প্রথম দৃশ্য
রাজপথ
ছাতা মাথায় এক পথিকের প্রবেশ, পিঠে লাঠির আগায় লোট-বাঁধা পুঁটলি, উস্কোখুস্কো চুল, শ্রান্ত চেহারা
পথিক । নাঃ ‒ একটু জল না পেলে আর চলছে না। সেই সকাল থেকে হেঁটে আসছি, এখনও প্রায় এক ঘণ্টার পথ বাকি। তেষ্টায় মগজের ঘিলু শুকিয়ে উঠল। কিন্তু জল চাই কার কাছে? গেরস্তের বাড়ি দুপুর রোদে দরজা এঁটে সব ঘুম দিচ্ছে, ডাকলে সাড়া দেয় না। বেশি চেঁচাতে গেলে হয়তো লোকজন নিয়ে তেড়ে আসবে। পথেও ত লোকজন দেখছিনে।‒ ঐ একজন আসছে! ওকেই জিজ্ঞেস করা যাক।
পথিক । মশাই, একটু জল পাই কোথায় বলতে পারেন?
ঝুড়িওয়ালা। জলপাই? জলপাই এখন কোথায় পাবেন? এ ত জলপাইয়ের সময় নয়। কাঁচা আম নিতে চান দিতে পারি‒
পথিক । না না, আমি তা বলিনি‒
ঝুড়িওয়ালা । না, কাঁচা আম আপনি বলেননি, কিন্তু জলপাই চাচ্ছিলেন কিনা, তা ত আর এখন পাওয়া যাবে না, তাই বলছিলুম‒
পথিক । না হে আমি জলপাই চাচ্ছিনে‒
ঝুড়িওয়ালা । চাচ্ছেন না ত ‘কোথায় পাব’ ‘কোথায় পাব’ কচ্ছেন কেন? খামকা এরকম করবার মানে কি?
পথিক । আপনি ভুল বুঝেছেন‒ আমি জল চাচ্ছিলাম‒
ঝুড়িওয়ালা । জল চাচ্ছেন তো ‘জল’ বললেই হয়‒ ‘জলপাই’ বলবার দরকার কি? জল আর জলপাই কি এক হল? আলু আর আলুবোখরা কি সমান? মাছও যা মাছরাঙাও তাই? বরকে কি আপনি বরকন্দাজ বলেন? চাল কিনতে এসে চালতার খোঁজ করেন?
পথিক । ঘাট হয়েছে মশাই। আপনার সঙ্গে কথা বলাই আমার অন্যায় হয়েছে।
ঝুড়িওয়ালা । অন্যায় তো হয়েছেই। দেখছেন ঝুড়ি নিয়ে যাচ্ছি‒ তবে জলই বা চাচ্ছেন কেন? ঝুড়িতে করে কি জল নেয়? লোকের সঙ্গে কথা কইতে গেলে একটু বিবেচনা করে বলতে হয়।
ঝুড়িওয়ালার প্রস্থান
পথিক । দেখলে! কি কথায় কি বানিয়ে ফেললে! যাক, ঐ বুড়ো আসছে, ওকে একবার বলে দেখি।
লাঠি হাতে, চটি পায়ে চাদর গায়ে এক বৃদ্ধের প্রবেশ
বৃদ্ধ । কে ও? গোপলা নাকি?
পথিক । আজ্ঞে না, আমি পুবগাঁয়ের লোক‒ একটু জলের খোঁজ কচ্ছিলুম‒
বৃদ্ধ । বল কিহে? পুবগাঁও ছেড়ে এখেনে এয়েছ জলের খোঁজ করতে? ‒ হাঃ, হাঃ, হাঃ। তা, যাই বল বাপু, অমন জল কিন্তু কোথাও পাবে না। খাসা জল, তোফা জল, চমৎকা-র-র জল।
পথিক । আজ্ঞে হাঁ, সেই সকাল থেকে হাঁটতে হাঁটতে বেজায় তেষ্টা পেয়ে গেছে।
বৃদ্ধ । তা তো পাবেই। ভালো জল যদি হয়, তা দেখলে তেষ্টা পায়, নাম করলে তেষ্টা পায়, ভাবতে গেলে তেষ্টা পায়। তেমন তেমন জাল ত খাওনি কখনো! – বলি ঘুম্ড়ির জল খেয়েছো কোনোদিন?
পথিক । আজ্ঞে না, তা খাইনি-
বৃদ্ধ । খাওনি? অ্যাঃ! ঘুম্ড়ি হচ্ছে আমার মামাবাড়ি‒ আদত জলের জায়গা। সেখানকার যে জল, সে কি বলব তোমায়? কত জল খেলাম‒ কলের জল, নদীর জল, ঝরণার জল, পুকুরের জল‒ কিন্তু মামাবাড়ির কুয়োর যে জল, অমনটি আর কোথাও খেলাম না। ঠিক যেন চিনির পানা, ঠিক যেন কেওড়া-দেওয়া সরবৎ!
পথিক । তা মশাই আপনার জল আপনি মাথায় করে রাখুন‒ আপাতত এখন এই তেষ্টার সময়, যা হয় একটু জল আমার গলায় পড়লেই চলবে‒
বৃদ্ধ । তাহলে বাপু তোমার গাঁয়ে বসে জল খেলেই ত পারতে? পাঁচ ক্রোশ পথ হেঁটে জল খেতে আসবার দরকার কি ছিল? ‘যা হয় একটা হলেই হল’ ও আবার কি রকম কথা? আর অমন তচ্ছিল্য করে বলবারই বা দরকার কি? আমাদের জল পছন্দ না হয়, খেও না- বাস্। গায়ে পড়ে নিন্দে করবার দরকার কি? আমি ওরকম ভালোবাসিনে। হ্যাঃ-
রাগে গজগজ করিতে করিতে বৃদ্ধের প্রস্থান
পাশের এক বাড়ির জানলা খুলিয়া আর এক বৃদ্ধের হসিমুখ বাহির করণ
বৃদ্ধ । কি হে? এত তর্কাতর্কি কিসের?
পথিক । আজ্ঞে না, তর্ক নয়। আমি জল চাইছিলুম, তা উনি সে কথা কানেই নেন না- কেবলই সাত পাঁচ গপ্প করতে লেগেছেন। তাই বলতে গেলুম ত রেগে মেগে অস্থির!
বৃদ্ধ । আরে দূর দূর! তুমিও যেমন! জিজ্ঞেস করবার আর লোক পাওনি? ও হতভাগা জানেই বা কি, আর বলবেই বা কি? ওর যে দাদা আছে, খালিপুরে চাকরি করে, সেটা ত একটা গাধা। ও মুখ্যুটা কি বললে তোমায়?
পথিক । কি জানি মশাই- জলের কথা বলতেই কুয়োর জাল, নদীর জাল, পুকুরের জল, কলের জল, মামাবাড়ির জল, ব’লে পাঁচ রকম ফর্দ শুনিয়ে দিলে-
বৃদ্ধ । হুঁঃ ‒ ভাবলে খুব বাহাদুরি করেছি। তোমায় বোকা মতন দেখে খুব চাল চেলে নিয়েছে। ভারি ত ফর্দ করেছেন। আমি লিখে দিতে পারি, ও যদি পাঁচটা জল বলে থাকে তা আমি এক্ষুনি পঁচিশটা বলে দেব-
পথিক । আজ্ঞে হ্যাঁ। কিন্তু আমি বলছিলুম কি একটু খাবার জল‒
বৃদ্ধ । কি বলছ? বিশ্বাস হচ্ছে না? আচ্ছা শুনে যাও। বিষ্টির জল, ডাবের জল, নাকের জল, চোখের জল, জিবের জল, হুঁকোর জল, ফটিক জল, রোদে ঘেমে জ-ল, আহ্লাদে গলে জ‒ল, গায়ের রক্ত জ‒ল, বুঝিয়ে দিলে যেন জ-ল ‒ কটা হয়? গোনোনি বুঝি?
পথিক । না মশাই, গুনিনি‒ আমার আর খেয়ে দেয়ে কাজ নেই‒
বৃদ্ধ । তোমার কাজ না থাকলেও আমাদের কাজ থাকতে পারে ত? যাও, যাও, মেলা বকিও না। ‒একেবারে অপদার্থের একশেষ!
বৃদ্ধের সশব্দে জানলা বন্ধ করণ
পথিক । নাঃ, আর জলটল চেয়ে কাজ নেই‒ এগিয়ে যাই, দেখি কোথাও পুকুরটুকুর পাই কি না।
লম্বা লম্বা চুল, চোখে সোনার চশমা, হাতে খাতা পেন্সিল, পায়ে কটকী জুতা, একটি ছোকরার প্রবেশ
লোকটা নেহাৎ এসে পড়েছে যখন, একটু জিজ্ঞাসাই করে দেখি। মশাই, আমি অনেক দূর থেকে আসছি, এখানে একটু জল মিলবে না কোথাও?
ছোকরা । কি বলছেন? ‘জল’ মিলবে না? খুব মিলবে। একশোবার মিলবে! দাঁড়ান, এক্ষুনি মিলিয়ে দিচ্ছি‒ জল চল তল বল কল ফল ‒ মিলের অভাব কি? কাজল-সজল-উজ্জ্বল জ্বলজ্বল-চঞ্চল চল্ চল্ , আঁখিজল ছল্ছল্ , নদীজল কল্কল্ , হাসি শুনি খল্খল্ অ্যাঁকানল বাঁকানল, আগল ছাগল পাগল‒ কত চান?
পথিক । এ দেখি আরেক পাগল! মশাই, আমি সে রকম মিলবার কথা বলিনি।
ছোকরা । তবে কি রকম মিল চাচ্ছেন বলুন? কি রকম, কোন ছন্দ, সব বলে দিন‒ যেমনটি চাইবেন তেমনটি মিলিয়ে দেব।
পথিক । ভালো বিপদেই পড়া গেল দেখছি‒ (জোরে) মশাই! আর কিছু চাইনে, ‒(আরো জোরে) শুধু একটু জল খেতে চাই!
ছোকরা । ও বুঝেছি। শুধু-একটু-জল-খেতে-চাই। এই ত? আচ্ছা বেশ। এ আর মিলবে না কেন?‒ শুধু একটু জল খেতে চাই ‒ভারি তেষ্টা প্রাণ আই-ঢাই। চাই কিন্তু কোথা গেলে পাই‒বল্ শীঘ্র বল্ নারে ভাই। কেমন? ঠিক মিলেছে তো?
পথিক । আজ্ঞে হ্যাঁ, খুব মিলেছে‒খাসা মিলেছে‒ নমস্কার। (সরিয়া গিয়া) নাঃ, বকে বকে মাথা ধরিয়ে দিলে‒ একটু ছায়ায় বসে মাথাটা ঠাণ্ডা করে নি। [একটা বাড়ির ছায়ায় গিয়া বসিল]
ছোকরা । (খুশী হইয়া লিখিতে লিখিতে) মিলবে না? বলি, মেলাচ্ছে কে? সেবার যখন বিষ্টুদাদা ‘বৈকাল’ কিসের সঙ্গে মিল দেবে খুঁজে পাচ্ছিল না, তখন ‘নৈপাল’ বলে দিয়েছিল কে? নৈপাল কাকে বলে জানেন ত? নেপালের লোক হল নৈপাল। (পথিককে না দেখিয়া) লোকটা গেল কোথায়? দুত্তোরি!
ছোকরার প্রস্থান
নেপথ্যে বাড়ির ভিতরে বালকের পাঠ‒ পৃথিবীর তিন ভাগ জল এক ভাগ স্থল। সমুদ্রের জল লবণাক্ত, অতি বিস্বাদ!
পথিক । ওহে খোকা! একটু এদিকে শুনে যাও তো?
রুক্ষমুর্তি, মাথায় টাক, লম্বা দাড়ি খোকার মামা বাড়ি হইতে বাহির হইলেন
মামা । কে হে? পড়ার সময় ডাকাডাকি করতে এয়েছ?‒ (পথিককে দেখিয়া) ও! আমি মনে করেছিলুম পাড়ার কোন ছোকরা বুঝি। আপনার কি দরকার?
পথিক । আজ্ঞে , জল তেষ্টায় বড় কষ্ট পাচ্ছি‒ তা একটু জলের খবর কেউ বলতে পারলে না।
মামার তাড়াতাড়ি ঘরের দরজা খুলিয়া দেওয়া
মামা । কেউ বলতে পারলে না? আসুন, আসুন। কি খবর চান, কি জানতে চান, বলুন দেখি? সব আমায় জিজ্ঞেস করুন, আমি বলে দিচ্ছি।
পথিককে মামার ঘরের মধ্যে টানিয়া নেওয়া
ঘর নানারকম যন্ত্র, নকশা, রাশি রাশি বই ইত্যাদিতে সজ্জিত
মামা । কি বলছিলেন? জলের কথা জিজ্ঞেস করছিলেন না?
পথিক । আজ্ঞে হ্যাঁ, সেই সকাল থেকে হাঁটতে হাঁটতে আসছি‒
মামা । আ হা হা! কি উৎসাহ! শুনেও সুখ হয়। এ রকম জানবার আকাঙ্খা কজনের আছে, বলুন ত? বসুন! বসুন! (কতকগুলি ছবি, বই আর এক টুকরা খড়ি বাহির করিয়া ) জলের কথা জানতে গেলে প্রথমে জানা দরকার, জল কাকে বলে, জলের কি গুণ‒
পথিক । আজ্ঞে, একটু খাবার জল যদি‒
মামা । আসছে‒ ব্যস্ত হবেন না। একে একে সব কথা আসবে। জল হচ্ছে দুই ভাগ হাইড্রোজেন আর এক ভাগ অক্সিজেন‒
মামা বোর্ডে খড়ি দিয়া লিখিলেন H2 + O = H2O
পথিক । এই মাটি করেছে!
মামা । বুঝলেন? রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় জলকে বিশ্লেষণ করলে হয়‒ হাইড্রোজেন আর অক্সিজেন। আর হাইড্রোজেন আর অক্সিজেনের রাসায়নিক সংযোগ হলেই হল জল! শুনছেন তো?
পথিক । আজ্ঞে হ্যাঁ, সব শুনছি। কিন্তু একটু খাবার জল যদি দেন, তাহলে আরো মন দিয়ে শুনতে পারি।
মামা । বেশ ত! খাবার জলের কথাই নেওয়া যাক না। খাবার জল কাকে বলে? না, যে জল পরিস্কার, স্বাস্থকর, যাতে দুর্গন্ধ নাই, রোগের বীজ নাই‒ কেমন? এই দেখুন এক শিশি জল‒ আহা, ব্যস্ত হবেন না। দেখতে মনে হয় বেশ পরিস্কার, কিন্তু অনুবীক্ষন দিয়ে যদি দেখেন, দেখবেন পোকা সব কিলবিল করছে। কেঁচোর মতো, কৃমির মতো সব পোকা‒ এমনি চোখে দেখা যায় না, কিন্তু অনুবীক্ষন দিয়ে দেখায় ঠিক এত্তো বড় বড়। এই বোতলের মধ্যে দেখুন, ও বাড়ির পুকুরের জল; আমি এইমাত্র পরীক্ষা করে দেখলুম; ওর মধ্যে রোগের বীজ সব গিজ্গিজ্ করছে‒ প্লেগ, টইফয়েড, ওলাউঠা, ঘেয়োজ্বর ‒ও জল খেয়েছেন কি মরেছেন! এই ছবি দেখুন‒ এইগুলো হচ্ছে কলেরার বীজ, এই ডিপথেরিয়া, এই নিউমোনিয়া, ম্যালেরিয়া ‒সব আছে। আর এই সব হচ্ছে জলের পোকা‒ জলের মধ্যে শ্যাওলা ময়লা যা কিছু থাকে ওরা সেইগুলো খায়। আর এই জলটার কি দুর্গন্ধ দেখুন! পচা পুকুরের জল‒ ছেঁকে নিয়েছি, তবু গন্ধ।
পথিক । উঁ হুঁ হুঁ হুঁ! করেন কি মশাই? ওসব জানবার কিচ্ছু দরকার নেই‒
মামা । খুব দরকার আছে। এসব জানতে হয়‒ অত্যন্ত দরকারী কথা!
পথিক । হোক দরকারী‒ আমি জানতে চাইনে, এখন আমার সময় নেই‒
মামা । এই ত জানবার সময়। আর দুদিন বাদে যখন বুড়ো হয়ে মরতে বসবেন, তখন জেনে লাভ কি? জলে কি কি দোষ থাকে, কি করে সে সব ধরতে হয়, কি করে তার শোধন হয়, এসব জানবার মতো কথা নয়? এই যে সব নদীর জল সমুদ্রে যাচ্ছে, সমুদ্রের জল সব বাস্প হয়ে উঠছে, মেঘ হচ্ছে, বৃষ্টি পড়ছে‒ এরকম কেন হয়, কিসে হয়, তাও ত জানা দরকার?
পথিক । দেখুন মশাই! কি করে কথাটা আপনাদের মাথায় ঢোকাব তা ত ভেবে পাইনে। বলি, বারবার করে বলছি‒ তেষ্টায় গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেল, সেটা ত কেউ কানে নিচ্ছেন না দেখি। একটা লোক তেষ্টায় জল-জল করছে তবু জল খেতে পায় না, এরকম কোথাও শুনেছেন?
মামা । শুনেছি বৈকি‒ চোখে দেখেছি। বদ্যিনাথকে কুকুরে কামড়াল, বদ্যিনাথের হল হাইড্রোফোবিয়া‒ যাকে বলে জলাতঙ্ক। আর জল খেতে পারে না‒ যেই জল খেতে যায় অমনি গলায় খিঁচ ধরে যায়। মহা মুশকিল!‒ শেষটায় ওঝা ডেকে, ধুতুরো দিয়ে ওষুধ মেখে খওয়ালো, মন্তর চালিয়ে বিষ ঝাড়ল‒ তারপর সে জল খেয়ে বাঁচল। ওরকম হয়।
পথিক । নাঃ‒ এদের সঙ্গে আর পেরে ওঠা গেল না‒ কেনই বা মরতে এসেছিলাম এখেনে? বলি, মশাই, আপনার এখানে নোংরা জল আর দুর্গন্ধ জল ছাড়া ভালো খাঁটি জল কিছু নেই?
মামা । আছে বৈকি! এই দেখুন না বোতলভরা টাটকা খাঁটি ‘ডিস্টিল ওয়াটার’‒ যাকে বলে ‘পরিশ্রুত জল’।
পথিক । (ব্যস্ত হইয়া) এ জল কি খায়?
মামা । না, ও জল খায় না‒ ওতে স্বাদ নেই‒ একেবারে বোবা জল কিনা, এইমাত্র তৈরি করে আনল‒ এখনো গরম রয়েছে।
পথিকের হতাশ ভাব
তারপর যা বলছিলাম শুনুন‒ এই যে দেখছেন গন্ধওয়ালা নোংরা জল‒ এর মধ্যে দেখুন এই গোলাপী জল ঢেলে দিলুম‒ বাস, গোলাপী রঙ উড়ে শাদা হয়ে গেল। দেখলেন ত?
পথিক । না মশাই, কিচ্ছু দেখিনি‒ কিচ্ছু বুঝতে পারিনি‒ কিচ্ছু মানি না‒ কিচ্ছু বিশ্বাস করি না।
মামা । কি বললেন! আমার কথা বিশ্বাস করেন না?
পথিক । না, করি না। আমি যা চাই, তা যতক্ষণ দেখাতে না পারবেন, ততক্ষণ কিচ্ছু শুনব না, কিচ্ছু বিশ্বাস করব না।
মামা । বটে! কোনটা দেখতে চান একবার বলুন দেখি‒ আমি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছি‒
পথিক । তাহলে দেখান দেখি। শাদা, খাঁটি চমৎকার, ঠাণ্ডা, এক গেলাশ খাবার জল নিয়ে দেখান দেখি। যাতে গন্ধপোকা নেই, কলেরার পোকা নেই, ময়লাটয়লা কিচ্ছু নেই, তা দিয়ে পরীক্ষা করে দেখান দেখি। খুব বড় এক গেলাশ ভর্তি জল নিয়ে আসুন ত।
মামা । এক্ষুনি দেখিয়ে দিচ্ছি‒ ওরে ট্যাঁপা, দৌড়ে আমার কুঁজো থেকে এক গেলাশ জল নিয়ে আয় ত।
পাশের ঘরে দুপদাপ শব্দে খোকার দৌড়
নিয়ে আসুক তারপর দেখিয়ে দিচ্ছি। ঐ জলে কি রকম হয়, আর এই নোংরা জলে কি রকম তফাৎ হয়, সব আমি এক্সপেরিমেন্ট করে দেখিয়ে দিচ্ছি।
জল লইয়া ট্যাঁপার প্রবেশ
রাখ এইখানে রাখ।
জল রাখিবামাত্র পথিকের আক্রমণ‒ মামার হাত হইতে জল কাড়িয়া এক নিঃশ্বাসে চুমুক দিয়া শেষ করা
পথিক । আঃ! বাঁচা গেল!
মামা । (চটিয়া) এটা কি রকম হল মশাই?
পথিক । পরীক্ষা হল‒ এক্সপেরিমেন্ট! এবার আপনি নোংরা জলটা একবার খেয়ে দেখান ত, কি রকম হয়?
মামা । (ভীষণ রাগিয়া) কি বললেন!
পথিক । আচ্ছা থাক, এখন নাই বা খেলেন‒ পরে খবেন এখন। আর এই গাঁয়ের মধ্যে আপনার মতো আনকোরা পাগল আর যতগুলো আছে, সব কটাকে খানিকটা করে খাইয়ে দেবেন। তারপর খাটিয়া তুলবার দরকার হলে আমার খবর দেবেন‒ আমি খুশী হয়ে ছুটে আসব‒ হতভাগা জোচ্চোর কোথাকার!
পথিকের দ্রুত প্রস্থান
পাশের গলিতে কে সুর করিয়া হাঁকিতে লাগিল‒ অবাক জলপান
পাত্রগণ : ভাবুক দাদা । প্রথম ভাবুক । দ্বিতীয় ভাবুক । ভাবুক দল ।
ভাবুকদাদা নিদ্রাবিষ্ট – ছোকরা ভাবুকদলের প্রবেশ
প্রথম ভাবুক । ইকি ভাই লম্বকেশ, দেখছ নাকি ব্যাপারটা? ভাবুকদাদা মূর্ছাগত, মাথায় গুজে র্যাপারটা!দ্বিতীয় ভাবুক । তাই তো বটে! আমি বলি এত কি হয় সহ্য? সকাল বিকাল এমন ধারা ভাবের আতিশয্য!
প্রথম ভাবুক । অবাক কল্লে! ঠিক যেমন শাস্ত্রে আছে উক্ত— ভাবের ঝোঁকে একেবারে বাহ্যজ্ঞান লুপ্ত। সাংঘাতিক এ ভাবের খেলা বুঝতে নারে মূর্খ— ভাবরাজ্যের তত্ত্ব রে ভাই সূক্ষ্মাদপি সূক্ষ্ম!
দ্বিতীয় ভাবুক । ভাবটা যখন গাঢ় হয়- বলে গেছেন ভক্ত, হৃদয়টাকে এঁটে ধরে আঠার মতো শক্ত।
প্রথম ভাবুক । (যখন) ভাবের বেগে জোয়ার লেগে বন্যা আসে তেড়ে, আত্মারূপী সূক্ষ্ম শরীর পালায় দেহ ছেড়ে— (কিন্তু হেথায় যেমন গতিক দেখছি শঙ্কা হচ্ছে খুবই আত্মা পুরুষ গেছেন হয়তো ভাবের স্রোতে ডুবি। যেমন ধারা পড়ছে দেখ গুরু-গুরু নিঃশ্বাস, বেশিক্ষণ বাঁচবে এমন কোরো নাকো বিশ্বাস। কোনখানে হায় ছিঁড়ে গেছে সূক্ষ্ম কোনো স্নায়ু ক্ষণজন্মা পুরুষ কিনা, তাইতে অল্প আয়ু।
ভাবের ভাবনা ভাবতে-ভাবতে ভবের পারে যায় রে
ভাবুক ভবের পারে যায়।
ভবের হাটে ভাবের খেলা, ভাবুক কেন ভোল?
ভাবের জমি চাষ দিয়ে ভাই ভবের পটোল তোল রে
ভাই ভবের পটোল তোল।
শান বাঁধানো মনের ভিটেয় ভাবের ঘুঘু চরে—
ভাবের মাথায় টোক্কা দিলে বাক্য-মানিক ঝরে রে মন
বাক্য-মাণিক ঝরে।
ভাবের ভারে হদ্দ কাবু ভাবুক বলে তায়
ভাব-তাকিয়ায় হেলান দিয়ে ভাবের খাবি খায় রেভাবুক ভাবের খাবি খায়।
কীর্তন ‘জমাট’ হওয়ায় ভাবুকদাদার নিদ্রাচ্যুতিভাবুক দাদা । জুতিয়ে সব সিধে করব, বলে রাখছি পষ্ট— চ্যাঁচামেচি করে ব্যাটা ঘুমটি কল্লি নষ্ট?প্রথম ভাবুক । ঘুম কি হে? সিকি কথা? আবাক কল্লে খুব! ঘুমোওনি তো— ভাবের স্রোতে মেরেছিলে ডুব। ঘুমোয় যত ইতর লোকে— তেলী মুদী চাষা— তুমি আমি ভাবুক মানুষ ভাবের রাজ্যে বাসা।
ভাবুক দাদা । সে ঘুম নয়, সে ঘুম নয়, ভাবের ঝোঁকে টং ভাবের কাজল চোখে দিয়ে দেখছি ভাবের রঙ; মহিষ যেমন পড়ে রে ভাই শুকনো নদীর পাঁকে, ভাবের পাঁকে নাকটি দিয়ে ভাবুক পড়ে থাকে।
প্রথম ভাবুক । তাই তো বটে, মনের নাকে ভাবের তৈল গুঁজি ভাবের ঘোরে ভোঁ হয়ে যাই চক্ষু দুটি বুজি!
দ্বিতীয় ভাবুক । হাঃ হাঃ হা— দাদা তোমার বচনগুলো খাসা, ভাবের চাপে জমাট, আবার হাস্য রসে ঠাসা।
ভাবুক দাদা । ভাবের ঝোঁকে দেখতেছিলেম স্বপ্ন চমৎকার কোমর বেঁধে ভাবুক জগৎ ভবের পগার পার। আকাশ জুড়ে তুফান চলে, বাতাস বহে দমকায়, গাছের পাতা শিহরি কাঁপে, বিজলী ঘন চমকায় মাভৈ রবে ডাকছি সবে খুঁজছি ভাবের রাস্তা (এই) ভণ্ডগুলোর গণ্ডগোলে স্বপ্ন হল ভ্যাস্তা।
প্রথম ভাবুক । যা হবার তা হয়ে গেছে— বলে গেছেন আর্য— গতস্য শোচনা নাস্তি বুদ্ধিমানের কার্য।
দ্বিতীয় ভাবুক । কি আশ্চর্য, ভাবতে গায়ে কাঁটা দিচ্ছে মশায় এমনি করে মহাত্মারা পড়েন ভাবের দশায়!
ভাবুক দাদা । অন্তরে যার মজুত আছে ভাবের খোরাকি— (তার) ভাবের নাচন মরণ বাঁচন বুঝবি তোরা কি?
দ্বিতীয় ভাবুক । পরাবিদ্যা ভাবের নিদ্রা— আর কি প্রমাণ বাকি পায়ের ধুলো দাও তো দাদা মাথায় একটু মাখি!
ভাবুক দাদা । সবুর কর স্থিরোভব, রাখ এখন টিপ্পনী, ভাবের একটা ধাক্কা আসছে, সরে দাঁড়াও এক্ষুনি।
প্রথম ভাবুক । বিনিদ্র চক্ষু, মুখে নাহি অন্ন আক্কেল বুঝি জড়তাপন্ন! স্নানবিহীন যে চেহারা রুক্ষ— এত কি চিন্তা— এত কি দুঃখ?
দ্বিতীয় ভাবুক । সঘন বহিছে নিশ্বাস তপ্ত— মগজে ছুটিছে উদ্দাম রক্ত। দিন নাই রাত নাই— লিখে লিখে হাত ক্ষয়— একেবারে পড়ে গেলে ভাবের পাতকোয়!
ভাবুক দাদা ।
শৃঙ্খল টুটিয়া উন্মাদ চিত্ত
আঁকুপাঁকু ছন্দে করিছে নৃত্য—
নাচে ল্যাগব্যাগ তাণ্ডব তালে
ঝলক জ্যোতি জ্বলিছে ভালে।
জাগ্রত ভাবের শব্দ পিপাসা
শূন্যে শূন্যে খুঁজিছে ভাষা।
সংহত ভাবের ঝংকার মাঝে
বিদ্রোহ ডম্বরু অনাহত বাজে।
দ্বিতীয় ভাবুক । (হ্যাঁ-হ্যাঁ) ঐ শোনো দুড়দাড় মার-মার শব্দ দেবাসুর পশুনর ত্রিভুবন স্তব্ধ।
প্রথম ভাবুক । বাজে শিঙা ডম্বরু শাঁখ জগঝম্প, ঘন মেঘ গর্জন, ঘোর ভূমিকম্প—।
ভাবুক দাদা ।
কিসের তরে দিশেহারা ভাবের ঢেঁকি পাগল পারা
আপনি নাচে নাচে রে!
ছন্দে ওঠে ছন্দে নামে নিত্যধ্বনি চিত্তধামে
গভীর সুরে বাজে রে।
নাচে ঢেঁকি তালে তালে যুগে-যুগে কালে-কালে
বিশ্ব নাচে সাথে রে!
রক্ত-আঁখি নাচে ঢেঁকি, চিত্ত নাচে দেখাদেখি
নৃত্য মাতে মাতে রে!
প্রথম ভাবুক ।
চিন্তা পরাহতা বুদ্ধি বিশুষ্কা
মগজে পড়েছে ভীষণ ফোসকা!
সরিষার ফুল যেন দেখি দুই চক্ষে!
ডুবজলে হাবুডুবু কর দাদা রক্ষে!
দ্বিতীয় ভাবুক । সূক্ষ্ম নিগূঢ় নব ঢেঁকিতত্ত্ব, ভাবিয়া-ভাবিয়া নাহি পাই অর্থ!
ভাবুক দাদা ।
অর্থ! অর্থ তো অনর্থের গোড়া!
ভাবুকের ভাত-মারা সুখ-মোক্ষ-চোরা;
যত সব তালকানা অঘামারা আনাড়ে
‘অর্থ-অর্থ’ করি খুঁজে মরে ভাগাড়ে!
(আরে) অর্থের শেষ কোথা কোথা তার জন্ম
অভিধান ঘাঁটা, সে কি ভাবুকের কম্ম?
অভিধান, ব্যাকরণ, আর ঐ পঞ্জিকা—
ষোল আনা বুজরুকী আগাগোড়া গঞ্জিকা।
মাখন-তোলা দুগ্ধ, আর লবণহীন খাদ্য,
(আর) ভাবশূন্য গবেষণা— একি ভূতের বাপের শ্রাদ্ধ?
ভাবের নামতা
ভাবের পিঠে রস তার উপরে শূন্যি—
ভাবের নামতা পড় মাণিক বাড়বে কত পুন্যি—
(ওরে মানিক মানিক রে নামতা পড় খানিক রে)
ভাব এক্কে ভাব, ভাব দুগুণে ধোঁয়া,
তিন ভাবে ডিসপেপ্শিয়া— ঢেকুর উঠবে চোঁয়া
(ওরে মানিক মানিক রে চুপটি কর খানিক রে)
চার ভাবে চতুর্ভুজ ভাবের গাছে চড়—
পাঁচ ভাবে পঞ্চত্ব পাও গাছের থেকে পড়।
(ওরে মানিক মানিক রে এবার গাছে চড় খানিক রে)
।। যবনিকা ।।