দৃশ্য এক।
সন্ধে সাড়ে পাঁচটা
কল্লোলিনী কলকাতার বুক দিয়ে হাসি মুখে প্রায় প্রায় ছুটতে ছুটতে বাস স্টপের দিকে এগিয়ে এলো অরিত্র। এত দিনে, এত দিনে তার স্বপ্ন পূরণ হয়েছে, প্রথমবার নিজের রোজগারের মাইনে নিজের হাতে পেয়েছে সে। এতগুলো টাকা তার একাউন্টে একবারে ঢুকেছে ,এটা যেন সে এখনো বিশ্বাস করতে পারছেনা! এটা সে পাবে সে জানত, অধীর আগ্রহে এর অপেক্ষাতেও ছিল, কিন্তু সত্যি আজ এটা হাতে পেয়ে সবটা এখনো যেন এক অলীক কল্পনা হিসেবে ঠেকছে তার।
ক্যাম্পাসিঙে যেদিন এই বিরাট সফটওয়্যার কোম্পানিতে এই চাকরিটা সে পেয়েছিল, সেই দিন থেকে আজ অব্দি এই গোটা সময়টা এখনো যেন তার একটা সুখস্বপ্ন বলেই মনে হয় ! সত্যি যদি স্বপ্নই হয় এটা তবে এই স্বপ্ন থেকে যেন তার ঘুম কখনো না ভাঙ্গে! এত দিন পর বাড়িতে গিয়ে মাকে বাবাকে যখন জানাবে তার প্রথম রোজগারের কথা কতটা খুশিতে ভরে উঠবে তাদের মুখটা ,আর শ্রুতি।
শ্রুতির কথাটা মনে পরতেই একটা ভিন্ন রকমের আনন্দে অজান্তেই অরিত্রের মুখটা যেন লাল হয়ে উঠলো। আর দেরী না এবার সে গর্বের সাথে শ্রুতির বাবা মায়ের সামনে গিয়ে দাঁড়াবে। তবে প্রথমে বাড়ি যাবার আগে এটিএম থেকে কিছু টাকা তুলতে হবে ,প্রথম মাসের মাইনে থেকে তার সংসার খরচ ছাড়াও বাবা মা এর জন্য আজ স্পেশাল কিছু কিনে নিয়ে যাবে সে। কতটা অবাক হয়ে যাবে তারা, ভাবতেই এই ধেড়ে বয়সেও ঠোঁটের কিনারায় একটা দুষ্টুমিতে ভরা হাসি ফুটে ওঠে অরিত্রের।
বাসের হর্নের আওয়াজে চিন্তার জাল কেটে বেরিয়ে আসে অরিত্র ,বাস এসে গেছে। বেশি ভীড় নেই আজ বাস স্টপে। তাও স্বভাব মত তড়িঘড়ি করে বাসে উঠতে গেল অরিত্র। বাসের হ্যান্ডেল ধরে সবে সে পাদানিতে এক পা রেখেছে কি রাখেনি হঠাত তার মাথাটা যেন ঘুরে গেল ,তার চারদিক যেন কুয়াশায় ঢেকে যাচ্ছে।
একটা অজানা জগতে যেন ক্রমশ হারিয়ে যাছে সে। সেই কুয়াশার ঘোরে তার চারদিকের জগত যেন একটু একটু করে অস্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে আর তার মধ্যে থেকে কিছু দৃশ্য যেন ক্রমশ ফুটে উঠছে তার সামনে।
একটি সাদা রঙের ঘর, কোন একজন মহিলা যেন তার সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে। তার মুখ খুব পরিষ্কার দেখা যাচ্ছেনা কিন্তু তা স্বত্তেও এই মুখ যেন তার ভীষণ রকম চেনা , কোথাও যেন সে দেখেছে এই মুখ। আর একজন কেউ , সাদা পোশাক পরে তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে ,আর যেন নিজেকে ধরে রাখতে পারছেনা অরিত্র। তার চারদিক যেন ক্রমশ কালো হয়ে আসছে ,একটা সময় এক গভীর অন্ধকারের মধ্যে যেন হারিয়ে গেল অরিত্র।
দৃশ্য দুই
সন্ধে সাতটা
আজকের মত শুটিং শেষ করে বাঁকা হাসি মুখে নিয়ে গাড়িতে এসে উঠলো শ্রমনা। আজকে শুটিং স্পটের সবাই বুঝতে পেরেছে শ্রমনা রায় কি জিনিস! নিজের অধিকার কিভাবে রাখতে হয় ,আর দরকারে কিভাবে পরগাছাদের টেনে উপড়ে ফেলতে হয় সেটা খুব ভালোভাবেই জানে শ্রমনা।
অনেক দিন ধরেই এই রুশা নামের মেয়েটা তার পথে কাঁটা হবার চেষ্টা করছিল, হুঁ দুঃসাহস কতদূর ?
বাংলা টেলিভিসন জগতের এক নম্বর নায়িকার সাথে কমপিট করার হিম্মত দেখিয়েছিল ওই কালকের উঠে আসা মেয়েটা! তেমনি জবাব, এক মুহূর্তে সিরিয়াল থেকে সোজা আউট। আজকেও শ্রমনা রায়ের কথা ফেলার ক্ষমতা প্রোডাকশনের নেই। ড্রাইভার গাড়ি চালিয়ে এসি অন করে দিয়েছে ,একটু একটু করে গাড়ির ভিতরটা ঠান্ডা হয়ে আসছে। ভেতরের জ্বালা ধরা রাগটাও যেন একটু ক্রমশ থিতিয়ে যাচ্ছে শ্রমনার। আর তার জায়গায় উঠে আসছে বিজয়িনী হওয়ার আনন্দ। এই জায়গা সে একদিনে পায়নি,কোনো বড় পরিবারের থেকে উঠে আসেনি সে ,একটু একটু করে তাকে এই জায়গাটা তৈরি করতে হয়েছে।
এই সাফল্য পেতে যে কত মূল্য তাকে দিতে হয়েছে এটা সে ছাড়া আজ আর কেউ জানেনা! কেউ তাকে পথ তৈরি করে দেয়নি ,একটু একটু করে নিজের হাতে পথ বানিয়ে তাকে সেই পথে চলতে হয়েছে।আর সেই পথে এগোনোর সাথে সাথে একটু একটু করে তার সমস্ত কাছের মানুষেরা তার থেকে দূরে সরে গেছে।
সেই ফেলে আসা জীবনটা যেন এক পূর্ব জন্মের মত লাগছে শ্রমনার, আচ্ছা এমন তো নয় যে শ্রমনা আজকেই ঘুম থেকে উঠে দেখবে তার এই পুরো জীবনটাই একটা স্বপ্ন। রোজকার মতন আজকেও মা তাকে ঘুম থেকে টেনে তুলে পড়তে বসাচ্ছে ,বাপি তাকে তার সেই আদ্যিকালের স্কুটারটায় করে তাদের ছোট্ট শহরটার সেই পুরনো গার্লস স্কুলে পৌছে দিচ্ছে।
নাহ এই সব ভেবে আর কোনো লাভ নেই ,সেই ছোট্ট সুমি আজ শ্রমনা রায়ে পরিনত হয়েছে। নদীর স্রোতের সাথে শুধুই এগিয়েই যাওয়া সম্ভব, স্রোতের বিপরীতে যাওয়া না কোনো কালে সম্ভব ছিল আর না সেই পথে ফিরে যাওয়ার জন্য আর কিছু পরে আছে শ্রমনার কাছে।…
এবার তার নেক্সট টার্গেট বিরাট বাজেটের ওই সিনেমাটা ,এটাই এবার শ্রমনার কাছে পাখির চোখ ,এটা একবার হিট করাতে পারলে এই টেলিভিসন এর জগত থেকে সোজা বড় পর্দায় একটা গ্র্যান্ড এন্ট্রি হবে মিস শ্রমনা রায়ের। নায়িকা ,নায়িকা পদ এবার তার চাই!
বাংলা সিনেমার এক নম্বর নায়িকা কে ? আর কে ওয়ান এন্ড অনলি শ্রমনা রয়।
আচমকা একটা ঝাকুনিতে চিন্তার জাল কেটে বাইরের জগতে যেন ফিরে আসে শ্রমনা ,কোনো সিগনালে যেন এসে দাঁড়িয়েছে গাড়িটা। ড্রাইভারকে রাশ ড্রাইভিং এর জন্য একটা ধমক দিতে গিয়েও থমকে যায় শ্রমনা। তার মাথাটা যেন কেমন একটা ঘুরছে ,কিছু বলতে গিয়েও যেন সে আর বলতে পারছেনা। একটা অদ্ভুত ফ্যাকাশে কুয়াশা যেন তাকে একটু একটু করে গ্রাস করছে ,একটা অচেনা জগতে যেন হারিয়ে যাচ্ছে শ্রমনা! কিন্তু সত্যি কি অচেনা জগত? কোথাও যেন ভীষণ চেনা নয় কি তার এই জগতটা ? এই সাদা রঙের ঘর , এই ঘর তার যেন খুব পরিচিত। আর কে সামনে এসে দাঁড়িয়েছে তার ? একজন মহিলা ,কিন্তু এই মহিলাকে কেন তার এত চেনা মনে হচ্ছে ? আর তার পাশে যেন আরো একজন কেউ এসে দাঁড়িয়েছে ,সাদা পোশাক পরা কেউ!
কি হচ্ছে এসব ? কোথায় সে ? এরা কারা ???? আর যেন নিজেকে সামলাতে পারেনা শ্রমনা, একটা অন্ধকারের মধ্যে যেন হারিয়ে যায় সে…
দৃশ্য তিন
রাত আটটা
কোচিং ক্লাস শেষ করে বাড়ি ফিরছে নীরা। বাড়ির সামনের গলিটার কাছাকাছি এসে মুখটা বিকৃত হয়ে উঠলো ওর। আবার, আবার বাড়িতে গিয়ে সেই এক দৃশ্য!
প্রথমেই তার এত রাত কেন হয়ে গেল তার এক গাদা জবাবদিহি , তারপর যথারীতি পড়াশুনা ও চাকরির চেষ্টা ছেড়ে সংসার করার বিনা খরচের উপদেশ!
মায়ের মেন্টাল ব্লাকমেলিং , অসুস্থতার ছুতোয় তাকে বিয়ে করে “থিতু” হওয়ার জন্য একগাদা ন্যাকামি! বৌমনির যথারীতি নাকি স্বরে এসে বলে ওঠা “ভাই আজকের রাতের রান্না তুমি একটু উতরে দিতে পারবে ,দেখনা বিকেল থেকে মাথাটা এত ধরেছে ,তার মধ্যে তোমার দাদা আবার তাড়াতাড়ি খাবার সেরে নেওয়ার জন্য তাড়া লাগিয়েছে , তুমি আছ বলে একটু ভরসা।“
ডিসগাস্টিং, মাথায় যেন আগুন জ্বলে যায় নীরার এই সব ন্যাকামি মনে পড়লেই। তার উপর বাবার সেই চিরন্তন বাণী “চাকরি করে কি হবে শুনি ,এমনিতেই তো বিদ্যা দিগগজ হয়ে মাটিতে পা পরেনা ,বলি বিয়ে থা তো করতে হবে নাকি? নাকি আমার আধুনিক কন্যের তাতেও মত নেই ?”
আর ভালো লাগেনা নীরার ,গ্রাজুয়াসনে এত ভালো মার্কস পেয়েও সে মাস্টার ডিগ্রী পড়তে পেলনা শুধু তার বাড়ির এই মান্ধাতা আমলের মানসিকতার জন্য। আর এখন নিজের টিউশনির টাকায় সরকারী চাকরির পড়াশুনা চালাচ্ছে সে, তাতেও এদের মুখ ভার। একদিন অসিতদার কোচিং ক্লাস থেকে একটু এক্সট্রা ক্লাস করে ফিরতে সামান্য দেরী হলেই একগাদা প্রশ্ন বাণের মুখে পড়তে হয় তাকে ,এত দিনেও কি একটুও ভরসা করতে পারেনা তাকে এরা?
আর তার স্বপ্ন গুলো? তার কি কোনো দাম নেই এদের কাছে ? সে জীবনে নিজের পায়ে দাঁড়াতে চায় , প্রতিষ্ঠিত হতে চায়। এটা কি তার এত বড় অপরাধ ? অন্যান্য মেয়েদের মত প্রেমে পরার সাধ তার কখনো হয়নি । তার ব্যক্তিত্বের সামনে এই ধরনের প্রস্তাবের কি পরিণাম হত তাও তো কারোর অজানা নয়, তাও তার পরিবারের সবার তার উপর এত অবিশ্বাস ?
নাকি অবিশ্বাস নয়, তার এই স্বপ্নকে, এই জেদকে ভাঙ্গার এক নিষ্ঠুর প্রয়াস! যাতে হাত মিলিয়েছে তার তথাকথিত সমস্ত কাছের মানুষেরা। আর ভালো লাগেনা নীরার ,মাঝে মাঝে তার চিন্তায় ফুটে ওঠে কবিগুরুর সেই দুটি পংতি
“রোজ কত কি ঘটে যাহা-তাহা।
এমন কেন সত্যি হয় না আহা।।”
বড় বেশি প্রিয় এই লাইন দুটি তার, সত্যি যদি এমন হয় যে সে ঘুম থেকে উঠে দেখল তার সমস্ত জগত বদলে গেছে এক নিমেষে। তার মা তাকে নিজের পায়ের দাঁড়াতে ফোর্স করছে ,তার বাবা মেয়ের রেজাল্ট নিয়ে গর্বিত , বৌমনি নিজের কোনো স্বার্থ ছাড়াই তার সাথে বন্ধুর মত চুটিয়ে আড্ডা দিচ্ছে আর দাদা নিজের নিস্পৃহ স্বত্তা ত্যাগ করে তার পড়ার মাঝখানে কখন অজান্তে তার কাছে এসে স্নেহভরা হাত তুলে দিচ্ছে তার মাথায় ,শান্ত স্বরে বলে উঠছে “তোর পড়াশুনা ঠিকঠাক চলছে তো ? কোনো কিছু দরকার হলে কিন্তু বলিস। ”
এই অলীক দৃশ্য কি কোনদিন সত্য হবেনা তার জীবনে , ভাবতে ভাবতে নীরা দেখে কখন যেন সে তার বাড়ির গেটের সামনেই এসে দাঁড়িয়েছে। পুরনো তিক্ততাটা আবার যেন তার মনে এসে শিকড় গেঁড়ে বসে। একরাশ বিরক্তি নিয়ে বাইরের গেটটা খুলে ভেতরে এসে কলিং বেলটা টিপতে যায় নীরা ,কিন্তু হঠাতই তার গোটা জগত যেন কেমন একটা অদ্ভুত কুয়াশায় হারিয়ে যায়। একটা অদ্ভুত ধোঁয়াশার মধ্যে যেন ক্রমশ নিজেকে হারিয়ে ফেলতে থাকে নীরা ,কিন্তু এই কুয়াশা যেন আসতে আসতে কেটে যাচ্ছে অথচ এ কোন অচেনা জগতে পৌছে গেছে সে ? নাকি অচেনা নয় বড় বেশি চেনা কোনো জগতে সে পৌছে যাচ্ছে!
বড় বেশি চেনা কিন্তু তাও যেন সে ঠিক মনে করতে পারছেনা কোথায় দেখেছে সে এই এত চেনা সাদা রঙের ঘরটি ? আর কে এই মহিলা তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে ? কেন এত বেশি আপন মনে হচ্ছে তার তাকে ? আর কেনই বা সে এতটা ব্যাকুল ভাবে তাকিয়ে রয়েছে তার দিকে ? হঠাত করে তার পাশে এসে যেন দাঁড়ালো অন্য একজন ব্যক্তি, সাদা পোশাক পড়া কেউ। আর কিছু ভাবতে পারছেনা নীরা ,একটা অদ্ভুত অন্ধকার একটা জমে থাকা নিরবতা তাকে গ্রাস করছে , এক গভীর সুপ্তির জগতে যেন ক্রমশ হারিয়ে যায় সে। ………
দৃশ্য চার
রাত ৯ টা
টেলিস্কোপে চোখ রেখে একমনে মহাকাশের অমানিশায় মহাবীণকার অভিজিতের সন্ধানে মগ্ন হয়ে আছে ময়ূখ। ছোটবেলা থেকেই এই একটা নেশাতেই মগ্ন সে। মহাকাশ যেন তাকে এক অব্যক্ত স্বরে আহ্বান জানায় নিজেকে তার কাছে প্রকাশিত করার জন্য। প্রতিটি নক্ষত্র যেন এক একটি আলাদা সুরে কথা বলে তার সাথে ,ওদের নিয়ে তার এই এক ভিন্ন জগত। কোথাও সপ্তর্ষির ধ্রুব নক্ষত্রকে চির পরিক্রমণ, কোথাও ছয়টি স্বামী পরিত্যক্তা অভাগী একটি মাত্র পালিত পুত্রকে সম্বল করে দিন অতিবাহিত করছে , আর কোথাও মহর্ষি বশিষ্ঠের কন্ঠলীনা অরুন্ধতী চিরন্তন প্রেমের দ্যুতিতে চির উজ্জ্বল। পুরানের এই কাহিনী গুলিতে যেন আজও এই মহাকাশের মহা রহস্যকে বাঁধতে চায় ময়ূখ। বিজ্ঞানের ছাত্র রূপে সে জানে এই নক্ষত্রগুলি দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকা হাইড্রোজেন এর পিন্ড ভিন্ন আর কিচ্ছু নয়, তবুও তার মনে বার বার ফুটে ওঠে ছোটবেলায় ঠাম্মার কোলে চেপে বসে শোনা সেই অদ্ভুত মন প্রাণ ভরিয়ে দেওয়া কাহিনীগুলো!
আর ঠাম্মার সেই হাসিমুখে বলে ওঠা “আমি সগ্গে চলে গেলে তুই আমাকে খুঁজে পাবি তো মন, নাকি তখন তোর ঠাম্মাকে ওই ছয় পোড়ারমুখী অভাগী বা ওই বরের পিরেমে বয়ে যাওয়া লজ্জাবতীর মধ্যে একজন বানিয়ে দিবি , চিনতে পারবি তো আমায় এই এত্ত বড় আকাশটায় ?”
ঠাম্মার ছোট্ট নাতি মন তখন ঠাম্মার কোলে মুখ লুকিয়ে বলে উঠত ” ঠিক পারব , তুমি দেখে নিও। এই হাজার হাজার তারার মধ্যে তুমি যেখানেই লুকিয়ে থাকো না কেন, আমি তোমায় ঠিক খুঁজে নেব ” আজ ও এই স্মৃতিতে যেন হারিয়ে যায় চব্বিশ বছরের ঝকঝকে যুবক ময়ূখ চাটার্জী। ময়ূখ বোধ করি বিশ্বের খুব কমসংখ্যক সেই মানুষদের মধ্যে পরে যাকে দুঃখ কখনই স্পর্শ করতে পারেনি। জীবনের অতি যন্ত্রণার মুহূর্তেও যেন আনন্দের গোপন ভান্ডার থেকে এক মুঠো হাসি ছড়িয়ে দিতে পারে সে যে কোনো মানুষের জীবনে। আর সেই জন্যই মনে হয় ভাগ্যও হার মেনে তার জীবনে দুঃখ আনার প্রয়াস করার চেষ্টাও ছেড়ে দিয়েছে । সুন্দর হাসিখুশিতে ভরা পরিবার , ভালো চাকরি ,
সত্যিকারের ভালো বন্ধুদের দল, নির্ঝঞ্জাট জীবন, আর কি চাইতে পারে মানুষ শান্তির সন্ধান পেতে গেলে ? না ময়ূখের আর কিছুই চাওয়ার নেই শুধু এই একটি নেশাতেই তার জীবনের অবসর মুহূর্তগুলো চির উজ্জ্বল হয়ে রয়েছে। বাড়ির ছোট ছেলে সে ফলে দায়িত্বও কম অথচ আদর প্রচুর ,অবশ্য শাসনও নেহাত কম নয় এই বয়সেও।
কিন্তু সেই শাসনও যেন আদরেরই নামান্তর। তার এই শখ বাড়ির সবার কাছে তার এক ছেলেমানুষিতে ভরা পাগলামি। এক একদিন রাত্রে খেতে দেরী হয়ে গেলে মা রাগের মাথায় এই টেলিস্কোপ ভাঙ্গতে ছোটেন, যদিও আজ
অব্দি তার সাধের টেলিস্কোপটির গায়ে একটি আঁচড় ও পরেনি। মনে পড়লে আজ তার হাসি পায় যে আগের টেলিস্কোপটি খারাপ হয়ে যাবার পর যখন সে মনমরা হয়ে চুপচাপ বসে ছিল তখন অন্যদের না জানিয়ে বাবা , মা ,দিদি, দুই দাদা ,এমনকি সদ্য বউ হয়ে আসা বড়বৌদি অব্দি তার হাতে লুকিয়ে টাকা গুঁজে দিয়ে গেছিল নতুন টেলিস্কোপ কেনার জন্য ,অবশ্য প্রত্যেকেই দুটি গালি গালাজ করেই ফিরেছিল,আর সবারই ধারণা ছিল যে সে বাকিদের অজান্তেই ময়ূখ কে টাকা লুকিয়ে দিচ্ছে। তারপর যখন সে এই ফাটাফাটি নতুন টেলিস্কোপ টি কেনার পর, আসল রহস্যটি ভেঙ্গে ছিল, তখন বাড়িতে হাসির যেন বন্যা বয়ে গেছিল।
মাঝে মাঝে নিজেকে খুব ভাগ্যবান মনে হয় ময়ূখের এত সুন্দর একটা জীবন ভগবান এর কাছ থেকে পাওয়ার জন্য । ঠাম্মার একটা কথা খুব মনে পরে ময়ূখের ” মন জীবনটা আনন্দের সঙ্গে বেঁচে দেখ ,প্রতিটা মুহূর্ত কত সুন্দর লাগবে! দুঃখ ভয়ে পাশ মাড়াতেই চাইবেনা । আর দেখবি এত সুন্দর সময়টা কত তাড়াতাড়ি ফুরিয়ে গেল ,একটা সময় যখন তুই চোখ বুজবি তখন কোনো আপসোস থাকবেনা রে ,থাকবেনা কোনো জ্বালা ,যেমন দেখ আমার নেই। যে দিন চোখ বুজব কোনো কষ্ট ছাড়াই টুপ করে ওই মহা অমানিশার জগতে হারিয়ে যাব ,কিন্তু জীবনে যদি দুঃখ কষ্টকে কাছে ঘেষতে দিস তবে দেখবি গোটা জীবনটাই এক অদ্ভুত না জানা আগুনে জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে। এক একটা মুহুর্তকেও এক এক যুগের মত ঠেকবে রে , তাই দুঃখু কষ্টকে সব সময় বলবি বাইরের রাস্তা দেখুন মশাই , বুঝলি ”
একটা অল্প হাসি ফুটে উঠলো ময়ূখের মুখে, এই মন্ত্রকেই জীবনে তার ভিত্তি প্রস্তর করেছে সে। আর এবারই তার টেলিস্কোপের চোখে এক খণ্ড মুহূর্তে ফেরারী আসামির মত ধরা পরে যান মহাবীণকার অভিজিত। অভিজিতকে বন্দী করে আপাতত এবার সব থেকে রহস্যময় নক্ষত্রটির দিকে দৃষ্টি ফেরে ময়ূখ, তার দৃষ্টি এবার সোজা সপ্তর্ষির দিকে , না সপ্তর্ষি নয় সপ্তর্ষীর ভিড়ে লুকিয়ে থাকা মহর্ষি বশিষ্ঠের প্রিয়তমা পত্নী ,তার কন্ঠলীনা সাধ্বী “অরুন্ধতীই” এবার তার লক্ষ্যস্থল।
তার ঠাম্মার ভাষায় বলতে গেলে মহাকাশের সব থেকে ঢঙী লজ্জাবতী, ময়ূখ না ময়ূখ না ঠাম্মার ছোট্ট মন একবার তাকে জিজ্ঞেস করেছিল “ঠাম্মা তুমি অরুন্ধতী কে ঢঙী, লজ্জাবতী কেন বল ?”
ঠাম্মা একমুখ হেসে উত্তর দিয়েছিল “কেন বলবনা বলত ,এত তারা আছে আকাশে ওর মত ঢং আর কজনের বলতো? একবারের জন্য সপ্তর্ষী তে উঁকি মেরে আবার লজ্জায় ঘোমটা টানে ,একটু মেঘ হলো কি না হলো, ঘোমটা সব সময় তৈরি , আবার বরকে কাছ ছাড়া করাও চলবেনা নবাব নন্দিনীর। আরে বাপু সাত ভাইয়ের মাঝে তোর কি না গেলে চলছেনা , বুঝলুম তোর বর ,তো এত ইয়ে কিসের ?” হো হো করে হেসে ওঠে ময়ূখ ঠাম্মার কথা গুলো মনে পড়লে, সত্যি ঠাম্মা পারত বটে । তো এবার ঠাম্মার লজ্জাবতীকেই খোঁজা যাক ,এই হলো ধ্রুব নক্ষত্র ,তবে এই হলো সপ্তর্ষি। সপ্তর্ষির মধ্যে এই হলেন মহর্ষি বশিষ্ঠ।
তবে ওই তো অরুন্ধতী ,কিন্তু একি রূপ অরুন্ধতীর ? চির লজ্জাবতী লজ্জা ত্যাগ করে আজ এ কোন রূপে এত উজ্জ্বল ভাবে ফুটে উঠেছে মহাকাশের বুকে ,এত ঔজ্বল্য কোথায় পেল সে ???
কিন্তু এ কি ??? বশিষ্ঠের বুকে এক পাশে লুকিয়ে থাকা ওই ছোট্ট ম্রিয়মান তারাটি তাহলে কে ? এই তো তাহলে অরুন্ধতী , এই যদি প্রকৃত অরুন্ধতী হয় তবে সপ্তর্ষি মন্ডলে এই নতুন নবম তারাটি কে?
আর এ কি অদ্ভুত বিকিরণ এই নক্ষত্রের ? কিন্তু সত্যি এ কি কোনো নক্ষত্র ,এই ধরনের অদ্ভুত আলো আজ অব্দি অন্য কোনো নক্ষত্রের তো দেখেনি ময়ূখ ,তবে কি এই অদ্ভুত মহাজাগতিক শক্তি ?
কিন্তু আর একি ?? এই অদ্ভুত নক্ষত্র (?) টির গতি যেন আরো বাড়ছে ,আরও বাড়ছে যেন তার ঔজ্বল্য, একটা প্রচণ্ড বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে পরে ময়ূখ, চিত্কার করে উঠতে চায় সে!
কিন্তু হঠাতই তার চারদিকে একটা অদ্ভুত সাদা কুয়াশার আবরণ যেন তাকে গ্রাস করে , একটা অদ্ভুত স্তরে যেন হারিয়ে যাচ্ছে সে , তার চারপাশের চেনা জগত সহসা অদৃশ্য হয়ে তার থেকেও বেশি চেনা কিন্তু তাও অচেনা এক অদ্ভুত জগত যেন ফুটে উঠেছে ,একোন জায়গা ,এই সাদা রঙের দেওয়াল, এই অসম্ভব চেনা কাতর মুখের মহিলা স্মৃতির কোন অধ্যায়ে এগুলো তার চাপা পরে রয়েছে ? কেন সে এগুলো সে মনে করতে পারছেনা ? তার একপাশেই সাদা পোশাকের একজন কেউ যেন দাড়িয়ে রয়েছে সেই মহিলার পাশে, আর যেন নিজেকে ধরে রাখতে পারছেনা ময়ূখ, একটা অদ্ভুত অসীমতার মধ্যে যেন নিজেকে হারিয়ে ফেলল সে।
পঞ্চম ও অন্তিম দৃশ্য
রাত সাড়ে দশটা
ধবধবে সাদা দেয়াল, সাদা মার্বেলের ঘরে বহুমূল্যের পালঙ্কের একধারে ব্যাকুল মুখে দাঁড়িয়ে রয়েছেন বৃদ্ধা মিসেস রমা গাঙ্গুলি। তার সমস্ত আনন্দ সব আশা নিস্তেজ ভাবে পড়ে রয়েছে তার সামনের শয্যায়, তার অচেতন স্বামী ভারত বিখ্যাত সাহিত্যিক রুদ্র গাঙ্গুলির রূপে। গত এক মাস ধরে এই ভাবেই অচেতন ভাবে বিছানায় শুয়ে রয়েছেন রুদ্র গাঙ্গুলি। নিজেদের ঘরটিকেই হাসপাতালের কেবিনে পরিণত করে দিয়েছেন মিসেস গাঙ্গুলি তার প্রিয়তম মানুষটির একটু ভালো লাগার জন্য। যদি নিজের চিরপরিচিত এই পরিবেশে থেকে তার ভালবাসার মানুষটি একটু সুস্থ হয়ে ওঠেন! স্মৃতির সমস্যাতে গত কয়েক বছর ধরেই তার ভালবাসার মানুষটি আক্রান্ত হয়েছিল ,কিন্তু একটা ছেলেমানুষী জেদে না নিজে স্বীকার করেছেন আর না স্ত্রীকে কিছু করতে দিয়েছিলেন। কিন্তু অদ্ভুত ভাবে বাস্তব জীবনের স্মৃতি ধীরে ধীরে এক এক পা করে অন্তরালে হারিয়ে গেলেও তার নব রচনার কাহিনী গুলি অঙ্গাঙ্গীক ভাবে আঁকড়ে ধরছিল তার সমস্ত জীবনটাকে। আর একটু একটু করে বাস্তব জীবনের থেকে যত দূরে সরে গেছেন এই রচনাকার, ততই তার নিজের রচিত কল্পনার জগতে গোলকধাঁধায় হারিয়ে ফেলেছেন নিজেকে। মিসেস গাঙ্গুলির পাশে দাঁড়িয়ে থাকা সাদা পোশাকের ডাক্তার সেন বলে ওঠেন ,”ম্যাডাম উনি আবার ইলিউসনের জগতে হারিয়ে যাচ্ছেন , আপনি বললে আমি আবার ওনাকে ইনজেকশন দিয়ে ফিরিয়ে আনছি বাস্তবের জগতে।”
মিসেস গাঙ্গুলি একটা ক্লান্ত হাসি হেসে বলে ওঠেন “কোনটা বাস্তব আর কোনটা অলীক তার বিচার কে করবে ডাক্তার বাবু ? এই বাস্তবের জগতে উনি তো জীবন্মৃত ,না কাউকে চিনতে পারছেন আর না কোনো স্মৃতি ওনার মনে ফুটে উঠছে। তার থেকে উনি যদি ওনার রচনার ওই জগতে অরিত্র রূপে বেঁচে ,শ্রমনার জীবনের উচ্চাকাঙ্খা ও গোপন হতাশায় শরিক হয়ে, নীরার জেদ ও সাহসের প্রতীক হয়ে আর ময়ূখের সাথে দুঃখ কষ্ট কে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে চির আনন্দের জগতে বেঁচে থাকতে পারেন তবে এই শেষ কটা দিন উনি না হয় ওই ভাবেই বাঁচুন। আর ইনজেকশন দেবার দরকার নেই ডাক্তার বাবু। ”
পরম স্নেহের সাথে নিজের স্বামী কপালের বলিরেখায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকেন মিসেস রমা গাঙ্গুলি ।
আর অন্যদিকে তখন অরিত্র নিজের প্রথম মাসের মাইনে দিয়ে বাবার জন্য তসরের পাজামা পাঞ্জাবী আর মায়ের জন্য দামী গরদের শাড়ি কিনে একমুখ হাসি নিয়ে শ্রুতির ধ্যান করতে করতে ছুটতে ছুটতে বাড়িতে এসে ঢোকে।
অরিত্রের পরে অপেক্ষায় থাকে শ্রমনা নিজের জীবনের গোপন নিরাশাকে লুকিয়ে চূড়ান্ত সফলতার সিঁড়িতে পদার্পনের ব্যাকুলতা নিয়ে!
নীরা নিজেকে প্রস্তুত করে সকল প্রতিকূলতার সাথে সংগ্রাম করে নিজের স্বপ্নকে সফল করতে, আর সবার আড়ালে মহাশূণ্যের অসীম রহস্যকে সাথে করে, একমুখ হাসি নিয়ে দূরে এসে দাঁড়ায় ময়ূখ তার রচয়িতার সমস্ত যন্ত্রণা, গ্লানি, কষ্টকে আশার সুমধুর প্রলেপ দিয়ে মুছে দিতে। তথাকথিত বাস্তব জগত একটু একটু করে মুছে গিয়ে তার নিজের রচনার অলীক জগত সত্য হয়ে উঠতে থাকে রুদ্র গাঙ্গুলির মানস পটে …
………………………………………………………………(সমাপ্ত)……………………………………………………….