১৮৭৮ সালে আমি লণ্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের ডক্টর অব মেডিসিন ডিগ্রী লাভ করি এবং সেনাবিভাগে সার্জনদের জন্য নির্ধারিত পাঠক্রমে যোগদানের জন্য নেট্লি যাত্রা করি। সেখানকার পাঠ শেষ করে যথারীতি সহকারী সার্জনরূপে পঞ্চম নর্দাম্বারল্যাণ্ড রেজিমেণ্টের সঙ্গে যুক্ত হয়। সিএ সময়ে ঐ রেজিমেণ্টের কর্মস্থল ছিল ভারতবর্ষ। আমি সেখানে যোগদান করবার আগেই দ্বিতীয় আফগান যুদ্ধ বেধে যায়। বোম্বাইতে জাহাজ থেকে নেমেই জানতে পারলাম আমার রেজিমেণ্ট গিরিবর্ত্মের ভিতর দিয়ে অগ্রসর হয়ে ইতিমধ্যেই শত্রুপক্ষের দেশে প্রবেশ করেছে। আমার মত আরও অনেক অফিসারের সঙ্গে যাত্রা করে নিরাপদেই কান্দাহার পৌঁছলাম এবং আমার রেজিমেণ্টকে পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে নতুন কর্মভার গ্রহণ করলাম।
সেই অভিযান অনেকের জন্যই এনে দিল সম্মান আর পদোন্নতি, কিন্তু দুর্ভাগ্য আর বিপদ ছাড়া আমাকে সে আর কিছুই দিল না। আমার বাহিনী থেকে সরিয়া আমাকে বার্কশায়ার বাহিনীর সঙ্গে যুক্ত করা হলে এবং তাদের সঙ্গেই মাইওয়ান্দের মারাত্মক যুদ্ধে আমি অংশগ্রহণ করলাম। সেখানেই একটি ‘যেজাইল’ বুলেট আমার কাঁধে বিদ্ধ হয়ে একখানা হাড় ভেঙে চুরমার করে দিল আর সাবক্লেভিয়ান ধমনীটা ঘেসড়ে গেল। আমার আর্দালি মারের প্রভুভক্তি আর সাহসের জন্যই খুনে গাজীদের হাত থেকে কোনরকমে বেঁচে গেলাম। একটা ভারবাহী ঘোড়ায় চাপিয়ে সে আমাকে নিরাপদে বৃটিশ লাইনে নিয়ে এল।
যন্ত্রণায় ক্লিষ্ট এবং দীর্ঘস্থায়ী কষ্টভোগের ফলে দুর্বল অসহায় অবস্থায় একদল আহত সৈনিকের সঙ্গে আমাকে পেশোয়ারের বেস-হাসপাতালে পাঠিয়ে দেওয়া হল। সেখানেই ধীরে ধীরে সুস্থ হতে লাগলাম। ক্রমে ওয়ার্ডের ভিতরে হাঁটাচলা করা আর বারান্দায় রৌদ্রে একটু-আধটু বেড়াবার মত স্বাস্থ্যও ফিরে পেলাম। হঠাৎ ভারতের অভিশাপ আন্ত্রিক জ্বরে আক্রান্ত হয়ে পড়লাম। কয়েক মাস আমার জীবনের কোন আশাই ছিল না। অবশেষে আমার যখন সেরে উঠলাম তখন আমি এতই দূর্বল ও শীর্ণকায় হয়ে পড়লাম যে একটা মেডিক্যাল বোর্ড স্থিত করলেন,–আর একটি দিনও নষ্ট না করে আমাকে লণ্ডনে পাঠিয়ে দেওয়া উচিত। তদনুসারে আমাকে সৈন্যবাহী জাহাজ ‘ওরোণ্টেস’-এ তুলে দেওয়া হল এবং তার এক মাস পরে পোর্টসমাউথ জেটিতে নামলাম। নষ্টস্বাস্থ্য পুনরুদ্ধারের কোন আশাই তখন ছিল না, তবু স্নেহময় সরকার স্বাস্থ্যোন্নতির জন্য নয় মাস সময় দিলেন।
ইংলণ্ডে আত্মীয়-স্বজন কেউ ছিল না। কাজেই আমি তখন বাতাসের মত স্বাধীন, অবশ্য দৈনিক এগারো সিলিং ছয় পেনি আয়ে একজন লোক যতটা স্বাধীন হতে পারে। এ অবস্থায় স্বাভাবিকভাবেই আমি লণ্ডনে হাজির হলাম, কারণ লণ্ডন হচ্ছে এমন একতা বড় ডোবা যেখানে সারা সাম্রাজ্যের যত ভ্রমণবিলাসী আর আলস্যপরায়ণ লোকেরা এক দূর্বার টানে এসে মিলিত হয়। স্ট্রাণ্ড-এর একটা প্রাইভেট হোটেলে আরামহীন অর্থহীন জীবন কাটতে লাগল। পকেটে যা টাকা ছিল তার তুলনায় একটু বেশী স্বাধীনভাবেই চলতে লাগলাম। ফলে ক্রমে আর্থিক অবস্থা এতই ভীতিপ্রদ হয়ে উঠল যে অবিলম্বেই বুঝতে পারলাম হয় মহানগরী ছেড়ে গ্রামাঞ্চলে চলে যেতে হবে, আর না হয় জীবনযাত্রার মান সম্পূর্ণ পাল্টাতে হবে। শেষের বিকল্পটাই বেছে নিলাম। স্থির করলাম, হোটেল ছেড়ে কোন স্বল্পব্যয়সাধ্য অঞ্চলে একটা বাসা নেব।
যেদিন এই সিদ্ধান্ত করলাম সেইদিনই ‘ক্রাইটেরিয়ন বার’-এ দাঁড়িয়ে আছি এমন সময় কে যেন কাঁধে হাত রাখল। ফিরে দাঁড়িয়েই চিনতে পারলাম—স্ট্যামফোর্ড, বার্টস-এ আমার অধীনে ড্রেসার ছিল। লণ্ডনের বিপুল জনারণ্যে পরিচিত মুখের দর্শন পাওয়া একজন সঙ্গীহীন লোকের কাছে খুবই সুখকর। এর আগে স্ট্যামফোর্ড আমার বিশেষ বন্ধুস্থানীয় ছিল না, কিন্তু সেদিন তাকে আমি সাগ্রহে অভ্যর্থনা জানালাম। সেও আমাকে দেখে খুশিই হল। আনন্দের আতিশয্যে তাকে ‘হোলবর্ণ’ এ মধ্যাহ্ন ভোজনের আমন্ত্রণ জানালাম এবং একটা এক্কাগাড়ি নিয়ে দুজনে যাত্রা করলাম।
লণ্ডনের জনবহুল রাজপথ দিয়ে সশব্দে যেতে যেতে সবিস্ময়ে সে প্রশ্ন করল, ‘শরীরটাকে কি করে ফেলেছ ওয়াটসন? বাখারির মত শুকিয়ে গেছ, গায়ের রঙ হয়েছে বাদামের মত।‘
আমার অভিযানের একটা সংক্ষিপ্ত বিবরণ তাকে দিলাম। সে বিবরণ শেষ হতেই আমরা গন্তব্যস্থলে পৌঁছে গেলাম। আমার দুর্ভাগ্যের কাহিনী শুনে সমবেদনার সুরে সে বলল, ‘আহা বেচারি! এখন কি করবে?’
‘একটা বাসা খুঁজছি’, আমি জবাব দিলাম। ‘যুক্তিসঙ্গত ভাড়ায় একটা আরামদায়ক বাসা পাওয়া যায় কিনা সেই সমস্যারই সমাধান করতে চেষ্টা করছি।‘
আমার সঙ্গী মন্তব্য করল, ‘খুব আশ্চর্য তো! তুমিই দ্বিতীয় ব্যক্তি যে ঐ কথাগুলি আজ আমাকে বললে।‘
‘প্রথম ব্যক্তিটি কে?’ আমি প্রশ্ন করলাম।
‘লোকটি হাসপাতালের কেমিক্যাল লেবরেটরিতে কাজ করে। আজ সকালেই সে দুঃখ করছিল। একটা ভাল বাসা সে পেয়েছে। কিন্তু ভাড়াটা তার আয়ত্তের বাইরে। অথচ একজন অংশীদারও সে পাচ্ছে না।‘
আমি চেঁচিয়ে বললাম, ‘সে যদি বাসার এবং ভাড়ার এজজন অংশীদার সত্যিই চায়, তাহলে আমিই সেই লোক। সঙ্গীহীন থাকার চাইতে একজন অংশীদার আমারও পছন্দ।’
মদের পাত্রের উপর দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে স্ট্যামফোর্ড বলল, ‘শার্লক হোমসকে তুমি এখনও চেন না। স্থায়ী সঙ্গী হিসাবে তুমি হয় তো তাকে পছন্দ করবে না।‘
‘কেন? তার বিরুদ্ধে কি বলবার আছে?’
‘না, এর কোন দোষের কথা আমি বলছি না। তবে তার চিন্তাভাবনাগুলো একটু অদ্ভুত ধরনের—বিজ্ঞানের কতকগুলি শাখায় বেশ উৎসাহী। আমি যতদূর জানি, লোকটি বেশ ভদ্র।’
‘ডাক্তারী ছাত্র নিশ্চয়’, আমি বললাম।
‘না—সে যে কি হতে চায় সেবিষয়ে আমার কোন ধারণাই নেই। আমার বিশ্বাস সে শরীর-সংস্থান বিদ্যায় বেশ পারদর্শী। একজন প্রথম শ্রেণীর রসায়নবিদও বটে। কিন্তু আমি যতদূর জানি সে কোনকালে নিয়মিত কোন ডাক্তারীশাস্ত্রের পাঠ নেয় নি। তার পড়াশুনাও অত্যন্ত আগোছালো আর খামখেয়ালি। কিন্তু নানা বিষয়ে জ্ঞান সে এত সঞ্চয় করেছে যে তার অধ্যাপকদেরও তাক লেগে যায়।’
আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ‘তুমি কি কোনদিন জানতে চাও নি সে কি হতে পারে?’
‘না। তার মনের হদিস করা সোজা কাজ নয়। তবে খেয়াল জাগলে তার মুখে কথার খই ফোটে।’
আমি বললাম, ‘তার সঙ্গে দেখা করতে চাই। যদি কারও সঙ্গেই বাস করতে হয়, আমি পড়াশুনা-করা চুপচাপ লোকই পছন্দ করি। অত্যধিক গোলমাল বা উত্তেজনা সহ্য করবার মত শক্তি এখনও ফিরে পাই নি। ও দুটো বস্তুই আফগানিস্থানে এত বেশী পেয়েছিলাম যে আর যতদিন বেঁচে থাকব ওতেই চলে যাবে। তোমার ওই বন্ধুর সঙ্গে কেমন করে দেখা হতে পারে?’
সঙ্গী উত্তরে বলল, ‘নিশ্চয় সে লেবরেটরিতে আছে। হয় সে সপ্তাহের পর সপ্তাহ সে স্থানই মাড়ায় না, আর না হয় তো সকাল থেকে রাত পর্যন্ত সেখানে কাজ করে। তুমি চাও তো খাওয়া শেষ করে একসঙ্গেই সেখানে পারি।’
‘নিশ্চয় যাব’ আমি বললাম। তারপরই আলোচনা অন্য পথে মোড় নিল।
যে ভদ্রলোকের সহ-বাসিন্দা হবার প্রস্তাব এইমাত্র করলাম, হোলবর্ণ থেকে বেরিয়ে হাসপাতালে যাবার পথে তার সম্পর্কে আরও কিছু বিবরণ স্ট্যামফোর্ড আমাকে জানান। বলল, ‘তার সঙ্গে যদি মানিয়ে চলতে না পার, তাহলে কিন্তু আমাকে দোষ দিও না। মাঝে মাঝে লেবরেটরিতে দেখা-সাক্ষাতের ফলে তার যেটুকু পরিচয় পেয়েছি তার বেশী কিছু আমি জানি না। তুমিই এক প্রস্তাব করেছ, কাজেই আমাকে যেন দায়ী করো না।’
আমি বললাম, ‘মানিয়ে চলতে না পারলে সরে গেলেই হবে। তারপর সঙ্গীর দিকে একটু কড়া চোখে তাকিয়ে বললাম, ‘দেখ স্ট্যামফোর্ড, মনে হচ্ছে বিশেষ কোন কারণে তুমি এ ব্যাপারে নিজেকে জড়াতে চাইছ না। লোকটির মেজাজ খুব খাপ্পা নাকি? না আর কিছু? রেখে-ঢেকে কথা বলো না।’
সে হেসে বলল, ‘অনির্বচনীয়কে ভাষায় প্রকাশ করা সহজ নয়। আমার বিচারে হোমস একটু অতি-বৈজ্ঞানিক ধাতের লোক—প্রায় অনুভূতিহীন। অনিষ্টসাধনের উদ্দেশ্য নয়, শুধুমাত্র ফলাফল সম্পর্কে সঠিক ধারণা লাভের গবেষণার খাতিরেই সে তার বন্ধুকে একচিমটে উদ্ভিজ্জ উপক্ষার ক্ষেতে দিচ্ছে, তাও কল্পনা করা যায়। তার প্রতি সুবিচার করতে হলে বলতে হয়, ওই একই কারণে সমান তৎপরতার সঙ্গে সে নিজেও ওটা খেতে পারে। নির্দিষ্ট ও সঠিক জ্ঞানার্জনের প্রতি তার একটা নেশা আছে বলে মনে হয়।’
‘এটা তো খুব ভালো কথা।’
‘ভাল, তবে বাড়াবাড়ি ঘটতে পারে। যখন কেউ ব্যবচ্ছেদ-কক্ষে মৃত প্রাণীকে লাঠি দিয়ে পিটাতে শুরু করে, তখন সে ব্যাপারটা বড়ই কিম্ভুতকিমাকার হয়ে ওঠে।’
‘মৃত প্রাণীকে লাঠির বাড়ি!’
‘হ্যাঁ। মৃত্যুর পরে শরীরে আঘাতের দাগ কতটা পড়ে সেটা পরীক্ষা করে দেখবার জন্য তাকে এরকম করতে আমি নিজের চোখে দেখেছি।’
‘তারপরেও তুমি বলছ, সে মেডিক্যালের ছাত্র নয়?’
‘না। ইশ্বর জানেন তার পড়াশুনার উদ্দেশ্য কি। কিন্তু আমরা তো এসে পড়েছি। তার সম্পর্কে নিজেই তোমার ধারণা গড়ে নিও।’ বলতে বলতে একটা সংকীর্ণ গলিতে মোড় নিয়ে ছোট পাশের দরজার ভিতর দিয়ে হাসপাতালের একটা অংশে প্রবেশ করলাম। এ জায়গা আমার পরিচিত। বিনা সাহায্যেই ঠাণ্ডা পাথুরে সিঁড়ি বেয়ে উঠে লম্বা বারান্দা ধরে এগোতে লাগলাম। দুই পাশে সাদা দেওয়াল আর বাদামী দরজার সারি। প্রায় শেষ প্রান্তে নীচু খিলানওয়ালা যে পথটা বেরিয়ে গেছে সেটা ধরে এগিয়ে গেলেই কেমিক্যাল ল্যাবরেটারি।
উঁচু ঘর। চারদিকে অসংখ্য বোতল। কতক সাজানো, কতক ছড়ানো। এখানে-সেখানে চওড়া নীচু টেবিল। তার উপর বকযন্ত্র, টেস্ট-টিউব আর ছোট বুনসেন বাতি, তার থেকে নীল কাঁপা-কাঁপা শিখা বেরুচ্ছে। ঘরে একটিমাত্র ছাত্র কোণের টেবিলে উপুড় হয়ে কাজ করছে। আমাদের পায়ের শব্দ শুনে যে একবার ফিরে তাকাল। তারপর সোজা দাঁড়িয়ে আনন্দে চেঁচিয়ে উঠল। আমার সঙ্গীর দিকে চোখ ফেলে ‘পেয়েছি! পেয়েছি!’ বলে চীৎকার করতে করতে সে একটা টেস্ট-টিউব হাতে নিয়ে আমাদের দিকে ছুটে এল। ‘এমন একটা রি-এজেন্ট আমি পেয়েছি একমাত্র হিমোগ্লোবিন দ্বারাই যার থেকে তলানি পড়ে, আর কিছুর দ্বারাই নয়।‘ একটা সোনার খনি আবিষ্কার করলেও বোধ হয় এর চাইতে বেশী আনন্দে তার চোখ-মুখ উদ্ভাসিত হত না।
‘ডাঃ ওয়াটসন, মিঃ শার্লক হোমস’, আমাদের দু-জনকে পরিচয় করিয়ে দিয়ে স্ট্যামফোর্ড বলল।
বেশ জোরের সঙ্গে আমার হাত চেপে ধরে সে সাদরে বলল, ‘কেমন আছেন? মনে হচ্ছে, আপনি আফগানিস্থানে ছিলেন?’
‘সেকথা আপনি জানলেন কেমন করে?’ আমি সবিস্ময়ে জিজ্ঞাসা করলাম।
মুচকি হেসে সে বলল, ‘ও কথা থাক।’ এখন সমস্যাটা হচ্ছে হিমোগ্লোবিন নিয়ে। আমার এই নতুন আবিষ্কারের গুরুত্ব আপনি নিশ্চয় বুঝতে পারছেন?’
আমি জবাব দিলাম, ‘রসায়নের দিক থেকে নিঃসন্দেহে ইণ্টারেস্টিং, কিন্তু বাস্তবক্ষেত্রে—‘
‘বলেন কি? চিকিৎসা-আইনের ক্ষেত্রে এতবড় আবিষ্কার গত কয়েক বছরের মধ্যে হয় নি। আপনি কি বুঝতে পারছেন না যে রক্তের দাগের বিষয়ে আমরা একটা অভ্রান্ত পরীক্ষা পেয়ে যাচ্ছি। চলুন তো ওখানে!’ আগ্রহের আতিশয্যে আমার কোটের আস্তিন চেপে ধরে যে টেবিলে সে কাজ করছিল সেখানে আমাকে টেনে নিয়ে গেল। ‘কিছুটা তাজা রক্ত নেওয়া যাক,’ বলে একটা লম্বা ভোঁতা সূঁচ আঙুলে ঢুকিয়ে দিল, আর ফোঁটা কয়েক রক্ত একটা পাত্রে ধরে নিল। ‘এবার এইটুকু রক্ত এক লিটার জলে মিশিয়ে দিলাম। দেখতে পাচ্ছেন, মিশ্রণটার রঙ বিশুদ্ধ জলের মত হয়ে গেল। এতে রক্তের অনুপাত দশ লক্ষে একের বেশী হবে না।’ কথা বলতে বলতে সে ঐ পাত্রে কয়েক টুকরো সাদা স্ফটিক ফেলে দিয়ে তাতে কয়েক ফোঁটা স্বচ্ছ তরল পদার্থ যোগ করল। দেখতে দেখতে মিশ্রণটায় মেহগেনি রঙ ধরল, আর কাঁচের পাত্রটার নীচে কিছু বাদামী রঙের তলানি পড়ল।
‘হাঃ! হাঃ!’ সে হাততালি দিয়ে হেসে উঠল, যেন ছোট শিশু একটা নতুন খেলনা পেয়ে আনন্দে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠেছে। ‘এটা কি বলুন তো?’
‘একটা কোন সূক্ষ্ম পরীক্ষা বলে মনে হচ্ছে,’ আমি বললাম।
‘সুন্দর! সুন্দর! পুরনো “গুয়াইকাম” পরীক্ষাটা যেমন গোলমেলে তেমনি অনিশ্চিত। রক্ত কণিকার অনুবীক্ষণিক পরীক্ষাটাও তাই। রক্তের দাগটা কয়েক ঘণ্টা পুরনো হয়ে গেলে তো পরের পরীক্ষাটা একেবারেই মূল্যহীন। অথচ এই পরীক্ষাটা তাজা বা বাসি উভয় রক্তের বেলায়ই সমান কার্যকরী। এই পরীক্ষাটা যদি আগে আবিষ্কৃত হত, তাহলে শত শত লোক যারা আজও পৃথিবীর মাটিতে ঘুরে বেড়াচ্ছে তারা অনেক আগেই তাদের কৃত অপরাধের শাস্তি ভোগ করত।’
‘সত্যি!’ আমি আস্তে আস্তে বললাম।
‘খুনের মামলাগুলি ক্রমাগত একটি পয়েণ্টের উপরই ঝুলে থাকে। হয় তো খুনের কয়েক মাস পরে একটা লোকের উপর সন্দেহ পড়ল। তার কাপড়-চোপড় পরীক্ষা করে বাদামী দাগ পাওয়া গেল। সেগুলো রক্তের দাগ, কাদার দাগ, মরচের দাগ, ফলের দাগ, না আর কিছু? এই প্রশ্ন অনেক বিশেষজ্ঞকেই বিচলিত করেছে। কিন্তু কেন? কারণ, কোন নির্ভরযোগ্য পরীক্ষা-ব্যবস্থা ছিল না। এবার “শার্লক হোমস পরীক্ষা”টা পাওয়া গেল, সুতরাং আর কোন অসুবিধা রইল না।’
কথা বলার সময় তার চোখ চকচক করছিল। বুকের উপর হাত রেখে সে এমনভাবে মাথা নীচু করল যেন কল্পনার চোখে দেখা এক সপ্রশংস জনতাকে অভিবাদন জানাচ্ছে।
তার উৎসাহ দেখে বিস্মিত হয় আমি বললাম, ‘আপনাকে অভিবাদন জানানো উচিত।’
‘গত বছর ফ্রাংকফোর্টে ভন বিস্কর্ফের কেসটাই ধরুন। এ পরীক্ষাটা তখন চালু থাকলে নির্ঘাৎ তার ফাঁসি হত। আরও ধরুন, ব্রাডফোর্ডের ম্যাসন, কুখ্যা মুলার; মঁৎপেলিয়ের-এর লেফেভার এবং নিউ অর্লিয়ান্সের স্যামসন। এ রকম আরও এককুড়ি কেসের কথা আমি বলতে পারি যেখানে এই পরীক্ষায় চূড়ান্তভাবে অপরাধের প্রমাণ হতে পারত।’
স্ট্যামফোর্ড হেসে বলল, ‘আপনি দেখছি অপরাধের একটি জীবন্ত পঞ্জিকা। এবিষয়ে আপনি একখানি পত্রিকা বের করতে পারেন। তার নাম দিন “অতীতের পুলিশী সমাচার”।’
আঙুলের মাথায় একটুকরো প্লাস্টার জড়াতে জড়াতে শার্লক হোমস বলল, ‘পত্রিকাটিকে খুব কৌতূহলোদ্দীপক করা যায় কিন্তু।’ তারপর হাসিমুখে আমার দিকে তাকিয়ে সে বলে উঠল, ‘কিন্তু আমাকে সাবধান হতে হবে। কারণ আমাকে নানারকম বিষয় নিয়ে নাড়াচাড়া করতে হয়।’ সে তার হাতখানা বাড়িয়ে ধরল। দেখলাম, তার সারা হাত কড়া এসিডে বিবর্ণ হয়ে গেছে এবং তাতে আগাগোড়া টুকরো টুকরো প্লাস্টার জড়ানো।
একটা তিন-পায়া উঁচু টুলে নিজে বসে আর একটা টুল পা দিয়ে আমার দিকে ঠেলে দিয়ে স্ট্যামফোর্ড বলল, ‘একটা কাজে আমরা এসেছি। আমার এই বন্ধু একটা আস্তানা খুঁজছেন। আপনি বলেছিলেন একজন অংশীদার খুঁজে পাচ্ছেন না, তাই আপনাদের দুজনকে দেখা করিয়ে দিলাম।’
আমার সঙ্গে এক বাসায় থাকার প্রস্তাবে শার্লক হোমসকে খুশিই মনে হল। বলল, ‘বেকার স্ট্রীটে একটা “সুইট” দেখেছি। আমাদের দুজনের বেশ কুলিয়ে যাবে। আশা করি তামাকের কড়া গন্ধে আপনার আপত্তি হবে না?’
জবাব দিলাম, ‘আমি নিজেও ধূমপান করি।’
‘তাহলে তো ভালই হল। নানারকম রাসায়নিক পদার্থ আমার কাছে থাকে। মাঝে মাঝে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করি। তাতে আপনার অসুবিধা হবে না তো?’
‘মোটেই না।’
‘ভেবে দেখি—আমার আর কি দোষ আছে। মাঝে মাঝে আমি চুপচাপ থাকি, পরপর কয়েকদিন হয় তো মুখই খুলি না। তখন যেন মনে করবেন না যে আমি খুব রেগে আছি। স্রেফ আমাকে একা থাকতে দেবেন, ব্যাস সব ঠিক হয়ে যাবে। এবার আপনার কি বলার আছে বলুন। একসঙ্গে থাকবার আগে দুজনেরই পরস্পরের দোষ-ত্রুটিগুলি জানা থাকা ভাল।’
তার জেরায় আমি হেসে উঠলাম। বললাম, ‘আমার একটা কুকুরের বাচ্চা আছে। আমার স্নায়ুগুলো খুব দূর্বল হয়ে পড়েছে, তাই হট্টগোল পছন্দ করি না। সময়ে অসময়ে ঘুম থেকে উঠি। আলসেমি করি। ভাল অবস্থায় আরও কিছু কিছু দোষ আছে, তবে আপাতত ঐগুলিই প্রধান।’
উদ্বিগ্ন কণ্ঠে সে প্রশ্ন করল, ‘হট্টগোল বলতে কি আপনি বেহালা বাজানোটাকে ধরেছেন?’
‘সেটা বাদকের উপর নির্ভর করে,’ আমি জবাব দিলাম। ‘বেহালার ভাল বাজনা তো দেবতাদের উপভোগ্য। কিন্তু বাজনা যদি বাজে হয়—’
হো-হো করে হেসে সে বলল, ‘বাস, বাস, তাহলে ঠিক আছে। ধরে নিচ্ছি ব্যবস্থাটা পাকা, অবশ্য যদি বাসাটা আপনার পছন্দ হয়।’
‘কখন দেখা যায়?’
‘কাল দুপুরে এখানে আসুন। একসঙ্গে গিয়ে সব পাকা করে ফেলব,’ সে জবাব দিল।
করমর্দন করে আমি বললাম, ‘ঠিক আছে। কাল দুপুরে।’
সে আবার কাজে মন দিল। আমরা হোটেলের দিকে পা বাড়ালামা।
হঠাৎ থেমে স্ট্যামফোর্ডের দিকে ঘুরে প্রশ্ন করলাম, ‘ভাল কথা, আমি আফগানিস্থান থেকে এসেছি উনি বুঝলেন কি করে?’
একটু রহস্যময় হাসি হেসে সঙ্গী বলল, ‘ঐটেই তাঁর বৈশিষ্ট্য। উনি যে কি করে সবকিছু বোঝেন, সেটা আরও অনেকে জানতে চেয়েছে।’
হাত ঘসতে ঘসতে আমি বললাম, ‘ওঃ! সেটা তাহলে একটা রহস্য? বেশ আকর্ষণীয় মনে হচ্ছে। আমাদের দুজনের মিলন ঘটিয়েছ বলে তোমার কাছে আমি কৃতজ্ঞ। তুমি তো জান, “মানুষের উপযুক্ত পাঠ্য বিষয়ই হল মানুষ।’
বিদায় নেবার সময় স্ট্যামফোর্ড বলল, ‘তাহলে ওকে পাঠ কর। যদিও খুব জটিল সমস্যায় পড়বে। আমি বাজি রেখে বলতে পারি, তুমি তাকে যতটা জানতে পারবে তার চাইতে অনেক বেশী সে তোমাকে জানতে পারবে। নমস্কার।‘
‘নমস্কার।’ অপরিচিতের সম্পর্কে প্রচুর আগ্রহ নিয়ে হোটেলের দিকে পা বাড়ালাম।
তার ব্যবস্থামত পরদিন দেখা করলাম এবং ২২১বি, বেকার স্ট্রীটের ঘরগুলি দেখলাম। দুটো আরামদায়ক শয়ন-কক্ষ, একটি বড় খোলামেলা সুসজ্জিত বসবার ঘর, তাতে দুটো প্রশস্ত জানালা দিয়ে প্রচুর আলো এসে পড়ছে। সব দিক থেকেই বাসাটা ভাল এবং সম-অংশে ভাড়াটাও ন্যায্য বলেই মনে হয়। কাজেই সেখানেই কথাবার্তা পাকা করে সঙ্গে সঙ্গে বাসার দখল নিয়ে নিলাম। আমি সেদিন সন্ধ্যায়ই হোটেল থেকে মালপত্র নিয়ে সেখানে গেলাম। শার্লক হোমস পরদিন সকালে কয়েকটা বাক্স্ ও পোর্টম্যাণ্টো নিয়ে হাজির হল। মালপত্র খুলে সাজিয়ে-গুছিয়ে নিতে দু’ একদিন কেটে গেল। ধীরে ধীরে দুজনেই নতুন পরিবেশে অভ্যস্ত হয়ে উঠলাম।
হোমসের সঙ্গে একত্রে বাস করা মোটেই কঠিন নয়। লোকটি চলা-ফেরায় শান্ত, স্বভাবে পরিমিত। রাত দশটার পরে কদাচিৎ জেগে থাকে, আর সকালে আমার ঘুম ভাঙবার আগেই প্রাতরাশ সেরে বাইরে বেরিয়ে যায়। কখনও সারাটা দিন কেমিক্যাল লেবরেটরিতে কাটায়। কখনও বা ব্যবচ্ছেদ-কক্ষে। আবার অনেকদিন শহরের অনুন্নত এলাকাগুলিতে দীর্ঘ পথ হেঁটে বেড়ায়। কাজের নেশা যখন পেয়ে বসে তখন কোন কাজেই সে পিছপা নয়। কখনও বা সম্পূর্ণ উল্টো। দিনের পর দিন বসবার ঘরে সোফায় বসে থাকে। সকাল থেকে সন্ধ্যে পর্যন্ত মুখে একটা কথা নেই, শরীরের একটু নড়ন-চড়ন নেই। সেসময় তার চোখে এমন একটা ফাঁকা স্বপ্নময় দৃষ্টি দেখেছি যাতে অনায়াসেই সন্দেহ হতে পারত যে নেশাখোর; কিন্তু তার সংযত ও পরিচ্ছন্ন জীবনযাত্রা দেখে সে ধারণা মনেও ঠাঁই পেত না।
যতদিন কাটতে লাগল, তার সম্পর্কে আমার আগ্রহ এবং তার জীবনের লক্ষ্য সম্পর্কে আমার কৌতূহল ততই বাড়তে লাগল। তার শরীর এবং চেহারাই এমন যে যে-কোন লোকের দৃষ্টি আকর্ষণ করবেই। লম্বায় ছ’ ফুটের উপরে, কিন্তু এতটাই কৃশকায় যে আরও ঢ্যাড়া মনে হয়। যে নেশার ঘোরের কথা এইমাত্র উল্লেখ করেছি সেসময়টা ছাড়া সাধারণভাবে তার চোখের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ এবং অন্তর্ভেদী। বাজপাখির মত সরু নাক, সারা মুখে সদা-সতর্কতা ও স্থির সিদ্ধান্তের আভাষ ফুটিয়ে তোলে। তার মোটা চৌকো থুতনি দৃঢ় চরিত্র মানুষের লক্ষণ। তার দুই হাতে সব সময়ই কালি আর কেমিক্যালের দাগ লেগে থাকত। তা সত্ত্বেও কোন কিছু ছোঁবার বেলায় সে খুবই খুঁতখুঁতে। কাজের যন্ত্রপাতি নাড়াচাড়া করবার সময় তার এই স্বভাব আমি অনেক সময় লক্ষ্য করেছি।
এই মানুষটি আমার কৌতূহলকে কতখানি জাগ্রত করেছিল, এবং নিজের সম্পর্কে তার নীরবতাকে ভাঙবার কতটা চেষ্টা আমি বারবার করেছি, সেকথা বললে পাঠক নিশ্চয়ই অনধিকার চর্চার অপরাধে আমার নিন্দা করবেন; কিন্তু তা করবার আগে মনে রাখতে হবে যে সেসময় আমার জীবন ছিল লক্ষ্যহীন এবং করবার মত কোন কাজও তখন আমার হাতে ছিল না। আমার স্বাস্থ্যের তখন যা অবস্থা তাতে আবহাওয়া অত্যন্ত ভাল না থাকলে আমি বাইরেও বেরোতে পারতাম না। এমন কোন বন্ধুও ছিল না যার সঙ্গে কথা বলে দৈনন্দিন জীবনের একঘেয়েমিকে কাটাতে পারি। সে অবস্থায় এই সঙ্গীটিকে ঘিরে যে ছোটখাট রহস্য ছিল তার সমাধানের চেষ্টায়ই আমি অনে সময় কাটিয়ে দিতাম।
সে ডাক্তারি পড়ত না। এবিষয়ে স্ট্যামফোর্ড যা বলেছিল আমার একটা প্রশ্নের উত্তরে সে নিজেও সেই উক্তিই সমর্থন করেছে। সে নিয়মিতভাবে এমন কোন পড়াশুনা করে না যাতে সে বিজ্ঞানের একটা ডিগ্রি পাবার উপযুক্ততা অর্জন করতে পারে, অথবা জ্ঞান-রাজ্যে প্রবেশের অন্য যে কোন দ্বার-পথ তার সামনে উন্মুক্ত হতে পারে। কিন্তু কোন কোন পাঠ্য বিষয়ে তার উৎসাহ এতই উল্লেখযোগ্য, এবং খামখেয়ালের দ্বারা সীমিত হলেও তার জ্ঞান এত অসাধারণভাবে প্রচুর ও সূক্ষ্ম যে তার অনেক বক্তব্যই আমাকে বিস্মিত করেছে। কোন নির্দিষ্ট লক্ষ্য সম্মুখে না থাকলে কোন মানুষ এত কঠিন পরিশ্রম করতে বা এত নির্ভুল তথ্য সংগ্রহ করতে পারে না। যারা আবোলতাবোল পড়াশুনা করে তাগের জ্ঞান কদাচিৎ সঠিক হয়ে থাকে। স্পষ্ট কারণ না থাকলে কোন মানুষ ছোটখাট বিবরণ সংগ্রহ করে মনকে বোঝাই করে রাখতে পারে না।
তার অজ্ঞানতাও তার জ্ঞানের মতই উল্লেখযোগ্য। সাম্প্রতিক সাহিত্য, দর্শন বা রাজনীতির সে প্রায় কিছুই জানে না। টমাস কার্লাইল থেকে উদ্ধৃতি দেওয়াতে সে খোলাখুলিই জিজ্ঞেস করে বসল, লোকটি কে এবং কি করতেন। কথাপ্রসঙ্গে যেদিন বুঝতে পারলাম যে সে কোপার্নিকাসীয় মতবাদ এবং সৌর জাগতিক গ্রহনক্ষত্র সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞ সেদিন আমার বিস্ময়ের সীমা রইল না। পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘোরে—এই বিংশ শতাব্দীতে কোন সভ্য মানুষ যে সেটা জানে না সে কথা আমি ভাবতেই পারি নি।
আমার মুখে বিস্ময়ের ভাব লক্ষ্য করে সে বলল, ‘মনে হচ্ছে তুমি এতে বিস্মিত হয়েছ। কিন্তু ও তথ্যটা জানবার পরে মনে হচ্ছে, আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করব ওটা ভুলে যেতে।‘
‘ভুলে যেতে!’
সে বুঝিয়ে বলতে শুরু করল, ‘দেখ, আমি মনে করি মানুষের মস্তিষ্ক গোড়ায় একটা ছোট শূন্য চিলেকোঠার মত। সেখানে পছন্দসই আসবাব জমানোই উচিত। একমাত্র বোকা লোকই যা কিছু পায় তাই সেখানে জমা করে। ফলে যে জ্ঞান তার পক্ষে দরকারী সেইটেই হয়ে ভীড়ে হারিয়ে যায়, না হয় অন্য সব জিনিসের সঙ্গে এমনভাবে তালগোল পাকিয়ে যায় যে দরকারের সময় তাকে আর খুঁজে পাওয়া যায় না। মস্তিষ্কের কুঠুরিতে কি রাখবে না রাখবে সেবিষয়ে দক্ষ কারিগর কিন্তু ভারী সতর্ক। কাজের জন্য দরকারী যন্ত্রপাতি ছাড়া আর কিছু সে সেখানে রাখে না। আর সে যন্ত্রপাতিও সংখ্যায় অনেক বলে সেগুলিকে সে বেশ সাজিয়ে-গুছিয়ে রাখে। ঐ ছোট কুঠুরিটার বর্ধনশীল দেওয়ালে আছে এবং সেটাকে যতদূর খুশি বাড়ানো যায় এ ধারণা কিন্তু ভুল। ঠিক জানবে, এমন একসময় আসে যখন নতুন কোন জ্ঞান পেতে হলেই পুরনো জ্ঞান কিছুটা ছাড়তে হবেই। কাজেই অদরকারী ঘটনা যাতে দরকারী ঘটনাকে মন থেকে ঠেলে সরিয়ে না দেয় সেদিকে দৃষ্টি রাখা অত্যন্ত প্রয়োজন।‘
কিন্তু সৌরজগৎ!’ আমি প্রতিবাদ করলাম।
অসহিষ্ণুকণ্ঠে সে বলে উঠল, ‘তা দিয়ে আমার কি দরকার? তুমি বলছ আমরা সূর্যের চারদিকে ঘুরিছি। বেশ তো, আমরা যদি চন্দ্রের চারদিকে ঘুরতাম তাতে আমি বা আমার কাজের তো তিলমাত্র তফাৎ হত না।‘
তার কাজটা কি জিজ্ঞাসা করতে যাচ্ছিলাম, কিন্তু তার হাবভাবে মনে হল প্রশ্নটাকে সে ভালভাবে নেবে না। যা হোক, আমাদের এই সংক্ষিপ্ত আলোচনার কথা ভাবতে ভাবতে তার থেকে কিছু কিছু তথ্য অনুমান করতে চেষ্টা করলাম। সে বলেছে, তার অভীষ্টের সঙ্গে যুক্ত নয় এমন কোন জ্ঞান লাভ করতে সে চায় না। অতএব যা কিছু … (এখানে কিছু অংশ পাঠোদ্ধার করা যায় নি বলে আপাতত মিসিং) …না হেসে থাকতে পারলাম না। তালিকাটি এইরূপ:
শার্লক হোমস—তার জ্ঞানের সীমা
১. সাহিত্যের জ্ঞান—শূন্য
২. দর্শনের জ্ঞান—শূন্য
৩. জ্যোতির্বিদ্যার জ্ঞান—শূন্য
৪. রাজনীতির জ্ঞান—দূর্বল
৫. উদ্ভিদবিদ্যার জ্ঞান—পরিবর্তনশীল। ধুতুরা, আফিম এবং সাধারণভাবে বিষাক্ত উদ্ভিদ সম্পর্কে পণ্ডিত। কিন্তু উদ্যানবিদ্যার কিছুই জানে না।
৬. ভূতত্ত্বের জ্ঞান—বাস্তব জ্ঞান আছে, কিন্তু সীমিত। একনজরেই বিভিন্নরকম মাটির পার্থক্য বলে দিতে পারে। বেড়িয়ে দিরে তার ট্রাউজারের দাগ দেখিয়ে সেগুলোর রং এবং ঘনত্বের বিচার করে কোন্ দাগ লণ্ডনের কোন্ অঞ্চল থেকে লেগেছে সেটাও আমাকে বলেছে।
৭. রসায়নের জ্ঞান—প্রগাঢ়।
৮. শারীর সংস্থান বিদ্যার জ্ঞান—সঠিক, কিন্তু শৃঙ্খলাহীন।
৯. উত্তেজক সাহিত্যের জ্ঞান—প্রচুর। এই শতাব্দীর যে কোন লোমহর্ষক ঘটনার প্রতিটি বিবরণ সে জানে বলে মনে হয়।
১০. ভাল বেহালা বাজাতে পারে।
১১. দক্ষ বিলিয়ার্ড খেলোয়াড়, বক্সার এবং অসিচালক।
১২. বৃটিশ আইনের ভাব বাস্তব জ্ঞান আছে।
তালিকাটি এই পর্যন্ত পড়েই হতাশ হয়ে সেটাকে আগুনে ফেলে দিলাম। নিজের মনেই বললাম, ‘এই সব সৎগুণের সম্মিলন ঘটিয়ে লোকটি কি করতে চাইছে যদি জানতে পারতাম, এবং কি সে কাজ যাতে এগুলি সব দরকার হয় যদি খুঁজে বের করতে পারতাম, তাহলে সেইদণ্ডে এসব চেষ্টা ছেড়ে দিতাম।’
বেহালা বাজাবার ক্ষমতার কথা আগেই বলেছি। সে ক্ষমতাও খুবই উল্লেখযোগ্য, কিন্তু তার অন্য সব গুণের মতই খামখেয়ালি। আমি জানি সে রাগ-রাগিণী বাজাতে পারে,–বেশ শক্ত রাগ-রাগিনীও। আমার অনুরোধে সে ‘মেণ্ডেলসন-এর লিয়েডার’ এবং অন্য প্রিয় রাগ বাজিয়ে আমাকে শুনিয়েছে। কিন্তু একা থাকলে সে কদাচিৎ কোন রাগ-রাগিণী বা পরিচিত সুর বাজায়। সন্ধ্যায় আরাম-কেদারায় গা এলিয়ে দিয়ে দুই চোখ বন্ধ করে কোলের উপর রাখা বেহালাটায় এলোমেলোভাবে ছড় টানতে থাকে। কখনও তাতে গম্ভীর বিষণ্ণ সুর বাজে, কখনও বা অদ্ভূত এক আনন্দের সুর। স্পষ্টই মনে হয়, তার মনের চিন্তাই যেন সুরের ভিতর দিয়ে আত্মপ্রকাশ করে। কিন্তু সে বাজনা তার চিন্তার ধারাকে সাহায্য করে, না কি সেগুলো নেহাতই তার খেয়লাএর ফল, তা আমি আজও বুঝে উঠতে পারি নি। সেই সব একটানা রুদ্ধশ্বাস বাজনার বিরুদ্ধে আমি হয় তো বিদ্রোহ ঘোষণাই করতাম যদি না সে প্রায়শই তার বাজনার শেষে একের পর এক আমার প্রিয় সুরগুলি বাজিয়ে আমার ধৈর্যচ্যুতির ক্ষতিপূরণ করে দিত।
প্রথম সপ্তাহকাল আমাদের কাছে কেউ এলো না। আমার ধারণা হল এই সঙ্গীটিও আমার মত নির্বান্ধব। কিন্তু শীঘ্রই বুঝতে পারলাম, তার পরিচিত জনের সংখ্যা অনেক, আর তারা সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষ। তাদের মধ্যে একজন ছিল হলদেটে, ইঁদুরমুখো কালো চোখওয়ালা মানুষ। তার নাম শুনেছিলাম মিঃ লেস্ট্রেড। সপ্তাহে তিন চার দিন সে আসত। একদিন সকালে একটি সুসজ্জিত তরুণী এল এবং আধ ঘণ্টার উপরে কাটিয়ে গেল। সেইদিন বিকেলেই একটি শুটকো পাকা-চুল লোক এল। দেখতে ইহুদী ফেরিওয়ালার মত। মনে হল লোকটা খুব উত্তেজিত। তার পরেই এল একটি নোংরা বয়স্কা স্ত্রীলোক। একদিন এসেছিল এক পাকা-চুল বৃদ্ধ; আবার কোনদিন বা নকল মখমলের পোশাক-পরা এক রেলের কুলি। এই সব নানা ধরনের লোক যখন হাজির হত তখন শার্লক হোমস আমার কাছ থেকে বসবার ঘরটা ব্যবহারের অনুমতি চেয়ে নিত, আর আমি আমার শোবার ঘরে চলে যেতাম। আমার এই অসুবিধা ঘটানোর জন্য সে সব সময়ই ক্ষমা চেয়ে নিত। বলত, ‘কাজের জন্য আমাকে ঘরটা ব্যবহার করতে হচ্ছে। এরা সবাই আমার মক্কেল।‘ তখনই সোজাসুজি প্রশ্ন করবার সুযোগ পেলেও জোর করে একজনের গোপন কথা জানবার কৌতূহল থেকে নিজেকে নিবৃত্ত করতাম। ভাবতাম, সেকথা উল্লেখ না করার কোন সঙ্গত কারণ হয় তো তার আছে। কিন্তু একদিন নিজে থেকেই সে প্রসঙ্গ উল্লেখ করে সে আমার এই ভ্রান্ত ধারণার অবসান ঘটাল।
আমার বেশ মনে আছে, সেদিনটা ছিল ৪ঠা মার্চ। অন্য দিনের তুলনায় একটু আগেই ঘুম থেকে উঠেছিলাম। দেখলাম, শার্লক হোমসের প্রাতরাশ তখনও সারা হয় নি। গৃহকর্ত্রী আমার দেরীতে ওঠার ব্যাপারে এতই অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন যে তখনও আমার প্রাতরাশ টেবিলে দেওয়া হয় নি, বা আমার কফিও তৈরী হয় নি। মানুষ অনেক সময় অকারণে রেগে যায়। আমিও সেইরকম রাগের সঙ্গে ঘণ্টাটা বাজিয়ে জানিয়ে দিলাম যে আমি তৈরী। তারপর টেবিল থেকে একখানা পত্রিকা টেনে নিয়ে তার উপর চোখ বুলিয়ে সময় কাটাতে লাগলাম। আমার সঙ্গী নীরবে টোস্টে কামড় দিচ্ছিল। একটা প্রবন্ধের শিরোনামের নীচে পেন্সিলের দাগ দেখে স্বভাবতই সেটার উপর দ্রুত চোখ বুলোতে লাগলাম।
প্রবন্ধের শিরোনামটি খুব জবরদস্ত—‘জীবনের পুঁথি।’ তাতে দেখানো হয়েছে, একজন অনুসন্ধিৎসু লোক সঠিক ও সুশৃঙ্খল পর্যবেক্ষণের ফলে জীবনের কতকিছু জানতে পারে। ব্যাপারটা কিন্তু আমার কাছে চাতুর্য ও অবাস্তবতার একটা খিঁচুড়ি বলে মনে হল। বেশ ধারালো ও তীক্ষ্ণ যুক্তি, কিন্তু সিদ্ধান্তগুলি কষ্টকল্পিত ও অতিরঞ্জিত বলে মনে হয়। লেখক দাবী করেছেন, একটি আকস্মিক কথা, মাংসপেশীর একটি মোচড় বা চোখের একটু দৃষ্টি থেকেই মানুষের মনের অন্তস্থল পর্যন্ত দেখা যায়। যে মানুষ পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণে সুশিক্ষিত তাকে ঠকানো অসম্ভব। তার সিদ্ধান্তগুলি ইউক্লিডের প্রতিপাদ্যের মতই অভ্রান্ত। কোন নূতন লোকের কাছে তার সিদ্ধান্তগুলি বিস্ময়কর মনে হবেই এবং যতক্ষণ তার অনুসৃত পদ্ধতিগুলি সে না শিখবে ততক্ষণ তাকে একজন যাদুকর বলেই মনে করবে।
লেখক বলেছেন, একজন যুক্তিবিদ একফোঁটা জল থেকে আতলান্তিক মহাসাগর বা নায়েগ্রা জলপ্রপাতের সম্ভবনাকে অনুমান করতে পারে, যদিও সে ও দুটোর একটাকেও দেখে নি, বা কারও থেকে ওদের সম্পর্কে কিছু শোনেও নি। সব জীবনই একটি প্রকাণ্ড শৃঙ্খল যার একটি গাঁটকে দেখতে পেলেই সমগ্রটাকে জানা যায়। অন্য সব শিল্প-কলার মত ‘অনুমান ও বিশ্লেষণ বিজ্ঞান’কেও সুদীর্ঘ অধ্যবসায় দ্বারাই আয়ত্ব করা যায়, এবং যেহেতু জীবন যথেষ্ট দীর্ঘস্থায়ী নয় সেজন্য কোনও মানুষের পক্ষেই এবিষয়ে পরিপূর্ণতা অর্জন করা সম্ভব নয়। কোন সমস্যার নৈতিক ও মানসিক দিকগুলি অত্যন্ত বিঘ্নসঙ্কুল; কাজেই ছোটখাট সমস্যাগুলিকে আয়ত্তে আনবার চেষ্টাই প্রথমে করা উচিত।
কোন মানুষের সঙ্গে দেখা হলে একনজরেই জানবার চেষ্টা করতে হবে তার অতীত ইতিহাস, তার বাণিজ্য বা অন্য জীবিকার পরিচয়। এরকম চেষ্টা প্রথমে বোকামির পরিচায়ক বলে মনে হতে পারে, কিন্তু ফলে মানুষের পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা ক্ষুরধার হয় এবং কোথায় চোখ ফেলতে হবে বা কি দেখতে হবে সে শিক্ষা লাভ করা যায়। একটা মানুষের হাতের নখ, তার কোটের আস্তিন, জুতো, ট্রাউজারের হাঁটুর কাছটা, তর্জনী এবং বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠের উপরকার কড়া, তার কথা, তার শার্টের কফ—এর প্রত্যেকটি থেকেই মানুষের জীবিকার পরিচয় পরিষ্কারভাবে ব্যক্ত হয়। কোন একটি ক্ষেত্রে এর সবগুলি প্রয়োগ করেও একজন যোগ্য অনুসন্ধানকারী সমস্যার উপর আলোকপাত করতে অসমর্থ হবেন এটা একেবারেই অকল্পনীয়।
‘কী অবর্ণনীয় বাগাড়ম্বর!’ চীৎকার করে বলতে বলতে আমি পত্রিকাটা টেবিলের উপর ছুঁড়ে দিলাম। ‘জীবনে এরকম বাজে লেখা কখনও পড়ি নি।’
‘কোনটার কথা বলছ?’ শার্লক হোলস প্রশ্ন করল।
প্রাতরাশ খেতে খেতে ডিমের চামচে দিয়ে দেখিয়ে আমি বললাম, ‘কেন, এই প্রবন্ধটা। মনে হচ্ছে তুমি এটা পড়েছ, কারণ এটার নীচে দাগ দিয়েছ। অস্বীকার করছি না যে লেখাটায় মুন্সিয়ানা আছে; আমি অবশ্য বিরক্ত হয়েছি। এটা নিশ্চয়ই কোন আরামকেদারাশ্রয়ী আলস্যবিলাসীর উদ্ভট মতবাদ। নিজের নির্জন পড়ার ঘরে বসে তিনি এই সব অবাস্তব কথার জাল বোনে। এসব একেবারেই অবাস্তব। আমার ইচ্ছা করে, পাতাল-রেলের কোন তৃতীয় শ্রেণীর কামরায় ঠেলে দিয়ে তাকে বলি, এবার সহযাত্রীদের জীবিকার পরিচয়গুলি দাও তো বাপধন। তার সঙ্গে আমি হাজার পাউণ্ড বাজী লড়তে রাজী।’
হোমস শান্তভাবে বলল, ‘তাতে তোমার টাকাটাই খোয়াবে। আর প্রবন্ধটার কথা যদি বল, ওটা আমি লিখেছি।’
‘তুমি!’
‘হ্যাঁ। পর্যবেক্ষণ ও অনুমানের কাজে আমার একটা ঝোঁক আছে। সে-সকল মত আমি ওখানে প্রকাশ করেছি, এবং যেগুলিকে তুমি অত্যন্ত অবাস্তব বলে মনে করছ, সেগুলো অত্যন্ত বাস্তবসম্মত—এত বাস্তব যে আমার রুটি-মাখনের জন্য আমি ওগুলোর উপরই নির্ভর করি।‘
‘কিন্তু কেমন করে?’ নিজের অজ্ঞাতেই প্রশ্ন করলাম।
‘দেখ, আমারও একটা জীবিকা আছে। আমার ধারণা এ ব্যাপারে পৃথিবীতে আমি একক। আমি একজন পরামর্শদাতা গোয়েন্দা। অবশ্য সেটা কি জিনিস তুমি বুঝবে কি না জানি না। এই লণ্ডনে অনেক সরকারী ও বে-সরকারী গোয়েন্দা আছে। এরা যখন পেরে ওঠে না, তখন আমার কাছে আসে, আমি তাদের পথ বাতলে দি। তারা সংগৃহীত সাক্ষ্য-প্রমাণাদি আমার কাছে পেশ করে, অপরাধ-ইতিহাসের যে জ্ঞান আমি অর্জন করেছি তারই সাহায্যে আমি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাদের ঠিক পথে পরিচালিত করতে সক্ষম হই। বিভিন্ন দুষ্কর্মের মধ্যে একটা মূলগত মিল আছে; ফলে হাজারটা দুষ্কর্মের বিবরণ তুমি উদ্ধার করতে পারবে না এটা হতেই পারে না। লেস্ট্রেড একজন নামকরা গোয়েন্দা। সম্প্রতি একটা জালিয়াতির মামলা নিয়ে বড়ই গোলমালে পড়েছিল তাই আমার কাছে এসেছিল।’
‘আর অন্যরা?’
‘বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই তাদের পাঠায় বেসরকারী গোয়েন্দা সংস্থা। কোন ব্যাপার নিয়ে গোলমালে পড়লেই তারা আলোকপাতের জন্য আসে। আমি তাদের কাহিনী মন দিয়ে শুনি, তারা আমার মন্তব্যগুলি মন দিয়ে শোনে, তারপর আমার ফীটা পকেটস্থ করি।‘
আমি বললাম, ‘তুমি কি বলতে চাও, সচক্ষে সব বিবরণ দেখেও যে রহস্যের কিনারা তারা করতে পারে না, তুমি এই ঘরে বসেই তার গিট খুলতে পার?’
‘ঠিক তাই। এবিষয়ে আমার কেমন একটা অন্তর্দৃষ্টি আছে। কখনও সখনও এমন কেস আসে যেটা একটু বেশী জটিল। তখন অবশ্য আমাকেও বাইরে বেরিয়ে নিজের চোখে সবকিছু দেখতে হয়। দেখ, আমার কতকগুলি বিশেষ জ্ঞান আছে যেগুলি প্রয়োগ করে আমি আশ্চর্য ফল পাই। এই প্রবন্ধে অনুমানের যেসব নিয়ম উল্লেখ করা হয়েছে এবং যেগুলি তোমার ঘৃণার উদ্রেক করেছে সেগুলি কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে আমার কাছে খুবই মূল্যবান। পর্যবেক্ষণ আমার দ্বিতীয় প্রকৃতি। প্রথম দিন সাক্ষাতের সময় আমি যখন বললাম যে তুমি আফগানিস্থান থেকে এসেছ, তখন তুমি বিস্মিত হয়েছিলে।‘
‘নিশ্চয় কেউ তোমাকে বলেছিল।‘
‘মোটেই তা নয়। আমি স্রেফ জানতে পেরেছিলাম যে তুমি আফগানিস্থান থেকে এসেছ। দীর্ঘদিনের অভ্যাসের ফলে চিন্তা-স্রোত এত দ্রুতগতিতে আমার মনে প্রবাহিত হয়ে যে অন্তবর্তী ধাপগুলো চিন্তা না করেই আমি সরাসরি সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি। অবশ্য সে ধাপগুলো তো থাকেই। চিন্তার ধারাটা এই রকম ছিল; এই ভদ্রলোক ডাক্তার, অথচ চালচলনে সামরিক ভাবভঙ্গি, কাজেই নিশ্চয় সামরিক ডাক্তার। তিনি নিশ্চয় সম্প্রতি গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চল থেকে এসেছেন, কারণ তার মুখমণ্ডল বাদামী, অথচ ওটা তাঁর চামড়ার স্বাভাবিক রং নয় যেহেতু তার কব্জী দুটো সাদা। তাঁর বিষন্ন মুখ দেখলে স্পষ্টই বোঝা যায় তিনি অনেক দুঃখ-কষ্ট ও রোগ ভোগ করেছেন। তাঁর বাঁ হাতটায় আঘাত লেগেছে কারণ সে হাতটা তিনি অস্বাভাবিকভাবে আড়ষ্ট করে রাখেন। গ্রীষ্মমণ্ডলের কোন্ স্থানে একজন ইংরেজ সামরিক ডাক্তারের পক্ষে এরকম কষ্ট ভোগ করা সম্ভব? আর কোথায়ই বা তাঁর হাতে আঘাতপ্রাপ্ত হতে পারে? নিশ্চয় আফগানিস্থানে। এই পুরো চিন্তাধারাটি কিন্তু এক সেকেণ্ডও সময় নেয় নি। আমি তখনই মন্তব্য করলাম, তুমি আফগানিস্থান থেকে এসেছ, আর তুমিও বিস্মিত হলে।‘
হেসে বললাম, ‘তুমি বুঝিয়ে বলার পরে অবশ্য ব্যাপারটা সরলই মনে হচ্ছে। এডগার এলেন পো-র ডিউপিনের কথা মনে পড়ছে। গল্পের বাইরেও এ ধরনের চরিত্র থাকে আমার জানা ছিল না।‘
শার্লক হোমস উঠে পাইপটা ধরাল। তারপর বলতে লাগল, ‘তুমি নিঃসন্দেহে ভাবছ যে ডিউপিনের সঙ্গে তুলনা করে আমার প্রশংসাই করছ। কিন্তু আমার মতে ডিউপিন খুব সাধারণ স্তরের মানুষ। পনের মিনিট চুপ করে থেকে হঠাৎ একটা যুৎসই মন্তব্য করে বন্ধুকে চমকে দেওয়ার যে কৌশল তিনি দেখান সেটা আসলে কিন্তু বড়ই লোক-দেখানো ও কৃত্রিম। অবশ্য বিশ্লেষণী শক্তি তাঁর ছিল, কিন্তু পো তাঁকে যতখানি বড় বলে কল্পনা করেছেন আসলে তিনি তা নন।‘
আমি প্রশ্ন করলাম, ‘তুমি কি গাবোরিয়-র বই পড়েছ? তোমার মতে লিকক কি একজন ভাল গোয়েন্দা?’
শার্লক হোমস ঠাট্টার ভঙ্গীতে নাকটা টানল। তারপর রাগতঃ স্বরে বলল, ‘লিকক তো একটা মহা আনাড়ি। একটা গুণই তার ছিল,–উৎসাহ। ও বই পড়ে তো আমি কাহিল হয়ে পড়েছিলাম। ব্যাপার কি না, একটি অজানা কয়েদিকে খুঁজে বের করতে হবে। আমি ও কাজ চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যেই করতে পারতাম। লিককের লেগেছিল ছ’মাস বা ওই রকম সময়। গোয়েন্দাদের কি বাদ দেওয়া উচিত সেটা শেখবার মত পাঠ্য-পুস্তক অবশ্য ও বইখানা হতে পারে।‘
যে দুটি চরিত্র আমার প্রিয় তাদের সম্পর্কে এই ধরনের উদ্ধত উক্তি করায় আমি কিছুটা অসন্তুষ্ট হলাম।
জানালার কাছে উঠে গিয়ে বাইরের জনবহুল রাস্তার দিকে তাকালাম। মনে মনে বললাম, ‘লোকটি চতুর বটে, তবে বড় দাম্ভিক।‘
যে দুঃখের সঙ্গেই সে বলল, ‘আজকাল আর অপরাধও নেই, অপরাধীও নেই। আমাদের কাজে এখন আর মস্তিষ্কের প্রয়োজন হয় না। আমি জানি, আমার মধ্যে ও বস্তুটি আমাকে বিখ্যা করবার পক্ষে পর্যাপ্তই আছে। অপরাধ উদঘাটনের কাজে যতটা পড়াশুনা এবং মেধা আমি প্রয়োগ করেছি আজ পর্যন্ত অপর কেউ তা করে নি। কিন্তু লাভ কি হল? ধরবার মত কোন অপরাধই ঘটে না। আর যাও বা ঘটে এতই জলের মত পরিষ্কার যে স্কটল্যাণ্ড ইয়ার্ডের যে কোন অফিসারই তার কিনারা করতে পারে।
লোকটির কথাবার্তার এই আত্মম্ভরিতা ক্রমেই আমাকে বিরক্ত করে তুলল কাজেই ভাবলাম এ প্রসঙ্গ পরিত্যাগ করাই শ্রেয়।
একটি দীর্ঘদেহ সাদাসিধে পোশাকের মানুষ রাস্তার অপর দিকে ধরে বাড়ির নম্বর দেখতে দেখতে ধীরে ধীরে অগ্রসর হচ্ছিল। তার হাতে একখানা নীল রঙের বড় খাম। নিশ্চয় কোন সংবাদ নিয়ে এসেছে। তাকে দেখিয়ে আমি বলে উঠলাম, ‘লোকটি না জানি কি খুঁজে বেড়াচ্ছে।‘
শার্লক হোমস বলল, ‘নৌবিভাগের অবসরপ্রাপ্ত সার্জণ্টের কথা বলছ?’
‘খালি বড়াই আর দম্ভ!’ মনে মনে ভাবলাম। ‘ভাল করেই জানে যে ওর এই অনুমানকে আমি পরখ করে দেখতে পারব না।‘
এ কথাগুলি ভাবতে না ভাবতেই লোকটি আমাদের দরজাতেই তার প্রার্থিত নম্বরটি দেখতে পেয়ে দ্রুতপায়ে রাস্তাটা পার হল। আমাদের কানে এল দরজায় ধাক্কার শব্দ, নীচে একটি গম্ভীর কণ্ঠস্বর এবং সিঁড়ি বেয়ে উঠবে ভারী পদধ্বনি।
ঘরের ভিতরে ঢুকে বন্ধুর হাতে চিঠিখানা দিয়ে সে বলল, ‘মিঃ শার্লক হোমসের জন্য।‘
এতক্ষণে তার মুখোশ খুলে দেবার একটা সুযোগ পাওয়া গেল। আচমকা একটা কথা বলে ফেলবার সময় এরকমটা যে ঘটতে পারে তা তো আর সে ভাবতে পারে নি। সরাসরি লোকটিকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আপনি কোথায় কাজ করেন জিজ্ঞাসা করতে পারি কি?’
রূঢ়কণ্ঠে সে জবাব দিল, ‘সেনাবিভাগে, ইউনিফর্মটা মেরামতের জন্য পাঠানো হয়েছে।‘
ঈর্ষার দৃষ্টিতে সঙ্গীর দিকে তাকিয়ে আবার প্রশ্ন করলাম, ‘আপনি কি ছিলেন?’
‘সার্জেণ্ট স্যার। রাজকীয় নৌবাহিনীর পদাতিক বাহিনী স্যার। কোন জবাব দেবেন না? ঠিক আছে স্যার।‘
দুটো গোড়ালি ঠুকে হাত তুলে সে স্যালুট করল। তারপরই চলে গেল।