শেয়ালের ফাঁদ
জয়রামবাবু বললেন, মানুষের মতো মানুষের মুখের ভাষাকেও রোগে ধরে। ষট্গর্ভ কথাটা রোগে ভুগে দাঁড়িয়েছে সাতগড়ায়। এ যেন সুকুমার রায়ের গল্পের মতো ছিল রুমাল, হয়ে গেল বেড়াল! ছিল ষট্রগর্ভ হয়ে গেল সাতগড়া!
খিকখিক করে হাসতে হাসতে লাগলেন আমাদের গৃহস্বামী জয়রাম সিঙ্গিমশাই। এখন আমরা অবশ্য ওঁর গৃহে নেই। ওঁর ফার্ম চক্কর দিয়ে অধিক ফলনশীল ভুট্টাক্ষেতের পাশে একটা নালার ধারে প্রকাণ্ড পাথরে বসে আছি। ডাইনে টিলার মাথায় সূর্য কাত হয়ে গড়াচ্ছে। শেষবেলার নরম রোদে সবুজ শস্য এবং গাছগাছালি ঘুম ঘুম চোখে দাঁড়িয়ে আছে! বাতাস বইছে না। কিন্তু গরমটা কমে গেছে। বাস! এখানে জুনমাসে কী প্রচণ্ড গরম, কল্পনা করা যায় না। এই গরমে কর্নেলের মাথায় বিদঘুটে বাতিক গজিয়ে উঠল। সাতগড়া নিয়ে এলেন টানতে টানতে। এসে থেকে মনটা খালি পালাই পালাই করছে।
সিঙ্গি মশাইয়ের বয়স বোধ করি বাহান্ন-পঞ্চান্নর মাঝামাঝি হবে। চেহারায় পোড় খাওয়া ভাব আছে। স্বাস্থ্যও চমঙ্কার। গায়ে ছাইরঙা স্পোর্টস গেঞ্জি, পায়ে গামবুট, মাথায় নীলচে রোদ-টুপি। একটা গাঁট্টা মারকুটে চেহারার কালো অ্যালসেশিয়ানের চেন ওর ডান হাতের মুঠোয়। বাঁহাতে একটা ছড়ি। কুকুরটা মাঝে মাঝে মুখ তুলে কী যেন দেখছে আর ছুটে যেতে চেষ্টা করছে। আতঙ্কে তার দিকে নজর রেখেছি। কুকুরটা আমার দুচক্ষের বিষ। হতচ্ছাড়া প্রাণীটা যেন তা টের পেয়েছে এবং দু-একবার মনিবের পায়ের কাছ থেকে ঘাড় বেঁকিয়ে লাল চোখে আমাকে গরগর করে শাসাচ্ছে।
আশ্চর্য, কুকুরটা কর্নেলের হাঁটুর কাছটা শুকছে। বুড়োকে কেন ওর অত পছন্দ হয়ে গেল ভেবেই পাচ্ছি না। সে কি ওঁর সায়েবি চামড়া আর সাদা দাড়ির জন্য? শালুক চিনেছে। গোপালঠাকুর!
জয়রামবাবু গর্ভের কাহিনী বলছেন। আমার চোখ-কান-মন কুকুরটার দিকে। একটু পরে কী ভাবে কুকুরটা ছাড়া পেয়ে গেল কে জানে! চেনসুন্ধু দৌড়ে গেল বেঁটে চওড়া পাতাওয়ালা গাছগুলোর দিকে। জায়গাটা ঘন ঘাস, ঝোপঝাড় আর শুকনো পাতায় ঢাকা। জয়রামবাবু একবার ধমক দিলেন, জনি! কাম ব্যাক। তারপর একটু হেসে বললেন, দেখুন না মজাটা! চেন কোথাও আটকে গিয়ে জব্দ হবে।
কুকুরটা ততক্ষণে গতি কমিয়ে একখানে গিয়ে থেমেছে এবং জিভ বের করে সামনে তাকিয়ে। জয়রামবাবু, বললেন, হ্যাঁ—যা বলছিলুম। ষটগর্ভ। তার মানে ছটা গুহা। ওই যে প্রায় ন্যাড়া পাহাড়টা দেখছেন দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে, ওখানেই আছে পাশাপাশি ছটা গুহা। পাঁচটা গুহাই ভেতরে ধস ছেড়ে বন্ধ হয়ে গেছে কোন যুগে! একটা অক্ষত আছে।
জিজ্ঞেস করলুম।ভেতরে ঢুকেছেন নাকি?
সিঙ্গিমশাই বললেন, যতবার ঢোকার চেষ্টা কেউ করেছে, ততবারই সাপের তাড়া খেয়ে পালিয়েছে। আমাকে তো তাড়া করে আমার ফার্ম অবধি এসেছিল। সে কে মারাত্মক অভিজ্ঞতা।
কী সাপ?
শঙ্খচূড়। জয়রামবাবু একটু হাসলেন। বললেন, গুলি করে মেরে ফেলিনি কেন? আপনারা তো দেখেছেন, বিষধর সাপ আমি মারি না, ধরি। এক্সপেরিমেন্ট করি। বিশেষ করে ওই শঙ্খচূড় সাপটাকে ধরার জন্য কত যে চেষ্টা করেছি, ব্যর্থ হয়েছি। সাপটা মশাই মানুষের চেয়ে ধূর্ত। কর্নেল সায়েবি এবার যদি কিছু করতে পারেন।
বলে উনি কর্নেলের দিকে ঘুরলেন। আমিও ঘুরে কর্নেলের দিকে তাকালাম। ওহে ধুরন্ধর ঘুঘু বুড়ো, তাই তোমার এই ভয়ঙ্কর জুন মাসে সাতগড়া আগমন। চোখে চোখ পড়লে প্রকৃতিবিদ বৃদ্ধ কাঁচুমাচু হাসলেন। তারপর একটু কেশে বললেন, ইয়ে—মিঃ সিংহ, আপনারা গল্প করুন। আমি নালার ধারটা ঘুরে আসি।
পাথরটা থেকে লাফ দিয়ে নেমে সোজা নালার ধারে কর্নেল কিছুটা এগোলেন। তারপর হাঁটু দুমড়ে বসলেন। তারপর ওঁর চিরাচরিত খেলা শুরু হয়ে গেল। একবার এদিকে একবার ওদিকে গুড়ি মেরে এগোচ্ছেন, কখনও কাত হয়ে প্রায় শুয়ে পড়েছেন ঘাসের ভেতর-এবং চোখে বাইনোকুলার। অ্যালসেশিয়ানটা হকচকিয়ে গেছে যেন বুড়োর কাণ্ড দেখে। গরগর করে দুঠ্যাঙে বসে দুঠ্যাঙে দাঁড়িয়ে কুকুরী পদ্ধতিতে।
সিঙ্গিমশাই অবাক হয়ে বললেন, কী ব্যাপার বলুন তো জয়ন্তবাবু?
মুচকি হেসে বললুম আবার কী? কোনও বিরল প্রজাতির পাখি-টাখি দেখেছেন।
তাই বলুন। বলে জয়রামবাবু প্যান্টের পকেট থেকে পাইপ বের করলেন।
আমার চোখ কর্নেলের দিকে যতটা না, ততটা কুকুরটার দিকে। একটু পরে দেখি, কর্নেল বেঁটে গাছগুলোর দিকে দৌড়ুচ্ছেন। ফাঁকা ঘাসজমিটায় গিয়েই কর্নেল আচমকা অদৃশ্য হয়ে গেলেন। আমি দারুণ চমকে উঠলুম। এ যে অবিশ্বাস্য ব্যাপার! চারদিকে অনেকটা ফাকা ওখানে। জলজ্যান্ত একটা মানুষকে জাদুকর যেমন স্টেজে অদৃশ্য করে দেয়, এও যেন তেমনি।
জয়রামবাবুও পাইপ সাফ করতে করতে দেখেছিলেন ব্যাপারটা। ওঁর চোখে-মুখে বিস্ময় ফুটে উঠতে দেখলুম। শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে বলে উঠলেন, সর্বনাশ! অ্যালসেশিয়ান ততক্ষণে কর্নেলের শূন্যে মিলিয়ে যাওয়ার জায়গায় পৌঁছে গেছে এবং গরগর করে ঘাস শুকছে। জয়রামবাবু পাথর থেকে লাফ দিয়ে দৌড়তে শুরু করলেন। আমিও ভ্যাবাচাকা খেয়ে ওঁকে অনুসরণ করলাম।
ঘাসজমিটায় প্রচুর শুকনো পাতা পড়ে রয়েছে। দুপুরের গরম হাওয়াই গাছগুলো থেকে শুকনো পাতা ঝেটিয়ে এনে জড়ো করে সম্ভবত! একখানা দেখি, পাতার জুপ বেজায় নড়ছে। জয়রামবাবু চেঁচিয়ে উঠলেন, কর্নেল! কর্নেল!
সেই স্তূপের ভেতর থেকে নাকিস্বরে আওয়াজ এল, এই যে এখানে।
জয়রামবাবু ছড়ির ডগা দিয়ে পাতাগুলো সরালে নিচে একটা টাকওয়ালা মাথা দেখা গেল—নিঃসন্দেহে সেই প্রখ্যাত গোয়েন্দাপ্রবর এবং অধুনা যিনি প্রকৃতিবিদ, তাঁরই বহুমূল্য ঘিলু ওই মাথার ভেতরই রয়েছে। একটা গভীর গর্ত থেকে যখন ওকে টেনে তুললুম, তখন ওর রূপ বদলে গেছে। আপাদমস্তক কাদার সঙ্গে শুকনো পাতা আর ঘাসের কুটো মেখে সে এক আজব মূর্তি।
কুকুরটাও গরগর করে হেসে উঠল। আমিও হাসি চাপতে পারলুম না কিন্তু জয়রামবাবু দুঃখিত মুখে বলতে থাকলেন, আমারই ভুল হয়ে গেছে! ছি ছি! আপনাকে সাবধান করে দেওয়া উচিত। ছিল—ওখানে শেয়ালের ফাঁদ পেতে রেখেছি। শেয়ালগুলো বড় জ্বালাতন করে কিনা। কচি আখ নষ্ট করে। ভুট্টার ক্ষেতে ঢুকে খামোকা ভুট্টাগুলো দাঁতে কেটে পয়মাল করে দেয়।
কর্নেল দাড়ি থেকে শুকনো পাতা সাফ করতে করতে গোমড়ামুখে বললেন, চলুন ফেরা যাক। তারপর কয়েক পা এগিয়ে বাচ্চা ছেলের মতো হি হি করে হেসে উঠলেন। হাসিটা ক্রমশ বদলাতে থাকল। হা হা হা হা ……তারপর হো হো হো হো….সে কী বিকট হাসি। এমন হাসি কস্মিনকালে এই রাশভারি লোকটিকে হাসতে দেখিনি। দমফাটানো হাসিটা বেড়ে চলেছে। জয়রামবাবু এবং আমি এবার একটু চমকে গেছি। কর্নেলের কি সেই বিদঘুটে হাসিরোগে ধরল? শেয়ালের ফাঁদে পড়ে কি সেই মারাত্মক অসুখের জীবাণু ঢুকে গেছে কর্নেলের শরীরে? কিছুক্ষণ পরে আমাদের উৎকণ্ঠা দূর করে কর্নেল হাসি থামালেন। তারপর বললেন স্নান করব।…
সাপের মাথার মণি
রাতে খাওয়ার টেবিলে জয়রামবাবু কর্নেলের সঙ্গে পাহাড়ের গুহার সেই শঙ্খচূড় সাপটাকে ধরার ফন্দিফিকির নিয়ে আলোচনা করছিলেন। কর্নেলের মতে, সাপটাকে আহত না করে ধরার একমাত্র উপায় হচ্ছে আঠা ব্যবহার। গুহার কাছাকাছি কোথাও অনেকটা আঠা ছড়িয়ে রাখলে কাজ হতে পারে। মানুষের পায়ের শব্দে সাপটি যদি বেরিয়ে আসে, আঠায় আটকে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। তখন একটা দড়ির ফাঁস পরাতে পারলে আর অসুবিধে হবে না।
জয়রামবাবুর মনে ধরল কথাটা। বললেন, তাহলে কাল সকালেই সম্বলপুর গিয়ে আঠা আনব। ওখানে আঠা তৈরির কারখানা আছে।
কর্নেল বললেন, আমিও বরং সঙ্গে যাব। সম্বলপুরে আমার এক বন্ধু আছেন দেখা করে আসা যাবে। তারপর আমার দিকে ঘুরে বললেন, জয়ন্ত ততক্ষণ নদীর ধারে গিয়ে সিনারি দেখবে। মহানদীর বুকে অনেক আশ্চর্য গড়নের পাথর দেখতে পাবে ডার্লিং। ওড়িশার বহু ভাস্কর্য সেইসব পাথর দিয়ে গড়া।
মনে মনে খাপ্পা আমি। একা এই ফার্মহাউসে সময় কাটানোর কথা ভাবা যায় না। মহানদীর ধারে যাব কী। আটটা বাজতে না বাজতে রোদ একেবারে আগুন হয়ে উঠবে। গায়ে ফোস্কা পড়ে যাবে।
বললুম, আচ্ছা জয়রামবাবু, শঙ্খচূড় সাপটা নিয়ে কী এক্সপেরিমেন্ট করবেন বলুন তো?
জয়রামবাবু মুচকি হেসে বললেন, প্রমাণ করব যে, সাপের মাথায় সত্যি মণি জন্মায়। লোকে বলে, অজগরের মাথায় নাকি মণি জ্বলে। বিলকুল মিথ্যে। অজগর হল পাইথনই। নির্বিষ পাইথনের মাথায় মণি হবে কোন দুঃখে? কয়লা থেকে যেমন হীরের জন্ম, তেমনি প্রচণ্ড বিষ থেকে মণির জম্ম। যে-সে মণি নয়, নীলকান্ত মণি। হীরের মতোই মণি দারুণ বিষাক্ত।
কিন্তু কী করে বুঝলেন শঙ্খচূড়টার মাথায় মণি আছে?
রহস্যময় ভঙ্গিতে কর্নেলের দিকে চেয়ে চাপা হেসে জয়রাম সিঙ্গি বললেন, দেখেছি। ইচ্ছে করলে আপনিও দেখতে পারেন, যদি রাতবিরেতে ফার্মের শেষ দিকটায় গিয়ে ওত পাতেন। পাহাড়ের গায়ে নীল ছটা ঝিকমিক করছে দেখতে পাবেন। মশাই, ঝিনুকের পেটে মুক্তো হয়। হাতির মাথার ভেতরে গজমোতি হয়। সাপের মাথাতেও মণি হয়। সবই প্রকৃতির সৃষ্টি। এতে অবাক হওয়ার কী আছে?…
অনেক রাতে কর্নেলের ডাকে ঘুমের আমেজ কেটে গেল। ফ্যানের হাওয়া ভ্যাপসা গরম ছড়াচ্ছে ঘরে। সাড়া দিয়ে বললুম, কী ব্যাপার?
কর্নেল চাপা গলায় বললেন, সাপের মাথার মণি দেখবে কি ডার্লিং? তাহলে আমার সঙ্গে চুপচাপ বেরিয়ে এস।
দরজাটা ভেজিয়ে রেখে আমরা বেরোলুম। এদিকটায় ফার্মহাউসের ফুল-ফলের বাগান। একেবারে অন্ধকার। কর্নেলের এত লুকোচুরির কারণ খুঁজে পাচ্ছিলাম না। বাগানে ঢোকার পর বাড়ির ভেতর অ্যালসেশিয়ানটার গজরানি শোনা যাচ্ছিল। একটু পরে থেমে গেল। ততক্ষণে অন্ধকারে দৃষ্টি পরিষ্কার হয়েছে। দেখলুম আমরা একটা পুকুরের ধারে এসে গেছি। দিনে পুকুরপাড়ে কলা আর পেঁপের গাছ দেখেছিলাম। তার ভেতর ঢুকে কর্নেল ফিস ফিস করে বললেন, আমাকে ছুঁয়ে এস পেছনে। সাবধান, শুকনো পাতা আছে। আস্তে পা ফেলবে।
ভয়ে ভয়ে বললুম, শেয়ালের ফাঁদ নেই তো?
কর্নেল নিশ্চয় হাসছিলেন নিঃশব্দে। কিছুটা চলার পর ফাঁকায় পৌঁছে দেখি, একটু তফাতে। আলো জ্বলছে কোনও বাড়িতে। সর্বনাশ! ওটাই তো সিঙ্গিমশাইয়ের সাপ-ঘর। সকালে কিছুক্ষণ সর্পদর্শন করে শোচনীয় অবস্থা হয়েছিল আমার। অসংখ্য সাপ কাচের বড়-বড় কফিনের মতো বাক্সে কিলবিল করছে। ওখানেই কি সাপের মণি দেখতে নিয়ে যাচ্ছেন কর্নেল?
আলোটা আসছিল জানালার ফাঁক দিয়ে। কর্নেল সেই ফাঁকে চোখ রেখে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলেন। উত্তেজনায় আমার বুক কাঁপছে। তারপর কর্নেল সরে এসে কানে কনে বললেন, যাও, দেখে এসো! পা টিপে টিপে এগিয়ে ফাকটায় চোখ রেখে দেখি, জয়রামবাবু একটা টেবিলের সামনে বসে আছেন। তার গলায় একটা সাপ জড়ানো। সাপটা ফণা তুলছে মাঝে মাঝে এবং কাঁধ ঘুরে পিঠে, আবার পিঠ থেকে বুকের দিকে নেমে আসছে। দেখে গা শিরশির করছিল আতঙ্কে। টেবিলের অন্যদিকে বসে আছে একটা রোগা এবং একটা বেঁটে মোটাসোটা লোক। তাদের দেখে মোটেও ভালমানুষ মনে হল না। চাপাগলায় জয়রামবাবু কী সব বলছেন বুঝতে পারলুম না। লোকদুটো চুপ করে আছে। টেবিলের ওপর দুটো প্যাকেট রয়েছে। একটা প্যাকেট থেকে জয়রামবাবু কয়েকটা ক্যাপসুল বের করলেন। সেই সময় কর্নেল এসে আমাকে সরিয়ে ফাকটা দখল করলেন। আমি ওঁর পাশে দাঁড়িয়ে রইলুম। মাথামুণ্ডু কিছু বুঝতে পারছিলুম না ব্যাপারটা।
জয়রামবাবু কি নিষিদ্ধ মাদকদ্রব্যের চোরাকারবার করেন? মনে এই সন্দেহ দানা বাঁধছিল। তাছাড়া রাত দুপুরে এভাবে দুটো লোকের সঙ্গে ক্যাপসুলের প্যাকেট নিয়ে কথা বলার কী কারণ থাকতে পারে?
সাতপাঁচ ভাবছি এবং ততক্ষণে উত্তেজনার ফলে ক্লান্তিও বোধ করছি, এমন কময় কর্নেল সরে এসে আমার কাঁধে হাত রাখলেন। তারপর কানে কানে বললেন, পেছন-পেছন এস।
এবার পুকুরপাড়ে না গিয়ে সোজা বাঁহাতি এগিয়ে একফালি সরু রাস্তায় পৌঁছুলুম। রাস্তাটা নক্ষত্রের আলোয় সাদা দেখাচ্ছিল। রাস্তার ওপাশে গাছ-পালা ঝোপঝাড় কালো হয়ে আছে। একটুও বাতাস বইছে না। রাস্তাটা ফার্ম এলাকার দক্ষিণ প্রান্তে ঘুরে পশ্চিমে চলেছে। কতক্ষণ পর সেই নালার কাঠের সাঁকোয় গিয়ে কর্নেল বললেন, কিছু বুঝলে?
ভদ্রলোক নিষিদ্ধ ড্রাগের চোরাকারবার করেন মনে হচ্ছে।
ওগুলো মাদক নয়। কর্নেল আস্তে বললেন। ওই ক্যাপসুলের মধ্যে আছে ভয়ঙ্কর ভাইরাস। সাপের বিষের সঙ্গে শেয়ালের ক্ষত থেকে একরকম জীবাণু নিয়ে মিশিয়ে জয়রাম সিঙ্গি ওই মারাত্মক ভাইরাস বা জীবাণু সৃষ্টি করতে পেরেছে। লোকটার বৈজ্ঞানিক প্রতিভা আছে সন্দেহ নেই। কেসময় বিদেশের একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে আণবিক জীববিজ্ঞানের গবেষণা করত শুনেছি।
অবাক হয়ে বললুম, ওই ভাইরাস দিয়ে কী করবেন সিঙ্গি মশাই?
কোনও দেশের ফসলের মাঠে কয়েকটা ক্যাপসুল ভেঙে ছড়িয়ে দিলে সব ফসলে রোগ ধরে যাবে। ইচ্ছে করলে দেশে দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি করা যাবে। মাঠের পর মাঠ যদি ফসলে রোগ ধরে যায়, তাহলে কী সাংঘাতিক অবস্থা হবে বুঝতে পারছ? তাছাড়া জল সংক্রামিত হয়ে মহামারীও হওয়া বিচিত্র নয়। বুঝতেই পারছ, কোনও শত্রুদেশের সরকার এমন সাংঘাতিক অস্ত্রের জন্য প্রচুর টাকা দিতে রাজি হবে।
সর্বনাশ! এর কোনও প্রতিষেধক নেই?
জানি না। থাকলে জয়রাম সিঙ্গির কাছেই তার ফরমুলা থাকতে পারে।
আপনি কেমন করে জানলেন?
বিশ্বস্তসূত্রে। বলে কর্নেল হঠাৎ ঘুরে দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে হাত তুললেন। ওই দেখো, জয়ন্ত। সাপের মাথার মণি জ্বলছে ষট্গর্ভ পাহাড়ের গায়ে।
তাকিয়ে দেখি, দূরে উঁচুতে একটা নীল আলোর বিন্দু ঝিকমিক করছে। ওটা নক্ষত্র নয়, তা ঠিকই। কিন্তু ওটা সত্যি যে শঙ্খচূড় সাপের মাথার মণি, তার প্রমাণ কী?
আমাদের মনের কথাটা বুঝি টের পেলেন ধুরন্ধর গোয়েন্দপ্রবর। কাঁধে হাত রেখে মৃদুস্বরে বললেন, ডার্লিং। এই পৃথিবীতেই বহু রহস্যময় জিনিস আছে, যা হঠাৎ চোখে পড়লে মানুষের আক্কেল গুড়ুম হয়ে যায়। যাকগে, এস। এবার গিয়ে ঘুমোনো যাক…
হায়েনার কান্না
সকালে কর্নেল জয়রামবাবুর সঙ্গে সম্বলপুর গেলেন জিপে চড়ে। মাইল ছয়েক দূরত্ব। আমি বেরোলুম না। রাতে ভাল ঘুম হয়নি। ভাবলুম সকালটা ঘুমিয়ে কাটানো যাবে। কিন্তু মনের ভেতর অস্বস্তি। এই ভয়ঙ্কর লোকের আতিথ্যে আর এক মুহূর্ত কাটাতে ইচ্ছা করছে না। উঠে গিয়ে বারান্দায় বসলুম। সামনে ফার্মের সবুজ শস্যক্ষেত। হঠাৎ দেখি, ভুট্টাক্ষেত থেকে রাতে দেখা সেই বেঁটে মোটা লোকটা বেরিয়ে আসছে। তার হাতে অ্যালসেশিয়ানের চেন। কুকুরটা লাল জিভ বের করে পেছনে-পেছন আসছে। তাহলে রাত সাপঘরে দেখা দুটো লোকই সিঙ্গিমশাইয়ের কর্মচারী। রোগা লোটাকে একপলক দেখেছিলুম সকালে। পুকুরপাড়ে দাঁড়িয়ে দাঁত ব্রাশ করছিল।
ডোরাকাটা গেঞ্জি আর জিনসের প্যান্টপরা বেঁটে লোকটা আসতে আসতে থমকে দাঁড়াল। অ্যালসেশিয়ানটা লাফ দিয়ে ঘুরল। লোকটাও ঘুরে কান খাড়া করে কী শুনল। কুকুরটা এবার তাকে টানতে টানতে ফের ভুট্টাক্ষেতের ভেতর নিয়ে গেল। জয়রামবাবু বলেছিলেন, ফার্মের ফসলে মাঝেমাঝে দিনদুপুরে বুনো, শুয়োর, কখনও হরিণের পাল, এমনকী সংরক্ষিত বনজঙ্গল থেকে হাতির দলও এসে হানা দেয়। শেয়ালের ভুট্টা নষ্ট করার কথাও বলছিলেন তাই ভুট্টাক্ষেতের শেষ দিকটায় উঁচু মাচানে পাহারার ব্যবস্থা আছে। মাচানটা গাছের আড়ালে দেখতে পাচ্ছি না। কিন্তু এবার কানে এল ঢং ঢং ঢং করে ক্যানেস্তারা পেটানোর শব্দ হচ্ছে। ফার্মহাউস থেকে কয়েকজন লোককে দৌড়ে যেতে দেখলুম। তারা চ্যাঁচাতে চাচাতে ভুট্টাক্ষেতে গিয়ে ঢুকল। প্রত্যেকের হাতে লাঠি বল্লম টাঙ্গি। খুব উত্তেজনার ব্যাপার, আমি বারান্দা থেকে নেমে গাছতলায় দাঁড়ালুম। হাতির পাল নিশ্চয় নয়, হরিণ কি শুয়োর হতে পারে।
এমন সময় সেই রোগা লোকটা এল। রাতে লোকটাকে কেমন বদমাশ দেখাচ্ছিল। এখন দেখি, ভারি অমায়িক চেহারা। মুখে বিনয়ের হাসি। বলল, শেয়ালের ফাঁদে কোনও জন্তু পড়েছে। দেখতে যাবেন নাকি স্যার?
ব্যাপারটা দেখতেই হয়। ওর সঙ্গে যেতে যেতে জিগ্যেস করলুম, আপনি কি ফার্মের কর্মচারী?
সে বলল, হা স্যার। আমার নাম রতনকুমার পাত্র। আমি সিঙ্গি সায়েবের ল্যাবরেটরি অ্যাসিস্ট্যান্ট।
রতনকুমার আমাকে ভুট্টাক্ষেতে ঢোকাল না। পাশ দিয়ে এগিয়ে নালার ধারে নিয়ে গেল। এখানেও একটা কাঠের সাঁকো আছে। সাঁকোতে একটু থেমে সে চাপা গলায় বলল, আমাকে কর্নেল সায়েব অনেকদিন থেকে চেনেন। তবে এ কথাটা দয়া করে এখানে কাউকে যেন মুখ ফসকে বলবেন না।
খুব অবাক হয়ে গেলুম। তাহলে কি সেই ভয়ঙ্কর ভাইরাস রহস্যের বিশ্বস্ত সূত্র এই লোকটিই?
কাল যেখানে কর্নেল ফাঁদে পড়েছিলেন, সেখান গোল হয়ে লোকগুলো দাঁড়িয়ে আছে। কেউ কেউ বল্লম দিয়ে কোনও প্রাণীকে ফাঁদের গর্তে খোঁচাচ্ছে এবং হতভাগ্য প্রাণীটা কোঁ-কে করে আর্তনাদ করে উঠছে। দৃশ্যটা বীভৎস। অ্যালসেশিয়ানটা গর্তের দিকে ঝুঁকে ক্রমাগত গর্জন করছে। বেঁটে লোকটা তাকে আটকে রেখেছে কোনওরকমে। বললুম, থাক। আর যাব না। জন্তুটা কী দেখে আসুন তো রতনবাবু।
রতনকুমার দৌড়ে গিয়ে দেখে এসে বলল, হায়েনা। সিঙ্গিসায়েব এবার হায়েনা নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করার সুযোগ পাবেন?
হায়েনাটা ওরা মেরে ফেললে কী করে সুযোগ পাবেন?
রতনকুমার হাসল। মারবে না। তবে হায়েনাটার গায়ে দগদগে ঘা করে দেওয়া হবে। তাই এমন করে বল্লম দিয়ে খোঁচাচ্ছে দেখছেন না?
ওই বেঁটে ভদ্রলোক কে বলুন তো?
ওর নাম জগদীশ। এলাকায় সবাই জগাগুণ্ডা বলে। এখন সিঙ্গিসায়েবের ডান হাত।
কথা বলতে বলতে আমরা ফিরে এলুম ফার্মহাউসে। রতনকুমার সাপ ঘরটার দিকে চলে গেল। ওকে যগর্ভ পাহাড়ের সাপ আর আলোটার কথা জিগ্যেস করব ভাবছিলুম। ও এমন হঠাৎ করে চলে গেল যে সে সুযোগই পেলুম না। সাপঘরের দিকে প্রাণ গেলেও যাব না। সাপ দেখলেই আমার গা গুলোয়।
দুর্ভাগা হায়েনাটার জন্য মন খারাপ হয়ে গেল। হায়েনাকে নিরীহ প্রাণী বলা যায়, যদিও তার নামে শিশুচুরির বদনাম রটে। বনে জঙ্গলে বহুবার হায়েনার ডাক শুনেছি। মানুষের পৈশাচিক হাসির মতো কতকটা। কিন্তু এবার হায়েনার কান্না শুনতে পেলুম!….
শঙ্খচূড়ের আবির্ভাব
দুপুরের আগেই কর্নেল ও জয়রামবাবু ফিরে এলেন। প্রচুর আঠা এনেছেন। খাওয়া-দাওয়ার পর কর্নেল, জয়রামবাবু জগদীশ আর রতন সেই পাহাড়ের দিকে রওনা হল। আমিও সঙ্গ ধরলুম। প্রচণ্ড রোদ তখনও। তবে গাছপালার ভেতর দিয়ে যেতে তত কষ্ট হচ্ছিল না। দুটো টিনভর্তি তরল আঠা বয়ে নিয়ে যাচ্ছিল জগদীশ আর রতন।
পাহাড়টা দূর থেকে যত ন্যাড়া ভেবেছিলুম, ততটা নয়। বেঁটে চ্যাপ্টা পাতাওয়ালা কিছু গাছও আছে। তবে পাহাড়ের গায়ে নানা আকারের সব পাথর। তার আড়ালে শঙ্খচূড় থাকা খুবই সম্ভব। জয়রামবাবু সবার আগে। বারবার সাবধান করে দিচ্ছিলেন। আমি পেছনে। সবসময় মাটিতে এপাশ-ওপাশে নজর রেখে উঠছি।
কিছুটা নিচে দাঁড়িয়ে কর্নেল বাইনোকুলারে চোখ রেখে অনেকক্ষণ গুহার মুখটা দেখলেন। তারপর বললেন, আমার সঙ্গে বরং এই ভদ্রলোক আসুন টিন নিয়ে। রতনকে দেখালেন কর্নেল।
জয়রামবাবু কেমন হেসে বললেন, রতন কেন, জগদীশকে নিন আপনি। জগদীশ খুব সাহসী লোক। রতন ভীতু। আর আমিও বারবার শঙ্খচূড়টার তাড়া খেয়েছি, আমার বুক ঢিপঢিপ করছে। ও জয়ন্তবাবু, আপনি বরং এখানেই থাকুন। কাজ নেই মশাই গুহার কাছে গিয়ে। : কর্নেল জগদীশকে সঙ্গে নিয়ে উঠে গেলেন গুহার দিকে। আমার ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছিল। জয়রামবাবু ডাকলেন, এস রতন, আমরা বরং গুহার ওপাশটায় আঠাটা ছড়িয়ে আসি।
একটা উঁচু পাথরে ঝটপট উঠে দাঁড়ালুম। রতন ও জয়রামবাবু বাঁ-পাশ দিয়ে উঠে বড় বড় পাথরের আড়ালে অদৃশ্য হলেন। কিন্তু কর্নেল ও জগদীশকে দেখতে পাচ্ছিলুম। জগদীশ আঠার টিনটি নামিয়ে রেখেই প্রায় দৌড়ে আমার কাছে চলে এল। কর্নেল আঠাটা ছড়াচ্ছেন না। বাঁ দিকে তাকিয়ে আছেন কেন বুঝতে পারলুম না। একটু পরে হঠাৎ জয়রামবাবুর বিকট চিৎকার শোনা গেল, সাপ! সাপ! পরই কর্নেলকে দেখলুম পকেট থেকে রিভলভার বের করে বাঁদিকে ছুটে গেলেন। পাথরের ওপর দাঁড়িয়ে আমি ঠকঠক করে কাঁপতে থাকলুম।
জগদীশ এক লাফে নিচে নামল। তারপর প্রায় গড়াতে গড়াতে পাহাড় বেয়ে নামতে থাকল।
এবার যা দেখলুম, চোখকে বিশ্বাস করতে পারলুম না। গুহার ভেতর থেকে একদঙ্গল পুলিশ বেরিয়ে এল। তারা বন্দুক পিস্তল উঁচিয়ে বাঁদিকে দৌড়ে গেল।
এতো দেখছি ছিল রুমাল, হয়ে গেল বেড়ালের মতো ব্যপার। ছিল শঙ্খচূড় সাপ, হয়ে গেল পুলিশ।
আর দাঁড়িয়ে থাকা অসম্ভব। ভয় পাওয়াও চলে না। হাঁপাতে হাঁপাতে গুহার কাছে উঠে গেলুম। ডাইনে ঘুরে দেখি তাজ্জব ব্যাপার। জয়রাম সিঙ্গির হাতে হাতকড়া পরিয়ে পুলিশের দল নেমে যাচ্ছে পাহাড় থেকে।
কর্নেল আমাকেই খুঁজছিলেন সম্ভবত। দেখতে পেয়ে ইশারায় ডাকলেন। কাছে গিয়ে বললুম, এ কি ভেলকির খেলা কর্নেল!
কর্নেল একটু হেসে বললেন, আর একটু দেরি হলে রতন বেচারাকে বাঁচাতে পারতুম না! সিঙ্গি ওর গায়ে সাপের বিষের ইনজেকশান দিতে যাচ্ছিল।
কর্নেল নামতে থাকলেন পাহাড় থেকে। বললুম, কী সাংঘাতিক লোক!
কর্নেল বললেন, সিঙ্গি টের পেয়েছিল রতন আমাকে চিঠি লিখে সব জানিয়েছে। অতি-চালাক এবং শয়তান কি না! তাই শঙ্খচূড় ফাঁদ পেতেছিল। আমার উপস্থিতিতেই রতনকে খুন করত এবং আমাকে বোকা বানাত। ওর সিরিঞ্জে জোড়া সুচ আছে। বিষাক্ত সাপের দাঁতের চিহ্ন এবং পোস্টমর্টেমে রক্তে সাপের বিষও পাওয়া যেত। আসলে নৃশংস জ্বর জয়রাম সিঙ্গি এভাবে আমার ওপরও প্রতিশোধ নিতে মতলব করেছিল। তাই আমাকে একটা মিথ্যা শঙ্খচূড় সাপ ধরার অনুরোধ করে এসেছিল কলকাতা গিয়ে। হ্যাঁ, সাপের মাথার মণিটা আসলে একটা নীল ক্ষুদে বার্। কাল সকালে পাখি দেখতে বেরিয়ে ওটা আবিষ্কার করেছিলুম।
ফার্মহাউসে ফিরে দেখি, পুলিশে ছয়লাপ। সাপঘরে তল্লাশি করে সেই ক্যাপসুলগুলো উদ্ধার করা হয়েছে। পুলিশ সুপার আশংকর শর্মার জিপে আমরা সম্বলপুর রওনা হলুম। পথে হঠাৎ শেয়ালের ফাঁদটার কথা মনে পড়ল। জিগ্যেস করলুম, শেয়ালের ফাঁদে পড়ার পর আপনার অত হাসির কারণ কী কর্নেল?
কর্নেল মুচকি হেসে বললেন, কেউ কেউ আমাকে আড়ালে বুড়োঘুঘু বলে ডাকে। শেয়ালের ফাঁদে পড়ার পর মনে হয়েছিল এবার কি তাহলে পুরনো খেতাব বাদ দিয়ে বুড়ো শিয়াল বলে ডাকবে? তবে শেয়াল খেতাব মন্দ না। শেয়াল অতিশয় ধূর্ত প্রাণী। এই ভেবেই হাসি এসে গিয়েছিল। বলে কর্নেল কালকের মতো আবার হাসিতে ফেটে পড়লেন।
হাসি সংক্রামক। সুতরাং আমরা জিপসুদ্ধ লোক হো হো করে হাসছিলুম। অবশ্য ড্রাইভার বাদে।
গাড়ি চালানোর সময় তার হাসতে মানা। তাছাড়া তার চেহারাও ছিল বেজায় বদরাগী।