আজিজুন্নেছা লস্কর জানালার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে নদীর পাণে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। বর্ষার এই ভরা মৌসুমে প্রতিদিন এই সময়টায় তিনি উদ্বিগ্নতা নিয়ে তাকিয়ে থাকেন। তার উদ্বিগ্নতা কমে না, বরং বাড়ে।ছেলে-মেয়ে দুটো মিনিট বিশেক হয় স্কুলে যাওয়ার জন্যে বেরিয়েছে। জানালা দিয়ে উজান বেয়ে আসা কোন খেয়া বা বারকি নৌকা দৃষ্টিগোচর না হওয়ায় তিনি মেজো মেয়ে নওরোজকে খেয়াঘাটে পাঠিয়েছেন, দেখে আসার জন্যে।নওরোজ এখনো ফেরেনি।জানালা দিয়ে বৃষ্টির ছাঁট ঘরে ঢুকছে। বৃষ্টির ছাঁট আস্তে আস্তে আজিজুন্নেছা লস্করকে ভিজিয়ে দিলেও সেদিকে তাঁর ভ্রুক্ষেপ নেই। খেয়াঘাটের দিক থেকে ভেসে আসা হৈ-হুল্লোড় ধ্বনির দিকে তিনি কান পেতে আছেন। তাঁর উদ্বিগ্নতা বাড়ছে। নৌকা ডুবে গেল নাকি ? প্রায়ই এ ঘাটে নৌকা ডুবে। এত মানুষ এ সময় নদী পার হয় ! এত মানুষ আসে কোত্থেকে !হৈ-হুল্লোড় ধ্বনি এগোচ্ছে। না, নৌকা ডুবে নি। নৌকা এগোচ্ছে।এপারের খেয়াঘাট দৃষ্টিসীমার আড়ালে হলেও বর্ষার এই ভরাট নদীতে ওপারের ঘাটে পৌছার জন্যে নৌকাগুলো উজান বেয়ে স মিলের কাছে এসে ছেড়ে দেয়। নদীর পাড় থেকে আজিজুন্নেছা লস্করের বাসা প্রায় দেড়শ গজ দূরে হওয়ায় নৌকাতে সহজেই তিনি ছেলে-মেয়েকে সনাক্ত করতে পারেন। তবে সমস্যা হয় ছেলে অভিকে নিয়ে। অভি একেকদিন একেক দিক দিয়ে যায় ।
আজ টেকনিক্যাল ঘাট দিয়ে তো কাল পূর্ব কাজির বাজার ঘাট দিয়ে , পরশু কিন ব্রিজ দিয়ে হেটে স্কুলে যায়। মেয়েটার এই সমস্যা নেই। ওপারে গিয়ে কিছু দূর হেটে জিতু মিয়ার বাড়ির কাছেই গার্লস হাই স্কুল। তাই অন্যঘাট পেরিয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। ইচ্ছেও নেই।প্রায় পাশাপাশি দুটো নৌকা এগিয়ে আসছে। একটু এগিয়ে থাকা নৌকার প্রায় সবাই মেয়ে। সবাই একই স্কুলের। বরইকান্দি-খোজারখলা আর এই টেকনিক্যাল রোডের যে সব মেয়ে মঈনুন্নেছা গার্লসে যায়, তারা সবাই খেয়াঘাটের কাছে আজাদ মিয়ার বাড়ির কাছে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করে । নৌকা এলে তারপর নদী পার হয়ে যায়।নৌকায় অসংখ্য ছাতার ভিড়ে আজিজুন্নেছা লস্কর তাঁর ছোট মেয়ে ডরোথিকে সনাক্ত করতে পারলেন। তাঁর মুখ দিয়ে স্বগতোক্তি বেরিয়ে এল, ‘ওউ নু ডরোথি, ফোল্ডিং ছাতা লইয়া উবাই রইছে। দেখ, ডর-বয় কুনতা আছে নি !’ ফোল্ডিং ছাতা নতুন বের হয়েছে । এদিকটায় এখনো আসেনি। তাঁর বড় মেয়ে নওবাহার ইন্ডিয়া থেকে এই ছাতা কিনে লোক মারফত পাঠিয়েছে । এক নিমিষে ছোট হয়ে যাওয়া বিভিন্ন রংয়ের ছাতা।আজিজুন্নেছা লস্কররা বর্তমান এই সিলেট ভূখন্ডের আদি বাসিন্দা না। সাতচলি্লশের দেশভাগের ফলে সৃষ্ট ঘোরতর মানবিক বিপর্যয়ে নিজ ভূমি-স্বজনহারা শিলচর-হাইলাকান্দির লস্কর-বড় লস্কর-বড় ভূইয়া- মজুমদারদের একাংশ। এই লস্কর-মজুমদাররা কেউ স্বেচ্ছায়, কেউ বিভিন্ন জটিলতায় পড়ে অপশন দিয়ে পাকিস্তানের সঙ্গী হয়।আজিজুন্নেছা লস্করের উদ্বিগ্নতা যায় না। অভিটা আজ কোন দিক দিয়ে গেল-কে জানে ? স্কুলে যাওয়ার সময় আজ পঞ্চাশ পয়সা খুঁজেছিল। বলেছিল, ‘আম্মা , আইজ আট আনা দেও।’ তিনি শুধু খেয়াপারাপারের জন্যে পঁচিশ পয়সা দিয়েছেন। তাও পাঁচ পয়সা বেশি। ভাবতেই তাঁর দুচোখ দিয়ে কয়েক ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল।
বাস্তবতাকে তিনি মেনে নিয়েছেন। স্থানে মান, স্থানচ্যুত হলে অসম্মান। তবুও মন মানে না। সময় আর কত হবে। প্রায় তিনযুগ। সে সময় তো সবকিছু এক ছিল।ভাবতে ভাবতে ভাবান্তরে গিয়ে আজিজুন্নেছা লস্কর শৈশবে ফিরে যান। ঘরের ডানদিকের দেয়ালে টিকটিকিটা টিক টিক করে ওঠে।তখন তিনি মক্তবের তৃতীয় শ্রেণির ছাত্রী। কেন্দ্র পরীক্ষা দিতে যাবেন বরাক পেরিয়ে তোপখানা এম.ই. স্কুলে। পরীক্ষায় যাওয়ার প্রাক্কালে বাবুজী বললেন, ‘যা,মা। আল্লার হাওলা। গাঙ্গ পার অইয়া দারে দারে যাইস্। আর বালা করিয়া পরীক্ষা দিস।’ তিনি ভালভাবে পরীক্ষা দিলেন। পাশ ও করলেন। দিননাথ নবকিশোর-স্বদেশি স্কুলে ভর্তিও হলেন। বছর চারেক পড়লেন।তারপর একদিন তাঁর সরকারি চাকুরিজীবী পাত্রের সঙ্গে বিয়ে হয়ে গেল।কিন্তু আজিজুন্নেছা লস্করের সুখ বেশিদিন স্থায়ী হলো না।দেশ ভাগের দামামা বেজে উঠল। শিলচর পাকিস্তানে যাচ্ছে-নিশ্চিত হয়ে স্বামী তাঁর পাকিস্তানে অপশন দিলেন।দেশভাগ হয়ে গেল।শিলচর পাকিস্তান হলো না। স্বামী টাইফয়েডে আক্রান্ত হয়ে শয্যাশায়ী হলেন। অপশন প্রত্যাহার করার সময় শেষ হয়ে এল। টাইফয়েড থেকে ভাল হয়ে উঠে স্বামী তাঁর কত চেষ্টা-চরিত্র করলেন। অপশন প্রত্যাহার করতে পারলেন না।আজিজুন্নেছা লস্কররা বৃন্তচ্যুত হলেন।প্রথম যখন আজিজুন্নেছা লস্কর স্বামীর সঙ্গে সিলেট আসবেন, বাবুজী আহাজারী গোপন করে বললেন, ‘যা, মা, ডরাইবার কুনতা নায়। আমি সিলট সরকারি আলিয়া মাদ্রাসার ফার্স্ট বেইচোর ছাত্র।
বরইকান্দিত লজিং থাকি পড়ছি। সাধুর বাজার খেয়াঘাট দি জুড়িন্দায় পার অইছি। যা, যা। হাবুইতা আমার চোউকো (চোখে) বাশের। চানি্ন গাটোর সিঁড়ি, আলি আমজাদোর গড়ি, জিতু মিয়ার বাড়ি।’মাইজী কাদঁতে কাদঁতে বিদায় দিয়ে বললেন, ‘যা তরে আল্লার আতো শফি দিলাম।’তারপর তো তাঁরা যাওয়া-আসাতে ছিলেন। প্রথম দিকে আসাম-বেঙ্গল রেলওয়ের কুলাউড়া-লাতু-মহিষাশন সেকশন হয়ে যেতেন। দেশ ভাগের তিন-চার বছর পর তাও বন্ধ হয়ে গেল। আর সতেরই সেপ্টেম্বরের যুদ্ধের পর সব কিছু বন্ধ হয়ে গেল।আজিজুন্নেছা লস্করের বাবুজী দুবছর আগে মারা গেলেন। সতেরই সেপ্টেম্বরের যুদ্ধের পর আর দেখা হয় নি। কত মুখ-কত স্বজনদের সঙ্গে আর দেখা হলো না।
আজিজুন্নেছা লস্কর আঁচল দিয়ে চোখ মুচলেন।মৃত্যুর আগে বাবুজীর হাতের লেখা একখানা চিঠি পেয়েছিলেন। করুণ সুরে সে চিঠিতে লেখা ছিল,’মারে, তোরে এক যুগেরও বেশি সময় ধরে দেখি নারে, মা। তোর মাইজীয়ে তোর লাগি কাঁদতে কাঁদতে চোখ নষ্ট করি লেইছে। জীবনের এই শেষ বেলায়, আমার আর দিবার কিছুই নাই। এই চিঠিটা আমার স্মৃতি হিসাবে রাখিস রে, মা।’আজিজুন্নেছা লস্কর চোখ মুচতেই থাকলেন।বছরখানেক হয় স্বামীও তাঁকে ফাঁকি দিয়ে পরপারে চলে গেছেন। জগত-সংসারে এখন আর তাঁর বলতে গেলে কেউ নেই। তিন-তিনটে ছেলে-মেয়ে নিয়ে অকুল সাগরে পড়েছেন। মেজো মেয়ে নওরোজ এখন আর কলেজে যায় না। জিজ্ঞেস করলে বলে, ‘আমারে নিয়া চিন্তা করিও না। আমি প্রাইভেটে ডিগ্রি পরীক্ষা দিমু। ডরোথি আর অভিরে নিয়া চিন্তা কর; বাবো।’ তিনি ভাবতেই থাকেন কিন্তু কিনারা পান না।’আজিজুন্নেছা লস্কর এবার বিলাপ করে কেঁদে উঠলেন। বিলাপ করতে করতে একপর্যায়ে তিনি জ্বলে উঠলেন। তাঁর সব জ্বলুনি গিয়ে পড়ল কংগ্রেস-মুসলিম লিগওয়ালাদের ওপর। তীব্র ঘৃণা নিয়ে তিনি স্বগতোক্তি করলেন, ‘হারামজাদা নেহেরু-প্যাটেল-জিন্না, তুমরার ক্ষমা নাই। দেশভাগ করি কুটি কুটি মানুষরে তুমরা বাস্তু থাকি উচ্ছেদ করছ। সারা উদ্বাস্তু অকলে ক্ষমা করি দিলেও আমি তুমরারে ক্ষমা করতাম নায়। আমি মরি গেলেও আমার পুয়ারে কইয়া যাইমু, বড় অইয়া ওউ তিন শয়তানোর সমাধিত গিয়া লাত্তাইস (লাথি দিস)।’বৃষ্টির বেগ বেড়েছে। আজিজুন্নেছা লস্কর ভিজে একাকার হয়ে গেছেন। সেদিকে তাঁর ভ্রুক্ষেপ নেই। নৌকাও মাঝ নদী পাড়ি দিয়ে ওপারে চলে গেছে, সেদিকেও খেয়াল নেই।আজিজুন্নেছা লস্কর বড় করে নিশ্বাস নিলেন।
অন্তরের অন্ত:স্থল থেকে উঠে আসা দীর্ঘনিশ্বাস।হায়রে জীবন ! মেয়ে মানুষের জীবন ! সারা জীবনে কত পরিবর্তন ! শৈশব-কৈশোরে বাবার হাওলায়, যৌবনে স্বামীর আর শেষ বয়সে ছেলের হাওলায়। মাঝখানে বিপদে পড়লে বিপদ সঙ্কুল পথ একাই পাড়ি দিতে হয়। কে-উ এগিয়ে আসে না।আজিজুন্নেছা লস্কর সবকিছু ঝেড়ে ফেলে দিয়ে বিপদসঙ্কুল পথ একাই পাড়ি দেয়ার জন্যে দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ হলেন। একা হাল ধরে তীরে যে তরী ভিড়াতেই হবে।নওরোজ ফিরে এসে ডাক দিতেই সম্বিত ফিরে পেয়েই দেখলেন, ওপারে ঘাটে নৌকা ভিড়েছে। মেয়েরা ডাঙ্গায় উঠছে। দৃঢ় সংঙ্কল্পবদ্ধ হলে তাঁর নৌকাও ঘাটে ভিড়বে। তিনিও ছেলে-মেয়ে নিয়ে ডাঙ্গায় উঠবেন।কিন্তু আজিজুন্নেছা লস্করের নৌকা ঘাটে ভিড়ল না। তিনি ছেলে-মেয়ে সঙ্গে নিয়ে ডাঙ্গায় উঠতে পারলেন না।অকস্মাৎ বুকের বামদিকের তীব্র ব্যথায় কুঁকড়ে ওঠে ঢলে পড়লেন। এবং শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করলেন।তাঁর শেষ ইচ্ছার কথা ছেলেকে ব্যক্ত করা হলো না।
গল্পের বিষয়:
গল্প