একটি ফুটবল ম্যাচ
গোলটা আমিই দিয়েছি। এখনও চিৎকার শোনা যাচ্ছে ওদের থ্রি চিয়ার্স ফর প্যালারাম—হিপ্ হিপ হুররে! এখন আমাকে ঘাড়ে করে নাচা উচিত ছিল সকলের। পেট ভরে খাইয়ে দেওয়া উচিত ছিল ভীমনাগের দোকানে কিংবা দেলখোস রেস্তোরায়। কিন্তু তার বদলে একদল পিনপিনে বিতিকিচ্ছি মশার কামড় খাচ্ছি আমি। চটাস করে মশা মারতে গিয়ে নিজের নাকেই লেগে গেল একটা রাম-থাপ্পড়। একটু উঁ-আঁ করে কাঁদব তারও উপায় নেই। প্যাচপেচে কাদার ভেতরে কচুবনের আড়ালে মূর্তিমান কানাই সেজে বসে আছি, আর আমার চারিদিকে মশার বাঁশি বাজছে।
—থ্রি চিয়ার্স ফর প্যালারাম। আবার চিৎকার শোনা গেল। একটা মশা পটাস করে হুল ফোটাল ডান গালে। ধাঁ করে চাঁটি হাঁকালুম—নিজের চড়ে নিজেরই মাথা ঘুরে গেল। অঙ্কের মাস্টার গোপীবাবুও কখনও এমন চড় হাঁকড়েছেন বলে মনে পড়ল না।
গেছি-গেছি বলে চেঁচিয়ে উঠতে গিয়ে বাপ বাপ করে সামলে নিলুম। দমদমার এই কচুবনে আপাতত আরও ঘণ্টাখানেক আমার মৌনের সাধনা। সন্ধ্যার অন্ধকার নামবার আগে এখান থেকে বেরুবার উপায় নেই।
চিৎকার ক্রমশ দূরে মিলিয়ে যাচ্ছে : থ্রি চিয়ার্স ফর প্যালারাম–হিপ হিপ হুররে।
আমি পটলডাঙার প্যালারামপালাজ্বরে ভুগি আর বাসক পাতার রস খাই। কিন্তু পটলডাঙা ছেড়ে শেষে এই দমদমার কচুবনে আমার পটল তোলবার জো হবে—একথা কে জানত!
আমাদের পটলডাঙা থান্ডার ফুটবল ক্লাবের আমি একজন উৎসাহী সদস্য। নিজে কখনও খেলি না, তবে সব সময়েই খেলোয়াড়দের প্রেরণা দিয়ে থাকি। আমাদের ক্লাব কোনও খেলায় গোল দিলে সাত দিন আমার গলা ভাঙা সারে না। হঠাৎ যদি কোনও খেলায় জিতে যায়—যা প্রায় কোনও দিনই হয় না—তা হলে আনন্দের চোটে আমার কষ্প দিয়ে পালাজ্বর আসে।
সদস্য হয়েই ছিলুম ভালো। গোলমাল বাধল খেলোয়াড় হতে গিয়ে।
দমদমার ভ্যাগাবন্ড ক্লাবের সঙ্গে ফুটবল ম্যাচ। তিনদিন আগে থেকে ছোটদির ভাঙা হারমোনিয়ামটা নিয়ে আমি ধ্রুপদ গাইতে চেষ্টা করছি। গান গাইবার জন্যে নয়—খেলার মাঠে যাতে সারাক্ষণ একটানা চেঁচিয়ে যেতে পারি—সেই উদ্দেশ্যে। তেতলার ঘর থেকে মেজদা যখন বড় একটা ডাক্তারির বই নিয়ে তেড়ে এল, তারপরেই বন্ধ করতে হল গানটা।
কিন্তু দমদমে পৌঁছেই একটা ভয়ঙ্কর দুঃসংবাদ শোনা গেল।
আমাদের দুই জাঁদরেল খেলোয়াড় ভণ্ট আর ঘন্টু দুই ভাই। দুজনেই মুগুর ভাঁজে আর দমাদ্দম ব্যাকে খেলে। বলের সঙ্গে সঙ্গে উড়িয়ে দেয় অন্য দলের সেন্টার ফরোয়ার্ডকে। আজ পর্যন্ত দুজনে যে কত লোকের ঠ্যাং ভেঙেছে তার হিসেব নেই।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত ওরা পটলডাঙা থান্ডার ক্লাবেরই ঠ্যাং ভাঙল। একেবারে দুটো ঠ্যাং ভাঙল। একেবারে দুটো ঠ্যাংই একসঙ্গে।
কাশীতে ওদের কুট্টিমামা থাকে। তা থাক-কাশি-সর্দি-পালাজ্বর—যেখানে খুশি থাক। কিন্তু কুট্টিমামা কি আর বিয়ে করার দিন পেল না? ঠিক আজ দুপুরেই টেলিগ্রামটা এসে হাজির। আর বিশ্বাসঘাতক ভণ্ট আর ঘন্টু সঙ্গে সঙ্গে লাফাতে লাফাতে হাওড়া স্টেশনে। থান্ডার ক্লাবকে যেন দুটো আন্ডারকাট ঘুষি মেরে চিৎ করে ফেলে দিয়ে গেল!
দলের ক্যাপ্টেন পটলডাঙার টেনিদা বাঘের মতো গর্জন করে উঠল।মামার বিয়ের ঘ্যাঁট গেলবার লোভ সামলাতে পারলে না। ছোঃ। নরাধমলোভী কাপুরুষ। ছোঃ!
গাল দিয়ে গায়ের ঝাল মিটতে পারে, কিন্তু সমস্যার সমাধান হয় না। পটলডাঙা থান্ডার ক্লাবের সদস্যরা তখন বাসী মুড়ির মতো মিইয়ে গেছে সবাই। ভন্টু ঘন্টু নেই—এখন কে বাঁচাবে ভ্যাগাবন্ড ক্লাবের হাত থেকে? ওদের দুদে ফরোয়ার্ড ন্যাড়া মিত্তির দারুণ ট্যারা। আমাদের গোলকিপার গোবরা আবার ট্যারা দেখলে বেজায় ভেবড়ে যায়—কোন্ দিক থেকে যে বল আসবে ঠাহর করতে পারে না। ওই ট্যারা ন্যাড়াই হয়তো একগণ্ডা গোল ঢুকিয়ে দিয়ে বসে থাকবে।
এখন উপায়?
টেনিদার ছোকরা চাকর ভজুয়া গিয়েছিল সঙ্গে। বেশ গাঁট্টাগোট্টা চেহারা—মারামারি বাধলে কাজে লাগবে মনে করেই তাকে সঙ্গে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। টেনিদা কটমট করে খানিকটা তার দিকে তাকিয়ে থেকে বললে, এই ভজুয়া ব্যাকে খেলতে পারবি?
ভজুয়া খৈনি টিপছিল। টপ করে খানিকটা খৈনি মুখে পুরে নিয়ে বললে, সেটা ফির কী আছেন ছোটবাবু?
—পায়ের কাছে বল আসবেধাঁই করে মেরে দিবি। পারবি না?
—হাঁ। খুব পারবে। বল ভি মারিয়ে দিবে—আদমি ভি মারিয়ে দিবে।—ভজুয়ার চোখে-মুখে জ্বলন্ত উৎসাহ।
–না না, আদমিকে মারিয়ে দিতে হবে না। শুধু বল মারলেই হবে। পারবি তো ঠিক?
–কেনো পারবে না? কাল রাস্তামে একঠো কুত্তা ঘেউঘেউ করতে করতে আইল তো মারিয়ে দিলাম একঠো জোরসে লাথি। এক লরি যাইতেছিলথ খাইয়ে একদম উত্সকো উপর চড়িয়ে গেল। বাস্—সিধা হাওড়া টিশন।
—থাম থাম—মেলা বকিসনি—টেনিদা একটা নিশ্চিন্ত দীর্ঘশ্বাস ফেলল; একটা ব্যাক তো পাওয়া গেল। আর একটা—আর একটা—এদিক ওদিক তাকাতে তাকাতে হঠাৎ চোখ পড়ল আমার ওপরে ঠিক হয়েছে। প্যালাই খেলবে।
—আমি।
একটা চীনেবাদাম চিবুতে যাচ্ছিলুম, সেটা গিয়ে গলায় আটকাল।
–কেন—তুই তো বলেছিলি, শিমুলতলায় বেড়াতে গিয়ে কাদের নাকি তিনটে গোল দিয়েছিলি একাই? সেসব বুঝি স্রেফ গুলপট্টি?
গুলপট্টি তো নির্ঘাত। চাটুজ্যেদের রকে বসে তেলেভাজা খেতে খেতে সবাই। দুটো-চারটে গুল দেয়, আমিও ঝেড়েছিলুম একটা। কিন্তু টেনিদা দুবার ম্যাট্রিকে গাড্ডা খেয়েছে, তার মেমোরি এত ভাল কে জানত?
বাদামটা গিলে ফেলে আমি বললুম, না, না, গুলপট্টি হবে কেন? পালাজ্বরে কাহিল করে দিয়েছে নইলে এতদিনে আমি মোহনবাগানে খেলতুম, তা জানো? এখন দৌড়োতে গেলে পিলেটা একটু নড়ে—এই যা অসুবিধে।
—পিলেই তো নড়াবি। পিলে নড়লে তোর পালাজ্বরও সরে পড়বে—এই বলে দিলুম। নে—নেমে পড়—
ফুর্—র্—র্—র্–
রেফারির বাঁশির আওয়াজ। আমি কী বলতে যাচ্ছিলুম, তার আগেই এক ধাক্কায় টেনিদা আমাকে ছিটকে দিলে মাঠের ভেতরে। পড়তে-পড়তে সামলে নিলুম। ভেবে দেখলুম, গোলমাল বেশি বাড়ানোর চাইতে দু-একটা গোল দেওয়ার চেষ্টা করাই ভাল।
যা থাকে কপালে! আজ প্যালারামেরই একদিন কি পালাজ্বরেরই একদিন!
খেলা শুরু হল।
ব্যাকে দাঁড়িয়ে আছি। ভেবেছিলুম ভজুয়া একাই ম্যানেজ করবে কিন্তু দেখা গেল, মুখ ছাড়া আর কোনও পুঁজিই ওর নেই। একটা বল পায়ের কাছে আসতেই রাম শট হাঁকড়ে দিলে। কিন্তু বলে পা লাগল না—উলটে ধড়াস করে শুকনো মাঠে একটা আছাড় খেল ভজুয়া। ভাগ্যিস গোলকিপার গোবা তক্কেতক্কে ছিলঅইলে ঢুকেছিল আর-কি একখানা।
হাই কিক দিয়ে গোবরা বলটাকে মাঝখানে পাঠিয়ে দিলে। রাইট আউট হাবুল সেন বলটা নিয়ে পাঁই-পাঁই করে ছুটল-ফাঁড়া কাটল এ-যাত্রা।
কিন্তু ফুটবল মাঠে সুখ আর কতক্ষণ কপালে থাকে। পরক্ষণেই দেখি বল দ্বিগুণ বেগে ফিরে আসছে আমাদের দিকে—আর নিয়ে আসছে ট্যারা ন্যাড়া মিত্তির।
ভজুয়া বোঁ-বোঁ করে ছুটল—কিন্তু ন্যাড়া মিত্তিরকে ছুঁতেও পারল না। খুট করে ন্যাড়া কাটিয়ে নিলে, ভজুয়া একেবারে লাইন টপকে গিয়ে পড়ল লাইনসম্যান ক্যাবলার ঘাড়ে।
কিন্তু ভজুয়ার যা খুশি হোক—আমার তো শিরে সংক্রান্তি। এখন আমি ছাড়া ন্যাড়া মিত্তির আর গোলকিপার গোবরার ভেতরে আর কেউ নেই। আর গোরাকে তো জানি। ন্যাড়ার ট্যারা চোখের দিকে তাকিয়ে হাঁ করে দাঁড়িয়ে থাকবে—কোন্ দিক দিয়ে বল যে গোলে ঢুকছে টেরও পাবে না।
—চার্জ! চার্জ!—সেন্টারহাফ টেনিদার চিৎকার : প্যালা, চার্জ—
জয় মা কালী! এমনিও গেছি—অমনিও গেছি। দিলুম পা ছুড়ে! কিমাশ্চর্যম। ন্যাড়া মিত্তির বোকার মতো দাঁড়িয়ে বলটা সোজা ছুটে চলে গেছে হাবুল সেনের কাছে।
—ব্রেভো, ব্রেভো প্যালা!—চারদিক থেকে চিৎকার উঠল : ওয়েল সেভড। তাহলে সত্যিই আমি ক্লিয়ার করে দিয়েছি। আমি পটলডাঙার প্যালারাম, ছেলেবেলায় টেনিস বল ছাড়া যে কখনও পা দিয়ে ফুটবল ছোঁয়নি—সেই আমি ঠেকিয়েছি দুর্ধর্ষ ন্যাড়া মিত্তিরকে! আমার চব্বিশ ইঞ্চি বুক গর্বে ফুলে উঠল। মনে হল, ফুটবল খেলাটা কিছুই নয়। ইচ্ছে করে এতদিন খেলিনি বলেই মোহনবাগানে চান্স পাইনি।
কিন্তু আবার যে ন্যাড়া মিত্তির আসছে! ওর পায়ে কি চুম্বক আছে! সব বল কি ওর পায়ে গিয়ে লাগবে?
দুবার অপদস্থ হয়ে ভজুয়া খেপে গিয়েছিল। মরিয়া হয়ে চার্জ করল। কিন্তু রুখতে পারল না। তবু এবারেও গোল বাঁচল। তবে গোবরা নয়—একরাশ গোবর। ঠিক সময়মতো তাতে পা পিছলে পড়ে গেল ন্যাড়া মিত্তির, আর আমি ধাঁই করে শট মেরে ক্লিয়ার করে দিলুম। ওদের লেফট আউটের পায়ে লেগে থ্রো হয়ে গেল সেটা।
কিন্তু আত্মবিশ্বাস ক্রমেই বাড়ছে। পটলডাঙার থান্ডার ক্লাবের চিৎকার সমানে শুনছি। ব্রেভো প্যালা-শাবাশ! আরে, আবার যে বল আসে! আমাদের ফরোয়ার্ডগুলো কি ঘোড়ার ঘাস কাটছে নাকি? গেল-গেল করতে করতে ওদের বেঁটে রাইট ইনটা শট করলে আমার পায়ের তলা দিয়ে বল উড়ে গেল গোলের দিকে।
গো-ও-ও-
ভ্যাগাবন্ড ক্লাবের চিৎকার। কিন্তু ওল আর নয়, স্রেফ কচু। অর্থাৎ বল তখন পোস্ট ঘেঁষে কচুবনে অন্তর্ধান করেছে।
গোল কিক্।
কিন্তু এর মধ্যেই একটা কাণ্ড করেছে ভজুয়া। বলকে তাড়া করতে গিয়ে শট করে দিয়ে গোল-পোস্টের গায়ে। আর তার পরেই আঁই-আঁই করতে করতে বসে পড়েছে পা চেপে ধরে।
ভজুয়া ইনজিওর্ড! ধরাধরি করে দু-তিনজন তাকে বাইরে নিয়ে গেল।
আপদ গেল! যা খেলছিল—পারলে আমিই ওকে ল্যাং মেরে দিতুম। গোলপোস্টটাই। আমার হয়ে কাজ সেরে দিয়েছে। কিন্তু এখন যে আমি একেবারে একা একা কুম্ভ রক্ষা করে নকল কুঁদিগড়! এলোপাথাড়ি কাটল কিছুক্ষণ। ভগবান ভরসা—আমাকে আর বল ছুঁতে হল না। গোটা দুই শট গোবরা এগিয়ে এসে লুফে নিলে, গোটা তিনেক সামলে নিলে হাফ ব্যাকেরা। তারপর হাফ-টাইমের বাঁশি বাজল।
আঃ—কোনওমতে ফাঁড়া কাটল এ-পর্যন্ত। বাকি সময়টুকু সামলে নিতে পারলে হয়!
পেটের পিলেটা একটু টনটন করছে বুকের ভেতরও খানিকটা ধড়ফড়ানি টের পাচ্ছি। কিন্তু চারদিক থেকে তখন থাণ্ডার ক্লাবের অভ্যর্থনা : বেড়ে খেলছিস প্যালা, শাবাশ! এমনকি ক্যাপ্টেন টেনিদা পর্যন্ত আমার পিঠ থাবড়ে দিলে : তুই দেখছি রেগুলার ফার্স্ট ক্লাস প্লেয়ার! না—এবার থেকে তোকে চান্স দিতেই হবে দু-একবার
এতে আর কার পিলে-টিলের কথা মনে থাকে। বিজয়গর্বে দু-গ্লাস লেবুর শরবত খেয়ে নিলুম। শুধু ভজুয়া কিছু খেল না—পায়ে একটা ফেটি বেঁধে বসে রইল গোঁজ হয়ে। টেনিদা দাঁত খিচিয়ে বললে, শুধু একনম্বরের বাক্যি-নরেশ! এক লাথসে কুত্তাকো লরিমে চড়া দিয়া! তবু একটা বল ছুঁতে পারলে না—ছছঃ—ছো?
ভজুয়া দু-চোখে জিঘাংসা নিয়ে তাকিয়ে রইল।
আবার খেলা শুরু হল। খোঁড়াতে খোঁড়াতে ভজুয়া আবার নামল মাঠে। আমার কানের কাছে মুখ এনে বললে, দেখিয়ে প্যালাবাবু ইস্ দফে হাম মার ডালেঙ্গে!
ভজুয়ার চোখ দেখে আমার আত্মারাম খাঁচাছাড়া। সর্বনাশ—আমাকে নয় তো?
—সে কী রে! কাকে?
—দেখিয়ে না—
কিন্তু আবার সে আসছে! ওই আসে—ওই অতি ভৈরব হরষে! আর কে? সেই ন্যাড়া মিত্তির! ট্যারা চোখে সেই ভয়ঙ্কর দৃষ্টি! এবার গোল না দিয়ে ছাড়বে বলে মনে হয় না!
ক্ষ্যাপা মোষের মতো ছুটল ভজুয়া। তারপরই বাপ বলে এক আকাশ-ফাটা চিৎকার! বল ছেড়ে ন্যাড়া মিত্তিরের পাঁজরায় লাথি মেরেছে ভজুয়া, আর ন্যাড়া মিত্তির ঝেড়েছে। ভজুয়ার মুখে এক বোম্বাই ঘুষি। তারপর দুজনেই ফ্ল্যাট এবং দুজনেই অজ্ঞান। ভজুয়া প্রতিশোধ নিয়েছে বটে, কিন্তু এটা জানত না যে ন্যাড়া মিত্তির নিয়মিত বক্সিং লড়ে।
মিনিট-তিনেক খেলা বন্ধ। পটলডাঙার থান্ডার ক্লাব আর দমদম ভ্যাগাবণ্ড ক্লাবের মধ্যে একটা মারামারি প্রায় বেধে উঠেছিল—দু-চারজন ভদ্রলোক মাঝখানে নেমে থামিয়ে দিলেন। ফের খেলা আরম্ভ হল। কিন্তু ভজুয়া আর ফিরল না ন্যাড়া মিত্তিরও না।
বেশ বোঝা যাচ্ছে, ন্যাড়া বেরিয়ে যাওয়াতে দলের কোমর ভেঙে গেছে ওদের। তবু হাল ছাড়ে না ভ্যাগাবণ্ড ক্লাব। বারবার তেড়ে আসছে। আর, কী হতচ্ছাড়া ওই বেঁটে রাইট-ইনটা!
—অফ সাইড। রেফারির হুইসল। আর-একটা ফাঁড়া কাটল।
পটলডাঙা ক্লাবের হাফ ব্যাকেরা এতক্ষণে যেন একটু দাঁড়াতে পেরেছে। আমার পা পর্যন্ত আর বল আসছে না। খেলার প্রায় মিনিট-তিনেক বাকি। এইটুকু কোনওমতে কাটাতে পারলেই মানে মানে বেঁচে যাই—পটলডাঙার প্যালারাম বীরদর্পে ফিরতে পারে পটলডাঙায়।
এই রে! আবার সেই বেঁটেটা! কখন চলে এসেছে কে জানে! এ যে ন্যাড়া মিত্তিরের ওপরেও এক কাঠি! নেংটি ইদুরের মতো বল মুখে করে দৌড়তে থাকে। আমি কাছে এগোবার আগেই বেঁটে কিক করেছে। কিন্তু থান্ডার ক্লাব বাঁয়ে শেয়াল নিয়ে নেমেছিল নির্ঘাত! ডাইভ করে বলটা ধরতে পারলে না গোবরা—তবু এবারেও বল পোস্ট ঘেঁষে বাইরে চলে গেল।
কিন্তু ন্যাড়া মিত্তিরকে যে-গোবরটা কাত করেছিল—সেটা এবার আমায় চিত করল। একখানা পেল্লায় আছাড় খেয়ে যখন উঠে পড়লুম তখন পেটের পিলেটায় সাইক্লোন হচ্ছে। মাথার ভেতরে যেন একটা নাগরদোলা ঘুরছে বোঁ-বোঁ করে। মনে হচ্ছে, কম্প দিয়ে পালাজ্বর এল বুঝি!
আর এক মিনিট। আর এক মিনিট খেলা বাকি। রেফারি ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছে বারবার। ড্র যাবে নির্ঘাত। যা খুশি হোক—আমি এখন মাঠ থেকে বেরুতে পারলে বাঁচি। আমার এখন নাভিশ্বাস! গোবরে আছড়া খেলে মাথা এমন বোঁ-বোঁ করে ঘোরে কে জানত!
গোল-কিক।
আবছাভাবে গোবরার গলার স্বর শুনতে পেলুম : কিক কর, প্যালা—
শেষের বাঁশি প্রায় বাজল। চোখে ধোঁয়া দেখছি আমি। এইবার প্রাণ খুলে একটা কিক করব আমি! মোক্ষম কিক! জয় মা কালী
প্রাণপণে কিক করলুম। গো—ও-ওল—গো-ও-ও-ল। চিৎকারে আকাশ ফাটার উপক্রম। প্রথমটা কিছুই বুঝতে পারলুম না। এত জোরে কি শট মেরেছি যে আমাদের গোললাইন থেকেই ওদের গোলকিপারকে ঘায়েল করে দিয়েছি?
কিন্তু সত্য-দর্শন হল কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই। গোবরা হাঁ করে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে। আমাদের গোলের নেটের ভেতরেই বলটা স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে। যেন আমার কীর্তি দেখে বলটাও হতভম্ব হয়ে গেছে।
তারপর?
তারপর খেলার মাঠ থেকে এক মাইল দূরের এই কচুবনে কানাই হয়ে বসে আছি। দুর থেকে এখনও ভ্যাগাবণ্ড ক্লাবের চিৎকার আসছে : থ্রি চিয়ার্স ফর প্যালারাম-হিপ হিপ হুরে!
খট্টাঙ্গ ও পলান্ন
ওপরের নামটা যে একটু বিদঘুটে তাতে আর সন্দেহ কী! খট্টাঙ্গ শুনলেই দস্তুরমতো খটকা লাগে, আর পলান্ন মানে জিজ্ঞেস করলেই বিপন্ন হয়ে ওঠা স্বাভাবিক নয়।
অবশ্য যারা গোমড়ামুখো ভালো ছেলে, পটাপট পরীক্ষায় পাশ করে যায়, তারা হয়তো চট করে বলে বসবে, ইঃ—এর আর শক্তটা কী! খট্টাঙ্গ মানে হচ্ছে খাট আর পলান্ন মানে হচ্ছে। পোলাও। এ না জানে কে!
অনেকেই যে জানে না তার প্রমাণ আমি আর আমার মতো সেই সব ছাত্র, যারা কমসে কম তিন-তিনবার ম্যাট্রিকে ঘায়েল হয়ে ফিরে এসেছে। কিন্তু ওই শক্ত কথা দুটোর মানে আমাকে জানতে হয়েছিল, আমাদের পটলডাঙার টেনিদার পাল্লায় পড়ে। সে এক রোমাঞ্চকর কাহিনী।
আচ্ছা গল্পটা তা হলে বলি।
খাটের সঙ্গে পোলাওয়ের সম্পর্ক কী? কিছুই না। টেনিদা খাট কিনল আর আমি পোলাও খেলাম। আহা সে কী পোলাও! এই যুদ্ধের বাজারে তোমরা যারা র্যাশনের চাল খাচ্ছ আর কড়মড় করে কাঁকর চিবুচ্ছ, তারা সে-পোলাওয়ের কল্পনাও করতে পারবে না। জয়নগরের খাসা গোপালভোগ চাল, পেস্তা, বাদাম, কিশমিশ–
কিন্তু বর্ণনা এই পর্যন্ত থাক। তোমরা দৃষ্টি দিলে অমন রাজভোগ আমার পেটে সইবে। তার চাইতে গল্পটাই বলা যাক।
টেনিদাকে তোমরা চেনো না। ছহাত লম্বা, খাড়া নাক, চওড়া চোয়াল। বেশ দশাসই জোয়ান, হঠাৎ দেখলে মনে হয় ভদ্রলোকের গালে একটা গালপাট্টা থাকলে আরও বেশি মানাত। জাঁদরেল খেলোয়াড়—গড়ের মাঠে তিন-তিনটে গোরার হাঁটু ভেঙে দিয়ে রেকর্ড করেছেন। গলার আওয়াজ শুনলে মনে হয় ষাঁড় ডাকছে।
এমন একটা ভয়ানক লোক যে আরও ভয়ানক বদরাগী হবে, এ তো জানা কথা।
আমি প্যালারাম বাঁড়ুজ্যে–বছরে ছমাস ম্যালেরিয়ায় ভুগি আর বাটি বাটি সাবু খাই। দুপা দৌড়াতে গেলে পেটের পিলে খটখট করে। সুতরাং টেনিদাকে দস্তুরমতো ভয় করে চলি শতহস্ত দূরে তো রাখিই। ওই বোম্বাই হাতের একখানা জুতসই চাঁটি পেলেই তো খাটিয়া চড়ে নিমতলায় যাত্রা করতে হবে।
কিন্তু অদৃষ্টের লিখন খণ্ডাবে কে?
সবে দ্বারিকের দোকান থেকে গোটা কয়েক লেডিকেনি খেয়ে রাস্তায় নেমেছি হঠাৎ পেছন থেকে বাজখাঁই গলা : ওরে প্যালা!
সে কী গলা! আমার পিলে-টিলে একসঙ্গে আঁতকে উঠল। পেটের ভেতরে লেডিকেনিগুলো তালগোল পাকিয়ে গেল একসঙ্গে। তাকিয়ে দেখি—আর কে? মূর্তিমান স্বয়ং।
—কী করছিস এখানে?
সত্যি কথা বলতে সাহস হল না বললেই খেতে চাইবে। আর যদি খাওয়াতে চাই তা হলে ওই রাক্ষুসে পেট কি আমার পাঁচ-পাঁচটা টাকা না খসিয়েই ছেড়ে দেবে! আর খাওয়াতে চাইলে—ওরে বাবা!
কাঁচুমাচু করে বলে ফেলোম, এই কেত্তন শুনছিলাম।
—কেত্তন শুনছিলে? ইয়ার্কি পেয়েছ? এই বেলা তিনটের সময় শেয়ালদার মোড়ে দাঁড়িয়ে কী কেত্তন শুনছিলে? আমি দেখিনি চাঁদ, এক্ষুনি দ্বারিকের দোকান থেকে মুখ চাটতে চাটতে বেরিয়ে এলে?
এই সর্বনাশ–ধরে ফেলেছে তো। গেছি এবারে। দুগানাম জপতে শুরু করে দিয়েছি ততক্ষণে, কিন্তু কার মুখ দেখে বেরিয়েছিলাম কে জানে, ফাঁড়াটা কেটে গেল! না চটে টেনিদা গোটা ত্রিশেক দাঁতের ঝলক দেখিয়ে দিলে আমাকে। মানে, হাসল।
–ভয় নেই—আমাকে খাওয়াতে হবে না। শ্যামলালের ঘাড় ভেঙে দেলখোসে আজ বেশ মেরে দিয়েছি। পেটে আর জায়গা নেই।
আহা বেচারা শ্যামলাল! আমার সহানুভূতি হল। কিন্তু আমাকে বাঁচিয়েছে আজকে। দধীচির মতো আত্মদান করে আমার প্রাণ, মানে, পকেট বাঁচিয়েছে।
টেনিদা বললে, এখন আমার সঙ্গে চল দেখি!
সভয়ে বললাম, কোথায়?
—চোরাবাজারে। খাট কিনব একখানা—শুনেছি শস্তায় পাওয়া যায়।
–কিন্তু আমার যে কাজ—
—রেখে দে তোর কাজ। আমার খাট কেনা হচ্ছে না, তোর আবার কাজ কিসের রে? ভারি যে কাজের লোক হয়ে উঠেছিস—অ্যাাঁ?–কথাটার সঙ্গে সঙ্গে ছোটখাটো একটি রদ্দা আমার পিঠে এসে পড়ল।
বাঃ–কী চমৎকার যুক্তি! টেনিদার খাট কেনা না হলে আমার কোনও আর কাজ থাকতে নেই। কিন্তু প্রতিবাদ করবে কে? সূচনাতেই যে রদ্দা পিঠে পড়েছে, তাতেই হাড়-পাঁজরাগুলো ঝনঝন করে উঠেছে আমার। আর একটি কথা বললেই সজ্ঞানে গঙ্গাপ্রাপ্তি অসম্ভব নয়।
–চল চল।
না চলে উপায় কী। প্রাণের চেয়ে দামি জিনিস সংসারে আর কী আছে?
চলতে চলতে টেনিদা বললে, তোকে একদিন পোলাও খাওয়াতে হবে। আমাদের জয়নগরের খাসা গোপালভোগ চাল—একবার খেলে জীবনে আর ভুলতে পারবি না।
কথাটা আজ পাঁচ বছর ধরে শুনে আসছি। কাজ আদায় করে নেবার মতলব থাকলেই টেনিদা প্রতিশ্রুতি দেয়, আমাকে গোপালভোগ চালের পোলাও খাওয়াবে। কিন্তু কাজটা মিটে গেলেই কথাটা আর টেনিদার মনে থাকে না। গোপালভোগ চালের পোলাও এ-পর্যন্ত স্বপ্নেই দেখে আসছি বসনায় তার রস পাবার সুযোগ ঘটল না।
বললাম, সে তো আজ পাঁচশো বার খাওয়ালে টেনিদা!
টেনিদা লজ্জা পেলে বোধহয়। বললে, না, না—এবারে দেখিস। মুশকিল কী জানিস-কয়লা পাওয়া যায় না—এ পাওয়া যায় না—সে পাওয়া যায় না।
পোলাও রাঁধতে কয়লা পাওয়া যায় না! গোপালভোগ চাল কী ব্যাপার জানি না, তা সেদ্ধ করতে কমন কয়লা লাগে তাও জানি না। কিন্তু কয়লার অভাবে পোলাও রান্না বন্ধ আছে। এমন কথা কে কবে শুনেছে? আমাদের বাসাতেও তো পোলাও মাঝে মাঝে হয়, কই র্যাশনের কয়লার জন্য তাতে তো অসুবিধে হয় না! হাইকোর্ট দেখানো আর কাকে বলে! ওর চাইতে সোজা বলে দাও না বাপু-খাওয়াব না। এমনভাবে মিথ্যে মিথ্যে আশা দিয়ে রাখবার দরকার কী?
টেনিদা বললে, ভালো একটা খাট যদি কিনে দিতে পারিস তা হলে তোর কপালে পলান্ন নাচছে, এ বলে দিলাম।
—পলান্ন!
-হ্যাঁ—মানে পোলাও! তোদের বুকড়ি চালের পোলাওকে কি আর পলান্ন বলে নাকি। হয় গোপালভোগ চাল, তবে না!
হায় গোপালভোগ! আমি নিঃশ্বাস ছাড়লাম।
তারপরে খাট কেনার পর্ব।
টেনিদা বললে, এমন একটা খাট চাই যা দেখে পাড়ার লোক স্তম্ভিত হয়ে যাবে! বলবে, হ্যাঁ—একটা জিনিস বটে! বাংলা নড়বড়ে খাট নয়—একেবারে খাঁটি সংস্কৃত খট্টাঙ্গ। শুনলেই অঙ্গপ্রত্যঙ্গ চমকে উঠবে!
কিন্তু এমন একটা খট্টাঙ্গ কিনতে গিয়েই বিপত্তি!
একেবারে বাঁশবনে ডোমকানা। গায়ে গায়ে অজস্র ফার্নিচারের দোকান। টেবিল, চেয়ার, সোফা, আলনা, আয়না, পালঙ্কের একেবারে সমারোহ। কোন দোকানে যাই?
চারদিক থেকে সে কী সংবর্ধনার ঘটা! যেন এরা এতক্ষণ ধরে আমাদেরই প্রতীক্ষায় দস্তুরমতো তীর্থের কাকের মতো হাঁ করে বসে ছিল।
—এই যে স্যার—আসুন—আসুন—
–কী লইবেন স্যার, লইবেন কী? আয়েন, আয়েন, একবার দেইখ্যাই যান—
—একবার দেখুন না স্যার—যা চান, চেয়ার, টেবিল, সোফা, খাট, বাক্স, ডেক্সো, টিপয়, আলনা, আয়না, র্যাক, ওয়েস্ট-পেপার বাসকেট, লেটার বক্স–
লোকটা যেভাবে মুখে ফেনা তুলে বলে যাচ্ছিল, মনে হচ্ছিল একেবারে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল পর্যন্ত বলে তবে থামবে।
টেনিদা বললে, দুত্তোর—এ যে মহা জ্বালাতনে পড়লাম।
উপদেশ দিয়ে বললাম, চটপট যেখানে হয় ঢুকে পড়ো, নইলে এর পরে হাত-পা ধরে টানতে শুরু করে দেবে।
তার বড় বাকিও ছিল না। অতএব দুজনে একেবারে সোজা দমদম বুলেটের মতো সেঁধিয়ে গেলাম—সামনে যে-দোকানটা ছিল, তারই ভেতরে।
–কী চান দাদা, কী চাই?
–একখানা ভালো খাট।
—মানে পালং? দেখুন না, এই তো কত রয়েছে। যেটা পছন্দ হয়! ওরে ন্যাপলা, বাবুদের জন্যে চা আন, সিগারেট নিয়ে আয়–
—মাপ করবেন, চা-সিগারেট দরকার নেই। এক পেয়ালা চা খাওয়ালে খাটের দরে তার পাঁচ গুণ আদায় করে নেবেন তো। আমরা পটলডাঙার ছেলে মশাই, ওসব চালাকি বুঝতে পারি। বাঙাল পাননি–হুঁ!
দোকানদার বোকার মতো তাকিয়ে রইল। তারপর সামলে নিয়ে বললে, না খান তো না খাবেন মশাই ব্যবসার বদনাম করবেন না।
–না করবে না! ভারি ব্যবসা—চোরাবাজার মানেই তো চুরির আখড়া। চা-সিগারেট খাইয়ে আরও ভালো করে পকেট মারবার মতলব!
মিশকালো দোকানদার চটে বেগুনী হয়ে গেল : ইঃ, ভারি আমার ব্রাহ্মণ-ভোজনের বামুন রে! ওঁকে চা না খাওয়ালে আমার আর একাদশীর পারণ হবে না! যান যান মশাই অমন খদ্দের ঢের দেখেছি।
—আমিও তোমার মতো ঢের দোকানদার দেখেছি যাও–যাও—
এই রে-মারামারি বাধায় বুঝি! প্রাণ উড়ে গেল আমার। টেনিদাকে টেনে দোকান থেকে বার করে নিয়ে এলাম।
টেনিদা বাইরে বেরিয়ে বললে, ব্যাটা চোর।
বললাম, নিঃসন্দেহ। কিন্তু এখানে আর দাঁড়িয়ো না, চলো, অন্য দোকান দেখি।
অনেক অভ্যর্থনা এড়িয়ে আর অনেকটা এগিয়ে আর একখানা দোকানে ঢোকা গেল। দোকানদার একগাল হেসে বললে, আসুন—আসুন—পায়ের ধুলো দিয়ে ধন্য করান! এ তো আপনাদেরই দোকান।
—আমাদের দোকান হলে কি আর আপনি এখানে বসে থাকতেন মশাই? কোন কালে বার করে দিতাম, তারপর যা পছন্দ হয় বিনি পয়সায় বাড়িতে নিয়ে যেতাম।
এ-দোকানদারের মেজাজ ভালো—চটল না। একমুখ পান নিয়ে বাধিত হাসি হাসবার চেষ্টা করলে : হেঁঃ—হেঁঃ—হেঁঃ। মশাই রসিক লোক। তা নেবেন কী?
–একখানা ভালো খাট।
—এই দেখুন না। এ-খানা প্লেন, এ-খানাতে কাজ করা। এটা বোম্বাই প্যাটার্ন, এটা লন্ডন প্যাটার্ন, এটা ডি-লুক্স প্যাটার্ন, এটা মানে-না-মানা প্যাটার্ন–
–থামুন, থামুন। থাকি মশাই পটলডাঙা স্ট্রিটে—অত দিল্লি-বোম্বাই কামসকাটকা প্যাটার্ন দিয়ে আমার কী হবে! এই এ-খানার দাম কত?
—ও-খানা? তা ওর দাম খুবই সস্তা। মাত্র সাড়ে তিনশো।
–সা–ড়ে তিনশো?—টেনিদার চোখ কপালে উঠল।
—হ্যাঁ–সাড়ে তিনশো। এক ভদ্দরলোক পাঁচশো টাকা নিয়ে ঝুলোঝুলি পরশু তাঁকে দিইনি।
-কেন দেননি?
–আমার এসব রয়্যাল খাট মশাই-যাকে-তাকে বিক্রি করব? তাতে খাটের অমর্যাদা হয় যে। আপনাকে দেখেই চিনেছি বনিয়াদী লোক। তাই মাত্র সাড়ে তিনশোয় ছেড়ে দিচ্ছি—আপনি খাটের যত্ন-আত্তি করবেন।
আহা-লোকটার কী অন্তদৃষ্টি। ঠিক খদ্দের চিনেছে তো। আমার শ্রদ্ধাবোধ হল। কিন্তু টেনিদা বশীভূত হবার পাত্র নয়।
—যান—যান মশাই, এই খাটের দাম সাড়ে তিনশো টাকা হয় কখনও? চালাকি পেয়েছেন? কী ঘোড়ার ডিম কাঠ আছে এতে?
বলতে বলতেই খাটের পায়া ধরে এক টান—আর সঙ্গে সঙ্গেই মড়মড়মড়াৎ। মানে, খাটের পঞ্চত্ব-প্রাপ্তি।
–হায়—হায়—হায়—
দোকানদার হাহাকার করে উঠল : আমার পাঁচশো টাকা দামের জিনিস মশাই, দিলেন সাবাড় করে? টাকা ফেলুন এখন।
–টাকা। টাকা একেবারে গাছ থেকে পাকা আমের মতো টুপটুপ করে পড়ে, তাই না? খাট তো নয়—দেশলাইয়ের বাক্স, তার আবার দাম!
দোকানদার এগিয়ে এসেছে ততক্ষণে। খপ করে টেনিদার ঘাড় চেপে ধরেছে : টাকা ফেলুন—নইলে পুলিশ ডাকব।
বেচারা দোকানদার—টেনিদাকে চেনে না। সঙ্গে সঙ্গে জুজুৎসুর এক প্যাঁচে তিন হাত দূরে ছিটকে চলে গেল। পড়ল একটা টেবিলের ওপর সেখান থেকে নীচের একরাশ ফুলদানির গায়ে। ঝনঝন করে দু-তিনটে ফুলদানির সঙ্গে সঙ্গে গয়াপ্রাপ্তি হয়ে গেল—খণ্ড-প্রলয় দস্তুরমতো।
দোকানদারের আর্তনাদ—হইহই হট্টগোল। মুহূর্তে টেনিদা পাঁজাকোলা করে তুলে ফেলেছে আমাকে, তারপর বিদ্যুৎবেগে ভিড় ঠেলে বেরিয়ে এসেছে বৌবাজার স্ট্রিটে। আর বেমালুম ঘুষি চালিয়ে ফ্ল্যাট করে ফেলেছে গোটা তিনেক লোককে। তারপরেই তেমনি ব্লিৎক্রি করে সোজা লাফিয়ে উঠে পড়েছে একখানা হাওড়ার ট্রামে। যেন ম্যাজিক।
পিছনের গণ্ডগোল যখন বৌবাজার স্ট্রিটে এসে পৌঁছেছে, ততক্ষণে আমরা ওয়েলিংটন স্ট্রিট পেরিয়ে গেছি।
আমি তখনও নিঃশ্বাস ফেলতে পারছি না। উঃ—একটু হলেই গিয়েছিলাম আর কী। অতগুলো লোক একবার কায়দামতো পাকড়াও করতে পারলেই হয়ে গিয়েছিল, পিটিয়ে একেবারে পরোটা বানিয়ে দিত।
টেনিদা বললে, যত সব জোচ্চোর। দিয়েছি ঠাণ্ডা করে ব্যাটাদের।
আমি আর বলব কী। হাঁ করে কাতলা মাছের মতো দম নিচ্ছি তখনও। বহু ভাগ্যি যে পৈতৃক প্রাণটা রক্ষা পেল আজকে।
ট্রাম চীনেবাজারের মোড়ে আসতেই টেনিদা বললে, নাম—নাম।
—এখানে আবার কী?
—আয় না তুই।…এক ঝটকায় উড়ে পড়েছি ফুটপাথে।
টেনিদা বললে, চীনেদের কাছে সস্তায় ভালো জিনিস মিলতে পারে। আয় দেখি। বাঙালীর হাত থেকে রক্ষা পেয়েছি, আবার চীনেম্যানের পাল্লায়। নাঃ, প্রাণটা নিয়ে আর বাড়ি ফিরতে পারব মনে হচ্ছে না। প্যালারাম বাঁড়ুজ্যে নিতান্তই পটল তুলল আজকে। কার মুখ দেখে বেরিয়েছিলাম হায় হায়!
সভয়ে বললাম, আজ না হয়—
চল চল ঘাড়ে আবার একটি ছোট রদ্দা।
ক্যাঁক করে উঠলাম। বলতে হল, চলো।
চীনেম্যান বললে, কাম কাম, বাবু। হোয়াত্ ওয়ান্ত? (What want?)
টেনিদার ইংরেজী বিদ্যেও চীনেম্যানের মতোই। বললে, কট ওয়ান্ট্।
–কত্? ভেরি নাইস্ কত্। দেয়ার আর মেনি। হুইচ তেক? (Cot? Very nice cot. There are many. Which take?)
—দি।…একটা দেখিয়ে দিয়ে টেনিদা বললে, কত দাম?
—তু হান্দ্রে লুপিজ (Two hundred rupees)।
—অ্যাঁ—দুশো টাকা! ব্যাটা বলে কী! পাগল না: পেট খারাপ? কী বলিস্ প্যালা এর দাম দুশো হয় কখনও?
চুপ করে থাকাই ভালো। যা দেখছি তা আশাপ্রদ নয়। পুরনো খাট রং-চং করে একটু চেহারা ফিরাবার চেষ্টা হয়েছে। খাট দেখে একটুও পছন্দ হল না। কিন্তু টেনিদা যখন পছন্দ করেছে, তখন প্রতিবাদ করে মার খাই আর কি! না হয় ম্যালেরিয়াতেই ভুগছি, তাই বলে কি এতই বোকা?
বললাম, হুঁ, বড্ড বেশি বলছে।
টেনিদা বললে, সব ব্যাটা চোর। ওয়েল মিস্টার চীনেম্যান, পনেরো টাকায় দেবে?
—হো-হোয়াত? ফিতিন লুপিজ? দোস্ত জোক বাবু। গিভ এইতি লুপিজ। (What? Fifteen rupees? Dont joke, Babu! Give eighty rupees.)
–নাও–নাও চাঁদ—আর পাঁচ টাকা দিচ্ছি–
—দেন গিভ ফিপতি—
শেষ পর্যন্ত পঁচিশ টাকায় রফা হল।
খাট কিনে মহা উল্লাসে টেনিদা কুলির মাথায় চাপালে। আমাকে বললে, প্যালা, এবারে তুই বাড়ি যা—
পোলাও খাওয়ানোর কথাটা জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হল কিন্তু লাভ কী। দোকানদার ঠেঙিয়ে সেই থেকে অগ্নিমূর্তি হয়ে আছে—পোলাওয়ের কথা বলে বিপদে পড়ব নাকি। মানে মানে বাড়ি পালানোই প্রশস্ত!
কিন্তু পোলাও ভোজন কপালে আছেই—ঠেকাবে কে?
পরের গল্পটুকু সংক্ষেপেই বলি। রাত্রে বাড়ি ফিরে খাটে শুয়েই টেনিদার লাফ। লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি ছারপোকা কাঁকড়াবিছে, পিশু কী নেই সেই চৈনিক খাটে? শোবার সঙ্গে সঙ্গেই জ্বালাময়ী অনুভূতি।
খানিকক্ষণ জ্বলন্ত চোখে টেনিদা তাকিয়ে রইল খাটের দিকে। বটে, চালাকি। তিনটে গোরা আর চোরাবাজারের দোকানদার ঠ্যাঙানো রক্ত নেচে উঠেছে মগজের মধ্যে। তারপরেই একলাফে উঠনে অবতরণ, কুড়ল আনয়ন–এবং–
অতগুলো বাড়তি কাঠ দিয়ে আর কী হবে। দিন কয়েক কয়লার অভাব তো মিটল। আর ঘরে আছে গোপালভোগ চাল—অতএব–
অতএব পোলাও।
খট্টাঙ্গের জয় হোক। আহা-হা কী পোলাও খেলাম! পোলাও নয়—পলান্ন। তার বর্ণনা আর করব না, পাছে দৃষ্টি দাও তোমরা।
দধীচি, পোকা ও বিশ্বকর্মা
আপাতত গভীর অরণ্যে ধ্যানে বসে আছি। বেশ মন দিয়েই ধ্যান করছি। শুধু কতকগুলো পোকা উড়ে উড়ে ক্রমাগত নাকে মুখে এসে পড়ছে আর এমন বিশ্রী লাগছে যে কী বলব! নাকে ঢুকে সুড়সুড়ি দিচ্ছে, কানের ভেতর ঢুকে ওই গভীর গহুরটার ভেতরে কোনও জটিল রহস্য আছে কিনা সেটাও বোঝবার চেষ্টা করছে। একবার ঢোক গিলতে গিয়ে ডজনখানিক খেয়েও ফেলেছি। খেতে বেশ মৌরি মৌরি লাগল—কিন্তু যা বিকট গন্ধ! বমি করতে পারতাম, কিন্তু ধ্যান করতে বসলে তো আর বমি করা যায় না। তাড়াব—সে-উপায়ও নেই, কারণ এখন আমি সমাধিস্থ—একেবারে নিবাত-নিষ্কম্প হয়েই থাকতে হবে আমাকে।
আমি গোড়াতেই বুঝেছিলাম এরকম হবে। হাবুলকেও বলেছিলাম কথাটা। কিন্তু সে তখন ইন্দ্ৰত্ব লাভ করে কৈলাসে শিবের কাছে যাওয়ার কথা ভাবছে, আমলই দিলে না। বললে, যাঃ যাঃ, এসব ওসব ফ্যাচফ্যাঁচ করিসনি। অরণ্যে পোকা থাকেই এবং নাকে মুখেও তারা পড়ে। চুপচাপ বরদাস্ত করে যানইলে মহর্ষি হবি কেমন করে?
তা বটে। তবে একটা জিনিস বুঝেছি মহর্ষিদের মেজাজ অমন ভীমরুলের চাকের মতো কেন, আর কথায় কথায়ই তাঁরা অমন তেড়ে ব্রহ্মশাপ ঝাড়েন কেন! আরে বাপু, ধৈর্যের একটা সীমা তো আছে মানুষের। নাকে মুখে অমন পোকার উপদ্রব হলে শান্তনুর মতো শান্ত মানুষও যে দুর্বাসা হতে বাধ্য, এ ব্যাপারে আমার আর তিলমাত্রও সন্দেহ নেই।
আচ্ছা জ্বালাতনেই পড়া গেল বাস্তবিক। সত্যি বলছি, আমি প্যালারাম বাঁড়ুজ্যে, পালাজ্বরে ভুগি আর বাসকপাতার রস খাই, আমার কী দায়টা পড়েছে মহর্ষি-টহর্ষির মতো গোলমেলে ব্যাপারে পা বাড়িয়ে? পটলডাঙার গলিতে থাকি, পটোল দিয়ে শিংমাছের ঝোল আর আতপ চালের ভাত আমার বরাদ্দ, একমুঠো চানাচুর খেয়েছি কি পেটের গোলমালে আমার পটল তুলবার, জো! এ-হেন আমি—একেবারে গোরুর মতো বেচারা লোক, আমিই শেষে পড়ে গেলাম ছহাত লম্বা আর বিয়াল্লিশ ইঞ্চি বুক-ওলা টেনিদার পাল্লায়।
আর টেনিদার পাল্লায় পড়া মানে যে কী, যারা পড়োনিউহু, ভাবতেই পারবে না। গড়ের মাঠের গোরা থেকে চোরাবাজারের চালিয়াত দোকানদার পর্যন্ত ঠেঙিয়ে একেবারে রপ্ত। হাত তুললেই মনে হবে রদ্দা মারলে, দাঁত বার করলেই বোধ হবে কামড়ে দিলে বোধ হয়। এই ভৈরব ভয়ঙ্কর লোকের খপ্পরে পড়েই আমাকে এখন মহর্ষি হয়ে ধ্যান করতে হচ্ছে।
কী আর করি! বসে আছি তো বসেই আছি। অরণ্যের ভেতরে একটা ফুটো—সেখান দিয়ে দেখছি হতভাগ্য হাবুলের নাক বেরিয়ে আছে। পোকার কামড়ে জেরবার হয়ে ভাবছি। ওই নাকেই একটা ধাঁ করে ঘুষি বসাব কিনা, এমন সময় শিষ্য দধিমুখের প্রবেশ।
দধিমুখ বললে, প্রভু আছে নিবেদন।
বললাম, কহ বৎস, শুনিব নিশ্চয়।
দধিমুখ বললে, কালি নিশিশেষে
দেখিলাম আশ্চর্য স্বপন।
দেখিলাম প্রভু যেন দেবদেহ ধরি
আরোহিয়া অগ্নিময় রথে,
চলেছেন মহাব্যোমে ছায়াপথ করি বিদারণ!
সত্ৰাসে কহিনু কাঁদি–
ওয়াকওয়াক্ থুঃ।
আর কী, পোকা! থু থু করে দধিমুখ সেটা আমার গায়েই ঝেড়ে দিলে, শিষ্যের আস্পর্ধাখানা দ্যাখো একবার। রাগে আমার শরীর জ্বলে গেল,—টিকি খাড়া হয়ে উঠল ব্রহ্মতেজে। কিন্তু শিষ্যকে শাপ দিলেই তো সব মাটি। মনে মনে ভাবলাম, দাঁড়াও চাঁদ, তোমাকেও শায়েস্তা করতে হচ্ছে।
হেসে বললাম, আছে, আছে রহস্য অদ্ভুত।
নিরেট মগজ তব সহজে তো বুঝিবে না সেটা,
কাছে এসো কহি কানে কানে।
দধিমুখ হাঁ করে তাকিয়ে রইল। আমার মুখ থেকে যা আশা করছিল তা শুনতে পায়নি কী যে করবে ঠিক বুঝতে পারছে না। দধিমুখ অসহায়ভাবে একবার চারদিকে তাকাল।
আমি বললাম, দাঁড়াইয়া কেন?
কাছে এসো, মুখ আনো কানের নিকটে,
তবে তো জানিবে সেই অদ্ভুত বারতা।
এসো বৎস–
বালক, আরও কাছে আয়–কাছে আয় না—
দধিমুখের বয়স অল্প—একেবারে আনাড়ি। ইতস্তত করে, যেই আমার কানের কাছে মুখ আনা, অমনি আমি পালটা জবাব দিলাম। মস্ত একটা হাঁ করলাম, সঙ্গে সঙ্গেই এক ঝাঁক পোকা পড়ল মুখের ভেতর। আর পত্রপাঠ সেগুলো থুথু শব্দে ফেরত গেল দধিমুখের গালে, নাকে, মুখে, কপালে। শিষ্যকে গুরুর স্নেহাশিস!
দধিমুখ অ্যাঁ-অ্যাঁ করে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে ঝড়াং করে ড্রপ সিন। খট করে বাঁশটা আমার নাকে পড়ল, তারপর সোজা নীচে। সিন শেষ হওয়ার আগেই দ্বিতীয় অঙ্ক সমাপ্ত।
তক্ষুনি স্টেজের ভেতর ছুটে এল ইন্দ্রবেশী হাবুল আর বিশ্বকর্মবেশী টেনিদা। টেনিদা বললে, এটা কী হল—অ্যাাঁ? এর মানেটা কী, শুনি?
আমি বিদ্রোহ করে বললাম, কিসের মানে?
টেনিদা দাঁত খিচিয়ে উঠল : প্লে-টা তুই মাটি করবি হতভাগা? কেন ওভাবে থুতু দিলি ক্যাবলার মুখে? একদম বরবাদ হয়ে গেল সিনটা। কী রকম হাসছে অডিয়ান্স—তা দেখছিস?
আমি বললাম, ক্যাবলাই তো থুতু দিয়েছে আগে।
টেনিদা বললে, হুম। দুটোর মাথাই একসঙ্গে ঠুকে দেব এক জোড়া বেলের মতো। যাক যা হয়ে গেছে সে তো গেছেই। এখন পরের সিনগুলোকে ভালো করে ম্যানেজ করা চাই–বুঝলি? যদি একটু বেয়াড়াপনা করিস তো একটা চাঁটির চোটে নাক একেবারে নাসিকে পাঠিয়ে দেব।
আমি বললাম, তুমি তো বলেই খালাস। কিন্তু স্টেজে হাঁ করে বসে ওই পোকা হজম করবে কে, সেটা শুনি?
টেনিদা হুঙ্কার করল, তুই করবি। আলবাত তোকেই করতে হবে। থিয়েটার করতে পারবি আর পোকা খেতে পারবি না? দরকার হলে মশা খেতে হবে, মাছি খেতে হবে–
হাবুল যোগ দিয়ে বললে, ইঁদুর খেতে হবে, বাদুড় খেতে হবে–
টেনিদা বললে, মাদুর খেতে হবে, এমন কি খাট-পালং খাওয়াও আশ্চর্য নয়। হুঁ হুঁ বাবা, এর নাম থিয়েটার।
–থিয়েটার করতে গেলে ওসব খেতে হয় নাকি?—আমি ক্ষীণ প্রতিবাদ জানালাম।
—হয় হয়। তুই এ-সবের কী বুঝিস র্যা—অ্যাাঁ? দানীবাবুর নাম শুনেছিস, দানীবাবু? তিনি যখন সীতার ভূমিকায় প্লে করতেন, তখন মনুমেন্ট খেয়ে নামতেন, সেটা জানিস?
—মনুমেন্ট খেয়ে!
—হ্যাঁ হ্যাঁ—মনুমেন্ট খেয়ে। যাঃ—যাঃ ক্যাঁচম্যাচ করিসনি। এক্ষুনি সিন উঠবে—কেটে পড়—নিজের পার্ট মুখস্থ করগে।
বেগুন-খেতে কাক-তাড়ানো কেলে হাঁড়ির মতো মুখ করে আমি স্টেজের একধারে এসে বসলাম। মনুমেন্ট খাওয়া! চালিয়াতির আর জায়গা পাওনি-মানুষে কখনও মনুমেন্ট খেতে পারে। কিন্তু প্রতিবাদ করলেই চাঁটি, তাই অমন বোম্বাই চালখানাও হজম করে গেছি।
থিয়েটার করতে এলেই পোকা খেতে হবে! কেন রে বাপু, তোমাদের সঙ্গে থিয়েটার না করতে পারলে তো আমার আর শিঙিমাছের ঝোল হজম হচ্ছিল না কিনা! আমি প্যালারাম বাঁড়ুজ্যে, আমার পেটজোড়া পিলে—দায় পড়েছিল আমার একমুখ কুটকুটে দাড়ি নিয়ে দধীচি সাজতে! যত সব জোচ্চোরের পাল্লায় পড়ে পড়ে এখন আমার এই হাঁড়ির হাল।
দিব্যি বসেছিলাম চাটুজ্যেদের রোয়াকে—ওরা উঠনে হাত-পা নেড়ে রিহার্সেল দিচ্ছিল। কিন্তু দধীচি সাজবার ছেলে পাওয়া যাচ্ছিল না। টেনিদা তার ভাঁটার মতো চোখ পাকিয়ে এদিক ওদিক তাকাতে তাকাতে এসে খপ করে আমার কাঁধটা ধরে ফেলল : অ্যাই পাওয়া গেছে।
আমি বললাম, অ্যাঁ-অ্যাঁ—
টেনিদা বাঘাটে গলায় বললে, অ্যাঁ-অ্যাঁ নয়, হ্যাঁ হ্যাঁ। দিব্যি মুনি-ঋষির মতো চেহারা তোর, বেশ অহিংস ছাগল ছাগল ভাব। গালে ছাগলের মতো দাড়ি লাগিয়ে দেব,যা মানাবে, আঃ! দেখাবে একেবারে রায়বাড়ির কেশোবুড়োটার মতো।
আপাতত এই তার পরিণতি।
এ-অঙ্কে আমার পার্ট নেই, তাই স্টেজের অন্ধকার একটা কোনায় ঝিম মেরে বসে আছি। দাড়িটা হাতে খুলে নিয়েছি, আর মশা তাড়াচ্ছি প্রাণপণে। নাঃ—এ অসম্ভব। আবার স্টেজে গেলেই ধ্যানে বসতে হবে এবং ধ্যানে বসা মানেই পোকা। আর কী মারাত্মক সে পোকা।
কী করা যায়?
রাগে হাড়-পিত্তি জ্বলছে। দয়া করে পার্ট করছি এই ঢের, তার ওপর আবার অপমান। এমন করে শাসানো। চাঁটি হাঁকড়ে নাক নাসিকে উড়িয়ে দেবে। ইস, শখখানা দ্যাখো একবার। না হয় তোমার আছেই পিরামিডের মতো উঁচু একটা অতিকায় নাক, আর আমার নাকটা না হয় চীনেম্যানদের মতো থ্যাবড়া, তাই বলে নাক নিয়ে অপমান। আচ্ছা, দাঁড়াও, দাঁড়াও। এই খাঁদা নাককেই–মৈনাকের মতো উঁচু করে তোমার ভরাড়ুবি করে ছাড়ব।
কিন্তু কী করা যায় বাস্তবিক?
ভেবে কূল-কিনারা পাচ্ছি না, ও-দিকে স্টেজে তখন দারুণ বক্তৃতা দিচ্ছে টেনিদা। এমন এক-একটা লাফ মারছে যে চাটুজ্যেদের ছারপোকা-ভরা পুরনো তক্তপোশটা একেবারে মড়মড় করে উঠছে। থিয়েটার করছে না হাই-জাম্প দিচ্ছে বোঝা মুস্কিল।
স্টেজ-ম্যানেজার হাবুল পাশ দিয়ে যাচ্ছিল। বললে, এই প্যালা, অমন ভূতের মতো অন্ধকারে বসে আছিস যে?
বললাম, একটু চা খাওয়া না ভাই হাবুল, গলাটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে।
হাবুল নাকটা কুঁচকে বললে, নেঃ নেঃ, অত চা খায় না। যা পার্ট করছিস, আবার চা!
অ্যাডিং ইনসাল্ট টু ইনজুরিঅ্যাঁ। আমি অন্ধকারে দাঁত বের করে হাবুলকে ভেংচে দিলাম, হাবুল দেখতে পেলে না।
চম্পট দেব নাকি দাড়িকাড়ি নিয়ে? সোজা চলে যাব বাড়িতে? দধীচির সিনে যখন দেখবে আমি বেমালুম হাওয়া—তখন টের পাবে মজাটা কাকে বলে। উহু—তাতে সুবিধে হবে না। তারপর কাল সকালে আমায় বাঁচায় কে? পটলডাঙার বিখ্যাত টেনিদার বিখ্যাত চাঁটিতে স্রেট পটল তুলে বসতে হবে।
না-না, ওসব নয়। সাপও মরবে, লাঠিও ভাঙবে না। এমন জব্দ করে দেব যে কিল খেয়ে কিলটি সোনামুখ করে গিলে নিতে হবে। টেনিদার বত্রিশ পাটি দাঁতের সঙ্গে আর একটি দাঁত গজিয়ে দেব—যার নাম আক্কেল দাঁত। আর সেই সঙ্গে টেনিদার ধামাধরা ওই স্টেজ-ম্যানেজার শ্রীমান হাবুল সেনকেও টেরটি পাইয়ে দিতে হচ্ছে।
ভগবানকে ডেকে বললাম, প্রভু, আলো দাও—এ অন্ধকারে পথ দেখাও! এবং প্রভু আলো দিলেন।
হাবুলকে বললাম, ভাই, পাঁচ মিনিটের জন্যে একটু বাড়ি থেকে আসছি।
হাবুল আঁতকে বললে, কেন?
—এই পেটটা একটু কেমন কেমন—
হাবুল বললে, সেরেছে। যত সব পেটরোগা নিয়ে কারবার—শেষটায় ডোবাবে বোধ হচ্ছে। একটু পরেই যে তোর পার্ট রে।
আমি বললাম, না, না, এক্ষুনি আসছি।
মনে মনে বললাম, পেট কার কেমন একটু পরেই দেখা যাবে এখন। মনুমেন্ট খাইয়ে পার্ট করাতে চাও—দেখি আরও কত গুরুপাক জিনিস হজম করতে পারো।
ঠিক পাঁচ মিনিটের মধ্যেই আমি ফিরলাম। ডাক্তার ছোটকাকার ওষুধের আলমারিটা হাতড়াতে বেশি সময় লাগেনি—একেবারে মোক্ষম ওষুধটি নিয়ে এসেছি। হিসেব করে দেখেছি আমার পার্ট আসতে আরও প্রায় ঘণ্টাখানেক দেরি—এর মধ্যেই কাজ হয়ে যাবে।
চায়ের বড় কেটলিটা যেখানে উনানের ওপর ফুটছে, সেখানে গেলাম। তখন কেটলির দিকে কারও মন নেই, সবাই উইংসে ঝুঁকে পড়ে প্লে দেখছে। টেনিদা লাফাচ্ছে ভীমসেনের মতো—আর সে কী ঘন ঘন ক্ল্যাপ। দাঁড়াও দাঁড়াওকত ক্ল্যাপ চাও দেখব।
পিরামিডের মতো নাক উঁচু করে বিজয়-গৌরবে ফিরে এল টেনিদা। একগাল হাসি ছড়িয়ে বললে, কেমন পার্ট হল রে হাবুল?
হাবুল কৃতার্থভাবে বললে, চমৎকার, চমৎকার। তুমি ছাড়া এমন পার্ট আর কে করতে পারত? অডিয়ান্স বলছে, শাবাশ, শাবাশ!
অডিয়ান্স কেন শাবাশ শাবাশ বলছে আমি জানি। তারা বুঝতেই পারেনি যে ওটা ভীমের না বিশ্বকর্মার পার্ট। কিন্তু আসল পার্ট করতে আর একটুখানি দেরি আছে—আমি মনে মনে বললাম।
স্টেজ কাঁপিয়ে টেনিদা হুঙ্কার ছাড়লে, চা—ওরে চা আন—
হাবুল উৰ্বশ্বাসে ছুটল।
আবার ড্রপ উঠেছে। দধীচির ভূমিকায় আমি ধ্যানস্থ হয়ে বসে পোকা খাচ্ছি। শিষ্য দধিমুখ এবার দূরে দাঁড়িয়ে আছে—আগের অভিজ্ঞতাটা ভোলেনি।
বিশ্বকর্মা আর ইন্দ্রের প্রবেশ। টেনিদা আর হাবুল।
হাবুল বললে, প্রভু, গুরুদেব,
আসিয়াছি শিবের আদেশে।
তব অস্থি দিয়া।
যেই বজ্র হইবে নির্মাণ—
টেনিদা বললে,
দেখাইব বিশ্বকর্মা যশ।
হেন অস্ত্র তুলিব গড়িয়া,
ঘোরনাদে কাঁপাইবে সসাগরা ব্রহ্মাণ্ড বিশাল
দীপ্ততেজে দগ্ধ হবে স্থাবর-জঙ্গম,–
তারপরেই স্বগতোক্তি করলে, উঃ, জোর কামড় মেরেছে পেটে মাইরি!
হাবুল চাপা গলায় বললে, আমারও পেটটা যেন কেমন গোলাচ্ছে রে!
আড়চোখে আমি একবার তাকিয়ে দেখলাম মাত্র। মনুমেন্ট খেয়ে হজম করতে পারো, দেখিই না হজমের জোর কত! আমি বললাম, তিষ্ঠ, তিষ্ঠ—
আগে করি ইষ্ট নাম ধ্যান–
ধ্যান ভঙ্গ যতক্ষণ নাহি হয়,
চুপচাপ থাকো ততক্ষণ।
তারপরে তনুত্যাগ করিব নিশ্চয়।
আমি ধ্যানে বসলাম। সহজে এধ্যান ভাঙছে না। পোকার উপদ্রব লেগেই আছে—তা থাক। আমি কষ্ট না করলে টেনিদা আর হাবুলের কেষ্ট মিলবে না। গরম চায়ের সঙ্গে কড়া পার্গেটিভ—এখনই কী হয়েছে!
টেনিদা মুখ বাঁকা করলে, শিগগির ধ্যান শেষ কর মাইরি। জোর পেট কামড়াচ্ছে রে!
আমি বললাম, চুপ। ধ্যান ভঙ্গ করিয়ো না
ব্ৰহ্মশাপ লাগিবে তা হলে—
ধ্যান কি সত্যি সত্যিই করছি নাকি! আরে ধ্যাৎ! আমি আড়চোখে দেখছি টেনিদার মুখ ফ্যাকাশে মেরে গেছে। হাবুলের অবস্থাও তথৈবচ। ভগবান করুণাময়।
টেনিদা কাতরস্বরে বললে, ওরে প্যালা, গেলাম যে। দোহাই তোর, শিগগির ধ্যান শেষ কর—তোর পায়ে পড়ছি প্যালা–
হাবুল বললে, ওরে, আমারও যে প্রাণ যায়–
আমি একেবারে নট-নড়নচড়ন। সামলাও এখন। মুনি-ঋষির ধ্যান-দেহত্যাগের ব্যাপার—এ কী সহজে ভাঙবার জিনিস!
–বাপস গেলাম—এক লক্ষে টেনিদা অদৃশ্য। একেবারে সোজা অন্ধকার আমতলার দিকে। পেছনে পেছনে হাবুল।
আর থিয়েটার?
সে কথা বলে আর কী হবে!
মৎস্যপুরাণ
তুমি যাও বঙ্গে, কপাল যায় সঙ্গে।
বঙ্গে আর যাব কোথায়, বঙ্গেই তো আছি—একেবারে ভেজালহীন খাঁটি বঙ্গসন্তান। আসলে গিয়েছিলাম বঙ্গেশ্বরী মিষ্টান্ন ভাণ্ডারে।
সবে দিন সাতেক ম্যালেরিয়ায় ভুগে উঠেছি। এমনিতেই বরাবর আমার খাইখাইটা একটু বেশি, তার ওপর ম্যালেরিয়া থেকে উঠে খাওয়ার জন্যে প্রাণটা একেবারে ত্রাহি ত্রাহি করে। দিনরাত্তির শুধু মনে হয় আকাশ খাই, পাতাল খাই, খিদেতে আমার পেটের বত্রিশটা নাড়ি একেবারে গোখরো সাপের মতো পাক খাচ্ছে। শুধু তো পেটের খিদে নয়, একটা ধামার মতো পিলেও জুটেছে সেখানে—আস্ত হিমালয় পাহাড়টাকে আহার করেও বোধহয় সেটার আশ মিটবে না।
সুতরাং বঙ্গেশ্বরী মিষ্টান্ন ভাণ্ডারে বসে গোটা তিনেক ইয়া ইয়া রাজভোগকে কায়দা করবার চেষ্টায় আছি।
কিন্তু তুমি যাও বঙ্গে—
হঠাৎ কানের কাছে সিংহনাদ শোনা গেল : এই যে প্যালা, বেড়ে আছিস–অ্যাঁ?
আমার পিলেটা ঘোঁৎ করে নেচে উঠেই কোঁৎ করে বসে পড়ল। রাজভোগটায় বেশ জুতসই একটা কামড় বসিয়েছিলাম, সেটা ঠিক তেমনি করে হাত আর দাঁতের মাঝখানে লেগে রইল ত্রিশঙ্কুর মতো। শুধু খানিকটা রস গড়িয়ে আদ্দির পাঞ্জাবিটাকে ভিজিয়ে দিলে।
চেয়ে দেখি—আর কে? পৃথিবীর প্রচণ্ডতম বিভীষিকা—আমাদের পটলডাঙার টেনিদা। পুরো পাঁচ হাত লম্বা খটে জোয়ান। গড়ের মাঠে গোরা ঠেঙিয়ে এবং খেলায় মোহনবাগান হারলে রেফারি-পিটিয়ে স্বনামধন্য। আমার মুখে অমন সরস রাজভোগটা কুইনাইনের মতো তেতো লাগল।
টেনিদা বললে, এই সেদিন জ্বর থেকে উঠলি নি? এর ভেতরেই আবার ওসব যা তা খাচ্ছিস? এবারে তুই নির্ঘাত মারা পড়বি।
—মারা পড়ব?—আমি সভয়ে বললাম।
—আলবাত! কোনও সন্দেহ নেই।—টেনিদা শব্দসাড়া করে আমার পাশের চেয়ারটায় বসে পড়ল : তবে আমি তোকে বাঁচাবার একটা চেষ্টা করে দেখতে পারি।
এই বলে, বোধহয় আমাকে বাঁচাবার মহৎ উদ্দেশ্যেই নাকি দুটো রাজভোগ তুলে টেনিদা কপ কপ করে মুখে পুরে দিলে। তারপর তেমনি সিংহনাদ করে বললে, আরও চারটে রাজভোগ।
আমার খাওয়া যা হওয়ার সে তো হল, আমারই পকেটের নগদ সাড়ে তিনটি টাকা খসিয়ে এ-যাত্ৰা আমার প্রাণটা বাঁচিয়ে দিলে টেনিদা। মনে মনে চোখের জল ফেলতে ফেলতে বেরুলাম দোকান থেকে। ভাবছি এবার হেদোর কোনা দিয়ে সই করে ডাফ স্ট্রিটের দিকে সটকে পড়ব, কিন্তু টেনিদা ক্যাঁক করে আমার কাঁধটা চেপে ধরল। সে তো ধরা নয়, যেন ধারণ। মনে হল কাঁধের ওপর কেউ একটা দেড়মনী বস্তা ধপাস করে ফেলে দিয়েছে। যন্ত্রণায় শরীরটা কুঁকড়ে গেল।
—অ্যাই প্যালা, পালাচ্ছিস কোথায়? ভয়ে আমার ব্রহ্মতালু অবধি কাঠ। বললাম, না, না, পা-পা পালাচ্ছি না তো!
—তবে যে মানিক দিব্যি কাঠবেড়ালির মতো গুটিগুটি পায়ে বেমালুম হাওয়া হয়ে যাচ্ছিলে? চালাকি না চলিষ্যতি। তোকে আমার সঙ্গে যেতে হবে এখন।
-কোথায়?
–দমদমায়।
আমি অবাক হয়ে বললাম, দমদমায় কেন?
টেনিদা চটে উঠল : তুই একটা গাধা।
আমি বললাম, গাধা হবার মতো কী করলাম?
টেনিদা বাঘা গলায় বললে, আর কী করবি? ধোপার মোট বইবি, ধাপার মাঠে কচি কচি ঘাস খাবি, না প্যাঁ-হোঁ প্যাঁ-হোঁ করে চিৎকার করবি? আজ রবিবার, দমদমায় মাছ ধরতে যাব—এটা কেন বুঝিস নে উজবুক কোথাকার?
—মাছ ধরতে যাবে তো যাও—আমাকে নিয়ে টানাটানি করছ কেন?
–তুই না গেলে আমার বঁড়শিতে টোপ গেঁথে দেবে কে, শুনি? কেঁচো-টেচো বাবা আমি হাত দিয়ে ঘাঁটতে পারব না—সে বলে দিচ্ছি।
–বাঃ, তুমি মাছ মারবে আর কেঁচোর বেলায় আমি?
–নে, রাস্তায় দাঁড়িয়ে এখন আর ফ্যাঁচক্যাঁচ করতে হবে না। চটপট চল শেয়ালদায়। পনেরো মিনিটের ভেতরেই একটা ট্রেন আছে।
আমি দাঁড়িয়ে ইতস্তত করছি, টেনিদা একটা হ্যাঁচকা মারলে। টানের চোটে হাতটা আমার কাঁধ থেকে উপড়েই এল বোধ হল। গেছি গেছি বলে আমি আর্তনাদ করে উঠলাম।
–যাবি কোথায়? আমার সঙ্গে দমদমায় না গেলে তোকে আর কোথাও যেতে দিচ্ছে কে! চল চল। রেডি—ওয়ান, টু–
কিন্তু থ্রি বলবার আগেই আমি যেন হঠাৎ দুটো পাখনা মেলে হাওয়ায় উড়ে গেলাম। মাথা ঝিমঝিম করতে লাগল, কানে শব্দ বাজতে লাগল ভোঁ-ভোঁ। খেয়াল হতে দেখি, টেনিদা একটা সেকেন্ড ক্লাস ট্রামে আমাকে তুলে ফেলেছে।
আমাকে বাজখাঁই গলায় আশ্বাস দিয়ে বললে, যদি মাছ পাই তবে ল্যাজ থেকে কেটে তোকে একটু ভাগ দেব।
কী ছোটলোক! যেন মুড়ো-পেটি আমি আর খেতে জানি না। কিন্তু তর্ক করতে সাহস হল না। একটা চাঁটি হাঁকড়ালেই তো মাটি নিতে হবে, তারপরে খাটিয়া চড়ে খাঁটি নিমতলাযাত্রা! মুখ বুজে বসে রইলাম। মুখ বুজেই শিয়ালদা পৌঁছুলাম। তারপর সেখান থেকে তেমনি মুখ বুজে গিয়ে নামলাম দমদমায় গোরাবাজারে।
রেললাইনের ধার দিয়ে বনগাঁর মুখে খানিকটা এগোতেই একটা পুরনো বাগানবাড়ি। টেনিদা বললে, চল, ওর ভেতরেই মাছ ধরবার বন্দোবস্ত আছে।
আমি তিন পা পিছিয়ে গেলাম। বললাম, খেপেছ? এর ভেতরে মাছ ধরতে যাবে কী রকম। ওটা নির্ঘাত ভুতুড়ে বাড়ি।
টেনিদা হনুমানের মতো দাঁত খিচিয়ে বললে, তোর মুণ্ড! ওটা আমাদের নিজেদের বাগানবাড়ি, ওর ভেতরে ভূত আসবে কোখেকে? আর যদি আসেই তো এক ঘুষিতে ভূতের বত্রিশটা দাঁত উড়িয়ে দোব–হুঁ হুঁ! আয়-আয়—
মনে মনে রামনাম জপতে জপতে আমি টেনিদার পিছনে পিছনে পা বাড়ালাম।
বাগানবাড়িটা বাইরে থেকে যতটা জংলা মনে হচ্ছিল, ভেতরে তা নয়। একটা মস্ত ফুলের বাগান। এখন অবশ্য ফুলটুল বিশেষ কিছু নেই, কিন্তু পাথরের কতকগুলো মূর্তি এদিকে ওদিকে ছড়ানো রয়েছে। কিছু কিছু ফলের গাছ—আম, লিচু, নারকেল—এইসব। মাঝখানে পুরনো ধরনের একখানা ছোট বাড়ি। দেওয়ালের চুন খসে গেছে, ইট ঝরে পড়েছে। এদিকে ওদিকে, তবু বেশ সুন্দর বাড়ি। মস্ত বারান্দা, তাতে খান কয়েক বেতের চেয়ার পাতা।
বারান্দায় উঠেই টেনিদা একখানা বোম্বাই হাঁক ছাড়লে, ওরে জগা—
দূর থেকে সাড়া এল, আসুচি।…তারপরেই দ্রুতবেগে এক উড়ে মালীর প্রবেশ। বললে, দাদাবাবু আসিলা?
টেনিদা বললে, ই আসিলাম। এতক্ষণ কোথায় ছিলি ব্যাটা গোভূত? শিগগির যা, ভালো দেখে গোটা কয়েক ডাব নিয়ে আয়।
—আনুচি—
বলেই জগা বিদ্যুৎবেগে বানরের মতো সামনের নারকেল গাছটায় চড়ে বসল, তারপর মিনিটখানেকের মধ্যেই নেমে এল ডাব নিয়ে। পর পর চারটে ডাব খেয়ে টেনিদা বললে, সব ঠিক আছে জগা?
জগা বললে, হুঁ।
বঁড়শি, টোপ, চার—সব?
জগা বললে, হুঁ।
–চল প্যালা, তাহলে পুকুরঘাটে যাই।
পুকুরঘাটে এলাম। সত্যিই খাসা পুকুরঘাট। শাদা পাথরে খাসা বাঁধানো। পুকুরে অল্প অল্প শ্যাওলা থাকলেও দিব্যি টলটলে জল। ঘাটটার ওপরে নারকেলপাতার ছায়া ঝিরঝিরে বাতাসে কাঁপছে। পাখি ডাকছে এদিকে ওদিকে। মাছ ধরবার পক্ষে চমৎকার জায়গা। ঘাটটার ওপরে দুটো বড় বড় হুইল বঁড়শিবঁড়শি দুটোর চেহারা দেখলে মনে হয় হাঙর কুমির ধরবার মতলব আছে।
টেনিদা আবার বললে, চার করেছিস জগা?
—হুঁ।
—কেঁচো তুলেছিস?
—হুঁ।
—তবে যা তুই, আমাদের জন্যে খিচুড়ির ব্যবস্থা করগে। আয় প্যালা, এবার আমরা কাজে লেগে যাই। নে বঁড়শিতে কেঁচো গাঁথ।
আমি কাঁদো কাঁদো মুখে বললাম, কেঁচো গাঁথব?
টেনিদা হুঙ্কার ছাড়ল : নইলে কি তোর মুখ দেখতে এখানে এনেছি নাকি? ওই তো বাংলা পাঁচের মতো তোর মুখ, ও-মুখে দেখবার মতো কী আছে র্যা? মাইরি প্যালা, এখন বেশি বকাসনি আমাকে–মাথায় খুন চেপে যাবে। ধর, কেঁচো নে।
কী কুক্ষণেই আজ বাড়ি থেকে বাইরে পা বাড়িয়েছিলাম রে। এখন প্রাণটা নিয়ে ঘরের ছেলে মানে মানে ঘরে ফিরতে পারলে হয়। আমার মুখের দিকে তাকিয়ে টেনিদার বোধহয় দয়া হল। বললে, নে নে, মন খারাপ করিসনি। আচ্ছা, আচ্ছা—মাছ পেলে আমি মুছোটা নেব আর সব তোর। ভদ্দর লোকের এক কথা। নে, এখন কেঁচো গাঁথ।
মাছ টেনিদা যা পাবে সে তো জানাই আছে আমার। লাভের মধ্যে আমার খানিক কেঁচো-ঘাঁটাই সার। এরই নাম পোড়া কপাল।
কিন্তু ভদ্দরলোকের এক কথা। সে যে কী সাংঘাতিক কথা সেটা টেনিদা টের পেল একটু পরে।
ছিপ ফেলে দিব্যি বসে আছি।
বসে আছি তো আছিই। জলের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে চোখ ব্যথা করতে লাগল। কিন্তু কা কস্য। জলের ওপর ফাতনাটি একেবারে গড়ের মাঠের মনুমেন্টের মতো খাড়া হয়ে আছে। একেবারে নট নড়ন-চড়ন–কিচ্ছু না।
আমি বললাম, টেনিদা, মাছ কই?
টেনিদা বললে, চুপ, কথা বলিসনি। মাছে ভয় পাবে।
আবার আধঘণ্টা কেটে গেল। বুড়ো আঙুলে কাঁচকলা দেখাবার মতো ফাতনাটি তেমনি মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। জলের অল্প অল্প ঢেউয়ে একটু একটু দুলছে, আর কিছু নেই।
আমি বললাম, ও টেনিদা, মাছ কোথায়?
টেনিদা বিরক্ত হয়ে বললে, থাম না। কেন বকরবকর করছিস র্যা? এসব বাবা দশ-বিশ সেরী কাতলার ব্যাপার—এ কী সহজে আসে? এ তো একেবারে পেল্লায় কাণ্ড। নে, এখন মুখে ইস্কুপ এঁটে বসে থাক।
ফের চুপচাপ। খানিক পরে আমি আবার কী একটা বলতে যাচ্ছি, কিন্তু টেনিদার দিকে তাকিয়েই থমকে গেলাম। ছিপের ওপরে একেবারে হুমড়ি খেয়ে পড়েছে, চোখ দুটো যেন ঠিকরে বেরিয়ে আসছে তার।
সত্যিই তো—এ যে দস্তুর মতন অঘটন। চোখকে আর বিশ্বাস করা যায় না; ফাতনা টিপটিপ করে নাচছে মাছের ঠোকরে।
আমাদের দু জোড়া চোখ যেন গিলে খাচ্ছে ফাতনাটাকে। দুহাতে ছিপটাকে আঁকড়ে ধরেছে টেনিদা—আর একটু গেলেই হয়! টিপটিপ—আমাদের বুক ঢিপঢিপ করছে সঙ্গে সঙ্গে। আমি চাপা গলায় চেঁচিয়ে উঠলাম, টেনিদা—
–জয় বাবা মেছো পেত্নী, হেঁইয়ো—
ছিপে একটা জগঝম্প টান লাগাল টেনিদা। সপাংসাঁই করে একটা বেখাপ্পা আওয়াজে বঁড়শি আকাশে উড়ে গেল, মাথার ওপর থেকে ছিড়ে পড়ল নারকেলপাতার টুকরো। কিন্তু বঁড়শি! একদম ফাঁকা মাছ তো দূরে থাক, মাছের একটি আঁশ পর্যন্ত নেই।
টেনিদা বললে, অ্যাঁ, ব্যাটা বেমালুম ফাঁকি দিলে! আচ্ছা, আচ্ছা যাবে কোথায়! আজ ওরই একদিন কি আমারই একদিন। নে প্যালা, আবার কেঁচো গাঁথ—
টান দেখেই বুঝতে পারছি কী রকম মাছ উঠবে! মাছ তো উঠবে না, উঠবে জলহস্তী। কিন্তু বলে আর চাঁটি খেয়ে লাভ কী, কেঁচো গাঁথা কপালে আছে, তাই গেঁথে যাই।
কিন্তু টেনিদার চারে আজ বোধ হয় গণ্ডা গণ্ডা রুই কাতলা কিলবিল করছে। তাই দু মিনিট না যেতেই এ কী! দু নম্বর ফাতনাতেও এবার টিপটিপ শুরু হয়েছে।
বললাম, টেনিদা, এবারে সামাল।
টেনিদা বললে, আর ফসকায়? বারে বারে ঘুঘু তুমি—হুঁ হুঁ! কিন্তু কথা বলিসনি প্যালা—চুপ। টিপটিপটিপ। টপ!
সাঁ করে আবার বঁড়শি আকাশে উঠল, আবার ছিড়ে পড়ল নারকেলপাতা। কিন্তু মাছ? হায়, মাছই নেই।।
টেনিদা বলেন, এবারেও পালাল? উঃ—জোর বরাত ব্যাটার। আচ্ছা, দেখে নিচ্ছি। কেঁচো গাঁথ প্যালা! আজ এসপার কি ওসপার।
তাজ্জব লাগিয়ে দিল বটে। বঁড়শি ফেলবামাত্র ফাতনা ড়ুবিয়ে নিচ্ছে, অথচ টানলেই ফাঁকা। এ কী ব্যাপার! এমন তো হয় না হওয়ার কথাও নয়।
টেনিদা মাথা চুলকোতে লাগল। পর পর গোটা আষ্টেক টানের চোটে মাথার ওপরে নারকেলগাছটাই ন্যাড়ামুড়ো হয়ে গেল, কিন্তু মাছের একটুকরো আঁশও দেখা গেল না।
টেনিদা বললে, এ কীরে, ভুতুড়ে কাণ্ড নাকি?
পিছনে কখন জগা এসে দাঁড়িয়েছে আমরা টেরও পাইনি। হঠাৎ পানে রাঙা একমুখ হেসে জগা বললে, আইজ্ঞা ভুতো নয়, কাঁকোড়া অছি।
–কাঁকোড়া? মানে কাঁকড়া?
জগা বললে, হুঁ।
–তবে আজ কাঁকড়ার বাপের শ্রাদ্ধ করে আমার শান্তি!… আকাশ কাঁপিয়ে হুঙ্কার ছাড়লে টেনিদা : বসে বসে নিশ্চিন্তে আমার চার আর টোপ খাচ্ছে? খাওয়া বের করে দিচ্ছি। একটা বড় দেখে ডালা কিংবা ধামা নিয়ে আয় তো জগা!
—ডালা! ধামা!—আমি অবাক হয়ে বললাম, তাতে কী হবে?
—তুই চুপ কর প্যালাবকালেই চাঁটি লাগাব। দৌড়ে যা জগাধামা নিয়ে আয়।
আমি সভয়ে ভাবলাম টেনিদার কি মাথা খারাপ হয়ে গেল নাকি? ধামা হাতে করে পুকুরে মাছ ধরতে নামবে এবারে?… কিন্তু–
কিন্তু যা হল তা একটা দেখবার মতো ঘটনা। শাবাশ একখানা খেল, একেবারে ভানুমতীর খেল। এবার ফাতনা ড়ুবতেই আর হেঁইয়া শব্দে টান দিলে না টেনিদা। আস্তে আস্তে অতি সাবধানে বঁড়শিটাকে ঘাটের দিকে টানতে লাগল। তারপর বঁড়শিটা যখন একেবারে কাছে চলে এসেছে, তখন দেখা গেল মস্ত একটা লাল রঙের কাঁকড়া বঁড়শিটা প্রাণপণে আঁকড়ে আছে। টেনিদা বললে, বঁড়শি জলের ওপর তুললেই ও ব্যাটা ছেড়ে দেবে। বঁড়শি আমি তোলবার আগে ঠিক জলের তলায় ধামাটা পেতে ধরবি, বুঝলি জগা! তারপর দেখা যাবে কে বেশি চালাক—আমি, না ব্যাটাচ্ছেলে কাঁকড়া!
তারপর আরম্ভ হল সত্যিকারের শিকারপর্ব। টেনিদার বুদ্ধির কাছে এবারে কাঁকড়ার দল ঘায়েল। আধঘণ্টার মধ্যে ধামা বোঝাই।
দুটো প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড হুইলের শিকার দু কুড়ি কাঁকড়া!
টেনিদা বললে, মন্দ কী! কাঁকড়ার ঝোলও খেতে খারাপ নয়। তোর খিচুড়ি কতদূর জগা?
কিন্তু ভদ্রলোকের এক কথা। আমি সেটা ভুলিনি।
বললাম, টেনিদা, মুড়োটা তোমার—আর ল্যাজা-পেটি আমার মনে আছে তো?
টেনিদা আঁতকে বললে, অ্যাাঁ।
আমি বললাম, হ্যাঁ।
টেনিদা এক মিনিটে কাঁচুমাচু হয়ে গেল, তা হলে?
–তা হলে মুড়ো, অর্থাৎ কাঁকড়ার দাঁড়া দুটো তোমার, আর বাকি কাঁকড়া আমার।
টেনিদা আর্তনাদ করে বললে, সে কী?
আমি বললাম, ভদ্দরলোকের এক কথা।
—তা হলে কাঁকড়ার কি মুড়ো নেই?
মুড়ো না থাকলেও মুখ আছে, কিন্তু আমি সে চেপে গেলাম। বললাম, ওই দাঁড়াই হল ওদের মুড়ো।
টেনিদা খানিকক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল, তারপর আস্তে আস্তে বসে পড়ল। বললে, প্যালা, তোর মনে এই ছিল! ও হো-হো-হো-
তা যা খুশি বলল। বঙ্গেশ্বরী মিষ্টান্ন ভাণ্ডারে সাড়ে তিন টাকার শোক কি আমি এর মধ্যেই ভুলেছি!
আজ দুদিন বেশ আরামে কাঁকড়ার ঝোল খাচ্ছি। টেনিদা দাঁড়া কী রকম খাচ্ছে বলতে পারব না, কারণ রাস্তায় সেদিন আমাকে দেখেও ঘাড় গুঁজে গোঁ-গোঁ করে চলে গেল, যেন চিনতেই পারেনি।