“তুষার দা এই নতুন অর্ডারটা এসেছে, সুকুমার রচনাবলীর। নয় নম্বর আদি গঙ্গা রোড, অনলাইন ফুল পেমেন্ট করে দিয়েছেন ভদ্রলোক ইউ এস থেকে। এবার বরং বেরিয়ে পড়ি অর্ডারটা নিয়ে কী বলো!
অদ্ভুত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে থমথমে স্বরে বলে উঠলেন তুষারদা “অর্ডারটা ক্যানসেল করে দাও সুমন। আর অনলাইন টাকাটা ফেরত দিয়ে অফিসিয়াল মেইল করে দাও, এই অর্ডারটা এরপর থেকে আমাদের পক্ষে আর ডেলিভারি করা সম্ভব নয়।
-মানে? কেন তুষারদা? এই কাছেই তো। আমিই গিয়ে আধঘন্টার মধ্যে ডেলিভারি দিয়ে আসছি। সত্যি কোন সমস্যা হবেনা।
গম্ভীর স্বরে বলে উঠলেন তুষারদা “সমস্যা আছে সুমন, যা বলছি সেটা করো অর্ডারটা ক্যান্সেল করে দাও।“
আমি একটু অবাক হয়ে বলে উঠলাম “ইয়ে মানে তুষারদা ভদ্রলোক কিন্তু ফুল পেমেন্ট করে দিয়েছেন। সেইদিক থেকে কোন সমস্যা নেই। কোন উল্টোপাল্টা দাবীও করেননি শুধু বলেছেন একটা বার্থডে গিফটের মতন র্যাপ করে নিয়ে যেতে, সে তো দুমিনিটের ব্যাপার। তাই বলছিলাম শুধু শুধু অর্ডারটা কেন ?
আমি আর কিছু বলতে পারলামনা, আচমকা একটা তীব্র স্বরে চীৎকার করে উঠলেন মানুষটি “যা বলছি সেটা ফলো করতে খুব কি অসুবিধে আছে তোমার সুমন? এত বেশি বুঝতে তোমায় কে বলেছে? যা বলছি সেটা করো। এক্ষুনি গিয়ে অর্ডারটা ক্যান্সেল করে দাও। নাহলে কালকে নিজের রেজিগনেশন লেটারটা আমার টেবিলে রেখে যাবে। আমার কপালেই যত কিছু জোটে। “
হতভম্ব হয়ে চুপচাপ তুষার দার ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম। সত্যি বলতে গেলে যতটা না খারাপ লাগছিল তার থেকে অবাক বেশি হলাম। এই দুমাস হলো এই কুরিয়ার কোম্পানিতে জয়েন করেছি, কিন্তু তুষারদার কাছ থেকে একদিনের জন্যেও কোন খারাপ ব্যবহার পাইনি। এত আপনজনের মতন আচরণ করেন, যে কোন কোন সময় মনেই হয়না যে উনি এই কোম্পানির মালিক। সেখানে হঠাত করে এইরকম রুক্ষ ব্যবহার ?
অফিস থেকে বেরিয়ে চুপচাপ বাইরের বেঞ্চটাতে গিয়ে বসলাম, হঠাত করে কি এমন অন্যায় করে বসলাম আমি ?
দূর থেকে গঙ্গার ঠাণ্ডা হাওয়া ভেসে আসছে, একটু একটু করে যেন তার নরম ছোঁয়ায় আমি ফিরে যাচ্ছি আজ থেকে দুমাস আগে।
কত নার্ভাস ছিলাম সেই সময়, কত ভুলও করেছি, কাস্টমারের কত শত কমপ্লেইনও ভেসে এসেছে তুষারদার কাছে। কিন্তু একবারের জন্যেও কোন খারাপ ব্যবহার করেননি মানুষটি।
উল্টে বারবার বলেছিলেন “ভুল তো হতেই পারে, নতুন কাজে এসেছিস ভুল না করলে শিখবি কিভাবে। চাপ নিবিনা একদম। কোন কথায় কান না দিয়ে চুপচাপ নিজের কাজ করে যা।
আচমকা কি এমন হল মানুষটার ?
হঠাত মাথার পেছনে একটা চাপড়, চমকে গিয়ে পেছন ফিরে দেখলাম অরুণ দা এসে দাঁড়িয়েছে।
-কী রে এখানে একা একা বিরহিনী রাধার মতন বসে বসে কার ধ্যান করছিস র্যা ?
– ধুত, কি যে বলো? একে শুধু শুধু উদোম ঝাড় খেলাম আজ তুষারদার কাছে, তায়…।
-কী তুষারদার কাছে ঝাড়? বলিসকি? এত আজব কথা! আজ অব্দি কেউ তুষারদার কাছে উদোম ঝাড় খেয়েছে এমন কথা তো কস্মিনকালে শুনিনি। করেছিলি কি ?
-আরে করেছিলাম কি সেকি আর আমিও জানি? শুধু একটা অর্ডার নিয়ে কথা বলতে গেছিলাম, তুষারদা দুম করে বলে দিল অর্ডারটা ক্যান্সেল করতে, আমি কেন জিজ্ঞেস করতেই উদোম ঝাড়। কি এমন মহাভারত অশুদ্ধ করে বসল অর্ডারটা কে জানে?
-অর্ডার? কোন অর্ডার বলত?
– আরে আজকেই এসেছে, কাল তেরই জুলাই আদিগঙ্গা লেনের একটা বাড়িতে একটা সুকুমার রচনাবলী ডেলিভারি দিয়ে আসতে হবে। এমনকি ইউ এস থেকে ভদ্রলোক পেমেন্ট অব্দি করে দিয়েছেন। তারপর যে হঠাত কি হলো তুষারদার?
আমাকে অবাক করে দিয়ে আচমকা উঠে দাঁড়িয়ে একটা গম্ভীর স্বরে বলে উঠল অরুণদা “তুষারদা একদম ঠিক করেছে রে সুমন। ভুলটা আমারই, সকালেই মেল চেক করে আমারই অর্ডারটা রিজিউজ করে দেওয়া উচিত ছিল। খবরদার ওই অর্ডারটার কথা আর ভুলেও মুখে আনবিনা।“
ভ্যাবাচাকা খেয়ে অরুণদার মুখের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম আমি, কি হচ্ছে এটা ? সকাল থেকে একটা সামান্য অর্ডার নিয়ে এত চিন্তিত কেন এরা ?
আমি কিছু বলার আগেই যেন জোর করে একটু হেসে বলে উঠল অরুণদা, “আচ্ছা শোন আর আর রাগ করে থাকিসনা, যা তুষারদার কেবিনে একবার যা। তোকে ডেকে পাঠিয়েছে। জানিস তো মানুষটা কেমন, আর সামান্য ব্যাপার নিয়ে মনে রাগ পুষে রাখিসনা ।“
একটু হেসে মাথা নেড়ে তুষারদার কেবিনের দিকে এগিয়ে গেলাম আমি।
-ডেকেছিলে তুষারদা ?
-হ্যাঁ রে বস। তোর অন্য অর্ডার গুলো শিডিউল করে নিয়েছিস?
-হ্যাঁ, মোটামুটি ঠিক করে নিয়েছি। আশা করছি খুব সমস্যা কিছু হবেনা।
-বেশ। আচ্ছা সকালের ব্যবহারে রেগে গেছিস না ? আমি একটু বেশি হার্সলি বিহেভ করেছি তোর সাথে তাই না রে ?
– না না তুষার দা, কি যে বলছ! তুমি আমাদের কতটা ভালবাস আমি কী জানিনা ? আর সেই জন্যই একটু অবাক হয়ে গেছিলাম । এই রকম হঠাত করে কখন তো তোমাকে আগে রেগে যেতে দেখিনি তাই আসলে।”
আমার দিকে তাকিয়ে একটু গম্ভীর স্বরে বলে উঠলেন মানুষটি “আসলে কি জানিস তো কিছু কিছু বিষয় এত দুর্বোধ্য হয়, যে তার সামনে পড়ে মানুষ আর নিজের উপর নিয়ন্ত্রন রাখতে পারেনা। কিছু ফেলে আসা তিক্ত স্মৃতি, যা আর মনে না পড়লেই বোধহয় ভাল হত!
একটু ইতস্তত করে বলে উঠলাম “তুমি কি আজ সকালের আসা অর্ডারটার বিষয়ে কিছু বলছ তুষারদা?”
আমার দিকে কিছু সময়ের জন্য একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে এক অদ্ভুত স্বরে বলে উঠলেন মানুষটি “একটা কথা জেনে রাখ সুমন, আজকের পর থেকে কোনদিনও এই অর্ডারটা এলে সোজা ক্যান্সেল করে দিবি। কোনমতেই কাউকে ওই ঠিকানায় পাঠাবিনা। খবরদার না। তা আমি এখানে থাকি কি না থাকি।“
হতবাক হয়ে কিছুক্ষন তাকিয়ে রইলাম মানুষটার দিকে, একটা সামান্য বইএর অর্ডার নিয়ে এত কেন চিন্তিত মানুষটি?
মুখটা পুরো ফ্যাকাশে হয়ে গেছে, এই কনকনে এসিতেও কপালে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে ঘামের রেখা। কি আছে এই অর্ডারটায় ?
সেই প্রশ্নটাই করে বসলাম মানুষটাকে “ কিন্তু একটা সামান্য বই এর অর্ডার নিয়ে এত চিন্তিত কেন হচ্ছ তুষার দা ?”
একটু চুপ হয়ে থেকে ড্রয়ার খুলে একটা পুরনো ডায়েরী আমার দিকে এগিয়ে দিল মানুষটা ।
-এটা কি তুষার দা ?
-তুই যে প্রশ্নটা করলি তার জবাব । আমার মনে হয়না এর উত্তর এর থেকে ভাল আর কেউ তোকে দিতে পারবে! নিয়ে যা আজ ডায়েরিটা, ভাল করে পড়। কাল এসে আমাকে জানাস তোর প্রশ্নের উত্তর পেয়েছিস কিনা।“
-কিন্তু ডায়েরীটা কার তুষারদা? তোমার ?
-নাহ। আমাদেরই একজন পুরোনো স্টাফ রাজীবের। আমাদের সব্বার খুব আদরের ছিল রে ছেলেটা। ভীষণ সরল
আর ততটাই প্রানবন্ত। বড্ড মায়া পড়ে গেছিল ছেলেটার উপরে।“
-কিন্তু এখন কোথায় ও? আমি তো কোনদিন দেখিনি ওকে এই অফিসে।
একটা বিষণ্ণ হাসি হাসি মুখে মেখে বলে উঠল তুষারদা “ও এখন আর আমাদের সাথে এখানে কাজ করেনা রে। তুই ডায়েরীটা নিয়ে যা আজ, পড়ে দেখ। কাল তোর যা প্রশ্ন আছে করিস আমায়। আর হ্যাঁ, যা বললাম মাথায় রাখিস, ভুলেও আর কোনদিন এই অর্ডারটা এপ্রুভ করবিনা, কেমন ?”
মাথা নেড়ে অফিস থেকে বেরিয়ে আসলাম আমি।
সন্ধে বেলা বাড়ি পৌছে ডায়েরীটা হাতে নিয়ে বসলাম, একটা সাধারণ বাদামী রঙ এর মলাট দেওয়া মাঝারি সাইজের ডায়েরী।
সালটা দেখে একটু চমকে গেলাম , আজ থেকে তিন বছর আগের। পাতা গুলো অল্প হলুদ হয়ে এসেছে, সামান্য ধুলো জমেছে মলাটের ফাঁকে।
অলস হাতে মলাটটা উল্টালাম,
অন্য প্রান্তেই একটা অল্প বয়সী ছেলের ছবি সাঁটা, ফর্সা ছিপছিপে গড়ন, মুখে একটা বোকা হাসি । চোখ দুটোতে যেন একরাশ সারল্য মাখা।
অলস হাতে পাতা উল্টিয়ে পড়তে শুরু করলাম
প্রথম তারিখ
১৩ই জুলাই ২০১৫
তুষারদা এই ডায়েরীটা গিফট করেছিল আমাকে, বলেছিল দিনের শেষে সারা দিনের যা যা ঘটলো নিজের মতন করে লিখে রাখবি, এতে নাকি মন থেকে সব ভার নেমে যায়। ডিপ্রেশন টিপ্রেশন আর পাশ মাড়ায়না। তুষারদাও যেমন, ওইসব রোগ শহরের বড় মানুষদের পোষা, আমাদের মতন অজ পাড়াগাঁ থেকে আসা অনাথ ছেলেদের সাথে আর এর কিসের সম্পর্ক!
কিন্তু তুষারদাকে কিছু বলতেও পারিনি, বড্ড স্নেহ করে মানুষটা আমায়। আজ উনি না থাকলে চাকরির খোঁজে এই শহরে কোথায় যে হারিয়ে যেতাম! কিন্তু ডায়েরীতে লেখা আর হয়ে ওঠেনি আমার। এই রোজকার চেনা জীবনে আর কিই বা লিখব।
কিন্তু আজ প্রথমবার কিছু লিখছি, কারণ আজ এমন কিছু ঘটলো যা কিছুতেই আমার মন সহজ সাধারণ বলে মেনে নিতে পারছেনা।
আজ সকালে একটা অর্ডার এসেছিল, আদি গঙ্গার কাছে একটা পুরোন বাড়িতে একটা সুকুমার রচনাবলী বার্থডে গিফট র্যাপ করে পৌছে দিতে হবে। যিনি অর্ডার করেছেন তিনি অনলাইনেই ফুল পেমেন্ট করে দিয়েছেন ইতিমধ্যে।
তুষারদা একটা অদ্ভুত কথা বলল, আমাদের সব থেকে বড় রাইভ্যাল কুরিয়ার কোম্পানি নাকি এই অর্ডারটা রিফিউজ করে ভদ্রলোককে আমাদের রেফারেন্স দিয়েছেন।
শুনে আমিও খুব অবাক হলাম, যারা আমাদের এক একটা অর্ডার কেড়ে নেওয়ার জন্য সবসময় প্রস্তুত তারা হঠাত এইরকম অযাচিত ভাবে আমাদের হাতে অর্ডার তুলে দিল!
আরো একটা আজব ব্যাপার ভদ্রলোক মেইল করে জানিয়েছিলেন বইটা যেন একটা ফাঁকা বাড়িতে গিয়ে রেখে দিয়ে আসি আমি। কারোর হাতে দেবার অথবা সই করিয়ে নেবার কোন প্রয়োজন নেই। এইরকম অদ্ভুত অফার জীবনে কোনদিন পায়নি আমাদের কোম্পানি। কিন্তু যিনি পেমেন্ট করছেন তার যদি কোন সমস্যা না থাকে তাহলে আর আমরা কি বলতে পারি ?
দুপুরের দিকে রওনা দিলাম অর্ডারটা ডেলিভারি করতে। কলকাতার এই প্রান্তে বহুদিন আসিনি, গলি তস্য গলি পার হয়ে এসে পৌছালাম আমার ঠিকানায়।
জায়গাটা বড় অদ্ভুত!
কলকাতার এত কাছে অথচ এত ফাঁকা। একপাশ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে আদি গঙ্গার মজা খাদ। একটু দূরেই এগিয়েই হাই ওয়ে, অথচ চারদিকে আর একটা বাড়িও নেই, একটা ফাঁকা মাঠের মধ্যে যেন একা নিজের অস্তিত্বটুকুর জানান দিয়ে কোনমতে দাঁড়িয়ে আছে পুরনো একতলা বাড়িটা।
ভাঙা জং ধরা গেটটা ঠেলে ভেতরে পা রাখলাম আমি। যেন একটা জীবন্ত কর্কশ শব্দে নিজের জানান দিয়ে খুলে গেল দরজাটা। সদর দরজা থেকে বাড়ির উঠোন অব্দি ছোট্ট পথটা একরাশ শুকনো পাতা দিয়ে মোড়া। মনে হয়না দীর্ঘ দিন কেউ এখানে আদৌ পা রেখেছে। সামনের পুরনো কোল্যাপসিবেল গেটটারও প্রায় একই অবস্থা, আর সব থেকে অবাক কাণ্ড গেটটায় একটা তালা অব্দি মারা নেই।
কিন্তু গেটটা পেরিয়ে ভেতরে পা রাখার পরেই হঠাৎ কেমন যেন একটা অদ্ভুত ফীল হতে লাগল আমার , মনে হল কেউ যেন আমার দিকে তাকিয়ে আছে, এক দৃষ্টিতে!
খুব গভীর ভাবে সে আমাকে লক্ষ্য করছে। জানিনা কেন কিন্তু আমার খুব খুব ভয় করছিল, মনে হচ্ছিল কিছু যেন আটকে আছে এই পোড়ো ভাঙা বাড়িটায়। কিসের যে টান বলতে পারবনা কিন্তু আমার যেন ভীষণ ইচ্ছে করছিল বাড়িটার ভেতরে ঢোকার, কিন্তু আবার একইসাথে কি একটা অদ্ভুত ভয়ও যেন আমার বুকের মধ্যেটাকে অবশ করে দিচ্ছিল।
ভেতরে ঢোকার জন্য পা বাড়াতে গেলাম, কিন্তু হঠাৎ আমার মনের ভেতর থেকে যেন ভেসে এল কারোর স্বর “চলে যা এখান থেকে, এ জায়গা ভাল নয়। বাঁচতে চাইলে পালা, আর দেরি করিসনা, পালিয়ে যা”
একটা হিমশীতল ভয়ের অনুভূতি আমার মেরুদণ্ড দিয়ে যেন একটু একটু করে নেমে যাচ্ছে , বইটা বারান্দায় ছুড়ে ফেলে দিয়ে প্রায় একছুটে বাইরে বেরিয়ে এলাম আমি!
কিন্তু কেন এতটা ভয় পেয়েছিলাম আমি? না, তার উত্তর সত্যি আমার কাছে নেই?
“চেয়েনাকো আগে পিছে, যেয়োনাকো ডাইনে-
সাবধানে বাঁচে লোকে,- এই লেখে আইনে”
এতটা পড়ে অবাক হয়ে ডায়েরীটা নামিয়ে রাখলাম আমি, কি বলতে চেয়েছে রাজীব? কি আছে ওই বাড়িটায়? অকারণে এত ভয় সেদিন কেন পেয়েছিল ছেলেটা?
আর শেষের এই লাইনটা? হঠাত করে একটা কবিতার লাইন কেন লেখার মাঝে জুড়ে দিয়েছিল রাজীব?
আর অপেক্ষা করা যেন অসম্ভব হয়ে উঠছে আমার কাছে , আবার ডায়েরীটা নিয়ে পড়তে শুরু করলাম।
তেরই জুলাই এর পর অনেকগুলো পাতায় তেমন কোন বিশেষ এন্ট্রি নেই।
এক জায়গায় হঠাত লেখা “ রাতে ঘুমের মাঝেও বাড়িটা কেন জানিনা ভেসে ওঠে আমার দুচোখের সামনে ? কি আছে বাড়িটায় ? আর আমি সত্যি কি সেদিন ভয় পেয়েছিলাম নাকি সবটাই আমার মনের ভুল?
“কতই ভাবি এসব কথা, জবাব দেবার মানুষ কই?”
বেশ কয়েকটা পাতা ছেড়ে আবার একজায়গায় লেখা
“রোজকারের এই কাজ করতে আর ভাল লাগেনা। কি পড়ে আছে এই কাজের মাঝে? না কোন নতুন স্বাদ আর না জীবনের কোন নিয়ম ভাঙার পালা? আমার ইচ্ছে করে রাস্তা দিয়ে প্রানখুলে চীৎকার করতে করতে ধূলো উড়িয়ে ছুটে যেতে। গঙ্গার বুকে দৌড়ে ঝাঁপ দিতে, বৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে সারা শরীর ভিজিয়ে প্রান খুলে গান গাইতে!
তার বদলে এ কিসের জীবন? এখন আর কাজে মন দিতেও ভাল লাগেনা। তুষার দার কথা ফেলতে পারিনা তাই নইলে…। কিন্তু আর বেশি দিন নয় , এই হুকোমুকো হ্যাংলা হয়ে আমি আর রইবনা, ঠিক তোমাকে ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে যাব , দেখে নিও তুষারদা। চন্দ্রবিন্দুর চ, বেরালের তালব্য শ আর রুমালের মা বুঝলে, হুউউউউ”
“আয় খ্যাপা-মন ঘুচিয়ে বাঁধন, জাগিয়ে নাচন তাধিন ধিন,
আয় বেয়াড়া সৃষ্টিছাড়া, নিয়মহারা হিসাবহীন।
আজগুবি চাল বেঠিক বেতাল, মাতবি মাতাল রঙ্গেতে-
আয়রে তবে ভুলের ভবে, অসম্ভবের ছন্দেতে।“
একটা অজানা আতঙ্ক আমার শিরদাঁড়া দিয়ে নেমে এল, যে কবিতাটা পড়ে ছোটবেলা থেকে মজা ছাড়া আর কোন অন্য ফীল হয়নি, সেটা পড়ে যে এইরকম ভয়ের অনুভূতি হতে পারে কোনদিনও ভাবিনি!
পাতা উল্টিয়ে এগিয়ে গেলাম , পরের এন্ট্রিটা দেখে এবার চমকে উঠলাম
“১২ই জুলাই, ২০১৬
আজ আবার এসেছে সেই অর্ডারটা, ওই একই বই । আমি, আমি যাবো ওটা নিয়ে, আর কাউকে যেতে দেবনা। তুষারদা শুধু শুধু বারণ করছিল, কেন আমি গেলে ক্ষতি কি ?
আমি ছাড়া আর কেউ যাবে কেন ওটা নিয়ে ? শিবঠাকুরের আপন দেশের আইন পেয়েছে নাকি? আমিই কাল আবার যাব ওটা নিয়ে। আমি শুধু জানিই ওর ডাক, আর কেউ কিচ্ছু জানেনা।“
“কেউ জানেনা এসব কথা, কেউ বোঝেনা কিছু
কেউ ঘোরেনা আমার মত ছায়ার পিছাপিছু।“
১৩ই জুলাই, ২০১৬
আজ আবার এসেছিলাম ওই বইটা নিয়ে, সেই এক অনুভূতি, সেই এক ডাক । কেউ কেউ নিশ্চয় আছে ওখানে, জানি, আমি জানি, মন প্রাণ দিয়ে অনুভব করেছি তাকে। আজ বারান্দা পেরিয়ে ভেতরে ঢুকেছিলাম । ভেতরের বড় ঘরটায় একটা বড় চৌকি, একটা পুরোন ট্রাঙ্ক আর একটা ভাঙা টিভি ছাড়া আর কিচ্ছু পড়ে নেই। কিন্তু…..
ঘরটার মধ্যে দিয়েই আর একটা দরজা, পাশের আর একটা ঘর যাবার পথ। কিন্তু এই একটা মাত্র ঘরের দরজায় তালা মারা। পুরোন আমলের জং ধরা একটা ভারি তালা, দরজার হুড়কোও প্রায় খুলে এসেছে। একটু চেষ্টা করলেই তালা ভেঙে ঘরে ঢোকা যেত!
জানিনা কেন, কিন্তু ওই ঘরটা যেন আমাকে দুহাত বাড়িয়ে শুধু নিজের দিকে ডাকছিল, আমি যেন পাগল হয়ে যাচ্ছিলাম আজ ওই ডাক শুনে, একটানে হুড়কোটা প্রায় খুলেই ফেলেছিলাম কিন্তু তখনই ফোনটা বেজে উঠল। অফিস থেকে আর্জেন্ট কল। তুষারদা ডেকে পাঠিয়েছে আমায়।
সব ফেলে ফিরে আসতে হলো আমায়!
কিন্তু কেন ফিরে এলাম কেন ?
আমি আবার আবার ফিরে যাব ওখানে। যেভাবেই হোক আমাকে ফিরতেই হবে ওই নয় নম্বর আদি গঙ্গা রোডে।“
এরপর শুধু একটা দীর্ঘ বিরতি, আর তারপরের লেখা প্রায় ছয় মাস পর
১০ই জানুয়ারী, ২০১৭
“এই নিয়ে আজ তিনবার গেলাম ওই নয় নম্বরে, কিন্তু সেই অনুভূতিটা আর ধরা দিচ্ছেনা!
কিন্তু কেন কেন ? বাড়িটার চারপাশে ঘোরাফেরা করলাম এতবার , কিন্তু ঢোকার ইচ্ছেটুকুও আর হলোনা। তবে কি শুধু ঐ দিনেই ?……
পরের এন্ট্রি থেকে আবার চমকে উঠলাম আমি
১২ই জুলাই ২০১৭
আমি কালকে ওখানে যাবোইইইইই। যেভাবেই হোক। তুষার দা কেন আমায় না করছে? হতে পারে আমি শেষ কয়েকমাস ঠিকঠাক কাজ করিনি। কিন্তু তার মানে আমার জিনিস কেউ এইভাবে কেড়ে নেবে ? কে তুষার দা আমাকে না করার? কাল আমি যাবোই যেভাবেই হোক, কাল কালই ওই ঘরটাতে আমায় ঢুকতে হবে! দেখি কে আমাকে আটকায় ?
“আয় যেখানে খ্যাপার গানে নাইকো মানে নাইকো সুর।
আয়রে যেথায় উধাও হাওয়ায় মন ভেসে যায় কোন সুদূর।।“
এরপর আর কোণ এন্ট্রি নেই, শুধু পরের একটা পাতা ছেঁড়া। ব্যস।
কী? কী হয়েছিল এরপর ? সত্যি কি রাজীব গিয়েছিল ওই বাড়িটাতে আবার ? কি হয়েছিল সেখানে ?
কাঁপা হাতে তুষারদার নম্বরটা ডায়াল করলাম, না ফোন সুইচড অফ। ইচ্ছে করেই কি ফোন অফ করে রেখেছে তুষারদা?
কাল , কাল সকালে সবার আগে অফিসে গিয়ে আমি জিজ্ঞেস করবো তাকে, যেভাবেই হোক সত্যিটা আমাকে জানতেই হবে।
পরের দিন সাতসকালে অফিসে গিয়ে সবার আগে ঢুকলাম তুষারদার কেবিনে। স্থির দৃষ্টিতে আমার মুখের দিকে কিছু সময়ের জন্য তাকিয়ে থেকে একটা ভারি স্বরে বলে উঠলেন মানুষটা।
-পড়েছিস মনে হচ্ছে ডায়েরীটা?
– “হ্যাঁ পড়েছি, কিন্তু তারপর তুষার দা ?
রাজীব কোথায় এখন ? কি হয়েছিল ওর সাথে ? আর ডায়েরীর এই শেষ পাতাটা? এটা ছেঁড়া কেন ? বলো আমাকে প্লীজ ।“
একটা গভীর দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বলে উঠলেন মানুষটা “ আগের বছর যখন রাজীব জোর করে অর্ডারটা নিয়ে গেল, তখন সত্যিই আমি ভীষণ চিন্তায় পড়ে গেছিলাম। আগের সেই কাজ পাগল সরল ছেলেটা এই শেষ দুবছরে যেন পুরো বদলে গেছিল। একটা অদ্ভুত খ্যাপামো দিন দিন ওকে একটু একটু করে গ্রাস করে নিচ্ছিল। অনেক বোঝানোর চেষ্টা করেছিলাম ওকে , কিন্তু কোন কথা বোঝা তো দূরস্ত, আদৌ শুনতো কিনা সেটাই বোঝা যেতনা।
অন্য কেউ হলে হয়ত ছাড়িয়েই দিতাম কাজ থেকে কিন্তু রাজীব বলেই পারিনি। এই সরল ছেলেটাকে যেন বড্ড ভালবেসে ফেলেছিলাম রে। একটা অবুঝ ছোটভাই ছাড়া আর কিছু মনে হতোনা ওকে।
তাই আগের বছর যখন ও আবার জোর করে বেরোল , কেন জানিনা মনটা ভীষন কু ডেকে উঠল। কি করব সত্যি বুঝতে পারছিলামনা। জানিনা কি ভেবে সেই আগের কুরিয়ার কোম্পানিকে ফোন করলাম, সরাসরি জানতে চাইলাম কেন হঠাত করে ওরা ওদের অর্ডার আমাদের হাতে তুলে দিয়েছিল?
প্রথমে কিছু বলতে চাইনি, কিন্তু পড়ে জোর করাতে যা শুনলাম!
বিশ্বাস কর আমার সারা শরীর আতঙ্কে কেঁপে উঠেছিল!”
আমি আর থাকতে পারলামনা, ভাঙা স্বরে কোণমতে বলে উঠলাম “এমন কি শুনেছিলে তুষার দা ?”
একটু দম নিয়ে আবার বলে উঠেছিল মানুষটা “ওদের যে ছেলেটা এই অর্ডার নিয়ে গেছিল সে ফেরার পথেই ট্রাক চাপা পড়ে মারা যায় রে সুমন। সবাই জানে অ্যাক্সিডেন্ট কিন্তু প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে বাদল হাসতে হাসতে ট্রাকের সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল। আর মুখে শুধু একটা লাইন আবৃত্তি করে যাচ্ছিল
“কোথায় বাড়ি কেউ জানেনা, কোন সড়কের মোড়ে,
একলা পেলে জোর করে ভাই গল্প শোনায় পড়ে।
বিদঘুটে তার গল্পগুলো না জানি কোন দেশী,
শুনলে পরে হাসির চেয়ে কান্না আসে বেশি।
না আছে তার মুণ্ডু মাথা , না আছে তার মানে ,
তবুও তোমায় হাসতে হবে তাকিয়ে বুড়োর পানে।“
স্থির দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে বলে উঠল তুষারদা “রাজীব এর ডায়েরীতে লেখা কবিতা গুলো পড়েছিস নিশ্চয়। অথচ জানিস প্রথমবার সুকুমার রচনাবলী নিয়ে ওই বাড়িটাতে যাবার আগে সুকুমার রায় কি কোন কবির কোন কবিতাই কোনদিন ওর মুখে শুনিনি আমি। “
আর এক মুহূর্ত দেরী না করে সোজা আমার বাইকে করে ছুটে গেছিলাম ওই পুরোন বাড়িটাতে।
যখন গিয়ে পৌছালাম দেখলাম রাজীব ভেতরের একটা ঘরের চৌকির পাশে বসে ওর ডায়েরিটা আপন মনে কি যেন এঁকে যাচ্ছে, পিছনের একটা ঘরের হুড়কো ভাঙা। দরজাটা অল্প খোলা, যেন কেউ সবে ঢুকে আবার এক নিমেষে ছুটে বাইরে বেরিয়ে এসেছে।
ওকে ডাকলাম আমি, ছেলেটা মুখ তুলে তাকালো আমার দিকে। সুমন বিশ্বাস কর, আমি জীবনে এত ভয় কখন কোন কিছু দেখে পাইনি রে । রাজীবের চোখ দুটো ওর ছিল, কিন্তু দৃষ্টি?
এই দৃষ্টি রাজীবের নয়। রাজীবের কি? এই দৃষ্টি কোন মানুষের হতে পারেনা , ওই পাগলাটে খ্যাপা দৃষ্টি আমি আমার সারা জীবনে ভুলতে পারবোনা রে ভাই।
একটা অদ্ভুত স্বরে হো হো করে হেসে উঠে বলে উঠেছিল ছেলেটা
“মাতবি মাতাল রঙ্গেতে”
তারপর ইশারা করে আমাকে ঘরটার ভেতরে ঢুকতে বলল।
দূর থেকে যেটুকু দেখতে পেয়েছিলাম ঘরটায় শুধু একটা ছোট্ট পড়ার টেবিল আর চেয়ার পাতা, আর কিছু বইয়ের পাতা এলোমেলো ভাবে ছড়িয়ে আছে মেঝেতে।
সবে এক পা এগিয়েছিলাম কি এগোইনি। আচমকা কেউ যেন পেছন থেকে টেনে ধরল আমায়, ফিরে দেখলাম কাতর মুখে আমার জামা ধরে পিছন দিকে টানছে রাজীব!
সেই পুরোন মুখ, যে মুখ আমি শেষবার দেখেছিলাম আজ থেকে দুবছর আগে !
সব সব খ্যাপামো যেন এক নিমেষে মুছে গেছে ওর মুখ থেকে, কিচ্ছু বলেনি ছেলেটা। মনে হচ্ছিল যেন বহু চেষ্টা করেও মুখে কিচ্ছু উচ্চারণ করতে পারছেনা ও, কেউ ওকে কিছু বলতে দিচ্ছেনা কিন্তু ওর চোখের দৃষ্টি বুঝতে আমার অসুবিধে হয়নি রে।
ওর দুই কাতর চোখ দিয়ে শুধু একটাই কথা বলছিল ছেলেটা “যেয়োনা দাদা, দোহাই তোমার ওর ভেতরে যেয়োনা।“
ওর দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলাম আমি, কিন্তু হঠাৎ ছেলেটা এক দৌড়ে ঘরের বাইরে বেরিয়ে এলো, আমি ওর পেছন পেছন ছুটে বেড়িয়ে এলাম বাড়িটা থেকে ।
পেছনের হাই ওয়েতে গিয়ে দাঁড়াল ছেলেটা। আমার দিকে একবারের জন্য ফিরে তাকালো ,আবার আবার সেই পাগলাটে খ্যাপামি যেন ফিরে এসেছে ওর মুখে!
একটা অদ্ভুত হাসি হেসে আবৃত্তি করে উঠেছিল
“আজগুবি চাল বেঠিক বেতাল , মাতবি মাতাল রঙ্গেতে-
আয়রে তবে ভুলের ভবে , অসম্ভবের ছন্দেতে।“
আমি আর কিছু বলার আগেই সামনের এগিয়ে আসা একটা টাটা সুমোর সামনে হঠাৎ গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছিল ছেলেটা। ড্রাইভার আর শেষ মুহূর্তে টাল সামলাতে পারেনি। রাজীব…।।
অস্ফুট স্বরে বলে উঠলাম আমি “তুষারদা…?”
একটা ম্লান হাসি হেসে বলে উঠলেন মানুষটি “হ্যাঁ রে, ও সেইদিনই আমাদের সবাইকে ছেড়ে চিরদিনের মতন সেই অসম্ভবের ছন্দের খোঁজে হারিয়ে গেছে।“
কিছু বলার ভাষা যেন হারিয়ে ফেললাম, শুধু একদৃষ্টিতে সামনের চেয়ার বসে থাকা মানুষটার দিকে তাকিয়ে থাকি আমি।
কতটা নীরব সময়ের দুজনের মাঝে কেটে গেল জানিনা, কিন্তু শেষ অব্দি ভাঙা স্বরে কোনমতে বলে উঠলাম আমি
“ ওই ঘরটাতে তুমি আর কোনদিন গেছ ? কি ছিল ওখানে ?”
ম্লান স্বরে বলে উঠল মানুষটা “না রে , না আমি এরপর কোনদিন ওখানে গেছি, না আর কাউকে যেতে দিয়েছি। কিন্তু“
-কিন্তু কি তুষার দা ।“
নীরবে ড্রয়ারটা খুলে একটা পুরোন ডায়েরীর ভাঁজ করে রাখা পাতা আমার সামনে রাখল তুষারদা।
-রাজীবের ডায়েরীর শেষ ছেঁড়া পাতাটা। যখন আমি ওকে আনতে ওই বাড়িতে গেছিলাম তখন পাতাটাতে এই ছবিটা আঁকছিল ও।“
কাঁপা কাঁপা হাতে ছবিটা খুলে দেখলাম আমি, আর তারপরেই একটা তীব্র আর্তনাদ আবার গলা চিরে বেরিয়ে এলো।
ছবিটা একটা ঘরের কিন্তু অসম্পুর্ণ। ছবিতে দেখা যাচ্ছে একটা ছোট্ট পড়ার টেবিলের সামনে পাতা আছে একটা চেয়ার, কয়েকটা বইএর পাতা এলোমেলো ভাবা ছড়ানো ছিটানো রয়েছে,
কিন্তু ও, ওকীইইইই?
বাকি পাতাটিতে ছেলেটি শুধুই কালি লেপে গেছে, কি বোঝাতে চেয়েছে ও? অন্ধকার নাকি …।
…………………………………………………………..(সমাপ্ত)……………………………………………………….