প্রাইভেট ডিটেকটিভ কৃতান্ত কুমার হালদার, সংক্ষেপে কে কে হালদার ওরফে আমাদের প্রিয় হালদারমশাই মন দিয়ে খবরের কাগজ পড়ছিলেন। হঠাৎ খি খি করে হেসে বললেন, খাইছে।
কোনও মজার খবর পড়লেই উনি এই কথাটি নিজের দেশোয়ালি ভাষায় সহাস্যে উচ্চারণ করেন। এবং আমিও ওঁর সঙ্গে মজা করার জন্য বলে থাকি, কে কাকে খেল হালদারমশাই?
এদিন আমার কৌতুকের মেজাজ ছিল না। সল্টলেক থেকে আসার পথে ইস্টার্ন বাইপাসে একটা পাজির পাঝাড়া ট্রাক আমার ঝকমকে গাড়িটার গা ঘষে দিয়ে গেছে। বেশ কিছু টাকা খরচের ধাক্কা। তাই হালদারমশাইয়ের দিকে মন ছিল না।
হালদারমশাই প্যান্টের পকেট থেকে নস্যির কৌটো বের করে একটিপ নস্যি নিলেন। তারপর বললেন, জয়ন্তবাবু কিছু জিগাইলেন না?
এতএব জিজ্ঞেস করতেই হল, খবরটা কী হালদার মশাই?
ছাতা।-বলে তিনি তার লম্বা তর্জনী দিয়ে বিজ্ঞাপনের পাতায় একটা ছোট্ট বিজ্ঞাপনের দিকে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন। লিখেছে : কার্জন পার্কে একটি কালো ছাতা কুড়াইয়া পাইয়াছি। মালিক উপযুক্ত প্রমাণ দিয়া লইয়া যান। গোবর্ধন সর্বাধিকারী। ৩৩/১ নস্কর লেন। কলিকাতা—৬১।
—এতে তো মজার কিছু দেখছি না হালদার মশাই। তা ছাড়া এটা তো বিজ্ঞাপন।
প্রাইভেট ডিটেকটিভ আবার একচোট হেসে বললেন, ছাতার উপযুক্ত প্রমাণ মানে কী? ছাতা নানা সাইজের হয়। একই সাইজের ছাতা অসংখ্য লোকের আছে। আবার সেই অসংখ্য লোকের মধ্যে অনেকেরই কালো ছাতা হারাইতে পারে।…. কী কন কর্নেলসার?
কর্নেল নীলাদ্রি সরকার চুরুট কামড়ে কয়েকটা পোস্টকার্ড সাইজের ছবি নাড়াচাড়া করছিলেন। ওঁর এই জাদুঘর সদৃশ ড্রয়িংরুমে ঢোকার সময়ই দেখে নিয়েছি, ছবিগুলো রংবেরঙের প্রজাপতির। হালদারমশাইয়ের কথা শুনে উনি বললেন, হালদারমশাই কি সুকুমার রায়ের বিখ্যাত সেই গোঁফচুরি পদ্যটা পড়েছেন?
গোঁফচুরি? হালদারমশাই খুব অবাক হয়ে বললেন, গোঁফ চুরি যায় ক্যামনে?
-বলেছিলেন, গোঁফের আমি, গোঁফের তুমি, গোঁফ দিয়ে যায় চেনা। কাজেই ছাতা দিয়েও মানুষ চেনা যায়। ছাতার আমি, ছাতার তুমি, ছাতা দিয়ে যায় চেনা।
হালদারমশাই গম্ভীর হয়ে গেলেন। বললেন, বুঝলাম না।
বুঝতে হলে আপনি এখনই গোবর্ধন সর্বাধিকারীর কাছে গিয়ে কালো ছাতাটি দাবি করুন।
অ্যাঁ? আমার তো ছাতা হারায় নাই।
—ধরুন, হারিয়েছে। এমন লোক নেই, জীবনে যে কখনও ছাতা হারায়নি। প্রাইভেট ডিটেকটিভ হাঁ করে তাকিয়ে ছিলেন। বললেন, কিন্তু উপযুক্ত প্রমাণ?
–ধরুন, বেঁটে কালো একটা ফোল্ডিং ছাতা, মেড ইন জাপান এবং কোম্পানির নাম তাকামিও আকামা।…বিখ্যাত কোম্পানি হালদারমশাই।
হালদারমশাই কেন যেন উত্তেজিত হয়ে উঠলেন। তাঁর গোঁফ তিরতির করে কাঁপতে লাগল। বললেন, কী কোম্পানি কইলেন য্যান? তাকাচ্ছি না—
—তাকামিও আকামা।
প্রাইভেট ডিটেকটিভ বিড়বিড় করে আওড়ে নামটা মুখস্থ করে ফেললেন। তারপর তার মুখে কৌতুক ফুটে উঠল। বললেন, তবে যাই গিয়া!
—হ্যাঁ। এখনই চলে যান। গিয়ে হয়তো দেখবেন নস্কর লেনে লম্বা লাইন পড়ে গেছে।
হালদারমশাই উঠে দাঁড়ালেন। তারপর সবেগে বেরিয়ে গেলেন। দরজার পর্দা বেশ কিছুক্ষণ ধরে দুলতে থাকল।
আমি অবাক হয়ে আমার প্রাজ্ঞ বন্ধুর কাণ্ডকারখানা লক্ষ্য করছিলাম। এতক্ষণে বললাম, হালদারমশাইকে এভাবে একটা কালো ছাতার পেছনে লেলিয়ে দিলেন যে? খামোকা বেচারা
কর্নেল আমার কথার ওপর বললেন, খামোকা নয় ডার্লিং। ইদানীং হালদার মশাইয়ের ডিটেকটিভ এজিন্সির ওপর শনির দৃষ্টি পড়েছে। না—কথাটা আমার নয়, ওঁরই। তুমি আসার আগে উনি তাই নিয়ে দুঃখ করেছিলেন। কোনও রহস্যময় ঘটনা কোথাও ঘটছে না। উনিও তাই হাতে কেস পাচ্ছেন না।
শুনে চমকে উঠেছিলাম। বললাম, এই কালো ছাতার বিজ্ঞাপনে কি আপনি কোনও রহস্যের গন্ধ পেয়েছেন?
বৃদ্ধ প্রকৃতিবিদ তার সাদা দাড়ি থেকে চুরুটের ছাই ঝেড়ে বললেন, জয়ন্ত! তোমাকে একবার বলেছিলাম, কালো জিনিস সবসময় রহস্যময় বলে মনে করা হয়। কালো বেড়াল, কালো কুকুর, কালো
হঠাৎ থেমে উনি টাকে হাত বুলোতে থাকলেন। কালো জিনিসকে মানুষ ভয় পায়। গোবর্ধনবাবুর ভয় পাওয়া স্বাভাবিক।
এইসময় ভেতরের ঘরের পর্দা তুলে ষষ্ঠীচরণ বলল, -বাবামশাই। আর কফি খাবেন নাকি? আমাকে এখনই বাজারের জন্য বেরুতে হবে।
-কফি দিয়ে তুই গোল্লায় গেলেও আপত্তি করব না।
বলে উনি ইজিচেয়ারে হেলান দিয়ে অভ্যাসমতো চোখ বুজলেন। বললাম, কর্নেল। তা হলে মনে হচ্ছে, বিজ্ঞাপনদাতা গোবর্ধন সর্বাধিকারী আপনার কাছে এসেছিলেন এবং আপনার পরামর্শেই বিজ্ঞাপন দিয়েছেন।
কর্নেল মাথা নাড়লেন, নাহ, সশরীরে আসেননি। কদিন আগে উনি টেলিফোন করেছিলেন। একটা কালো ছাতা কুড়িয়ে পেয়ে ভদ্রলোক নাকি সমস্যায় পড়েছেন।
—কী সমস্যা?
কর্নেল চোখ খুলে একটু হাসলেন, সমস্যাটা ভৌতিক।
–তার মানে?
–ছাতাটা বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার পর থেকে নাকি ভূতের উপদ্রব শুরু হয়েছে।
অস্থির হয়ে বললাম, আহা! খুলে বলুন না শুনি।
ষষ্ঠী যে কেটলিতে জল চাপিয়েই পর্দা তুলে কফি খাওয়ার কথা জানতে চাইছিল, সেটা বুঝলাম কারণ সে খুব শিগগির কফি নিয়ে হাজির হল। কফিতে চুমুক দিয়ে কর্নেল বললেন, কোনও বাড়িতে ভূতের উপদ্রবের কতকগুলো ধরাবাঁধা লক্ষণ আছে। রাতদুপুরে ছাদে ধুপধুপ পায়ের শব্দ, কিংবা দরজায় নক করা, কখনও কিছু অদ্ভুত শব্দ—তুমি ভূতের ব্যাপারে নতুন কিছু আশা কোরো না ডার্লিং! এই মহাকাশযুগেও ভূতেদের চরিত্র বদলায়নি।
-হ্যাঁ। আপনি হালদারমশাইকে দেখছি আসলে ভূতের পেছনেই ছোটালেন?
—কী আর করা যাবে? উনি চৌত্রিশ বছর গোয়েন্দা পুলিশে চাকরি করেছেন। অবসর নিয়েও গোয়েন্দগিরির অভ্যাস ছাড়তে পারেননি! তাই আজও অনেক আশা নিয়ে আমার কাছে এসেছেন মনে হচ্ছিল। দেখা যাক, উনি ভূতকে জব্দ করতে পারেন কি না।
হেসে ফেললাম, বরাবর দেখে আসছি, হালদারমশাই গোয়েন্দাগিরি করতে বিভ্রাট বাধিয়ে ফেলেন। নিজেও কম নাকাল হন না। এবারও দেখব, উনি ফেঁসে গেছেন।
কর্নেল আমার কথায় কান না দিয়ে আবার প্রজাপতির ফোটোতে মন দিলেন। এবার ড্রয়ার থেকে আতস কাচ বের করে ফোটোগুলো দেখতে থাকলেন।
কিছুক্ষণ পরে ডোরবেল বাজল। ষষ্ঠী বেরিয়ে গেছে। দরজায় ইন্টারলকিং সিস্টেম আছে। ভেতর থেকে নব ঘুরিয়ে খুলে বেরুনো যায়। কিন্তু বাইরে থেকে ঢুকতে হলে চাবির দরকার হয় কর্নেল বললেন, জয়ন্ত। দেখ তো কে এল?
ড্রয়িংরুমের পর ছোট্ট ওয়েটিংরুম। তারপর বাইরের দরজা। সেটা খুলে দেখি, একজন প্রৌঢ় ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে আছেন। পরনে সাদাসিধে ধুতিপাঞ্জাবি, কাঁধে একটা ব্যাগ ঝুলছে। নমস্কার করে বললেন, আমি একটু কর্নেলসাহেবের সঙ্গে দেখা করতে চাই। জরুরি দরকার আছে।
ওঁকে কিছু জিজ্ঞেস করার সুযোগ পেলাম না। উনি আমাকে পাশ কাটিয়ে ঢুকে পড়লেন। তারপর ড্রয়িং রুমের পর্দা তুলে বললেন, বড় বিপদে পড়ে ছুটে এসেছি সার। আমাকে বাঁচান।
ওঁর পেছন পেছন গিয়ে আমি সোফার কোনার দিকে বসলাম। কর্নেল ওঁকে না দেখেই বললেন, বসুন গোবর্ধনবাবু তারপর কথা হবে।
ভদ্রলোক ধপাস করে বসেই বললেন, আপনি আমাকে কী করে চিনলেন সার?
—আপনার কণ্ঠস্বর শুনে। আপনার কণ্ঠস্বরের একটা বৈশিষ্ট্য আছে। সম্ভবত এর কারণ আপনার টনসিলের অসুখ। কিন্তু আপনি অপারেশন করাতে ভয় পাচ্ছেন।
—আপনি সাক্ষাৎ অন্তর্যামী সার।
নাহ।–কর্নেল এবার ওঁর দিকে ঘুরে বসলেন। বলুন, আবার আপনার কী বিপদ হয়েছে? এই বিপদটা নিশ্চয় ভূতের নয়?
—আজ্ঞে না। মানুষের।
—যেমন?
—আমার বাড়ির সামনে সকাল থেকে লম্বা লাইন পড়ে গেছে। আপনার কথায় বিজ্ঞাপন দিয়ে এই বিপদে পড়েছি সার। কী ভাবে এতলোকের সঙ্গে কথা বলব বলুন? একে তো আমার টনসিলে ব্যথা। তাই পেছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে তালা এঁটে চলে এসেছি। এতক্ষণ হয় তো ওরা হুলস্থূল বাধিয়েছে। আজকাল লোকেদের মতিগতি তো জানেন সার। একটুতেই ভাঙচুর শুরু করে দেয়।
—ছাতাটা আপনি নিয়ে এসেছেন দেখতে পাচ্ছি।
হ্যাঁ সার। ব্যাগে ভরে কী সাবধানে না নিয়ে এসেছি, বলার নয়। এই নিন— বলে গোবর্ধন সর্বাধিকারী ব্যাগ থেকে একটা ছোট্ট কালো ফোল্ডিং ছাতা বের করে কর্নেলকে দিলেন।
কর্নেল ছাতাটা টেবিল রেখে বললেন, এবার আপনি কয়েকটা দিন গা ঢাকা দিন।
গোবর্ধনবাবু অবাক হয়ে গেলেন, আজ্ঞে?
—গা ঢাকা দিন। যদি প্রাণে বাঁচতে চান, অন্যত্র আত্মীয়স্বজন বা বন্ধুবান্ধবের বাড়িতে গিয়ে থাকুন। বাইরে বেরুবেন না কিন্তু। হা—দেরি নয় এখনই। কুইক।
গোবর্ধন সর্বাধিকারী হতবাক হয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। আমিও তেমনই হতবাক হয়ে কর্নেলের দিকে তাকালাম।
কর্নেল এবার ছাতাটা খুলে উল্টোপাল্টে খুঁটিয়ে পরীক্ষা করতে ব্যস্ত হলেন। ভেতরটা আতস কাচ দিয়ে দেখে নিলেন। তারপর ওটা গুটিয়ে ভাঁজ করে বললেন, -গোবর্ধনবাবুর মতো এই ছাতাটারও টনসিলের অসুখ আছে বলে মনে হচ্ছে।
—ছাতার আবার টনসিল থাকে নাকি?
কর্নেল গম্ভীর মুখে বললেন, —ছাতা খুললে শিকগুলো বাঁটের ওপরদিকে উঠে আটকে দিয়ে সেখান থেকে চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে, তার ওপরের অংশটাকে টনসিল বললে মহাভারত অশুদ্ধ হয় না জয়ন্ত। তাকামিও আকামা কোম্পামির এই ছাতার টনসিল যে অসুস্থ, তার কারণ ওটা বেজায় মোটা। ঠাণ্ডা লেগে ফুলে গেছে যেন।
কিছু জিজ্ঞেস করলে আবার হেঁয়ালি শুনতে হবে। তাই চুপ করে গেলাম।
সেদিন সন্ধ্যায় দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকার অফিসে পুলিশসূত্রে পাওয়া একটা ডাকাতির খবর জম্পেশ করে লিখছি, সেই সময় কর্নেলের টেলিফোন এল।
–জয়ন্ত! যত শিগগির পারো, চলে এসো।
—তাকামিও আকামা?
—না, হালদারমশাই।
হাসতে হাসতে বললাম, ভূতের হতে জব্দ হয়ে ফিরেছেন তো?
—জব্দ হয়েছেন এবং ভূতেরা ওঁকে ফিরতে দিচ্ছে না।
—সে কী!
–ফোনে সব কথা বলা যাবে না। চলে এস কুইক।…
খবরটা দ্রুত লিখে চিফ রিপোর্টারের কাছে জমা দিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। সারা রাস্তায়। যেখান-সেখানে যানজট। কর্নেলের বাড়ি পৌঁছতে সাড়ে সাতটা বেজে গেল।
আমি ড্রয়িং রুমে ঢুকে দেখি কর্নেল তৈরি হয়েই আছেন। বললেন, আগে এক পেয়ালা কফি খাও। নার্ভ চাঙ্গা করো। তারপর বেরুব। ষষ্ঠী–।
বললাম, হালদারমশাইয়ের কথা বলুন আগে।
কর্নেল নিভে যাওয়া চুরুট জ্বেলে নিয়ে একরাশ ধোঁয়ার মধ্যে বললেন, তোমাকে ফোন করার একটু আগে হালদারমশাই ফোন করেছিলেন। উনি গোবর্ধনবাবুর ঘরে বন্দি।
-কে ওঁকে বন্দি করল?
নস্কর লেনের পেছনেই একটা কবরখানা। কাজেই ভূতের অভাব নেই।
-ওঃ কর্নেল। প্লিজ। ভূত-টুত বোগাস।
—ভূত ছাড়া কী বলা যাবে? নস্কর লেনে গোবর্ধনবাবুর বাড়ির সামনে থেকে লাইন পড়েছিল। সে এক হুলস্থুল কাণ্ড। পাড়ার বাসিন্দারা অতিষ্ঠ হয়ে পুলিসকে খবর দেয়। পুলিস এসে লাঠি চার্জ করে সবাইকে ভাগিয়ে দেয়। হালদারমশাই পুলিশের তাড়া খেয়ে পাঁচিল ডিঙিয়ে গোবর্ধনবাবুর বাড়িতেই ঢুকে পড়েন। তারপর ওঁর যা স্বভাব!
ষষ্ঠী কফি আনল। কফিতে চুমুক দিয়ে বললাম, তারপর?
–কর্নেল হাসলেন, গোবর্ধনবাবু পেছনের দরজা দিয়ে পালানোর সময় বেডরুমের তালা দিতে সম্ভবত ভুলে গিয়েছিলেন। কারণ দরজায় তালা আটকানো ছিল না। হালদারমশাই গোগায়েন্দাগিরি করতে সেই ঘরে ঢুকে পড়েন। কিছুক্ষণ পরে—ভূত ছাড়া আর কী বলা যাবে, আচমকা বাইরে থেকে দরজা কেউ বন্ধ করে দেয়। এবার অবস্থাটা বোঝো! হালদারমশাই যে কাউকে ডাকবেন, তার উপায় নেই। কারণ অন্যের ঘরে বেআইনিভাবে ঢুকে বসে আছেন। জানলাগুলোও বন্ধ। সুইচ টিপে আলো জ্বলেনি। উনি সিগারেট খান না যে সঙ্গে দেশলাই বা লাইটার থাকবে। ওই অবস্থায় বেলা এগারোটা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত নাকি মশার কামড়। ওঃ! মর্মান্তিক অবস্থা যাকে বলে!
কর্নেল চুপ করলে বললাম, তারপর কী হল বলুন?
—জানলার ফাঁকে বাইরের আলোর ছটা দেখে হালদারমশাই টের পান সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। তখন একটা জানলা একটু ফাঁক করেন। সেই সময় বিছানার পাশে টেলিফোনটা চোখে পড়ে। তারপর আমাকে টেলিফোন করেন। চলো। গিয়ে ওঁকে আগে উদ্ধার করা থাক।
তিনতলা থেকে নেমে কর্নেল বললেন, তোমার গাড়ি এখানেই থাক। আমরা ট্যাক্সি করে যাব। তারপর হাঁটতে হবে একটুখানি।
বরাবর দেখে আসছি, কলকাতার কোনও ট্যাক্সিচালক কর্নেলকে না করেন না। সম্ভবত ওঁর দাড়ি আর লম্বাচওড়া সায়েবি চেহারা দেখেই তারা ওঁকে সমীহ করেন। ট্যাক্সিচালক শর্টকাটে আমাদের মোটামুটি চওড়া একটা রাস্তায় নামিয়ে দিলেন। এলাকাটা পূর্ব কলকাতায় গোবরা কবরখানার কাছাকাছি। নস্কর লেন একটা আঁকাবাঁকা সংকীর্ণ গলি। দূরে-দূরে এক-একটা ল্যাম্পপোস্ট। একে তাকে জিজ্ঞেস করে ৩৩ নম্বরটা যদি বা পাওয়া গেল, ৩৩/১ খুঁজতে বেশ দেরি হল। ৩৩ নম্বরে একটা কারখানা। তার পাশে এঁদো পুকুর। পুকুরের খানিকটা ভরাট করে বাড়ি উঠেছে। গোবর্ধনবাবুর একতলা ছোট্ট পুরনো বাড়িটা সেই পুকুরের একধারে গাছপালার ভেতর লুকিয়ে ছিল। সদর দরজা নস্কর লেন থেকে বেরুনো একটা কানাগলির মুখে। সেখানে অন্ধকার ঘন হয়ে আছে। সম্ভবত ল্যাম্পপোস্টের আলোর ছটা চোখে পড়েই হালদারমশাই সাহস করে জানলা ফাঁক করেছিলেন।
কর্নেল টর্চের আলো ফেলে একটু কাসলেন। কোনও সাড়া এল না। তখন এদিকের জানালার কাছে গিয়ে চুপি চুপি ডাকলেন, হালদারমশাই!
তারপর সত্যিই ভৌতিক উপদ্রব শুরু হয়ে গেল। আমাদের আশেপাশে কয়েকটা ছোট-ছোট ঢিল পড়ল। ছাদের ওপর কী একটা শব্দ হল। কর্নেল টর্চের আলো ফেললেন। কিন্তু কিছু দেখা গেল না। পাশেই একটা খাটাল। সেখানে চালাঘরে মিটমিটে একটা ল্যাম্প জ্বলছিল। খাটালের লোকেরা ছায়ামূর্তির মতো বসে চাপা গলায় গল্প করছিল। তাই বললাম, -কর্নেল, বরং চলুন, ওদের ডেকে হালদারমশাইকে উদ্ধারের ব্যবস্থা করি।
আমার কথা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আবার কয়েকটা ঢিল পড়ল। কর্নেল বললেন, চলো! পুকুরের পাড় ঘুরে পেছনের দরজায় যাই। গোবর্ধনবাবুর বাড়িটা এমন জায়গায়, তা ভাবিনি। অথচ বাড়িতে টেলিফোন আছে।
কারখানার পাঁচিলের পাশ দিয়ে ঘুরে পুকুরপাড়ে গেলাম। পাড় বলতে একমিটার চওড়া জায়গা। সেখানে আগাছার জঙ্গল। পায়ের কাছে টর্চের আলো ফেলে দুজনে সেই জঙ্গলের ভেতর দিয়ে পেছনের দরজায় গেলাম। কর্নেল একটু হেসে বললেন, ভূত এত ভীতু হয় জানতাম না। এই দরজা দিয়ে কেটে পড়েছে দেখছি।
তারপর তিনি দরজায় টর্চের আলো ফেললেন। এ দরজায় তালা থাকার কথা। কিন্তু তালা নেই!
ভেতরে ঢুকে কর্নেল দরজাটা বন্ধ করে দিলেন। টর্চের আলোয় অপরিচ্ছন্ন ছোট্ট উঠোন, একটা টিউবেল আর পাশাপাশি দুটো ঘর দেখা গেল। দুটো ঘরেই তালা আটকানো আছে। কর্নেল প্রথমে ডানদিকের ঘরের কড়া নাড়লেন। কোনও সাড়া না পেয়ে বাঁদিকের ঘরের দরজার কড়া নাড়তে থাকলেন। কিছুক্ষণ পরে ঘরের ভেতর একটা নড়াচড়ার শব্দ শোনা গেল। কর্নেল চাপা গলায় ডাকলেন, হালদারমশাই!
এবার হালদারমশাইয়ের সাড়া পেলাম। ঘুমজড়ানো গলায় বললেন, আবার ডিসটার্ব করে! গুলি করব কইয়া দিলাম। কর্নেল বললেন, হালদারমশাই! অন্যের বিছানায় ঘুমুনো উচিত নয়। উঠে পড়ুন।
—অ্যাঃ! আমি ঘুমাইতাছি?
-হ্যাঁঃ। জেগে উঠুন। শিগগির।
আমি টর্চের আলোয় বারান্দার এক কোণে দেয়ালের গায়ে ইলেকট্রিক মিটারবক্স আর মেইন সুইচ দেখছিলাম। সুইচটা অফ করা আছে। তখনই অন করে দিলাম। ততক্ষণে হালদারমশাই ঘরের ভেতরে দরজার কাছে এসে শাসাচ্ছেন, পরিচয় না দিলে গুলি করব!
বললাম, হালদারমশাই! আমি জয়ন্ত। আমার সঙ্গে কর্নেল আছেন।
ঘরের দরজা টানাটানির শব্দ হল। হালদারমশাই বললেন, সুইচ গেল কই?
খুঁজে দেখুন। সুইচ কোথায় তা আপনি নিশ্চয় দেখেছিলেন।-বলে কর্নেল পাশের ঘরের দরজায় চলে গেলেন।
সেই সময় ঘরের ভেতর এবং বরান্দায় আলো জ্বলে উঠল। কর্নেল পাশের ঘরের তালাটা পরীক্ষা করে ফিরে এলেন। তারপর পকেট থেকে একগোছা নানা সাইজের চাবি বের করে অনেক চেষ্টার পর এই ঘরের তালাটা খুলে ফেললেন। দরজা খুলে দুজনে ঘরে ঢুকলাম। হালদারমশাই দুহাতে চোখ মুছে বললেন, আমি কি স্বপ্ন দেখতাছি?
বললাম, না হালদারমশাই! স্বপ্ন নয়।
কর্নেল ঘরের ভেতরটা দেখতে ব্যস্ত হয়েছেন। হালদারমশাই বড় মশা! বলে বেরিয়ে বারান্দায় গেলেন। দেখলাম, উনি মশার কামড় থেকে বাঁচতে মশারি মুড়ি দিয়ে শুয়েছিলেন। অন্ধকারে মশারি খুঁজে পেলেও তা খাটাতে পারেননি। ঘরে একটা খাটে সাদাসিধে বিছানা, একটা কাঠের আলমারি, দুটো চেয়ার আর একটা ছোট্ট টেবিল। দেওয়ালের তাকে খানকতক পুরনো ধর্মগ্রন্থ, ওষুধের শিশি, এইসব নানা জিনিস।
কর্নেল, বিছানার পাশে টুলে রাখা টেলিফোনের রিসিভার তুলেই বললেন, ডেড। বোঝা যাচ্ছে, আমরা আসার পরই টেলিফোনের তার ছেড়া হয়েছে। খুব চালাক ভূত! জয়ন্ত! বাইরে গিয়ে লক্ষ্য রাখখা। হালদারমশাইকে বলো, দরকার হলে ভূতকে ভয় দেখানোর জন্য উনি যেন ওঁর ফায়ার আর্মস রেডি রাখেন। কিন্তু না—গুলি ছোড়া চলবে না।
বেরিয়ে গিয়ে হালদারমশাইকে কথাটা বলতেই উনি পকেট থেকে খুদে আগ্নেয়াস্ত্র বের করে বললেন, আই অ্যাম অলওয়েজ রেডি।
একটু পরে কর্নেল বেরিয়ে এসে দরজা বন্ধ করে সেই মাস্টার কি-র সাহায্যে আগের মতো তালাটা এঁটে দিলেন। তারপর আমাদের দাঁড়িয়ে থাকতে বলে পাশের ঘরের তালা খুললেন এবং ভেতরে ঢুকে গেলেন।
আর ঢিল পড়ল না। ছাদেও কোনও শব্দ শোনা গেল না। মিনিট দু-তিন পরে কর্নেল পাশের ঘর থেকে বেরুলেন, এবং দরজা বন্ধ করে তালাটা দিব্যি আগের মতো এঁটে দিলেন। তারপর বললেন, আর নয়। এবার কেটে পড়া যাক।
কিন্তু অবাক কাণ্ড বাড়ির পেছনের দরজা কখন কে বাইরে থেকে আটকে দিয়ে গেছে। হালদারমশাই পাঁচিল টপকে ওধারে গিয়ে চাপা হুঙ্কার দিয়ে একটা কিছু করলেন এবং দরজাটা খুলে গেল। তিনি খি খি করে হেসে বললেন, —পুরানো কড়া। এক টানেই ব্রেকডাউন।
কর্নেল বললেন, কুইক! ভূতের মুখে খবর পেয়ে যে কোনও সময় পুলিশ এসে পড়তে পারে। পুলিশ অনধিকার প্রবেশের দায়ে আমাদের অ্যারেস্ট করলে একটু ঝামেলা হবে।
আমরা পুকুরপাড়ের ভেতর দিয়ে কারখানার পাঁচিলের কাছে গিয়ে আবার নস্কর লেনে পৌঁছলাম।
সে-রাতে কর্নেলের অ্যাপার্টমেন্টে ফিরে কাজুবাদাম পটাটোচিপসের সঙ্গে কফি খেতে খেতে ক্ষুধার্ত হালদারমশাই শুধু মশা নিয়ে বকবক করছিলেন। বোঝা গেল, পাশে খাটাল এবং এঁদো পুকুর থাকার দরুন ওখানে মশার বড় উপদ্রব আছে। এক ফাঁকে ওঁকে জিজ্ঞেস করলাম, মশার উপদ্রব তো থাকারই কথা। কিন্তু ভূতের উপদ্রব টের পাননি?
হালদারমশাই চমকে উঠে বললেন, কী কইলেন? ভূতের উপদ্রব?
কর্নেল বললেন, হালদারমশাই! গোবর্ধন সর্বাধিকারী কালো ছাতাটা কুড়িয়ে পাওয়ার পর থেকে ওঁর বাড়িতে ভূতের উৎপাত শুরু হয়েছিল।
প্রাইভেট ডিটেকটিভ খুব গম্ভীর হয়ে গেলেন। তারপর ফেঁস করে শ্বাস ছেড়ে বললেন, কর্নেলসার! চৌতিরিশ বৎসর পুলিশে চাকরি করছি। কিন্তু এমন সাংঘাতিক এক্সপিরিয়েন্স হয় নাই। হঃ! ছাদের উপর ধুপধুপ শব্দ শুনছি। দরজার কড়া নড়ছিল—একবার নয়, অনেকবার। তারপর পাশের ঘরে কী সব খুটখাট নাড়াচাড়া। কিন্তু তখন কান দিই নাই। এখন মনে খটকা বাধল। আপনারা ভূতের উপদ্রব কইলেন!
-গোবরা কবরখানা কিন্তু বাড়িটার কাছাকাছি হালদারমশাই!
আমিও না বলে পারলাম না, কর্নেল! আমরা গিয়েও কিন্তু ভূতুড়ে উৎপাত দেখেছি। ঢিল পড়ছিল। ছাদের ওপর কী একটা অদ্ভুত শব্দ শুনেছি। সে-কথা হালদারমশাইকে বলা উচিত।
হালদারমশাই উত্তেজিতভাবে বললেন, হেভি মিস্ত্রি! তবে আমার নামও কে.কে. হালদার। ভূতের বাপের শ্রাদ্ধ যদি করতে না পারি, আমার কান কাইট্টা কুত্তার গলায় লটকাইয়া দিমু।
বলেই উনি সবেগে বেরিয়ে গেলেন। বরাবর দেখে আসছি, প্রচণ্ড উত্তেজনায় ওঁর মুখে দেশোয়ালি ভাষা বেরিয়ে যায়। আমি হেসে ফেললাম, কর্নেল! হালদারমশাই আবার ওবাড়িতে হানা দিতে গেলেন না তো?
কর্নেল সে-কথায় কান না দিয়ে বললেন, তুমি কী বুঝলে বলো জয়ন্ত?
বললাম, অনেক আগেই বুঝে গেছি।
-বাহ্। বলো শুনি!
—পুকুর বুজিয়ে যে-প্রোমোটার ওখানে বাড়ি তুলছে, এটা তারই চক্রান্ত। ভূতের উৎপাতে অতিষ্ঠ হয়ে গোবর্ধনবাবু বাড়ি বেচে অন্য কোথাও চলে যেতে চাইবেন এবং প্রোমোটার ওঁর বাড়িটা কিনে নিয়ে বহুতল বাড়ি তুলবে।
—কিন্তু তাকামিও আকামা কোম্পনির তৈরি ছাতার সঙ্গে এর কী সম্পর্ক?
—হঠাৎ ভূতের উৎপাতের সঙ্গে ওই কালো ছাতাটা তো জড়িয়েই গেছে। গোবর্ধনবাবু ওটা কুড়িয়ে পাওয়ার পর থেকে ভূতের উৎপাত শুরু হয়েছে। পোমোটারের লোক কার্জন পার্কে গোবর্ধনবাবুর চোখে পড়া জায়গায় ছাতাটা ফেলে রেখেছিল।
-হুঁ। গোবর্ধনবাবু কার্জন পার্কে ঘাসের ওপর বসেছিলেন। হঠাৎ পাশেই ওই ছাতাটা পড়ে থাকতে দেখেছিলেন বটে!
ঘড়ি দেখে বললাম, আমি উঠি। এগারোটা বাজতে চলল।
কর্নেল মিটিমিটি হেসে বললেন, এত রাতে সল্টলেকে একা ফিরবে! ইস্টন বাইপাসে তোমার গাড়ির ভেতর ভূত ঢুকে গেলেই বিপদ। নস্কর লেন থেকে বাইপাস বেশি দূরে নয়। হা—এমনও হতে পারে, নস্কর লেন থেকে আমাদের ফলো করে এস, ভূত তোমার গাড়ির তলায় ঘাপটি পেতে বসে আছে।
—ভূত-টুত বোগাস!
—টুত আরও সাংঘাতিক, ডার্লিং! কাজেই আমার বাড়িতেই রাতটা কাটিয়ে যাও। ষষ্ঠী! আমরা এবার খেতে যাচ্ছি।
কর্নেলের অ্যাপার্টমেন্টে রাত কাটানো নতুন কিছু নয়। তবে আমি বিছানা থেকে দেরি করে উঠি। এদিন ঘুম ভাঙল পৌনে আটটায়। তা-ও ষষ্ঠী না ডাকলে আরও কিছুক্ষণ বিছানায় পড়ে থাকতাম।
আটটা নাগাদ ড্রয়িংরুমে ঢুকতেই কর্নেলের সম্ভাষণ শুনলাম, মর্নিং জয়ন্ত! আশাকরি সুনিদ্রা হয়েছে।
—মর্নিং! আপনার দেখছি সত্যিই পেছনে একটা চোখ আছে!
প্রাজ্ঞ রহস্যভেদী একটা আলমারির কাচের দিকে তর্জনি তুলে বললেন, —ওখানে তোমার প্রতিবিম্ব পড়েছিল। ডার্লিং! সবসময় সচেতন থাকলে অনেককিছু জানা এবং দেখা হয়ে যায়। তো বসো! হালদারমশাইকে টেলিফোন করে আসতে বলেছি। না, উনি গতরাতে আর নস্কর লেনে ওত পাততে যাননি। আজ রাতে যেতেন। আমি বললাম, আর ওখানে যাওয়ার দরকার হবে না। বরং এখানে চলে আসুন।
—কী ব্যাপার?
—সাতটায় ছাদের বাগানে ছিলাম। তখন ষষ্ঠী গিয়ে খবর দিল, গোবর্ধনবাবু নামে এক ভদ্রলোক টেলিফোন করেছেন। জরুরি দরকার। অগত্যা নেমে এসে কথা বলতে হল। গোবর্ধনবাবু আমার সঙ্গে দেখা করতে চান। জরুরি দরকার আছে।
—কিন্তু আপনি তো ওঁকে গা-ঢাকা দিয়ে থাকতে বলেছেন!
—বলেছি। অথচ উনি দেখা করতে চান। তাই ওঁকে নটার মধ্যেই আসতে বলেছি। ষষ্ঠী ট্রেতে কফি-দুধ-চিনি-পেয়ালা আর স্ন্যাক্স রেখে গেল। কর্নেল কফি শেষ করে চুরুট ধরালেন। তারপর হঠাৎ উঠে ভেতরে চলে গেলেন। সেই কালো ছাতাটা নিয়ে ফিরে এলেন। ছাতাটা টেবিলে রেখে কর্নেল বললেন, তাকামিও আকামা কোম্পানির এই ছাতাটার গলায় টনসিলের অসুখ ছিল। কাল দুপুরে অসুখটা সারিয়ে দিয়েছি।
-ওঃ কর্নেল! আবার হেঁয়ালি করছেন।
-হেঁয়ালি? মোটেও না। ছাতাটার গলায় প্রায় এক ইঞ্চি ব্যাস এবং তিন ইঞ্চি লম্বা গোল শক্ত জিনিস আটকে ছিল। ছাতার মাথার টুপি খুলে সেটা বের করে ফেলেছি। ছাতাটা এখন সুস্থ।
—জিনিসটা কী?
—জানি না। যথাস্থানে পরীক্ষা করাতে হবে। তবে এখন ওসব কথা নয়।
মুখটি বুজে থাকো।
বলেই কর্নেল সোজা হয়ে বসলেন।
দোতলায় লিন্ডাদের কুকুরটা চঁচামেচি করছে। হালদারমশাই আসছেন। কেন জানি না, কুকুরটা ডিটেকটিভ ভদ্রলোককে সহ্য করতে পারে না।-ষষ্ঠী! দরজা খুলে দে।
তখনই ডোরবেল বাজল। এবং একটু পরে হালদারমশাই সবেগে ঘরে ঢুকে সোফায় বসে বললেন, মিস্ত্রি স হইল ক্যামনে?
কর্নেল বললেন, কফি খান। নার্ভ চাঙ্গা করুন। খবরের কাগজ পড়ুন। তারপর সে-সব কথা হবে।
ষষ্ঠী হালদারমশাইয়ের জন্য বেশি দুধ-মেশানো স্পেশাল কফি নিয়ে এল। উনি গম্ভীর মুখে কফিতে চুমুক দিয়ে খবরের কাগজ টেনে নিলেন। অন্যদিনের মতো একটা খাইছে শোনার জন্য উদগ্রীব ছিলাম। কিন্তু উনি আমাকে নিরাশ করলেন।
কিছুক্ষণ পরে আবার ডোরবেল বাজল। ষষ্ঠী দেখে এসে বলল—কালকের সেই ভদ্রলোক এসেছেন।
কর্নেল ধমক দেওয়ার ভঙ্গিতে বললেন, ওঁকে নিয়ে আয় হতভাগা। এরপর আস্তে পর্দা তুলে গোবর্ধন সর্বাধিকারী ঘরে ঢুকে বিনীতভাবে নমস্কার করে বললেন, কর্নেলসাহেবকে বিরক্ত করার ইচ্ছা ছিল না। কিন্তু–
কর্নেল বললেন, আপনি বসুন।
গোবর্ধনবাবু বসলেন। তারপর আমাকে এবং হালদারমশাইকে একবার দেখে নিলেন। হালদারমশাই তাঁকে দেখছিলেন। কর্নেল বললেন, আলাপ করিয়ে দিই! উনি হালদার প্রাইভেট ডিটেকটিভ এজেন্সির মিঃ কে কে হালদার। হালদারমশাই! ইনিই মিঃ গোবর্ধন সর্বাধিকারী।
প্রাইভেট ডিটেকটিভ নড়ে বসলেন, আপনার ছাতা? আপনিই বিজ্ঞাপন দিছিলেন পেপারে?
গোবর্ধনবাবু বললেন, আজ্ঞে হ্যাঁ। ওই ছাতা নিয়ে কী বিপদে পড়েছিলাম বলার নয়। কর্নেল বললেন, বলুন গোবর্ধনবাবু!
—আজ্ঞে, ছাতাটার আসল মালিকের খোঁজ পেয়ে গেছি। আমার এক ভাগনে ভবানীপুরে থাকে। সে আমাকে কথায়-কথায় কাল সন্ধ্যাবেলা—
—এক মিনিট! আপনি তা হলে কলকাতাতেই ছিলেন?
—থাকব না তো কোথায় যাব? আমার কি কোথাও যাওয়ার উপায় আছে?
—বেশ। আপনি ছাতা ফেরত নিতে এসেছেন তো?
—আজ্ঞে!
কর্নেল টেবিল থেকে ছাতাটা তুলে ওঁকে দিলেন। উনি ছাতাটা বগলদাবা করে উঠে দাঁড়ালেন। কর্নেল একটু হেসে বললেন, আপনার টনসিল সেরে গেছে দেখছি!
গোবর্ধনবাবু কেমন একটু হকচকিয়ে গেলেন। বললেন, আজ্ঞে তা–
—আপনার ছাতারও টনসিলের অসুখ ছিল গোবর্ধনবাবু! সারিয়ে দিয়েছি।
—ছাতার টনসিলের অসুখ। কী বলছেন কর্নেলসাহেব!
কর্নেল নিভে যাওয়া চুরুট ফেলে বললেন, আপনার টনসিলের অসুখ সেরেছে বটে, কিন্তু আপনি একটু রোগা হয়ে গেছেন।
গোবর্ধনবাবু হাসবার চেষ্টা করে বললেন, ভয়ে কর্নেলসাহেব! ভয়ে আর দুশ্চিন্তায়। আচ্ছা চলি।
—একটু কফি অন্তত খেয়ে যান!
—আরেকদিন এসে খাব। একটু তাড়া আছে।
-–আচ্ছা গোবর্ধনবাবু! আপনি কি রোজই কার্জন পার্কে বেড়াতে যান?
—যাই কর্নেলসাহেব। অফিস থেকে বেরিয়ে কার্জন পার্কে কিছুক্ষণ বসে থাকি।
—আপনি এত সকালে চুল হেঁটেছেন দেখছি! গোঁফটাও হেঁটেছেন! গোবর্ধনবাবু আবার একটু ভড়কে গেলেন। যাওয়ারই কথা। আমিও কর্নেলের প্রশ্নের মাথামুণ্ডু খুঁজে পাচ্ছি না। হালদারমশাই গুলি-গুলি চোখে তাকিয়ে আছেন। উত্তেজনায় তাঁর গোঁফ তরতর করে কাঁপছে। গোবর্ধনবাবু কাঁচুমাচু হেসে বললেন, আসার পথে ফুটপাতে হেঁটে নিলাম।
—আপনার বাড়ি টেলিফোন আছে। আপনি ফুটপাতে চুল আর গোঁফ ছাঁটলেন? এটা আপনাকে মানায় না। যাই হোক, কাল আপনি বাড়ি থেকে বেরুনোর সময় ঘরে তালা দিতে ভুলে গিয়েছিলেন। তাই প্রাইভেট ডিটেকটিভ হালদারমশাই আপনার ঘরে ঢুকতে পেরেছিলেন। তাই না হালদারমশাই?
হালদারমশাই শ্বাসপ্রশ্বাসের সঙ্গে শুধু বললেন, -হঃ!
সর্বনাশ! তা হলে তো এতক্ষণ আমার সব চুরি হয়ে গেছে।—বলে গোবর্ধনবাবু পা বাড়ালেন।
কর্নেল বললেন, না। আপনার ঘরের দরজায় একটা তালা আমরা কাল রাতে দেখে এসেছি। তাই না হালদারমশাই?
প্রাইভেট ডিটেকটিভ বললেন, হঃ! কোন ব্যাটা তালা আটকাইয়া দিছিল। তখন আমি ওনার ঘরে ভরা। ওঃ। সে কী মশা! ও বাড়িতে থাকেন কী কইরা বুঝি না।
কর্নেল বললেন, তাকামিও আকামা কোম্পানির ছাতাটা নিয়ে যাচ্ছেন, যান। কিন্তু মনে রাখবেন, ছাতাটার টনসিলের অসুখ আমি সারিয়ে দিয়েছি।
গোবর্ধনবাবু কেমন চোখে তাকিয়ে থাকার পর আবার ঘুরে দরজার দিকে পা বাড়ালেন।
কর্নেল এবার খুব গম্ভীর কণ্ঠস্বরে বলে উঠলেন, আপনাকে একটু বসতে হবে জনার্দনবাবু!
ঘরে যেন বিনামেঘে বাজ পড়ল। আমি ও হালদারমশাই পরস্পর তাকাতাকি করলাম। কর্নেল পকেট থেকে সেই ছোট্ট গোল ফিল্মরোলের মতো জিনস বের করে বললেন, জনার্দনবাবু! এই জিনিসটা আপনার কাছে পৌঁছুনোর কথা। এটাই ছাতার টনসিলের মধ্যে ছিল। কিন্তু আপনার দুর্ভাগ্য! আপনি কোনও কারণে সেদিন কার্জন পার্কে সময়মতো পৌঁছুতে পারেননি। এদিকে আপনার যমজভাই গোবর্ধনবাবু সেখানে নেহাত খেয়ালে গিয়ে পড়েছিলেন। তাই এই ছাতাটা তারই সামনে ফেলে রেখে চলে যায় আপনার স্মাগলিং গ্যাংয়ের কোনও কো… না-না। পালানোর চেষ্টা করবেন না।
হালদারমশাই ততক্ষণে উঠে দাঁড়িয়েছেন। একলাফে এগিয়ে গিয়ে জনার্দন সর্বাধিকারীকে ধরে ফেললেন, এই ব্যাটা আমারে ঘরে আটকাইয়া রাখছিল! এই সে ভূত। এই ভূতের জন্য—ওঃ! সে কী মশা!
কর্নেল বললেন, -জনার্দনবাবু! কাল রাতে আপনার ঘরে ঢুকে সব দেখেছি। আপনার নামও জানতে পেরেছি। খাটের তলায় বিদেশি ইলেকট্রনিক সরঞ্জাম থেকে শুরু করে নানা দামি জিনিস ঠাসা আছে। আপনি আপনার যমজ ভাই গোবর্ধনবাবুর টেলিফোন ট্যাপ করে রেখেছিলেন, তা-ও দেখেছি। আমরা যাওয়ার পর বেগতিক বুঝে ওঁর টেলিফোনের তার ছিঁড়ে ফেলেছিলেন আপনি।
এই সময় ডোরবেল বাজল। কর্নেল হাঁকলেন, ষষ্ঠী!
একটু পরে আমার পরিচিত কাস্টমস অফিসার রথীন মৈত্র এবং তার দুজন অনুচর ঘরে ঢুকলেন। রথীন মৈত্র বললেন, ৩৩/১ নস্কর লেনের একটা ঘরে রেইড করে প্রচুর ড্রাগ ক্যাপসুল পেয়েছি কর্নেল সরকার! তো এই বুঝি সেই জনার্দন সর্বাধিকারী? একবার ভুল করে এঁর যমজ ভাইকে অকারণ হ্যারাস করেছিলাম আমরা। এই জনার্দনরা ড্রাগ পাচার করে এনে দেশটার সর্বনাশ করছে।
কর্নেল সেই ফিল্মরোলের মতো জিনিসটা ওঁর হাতে দিয়ে বললেন, —এতেও নিষিদ্ধ ড্রাগ ভরা আছে। আপনারা পরীক্ষা করলে বলতে পারবেন, এর কত দাম। আর জনার্দনবাবুর ছাতাটাও নিয়ে যান।
রথীন মৈত্র জনার্দনবাবুকে ছাতাসহ পাকড়াও করে নিয়ে গেলেন। হালদারমশাই একটিপ নস্যি নিয়ে বললেন, কী কাণ্ড! যমজ ভাই, তা বুঝলেন ক্যামনে কর্নেলসার?
কর্নেল বললেন, গতরাতে যখন জনার্দনবাবুর ঘরে ঢুকি, তখন কিছু বুঝতে পারিনি। জনার্দন সর্বাধিকারীর বিজনেস কার্ড ওই ঘরে দেখতে পেলেও ওঁকে তো তখনও চর্মচক্ষে দেখিনি! এদিকে গোবর্ধনবাবুও বলেননি তার কথা। হাজার হলেও সহোদর ভাই। তাই আমার কাছে কথাটা গোপন রাখা স্বাভাবিক। তবে হ্যাঁ—এটা সুস্পষ্ট যে, উনি টের পেয়েছিলেন ভূতের উৎপাত কে বাধিয়েছে। আসলে উনি ভাইটিকে বাঁচানোর জন্যই শেষ পর্যন্ত ছাতাটা আমার হাতে তুলে দিয়েছিলেন। কিন্তু আজ সকালে যখন ওঁর ফোন এল, তখন প্রথমে একটু খটকা লাগল। কণ্ঠস্বর কতকটা এক হলেও টনসিলের রোগীর মতো নয়। তারপর কিছুক্ষণ আগে যখন ষষ্ঠী এসে বলল, কালকের সেই ভদ্রলোক এসে দাঁড়িয়ে আছেন, তখন খটকাটা বেড়ে গেল। গোবর্ধনবাবুর তো সোজা এ ঘরে ঢুকে পড়া উচিত ছিল। তারপর আমার প্রশ্নগুলো স্মরণ করুন। চুলের ছাঁট, গোঁফ, একটু রোগাটে গড়ন এবং আমার প্রশ্নগুলোর উত্তর থেকে স্পষ্ট বুঝলাম, ইনি কখনই গোবর্ধনবাবু নন। এঁকে যমজভাই বলে সাব্যস্ত করতেই হল।
যমজদের বিষয়ে আমি কিছু পড়াশুনা করেছি। দেখতে একইরকম হলেও যমজদের মধ্যে আচরণগত কিছু তফাত থাকে। দুজনের আঙুলের ছাপও আলাদা। তার চেয়ে বড় কথা, কাল গোবর্ধনবাবুর সঙ্গে আমার কী কথা হয়েছিল ইনি তা জানেন না।
হালদারমশাই খি খি করে হেসে উঠলেন। আমি বললাম, এ তা হলে সুকুমার রায়ের সেই গোঁফচুরি পদ্যটার ব্যাপারই হয়ে দাঁড়াল। ছাতার আমি, ছাতার তুমি, ছাতা দিয়ে যায় চেনা! কিন্তু গোবর্ধনবাবুকে আপনি গা-ঢাকা দিতে বলেছিলেন কেন?
কর্নেল হাঁকলেন, ষষ্ঠী! আরেক রাউন্ড কফি!
তারপর বললেন, আমার সন্দেহ হয়েছিল, ছাতার মধ্যে এমন কিছু লুকোনো আছে, যার জন্য গোবর্ধনবাবু আরও সাংঘাতিক বিপদে পড়তে পারেন।