে বাবা! তারপর সে ব্যস্তভাবে উনুন ধরাতে গেল।
আমরা কর্নেলের তাঁবুতে গেলুম। ডঃ প্রসাদ বললেন, লোকটার নোটবইয়ে নিশ্চয় সব কথা লেখা আছে। চিনা ভাষা জানলে ভাল হত। কিন্তু …
কথা কেড়ে কর্নেল বললেন, আমি অল্পস্বল্প জানি চিনাভাষা। দেখি, কী লেখা আছে।
কর্নেল মিনিট দশেক ধরে নোটবইটা নিয়ে মেতে রইলেন। আমরা দুজনে চুপচাপ কৌতুহল নিয়ে বসে রইলুম। তারপর কর্নেল বললেন, লোকটার নাম সান ওয়ানসু। হংকং-এ বাড়ি। কীভাবে ভেগা দ্বীপের পিঁপড়ে-মানুষদের কথা জেনেছিল, লেখা নেই। তবে এটুকু লেখা আছে, মোট তিনবার এসেছে এর আগে। পিঁপড়ে-মানুষদের রাজার মুকুটে যে বহুমূল্য মণি দেখেছি, আমরা, সান ওয়ান-সু ওটা হাতাতে চেয়েছিল।
ডঃ প্রসাদ বললেন, ওদের সঙ্গে ভাব করল কীভাবে, লেখা নেই?
কর্নেল বললেন, আছে। প্রথমবার এসে ওদের গতিবিধি জেনে গিয়েছিল আড়াল থেকে। দ্বিতীয়বার সঙ্গে এনেছিল একটা প্রকাণ্ড কেক।
বললুম, কেক দিয়ে পিঁপড়ে-মানুষদের সঙ্গে ভাব করেছিল? ভারি বুদ্ধিমান তো।
কর্নেল বললেন, হ্যাঁ। তৃতীয়বার সঙ্গে এনেছিল এক বস্তা চিনি।
বললুম, কিন্তু এবার তার সঙ্গে কিছু ছিল না। আমি দেখছি!
কর্নেল হাসলেন। বললেন, এই চতুর্থবার সে যা এনেছিল, তা বেলুনের বাস্কেটে এখন আছে। ওই যে দেখছ প্যাকেট বাঁধা জিনিসটা, ওটা লজেঞ্জুস।
আমরা সবাই একসঙ্গে হেসে উঠলুম। কর্নেল ফের বললেন, প্যাকেটটা সঙ্গে নিয়ে কেন যায়নি, একটু ভাবলেই বোঝা যায়। আমার মনে হচ্ছে, পিঁপড়ে-মানুষদের রাজাকে সে সমুদ্রের ধারে তার বেলুনের কাছে নিয়ে যেতে চেয়েছিল। হয়তো বলেছিল, ওখানে গেলেই রাজাকে উপহারটা দেবে। তার মতলব ছিল, ওইভাবে ডেকে নিয়ে গিয়ে মণিটা কেড়ে নিয়ে বেলুনে চড়ে পালাবে। কিন্তু পিঁপড়ে-মানুষেরা বুদ্ধিমান। ওর মতলব টের পেয়েছিল।
আমার বুদ্ধি খেলল এবার। বললুম, উঁহু। তা নয়। বেলুনটা আমরা নিয়ে এসেছিলুম বলে সমুদ্রের ধারে গিয়ে যখন পিঁপড়ে-মানুষরা কিছু পায়নি, তখন রেগে গিয়ে ওকে বন্দি করেছিল।
কর্নেল সায় দিলে বললেন, মন্দ বলোনি জয়ন্ত। সম্ভবত …
কর্নেলের কথা হঠাৎ বন্ধ হল। উনি কোণের দিকে গুটিয়ে রাখা বেলুনটার দিকে হঠাৎ এগিয়ে গেলেন। তারপর বলে উঠলেন, সর্বনাশ! বেলুনের অবস্থাটা কী করেছে! কুটিকুটি করে রেখে গেছে যে!
আমি ও ডঃ প্রসাদ হুমড়ি খেয়ে দেখতে লাগলুম। বেলুনের ভাজকরা রবারটা আর আস্ত নেই। ঝাঁঝরা হয়ে রয়েছে। তার মানে বেলুনটা আর ওড়ানো যাবে না। দোলনার মতো বাস্কেটটা টিকে আছে। তার মধ্যে বসার আসন, লজেন্সের প্যাকেট, অল্পস্বল্প কলকজা রয়েছে। পিঁপড়ে-মানুষেরা সে সব ছোঁয়নি। লজেন্সের প্যাকেটটা অন্তত নিয়ে পালানো উচিত ছিল। কেন নেয়নি?
ডঃ প্রসাদ একটু হেসে বললেন, আমরা লজেন্সগুলো দিয়ে ওদের সঙ্গে ভাব করব। কী বলেন কর্নেল?
কর্নেল গম্ভীর মুখে বললেন, ওই লজেন্সে তীব্র বিষ মেশানো আছে, ডঃ প্রসাদ।
আমরা দুজনে আঁতকে উঠলুম, সে কী! কীভাবে বুঝলেন?
কর্নেল বললেন, ওই দেখ, কত খুদে পিঁপড়ে আর পোকামাকড় মরে পড়ে রয়েছে। তাই দেখে পিঁপড়ে-মানুষেরা প্যকেটটা ছোঁয়নি। এবার আশা করি বুঝতে পারছ, লোকটাকে কেন ওরা অমন
আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে শাস্তি দিচ্ছিল।
ডঃ প্রসাদ বললেন, সর্বনাশ! পিঁপড়ে-মানুষেরা দেখছি ভারি ধূর্ত। আমরা বেরিয়ে গেছি, আর ওরা সেই ফাঁকে এতসব কাণ্ড করেছে। তার মানে, ওরা সারাক্ষণ আমাদের চোখে-চোখে রেখেছে। কিন্তু ওদের আস্তানা থেকে আমরা এতদূরে রয়েছি। আমরা ওদের অস্তানায় পৌঁছনোর আগেই অত তাড়াতাড়ি কীভাবে ওরা এখানে এল এবং ফিরে গেল?
কর্নেল বললেন, সেটা একটা রহস্য বটে। আমার মনে হচ্ছে এখানে কোথাও একটা সিধে পথ আছে, মাটির তলায়-তলায়। অর্থাৎ পিঁপড়ে-মানুষদের বসতি এখান থেকে উত্তর-পশ্চিম কোণে মাইলটাক দূরে। ওদিকটা জঙ্গল আর পাহাড়ে বড় দুর্গম দেখাচ্ছে।
এই সময় হঠাৎ জিম একটা চাপা-গরগর আওয়াজ করল। আগের আতঙ্ক মেশানো আওয়াজ। তারপর এক বিচিত্র দৃশ্য দেখলুম।
আমাদের সামনে খোলামেলা ঘাসের মাঠে আচম্বিতে পিলপিল করে কালো রঙের পিঁপড়ে-মানুষ যেন মাটি খুঁড়ে বেরুল। অসংখ্য জায়গা থেকে অসংখ্য পিঁপড়ে মানুষ আর তাদের
সঙ্গে সেই নেকুরের পাল।
বুঝলুম অজস্র গর্ত ছিল। ঘাসের আড়ালে। ওগুলো সুড়ঙ্গপথ। সেখান দিয়ে বেরিয়ে গোটা মাঠ জুড়ে একটা মোটা কালো রেখার মতো দাঁড়িয়ে আছে ওরা সামনে একটা করে নেকুর নিয়ে একজন করে পিঁপড়ে-মানুষ। নিশ্চয় ওরা সেনাবাহিনী।
তারপর দীর্ঘ সেই কালো রেখা অর্ধবৃত্তাকার হয়ে এগিয়ে আসতে থাকল আমাদের দিকে। কতক্ষণ হতবাক হয়েছিলুম কে জানে! হঠাৎ কর্নেল চেঁচিয়ে উঠলেন, সমুদ্রের কাছে চলো সবাই! সমুদ্রের কাছে! তারপর দৌড়ে তাঁবুতে গিয়ে ঢুকলেন।
কখন ষষ্ঠীচরণ রান্না ফেলে আমাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। সে বলে উঠল, ওরে বাবা!
আমি রুদ্ধশ্বাসে বললুম, রাইফেল এনে গুলি ছুড়ি কর্নেল!
কর্নেল তাঁবুর ভেতর থেকে শুনতে পেয়ে বললেন, না জয়ন্ত; গুলি করে ওদের শেষ করে যাবে না। সারা দ্বীপের মাটির তলায়-তলায় দুর্গের মতো কোটি কোটি পিঁপড়ে-মানুষ রয়েছে মনে হচ্ছে; এস, সবাই সমুদ্রের দিকে পালাই।
আমরা চারজনে সব কিছু ফেলে পুবে সমুদ্রের দিকে দৌড়ে চললুম। কর্নেল শুধু বেতার যন্ত্রটা সঙ্গে নিয়েছেন দেখা গেল।
যখন বিচে পৌঁছলুম, তখন আমাদের দম আটকানো অবস্থা। বুঝতে পারছিলুম না, এখানে কীভাবে ওদের হাত থেকে বাঁচব। এদিকে সমুদ্র অনেকটা শান্ত! কর্নেল সোজা জলে নেমে গিয়ে ডাকলেন, এস জয়ন্ত। আসুন ডঃ প্রসাদ। আমরা এখন নিরাপদ।
ষষ্ঠীচরণ কর্নেলের দিকেই জলে নেমেছে। ঢেউয়ের ঝাঁপটায় কোমর অব্দি ভিজে যাচ্ছে। ওদের। আমি ডঃ প্রসাদও ওদের কাছে গেলুম। বললুম, কর্নেল! আমরা এখানে কীভাবে নিরাপদ? ওই তো ওরা এগিয়ে আসছে।
কর্নেল বেতার যন্ত্রের চাবি ঘুরিয়ে কোন বেতার ধরে রেখেছিলেন। বললেন, ওরা জলকে বড় ভয় পায়।
জিমকে আমি দুহাতে বুকের কাছে ধরে রেখেছি। সে থরথর করে কাঁপছে। বিচের ওধারে উঁচু ঝোপঝাড়ের ভেতর থেকে নেমে আসছে পালে পালে নেকুর। বীভৎস তাদের মুখভঙ্গি। জিভ লকলক করছে। পিঁপড়ে-মানুষেরা তিড়িং-বিড়িং করে নাচতে নাচতে আসছে ওদের পেছন-পেছন!
বিচের বালিতে এসে ওরা থমকে দাঁড়াল।
কর্নেল বেতার যন্ত্রে কার সঙ্গে কথা বলছিলেন। শুনলুম উনি বললেন, হা-হা, ভেগা আইল্যান্ড। শীগগির হেলিকপ্টার নিয়ে আসুন। আমরা বিপন্ন।
ষষ্ঠীচরণ চোখ বুজে ঠকঠক করে কাঁপছে একহাঁটু জলে। জিম আমার বুকে মুখ লুকিয়েছে। ডঃ প্রসাদ বিড়বিড় করে বলেছেন, আহা! ক্যামেরাটা আনলে কত ভাল হত! কেউ কি বিশ্বাস করবে আমাদের কথা?
কথাটা কানে যেতেই কর্নেল প্রায় আর্তনাদ করে বললেন, ওই যাঃ! আমার ক্যামেরাটা আর কি ফিরে পাবো? কী ভুলো মন আমার!
উজ্জ্বল রোদে সোনালি বিচের ওপর পালে পালে জিভ বের করা নেকুর আর অসংখ্য পিঁপড়ে-মানুষ একইভাবে দাঁড়িয়ে।
ঘরের ছেলে বেঁচে-বর্তে ভেগা আইল্যান্ড থেকে ঘরে ফিরতে পেরেছিলুম, এই যথেষ্ট! দিন সাতেক পরে পোর্টব্লেয়ার থেকে কর্নেল তাঁর বন্ধু, বিমানবাহিনীর সেই জাঁদরেল অফিসারের সাহায্যে হেলিকপ্টারে চেপে ভেগা দ্বীপে তার অত্যদ্ভুত ক্যামেরা আর আমার রাইফেলের খোঁজে পাড়ি জমিয়েছিলেন। কিন্তু কোথায় ভেগা দ্বীপ? দ্বীপটা যেন বেমালুম তলিয়ে গেছে ভারত মহাসাগরে। অনেক ওড়াউড়ি করে তারা ফিরে আসেন।
এখন কর্নেল বলেন, তাহলে কি আমরা চারজনেই একইরকম বিদঘুটে স্বপ্ন দেখেছিলুম?
ষষ্ঠীচরণ বলে, তা আর বলতে?
আমিও সায় দিয়ে বলি, ঠিক ঠিক। স্বপ্নই বটে। তবে যদি ক্যামেরা বা রাইফেল হারায়, তাহলে তো বড় রহস্যের ব্যাপার। ও কর্নেল, জীবনে এত রহস্যের সমাধান করেছেন, এটা করবেন না?
কর্নেল উদাসভাবে শুধু বলেন, তাই তো!