বনফুলের গল্পসমগ্র

বনফুলের গল্পসমগ্র

অজান্তে

সেদিন আপিসে মাইনে পেয়েছি।
বাড়ী ফেরবার পথে ভাবলাম ‘ওর’ জন্যে একটা ‘বডিস্‌’ কিনে নিয়ে যাই। বেচারী অনেক দিন থেকেই বলছে।
এ-দোকান সে-দোকান খুঁ’জে জামা কিনতে প্রায় সন্ধ্যা হয়ে গেল। জামাটি কিনে বেরিয়েছি–বৃষ্টিও আরম্ভ হল। কি করি–দাঁড়াতে হল। বৃষ্টিটা একটু ধরতে–জামাটি বগলে ক’রে–ছাতাটি মাথায় দিয়ে যাচ্ছি। বড় রাস্তাটুকু বেশ এলাম–তার পরই গলি, তা-ও অন্ধকার।
গলিতে ঢুকে অন্যমনস্ক হয়ে ভাবতে ভাবতে যাচ্ছি–অনেকদিন পরে জা নতুন জামা পেয়ে তার মনে কি আনন্দই না হবে! আজ আমি–
এমন সময় হঠাৎ একটা লোক ঘাড়ে এসে পড়ল। সেও পড়ে গেল, আমিও পড়ে গেলাম–জামাটি কাদায় মাখামাখি হয়ে গেল।
আমি উঠে দেখি–লোকটা তখনও ওঠেনি–ওঠ্‌বার উপক্রম করছে। রাগে আমার সর্বাঙ্গ জ্বলে গেল–মারলাম এক লাথি!

“রাস্তা দেখে চলতে পারো না শুয়ার!”
মারের চোটে সে আবার পড়ে গেল–কিন্তু কোন জবাব করলে না! তাতে আমার আরও রাগ হল–আরও মারতে লাগলাম।
গোলমাল শুনে পাশের বাড়ীর এক দুয়ার খুলে গেল। লণ্ঠন হাতে এক ভদ্রলোক বেরিয়ে এসে জিজ্ঞাসা করলেন–“ব্যাপার কি মশাই?”
“দেখুন দিকি মশাই–রাস্কেলটা আমার এত টাকার জামাটা মাটি করে দিলে। কাদায় মাখামাখি হয়ে গেছে একেবারে। পথ চলতে জানে না–ঘাড়ে এসে পড়ল–”
“কে–ও? ওঃ–থাক্‌ মশাই মাফ করুন, ওকে আর মারবেন না! ও বেচারা অন্ধ বোবা ভিখারী–এই গলিতেই থাকে–”
তার দিকে চেয়ে দেখি–মারের চোটে সে বেচারা কাঁপছে–গা’ময় কাদা। আর আমার দিকে কাতরমুখে অন্ধদৃষ্টি তুলে হাত দুটি জোড় করে আছে।

 

অমলা

অমলাকে আজ দেখতে আসবে। পাত্রের নাম অরুণ। নাম শুনেই অমলার বুকটিতে যেন অরুণ আভা ছড়িয়ে গেল। কল্পনায় সে কত ছবিই না আঁকলে। সুন্দর, সুশ্রী, যুবা–বলিষ্ঠা, মাথায় টেরি, গায়ে পাঞ্জাবি–সুন্দর সুপুরুষ।
অরুণের ভাই বরুণ তাকে দেখতে এল। সে তাকে আড়াল থেকে দেখে ভাব্‌লে–‘আমার ঠাকুরপো!’
মেয়ে দেখা হয়ে গেল। মেয়ে পছন্দ হয়েছে। একথা শুনে অমলার আর আনন্দের সীমা নেই। সে রাত্রে স্বপ্নই দেখলে!
বিয়ে কিন্তু হল না–দরে বন্‌ল না।

।।দুই।।

আবার কিছুদিন পরে অমলাকে দেখতে এল। এবার পাত্র স্বয়ং। নাম হেমচন্দ্র। এবারও অমলা লুকিয়ে আড়াল থেকে দেখলে, বেশ শান্ত সুন্দর চেহারা–ধপ্‌ধপে রঙ–কোঁকড়া চুল–সোনার চশমা–দিব্যি দেখতে।
আবার অমলার মন ধীরে ধীরে এই নবীন আগন্তকের দিকে এগিয়ে গেল।
ভাবলে–কত কি ভাবলে!
এবার দরে বন্‌ল, কিন্তু মেয়ে পছন্দ হল না।

।।তিন।।

অবশেষে মেয়েও পছন্দ হল–দরেও বন্‌ল–বিয়েও হল। পাত্র বিশ্বেশ্বর বাবু। মোটা কালো গোলগাল হৃষ্টপুষ্ট ভদ্রলোক–বি. এ. পাশ সদাগরি আপিসে চাক্‌রি করেন।
অমলার সঙ্গে যখন তাঁর শুভদৃষ্টি হল–তখন কি জানি কেমন একটা মায়ায অমলার সারা বুক ভরে গেল। এই শান্ত শিষ্ট নিরীহ স্বমী পেয়ে অমলা মুগ্ধ হ’ল।
অমলা সুখেই আছে।

 

আত্ম-পর

সারা সকালটা খেটেখুটে দুপুর বেলায় দক্ষিণ দিকের বারাণ্ডায় একটা বিছানা পেতে একটু শুয়েছি। তন্দ্রাটি যেই এসেছে–অমনি মুখের উপর খপ্‌ ক’রে কি একটা পড়ল। তাড়াতাড়ি উঠে দেখি একটা কদাকার কুৎসিত পাখীর ছানা। লোম নেই–ডানা নেই–কিম্ভূতকিমাকার! বাগে ও ঘৃণায় সেটাকে উঠোনে ছুঁড়ে ফেলে দিলাম।
কাছেই একটা বেড়াল যেন অপেক্ষা করছিল–টপ।। করে মুখে করে নিয়ে গেল। শালিক পাখীদের আর্তরব শোনা যেতে লাগল।
আমি এপাশ ওপাশ করে আবার ঘুমিয়ে পড়লাম।
তারপর চার পাঁচ বছর কেটে গেছে!
আমাদের বাড়ীতে হঠাৎ একদিন আমারই বড় আদরের একমাত্র ছেলে শচীন হঠাৎ সর্পঘাতে মারা গেল। ডাক্তার–কবরেজ–ওঝা–বদ্যি কেউ তাকে বাঁচাতে পারলে না। শচীন জন্মের মত আমাদের ছেড়ে চলে গেল।
বাড়ীতে কান্নার তুমুল হাহাকার।
ভিতরে আমার স্ত্রী মূর্ছিত অজ্ঞান। তাঁকে নিয়ে একজন লোক শশব্যস্ত হয়ে উঠেছে। বাইরে এসে দেখি দড়ির খাটিয়ার ওপর শুইয়ে বাছাকে নিয়ে যাবার আয়োজন হচ্ছে।
তখন বহুদিন পরে–কেন জানিনা–সেই পাখীর ছানাটার কথা মনে পড়ে গেল।
সেই চার পাঁচ বছর আগে নিস্তব্ধ দুপুরে বেড়ালের মুখে সেই অসহায় পাখীর ছানাটি, আর তার চারদিকে পক্ষীমাতাদের আর্ত হাহাকার।
হঠাৎ যেন একটা অজানা ইঙ্গিতে শিউরে উঠলাম।

 

একফোঁটা জল

রামগঞ্জের জমিদার শ্যামবাবু যে খেয়ালী লোক তা জানতাম। কিন্তু তাঁর খেয়াল যে এতদূর খাপছাড়া হতে পারে তা ভাবিনি। সেদিন সকালে উঠেই এক নিমন্ত্রণ পত্র পেলাম। শ্যামবাবু তাঁর মাতৃশ্রাদ্ধে সবান্ধবে নিমন্ত্রণ করেছেন। চিঠি পেয়ে আমার মনে কেমন যেন একটু খটকা লাগল। ভাবলাম–শ্যামবাবুর মায়ের অসুখ হল অথচ আমি একটা খবর পেলাম না! আমি হলাম এদিককার ডাক্তার।
যাই হোক নেমন্ত্রন্ন যখন করেছেন তখন যেতেই হবে। গেলাম। গিয়ে দেখি শ্যামবাবু গলায় কাচা নিয়ে সবাইকে অভ্যর্থনা করছেন। তাঁর মুখে একটা গভীর শোকের ছায়া। আমাকে দেখেই বল্লেন, “আসুন ডাক্তারবাবু–আসতে আজ্ঞা হোক্‌!”
দু’চার কথার পর জিজ্ঞাসা করলাম–“ও, আপনি শোনেননি বুঝি! আমার মা ত আমার ছেলেবেলাতেই মারা গেছেন–তাঁকে আমার মনেও নেই–ইনি আমার আর এক মা–সত্যিকারের মা ছিলেন।”
ভদ্রলোকের গলা কাঁপতে লাগল।
আমি বললাম–“কি রকম? কে তিনি?”
তিনি বললেন–“আমার মঙ্গলা গাই–আমার মা কবে ছেলেবেলায় মারা গেছেন মনে নেই–সেই থেকে ওই গাইটিই তো দুধ খাইয়ে আমাকে এত বড় করেছে। ওরি দুধে আমার দেহ মন পুষ্ট। আমার সেই মা আমায় এতদিন পরে ছেলে গেলেন ডাক্তারবাবু!”
এই বলে তিনি হু হু করে কেঁদে ফেল্লেন।
আমার বিস্ময়ের আর সীমা রইল না।

 

খেঁদি

তখন সবে সন্ধ্যা।–মালতী ঘরে এসে প্রদীপটা জ্বালতেই তার স্বামী বলে উঠল–“লতি…আমি একটা নাম ঠিক করেছি।”
“কি?”
“ওই যে তুমি বল্লে–‘কি’।”
“তার মানে?”
“ইংরিজি key মানে চাবি আর বাঙলা ‘কি’–একটা প্রশ্ন। মেয়ে মানুষের পক্ষে বেশ মানানসই নাম হবে।”
“এখন কোথায় কি তার ঠিক নেই–এখন থেকেই নামকরণ! আর আমার মেয়েই হবে তুমি জান্‌লে কি করে? ও জ্যোতিষীর কথায় আমার একটুও বিশ্বাস নেই।”
“না–না ঠিক মেয়ে হবে–দেখো তুমি। আমাদের শ্যামবাবু জাগ্রত জ্যোতিষী!”
“ধর যদি মেয়েই হয়–তা বলে ওই নাম রাখতে হবে? কত সব ভাল নাম আছে–”
“যথা–শরৎশশী, নিভাননী, ইন্দুবালা, প্রভা, প্রতিভা, সুধা, আশালতা–এই সব ত? সব বাজে–পুরানো, সেকেলে, এক ঘেয়ে! আমার মেয়ের নাম হবে একেবারে নতুন।”

মালতীর প্রসব হবার দুমাস পূর্বে তার স্বামী কলেরায় মারা গেল। প্রসব হতে গিয়ে মালতীও মারা গেল। জ্যোতিষীর কথা ফলেছিল–মালতীর মেয়েই হয়েছিল। সে এখন তার মামার বাড়ী সোনারপুরে মানুষ হচ্ছে। তাঁরা তার নাম রেখেছেন “খেঁদি!”

 

চোখ গেল

সাধারণের চোখে হয়ত সে সুশ্রী ছিল না।
আমিও তাহাকে যে খুব সুন্দরী মনে করিতাম তাহা নহে–কিন্তু তাহাকে ভালবাসিতাম। তাহার চোখ দুটিতে যে কি ছিল তাহা জানি না। তেমন স্বপ্নময় সুন্দর চোখ জীবনে কখনও দেখি নাই। দুষ্টু বলিয়াও তাহার অখ্যাতি ছিল।
সেই কুরূপা এবং চঞ্চলা মিনি আমার চিত্ত-হরণ করিয়াছিল! তাহার চোখ দেখিয়া আমি মুগ্ধ হইয়াছিলাম।
মনে আছে তাহাকে একদিন নিভৃতে আদর কইয়া বলিয়াছিলাম–“ইচ্ছে করে তোমার চোখ দুটো কেডে রাখি।”
“কেন?”
“ওই দুটোই ত আমাকে পাগল করেছে। আমি সব চেয়ে ওই দুটোকেই ভালবাসি।”
এত ভালবাসিতাম–কিন্তু তবু তাহাক পাই নাই।
অজ্ঞাত অপরিচিত আর একজন আসিয়া বাজনা বাজাইয়া সমারোহ করিয়া তাহাকে লইয়া চলিয়া গেল।
প্রাণে বড্ড বাজিল।
কিন্তু সে বেদনা হয়ত মুছিয়া যাইত যদি সঙ্গে সঙ্গে আর একটা মর্মান্তিক ঘটনা না ঘটিত।
মিনি যখন বাপের বাড়ী আসিল, দেখি, তাহার দুটি চক্ষুই অন্ধ। কারণ শোনা গেল যে চোখে গোলাপ জল দিতে গিয়া সে ভুলক্রমে আর একটা ঔষধ দিয়া ফেলিয়াছে।

আমার সঙ্গে আড়ালে একদিন দেখা হইয়াছিল।
বলিলাম–“অসাবধানতার জন্যে অমন দুটি চোখ গেল!”
সে উত্তর দিল–“কেন যে গেল তা যদি না বুঝতে পেরে থাক তাহলে না জানাই ভাল!”

 

পারুল প্রসঙ্গ

“ও কি তোমাদের মত উপায় ক’রে খাবে নাকি?”
“উপায় ক’রে না খাক–তা ব’লে মাছ দুধ চুরি ক’রে খাওয়াটা–”
“আমার ভাগের মাছ দুধ আমি ওকে খাওয়াব!”
“সে তো খাওয়াচ্ছই–তাছাড়াও যে চুরি করে। এরকম রোজ রোজ–”
“বাড়িয়ে বলা কেমন তোমার স্বভাব। রোজ রোজ খায়?”
“যাই হোক–আমি বেড়ালকে মাছ দুধ গেলাতে পারব না। পয়সা আমার এত সস্তা নয়।”
এই বলিয়া ক্রুদ্ধ বিনোদ সমীপবর্তিনী মেনি মার্জারীকে লক্ষ্য করিয়া চাটজুতা ছুঁড়িল। মেনি একটি ক্ষুদ্র লম্ফ দিয়া মারটা এড়াইয়া বাহিরে চলিয়া গেল। সঙ্গে সঙ্গে স্ত্রী পারুলবালাও চক্ষে আঁচল দিয়া উঠিয়া গেলেন। বিনোদ খানিকক্ষণ গুম্‌ হইয়া রহিল। কতক্ষণ আর এ-ভাবে থাকিবে? অবশেষে তাহাকেও উঠিতে হইল। সে আসিয়া দেখে পশ্চিম বারান্দায় মাদুর পাতিয়া অভিমানে পারুলবালা ভূমি-শয্যা লইয়াছেন।
বিনোদ জিনিসটা লঘু করিয়া দিবার প্রয়াসে একটু হাসিয়া বলিল–“কি করছ ছেলেমানুষী! আমি কি সত্যি সত্যি তোমার বেড়াল তাড়িয়ে দিচ্ছি!”
পারুল নিরুত্তর।
বিনোদ আবার কহিল–“চল চল–তোমার বেড়ালকে মাছ দুধই খাওয়ান যাক্‌।”
পারুল–“হ্যাঁ, সে তোমার কাছে মাছ দুধ খাওয়ার জন্যে ব’সে আছে কি না? তাড়াবেই যদি, এই অন্ধকার রাত্রে না তাড়ালে চলছিল না?”
“আচ্ছা, আমি খুঁজে আন্‌ছি তাকে–কোথায় আর যাবে?” বিনোদ লণ্ঠন হাতে বাহির হইয়া গেল।
এদিক ওদিক রাস্তা ঘাট জামগাছতলা প্রভৃতি চারদিক খুঁজিল, কিন্তু মেনির দেখা পাইল না। নিরাশ হইয়া অবশেষে ফিরিয়া আসিয়া দেখিল–পারুল ঠিক তেমনি ভাবেই শুইয়া আছে!–“কই দেখ্‌তে পেলাম না ত বাইরে। সে আসবে ঠিক। চল, ভাত খাইগে চল।”
“চল, তোমাকে ভাত দিই, আমার আর ক্ষিদে নেই।”
“Hunger strike করবে না কি!”
পারুল আসিয়া রান্নাঘরে যাহা দেখিল–তাহার সংক্ষিপ্ত পরিচয় এই :– কড়ায় একটুও দুধ নাই–ভাজা মাছগুলি অন্তর্হিত–ডালের বাটিটা উল্টান।
এই বিসদৃশ ব্যাপার দেখিয়া পারুল অপ্রস্তুত!
বিনোদ এ-সম্বন্ধে আর আলোচনা করা নিরাপদ নয় ভাবিয়া যাহা পাইল খাইতে বসিয়া গেল।
পারুলবালাও খাইলেন।
উভয়ে শুইতে গিয়া দেখে মেনি কুণ্ডলী পাকাইয়া আরাম করিয়া তাহাদের বিছানায়।

 

বাড়তি মাশুল

একেই বলে বিড়ম্বনা।
আমি একজন ডেলি প্যাসেঞ্জার। সেদিন সমস্ত দিন আপিসে কলম পিষে উর্ধ্বশ্বাসে হাওড়ায় এসে লোকাল ট্রেণের একখানি থার্ড ক্লাসে বসে হাঁপাচ্ছি–এমন সময় দেখি সামনের প্লাটফর্ম থেকে বোম্বে মেল ছাড়ছে আর তারই একটি কামরায় এমন একখানি মুখ আমার চোখে পড়ে গেল যাতে আমার সমস্ত বুক আশা আনন্দে দুলে উঠল।
বহুদিন আগে এমার এক ছেলে তারকেশ্বরে মেলা দেখতে গিয়ে ভীড়ে কোথায় হারিয়ে যায়–আর ফেরেনি। অনেক খোঁজ-খবর করেছিলাম, কিছুতেই কিছু হয়নি। ভগবানের ইচ্ছা বলে মনকে প্রবোধ দিয়েছিলাম। আজ হঠাৎ তারই মুখখানি–হ্যাঁ ঠিক সেই মুখটিই বম্বে মেলের একটা কামরায় দেখতে পেলাম।
আর কি থাকতে পারি?
তাড়াতাড়ি গিয়ে বম্বে মেলে উঠলাম। সঙ্গে সঙ্গে মেলও ছেড়ে দিলে। ট্রেণে উঠে আবার ভাল করে দেখলাম–হ্যাঁ ঠিক সেই–পাশে একটি বৃদ্ধও বসে আছেন।
ভয়ে ভয়ে রুদ্ধ নিশ্বাসে জিজ্ঞাসা করলাম, “এতদিন কোথায় ছিলি–আমাকে চিনতে পারিস?”
হা ঈশ্বর–সে উত্তর দিলে হিন্দীতে। “হামরা নাম পুঁছতে হেঁ? কেউ? হামারা নাম মহাদেও মিসর, ঘর ছাপরা জিলা।” সমস্ত মনটা যেন ভেঙ্গে গেল–মনে হল যেন দ্বিতীয়বার আমি পুত্রহারা হলাম।
বৃদ্ধটি বললে–“হামরা লেডকা হ্যায় বাবুজি, আপ কেয়া মাঙ্‌তে হেঁ!”
রুদ্ধকণ্ঠে বলিলাম–“কিছু না!”
বেচারী ছাপরাবাসী পিতাপুত্রকে বিস্মিত করে দু-ফোটা চোখের জলও আমার শুষ্ক শীর্ণ গালের উপর গড়িয়ে পড়ল।
বর্দ্ধমানে নামলাম।
আবার Excess fare বাড়তি মাশুল দিতে হল।

 

বেচারামবাবু

হরিশ মুদী সন্ধ্যাবেলা হিসাব বুঝাইয়া গেল যে গত মাসের পাওনা ২৭.৭০ পঃ হইয়াছে এবং তাহা অবিলম্বে দেওয়া দরকার। সদ্য-অফিস-প্রত্যাগত বেচারামবাবু বলিলেন–“আচ্ছা মাইনেটা পেলেই–!” অতঃপর কাপড়-চোপড় ছাড়িয়া বেচারামবাবু বাহুরের রোয়াকটিতে বসিয়া হাঁক দিলেন–“অরে চা আন্‌–।” চা আসিল। চা আসিবার সঙ্গে সঙ্গে পাড়ার হরিবাবু, নবীন রায়, বিধু ক্লার্ক প্রভৃতি চার পাঁচজন ভদ্রলোকও সমাগত হইলেন এবং সমবেত গল্প-গুজব সহযোগে চা-পান চলিতে লাগিল।
গল্প চলিতেছে। এমন সময় বেচারামবাবুর ছোট মেয়ে পুঁটি আসিয়া উপস্থিত–“বাবা, দুখানা চিঠি এসেছে আজ ডাকে। আনব?”
পুঁটির ছোট বোন টুনিও সঙ্গে সঙ্গে আসিয়াছিল। সে কহিল–“আমি আনব বাবা!” বেচারামবাবু মীমাংসা করিয়া দিলেন–“আচ্ছা দু’জনে দুটো আনো!”
শ্রীযুক্ত বেচারাম বক্‌সির পাঁচ কন্যা এবং দুই পুত্র।
পুঁটি ও টুনি দুজনে দু’খানি পত্র বহন করিয়া আনিল। প্রথম পত্রখানি বেচারামবাবুর প্রবাসী পুত্র বহরমপুর হইতে লিখিয়াছে–তাহার জলেজ ফি, হস্টেল চার্জ প্রভৃতি লইয়া এ মাসে ৫৫ টাকা চাই। দ্বিতীয় পত্রটি তাঁহার কন্যা শ্বশুরবাড়ী হইতে লিখিয়াছে যে গত বৎসর ভাল করিয়া পূজার তত্ত্ব করা হয় নাই বলিয়া তাহাকে অনেক খোঁটা সহ্য করিতে হইয়াছিল। এবার যেন পূজার তত্ত্বে কার্পণ্য করা না হয়, তাহা হইলে তাহার পক্ষে স্বশুরবাড়ীতে তিষ্ঠান দায় হইবে।
বেচারামবাবু চিন্তিত মুখে পত্র দুটি পকেটস্থ করিলেন।
…আবার গল্প চলিল। নবীন রায় একটা পান মুখে পুরিয়া কহিলেন–“তোমার মেজ মেয়ের বিয়ের কচ্ছ কি? বিয়ে না দিলে আর ভাল দেখাচ্ছে না!”
বেচারাম কহিলেন–“পাত্র একটা দেখ না!”
নবীন তদুত্তরে বলিলেন–“পাত্র একটি আছে, খাইও খুব বেশী নয়। ৫০১ টাকা নগদ–তেত্রিশ ভরি সোনা আর বরাভরণ। এমন কিছু বেশী নয় আজকালকার দিনে।”
থামিয়া বেচারাম উত্তর দিলেন–“তা বটে।”
ক্রমে সভা ভঙ্গ হইল। বেচারামবাবু অন্দরে গেলেন। ভিতরে গিয়া আহারে বসিতেই গৃহিণী হরিমতি কাছে আসিয়া বসিলেন এবং নানা কথার পর বলিলেন–“বিনোদের মুখে মাসীমা খবর পাঠিয়েছেন যে, কাল তিনি আসবেন। কিছু আলোচান আর একসের দুধের কথা বলে দিও তাহলে কাল থেকে। তিনি আফিং খান জান তো?”
শুইতে গিয়া দেখিলেন ছেলেমেয়েরা ঘুম ভাঙিয়া কাঁদিতেছে। বলিলেন–“কি হল এদের?”
স্ত্রী বলিলেন–“হবে না? শীত পড়ে গেছে–কারো গায়ে একটা জামা নেই। লেপটা ছিঁড়ে গেছে। সেই পাঁচ বছর আগে করান হয়েছিল। ছিঁড়বে না আর। তোমাকে ত বলে বলে হার মেনেছি। কি আর করব বল!”
বেচারাম এবার আর কিছু বলিলেন না! শুধু টেবিলের উপর আলোটার দিকে চাহিয়া রহিলেন। মোমবাতিটা পুড়িয়া পুড়িয়া প্রায় নিঃশেষ হইয়া আসিয়াছে।

 

সার্থকতা

আমার অতীত জীবনের দিকে চাহিয়া দেখি–আর আমার দুঃখ হয়! সে যেন একটা সুখ-স্বপ্ন ছিল! সেই আমার অতীত জীবনের স্মৃতি…আজ সত্যি সত্যিই স্মৃতিমাত্র। মাঝে মাঝে মনে হয় আমার সে জীবন গেল কোথায়? সেই শোভন, সুন্দর, মোহন জীবন।
…একদিন আমার রূপ ছিল–সৌরভ ছিল–মধু ছিল। আমার সেই সুষমার দিনে কত মধুলুব্ধ ভ্রমরই না আমার কানে কানে বন্দনার স্মৃতিগান তুলিয়াছে!…তাহারা আজ কোথায়?
…এই আকাশ বাতাস আলো একদিন কতই না ভালো লাগিয়াছে! একদিন ইহাদের লইয়া সত্যই আমি পাগল হইয়া থাকিতাম…আজ কোথায় গেল আমার সেই পাগলামি…সেই সহজ উন্মাদনা–ছন্দময়ী ভাললাগার নেশা! আজ কই তারা সব?
…আজ আমি পরিপক্ক–অভিজ্ঞ। আমার সেই অতীতের তরল অনুভূতি জমিয়া যনে কঠিন হইয়া গিয়াছে।
আমার আজ কেবলই মনে হইতেছে…আমার অতীত আর ফিরিবে না জানি–কিন্তু ভবিষ্যত? সে কেমন–কি জানি! আমার আনন্দময় অতীতকে হারাইয়া আজ এই যে পরিপক্ক অভিজ্ঞ হইয়া উঠিয়াছি–ইহার পরিণতি কি?–ইহার সার্থকতা কোথায়?
* * *
গাছের একটি পাকা ফল এইসব ভাবিতেছিল। হঠাৎ বাতাসের দোলায় মাটিতে পড়িয়া গেল।…একটি পাখী আসিয়া ঠোঁটে করিয়া ফলটি লইয়া একটি ডালে বসিল এবং পরম আনন্দে ঠোকরাইয়া খাইতে লাগিল!

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত