টানাপোড়েন

টানাপোড়েন

কুয়োকাটার জেলে আবুল হাশেমের করোটিতে যে-কোনো অবসরে একটি চমৎকার রঙিন মাছ সাদা পাখনা মেলে ভেসে বেড়ায়। ছাই রঙের শরীরে রূপালি বুটি–কী অপরূপ ভঙ্গি—মুখের দু’পাশে লাল রঙের দুটি দাঁড়া। তখন হাশেমের মাথায় সাগরের ঢেউ–ঢেউয়ের মাথায় মাছ। নাচতে নাচতে ছুটে আসছে তটরেখায়–সৈকতের কাছাকাছি এখন আকাশজুড়ে লাল মেঘ–সূর্য নরম আলো ছড়িয়ে ড়ুবে যাচ্ছে। তখন রঙিন মাছ হাশেমের স্বপ্নের মধ্যে লাল দাঁড়া বিস্তৃত করে। আঁকিবুকি রেখায় ভরে যায় করোটি। আবুল হাশেমের ভাবনা গাঢ় হয়। ভাবে, জীবনের এই একাকিত্বের শূন্যতা প্রকৃতি ভরিয়ে দেয় বলেই ওর স্বপ্নে এমন রঙিন মাছের আনাগোনা। ওর অবসরের কোনো নির্দিষ্ট সময় নেই। গভীর সমুদ্রে ট্রলারে বসে মাছভর্তি জাল টানার মুহূর্তেও ও ক্ষণিকের জন্য অবসরে চলে যেতে পারে। আনমনে নিজেকে গভীর উপলব্ধির মধ্যে ছেড়ে দিতে পারাটাই ওর অবসর। মহাজনকে মাছের হিসাব বুঝিয়ে দেওয়ার ফাঁকেও ও অবসর ভোগ করে। জাল মেলে দিয়ে ঘরে ফেরার সময়টাতো ওর সবটুকু অবসর। ওর মনে হয় ওর একাকিত্বই অবসর। এবং তাকে কেন্দ্র করে রঙিন মাছের খেলা। এ খেলা এক অদৃশ্য সুতোর খেলা–নিজের সঙ্গে নিজের এক্কাদোক্কা। একজন জেলের এমন জীবন হবার কথা নয়, তবু হয়েছে। কারণ মাছ ধরা ওর পেশা নয়, নেশা–সাগর ওর রক্তের হাতছানি। জীবন তো ওর ধানি জমিতে বাঁধা আছে, বছরের খোরাক হয়ে যায় সে জমি থেকে। তবু মাটি ওর বন্ধন নয়, বন্ধন সাগর। এই বন্ধন নাড়ির পরতে পরতে–কোথায় এর শুরু, কোথায় শেষ তা বলতে পারে না। শুধু অনুভব করে, এই না বুঝে ওঠাটাই ওর কাছে খেলা।

আবুল হাশেম এই সাগরের কাছাকাছি থাকার জীবনের জন্য নির্জন অবসরে ওর পূর্ব পুরুষের কাছে কৃতজ্ঞতা জানায়। জানানোর ভঙ্গিটি দারুণ। কারণ তখন ও শুদ্ধ ভাষায় কথা বলে–যেহেতু সেই কথাটি ওর মুখের নয়, কথাটি চৈতন্যের–তখন ও অন্য মানুষ হয়ে যায় এবং পরিষ্কার ভাষায় বলে, তোমার কাছে আমার ঋণ শোধ করবার নয়। এও ওর কাছে সেই অদৃশ্য সুতোর খেলা। টানানো সুতোর ওপর উঠে আসে সেই মানুষটি, যার কাছে ও কৃতজ্ঞ, যে শ্বশুরের সম্পত্তির লোভে ঘরজামাই হয়ে রাঙাবালি থেকে এই কুয়োকাটায় চলে এসেছিল। লোকটি কোনোদিন সম্পত্তির মালিক হতে পারেনি–শ্বশুর তাকে বিশ্বাস করেনি। মৃত্যুর আগে সব সম্পত্তি একমাত্র মেয়ের নামে লিখে দিয়েছিল। সব সম্পত্তির মালিক বউ থাকলেও, এ নিয়ে মাথা ঘামায়নি ও। ধরে নিয়েছিল যেহেতু সে নিজের স্ত্রীর আলিক, অতএব তার সম্পত্তিরও মালিক, এই বোধেই সে রগরগে থাকত–সম্পত্তির ভোগদখলদারিতে সিদ্ধহস্ত ছিল। বউ তার দাবড়ানোর চোটে কোনোদিন মুখ খুলতে পারেনি। আবুল হাশেমের বাবা ছিল বাপের একমাত্র ছেলে। সেই সূত্রে মায়ের সম্পত্তির উত্তরাধিকার হয়েছিল। এখন সে সম্পত্তি আবুল হাশেমের দখলে।

ওর বাপ-দাদা ওকে যে জীবনযাপনের সুযোগ দিয়েছে, সে সুযোগ নিয়ে এখন ওর রাতদিনের খুনসুটি–আবুল হাশেম উদ্দেশ্যহীন হাঁটতে থাকে–নিশিপাওয়া লোকের মতো সে হাঁটা। কখনো কেউ ওর পাশ দিয়ে যাবার সময় সালাম দিলে ও উত্তর দেয় না, অর্থাৎ শুনতে পায় না–অর্থাৎ আনমনা থাকে বলে খেয়াল করে না। ভাবনা ওকে বধির করে ফেলে।

জংলা পথটুকু পেরিয়ে এখানে দাঁড়ালে স্পষ্ট দেখা যায় সাগরের পানি তোলপাড় করে। হাশেম নিজেও বুঝতে পারে না যে এই পানির তোলপাড় দেখতে ও এখানে আসে কি না। তোলপাড়ের ভেতরে একটা গম্ভীর ডাক আছে, একটা গাঢ় ছায়া আছে কিংবা কঠিন শব্দ আছে। সবকিছুই হাশেমের নিজস্ব। কত বছর ধরেই তো এভাবেই চলে যাচ্ছে। ও হেঁটে আসে, দু’হাতে গাছের ডাল সরায়। উঁচু ঢিবির ওপর বসে। বসলে দেখতে পায় পানির তোলপাড় কালচে সবুজ হয়ে যায়–দূর থেকে ছুটে এসে গড়িয়ে যাওয়াটা মনে হয় এক ধরনের পাগলামি–যে পাগলামি বুকের ভেতর অনবরত দপদপায়। তখন চরাচরে জ্যোৎস্না–গোল চাদ মাথার ওপর নেমে আসে–শূন্য প্রান্তর বিস্তৃত হতে থাকে–তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে গোল চাদ বাড়ে–যেন এত বড় চাঁদ পৃথিবীর কোথাও আর হয় না। ঘোর পূর্ণিমা আবুল হাশেমের আচ্ছন্নতা বাড়িয়ে দেয়। ও দিগন্তে চোখ ফেললে দেখতে পায় নিরল শূন্যতা। পেছনে তাকালে গাছের মাথাগুলো জমাট বেঁধে থাকে, সে মাথায় অন্ধকার–অন্ধকারের মধ্যে মানুষের গুঞ্জন। সে গুঞ্জন ভেদ করে উঠে আসতে থাকে রঙিন মাছ। আঁক-বাঁধা মাছের সারি বিন্দুর মতো স্থির হয়ে যায় পূর্ণিমায়–ভরা যুবতী চাদের কাছে–সে চাদ আবুল হাশেমের বিচিত্র শব্দভরা করোটির ভেতর রঙিন মাছসহ প্রবেশ করে। মুহূর্তে ওর চেতনার চরাচর আলোকিত হয়ে যায়।

আবুল হাশেম সৈকতে নেমে আসে। সেখানে হাটুজল, সে জলে লবণ নেই, সেখানে মিঠে-পানির মাছের নির্বাস। সৈকতে টুকরো টুকরো জলাশয়–অজস্র, অসংখ্য। ওর পেছনে হাজার হাজার মোষের সারি, ওরা ঘরে ফিরছে। খুরের চাপে বালুর মধ্যে ছোট ছোট গর্ত হচ্ছে। আবুল হাশেম বালকের মতো সেই গর্তগুলো পা দিয়ে ভরিয়ে দেওয়ার খেলায় মাতে। জোয়ার আসে। এখন জোয়ারের সময়। এ সময়েই ছাই রঙের মাছ আবুল হাশেমকে সোনালি দিগন্তে নিয়ে যায়। ও তখন জেলে থাকে না–একজন রূপকথার রাজকুমার হয়। ওর ট্র্যাকের বিড়ি উঠে আসে ঠোঁটে। দিয়াশলাইর বারুদ জ্বলে ওঠে। মোষের পায়ের গর্তগুলো সব মুছে দেয় ও ভাবে, এখনই আমার যৌবনের সময়। সব গর্ত মুছে গিয়ে সমান হয়ে যাক দিনগুলো। মোষ ঘরে ফিরলে আমরা মোষ দুইয়ে মাটির পাতিলে ঘন দই বানাবো। তারপর দইয়ের ভাঁড় নিয়ে চলে যাব হাটে। সেই দই নীলগঞ্জ নদী দিয়ে চলে যাবে দূরে–অনেক দূরের মানুষের কাছে। সেই সব মানুষেরা জানবে না, একজন স্বাপ্নিক আবুল হাশেম মোষের ঘন দুধের দই বানিয়ে বেসাতি করে–তার দই শুধুই দই নয়–তা শুধু গলনালী বেয়ে পেটে যায় না, সেটা মগজেও পৌঁছে। সেই দই খেলে মানুষ স্বপ্ন দেখে, স্বাপ্নিক হয়ে ওঠে। ও সব মানুষের ভেতর স্বপ্নের ছড়াছড়ি দেখতে চায়–স্বপ্ন দেখতে শিখলে মানুষ দুঃখ ভোলে।

ভাবতে ভাবতে অন্ধকারে হেসে ওঠে আবুল হাশেম। না, ঠিক অন্ধকার নয়, বিশাল গোল চাঁদের দিগন্ত জোড়া পূর্ণিমা থাকলে অন্ধকার হয় কী করে? হওয়া উচিত নয়। হওয়া ঠিক নয়। তবু হয়। কারণ অন্ধকার তো শুধু নিজের মন নয়, অন্ধকার প্রকৃতিতেও। ওর বামের বিশাল সমুদ্রটি অন্ধকার–ভীষণ, ভয়াল। ওর মনে হয় ওখানে পূর্ণিমার আলো পৌঁছায়নি, হয়তো কখনোই পৌঁছায় না। সেজন্য কখনো অকস্মাৎ ওটা বিশাল ভয়ংকর হয়ে ওঠে। আবুল হাশেমের ডানে বনরাজি–সেখানে গাছের ছায়া–ছায়ার ঘনত্ব আছে–সেই ঘনত্ব হাঙরের পাখনার মতো ত্রিকোণাকৃতি, সেখানে আবুল হাশেম ইচ্ছে করলেই যেতে পারে না। ওর ভয় লাগে–ভয়ে বুক কুঁকড়ে যায়। এছাড়া ওর সামনে এবং পেছনে আলো–অপরূপ আলো–কুয়াকাটার পূর্ণিমার এই আলোটুকু একদম ওর একার। এই আলো বুকে নিয়ে ওর বয়স এখন বাহাত্তর। লোকে বলে, বাহাত্তরে বুড়া। ওরা ওর নাম প্রায় ভুলেই গেছে। তাতে ওর কোনো দুঃখ নেই। ও ভাবে, নামে কী এসে যায়। মানুষ ওকে চিনলেইতো হয়। মানুষের সঙ্গেই তো মানুষের সব যোগাযোগ–নামের কথা ভেবে মানুষকে কি দূরে ঠেলে রাখা যায়?

হাটের দিন এলেই ওর চিত্ত চঞ্চল হয়ে ওঠে। হাটের দিনে ও মানুষের গায়ের গন্ধ পায়। সে ঘ্রাণ ওর মগ্ন চৈতন্য আলোকিত করে। আবুল হাশেম বিচিত্র পসরা নিয়ে বসে থাকা দোকানির সঙ্গে অন্তরঙ্গ হবার চেষ্টা করে। জিনিস কিনুক আর না কিনুক, সবার কাছে ও যায়। দু’দণ্ড দাঁড়িয়ে কথা বলে, কিছু উপদেশ দেয় কিংবা ব্যক্তিগত কথাবার্তা বলে, কোথাও বা কথা বলার ফুরসত হয় না। দোকানি ব্যস্ত থাকে। আবুল হাশেমের মন খারাপ হয় না। চোখাচোখি হলেও মনে করে অনেক কথা হয়েছে। এই সব মানুষেরা সাগর এবং গাছের মতো। অন্ধকার এবং ছায়া আছে ওদের। বাড়তি আকর্ষণ ঘ্রাণ। সেটা অনেক মানুষ এক জায়গায় হলে টের পাওয়া যায়। নইলে সে ঘ্রাণ ঘন হয় না। ঘন না হলে তা আবুল হাশেমের ইন্দ্রিয় স্পর্শ করে না। মানুষকে ও বড়োমাপেই দেখে। মানুষকে ও মাছি বানায় না–মাছি বানাতে খারাপ লাগে–মানুষের অন্ধকার ও দূরে রেখে দেয়–মানুষের ছায়াটুকু কাছে রাখে–খুব কাছে, একদম বুকের কাছাকাছি।

হাটের দিন এলেই মানুষের মাথার ওপর দিয়ে ঢেউ বয়ে যেতে দেখে। এই দেখা ওর বাড়তি আনন্দ। সবকিছুর ভেতরে থেকে পালিয়ে যাওয়ার আনন্দ। নিজের এইসব অনুভবগুলো আবুল হাশেমের কাছে ভীষণ দামী।

একদিন চৈতালি হাটে জমজমাট কবিগান বসেছিল। সেদিন গায়েনের সঙ্গে ধুয়া ধরে নেচেছিল। বলেছিল, ‘বাহাত্তরে বুড়া মুই, গায়েন তুই মোর পরানের সই।’ কেন এমন একটি কথা ওর মনে হয়েছিল ও তা জানে না। ওর বয়স বাহাত্তর না আরো বেশি নাকি আরো কম সেটাও ওর জানা নেই। ও পরে অনেক ভেবে দেখেছে যে ওর নিজের কবি হওয়ার বাসনা হয়েছিল। ওর ভেতরে কোনো কামনা জন্মালে রঙিন মাছটা প্রবল হয়ে ওঠে। তখন ও নিজেকে স্থির রাখতে পারে না। একটা কিছু করতে না পারার তাড়নায় ওর শরীর কাঁপতে থাকে। সে কাঁপুনি দৃষ্টিগ্রাহ্য নয়, অদৃশ্য। যাহোক সেই থেকে ও লোকের মুখে মুখে বাহাত্তুরে বুড়া হয়ে গেল। ক্ষতি কি? না, কোনো ক্ষতি নেই। ওর ভালোই লাগে। লোকে ওর নাম ভুলে যাওয়ার অর্থ তো ওর আর একটা জন্ম। আবুল হাশেম নতুন জন্মের চিন্তায় আনমনা হয়ে যায়।

ওর তো এখন সেই নতুন জন্মের রেশ চলছে। ও নিজে একটা নাটাইয়ের সুতো ধরে রেখেছে–নাটাইটা গড়াচ্ছে–আর সুতো ছড়িয়ে যাচ্ছে, কী চমৎকার রঙিন সুতো। সেই সুতো ওর জন্য নকশা বানায়–সেই নকশায় পা রাখলে ওর স্বপ্ন প্রবল হয়ে ওঠে। কয়েক বছর আগে এক গহীন অন্ধকার রাতে প্রবল জলোচ্ছ্বাসে ওর এক জীবনের সবকিছু ধুয়েমুছে গেছে। তারপর আবার শুরু–আবার স্বপ্নের ভেতর দিয়ে হেঁটে যাওয়া। এখন কি ওর সময় হয়েছে এই নতুন জীবন গড়বে, যাকে মানুষ নির্মাণ বলে? মেন ঘর গড়া যায়–যে গড়া বস্তু দিয়ে কিংবা মানুষ দিয়ে? ঘরের ভিটি বাঁধা হয়, বেড়া লাগানো হয়, ছনের চাল ওঠে–চাল ছেয়ে দেয় ঘরামি আরো কিছু মানুষ লাগে ঘর গড়তে–অন্তত একজন মানুষ–তারপর মানুষ বাড়ে এক থেকে দুই–দুই থেকে পাঁচ। জন্মের বেড়ে ওঠা তো এমনই। ওই বেড়ে ওঠায় গড়ার আনন্দ থাকে, সুখের কাপন থাকে।

তখন ওর রাহনুমের কথা মনে হয়। ভাবে, এখন কাথার নিচে রাহানুম ঘুমিয়ে আছে হয়তো। নিঃশ্বাসে ওর বুক কাঁপছে, মৃদু ওঠানামা। ওর নাকের বাঁশি ফুলছে আর কমছে। ঠোঁটজোড়ায় অদ্ভুত টান, জিভ দিয়ে চাটলে চমৎকার ভিজে থাকে। ওর নিমীলিত চোখের পাতায় গভীর কালো রেখা–যখন চোখজোড়া খোলা থাকে, চোখের তারায় ভাষা ফুটে ওঠে, ওহ! আবুল হাশেম বড়ো বেশি নিঃশব্দে নিজেকে শাসন করে। ডান পায়ের বুড়ো আঙুল দিয়ে বালু খুঁচিয়ে বলে, যেভাবেই হোক আমি ওর বাবা। কারণ ও আমাকে বাবা ডাকে।

প্রচণ্ড রকমের ধমক দেয় নিজেকে। তাহলে এই বয়সে মানুষের সবকিছু কি ফুরিয়ে যাবে? কেন? কেন একটা ভাঁড় হয়ে এমন নারকীয় জীবনযাপন? কেউ না কেউতো আমার হবে, কেউ না কেউতো আমার পাশে থাকবে।

ও হাঁটতে হাঁটতে অনেকদূর চলে এসেছে। এখন ওর পরিচিত টিবিটা আর দেখা যাচ্ছে না। চারদিকে কেবলই পূর্ণিমা। বিশাল চাদ ওর মাথার ওপর নড়ছে। ও জানে না কোথায় যাচ্ছে? জানে না ঘরে না ফিরলে রাহানুম আর সুখদীপ ভাববে কি না। দুটো মানুষকে নিয়ে ও আবার একটা নতুন সংসার গড়েছে। ওদের কথা ভাবতে না চাইলেও ভাবতে হয়। আর ওরাতো ওর কথা ভাববেই। ওদের যে আর কেউ নেই। তাই ওকে ওদের ভীষণ প্রয়োজন। শুধু প্রয়োজন? আর কিছু না? শুধু প্রয়োজন দিয়ে কি ঘর হয়? ভালোবাসা ছাড়া? এই সব ভাবতে গেলে ওর কষ্ট বেড়ে ওঠে। ওর এখন এই সংসারের কোনোকিছু ভাবতে ভালো লাগছে না। ও শুধুই একটা স্বপ্ন দেখতে চায়। জোয়ারের জলে ওর পা। ভিজে যাচ্ছে। ভেজা বালুতে পা দেবে যাচ্ছে। আর রঙিন মাছটা ওর পা বেয়ে উপরে উঠছে, উঠছে। এখন ওটা ঊরুতে এসে স্থির হয়েছে। আবুল হাশেমের দৌড়তে ইচ্ছে করে। দৌড়ে অনেকদূরে চলে যায় ও। যৌবনে বৌয়ের সঙ্গে ওর এমন একটা খেলা জমে উঠত। বৌয়ের ডান উরুতে একটা বড়ো লাল জড়ল ছিল। সেই একটি জায়গায় মুখ নেমে যেত ওর, যেমন খাবারের চাড়িতে নেমে আসে মোষের মুখ। জড়লটা যেন যম–হরণ করে নিত আবুল হাশেমের হৃৎপিণ্ড। অদ্ভুতভাবে স্তব্ধ হয়ে যেত ও, নিঃসাড় হয়ে আসত শরীর।

সেই খেলাটা এখন ওর মাথায় ভর করেছে। এই বালিয়াড়ির মধ্যে ও একটা লাল জড়ল খুঁজে বেড়ায়। কিন্তু সেই সময়টাতো এখন ওর চারপাশে নেই–সেই বয়সটা নেই–সেই মাদকতাময় শিহরণও নেই। ও অল্পক্ষণে ক্লান্ত হয়ে যায়। মনে হয় চারপাশে গোঙানির শব্দ। সেই শব্দ হাতের মুঠিতে নিয়ে আজরাইল আসছে। ওহ, কেমন যেন লাগছে।

চারদিকে অজস্র লাল কাঁকড়া, শরীরে লাল কাঁকড়ার দংশন। আবুল হাশেমের নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হয়। ও আর সামনে এগুতে পারে না। ফিরতে থাকে নিজের ঘরের দিকে। ঘর? ঘরটা কি ভুল ঘর? রাহালুমের বাবা ডাক কি ভুল? কিংবা সুখদীপের দাদা ডাক? এতক্ষণে আবুল হাশেমের বুকে হাঁফ ধরে। ওর আর হাঁটতে ইচ্ছে করে না। রাত কত জানে না। কোথাও কোনো মানুষ নেই। কেবল সমুদ্রের গর্জন। যে গর্জন একবার উন্মত্ত হয়ে ভাসিয়ে দিয়েছিল কুয়োকাটার জনপদ।

কষ্ট ঘটনা কখনো কখনো নষ্ট ঘটনা হয়ে যায়–যে ঘটনা মনে করলে বুক তোলপাড় করে, মাথা ঘুরিয়ে ওঠে। ওই ঘটনা করোটিতে গেঁথে থাকে–সাগরে নোঙর ফেলে গেঁথে রাখা নৌকার মতো। ঢেউয়ে বা বাতাসে কেবলই দোলে। স্মৃতিও তেমন–সুযোগ পেলেই দুলে ওঠে। এই মুহূর্তে ও প্রাণপণে সেই ঘটনাটা ভুলে যেতে চেষ্টা করে।

ও মনে করে ও এখন কুয়োকাটা থেকে আলিপুর বাজারের দিকে হেঁটে যাচ্ছে–যখন দু’পাশে সবুজ ধানক্ষেত কিংবা কেটে নেওয়া ধান গাছের নাড়া হা-হা শূন্যতা সৃষ্টি করে ভৌতিক হাসি হাসে তখন আবুল হাশেম ভীষণ বিষণ্ণ হয়ে যায়। ও রাস্তার পাশে পা ছড়িয়ে বসে থাকে। সামনের জলাভূমিতে ব্যাঙ লাফায়। সেখান থেকে এক ধরনের শব্দ আসে। না, ঝিঁঝির ডাক নয়, কিসের ও জানে না। যেন এই শব্দটা ও কোনোদিন শোনেনি। অথচ মনে হয় চেনা–প্রতিদিনের শোনা। তবু সেই শব্দটা অজানাই থেকে যায়। আবুল হাশেম আনমনা হবার চেষ্টা করে। ওর চারপাশে অসংখ্য জোনাকি জ্বলে। হাজার হাজার আলোর বিন্দু জ্বলে আর নেতে, জ্বলে আর নেভে। ও শুনতে পায় যে ওকে দেখে লোকে বলছে, আহা বেচারা। বলে, আহা বেচারার কেউ নেই। বেচারার কি যে কষ্ট! কষ্ট কী? কষ্ট কি জোনাকির আলো? নাকি ঝিঁঝির ডাক? আবুল হাশেম চিৎপাত ঘাসের ওপর শুয়ে পড়ে।

ও দেখে আকাশ–দিগন্ত এবং কতগুলো নকশা জ্যোৎস্নায় ঝকমক করছে। ওর সামনে সবকিছু মুছে যায়–ঊরু থেকে স্ত্রীর লাল জড়লের চিহ্নও। যৌবনে এই জড়লটা দুজনের খুব প্রিয় বিষয় ছিল। নানা কথা হতো ওটা নিয়ে। আবুল হাশেমকে মণিমালা বলত, মুই যদি কোনোদিন হারাইয়া যাই তহন এই জড়ল দেইখ্যা মোরে বিছরাইয়া লইও।

ক্যা, তুমি হারাইয়া যাবা ক্যা?

হারাইয়া যামু ক্যা? ধর একটা বড় বইন্যা হইলো। সবকিছু ভাইস্যা গেল।

পাগল, তোমারে আমি ভাসতে দিমু না। বোহের লগে বাইন্দা রাখমু। মোরা কেউ হারাইয়া যামু না, কেউ না।

কথা বলতে বলতে আবেগে ছলছল করে উঠত আবুল হাশেমের চোখ। মণিমালা আঁচল দিয়ে ওর চোখ মুছিয়ে দিত। তারপর নিজের চোখও মুছত। দুজনের আবেগ থিতিয়ে গেলে মণিমালা খুব নিচুস্বরে বলত, বইন্যার কি ঠিক আছে? সাগরের কূলের মানু আমরা। বইন্যাতো মোগরে ভাসাইতেই পারে।

আর বইন্যার কথা না।

আবুল হাশেম প্রবল চুমুতে ওর ঠোঁটজোড়া বন্ধ করে দিত। মণিমালা তলিয়ে যেত সেই বন্যার তোড়ে। তারপর কখন দুজনে ঘুমিয়ে পড়ত টেরও পেত না।

কিন্তু তারপরতো বন্যা ঠিকই মণিমালাকে ভাসিয়ে নিয়ে গেল। কই খুঁজে পাওয়া তো আর হলো না। কোথায় ছিল ওর লাল জড়ল? একটা চিহ্ন নিয়েও কেন মণিমালা অপরিচিতের সঙ্গে মিশে গেল? কেন তাকে আলাদা করে খুঁজে পাওয়া হলো না? ঘাসের ওপর দু’হাত ছড়িয়ে রেখে আবুল হাশেম আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে।

পাশ দিয়ে একটা কুকুর হেঁটে যায়। কুয়োকাটার পূর্ণিমা আবুল হাশেমের চোখে কুকুরটিকে মানুষ করে দিলে ও কুকুরের লেজ ধরে টান দেয়। কুকুরটি বন্ধুর মতো ওর পাশে শুয়ে পড়ে। লেজ নাড়ে। জিভ বের। করে রাখলে ওর জিভ থেকে টপটপ করে লালা ঝরে। কুকুরটি একসময়ে আবুল হাশেমের গায়ের ওপর পা উঠিয়ে দেয়। এক সময়ে ওর মাথাটা আবুল হাশেমের পেটের ওপর রাখে। আবুল হাশেমের মেদহীন শরীর। নিঃশ্বাসে পাঁজরের হাড় ওঠে আর নামে। এক সময়ে ও কুকুরের মাথায় হাত রাখে। ওর ঘুম পায়। না, ঠিক ঘুম নয়, তন্দ্রা। কোনো এক গভীর শব্দ বারবার ওর চেতনাকে ছিন্নভিন্ন করে। ওই শব্দটা আর্তনাদ হয়ে ছড়িয়ে যাচ্ছে। তখন কুকুরটা লাফিয়ে উঠে ঘেউ-ঘেউ শব্দ করে ছুটে যায় বেশ খানিকটা দূরে। আবার ফিরে আসে–আবার যায়। ও হয়তো কোনো একটা খেলা পেয়েছে সেই খেলায় ও আনন্দ পাচ্ছে। আহ আনন্দ! আনন্দ কি কুকুরের ঘেউ ঘেউ? আবুল হাশেম উঠে বসে। সেদিন ওর আর আলিপুর বাজারে যাওয়া হয়নি। এভাবেই ওর অনেক কাজ নষ্ট হয়–ও নিজেকে টালমাটাল অবস্থায় নিয়ে যায় এবং সবশেষে এক নিঃশব্দ পৃথিবীতে ক্রমাগত হামাগুড়ি দিতে থাকে। ওর যন্ত্রণা হয়, চামড়া পুড়ে যায় এবং এক ধরনের বোবা আতঙ্ক ওর করোটিতে পরিব্যাপ্ত হয়।

ঠিক এখন এই মুহূর্তে ও ঘরে ফিরতে চায়। হ্যাঁ ঘর। এখন ওর একটি ঘর আছে। সাগরে মাছ ধরে ঘরে ফিরে আসার মতো ঘর আছে। কেউ কেউ ওর অপেক্ষায় থাকে। তবে বাবা, মা, ভাইবোন নিয়ে ঘর নয়। যৌবনে যেমন একদিন একটি ভিন্ন মানুষকে নিয়ে, যে মানুষের গর্ভে সন্ত নি উৎপাদন করা যায়, তেমন মানুষ নিয়ে যে ঘর গড়ে তুলেছিল, সে ঘর এটি নয়। এই ঘর অন্য এক ঘর–এটিও তো গড়ে তোলা। তিনজন মানুষের একত্র অবস্থান কি ঘর? গড়ে তুললেই কি ঘর হয়? মানুষে মানুষে আত্মিক সম্পর্ক জন্মায়, হয়তো জন্মায়, হয়তো জন্মায় না। তবু একত্র বসবাসের মধ্য দিয়ে এক ধরনের মায়া জন্মায়–সেটা হয়তো খুব গভীরভাবে নাড়ির পরতে বাধার মতো করে বাঁধে না কিন্তু শূন্যস্থানকে ভরিয়ে মানুষের ক্লান্তি কমিয়ে দেয়। ক্লান্তি? এই মুহূর্তে ক্লান্তির ভারে পা কেমন নুয়ে আসছে। এই জংলা পথটুকু পেরিয়ে ঘরে পৌছুতে কতদিন লাগবে। কতকাল?

আবুল হাশেমের আর উঠতে ইচ্ছে করে না। সাগরের জোয়ার আসছে–মৃদু গর্জনধ্বনি ওর কানে সংগীতের মতো ভেসে আসছে। যেন মণিমালার কোলজোড়া প্রথম সন্তান। ও গুনগুনিয়ে গান গেয়ে মেয়েকে ঘুম পাড়াচ্ছে। প্রথম সন্তানে কি খুশি ছিল ও! চকচক করত ওর দৃষ্টি। নাকি মাতৃত্বের প্রকাশটাই অমনি–এতদিনেও আবুল হাশেমের কাছে এই বোধটা পরিষ্কার নয়। জোয়ারের কলতান শুনতে শুনতে ও নিশি-পাওয়া মানুষের মতো উঠে দাঁড়ায়। চারপাশে তাকিয়ে দেখে কুকুরটা নেই। কখন চলে গেছে ও টেরই পায়নি। ও আচ্ছন্নের মতো হাঁটতে শুরু করে।

তখন আবুল হাশেম দেখতে পায় সুখদীপ দৌড়তে দৌড়তে আসছে। চিৎকার করছে, দাদা, দাদা গো–আবুল হাশেমের বুক ধুকপুক করে, আহা, ওই সাত বছরের বালক জানে না যে আবুল হাশেম ওর কেউ নয়। ও কত গভীর স্বরে ডাকে। যেন ওর সঙ্গে জন্মজন্মান্তরের সম্পর্ক। কোনোদিন বুঝি এ নাড়ির বন্ধন ছিন্ন হবে না। ওদের উঠোনে জ্যোৎস্না বিছিয়ে থাকলে সুখদীপ আবুল হাশেমের কোল দখল করে বসে। বলে, দাদা এউক্কা গল্প কয়েন?

গল্প? কী গল্প কমু?

যা আমনহের ইচ্ছা।

আবুল হাশেম বুঝে পায় না যে কি গল্প বলবে। কত গল্প তো সুখদীপকে বলা হয়েছে। রাজা, রানি, রাজকুমার, রাজকন্যা, দৈত্য-দানব থেকে শুরু করে হাতি-ঘোড়া, ব্যঙ্গমা-ব্যঙ্গমী, সেপাই-লস্কর সব শেষ। এমনকি সমুদ্রের গল্প, মাছ ধরার গল্পও করা হয়েছে। শুধু সুখদীপের নিজের গল্পটি বলা হয়নি। ওকে বলা দরকার। কবে? কখন? কেমন করে? সুখদীপ কি এই গল্প রূপকথা শোনার মতো আগ্রহ নিয়ে শুনবে? না কি শুনতে চাইবে না? কেমন করে বললে ওর শুনতে ভালো লাগবে? এটাই বুঝি হবে ওর জীবনের শ্রেষ্ঠ গল্প শোনা? ও মাথা ঝাঁকিয়ে ওঠে। নিজেই নিজেকে বলে, আমি জানি না। আজো সুখদীপ দৌড়ে এসে দু’হাতে জড়িয়ে ধরে ওকে। পেছনে রাহানুম। ওরা ঘুমোয়নি। ওরা ওর জন্য অপেক্ষা করেছে। তারপর খুঁজতে বেরিয়েছে। রাহামের ছায়াটা দু’পাশের গাছ-গাছালির সঙ্গে মিশে যায়। রাহানুম নারী। নারীর ছায়ায় ঘ্রাণ আছে। আবুল হাশেমের অনুভূতি গাঢ় হতে থাকে। একদিন জঙ্গলের ভেতর দিয়ে আনমনে হাঁটতে হাঁটতে আবুল হাশেম অজস্র ঝরাপাতা মাড়িয়ে গিয়েছিল। বর্ষার জলে সে পাতাগুলো নরম হয়েছিল। এখন নরম কোনোকিছু স্পর্শ করলে ওর শরীরে শিহরণ জাগে। ও ভুলে যায় ওর বয়সের কথা। ও সেদিন ভেবেছিল বর্ষার জলে ভিজে থাকা ঝরাপাতা নারী। নারী ভাবতেই ওর সমুদ্রের কথা মনে হয়। ওর কাছে সমুদ্র নারী। যার গর্ভ থেকে ওর জাল ভরে রূপোলি মাছ উঠে আসে। নারী ছাড়া কে আর এমন উজাড় করে দেয় নিজেকে? সৈকতের ভেজা বালুও ওর কাছে নারী। পায়ে জড়িয়ে থাকে প্রবল মমতায় কিংবা প্রিয়তমা হয়ে হেঁটে হেঁটে অনেকদূরে চলে যাবার মন্ত্রণা দেয়। স্বপ্নের ঘোরে হেঁটে চলে যায়, পেছনের কিছুই মনে থাকে না। নারী ছাড়া কে এমন দিগ্বিদিক পাগল করা ডাক দেবে? এতকিছুর মধ্যে ও একা, একজন মানুষ, যার পৌরুষ আছে, ক্ষমতা আছে এবং শক্তি আছে। তাই আবুল হাশেম নিজের বয়সের কথা ভুলে যায়।

বয়সের কথা ভুলে যাওয়ার মধ্যে প্রচণ্ড সুখ আছে। ওর কাছে তা এক ধরনের নতুন জন্ম। আবুল হাশেমের মনে হয় ও প্রতি মুহূর্তে নতুন। জন্মের স্বাদ অনুভব করে। ওর নারীকে নিয়ে ভাবনায়ও এমন বোধ কাজ করে। যে-কোনো কিছুকে নারী ভাবা এবং তার সংলগ্ন হওয়া মানে নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার। যেমন করে সুখদীপকে হাজার রকমের গল্প শোনায়, গল্প বলার হাজার টং বের করে তেমন করে নিজের সঙ্গে এই প্রতিদিনের সখ্য। ফলে আবুল হাশেমের মন-মাতানো দিনযাপন। ও সুখদীপের মাথাটা আঁকড়ে ধরে বলে, দাদা তুমি ঘুমাও নাই?

ঘুমামু ক্যা? আমনহে যে ঘরে নাই? আমনহে ঘরে না থাকলে মোর ঘুম আয় না।

ততক্ষণে রাহানুম কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। ওকে কেমন ভিন্ন নারী মনে হয়। মনে হয় না যে অনেককাল আগে এই মেয়েটির সঙ্গে ওর দেখা হয়েছিল। মেয়েটি ওকে বাবা ডেকে ওর আশ্রয়ে নিজের দুঃখ ভুলেছে। নতুন করে বাঁচতে শিখেছে। এখন কি মেয়েটির মনে কোনো দুঃখ আছে? ও কি প্রতি মুহূর্তে নুতন জন্মের স্বাদ অনুভব করে? পালিয়ে যেতে চায় কোথাও? অনেকদূরে? আর কারো কাছে? হয়তো না। মেয়েটি সরল। ও গভীর করে কিছু ভাবে না। বড় কোনো আকাভক্ষাও নেই? না কি ওর সামনে কোনো সুযোগ নেই? সুযোগ এলে ও হয়তো তা কাজে লাগাবে। রাহানুমের কণ্ঠস্বর বড়ো সুন্দর। সেই কষ্ঠে আজ অভিযোগ, বাবো, আমনহে যে ক্যা এইরকম করেন?

কি হরি?

ক্যা পাগলামি?

তোমাগো কষ্ট অয়।

রাহানুম চুপ করে থাকে।

কতা কও না ক্যা মা, মুই তোমাগো জ্বালা দি?

জালা দিবেন ক্যা? জালা তো আমনহের। আমনহের তো অনেক জ্বালা। এই বয়সী মানহের পরিবার না থাকলে কি যে কষ্ট অয়!

আবুল হাশেম মনে মনে বিড়বিড় করে, কষ্ট কী? তিনজন মানুষ একত্র থাকলে আবার কষ্ট কী? অন্ধকারে রাত গাঢ় হয়। অন্ধকারে মমতা বাড়ে, অন্ধকারে মমতা ছিন্নভিন্ন হয়। রাস্তার দুপাশে অসংখ্য নারকেল গাছ। নারকেল গাছের পাতার ফাঁকে আকাশ একটা রেখার মতো। বর্ষায় গাছ-গাছালি স্নিগ্ধ হয়ে ওঠে। কী নরম, কী সতেজ, কী সবুজ! এই সবের মধ্যে রাহনুমের উপস্থিতি বড়ো বেশি তীব্র।

সুখদীপের হাত ধরে আবুল হাশেম সামনে হাঁটে, পেছনে রাহানুম। ও একরোখা মেয়ে, রাগ বেশি। পান থেকে চুন খসলে রেগে যায়, বকাবকি করে। আবুল হাশেম চুপচাপ শোনে। কখনো রাহালুমের সঙ্গে কোনো বিরোধে যায় না। ও মহাজনের বাড়িতে ধান ভেনে বছরের খোরাক জোগাড় করার চেষ্টা করে। পারতপক্ষে আবুল হাশেমের কাছে। হাত পাতে না। সুখদীপকে ওরা দুজনেই দেখে। ও দুজনেরই। কিছুদূর গিয়ে আবুল হাশেম পেছন ফিরে দাঁড়ায়। রাহানুম খানিকটা পিছিয়ে পড়েছে। সুখদীপ চেঁচিয়ে ডাকে, মা তরতরি আও?

আবুল হাশেমও দাঁড়িয়ে পড়ে। বেশ খানিকটা দূর থেকে রাহাম এগিয়ে আসছে। যত এগিয়ে আসছে আবুল হাশেমের চোখে ও তত অস্পষ্ট হয়ে উঠছে। কেন এমন হয়? কেন মাঝে মাঝে চোখের সামনে থেকে সবকিছু মুছে যেতে থাকে, জেগে ওঠে ভিন্ন অবয়ব–যার কাছে আবুল হাশেম কিছুতেই যেতে পারে না–তখন সেই রঙিন মাছটা আবুল হাশেমের মগজ আলোকিত করে দেয়। সেই আলোকিত মুহূর্তে রাহানুম আবুল হাশেমের কাছে এসে দাঁড়ায়। ওর হৃদয় তোলপাড় করে ওঠে, কি রে তোর হারাদিন খাডনি গেছে? আঁটতে খারাপ লাগছে মা?

না বাবো, না, আইজগো পুন্নিমা খুব সুন্দর। জানো বাবো, এত বড় গোল চান মুই আর দেহি নাই।

এইডা দেইখ্যা মুই পাগল অইয়া যাই।

আবুল হাশেম হা-হা করে হাসে। হাসি ছড়িয়ে যায় খোলা প্রান্তরে। দমকে দমকে হাসির রেশ বাড়তে থাকে। হাসতে থাকে রাহানুম এবং সুখদীপও। ওরা খানিকটা অবাক হয়ে আবুল হাশেমের এই প্রবল হাসি শোনে। ওরা বুঝতে পারে না যে আবুল হাশেম নিজেকে মেলে দিতে চাইছে এই খোলা প্রান্তরে। ও চায় যতদূর চোখে দেখা যায় ততদূর ছড়িয়ে যাক ওর হাসি–কিংবা যেটুকু চোখে দেখা যায় না, সেখানেও পৌঁছে যাক ওর হাসি।

একসময় সুখদীপ আবুল হাশেমের হাত ধরে টান দিয়ে বলে, এইর লাইগ্যা তো মানে আমনহেরে পাগলা বুড়া কয়।

আবুল হাশেমের যে হাসি প্রায় থেমে এসেছিল সেটা আবার প্রবল হয়ে ওঠে–হাসির তোড়ে হেঁচকি ওঠে ওর। আসলে ঠিক হেঁচকি নয়, একটা টান, যেটার রেশ ফুরোয় না।

তখন অন্য দুজন মানুষ ভয় পায়। হাসিও যে ভয়ের হতে পারে ওরা দুজনে তা অনুভব করে। সুখদীপ রাহনুমকে জড়িয়ে ধরে। রাহানুম। আবুল হাশেমের হাত চেপে ধরে বলে, অত আইস্যে না, বাবো।

আবুল হাশেম রাহামের মাথায় হাত রেখে থমকে দাঁড়িয়ে বলে, ক্যা, হাসুম না ক্যা?

জানো না যত হাসি অত কান্না, কইয়া গেছে রাম সন্না।

কান্দনের আর বাহি কি? কান্দনতো মোর ফুরাইয়্যা গেছে। মুই আর কাম না।

এহন মোগ হপ্পন দেহনের সময় না বাবো?

হ্যাঁ, সত্য কথা।

বড়ো একটা শ্বাস ফেলে আবুল হাশেম কথাটা বলে।

শ্বাস ফেললা ক্যা, বাবো?

রাহানুমের কণ্ঠ বড়ো বেশি আন্তরিক। আবুল হাশেমের কোনো জবাব নেই। দীর্ঘশ্বাস তো ও ফেলতে চায়নি, দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। ওর কিসের দুঃখ? ওতো দুঃখ কাটিয়ে ওঠার জন্য কতকিছু আপন করেছে। এই একা একা ঘুরে বেড়ানোটা তার একটা অংশ। তবে কেন, কিসের জন্য দীর্ঘশ্বাস। পূর্ণিমার গোল চাঁদও তো ওর আপন করে নেওয়া জিনিসের অংশ–মানুষ এবং প্রকৃতিকে ও সমানভাবে আপন করতে পেরেছে–সেইসব কিছুতে নিজের স্বস্তি খুঁজেছে, ভালো লাগা জড়িয়েছে। তবু গভীর সমুদ্রে মাছ ধরতে গেলে দীর্ঘশ্বাস উঠে আসে বুক। ভেঙে। সমুদ্রের ওপর অভিমান হয়। কেন? কেন এই অর্থহীন মন খারাপ?

অনেকদিন আগে তো জীবনের বড়ো একটা অংশ চুকেবুকে গেছে–এই চুকে যাওয়ার ফলে ওর নতুন যাত্রা শুরু হয়েছে। মানুষের নতুন যাত্রা যতই দুঃখের ভেতর থেকে শুরু হোক না কেন যাত্রা তো আনন্দ। নতুন পথের আনন্দ, নতুন আলোর আনন্দ। ক্লান্তি মনে করলেই ক্লান্তি। ক্লান্তিকে বেশিদিন বয়ে বেড়ানো যায় না–ওটা আপন থেকে ঝরে পড়ে। না ঝরলে কি বেঁচে থাকা সহজ হতো? সেই চুকেবুকে যাওয়ার দিনটি বুকে চেপে বসলে দীর্ঘশ্বাস আসে। অথচ এখন এমনও তো হতে পারে যে বিশাল একটা ঝড় উঠলে মধ্য সমুদ্রে হারিয়ে যেতে পারে ওর ট্রলার? তখন কি ও আবার কোনো চরে ভেসে উঠবে? দেখবে আর একটি নতুন জীবন ওর অপেক্ষায়? না, আর না।

কিন্তু কেন নয়? জীবনের কি শেষ আছে? শুরু করলেইতো হয়। শুরু করাটাইতো নতুনত্ব। এর জন্য কি বয়স লাগে? না, লাগে না। যত বয়সই হোক না কেন আমি স্বপ্ন দেখব। আমি আলোকিত করব জীবন। তখন সেই রঙিন মাছটা ভেসে আসে আবুল হাশেমের করোটিতে। বঙ্গোপসাগর নয়, কুয়োকাটার পূর্ণিমা যদি একটা দিগন্ত-বিথারী সমুদ্র হয় তবে একটা রঙিন মাছ সেই সমুদ্রে থাকবে। সেটা আবুল হাশেমের একার, আর কারো নয়। সেই মাছ শত কোটি হয়ে আবুল হাশেমের জাল ভরে দেবে, ঘর ভরে দেবে। ট্রলার গড়ে দেবে। ওহ্ একটা নতুন ট্রলার। ভাবতে ভাবতে আবুল হাশেম যুবক হয়ে ওঠে। যুবক বয়স থেকেই। একটা নুতন ট্রলারের স্বপ্ন ছিল ওর, যে স্বপ্ন কোনোদিন পূরণ হয়নি। ও জানে এখন আর হবার নয়। তবু সেই রঙিন করোটিতে কেলিবিলাসে মেতে উঠলে ও সমস্ত অনুভব নিয়ে চাঙা হয়ে ওঠে। শরীরের নতুন। পুলক, যেন প্রবল খরতাপে ভেজা বালুর ওপর দিয়ে হেঁটে যাওয়া দূরের বিন্দুর দিকে তাকিয়ে, যেখানে তাকালে মনে হয় আকাশের সঙ্গে সাগরের আলিঙ্গন। এইসব ভাবনায় আবুল হাশেমের চিত্ত চঞ্চল হয়ে ওঠে। ওর। ভারি আনন্দ হয়। ইচ্ছে করে দৌড়ে উঠোনটা এক পাক ঘুরে আসতে।

ততক্ষণে ওরা বাড়ির উঠোনে এসে দাঁড়িয়েছে। ঝকঝকে তকতকে নিকোনো উঠোন। রাহানুম ভিটেবাটি ছিমছাম করে রাখতে ভালোবাসে। বারান্দায় হোগলার মাদুর পাতা। সুখদীপ দৌড়ে গিয়ে মাদুরের ওপর গড়িয়ে পড়ে, ডিগবাজি খায়। আবুল হাশেম নিজেকে বলে, আমি তো এখন সুখদীপ হয়ে গেছি। একদম ওর মতো, ওর বয়সী। তখন সুখদীপ দৌড়ে এসে আবুল হাশেমের হাত ধরে বলে, দাদা, গপ্পো–

ধমকে ওঠে রাহানুম, কেবল গপ্পো? বাবো ভাত খাইবে না?

সুখদীপ রাহনুমকে ভেংচি কাটে। তারপর দৌড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরে বলে, মোরও খিদা লাগছে।

হো-হহা করে হেসে ওঠে আবুল হাশেম, যেন জীবনের এমন মজা ও আর কখনো পায়নি।

রাহানুম হাসে না। ওর রাগ হয়। সুখদীপকে এক ধাক্কায় সরিয়ে দিয়ে ও দপদপিয়ে ঘরে চলে যায়। ঘরে কুপি জ্বালানো ছিল। উঠোনে দাঁড়িয়ে খোলা দরজা দিয়ে আবুল হাশেম দেখতে পায় ঘরে কুপির শিখা কাঁপছে। একটু পর কুপির শিখা আড়াল করে দাঁড়ায় রাহানুম। ওকে একটা বিশাল ঢেউয়ের মতো মনে হয়–সমুদ্র ক্ষেপে গেল যে ঢেউ উন্মত্তের মতো ছুটে আসে, ভাসিয়ে দিয়ে চলে যায় পুরো জনপদ। চিহ্ন থাকে না বাড়িঘর, ছোট গাছ কিংবা মানুষের। রাহানুম ভাতের হাঁড়ি, বাসনকোসন নাড়াচাড়া করছে। টুংটাং শব্দ আসছে কখনো কখনো। এখন খেতে হবে, ঘুমুতে হবে, একটি পুরা রাত্রি পার করতে হবে। ঘুমের মধ্যে নিঃশব্দ মৃত্যু না ঘটে গেলে কিংবা প্রবল জলোচ্ছ্বাস তিরিশ ফুট উঁচু হয়ে সাগর থেকে ছুটে না এলে, কোনো তোলপাড়ে সবকিছু তছনছ না হয়ে গেলে আবুল হাশেমের জীবনে আর একটি দিনের সূর্য উঠবে। ভাবতে ভাবতে ও সুখদীপকে নিয়ে পুকুরের পাড়ে আসে। সুখদীপ দৌড়ে ঘাটলায় নামে। ঝপঝপিয়ে মুখে পানি দেয়। ভিজে যায় গলা, বুক। অল্পক্ষণ পানি নিয়ে মাতামাতি করে ও। দু’হাতে পানি নিয়ে চারদিকে ছড়িয়ে দেয়। তারপর এক দৌড়ে ঘরের বারান্দায় গিয়ে ওঠে।

আবুল হাশেমের মনে হয় ও একটা উড়ুক্কু মাছ। এই গতি বোধহয় শৈশবেই থাকে, যত দিন যায় গতি কমতে থাকে। আবুল হাশেমের এই বয়সে কোথাও গতি নেই। ওর গতি এখন স্বপ্নে। ওর জীবনে এখন এক উজ্জ্বল স্বপ্নের সময়। স্বপ্নের ভেতরে ও দ্রুতবেগে মাইল মাইল পথ হেঁটে যায়–দুরন্ত গতিতে ট্রলার ছোটায়। ক্লান্তিহীন। ক্ষান্তিহীন।

ও পুকুরের ঘাটলায় বসে দুহাতে পা পরিষ্কার করে। আঙুলের ফাঁকে ফাঁকে বালু জমে আছে। প্রায় হাঁটু পর্যন্ত সৈকতের বালু উঠে এসেছে। বালু তাড়াতে ও বড়ো বেশি নিমগ্ন হয়ে পড়ে। শরীর শিরশির করছে। মনে হয় যেন জিভের নিচেও বালুর পরত জমেছে। ওর মগ্ন চৈতন্যে একটা ডাক ভেসে আসে। ও উপেক্ষা করে। এখন কোনো ডাক শুনতে চায় না। তবু শব্দটা ওর ভেতরে প্রবেশ করে। ও বুঝতে পারে রাহানুম বারান্দা থেকে বাবা, বাবা করে চিৎকার করছে। স্থবির হয়ে আসে আবুল হাশেমের শরীর। ও কি রাহামের বাবা? কেমন করে? যে পদ্ধতিতে একজন মানুষ আর একজন মানুষের বাবা হয় সে পদ্ধতিতে ওর এবং রাহানুমের জীবনে অনুপস্থিত। ওর চেঁচিয়ে বলতে ইচ্ছে করে, আমি বাবা নই। আমার কেউ নেই। কিন্তু ওর গলা দিয়ে শব্দ বের হয় না। ও বোঝে ওর কোনো কিছু বলা হবে না। জীবনটা এমন–এমন জটিল সম্পর্কে নিগড়ে বাঁধা–এর থেকে মুক্তি নেই। আবুল হাশেম ইচ্ছে করলেই চেঁচাতে পারে না। এমন করেই মেনে নিতে হয় বন্দিত্ব। নিজের কাছ থেকে কোথাও কি পালানোর উপায় আছে? পানির ভেতর আবুল হাশেমের দু’হাত থেমে থাকে। মনে হয় পানির স্পর্শও সুখকর নয়–তা জটিল এবং যন্ত্রণাকর।

এক সময়ে রাহালুমের কণ্ঠ তীব্র হয়ে ওঠে। ও চেঁচিয়ে ডাকছে। হয়তো ভেবেছে যে আবুল হাশেম শুনতে পাচ্ছে না। হয়তো আবুল হাশেম বধির হয়ে গেছে। যেমন বধির হয়ে গিয়েছিল সেই প্রলয়ঙ্করী জলোচ্ছ্বাসের পর–যখন ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছিল শরীরের যাবতীয় শিরা-উপশিরা–বিধ্বস্ত হয়ে গিয়েছিল মগজ এবং দু’চোখ থেকে বিলুপ্ত হয়েছিল স্বপ্ন। আজ আবুল হাশেমের জীবনে আবার স্বপ্ন উজ্জ্বল হয়েছে। কিন্তু সে স্বপ্ন শুধুই মগজের–ধুলোমাটির নয়–যে ধুলোমাটির মধ্যে প্রতিদিনের জীবন বাড়তে থাকে। আবুল হাশেম দ্রুত হাত পা প্রক্ষালন করে। লুঙ্গি হাঁটুর ওপরে ওঠানো। দু’হাতে মুখে পানি ছিটায়। ঊরু ভিজে যায়। নাকের ভেতর পানি যায়। চোখ জ্বালা করে। মিঠে পানির স্পর্শ, তবু আবুল হাশেমের চামড়ায় সে স্পর্শে নোনা স্পর্শ। ও কিছুতেই নোনা-স্পর্শ থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পারে না যেন নাকের পাশ দিয়ে খলখলিয়ে বয়ে যাচ্ছে নোনা পানির স্রোত–মাথার ওপর দিয়ে–পায়ের নিচেও–নোনা জল স্পর্শ করে ভূমি–নষ্ট হয়ে যায় ভূমির উর্বরতা। আবুল হাশেম এখন তেমন এক পতিত জমি–যে জমির ফসল নষ্ট করেছে সাগরের লবণাক্ততা। ও ঘাটলা থেকে উঠে আসে। একগুচ্ছ ঘাসে পা মুছে নেয় এবং ঘাড় নিচু করে লুঙিতে মুখ মোছে। ওর। শরীরে জলের চিহ্ন রাখতে চায় না। কিন্তু মুছবে কী করে? নোনা জলতো ধুয়ে-মুছে নিয়ে গেছে জীবনের সব ফসল।

আবুল হাশেম দ্রুত পায়ে ঘরে আসে। সুখদীপের সানকিতে বড়ো একটা মাছ। ও মাছের কাঁটা বাছে। ফকফকে সাদা ভাত লাল সানকিটায়–আবুল হাশেম অন্ধের মতো তাকায়। ভাতকে ভাত মনে হয় না। ওগুলো কি কাঁকড়ার গুঁড়ি গুঁড়ি বাচ্চা? লুঙ্গি দিয়ে হেঁকে তুললে হাজার হাজার উঠে আসে। ও হোগলার ওপর বসে নিজের সানকি টেনে নেয়। এক নিমগ্ন ঘোরে ও ভাত খেতে থাকে–পেট ভরে ভাত খায়।

রাহানুম ওর থালায় মাছ তুলে দেয়, শাক ভাজি দেয়, খেসারির ডাল দেয়, তিন-চার চামচ ভাত বেশি দেয়–তবু আবুল হাশেম না করে না। খেতেই থাকে। সুখদীপ এবং রাহানুম যে অবাক হয়ে ওর দিকে তাকায় সেটা ও খেয়াল করে না। ওর কেবলই মনে হয় ও যেন কতকাল খায়নি। সেই জলোচ্ছ্বাসের পর প্রচণ্ড খিদে নিয়ে অনবরত দৌড়ে বেড়াত চরের মধ্যে। কোথাও কোনো খাবার ছিল না। তীব্র বিবমিষায় মাথা চক্কর দিয়ে উঠলে ও দু’হাতে পেট চেপে মাটিতে গড়াত। ভিজে মাটিতে মাখামাখি শরীর–কী অসহ্য যন্ত্রণায় কেটেছিল কটা দিন।

বাবো, আর এক চামুচ ভাত দিমু?

আবুল হাশেম রাহামের কণ্ঠ শুনতে পায় না। তখন তো চরের মধ্যে কেবল আর্তনাদ ছিল–ছিল মানুষের আহাজারি। কোনো পাখির ডাক না, পানির কলকল না–প্রচণ্ড এক ভৌতিক নিস্তব্ধতা অকস্মাৎ মানুষের সব আর্তনাদ ভাসিয়ে নিয়ে যায়। মুখ থুবড়ে পড়ে থাকে সবাই–স্বজন হারানোর বেদনা বরফের মতো জমাট হয়ে ছিল। ওহ্ সেই কটা দিন! সেই কটা দিন! আবুল হাশেমের কণ্ঠে অস্ফুট ধ্বনি। চোখ গোলাকার বর্তুল, অথচ বিস্ফারিত। আদিম গুহা থেকে বেরিয়ে আসা বুনো জন্তুর মতো হয়ে যায় আবুল হাশেম।

রাহানুম বিস্মিত হয়ে ডাকে, বাবো, ও বাবো? কি অইছে?

রাহামের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে আবুল হাশেম। সেই মুখটা বালুর ওপর আঁকাবাঁকা রেখা হয়ে যায়, যে রেখাগুলো অজস্র কাঁকড়ার চলে যাওয়ার পদচিহ্ন। তখন ওর কেউ ছিল না, কেউ না। স্ত্রী, ছয় ছেলেমেয়ে, বাবা-মা, ভাইবোন, আত্মীয়স্বজন, কেউ না। বিরাট প্রান্ত র ছিল ওর জন্য উন্মুক্ত, ও ছিল সেই প্রান্তরের অধীশ্বর–তারপর থেকে খোলা প্রান্তরে একা একা ঘুরে বেড়ানো ওর অভ্যেস হয়ে গেল। হা-হা করে হেসে উঠতে চায় ও। কিন্তু পরক্ষণে বিহ্বল হয়ে তাকিয়ে থাকে রাহানুমের মুখের দিকে। ওর খাওয়া শেষ। ও এখন হাত দেবে। রাহানুম পানির গ্লাস এগিয়ে দেয়। আবুল হাশেম সানকি ভরে পানি ঢালে তারপর সেখানে হাত ডোবায়। ধুয়ে যায় ডাল, তরকারির ঝোল, ভাতের চিহ্ন।

ও নিঃশব্দে উঠে আসে। বারান্দার হোগলার ওপর বসে বিড়ি ধরায়। শুনতে পায় সুখদীপ হাসছে। রাহানুম ওকে ধমকাচ্ছে। হাসতে নিষেধ করছে। বলছে, বেশি হাসি ভালো না। রাহামের এই এক অভ্যেস। হাসি শুনলে ও ভয় পায়। মনে করে হাসলেই সামনে বিপদ। আবুল হাশেম বিড়বিড়িয়ে বলে, জানি না, জানি। ক্যান হাসি শুনলে তোর এমন লাগে। কিন্তু সুখদীপের এখন হাসার বয়স, ও হাসবেই। শৈশবেইতো মানুষ না বুঝে হাসে, তারপর কি আর পারে? কিন্তু না, এটা বোধহয় সত্যি নয়, সেই খোলা প্রান্তরে একা হয়ে যাবার পর তো আবুল হাশেম অকারণেও হাসতে শিখেছে। তখনতো ওর শৈশব ছিল না। কৈশোরও। একেবারে ভরা মধ্যবয়স। সেই যে শুরু। এখনো হা-হা করে হাসলে বুকটা খোলা প্রান্তরে ছুটে যাওয়া বাতাসের মতো শোঁ-শোঁ শব্দময় হয়ে যায়। তখন রঙিন মাছ ভেসে আসে, বুদ্বুদ ওঠে, গাছের পাতারা সবুজ হয়, জংলাভূমির ঝরা পাতাগুলো পায়ের নিচে মচমচ করে। নাকের কাছে বুনোফুলের গন্ধ তীব্র হয়। গভীর সমুদ্রে গেলে গাঙচিলেরা ট্রলারের ওপর দিয়ে উড়ে যায়। ওদের ছায়া পড়ে শরীরে। চারদিকের অথৈ নীলে সেই শব্দময় হাসির থৈ-থৈ নৃত্য কলকল শব্দে বয়।

এক সময়ে ও অনুভব করে সুখদীপের হাসি আর নেই। ও খেয়েদেয়ে শুয়েছে। রাহানুম খাচ্ছে, নয়তো বাসনকোসন গুছিয়ে রাখছে। তারপর একবার ওর কাছে আসবে। বলবে, বাবো, ঘুমাইবেন না? এমন পূর্ণিমা রাতে আবুল হাশেমের ঘুম আসে না, আসতে চায় না। আর যদি আসেই তবে আবুল হাশেম এই বারান্দায় হোগলার ওপর ঘুমিয়ে যাবে। কোনো কিছু তখন ওর আর মনে থাকবে না। দু’চোখ জুড়ে ঘনিয়ে থাকবে অন্ধকার। পৃর্ণিমার বিপরীতে যে অন্ধকার থাকে তার নামইতো অমাবস্যা। অমাবস্যা ও সহ্য করতে পারে না। এইতো ক’বছর আগে অমাবস্যার রাতে সমুদ্র ফুলে-ফেঁপে উঠেছিল। কী ভীষণ অন্ধকার ছিল সেদিন।

সন্ধ্যা থেকে টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়ছিল। গোয়ালে গরুগুলো চাড়িতে মুখ দেয়নি। ব্যাকুল স্বরে ডেকেছিল কেবল। ঘরে-বাইরে ছুটোছুটি করেছিল আবুল হাশেমের পঞ্চান্ন বছরের স্ত্রী মণিমালা। ওর বাবার এক পীর সাহেব এই নাম রেখেছিল। পীর সাহেব ওর বাবাকে বলেছিলেন, মাইয়া যা কয় হুনবেন। মাইয়ার মধ্যে জ্যোতি আছে।

জ্যোতি নয়, মণিমালার ছিল ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়। সুখ-দুঃখের অনেক কিছুই আগে থেকে আঁচ করতে পারত। আবুল হাশেমের কাছে এসে বারবার বলছিল, আইজ একডা কিছু ঘটবে।

মার ক্যাবল অলুক্ষণে কতা।

চেঁচিয়ে ওঠে বড়ো ছেলে আজফার। আবুল হাশেমের বুক ভয়ে কাঁপে। ও চেনে ওর স্ত্রীকে, বিশ্বাসও করে। মণিমালা যখন বলছে তখন একটা কিছু ঘটবেই।

রাত যত বাড়ে, ঝড়ের দাপট বাড়ে। বাতাসে নারকেল গাছের মাথা ভেঙে পড়ে। ঘুটঘুটে অন্ধকারে দু’হাত দূরের কিছুই চোখে পড়ে না। কনকনে বাতাসের জোর ঝাপটা এসে চামড়া ফাটিয়ে দিয়ে যায় যেন। চিনচিন করে ওঠে গাল-ঠোঁট। মণিমালা আজফারকে ডেকে বলে, গরুগুলোর বাঁধন খুইল্যা দে। হাঁস-মুরগির খোঁয়াড় খুইল্যা দে।

আজফার দৌড়ে উঠোনে নামে। বড়ো বড়ো ফোঁটায় বৃষ্টি পড়ছে। বাতাসের জোর ধাক্কা বাড়ছে। বৃষ্টির সূঁচালো ফোঁটা তীরের মতো ঢুকে যায় শরীরে। গোয়ালে ও স্থির দাঁড়াতে পারে না। বাতাস ওকে উড়িয়ে নিতে চায়। একবার এদিকে একবার ওদিকে পড়ে যেতে চায়। কখনো বেড়ার সঙ্গে ধাক্কা খায়। অন্ধকারে গরুর দড়ি খুঁজে পেতে কষ্ট হচ্ছে। অস্থির গরুগুলো লাথি দিচ্ছে। বারান্দা থেকে বাবা ওকে ডাকছে। নিরুপায় ব্যর্থতায় আজফার হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে। একটি গরুর দড়িও খুলতে পারে না আজফার। আবুল হাশেমের ব্যাকুল কণ্ঠ বাতাস ছিড়েখুঁড়ে ওর কাছে ছুটে আসে, ও বাবা তুই ঘরে আয়, ও বাবা আজফার। শোনা যায় মণিমালারও কণ্ঠ। দুজনেই ব্যাকুল হয়ে ওকে ডাকছে। আজফার গরু রেখে দৌড়ে ঘরে ফেরে। তখন ওর বুক ফেটে যায়। ও বুঝতে পারে খুঁটি উপড়ে না গেলে গরুগুলো বাঁধা অবস্থায় মরে যাবে। খুঁটি খুলে দিতে পারলে গরুগুলো ভাসতে ভাসতে কোথাও না কোথাও গিয়ে হয়তো বেঁচে যেতে পারত, নাও পারত। কিন্তু এখনতো ওই গোয়াল ঘরে ওগুলোর মৃত্যু নিশ্চিত। ওর মাথা এলোমেলো হয়ে গেলে ও একটা সুরাও পড়তে পারে না। ব্যাকুল হয়ে শক্ত হাতে বারান্দার খুঁটি চেপে ধরে। তখন শুনতে পায় প্রবল গর্জনে এগিয়ে আসছে সমুদ্র। আকাশে চাঁদ নেই। আকাশে ঘন কালো মেঘ–অন্ধকারে তা দেখা যায় না। একসময়ে আজফার চিৎকার করে ওঠে, বাবো, কেয়ামত, কেয়ামত। আইজ কেয়ামতের রাইত বাবা।

আজফারের কথা শুনে আবুল হাশেমের চৈতন্যে কেয়ামত শব্দ তোলপাড় করে ওঠে। তাইতো, কেয়ামত কি এমন? এমন ভয়াবহ, এমন সর্বগ্রাসী! সেদিন কি এমন ঘুটঘুটে অন্ধকার থাকবে? না, বিশ্বাসতো এমন যে সেদিন মাথার এক হাত ওপরে সূর্য নেমে আসবে। তাহলে? তাহলে কেয়ামত কেমন?

শুনতে পায় ঘরের ভেতর মণিমালা চিৎকার করে কাঁদছে। দরুদ পড়ছে। ও দ্রুতপায়ে ঘরে ঢোকে। বুঝতে পারে মণিমালা ছোট মেয়ে দুটোকে কোলের মধ্যে নিয়ে চৌকির ওপর বসে আছে। আবুল হাশেম আযান দেয়।

আশেপাশের বাড়ি থেকে কয়েকজন দৌড়ে এসে উঠেছে ওদের বারান্দায়। ওদের গায়ে ভিজে কাপড় সপসপ করছে। ওদের ব্যাকুল প্রশ্ন, কি অইবে মিয়াবাই?

আল্লার নাম ল।

আবুল হাশেমের গলা কেঁপে যায়। আজফার তীব্র কণ্ঠে বলে ওঠে, সাগর ফুইলা উঠছে। আল্লার নাম লইলে কি বাঁচন যায়?

মৃত্যুচিন্তায় হতবিহ্বল মানুষগুলো হাহাকার করে ওঠে। কপাল চাপড়ায়। এমন সর্বনাশ ওরা আগে কখনো দেখেনি বলে বিলাপ করে। ততক্ষণে উঠোনে জমে ওঠে ভিড়–আরো নারী-পুরুষ ছুটে এসেছে আশ্রয়ের আশায়। আবুল হাশেম আযান দিতেই থাকে। চিৎকার করতে করতে ওর গলা ভেঙে যায়। সেই সঙ্গে যুক্ত হয় মানুষের কোলাহল এবং আর্তনাদ। আর সময় নেই। প্রবল বেগে ছুটে আসছে জলোচ্ছ্বাস। কানের তালু ফেটে যেতে চায় সেই শব্দে।

ওহ খোদা!

ঘরের ভেতর মণিমালা আবার আর্তনাদ করে, যে কণ্ঠ নীরব হয়ে গিয়েছিল সে কণ্ঠে এখন মরণধ্বনি–ও ছুটে দরজার কাছে এসে দাঁড়ায়। ছোট মেয়েটি কোলে, বড়োটি মায়ের কোমর জড়িয়ে ধরে আছে। আবুল হাশেম মণিমালার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়।

মণিমালা দু’হাত দিয়ে স্বামীর হাত জড়িয়ে ধরে, এই জনমে আপনের লগে আর দেহা অইবো না।

আবুল হাশেমের বুক কেঁপে ওঠে। শরীরও কাঁপে থরথর করে। স্ত্রীকে কোনো সান্ত্বনা দিতে পারে না। স্ত্রীর হাত জড়িয়ে ধরেই বলে, লাইলাহা ইল্লা আন্তা ছোবহানাকা ইন্নি কুনতু মিনাজ জোয়ালিমিন।

তারপর এক গভীর হিমশীতল স্পর্শে ভেসে যায় চরাচর। কে কোথায় চলে যায় আবুল হাশেম তা আর জানে না। মণিমালা শক্ত মুঠিতে চেপে রেখেছিল। কেমন করে বিচ্ছিন্ন হলো ওরা? আবুল হাশেম জানে না। জানার কথা চিন্তা করতে চাইলেই ওর মগজে একটি শব্দ স্থির হয়ে থাকে, কেয়ামত। সে রাতকে ও কেয়ামত ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারে না। ও কাউকে খুঁজে পায়নি। সাগর ওদের কতদূর ভাসিয়ে নিয়ে গেছে? কোনো নতুন চরে রেখে এসেছে ওদের লাশ? সে লাশ কি শকুনে খেয়েছে? ভাবলে বুকের ব্যথা তীব্র হয়–একজন মানুষকেও খুঁজে পেল না ও। এমন সাজানো-গোছানো সংসার ভেসে সাফ হয়ে গেল। ভিটে ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট ছিল না। অস্থির হয়ে ওঠা গরুগুলোও কোথায় যে ভেসে গেল? কিন্তু খুঁজে পেল ভিন্ন দুজন মানুষ–একজন রাহানুম। অন্যজনের নাম ওরা জানত না। রাহানুম নাম রাখল সুখদীপ।

ওদের না পেলে হয়তো অন্যরকম হতো জীবন। হয়তো পাগল হয়ে যেত। পথে পথে ঘুরে বেড়াত–ন্যাংটো, নোংরা খুঁটে-খাওয়া হয়ে যেত এতদিন। যেমন মতি পাগলা ঘুরে বেড়ায় পথেঘাটে, বাজারে। ভাবলে শিউরে ওঠে শরীর। ওহ্ বেঁচে থাকার ওই পতন থেকে ওকে বাঁচিয়ে দিয়েছে রাহানুম আর সুখদীপ। ওদের পেয়ে ও একটা দায়িত্ব পেয়েছে, দায়িত্ব পেয়ে ওর কাজ বেড়েছে। কাজ ওর শোক কমিয়েছে। তাই ওর হৃদয় শান্ত হয়েছে, স্থিত হয়েছে। ও মানুষের মতো বেঁচে থাকার যোগ্যতা ফিরে পেয়েছে। ও রাহানুম আর সুখদীপের কাছে কৃতজ্ঞ হয়ে ওঠে। বোঝে মানুষই পারে মানুষকে মানুষ রাখতে।

মাঝে মাঝে রাহানুম বলে, বাবা আমনেরে না পাইলে মোগ কি অইতো? মোরা কই যাইতাম? সুখদীপ ওই সাগরের ধারে মইরা থাকত। আর মুই ভিখ করতাম।

আবুল হাশেম গভীর চোখে ওর দিকে তাকিয়ে বলেছিল, তোমারে মুই বাঁচাইছিলাম, আর সুখদীপরে তুমি। আর সুখদীপ আমাগো দুইজনরে বাঁচায়ে দিছে। নইলে মোরা পাগল হইয়া যাইতাম।

রাহামের দৃষ্টি কৃতজ্ঞতার ভারে চকচক করে ওঠে। তারপর মাথা নেড়ে বলে, হ ঠিক। আমরা হকলে হক্কলের লাইগা। হলে সমান।

আবুল হাশেম অনেক ভেবেছে, প্রয়োজন কি বন্ধন টিকিয়ে রাখে? তাহলে ওরা কি আমৃত্যু এভাবে দিন কাটাতে পারবে? কেউ কাউকে কখনো ছেড়ে যাবে না? ভাবতে ভাবতে ওর একটা বিড়ি ফুরিয়ে যায়। ও সেই আগুন থেকে আর একটা বিড়ি ধরায়। তখন রাহানুম বাসনকোসন গুছিয়ে রেখে কাছে এসে দাঁড়ায়, বাবো স্বরে লন? ঘুমাইবেন না?

ঘরে গরম লাগে। এহানে থাহি। তুমি ঘুমাও।

রাহানুম চলে যায়। ঘরের দরজা বন্ধ করে। একটু পরে নিভে যায় কুপির আলো। চারদিক সুনসান। আবুল হাশেমের কানে অস্পষ্ট গোঙানির ধ্বনি ভেসে আসে। আবুল হাশেম জানে এই মুহূর্তে ওই শব্দের। কোনো বাস্তব ভিত্তি নেই। ওটা চৈতন্যের ভেতরের শব্দ। ও ভাবনা ঘুরিয়ে নেয়। বুঝতে পারে রাহানুম শুয়ে পড়েছে। একটু পর ওর ঘুম গাঢ় হয়ে যাবে। এই শব্দময় পৃথিবী থেকে ও দূরে চলে যাবে। কেমন করে শুয়েছে রাহনুম? চিৎ হয়ে না কাৎ হয়ে? নাকি উপুড় হয়ে? নিঃশ্বাসে ওর বুক উঠছে আর নামছে। অন্ধকারে ওর চোখের পাতা স্তব্ধ। সেদিনও বালুর ওপর চোখ বুজে পড়েছিল রাহানুম। না, সেটা ঘুমুনোর জন্য শুয়ে থাকা ছিল না। ঘুমুনোর ভঙ্গি অমন হয় না। ক্ষীণ নিঃশ্বাসের কারণে ওর কোনো স্পন্দন বোঝা যাচ্ছিল না। ও ছিল মৃতবৎ। শুয়ে থাকার যে ভঙ্গি নিপ্রাণ থাকে, সেখানে ভঙ্গিটা প্রধান হয় না। প্রধান হয় বাস্তববোধ, তার কার্যকারিতা। সেদিন রাহনুমের শরীর সবটুকু কার্যকারিতা হারিয়েছিল।

আবুল হাশেম জোরসে বিড়িতে টান দেয়। উঠোনে বেলগাছের ছায়া পড়েছে। সেই ছায়ায় আঁকাবাঁকা সুন্দর একটা ছবি ফুটে উঠেছে উঠোনের ওপর। সেই ছায়ার দিকে তাকিয়ে ছবিটা রাহানুম হয়ে যায় আবুল হাশেমের দৃষ্টির সামনে। এমন একটা ছবি সেদিন জ্ঞান ফেরার পর আবুল হাশেম দেখেছিল। ওর পাশেই এমন ছবির মতো পড়েছিল রাহানুম। ও কোন এলাকা থেকে ভেসে এসেছিল আবুল হাশেম জানে না। চুলগুলো মুখের ওপর লেপ্টে ছিল। নগ্ন শরীর। আবুল হাশেম চমকে উঠে আত্মস্থ হয়ে দেখেছিল, ও এক তীক্ষধার যুবতী। নিঃসাড়, নিস্পন্দ শরীর। কাছে-ধারে কেউ আর কোথাও নেই। সাগর শান্ত, কোনো ঝড় নেই, বাতাস নেই, বৃষ্টির ফোঁটা নেই, মেঘ নেই। ও ভেবেছিল এমন। শান্ত, স্নিগ্ধ প্রকৃতির মাঝেই জীবন শুরু হয়।

ও উঠে হাঁটতে থাকে। হেঁটে হেঁটে চারপাশে ঘুরে বেড়ায়। দেখতে পায় ঘর-সংসারের অনেক ছোটখাটো জিনিস বালুর মধ্যে গেঁথে আছে। ও একটা শাড়ি কুড়িয়ে এনে ঢেকে দেয় রাহনুমকে। ভেবেছে, ও মৃত। চারদিকে মানুষজন উল্টেপাল্টে পড়ে আছে। কে মৃত, কে জ্ঞান-হারানো বোঝা যায় না। তবে ও কেন রাহামের জন্য মমতা বোধ করল? ও যদি মরেই থাকে তবে কিসের লজ্জা? লজ্জা ঢাকারই বা দরকার কী? এত এক কঠিন সময়–চারদিকে বিপর্যস্ত জীবন। এ জীবনে হাহাকার, ক্রন্দন–তবু সবকিছু ছাড়িয়ে মানুষের জন্য মানুষের মমতা। মানুষইতো পারে মানুষের লজ্জা ঢেকে দিয়ে তাকে বড়ো করে তুলতে। ও শাড়ি দিয়ে ঢেকে দেওয়া রাহালুমের দিকে তাকানোর সঙ্গে সঙ্গে বুকের ভেতর ঝড় বয়ে যায়। আসলে রাহানুম উপলক্ষ মাত্র, ওর বুকের ভেতর তীব্রভাবে গেঁথে আছে মণিমালা। ওর ব্যাকুল দৃষ্টি মণিমালাকে খুঁজছে। ও কোনোকিছু অবলম্বন করে মণিমালার শোক সামলাতে চাইছে, নিজেকে শক্ত করতে চাইছে। কিন্তু পারছে কই? চারদিকে তাকিয়ে অনুভব করতে চায় যে মণিমালা কি কোথাও এমন উলঙ্গ হয়ে পড়ে আছে? শকুনে খুবলে খাচ্ছে মণিমালাকে? না কি ওর মতো কেউ ঢেকে দিচ্ছে মণিমালার লজ্জা? ভাবতেই ড়ুকরে কেঁদে ওঠে ও।

অনেকক্ষণ হাঁটুতে মাথা গুঁজে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে শান্ত হয়। সাগরের গর্জন ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই এ বেলাভূমিতে। কোথাও পাখির ডাকও নেই। ও আকাশের দিকে তাকায়, ঝকঝকে নীল আকাশ, পরিষ্কার দিন। ওর বুক ভেঙে আসে, হাঁটু ভেঙে আসে। খিদেয় ওর পেট জ্বলে, পিপাসায় বুক শুকিয়ে যায়। তারপরও যতটুকু শক্তি ও প্রাণপণ চেষ্টায় যতদূর যেতে পারে ততদূর গিয়ে মণিমালাকে খোঁজে, ছেলেমেয়েদের খোঁজে, না কেউ কোথাও নেই, কারো কোনো চিহ্নও নেই–ওদের কারো একটি জামা, একটি লুঙ্গি অথবা একটি মৃত গরু কিংবা খোয়াড়ের সবচেয়ে বড়ো হাঁসটি। নিজের ভুল হতে পারে ভেবে যারা উপুড় হয়ে আছে তাদের উল্টে দেখে। হতাশ হয়, ক্লান্ত হয়। বুকে হাঁফ ধরে। বুক চেপে গেলে নিঃশ্বাস ফেলতে কষ্ট হয়। ও একটু একটু করে ডাঙার দিকে এগোয়। গাছের ডালে আটকে আছে মানুষ, ঝুলছে। হাত ছড়িয়ে আছে দুদিকে, পায়ে বিশাল ক্ষত। ভয়ে শিউরে ওঠে আবুল হাশেম। দ্রুত চোখ বন্ধ করে। কিন্তু কতবার চোখ বন্ধ করবে ও? সামনেই খেজুর কাঁটায় বিধে আছে তিনটে শিশু–যেন কোচ দিয়ে গেঁথে তোলা মাছ। আরো দৃশ্য আছে–বীভৎস, ভয়াবহ। কিন্তু এইসব দৃশ্য আবুল হাশেম দেখতে চায় না, ওর হৃদয় পীড়িত হয়–পীড়িত হয়ে জ্বলতে থাকে এবং ওর ভেতরে আর একটি জলোচ্ছ্বাস বেড়ে ওঠে–সে বেড়ে ওঠায় গড়াতে থাকে ওর মনোভূমি, ওলটপালট হয়ে যায়–ও বদলাতে থাকে, যেমন বদলায় সাপের খোলস।

আবুল হাশেম নিজেকে নিজের ভেতর ধরে রাখতে পারে না। টের পায় ক্ষয়ে যাচ্ছে, ক্ষয়ে যাচ্ছে পুরনো আবুল হাশেম। ও আবার সমুদ্রের দিকে হাঁটতে থাকে। ও বুঝতে পারে না যে ও কোথায় এসেছে। এখন ও পুবে যাবে না পশ্চিমে? পুবে আছে কি ও বাড়ি-ঘর? না কি পশ্চিমে? একটি ভাঙা ট্রলারের ওপর ও এসে বসে।মাথা কেমন করছে। ট্রলারের গায়ে হেলান দেয়। দেখতে পায় জোয়ার আসছে।

এক সময়ে এই দিন ফুরিয়ে যাবে, রাত আসবে। তখন? না, ভয় পায় না ও। সেইসব দৃশ্যগুলো ওকে এখন আর ভীত করে রাখছে না। ও এইসব দৃশ্য বাস্তব বলে ধরে নিয়েছে। বোঝে বুকের ভেতর ভয়ের কিছু নেই। বুকের ভেতরের ক্ষয়ে যাওয়া ওর ভয় রোধ করেছে। ও ভাঙা ট্রলারে বসে থেকে পাখির ডাক শোনার চেষ্টা করে। কিন্তু না, দু’চারজন মানুষের আর্তনাদ ওর কান ভরে দেয়। এতক্ষণে ও খেয়াল করেনি যে যারা বালুর মধ্যে উপুড় হয়ে চিৎ হয়ে পড়েছিল তারা কেউ কেউ নড়েচড়ে উঠছে–তারা জ্ঞান ফিরে পেয়েছে। এতক্ষণ ওরা মুমূর্ষ ছিল। জ্ঞান ফিরে পেয়ে ওরা আর্তনাদ করছে। ওহ কী নিদারুণ সেই শব্দ। এতক্ষণ ও শব্দ শোনার জন্য ব্যাকুল ছিল। কিন্তু সে তো এমন ভয়াবহ শব্দ নয়। যে শব্দ আনন্দের নয়–সান্ত্বনার নয়–অনুপ্রেরণার নয় সে শব্দ ওকে নিষ্পেষণ করতে থাকে। শব্দ যেন আকাশ-পাতাল ফুড়ে বেরিয়ে আসছে। মানুষের হৃদয়ে কি এমন হাহাকার জমে থাকে? আগে কখনো। তো এমন শব্দ শোনেনি আবুল হাশেম। বিলাপ শুনতে শুনতে ওর শরীর অবশ হয়ে গেলে ও আবার জ্ঞান হারায়। চোখের সামনে বিলুপ্ত হয় এক সকালের এই পরিচিত জায়গাটি।

বিকেলের দিকে জ্ঞান ফিরলে দেখতে পায় ওর পায়ের কাছে রাহানুম, গুটিসুটি বসে আছে–আলুথালু চুল–উদ্ভ্রান্ত চাউনি। আবুল হাশেম ধড়মড়িয়ে উঠে বসে, ভূত দেখার মতো চমকে ওঠে। রাহানুম কেন ওর কাছে এসে বসে আছে তা ও বুঝতে পারে না। যে শাড়িটি কুড়িয়ে এনে আবুল হাশেম ওকে মৃত মনে করে ঢেকে দিয়েছিল সেই শাড়িটি পরে আছে। ও কোনদিকে তাকিয়ে আছে বোঝা যায় না। যদিও আবুল হাশেমের নিজের খুব অবসন্ন লাগছিল, তবুও ওর চেতনা ছিল প্রখর। কিন্তু রাহানুমকে দেখে ওর মনে হচ্ছিল ও সুস্থ নয়, অপ্রকৃতিস্থ। ও মৃদু স্বরে ডাকে, মা, মাগো?

সাড়া নেই। ঘুরেও তাকায় না। দূর সাগরের দিকে তাকিয়ে আছে, মনে হয় ও ভেতরে ভেতরে কোনো একটা কিছুর প্রস্তুতি নিচ্ছে। ও ভাঙবে, গড়বে কিংবা ইস্পাতের মতো কঠিন হবে–এই ভাঙচুরের সময় বড়ো কঠিন সময়। মানুষ যখন কঠিন সময় পার হয় তখন পারিপার্শ্বিকের সবকিছু ভুলে যায়–ওর সামনে বড়ো কিছুই প্রবল হয়ে ওঠে, সেটা সমুদ্র কিংবা আকাশ। আবুল হাশেমের ইচ্ছে করে রাহানুমকে ধরে প্রবলভাবে নাড়িয়ে দিতে। দেখতে চায় মেয়েটি কি মাটির সঙ্গে গেঁথে শিলা হয়ে গেছে না কি ওর মধ্যে প্রাণ আছে? কিন্তু কিছুই করা হয় না। কিছু করতে ভয় পায় ও। আবুল হাশেম বুঝতে পারে রাহানুম আছে বলে ওর অবসন্নতা কেটে যাচ্ছে। ওর ভালো লাগছে–এবং বুকের। ভেতর পাখির ডাক শোনার যে ব্যাকুলতা ছিল তেমন একটি শিস বাড়ছে। ওর ভালো লাগছে।

ও আস্তে আস্তে আবার জিজ্ঞেস করে, তোমার নাম কী মাগো?

রাহানুম জবাব দেয় না। শুধু ওর দিকে তাকায়। আবুল হাশেম ভাবে, এই ট্রলারটিকে মেয়েটি হয়তো একটি আশ্রয় ভেবেছে–একটি ঘর কিংবা গাছের ছায়া। তখন ও বিড়বিড় করে কী যেন বলে আবুল হাশেম বুঝতে পারে না। কিন্তু ওর বিস্ময়ের ঘোর কাটে না। এই মরা মেয়েটি বেঁচে আছে? কিন্তু ওর কণ্ঠে আর্তনাদ নেই কেন? ও বিলাপ করছে না কেন? বিলাপের কথা মনে করতেই ওর বুকটা আবার কেমন হয়ে যায়। ও দুর্বল কণ্ঠে রাহানুমকে বলে, তোমার বাড়ি কোমনে মাগো?

রাহানুম এবারও উত্তর দেয় না। ও কিছুই মনে করতে পারছে না। ও বারবার হাত বাড়ায়, তারপর শূন্য হাত ফিরিয়ে আনে নিজের কোলের ওপর। আবুল হাশেমের ভেতরে ভেতরে জেদ বাড়ে। মেয়েটি কথা বলছে না কেন? কথা বলবে না কেন? ও ওকে আবার একই প্রশ্ন করে। ও তেমনি নির্বিকার। আর কোনো কথা হয় না। ও ট্রলারের ওপর থেকে নেমে পড়ে। খানিকটুকু সামনে হেঁটে আসে। কিন্তু রাহানুমকে ছেড়ে বেশিদূর যেতে পারে না। ফিরে এসে ট্রলারের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। নিরুপায় ক্ষোভ নিয়ে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে থাকে। এখন ভাটি। সরসরিয়ে নেমে যাচ্ছে জল। আবুল হাশেমের মাথা আস্তে আস্তে পরিষ্কার হচ্ছে। ঘোর কেটে যাচ্ছে। ও পরিস্থিতি বুঝতে চাইছে। এখন কী করবে ভেবে কুলিয়ে উঠতে পারছে না। মেয়েটি বারবার হাত বাড়ায় কেন? ও কাকে খোজে? কোন গ্রামের মেয়ে। বাবা কে? স্বামী কি ছিল? কিন্তু ওকে প্রশ্ন করে কী লাভ? ওতো উত্তর দেয় না। আহা বেচারি। ভাবতেই আবুল হাশেম নিজের পরিবারের চিন্তায় ব্যাকুল হয়ে ওঠে। তখন ওর কান্না পায়। ও শব্দ ক করে কেঁদে ওঠে।

কান্নার শব্দে রাহানুম আবুল হাশেমের দিকে ফিরে তাকায়। ওর দৃষ্টি চঞ্চল হয়ে উঠেছে। এতক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে থাকা মানুষটি যেন আপন নিয়মে ফিরে এসেছে। আবুল হাশেম অনুভব করে যে ওর চোখের ভাষা পড়া যাচ্ছে। আবুল হাশেমের মুখের দিকে তাকিয়ে থেকেই ও মাথা নাড়ায়। বিড়বিড়িয়ে বলে, না, মনু না, কাঁদে না। গেদু মোর, কাঁদে না।

আবুল হাশেম কেঁদে কেটে লুঙ্গি দিয়ে চোখ মোছে। তখন রাহানুম। আস্তে আস্তে বলে, কান্দেন ক্যান?

তুমি কান্দ ক্যান?

মোর গেদু? মোর গেদু কোমর্নে? ও মাগো–

রাহানুম এতক্ষণে তারস্বরে চিৎকার করে। বিলাপ করে, ও মোর গেদুরে তুই অহন কোমনে? বানের সময় তুইতো মোর বুকের মইদ্যে ছিলি। ওহ্ হোরে ..

রাহানুমের কান্নার একটা ঢঙ আছে। সেটা অনেকক্ষণ রেশ জাগিয়ে রাখে। সেই শব্দে বিভিন্ন রকম ওঠানামা আছে। আবুল হাশেম কান পেতে শোনে। এই শোনার অভিজ্ঞতা ওর একদম নতুন। ও কখনো এমন শব্দের কান্না শোনেনি। এমন ঘটনাতো ওর জীবনে ঘটেও নি। ও কী করে জানবে যে কান্নার এমন হাজার রকম শব্দ আছে। নিজের কান্নাতো এমন কান পেতে শোনা যায় না। শোনা গেলে বুঝতে পারত কান্নার ওঠানামা কীভাবে হৃদয়কে স্পর্শ করে। সে শব্দ অনুসরণ করে নিজের দিকে তাকালে বুকটা হু-হু করে ওঠে। মণিমালা কোথায়? ও কি কোথাও বসে এমন করে কাঁদছে? মণিমালার বিলাপ আবুল হাশেমকে কখনো শুনতে হয়নি। ও কি সেজন্য ভাগ্যবান? হ্যাঁ, ভাগ্যবান, ভীষণ ভাগ্যবান। তাই এই কান্না ও শুনতে চায় না। রাহানুম কাঁদতেই থাকে। ও এই কান্নার শব্দ থেকে দূরে চলে যাবার জন্য উঠে হাঁটতে থাকে। দ্রুত পায়েই হাঁটে। তখন রাহানুম চিৎকার করে ওর পিছে ছুটে আসে, ও বাবা আমনহে কোমনে যান? মুই আমনহের লগে যামু?

আবুল হাশেম থমকে যায়। স্থাণুর মতো দাঁড়িয়ে থাকে। কে ওকে এমন ব্যাকুল স্বরে বাবা বলে ডাকছে? মেয়েটি তো ওর আত্মজা নয়। তবে ও কে? কে ও? এ কেমন সম্পর্ক মানুষের মধ্যে? কী করে গড়ে ওঠে? আবুল হাশেম স্নেহের ব্যাকুলতায় রাহামের হাত ধরে। ততক্ষণে ওর ফোঁসফোসানি কমেছে। হেঁচকি ওঠা বন্ধ হয়ে আসছে। দৃষ্টি শান্ত, স্পষ্ট। এতক্ষণে ওকে স্বাভাবিক মানবী মনে হচ্ছে।

আবুল হাশেম ওর চোখে চোখ রেখে বলে, মাগো, মুইওতো জানি যে মুই কই যামু? লও, তুমি মোর লগে লও।

তখন সূর্য পশ্চিমে, লাল আভায় লাল হয়ে গেছে দিগন্ত। ভাটির টান শেষ হয়নি। দুজনে কোনো কিছু স্থির করতে না পেরে পশ্চিমমুখো হাঁটতে থাকে। ভাবে যেদিকে আলো সেদিকেই হয়তো ঘর থাকে–মানুষ থাকে, লোকালয় থাকে। কতদূর যেতে হবে? ক্ষুধায়, ক্লান্তিতে পা চলে না। তবু ওরা থামবে না বলেই ঠিক করে। কতদূর হেঁটেছে জানে না–কতদূর যাবে জানে না। বিকেল প্রায় শেষ, সন্ধ্যা ছুঁই ছুঁই করছে। প্রশান্ত সাগরে দিনের শেষ আভা। ওরা দেখতে প্রায় খানিকটা দূরে আরো একটা ভাঙা ট্রলার উল্টে আছে। রাহানুম আবুল হাশেমের মুখের দিকে তাকায়, বাবো, আর আঁটতে পারমু না।

আবুল হাশেম ক্লান্ত কণ্ঠে বলে, মুইও আর আঁটতে পারি না। পাও চলে না।

মোরা ওই ট্রলারটার ধারে বমু।

চলেন ওইহানে যাই।

রাহানুম উৎসাহী কণ্ঠে কথা বলে। ওর ভেতরে জোর ফিরে এসেছে। বাঁচার তাগাদা প্রবল হচ্ছে। এখন ওর একটি আশ্রয় দরকার। ও একজন বাবা পেয়েছে, এখন একটি ঘর পেলে ও হয়তো টিকে যাবে। টিকে যাওয়া ছাড়া এই মুহূর্তে ওর অন্য চিন্তা নেই। আবুল হাশেম বুঝতে পারে বয়সের তারুণ্য ওর ভেতরে দ্রুত শক্তি সঞ্চারিত করেছে। তাই বালুর ওপর দিয়ে বেশ শক্ত পায়ে হেঁটে যাচ্ছে রাহানুম। আবুল হাশেম বেশ খানিকটা পিছিয়ে পড়েছে। ধকলের ক্লান্তি ও কিছুতেই কাটিয়ে উঠতে পারছে না।

দুজনে ভাঙা ট্রলারের কাছাকাছি আসতেই শুনতে পায় শিশুর কান্না। কী করে সম্ভব? চমকে ওঠে রাহানুম। ওর শরীর কেঁপে ওঠে। থমকে দাঁড়িয়ে আবুল হাশেমের মুখের দিকে তাকায়। মুহূর্ত মাত্র। তারপর সেই কান্না লক্ষ্য করে ছুট লাগায়। কিছুদূর ছুটে এসে রাহানুম থেমে যায়। দেখতে পায় ছোটার ফলে ওর স্তন থেকে দুধ ঝরছে, ভিজে গেছে শাড়ি। এই দৃশ্য ওকে আরো ব্যাকুল করে তোলে। ও ছুটতে ছুটতে ভাঙা ট্রলারটার কাছে এসে দাঁড়ায়। শিশুটি ট্রলারের নিচে বসে আছে। হয়তো বছর দুয়েক বয়স হবে। কীভাবে বেঁচে গেল ও? রাহানুম শিশুটির সামনে হুমড়ি খেয়ে বসতে বসতে ভাবে, আল্লাহ বুঝি এমনই দয়ার সাগর। ওর মনে হয় শুধু ওরই জন্য এই শিশুটি এখানে বেঁচে আছে। এই অলৌকিকতা কোনো হিসাবের মধ্যে পড়ে না। কৃতজ্ঞতায় ও অভিভূত হয়ে যায়। ওর বুকের ভেতরের তোলপাড় প্রবল জলোচ্ছ্বাসের চাইতেও বিশাল হয়ে ওঠে। ও ক্ষিপ্র হাতে শিশুটিকে বুকে জড়িয়ে ধরে। আদরে আদরে ওকে পিষ্ট করে। তিন মাস আগে ও মা হয়েছিল, ওর প্রথম সন্তান।

শিশুটি পাগলের মতো ওর বুকে মুখ ঘষে। রাহানুম বুঝতে পারে ওর স্তন নির্গমন চায়, যেটুকু তরল পদার্থ ঝরেছে সেটুকুই যথেষ্ট নয়, আরো ঝরবে, আরো। শিশুটি অস্থির হয়ে উঠেছে। ও আশ্রয় চায়, খাবার চায়। যদিও কান্না ছাড়া এখন ওর আর কোনো ভাষা নেই, তবুও এখন কান্না বন্ধ। ও একবার দুহাতে রাহামের গলা জড়িয়ে ধরে। একবার কাঁধ খামচে দেয়, আর একবার গালে গাল ঘষে। ও কী করবে বুঝতে পারছে না। ওর ক্ষুদ্র হাত রাহামের শরীরের কোনো একটি জায়গায় পৌঁছতে চায়, কারণ ও মায়ের স্তন পান করেছে। ও জানে যে স্বাদ কী। যে স্বাদের জন্য ওর জিহ্বা তীক্ষ হয়ে উঠেছে। কিন্তু ঈপ্সিত জিনিস ও পাচ্ছে না। কেউ ওকে সাহায্য করছে না। কোনো কিছু করতে না পেরে শিশুটি আবার ভঁা করে কেঁদে ফেলে। ওর চিৎকারে রাহামের শ্রবণশক্তি যেন বধির হয়ে যায়। নিজেকে অপরাধী মনে হয়। কেন এই মানব শিশুকে অকারণ কষ্ট দেওয়া? ও শিশুটিকে কাঁধের ওপর ফেলে পিঠ চাপড়ে দিতে চাইলে শিশুটি প্রতিবাদ করে। হাত-পাত ছুঁড়ে চিৎকার করে কোল থেকে নেমে যেতে চায়।

তখন রাহানুম ট্রলারের ভাঙা কাঠের গায়ে হেলান দিয়ে বসে পা ছড়িয়ে দেয়। শিশুটি ওর কোলে। বেশ খানিকটা তফাৎ থেকে আবুল হাশেম এগিয়ে আসছে। ও রাহামের মতো ছুটতে পারেনি। ছুটলে বুকে হাঁফ ধরে, বয়স ওকে জাপটে ধরেছে। রাহানুম বুঝতে পারে যে আবুল হাশেম এগিয়ে আসছে, কিন্তু ও পুরো একজন মানুষকে দেখতে পায় না। চারদিকে অন্ধকার নেমে এসেছে। রাহানুম বুকের কাপড় সরিয়ে শিশুটির মুখে নিজের স্তন তুলে দেয়। ওহ্ কী আনন্দ! কী আশ্চর্য সুন্দর সন্ধ্যার এই নেমে আসা। রাহানুম দু’চোখ মেলে তাকিয়ে থাকে। অনেকদূরে বনভূমির মাথায় যে অন্ধকার নেমেছে তা অস্পষ্ট নয়, গাঢ়–তবু সেখানে আলো দেখতে পায় রাহানুম। পাতার ফাঁক দিয়ে চুইয়ে পড়ছে। আলো, প্রশাখার ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয় আলো–কাণ্ডের ভেতর দিয়ে শেকড়ে পৌঁছে যায় সে আলো। রাহানুম চোখ বুজতে পারে না–চোখের পাতা পড়ে না। ওর মাথায় স্বপ্ন ঘনিয়ে ওঠে–সে স্বপ্নের ভেতর দিয়ে আলোর নদী বয়ে যায়। ও বুঝে যায় এই মহাপ্রলয়ের পর জীবনের এইটুকু সুখ ওর পাওনা ছিল।

আবুল হাশেম ধীরে পায়ে এগিয়ে এসে দেখতে পায় এক অলৌকিক স্বর্গীয় দৃশ্য। রাহালুমের উন্মুক্ত বুকে এক মানব শিশু। শিশুটিকে নিয়ে ও মগ্ন হয়ে আছে। ওর কোনোদিকে খেয়াল নেই। এই পৃথিবী ওর কাছে। অবলুপ্ত হয়েছে, গতরাতের জলোচ্ছ্বাস এখন আর ওর জীবনে মহাপ্রলয় নয়। ও জানে ও একজন মানবী–ও প্রকৃতি–শিশুদের বাঁচিয়ে রাখা ওর ধর্ম।

এই দৃশ্য দেখে আবুল হাশেমের বুক ভরে যায়, প্রচণ্ড তৃপ্তি ওকে আচ্ছন্ন করে। ওদের প্রথম সন্তান হবার পর মণিমালাকেও এমনই লাগছিল–প্রকৃতির মতো জীবনদায়িনী, যাদের ক্রোড়স্পর্শ না পেলে বন্ধ হয়ে যেত মানবজাতির ধারাবাহিকতা। এখন অন্ধকার বলে রাহানুমের মুখটা পরিষ্কার দেখা যায় না, তবু সে মুখে জ্যোতি আছে, আবুল হাশেমের এটা অনুভব। তখন মণিমালাকে দেখতে ওর ভালো লাগত, নতুন মনে হতো, কেমন জানি অন্যরকম। মণিমালার চেহারায় আলোর জ্যোতি খেলত। মণিমালা লজ্জা পেয়ে বলত, এমন করে তাকিয়ে থাহেন ক্যা?

আবুল হাশেম মাথা নেড়ে বলত, কী জানি ক্যা।

উত্তরটা ওর নিজের কাছেও পরিষ্কার ছিল না। আবুল হাশেমের অন্যমনস্ক মাথা নাড়া দেখে মণিমালা ছেলেকে শাড়ির আঁচলের নিচে আড়াল করে বলত, আমনেহ তাকায়ে থাকলে পোলাডার যদি কিছু অয়?

ওই কথা শুনে লজ্জায় কুঁকড়ে যেত আবুল হাশেম। অপরাধীর মতো দ্রুত সরে যেত মা ও ছেলের সামনে থেকে। এই কথা মনে করেই ও ভাঙা ট্রলারের উল্টোদিকে চলে যায়। ওর তাকিয়ে থাকা দিয়ে ও কারো ক্ষতি করতে চায় না, আর কোনো ওলটপালট নয়। এখন এক দারুণ সময়। প্রত্যেকেই নতুন জীবনের সূচনায় দাঁড়িয়ে আছে। আবুল হাশেমের করোটিতে বানের পানি পলিমাটি ফেলে। যেন বলছে, শুভযাত্রা হোক, শুভযাত্রা। এই সময়, এই অন্ধকার ওর ভালোই লাগছে।

উল্টো দিকে আসতেই দেখে ট্রলারের ফাঁকে একজোড়া নারকেল আটকে আছে। ও খুশি হয়ে যায়। এখন ওদের কিছু খাবার দরকার, নইলে শক্তি ফুরিয়ে আসছে। ও ট্রলারের গায়ে পিটিয়ে নারকেল ভাঙে। দাঁত দিয়ে কামড়িয়ে কয়েক টুকরো বের করে। ট্রলারের ওপর থেকে রাহামের দিকে হাত বাড়িয়ে দেয়, ল মা খা।

কি যে ভোখ লাগছিল মাগো। আমনহে না থাকলে কে মোরে খান দিত বাবো?

রাহানুমের কৃতজ্ঞ কণ্ঠ শুনে আবুল হাশেমের বুক জুড়িয়ে যায়। কোনো জবাব দেয় না। একটু পরপর নারকেলের টুকরো রাহামের হাতে তুলে দেয়। রাহানুম কুটকুট শব্দে নারকেল চিবোয়। দুজনে। অনেকক্ষণ ধরে একজোড়া নারকেল খেয়ে ফেলে।

পেটপুরে খেয়ে শিশুটি ওর নতুন মার কোলে ঘুমিয়ে আছে। ওর জন্য নিরাপদ, নিশ্চিত আশ্রয়। ট্রলারের পাটাতনে আবুল হাশেম চিৎপাত শুয়ে থাকে। চোখে ঘুম নেই। মাথার ওপর তারাভরা আকাশ। অসংখ্য জ্বলজ্বলে তারা ভোরের শিউলির মতো ছড়িয়ে আছে। সেই শৈশবে শিউলি-কুড়োনোর দিন ছিল ওর জীবনে, স্মৃতির ভেতরে তারার মতো ফুটে আছে তা। সেই দিনগুলো কখনো মিথ্যে হয়ে যায় না, সময়ের ভাঁজে ভাঁজে ড়ুবে থাকে। সময়ের ভাজ পড়ে সময়ের ওপর–এভাবেইতো এগিয়ে যায় জীবন।

ও খুব কোমল কণ্ঠে রাহামকে ডাকে, রাহনুম? মাগো? সাড়া নেই। হয়তো ট্রলারের গায়ে মাথা রেখে ঘুমিয়ে গেছে। রাহামের কাছ থেকে ওর কথা শুনতে চেয়েছিল আবুল হাশেম। কেমন সময় ওর জীবনের ওপর দিয়ে বয়ে গেছে তা জানার বড় সাধ হয়। কিন্তু না, ওর ঘুম আর ভাঙাতে চায় না। ও অবাক হয় এই ভেবে যে এই মেয়েটি কত সহজে ওর কাছাকাছি চলে এসেছে–কত সহজে একটি শিশুর মা হয়েছে। সবইতো সেই জীবনের ধারাবাহিকতা যে জীবনের কোনোকিছু হারিয়ে যায় না। স্মৃতির ভাজে জড়িয়ে থাকে সেইসব দিন। শুধু প্রয়োজন মানুষকে বদলে দেয় খানিকটুকু।

আবুল হাশেম ঘুমহীন চোখে দেখে আকাশে নক্ষত্র, নক্ষত্রপুঞ্জ ছায়াপথ, অজবীথি, এক মহাবিশ্ব। এইসব নিয়ে এতদিনের জীবন হারিয়ে আর এক জীবন গড়ে ওঠে। এইসব দিয়ে মানুষ, মানুষ থেকে। মানুষের ভেতর চলে যায়।

এভাবেই তিনজন মানুষের ঘর-সংসার আবার গড়ে ওঠে। তখনো অন্ধকার ভালো করে কাটেনি। রাহানুম দ্রুত পায়ে নিঃশব্দে সাগরের পাড়ে এসে দাঁড়ায়। দেখে এসেছে নিঃসাড় ঘুমচ্ছে আবুল হাশেম। সুখদীপ ওর গলা জড়িয়ে রেখেছিল। রাহানুম হাত ছাড়িয়ে উঠে এসেছে। ভোরের ঠাণ্ডা বাতাসে ঘুমের আমেজ কেটে যায়। বড়ো বড়ো ঢেউ এসে গড়িয়ে যাচ্ছে সৈকতে।

এ সময়ে এভাবে সাগরের পাড়ে ছুটে আসা ওর এক প্রিয় অভ্যেস হয়েছে। ঘুম ভেঙে গেলে জোর করে আর চোখের পাতা বুজে রাখতে পারে না–তোলপাড় করে বুক; মন খারাপ প্রবল হয়ে উঠতে থাকে, তখন ও ভোরের স্নিগ্ধ বাতাস গায়ে মেখে ছুটে আসে। ও জানে এই ছুটে আসা ওর মুক্তি–নইলে ভেতরটা গুড়িয়ে যেতে থাকে। এই অভ্যেস ওর এই নতুন জীবনের–আগে ও কখনো সাগর দেখেনি। সাগর থেকে বেশ খানিকটা দূরে ছিল ওদের গ্রাম–এভাবে চাইলেই ছুটে যেতে পারত না। এখন সাগর এত আপন হয়েছে যে বিশ বছর ও সাগর।

দেখে কাটিয়েছে, এটা ওর মনেই হয় না। এই আপন হয়ে ওঠা ওর এক দারুণ অভিজ্ঞতা–ওকে বাঁচিয়ে দিয়েছে অবিরত দুঃখের দংশন থেকে। ও জলের ভেতর লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে নিজেকে উজাড় করে। ফেলে।

আজো রাহানুম এক পা, দু’পা করে পানিতে নামে। আজ আর ঝাপিয়ে পড়ে না ও। একটু একটু করে পানির সঙ্গসুখ অনুভব করতে চায়। ও এভাবেই উপভোগ করে। প্রতিদিন একইভাবে নিজেকে উজাড় করে না। একটু একটু করে এগুতে ওর মনে হয় যতই পানির স্পর্শ বাড়ে ততই শিরশির করে শরীর। বিশ বছর বয়সে মা হয়েছিল ও, বিয়ে হয়েছিল আঠারোতে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই তো ভেঙে গেল সব। ঢেউ ওর গলা সমান হয়েছে, আর একটা ঢেউ এলে তলিয়ে যাবে ও। তারপর ভুস করে মাথা জাগিয়ে উঠবে।

কিন্তু গলা সমান পানি থেকে ও আবার তীরের দিকে যায়, এত তাড়াতাড়ি ড়ুবতে চায় না। এটুকুই ওর মজা, এক ধরনের সুখ। অনেকটা যৌন সুখের মতো, বিয়ের পরই যে অনুভূতি ওকে আচমকা ধাক্কায় বদলে দিয়েছিল। এই বিস্ময়ের ঘোর কাটতে সময় লেগেছিল ওর। এখন মনে হয় বিশ বছর বয়সে একজন নারীর জীবন থেকে পুরুষ হারিয়ে গেলে হয়তো এমনই হতে পারে। ও জানে না এমন হয় কি না, ও বোঝে না এমন হওয়া উচিত কি না। শুধু ওর জীবনে এটুকু কি সম্পদ হয়ে থাকবে? অনুভূতির সম্পদ? ও বিড়বিড়িয়ে বলে, থাকুক, থাকুক।

শাড়িটা ওর গায়ে লেপ্টে গেছে। আলো ফুটলে ও নিজেকে পরিষ্কার দেখতে পাবে। দিনের প্রথম আলোতে নিজেকে দেখাটা ওর আনন্দ। কোথাও কেউ নেই, এ সময় কেউ থাকে না। তাই নিজেকে ছড়িয়ে রাখার এই জায়গাটা ওর আপন ঘরের কোণের মতোই লাগে–মনে হয় না এই খোলামেলা বিশাল চারপাশ অন্যদেরও, সবার। ও সৈকতে উঠে আসে। স্রোতে ভেসে আসা হিংরা কুড়ানোর জন্য ও বালুর ওপর হাঁটু গেড়ে বসে। রোদ উঠলে ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা হিংরা কুড়ানোর জন্য ছুটে আসবে। এক একজন প্রায় ছোটখাটো এক ঝুড়ি হিংরা সংগ্রহ করতে পারে। রাহানুমও একটা টুকরি নিয়ে এসেছে। ও খুঁজে খুঁজে হিংরা তোলে আর গুনগুনিয়ে গান গায়। এই গানটা জামালের খুব প্রিয় ছিল। অন্ধকারে পুকুরপাড়ে দুজনে বসলে জামাল ওকে গান গাইতে বলত। ও চাপাস্বরে গাইত। ভয় ছিল পাছে বাড়ির লোকেরা শুনে ফেলে। জামাল ওর কণ্ঠে অভিভূত হয়ে বলত, আহা কী মিষ্টি গলা! আর একড়া গান গাও ময়না।

ধুত না। মানহে মন্দ বলবে।

অহনতো কোনো মানু নাই। ক্যাবল তুমি আর আমি।

তবু গলা ছেড়ে গান গাইতে ওর সংকোচ হতো। একটির বেশি দুটিও কখনো গাওয়া হয়নি। হিংরা তুলতে তুলতে মুহূর্তে হাত থেমে যায়। সাগরের দিকে তাকিয়ে নিঃশ্বাস ফেলে, এখন জামাল কোথায়?

কিন্তু ভাবনা বেশিক্ষণ স্থিত হয় না। আবার ও ফিরে আসে নিজের বলয়ে–আবার কণ্ঠ গুনগুনিয়ে ওঠে। দ্রুত হাত চলে। প্রতিদিন ভোরবেলা সাগরে আসা হয় না। মাঝে মাঝে আসে, যেদিন করোটিতে রঙিন মাছ পাখনা মেলে ভেসে ওঠে সেদিন ও না এসে থাকতে পারে না, দেখতে চায় নিজেকে। ভোরের কুমারী আলোয় একজন কুমারী মেয়ের আকাক্ষা তীব্র হয়ে উঠলে–শরীরে রঙিন মাছ খুনসুটি করলে ও আর নিজেকে স্থির রাখতে পারে না। এই সাগর, বনানী, আকাশ এবং দিনের শুরুতে ও দেখতে পায় জলোচ্ছ্বাসে ধুয়ে যাওয়া একটি ছোট্ট জনপদ। আবুল হাশেমের সংসারে স্থিত হওয়ার পর ও আবুল হাশেমকে সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিল নিজের গ্রামে, কিন্তু না সেখানে গ্রামের কোনো চিহ্ন নেই–একজন মানুষ, একটি ছাগল, একটি হাঁস কিংবা একটি গাছ কিছুই, কেবল খাঁ-খাঁ শূন্যতা, ধুয়ে পরিষ্কার হয়ে যাওয়া সাদা মাটি। সেই শূন্যতায় কেমন অবশ হয়ে গিয়েছিল ওর চিন্তাশক্তি এমন করে ধ্বংস হয়ে যেতে পারে একটি গাঁ? একফোঁটা চিহ্নও পেছনে ফেলে রাখবে না? ও ভাবতে পারে না। ফলে ওর কান্না আসে না, দুঃখও হয় না–ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে শুধু। একসময়ে আবুল হাশেম ওর হাত ধরে বলে, চল মা?

ও আবুল হাশেমের মুখের দিকে তাকিয়ে বলেছিল, কোমনে?

ক্যা মোর ঘরে?

আমনেহর ঘর?

তখন ওর সামনে ঘর ছিল না, ভিটেও না। দৃষ্টিতে শূন্যতায় বাধা পায় না। যতদূর চোখ যায় ঘর কোথায়? সে সময়ে ওর কোলে সুখদীপ কেঁদে ওঠে এবং সঙ্গে সঙ্গে সেই শূন্যতায় শিশুর কান্না জীবনের প্রবাহ ফিরিয়ে আনে। ও সুখদীপকে ঘাড়ের ওপর ফেলে পিঠ চাপড়ে কান্না থামাতে চায়। তারপর আবুল হাশেমের দিকে ফিরে বলে, বাবো, চলেন, আমনের ঘরে যাই।

তারপর ভেবেছিল জামাল বেঁচে থাকলে একদিন না একদিন ওকে খুঁজতে আসবে। আবুল হাশেমও ওকে এমন আশ্বাসই দিয়েছিল। ও আশায় আশায় দিন গুনেছে। কই এলো না তো, প্রতীক্ষার প্রহরই শেষ। সাগরের দিকে তাকিয়ে থেকেছে, কোনো ইঞ্জিন নৌকা কিংবা ট্রলারের আশায়। রাস্তার দিকে তাকিয়ে থেকেছে একটি মানুষের বিন্দু থেকে বৃহৎ হয়ে ওঠার আশায়, কিন্তু সবটাই অলীক, বৃথাই কেটে গেল কতগুলো বছর। সাগর যদি তিরিশ ফুট উঁচু হয়ে ওঠে, বাঁচতে পারে না অনেকে, যেমন মণিমালারা কিংবা জামালরা। শুধু আবুল হাশেমরা, রাহনুমরা বেঁচে থাকে আর একটি ঘর গড়ে তোলার আশায়। এবং সেই সঙ্গে একটি শিশুও। ওহ্ একটি শিশু! সেদিন দুধের ভারে কী বিশালকায় হয়ে উঠেছিল ওর স্তন। কী অপার আনন্দ ছিল একটি শিশুকে বুকে জড়িয়ে ধরার মধ্যে। আজ? আজ রাহানুম অন্যকিছু চায়–অন্য স্পর্শ, একটি হাত, একজোড়া ঠোঁট, গভীর নিঃশ্বাস। রাহামের সর্বাঙ্গে রঙিন মাছটা উঠে আসে–সোনালি শরীরের মাছে কালো ফোঁটা। সূঁচালো ঠোঁট। মাছের সুঁচালো ঠোঁট ওর শরীরে ঘুরে বেড়ায়। রাহানুম ব্রিত বোধ করে। ও হিংরার টুকরি রেখে আবার নেমে আসে জলে। পায়ের পাতার সমান জল–সেখানে মাছের সুঁচালো ঠোঁট। হাঁটু সমান জল–সেখানে মাছের ঠোঁট। কোমর সমান জল–সেখানে মাছের সুঁচালো ঠোঁট। বুক সমান জল, মাছের সঁচালো ঠোঠের ওপর বুক কাঁপে–কেঁপে কেঁপে এলিয়ে পড়ে, আলুথালু হয়ে যায়, অগোছালো হয়ে যায়–সাগরের তিরিশ ফুট ফুলে-ফেঁপে ওঠার মতো স্বাভাবিক, উন্মত্ত এবং গর্জমান হয়ে যায়। তখন স্রোতে ওর শাড়ি ভেসে গেলে ও নিজেই একটা রঙিন মাছ হয়ে যায়–স্বপ্নের, যন্ত্রণার এবং আগামী দিনের। রাহানুমের কান্না পায়। ও ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে। নিজেকে ফাঁকি দিয়ে সাগরে এসে এই সুখ মেটানোর দায় থেকে ও নিজেকে মুক্ত করতে চায়। কেবলই ভাবে, এভাবে নয়, এভাবে নয়। এই নগ্ন শরীর নিয়ে ও কী করবে? ওর তো কিছু চাওয়া আছে।

তখনো সূর্য ওঠেনি। আকাশ লাল হয়েছে মাত্র। ও দু’চোখ মেলে দিগন্ত দেখে। এভাবেই তো বিশাল হওয়া–এভাবেই তো শুরু, এভাবেই। প্রথমে নীল ছিল আকাশ, তারপর সাদা হলো, তারপর লাল–রাহানুম নিজের মনে জোর খোঁজে এই ভেবে যে শুধু আকাশ বদলাবে কেন? কেন রূপান্তর সর্বত্র নয়? কেন নিজের মধ্যে নয়? যৌবনটা নীল ছিল, জামালের সঙ্গ-সুখ ছিল, মাতৃত্বের স্বাদ ছিল–সন্তানের আনন্দ–সবকিছু মুছে গিয়ে কেমন সাদা হয়ে গেল দিনগুলো, কত আর অপেক্ষা, কত? কোথাও থেকে তো জামাল আসে না–না সাগর থেকে, না বনভূমি থেকে, যেমন অনেক সময় অকস্মাৎ ফিরে আসত মাছ ধরা ফেলে রেখে, তখন ওর মধ্যে ঘরের টান প্রবল হয়ে উঠত–রাতগুলো হয়ে যেত নির্মল সাদা মেঘ। তারাভরা আকাশের দিকে তাকিয়ে দুজনে বসে থাকত পুকুরপাড়ে, মাথার ওপর শ্যামকুঁকড়ার ডাক। একটি নির্দিষ্ট গাছের মাথার দিকে তাকিয়ে থাকলে সেই মাথা দূর থেকে ক্রমাগত কাছে চলে আসত। একদম সামনে, একটি নকশিকাঁথার নকশা হয়ে–চিত্রিত ফুল বা হাঁড়ি, গাছ বা হরিণ–যেমন ঘন বন গজিয়ে উঠেছে ফাতরার চরে তেমন বন গজিয়ে ওঠে রাহালুমের চোখের সামনে। কোনো একটি জিনিস কাছে চলে এলে তখন ওর দুচোখের দৃষ্টি একসঙ্গে কাজ করে না। ডান চোখ দিয়ে তাকালে বাম চোখ সরে যায়, বাম চোখ দিয়ে তাকালে ডান চোখ। তখন আন্ধারমানিক নদী ওর মাথার মধ্যে খেলা করে–দৃষ্টির রেখা নদীর জল হয়ে সাগরের দিকে ছোটে।

জামালকে ও অনেকদিন বলেছিল সাগর দেখাতে নিয়ে যেতে। বলেছিল, মোর সাগর দেহার বড় সাধ। দেখমু ঢেউ কেমুন গর্জন করে।

তোমার ভয় করব না?

জামালের ঠোঁটে হাসির ঝিলিক।

ক্যা? পানিরে ভয় কী?

জামাল বলেছিল, ঠিক আছে, একদিন তোমারে সাগরে লইয়া যামু। ঢেউয়ের মদ্যে ভাসায়ে দিমু। তখন ভয় পাইলে–কথা শেষ না করতে দিয়ে রাহানুম বলেছিল, ভয় পাইলে কী? তুমি তো লগে থাকবা। তোমারে জাপটায়ে ধইরা রাখমু।

ক্যামনে ধরবা এহন দেহাও।

ধুত, ক্যাবল শয়তানি।

হাসতে হাসতে জামাল ওকে জড়িয়ে ধরে। জামাল জড়িয়ে ধরলে ওর কাছে তা সাগরে যাওয়ার সুখ হয়ে যেত।

এখন? এখন ও বোঝে পানি কত ভয়াবহ, প্রলয়ঙ্করী, ধ্বংসকারী হয়। কে বলে পানির অপর নাম জীবন? মরণ, মরণ বলতে বলতে রাহানুম জল ছেড়ে উঠে আসতে থাকে–ভিজে শাড়ি পায়ে জড়িয়ে। যায়। ওর দৃষ্টি সৈকতে আটকে থাকে। ও বাম চোখে দেখতে থাকে পানির একটি সবুজ রেখা আকাশ ছুঁয়েছে ডান চোখে দেখে এক বিশাল বালির পাহাড় মাথা ছাড়িয়ে উঠেছে। অনবরত বালি ঝরছে সেখান থেকে। সে বালি ধুয়ে যাচ্ছে সাগরের জলে। যেদিন সুখদীপকে পেয়েছিল সেদিনও তো এমন বালি ধুয়ে যাচ্ছিল সাগরের জলে। সুখদীপ নামটা ওর রাখা। সেদিন সুখদীপকে না পেলে ওর জীবনটা হয়তো অন্য রকম হতো–যেমন আবুল হাশেমের সঙ্গে দেখা না হলে। ওর শরীর থেকে জল গড়িয়ে নামে। ও আর জলের ভেতর নেই। হিংরার টুকরিটা কাঁখে তুলে নিলে ও বুঝতে পারে ওর এবার ঘরে ফেরার সময়। ঘর? ঘর মানে কী? তিনজন মানুষ এক জায়গায় হলেই কি ঘর হয়? হৃদয়ের বন্ধন কি জোড়াতালির উর্ধ্বে, নাকি জোড়াতালির মধ্যে? রাহালুমের কাছে এর কোনো নির্দিষ্ট জবাব নেই। ও হাঁটতে থাকে। চারদিক খোলা এই হা-হা করা শূন্যতায় রাহালুমের একটা পাতানো ঘর থাকলেও রাহানুম বড়ো বেশি নিঃসঙ্গ বোধ করে। ধুয়েমুছে গেছে ওর বাবা-মা-ভাই-বোেন, ধুয়ে মুছে গেছে শ্বশুর-শাশুড়ি, স্বামী, ননদ–কিংবা ওরা কেউ কোথাও বেঁচে থাকলেও ও কারো হদিস জানে না। নিজের জীবন ছাড়া ওদের কোনো চিহ্ন নেই ওর কাছে। ওর এই নিঃসঙ্গতা কোনো আপাত নিঃসঙ্গতা নয়–এর বিস্তৃতি ব্যাপক এবং গভীর। এই গভীরতা থেকে ওর মুক্তি নেই। সৈকত পেরিয়ে আসার আগে ও একবার পেছন ফিরে তাকায়। এখানে কেবল চারদিকের সাদা আলো আর রাহানুম। আর কেউ নেই–আর কেউ কাছে এসে দাঁড়ায় না–শুধু স্বপ্নের মধ্যে রঙিন মাছটা সূচালো মুখ নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। রাহানুম আর একা থাকতে চায় না–চায় আর কাউকে, আর একজন মানুষ। এই সাদা আলোর ভেতর থেকে বেরিয়ে আসা জীবনের একটা ভিন্ন স্রোত।

যে এসে বলবে, তোমার জন্য কতকাল ধরে অপেক্ষায় আছি, কেন তোমাকে খুঁজে পাই না, কেন লুকিয়ে থাকো? সেই কণ্ঠস্বর যেন উথালপাথাল করে আছড়ে পড়ছে কানের ওপর। শিরশির করে ওঠে শরীর। ও মনে মনে বলে, ক্যামনে তুমি মোরে পাইবা? মোর যে শরম করে। লোকটি এগিয়ে এসে ওর হাত ধরে, শরম কেন রাহনুম? আমি তোমার কতকালের চেনা–তুমি আমার সব জানো–সব। আমি তাকালে আমার চোখে তুমি বাঁধা পড়ো, আমি কাছে দাড়ালে আমার গায়ের গন্ধ তোমাকে তাড়িত করে। আমি হাত বাড়ালে তুমি বিবি হাওয়া হয়ে ছুটে এসে দু’হাত বাড়িয়ে সে হাত ধরো। আমি আর তুমি হেঁটে যাই স্বর্গীয় উদ্যানের ভেতর দিয়ে, পেরিয়ে যাই উদ্যানের সীমানা। পেছনে পড়ে থাকে ঈশ্বরের হাহাকার। আমরা তাকাই না, ফিরি না–আমরা পৃথিবীর। আদর্শ মানুষ হয়ে নরম মাটিতে পা রেখে ঘর গড়ি।

চেতনার পথে কত কিছু কেমন করে ঢুকে যায়–এত কিছু ভাবনা ওর করোটিতে ভেসে আসে কোথা থেকে ও জানে না–মানুষের আদিম ভাবনা বুঝি এমন–এমন। ওর মন খারাপ হয়ে গেলে হিংরার টুকরিটা অসম্ভব ভারী মনে হয়। ওই বালুভূমি ছাড়িয়ে বনভূমিতে ওঠে। পায়ের নিচে দূর্বা ঘাস, মেটো পথের দুপাশে বৈচি, বনবরই আর ভট ফুলের ঝোপ। দূরে গোল হয়ে আছে মিঠে পানির জলাভূমি, তার ওপাশে ধানক্ষেত, নারকেল গাছগুলো সবচেয়ে উঁচু হয়ে মাথা তুলে রেখেছে। প্রতিদিনের চেনা এই পথ–প্রতিদিনের আসা-যাওয়া, তবুও এই পথের দু’পাশে কোথাও একটা ছন্দ আছে, সেটা ও অন্যদিন দেখতে পায় না, আজ পাচ্ছে। আজ ওর অন্যরকম লাগছে কেন? ওর ইচ্ছে হয় একটু বসতে। মনে হয় ইচেছইতো সব–ইচ্ছেইতো মানুষকে চালিয়ে নিয়ে বেড়ায়। ছুটতে বলে, বসতে বলে। খেতে বলে, ঘুমুতে বলে। ইচ্ছে না থাকলে কি চলা যায়? বেগবান হওয়া যায়? হঠাৎ করে মাথার ওপর পাখি ডেকে ওঠে। ও ওপরে তাকায়–পাখির ডাকে নিজের ইচ্ছেটাই যেন কচকচিয়ে ওঠে। রাহানুম খুশিতে চারদিক তাকায়। পাখিটা উড়তে উড়তে অনেকদূর চলে যাচ্ছে–মিলিয়ে যাচ্ছে, আর দেখা যাচ্ছে না। দেখাতো যাবেই না। সবকিছুই এক সময় না এক সময় জীবন থেকে মুছে যায়। উল্টো দিক থেকে উড়তে উড়তে আসে নতুন পাখি। ও জঙ্গলের ভেতর খানিকটা ঢুকে দাঁড়িয়ে থাকে। হিংরার টুকরিটা কোমর থেকে নিচে নামায়। ভারী টুকরি বহন করার ফলে কোমরে কেমন খিচ ধরে আছে। নিজেকে টানটান করার জন্য ও দু’হাত ওপরে তোলে। বাঁয়ে ঝোঁকে, ডানে ঝেকে–আড়মোড়া ভাঙে। বেশ ঝরঝরে লাগছে।

তখন ওর মনে হয় কেন কেবলই ঘরে ফেরা? কেন দেরি করলে কী হয়? সুখদীপ খিদেয় কাঁদছে? সুখদীপ ওর ছেলে–ছেলের জন্য ওর বুকে মমতা আছে। সুখদীপ কাঁদলে ওর কষ্ট হবে। তাই ওকে হিংরা সেদ্ধ করে লবণ মাখিয়ে দিতে হবে। ও খাবে। খেয়ে দেয়ে খেলতে যাবে। ছেলেকে খুশি রাখা কি মার দায়িত্ব? হয়তো তাই। রাহানুম নিজেকে বোঝায়। শুধু সুখদীপ কেন, ঘরে আবুল হাশেম আছে। তাকেও খেতে দিতে হবে। সে হিংরা সেদ্ধ খাবে না। খাবে পান্তা, সঙ্গে বাসি তরকারি কিংবা একমুঠি পোড়া মরিচ। মরিচে লাল হয়ে যাবে ভাত-ভর্তি সানকি। খেয়েদেয়ে আবুল হাশেম বেরুবে। সংসারে কত কাজ আছে সেগুলো করতে হয়। তারপর রাহানুম নিজে ভাত খাবে। খেয়েদেয়ে বড়ো করে ঢেকুর তুললে ওর মনে হয় জীবনের একটা সীমানা আছে। এপার আর ওপার। জলোচ্ছাসের সেই কালরাত সেই সীমানা টানা লাইন। মোটা দাগে টানা, মুছে ফেলা কঠিন। ঢেকুর তোলার পর কি? রাতের এঁটো বাসনকোসন-হাঁড়িপাতিল ধোওয়া, উঠোন ঝাড় দেওয়া, গোয়াল পরিষ্কার। করা, দুপুরের রান্নার জন্য তৈরি হওয়া? এই যদি সব হয় তাহলে কেন ঘরে ফিরবে? না, আজ ও ফিরবে না। ও একটা বড়ো গাছের কাণ্ডে হেলান দিয়ে বসে থাকে। পা ছড়িয়ে দেয়, ভিজে শাড়ি গা থেকে আগলা করে পানি নিংড়ায়। ওপর থেকে শুকনো পাতা ঝরে পড়ে ওর কোলের ওপর। পাতাটা নেড়েচেড়ে নিরিখ করার জন্য চোখের সামনে ধরতেই দৃষ্টি ডান এবং বাম হয়ে যায়।

জামাল ওকে নিয়ে বেড়াতে অলোবাসতো। পুকুরপাড় থেকে উঠে আসতে রাত হয়ে যেত–ওদের চারদিকে জোনাকির ভিড় জমে উঠত। মাত্র দুটো বছর, তবুতো এখনো জামালই–সবকিছু ফুরিয়ে যাবার পরও ছয় বছর পেরিয়েছে তবু জামালই ওর জীবনে সত্য হয়ে আছে। এই সত্য এখন আর ওর মানতে ভালো লাগে না–এই সত্যকে ও অস্বীকার করে নতুনের প্রতিষ্ঠা চায়। যেমন করে একদিন জামাল ওর জীবনে নতুনের দরজা খুলেছিল। কত রাত, কত দিন ওদের ভালো লাগার মুহূর্ত পেরিয়েছে। ওদের খুনসুটি দেখে রাগ করত ওর ভাশুর। রাগী মানুষটির কাছে হৃদয়ের ব্যাপারগুলো ছিল উপেক্ষণীয়, মূল্যহীন। কিন্তু জামাল তার বড় ভাইয়ের মনোভাব কখনো মানেনি। রাহালুমের সঙ্গে ওর শারীরিক সম্পর্কের চেয়ে অনেক গাঢ় সম্পর্ক ছিল মনের। তাহলে জামালই কি ওর জীবনের একমাত্র মানুষ থাকবে? রাহানুম পাতাটা পায়ের নিচে রাখে। মনে মনে বলে, না, এই শুকনো পাতার মতো ঝরে যাবে জামাল। আবার বসন্ত, আবার নতুন পাতা গজানোর দিন। আমি কিছুতেই ফুরিয়ে যাব না।

আমি কি একজন মানুষ? না, অনেকজন? আমি কি ঢেউয়ের মতো ভেঙে ভেঙে বিশাল হই? ঢেউ যেমন স্রোতে মিশে যায়—খলখল কলকল শব্দে গড়ায়–গড়াতে গড়াতে–আহ আমি আর ভাবতে চাই না। ও তখন শুকনো পাতা পায়ের নিচে মাড়িয়ে চলে, একটি দিনের শুরু, আর একটি দিনের শেষ। অতএব আমি অনেক, অনেকজন। চারদিক থেকে সাদা আলো মুছে যাচ্ছে–দিন স্পষ্ট হয়ে উঠছে। উঠবেই। তাই সরে যাচ্ছে গাছের মাথার ওপর থেকে ফিকে অন্ধকার। রাহানুম অস্থির বোধ করে। এক পা দুপা ফেলে জঙ্গলের ভেতর খানিকটা হেঁটে আসে। এখানে অন্য কোনো প্রাণী নেই, ভয় শুধু সাপ, নয়তো শুয়োপোকা। শুয়োপোকা ভীষণ ভয় পায় রাহানুম। হঠাৎ করে সেই ভয়ে ও চারদিক তাকায়–পাতার নিচ, পাতার ওপর দেখে। না কোথাও খুঁয়োপোকা নেই। সামনে পিছনে সাপও নেই। এই মুহূর্তে এটা ওর জন্য ভীষণ নিরাপদ জায়গা। তবুও ওকে ঘরে ফিরতে হবে।

এই মেঠো শুকনো মাটির পথ বেয়ে আমাকে পৌছুতে হবে ঘরে–ঘরে আমার জন্য অনেক কাজ অপেক্ষা করছে। আমি গেলে নড়বে গৃহস্থালি, সুস্থির হবে গৃহস্থালি–সেই ভুবন একটি স্বাভাবিক আকার পাবে। নইলে নকশা উল্টে যাবে, বেঢপ আকার গ্রাস করে ঘরের মানুষকে–প্রত্যেকে বিরক্ত হয়, মন খারাপ করে এবং তা কারোই কাম্য নয়। সুতরাং আমাকে যেতেই হবে। নিজের জন্যও এই যাওয়া। আমি এখন বৃত্তের মধ্যে প্রবেশ কর।

রাহানুম হিংরার টুকরি নিয়ে উঠে দাঁড়ায়। গাছের আড়াল থেকে তখনো বের হয়নি। পা দুরে কি দাবে না তখন পেছনে শুনতে পায় গানের সুর–কেউ বুঝি গান গাইতে গাইতে এগিয়ে আসছে। পরিচিত সুর নয়–গাঁয়ের চেনা কেউ হবে বলে ওর মনে হয় না। লোকটি এগিয়ে এসেছে। রাহানুম গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে দেখে। না, লোকটিকে ও চেনে না। সম্ভবত ও ভিন্ন গায়ের কেউ। লোকটি অনেকটা এগিয়ে গেলে ও রাস্তায় ওঠে। পেছনে আর কেউ নেই, সামনে একজন মানুষ চলে যাচ্ছে। একজন মানুষকে চলে যেতে দেখলে মন খারাপ হয় ওর। ও দুপা এগিয়ে থমকে দাঁড়ায়। ওর এগুতে ইচ্ছে করছে না। লোকটি চলে যাক–একদম ওর দৃষ্টির আড়ালে গেলে তারপর ও এগুবে। ও জঙ্গলের ভেতর ঢুকে একগোছা স্বর্ণলতা ঘেঁড়ে, জানে না কী করবে? ছিড়লই বা কেন? স্বর্ণলতা দিয়ে দু’হাতে দড়ি পাকায়। তারপর ছুঁড়ে দেয় দূরে। ওটা কপলা গাছের ডালে গিয়ে আটকে থাকে।

মানুষটি চলে গেলে ওর মাথা এমন দড়ির মতো পাকিয়ে থাকে। মনের বিনুনি এমন জটিল হয়ে উঠেছে যে, ও কোনো শক্ত বাঁধনে নিজের সবটুকু বেঁধে রাখতে চায়। ও ঝরাপাতা না মাড়িয়ে নিঃশব্দে জঙ্গল থেকে বেরিয়ে আসে। আজ অনেক বেলা হয়ে গেল ফিরতে। আর কোনোদিন ও এত দেরিতে ফেরেনি। এই দেরিতে ফেরার জন্য ওর কেমন সংকোচ হয়। গায়ে ভিজে শাড়ি লেপ্টে থাকলে ওর তি হওয়ার মাত্রা বেড়ে যায়। দু-একজন মানুষ পথে বেরিয়েছে, সবাই ওর চেনা, ওরা ট্রলারে যাচ্ছে। মাছ ধরতে যাবে। ওদের কারো পিঠে জাল, কারো ঘাড়ে পানিভরা কলস। নোনা সমুদ্রে গেলে মিঠে পানি সঙ্গে না থাকলে ওরা তৃষ্ণায় মরে যাবে। রাহালুমের বুক শিউরে ওঠে। তৃষ্ণা যে কত হাজার রকমের! ওহ মানুষের তৃষ্ণা কত প্রবল। মানুষ কেবল তৃষ্ণা নিয়ে ছটফট করে। ও বুঝতে পারে যারা ওর দিকে তাকিয়ে থাকছে তাদের ভাষা। ও কারো দিকে তাকায় না। দ্রুত পায়ে হাঁটে। সুখদীপের কথা মনে হতেই ওর মন খারাপ হয়ে যায়। ও হয়তো ঘুম থেকে উঠে কান্নাকাটি করছে–হয়তো ওর ভীষণ খিদে পেয়েছে। আহা বেচারা আবুল হাশেমের কথা মনে হতেই ওর ভয় করে। হয়তো চোয়াল কঠিন করে বারান্দায় বসে আছে, পছন্দ করতে পারছে না ওর এতটা বেলা পর্যন্ত ঘরে না ফেরা।

পথে বুড়ো মুনসি একগাল হেসে কুশল জিজ্ঞেস করে, কেমন আছো মা?

আছি ভালো।

রাহানুম হেসে মাথা নাড়ে। মুনসি চাচাকে ওর ভালো লাগে। হাসিভরা মুখের দিকে তাকালে মনে হয় আপনজন। মুনসির চেহারায় একজন পিতার প্রশ্রয় আছে। মুখ থেকে হাসি ফুরোয় না। কখনো রাগতে দেখা যায় না। আবুল হাশেম বলে মুনসি পুরুষ মানুষ না। রাগ না থাকলে পুরুষ মানুষকে মানায় না। আসলে মুনসির জালে প্রচুর মাছ ওঠে এটা আবুল হাশেমের ঈর্ষা এবং ক্রোধ। রাহানুমকে প্রায়ই এই কথা শুনতে হয়। এসব কথা মনে করে রাহানুম হেসে ফেলে, আমনহে ভালো। আছেন চাচা?

হ, আছি। সাগরে গেইল্যা বুঝি?

হ, গেইল্যাম।

ভালো, ভালো। হিংরা টোকাইছো?

হ, আইজ মেলা পাইল্যাম।

ভালো, ভালো।

মুনসি ঘন ঘন মাথা নাড়তে নাড়তে চলে যায়।

রাহানুম দেখে গাছ-গাছালির মাথায় রোদ ভরে গেছে। ওর জীবনে আর একটি দিনের আলো এবং রোদ শুরু হলো। আলো এবং রোদ–আলো এবং রোদ–ভাবতে ভাবতে রাহানুম বাড়ির উঠোনে এসে দাঁড়ালে অবশ হয়ে যায় শরীর। দেখে সাগরের পাড়ে দেখা সেই লোকটি উঠোনে দাঁড়িয়ে আছে। কোমরে হাত রেখে চারদিকে তাকাচ্ছে। এখন রাহামের দিকে ওর পিঠ। ঘুরলেই রাহানুমকে দেখতে পাবে। ও চট করে ঘুরছে না। একভাবে দাঁড়িয়ে আছে। বারান্দায় উঠবে কি না হয়তো তা ভাবছে কিংবা চিৎকার করে কাউকে ডাকবে কি না সেকথাও ভাবছে। রাহানুম বুঝে যায় যে আবুল হাশেম এবং সুখদীপ ঘুম থেকে উঠেনি। তাই ও কাউকে দেখতে পাচ্ছে না। রাহানুম স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে হিংরাভা টুকরি নিয়ে রান্নাঘরের দরজার কাছে রাখে। তখন লোকটি রাহানুমকে দেখতে পায় এবং দু’পা এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করে, এইডা কি আবুল হাশেমের বাড়ি?

হ।

রাহানুম সোজাসুজি লোকটির মুখে দিকে তাকাতে পারে না। মাটির দিকে তাকিয়ে থাকে। মাথার ঘোমটা ঘন ঘন টানে।

লোকটি ভরাট কণ্ঠে বলে, হের ধারে মোর কাম আছে?

আইছেন কোমনে দিয়া?

লতাচাপালি দ্যা আইছি।

বয়েন।

রাহানুম বারান্দায় বিছানো হোগলা দেখিয়ে দেয়। এতক্ষণে লোকটির চোখে চোখ পড়ে। লোকটি গভীর চোখে ওর দিকে এক পলক তাকিয়ে বারান্দায় গিয়ে বসে। ওর পায়ে জুতো নেই। পরনে সবুজের ওপর সাদা চেক-কাটা লুঙ্গি। সেটা পায়ের গোড়ালি থেকে অনেকখানি ওপরে ওঠানো। জুতো না পরে অনেকদূর থেকে হেঁটে এলে বুঝি লুঙ্গি এভাবে পরতে হয়। গায়ে ছিটের জামা। সাদার ওপর খয়েরি রঙের লতাপাতা আঁকা ছিটকাপড়। জামার ওপরের দিকে দুটো বোম খোলা। বুকের ঘন কালো পশম দেখা যায়। ওর বাম হাতে তাবিজ বাঁধা–বেশ বড়ো সাদা রঙের তাবিজ। ওর চোখে চোখ পড়ার পর থেকে রাহামের মনে হয় চোখ জোড়ায় এক ধরনের মায়া আছে।

মনে মনে দুরন্ত সাহস সঞ্চয় করে জিজ্ঞেস করে, আমনেহর নাম কি?

জবেদ আলী।

নাম বলে লোকটি মুচকি হাসে। বড়ো গোঁফ। খাড়া নাক। শরীরের বাঁধুনি ভালো। খুব অল্প সময়ে জবেদ আলীকে দেখা হয়ে যায় রাহামের। ওর ভালোই লাগে। ওর ভেজা শাড়ি শরীরে শুকিয়ে গেছে।

অনুভব করে আঁটসাঁট শরীরের বাঁধনে ফুরফুরে ভাব। দ্রুত দরজা ঠেলে ঘরে ঢোকে।

বাজান? বাজান?

জবেদ আলী বারান্দায় বসে রাহালুমের কণ্ঠস্বর শুনতে পায়। মনে হয় এক আশ্চর্য কণ্ঠ–এর সঙ্গে সাগরের কলধ্বনির মিল আছে, তবু শুনতে ভালো লাগছে। রাতদিন শুনলেও ভালো লাগা ফুরোবে না। জবেদ আলী মনে মনে হিসেব কষে। ক্ষেত, লাঙ্গল, গরু, ফসল ইত্যাদির হিসেব। কত ধানে কত চাল সে হিসেবও মনের মধ্যে পাক খায়।

রাহানুম আরো দুতিন বার বাজান, বাজান বলে ডাকে। শেষ রাতের দিকে ঘুমিয়েছে আবুল হাশেম। ধরতে গেলে প্রায় সারারাতই জাগা। তাই ঘুম ভাঙে না। আরো কয়েকবার ডাকতে হয় রাহনুমকে। যখন ঘুম ভাঙে তখন বিভ্রান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে আবুল হাশেম, যেন পূর্ণিমার সুরা পান করে তার মগজে এখন খোয়ারি। রাহানুম ওকে ধাক্কা দেয়।

ও বাবো, ওঠেন। লতাচাপালি দ্যা আমনহের ধারে অউক্যা ব্যাডা আইছে।

কোমনে? ক্যা?

যেন আবুল হাশেমের কান পরিষ্কার নয়। ঠিকমতো শুনতে পাচ্ছে না।

লতাচাপালি দ্যা বাবো? লতাচাপালি?

রাহানুম কিছুটা চেঁচিয়ে বলে। আবুল হাশেম তবুও জিজ্ঞেস করে, ক্যা আইছে?

মুই জানি না।

অকস্মাৎ মন খারাপ হয়ে যায় রাহালুমের। অভিমানও হয়। লোকটিতো ওকে বলেনি যে কেন এসেছে। লোকটিতে ওকে বলতে পারত? বললে কী ক্ষতি হতো। অভিমানে ওর চোখ ছলছলিয়ে উঠতে চায়। ও ঠোঁট কামড়ে রেখে নিজের আবেগ দমন করে।

আবুল হাশেম বিছানায় উঠে বসে। ঘুমের আমেজ কাটতে চায় না। বসে বসে হাই তোলে। চোখ কচলায় আড়মোড়া ভাঙে। বালিশের নিচ থেকে গেঞ্জিটা টেনে বের করে গায়ে দেয়। গামছা খুঁজে নিয়ে ঘাড়ের ওপর ফেলে। রাহানুম ভেবে দেখল লোকটি যদি ওকে বলত কেন এসেছে তাহলে আবুল হাশেমের কাছে ও বেশ বাহাদুরি নিতে পারত। খবরটা বলতে পারলে আবুল হাশেমের কাছে ও গুরুত্বপূর্ণ হয় যেত। সেটি হলো না। এটি একটি পরাজয় বলে মনে হয় ওর।

এখন আবুল হাশেম উঠছে না দেখে ওর রাগ হয়। লোকটি বাইরে অপেক্ষা করছে। ও কতক্ষণ অপেক্ষা করবে? কাউকে বসিয়ে রাখলে তাকে গুরুত্ব কম দেওয়া হয়। রাহানুম দাঁত কিড়মিড় করে। আবুল হাশেম দ্রুত বেরিয়ে লোকটিকে আপ্যায়ন করলে লোকটির কাছে ওর গুরুত্ব বাড়ত। বুঝত বাবার সংসারে রাহামের ভীষণ প্রতিপত্তি। মনে হয় এখানেও ওর পরাজয় হলো। সকাল বেলার দারুণ সময় পেরিয়ে ও এখন খারাপ সময়ে প্রবেশ করেছে। ও বিষণ্ণ হয়ে যায়। খারাপ লাগতে শুরু করে।

আবুল হাশেম তখনো বিছানায় বসেই আছে। রাহানুম দৃষ্টিতে আগুন ঝরিয়ে বিড়বিড়িয়ে গাল দেয়, বুড়া হাবড়া। য্যান ল্যাংড়া অইছে। আঁটতে পারে না।

আবুল হাশেম রাহানুমকে ভ্রুক্ষেপ করে না। ধীরেসুস্থে স্পঞ্জের স্যান্ডেলে পা ঢোকায়। রাহানুম ঘরের কোণে গিয়ে এঁটো বাসনকোসন নিয়ে পুকুরঘাটে যাবার জন্য তৈরি হয়। পরক্ষণে ও চুপ করে বসে থাকে। ওই লোকটির সামনে দিয়ে পুকুরঘাটে যেতে লজ্জা করে। দুদুটো পরাজয় ওকে ম্রিয়মাণ করে রেখেছে। দেখতে পায় আবুল হাশেম ধীরেসুস্থে বাইরে যাচ্ছে। সুখদীপ ঘুম থেকে উঠে বাইরে গিয়েছিল–পুকুর থেকে হাতমুখ ধুয়ে এসেছে। হোগলার ওপর বসেই চেঁচিয়ে বলে, মা ভাত দাও।

রাহানুম তাকের ওপর থেকে একটা কাচের বাসন নামায়। সেই বাসনে সুখদীপকে পান্তা বেড়ে দেয়। সুখদীপের চোখ জ্বলজ্বল করে ওঠে। ও বুঝতে পারে না মায়ের আজ কিসের খুশি যে ওকে কাচের বাসনে খেতে দিল? ও মার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। কাচের বাসনে ভাত দিলে ও ভীষণ খুশি হয়, কিন্তু বাসন তো সবদিনের জন্য নয়। সুখদীপ ইচ্ছে করলেই কাচের বাসনে খেতে পারে না–তার জন্য বিশেষ দিন বা অতিথির প্রয়োজন হয়। ও ধরে নেয় আজ তাহলে মায়ের কাছে ওই লোকটি বিশেষ অতিথি। ও সাবধানে দু’হাত বাড়িয়ে মার হাত থেকে বাসনটা নেয়।

কৌতূহল চেপে রাখতে না পেরে জিজ্ঞেস করে, বাসনে ভাত দিলা ক্যা মা?

রাহানুম মৃদু হাসে, কিছু বলে না। পান্তা ভাত সপসপিয়ে খায় সুখদীপ। রাহানুম ওর উজ্জ্বল মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। এই ছেলেটিকে ও গর্ভে ধারণ করেনি, কিন্তু ও জানে ও ওর মা। এই স্বস্তি নিয়ে ছেলেটি কি সারাজীবন কাটাবে? না কি এখনই ওকে সবকিছু বলে দেওয়ার সময়? ও জেনে যাক ওর জীবনের এক কঠিন সত্যকে। কেন ওকে এই সত্য থেকে আড়াল করে রাখতে হবে? কী লাভ? তাতে ওর জীবনের ক্ষতিবৃদ্ধিই বা কী? রাহানুম নরম কণ্ঠে ডাকে, সুখদীপ।

ও মুখ তুলে তাকায়। মুখভর্তি ভাত, গাল ফুলে আছে। কথা বলতে পারছে না। ভুরু উঁচিয়ে ইশারায় ইঙ্গিত করে, কী?

রাহানুমের বুক তোলপাড় করে ওঠে। বলেই ফেলবে বুঝি সব। সুখদীপ কেঁাত করে ভাত গিলে বলে, কি মা?

তখন বারান্দা থেকে আবুল হাশেম প্রবল উচ্ছ্বাসে চেঁচিয়ে ওঠে, ও রাহানুম, সুখদীপ? হুইন্যা যা?

রাহানুম দরজার কাছে এসে দাঁড়ায়, বাজান।

জবেদ আলী খবর আনছে আন্ধারমানিক নদী দ্যা যে চর জাগছে ওইডা মোর। ওহানে আগে মোর জাগা আল্যে। বেডারে তো মিষ্টিমুখ করান লাগে। গরে মিডা আছে?

আছে বাবো। তালের মিডা।

দে মিডা দে, ভাত দে।

রাহানুম বুঝতে পারে যে জবেদ আলী ওর দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আবুল হাশেমকে কাজের কথা বলা হয়ে গেছে জবেদ আলীর। সুতরাং আবুল হাশেমের সঙ্গে কাজ শেষ। এখন সে মুক্ত মানুষ। অনায়াসে রাহামের দিকে মনোযোগ দিতে পারে। এখন আর কে তাকে বাধা দেবে? চোখে চোখ পড়লেও দেখে জবেদ আলীর দৃষ্টি একটুও নড়ে না, কাঁপে না–স্থির অচঞ্চল। ওর শরীর শিরশির করে। রঙিন মাছের সূঁচালো মুখটা ওর উরুতে এসে আটকে যায়। ও দ্রুতপায়ে ফিরে আসে আগের জায়গায়। সুখদীপের খাওয়া শেষ। ওর বাসনে পানি ঢেলে হাত ধুয়ে নেয়। একবার মুখ তুলে জিজ্ঞেস করে, কী অইছে মা?

রাহানুম আস্তে করে বলে, তোর দাদা নতুন চরের মহাজন অইছে।

ক্যামনে?

ওহানে আগে তোর দাদার জাগা আল্যে। নদী ওই জাগা ভাইঙ্গা নেয়। অহন ওহানে চর উঠছে।

মোরা যামু না?

জানি না বাজান।

রাহালুমের চিত্তে শঙ্কা। সুখদীপের মতো খুশিতে লাফিয়ে উঠতে পারে না। আবুল হামেশের অনেককাল আগের সম্পত্তি। তাতে ওদের কী? ওরাতো আবুল হাশেমের কেউ না। ফলে জমিতে ওদের কোনো ভাগ নেই। কোনো দাবিও নেই।

তাই বলে ওরা কি খুশি হবে না? আবুল হাশেম এই মুহূর্তে ওদের আশ্রয়দাতা, শুধু আশ্রয়দাতাতো নয়, আবুল হাশেম ওদের প্রিয়জন। ওরা আবুল হাশেমকে ভালোবাসে, আবুল হাশেম ওদের ভালোবাসে। তাই আবুল হাশেমের ভালোেমন্দের সঙ্গে ওদের জড়িত হওয়া উচিত। রাহানুম অকস্মাৎ খুশিতে গদগদ হয়ে বলে, হ, বাজান, মোরাও নতুন চরে যামু। তোমার দাদার চরতো মোগও চর। আল্লারে নতুন মাটির গন্ধ না জানি কেমুন।

হ মা, ঠিক কথা।

লাফিয়ে ওঠে সুখদীপ। একছুটে বারান্দায় গিয়ে আবুল হাশেমের কোল ঘেঁষে বসে।

রাহানুম তালের গুড়ভরা কলস নামায় তাকের ওপর থেকে। একটা কলসের গুড় তলানিতে এসে ঠেকেছে। ও সে কলসটা না নামিয়ে নতুন একটা কলস খোলে। নতুন মেহমানের জন্য একটু ভিন্ন আয়োজন। আবুল হাশেম ঘরে ঢোকে। ভীষণ উত্তেজিত। ফিরে পাওয়া সম্পত্তির কথা শুনে নিজেকে ধরে রাখতে পারছে না। উত্তেজিত হলে আবুল হাশেম দ্রুত কথা বলে এবং কাঁধে রাখা গামছা ঘন ঘন নাড়ায়। বলে, কাচের বাসনে ভাত দে মা?

রাহানুম আরো দুটো কাচের বাসন মামায়। জবেদ আলী ওদের জীবনে ওলটপালট ঘটিয়ে দিয়েছে। রাহানুম হাতের কাজ বন্ধ করে আবুল হাশেমের দিকে তাকায়। আবুল হাশেম দুবার পায়চারি করে। আবার বলে, তুই জবেদ আলীরে ভাত দে মা। মুই পুকুর ধার দ্যা আই।

বাবো, বেডাটা কে? আগে তো দেহি নাই?

ওর বাপ মোর জমির বর্গাদার আল্যে।

অহন নাই?

জমিতো ছেল না। অহন চর জাগছে।

আবার বর্গা দেবেন?

দেহি, কী করি। আবুল হাশেম মাথা নেড়ে চলে যায়। উত্তেজনা রাহানুমকেও আচ্ছন্ন। করে। নতুন চর? কেমন দেখতে? মাটি কি ফকফকে সাদা নাকি লাল? সেটা কি পলিমাটির চর? নাকি কাদাভরা? স্বপ্নের মতো মনে হয় নতুন চরের গল্প। ছোটবেলার শোনা রূপকথা যেন। তেপান্তরের মাঠ আর পঙ্খীরাজ ঘোড়ায় করে চড়ে আসা রাজপুত্র। ওই কী আনন্দ। বাবো একডা চরের মহাজন। ভাবতে ভাবতে পান্তাভাতের হাঁড়িতে হাত ড়ুবিয়ে কাচের বাসনে ভাত ওঠায়। বেশ বড়ো একটা বাটিতে গুড় ভরেছে। লোকটি কেমন খেতে পারে? অনেক? কী খেতে ভালোবাসে? কেমন তরকারি? কী মাছ বেশি পছন্দ? ও কি আইট্টা কলা দিয়ে ভাত মাখিয়ে খায়? মোষের দুধ খায় নাকি গরুর? ওর স্বাস্থ্য ভালো, চমৎকার তাগড়া। নিশ্চয়ই ও প্রচুর খায়। এই সিদ্ধান্তে আসার সঙ্গে সঙ্গে লোকটির খাওয়া সম্পর্কে ওর ধারণা হয়ে যায়। কাচের বাসনে ভাত বেড়ে ওর মনে হয় রাতের বাসি তরকারি দিয়ে ভাত দেওয়া ঠিক হবে না। ও দ্রুত মাচানের ওপর উঠে মাটির হাঁড়িতে তুষের ভেতর লুকিয়ে রাখা দুটো হাঁসের ডিম বের করে। রান্নাঘরে গিয়ে পেঁয়াজ-মরিচ কুচিয়ে ভেজে ফেলে। ওর খুব। ইচ্ছে করে আরো কিছু রান্না করতে, কিন্তু এখনতো সময় নেই। এখন ভোরের খাবার দিতে হবে। লোকটি অনেকদূর থেকে হেঁটে এসেছে, নিশ্চয়ই ভীষণ খিদে পেয়েছে। তাহলে কি লোকটিকে ও দুপুরে খেয়ে যাবার জন্য বলবে? মন্দ হয় না। আবুল হাশেম রাজি হতে পারে। বাড়তি ঝামেলা মনে করবে না। কারণ অতিথি তো ওদের তেমন কেউ আসে না। কেউ এলে কত যে খুশি লাগে আজ তা মনে হলো। ডিম ভাজা পান্তাভাতের ওপর সাজিয়ে দেয় ও। সরষে তেলে শুকনো মরিচ ভেজেছে অনেকগুলো। কয়েকটা মরিচ ভাতের ওপর গেঁথে দেয়, যেন উঁচু পাহাড়ের ওপর পতাকা উড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। ভাতের থালার দিকে তাকিয়ে থেকে ও নিজেই মুগ্ধ হয়ে যায় সারক্ষণে মনে হয় এতকিছু ভাবা কি সংগত না অসংগত? তাহলে ওকি অন্যকিছু ভাববে? ও কী কাজ করে? মাছ ধরে না জমি চাষ করে? ওর কি ঘরে বউ আছে? ছেলেমেয়ে? ওর কি সুখের সংসার? মুহূর্তে বিষণ্ণ হয়ে যায় রাহানুম। সঙ্গে সঙ্গে ওর মনে হয় এতকিছু ভাবা উচিত নয়। যে ভাবনা মন খারাপ করে সে ভাবনা। দূরে থাকুক বলে ও উঠে পড়ে।

ততক্ষণে আবুল হাশেম হাতমুখ ধুয়ে এসেছে। এতক্ষণ সুখদীপ ওর সঙ্গে কথা বলছিল। লোকটি কী কথা জিজ্ঞেস করেছে সুখদীপকে? ও সুখদীপকে ডাকে। সুখদীপ দৌড়ে আসে, কী মা?

এইগুলা লইয়া যাও।

সুখদীপের হাতে পানির জগ আর লবণের বাটি পাঠায়। নিজে ভাতের বাসন দুটো নিয়ে এসে বারান্দায় হোগলার ওপর রাখে। ডিম ভাজা এবং লাল মরিচ সাদা ভাতের ওপর বেশ নকশি করা মনে হচ্ছে, ভালোই লাগে রাহামের। বুঝতে পারে লোকটির কাছাকাছি এলে ওর বিষণ্ণতা কেটে যায়। শুধু বুকের ভেতর আশঙ্কা, ডিমভাজা লোকটার পছন্দ হবে তো?

ভাত দেখে দরজার এপাশে আসার সঙ্গে সঙ্গে ও নিজের আচরণে নিজেই বিব্রত বোধ করে। বুঝতে পারে না যে লোকটাকে খুশি করার জন্য ওর এমন আপ্রাণ চেষ্টা কেন? ও এমন ভাব করছে যেন লোকটার খুশি-অখুশির ওপর ওর অনেক কিছু নির্ভর করছে? এইসব ভেবে ও খুব লজ্জিত হয়। গুড়ের বাটিটা নিয়ে ও আর লোকটির সামনে যেতে পারে না। সেটা নিয়ে যাবার জন্য সুখদীপকে ডাকে।

লোকটি খেতে শুরু করলে আবুল হাশেম ঘরে ঢোকে। রাহানুম তড়িঘড়ি জিজ্ঞেস করে, বাবো আমনহের ভাত দিমু?

অহন না, পরে।

আবুল হাশেমের মধ্যে সেই আবুল হাশেম জেগে উঠেছে, যার বাড়িঘর, জমি জলোচ্ছ্বাসে ধুয়েমুছে যায়নি। যার জমি ছিল, ধান ছিল, গাভী-বলদের বাথান ছিল, অসংখ্য হাঁস-মুরগি, ডিম–শত শত ডিম। ছিল। সে কেন বর্গাচাষীর সঙ্গে ভাত খাবে? আবুল হাশেম খানিকটা দূরত্বে বসে জবেদ আলীর খাওয়া দেখে। বেশ খেতে পারে ছেলেটি। মুহূর্তে দু’প্লেট ভাত সাবাড় হয়ে যায়। রাহানুম খালি প্লেটে আবার ভাত দিয়ে পাঠায়। আরো এক বাটি গুড় পাঠায়। সুখদীপ ছুটোছুটি করে এসব আনা-নেওয়া করে। রাহানুম দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে খাওয়া দেখে। হ্যাঁ, খাওয়ায় দারুণ মানুষটি। সুখদীপ ওর সামনে বসে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। এতক্ষণ এটা-ওটা প্রশ্ন করছিল। এখন একদম চুপ। জবেদ আলী এক জগ পানি খেয়ে ওর দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলে, আর এক জগ পানি লও।

মা, পানি দেও।

সুখদীপ জগ হাতে ঘরে ঢোকে। জবেদ আলী বুঝতে পারে তিনজন মানুষ অবাক হয়ে ওর খাওয়া দেখছে। ওর লজ্জা হয় না। বরং ওর আচরণে এক ধরনের বীরত্ব প্রকাশ পায়, যেন এভাবেই জয় করতে হয়। এভাবেই উপরে থাকতে হয়–নিজেকে প্রকাশ করতে হয়। অন্যদের চোখের সামনে দিয়ে বীরদর্পে হেঁটে যেতে হয়।

সুখদীপ জগভর্তি পানি এনে রাখে। ও ছুটোছুটি করে কাজ করে। পানি রেখে ছুটে গেলে রাহানুম ওর হাতে পানের থালা দেয়। সেটা রেখে এসে রাহানুমকে আস্তে করে জিজ্ঞেস করে, মা বেডারে কি কয়া ডাকমু?

চাচা।

মোর চাচা অয় বুজি?

চাচা অয় না। চাচা ডাকন লাগে।

মা, মোর বাপ কেমনে?

মুই জানি না।

বেডায় মোরে জিগাইলো।

কি?

মোর বাপ কোমনে? মুই কইছি, মুই জানি না। মোর বাপ নাই হুইনা বেড়ায় একটা হাস দিল। হাস দিলো ক্যা মা? বাপ না থাকলে কি হাস দেওন লাগে?

রাহানুম বুঝতে পারে সুখদীপ আহত হয়েছে। এতদিন ওকে কেউ বাপ নিয়ে কথা বলেনি। বয়স্করাতো সবাই জান ঘটনাটা। ছোটদের বাপ। নিয়ে মাথাব্যথা নেই। সুখদীপেরও এই নিয়ে কোনো প্রশ্ন ছিল না। লোকটি কেন শিশুটিকে খোঁচালো? কী মতলব ওর? সুখদীপের বাবা না থাকার ওপর কি ওর কিছু সিদ্ধান্ত নির্ভর করছে। মিশ্র প্রতিক্রিয়ায় ও তাড়িত হতে থাকে।

সুখদীপ ওর হাত ধরে ঝাকুনি দিয়ে বলে, কথা কওনা ক্যা মা? বাপ থাকলে কি হাস দেওন লাগে?

ও ওকে আদর করে বলে, অইছে যা অহন।

ওর মনেও চিন্তা গেঁথে থাকে, সত্যিইতো সুখদীপের বাবা না থাকলে ওকে হাসতে হবে কেন? এটা কি হাসির কথা? নাকি ওর বাবা না থাকাতে লোকটি খুশি হয়েছে?

তখন আবুল হাশেম ঘাড়ের ওপর ফেলে রাখা গামছা দোলাতে দোলাতে ঘরে ঢোকে। রাহানুম দ্রুত কাছে গিয়ে দাঁড়ায়, বাবো ওনারে দুপুরে ভাত খাইয়া যাইতে কন?

দাওয়াত দিবি?

হ। আমনহে জমির মালিক হইলেন। এতবড়ো খুশির খবর।

খুশি?

আবুল হাশেমের দৃষ্টিতে রঙিন মাছটা উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। ছাইরঙা শরীরে রুপোলি বুটি যেন আন্ধারমানিক নদীতে হাজার তারার বুজবুড়ি। উঠছে, এলিয়ে মিশে যাচ্ছে, আবার উঠছে, ওহ কী আনন্দ? ভাবতে ভাবতে আবুল হাশেমের ভুরু বারবার কপালে ওঠে। নাকের ফুটো বড়ো হয় এবং সঙ্গে সঙ্গে ও একটা বিরাট হাঁচি দেয়। হাঁচি দিয়ে বলে, আলহামদুলিল্লাহ।

রাহানুম উদগ্রীব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ওর প্রশ্নের উত্তর ও পায়নি। আবুল হাশেম কী বলবে ও তা জানে না। তাই আবার দ্রুত কণ্ঠে বলে, বাবো, মুই কতদিন পলাও রান্দি নাই। শাক্যরখানি চাউল আছে গরে। আমনহে মেলাদিন মুরাও খান নাই।

রাহালুমের দীপ্ত দৃষ্টিতে আবুল হাশেমের দৃষ্টি আটকে যায়। বুঝতে পারে মেয়েটির কণ্ঠে এক ভিন্ন রকমের ব্যাকুলতা। ওর মনে হয় নতুন চরের কথায় রাহনুমের মনে এমন খুশির জোয়ার। মণিমালা বেঁচে থাকলে হয়তো এমন খুশিই হতো। ও রাহামের সঙ্গে বড়ো বেশি একাত্মতা অনুভব করে। ওর দিকে তাকিয়ে মিগ্ধ হাসি হেসে বলে, যা রান্নাবাড়ার জোগান দে। মুই বেডারে খাইয়া যাতি কমু। দেহিস আভা পাড়া মুরা যেন জবাই করিস না। মেলা খিদা লাগছে। অহন মোরে ভাত দে।

রাহানুম আবুল হাশেমকেও কাচের বাসনে পান্তা বেড়ে দেয়। ডিম ভাজা এবং ভাজা লাল মরিচ দেয়। আয়োজন দেখে মুচকি হাসে আবুল হাশেম। রাহানুম জিজ্ঞেস করে, বাবো হাস দিলেন ক্যা?

আবুল হাশেম কোত করে ভাত গিলে বলে, এমনে।

ওদের মধ্যে আর কোনো কথা হয় না। ওর সব কাজ পড়ে আছে। রাতের হাঁড়িকুড়ি কিছুই দেওয়া হয়নি। নিজেরও খাওয়া হয়নি। পান্তা শেষ। এই বেলা ওর আর খাওয়া হবে না। মনে মনে ভাবে, থাক, না খেলে কী হবে? একবেলা না খেলে তো মানুষ মরে যায় না। রোজার সময় কতদিন সেহেরি খাওয়া হয়নি। সেদিন না খেয়েই রোজা রেখেছে। আর আজকের পরিস্থিতিতে অন্যরকম। একজন মানুষ হঠাৎ করে সাতসকালে উঠোনে এসে দাঁড়ালে তখন অন্য আর একজন মানুষের না খেয়ে থাকতে হয়। এই ব্যাকুলতাই কি ঘর? খুব কাছের কারো জন্য তীব্র আকাক্ষা। নইলে ঘরটা হয়ে যায় কেবলই বাসস্থান? শুধুই দিন কাটানোর আস্তানা? না এমন ঘর ও চায় না। ঘর হবে উষ্ণতার–ভালোবাসার; ব্যাকুলতার–তীব্রতার।

ঘরের স্বপ্নের ছবি দেখতে দেখতে ও পেছন দরজা দিয়ে উঠোনে নামে। কোন মুরগিটা ধরবে চিন্তা করতে থাকে। বাচ্চা ফুটানোর জন্য ধাড়ি মুরগিটা ডিমে তা দিচ্ছে। ওটার মুখ থেকে গরগর শব্দ বেরুচ্ছে। রাহানুম কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। মুরগিটা একটা ডিম ঠোকরাচ্ছে। এখন একটা বাচ্চা বের করবে। খোসাটা ভেঙে দুটুকরো হয়ে গিয়ে একটি বাচ্চা বেরুলো। ওটা নড়ছে। লোমহীন শরীরটা কাঁপছে। রাহনুম হাতে তুলে নেয়। কী নরম, কী তুলতুলে। রাহনুমের হাতের তালুতে ওর একটা অস্তিত্ব আছে। ওর হাতের তালুর রেখার মতো মুরগির বাচ্চাটির শরীর–আঁকাবাঁকা নীল রেখা বেড়ে উঠছে ওই শরীরে–পাতলা চামড়া ভেদ কের ফুটে উঠেছে অন্তরালের বস্তুনিচয়। ধাড়ি মুরগি গরগর শব্দে ক্রোধ প্রকাশ করছে, রাহানুমকে আক্রমণ করতে চাইছে, রাহালুমের উপস্থিতি ওর কাছে কাম্য নয়।

বাচ্চাটি রেখে দিয়ে ও নিজের করতলে তাকায়। যদি সমস্ত রেখাগুলো দেখা যেত? ও নিজের হাত কপালে ঠেকায়। এই মুহূর্তে ফুটে উঠুক কোনো সৌভাগ্যের চিহ্ন। আর একবার জ্বলে উঠকু ওর নিয়তি। আর একবার। ভাবতেই হৃদয় গুড়িয়ে যায় রাহানমের। বির হয়ে যায় শরীর। মুরগির খাঁচার সামনে থেকে উঠতে ইচ্ছে করে না। একদিন ও নিজেও ডিমের খোলস-ভাঙা সন্তান পেয়েছিল। তারপর? ঘরের ভেতর থেকে আবুল হাশেমের ডাক শুনতে পায়, মা মাগো। তবুও উঠতে পারে না রাহানুম। আবার আবুল হাশেম ডাকে, মাগো কই গেলা, পানি দেও।

ও নড়ে না। ডাকুক, ডেকে ডেকে ক্লান্ত হয়ে যাক আবুল হাশেম। ও আর সাড়া দেবে না। আবুল হাশেমের প্রয়োজন ওর জীবনে দীর্ঘস্থায়ী হোক ও তা চায় না। কারণ সত্যিকারের ঘরের বাইরে ছিটকে পড়ে এইভাবে একা একা বেঁচে থাকা অর্থহীন। ও খোপ থেকে মুরগি নিয়ে পাশের বাড়িতে যায় মুরগিটা জবাই করার জন্য। পেছনে পড়ে থাকে আবুল হাশেমের ডাক।

দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার পরিপাটি আয়োজন হয়। বাতাসে ভেসে বেড়ায় পোলাওর গন্ধ। সুখদীপ অন্তহীন খুশিতে ভরপুর। যতক্ষণ রান্না। হয় রাহালুমের হাতের কাছে থাকে। এটা-ওটা এগিয়ে দেয়। তারপর একসময় ফাঁক বুঝে চলে যায় জবেদ আলীর সঙ্গে।

খাওয়া-দাওয়ার সময়ে রাহাম ইচেছ করে নিজ হাতে পরিবেশন করে। সকালে যে সাহসটুকু অর্জন করতে পারেনি দুপুরে সেই সাহসটুকু ও অর্জন করে। সাহস হবে না কেন? কতদিন ও প্রিয়জনকে সামনে বসিয়ে ভাত খেতে দেয়নি। কতদিন হয়ে গেল, তাজা স্মৃতি ঝাপসা হয়ে গেছে যে! সরাসরি মুখের দিকে না তাকালেও অনুভব করতে পারে যে জবেদ আলী গভীর দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকায়। লোকটির ভাসা চোখে ডাক আছে–সাগর যেমন জেলেকে ডাকে তেমন ডাক। কখনো জেলে ঝড়-জল উপেক্ষা করে, বুঝতে পারে না বিপদের সংকেত, ভুলে যায় মরণের কথা, জবেদ আলী এখন তেমন একটা সাগর। ওকে মরণের ডাক দিয়েছে। বাসন ভর্তি করে পোলাও-মাংস এগিয়ে দেবার সঙ্গে চোখাচোখি হয় জবেদ আলীর সঙ্গে। লোকটি মুচকি হাসে, এত চেনা সে হাসি যে চট করে বোঝা যায় না। শুধু বুঝতে পারে রাহানুম একা।

একটু দূরে একটা জলচৌকিতে আবুল হাশেম বসে আছে। ঘোমটার আড়ালে রাহালুমের মুখ দেখা যায় না। তাই রাহামের আবেগ আবুল হাশেম বুঝতে পারে না। জমি ফিরে পাওয়ার খুশিই প্রধান বলে ধরে নেয়। সে জবেদ আলীর সঙ্গে নানা প্রসঙ্গ নিয়ে কথা বলছে। জবেদ আলী ছোট্ট করে জবাব দিচ্ছে। কখনো হা-না করে মাথা নাড়ছে। ভাবটা এমন যে ওর কথা বলার খুব ইচ্ছে নেই। রাহনুমের ধারণা জবেদ আলী মন দিয়ে কথা শুনছে না। ওর আগ্রহ এখন খাবারে এবং রাহামে। দীর্ঘদিন এমন সুস্বাদু খাবার ও খায়নি। বছর দেড়েক আগে বউ মারা যাবার পর মা ছাড়া আর কেউ ওকে ভাত বেড়ে দেয়নি। জবেদ আলীর আজ সুখের দিন হবে না তো কার হবে?

ওর সঙ্গে সুখদীপ খাচ্ছে। পোলাও-মুরগি পেয়ে ও আজ খুব খুশি। কোনোদিকে তাকায় না, একমনে ভাত খায়। অনেকক্ষণ জবেদ আলীর সঙ্গে ঘুরেছে। পুকুরে গোসল করেছে। দুজনে অনেক গল্প করেছে। জবেদ আলী জেনে গেছে যে রাহানুম সুখদীপের মা, ওর বাবা নেই, কোথায় সেটা সুখদীপও জানে না। তবু জবেদ আলীর খানিকটুকু খটকা থেকেই যায়। ওর ধারণা রাহালুমের দৃষ্টিতে কুমারীর লজ্জা আছে, সংকোচও আছে–বিবাহিতা নারীর খোলামেলা ভঙ্গি ওর মধ্যে কম। কোথায় যেন খানিকটুকু ফাঁক থেকেই যায়। যেজন্য রাহানুম ওর কাছে কিছুটা রহস্য, কিছুটা বিস্ময়। বোঝাই যায় বিবাহিত জীবনের দীর্ঘ অভিজ্ঞতা ওর নেই–পুরোপুরি নারী হয়ে ওঠার শুরুতেই ও কোনো না কোনোভাবে বাধাগ্রস্ত হয়েছে। সেটা কীভাবে, জবেদ আলী তা বুঝতে চায়।

ওর বাসনে ভাত প্রায় শেষ, তরকারিও তেমন নেই। রাহানুম নতুন করে পোলাও তুলে দেয়। তাঁর হাত কাঁপে। তরকারি দেবার সময় বাসনের বাইরে ঝোল পড়ে যায়। আবুল হাশেম হা-হা করে ওঠে, এইডা কী করলি মা? চৌউকখে দেহ না? গায়ে বল নাই। হাত কাঁপে ক্যা?

আবুল হাশেমের কড়া ধমকে জবেদ আলী ব্ৰিত বোধ করে। তবু মৃদু হেসে বলে, থাউক চাচা। কিছুতো অয় নাই।

না, না, কামডা ঠিক অয় নাই। মাইয়ামানষের হুঁশ থাকা লাগে।

আবুল হাশেম যে কিছুটা বিরক্ত তা বোঝা যায়। সে এখানে রাহানুমের উপস্থিতি পছন্দ করছে না। ভাবতেই রাহানুম মনে মনে ফুসে ওঠে। যদি ওর করতলে কোনো সৌভাগ্য চিহ্ন জেগে ওঠে তাহলে ও আর আবুল হাশেমের কর্তৃত্ব মানবে না। আবুল হাশেমের ধমক নিঃশব্দে হজম করলেও রাহামের চিত্ত অপ্রসন্ন হয় না। ও কিছুতেই ভুরু কুঁচকে রেখে নিজের ক্রোধ প্রকাশ করবে না বলে ঠিক করে। এ সময়ে মন খারাপ করলে চেহারায় তার ছাপ পড়বে, যেটা জবেদ আলীর ভালো নাও লাগতে পারে। ও বুঝতে পারে জবেদ আলীও আবুল হাশেমের ওপর বিরক্ত হয়েছে।

তখন আবুল হাশেম জবেদ আলীর দিকে মনোযোগ দেয়, খাও, বাজান খাও। মাগো, ওরে আরো দু’খান গোস্ত দাও। তোমারে মুই কত ছোড় দেখছিলাম। কতকাল মোগ দেহা নাই। তোমার বাপে ভালো আছে?

হ, ভালো আছে।

তোমার পরিবার কি বাজান?

মোর পরিবার নাই। বিয়া কইল্যাম। গত বছর মইরা গেছে। গুড়াগাড়াও নাই।

আহা, দুখের কতা।

জবেদ আলী মুচকি হাসে। আবুল হাশেমকে আড়াল করে রাহানুম ঝটিতে ওর মুখের দিকে তাকায়। মুচকি হাসি জবেদ আলীর স্বভাব। ওর ভালোই লাগে। রাহানুম বুঝতে পারে লোকটি ক্রমাগত ওকে টানছে–যতই দিন বাড়ছে সে টান প্রবল হচ্ছে। এখন ওর বউ নেই এবং ছেলেমেয়েও নেই শুনে ওর বুকের ওপর থেকে বিশাল ভার নেমে যায়। এবং সেখানে অকস্মাৎ বাঁধভাঙা আনন্দের স্রোত এসে ভরে যায়। ও সঙ্গে সঙ্গে একটি সিদ্ধান্ত নেয়, কঠিন সিদ্ধান্ত।

জবেদ আলীকে জানাতে হবে যেও সুখদীপের মা নয়। কোনো সুখদীপ ওদের মাঝে দেয়াল তুলে দাঁড়াবে না। ওর জীবনে পিছুটান নেই, ও একা–ভীষণ একা। অনায়াসে সুখদীপকে ছেড়ে জবেদ আলীর হাত ধরে চলে যেতে পারে। বউ-ছেলেমেয়ে না থাকার মতো এত ভালো খবর আজ ওর জন্য জমা ছিল–কী দারুণ দিন। নিশ্চয়ই করতলে সৌভাগ্য চিহ্ন ফুটে উঠেছে। ও দেখতে পাচ্ছে না; দেখার দরকারও নেই। শুধু সৌভাগ্যের ঘটনাগুলো ঘটে গেলেই হয়।

ও আবুল হাশেমের শ্রবণশক্তি আড়াল করে চাপা কণ্ঠে বলে, আমনহেরে আর দুগ্যা পোলাও দি?

দ্যান।

জবেদ আলী মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়। ও নিজেও আবুল হাশেমের শ্রবণশক্তি আড়াল করতে চায়। কিন্তু বুঝতে পারে ঘটনাটি আড়াল করা হয় না। তা আবুল হাশেমের প্রখর দৃষ্টিশক্তি এড়ায় না। এই ছোট্ট নাটকটুকু ও ধরে ফেলতে পারে।

রাহানুম থালা ভরে পোলাও দেয়। নারকেলের দুধ দিয়ে ডিম রান্না করেছে, মুরগির ঝোল করেছে, সঙ্গে চিচিঙ্গার ভাজি। ও জবেদ আলীকে আরো দুটো ডিম তুলে দেয়। বুঝে যায় যে এ বেলাও ওর নিজের তেমন কিছু জুটবে না, হয়তো মুরগির নরলি বা পাখনা বা গিলা। কী এসে যায়? একজন মানুষ তো খুশি হচ্ছে, যার খুশির সঙ্গে নিজের খুশি যুক্ত করার জন্য ও উদগ্রীব হয়ে উঠেছে।

আবুল হাশেম বিড়ি ফুকছে, একটার পর একটা। সাধারণত এমন। একটানা টানে না ও। কিন্তু আজ ভেতরে ছটফটানি–বিড়ির নেশা একটা অবলম্বনের মতো। আবুল হাশেম একরাশ ধোয়া ছাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দ্রুত কিছু চিন্তা করে। রাহানুমকে দেখে, সুখদীপকেও অন্য দৃষ্টিতে অবলোকন করে। বুঝতে পারে রাহানুম জবেদ আলীকে সামনে রেখে এই সংসারকে উপেক্ষা করছে। করুক, করতে পারলে মঙ্গলই হয়। এখন রাহামের মুখটা ওর সামনে জলোচ্ছ্বাসে আছড়ে পড়া ভাঙা ট্রলারের মতো মনে হয়–টুকরো টুকরো, বিক্ষিপ্ত। আবর্জনার মতো জমিয়ে আগুন ধরিয়ে দিলেই হয়–পুড়ে ছাই হয়ে যাবে। ও সুখদীপের দিকে আবার তাকায়–দেখে সুখদীপ একটা কাঁকড়া, কারো পায়ের। নিচে চাপা পড়ে মরে চ্যাপ্টা হয়ে আছে। ওটার ঠ্যাং ধরে সমুদ্রে ছুড়ে ফেলে দিলেই হয়। নদী থেকে যে মানুষের জমি জেগে ওঠে তার আর পুরনো জোড়াতালি চলে না। তাকে সবকিছু নতুন করে ঢেলে সাজাতে হয়।

ও তখন আকর্ণ বিস্তৃত হাসিতে উদ্ভাসিত হয়ে বলে, তুমি আজ রাতে আমার এহানে থাকো বাজান। কার্ল বেহানে আমি তোমার লগে নতুন চরে যামু।

রাহানুম চমকে আবুল হাশেমের মুখের দিকে তাকায়। ও দেখতে পায় বালুর ওপর কাঁকড়ার হেঁটে যাওয়ার মতো আঁকাবাকা রেখা জেগে উঠেছে সেই মুখে। ভুরু কুঁচকে আছে এবং দুভুরুর মাঝে প্রশ্নবোধক চিহ্ন। সেজন্যই বোধহয় চোখ জোড়া ছোট দেখাচ্ছে। আবুল হাশেম কেন জবেদ আলীকে থাকতে বলছে? কী মতলব? শুধুই কি জমি দেখতে যাওয়া নাকি অন্যকিছু? রাহানুম কিছু বুঝে ওঠার আগেই জবেদ আলী খুশিতে মাথা ঝাকায়। ঘন ঘন মাথা নেড়ে বলে, হ, ঠিকই কইছেন চাচা। আমনহের যাওনেরই কাম।

কথাটা বলার পরপরই জবেদ আলীর সঙ্গে রাহালুমের চোখাচোখি হয়। রাহামের ঠোঁটে চিকন হাসির রেখা, প্রায় অদৃশ্য, গভীর দৃষ্টিতে না তাকালে দেখা যায় না, তবু সেই হাসির রেখা জবেদ আলীর দৃষ্টি এড়ায় না। বউ মরে যাওয়ার পর থেকে ওর মনে যে দুঃখবোধ জমাট ছিল এই মুহূর্ত থেকে তা দ্রবীভূত হতে শুরু করেছে। ও আশ্বস্ত হয় এই ভেবে যে যাক কাউকে খুঁজে পাওয়া গেল। যে খানিকটা অন্যরকম, ভাবে প্রকাশ করে, শুধুই ঘরের বউ হবে না। সন্তানের মা হতে গিয়ে হয়তো মরেও যাবে না।

বিকেলে জবেদ আলীকে নিয়ে আবুল হাশেম হাটে যায়। ঘরে আতপ চাল ছিল। তার সঙ্গে খেজুরের গুড় দিয়ে রাহানুম পায়েস রান্না করে। সুখদীপ বসে আছে সামনে। ওর চোখে লোভ, কখন রান্না শেষ হবে। রাহানুম সুখদীপের মুখের দিকে তাকাতে পারে না। তাকালেই মনে হয় নিজের সুখের জন্য আজ ও এই ছেলেটিকে দূরে ঠেলে দেবে। এটা এক ধরনের চেষ্টা, মানুষ যেমন অনেক কিছু করার জন্য চেষ্টা করে এও তেমন। তারপর চেষ্টা সফল হলে ও চলে যাবে জবেদ আলীর সঙ্গে–লতাচাপালি, যে গায়ের কাছাকাছি একটি নতুন চর জেগে উঠলে ওর সৌভাগ্যের চিহ্ন হয়ে একজন মানুষ এই বাড়িতে আসে।

ও ধোঁয়া-ওঠা গরম হাঁড়ি চুলো থেকে নামায়। পাটালি গুড়ের খুশবুতে বেশ চনমনে হয়ে ওঠে খাবার ইচ্ছে। সুখদীপ জিভ চেটে বলে, মা, মোরে একটু দিবা?

মা, কে তোর মা?

রাহানুম প্রায় আঁতকে উঠে কথাটা বলতে চায়। কিন্তু পরক্ষণে নিজেকে শাসন করে। ছিঃ! কী কঠিন চেষ্টা। ও কেন ভাবছে এই ছেলেটির মা না হলেই ও কুমারী হয়ে যাবে? ও তো কুমারী নয়, জবেদ আলীর সঙ্গে ওর তো নতুন সংসার হবে না। জবেদ আলী যদি ওকে প্রত্যাখ্যান করে! তখন? রাহানুষের দুচোখে ছাপিয়ে জল আসে।

মা কান্দো ক্যা?

রাহানুম জবাব দেয় না। ছোট্ট একটা বাটিতে পায়েস বেড়ে দেয় সুখদীপকে। ও বাটি নিয়ে ঘরের বারান্দায় চলে যায়। ও যখন খুশি হয়ে কিছু খায় তখন গুনগুনিয়ে শব্দ করে। ওই শব্দ শুনলে রাহানুম বুঝতে পারে যে খাবারটি ওর খুব পছন্দ হয়েছে। ও তখন চুলোর আগুন নিভিয়ে। দিয়ে সুখদীপের কাছে এসে বসে। সুখদীপের খাওয়া শেষ। বাটি চেটেপুটে নিচ্ছে। তারপর রাহানুমের দিকে তাকিয়ে বলে, খুব মজা লাগছে মাগো।

রাহানুম মৃদু হেসে বলে, আর একটু নিবি!

ও লম্বা করে মাথা কাত করে। শূন্য বাটি এগিয়ে ধরে বলে, দেও।

মোর লগে আয়। হঠাৎ করে ওর মনে হয় আজ ছেলেটিকে খাইয়ে-দাইয়ে খুশি রাখা উচিত। বেচারা, কাল থেকে ভুলে যাবে মায়ের আদর। আর কাউকে কি ও পাবে যে ওকে এমন করে বুকে টেনে নেবে? যদি না পায়, তখন ও কী করবে? থাক, ভবিষ্যতের এতকিছুর ভাবনার দায় ওর নেই। যা ঘটবে তার অপেক্ষা করাই এখন দরকার।

বাটিভর্তি পায়েস নিয়ে দুজনে আবার বারান্দায় ফিরে আসে। সুখদীপ রাহনুমকে বলে, মা তুমি একটু খাইবা না?

না। অহন না?

মেহমান আল্যে খাইবা?

রাহানুম প্রশ্নের জবাব দেয় না। সুখদীপ আবার বলে, এমুন মেহমান পেত্যেক দিন আল্যে কত মজা! মাগো তাইলে তুমি কত কিছু রানধবা।

চুপ শয়তান ছেমড়া।

রাহানুম রাগে না, ওকে মিষ্টি আদর করে। ভাষাটা অমনই হয়।

সুখদীপ পুরো বাটি সাবাড় করে দিয়ে বলে, মাগো তুমি আইজকা এত খুশি ক্যা? আইজকা কিসের দিন? আইজতো ঈদ না।

ক্যাবল কথা। চুপ কর।

রাহানুম ধমকে ওঠে। তারপর বারান্দা থেকে নেমে বাইরে দরজার দিকে যায়। এখনো ফিরছে না কেন ওরা?

সন্ধ্যার পর জবেদ আলী হাট থেকে ফিরে আসে। হাতে দুটো বড়ো ইলিশ। তখন উঠোনে ফকফকে জ্যোৎস্না রাহানুম চুলা থেকে ভাত নামিয়েছে। মাছের অপেক্ষায় আছে। ওৱান্নাঘরের দরজায় চুপচাপ বসে থাকে। সুখদীপ উঠোনে দৌড়ে বেড়ায় আর ছড়া কাটে। ও মানুষটিকে উঠোনে ঢুকতে দেখতে পায়। মানুষটি সোজাসুজি রান্নাঘরের দরজায় এসে দাঁড়ায়। মাছ দুটো ওর সামনে বাড়িয়ে দেয়, চাচার আইতে এটটু। দেরি অইবে।

বাবা কেমনে?

বিব্রত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে রাহানুম। যেন এই মুহূর্তে ওর গোপনীয়তার সব লজ্জা থেকে উদ্ধার করতে পারে আবুল হাশেম। নইলে একা একা নিজেকে আর সামলানো যাচ্ছে না।

জবেদ আলী একটি সিঁড়ি টেনে দরজার কাছে বসতে বসতে বলে, ক্যা বাবো না থাকলে ডর করে?

রাহানুম সাহস করে বলে ফেলে, ডর কিয়ের? আমনহে আছেন না?

হো হো করে হেসে ওঠে জবেদ আলী। হাসতে হাসতে বলে, মুই ভাবলাম বাবো না থাকলে মোরে বুজি তোমার ডর। মুই তো একটা বাঘ, না অইলে ভালুক।

মুই কি তা কইলাম?

না, না, কও নাই, কইবা ক্যা।

আবার হাসে জবেদ আলী। এখন আর মুচকি হাসি নয়। সন্ধ্যা নামলে, উঠোনে পূর্ণিমার আলো ছড়িয়ে গেলে পুরুষ মানুষের ঠোঁটে মুচকি হাসি থাকতে নেই–সে হাসিকে শব্দে বিশাল করে তুলতে হয়।

জবেদ আলী রান্নাঘরের দরজায় বসে থাকে দেখে রাহানুম খানিকটা বিব্রত বোধ করে। এমনিতেই জবেদ আলীর সশব্দ হাসিতে ওর ভেতরের সমস্ত কলকবজা বিকল হয়ে যাচ্ছে। ও স্থির থাকতে পারছে না–কত অসংখ্য দিন পেরিয়ে একজন পুরুষ মানুষ ওর কত কাছে। যদি ও হাত বাড়ায় তাহলে ওকে ছুঁতে পারে। একটি শিশু ছাড়া বাড়িতে কেউ নেই। লোকটির এমন ইচ্ছে হতেই পারে। ও এখন বুঝতে পারে লোকটি কেন বাঘ বা ভালুক হতে চায়। রাহানুম ভয়ে ঘামতে থাকে। তড়িঘড়ি বলে, আমনহে হাতনায় বয়েন।

ক্যা, এহানে থাকলে কী অয়?

বাবো, যদি আহে।

ডর কী?

জবেদ আলী আবার হাসে।

রাহানুম বলে, ডর না শরম লাগে।

লজ্জায় ওর মাথা হাঁটুর ওপর নেমে আসে।

মুই দূরে যামু ক্যা। মুই তোমার ধারে থাকবার চাই। মুহূর্তে জবেদ আলীর মুখের দিকে তাকায় রাহানুম। অন্ধকারে ভালো দেখা যায় না, কিন্তু বুঝতে পারে দৃষ্টি চকচক করছে। চুলোর আগুনের হালকা আভায় জবেদ আলীর দৃষ্টি ছুঁচালো হয়ে উঠতে থাকে। রাহানুম দ্রুত মাথা নিচু করে ফেলে।

জবেদ আলী বলে, শরম পাও ক্যা? শরম কিয়ের? কথা বলতে বলতে ও রাহামের দু’হাত জড়িয়ে ধরে। গাঢ় কণ্ঠে বলে, মুই জানি তুমি।

কী চাও। জানি না?

হ, জানেন।

রাহানুম দ্বিধাহীন মাথা নাড়ে। তারপর বলে, হাত ছাড়েন। মাছ কাটি। রান্দনের দেরি অইয়া যাইবে।

অউক।

খিদা পাইবে না?

পাইবে।

খিদা লাগলে সুখদীপ কানবে।

কান্দুক।

ভাত রান্দা না অইলে বাবো রাগ অইবে।

রাগ অউক।

রাহানুম ফিক করে হেসে ফেলে। প্রবল ছেলেমানুষি জবেদ আলীর। কণ্ঠে। দৃষ্টিতে দুষ্টুমি। ওর মুঠিতে রাহালুমের হাত ঘেমে ভিজে যায়।

জবেদ আলী বলে, যদি হাত না ছাড়ি? ছাড়ুম না। এই হাত ধইরা লগে লইয়া যামু।

ওহ্ ছাড়েন। সুখদীপ আইতে পারে।

তখন জবেদ আলী হাত ছেড়ে দিয়ে উদ্বিগ্ন কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে, ওর বাপ কহন মরছে?

ও মোর পোলা না।

তোমার পোলা না?

না, মোর পোলা না।

জব্বর খুশির খবর। তাইলে তো তোমারে বিয়া করতে মোর বাধা কি? মোর মা-বাবো কিছু কইব না। একটা কথা, সুখদীপ তোমারে মা ডাকে ক্যা?

তখন রাহানুম জবেদ আলীকে জলোচ্ছ্বাসে আক্রান্ত সেই প্রলয়ঙ্করী রাতের গল্প শোনায়।

গল্প শুনে জবেদ আলী বলে, তোমার রিয়া অইছিলো এইডা মোগ বাড়িতে কারো ধারে কওনের কাম নাই।

তারপর ও শিস বাজাতে বাজাতে গিয়ে উঠোনে দাঁড়ায়। এদিক-ওদিক তাকিয়ে সুখদীপকে দেখতে পায় না। ও হয়তো বাড়ির বাইরে গেছে কিংবা পুকুরঘাটে। জবেদ আলী চিৎকার করে সুখদীপকে ডাকে।

রাহানুম কাঠে লাগানো বড়ো বটিতে মাছ কাটে, তাজা কচকচে মাছ। রক্ত বটির গা বেয়ে গড়াতে থাকে। মাছের পেট থেকে বড়সড় ডিম বের হয়, একগাদা নাড়িভূঁড়ি, কালো রঙের পিত্তথলি–এই থলিটি সাবধানে ছাড়িয়ে নিয়ে দূরে ফেলে দেয় ও। পিত্ত গলে গেলে মাছটা তেতো হয়ে যাবে–বিস্বাদ লাগবে খেতে। জবেদ আলীর মুখেতো বিস্বাদ খাবার দেওয়া যায় না। বড়ো গামলায় করে মাছ ধুয়ে নেয় ও। কিছু মাছ ভাজবে, কিছু রাঁধবে। প্রচুর পেঁয়াজ-কাঁচামরিচ দিয়ে দুইজোড়া ডিম সঁতলে নেবে। দারুণ হবে খেতে। তাজা ইলিশের গন্ধে ম-ম করে বাড়ি। রাহালুমের মনে হয় কত দিন পর বাড়িতে আজ উৎসব।

এইসব কাজের ফাঁকে জবেদ আলীর ডাক শুনে ওর কাছে ছুটে আসে সুখদীপ। এসেই হাত চেপে ধরে, ডাকেন ক্যা?

গেলহি কেমনে?

এ প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে সুখদীপ খলখল করে হাসে। দুজনে। হাতনায় হোগলার ওপরে বসে।

তোর কাইল স্কুল নাই? অহন পড়ালেখা নাই?

স্কুলে যামু না।

ক্যা?

আমনহে যদি বাড়ি থাহেন—

মুই কাইল চল্যা যামু।

তখন সুখদীপ ওর গলা জড়িয়ে বলে, আইজ একটা খুশির দিন। মা কতকিছু রাব্দে। আমনহে আমার লগে একটা গল্প কন।

গল্প?

জবেদ আলীর চোখে হিংস্র আলো ফুটে ওঠে। একটু আগে ও রাহানুমের কাছে একটি গল্প শুনেছে। এই গল্পটি এই ছেলেটি জানে না। গল্পটি ছেলেটিকে জানতে হবে। গল্পটি ওকে জানিয়ে দিয়ে রাহনুমকে নিয়ে ওর নতুন সংসার।

ও তখন ছেলেটিকে গল্প বলতে আরম্ভ করে, ভয়াল হিংস্র রাতের গল্প। একটু একটু করে, গল্পের খোসা ছাড়ায়, একটু একটু করে এগোয়–রূপকথা নয়, অথচ ভিন্ন এক জীবন–ছেলেটির কাছে একদম নতুন। ও রুদ্ধশ্বাসে জবেদ আলীর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে, চোখের পলক পড়ে না, চোখের মণি নড়ে না, ওর কণ্ঠ রুদ্ধ। কারণ তখনো ও জানে না যে সুখদীপ নামের একটি ছেলে এই গল্পের নায়ক, অথচ সে শিশুটি প্রবল জলোচ্ছ্বাসে ভেসে যাওয়ার পর থেকে ওই শিশুর জন্য ওর বুক ফেটে যাচ্ছে। শিশুটি মা খুঁজে পেলে ওর মুখে হাসি ফুটে ওঠে। জবেদ আলী ইনিয়ে-বিনিয়ে গল্প বানায়, কণ্ঠ কখনো ওঠা-নামা করে, কখনো বিস্তৃত হয়, কুঁকড়ে যায় এমনকি হিসহিস শব্দে হিংস্রও হয়ে ওঠে। হিংস্র হয়ে উঠলে সুখদীপের ভয় করে। তখন ও জবেদ আলীর হাত চেপে ধরে। আবার ভালো মুহূর্তে হাত ছেড়ে দেয়।

রাহানুম রান্নায় ব্যস্ত। ছাঁকছুক শব্দে ও জানতেও পারে না যে জবেদ আলী আর একটি নাটক তৈরি করেছে। ওই নাটকে দ্রুত বদলে যাচ্ছে রাহানুষের জীবন। ও হারাচ্ছে সুখদীপকে, যে দায়িত্বটি ও নিজেই পালন। করতে চেয়েছিল, সে দায়িত্ব আর পালন করতে হবে না।

গল্পের শেষে সুখদীপকে যখন শোনানো হয় যে গল্পের শিশুটি ও নিজে তখন ও চিৎকার করে কেঁদে ওঠে, মিছা কতা। এক্কেরে মিছা কতা? মিছা কতা কন ক্যা?

মিছা না–হাছা কতা।

সাপের মতো হিসহিস করে জবেদ আলীর কণ্ঠ। ও এখন জল্লাদের মতো ক্রুর–একই নিষ্ঠুর ভঙ্গিতে বলে যাচ্ছে, তোর বাপ নাই, মা নাই, কেউ নাই, তুই অউক্কা এতিম পোলা।

সুখদীপ ছুটে রান্নাঘরে যায়, মা তুমি মোর মা না?

রাহানুমের বুক কটকট করে। ও চট করে উত্তর দিতে পারে না। এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য যদিও ওর মনে মনে ভাবনা ছিল, কিন্তু প্রস্তুতি ছিল না। ও মুহূর্তের মধ্যে নিজেকে নির্মম করে তুলতে পারে না। মনে পড়ে এইতো সেদিন ও সুখদীপকে বুকের দুধ খাইয়ে বড়ো করে তুলেছে। এ ছাড়া সুখদীপ আর কারো কাছে যেতে চাইত না। এখনো তো ওর গলা না জড়িয়ে ধরে সুখদীপ ঘুমোতে পারে না। মা, মা করে যখন ডাকে তখন ক্ষণিকের জন্যও মনে পড়েনি যে সুখদীপকে ও গর্ভে ধরেনি। তাহলে এত তাড়াতাড়ি–এত তাড়াতাড়ি সবকিছু–নাহ্ রাহানুম সুখদীপের প্রশ্নের জবাব দিতে পারে না।

মার কাছ থেকে কোন সাড়া না পেয়ে সুখদীপ আবার জবেদ আলীর সামনে এসে দাঁড়ায়। চিকার করে বলতে থাকে, মুই এতিম পোলাতো তোমার কি কুত্তার বাচ্চা? তুমি ক্যা মোরে এতিম বানাইবা? মায়েতো কিছু কয় না?

জবেদ আলী ওকে তেড়ে ওঠে, বাব্বা কেউটা একটা। কে তোর মা? এহানে তোর মা নাই। তোর মা ঝড়ের রাইতে মরছে।

সুখদীপ একথা শুনে আবার দৌড়ে রাহালুমের সামনে এসে দাঁড়ায়। কান্নার চোটে ওর কণ্ঠ দিয়ে স্বর বেরুতে চায় না। ও এখন রীতিমতো ফোঁপাচ্ছে।

মা তুমি কতা কও না ক্যা? কও মা ওই বেড়া যা কয় হে মিছা? বেড়া সব মিছা কতা কয়?

রাহাম নিজেকে সামলে নেয়। সুযোগের সদ্ব্যবহার করার জন্য তৈরি হয়ে যায়। নিস্পৃহ কণ্ঠে বলে, না বাবা, সব হাছা কতা।

রাহালুমের এই শক্ত উচ্চারণ করার সময় একটুও গলা কাঁপে না। বরং কথাটা বলতে পেরে নির্ভার হয়ে যায় ও। ধরে নেয় সুখদীপ কেঁদেকেটে চুপ করে যাবে। কিন্তু রাহামের কাছ থেকে ওই কথা শোনার পর ও মুহূর্তমাত্ৰ থমকে থাকে, তারপর দৌড়ে উঠোন পেরিয়ে পুকুরঘাটে চলে যায়। ওর ফোঁপানির শব্দ ভেসে আসছে। জবেদ আলী জানে, এটা নিয়ে ভাবার কিছু নেই। দুদিন কেঁদেকেটে ঠিক হয়ে যাবে সুখদীপ। তারপর নিজের ভাগ্য নিজেই বুঝবে। আবুল হাশেমের সংসারে থেকে যাবে ও। আবুল হাশেমের তো একজন কাউকে দরকার হবে।

আবুল হাশেম এখনো ফেরেনি। কোথায় গেল বুড়ো? ওর হাতে মাছ ধরিয়ে দিয়ে বলেছিল, তুমি যাও। মুই আহি। এতক্ষণে তো হাট ভেঙে গেছে। তাহলে আসছে না কেন? জবেদ আলী ট্র্যাক থেকে বিড়ি বের করে ধরায়। অন্ধকারে ধোয়ার কুণ্ডলী ওঠে। গোল্লা গোল্লা হয়ে ছড়িয়ে যায়। ছড়িয়ে পড়ে। গোল্লাগুলি রাহামের মুখ হয়–একজন নারী যে এতকাল ওরই প্রতীক্ষায় ছিল–প্রতীক্ষায় থাকাটাই সাধনা। প্রতীক্ষার অবসান মানে ফসল, গোলাভরা শস্যদানা। জবেদ আলীর ঠোঁটের কোণে চিকন হাসি ঝুলে থাকে, অন্ধকারে দেখা যায় না, ওটা শুধু ওর আত্মতৃপ্তি এবং আনন্দ।

রাহানুম ওর জন্য রান্না করছে, ভাবতে ওর ভালোলাগে–রান্নার চমৎকার গন্ধ আসছে, যেন খাবার নয়, তা রাহামের শরীর। চুল থেকে উঠে আসছে ফুলের গন্ধ–ছড়িয়ে যাচ্ছে বিছানায়, বালিশে, ঢুকে যাচ্ছে জবেদ আলীর ভেতরে। গন্ধ ওকে পাগল করে তোলে। জবেদ আলীর ঠোঁটে ঝুলে থাকা হাসি বিস্তৃত হয়–কতদিন নারীর শরীর স্পর্শ করা হয়নি, সেই আষাঢ় মাসে, প্রবল বৃষ্টির রাতে বউ মরে যাওয়ার পর। সেদিন আকাশে জ্যোৎস্না ছিল না–ওর সামনে উঠোনময় আলো ছিল না। প্রবল ব্যাঙের ডাকে তোলপাড় করছিল প্রান্তর, সেই রাতে মরে গেল ওর বউ। এখন রাহানুম ওর সামনে, ওর মুখে ভাষা আছে–চোখেও। যেন রহস্যময়ী নারী রাহানুম–গন্ধ এবং আলোয় ভরা। এইসব ভাবনার নিমগ্ন অবসরে সুখদীপ অন্ধকার ফুঁড়ে সামনে এসে দাঁড়ায়। ওর হাতে উদ্যত দা। চমকে ওঠে জবেদ আলী একলাফে সরে যায়।

তুই মোগ বাড়ি আইছ ক্যা? কে তোরে আইতে কইছে? মুই তোরে কোপাইয়া শ্যাষ করমু।

হারামজাদা, কুত্তার বাইচ্চা, জাউরা শয়তান।

জবেদ আলী চিৎকার করে গালি দেয়। রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে আসে রাহানুম।

ও বাজান, বাজান তুমি কী হরো?

ও তোমারে কাইড়া লইতে চায় মা। আমি ওরে কোপাইয়া শ্যাষ করমু।

সুখদীপ বারান্দায় লাফালাফি করে।

হোন, বাজান, হোন।

রাহানুম ওকে ধরতে চায়। সুযোগ বুঝে জবেদ আলী পেছন দিক থেকে ওর হাতটা মুচড়ে ধরে। দা কেড়ে নেয় এবং গোটা কয়েক থাপ্পড় দিয়ে ধাক্কা মেরে ফেলে দেয়। চিৎকার করে কাঁদে সুখদীপ। মাটিতে পড়ে গিয়ে ও আরো ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। রাহানুম ধরতে গেলে ওর হাত কামড়ে দেয়। ও পাগলের মতো উঠোনে ঘুরপাক খায়। চিৎকার করে জবেদ আলীকে গালাগাল করে। জবেদ আলী ওকে তাড়া করলে বাড়ির বাইরের দিকে ছুটে চলে যায়। অন্ধকারে ওকে আর দেখা যায় না। ওর কান্নার শব্দও আর নেই।

তখন আবুল হাশেম উঠোনে এসে দাঁড়ায়।

অর কী অইছে?

রাহানুম কথা বলে না, নিঃশব্দে রান্নাঘরে চলে যায়। জবেদ আলীও চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। কারো কাছ থেকে কোনো সাড়া না পেয়ে আবুল হাশেমও আর কোনো কথা বলে না। সে নিজেও বেশ ক্লান্ত। ধরে নেয় সুখদীপের কী হয়েছে, এটা না জানলে ওর তেমন কোনো ক্ষতি নেই। বাচ্চাদের কত কিছু হতে পারে, সব জানার দরকারই বা কী? তবু মনটা খচখচ করে। আহা, এই ছেলেটিকে ও দুধের-শিশু থেকে পালছে। ওর কেউ না, তবুতো মনের মধ্যে একটা টান আছে। রাহানুম রান্নায় ফিরে গেছে। আজ ও কথা বলল না কেন? ওরইতো উচিত ছিল গলগলিয়ে সব কথা বলা। তবে ওর মুখ বন্ধ কেন? সুখদীপকে নিয়েতো ও-ই বেশি কথা বলে। ছেলে, ছেলে করে পাগল। আজ ওর মুখে কথা নেই, শুধু রান্নাঘরের কড়াইয়ে ইলিশ মাছের টুকরো তেলের ওপর ছ্যাকহঁ্যাক করে। এই শব্দ দিয়ে রাহামের কোনা কিছু বোঝা যায় না। ওর সবটাই আড়াল হয়ে থাকে। আবুল হাশেমের মনে হয় তাহলে কি বড়ো রকমের কোনোকিছু ঘটে গেছে?

এমন আশঙ্কা নিয়ে, অর কী অইছে, বলতে বলতে আবুল হাশেম বারান্দার হোগলার ওপর বসে। দু’হাত পেছনে ঠেস দিয়ে শরীর ছেড়ে দেয়। তখন অন্ধকার থেকে আবার তীরের মতো ছুটে আসে সুখদীপ।

দাদা, এই বেডা কয়, মুই তোমার কেউ না? মোরে তোমরা টোকায়ে আনছো? কও দাদা, এইডা এক্কেরে মিছা কতা?

আবুল হাশেম চুপ করে থাকে।

সুখদীপ ফোঁপাতে ফোঁপাতে একই কথা বলে।

আবুল হাশেম চুপ করে থাকে–ওর মাখার মধ্যে স্বপ্ন–নতুন চর জেগেছে, কিন্তু এই ছেলেটি ওর উত্তরাধিকার নয়, ওকে সত্যি কথাটা বলে দেওয়া ভালো। এখনই এক মহা মুহূর্ত। আবুল হাশেমের বুকের ভেতর উথালপাথাল। সুখদীপ ওর মুখখামুখি উবু হয়ে বসেছে, কান্নার ধ্বনি কমে এসেছে। ও এখন উদগ্রীব হয়ে আছে, ওর বুকের ভেতরে যাবতীয় কলকবজা চলাচল বন্ধ। অন্ধকারে সুখদীপের মুখ স্পষ্ট নয়, ওখানে কী বিচিত্র নকশা জেগেছে সেটা আবুল হাশেম দেখতে পাচ্ছে না। জ্যোৎস্না তত জোরালো নয়, কারণ চাদ ক্ষয়ে আসছে–চাদের কাছাকাছি এক টুকরো মেঘ। সুখদীপ একই কথা বারবার আউড়ে। যাচ্ছে। ওর কণ্ঠ ক্ষীণ। আবুল হাশেমকে নিশ্ৰুপ দেখে ওর ভেতরটা ক্ষয়ে গেছে, ও আর তেমন শক্তি পাচ্ছে না। নাকি ও এক প্রচণ্ড বিস্ফোরণের অপেক্ষায় থম ধরে আছে?

রাহনুমের কড়াই থেকে ছ্যাঁকছ্যাঁক শব্দ আসছে না। ও কড়াইটা চুলো থেকে নামিয়ে রেখে উদগ্রীব হয়ে রান্নাঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে আছে। জবেদ আলী এগিয়ে এসে বলে, ছেমড়ারে হাছা কতাটা কয়েন। চাচা।

আবুল হাশেম তবু নিশ্ৰুপ। ওর করোটিতে রঙিন মাছ ভেসে এসেছে। বুঝে যায় কেন জবেদ আলীর এই তড়িঘড়ি ভঙ্গি–কেন ও সুখদীপকে রাহানুষের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করতে চায়! কী ওর আকাঙ্ক্ষা। আজ সকালে ও এসেছে, এর মধ্যে এমন বিচিত্র তোলপাড় এই সংসারে? জবেদ আলী যখন ঘটনাটা ঘটিয়েই ফেলেছে তাহলে তো আবুল হাশেমের জন্য এটা একটা সুযোগ! ও অনুপ্রাণিত হয়ে ওঠে। নিজেকে বলে, এখনই সময়, এখনই। তিনজন মানুষ যে এক নয় ওটা তো সবাইকেই বুঝতে হবে। ওদের দায়িত্ব যে আবুল হাশেমের নয় সেটাও জানতে হবে। এই জানা যতই নির্মম হোক অতে ওর কি এসে যায়? কে সুখদীপ? কে রাহানুম? পথ চলতে কোনো একদিন দেখা হলেই কি আপন হবে? আবুল হাশেমের সামনে নিজের অতীত প্রবল হয়ে ওঠে। সে অতীতকে আঁকড়ে ধরে ওসামনে তাকাতে চায়–সে অতীতের আদলে ভবিষ্যৎ গড়ে তুলতে চায়। কারণ ওর জমি জেগে উঠেছে–নতুন জমি। এখনই তো সময় এই কয়টা বছর মুছে ফেলার।

সুখদীপ ওর সামনে বসে আছে। উবু হয়ে বসে ছিল, এখন হাঁটু মুড়েছে। একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে ওর মুখের দিকে। ওর দৃষ্টি বিস্ফারিত, ফুলে উঠছে নাক–ওর জীবনে এখন এক রুদ্ধশ্বাস অপেক্ষা। আবুল হাশেমের একটি কথার ওপর নির্ভর করছে ওর জীবনে অনেক কিছু। ওই মুখে আজ জ্যোৎস্না নয়, মেঘের মাখামাখি। ওই মেঘ গাঢ় হবে, অন্ধকার ঘনীভূত হবে–প্রবল বর্ষণে ধুয়ে যাবে প্রান্তর।

আবুল হাশেম খুব আস্তে করে কথাটা বললেও কথাটায় ষাঁড়ের গর্জন ধ্বনিত হয়। সে গর্জনে ছিটকে পড়ে যায় সুখদীপ। ওর দুকান ভরে বাজতে থাকে, হ দাদা, বেবাকটাই হাছা কতা।

তীব্র কণ্ঠে চেঁচিয়ে উঠে চিৎকার করে কাঁদে সুখদীপ। তারপর দৌড়ে পুকুরঘাটে চলে যায়। জবেদ আলী পিছু পিছু যায়। গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকে। সুখদীপ ঘাটলায় বসে দুহাতে মুখ ঢেকে কাঁদে। ওই শব্দে জবেদ আলীর কখনো মুহূর্তের জন্য খারাপ লাগে, সঙ্গে সঙ্গে ও তা ঝেড়ে ফেলে দেয়। ও সহানুভূতি জানাবার জন্য দাঁড়িয়ে নেই। লক্ষ্য রাখতে এসেছে যে ছেলেটি যেন কোনো অঘটন না ঘটায়। কিন্তু ও বসে আছে–ও হয়তো মৃত্যুর কথা ভাবছে না। এই বয়সে মৃত্যুর কথা ভাবা যায় না। তবে ওর ভেতর প্রতিশোধের আগুন জ্বলছে। ও জবেদ আলীকে খুন করতে চায়। আজ রাতে একটুও না ঘুমিয়ে, ভীষণ নিঃশব্দে, দা নিয়ে এসে ও কি জবেদ আলীকে কুচিকুচি করবে? হয়তো করত যদি ও একটি পুরুষ হতো। কিন্তু ও শিশু। গায়ের জোরে কোনোকিছু করা ওর পক্ষে সম্ভব নয়। এসব ভাবতে ভাবতে জবেদ আলী কূর আনন্দে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে শিশুর কান্না শোনে–যে শিশুর কিছুক্ষণ আগেও ঘর ছিল, মা ছিল, দাদা ছিল, এখন ও এতিম। মুহূর্তের মধ্যে ওর সামনে সবকিছু নেই হয়ে গেছে। পৃথিবীতে ওর কেউ নেই। এই নিঃসঙ্গতা জাগতিক এবং মানসিক। সুখদীপ এখন কোথায় যাবে?

কোথায় যাবে তাতে জবেদ আলীর কী এসে যায়? ও নিজেকে শক্ত করে ফেলে। সুখদীপের কান্না এখন আর ওকে স্পর্শ করে না। ও গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে বিড়ি ধরায়। বিড়ির আগুন জোনাকির মতো জ্বলে। জোরসে টান দিলে আলো যেমন উজ্জ্বল হয়ে ওঠে তেমন চকচক করে জবেদ আলীর চোখ–ও মনে মনে,আঁক কষে, নষ্ট আঁক–কেমন করে জব্দ করবে একটি শিশুকে অর নকশা সে আঁকে। ঠিক করে সুখদীপের কান্না থিতিয়ে এলে জবেদ আলী প্রথমে ওর হাত ধরে মুচড়ে দেবে তারপর বশে এলে হ্যাঁচকা টানে ধাক্কা মেরে হিড়হিড় করে টেনে বারান্দায় নিয়ে ফেলবে। দরকার হলে বেশ কয়েক ঘা লাগিয়ে দেবে। ওকে মারলে কেউ কিছু বলবে না। ও বুঝে যায় যে আবুল হাশেম এবং রাহানুম কেউই শিশুটির পক্ষে নয়। ওরা নিজ নিজ খেলার কোর্টে দাঁড়িয়ে গেছে। এখন কেবল গোল্লাছুটের বাকি। এই পুঁচকে ছেলেকে জব্দ করা এক নিমেষের কাজ। জবেদ আলী জোরসে টান দিয়ে বিড়িটা ছুড়ে ফেলে দেয়। মনে হয় এখনও পুরোপুরি তৈরি। শিশুটি ওর নাগালের ভেতর। হাতটা ধরে মুচড়ে দিলেই হয়।

আবুল হাশেম জবেদ আলীর ব্যবহারে কিছুটা দ্বিধান্বিত। ও বুঝতে পারে না যে কেন জবেদ আলী সুখদীপকে রাহানুম থেকে আলাদা করে দিল? কী এর উদ্দেশ্য? ও কি রাহানুমকে বিয়ে করতে চায়? যেমন আবুল হাশেমের নিজেরও একটি পরিকল্পনা মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে–যে জন্য ও হাট থেকে ফেরার পথে নূরুল আলমের বিধবা বোনের খোঁজ করতে গিয়েছিল–যার হাতের বানানো পান খেয়ে কিছুতেই উঠতে ইচ্ছে করছিল না, তাই এত রাত হয়েছে। জীবনে নারীর কথা ও ভুলেই গিয়েছিল–সেই নারী প্রথম পূর্ণিমার বিশাল চাদ, আলোকিত করে দিতে পারে আবুল হাশেমের এই জীবন। আবুল হাশেম চমকে নিজের দিকে তাকায়। এই জীবন! এই জীবন আবার কী? আর কত? অনেক, অনেক–নিজেই নিজের প্রশ্নের উত্তর দেয়। যার জীবনে হারানো চর নতুন হয়ে ফিরে আসে তার জীবনের তো সবে শুরু, তার আর বয়স কী, বার্ধক্য কী? আর দেরি নয়–আর বৃথা সময় নষ্ট নয়, এখন ওর গোছানোর পালা। কিন্তু জবেদ আলী কী চায়? রাহনুমকে? ভেবেছে রাহানুম আবুল হাশেমের মেয়ে?

আবুল হাশেমের প্রচণ্ড হাসি পায়। কিন্তু ও অতি কষ্টে নিজেকে দমন করে। এখনই এতকিছু প্রকাশ করতে চায় না। আগে জবেদ আলীকে বুঝতে চায়। ও যদি শুধুই রাহনুমকে বিয়ে করতে চায়, ভালো–আপত্তি নেই। কিন্তু রাহানুমকে আবুল হাশেমের মেয়ে ভেবে নতুন চরের উত্তরাধিকারী হতে চাইলে তো গোল বাধবে। কিন্তু পরক্ষণে নির্ভাবনা হয়ে যায় ও। গোলই বা বাধবে কেন? সময়ই সব কথা বলে দেবে। এত তড়িঘড়ি সব ফয়সালা না করাই ভালো। আজ রাতটুকু ওই শিশুটির রাত হয়ে থাক–নিজেকে জানার, কষ্টের এবং বড়ো হয়ে ওঠার।

এইসব ভাবতে ভাবতে আবুল হাশেম রান্নাঘরের দরজায় এসে দাঁড়ায়। খিদে পেয়েছে। বেশ রাতও হয়েছে। এখন ঘুমুতে হবে। ভীষণ ঘুম পাচ্ছে। ও দেখতে পায় রাহামের রান্না শেষ। ও গামলায় ভাত বাড়ছে, বাটি ভর্তি মাছের তরকারি, চমৎকার খুশবু ছুটেছে। পেটের ভেতর নাড়ি পাক দিয়ে ওঠে। সেই কোন দুপুরে খেয়েছে, তারপর আর কিছু খাওয়া হয়নি। আগুনের আঁচে রাহালুমের চেহারা লালচে হয়ে উঠেছে, শ্যামলা গালে হাসিতে টোল পড়ে। ওর চোখের কোণে দুটো জল। ও কি কাঁদছে নাকি ঘাম? আবুল হাশেম গলা খাকারি দেয়। রাহানুম ওর দিকে তাকায় না। মুখ না তুলেই বলে, বাবো আমনহে হাতনায় বয়েন। মুই ভাত আনি। সুখদীপ? ও সুখদীপ?

রাহানুম গলা উঁচিয়ে ডাকলে আবুল হাশেম বাধা দেয়, থাক অরে ডাইকো না। মুই দেহি।

আবুল হাশেম দু’পা এগুতেই দেখতে পায় জবেদ আলী ওকে চ্যাংদোলা করে দোলাতে দোলাতে নিয়ে আসে। যেন ওকে বধ্যভূমিতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, যেটুকু জীবনশক্তি আছে সেটুকুও নিঃশেষ করা হবে। ও আর কোনোদিন ওদের পথের বাধা হয়ে থাকবে না। সুখদীপ হাত-পা ছুঁড়ছে, প্রাণপণে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করছে। ও ওর সর্বশক্তি দিয়ে প্রতিপক্ষের সঙ্গে লড়ছে। কিন্তু জবেদ আলীর সঙ্গে ও পারবে কেন?

ওই অবস্থায় আবুল হাশেম ওকে জাপটে ধরে কোলে নেবার চেষ্টা করে। বলে, থাম, দাদা ভাই, থাম। দেহি কার গায়ে বল বেশি। আয়, মোর ধারে আয়।

সুখদীপ আবুল হাশেমের হাত কামড়ে দেয়। তখন জবেদ আলী ওকে ধপ করে নিচে নামিয়ে দেয়। আবুল হাশেম উহ্ শব্দ করে কামড়ের জায়গায় থুতু লাগায়। দাতের দাগ বসে গেছে। জ্বালা করছে, তবে রক্ত বের হয়নি। আবুল হাশেমের মৃদু কাতরানিতে সুখদীপ ঘাড় বাঁকা করে ওর দিকে তাকিয়ে থাকে। জবেদ আলী গজগজিয়ে বলে, ছ্যামড়া মানুষ না, শয়তানের ছাও। আস্ত ইবলিশ।

ততক্ষণে রাহানুম ওদের কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। ও হাঁটু গেড়ে বসে সুখদীপকে দু’হাতে জড়িয়ে ধরে। বলে, আও বাজান, ভাত খাও। তোমার ভাত খাওয়া অইলে এউক্কা গল্প কমু।

গল্প? থুঃ।

সুখদীপ রাহামের মুখের ওপর থুতু ছিটায়। সে থুতু ছিটিয়ে ছড়িয়ে যায় চারদিকে। থুতু গিয়ে লাগে জবেদ আলীর মুখে এবং আবুল হাশেমের মুখেও।

ওরা কেউ থুতু মোছর জন্য নিজেদের হাত ওঠাতে পারে না, যেন এক শীতল স্পর্শ কামড়ে ধরে আছে ওদের চামড়া–ঘষলেই যা মুছে। যাবে না। ওই থুতু ওদের শরীরে এক স্থায়ী দাগ।
আন্ধারমানিক নদীর কিনারে চোখ বুজে দাঁড়িয়ে থাকে আবুল হাশেম। নতুন চরের গন্ধ ওর ফুসফুস বেয়ে নিচের দিকে নামতে থাকে। চর জেগেছে মাত্র–এই নিয়ে বিভিন্ন শরিকের মধ্যে বিরোধ মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে–প্রভাবশালীরা অন্যায়ভাবে দখল করতে চাচ্ছে। কিন্তু আবুল হাশেম জানে শেষ পর্যন্ত কেউই টিকতে পারবে না, কারণ ওর কাগজপত্রে কোনো ফাঁক নেই। কিন্তু ভয় একটাই, চর দখলের সময় কেউ কাগজপত্রের ধার ধারে না। জোর যার মুল্লুক তার, এমন একটা ভাব নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে ক্ষমতাশীলরা। ওর খানিকটা মন খারাপও হয়ে যায়। কারণ ও জানে শক্তির জয় সর্বত্র–অন্যায়কারীরা অর্থের জোরে বিভিন্নভাবে প্রতিষ্ঠা পায়। আবুল হাশেমের তো এখন অর্থ নেই, লোকবলও নেই। কেমন করে ও শেষ পর্যন্ত টিকে থাকবে? ভয়ে বুকের ভেতর কুঁকড়ে যায়। ভয় পেলে, মন কুঁকড়ে থাকলে ওর করোটিতে সোনালি মাছ ডানা মেলে না। আর সোনালি মাছ ডানা না মেললে ও স্বপ্ন দেখতে পারে না।

আবুল হাশেম দ্রুত নিজের ভেতর থেকে ভয় তাড়িয়ে দিতে চায়। যৌবন ফিরে পাবার আকাঙ্ক্ষায় ও শক্তি সঞ্চয় করে মনে মনে। উড়িয়ে দেয় অমূলক আশঙ্কা। ধরে নেয় ও একাই এই একচ্ছত্র সাম্রাজ্যের মালিক। যে জমি একদিন ওর ছিল, যা একদিন নদীগর্ভে চলে গিয়েছিল, তা এখন আবার ওর মণিমালা হয়ে ফিরে এসেছে। ওর ভয় কী? ভয় কেন থাকবে? বিয়ের পরে ওদের যখন নতুন জীবন তখন মণিমালা ওকে ভালোবাসার কথা বলত। আর যে গভীর ভালোবাসা পায় সে তো সাহসী পুরুষ।

মণিমালা বলত, মোর জমি আমনহের জমি। আমনহেই বেবাক জমির মালিক। মোরে দু’গা ভাত দিবেন ক্যাবল।

আহ, কি প্রবল ভালোবাসা ছিল মণিমালার কণ্ঠে, দৃষ্টিতে, আচরণে। মণিমালা গভীর মমতায় ঘিরে রেখেছিল ওকে। ওর কোনো অভাববোধ ছিল না। মণিমালার মতো স্ত্রী থাকলে কোনো পুরুষ মানুষের ভয় থাকে না। ওর কোনো ভয় ছিল না। এখন তো মণিমালা ওর পাশে নেই–শুধু স্মৃতি। স্মৃতিটুকু আঁকড়ে ধরে ও নদীর কিনারে দাঁড়িয়ে পা দাবায়। থেমে যায় বুকের ভেতরের কাঁপুনি করোটিতে ভেসে আসে সোনালি মাছ। ও মণিমালার উদ্দেশে বঙ্গে, তুমি মোর বেবাক কিছু–মোর টাহার পাহাড়, মানুষের গায়ের বল। মণিমালার স্মরণে দীর্ঘকাল পর আবুল হাশেমের চোখে দুফোঁটা জল গড়ায়। এখন গভীর করে ওকে আর। তেমন মনে পড়ে না। এই মুহূর্তে শক্তি সঞ্চয়ের জন্য মণিমালাকে প্রয়োজন–কারণ মণিমালার স্মৃতি ছাড়া ওর পাশে আর কেউ নেই।

ও হাতের তালুতে চোখের জল মুছে ফেলে। জানে, ওর ভয় কেটে গেলে বর্তমানের জাগতিক নানা কিছু ওকে গ্রাস করবে, তখন তলিয়ে যাবে মণিমালা। বড়ো হয়ে উঠবে বেঁচে থাকা, পারিপার্শ্বিক এবং নিত্যদিনের ঘরগেরস্তির খুঁটিনাটি। তাই ও ভালোভাবে বেঁচে থাকার তাগিদে অল্পক্ষণের মধ্যে নিজের ভেতর শক্তি সঞ্চয় করে।

নদীর পানিতে তোলপাড়। ছোট ছোট ঢেউ ভাঙে আর গড়ে–গড়ে আর ভাঙে–যে ভাঙায় তৈরি হয় আবুল হাশেমের নিজের নকশা। পানির নিচে গুচ্ছ গুচছ ঘাস–ডানে বামে সামনে পেছনে ঘাসের বিস্তার। যে জায়গাতে পা রাখে না কেন সেটাই ওর জন্য স্বস্তি। দূরের প্রান্তর জুড়ে সবুজ দিগন্তের কাছাকাছি রেখাটি সবুজ এবং আবুল হাশেমের হৃদয় এখন সবুজ–যদি কেউ বলে ওটা ফসিল হয়েছে তাহলে ও মানবে না। মণিমালার স্মৃতিই ওর সব বলে মন মানতে চায় না। সে গণ্ডি পেরিয়ে ও যেতে চায় অন্য কোথাও, আরো দূরে। বাহাত্তর বছর বয়স হলেই হৃদয়ের রঙ পাল্টায় না, সেটা কাশফুল হয়ে যায় না। ওর শরীরের লোমগুলো ধানের কচি চারার মতো সবুজ হয়েছে–এখানে অন্য কোনো রঙ মানায় না। এই রঙ নিয়ে ও অনায়াসে একজন বিধবা নারীর কাছে যেতে পারে–তার গর্ভে উৎপাদন করতে পারে সন্তান।

জবেদ আলী বলেছে এই চরে ও ঘর ওঠাবে–নতুন বাঁশ, বাঁশের বেড়া, হোগলার ছাউনি দিয়ে ঘর। প্রথম বসতি হবে ওর। নতুন মাটিতে এক নতুন জীবনের শুরু। যার নাম সংসার। বলেছে, রাহানুমকে নিয়ে সংসার পাতবে ও। এই জমি ও চাষ করবে। লাঙল আসবে, হালের বলদ আসবে, বীজ আসবে। নতুন জমি বিক্ষত হবে লাঙলের ফলায়–বিক্ষত হবে রাহানুম, ওর জমিতেও চাষ হবে, বীজ বোনা হবে। সোনালি ফসলে ভরবে জমিন, ভরবে জীবন। দুয়ে মিলে গড়ে উঠবে সংসার। ওহ সংসার! আবুল হাশেম উত্তর দিকে মুখ করে দাঁড়ালে বাতাসে ওর চুল ওড়ে, ভুরু কাঁপে। বুকটা আইচাই করে। সংসার? মণিমালার সঙ্গে ওর একটা সংসার ছিল। সে স্মৃতি ঝাপসা হয়ে এসেছে, যদিও প্রয়োজনে সেই স্মৃতিকে আঁকড়ে ধরে নিজেকে ক্ষয়ে যাওয়ার হাত থেকে বাঁচাতে চায়। কিন্তু সে অনুভূতি তাৎক্ষণিক, সাময়িক। এখন ও নূরবানুকে নিয়ে সংসার করার কথা ভাবছে। নতুন জমির মালিক হলে সংসার ছাড়া সে কর্তৃত্ব জমে না। জমি ওকে স্বপ্ন দেখাচ্ছে। কারণ রাত্রিবেলা ঘর থেকে বেরোলেই ওর সামনে থাকে ফকফকে জ্যোৎস্না। ও অমাবস্যা। ভালোবাসে না। ও একজন মানুষ। ওর কান্না পায়, সুখ হয়। মরণের সুখ, একাকিত্বের সুখ। কী যেন একটা ওকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়। কী? জলোচ্ছ্বাসের গভীর কালো রাত? কুয়োকাটার পূর্ণিমা? গভীর সমুদ্র? সেই অদ্ভুত সুন্দর রঙিন মাছটা? তখন ওর মনে হয় ওই মাছটাই ওর সব। ওটাকে জুড়েই ওর আকাক্ষা এবং মন কেমন করা।

দেখতে দেখতে সাত দিন পেরিয়ে গেল এখানে। জবেদ আলীর সঙ্গে রাহামের বিয়ের কথা পাকাপাকি হয়েছে। রাহানুমের মতামত নেওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। আবুল হাশেম জানে রাহানুম বিয়ের জন্য মুখিয়ে আছে। জবেদ আলীর বাপ আপত্তি করেনি। তার বলার কিছু নেই। আবুল হাশেম জানে ওর নিজের মেয়ে হলে এই বিয়ে হতো না। মালিকের মেয়ের সঙ্গে বর্গাদারের ছেলের বিয়ে হয় না। হতে পারে না। মেয়ে যদি বর্গাদারের ছেলের প্রেমে পড়ে ঘর ছেড়ে পালিয়ে যেত তাহলেও ও মেয়েকে ধরে এনে দু’টুকরো করে কেটে নদীতে ভাসিয়ে দিত। এখন ও রাহানুমকে বিদায় করতে চাইছে। ওর জীবনে রাহালুমের প্রয়োজন ফুরিয়েছে। তাই ও অনায়াসে জবেদ আলীর বাপকে বলে দিতে পেরেছে যে রাহানুম ওর কোনো সম্পত্তি পাবে না। এসব নিয়ে বাপ-ছেলেতে যেন কোনো চিন্তাভাবনা না করে।

শুনে জবেদ আলী মুচকি হেসেছে। তারস্বরে বলেছে, মোর সম্পত্তি লাগবে না। মুই সম্পত্তি দি হরমু কী? আর নিচুস্বরে বলেছে, মুই। রাহানুমের ছাড়া বাঁচুম না।

শুনে আবুল হাশেম মনে মনে হেসেছে। যৌবনে ও মণিমালাকে বলেছিল, তোমারে ছাড়া মুই বাঁচুম না।

এখন ওর কাছে মণিমালার স্মৃতি ঝাপসা।

শৈশবের সুখদীপকে কোলে নিয়ে দোলাতে দোলাতে রাহানুম বলত, বাবো এই পোলাডারে ছাড়া মুই বাচুম না।

সুখদীপ ছিল রাহামের সুখের প্রদীপ। এখন? সব কেমন উল্টে গেল। তাহলে তিনজনের এই একত্রে বসবাস কি মিথ্যে? এখন তো ওরা একে অপরকে ছাড়া বাঁচতে চাইছে। এই বাঁচাকে সত্য করে তুলতে চাইছে। তাহলে এই এত বছরের দিনগুলোর কী হবে? নদীর মতো বয়ে যাওয়া দিন।

নদীর ধারে দাঁড়িয়ে শূন্য চরের ওপর দিয়ে তাকালে দূরের গাছপালা দেখা যায়–মাঠের পরে মাঠ, ছোট ছোট বাড়ি। আবুল হাশেম একটুক্ষণ পায়চারি করে। চমৎকার একটি কাচপোক ওর মাথার চারপাশে ঘঘারে। তারপর উড়ে গিয়ে নলখাগড়ার মাথার ওপর গিয়ে বসে–আবার উড়ে আসে। পোকাটি এক ধরনের শব্দ করে, সেই শব্দ অনুসরণ করে আবুল হাশেম নিজের দিকে তাকায়, দেখতে পায় এই নতুন চরের পলিমাটিতে ও ছাড়া আর কেউ নেই। এই নদী, কাচপোকা এবং ওর মধ্যে সখ্য স্থাপিত হয়েছে। এই তিনজনকে নিয়ে সংসার নয়। এই তিনজন একে অপরের পরিপূরক। পরস্পরের নির্ভরতা মাত্র, যেমন নির্ভরতা ছিল ওদের তিনজনের সংসারে। সেই সংসারে এখন ভাঙন, প্রবল ভাঙন, কারণ সেখানে নতুনের প্রবেশ ঘটেছে। তাই তছনছ হয়ে গেছে আশা, ভেসে যাচ্ছে সব, সব। কে ঠেকাবে? কেউ তো নেই। কেউ না।

একটু পর পর নৌকা বোঝাই বাঁশ, গোলপাতা ইত্যাদি নিয়ে জবেদ আলী এবং ওর বাপ আসে। ওরা আজ ঘর তুলবে। প্রথমেই দখল দেবে, তারপর অন্যদের সঙ্গে মারামারি-লাঠালাঠি ইত্যাদি। রক্ত ঝরবে এবং মৃত্যু ঘটবে, অবধারিত সত্য। এ অভিজ্ঞতা আবুল হাশেমের জীবনের।

কারণ ও জীবনের এইসব ঘটনার বাইরে নয়। বাইরে থাকতেও চায় না।

জবেদ আলীদের সঙ্গে আরো দুজন কামলা এসেছে। ওরা ঝটপট বঁশ পোঁতার কাজে লেগে গেছে। কোনোরকমে বাঁশ পুঁতে চারদিকে বেড়া দিয়ে ওপরে পাতার ছাউনি দিয়ে দিলেই হয়ে যায়। এটা দখলের প্রথম শর্ত।

কাচপোকা উড়ে এসে আবুল হাশেমের ঘাড়ে বসে। ঘাড়ে কাচপোকা নিয়ে ও দেখতে থাকে যে কেমন করে নতুন ঘর ওঠে–তারপরও ওর চোখের সামনে থেকে ছবি মুছে যায় না, দেখতেই থাকে ঘর ওঠার পরের দৃশ্যগুলো–ঘরের পাশে কতগুলো কলাগাছ লাগানো হয়, রসুই ঘরের পাশে চেঁকি বসে, সেই ঘরে প্রবেশ করে একজোড়া দম্পতি, হাঁড়িকুড়ি কেনা হয়, চুলো বসে, আগুন জ্বলে, ভাত খাওয়া হয়, দিন ফুরোয়, রাত নামে, ভাত খেয়ে ঘুমুতে যায় দম্পতি, আবার ভোর হয়। মাঠে যায় একজন–মাটি চষে, ধান বোনে। ঘরে থাকে একজন–ধান ভানে, আঙিনা নিকোয়। ঝকঝকে তকতকে ঘরদোর। বাতাসে লুঙ্গি শুকায়, শাড়ির আঁচল ওড়ে। কবুতর ঘর বাঁধে, শালিক উড়ে বেড়ায়–পেঁচা ডাকে রাতের বেলা। ফকফকে জ্যোৎস্নায় ধুয়ে যায় গাছ, ঘর, মানুষ, মানুষ, মানুষ। আবার ভোর হয়। কাকা-ডাকা ভোর।

এইসব ভাবনার মাঝে জবেদ আলীর বাপ ওর কাছে এসে দাঁড়ালে কাচপোকা উড়ে যায়। লোকটির মুখে পাতলা দাড়ি। গায়ে তালিমারা পাঞ্জাবি, ও ভূমিহীন কৃষক, কাঁধে গামছা রাখে এবং ঘন ঘন কপালের ঘাম মোছে। খুব নিচুস্বরে বিনীত ভঙ্গিতে বলে, মহাজন বিয়ার সময় পোলাডারে কিছু দিবেন না?

যৌতুক?

হা-হা করে হেসে ওঠে আবুল হাশেম।

না, না যৌতুক না। মোর কি যৌতুক চাওয়ার সাহস অয়? না চাওয়া উচিত? আমনহের যা মনে লয়? বাপেতো মাইয়ারে আশীর্বাদ করে।

মাইয়া?

আবুল হাশেম হা-হা করে হেসে ওঠে। জবেদ আলীর বাপের মুখ কালো হয়ে যায়, খানিকটা অপমানিতও বোধ করে। তবু মরিয়া হয়ে বলে, মাইয়া না তো কী? বাপতো ডাকছে।

বাপ ডাকলেই মাইয়া অয়?

না, অয় না। আমনেহতো বাপ ডাকতে মানাও করেন নাই। মাইয়াডা বাপ ডাকছিল–

থাক, বেশি কথা কওন ভালো না।

আবুল হাশেম জবেদ আলীর বাপকে ধমক দেয়। তারপর ওর চোখের ওপর চোখ রেখে রূঢ় কণ্ঠে বলে, চর জাগছে, অহন মোর মেলা খরচ। মুই কিছু করবার পারুম না। পোলারে বিয়া করাইলে করাইবা, না। করাইলে নাই। ভাইবা দেহে, যা ইচ্ছা।

জবেদ আলীর বাপ একদম চুপসে যায়। ভেতরে ভেতরে ক্রোধ হলেও সেটা সে প্রকাশ করতে পারে না। প্রকাশ করার সাহস না করাই উচিত বলে মনে করে। ভেতরে ভেতরে ফুসতে থাকে। নিজেকে দমিয়ে রাখার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে, কিন্তু পারে না। কাচপোকাটা আবার কাছাকাছি উড়ে এলে ও হাত বাড়িয়ে খপ করে ধরে ফেলে। তারপর পায়ের নিচে পিষে মারে।

আবুল হাশেম তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে ঠাণ্ডা গলায় বলে, কামডা ঠিক করলা না।

মহাজন নতুন চর যদি আমনহের অয়, তাইলে পোকাড়া মোর। মোগ বিত্ত নাই, কিন্তু বনজঙ্গল-পোকামাকড় তো আছে। মুই যদি পোকাডারে পিষাই মারতে চাই, তাহলে হেইডা মুই মারি। আপনে না। কইবেন ক্যা?

আবুল হাশেম হাঁ করে লোকটির মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। প্রচণ্ডভাবে বিস্মিত হয়। লোকটি বলে কী? বর্গাচাষীর দাপট তো কম নয়? ও কি ছেলের বিয়ের কথা পাকাপাকির পর নিজেকে আবুল হাশেমের সমকক্ষ ভাবছে? ছেলের ব্যর্থ হিসেবে নিজেকে আবুল হাশেমের ওপরে স্থান দিচ্ছে। সেজন্যই কি’রাহানুমকে ওর মেয়ে বানানোর জন্য এত চাপাচাপি? হ্যাঁ এই হবে। আবুল হাশেম সিদ্ধান্তে এসে যায়।

জবেদ আলীর বাপ পোকা মেরে নদীর দিকে খানিকটা নেমে গেছে। ও এখন হাঁটু পানিতে দাঁড়িয়ে। লুঙ্গি হাঁটু পর্যন্ত ওঠানো। ওর সরু পা পানিতে ড়ুবে আছে। ও আঁজলা ভরে পানি তুলে মুখে ছিটায়। ও কি প্রমাণ করছে যে নদীতে ওর প্রবল অধিকার? মানুষের সঙ্গে না পেরে ও প্রকৃতিকে নিজের দখলে রাখতে চাইছে। জবেদ আলীর বাপ এভাবে আবুল হাশেমকে উপেক্ষা করছে। আবুল হাশেম বুড়ো আঙুল উঁচিয়ে বলে, কচু। জবেদ আলীর বাপ তো দেখতে পায় না। ওর পিঠ আবুল হাশেমের দিকে ফেরানো।

আবুল হাশেম নদীর পাড়ে দাঁড়িয়েই থাকে, নদীতে নামে না। ওর। জলের স্পর্শের প্রয়োজন নেই। কারণ ওর শরীরে রাগ নেই। ওর শরীর। রাগে টলছে না। হাঁটু পানিতে দাঁড়িয়েই জবেদ আলীর বাপ গামছা দিয়ে। ঘাড় গলা মুছে নেয়। তারপর উঠে আসে নদী থেকে। আবুল হাশেমের দিকে তাকায় না। আবুল হাশেম এতক্ষণে মজা পেতে শুরু করেছে। লোকটি ছেলের বাপ–ওর আচরণে তা বুঝিয়ে দিচ্ছে এবং হনহনিয়ে হেঁটে পুবদিকে খানিকদুর চলে যায়। আবুল হাশেম ধরে নেয় বেশিক্ষণ লোকটি এই রাগ ধরে রাখতে পারবে না, একটু পরই শান্ত হয়ে যাবে। শান্ত ওকে হতেই হবে। কারণ আবুল হাশেম জমির মালিক। লোকটির এখানে কোনো কাজ নেই, ও দেখতে এসেছে কেবল এবং একই সঙ্গে আবুল হাশেমের কাছ থেকে কিছু আদায় করার ধান্দাও।

আবুল হাশেম লোকটির দিকে তাকিয়ে থাকে। ওর হেঁটে যাওয়া দেখে, ঘন ঘন গামছা নাড়তে দেখে। লোকটি ছিপছিপে লম্বা, দূর থেকে ওকে আরো চিকন দেখায়, খুব ছোট একগোছা পাটকাঠির মতো। ও আবুল হাশেমকে মহাজন বলল কেন? আবুল হাশেম কি মহাজন? না, ঠিক তা নয়।

নদীর ভাঙনে তলিয়ে যাওয়ার আগে ওর কিছু জমি ছিল। তারপরতো সেগুলো নদী গ্রাস করল। এখন ওর তেমন কিছু নেই। শুধু ভিটে এবং সামান্য কিছু ধানি জমি। এতে ঠিকমতো হয় না বলে মৌসুমের বাইরের সময়টায় আবুল হাশেম মাছ ধরতে সাগরে যায়। ও নিজে জেলে, ওর ওপর একজন মহাজন আছে। আসলে জবেদ আলীর বাপ ওকে খুশি করার জন্য মহাজন বলেছে। মহাজনই যদি মানবে তবে এমন কঠিন করে কথা বলত না আবুল হাশেম দীর্ঘশ্বাস ফেলে। মানুষ নিজের ইচ্ছার পূরণ দেখতে না পেলে রুষ্ট হয়, ক্ষিপ্ত হয়, তারপর দূরে দাঁড়িয়ে নিজের চিন্তাগুলো সংহত করার চেষ্টা করে।

তখন আবুল হাশেম পায়ের নিচে পিষ্ট হওয়া কাচপোকাটাকে দেখে। পোকাটার শরীর চকচক করছে, পাখনা খুলে পড়ে আছে অথচ জৌলুস তখনো কমেনি। ওর ইচ্ছে করে পোকাটাকে হাতে উঠিয়ে মুঠোর মধ্যে ধরে রাখতে। পরক্ষণে দু’পা পিছিয়ে যায়। যে জিনিসটি জবেদ আলীর বাপের পায়ের নিচে যায়, সেটা আবুল হাশেম হাতে ওঠায় না। ও নদীর পাড়ে পায়চারি শুরু করে।

দেখতে দেখতে ছোট ঘরটির চারদিকে বেড়া দাঁড়িয়ে যায়। দ্রুত কাজ করে ওরা। জবেদ আলীর উৎসাহ অন্তহীন। ও এক মুহূর্তও জিরোবার জন্য দাঁড়ায় না। ও রোদ উপেক্ষা করছে, পরিশ্রম উপেক্ষা করছে, দরদরিয়ে ঘাম ঝরছে তাও উপেক্ষা করছে। ও যেন একটা মৌমাছি–ব্যস্ত, ভীষণ ব্যস্ত আপন সঞ্চয়ের জন্য। রোদে ওর মাথাটা কেমন ঝিমঝিম করে। চারদিকে একটা গাছ নেই, কোথাও কোনো ছায়া নেই। ছায়া না থাকা যে কি ভীষণ ভয়াবহ আবুল হাশেম তা মর্মে মর্মে টের পায়। বুকের ভেতর এক অদ্ভুত তাড়না–কিসের ও তা বুঝতে পারে না। তখন ওর খুব খারাপ লাগতে থাকে।

একটু পর জবেদ আলীর বাপ আবার ওর কাছে আসে। হাঁটাতে বিনম ভঙ্গি। খানিকক্ষণ আগের লোকটি সে আর নয়। বিনীতভাবে বলে, মহাজন লন বাড়িত যাই। আমনহের মুখটা রোদে পুইড়া গেইলো।

আবুল হাশেম মৃদু হাসে। লোকটির বিনীত ভঙ্গি দেখে ওর ওপর আবুল হাশেমের আর কোনো রাগ নেই।

লোকটি আবার মৃদু স্বরে বলে, এই রোদে আমনহের কষ্ট অয় মহাজন। লন যাই। দুপুরের ভাত খাঅনের বেলা অইছে।

আবুল হাশেম পুলকিত বোধ করে। বলে, তুমি মোরে মহাজন কও ক্যা?

মহাজনরেতো মহাজনই কওন লাগে। মুই কি করুম? মোগ তো এক কুড়াও জমি নাই। আমনহেরতো আছে। অহনতো আবার চর জাগছে। আমনহেরে আর পায় কে। লন, নৌকায় যাই মহাজন।

নৌকায়? সাগরে মাছ ধরতে গেলে তো মোর রইদ লাগে না। রইদে মোর মুখও পড়ে না।

লোকটি হি-হি করে হেসে উঠে বলে, তহনতো আমনহে মহাজন থাহেন না। তহন আমনহে মহাজনের নৌকায় মাছ ধরেন। আমনহে তহন জাইল্যা। মাছ মারার কামলা।

লোকটি হাসতেই থাকে। খানিকক্ষণ আগে লোকটি রেগে গিয়েছিল, এখন ও হাসছে। কিছুক্ষণ আগে ওর শরীরে আগুন ছিল, তাই ও দ্রুত নেমে গিয়েছিল নদীতে। এখন ওর শরীর নদী, ও আর নদী চায় না। ও কণ্ঠের বিদ্রুপে তাতিয়ে দিচ্ছে আবুল হাশেমকে, আবুল হাশেমের এখন জলের স্পর্শ প্রয়োজন। আবুল হাশেম ওকে কিছু না বলে হাসার সময় দেয়। ও লোকটির দিকে কঠিন চোখেও তাকায় না। বরং কৌতুক বোধ করে। ঠোঁটের ওপর সূক্ষ্ম হাসির রেখা জাগিয়ে রেখে ও লোকটির দিকে তাকিয়ে থাকে। আবুল হাশেমের কোনো প্রতিক্রিয়া না পেয়ে একসময় লোকটির হাসি থেমে যায়। ও দ্রুত কণ্ঠে বলে, লন মহাজন যাই।

আবুল হাশেম মৃদু হেসে বলে, মহাজন মুই না তুমি?

লোকটি না শোনার ভান করে। লাফিয়ে নৌকায় ওঠে। আবুল হাশেম মাঝখানে বসে। জবেদ আলীর বাপ মাঝির বিপরীত দিকের গলুইয়ে চলে যায়। ওর মাথায় সাদা টুপি, ক্রুশে বোনা টুপি, হয়তো ওর বউ কিংবা মেয়ের তৈরি। সবুজ লুঙ্গি পরেছে লোকটা, নিচের দিকের খানিকটা অংশ ফাটা। ছোটবেলা থেকে মাঠে কাজ করতে করতে পায়ের আকার নষ্ট হয়ে গেছে। আঙুলগুলো ফাঁক ফাঁক। লোকটার মুখে অসংখ্য কুঞ্চন। চোখ বসে গেছে। বয়স কত বোঝা যায় না। লোকটা হাঁটুর ওপর দু’হাত জড়ো করে বসে আছে। ওর ভঙ্গিটা দেখে আবুল হাশেমের হাসি পায়, ও আচমকা হা-হা করে হেসে ওঠে। চমকে ওঠে জবেদ আলীর বাপ, বোকার মতো আবুল হাশেমের দিকে তাকায়। ভুরুজোড়া কপালের ওপর তোলা, কিন্তু কোনো প্রশ্ন করে না।

ওর হাসি থেমে গেলে মাঝি জিজ্ঞেস করে, মহাজন হাসেন ক্যা?

এউক্কা কতা মনে অইলো।

জবাব শুনে জবেদ আলীর বাপের ভুরু স্বাভাবিক জায়গায় ফিরে আসে, যেন কোনো কারণে আশ্বস্ত হয়েছে, এমন একটা ভাব। আবুল হাশেম দূরের দিকে তাকিয়ে থাকে। ফাতরার চরের গাছগুলো কালচে সবুজ হয়ে বেড়ে উঠেছে, দূর থেকে ঘন জঙ্গলের মতো দেখায়, মনে হয় আকাশের নিচে সবুজ পাথরের দেয়াল। ডানে অনেকদূরে বঙ্গোপসাগরের বিস্তার। কেবলই দিশপাশহীন পানি। যে পানি আবুল হাশেমের ধ্বংস, যে পানির সঙ্গে ওর সখ্য।

সাগরের দিকে তাকালে আবুল হাশেমের বুকের ছাতি প্রসারিত হয়। ঘৃণা এবং ভালোবাসা দুটোই প্রবল হয়। কারণ সাগরের সঙ্গে ওর শত্রু ও বন্ধুর সম্পর্ক।

জোয়ার আসছে। জোয়ারের বিপরীত যেতে হচ্ছে বলে নৌকার দুলুনি বেড়ে যায়। আবুল হাশেম শক্ত হয়ে বসে। নিজের অজান্তেই শরীর কেমন সতর্ক হয়ে যায়। সামনেই নদীর এক অদ্ভুত সমান্তরাল আছে–মিঠে পানি এবং নোনা পানির সমান্তরাল। নদীর এ এক আশ্চর্য মিলন। এ জায়গার ঢেউয়ে উথাল-পাথাল বেশি। তবু এ জায়গায় এলে আবুল হাশেমের মনে হাজার রকম দার্শনিক চিন্তা আসে। এই সমান্তরালকে ও জীবনের নানাক্ষেত্রে মিলনের সঙ্গে এক করে দেখতে ভালোবাসে। ওর মনে হয় এভাবেই মানুষ ও প্রকৃতি এক হয়। এইসব ভাবনা নিয়ে ও দূরের দিকে তাকিয়ে থাকে।

জবেদ আলীর বাপও শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। গতকাল টাকা ধার করে আবুল হাশেমের জন্য একটা ইলিশ মাছ কিনেছিল। তার কয়েক টুকরো আছে আজ দুপুরের জন্য–বউ বলে দিয়েছে সন্ধ্যায় হাটে যেতে হবে। হাটে যাওয়ার ইচ্ছে ওর নেই, কারণ পকেটে পয়সাও নেই। তাই দুপুরে খাইয়ে-দাইয়ে আবুল হাশেমকে বিদায় করার জন্য ও ব্যস্ত হয়ে উঠেছে। লোকটিকে ও আর সহ্য করতে পারছে না। অথচ ওর সঙ্গে ভালো ব্যবহার করতে হচ্ছে–নিজের সঙ্গে নিজের যুদ্ধ আর কি? নিজের ছেলের ওপর রাগ বাড়তে থাকে জবেদ আলীর বাপের। কী একটা মেয়েকে দেখে এসে বিয়ে করার জন্য পাগল হয়ে উঠেছে। অন্য জায়গায় বিয়ে করলে বেশ কিছু জিনিসপত্ৰতো ঘরে আসত। এই বিয়ে মানে ডডকলা–বউছাড়া বাকিটা শূন্য। রাগে, বিরক্তিতে জবেদ আলীর। বাপের ভুরু আবার কপালে ওঠে। সাদা টুপি কপালে এঁটে আছে–টুপির ফুটোর ফাঁকে চুল বেরিয়ে খাড়া হয়ে আছে। ও নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য টুপিটা একবার খোলে এবং আবার পরে। ওর হাত নিশপিশ করে, ও একটা কিছু করতে চায়, নাগালের মধ্যে পানি ছাড়া কিছু নেই, ফলে ও বসে হাতটা নদীতে ড়ুবিয়ে দিয়ে পানি নাড়াচাড়া করে। তারপর ভেজা হাতটা মুখে বুলিয়ে নেয়। ওর এইসব দেখে আবুল হাশেমের হাসি পায় এবং আচমকা হা-হা করে হেসে ওঠে।

এবার আর জবেদ আলীর বাপের ভুরু কপালে ওঠে না। সরাসরি প্রশ্ন করে, হাসেন ক্যা মহাজন?

তোমার রাগ দেইক্যা হাসি।

মুই গরিব মানু। মোর আর রাগ কী?

বেড়া মানু রাগ করলে মনের জোর বাড়ে।

গরিবের ঠ্যাংয়ে জোর নাই, কোমরেও জোর নাই। কেবল মনের জোর দিয়া কি প্যাডের খিদা পুরে? যারা প্যাডের খিদা পুরাইতে পারে না হেরা কি বেড়া মানু? হেরা গলে মাইয়া মানু। মুই বেড়া মানু না। মহাজন।

কি কইলা?

হাছা কতাই কইছি। মুই ক্যাবল শাড়ি পিন্দি না। তফাৎ এই। মুই আর মোর বউ হমান। হেওতে ধান ভাইনা দুইডা টাকা কামাই করতে পারে। হাটে যাওনের সময় নিজের খুতি ভাইঙা টাহা দেয়। মুই সওদা আনি। হে ভাত রানধলে মোরা খাই। মোগ খিদা মিডে।

জবেদ আলীর বাপ কথাগুলো বলে ঈষৎ হাসে। এখন ওকে একজন পীরের মতো দেখাচ্ছে। আবুল হাশেম যেন ওর মুরিদ। কতকাল ধরে এই দরগায় পড়ে আছে ও। অথচ এই লোকটিকে এত কাছে থেকে আগে এমন করে দেখা হয়নি। আবুল হাশেম মনে মনে চমকে ওঠে। জবেদ আলীর বাপের হাসিতে ব্যঙ্গ না দুঃখ তা আবুল হাশেম বুঝতে পারে না।

একটু আগে আবুল হাশেম ওকে বিদ্রুপ করে দু’বার হেসেছে। এখন মনে হচ্ছে ও বেকুবের মতো হেসেছে। এই অর্থহীন হাসি হাসার জন্য আবুল হাশেম লজ্জিত হয়।

জবেদ আলীর বাপ মুখে হাসি রেখেই বলে, কিছু কইলেন না যে মহাজন?

থামো, বেশি বক বক কইরো না।

ও নিজেকে সামলে নিয়ে ধমক দেয়। কিন্তু দেখতে পায় জবেদ আলীর বাপের ঠোঁট থেকে হাসি মুছে যায় না। লোকটি আবার উদাস হয়ে নদীর দিকে তাকিয়ে থাকে। এগিয়ে আসছে গ্রাম। নৌকা খালে ঢুকেছে। ওর বাড়ির সীমানা দেখা যাচ্ছে।

ওর বাড়ি যত এগিয়ে আসে ততই শরমে মরে যায় আবুল হাশেম। নৌকা থেকে লাফ দিয়ে নামতে গিয়ে ওর একটা পা কাদায় পড়ে। স্পঞ্জের স্যান্ডেলটা ঢুকে থাকে কাদার মধ্যে। হা-হা করে ওঠে জবেদ আলীর বাপ। মাঝিকে কষে ধমক দেয়, হারামজাদা চোহে দেহ না? কাদার মধ্যে নৌকা গুলি ক্যা?

আর কোনহানে থুমু? জাগাতো নাই। অহন ভাটি না?

মাঝি গজগজ করে।

মহাজন চোহে দেইক্যা লাফ দেবে না?

হইছে, হইছে থাম তোরা।

আবুল হাশেমের রাগে শরীর কাঁপে। কিন্তু কিছু করার নেই। জবেদ আলীর বাপ কাদার মধ্যে থেকে ওর স্পটা টেনে বের করেছে।

খালের পানিতে পা ধুয়ে জুবেদ আলীর বাপের উঠোনে এসে দাঁড়াবার পরও ওর মনে হয় ও শরমে মরে যাচ্ছে। খিদেয় মাথা চক্কোর দিচ্ছে, তবু ওর খাবার কথা চিন্তা করতে ভালো লাগে না। একটু পর খাবার আয়োজন হয়। জবেদ আলীর মা রান্না ভালো করে। কিন্তু ঠিকমতো খেতে পারে না আবুল হাশেম, যেন কোনোকিছু ঠিকমতো গলা দিয়ে নামতে চায় না। ও ভাত নিয়ে নাড়াচাড়া করে। জবেদ আলীর বাপ দু’টুকরো ইলিশ উঠিয়ে দিতে গেলে বাম হাত দিয়ে বাধা দেয়।

দিও না, খাইতে ভাল্লাগে না।

রান্দা ভালো অয় নাই?

অইছে। মোর জিহ্বায় স্বাদ নাই।

বাড়ির লাইগ্যা মন পোড়ে?

ক্যা? পুড়বো ক্যা? বাড়িতে কেডা আছে?

মাইয়া।

আবুল হাশেম জবাব দেয় না। জবেদ আলীর বাপের মাইয়া শব্দটি শানে কেবল। জবেদ আলীর বাপ বিভিন্ন চেষ্টায় আবুল হাশেমের মনে মাইয়া শব্দটি প্রতিষ্ঠিত করতে চায়। ওর মনে মতলব কাজ করে। তাই আবুল হাশেম উপেক্ষা করে–উপেক্ষা করে বোঝাতে চায় যে গায়ের জোরে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয় না। তার জন্য খুব গভীর ভিত লাগে। রাহানুম এবং সুখদীপের সঙ্গে আবুল হাশেমের সম্পর্ক ছুটে গেছে। ও কাচের বাসনের ধারে মুখ লাগিয়ে ফুডৎ করে ডাল টানে। কিন্তু জবেদ আলীর বাপের দিকে তাকাতে পারে না। কিছুতেই ওর গ্লানি কাটে না।

হাত ধোয়ার সঙ্গে সঙ্গে পান এসে যায়। পানের খিলি মুখে পুরে আর দেরি করে না আবুল হাশেম। এখন না বেরুলে সন্ধ্যার আগে পৌছুতে পারবে না। এই মন খারাপের মধ্যে খুব আকস্মিকভাবে বাড়ির জন্য একটা টান ওঠে। একটু আগেও জবেদ আলীর বাপের প্রশ্নের উত্তরে ও বাড়ির কথা অস্বীকার করেছিল।

মহাজন, কতা তো পাকা?

হ। কতা পাকা। ছামনের মঙ্গলবার। তোমরা কয়জন আবা?

ধরেন চাইর-পাঁচজন আমু।

আচ্ছা, ঠিক আছে।

দরজার পাশ থেকে জবেদ আলীর মা কথা বলে, আবারো আইবেন মহাজন।

দেহি।

আবুল হাশেম পা বাড়ায়। ও পশ্চিম দিকে যাচ্ছে। সূর্য ঠিক ওর মুখের ওপর। খাড়া রোদ মাথা তাতিয়ে দেয়। দ্রুত পায়ে হাঁটে ও ঘাটে নৌকা তৈরি।
সন্ধ্যার আগেই নিজের গ্রামে পৌঁছে যায় ও। আলীপুর বাজার থেকে তিন মাইলের পথ। আগের মতো হাঁটতে পারে না। বুকে হাঁফ ধরে। নইলে ও অনেক আগেই পৌঁছে যেত, তখনো হালকা আলো চারদিকে ছড়িয়ে। রাহানুম বাড়ির বাইরের রেন্ডি গাছের নিচে দাঁড়িয়ে, কিছুটা বিষণ্ণ এবং উদাস। আবুল হাশেম ওকে দূরে থেকে চিনতে পারে না। ভাবে অন্য কোনো নারী। কাছাকাছি আসতেই রাহানুম চেঁচিয়ে ওঠে, ও বাবো।

কি অইছে?

আবুল হাশেম গাছের ছায়ায় এসে দাঁড়ায়, তখনো বুকের হাফ ছাড়েনি, শরীরে ঘাম, যেন গা পুড়ে যাচ্ছে এবং মনে গ্লানি। এতদিনে আবুল হাশেম বোঝে যে গ্লানি কাটিয়ে ওঠা কঠিন কাজ। বাবো সুখদীপ কুয়োকাটা গোনে চইল্যা গেছে।

কোম্মো?

ঢাকা।

ক্যামনে গেছে?

এক বেডা আর মাতারি আইলো বেড়াইতে। হেরা হেগো কামের মানু বানাইয়া লইয়া গেছে। সুখদীপ হেগো হামনে কান্দাকাটি করছে। কইছে মুই এতিম। মোরে আমনহেগো লগে লইয়া যান।

তোর ধারে কইয়া গেছে?

না। মোরে মনির আইয়া খবর কইছে।

মোগ কথা কিছু কয় নাই।

না। ঢাকায় যাইতে পাইরা ও খুব খুশি। কইছে আর কনুদিন ও ফিরা আইবে না।

সেয়ানা পোলা।

ও খুব দুখু পাইছে, না বাবো।

পাইছে মনে অয়।

হঠাৎ করে রাহানুম ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে।

ও মোগ ভুইল্যা গেল ক্যামনে?

তখন আবুল হাশেম আজকের দিনের তৃতীয়বারের মতো আচমকা হাসি হেসে ওঠে। হা-হা হাসতেই থাকে। নিমেষে স্তব্ধ হয়ে যায় রাহানুমের কান্না, বিস্ফারিত চোখে শুকিয়ে থাকে আবুল হাশেমের দিকে। আবুল হাশেমের হাসি থামার পরও ও কেন হাসল এই প্রশ্ন করতে পারে না। আবুল হাশেম ঘরের দিকে পা বাড়াতে গিয়েও ফিরে। দাঁড়ায়। বলে, মোরাই তো ভুইল্যা গিয়া ওরে এতিম বানাইয়া দিলাম। হেইলে ও ভুলবে না ক্যা? ‘

কন দোষ কি মোগ?

ও যা হরছে ভালই হরছে। মোগ আর দুকুখ কি? মোরা তো ওরে তাড়াইতেই চাইলাম। ঠিক না মাগো?

রাহানুম আচমকা প্রশ্ন করে, বাবো আমনহে কি মোরেও তাড়াইতে চান?

মুই চামু ক্যা? তুমিতো যাইতে চাইল্যা মাগো? কতো সব পাকা অইছে।

বলতে বলতে আবুল হাশেম ঘরে চলে যায়। রাহানুম নড়তে পারে। আবুল হাশেম তো ঠিকই বলেছে। মিথ্যে নয়। তবু রূঢ় কথা শুনতে খারাপ লাগে। কোনো কিছু খারাপ লাগলে মাথাটা ঝিম মেরে যায়। তবু ও জোর করে শক্তি সঞ্চয় করে এবং সব ঝেটিয়ে নিজের হৃদয়ের দিকে তাকায়, সত্যিইতো ও তো চেয়েছিল সুখদীপের কাছ থেকে মুক্তি। সুখদীপ নিজের পথ বেছে নিয়ে চলে গেছে। ওকে বলে কয়ে বিদায় নেয়নি। তাতে কি এসে যায়? ও কেন এটা ভেবে আহত হচ্ছে? ছেলেটাকে আঘাত করার আগে ও তো সুখদীপ কতটা আঘাত পাবে তা একবারও ভাবেনি।

সন্ধ্যা হয়েছে। মাথার ওপরের গাছটায় পাখিগুলো তারস্বরে চেঁচামেচি করছে। ঘর তো আশ্রয়, তবে ওরা চেঁচায় কেন এমন? আনন্দেই? নিশ্চয়ই আনন্দের কলরব। এই ঘরের আকাঙ্ক্ষাইতো ওর মধ্যে দীপ্র হয়ে উঠেছে। ও আরো কিছুক্ষণ গাছের নিচে দাঁড়িয়ে থেকে করব শোনে, নিজের হৃদয় মেলে দেয়, ভরুক, এই শব্দে ভরে যাক ওর হৃদয়, যেন নিতে না হয় অনেক দূরের পাড়ি, আর কোনো অপেক্ষা নয়। রাহানুম দু’পা এগিয়ে আবার ফিরে আসে।

অন্ধকার গাঢ় হচ্ছে, আকাশে মেঘ এবং চাঁদ, পূর্ণিমার শেষ। সামনের ধানক্ষেত, মেঠো রাস্তা, দূরের বাড়ি সবটাই জবেদ আলীর বুক। এবং পিঠের মতো। মনে হয় ওই রাস্তা ধরে এগিয়ে আসছে একজন মানুষ, তেল চপচপে চুলগুলো উল্টিয়ে আঁচড়ানো, সিথি নেই। গায়ে নীল রঙের জামা, পরনে সবুজ লুঙ্গি, লোকটার বুকে পাখিদের কলরব। রাহানুম দেখতে পায় কলরব বিস্তৃত হচ্ছে, প্রথমে ধানক্ষেতে। কলরবে ধানক্ষেতের মাথা কাঁপছে, কাপুনি মাদকতাময় শিহরণের জন্য, ওখানে লুকিয়ে আছে জবেদ আলী, এই অন্ধকারের মতো কালো শরীর, অনেকটা পোড়া কাঠের মতো। এরপর কলরব বিস্তৃত হয়ে মেঠো রাস্তায়, কলরবের তুমুল উদ্দামে মাটি চৌচির, গুঁড়িয়ে যায়, ধুলোতে ভরে যায়। পথ, লাল ধুলো ঢেকে ফেলে চারদিক, কোথাও কোনো মানুষ নেই, কিছুই দেখা যায় না, শুধু জবেদ আলী ভেসে থাকে ধুলোর ওপর, ওর সঙ্গে আকাশের মিতালী।

এরপর কলরব বিস্তৃত হয় গাছে, গাছের পাতার শিরা-উপশিরায় ধ্বনি, প্রবল ধ্বনি গর্জে ওঠে শাখায়, বাকলে, পত্রের রঙে, কোথাও কোনো নিঃশব্দ-নির্জন জায়গা নেই, ওই ধ্বনি একজনের কণ্ঠস্বর, সে মানুষ জবেদ আলী–একমাত্র মানুষ, যার কণ্ঠস্বর রাহালুমের অন্তর পর্যন্ত পৌঁছায়।

কলরব আরো বিস্তৃত হয় ঘরবাড়িতে, যে বাড়িগুলোতে মানুষেরা বসে আছে, প্রবল কলরব বুকে চেপে বসে আছে, ওরা অপেক্ষা করছে একটি আহ্বানের জন্য–সে আহ্বান জবেদ আলীর। ও ওদের ডেকে বলবে, আমি বউ নিয়ে এসেছি, তোমরা ওকে বরণ করো।

সঙ্গে সঙ্গে সব মানুষের হৃদয়ের অর্গল খুলে যাবে, ওরা গান গেয়ে উঠবে, নতুন কুলোয় ধান-দুর্বো, সুপোরি রেখে ওকে বরণ করবে।

গুরুজনের আশীর্বাদে ভরে যাবে ওর সৌভাগ্য। দুকান ভরে কলরব শুনতে শুনতে নিমগ্ন হয়ে যায় রাহানুম।

আবুল হাশেম বারান্দা থেকে তীক্ষঋরে ওকে ডাকে, ও শুনতে পায় না। ওর কানে তো একটাই কণ্ঠস্বর, সেটা ভেঙে ভেঙে শত হয়–সমবেত কণ্ঠ ওর মঙ্গলধ্বনি উচ্চারণ করছে। রাহানুম এতক্ষণে নিজেই এক থেকে বহুর মধ্যে বিস্তৃত হয়। বিস্তার সাগরের মতো বাড়ে।

আবুল হাশেম দ্বিতীয়বার আরো উচ্চকণ্ঠে ওকে ডাকে। ও শুনতে পায় না। এখনতো অন্যকিছু শোনার সময় নয়, এখনো তো কারো আহ্বানে সাড়া দেবার সময় নয়। ও নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত।

তখন আবুল হাশেম দ্রুত পায়ে এসে ক্রোধে ফেটে পড়ে। রাহানুম কোথায় থাকতে পারে অন্ধকারে তা অনুমান করে নেয়। চিৎকারে কণ্ঠে আলো প্রস্ফুটিত হয়, সে আলোয় রাহানুম দেখতে পায় আবুল হাশেমকে, সাদা ধবধবে চুল, দাড়ি, খালি গা, বুকের পশমও সাদা, সাদা লুঙ্গি পরে আছে, বাহাতুরে বুড়ো।

কতকুন ধইরা বোলাই কানে হোনো না?

ক্যা, বোলান ক্যা?

রাহানুম চড়াও হওয়ার চেষ্টা করে অনেকক্ষণ ধরে ডাকছে, সেটা মুখ্য নয়। একজন মানুষ আর একজনকে হাজারবার ডাকতে পারে। কিন্তু কেন ডাকবে? আবুল হাশেম কেম ওর নিজস্ব সময় নষ্ট করবে? ওরওতো কিছু ভাবনা থাকতে পারে, যেখানে ও কোনো গোলযোগ চায় না। ওরওতো কিছু একান্ত সময় দরকার, যেটা শুধু ওর একলার, আর কারো নয়, যেখানে ও কোনো ঝামেলা ঢুকতে দিতে চায় না। ও আবুল হাশেমকে উপেক্ষা করে নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে চায়।

আবুল হাশেম চেঁচিয়ে কড়া কণ্ঠে বলে, ঘরে ল। মায়ামানের আন্দারে গাছের তলায় থাহা ভালা না।

মোর গাছের তলায় থাকতে ভালা লাগে। কত পক্ষী বোলে।

ঘরে ল।

আবুল হাশেমের কণ্ঠে প্রচণ্ড ধমক, যেন রাহালুমের সামনে এক বিস্ফোরণ। ওর দাঁত কিড়মিড় করে ওঠে। কোনোদিন আবুল হাশেম ওর সঙ্গে এমন ধমক দিয়ে কথা বলেনি। পরক্ষণে মনে হয় ও নিজেও আবুল হাশেমের সঙ্গে এমন আচরণ করেনি। কত দ্রুত এবং কত অল্প সময়ে সংসারটা ওলটপালট হয়ে গেল। রাহানুম যে আচরণের সঙ্গে এতদিন পরিচিত ছিল না, আজ সে আচরণের শুরু। এখন ও ধমকের পরেও নড়ে না।

কি, গেলি না?

মুই যামু না। আমনহে যান।

আবুল হাশেমের রাগ পড়ে যায়, অসহায় বোধ করে। আবার ওর মধ্যে পরাজয়ের গ্লানি মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। আজ দুপুরে ও জবেদ আলীর বাপের কাছে পরাজিত হয়েছে। এখন রাহানুম। ভাবতেই ওর শরীর শিউরে ওঠে। নড়তে পারে না, অন্ধকারে ওর হাঁটু কাঁপে। কণ্ঠস্বর ভেঙে যায়, মুখ থুবড়ে পড়তে পড়তে আবুল হাশেম এক বিপন্ন মানুষের কণ্ঠস্বরে বলে, মোর খিদা লাগছে মাগো?

এতক্ষণে রাহানুম নরম হয়। এই আবেদনের পর আর নিজেকে কঠিন রাখা সম্ভব নয়। ও নিজেও কোমল কণ্ঠে বলে, লন, ঘরে লন।

ও আবুল হাশেমকে পেছনে রেখে এগিয়ে যায়। গাছের নিচে রেখে আসে ওর ঘর-গেরস্তির স্বপ্ন। অজস্র জোনাকি সেই স্বপ্ন ঘিরে জ্বলতে থাকে। ঝিঁঝির ডাকও প্রবল হয়। আলো এবং ধ্বনি দিয়ে গড়ে ওঠে মানুষ। রাহানুম এখন তেমন মানুষ। ওর জীবনে জোনাকি এবং ঝিঁঝির ডাকও প্রবল হয়। আলো এবং ধ্বনির আবিষ্কার মানুষের জন্য, আলো এবং ধ্বনি দিয়ে গড়ে ওঠে মানুষ। রাহানুম এখন তেমন মানুষ। ওর জীবনে জোনাকি এবং ঝিঁঝি আলো ও ধ্বনি ছড়ায়। এবং এইসব অনুষঙ্গে জীবন ভরে উঠেছে বলেও শুধু পূর্ণিমা নয়, ঘোর অমাবস্যাও। চায়। অমাবস্যার অন্ধকারে হেঁটে যেতে ওর ভয় নেই।

কৃষ্ণপক্ষে ওর বিয়ে হয়। জবেদ আলীর বাপ চার-পাঁচজন লোক নিয়ে এসেছে। ছোট আয়োজন। নতুন শাড়ি, ব্লাউজ, পেটিকোট এনেছে। স্নাে, পাউডার, ফিতা-ক্লিপও দিয়েছে জবেদ আলী। আবুল হাশেম জবেদ আলীকে লুঙ্গি, গেঞ্জি, পাঞ্জাবি কিনে দিয়েছে। পুকুর থেকে বড়ো মাছ ওঠানো হয়েছে, মুরগি জবাই হয়েছে, পোলাও রান্না হয়েছে। রাহানুম ভোররাতে উঠে এসব রান্নার আয়োজন করেছে। বরপক্ষ আসার আগেই সব কাজ শেষ। পাশের বাড়ির করম আলীর বউ ওকে সাহায্য করেছে। এত কাজ তবু কোনো ক্লান্তি নেই ওর। বরং মনে হয়। অন্যদিনের চেয়ে তাড়াতাড়িই হয়েছে। সময় যেন উড়তে উড়তে চলে যাচ্ছে। সময়ের হাতে আজকের দিনটি একটি বড়ো লাল ঘুড়ি, নাটাইয়ে সুতো ছেড়ে দিয়েছে, সে সুতোর কোনো শেষ নেই।

কাজ শেষে পুকুর থেকে গোসল করে আসার পর ভীষণ সতেজ লাগে নিজেকে, মনে হয় দিনটি যদি লাল ঘুড়ি হয়, তবে নাটাইয়ের সুতো। এখন ওর হাতে। ও ইচ্ছে করলে যা খুশি তা করতে পারে। জবেদ আলীর পাঠানো নতুন কাপড়ের ভাঁজ খুললে সে গন্ধ ওকে মোহিত করে। সে শাড়ি পরার পর ওর আরো ঝকমকে অবস্থা। সোনালি জরির পাড়ের টকটকে লাল রঙের শাড়ি, সঙ্গে হলুদ রঙের ছিটের ব্লাউজ। বারবার আয়নায় মুখ দেখে ও। নিজের মুখই নিজের কাছে দারুণ মায়াময় মনে হয়। স্নাে মাখলে ত্বকের উজ্জ্বলতা বাড়ে, কাজলে টানটান হয়ে যায় চোখ জোড়া। আহ কী সুন্দর, কী সুন্দর। অভিভূত হয় রাহানুম। কতকাল, ও ভুলে গেছে কতকাল আগে ও এমন করে সেজেছিল। ছোট আয়নায় নিজেকে বারবার দেখে ওর আশ মেটে না। মনে হয় ও কি নিজেই একটি লাল ঘুড়ি?

মৌলবি সাহেব এসেছে। বিয়ে পড়ানো হবে। রাহানুম চৌকির ওপর ঘোমটা দিয়ে বসে আছে। বুকের ভেতর থরথর কাঁপুনি, কেমন অস্থির লাগে, কিছুই ভাবতে পারে না–শুধু বুকের ভেতর একটি শব্দ কবুল, কবুল। এছাড়া ওর কাছে আর কোনো ধ্বনি নেই, আর কোনো অনুভব নেই–মুছে যাচ্ছে পরিপার্শ্ব।

খাওয়া-দাওয়া শেষ হতে দুপুর গড়িয়ে যায়। বিকেলে চলে যায় জবেদ আলীর বাপ ও অন্যরা। আজ রাতে আবুল হাশেমের বাড়িতে জবেদ আলী ও রাহানুমের বাসর। আগামীকাল ভোরে দুজনে চলে যাবে নতুন চরে।

অনেক রাত পর্যন্ত জেগে থাকে আবুল হাশেম। কিছুতেই ঘুম আসে না। ওরা ঘরের ঝপ বন্ধ করেছে অনেকক্ষণ। কোথাও কোনো সাড়াশব্দ নেই। কুপিটা নিভিয়ে দিয়েছে ও। চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। বুকের ভেতর ভার-ভার লাগে। সাজানো গোছানো এই কয় বছরের জীবনে বেশ বড়ো পরিবর্তন হয়ে গেল। এই পরিবর্তনের ক্রান্তির সময়টুকু বুকে। বাজছে। আগামীকাল থেকে ও একা হয়ে যাবে, ওর পাশে কেউ থাকবে না। অমাবস্যা ওর ভালো লাগে না। তবু বসে রয়েছে ঘরের বাইরে, কী করবে, কোথায় যাবে? কোথায় স্থিতি? হঠাৎ হঠাৎ অনেক দূর থেকে রাতজাগা পাখির ডাক ভেসে আসে। মনে হয় দূর থেকে কেউ ডাকছে। কে? ডাকটা কি নিজের অন্তরের? ও মনেপ্রাণে তেমন কারো ডাক শুনতে চাইছে যে ওর নিজের ঔরসের কেউ, যার সঙ্গে ওর জন্ম-জন্মান্তরের সম্পর্ক। নতুন করে রাহানুম ওর বর্গাচাষীর বউ। এর বেশিকিছু তো নয়। হায় সম্পর্কের কি বিচিত্র বেড়াজাল! জবেদ আলী এ বাড়িতে আসার আগে ওরা কেউই ভাবেনি এমন একটা অদৃশ্য জলোচ্ছ্বাস প্রবল বেগে বয়ে যাবে ওদের ওপর দিয়ে। এখন থেকে রাহানুম ওর কাছের কেউ নয়। বর্গাচাষী স্বামীর মতো রাহানুম ওকে মহাজন বলবে কি?

আচমকা অন্ধকারে হা-হা করে হেসে ওঠে আবুল হাশেম। অন্ধকারে সে হাসি ধ্বনিতে-প্রতিধ্বনিত হয়। হাসির রেশ ফুরিয়ে গেলে ও একটা বিড়ি ধরায়। বিড়ির আগুন অন্ধকারে একবিন্দু আলো। নাকের ওপর দিয়ে তাকালে চোখ থেকে সে আলোর বিন্দুটি একটি সরলরেখা। আবুল হাশেম এক সময়ে সরলরেখা সরিয়ে দিয়ে একমুখ ধোয়া ছাড়ে। সেটি একটি গোলাকার বৃত্ত হয়। ও দেখতে পায় না। আগুনের সরলরেখা এবং ধোয়ার গোলাকার বৃত্ত নিয়ে ওর স্নায়ু শিথিল হতে থাকে–অর্থাৎ ঘুম পাচ্ছে।

পরদিন রাহানুম চলে গেল। যাবার সময় ভীষণ কান্নাকাটি করল। আবুল হাশেম ওকে নুতন জীবন দিয়েছে এমন কথা বলতে ভুলল না। সালাম করতে গিয়ে পায়ের কাছে বসে পড়েছিল ও। কান্নার দমকে অনেকক্ষণ উঠতে পারেনি। আবুল হাশেম ওর মাথায় হাত রেখে ভেবেছিল যেন নিজের মেয়ের বিদায় দিচ্ছে ও। মুহূর্তে কেমন অবশ লাগে ওর, এই আন্তরিকতাটুকু কি সত্য নয়? সেই থেকে নিজের ভেতরে খটকা থেকে গেছে। অনেক ভাবনাই মেলাতে পারছে না।

এখন শূন্য ঘরবাড়ি। আবুল হাশেম তার দূরসম্পর্কের খালাকে আনিয়েছে কিছুদিনের জন্য। অবশ্য বয়সে আবুল হাশেমের ছোট–নিঃসন্তান বিধবা। কিন্তু বাপের সংসারে তার প্রয়োজন ভীষণ, তাই বেশিদিন থাকতে পারবে না। চুপচাপ থাকে। সাত চড়ে মুখে রা নেই। বাড়িতে আছে কী নেই সেটাও ঝেঝা যায় না। মাঝে মাঝে মহিলার ওপর বিরক্ত হয় আবুল হাশেম। কিন্তু কিছু বলার উপায় নেই, বলা যায় না। আবুল হাশেম ঘরে বউ আনলে এই খালা চলে যাবে।

কেউ কেউ প্রস্তাব করেছিল এই নিঃসন্তান মহিলাকে তার সংসারে রেখে দেবার জন্য। যে কটা দিন বাঁচে সে কটা দিন নিরবিলি কাটিয়ে যাক। ভাইয়ের সংসারে বেচারাকে এই বয়সেও গাধার খাটুনি দিতে হয়। কিন্তু আবুল হাশেম ওদের প্রস্তাবে রাজি হয়নি। ঘরে বউ আনলে অন্য কাউকে এখানে রাখবে না ও। তাতে সংসারে অশান্তি। তাছাড়া অন্যের বোঝা টানার ইচ্ছেও ওর নেই। এখন ঝামেলামুক্ত জীবন চায়–চায় যৌবনের নিরিবিলি গৃহকোণ, যেখানে শুধুই দুজন, স্বপ্ন এবং খুনসুটির দিনরাত। আবুল হাশেম বাড়ির আঙিনা, চারপাশ ঝাড় দিয়ে পরিষ্কার করার জন্য লোক ডাকে, নিজে দাঁড়িয়ে তদারক করে। কোথাও একফোঁটা ময়লা রাখতে চায় না। মুহূর্তে থমকে চায় ওর চিন্তা। তাহলে কি রাহানুম আর সুখদীপ ওর জীবনে আবর্জনা ছিল? যে ময়লা উড়ে গেছে বাতাসের ঝাঁটাতে? ওর চারদিক এখন সাফ-সুতরো–ময়লা নেই কোথাও? আহ না, এমন করে ভাবা উচিত নয়। বড়ো কঠিন ভাবনা–নির্মম ভাবনা। হৃদয় মানে না এমন ভাবনা। ওর কষ্ট হয়। আসলে রাহানুম আর সুখদীপ ওর সুখের স্মৃতি। হাজার হলেও ও মানুষতো–মানুষেরই তো উচিত মানুষকে নিয়ে ভাবনায় থাকা। এতো স্বার্থপর হচ্ছে কেন ও? কেন এতো তাড়াতাড়ি উড়িয়ে দিতে চায় সুখদীপ আর রাহানুমকে? নিজের আচরণের জন্য ওর খুব লজ্জা হয়। প্রচণ্ড গ্লানি অনুভবের কারণে ও মুষড়ে পড়ে। সাফ-সুতরো পরিষ্কার বাড়িঘরের দিকে তাকিয়ে ওর কান্নাই পায়।

দুদিন লাগে ওর নিজেকে শক্ত করে তুলতে। তৃতীয় দিন বিকেলে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে নূরবানুর ভাইয়ের কাছে যায়। প্রথমে বেশ অনেকক্ষণ জীবন-জগৎ সম্পর্কে নিজের ভাবনার কথা বলে, সে চিন্তায় বেশ খানিকটা দার্শনিক চিন্তার প্রতিফলন থাকে। নূরবানুর ভাই মুগ্ধ হয়েই। শোনে। একজন বুড়োকে কিছুটা সম্মান প্রদর্শনের জন্য ও ভেতরে ভেতরে উদ্বুদ্ধ হয়। আবুল হাশেমকে ওর ভালোই রাগে। পরক্ষণে আবুল হাশেমের জন্য ওর মায়া হয়–আহা বেচারা, পুরা সংসার হারিয়ে কেমন একা হয়ে গেছে। রাহালুমের বিয়ে এবং সুখদীপের চলে যাওয়ার খরবতো গায়ের সবাই জানে। আবুল হাশেম এখন একা একা কেমন করে থাকবে, ভাবতেই নূরবানুর ভাই দুরুদ অনুভব করে। মানুষ এভাবেই একজন আর একজনের কাছাকাছি চলে আসে। ভেতর থেকে পানসুপোরি আসে। আবুল হাশেম আয়েশ করে পান খায়, আঙুলের ডগায় চুন তুলে নেয়। পানের বোঁটা দিয়ে নাক চুলকায়। উসখুস করে নূরবানুর ভাই। বুঝতে পারে না একজন বুড়োকে আর কতক্ষণ সম্মান করতে হবে। দুজনে মিলে হাটের দিকে গেলে কেমন হয়? ও তখন ধীরে সুস্থে বলে, যেন কথাটা আবুল হাশেমকে স্মরণ করাচ্ছে এমন ভঙ্গি, আইজতে হাটবার, না? লন, হাটে যাই। মেলা সওদা করা লাগবে।

আবুল হাশেম চমকে তাকায়, সওদা? মোর সওদা লাগবে না।

মোর লাগবে।

আবুল হাশেম ওর ইঙ্গিত বুঝতে পেরে তাড়াতাড়ি বলে, তোমার লগে মোর এটটু কতা আছে গদু মাতবর।

কতা? কি কইবেন? কন।

আবুল হাশেম সরাসরি কিছু বলতে পারে না। অনেক ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ইনিয়ে বিনিয়ে নূরবানুকে বিয়ের কথা বলে। চমকে উঠে গম্ভীর হয়ে যায় নূরবানুর ভাই। আবুল হাশেম এমন একটা প্রস্তাব দিতে পারে তা ও ভাবতেই পারেনি।

নূরবানু ওর একমাত্র বোন। বছর দশেক আগে বিধবা হয়েছে। ছেলেমেয়ে নেই। ওর সংসারে থাকলে নূরবানুকে ও কখনো বোঝা মনে করেনি। বরং নূরবানু ওর সংসারের হাল ধরেছে বলে ওর বউ খানিকটা শান্তিতে আছে। ছেলেমেয়েগুলো তো সব ফুফু বলতে অজ্ঞান, ধানের মৌসুমে ওর স্ত্রীতো নুরবানু ছাড়া অচল। এসবের বাইরেও ওর সংসারে নূরবানুর এক গভীর মমতার স্থান আছে। তাছাড়া নুরবানুর বয়স নেহাৎ কম নয়, এ বয়সে বিয়ে দিলে লোকে কি বলবে?

নূরবানুর ভাই গদু মাতবর, গায়ের কেউকেটা নয়, তবে অবস্থা একদম খারাপও নয়, নিজের মান-সম্মানের ব্যাপারটি চিন্তায় রাখে। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে, আমনহে এইডা কি কইলেন?

ক্যা, খারাপ কত?

এই বয়সে কি আর বিয়া অয়?

অয় না ক্যা? বিয়া বইলেই অয়।

আবুল হাশেম মুচকি হাসে। বলে, আন্ধারমানিক নদীর মধ্যে মোর জায়গাগুলা জাইগ্যা উঠছে। মোর পোলা লাগে। জমির মালিক অইবে।

আমনেহ পাগল অইলেন?

পাগল হমু ক্যা? এইডাই সত্যি কতা। বংশ না থাকলে কী অয়? আমনহে আমনহের বইনেরে জিগাইয়া দেহেন। মুই আজ যাই। কাইল। আবার আমু।

গদু মাতবর হাঁ করে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। কথা বলতে পারে না। আবুল হাশেম সেই মুখের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে, যেন। বলতে চায় এ এক রাজ্যজয়ের খবর। এখন ওর বীরদর্পে হেঁটে যাবার সময়। ও গদ মাতবরের চোখে চোখ ফেলে ভরু উঁচ করে, যেন জিজ্ঞেস করতে চায় অমন করে তাকিয়ে আছ কেন? কিন্তু কথা বলে না, যেহেতু গদু মাতবরের মুখে রা নেই। তাই আবুল হাশেম কথা বলে ওর বিস্ময়ের ঘোর কাটাতে চায় না। ওর সামনে দিয়ে বীরদর্পে হেঁটে যায়–এখন ওর অমন করে হাঁটার সময়–এখন ওর বয়সকে উপেক্ষা করার সময়–কারণ ওর সামনে নতুন বসতির স্বপ্ন। ও এক নতুন দ্বীপে এসে ঠেকেছে–সামনে অনেক কাজ। জঙ্গল কাটতে হবে, মাটি তৈরি করতে হবে, ক্ষেত বানাতে হবে–ফসল বুনতে হবে। খোলা দ্বীপের ওপর দিয়ে ছুটে আসে হা-হা বাতাস–বিশুদ্ধ স্নিগ্ধ বাতাস, বুকভরে টেনে নিয়ে ওর ভেতরটা সাফ-সুতরো হয়ে যায়। কষ্ট নেই, দুঃখ নেই, এখন কেবলই স্বপ্নের সুখ।

নূরবানুর ভাইকে বিয়ের কথা বলতে পেরে ও খুব হালকা বোধ করে। বীরদর্পে হাঁটলে কোথাও অকারণে দাঁড়ানো যায় না—এমন জায়গায় এসে থামতে হয় যেটা নিজস্ব সাম্রাজ্য, যে সাম্রাজ্য দিশপাশহীন। সেজন্য ও আর কোথাও না দাঁড়িয়ে সোজা সৈকতের চরে আসে। এটাইতো জায়গা, যেখানে নিজেকে খুলে ফেলা যায়। ওর এখন দরকার ওর নিজের মুখোমুখি হওয়া–আনন্দ, অপার আনন্দ চারদিকে থৈ-থৈ করছে। নতুন কোনো কিছুর শুরুতে মানুষের ভেতরে যেমন তীব্র উত্তেজনা থাকে আবুল হাশেমের মধ্যে এখন সেই উত্তেজনা। সৈকতে দাঁড়িয়ে ও একবার বনভূমির দিকে তাকায়, একবার সমুদ্রের দিকে। সমুদ্র ওকে প্রেরণা দেয়, বুকের ভেতর আনন্দের গর্জন। বনভূমির দিকে তাকালে মন স্নিগ্ধ হয়ে যায়–সংসারের কোলে নিবিড় শান্তি। আজ আর সোজা পূর্ব বা পশ্চিমে হাঁটে না ও। উত্তর-দক্ষিণে সাগর এবং বনভূমি বরাবর পায়চারি করতে থাকে। শুনতে পায় চারদিকে প্রবল তোলপাড়–কারা ডাকছে আবুল হাশেমকে? মণিমালা কি? না মণিমালার ডাক ও আর শুনবে না। ও আর পেছন দিকে যাবে না। এখন ওর সামনে নূরবানু। কতদিন আগে যেন নূরবানুকে একবার দেখেছিল? এখন আর মনে নেই। নূরবানুর কথা মনে হতেই শরীর শিরশির করে যেন পায়ের নিচ দিয়ে ঢুকে যাচ্ছে বালুকণা বলছে, চলো অন্য কোথাও যাই। প্রতিটি বালুকণা নূরবানুর মুখ সেই ভুরু, নাক, চোখ, ছিপছিপে শরীর–সর্ব অবয়ব। নূরবানুর কথা ভাবলে আবুল হাশেমের পা থেমে যায়, ও দাঁড়িয়ে পড়ে। দেখে মোষের সারি ঘরে ফিরছে–কালো কুচকুচে মোষগুলো প্রকৃতির পটভূমিতে এক একটি বিশাল নক্ষত্র।

পরদিন দুপুরের পর গদু মাতবর ওর বাড়িতে আসে। ওকে দেখে আকস্মিক খুশিতে বিমূঢ় হয়ে যায় আবুল হাশেম। নুরবানুর ভাই তাহলে রাজি হওয়ার প্রস্তাব নিয়ে এসেছে। সুখবরটা বাড়ি বসে পাবে ধারণাই করতে পারেনি। দুপুরের খাওয়াটা একটু বেশি হয়ে গিয়েছিল। চমৎকার রান্না করে ওর খালা, মনে হয় এতদিনকার জীবনযাপনে এ রান্না একদম অন্যরকম। আয়েশ করে গড়িয়ে নিচ্ছিল বিছানায়। খানিকক্ষণের জন্য সামান্য তন্দ্রার মতো হয়। একটা ভালো স্বপ্নও দেখে। মনের এই প্রশান্ত অবস্থায় নূরবানুর ভাই, অর্থাৎ সৌভাগ্য। আবুল হাশেম তাই গদু মাতবরকে দেখে বিমূঢ় ভাবটা কাটিয়ে উঠে বোকার মতো হাসে। তড়িঘড়ি হাতলবিহীন চেয়ারটা এগিয়ে দিয়ে বলে, বয়েন।

বইতে আহি নাই।

নূরবানুর ভাই গম্ভীর–মুখজুড়ে বিরক্তি, দুই ভুরুর মাঝখানে কপালটা কুঁচকে থাকে। সেই থাকার ফলে চোখ ঘোট দেখায়। আবুল হাশেম আনন্দে বিহ্বল হয়ে ওঠার ফলে স্বাভাবিক অবস্থায় ছিল না, গদু মাতবরের তিক্ত চেহারা প্রথমে খেয়াল করেনি। তাই উত্তরটা শুনে ও চমকে ওঠে এবং নিজের কাছে ধাক্কা খায়।

হোনেন হাশেম মিয়া মোর বইনে কইছে আমনহেরে ছামনে পাইলে দাও দিয়া কোপাইয়া কাইড়া ফালাইবো। কইছে, আমনহের এ্যাতো সাহস অইল ক্যামনে যে আমনহে বিয়ার কতা কন?

আবুল হাশেম চোখ গোল করে তাকিয়ে থাকে। মুখ দিয়ে কথা বেরোয় না, যেন নিঃশ্বাসও বন্ধ হয়ে গেছে। গতকাল এই লোকটিকে অনেক বেশি সহানুভূতিশীল, বিনয়ী, ভদ্র মনে হয়েছিল। ওর মুখ দেখে মনে হচ্ছিল ও যেন আবুল হাশেমের একজন খাটি দরদি। আর আজ এখন? গদু মাতবর মাটিতে পা দাপিয়ে বলে, এই কতা আমনহে। গেরামের কারো কাছে কইতে পারবেন না। মোর বইনের য্যান কোনো দুর্নাম না অয়। যেই কতা মুখ দ্যা বাইর করছেন তা আবার গিলা ফেলেন। একদম চুপ, খামোশ!

আবুল হাশেমের মুখের ওপর আঙুল নাড়ায় গদু মাতবর। আবুল হাশেমকে তা সহ্য করতে হয়। গদু মাতবরের ওপর ও ঝাঁপিয়ে পড়তে পারবে না, কারণ গদু মাতবর ওর চেয়ে তাগড়া। তাছাড়া ও নূরবানুর কাছ থেকে শক্তি সঞ্চয় করেছে। সেটাই এখন ওর বড়ো বর্ম। আবুল হাশেম দাঁতমুখ খিচিয়ে রাখা গদু মাতবরের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। দেখতে পায় লোকটির মুখটা আর মুখ নেই–ওটা কাঁকড়া হয়ে আট পায়ে আবুল হাশেমকে রক্তাক্ত করছে।

যা কইলাম মনে থাহে’য্যান। না অইলে ফাটাফাটি অইবো। মোর বইনে কইছে একটা কতা য্যান এইদিক ওইদিক না অয়। অহন যাই।

খাড়াও।

প্রবলভাবে চিৎকার করে ওঠে আবুল হাশেম। এতক্ষণে ও নিজের ভেতর আত্মস্থ হতে পেরেছে। তর্জনী তুলে কঠিন স্বরে বলে, হোনো, তোমার বইন ছাড়া গেরামে আর মাইয়া নাই? মুই বিয়া করমু। অহন ঠিক করলাম কুমারী মাইয়া বিয়া করমু, মোর বেবাক সম্পত্তি দিলেই মাইয়া পামু। মোরও পোলা অইবো। তোমরা দেইখা লইও।

থুঃ বুড়া হগুন। নিজের বয়সের হিসাব নাই।

ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে আবুল হাশেম। চেঁচিয়ে বলে, কি কইলা? কি কইলা? বেডা মানষের আবার বয়স লাগে নাহি? বেড়া মানুষের জোয়ানি শ্যাষ অয় না। মুই দেহায়ে ছাড়ুম।

কচু। থুঃ।

গদু মাতবর বুড়ো আঙুল দেখাতে দেখাতে চলে যায়। আবুল হাশেম পেছনে দাঁড়িয়ে উচ্চস্বরে চিৎকার করতে থাকে। গদু মাতবর ভ্রুক্ষেপ করে না।

আবুল হাশেম কিছুক্ষণের জন্য আবার স্তব্ধ হয়ে যায়। গদু মাতবর মুন্সির বাড়ির আড়ালে মিলিয়ে গেলে ও আচমকা হা-হা করে হেসে ওঠে। মুহূর্তে উড়িয়ে দেয় এতক্ষণের বাগবিতণ্ডা। নিজের সিদ্ধান্তে অটল হয়ে ওঠে। ও নিজেই নিজের হাসিতে শুনতে পায় সমুদ্রের গর্জন, ও ঠিক করে আগামীকাল ভোরেই মাছ ধরার জন্য বেরিয়ে পড়বে। দিন সাতেক সমুদ্রে থেকে এসে বিয়ের জন্য কনে খুঁজে বের করবে, ওর সমস্ত সম্পত্তি বাজি, তবু কুমারী মেয়ে চাই এবং সন্তান।

আবুল হাশেম হাঁটতে হাঁটতে সৈকতে আসে। ট্রলার ঠিকঠাক করে মহাজনের বাড়ি যাবে জাল গোছাতে এবং অন্য সঙ্গীদের খবর দিতে। জোয়ারে ট্রলার দুলছে। ও লাফিয়ে ট্রলারে উঠে পা ঝুলিয়ে বসে। ছোটবেলায় গাছে দড়ি বেঁধে যেমন দোলনায় দুলত, তেমন আমেজ ওকে আচ্ছন্ন করে রাখে। ও গুনগুনিয়ে ছড়া কাটে। চোখ বন্ধ করে, চোখ খুলে রাখে। পানিতে পা ভেজায় আবার পা উঠিয়ে নেয়। ছড়ার লাইন ভুলে গিয়ে মুখে গুনগুন শব্দ করে, যেন ও একটা থেকে আর একটা অবলম্বনে লাফিয়ে লাফিয়ে চলে যায়। একসময়ে ও জোয়ারের হাঁটুজলে পা ড়ুবিয়ে। ছেলেবেলার মতো হেঁটে হেঁটে পাড়ের দিকে এগুতে থাকে। সূর্য পাটে গেছে, আর কিছুক্ষণের মধ্যে আলো নিভবে।

তখন ও দেখতে পায় পুবদিক থেকে দৌড়তে দৌড়তে একটি লোক আসছে। অচেনা না চেনা মানুষ, তা দূর থেকে ঠাহর করতে পারে না, শুধু ভঙ্গিমা চেনা চেনা লাগে মনে হয়, যেন পরিচিত কেউ। ও কে? কেন দৌড়চ্ছে? হয়তো ভিন গাঁয়ের কেউ। কারো জন্য সুখবর আনছে, নাকি দুঃসংবাদ? আবুল হাশেম আবার ট্রলারের কাছে ফিরে যায়, মনে হয় একটা ভয়ানক অবলম্বন চাই। অবলম্বনহীন দাঁড়িয়ে থাকলে ও জোয়ারের তোড়ে ভেসে তলিয়ে যাবে। লোকটি কাছাকাছি চলে এসেছে। এখন ওকে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে, অস্পষ্ট অবয়ব আর নেই, একজন জোয়ান তাগড়া লোক। লুঙ্গি মালকোচা মেরে পরা, হয়তো দৌড়নোর সুবিধার জন্য। গায়ে গেঞ্জি, লোকটি বড়ো বড়ো পা ফেলছে, খুব দ্রুত ওর দিকেই আসছে। তবু লোকটি কে সে সম্পর্কে নিশ্চিত হতে আবুল হাশেমের আরো কিছুক্ষণ সময় লাগে। কাছে এলে ও চিনতে পারে, গফুর, জবেদ আলীর চাচাতো ভাই।

গফুর ওকে এখানে পাবে আশা করেনি, তাই দেখেই চেঁচিয়ে ওঠে, মহাজন।

তারপর জোয়ারের জল উপেক্ষা করে দৌড়ে ট্রলারের কাছে আসে। মহাজন সব্বোনাশ। সব্বোনাশ?

লোকটি হাঁফাতে থাকে। কথা বলতে পারে না। ওর দম নেওয়া প্রয়োজন–ওর বুক ঘন ঘন ওঠানামা করছে। পেট পিঠের সঙ্গে লেগে আছে, রোদে পোড়া গায়ের চামড়া, গলার চারপাশে ঘাম শুকিয়ে সাদা হয়ে আছে। লোকটি ট্রলারের সামনের দিকটা ধরে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে নিজেকে সামলাচ্ছে। একসময় ওর নিঃশ্বাস পড়া শান্ত হয়। এতক্ষণ আবুল হাশেম একটি প্রশ্নও না করে, ওকে দম নেবার সুযোগ দিয়েছে। নিজের আচরণে নিজেই অবাক হয়। কিভাবে এত সহিষ্ণু হলো? দুপুরের ঘটনার পর ও কি ধৈর্য ধরতে শিখে গেল? এই ধৈর্য ধরার অর্জন মানুষের জন্য কখনো কখনো ভীষণ জরুরি, যখন মানুষের চারদিকে সর্বনাশের শুকনো পাতা ওড়ে। তাই সর্বনাশ শব্দটি শোনার পর থেকে ওর ধৈর্য আরো বেড়ে যায়। ও একমনে গফুর মিয়ার হাঁফ-ধরা বুকের ওঠানামা দেখে।

গফুর মিয়া খানিকটা ধাতস্থ হলে আবুল হাশেম বলে, খবর ক দেহি।

কাইলকা নুরু মোল্লা নতুন চর দুখল কইরা নিছে। রাইতে জবেদ ভাইর ঘরে আগুন দেছে। ভাই-ভাবি পুড়া মরছে। এক্কেরে অঙ্গার হয়া গেছে মহাজন।

গফুর ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে।

আবুল হাশেম নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকে। অঙ্গার? অঙ্গার কি? অঙ্গার কেমন? মানুষ কেমন করে অঙ্গার হয়? অঙ্গার হলে কেমন দেখায়?

তখনো কেঁদে যাচ্ছে গফুর।

আবুল হাশেমের মনে হয় ও কিছুই দেখতে পাচ্ছে না। সামনে থেকে গফুর যায়। জেগে থাকে কান্নার শব্দ, যেন পৃথিবীতে ধ্বনি ছাড়া আর কিছু থাকতে নেই। কেবল ধ্বনিই পারে বিস্তৃত হতে। অল্পক্ষণে আবুল হাশেমের করোটিতে সে শব্দ পরিব্যাপ্ত হয় এবং ওর আর কিছুই মনে পড়ে না। ও নড়তে পারে না, হেঁটে কোথাও চলে যেতে পারে না। ওর পুরো অবয়ব যেন ট্রলারের সঙ্গে মিশে গেছে। ও পাটাতনের ওপর চিৎ হয়ে শুয়ে থাকে।

দেখে আকাশের সীমানা থেকে দিগন্তরেখার কাছাকাছি দুজন মানুষ অঙ্গার হয়ে ঝুলে আছে–এতক্ষণে ও বুঝতে পারে অঙ্গার কি, অঙ্গার কেমন। রাহামের জন্য ওর চোখ জলে পরিপূর্ণ হয়ে যায়। সে জল গাল বেয়ে গড়ালে ও বুঝতে পারে যে নতুন চরটি হাতছাড়া হয়ে গেল–ওটা দখল করা ওর কোনোদিন হয়ে উঠবে না, কারণ ওর সেই লোকবল নেই, অর্থবলও নেই।

তখন ও গফুরের দিকে তাকায়। ওর কান্না থেমে গেছে। চোখও মোছে না। শান্ত হয়ে ট্রলারের ওপর মাথা এলিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। যেন কিছু ভাবছে, কিছু সমাধানের কথা। কিংবা নতুন করে শুরু করার জন্য কিছু। নয়তো আবুল হাশেম থেকে কিছু শোনার অপেক্ষায় ধৈর্য ধরে আছে।

আবুল হাশেম উৎকণ্ঠিত গফুরকে বলে, তুই বাড়ি যা গফুর। মুই একটু পর আমু।

জোয়ারের জলে ছপছপ শব্দ করতে করতে চলে যায় গফুর।

সন্ধ্যা হলে গোল চাঁদ ওঠে, বিশাল চাদ সমুদ্রের তরঙ্গে নাচে–সৈকতে বিছিয়ে থাকে পূর্ণিমার আলো। গফুরের কান্না থেমে গেছে, এখন আর শব্দ নেই কিন্তু শব্দ আছে আবুল হাশেমের করোটিতে। ও ট্যাক থেকে বিড়ি বের করে। চিৎ হয়ে শুয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে ও বিড়ির ধোঁয়া ছাড়ে। বিড়ির মাথায় একবিন্দু আগুন জ্বলজ্বল করে। নাকের ওপর দিয়ে বরাবর তাকালে সে অণ্ডনের একটা সরলরেখা তৈরি হয়। ও জানে। ওই একবিন্দুই স্বপ্ন–স্বপ্ন ছাড়া মানুষের বেঁচে থাকা কঠিন। তখন ওই সরলরেখার মাথায় একটি রঙিন মাছ ভেসে ওঠে।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত