কালো পাথরের মতো দেখতে জিনিসটাকে…আলো পড়লেই ঠিকরে পড়ত হরেক রশ্মি…চর্কির মতো ঘুরত রশ্মিগুলো…ধাতু বিজ্ঞানীও বলতে পারেননি ধাতুটা কী! রহস্যময় এই বস্তুটাই চুরি গেল আরও রহস্যজনকভাবে রাতদুপুরে কান্দ্রা উপত্যকায়…পাহাড় থেকে নেমে এল ঝোড়ো হাওয়া…শোনা গেল ঘুঙুরের শব্দ…নিভে গেল সব আলো! তারপর?
বেহালা রোগ
সেদিন সকালে কর্নেল নীলাদ্রি সরকারের ডেরায় গিয়ে তার প্রিয় ভৃত্য ষষ্ঠীচরণকে কেমন যেন মনমরা লক্ষ্য করছিলুম। কর্নেল তখনও ছাদে ক্যাকটাস এবং অর্কিডের সেবায় মশগুল। এসব সময় অবস্থা মৌনীবাবাদের মতো! তাই নিচের ড্রইংরুমে অপেক্ষা করছিলুম। ষষ্ঠী যথারীতি কফি দিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু মুখটা বেজায় গম্ভীর। চেহারা উস্কোখুস্কো। চোখের তলায় যেন কালি। জিগ্যেস করেছিলুম, অসুখ-বিসুখ নাকি?
ষষ্ঠী শুধু মাথা নেড়েছিল। এরকম মাথা নাড়ার মানে হ্যাঁ বা না যে কোনওটাই হতে পারে।
কিছুক্ষণ পরে কফির পেয়ালা নিতে এল সে। তখন বললুম, তোমাকে এমন দেখাচ্ছে কেন ষষ্ঠী?
ষষ্ঠীচরণ দাঁড়িয়ে মুখ নামিয়ে আঙুল খুঁটতে থাকল। তারপর গলার ভিতর বলল, ঠিক বুঝতে পারছি না দাদাবাবু!
—আহা! তোমার হয়েছে কী বলবে তো?
এবার ষষ্ঠী নিজের মাথাটা দুহাতে আঁকড়ে ধরে বলল, আমি হয়তো আর বাঁচব না দাদাবাবু। আমার মাথার ভিতর কী একটা হয়েছে দুদিন থেকে। বাবামশাইকে বললুম তো হেসে উড়িয়ে দিলেন। ইদিকে আমার মাথার ভিতর খালি বেহালা বাজছে!
অবাক হয়ে বললুম, বেহালা বাজছে? সে আবার কী?
আজ্ঞে হ্যাঁ। এই তো এখনও বাজছে।ষষ্ঠী করুণ মুখে বলল।মাঝে মাঝে বাজছে, আবার বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। প্রথমে ভেবেছিলুম কেউ কোথাও বেহালার বাজনা শিখছে। এ বাড়ির সব ফেলাট, আশেপাশের বাড়ির সব ফেলাট, খুব খোঁজাখুঁজি করেছি। শেষে বুঝতে পেরেছি আমার খুলির ভিতর বাজছে। আমার বড় কষ্ট দাদাবাবু!
হঠাৎ চমকে উঠলুম। এ কী! আমার মাথার ভিতরও যেন বেহালা বাজছে। এতক্ষণ খেয়াল করিনি। এবার স্পষ্ট বুঝতে পারছি, অত্যন্ত ক্ষীণ সুরে ঝিঝিপোকার ডাকের মতো কো কো করে বেহালা বাজছে। ষষ্ঠী আমার মুখের অবস্থা দেখে কী বুঝল কে জানে, ফেঁস করে শ্বাস ছেড়ে কফির পাত্র নিয়ে চলে গেল।
বড় ভাবনায় পড়ে গেলুম। কলকাতায় একেক সময় একেক রকম উদ্ভুট্টে রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটে। এই বেহালা-রোগ নিশ্চয় সংক্রামক। ষষ্ঠীর হাতে কফি খাওয়ামাত্র আমাকে ধরেছে। দুহাতে মাথা আঁকড়ে ধরে জোরে ঝাকুনি দিলুম। মাথায় বারকয়েক গাঁট্টা মারলুম। তখন হঠাৎ অতিসূক্ষ্ম বেহালার সুরটা থেমে গেল।
কিন্তু একটু পরেই ফের শুরু হয়ে গেল মারাত্মক সেই বাজনা। কে কে কে কেঁ—অস্বস্তিকর হতচ্ছাড়া একটা সুর। আতঙ্কে আমার গলা শুকিয়ে গেল। এই সময় কোনার দিকে সিড়িতে আমার প্রাজ্ঞ বন্ধুর পায়ের শব্দ শোনা গেল। আর্তনাদের সুরে চেঁচিয়ে উঠলুম, কর্নেল! কর্নেল।
কর্নেলের পরনে গার্ডেনিংয়ের পোশাক। হাতে খুরপি এবং সাদা দাড়িতে শুকনো পাতা। আমার দিকে দৃকপাত না করে সটান বাথরুমে ঢুকলেন। আমি মরিয়া হয়ে আবার মাথায় গাঁট্টা মারতে থাকলুম। বাজনাটা যেন কর্নেল আসার পরই বেড়ে চলেছে। মনে হচ্ছে একটা অদৃশ্য বেহালার ছড় ধারালো করাতের মতো আমার ঘিলুকে ফালাফালা করছে।
তারপর কর্নেলের ডাক শুনতে পেলুম।জয়ন্ত কি ইদানীং বক্সিং শিখতে শুরু করেছ? আমার মনে হয়, নিজের মাথার চেয়ে এ ব্যাপারে বালি ভর্তি একটা বস্তাই উপযুক্ত জিনিস।
বোবা ধরা গলায় বললুম, বক্সিং নয়, বক্সিং নয়। মাথার ভিতর কী একটা কেলেঙ্কারি।
—অ্যাসপিরিন বড়ি খাও!
–না, না। বেহালার বাজনা। ওঃ! আমার মাথার ভিতর কেউ বেহালা বাজাচ্ছে!
কর্নেল আসতে আসতে থমকে দাঁড়িয়ে গিয়েছিলেন। পর্দার ফাঁকে ষষ্ঠীচরণের মুণ্ডু দেখা যাচ্ছিল। সে বলে উঠল, বাবামশাইকেও ধরবে বেহালা রোগে। পেখমে আমাকে ধরল। তাপরে কাগুজে দাদাবাবুকে ধরল। প্রিতিকার না করলে আপনাকেও ধরবে। তখন বুঝবেন কী কষ্ট!
কর্নেল ঘুরে চোখ কটমটিয়ে তাকালেন ওর দিকে। ষষ্ঠী মুণ্ডু সরিয়ে নিল পর্দার আড়ালে। তারপর কর্নেল আমার দিকে ঘুরে হো হো করে হেসে উঠলেন।
ক্ষুব্ধ হয়ে বললুম, আপনি হাসছেন! পারছেন হাসতে? কোথায় ডাক্তার ডাকার ব্যবস্থা করবেন, তা নয়, মজা দেখছেন। ঠিক আছে। আমি ডাক্তারের কাছে যাচ্ছি।
উঠে দাঁড়াতেই কর্নেল এগিয়ে এসে আমার কাঁধে থাবা হাঁকড়ালেন। তারপর হিড়হিড় করে টেনে একটা একোয়ারিয়ামের কাছে নিয়ে গিয়ে বললেন, ওটা কী?
হকচকিয়ে গিয়েছিলুম। একোয়ারিয়ামের ভিতর একটি কালচে বাদামি রঙের জলচর জীব রয়েছে। দেখতে দেখতে বললুম, কাঁকড়া বলে মনে হচ্ছে।
—এই কাঁকড়াটির সঙ্গে তোমার এবং ষষ্ঠীর বেহালা-রোগের সম্পর্ক আছে।
—তার মানে? কর্নেল আবার অট্টহাসি হেসে বললেন, দেখতে পাচ্ছ? কাঁকড়ার সামনে একটা লম্বাটে ঠ্যাং মুখের কাছে বেঁকে তিরতির করে কাঁপছে। জলে বুজকুড়ি ওঠাও তো দেখতে পাচ্ছ।
—পাচ্ছি। কিন্তু—
—একে বলে ফিডলার ক্র্যাব। বেহালা-বাজিয়ে কাঁকড়া।
সঙ্গে সঙ্গে ঘিলু পরিষ্কার হয়ে গেল। আমিও হো হো করে হাসতে লাগলুম। পর্দার আড়ালে ষষ্ঠীরও খিক খিক হাসি শোনা গেল। ওই হতচ্ছাড়া কাঁকড়াটাই তাহলে বেহালা বাজাচ্ছে এমন সুরে!
কর্নেল একোয়ারিয়ামের দিকে ঝুঁকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বললেন, লক্ষ্য করো ডার্লিং, ফিডলার কাঁকড়ার দুপাশের দুটো সাঁড়াশির মতো হাত কিন্তু একই গড়নের নয়। একটা ছোট্ট, অন্যটা বড়। এ এক সৃষ্টিছাড়া জীব। জীবজগতে যেসব প্রাণীর হাত আছে, তাদের দুটো হাতের গড়ন ও আয়তন একইরকম। শুধু ফিলডার কাঁকড়া ব্যতিক্রম। এক অদ্ভুত বৈষম্যের প্রতীক।
আমরা সোফায় এসে বসলুম। কর্নেলের ব্রেকফাস্ট দিয়ে গেল। কর্নেল আমাকে হাত লাগাতে ইশারা করলেন। বললুম, ধন্যবাদ। জব্বর ব্রেকফাস্ট সেরেই বেরিয়েছি।
খেতে খেতে কর্নেল আবার ফিডলার কাঁকড়া নিয়ে পড়লেন।—ফিডলার কাঁকড়াকে অদ্ভুত বৈষম্যের প্রতীক বলেছি। কেন বলেছি, তার ব্যাখ্যা করতে হলে পদার্থ বিজ্ঞানের ল অফ প্যারিটি বা সাদৃশ্যের নিয়ম সম্পর্কে মোটামুটি কিছু ধারণা দরকার।
বেগতিক দেখে বললুম, কী দরকার আর? বেহালা-রোগ তো সেরে গেছে।
কর্নেল গ্রাহ্য করলেন না আমার কথা। বললেন, জয়ন্ত, পদার্থবিজ্ঞানীরা দেখছেন, এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে প্রকৃতি যা কিছু সৃষ্টি করেছে, সবই যেন জোড়ায়-জোড়ায় করেছে। একটা অপরটার ঠিক উল্টো। উপমা দিয়ে বলছি—যেমন কিনা, তোমার ডানহাত আর বাঁহাত। সাদৃশ্যের নিয়ম অনুসারে বলা যায়, প্রকৃতি কিছু জিনিস যেন ডানহাতের পাকে—তকলিতে পাক ঘুরিয়ে সুতো কাটার মতো আর কি, এবং কিছু জিনিস বাঁহাতের পাকে তৈরি করেছে। ইংরেজিতে একে বলে, নেচারস রাইটহ্যান্ড টুইস্ট অ্যান্ড লেফটহ্যান্ড টুইস্ট। একটা অন্যটার উল্টো—যেমন দর্পণবিম্ব। দেখা যাবে, সব অসমানুপাতিক গড়নের জিনিসের দর্পণবিম্ব একেবারে উল্টো। যেমন আয়নার সামনে দাঁড়াও। দেখবে তোমার ডানহাত বাঁহাত হয়ে গেছে এবং বাঁহাত হয়ে গেছে ডানহাত। কিন্তু সমানুপাতিক গড়নের জিনিস—ধর একটা গ্লাস, আয়নার ভিতর একই রকম দেখাবে। উল্টো দেখাবে না। মজাটা হল, মানুষের হাত বা জলের গ্লাস এসব উদাহরণ নেহাত স্থূল উপমা। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে অনেক অসমানুপাতিক আণবিক গড়নের জিনিস পরীক্ষা করে দেখা গেছে এরকম দুটো জিনিস বাইরে-বাইরে দেখতে একই রকম, অথচ আণবিক গড়নে পরস্পর উল্টো। একটা যেন অপরটার দর্পণবিম্ব। ইংরেজিতে বলা হয়, মিরর ইমেজ। কিন্তু এখানেই বিপদ। কোনও জিনিস যদি তার ওই মিরর-ইমেজের মতো জিনিসের—তার মানে উল্টোসত্তার সংস্পর্শে আসে, সঙ্গে সঙ্গে তা ধ্বংস হয়ে যাবে। ধ্বংসটা কী রকম তারাও উপমা দিই। ধর, একটা লাঠির গায়ে একটা দড়ি ডানপাকে ঘুরিয়ে জড়িয়ে রেখেছ। কিন্তু দড়িটা বাঁপাকে ঘোরালেই কী ঘটবে? দড়ি ও ছড়ি আলাদা হয়ে যাবে। এই হল নেচারস রাইটহ্যান্ড টুইস্ট আর লেফটহ্যান্ড টুইস্টের রহস্য।
কান ভো ভো করছিল। কর্নেল জলের গ্লাস তুলে নিয়ে জল খেতে গিয়ে হঠাৎ থামলে আবার শুরু করবেন ভেবে দ্রুত বললুম, বুঝেছি আপনি আসলে ম্যাটার অ্যান্টিম্যাটারের কথা বলছেন।
কর্নেল জল খেয়ে গ্লাসটা রেখেছেন, এমন সময় কলিং বেল বাজল। তারপর ষষ্ঠী এসে ভিজিটিং কার্ড দিল। কার্ডটাতে চোখ বুলিয়ে কর্নেল যেন চঞ্চল হয়ে উঠলেন। হন্তদন্ত হয়ে এগিয়ে গেলেন দরজার দিকে।
কর্নেলের সঙ্গে যিনি ঢুকলেন, তাকে দেখে আমিও চঞ্চল হয়ে উঠলুম। কান্দ্রার নবাব মির্জা আজমল খানের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল গত ডিসেম্বরে দিল্লিতে ওয়ার্লর্ড ওয়াইল্ড লাইফ পোকেটশন সোসাইটির সম্মেলনে। ভদ্রলোক একজন প্রখ্যাত ওরিন্থােলজিস্ট অর্থাৎ পক্ষিবিজ্ঞানী। বোম্বের সালিম আলির ঘনিষ্ঠ বন্ধু। সালিমসায়েবও সেই সম্মেলনে এসেছিলেন।
মির্জাসায়েব অমায়িক এবং খেয়ালি প্রকৃতির মানুষ। কর্নেলের মতোই তাগড়াই ফর্সা, চেহারা। তবে কর্নেলের মুখে সাদা দাড়ি এবং এবং মাথায় প্রশস্ত টাক, মির্জাসাহেবের মুখে শুধু বিশাল গোঁফ, মাথা ভর্তি ঝাকড়া মাকড়া চুল। বয়সে দুজনেই অবশ্য ষাটের ওধারে।
মির্জাসায়েব সোফায় বসেই ঘোষণা করলেন, আপনাদের নিতে এলুম।-বলে আমার দিকে ঘুরলেন।-হ্যাঁ, আপনাকেও। কারণ ভেবে দেখলুম, একজন সাংবাদিকেরও এসব বিষয়ে জড়িত থাকা উচিত।
কর্নেল একটু হেসে বললেন, কীসব বিষয়ে বলুন তো?
-বলছি। বলে হঠাৎ মির্জাসাহেব মাথাটা জোরে নাড়া দিলেন। বললেন, আরে কী মুশকিল!
-কী হল মির্জাসাহেব?
—হঠাৎ মাথার ভিতর কী যেন–
—বেহালার বাজনা নয় তো?—বলে উঠলুম সঙ্গে সঙ্গে।
মির্জাসাহেব মাথাটা আবার ঝাঁকুনি দিয়ে বললেন, সর্বনাশ! বেহালার বাজনার মতো মাথার ভিতর এ কী বিশ্রী উপদ্রব শুরু হল!
কর্নেল গম্ভীর মুখে বললেন, ফিডলার ক্র্যাব। ওই একোয়ারিয়ামে বসে বেহালা বাজাচ্ছে।
তাই বলুন! -কান্দ্রার নবাব হা হা করে অট্টহাসি হাসতে লাগলেন।…।
ঘুঙুরপরা চোর!
কফিতে চুমুক দিয়ে মির্জাসাহেব গম্ভীর হয়ে বললেন, এখনও লোকে আমাকে মির্জানবাব বলে ডাকে। খাতিরও করে। কিন্তু নবাবি তো কবে ঘুচে গেছে। প্রিভিপার্স বাবদ বার্ষিক বৃত্তিও সরকার বন্ধ করে দিয়েছে। সেজন্য অবশ্য আমি মোটেই দুঃখিত নই। ধনসম্পদে আমার কোনওদিনও রুচি ছিল না। কিন্তু জিনিসটা আমার পূর্বপুরুষের সংগৃহীত সম্পদ। বাজারে নিশ্চয় ওটার অনেক টাকা দাম। দামের জন্য নয়, একটা পারিবারিক ও বংশানুক্রম পবিত্র স্মৃতির প্রতীক বলেই আমার কষ্ট হচ্ছে।
কর্নেল বললেন, জিনিসটা বলতে কোনও রত্নের কথাই হয়তো বলছেন। সেটা কি চুরি হয়ে গেছে?
কান্দ্রার নবাব নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, হ্যাঁ। খুব রহস্যময় চুরি।
–কবে চুরি গেছে?
—গত ২৫ মার্চ রাত্রে। আমি তখন কান্দ্রা লেকের ধারে তাঁবুতে ছিলুম। খবর পেয়েছিলুম হিন্দুকুশ থেকে এক ঝাঁক ভরত পাখি এসেছে। দুদিন ধরে খুঁজে বেড়াচ্ছিলুম। ২৬ মার্চ সকালে খবর পেলুম নুরে আলম চুরি গেছে। নুরে আলম কথাটার মানে ব্রহ্মাণ্ডের জ্যোতি। এমন নামের কারণও ছিল। ওটা একটা অত্যাশ্চর্য রত্ন। বিস্তর জহুরিকে দেখানো হয়েছে। কেউ বলতে পারেনি ওটা কী। কালো রঙের পাথরের মতো দেখতে। অথচ আলো পড়লেই নীল লাল সাদা সবুজ হরেক রঙের রশ্মি ঠিকরে পড়ত আর সেই রশ্মিগুলো চর্কির মতো ঘুরত। একবার এক ধাতুবিজ্ঞানীকে দেখিয়েছিলুম। তিনিও চিনতে পারেননি ওটা কী ধাতু।
—হুঁ। কীভাবে চুরি গেছে?
—কান্দ্রা উপত্যকায় এই সময়টা মাঝরাতে পাহাড় থেকে একটা ঝোড়ো হাওয়া নেমে আসে। গ্রীষ্ম অব্দি এটা দেখা যায়। ২৫ মার্চ রাতে ঝড়টা যখন আসে, হঠাৎ বাড়ির সব আলো নিভে গিয়েছিল। ঝড়টা মিনিট কুড়ি ছিল। ওই সময় দারোয়ান একটা অদ্ভুত শব্দ শোনে। শব্দটা কতকটা ঘুঙুরের মতো। কেউ যেন পায়ে অসংখ্য ঘুঙুর বেঁধে ঝমঝম করে হেঁটে বেড়াচ্ছে। বাবুর্চি কিসমত খাঁ বলেছে, সে অন্যরকম শব্দ শুনেছে। শিসের শব্দের মতো। তারপর
—আগে বলুন, নুরে আলম ছিল কোথায়?
—আমার বেডরুমে দেয়ালে আঁটা আয়রনচেস্টের ভিতর। চোর সেটার একটা পাল্লা সম্ভবত গ্যাসের আগুনে—তার মানে, অ্যাসিটিলিনে গলিয়ে তরল করেছে। তারপর জিনিসটা হাতিয়েছে।
–দরজা বন্ধ ছিল বাইরে থেকে?
—নিশ্চয় ছিল। তালা গলিয়ে ফেলেছে। কিন্তু ভয়ঙ্কর ব্যাপার হল, দরজার বাইরে আমার এক পরিচারক কুদরত খায়ের লাশ পড়ে ছিল। নিশ্চয় সে টের পেয়ে ছুটে গিয়েছিল। কিন্তু তাজ্জব ব্যাপার, তার লাশ একেবারে পুড়ে ছাই! একদলা ছাই তুলে কবর দেওয়া হয়েছে।
—ছাই! কর্নেল অবাক হয়ে বললেন।পোস্টমর্টেম হয়নি?
-কীভাবে হবে? তবে একমুঠো ছাই পুলিশ দিল্লির ফরেন্সিক এক্সপার্টদের কাছে পাঠিয়েছিল, তাদের মতে, প্রচণ্ড ভোল্টের বিদ্যুৎ বয়ে গেছে কুদরত খাঁর শরীরে।
–বাজ পড়ে মারা গেলেও কিন্তু লাশ পুড়ে ছাই হয় না।
—হ্যাঁ। তাছাড়া ঘরের ভিতর বাজ ঢুকবে কীভাবে? বাজের তো ঠ্যাং গজায়নি।
আমি বললুম, শ্মশানের বৈদ্যুতিক চুল্লিতে মড়া পুড়িয়ে ছাই করা হয়। নিশ্চয় অতটা ভোল্টেজ হলে কুদরত খাঁর দেহ ছাই হত না!
মির্জানবাব কফি শেষ করে বললেন, তাহলেই বুঝুন কেমন চোর!
কর্নেল একটু হেসে বললেন, বৈদ্যুতিক চোর!
মির্জাসায়েবের মুখে অবশ্য হাসি ফুটল না। উনি জ্যাকেটের পকেটে হাত ভরে কিছু বের করেছিলেন। ভাবলুম সিগারেটের প্যাকেট বের করছেন। কিন্তু তার বদলে বের করলেন কাগজে জড়ানো একটা চাকতির মতো জিনিস। মোড়ক খুললে দেখলুম, জিনিসটা একটা কালো রঙের চাকতি। আয়তনে রুপোর টাকার চেয়ে সামান্য বড়। চাকতিটার দুপিঠেই সাদা আঁকজোক।
সেটা কর্নেলের হাতে দিয়ে কান্দ্রার নবাব বললেন, এই জিনিসটা কুদরত খায়ের লাশের কাছে। পড়েছিল। ফরেন্সিক টেস্ট করানো হয়েছে। ওঁরা বলতে পারেননি এটা কোনও ধাতু না পাথর। কোনও জৈব পদার্থও নয়। মোট কথা, এটা বিজ্ঞানীদের এ পর্যন্ত জানা কোনও পদার্থের মধ্যে পড়ে না।
কর্নেল উঠে গিয়ে তার আতস কাচ নিয়ে এলেন। তারপর পরীক্ষা করতে করতে বললেন, উঁহু—এই আঁকজোকগুলো ফার্সি নয়। কী ভাষা কে জানে।
মির্জাসায়েব বললেন, কর্নেল, এই জিনিসটাকে কান্দ্রার লোকেরা বলে ওজরাকের পাঞ্জা।
কর্নেল মুখ তুললেন। ভুরু কুঁচকে বললেন, ওজরাকের পাঞ্জা!
আমি অবাক হয়ে বললুম, ওজরাক! সে আবার কে?
কান্দ্রার নবাব বললেন, ওখানকার লোকে—বিশেষ করে পশুপালক গুজর উপজাতির লোকেরা বংশপরম্পরায় বিশ্বাস করে, কান্দ্রা উপত্যকার পশ্চিমের পাহাড়ে বাস করে ওজরাক নামে এক মায়াবী জাদুকর। তার নাকি উড়ান-খাটোলা বা উড়ন্ত খাটিয়া আছে। তাতে চেপে মাঝে মাঝে ওজরাক বেড়াতে যায় নক্ষত্রের দেশে।
হাসতে হাসতে বললুম, রীতিমতো রূপকথা!
কে কানে!—মির্জাসায়েব বললেন।—ওজরাক নাকি খেয়াল বশে কখনও তার পাহাড়পুরী থেকে নেমে আসে কান্দ্রা উপত্যকায়। যখনই আসে, এই পাঞ্জা ফেলে রেখে যায়। যেন জানিয়ে যায়, আমি এসেছিলুম।
—আপনি বিশ্বাস করেন এসব কথা?
মোটেও করি না। কিন্তু ২৫ মার্চ রাত্রে যখন লেকের ধারে তাঁবুতে ছিলুম, ঝড় ওঠার সময় দূর আকাশ থেকে একটা আলো নেমে আসতে দেখেছিলুম। ভেবেছিলুম, উল্কা কিংবা কান্দ্রা অবজারভেটরির আবহাওয়া বেলুন। কে জানে কী!
—আর কারুর কাছে ওজরাকের পাঞ্জা আছে জানেন? দেখেছেন এমন পাঞ্জা?
—দেখেছি। গুজরদের সর্দার হালাকু একটা পাঞ্জা কুড়িয়ে পেয়েছিল। সেটা যত্ন করে রেখে দিয়েছে। দেখিয়েছিল আমাকে।
কর্নেল চাকতিটা খুঁটিয়ে পরীক্ষা করছিলেন। কান করে শুনি, বিড়বিড় করে বলছেন, ওজরাকের পাঞ্জা….ওজরাকের পাঞ্জা…ওজরাক…ওজরাক…
তারপর সোজা হয়ে বসলেন। মির্জাসাহেব! এগুলো হরফ নয়। প্রতীক চিহ্ন। পাঁচটা করে আঁকা-বাঁকা সাদা রেখে আসলে বজ্রচিহ্ন।
এই বলে উনি হন্তদন্ত উঠে গেলেন বুকশেলফের কাছে। একটা প্রকাণ্ড বই টেনে পাতা ওল্টাতে থাকলেন। তারপর উজ্জ্বল হাসি নিয়ে সোফায় ফিরলেন। বললেন, আমার স্মৃতিশক্তি ক্ষয়ে যাচ্ছে দ্রুত। প্রকৃত বার্ধক্যের লক্ষণ চুলদাড়ি সাদা হওয়া বা বয়স বেশি হওয়াতে নেই। যাই হোক, এই বইটা হল রিচার্ড কেলির লেখা এ শর্ট ওয়াক ইন দি কারাকোরাম অ্যান্ড হিন্দুকুশ। পর্যটক কেলি ১৮৭৯ সালে কাশ্মীর, আফগানিস্তান আর পামির অঞ্চলে কিছুদিন ঘুরে বেড়িয়েছিলেন। ওই সময় তিনি স্থানীয় লোকেদের কাছে ওজরাকের পাঞ্জার কথা শোনেন। তবে তিনি জিনিসটা দেখেননি।
মির্জাসায়েব জিগ্যেস করলেন, ওজরাকের গল্পও তাহলে শুনে থাকবেন কেলি। লিখেছেন কিছু?
কর্নেল জবাব দিলেন, হ্যাঁ। কেলির মতে, ওটা স্রেফ রূপকথা।
কর্নেলের হাত থেকে পাঞ্জাটা চেয়ে নিলুম। দেখতে দেখতে বললুম, এটাকে পাঞ্জা বলার কারণ কী?
মির্জাসায়েব বললেন, পাঞ্জা এসেছে পাঞ্জ শব্দ থেকে। ফার্সি পাঞ্জ আর সংস্কৃত পঞ্চ একই শব্দ। কিন্তু পাঞ্জা বলতে বোঝায় হাতের পাঁচটা আঙুলের ছাপ। আগের দিনে বাদশারা কোনও হুকুমজারি করলে কিংবা সরকারি চিঠিপত্তর পাঠালে তাতে পাঁচটা আঙুলের টিপছাপ মেরে দিতেন। সই জাল করা যায়। কিন্তু আঙুলের ছাপ জাল করলে ধরা পড়বেই। কারণ প্রত্যেকটি মানুষের আঙুলের ছাপ আলাদা। এই কালো চাকতির পাঁচটা বজ্রচিহ্নকে কান্দ্রার লোকেরা ওজরাকের পাঁচ আঙুলের ছাপ বলে বিশ্বাস করে।
কর্নেল মন্তব্য করলেন, ওজরাকের পাঞ্জায় বজ্রচিহ্ন থাকার অর্থ দাঁড়াচ্ছে, ওজরাক বজ্রদেবতা।
আমার মাথায় চমক খেলে গেল। বললুম, কর্নেল! ওজরাক শব্দটা বজ্রের অপভ্রংশ নয় তো?
তুমি হয়তো ঠিকই বলেছ, জয়ন্ত। কর্নেল বইটা রাখতে গেলেন শেলফে। রেখে এসে ফের বললেন, ভাষাতাত্ত্বিক পণ্ডিতদের মতে, ওইসব অঞ্চলের সব ভাষা ও উপভাষার উদ্ভব ঘটেছে একটা পুরনো ভাষা থেকে, যাকে বলা যায় ইন্দো-ইরানি মূল ভাষা। তাই ভারতীয় প্রধান ভাষা সংস্কৃতের সঙ্গে ওদের মিল দেখা যায় এত।
মির্জাসায়েব একটু চঞ্চল হয়ে উঠলেন। বললেন, ভাষাতত্ত্ব থাক, কর্নেলসায়েব! আমার নুরে আলম চুরির ব্যাপারে কী করছেন বলুন!
কর্নেল অভ্যাসমতো চোখ বুজে দাড়িতে আঙুলের চিরুনি টানছিলেন। সেই অবস্থায় বললেন, ইদানীং দেশের বিভিন্ন জাদুঘর বা প্রত্নশালা থেকে বেশ কিছু ঐতিহাসিক রত্ন এবং মূর্তি চুরির হিড়িক পড়ে গেছে। না—কোথাও ওজরাকের পাঞ্জা পড়ে থাকতে দেখা যায়নি। তবে চুরির পদ্ধতি অনেকটা একরকম। অ্যাসিটিলিন প্রায়োগ করেছে চোর। সেই সঙ্গে আরও একটা মিল এখন দেখতে পাচ্ছি। চুরি হয়েছে দুপুর রাতে এবং…
হঠাৎ নড়ে বসলেন কর্নেল। চোখ খুলে বললেন, কী আশ্চর্য!
মির্জাসায়েব বললেন, কী ব্যাপার?
ঝড় বা ঝোড়ো হাওয়া!
-তার মানে?
—প্রত্যেকটি চুরি হয়েছে গভীর রাতে এবং সেই সময় ঝড় বইছিল।
আমি বললুম, ঝড়ের সময় মওকা বুঝেই চোর এসেছিল হয়তো!
কর্নেল উঠে পায়চারি করতে করতে উত্তেজিতভাবে বললেন, শুধু ঝড় নয়, অদ্ভুত সব শব্দ। মির্জাসায়েব বলছিলেন, দারোয়ান যেন ঘুঙুরের শব্দ শুনেছে। প্রত্যেকটি চুরির রিপোর্টে এর উল্লেখ আছে। রক্ষীরা বলছে, যেন কোথায় ঝমর ঝম শব্দে ঘুঙুর বেঁধে কেউ নাচছিল।
আমি ও কান্দ্রার নবাব নিঃশব্দে দেখাদেখি করছিলুম পরস্পরের দিকে। বলার কিছু খুঁজে পাচ্ছিলাম না।
ওজরাকের ইন্দ্রজাল
কান্দ্রা উপত্যকার চারিদিকেই উঁচু সব পাহাড়। পূর্বদিকে একটা গিরিবর্ক্স আছে, যার নাম হায়দার পাস, কান্দ্রার নবাবের পূর্বপুরুষের নামে। স্থলপথে কান্দ্রায় ঢুকতে হলে হায়দার পাস হয়ে যেতে হয়। কিন্তু শীতের দু-তিনটে মাস ওই গিরিবর্ক্স বরফ জমে বন্ধ হয়ে যায়। তবে এ যুগে বিমানের দৌলতে কান্দ্রা যাতায়াতে আগের মতো বাধাবিপত্তি নেই। বারোমাসই যাতায়াত চলে শীতের সময়টা বিমানে বাকি সময় মোটর গাড়িতে।
এখন এপ্রিলে হায়দার পাস খুলে গেছে। কান্দ্রায় বসন্ত ঋতুর সমারোহ। তবে এই ভূস্বর্গ ভ্রমণে খুব কড়াকড়ি আছে সরকার থেকে। প্রতিরক্ষা দফতরের কড়া নজর পর্যটকদের দিকে। অবজারভেটরি, রেডার কেন্দ্র, স্পেস রিসার্চ ল্যাবরেটরি, বিমানবাহিনীর ব্যারাক এবং একটি বিমানক্ষেত্র—কান্দ্রা ভ্যালিতে এতসব ব্যাপার। কাজেই কড়াকড়ি থাকা স্বাভাবিক।
সম্প্রতি কান্দ্রা অবজারভেটরিতে যে টেলিস্কোপটি বসানো হয়েছে, সেটা এশিয়ার বৃহত্তম। অবজারভেটরির ডিরেক্টর ডঃ শীলভদ্র সোম কর্নেল এবং আমাকে ঘুরে-ফিরে সব দেখাচ্ছিলেন। কর্নেলের সঙ্গে ওয় পরিচয় আছে দেখে অবাক হইনি। আজকাল কর্নেলের কোনও ব্যাপারে অবাক হই না।
দেখাশোনা শেষ হলে ডঃ সোম আমাদের নিয়ে গেলেন তার অফিস ঘরে। এখান থেকে কান্দ্রা উপত্যকার বহুদূর পর্যন্ত নজরে পড়ে। কর্নেল চুরুট জ্বেলে ধোঁয়ার ভিতর থেকে বললেন, ডঃ সোম ২৫ এবং ২৬ মার্চের অবজার্ভেশন রিপোর্টটা এবার দেখতে চাই।
কর্নেল ফাইলে মনোনিবেশ করলেন। ততক্ষণে কফি আর স্ন্যাক্স এসে গেল। নবাববাড়ি লাঞ্চ সেরে আমরা বেরিয়েছি। এখন প্রায় তিনটে বাজে।
কফি খেতে খেতে রিপোর্ট পাঠ শেষ করে কর্নেল মুখ তুলে একটু হাসলেন।মাঝরাতের ঝড়টার কিছু বৈশিষ্ট্য ছিল তাহলে!
ডঃ সোম বললেন, ছিল। ১০ মিনিট ৫৭ সেকেন্ডের ঝড়। সারা কান্দ্রা ভ্যালির পাওয়ার ফেল করেছিল অতক্ষণ। আমাদের অবজার্ভেটরির সব যন্ত্রপাতি নিষ্ক্রিয় হয়ে গিয়েছিল। সূক্ষ্ম কিছু যন্ত্র একেবারে অকেজো হয়ে গিয়েছিল। সেগুলো রিপ্লেস করতে হয়েছে। মেরামত করেও চালু করা যায়নি। কিন্তু তার চেয়ে সাংঘাতিক ব্যাপার, কসমিক ডাস্ট পাওয়া গেছে ছাদের ফুলগাছের পাতায় এবং খোলা ট্যাংকের জলে।
কসমিক ডাস্ট মহাজাগতিক ধূলিকণা!-কর্নেল সোজা হয়ে বললেন।
ডঃ সোম হাসতে হাসতে বললেন, যেন মহাজাগতিক ঝড়ের একটা বিক্ষিপ্ত প্রবাহ পৃথিবীর আবহমণ্ডলে ঢুকে পড়েছিল সে রাতে!
কর্নেল ব্যস্তভাবে বললেন, এখানকার রেডার স্টেশন কী বলে?
ডঃ সোম একটা ফাইল নিয়ে এলেন। চোখ বুলিয়ে দেখে বললেন, হ্যারেডারে দশ সেকেন্ডের জন্য দক্ষিণ-পশ্চিম আকাশে অজানা কোনও বিমানের সংকেত পাওয়া গিয়েছিল। তারপর সেটা রেডার-স্ক্রিন থেকে সরে যায় ডানদিকে নিচে। এই দেখুন, গতিটা ধনুকের মতো বাঁকা দেখানো হয়েছে।
কর্নেল ফাইলটা নিয়ে কিছুক্ষণ চোখে বুলিয়ে বললেন, বিমানক্ষেত্রে ওইসময় কোনও বিমান নামেনি তাহলে?
—না। ওঁরা বলেছেন, প্রায়ই চীনা বিমান ভারতীয় এলাকায় ঢুকে পড়ে এবং পালিয়ে যায়। এও কোনও উন্নতধরনের চীনা বিমান হওয়া সম্ভব। কারণ ম্যাগনেটিক ফিল্ডে প্রচণ্ড অভিঘাত ধরা পড়েছিল।
আমি বললুম, নবাব মির্জাসায়েব লেকের ধারে তাঁবু থেকে ওদিকে একটা আলো নামতে দেখেছিলেন!
ডঃ সোম চমকে উঠলেন। কর্নেল একটু হেসে বললেন, উফো! আনআইডেন্টিফায়েড ফ্লাইং অবজেক্ট!
ডঃ সোম হাসতে লাগলেন।—ঠিক তাই! শুধু মির্জাসায়েব কেন, কান্দ্রা এলাকার লোকে প্রায়ই উফো দেখে। এসআরএল থেকে তদন্ত করে দেখা গেছে, কোনওটা আমাদের আবহাওয়াবেলুন, কোনওটা উল্কা, আবার কোনওটা চীনা গুপ্তচর বিমান অথবা কোনও স্পাইং ডিভাইস।
কর্নেল আবার ফাইলে চোখ রেখেছিলেন। বললেন, কান্দ্রা ভ্যালির পশ্চিম পাহাড় কি সত্যি দুর্গম, ডঃ সোম?
—ভীষণ দুর্গম। কোনও মানুষের পক্ষে ওই খাড়া গ্রানাইট দেয়াল বেয়ে ওঠা সম্ভব নয়।
-প্লেনে?
—প্লেনের পক্ষে আজকাল অসম্ভব তো কিছুই নেই। কিন্তু তার ওধারে চীনের অসংখ্য ঘাঁটি আছে। তাই প্লেনে ওদিকে ঘোরাঘুরি নিরাপদ নয়।
—আপনি ওজরাকের কথা শুনেছেন, ডঃ সোম?
ডঃ সোম হাসতে হাসতে বললেন, ছেলে ভুলোমনা রূপকথা!
—মির্জাসায়েবের পরিচারকের মৃতদেহ ছাই হওয়ার ব্যাপারে কী বক্তব্য?
ডঃ সোম গম্ভীর হয়ে বললেন, নবাববাড়িতে চুরি হওয়ার কথা শুনেছি। ওসব ব্যাপার পুলিশের এক্তিয়ারে পড়ে। তবে এটুকু বলতে পারি, চুরির সঙ্গে একটা বৈদ্যুতিক দুর্ঘটনাও জড়িত।
—কিন্তু সেজন্য যে প্রচণ্ড ভোল্টেজ দরকার, তা নবাববাড়ির ডোমেস্টিক লাইনে নেই।
—দেখুন কর্নেল, কোনওভাবে যদি আর্থ লাইন নষ্ট হয়ে যায়, তাহলে অনেকক্ষেত্রে হেভি ভোল্টেজ দুর্ঘটনা ঘটাতে পারে। আবার ট্রান্সফর্মার যে সাপ্লাই লাইনে এসেছে, তার আর্থ লাইন নষ্ট হলে ট্রান্সফর্মারও জ্বলে যায়। নবাববাড়ির পিছনেই একটা ট্রান্সফর্মার আছে। সেটা জ্বলে গিয়েছিল শুনেছি। কাজেই ডেডবডি ছাই হওয়ার মধ্যে অলৌকিক কিছু থাকতে পারে না। অনেক সময় সাপ্লাই লাইনে আর্থ লাইনের গণ্ডগোলের জন্য আলো প্রচণ্ড বাড়ে ও কমে—যাকে বলে ফ্লাকচুয়েশন! একবার আমার কোয়ার্টারেই এমন হয়েছিল। ধোঁয়া বেরুতে শুরু করেছিল। বাল্ব কেটে গিয়েছিল। টি. ভি. ফ্রিজ ইত্যাদি নষ্ট হয়ে গিয়েছিল।
কর্নেল উঠলেন।—চলি ডঃ সোম! আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। প্রয়োজনে আবার আপনাকে বিরক্ত করতে আসব।
অবশ্যই আসবেন।—ডঃ সোম করমর্দন করলেন কর্নেলের সঙ্গে তারপর আমার করমর্দন করে বললেন, জয়ন্তবাবু! আমাদের কাজকর্ম সম্পর্কে আশা করি কাগজে লিখবেন।
ডঃ সোমের কাছে বিদায় নিয়ে যখন বেরুলুম, তখন কান্দা উপত্যকায় বিকেলের গোলাপি রোদুর নেমেছে। পাহাড়ের গা কেটে রাস্তা নেমেছে ঘুরে-ঘুরে। মির্জাসায়েবের গাড়িতে আমরা এসেছিলুম। ড্রাইভারের নাম বদর খাঁ। একখানে হঠাৎ গাড়ি থামিয়ে সে হিন্দিতে বলল, দেখুন সায়েব! ওজরাকের কথা জিজ্ঞেস করছিলেন—ওই দেখুন ওজরাকের দেশ! আজব জাদু দেখুন!
কর্নেল মুখ বাড়ালেন। আমি বললুম কই জাদু, বদর খাঁ?
বদর খাঁ বলল, পশ্চিমদিকে নজর দিন, সায়েব!
আমাকে গাড়ি থেকে নামতে হল। কারণ গাড়ির মুখ উত্তরে এবং কর্নেল বসেছেন বাঁদিকে, আমি ডাইনে। নেমে গিয়ে হতবাক হয়ে পড়লুম।
ওই পার্থিব সৌন্দর্যের কোনও তুলনা নেই। পশ্চিমের পাহাড়গুলোর চুড়ো কোনওটা গির্জার মতো ছুঁচলো, কোনওটা পিরামিডের মতো তিনকোনা আর তাদের ফাঁকে গলিয়ে পিচকিরির মত রংবেরঙের আলোর দীর্ঘ দীর্ঘ ফালি উপারি সবুজ সমভূমিতে নেমে আসছে। পাহাড়গুলোর কঁধে ঘন নীল কুয়াশার আলোয়ান চাপানো যেন। কিন্তু বড় মায়াময় ওই রামধনুর মতো অথবা প্রিজমের মতো বিচ্ছুরিতবর্ণালী! এমন আশ্চর্য রঙের খেলা আর কখনও দেখিনি।
দেখতে দেখতে ওজরাকের ওপর যেন বিশ্বাস এসে গেল। ওখানে কোনও মায়াবী জাদুকর বাস করে, তা মিথ্যা নয়। তার খেয়ালি হাতের অপরূপ ওই ইন্দ্রজাল দেখে তারিফ করবে না সে কোন মূখ! আমি ভাবে গদ গদ হয়ে বললুম, অপূর্ব খাসা! কর্নেল, ওজরাককে আমার প্রণাম করতে ইচ্ছে করছে।
কর্নেল চোখে বাইনোকুলার রেখেই নামিয়ে ফেললেন।নাঃ! খালি চোখেই রঙের খেলাটা দেখা যাচ্ছে। তবে ডার্লিং। তুমি যতই বলো, এর মধ্যে কোন জাদু আমি দেখতে পাচ্ছি না। আশা করি, দার্জিলিঙের টাইগার হিল থেকে তুমি সূর্যোদয় দেখেছ!
আপত্তি করে বললুম, এটা সূর্যাস্ত। তাছাড়া কিসের সঙ্গে কিসের তুলনা! কর্নেল, শুধু রঙিন আলো হলেও কথা ছিল! আপনি কি দেখতে পাচ্ছেন না ওজরাকের জাদুপুরীও ক্রমশ ভেসে উঠেছে! ওই দেখুন, যেন রংবেরঙের সাতমহলা প্রাসাদ ভাসছে শূন্যে।
বদর খাঁ বিড়বিড় করে কী আওড়াচ্ছিল চোখ বুজে। এবার দুহাতে মুখ ঘষে তাকে গাড়িতে ঢুকতে দেখলুম। বলল, চলে আসুন সায়েব! বেশিক্ষণ দেখলে চোখ নষ্ট হয়ে যাবে। ওজরাক হল গিয়ে শয়তানের চেলা। শয়তানের কাছে জাদু শিখে মানুষকে ভোলায় সে। সেদিন ঠিক এমনি সময়ে হালাকুর মেয়ে ভেড়া চরাতে গিয়ে ওজরাকের পাল্লায় পড়েছিল! জোর বেঁচে পালিয়ে এসেছে।
গাড়ি আবার এগোল। কর্নেল বললেন, বদর খাঁ! হালাকু থাকে কোথায়?
বদর খাঁ বলল, লেকের দক্ষিণে এখান থেকে ছ-সাত মাইল দূরে ওদের তাঁবু।
—সেখান গাড়ি করে যাওয়া যায় না বদর খাঁ?
—লেক অব্দি গাড়ি যাবে। তারপর আধামাইল পায়দল যেতে হবে।
–নিয়ে যাবে আমাদের?
বদর খাঁ হাসল।-হজুর নবাবসায়েবের হুকুম আছে। যেখানে যেতে চাইবেন, এ বান্দা সেখানেই নিয়ে যাবে। তবে গুজরদের তাঁবুর এলাকায় সাবধানে যেতে হবে, সায়েব! ওদের কুকুরগুলো বড্ড বেতমিজ।
কর্নেল হাসতে হাসতে বললেন, কুকুর বশ করার ব্যাপারে আমিও এক ওজরাক, বদর খাঁ!
রিয়া ও তার প্রতিবিম্ব
কান্দ্রা ও লেকের কাছে গাড়ি থামিয়ে বদর খাঁ বলল, একটু অপেক্ষা করুন আপনারা। গাড়িটা কোথাও লুকিয়ে রেখে আসি। আজকাল এ তল্লাটে খুব গাড়ি চুরি হচ্ছে।
সে একটু তফাতে উইলোঝোপের আড়ালে গাড়িটাকে এমনভাবে রেখে এল, রাস্তা থেকে ঠাহর হচ্ছিল না ওখানে কোনও গাড়ি আছে। গাড়িটার রংও অবশ্য ঘন সবুজ।
ফিরে এসে বদর খাঁ বলল, আপনাদের সঙ্গে টর্চ আছে তো? ফিরতে আঁধার হয়ে যাবে।
কর্নেল বললেন, আছে। এমনকী কুকুর-বশ করা যন্ত্রও আছে!
বদর খাঁ খুব অবাক হয়ে পা বাড়াল। অবাক হলুম আমিও। নিশ্চয় রসিকতা করছেন কর্নেল। পাইনবনের ভিতর এখনই আবছা আঁধার জমেছে। পায়ে চলা রাস্তা ধরে বনটা পেরুলে খোলামেলায় পৌঁছলুম। এবার আর রাস্তার চিহ্ন নেই। এখানে-ওখানে পাথরের বোল্ডার পড়ে আছে। ঘন ঘাসের জঙ্গল গজিয়ে রয়েছে সবখানে। তার মাঝে মাঝে কিছু গাছপালা। এটা মোটামুটি একটা সমতলভূমি বলা যায়। পশ্চিমে পাহাড়ের সেই আলোর জাদু আর চোখে পড়ছে না। সূর্য একটা তিনকোনা চূড়ার আড়ালে নেমে গেছে। তাই সারা তৃণভূমির উপর পাহাড়ের বিশাল ছায়া নেমেছে। ঘাসের জঙ্গলের ভিতর গুজরদের তাঁবু চোখে পড়ছিল। কিছুক্ষণ পরে তাদের খোঁয়াড় দেখা গেল। বেড়ায় ঘেরা বিশাল খোঁয়াড়ে অসংখ্য ভেড়া-ছাগল-দুম্বা জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
কর্নেল আমাকে গাছপালা চেনাচ্ছিলেন।—ওই দেখছ—ওটা ওক। ওইটে হল বুনো আখরোট। ওগুলো পোলার। আর ওই গাছটা লক্ষ্য কর-মালবেরি। যাকে বলে তুঁতফলের গাছ।
হঠাৎ বদর খাঁ থমকে দাঁড়াল। আঁতকে ওঠা গলায় বলল, কুকুর সায়েব! কুকুর আসছে!
চমকে উঠে দেখি, খোঁয়াড়ের দিক থেকে তিনটে তাগড়াই কুকুর জিভ বের করে দৌড়ে আসছে আমাদের দিকে। আমি পকেট থেকে ঝটপট রিভলভার বের করতেই কর্নেল বললেন, আঃ! কী করছ জয়ন্ত! রিভলভার লুকিয়ে ফেলো শিগগির।
বলে উনি সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। তারপর জ্যাকেটের ভিতর পকেট থেকে একটা কাচের টিউব বের করলেন। কুকুর তিনটে যখন প্রায় হাত দশেক তফাতে এসে গেছে, তখন সেই টিউব বাড়িয়ে দিলেন সামনের দিকে এবং ছিপি খুলে ফেললেন।
সঙ্গে সঙ্গে তিনটে কুকুরই থেমে গেল। মুখ নিচু করে কেঁউ কেঁউ শব্দ করতে থাকল। কর্নেল হাসতে হাসতে একটুখানি এগিয়েছেন, আর তিনটে, কুকুরই লেজ গুটিয়ে কুঁকড়ে পিঠটানা দিল। বদর খাঁ খ্যা খ্যা করে হেসে কুকুর তিনটেকে দুয়ো দিতে থাকল।
অবাক হয়ে বললুম, ব্যাপারটা কী কর্নেল?
কর্নেল মুচকি হসে পা বাড়িয়ে বললেন, আমার সাম্প্রতিক উদ্ভাবন। এর নাম দিয়েছি ফরমুলা-ডগ। অ্যামোনিয়ার সঙ্গে উনিশরকম রাসায়নিক দ্রব্য মিশিয়ে এটা তৈরি করেছি। এর এমনই উৎকট গন্ধ যে কুকুর কেন, কেঁদো বাঘও কেঁচো হয়ে পালিয়ে যাবে। অবশ্য মানুষের উপর এখনও পরীক্ষা করিনি। এখনই করা যেতে পারে।-বলে টিউবটা আমার দিকে ঘোরালেন।
গন্ধ পেলুম কি না জানি না, আঁতকে উঠে নাক বন্ধ করে পিছিয়ে এলুম। —দোহাই কর্নেল! এই কুকুর তাড়ানো ফরমুলা-ডগ প্রয়োগের জন্য আরও মানুষ পাবেন।
কর্নেল ছিপি এঁটে টিউবটা প্যাকেটের ভিতর চালান করলেন। বদর খাঁ নাকের ফুটোয় আঙুল ঢুকিয়ে বলল, বহৎ বদ বু নিকালতা।
গুজরদের তাঁবুতে ততক্ষণে কুকুরের ব্যাপারটা ওরা টের পেয়ে গেছে হয়তো। একদল লোক বেরিয়ে আমাদের দেখছে। বদর খাঁ চেঁচিয়ে ডাকল, হালাকু! হালাকু! জলদি ইধর আও। কলকাত্তাসে সাবলোগ তুমহারা মুলাকাত মাংতা।
একজন প্রৌঢ় তাগড়াই গড়নের লোক ভিড় থেকে আমাদের দিকে দৌড়ে এল। তার মাথায় প্রকাণ্ড পাগড়ি, পরনে ঢিলে কোর্তা আর শালোয়ার। পা অবশ্য খালি। সেলাম দিয়ে বদর খাঁ-র দিকে জিজ্ঞাসু চোখে তাকাল। বদর খাঁ বলল, নবাববাহাদুর এঁদের পাঠিয়েছেন। এঁরা তোমার সঙ্গে কথা বলতে চান।
গুজর সর্দার আমাদের খুব খাতির দেখিয়ে তাঁবুতে নিয়ে গেল। তাঁবুগুলো চামড়া সেলাই করে তৈরি। কোনওটার উপর তেরপলও চাপানো হয়েছে। খোলা জায়গায় উনুন পেতে মেয়েরা রাতের রান্নায় ব্যস্ত। কেউ চাপাটি বানাচ্ছে। কেউ প্রকাণ্ড পাত্রে দুধ জাল দিচ্ছে। ভিড় হটিয়ে হালাকু চামড়ার আসন পেতে আমাদের বসাল। আশেপাশে কোথাও কুকুরের লেজের ডগটুকুও দেখতে পাচ্ছিলুম না।
কর্নেল লোকের সঙ্গে ভাব জমাতে ওস্তাদ। হালাকু সর্দারের সঙ্গে খোশগল্প জুড়ে দিয়েছেন। হালাকু ভাঙা-ভাঙা হিন্দিতে কথা বলছে। আমরা নবাববাহাদুরের মেহমান শুনে সে একেবারে ভক্তিতে গদগদ। বলল, এবার শীতকালটা কান্দায় এসে ভালই কাটল। যেখানেই ঘুরে বেড়াই, কান্দ্রার জন্য মন পড়ে থাকে আমাদের। পুরুষানুক্রমে কান্দ্রার নবাব আমাদের মা-বাপের মতো। এই যে ঘাসের জঙ্গল দেখছেন, তার মালিক ওঁরা। কোনও খাজনা কখনও দাবি করেননি। আমরা এসে তাই ভেট দিই। ছাগল ভেড়া, কখনও মাখন দুধ চর্বি—যা পারি দিই। তো নবাববাহাদুর কিছুতেই নিতে চান না। বলেন, মিলিটারিদের দিয়ে এস। ওরাই নাকি এখন এই ঘাসের জঙ্গলের মালিক। আমি বিশ্বাস করি না, হুজুর।
কর্নেল বললেন, এবার গ্রীষ্মে কোথায় যাবে, সর্দার?
হালাকু বলল, পামির এলাকায় যাব। সেখানে চীনাদের রাজত্ব। সেখান থেকে যাব কাশগড়, তারপর উত্তরে মাকরান। সেখানে হুজুর, রুশ মুল্লুক। সেখান থেকে আবার কান্দ্রায় ফিরে আসব। ওসব মুল্লুকে শীতের সময় খালি বরফ আর বরফ। জানোয়ার কী খেয়ে বাঁচবে?
কর্নেল বললেন, আমি তোমার কাছে এসেছি ওজরাকের কথা শুনতে। তোমার কাছে নাকি ওজরাকের পাঞ্জা আছে।
হালাকু চোখ বড় করে তাকাল। তার মুখটা গম্ভীর হয়ে গেল। দুর্বোধ্য ভাষায় কাউকে কী বলল, তারপর উঠে তার তাঁবুতে ঢুকল। একটা লোক ব্যস্তভাবে আমাদের সামনে একপাঁজা কাঠ এনে আগুন ধরাল। বেশ ঠাণ্ডা টের পাচ্ছিলুম। আগুনের কুণ্ড ঘিরে বসলুম আমরা। তারপর হালাকু বেরিয়ে এল তাঁবু থেকে।
তার হাতে সেই ওজরাকের পাঞ্জা। কর্নেলের হাত দিয়ে সে বলল, আমি খুব ভাবনায় পড়ে গেছি হুজুর। আজই ভাবছিলুম, পাঞ্জাটা যেখানে পেয়েছিলুম, ফেলে দিয়ে আসব নাকি। এটা আর কাছে রাখতে সাহস হচ্ছে না।
—কেন সর্দার?
হালাকু উদ্বিগ্ন মুখে বলল, আমার মেয়ে রিয়া দুদিন আগে ওজরাকের পাল্লায় পড়েছিল। খুব বেঁচে গেছে।
কথাটা বদর খাঁ বলেছিল। তখন অতটা গ্রাহ্য করিনি। তাই বললুম, ব্যাপারটা খুলে বলো তো সর্দার!
হালাকু বলল, পশ্চিমপাহাড়ের নিচে একটা নহর আছে। লেক থেকে নহরটা বেরিয়ে পশ্চিমপাহাড়ের নিচে দিয়ে চলে গেছে। এখন নহরে অল্প একটু জল আছে। আমরা নহরের ওপারে কখনও যাই না। রিয়া সেটা জানে। তবে ওর দোষ নেই। আমায় একটা মদ্দা ভেড়া খুব বদমাশ। পাল থেকে প্রায়ই পালিয়ে যায়। সেটা নহরের ওপরে চলে গিয়েছিল। রিয়া সেটাকে ধরে আনতে গিয়েই ওজরাকের পাল্লায় পড়েছিল।
কর্নেল বললেন, তোমার মেয়ের মুখেই ব্যাপারটা শুনতে চাই সর্দার। তাকে ডাকো।
হালাকুর ডাকে একটি কিশোরী এগিয়ে এল। ছিপছিপে গড়ন, পাকা আপেলের মতো গায়ের রং। পরনে সালোয়ার-কামিজ। চুলে লাল একটা রুমাল বাঁধা। হালাকু তাদের ভাষায় কিছু বলল।
রিয়া কাঁচুমাচু হাসছিল। কর্নেল পকেট থেকে একটা চকোলেটের প্যাকেট বের করে বললেন, নাও রিয়া! এটা তোমার জন্য এনেছি।
হালাকুর ইশারায় রিয়া সেটা নিল। তারপর ভাঙা-ভাঙা হিন্দিতে যা বলল, তা যেমন অদ্ভুত, তেমনি রোমাঞ্চকর। আমার তো বিশ্বাস করতেই বাধছিল। ঘটনাটা এই :
সেদিন বিকেলে বাধ্য হয়ে গাড়োলটার (মদ্দা ভেড়া) জন্য সে নহর (খাল) পেরিয়ে ওপারে গিয়েছিল। হঠাৎ সে দেখল কী, অবিকল তার মতো একটি মেয়ে একটা পাথরের উপর দাঁড়িয়ে আছে। একই পোশাক, একই গড়ন। ভাল করে দেখার জন্য সে এগিয়ে গেল। তারপর ভীষণ অবাক হল। মেয়েটি হুবহু তার মতো দেখতে। আয়নার ভিতর নিজের মুখ তো সে দেখেছে। রিয়া গুজর মেয়ে। ভীতু নয় সে। রেগে গিয়ে বলল, তুমি কে?
মেয়েটিও গুজর ভাষায় বলল, তুমি কে?
রিয়া বল, আমি রিয়া।
মেয়েটিও বলল, আমি রিয়া।
—মিথ্যে বোলো না। তোমার বাবার নাম কী?
রিয়া পাথর তুলে তেড়ে যেতেই মেয়েটা যেন শূন্যে ছিটকে গেল। আকাশে ভেসে সে রিয়াকে যেন ভেংচি কাটতে লাগল। রিয়া পাথর ছুড়ল। মেয়েটি অমনি যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। তখন রিয়া ভয় পেয়ে দৌড়ে পালিয়ে এল নহর পেরিয়ে।…
রিয়ার মুখে আদিম সরলতা। তবু কথাগুলো সে বানিয়ে বলছে কি না বোঝা কঠিন। কর্নেল বললেন, হুঁ—আর গাড়োলটার কী হল?
জবাব দিল হালাকু।—রিয়ার মুখে এসব শুনে আর গাড়োলটার খোঁজে যেতে আমরা সাহস পাইনি! সন্ধে হয়ে গিয়েছিল। পরদিন সকালে দলবেঁধে শিঙ্গা, ঢোল এসব নিয়ে সেখানে গেলুম। নহরের ধারে ওজরাকের পুজো দিলুম। আগুনে ঘি আর ভেড়ার রক্ত দিয়ে পুজো দেওয়ার নিয়ম। পুজো দিয়ে সাহস করে নহরের ওপারে গেলুম। বেশিদূর যেতে হয়নি। গাড়োলটা ঘাসের ভিতর মরে পড়েছিল। কিন্তু হুজুর, তাজ্জব ব্যাপার—যেই মরা জানোয়ারটাকে ওঠাতে গেছি, দেখি কী, পুরোটাই ছাই!
কর্নেল, আমি ও বদর খাঁ একসঙ্গে বলে উঠলুম, ছাই!
—হ্যাঁ—একদলা ছাই। অথচ দেখে বোঝার উপায় ছিল না। যেমনকার চেহারা, লোমের রং তেমনি ছিল। কিন্তু হাত ঠেকাতেই ছাই হয়ে গেল। আমরা ভয় পেয়ে পালিয়ে এলুম। গুজরাক বড় জাদুকর, হুজুর! সে তো মানুষ নয়, সে হল পরীদের রাজা। পশ্চিম-পাহাড়ে আছে পরীস্তান। তার বাস সেখানেই। চিরকাল তার কথা শুনে আসছি আমরা।
বদর খাঁ মন্তব্য করল, ওজরাক তাহলে একজন জিন। কেতাবে জিনের কথা আছে বটে।
ওজরাকের আবির্ভাব
নবাবপ্রাসাদের ডাইনিং হলে ডিনার খেতে খেতে কর্নেল হালাকুর মেয়ে রিয়ার ঘটনাটা মির্জাসায়েবকে শোনাচ্ছিলেন। মির্জাসায়েব বললেন, এবার মনে হচ্ছে ওজরাকের ব্যাপারটা হয়তো রূপকথা নয়। একজন মুসলিম হিসেবে অবশ্যই আমি জিন বিশ্বাস করতে বাধ্য। আমাদের শাস্ত্রে বলা হয়েছে, খোদাতালা এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে মানুষের মতো জিনকেও সৃষ্টি করেছেন। অবশ্য জিনের সৃষ্টি আগুন থেকে। তারা আকাশের অন্য একটা স্তরে বাস করে। আমার ধারণা, এর মধ্যে একটা তত্ত্ব লুকিয়ে আছে। আধুনিক বিজ্ঞান অন্য গ্যালাক্সিতে পৃথিবীর মতো গ্রহ এবং প্রাণী থাকার সম্ভাবনা অস্বীকার করে না। ইসলামি শাস্ত্রে উল্লিখিত আগুনের দেহধারী জিন কি তাহলে অন্য কোনও গ্রহের উন্নত কোন জীব? মুসলিম লোকশাস্ত্রে বলা হয়েছে, জিনরা পুরুষ। পরীরা হল তাদেরই স্ত্রীজাতি। জিন-পরীর ছটা লেগে নাকি মানুষের মারাত্মক অসুখ হয়। তার মানে, বহু আলোকবর্ষ দূরের কোনও অজ্ঞাত গ্রহের ওইসব প্রাণীদের শরীর আলোর কণিকা দিয়ে হয়তো তৈরি। তা থেকে যে রশ্মি ঠিকরে পড়ে, পৃথিবীর মানুষের পক্ষে তা ক্ষতিকর। তাই তাদের সংস্পর্শে গেলে মানুষ দুরারোগ্য অসুখ-বিসুখে ভুগে মারা পড়ে। আপনার কি মনে হয় কর্নেল?
কর্নেল একটু হেসে বললেন, পবিত্র কোরান আমিও পড়েছি মির্জাসায়েব! অবশ্য ইংরেজি অনুবাদে। কোরানে ঈশ্বর বলেছেন : আমি মানুষ ও জিন সৃষ্টি করেছি। তাছাড়া ১৮টি ব্রহ্মাণ্ড বা গ্যালাক্সির কথাও কোরানে বলা হয়েছে।
মির্জাসায়েব উৎসাহে চঞ্চল হয়ে বললেন, তাহলে দেখুন, আধুনিক বিজ্ঞানেও–
আমি ওঁর কথা কেড়ে বললুম, মহাভারত এবং রামায়ণেও বিস্তর ব্যাপার আছে, যা আধুনিক বিজ্ঞানের সঙ্গে মিলে যায়। যেমন, সৌরভ নগরী—যা মহাকাশে ভাসমান এক পুরী। কৃত্রিম উপগ্রহ নয়? তারপর নারদের বাহন পেঁকি। রকেট ছাড়া আর কি হতে পারে? চেঁকির সঙ্গে রকেটের গড়নের আশ্চর্য মিল! তারপর পুষ্পক রথ হল বিমান। মহাভারতের যুদ্ধের বর্ণনা পড়লে তো মনে হয় পারমাণবিক অস্ত্রের লড়াই।
কর্নেল বলে উঠলেন, ডার্লিং, আমরা হয়তো দানিকেনের আজগুবি তত্ত্বের দিকে এগোচ্ছি। মির্জাসাহেব, বরং শাস্ত্ৰ-পুরাণ থাক আপাতত। আপনার হতভাগা পরিচারক কিংবা হালাকুর পালছাড়া গাড়োল জিনের বাদশা ওজরাকের সংস্পর্শে এসে ছাই হয়ে গেছে কি না এখনও প্রমাণ পাইনি। ক্রমশ আমার মাথায় একটা চিন্তা ভেসে আসছে। কেউ কি লেসার রশ্মি অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছে? কে জানে!
মির্জাসাহেব বললেন, কিন্তু, ঝড়, পাওয়ার ফেল, আকাশ থেকে অদ্ভুত আলো নেমে আসা, ঘুঙুরের মতো শব্দ, তীব্র শিস–
—ওজরাক যদি জিনই হয়, সে আপনার এবং দেশের পাঁচটা প্রত্নশালার ধাতুরত্ন ও মূর্তি চুরি কেন করবে, ভেবে পাচ্ছি না মির্জাসাহেব। জিন যদি সত্যি থাকে, তার বাস সম্ভবত বহু আলোকবর্ষ দূরের কোন ব্রহ্মাণ্ডে। ধরে নিচ্ছি, সে কান্দ্রার পশ্চিম পাহাড়ে এসে ঘাঁটি করেছে। কিন্তু প্রত্নদ্রব্য আর মূল্যবান রত্নে তার লোভ কেন হবে? এসব তো নেহাত পৃথিবীর জিনিস। এসবের চেয়ে মূল্যবান আর বিস্ময়কর জিনিস আশা করি অন্য ব্রহ্মাণ্ডের গ্রহে বিস্তর আছে।
শুনেছি, জিনেরা খুব খেয়ালি। ওজরাকও নাকি খেয়ালি জাদুকর।
মির্জাসায়েব আনমনে বললেন। তবে আমার পূর্বপুরুষের সংগৃহীত নুরে আলম রত্নের কথা ভাবুন। এ রত্ন নিশ্চয় অন্য কোনও গ্রহের জিনিস। ধাতু-বিজ্ঞানীদের অজানা এ রত্ন। আমার মনে হচ্ছে ওজরাক এতদিনে হয়তো তা টের পেয়ে চুরি করে নিয়ে গেছে। কে বলতে পারে, আমার পূর্বপুরুষদের কেউ এ রত্ন পশ্চিমের পাহাড়ে কুড়িয়ে পাননি। রত্নটা হয়তো ছিল ওজরাকেরই।
কর্নেল হাসতে হাসতে বললেন, ওজরাক যদি জিন এবং মায়াবি জাদুকর, তাহলে রাত-দুপুরে তাকে চুরি করতে হয় কেন? মির্জাসায়েব, ন্যায়শাস্ত্রে কাকতালীয় যোগ বলে একটা ব্যাপার আছে। কাক এসে তালগাছে বসল এবং অমনি একটা তাল পড়ল এই দেখে কেউ যদি ভাবে, কাক এসে বসাই তাল পড়ার কারণ, তাহলে সে ভুল করবে। যোগাযোগটা আকস্মিক।
মির্জাসায়েব ভুরু কুঁচকে বললেন, তার মানে?
কর্নেল সে কথার জবাব না দিয়ে বললেন, একটা কাজ আপনাকে করতে হবে। আপনি কালই প্লেনে দিল্লি চলে যান এবং খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দিন : নুরে আলম চুরি গিয়ে আপনি আপনার পূর্বপুরুষের সংগৃহীত বিখ্যাত কয়েকটি রত্ন আর রাখতে সাহস পাচ্ছেন না। তাই নিলামে বেচে দিতে চান। নিলামে যাঁরা কিনতে চান, তারা যেন এক সপ্তাহের মধ্যে যোগাযোগ করেন।
—সে কী! আর তেমন রত্ন কীই বা আছে? আমার পরলোকগতা স্ত্রীর কিছু জড়োয়া অলঙ্কার ছাড়া আর কিছু তো নেই! বলেছিলুম না? আমি এখন নামেই নবাব!
—সত্যি কিছু বেচতে হবে না মির্জাসাহেব। শুধু বিজ্ঞাপন দিতে বলছি।
আমি মুখ খুলতে যাচ্ছিলুম, কর্নেল এমন চোখ কটমট করে তাকালেন যে ঢোক গিলে থেমে গেলুম। মির্জাসায়েব বললেন, ঠিক আছে। তাই হবে।
কর্নেল বললেন, কাল সকালে আমরা হালাকুর অতিথি হয়ে যাচ্ছি। ফিরে এসেই আপনি আমার সঙ্গে যোগাযোগ করবেন। আমার ইচ্ছা দুটো দিন অন্তত গুজরদের সঙ্গে কাটাব।…
কিছুক্ষণ পরে অতিথিশালায় শুতে এসে কর্নেলকে বললুম, আপনি যাই বলুন, ওজরাক অন্য গ্রহের কোনও উন্নত স্তরের প্রাণী। মানুষেরই উন্নত সংস্করণ—সুপারম্যান।
কর্নেল চুরুটের ধোঁয়ার ভিতর বললেন, কেন ডার্লিং?
—রিয়ার প্রতিবিম্বের কী ব্যাখ্যা হতে পারে? আপনি আমাকে ল অফ প্যারিটি এবং মিরর-ইমেজতত্ত্ব বোঝাচ্ছিলেন সেদিন। ওজরাক মিরর-ইমেজ সৃষ্টি করতে জানে। ওই ঘটনা শোনার পর আমার অ্যালিস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ডের গল্পটা মনে পড়ছে। অ্যালিস যেমন আয়নার ভিতরকার দেশে গিয়েছিল, রিয়াও হয়তো তেমনি–
বাধা দিয়ে কর্নেল বললেন, উল্টো মানুষদের দেশ, বলো জয়ন্ত। আয়নার ভিতরকার মানুষে একেবারে উল্টো নয় কি? তার পিলে ডাইনে, লিভার বাঁয়ে, হার্ট ডানদিকে এবং তার চোখ, নাকের ফুটো, হাত, পা সবই উল্টো। মহাকাশ বিজ্ঞানীরা মনে করেন, এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের অবিকল উল্টো বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ড আছে কোথাও—হুবহু প্রতিবিম্ব যেন। সেই এলাকায় গিয়ে পড়লে মহাকাশচারী তার মহাকাশযান সমেত উল্টো হয়ে যাবে, অথচ সে তা টের পাবে না। তারপর সে যখন তার নিজের বিশ্বে ফিরে আসবে, অমনি হবে সাংঘাতিক কাণ্ড। প্রচণ্ড বিস্ফোরণে সে তার যান-সমেত পুড়ে ছাই হয়ে যাবে। তোমাকে দড়ি ও ছড়ির উপমা দিয়েছিলুম। আশা করি মনে আছে!
বললুম, হ্যাঁ-ম্যাটার এবং অ্যান্টিম্যাটার পরস্পরের সংস্পর্শে এলে ধ্বংস হবে। কর্নেল! রিয়া বেচারি জোর বেঁচে গেছে বলা যায়। উল্টো-রিয়ার সঙ্গে ছোঁয়াছুঁয়ি হলেই কী হত ভেবে দেখুন!
হুঁ, ঠিক তাই ঘটত। ওজরাক যেই হোক, খুব সাবধানী এবং কৌতুকপ্রিয়। কর্নেল রাতের পোশাক পরতে ব্যস্ত হলেন। ফায়ারপ্লেসে আগুনের সামনে গিয়ে বসে ডাকলেন, এখানে এস ডার্লিং!
আরাম করে বসলুম আগুনের সামনে। বললুম, আচ্ছা কর্নেল, মিরর-ইমেজ বলুন বা উল্টো বস্তুই বলুন, বুঝলুম তার আণবিক গড়ন আপনার তত্ত্ব অনুসারে অসমানুপাতিক। কিন্তু তা অ্যান্টিম্যাটার কেন?
-কোনও অসমানুপাতিক আণবিক গড়নের বস্তুর মধ্যে পজিটিভ চার্জ করা ইলেকট্রন অর্থাৎ পজিট্রনের সঙ্গে নেগেটিভ চার্জ করা প্রোটনের সন্নিবেশ ঘটলে সেটি অ্যান্টিম্যাটার হয়ে যায়।
-তাহলে তো ম্যাটারকে অ্যান্টিম্যাটারে পরিণত করা সম্ভব?
—হ্যাঁ–তত্ত্বের দিক থেকে সম্ভব।
-বাস্তবেও সম্ভব হয়েছে বৈকি। রিয়ার প্রতিবিম্বের আর কী ব্যাখ্যা হয়? প্রকৃতির ডান হাত বাঁ হাতের লেখার কথা বলছিলেন। মানুষ তো প্রকৃতির বহু নিয়ম জেনে বিস্তর খেলা খেলতে পেরেছে। প্রকৃতির প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠেনি কি মানুষ?
—হুঁ—তা তো হয়েইছে।
প্রকৃতির লেফট হ্যান্ড টুইস্টের নিয়ম ওজরাক জানে।
কর্নেল হাসলেন।—ওজরাকের প্রতি তোমার বিশ্বাস ও ভক্তি দেখে আশঙ্কা হচ্ছে, ডার্লিং! ওজরাক তোমাকে তুলে নিয়ে না যায়! সাবধান!
হাসতে হাসতে বললুম, নিয়ে গেলে খুশিই হব। পৃথিবীটা গলে পচে গেছে। এখানে আর থাকতেই ইচ্ছে করে না।
কর্নেল আগুনে আবার একটা কাঠ গুঁজে দিয়ে হেলান দিলেন। চোখ বুজে রইলেন। আমি হাই তুলে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়লুম।
নতুন জায়গায় গিয়ে সহজে ঘুম আসে না। কাল রাতে ভাল ঘুম হয়নি। এ রাতেও তাই। চোখ বুজে ঘুমোনোর চেষ্টা করছিলুম। ঘুম আসছিল না। মাঝে মাঝে চোখ খুলে দেখছিলুম, কর্নেল তখনও ফায়ারপ্লেসের সামনে বসে আছেন হেলান দিয়ে। চোখ বন্ধ। ওখানেই ঘুমচ্ছেন নাকি? অবশ্য ওঁর ঘুমের লক্ষণ হল নাক ডাকা। নাক যখন ডাকছে না, তখন ঘুমচ্ছেন না। চিন্তাভাবনা করছেন নিশ্চয়।
তারপর কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলুম। হঠাৎ ঘুম ভেঙে সেটা টের পেলুম। বাইরে চাপা শোঁ শো শব্দ শোনা যাচ্ছিল। ঝড় হচ্ছে নাকি? কান্দ্রা উপত্যকায় মাঝরাতে ঝড় আসে শুনেছি। তাহলে সেই ঝড়! কিন্তু ঘরের ভিতর এত অন্ধকার কেন? জানালার পর্দার মাথায় কাচের খানিকটা অংশ বাইরের আলো এসে প্রতিফলিত হতে দেখেছি। তার ফলে ঘরের আলো নেভালেও ঘরের ভিতর আবছা সবকিছু দেখা যায়। কিন্তু বাইরে আলো নিভে গেছে। ঝড়ের শব্দটা বাড়ছে। ফায়ারপ্লেসের আগুনও নিভে গেছে। টেবিলল্যাম্পের সুইচ টিপলেও আলো জ্বলল না। কর্নেলের নাক ডাকছিল। ডাকলুম, কর্নেল! কর্নেল!
নাক ডাকা থেমে গেল ওঁর। জড়ানো গলায় বললেন, কিছু না। ঘুমোও!
বললুম, ঝড় বইছে। পাওয়ার ফেল! আলো জ্বলছে না।
তারপর চমকে উঠলুম চাপা ঝমর-ঝম ঘুঙুরের শব্দে। এক লাফে কর্নেলের বিছানার কাছে গিয়ে ওঁকে ধাক্কা দিতে দিতে বললুম, ঘুঙুরের শব্দ হচ্ছে, ওই শুনুন!
এবার কর্নেল উঠে বসলেন। অন্ধকারে ওঁকে দেখতে পাচ্ছিলুম না। ব্যস্তভাবে বললেন, কী আশ্চর্য! টর্চটাও জ্বলছে না দেখি। জয়ন্ত, তোমার টর্চটা দেখো তো?
আমার বিছানা হাতড়ে টর্চ পেলুম। কিন্তু জ্বলল না। বললুম, আমার টর্চটাও যে জ্বলছে না!
কর্নেল বললেন, বেরিও না। জানালা খুলে দেখা যাক, ব্যাপারটা কী?
ঘুঙুরের শব্দটা সমানে শোনা যাচ্ছে। ঝমর ঝম ঝমর ঝম ঝমর ঝম…একজন নয়, যেন অসংখ্য নর্তক-নর্তকী স্টেজে উদ্দাম নাচ জুড়েছে। ঘুঙুরের আওয়াজ অবশ্য চাপা, যেন বহুদূর থেকে শোনা যাচ্ছে। কর্নেলকে জানালা ফাঁক করতে দেখলুম। তখন তার কাছে গিয়ে দাঁড়ালুম। আকাশ পরিষ্কার। ঝকমক করছে নক্ষত্র। অথচ জোরালো একটা ঝড় বয়ে যাচ্ছে শোঁ শোঁ শন-শন শব্দে। ঘুঙুরের শব্দটা কিন্তু বদ্ধ-ঘরের ভিতর যেমনটি শুনছিলুম, বাইরেও তেমনটি। ফিডলার কাঁকড়ার বেহালার বাজনা যেমন মাথার ভিতর বাজছে মনে হচ্ছিল, এও কতকটা তেমনি।
হঠাৎ অনেক দূরে একটা আলোর মতো জিনিস চোখে পড়ল। বললুম, ওটা কী কর্নেল?
কর্নেল জবাব দিলেন না।
আলোটা ভারি অদ্ভুত। মাটি থেকে সামান্য উঁচুতে ভাসছে। একটু পরে বুঝতে পারলুম, ওটা নিজেই আলোকিত। কিন্তু অন্য কোনও জিনিসকে আলোকিত করছে না। তাহলে ওটা নিশ্চয় আলো নয়।
অথচ ওটা যেন ঘুরছে। দেখতে কতকটা সিলিং ফ্যানের গোলাকার অংশটার মতো। ঘুরছে বলছি, কারণ ওটার গায়ে কিছু লাল নীল সবুজ হলুদ ফুটকি দেখতে পাচ্ছি এবং ফুটকিগুলো স্থান বদল করছে।
মিনিট তিনেক পরে অদ্ভুত আলোর মতো জিনিসটা উপরের দিকে উঠতে শুরু করল। অনেক উঁচুতে পৌঁছে স্থির হয়ে রইল আধ মিনিট। তারপর হঠাৎ একটা ছুড়ে মারা ডিসকাসের মতো কাত হয়ে বিদ্যুৎবেগে দূরে চলে যেতে যেতে মিলিয়ে গেল নক্ষত্রের মধ্যে।
খেয়াল করে দেখি, ঝড়টা থেমে গেছে। ঘুঙুরের শব্দও নেই। তারপর প্লেনের শব্দ শুনতে পেলুম। কর্নেল বললেন, মনে হচ্ছে বিমানবাহিনীর বিমান এতক্ষণে ওটার খোঁজে বেরিয়ে পড়েছে। যাই হোক, জয়ন্ত! তাহলে ওজরাকের উড়ন-খাটোলা স্বচক্ষে দর্শনের সৌভাগ্য হল আমাদের। অবশ্য উফো-দর্শনও বলা যায়। তুমি কলকাতা ফিরে দৈনিক সত্যসেবকে দারুণ জাঁকালো একটি রিপোর্ট লিখবে, আশা করি।-বলে কর্নেল জানালা বন্ধ করলেন। অমনি বাইরে আলো জ্বলে উঠল।
বললুম, নিশ্চয় লিখব।তারপর টেবিল ল্যাম্পের সুইচ টিপলুম। আলো জ্বলল।
কর্নেল তাঁর বিছানায় গিয়ে চিত হলেন। বললেন, ব্যাপারটা গোলমেলে হয়ে গেল দেখছি। আমাকে আবার গোড়া থেকে সাজাতে হবে।
জিগ্যেস করলুম, কী?
—ওজরাক এবং ওইসব চুরিচামারি নিয়ে একটা থিওরি দাঁড় করিয়েছিলুম।
দরজায় টোকার শব্দ এবং মির্জাসায়েবের উত্তেজিত ডাকাডাকি শুনে দরজা খুলে দিলুম। মির্জাসায়েব হাঁফাতে হাঁফাতে বললেন, কর্নেল! কর্নেল! বড় তাজ্জব ঘটনা–
কর্নেল বাধা দিয়ে বললেন, সব দেখলুম, মির্জাসায়েব! বড় রহস্যময় ব্যাপার।
—আমার বড় ভয় ভয় করছে, কর্নেল! ওজরাক আবার কেন এসেছিল?
—এ প্রশ্নের জবাবের জন্য আমাকে দুটো বা তিনটে দিন সময় দিন।
মির্জাসায়েবের মুখ দেখে মনে হচ্ছিল, উনি আশ্বস্ত হতে পারছেন না।…
উল্টো-কর্নেলের পাল্লায়
সকালের ফ্লাইটে মির্জা নবাব দিল্লি গেলেন কাগজে বিজ্ঞাপন দিতে। আমরা বিমানঘাঁটিতে ওঁকে বিদায় দিয়ে ডঃ সোমের কোয়ার্টারে গেলুম। বদর খাঁ গাড়ি নিয়ে বাইরে অপেক্ষা করতে থাকল। সে আমাদের কান্দ্রা লেকে পৌঁছে দেবে।
ডঃ সোম বললেন, সাংঘাতিক ব্যাপার, কর্নেল। কাল রাতে উফো নেমেছিল। তাকে তাড়া করে যাচ্ছিল এয়ারফোর্সের একটা মিগ বিমান। সেটা পশ্চিমের পাহাড়ে নিখোঁজ হয়ে গেছে। সম্ভবত কোথাও ভেঙে পড়েছে। আজ সকালে দুটো হেলিকপ্টার গেছে খুঁজতে।
কর্নেল একটু হেসে বললেন, আপনি উফো বলছেন!
ডঃ সোমও হাসলেন।—প্রতিরক্ষাবিজ্ঞানী রামস্বরূপ ব্রহ্মের মতে নাকি অত্যন্ত উন্নত ধরনের চীনা বিমান। চৌম্বকশক্তিসম্পন্ন আরোহীবিহীন বিমান। বহু দূরের ঘাঁটিতে বসে রিমোট কন্ট্রোল সিস্টেমে চালানো যায় এই ম্যাগনেটিক প্লেনকে। ডঃ ব্রহ্মের ধারণা, ভূপৃষ্ঠের চৌম্বক প্রবাহের সংস্পর্শে এলেই স্বাভাবিক নিয়মে চুম্বকে চুম্বকে বিকর্ষণ ঘটে এবং বিপজ্জনক ঝড় সৃষ্টি হয়। পাওয়ার ফেল করে। ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়।
—আপনার মতামত কী?
ডঃ সোম দাঁতের ফাঁকে উচ্চারণ করলেন আন-আইডেন্টিফায়েড ফ্লাইং অবজেক্ট। কারণ নিঃসংশয়ে এখনও কিছু বলা যাচ্ছে না। অবশ্য উফো বললেই সেটা অন্য গ্রহের মহাকাশযান বোঝায় না। শুধু বোঝায়, অজানা উড়ন্ত জিনিস।
কফি না খাইয়ে ছাড়বেন না ডঃ সোম। কথাবার্তার ফাঁকে কফি এল। কফি খেতে খেতে ফোন বাজল। ডঃ সোম ফোনে কিছুক্ষণ কথা বলে গম্ভীর মুখে ফিরে এলেন আমাদের কাছে। বললেন, স্পেস রিসার্চ ল্যাবরেটরির ডিরেক্টর ডঃ হোসেন ওজরাকের পাঞ্জা কুড়িয়ে পেয়েছেন।
কর্নেল ও আমি চমকে উঠলুম। কর্নেল বললেন, কোনও ডেডবডি?
—তা তো বললেন না! ছাদের সোলার প্যানেলের ভিতর পড়ে ছিল বজ্রচিহ্ন আঁকা চাকতি।
—কিছু চুরি গেছে কি?
ডঃ সোম আস্তে বললেন, এ এম ডি এস যন্ত্রটা কম্পিউটারসুদ্ধ উপড়ে নিয়ে গেছে চোর।
—জিনিসটা কী?
—অ্যান্টিম্যাটার ডিটেকশন সিস্টেম।
কর্নেল নড়ে বসলেন। আমি হকচকিয়ে গেলুম। কর্নেল বললেন, যন্ত্রটা আয়তনে নিশ্চয় ছোট ছিল? নইলে চোরের অসুবিধে হওয়ার কথা।
—খুবই ছোট। একটা পকেট-রেডিওর মতো দেখতে। তার কম্পিউটারের আয়তন আরও ছোট। একটা মাউথ-অর্গানের সাইজ।
ডঃ সোম উঠে দাঁড়ালেন।—ডঃ হোসেনের ওখানে যেতে হচ্ছে এখনই। আপনারা ইচ্ছে করলে আসতে পারে আমার সঙ্গে।
কর্নেল বললেন, থাক্। বরং পরে একদিন গিয়ে আলাপ করব ওঁর সঙ্গে। আমার একটা জরুরি অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে।…
বদর খাঁ কাল রাতের ঘটনা নিয়ে উত্তেজিতভাবে আলোচনা করতে করতে গাড়ি চালাচ্ছিল। জিনের বাদশা ওজরাকের ভয়ে সে তটস্থ। রাতে ওজরাকের উড়ন-খাটোলা নামতে দেখেছে অনেকে। তাই নিয়ে সারা এলাকা জুড়ে নাকি আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। কেউ কেউ কান্দ্রা ছেড়ে চলে যাওয়ার কথাও নাকি ভাবছে।
লেকের কাছে আমাদের পৌঁছে দিয়ে বদর খাঁ বলল, আপনারা কখন ফিরবেন সায়েব?
কর্নেল বললেন, পরশু সকালে ঠিক এই সময় তুমি গাড়ি নিয়ে চলে আসবে এখানে। আমরা এই চেনার গাছের তলায় তোমার অপেক্ষা করব।
বদর খাঁ গাড়ি নিয়ে চলে গেল। আমাদের দুজনের পিঠেই ছোটখাট দুটো বোঁচকা। বিস্তর টুকিটাকি জিনিসে ভর্তি। পাইন বনটা পেরিয়ে তৃণভূমিতে পৌঁছে গুজরদের কুকুরগুলোর কথা মনে পড়ল। কিন্তু দূর থেকে নজর রেখেও তাদের লেজের ডগাটুকুও দেখতে পাচ্ছিলুম না।
ঘাসের মাঠে কয়েকটা ঘোড়া চরছে। খোঁয়াড়টা শূন্য। ভেড়া-ছাগল-দুম্বার পাল চরাতে নিয়ে গেছে গুজর রাখালেরা। তাঁবুর সামনে বুনো আখরোট গাছের তলায় কিছু মেয়ে মাখন তৈরি করছে। মাটির মাত্রে দুধ জ্বাল দিচ্ছে কেউ। বুড়োরা চামড়ায় নুন মাখিয়ে রোদে দিচ্ছে। হালাকু সর্দার আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল। এগিয়ে এসে আমাদের সে অভ্যর্থনা করল।
হালাকু একটু তফাতে ওক গাছের তলায় একটা নতুন তাঁবু দেখিয়ে বলল, ওই আপনাদের ডেরা হুজুর। আশা করি, কোনও তকলিফ হবে না। যে নহরের কথা বলেছিলুম, সেটা পিছনেই। খুব পরিষ্কার জল পাবেন। আর পাখির কথা বলেছিলেন, নহরের ওখানে হরেকরকম হাড়ি পাখি দেখতে পাবেন। যত খুশি, ফোটো খিচুন—ওরা ভয় পায় না। নবাববাহাদুরও ওখানে এসে ডেরা পাতেন। গত মাসেও এসে কিছুদিন ছিলেন ওখানে।
তাঁবুটা ছাগলের চামড়া সেলাই করে তৈরি। কেমন একটা আঁশ গন্ধ। কর্নেল আমার মুখের ভাবে সেটা টের পেয়ে বললেন, ডার্লিং, ঘণ্টা কয়েকের মধ্যে সয়ে যাবে।
সন্ধ্যার মতো দু-পাত্র টাটকা ছাগলের দুধ নিয়ে এল হালাকু। সঙ্গে মেয়ে রিয়া! হালাকু বলল, সায়েবদের খাতিরযত্নের ভার রিয়ার উপর। যা দরকার, একে বলবেন।
হালাকু কাল রাতের উড়ন-খাটোলা নামার গল্প করতে লাগল। কর্নেল জিজ্ঞেস করলেন, ঠিক কোন জায়গায় নেমেছিল বলতে পার সর্দার?
জবাব দিল রিয়া।—আমি জানি। আগের বারও সেখানে নেমেছিল।—বলে সে পূর্ব-দক্ষিণ দিকে আঙুল নির্দেশ করল।
হালাকু অবাক হয়ে বলল, তুই কেমন করে জানলি?
রিয়া বলল, সেদিন সকালে পাল চরাতে গিয়ে পোড়া ঘাস দেখেছিলুম। তুমি আজকাল সব কথা ভুলে যাও। তাই শুনে তুমি বকাবকি করেছিলে না?
কর্নেল পাশে পড়ে থাকা একটা পাথরের উপর উঠে চোখে বাইনোকুলার রাখলেন। দেখতে দেখতে বললেন, হু, রিয়া ঠিকই দেখিয়েছে। ওখানে মিলিটারি ভ্যান নিয়ে একদল অফিসার তদন্ত করতে এসেছে। আরে! ডঃ সোমও এসে গেছেন দেখছি। জোরালো তদন্ত হচ্ছে তাহলে।
নেমে এসে ফের বললেন, তাহলে এবেলা আর ওখানে যাওয়া হল না। সর্দার, বিকেলে তোমার মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে জায়গাটা দেখতে গেলে আপত্তি করবে না তো?
হালাকু একগাল হেসে বলল, হুজুর! মা-হারা একটি মোটে মেয়ে। তাকে আপনার জিম্মায় দিয়েছি! ইচ্ছে করলে টাউনে নিয়ে গিয়ে লেখাপড়া শেখান, মেমসাব বানিয়ে দিন।
সে খুব হাসতে লাগল।
রিয়া গাল ফুলিয়ে বলল, আমি লেখাপড়া শিখব না। মেমসায়েবও হব না।
কর্নেল বললেন, তাহলে কী হতে চাও তুমি?
–কিছু না।
–বুঝেছি, মাঠে মাঠে জানোয়ারের পাল নিয়ে ঘুরে বেড়াতেই তোমার ভাল লাগে। রিয়া আস্তে বলল, খুব ভাল লাগে।
হালাকু বলল, ওর জন্ম হয়েছিল পামির এলাকার রিয়ায়। তাই ওর নাম রেখেছিলুম রিয়া। সেখানে এমনি ঘাসের মাঠ, হুজুর। ওই মুল্লুকে রিয়া কথার মানে ঝরনা।
রিয়ার সঙ্গে কর্নেলের খুব ভাব হয়ে গেল। আমার প্রতি তার লক্ষ্য কম। বুঝতে পারছিলুম, কর্নেলের দাড়িই ওকে বশ করে নিয়েছে। কিছুক্ষণ পরে আমরা দুজনে বেরিয়ে পড়লুম।
পিছনের নালাটা প্রায় ফুট তিরিশেক চওড়া। পাথরে ভর্তি। তার ফাঁকে ঝিরঝিরে স্বচ্ছ জল বয়ে যাচ্ছে। একখানে ডোবার মতো গর্ত করে জল জমানো হয়েছে। কর্নেল কিছুক্ষণ পাখি দেখায় মন দিলেন। টেলিলেন্স লাগানো ক্যামেরায় ছবিও তুললেন প্রচুর। নালার দুধারে রংবেরঙের ফুলের ঝোপ। মনে হচ্ছিল, স্বর্গে চলে এসেছি। পাখির গান, ফুলের রং, গাছপালার সবুজ জেল্লা আর স্নিগ্ধ রোদ নিয়ে চারদিকে আশ্চর্য এক পবিত্র সরলতা। একঝাঁক পোলারের ভিতর দিয়ে বাতাস বয়ে যেতে যেতে যেন অর্কেস্ট্রার বাজনা বাজিয়ে যাচ্ছে।
তুঁতগাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে ছিলুম। কর্নেলকে দেখলুম নহরের বুকে পাথরে পা রেখে রেখে ওপারে চলে গেলেন। তারপর চোখে বাইনোকুলার স্থাপন করে ঝোপের আড়ালে উধাও হলেন।
উধাও তো উধাও! ওপারে ঘাসের জঙ্গল প্রায় ফুট পাঁচেক উঁচু হয়ে দূরে পাহাড়ের গায়ে মিশে গেছে। যেন এক সবুজ সমুদ্রের ঢেউ আছড়ে পড়ছে ধূসর-নীল কঠিন শিলার উপর। মাঝে মাঝে দ্বীপের মতো উঁচু গাছের জটলা এবং কোথাও গ্রানাইট শিলার ঢিপি।
কর্নেলের ছাইরঙা টুপি একবারের জন্য চোখে পড়ল। বুঝলুম কোনও বিরল প্রজাতির পাখির পিছনে ধেয়ে চলেছেন। তার মানে এবেলার মতো ওঁর আশা বৃথা।
সিগারেট ধরিয়ে প্রকৃতির সৌন্দর্যে মন দিলাম। কর্নেলের এমন বাতিকগ্রস্ত আচরণ নতুন দেখছি না। পোলারশ্রেণীর ভিতর বাতাসের অর্কেস্ট্রা বেড়ে গেছে ততক্ষণে। রঙিন ফুলগাছগুলো তালে তালে নাচ জুড়েছে। একসময় হঠাৎ আমার মাথায় উপর উঁতগাছের ডালপালা থেকে একঝাক টিয়াপাখি বেসুরে চেঁচিয়ে উঠল এবং ঊ্যা টা করে চেঁচাতে চেঁচাতে পালিয়ে গেল।
তারপরই বাঁদিকে কয়েক হাত তফাতে কর্নেলকে দেখতে পেলুম। কিন্তু এমন কেন দেখাচ্ছে ওঁকে? মুখে কেমন পাগলাটে হাসি। চোখ দুটো রাঙা। বললুম, অমন করে তাকাচ্ছেন কেন? কী হয়েছে?
কর্নেল নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে তেমনি পাগলাটে হাসি ঠোঁটে রেখে একটু এগিয়ে এলেন। অবাক হয়ে বললুম, কথা বলবেন তো? অমন করছেন কেন?
কর্নেল প্যান্টের পকেট থেকে চুরুট বের করলেন। দৃষ্টি কিন্তু আমার দিকেই। চুরুটটা ঠোঁটে রেখে লাইটার ধরাচ্ছেন, সেই সময় লক্ষ্য করলুম, চুরুটটা বাঁহাতে বের করেছেন এবং লাইটার ধরাচ্ছে ডানহাতে।
এতকাল ওঁর অভ্যাসের সঙ্গে পরিচিত আমি। ডানহাতে চুরুট নিয়ে বাঁহাতে লাইটার জ্বালেন। দ্বিতীয়বার খটকা লাগল ওঁর কপালের দিকে তাকিয়ে। ওঁর কপালে বাঁদিকে একটু কাটা দাগ আছে। কিন্তু এখন দেখছি দাগটা ডানদিকে।
দেখামাত্র আঁতকে পিছিয়ে এসে চেঁচিয়ে উঠলুম, কর্নেল! আপনি উল্টো মানুষ!
সঙ্গে সঙ্গে কর্নেল অদৃশ্য। আমিও ঝোপজঙ্গল ভেঙে পাথরে আছাড় খেতে খেতে একেবারে তাঁবুর সামনে গিয়ে ধপাস করে বসে পড়লুম। হালাকু দৌড়ে এসে বলল, কী হয়েছে হুজুর?
বললুম। কিছু না।…
আবার এক মৃতদেহ
ধাক্কাটা সামলে নিতে সময় লাগল। বার বার মনে হচ্ছিল, ব্যাপারটা হয়তো আমি চোখ দিয়ে দেখিনি, মন দিয়ে দেখেছি। অর্থাৎ নিতান্তই দিবাস্বপ্ন! তঁতগাছের ছায়ায় স্নিগ্ধ বাতাসে দাঁড়িয়ে প্রকৃতির সৌন্দর্যের মধ্যে অকারণ দিনদুপুরে ভূত দেখার মতোই উল্টো-কর্নেল দর্শনের কোনও মানে হয় না।
হালাকু আমার মুখের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তখনও। একটু ধাতস্থ হওয়ার পর বললুম, তেমন কিছু না সর্দার! নহরের ওপারের জঙ্গলে বাঘের মতো কী যেন দেখলুম।
হালাকু হাসতে হাসতে বলল, এ মুল্লুকে শের কোথায় হুজুর? নিশ্চয় তাহলে বোজি কুহি দেখেছেন।
—বোজি কুহি? সে আবার কী জানোয়ার?
–বুনো পাহাড়ি ছাগল।
হালাকু নিশ্চয় আইবেক্সের কথা বলছে। সে কিছু ক্ষণ বোজি কুহি নিয়ে বকবক করল। তারপর চলে গেল তাদের তাঁবুর দিকে। একটা গাছের তলায় ভেড়ার মাংস কাটা হচ্ছে। আমাদের সম্মানে গুজরদের ডেরায় আজ ভোজ দেওয়া হবে। রান্নাবান্নার আয়োজন চলেছে ওখানে। একটু পরে রিয়া এল সুন্দর নকশা আঁকা চীনা মাটির পাত্রে একগাদা শুকনো ফল নিয়ে বলল, ছোটসায়েব, বাবা এই ফলগুলো দিয়ে পাঠাল। বড়সায়েব এলে দুজনে মিলে খাবেন আপনারা। রান্না হতে আজ বিকেল হয়ে যাবে কিনা!
থালাটা সে বাঁহাতে নামিয়ে রাখতেই আঁতকে উঠে বললুম, ও কী রিয়া! তুমি বাঁহাতে থালা রাখছ যে?
অপ্রস্তুত হয়ে সে ডানহাত ঠেকাল থালায়। মুখে কাঁচুমাচু হাসি।
তবু সন্দেহ গেল না। মায়াবি ওজরাক রিয়ার প্রতিবিম্বকে পাঠিয়েছে কি না বোঝা দরকার। বললুম, আচ্ছা রিয়া, তুমি কোন হাতে খাবার খাও?
রিয়া খুব অবাক হয়ে ডানহাতটা দেখাল। তখন সন্দেহটা চলে গেল। শুকনো ফলের থালাটা তাঁবুর ভিতর রেখে একটা পাথরের ওপর বসে রইলুম। দৃষ্টি পশ্চিমে নহরের ওদিকে। কিছুক্ষণ পরে দূরে ঘাসের জঙ্গলে চলমান একটা ছাইরঙা টুপি দেখতে পেলুম। অমনি সতর্ক হয়ে উঠলুম।
টুপিপরা লোকটি ঘাসের জঙ্গল থেকে বেরিয়ে নহরের পাড়ে এল। হ্যাঁ, কর্নেল নীলাদ্রি সরকার তো বটেই। কিন্তু আসল, না জাল? প্রকৃত কর্নেল, না দর্পণবিম্ব কর্নেল? সিধে কর্নেল, না, উল্টো কর্নেল? ওজরাকের দেশের সীমান্তে এসে এবার থেকে পদে পদে সতর্ক থাকা দরকার।
নহর পেরিয়ে সিধে বা উল্টো কর্নেল হনহন করে এগিয়ে আসছেন। বুকে ক্যামেরা ও বাইনোকুলার তেমনি ঝুলছে। প্রজাপতি-ধরা লাঠি ও জাল অবশ্য নিয়ে বেরোননি। ওকতলায় পৌঁছে হাসিমুখে যেই সম্ভাষণ করেছেন, হ্যালো ডার্লিং, অমনি পকেট থেকে রিভলভার বের করে গর্জে উঠেছি, হ্যান্ডস আপ!
থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে গেলেন দুহাত তুলে।
বললুম, একটু নড়লেই গুলি ছুড়ব। দাঁড়ান, আগে পরীক্ষা করি। তারপর
—জয়ন্ত! জয়ন্ত! কী আশ্চর্য!
সতর্কভাবে কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে কপালের দাগটা দেখলুম। ঠিক বাঁদিকেই আছে। তবু নিঃসন্দেহ হওয়া দরকার। বললুম, চুরুট বের করে লাইটার জ্বেলে ধরিয়ে নিন।
কর্নেল হো হো হেসে হাত নামিয়ে বললেন, ডার্লিং, আমি উল্টো-টুল্টো নই। একেবারে সিধে। হুঁ, বুঝেছি। কিছুক্ষণ আগে ওই ঘাসের জঙ্গলে আমিও একজন উল্টো-জয়ন্তকে দেখে এলুম।
হকচকিয়ে গিয়ে বললুম, বলেন কী!
–তুমি কোথায় উল্টো-কর্নেলকে দেখলে?
–ওই তো ওখানে!
কর্নেল পাথরটাতে বসে বললেন, উল্টো-তুমি একেবারে রাশিয়ান ব্যালে নাচ দেখিয়ে আমাকে মুগ্ধ করে দিয়েছ! ওঃ! সে কী নাচ তোমার। বলশয়ের স্টেজে অমন হংসনৃত্য নাচলে রুশ-নাচিয়েদের মাথা হেঁটে হয়ে যেত।
—উল্টো-আপনি কিন্তু বদ্ধপাগল!
—তা স্বাভাবিক। সিধে-আমির মধ্যে কিছু পাগলামি থাকা যখন সম্ভব!
-বাপস! মুখে পাগলাটে হাসি, চোখে পাগলাটে চাউনি!
ওজরাক যেই হোক, আমাদের নিয়ে তামাশা শুরু করেছে দেখছি। কর্নেল চুরুট বের করে অভ্যস্ত ভঙ্গিতে জ্বেলে নিলেন। ধোঁয়ার মধ্যে ফের বললেন, আমার সব থিওরি তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়েছে, জয়ন্ত! এতকাল অসংখ্য রহস্যের মোকাবিলা করেছি এবং অদ্ভুত অদ্ভুত ঘটনার চুলচেরা ব্যাখ্যা করতে পেরেছি। কিন্তু এবার যে রহস্যের সামনে এসে পড়েছি, তার সম্ভবত কোনও পার্থিব ব্যাখ্যা নেই।
অবাক হয়ে বললুম, আপনি কি তাহলে জিনের অস্তিত্বে বিশ্বাসী হলেন, কর্নেল?
—জানি না। সত্যি কিছু জানি না।
আমার প্রাজ্ঞ বন্ধুকে এমন হতাশাগ্রস্ত কখনও দেখিনি। সারা দুপুর তাঁকে ভীষণ গম্ভীর ও চিন্তাকুল দেখছিলুম। গুজরদের সামাজিক ভোজে গিয়ে উনি নামমাত্র আহার করলেন। প্রকাণ্ড চাপাটি, ভেড়ার মাংস, মধু, ছাগলের দুধ, শুকনো ফল—আয়োজনে কোনও ত্রুটি ছিল না। খাওয়ার পর উদ্দাম নাচগান শুরু করল ওরা। রিয়াও খুব নাচল। একফাকে আমরা দুজনে কেটে পড়েছিলুম। তাঁবুতে একটু বিশ্রাম নেওয়ার পর কর্নেল বললেন, ইচ্ছে ছিল রিয়াকে টোপ হিসাবে ব্যবহার করব। কিন্তু আর সাহস করে ঝুঁকি নিতে পারছি না। চলো, দুজনেই রওনা হই।
কথাটা বুঝতে পারলুম না। জিগ্যেস করেও কোনও জবাব পেলুম না কর্নেলের। শুধু মনে পড়ল, হালাকুকে কর্নেল সকালে বলছিলেন, রিয়াকে নিয়ে সেই উফো নামার জায়গায় যাবেন।
মাইলতিনেক পাথুরে মাটি আর ঘাসের জঙ্গল ভেঙে যেখানে পৌঁছলুম, সেখান থেকে পূর্বে কান্দ্রা শহর এবং এসআরএল অবজারভেটরি ইত্যাদি পরিষ্কার দেখা যায়। পশ্চিমের পাহাড়ে আজও সেই আলোর অপরূপ নানা রঙের খেলা দেখা যাচ্ছিল।
কর্নেল বললেন, কালরাত্রে মনে হচ্ছিল উফো নামার জায়গাটা এতদূরে নয়। নেহাত চোখের ভুল। দেখতে পাচ্ছ জয়ন্ত, কতখানি জায়গায় ঘাস পুড়ে ছাই হয়ে গেছে?
প্রায় তিরিশ বর্গমিটার জায়গা কালো হয়ে আছে। কর্নেল সাবধান করে না দিলেও ওই ছাইয়ের ত্রিসীমানায় ঘেঁসতুম না। কর্নেল হাঁটু মুড়ে একপ্রান্তে বসে ছাই দেখতে দেখতে বললেন, সকালে ডঃ সোম এবং আর যাঁরা এসেছিলেন, অনেক ছাই তুলে নিয়ে গেছেন দেখছি। তেজস্ক্রিয়তা থাকাও হয়তো সম্ভব ছাইয়ের মধ্যে।
—তাহলে অত কাছে বসে আছেন কেন? উঠে আসুন।
কর্নেল একটু হাসলেন। উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, থাকলেও সে তেজস্ক্রিয়তার পরিমাণ খুব সামান্যই হবে। ক্ষতি করার ক্ষমতা হয়তো খুবই কম।
চারদিকে চক্কর দিয়ে এলেন কর্নেল। মনে মনে হিসেব কষে বললেন, উফোটা যদি চৌম্বকশক্তিসম্পন্ন বিমানই হয়, আয়তনে খুবই ছোট। ব্যাস বড় জোর দশফুট—তার বেশি কিছুতেই নয়। তিনটে ঠ্যাং ছিল। ওই দেখ, তিনটে গর্ত। আকার কাল রাত্রে যা দেখেছি, কিছুটা কমলালেবুর মতো—ওপর ও নিচেটা চাপা।
—আমার তো মনে হচ্ছিল, ফ্যানের বডি-অংশটার মতো।
কতকটা তাই বটে। কর্নেল ঘুরে পিছনে কী দেখছিলেন। কী ওটা?—বলে এগিয়ে গেলেন। তারপর হেঁট হয়ে যে জিনিসটা কুড়িয়ে নিলেন, সেটা আমার পরিচিত। ওজরাকের পাঞ্জা!
কর্নেল পাঞ্জাটা দেখতে দেখতে বললেন, ডঃ সোমদের এটা চোখে পড়া উচিত ছিল।
পড়েনি কেন?
বললুম, ওঁরা চলে যাওয়ার পর ওজরাক হয়তো পাঞ্জাটা আপনার জন্য রেখে গেছে।
কর্নেল আমার রসিকতায় মন দিলেন না। পাঞ্জাটা পকেটস্থ করে বললেন, চলো তো, ওদিকটা দেখে আসি।
আমরা সিধে নাকবরাবর পশ্চিমদিকে হেঁটে চললুম। চূড়ায়-চূড়ায় সেই বিচিত্র বর্ণালী এখনও বিচ্ছুরিত হচ্ছে। পিচকিরির ধারার মতো নেমে আসছে সবুজ তৃণভূমিতে। চোখ-ধাঁধানো ওই অপার্থিব ইন্দ্রজাল মস্তিষ্ককে আচ্ছন্ন করে ফেলছিল। মাইলটাক এগিয়ে সেই নহর দেখতে পেলুম। একটু দ্বিধা হচ্ছিল। অস্বস্তি জাগছিল। কিন্তু কর্নেলকে অনুসরণ করতেই হল।
নহরের ওপারে কিছুদূরে গিয়ে পাহাড়ের ছায়ার মধ্যে পৌঁছেলুম আমরা। আরও কিছুটা যাওয়ার পর চূড়ার বর্ণালী আর দেখা যাচ্ছিল না। আমাদের সামনে খাড়া দাঁড়িয়ে আছে কঠিন গ্র্যানাইট শিলার আকাশভেদী দেয়াল। নিচে বিশাল বিশাল পাথরের চাই পড়ে আছে। যুগ যুগ ধরে ভেঙে পড়েছে ওই দেয়ালের চাবড়া। সেগুলোর ভিতর দিয়ে এগিয়ে কর্নেল একখানে দাঁড়ালেন। তারপর বাইনোকুলারের সাধারণ লেন্সে আরও একটা লেন্স এঁটে দিলেন।
কিছুক্ষণ চূড়াগুলো খুঁটিয়ে দেখার পর বললেন, আশ্চর্য তো! এই পাহাড়ের কোনও চূড়াতেই একচিলতে বরফ জমেনি। এ তো অসম্ভব ব্যাপার! চারদিকের সব পাহাড়ের মাথায় বরফ জমে আছে। শুধু এই অংশটায় বরফ নেই। অবাক লাগছে, ডঃ সোম এই বৈশিষ্ট্যের কথা তো বলেননি।
সূর্য কালো পাহাড়ের পিছনে নেমেছে। তাই চূড়াগুলোর শীর্ষরেখা রঙিন দেখাচ্ছে এবং আকাশেও খানিকটা জায়গা জুড়ে ছোপ পড়েছে।
সেদিকে তাকিয়েছিলুম তন্ময় হয়ে। হঠাৎ কোথাও গুলির শব্দ শোনা গেল কয়েকবার এবং কর্নেলের চাপা গলার ডাকে সম্বিৎ ফিরল। কর্নেল চাপাস্বরে বললেন, তুমি এখানে অপেক্ষা কর। আমি আসছি। তুমি বরং বাঁদিকে—
দ্রুত বললুম, কোথায় যাবেন? চলুন, আমি যাচ্ছি।
—না। তুমি এখানে পাথরের আড়ালে বসে বাঁদিকে লক্ষ রাখখা। কাউকে দেখতে পেলে কি না আমাকে বলো। ওদিকে লক্ষ রাখার জন্য তোমাকে এখানে থাকতে হবে।
মাথামুণ্ড বুঝলুম না। একা থাকতে আমার অস্বস্তিও হচ্ছিল। কিন্তু বরাবর ওঁর কথা মেনে চলেছি, এখনও মেনে নিলুম। ভেবে পেলুম না, কে এমন জায়গায় এসে গুলি ছুড়ছে? কেনই বা ছুড়ছে?
কর্নেল গুড়ি মেরে এগিয়ে পাথর ও ঝোপের আড়ালে অদৃশ্য হয়ে গেলেন। আমি ওঁর কথামতো একটা পাথরের আড়ালে বসে বাঁদিকে লক্ষ রাখলুম।
বসে আছি তো আছি। তাকিয়ে থাকতে থাকতে চোখ জ্বালা করছে। দিন শেষের আবছায়া ক্রমে ঘন হয়ে যাচ্ছে। কনকনে ঠাণ্ডা বইতে শুরু করেছে। কিন্তু কর্নেলের যেমন ফেরার নাম নেই, তেমনি বাঁদিকে তাকিয়ে এতক্ষণ কারুর টিকিটি পর্যন্ত চোখে পড়েনি। আঁধার জমে এলে অসহ্য লাগল। অস্বস্তিটাও বেড়ে গেল। এখন কর্নেল ফিরে এলে তিনি সিধে না উল্টো কর্নেল তাও বোঝা কঠিন হবে যে।
তাছাড়া একেবারে ওজরাকের এলাকায় এসে পড়েছি। খপ করে ধরে মহাকাশে কোনও অজানা গ্রহে নিয়ে গিয়ে ফেললে আর এর চিরচেনা পৃথিবীতে ফেরার চান্স নেই।
মরিয়া হয়ে উঠে দাঁড়ালুম। টর্চ জ্বেলে নাড়তে নাড়তে গলা ফাটিয়ে ডাকাতে লাগলুম, কর্নেল। কর্নেল।—সত্যি বলতে কী, এ ডাকাডাকি নেহাত আতঙ্কের চোটেই।
কোনও সাড়া এল না। আরও বারকতক ডেকে হঠাৎ মাথায় এল, কর্নেলের নিশ্চয় কোনও বিপদ ঘটেছে। এতকাল কত সাংঘাতিক বিপদ থেকে, এমনকী মৃত্যুর মুখ থেকে ওই বৃদ্ধ আমাকে
উদ্ধার করে এনেছেন! আর আমি ওঁর বিপদের সময় আতঙ্কে পাগলের মতো কাণ্ড করছি।
পকেট থেকে গুলিভরা রিভলভার বের করে উনি যেদিকে গেছেন, সেদিকে এগিয়ে চললুম। এবার আমার মনে সাহস আর জেদ ফিরে এসেছে। ওজরাক হোক আর যেই হোক, একটা হেস্তনেস্ত না করে ছাড়ব না।
কিছুদূর এগিয়ে পাহাড়ের দেয়ালের ঠিক নিচে একখানে টর্চের আলো ফেলে চমকে উঠলুম। কেউ চিত হয়ে পড়ে আছে পাথরের উপর। বুকের ভিতরটা ধড়াস করে উঠল। কিন্তু কাছে গিয়ে দেখি কর্নেল নন। অচেনা একজন লোক! চোখ বুজে নিস্পন্দ পড়ে আছে। পরনে সাধারণ প্যান্ট-শার্ট আর চামড়ার জ্যাকেট। মুখের গড়নে কাশ্মীরি বলেই মনে হচ্ছিল।
বেঁচে আছে কি না হাতের নাড়ি পরীক্ষা করে দেখার জন্য ওর ডান হাতটা যেই তুলতে গেছি, একমুঠো ছাই উঠে এল হাতে। ওমনি হাত ঝেড়ে পিছিয়ে এলুম। টর্চের আলো কমে এসেছে। ততক্ষণে। ব্যাটারি ফুরিয়ে গেছে তাহলে। ভীষণ অসহায় বোধ করলুম। সেই সঙ্গে আতঙ্কটা আবার টেনে ধরল আগের মতো। এই হতভাগ্য লোকটিও নির্ঘাত ওজরাকের বলি! এখানে কেন এসেছিল সে? কর্নেলও কি এমনি ছাই হয়ে পড়ে আছেন কোথাও?
টর্চের আলো নিভিয়ে দিলুম। তারপরই একটু দূরে কর্নেলের কণ্ঠস্বর শুনে চমকে উঠলুম।—জয়ন্ত নাকি?
আমার গায়ে টর্চের আলো পড়ল। বোবাধরা গলায় বললুম, আপনি কর্নেল তো?
—হ্যাঁ, ডার্লিং! তুমি যা ভাবছ, তা নই।
টর্চ নিভে গেল। তখন আমার টর্চ জ্বেলে দেখি, কর্নেল এবং একজন লোক এগিয়ে আসছে। কপালের কাটা দাগটা দেখে নিতে ভুল করলুম না। প্রকৃত কর্নেলই বটে। উত্তেজিতভাবে বললুম, এখানে একটা ডেডবডি পড়ে আছে। একেবারে ছাই হয়ে গেছে পুড়ে। অথচ চেহারা অবিকৃত, পোশাকও!
কর্নেল বললেন, দেখেছি। কিন্তু তোমার ভয় পেয়ে ছুটোছুটি চঁচামেচি করা উচিত ছিল না। জোর বেঁচে গেছ। তোমাকে ওখানে বসে থাকতে বলেছিলুম।
আঁধারে কিছু দেখা যাচ্ছিল না যে! তাছাড়া আপনার দেরি দেখে–
কর্নেল বাধা দিয়ে বললেন, ঠিক আছে। কাশিমসায়েব, আর এখানে নয়, চলুন। যেতে যেতে কথা হবে। হতভাগ্য বশির খাঁয়ের ডেডবডি ফেলে রেখে যেতে হচ্ছে, এটাই দুঃখ।
লাল আপেলের খপ্পরে
কাশিম খাঁ প্রতিরক্ষা দফতরের ইনটেলিজেন্স ব্রাঞ্চের একজন অফিসার। আর যে লোকটা পুড়ে ছাই হয়ে পড়ে আছে, সেই বশির খাঁ তাঁরই একজন স্থানীয় এজেন্ট। বশির তাকে গোপনে খবর দিয়েছিল, পশ্চিম পাহাড়ের ওখানে কিছুদিন থেকে সন্দেহজনক লোকের গতিবিধি তার নজরে পড়েছে।
আসলে বশির ছিল ডাবল-এজেন্ট। চীন ও পাকিস্তানের সাহায্যে একটি দেশদ্রোহী গোষ্ঠী কাশ্মীরকে ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন করে স্বাধীন রাষ্ট্র করার জন্য বহুদিন থেকে চক্রান্ত করছে। সেই গোষ্ঠীর সাংকেতিক নাম লাল আপেল। বশির এদের কাছেও টাকা খেত।
গত রাত্রে উফো নামের ফলে কান্দ্রা এলাকায় প্রতিরক্ষা দফতরের লোকেদের মধ্যে খুব উত্তেজনা ছিল। বশির এই সুযোগে কাশিম খাঁকে পশ্চিম পাহাড়তলিতে যেতে বলেছিল মিথ্যা খবর দিয়ে। সেখানে ওত পেতে বসে ছিল লাল আপেলের একজন ঘাতক।
কিন্তু তারপরই ঘটেছিল ভারি অদ্ভুত ঘটনা।
কাশিম খাঁ যখন বশিরের কথামতো নির্দিষ্ট জায়গায় পৌঁছেছেন, দেখলেন বশির পাহাড়ের খাড়া দেয়ালের নিচে দাঁড়িয়ে তাকে ইশারায় ডাকছে। এই রকমই অবশ্য কথা ছিল। কিন্তু কাশিম খাঁ ওর কাছে যাওয়ার জন্য সবে পা বাড়িয়েছেন, হঠাৎ দেয়াল ঠুড়ে এক ঝলক বিদ্যুৎ খেলে গেল যেন এবং সঙ্গে সঙ্গে বশির পড়ে গেল নিঃশব্দে। বিদ্যুতের ঝলকটা বড়জোর এক সেকেন্ডের জন্য।
কাশিম খাঁ থমকে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তারপর দেখলেন, বশিরের বাঁদিকে একটা পাথরের আড়াল থেকে একজন লোক পড়ি-কী-মরি করে দৌড়ে পালাচ্ছে। তার মাথায় লাল রুমাল বাঁধা। সঙ্গে সঙ্গে কাশিম খাঁ বুঝতে পেরেছিলেন লোকটা লাল আপেল। তাই রিভলভার তাক করে গুলি ছুড়েছিলেন।
কাশিম খাঁর তাড়া খেয়ে সে লুকিয়ে পড়েছিল। এই সময় কাশিম খাঁ কর্নেলকে ছুটে আসতে দেখেন। দিন-শেষের আবছা আলোয় কর্নেলকে দেখে তিনি ভ্যাগিস চিনতে পেরেছিলেন। নইলে কর্নেলকে গুলি খেয়ে পড়ে থাকতে হত।
ততক্ষণে কাশিম খাঁ বশিরের মতলব বুঝতে পেরেছেন। কর্নেল এবং তিনি সেই লাল আপেলের ঘাতককে খুঁজতে থাকেন। কিন্তু লোকটাকে খুঁজে পাওয়া যায় না। তার কিছুক্ষণ পরেই আমি কর্নেলের খোঁজে সেখানে গিয়ে পড়ি।
কাশিম খাঁর রিভলভারের গুলি খেয়ে আমাকেও চিত হয়ে পড়ে থাকতে হত। ভাগ্যিস কর্নেল তাকে বাধা দিয়েছিলেন।…
গুজরদের তাঁবুতে ফিরে আসার পথে কর্নেল এই কাহিনি আমাকে শুনিয়ে বললেন, জয়ন্ত! ওজরাক যেই হোক, মারাত্মক লেসার রশ্মিকে অস্ত্র হিসাবে সে ব্যবহার করছে। তবে আমরা লেসার অস্ত্র বলতে যা বুঝি, তার চেয়ে উন্নতমানের এবং সাংঘাতিক তার অস্ত্র।
—কিন্তু বশিরের উপর তার রাগের কারণ কী? কাশিম খাঁ হাসতে হাসতে বললেন, বশির কোনও বেয়াদপি করে থাকবে তার সঙ্গে।
কর্নেল বললেন, আপনার জিপ তো লেকের কাছে। তাহলে কিছুক্ষণ আমাদের তাঁবুতে কাটিয়ে যান!
কাশিম খাঁ বললেন, আজ থাক, কর্নেল! দেরি হয়ে যাবে। এখনই ফিরে গিয়ে আমাকে এই ঘটনার রিপোর্ট দিতে হবে। তাছাড়া গুজরদের তাঁবুতে আমার যাওয়া ঠিক নয়। ওদের মধ্যেও লাল আপেলের চর আছে।
-বলেন কী!
—সেইরকমই খবর আছে আমাদের হাতে। আপনারা একটু সাবধানে থাকবেন।
একটু দূরে গুজরদের তাঁবুতে আলো দেখা যাচ্ছিল। কাশিম খাঁ বিদায় নিয়ে অন্ধকারে উধাও হয়ে গেলেন। ভদ্রলোকের সাহসের প্রশংসা করতে হয়। এমন কাণ্ডের পর নার্ভ ঠিক রেখেছেন এবং অন্ধকারে ঘাসের জঙ্গল আর পাথরের দুর্গমতা পেরিয়ে অকুতোভয়ে কেমন হেঁটে গেলেন।
ওকগাছটা ফাঁকা জায়গায় কালো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তলায় একটা কাঠ পুঁতে মশাল জ্বেলে বেঁধে রেখেছে হালাকু। পাথরটাতে বসে বোধ হয় আমাদের তাঁবু পাহারা দিচ্ছে সে। হাতে বল্লম।
আমাদের দেখে সেলাম দিয়ে বলল, খুব ভাবনায় ছিলুম হুজুর। যাকগে, দেওতাজির কৃপায় ভালয় ভালয় ফিরতে পেরেছেন।…
রাত এগারোটা অব্দি ওদের তাঁবুর ওদিকে নাচগান চলল। শুকনো ঘাসের উপর চামড়ার বিছানা আর বালিশে শুয়ে অনভ্যাসের দরুন ঘুম অসম্ভব ব্যাপার। কর্নেলের রীতিনীতি আলাদা। উনি গাছের ডালে শুয়েও নাক ডাকিয়ে ঘুমোতে পারেন দেখেছি।
শুয়ে ঘুমজড়ানো গলায় বললেন, খামোকা মির্জাসায়েবকে কাগজে বিজ্ঞাপন দিতে পাঠালুম। একগাদা টাকা গচ্চা যাবে। নিশুতি রাতে নবাবী রত্নালঙ্কারের লোভে কোনও চোর আসবে না। আসলে আমি ওজরাককে ভুল বুঝেছিলুম।—ল অফ প্যারিটি….নেচারস লেফট হ্যান্ড টুইস্টের পদ্ধতি…
নাক ডাকার মধ্যে কর্নেল যেন ঘুমের দেশে যেতে যেতে প্রলাপ বকছেন। বিরক্ত হয়ে ডাকলুম, কর্নেল! কর্নেল!
নাক ডাকা থামাল। বললেন, বলো ডার্লিং!
-কী শুধু ল অফ প্যারিটি-প্যারিটি করছেন! আসল ব্যাপারটা কী?
—মিরর-ইমেজ তৈরির কৌশল ওজরাক জানে।
—তা তো জানেই। সেটা আমি আর আপনি স্বচক্ষে দেখেছি দুজনে। রিয়াও দেখেছিল।
আবার নাক ডাকতে থাকল কর্নেলের। আমার খোঁচা খেয়ে জড়ানো গলায় শুধু বললেন, জেরক্স মেশিনের মতো একটা ড়ুপ্লিকেটিং মেশিনই যথেষ্ট। তার সঙ্গে আই আর প্রোজেক্টর।
–কী বলছেন?
–ইমেজ রিফ্লেকশন প্রোজেক্টর।
–কর্নেল! প্লিজ! খুলে বলুন। তালে তালে নাক ডাকতে থাকল। আর হাত বাড়িয়ে খোঁচাখুঁচি করেও জাগাতে পারলুন না। শরীর তো নয়, পাথর।
তাঁবুর সামনে হালাকু আগুনের কুণ্ড জ্বেলে দিয়েছিল। এখনও আগুন জুগজুগ করছে। ওদের নাচগান থেমে গেছে। নিঃসাড় স্তব্ধ তৃণভূমিতে মাঝে মাঝে রাতপাখির ডাক শোনা যাচ্ছে। কখনও ঘুম জড়ানো গলায় কুকুরগুলো ডেকেই চুপ করে যাচ্ছে। হালাকু যে কম্বল দিয়েছে, সেটা খুবই কর্কশ। ভেড়ার লোম দড়ির মতো পাকিয়ে তৈরি। তার উপর আঠা দিয়ে একরাশ পশম এঁটেছে। কিন্তু যত নরম হোক কিংবা গরম হোক, অস্বস্তিকর।
রাত বারোটার পর সেই পাহাড়ি ঝোড়ো হাওয়াটা শনশনিয়ে এসে গেল। ঘাসের জঙ্গলে ভূতুড়ে শব্দ হতে থাকল। আমাদের তাঁবুর মুখ পুর্বদিকে। ঝড়টা বইছে পশ্চিম থেকে। কিন্তু তা সত্ত্বেও তাঁবুর তলা দিয়ে কনকনে বিচ্ছিরি হাওয়া ঢুকে তোলপাড় জুড়ে দিল। তাঁবুটাই মাঝে মাঝে উড়ে যাওার ভঙ্গি করছে। চুপচাপ কম্বলের ভিতর সেঁটে থাকলুম।
হঠাৎ খেয়াল হল, হালাকু বলে গেছে, কুণ্ডের আগুনটা যেন শোওয়ার আগে নিভিয়ে ফেলি। কারণ, রাতের ঝড়টা এলে অঙ্গার উড়ে ঘাসের জঙ্গলে পড়বে এবং আগুন ধরে যাবে।
পর্দার ফাঁকে উঁকি মেরে দেখি, ঝড়ের ধাক্কায় প্রায় নিভে যাওয়া আগুন চাঙ্গা হয়ে উঠেছে এবং ফুলকি ছড়াচ্ছে চিড়বিড়িয়ে।
দেখামাত্র বেরিয়ে গেলুম। পাশেই জলভরা মাটির পাত্র আছে। পাত্র থেকে জল ঢেলে আগুনের কুণ্ডটা নিভিয়ে দিলুম। তারপর হেঁট হয়ে তাঁবুতে ঢুকতে যাচ্ছি, মাথার পিছনে খটাস করে আঘাত লাগল। প্রচণ্ড আঘাত। মাথা ঘুরে গেল। এক সেকেন্ডের জন্য মনে হল, তাঁবুর কাঠেই হয়তো ধাক্কা লেগেছে।
তারপর কী হয়েছে, জানি না।….
চোখ খুলে কিছু বুঝতে পারছিলুম না। একটা বদ্ধ পাথরের ঘর, ঢালুমতো এবড়ো-খেবড়ো তার ছাদ এবং একটা গোল ঘুলঘুলি দিয়ে দিনের আলো এসে পড়েছে। দুজন লোক একপাশে বসে ফ্লাক্স থেকে চা বা কফি ঢেলে খাচ্ছে। তাদের মাথায় লাল রুমাল বাঁধা। পাশে দুটো স্টেনগান পড়ে আছে।
অমনি মনে পড়ে গেল লাল আপেল-এর কথা। উঠে বসার চেষ্টা করলুম। কিন্তু মাথায় যন্ত্রণা। অনেক কষ্টে অবশ্য উঠতে পারলুম। লোক দুটো কুতকুতে চোখে আমার দিকে তাকিয়ে পাত্রে চুমুক দিচ্ছিল। একজন দুর্বোধ্য ভাষায় অপরজনকে কিছু বলল। অপরজন মাথা নাড়ল। তখন প্রথমজন ভাঙা-ভাঙা হিন্দিতে আমাকে বলল, এই বাঙালি বুড়বাক! তুই কি খবরের কাগজের লোক?
বললাম, হ্যাঁ। তোমরা আমাকে ধরে এনেছ কেন?
—তোকে আমাদের লড়াইয়ের কথা লিখে তোর কলকাতার কাগজে পাঠাতে হবে।
-কী লড়াই তোমাদের?
-কাশ্মীরের লোক চাই স্বাধীন কাশ্মীর। তাই তারা লড়াই করছে।
হাসবার চেষ্টা করে বললুম, কাশ্মীরের লোক ভারতে থাকতেই চায়। কাশ্মীর ভারতেরই অংশ। তাই স্বাধীনতার পর এতকাল ধরে তারা ভোট দিয়ে ভারতের অন্যান্য রাজ্যের মতো সরকার গড়ছে। স্বাধীন কাশ্মীর চাইলে তারা কেউ ভোট দিত না। ভোট বয়কট করত।
দ্বিতীয় লোকটি দাঁত খিচিয়ে বলল, ভোট দিচ্ছে তারা বাধ্য হয়ে।
—তোমাদের সঙ্গে তর্ক কথার ইচ্ছে নেই। কারণ তোমরা মিথ্যাবাদী।
দ্বিতীয় লোকটি আমার চোয়ালে ঘুষি মারল। প্রথম লোকটি তাকে বাধা দিয়ে বলল, মেজাজ ঠিক রাখো দোস্ত। এই বুড়বাক! শোন। কাশ্মীরি বুড়বাকরাই ভোট দিচ্ছে। তুই আমাদের নায্য লড়াইয়ের কথা লিখে দস্তখস্ত করে দিবি। আমাদের লোক কলকাতায় তোর কাগজের ঠিকানায় পাঠিয়ে দেবে।
—আমি লিখলেও তা ছাপা হবে না।
দুজনেই একটু অবাক হল। প্রথমজন বলল, কেন ছাপা হবে না? তুই তো তোর কাগজের রিপোর্টার! যা পাঠাবি, তাই ছাপা হবে।
—না হবে না। খবরের কাগজ যা খুশি ছাপতে পারে না।
দ্বিতীয় লোকটি খাপ্পা হয়ে উঠে দাঁড়াল। বলল, বলেছিলুম দোস্ত, এভাবে কাজ হবে না! ওকে পাহাড় থেকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিই, চল। ওকে ছেড়ে দিলে উল্টে আমাদের বিরুদ্ধে লিখে সরকারকে খেপিয়ে দেবে।
প্রথম লোকটি কাঁধের ব্যাগ থেকে একটা কাগজ বের করে আমাকে দিল। ইংরেজিতে টাইপ করা কাগজ। পড়ে আমার চক্ষুস্থির। আমি দৈনিক সত্যসেবকে খবর পাঠাচ্ছি : কাশ্মীরের জনগণের সঙ্গে কথা বলে বুঝতে পেরেছি, তারা স্বাধীন কাশ্মীর চায় ইত্যাদি, ইত্যাদি।
বুঝলুম, লাল আপেলের উগ্রপন্থীরা রীতিমতো শিক্ষিত এবং চতুর লোক। সব খবর ওদের নখদর্পণে। প্রথম লোকটি বলল, দস্তখত করে দে!
কাগজটা ছিঁড়ে ওর মুখে ছুড়ে মারলুম। সঙ্গে সঙ্গে সেও উঠে দাঁড়াল। সঙ্গীকে কিছু বলল। তারপর দুজনে আমাকে হ্যাচকা টানে ওঠাল। ঠেলতে ঠেলতে নিয়ে চলল।
দরজার সামনে একটা চাতাল মতো। সেখানে গিয়েই আমার বুক কেঁপে উঠল। মাথা ঘুরতে থাকল। চারদিকে খাড়া সব পাহাড় এবং সামনে অতল খাদ। সেই খাদের নিচে অন্ধকার থমথম করছে।
তাহলে এবার নরকে গিয়ে রিপোর্টারি কর!—বলে দুজনেই আমাকে প্রচণ্ড ধাক্কা মারল। গড়িয়ে পড়লুম শূন্যে। আর্তনাদ করলুম কি? জানি না। শুধু টের পাচ্ছিলুম অনন্তকাল ধরে শূন্য তলিয়ে যাচ্ছি এবং নিচে থমথমে অন্ধকার হাঁ করে আছে।…
স্বপ্ন কিংবা স্বপ্ন নয়। হঠাৎ কিসের ছোঁয়া লাগল। খুব আরামদায়ক নরম জিনিসে আটকে গেলুম, অথবা কোনও অলৌকিক বিশাল করতল আমাকে লুফে নিল। কোনও ঝাকুনি পর্যন্ত লাগল না।
আস্তে আস্তে চোখ খুলে তাকালুম। একটা বিস্ময়কর পরিবেশ! এটা একটা ঘরই বটে। কিন্তু চারপাশের দেয়াল ও ছাদ অনুজ্জ্বল নানা রঙের আলো দিয়ে যেন তৈরি। এত রং, অথচ চোখ ধাঁধিয়ে যাচ্ছে না। কিন্তু তার চেয়ে আশ্চর্য ব্যাপার, আমি শূন্যে চিত হয়ে ভাসছি। পিঠের নিচে কিছু নেই।
আমার সামনে একটু তফাতে দাঁড়িয়ে আছে একটা মানুষের গড়নের পুতুল। হ্যাঁ, পুতুলই বটে। সাদা কাচের পুতুল। তার সারা দেহে নানা রঙের আলোর স্রোত বইছে। তার পরনে কোনও পোশাক নেই, অথবা ওই হরেক-রঙা চঞ্চল আলোই তার পোশাক।
বর্ণনা দেওয়া অসম্ভব। তার মুখটা পুতুলের মুখের মতো আঁকানো। চুলগুলো লাল। চোখ দুটো নীল। ঠোঁট দুটোও লাল। তার চোখের উপর ভুরু বলতে কিছু নেই। অথচ কী সুন্দর তার চেহারা! পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ শিল্পীর তুলিতে আঁকা একটি ছবি।
সোজা হয়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলুম। পারলুম না। যতবার পা দুটো নিচের মেঝের দিকে নিয়ে যাচ্ছি, আবার ভেসে উঠছি। এবার মনে হল, আমি ভরশূন্য অবস্থায় আছি সম্ভবত। মহাকাশযানের ভিতর মহাকাশচারীদের এমনি অবস্থা টিভিতে কতবার দেখেছি।
তারপর টের পেলুম, ওই রঙিন পুতুলের মতো প্রাণীটা আমাকে কিছু বলছে। তার ঠোঁট দুটো কিন্তু নড়ছে না। অথচ আমার মাথার ভিতর তার কথা ভেসে উঠছে অনুভূতিমালার মধ্যে দিয়ে। সে বলছে, তোমার কোনও ক্ষতি করব না। ভয় পেও না। আর দেখো, আমি তোমার সঙ্গে স্নায়বিক তরঙ্গের ভাষায় কথা বলছি। তুমিও বলার চেষ্টা করো। আমি বুঝতে পারব। নাও, চেষ্টা করো। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলুম। স্নায়বিক তরঙ্গের ভাষাটা আবার কেমন?
-বন্ধু! ব্রেনওয়েভের কথাই আমি বলছি। মনকে তোমার বক্তব্যের দিকে একাগ্র করতে হবে। তুমি যা বলতে চাইবে, তার সঙ্গে অন্য চিন্তাকে এনে ফেলো না। চেষ্টা করে দেখো, পারবে।
মনকে একাগ্র করে চিন্তার মধ্যে বললুম, তুমি কে, বন্ধু?
—ওজরাক।
চমকে উঠলুম।–তুমিই তাহলে ওজরাক!
আমার স্নায়ুতরঙ্গে ওজরাকের হাসি প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল। চিন্তা দিয়ে বললুম, আমাকে কোথায় এনেছ?
—আমার পৃথিবীর ঘাঁটিতে। কান্দ্রার পশ্চিম পাহাড়ে।
—আর কোথায় আছে তোমার ঘাঁটি?
—তোমাদের জানা গ্রহ বৃহস্পতিতে।
–তোমার দেশ কোথায়?
—আলফা সেন্টোরির একটি গ্রহে। এখানে থেকে ৪.৩ আলোকবর্ষ দূরে। এ অবশ্য তোমাদের হিসাব। তোমাদের সময়ের মাপের সঙ্গে আমাদের সময়ের মাপের কোনও মিল নেই।
-তুমিই কি পাঞ্জা ফেলে রাখো যেখানে সেখানে?
-হ্যাঁ। তোমাদের মনে কৌতূহল সৃষ্টির জন্য। যদি কেউ যোগাযোগ করে, সেই ভেবে।
—কান্দ্রার নবাবের নুরে আলম কি তুমিই নিয়ে এসেছ?
—হ্যাঁ, জিনিসটা আমারই। অসাবধানে পড়ে গিয়েছিল। একটা লোক কুড়িয়ে নিয়ে গিয়েছিল। তোমাদের সময়ের হিসাবে এ টিনা দুশো বছর আগেকার। যাই হোক, পরে জানতে পেরে রোবট পাঠিয়ে নিয়ে এসেছি।
—আমাদের বিভিন্ন জাদুঘর থেকে যেসব রত্ন আর মূর্তি চুরি গেছে, তাও কী তোমার কীর্তি?
—আমারই।
—কেন এসব করেছ?
—ওগুলোর বস্তু-প্রতিবিম্ব সৃষ্টি করব বলে। কাজ হয়ে গেলেই ওগুলো ফেরত পাঠাব।
—প্রতিবিম্ব কেন সৃষ্টি করবে?
–দেশে ফিরে গিয়ে সবাইকে দেখাব। কিছু নিদর্শন নিয়ে যাওয়া তো উচিত।
—কিন্তু এসআরএল থেকে অ্যান্টিম্যাটার ডিটেকশন যন্ত্র কেন নিয়ে এসেছে?
–দরকার হয়েছে। এ ধরনের জিনিস আজও আমরা তৈরি করতে পারিনি। তাই বহুবার অ্যান্টিম্যাটার গ্যালাক্সি—যাকে বলা যায় প্রতিবিম্ব সেখানে দৈবাৎ গিয়ে পড়ে আমাদের অনেকে ধ্বংস হয়েছে। আমাদের শরীর আলো-কণিকায় গড়া। কিন্তু অ্যান্টি-পার্টিকল নয়। আলফা-সেন্টোরি এলাকা এই গ্যালাক্সিরই অন্তর্ভুক্ত। তবে তোমাদের যন্ত্রটার বস্তু-প্রতিবিম্ব তৈরি করে ফেরত পাঠাব রোবটের হাতে। অন্যের জিনিস আমরা নিই না। নিলে তা ফেরত দিই। রোবট এনেছি সেইজন্যই।
তোমরাও তাহলে রোবট তৈরি করেছ?
–বন্ধু! আমার একই গ্যালাক্সির প্রাণী। পরিবেশের দরুন আমাদের দেহের উপাদানে যতই তফাত থাক, একই গ্যালাক্সিতে একই ধরনের সভ্যতার বিকাশ ঘটবে, এটাই প্রকৃতির নিয়ম। তবে তোমরা এখনও পিছনে পড়ে আছে। আমাদের যন্ত্র-প্রাণী তোমাদের চেয়ে বহু উন্নত।
—তোমাদের খাদ্য কী?
—এনার্জি। নক্ষত্র থেকে এনার্জি সংগ্রহ করে আমাদের খাদ্যভাণ্ডার গড়ে তোলা হয়েছে।…তুমি হাসছ কেন বন্ধু?
—রিয়ার, আমার আর আমার বৃদ্ধ বন্ধুর প্রতিবিম্ব পাঠিয়েছিলে কেন?
—কৌতুক ছাড়া আর কোনও উদ্দেশ্য ছিল না।
—বশির খাঁকে মারলে কেন?
—আমার রোবটের পাল্লায় পড়েছিল। ওর নাম বুরাখ। বুরাখ এই ঘাঁটি পাহারা দেয়। ও যাকে ছোঁয়, সে মারা পড়ে। পৃথিবীতে এসে বুরাখ বড় নিষ্ঠুর আয় বদরাগী হয়ে গেছে। ওকে সামলানো যাচ্ছে না।
–রিয়াদের মদ্দা ভেড়াটা কী দোষ করেছিল?
—বুরাখ গাড়োলটা দেখে অবাক হয়েছিল। তাই ছুঁয়ে দেখতে চেয়েছিল।
—বুরাখের পায়ে কি ঘুঙুর বেঁধে রেখেছ?
—সে আবার কী জিনিস? ওটা যন্ত্রের শব্দ। আমার স্পেসশিপের মতো বুরাখও ম্যাগ্নেটিক এলিমেন্টে তৈরি।
–আমাকে উদ্ধার করল কে?
—বুরাখ। আমার হুকুমে।
—আমি পুড়ে ছাই হইনি যে?
—আমি ওর ধ্বংস-ক্ষমতা নিউট্রাল করে দিয়েছিলুম।
—আমাকে কী বন্দি করে রাখবে, বন্ধু?
—না। তোমার বস্তু-প্রতিবিম্ব সৃষ্টি করে নিয়ে তারপর তোমাকে রেখে আসব।
বলে ওজরাক পিছনের আলোর দেয়ালের সঙ্গে মিশে গেল। এতক্ষণে আমার মাথাটা ঝিমঝিম করতে থাকল। আবার চোখ বুজে এল। চেষ্টা করেও চোখ খুলতে পারলুম না। শূন্যে ভাসার আরামদায়ক অনুভূতি আমাকে ঘুমের দিকে টানছিল।…
বিদায় বন্ধু ওজরাক!
কেউ যেন দূর থেকে ডাকছিল। চোখ খুলে দেখি, ওজরাক দাঁড়িয়ে আছে। আমার মস্তিষ্কের স্নায়ুতে তার স্নায়ুতরঙ্গের প্রতীকী ভাষা প্রতিধ্বনিত হল : বন্ধু! বন্ধু! তোমার বস্তু-প্রতিবিম্ব দেখো। কেমন হয়েছে বল?
ভরহীন অবস্থায় ভেসে থেকে দেখলুম, অবিকল আরেক আমি দাঁড়িয়ে আছে ওজরাকের পাশে। মুখ দিয়ে মানুষের ভাষায় বলার চেষ্টা করলুম, হাই জয়ন্ত চৌধুরি! কোনও শব্দই বেরুল না। তখন হাত নাড়লুম। আমার প্রতিবিম্ব বাঁ হাত নেড়ে একটু হাসল।
ওজরাক জানিয়ে দিল, বাতাস না থাকায় শব্দ হবে না। বাতাসের বদলে আমরা আলোকতরঙ্গ থেকে শ্বাসপ্রশ্বাস নিই। আমরা কথা বলি স্নায়ুতরঙ্গের মাধ্যমে।
–বন্ধু ওজরাক! আমার প্রতিবিম্ব তো অ্যান্টিম্যাটার। তবু বিস্ফোরণ ঘটছে না কেন?
—শক্তিশালী কণিকা ট্যাকিওনের ফ্রেমে ঘিরে রেখেছি।
—ওই স্কেলের মতো জিনিসটা কী?
—ড়ুপ্লিকেটিং মেশিন। ওটা বস্তু-প্রতিবিম্ব তৈরি করে।
—রিয়ার, আমার বা কর্নেলের প্রতিবিম্ব তৈরি করেছিলে ওতে?
-হ্যাঁ। তবে ওটার সঙ্গে আই আর প্রোজেক্টর জুড়ে তবেই তোমাদের প্রতিবিম্ব পাঠাতে পেরেছিলুম।
–ইমেজ রিফ্লেকশন প্রোজেক্টর! আমার বৃদ্ধ বন্ধু কর্নেল নীলাদ্রি সরকার এই যন্ত্রটার কথা বলছিলেন বটে!
–বুড়ো লোকটিকে আমার খুব পছন্দ।
—ওঁকে ধরে আনতে বুরাখকে পাঠিয়ে দাও না কেন?
—হাতে সময় নেই। ডাক এসে গেছে। আমাকে রওনা দিতে হবে।
ওজরাকের চাঞ্চল্য অনুভব করছিলুম। আমার স্নায়ুতে প্রচণ্ড চাপ লাগছিল। সে একটা হাত বাড়িয়ে দিল আমার দিকে। এবার দেখতে পেলুম ওর হাতের তালু থেকে আঙুল পর্যন্ত আঁকাবাঁকা পাঁচটা সাদা রেখা ঝিকমিক করছে। বজ্রের প্রতীক। ভয়ে ভয়ে হাত বাড়িয়ে দিলুম। কোনও অনুভূতি জাগল না। মনে হল না কিছু আঁকড়ে ধরেছি বা স্পর্শ করেছি। যেন শূন্যে করমর্দন করছি। কিন্তু চোখে দেখতে পাচ্ছি। তার হাতে আমার হাত। দুটে হাতই পরস্পর ঝাঁকুনি দিচ্ছি। স্নায়ুতরঙ্গের প্রতীকী ভাষায় বিদায় জানাচ্ছি পরস্পরকে।
তারপর ওজরাক আলোর দেয়ালের দিকে ঘুরল। অমনি একটা বেঁটে মূর্তি বেরিয়ে এল। সঠিক বর্ণনা অসম্ভব। বড় জোর বলা যায়, জল দিয়ে একটা বেঁটে ও চ্যাপ্টা পুতুল বানানো সম্ভব যদি হত, এইরকমই দেখাত। ওজরাক চিন্তার ভাষায় আদেশ দিল, বুরাখ! আমার পৃথিবীর বন্ধুকে রেখে এস।
বুরাখ আমাকে ধরল। তার শরীর তুলতুলে স্পঞ্জের মতো। আমার প্রতিবিম্ব মমির মতো দাঁড়িয়ে আছে। তার দিকে হাত নেড়ে চিন্তার ভাষায় বললুম, বিদায় জয়ন্ত চৌধুরি।
হতচ্ছাড়া দ্বিতীয় জয়ন্ত কেন জানি না, গোমড়া মুখে দাঁড়িয়ে রইল। নির্বাসনের দুঃখেই কি? ওজরাক হাত তুলল। বিদায় বন্ধু!
ওজরাক, না মুসা!!
কেউ ডাকছিল। চোখ খুলেই ভড়কে গেলুম। আমার উপর ঝুঁকে আছে চিরচেনা দাড়িওয়ালা একটা মুখ। মুখে সস্নেহ হাসি—কেমন বোধ করছ, ডার্লিং? একটু অপেক্ষা করো। কাশিম খাঁ অ্যামবুল্যান্স আনতে গেছেন।
উঠতে গিয়ে টের পেলুম, শরীর প্রায় নিঃসাড়। মাথার পিছনে যন্ত্রণা। আস্তে বললুম, আমি কোথায়?
—কান্দ্রার তৃণভূমিতে।
—বুঝেছি! ওজরাকের রোবট বুরাখ আমাকে এখানে রেখে গেছে। কর্নেল হাসতে হাসতে বললেন, ওজরাকের রোবট নয় জয়ন্ত, গুজর রাখাল ছেলেরা।
–অসম্ভব!
—উঁহু। দক্ষিণে পাহাড়ের ধারে গভীর খাদে একটা ডোবা আছে। জলের ধারে তুমি পড়েছিলে। রাখাল ছেলেরা এতদূরে বয়ে এনে আমাকে খবর দিতে গিয়েছিল।
এবার দেখলুম, চারপাশে ভিড় করে গুজররা দাঁড়িয়ে আছে। হালাকু এবং রিয়াও আছে। হালাকু ভয় পাওয়া গলায় বলল, হুজুর! উনি ওজরাকের চেলা বুরাখের নাম করছেন! ওঝা ডাকাই উচিত ছিল।
রাগ করে বললুম, ওজরাক আমার বন্ধু। তার সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে। সে আলফা-সেন্টোরি নক্ষত্রজগতের বাসিন্দা। সে এক আলোর মানুষ।
কর্নেল নির্বিকারভাবে বললেন, আলোর নয়, নেহাতই রক্তমাংসের। তার নাম মুসা।
—কী বলছেন! কে মুসা?
–একসময়কার আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন পদার্থবিজ্ঞানী। কাশ্মীরের লোক। ল অফ প্যারিটি নিয়ে গবেষণায় সুনাম ছিল। দুঃখের বিষয়, তিনি পরে কট্টর ভারতবিরোধী হয়ে পড়েন। লাল আপেল দল তাঁরই গড়া।
বললুম, আমি বিশ্বাস করি না। ওজরাকের সঙ্গে আমার কত কথা হয়েছে। সে–
কথা কেড়ে কর্নেল বললেন, তুমি পাহাড় থেকে ডোবার জলে পড়ে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলে ডার্লিং! অজ্ঞান অবস্থায় বোধ করি একটি উদ্ভট স্বপ্ন দেখেছ। আমরা আজ দুপুরে পশ্চিম পাহাড়ের ভিতর লাল আপেল-নেতা মুসার গোপন ঘাঁটি আবিষ্কার করেছি। মুসা তার ম্যাগ্নেটিক ফ্লাইং শিপে চেপে আকসাই চীনের দিকে পালিয়ে গেছেন। সঙ্গে রোবটটিকেও নিয়ে গেছেন। তবে তাঁর আবিষ্কৃত ম্যাটার ড়ুপ্লিকেটিং মেশিন, ইমেজ রিফ্লেক্টর, কিছু লেসার অস্ত্র আর চুরি যাওয়া জিনিসগুলো উদ্ধার করতে পেরেছি।
অবাক হয়ে বললুম, রত্ন আর মূর্তি চুরি কেন করতেন মুসা?
—ড়ুপ্লিকেটরে ওগুলোর অসংখ্য বস্তু-প্রতিবিম্ব তৈরি করে বিদেশে বেচে দলের জন্য অর্থ সংগ্রহই ছিল উদ্দেশ্য। কিন্তু মুসা প্রথমে খেয়াল করেননি, বস্তু-প্রতিবিম্বের অ্যান্টি-ম্যাটার হওয়ার চান্স আছে। ওতে হাত দিলেই বিস্ফোরণ ঘটবে। পরে ব্যাপারটা খেয়াল হওয়ায় স্পেস রিসার্চ ল্যাব থেকে অ্যান্টি-ম্যাটার ডিটেকশন সিস্টেম চুরি করেন।
—কীভাবে চুরি করতেন?
-ম্যাগ্নেটিক ফ্লাইং শিপ রেডার স্ক্রিনের পাল্লার বাইরে কোথাও রেখে মিসাইল সিস্টেমের সাহায্যে রোবটটিকে নির্দিষ্ট টার্গেটের দিকে পাঠাতেন। ধরো, কোনও জাদুঘরে রত্ন বা মূর্তি হাতাতে চান। আগে থেকে লাল-আপেলের চররা দর্শকদের ভিড় সেই জাদুঘরে গিয়ে জিনিসটা কোথায় আছে এবং কীভাবে সে ঘরে পৌঁছনো যাবে, সবকিছু তথ্য সংগ্রহ করেছে। নকশা তৈরি করেছে। মুসা সেইসব তথ্য ও নকশার ডাটা কোড-ল্যাংগুয়েজে রূপান্তরিত করে রোবটের মাথায় ভিতরকার কম্পিউটারে ফিড করিয়েছেন। রোবটের বুকে টিভি ক্যামেরা ফিট করে দিয়েছেন। এবার রোবটটি কম্পিউটারের সাহায্যে টার্গেটে পৌঁছে কাজ করবে। লেসার বিমের তাপে ঘরের তালা গলাবে। লকারে রত্ন থাকলে লকার গলিয়ে ফেলবে। মূর্তির বেলায় অবশ্য কাজটা সহজ। যদি রোবট ভুল করে, সেজন্য সাবধানী মুসা ফ্লাইং শিপে বসে টিভি স্ক্রিনে লক্ষ রাখতেন। বেগতিক দেখলে রিমোট কন্ট্রোল সিস্টেমে রোবটকে সাহায্য করতেন। রোবটের সামনে মানুষ পড়লে রোবট লেসার বিম প্রয়োগ করে তাকে পুড়িয়ে ছাই করে দেবে। আশা করি, পদ্ধতিটা বুঝতে পেরেছ?
—কিন্তু ঘুঙুরের শব্দ, শিস, ঝড়?
—ডঃ সোম ঠিক বলেছিলেন। মুসার ম্যাগ্নেটিক ফ্লাইং শিপ এবং পৃথিবীপৃষ্ঠের চৌম্বক প্রবাহের মধ্যে বিকর্ষণঘটিত এবং বিকর্ষণজনিত অভিঘাত বায়ুমণ্ডলে তরঙ্গ সৃষ্টি করত। ঝড় এবং ওইসব অদ্ভুত শব্দ তারই ফলাফল।
একটু চুপ করে থেকে বললুম, রিয়ার প্রতিবিম্ব, আমার বা আপনার প্রতিবিম্ব নিয়ে কি তামাশা করতেন মুসা?
কর্নেল হাসলেন। তামাশা নয়। ত্রিমাত্রিক প্রতিবিম্বের মরীচিকা প্রতিফলিত করে ভয় দেখানোই ছিল উদ্দেশ্য, যাতে কেউ পশ্চিম পাহাড় তল্লাটে পা না বাড়াই! ওজরাকের কিংবদন্তিকে কাজ লাগাতে চেষ্টা করেছেন মুসা।
—ওজরাকের পাঞ্জাও কি ওঁর তৈরি?
–না জয়ন্ত! ওগুলো ন্যাচারাল রক ফর্মেশন। হাজার হাজার বছর আগে এই এলাকায় উল্কা পড়েছিল। উল্কার উপাদান আর ভূ-পৃষ্ঠের শিলা-উপাদানে বহু রাসায়নিক পদার্থ আছে। উভয়ের মিশ্রণে বিক্রিয়ার ফলে ওই চাকতিগুলো ব্যাঙের ছাতার মতো সৃষ্টি হয়েছিল। শিলাছত্রাক বলতে পার। তবে মুসা এগুলো ওজরাক-রহস্যের নিদর্শন হিসাবে কাজে লাগাতেন। চোখে ধূলো দেওয়ার প্রচেষ্টা আর কী!
সামরিক বাহিনীর অ্যাম্বুল্যান্স এসে গেল। গুজরদের ভিড় হটিয়ে কাশিম খাঁ এলেন। সঙ্গে স্ট্রেচার নিয়ে দুজন স্বাস্থ্যকর্মী। স্ট্রেচারে যখন আমাকে ওঠানো হয়েছে, চোখ গেল পশ্চিম পাহাড়ের দিকে। অমনি ওজরাকের ইন্দ্রজাল দেখতে পেলুম। কী অপরূপ বর্ণবিচ্ছুরণ! ধারায়-ধারায় নেমে আসছে অজস্র রঙের ঝরনা। কান্দ্রার তৃণভূমিকে স্বর্গের সৌন্দর্যে সাজিয়ে তুলেছে। কে বলে ওজরাক নিছক স্বপ্ন? ওই তো দেখছে পাচ্ছি, আঁকাবাঁকা বর্ণালীরেখায় স্পষ্ট ফুটে উঠেছে তার ছাপ। যে আলোর আঙুল আমি দেখেছি, ওই তো তার বিস্ময়কর প্রতীক।
তারপরই আমার হাসি পেল। স্বপ্নের ওজরাক আমার প্রতিবিম্ব নিয়ে চলে গেছে ৪.৩ আলোকবর্ষ দূরের আলফা সেন্টোরি নক্ষত্রলোকে। এতক্ষণ কি সেখানে ওজরাকের ডাইনিংরুমে বসে দ্বিতীয় জয়ন্ত চৌধুরি খিদের চোটে গপগপ করে এনার্জি খাচ্ছে? সে কি বুঝতে পারছে, সে বাঁহাতে খাচ্ছে এবং তার পিলে পেটের ডানদিকে, যকৃৎ বাঁদিকে, হার্ট ডানদিকে—সে এক উল্টো-মানুষ?
তা না বুঝলে সে বড্ড বোকা। স্নায়ুতরঙ্গের ভাষায় ওজরাকের উদ্দেশে বললুম, বন্ধু! জয়ন্তের ঘিলুতে অন্তত এক চামচ কসমিক ইনটেলিজেন্স মিশিয়ে দিও। সে বরাবর বড্ড বোকা।