মানব শরীর বড়ো জটিল। আর তেমনি বিচিত্র আর অগণিত তার রোগ। ছয় সাত বছর ধরে ডাক্তারি পড়ে একজন ডাক্তার মাত্র তার তিরিশ-চল্লিশ শতাংশই জেনে উঠতে পারেন। আর তারপর সারা জীবন ধরে অভিজ্ঞতার আলোয় হয়তো আর কুড়ি-তিরিশ শতাংশ শেখেন। একজন্মে সব জেনে ফেলা প্রায় অসম্ভব। আর সব কিছু তো বিজ্ঞানই এখনও জানে না, ডাক্তার জানবে কেমন করে? এখন গুগুলের হাত ধরে চিকিৎসা বিজ্ঞান মানুষের হাতের মুঠোয়। সব রোগের চিকিৎসা সেখানে লেখা আছে। তবুও ডাক্তারের কী প্রয়োজন? প্রয়োজন শরীরে হাত দিয়ে পরীক্ষার, আর দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতার, যেটা ডক্টর গুগুল, মিস্টার ইন্টারনেট আর সর্বজ্ঞ নেটিজেনদের নেই। তাই বুকের বামদিকে ব্যথা ‘অ্যাসিডিটি’-র জন্য, নাকি হৃদযন্ত্রের ব্যথা, নাকি ফুসফুসের টিউমার থেকে হচ্ছে, কিম্বা বুকের মাংসপেশি বা হাড়ে বেদনা এটা গুগুল বা নেট বলে দিতে পারে না। পারে ডাক্তারের অভিজ্ঞতা লব্ধ জ্ঞান আর স্পর্শ। আর তাই আজও অসুখ বিসুখে মানুষ চিকিৎসকের কাছে ছোটে, গুগুলের কাছে নয়। আর তার অন্যথা ডেকে আনতে পারে ভয়ানক বিপদ। এই গল্প হাসি মজার ছলে জীবনের এই অনস্বীকার্য ধ্রুব সত্যকেই তুলে ধরেছে।
।। ১।।
মিলনবাবু ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে মিলিয়ন ডলারের স্বপ্ন দেখেন। বাস্তবে তাঁর মতো হাড়কেপ্পন মানুষের জুড়ি মেলা কঠিন। সরকারি অফিসে ভালো চাকরি করেন। কিন্তু, খরচের ব্যাপারে দশ পা দূরে। সাহায্যপ্রার্থীরা তাঁকে আড়ালে মক্ষীচুষ বলেন, পাড়ার ক্লাবের পূজা কমিটির ছেলেরা তাঁকে দেখলে আওয়াজ দেয়, কারণ গেল দুর্গা পূজায় যখন শেষ অবধি অনেক দরাদরির পর দশ টাকা চাঁদা দিতে রাজি হলেন, পাড়ার পরোপকারী বিশু উলটে ওনাকেই মিষ্টি খাবার টাকা ধরিয়ে এসেছিল, আর সেটা উনি ভালোবেসে নিয়েও নিয়েছিলেন। রবিবার বাজার করতে যান সবসময় বেলার দিকে। কারণ সে সময় কিছু পচা সবজি, বাতিল ফল আর মরা মাছ পড়ে থাকে। সেগুলো সস্তায় কেনার জন্যও যে পরিমাণ দরাদরি উনি করেন, তাতে বিরক্ত হয়ে শেষমেশ বিক্রেতা অনেক কমেই পরিত্যক্ত সামগ্রী ওনার হাতে তুলে দেন। তবে কেউ ওনার মেয়ে তুলির ফেসবুকের পোস্ট দেখে বিভ্রান্ত হবেন না যেন। আম কাঁঠালের মরশুমে হিমসাগরের ঝুড়ির পাশে দাঁড়িয়ে পোস্ট কিংবা ইলিশ বিক্রেতাকে দশ টাকা দিয়ে হাতে দেড় কিলোর ইলিশ ধরে সেলফি আর তাতে বারো হাজার লাইক, কিংবা মাল্টিপ্লেক্সের বাইরে “অ্যামাজন অভিযানের” পোস্টারের সামনে ছবি, এসবের পিছনে লুকিয়ে থাকা তুলির চোখের জল, বাবার বিরুদ্ধে জমে ওঠা ক্ষোভের মিথ্যে আস্ফালন অবশ্য কারও চোখে পড়ে না।
কিন্তু, মিলনবাবুর কার্পণ্য ধ্রুপদী মাত্রা পায় যখন তিনি বা পরিবারের কেউ অসুস্থ হয়ে পড়েন। পরিবার বলতে স্ত্রী, মেয়ে আর বৃদ্ধা মা। বিভিন্ন রোগ ও তার নিরাময়ের ব্যাপারে মিলনবাবুর রিসার্চ ওয়ার্ক এবং নিষ্ঠা ও অধ্যবসায় দেখলে যে কোনও প্রতিষ্ঠিত গবেষক ঈর্ষান্বিত হবেন। বেশ কিছুদিনের অক্লান্ত গবেষণা ও পরিশ্রমে অফিস কলিগ, আত্মীয়স্বজন, পাড়ার লোক, প্রতিবেশী এবং সর্বোপরি পাড়ার মেডিসিন শপের ছেলেটি, এঁদের সহায়তায় তিনি একটি ফাইল প্রস্তুত করেছেন। পরিবারের যে কোনও রকম অসুখে এই ফাইল একেবারে অব্যর্থ। অবশ্য উদাহরণ ব্যতীত বিষয়টা খোলসা হবে না। তুলি তখন আরেকটু ছোটো। ধুম জ্বর। ওর মা বার বার জলপট্টি করছেন, ওষুধ খাওয়াচ্ছেন। কিন্তু জ্বর কমার নাম নেই। শেষে পাড়ার শিশু বিশেষজ্ঞের কাছে নাম লিখিয়ে এলেন। যখন চেম্বারে যাবার জন্য তৈরি, মিলনবাবু আটকে দিলেন। তাঁর বহু গবেষণালব্ধ ফাইলটি প্রথমবারের মতো সেবার বেরিয়েছিল। পাড়ার মিলি কিছুদিন আগে জ্বরে পড়েছিল, তুলির খেলার সঙ্গী, তাকে ডাক্তার দেখে যে প্রেসকিপশান করেছিল তার জেরক্স কপি বেরোল। না, বন্ধুরা, মিলনবাবু জেরক্সে খরচ করেননি। মিলির বাবাই ওনার অনুরোধে জেরক্স করে দিয়েছিলেন ওনাকে। সেটাই মিলনবাবুর গবেষণার প্রথম সফল বাস্তব প্রয়োগ ছিল। এরপর আর ফিরে তাকাতে হয়নি তাঁকে, পরিবারের সবরকম অসুখবিসুখেই তাঁর গবেষণা একেবারে স্টেপ আউট করে ছক্কা হাঁকিয়েছে।
।। ২।।
দু-একটা সফল প্রয়োগের পরেই বাবার কুখ্যাতির ভারে ন্যুব্জ হয়ে থাকা তুলি হঠাৎ আবিষ্কার করে তাকে আর তার মাকে তার বন্ধুরা আর তাদের মায়েরা বেশ সম্ভ্রমের চোখে দেখছে। খেলার মাঠে সে যেমন বন্ধুদের কাছে কিপটের মেয়ে হিসেবে ব্রাত্য হয়ে থাকত, হঠাৎ করেই তার খাতির গেছে বেড়ে। ওকে আগে ব্যাট করতে দেওয়ার জন্য কাড়াকাড়ি পড়ে যাচ্ছে। যে ঝিমলি আম্পায়ারিং করার সময় খালি ওকে লেগ ষ্ট্যাম্পের অনেক বাইরের বলেও লেগ বিফোর দিয়ে আউট করে দিত, সে পরিস্কার উইকেটের পিছনের ক্যাচ ব্যাটে লাগেনি বলে মাথা নেড়ে দিচ্ছে, আর সকলে প্রতিবাদ না করে নির্দ্বিধায় সেটা মেনেও নিচ্ছে, এমনটা তুলির কাছে অভূতপূর্ব।
অফিস যাওয়ার আগে, সকালে পাড়ার শিবুর চায়ের দোকানে মিলনবাবু খানিক বসে থাকেন, সেটা শিবুর দোকানে রাখা খবরের কাগজটায় টুক করে একটু চোখ বুলিয়ে নেওয়ার জন্য। কোনোদিন যদি খুব ভিড় থাকে বা কাগজ বহু হাত ঘুরে আর ওনার কাছে এসে না পৌঁছায়, খুব একটা ক্ষতি হয় না ওনার। বেঞ্চে বসা লোকজনের আলোচনা থেকে ভারত সাউথ আফ্রিকার খেলার ফলাফল, কিম্বা শেয়ার মার্কেটের ধ্বস, ডিমানিটাইজেশান থেকে শতাব্দীর ডিরেইল হওয়া, আজ আর কালের ভাগ্যফল থেকে ভোটের সিট ভাগাভাগি সব খবরই বিনামূল্যে সংগ্রহ করে ফেলেন, অথচ খবরের কাগজের বা কেবলের পয়সা কিছুই গুনতে হয় না। যেটুকু খবর পেতে বাকি থাকে, সেটা অফিসে বসে, আর বাসে একটু চোখকান খোলা রাখলেই জোগাড় করে নেওয়া যায়। অফিস থেকে ফিরে মিলনবাবু গরমের দিনে একটু পার্কে বসেন। এতে কিছুটা হলেও সিলিং ফ্যানের বিল বাঁচানো যায়, যদিও ঘুমোনোর সময় ছাড়া উনি হাতপাখাই সাধারণতঃ ব্যবহার করেন – ভগবান হাত দিয়েছেন কীসের জন্য, তোমরাই বল? কিন্তু, ছেলে আর বৌ এত কুঁড়ে, ভগবানের দেওয়া হাতে জং ফেলে দিয়ে সর্বদা সিলিং ফ্যান চালিয়ে রাখবে। যাই হোক, উনি পার্কের বেঞ্চে এসে বসলেই সে বেঞ্চ থেকে লোকজন দ্রুত পাতলা হয়ে যায়। মিলনবাবু এসবে অভ্যস্ত হয়ে গেছেন, তাই তেমন মাইন্ড করেন না। কিন্তু, পাড়ার রমেশ যখন উঠে গেল না, তখনই উনি বরঞ্চ মাইন্ড করলেন, কারণ এমনটি আগে কখনও ঘটেনি। রমেশ যখন একেবারে পাশে সরে এল, তখন উনি রীতিমতো ঘামতে শুরু করলেন। আসলে, যাকে লোকে এড়িয়ে চলে, তার কাছাকাছি কেউ এলে তার ভয় হবারই কথা। রমেশের সম্বন্ধে বিশেষ কিছু জানেন না মিলনবাবু। শুনেছেন, সেলসম্যানের কাজ করে। তবে কি কোনও জিনিস বিক্রি করার ধান্দায় আছে ছেলেটি? এইসব সেলসম্যানরা খুব বলিয়ে কইয়ে হয়, আর এমনভাবে নিজের প্রোডাক্টের গুণকীর্তন করবে, আর একটা কিনলে দশটা ফ্রি গোছের প্রলোভনের ফাঁদে ফেলে দেবে যে ওনার মতো হারকেপ্পন মানুষও বিভ্রান্ত হয়ে কিনে ফেলতে পারেন। একবার বাসে আর একবার ট্রেনে এমনি ঠকে গেছিলেন
মিলনবাবু। ট্রেনে উঠেই হকার ছেলেটি বলেছিল, “আজ আপনাদের জন্য কোম্পানির তরফে বিশেষ অফার। আপনি যদি এই একটি নীল কালির পেন দশ টাকা দিয়ে কেনেন, তাহলে শুধুমাত্র আজকের জন্য কোম্পানি এর সঙ্গে আপনাকে আরও দুটো লাল কালির পেন দিচ্ছে সম্পূর্ণ বিনামূল্যে।” মিলনবাবু তখনও ফিরেও তাকাননি তাঁর দিকে। যত আজেবাজে জিনিস গছিয়ে দেবে। কিন্তু এরপর কান খাড়া হয়ে যায়, ছেলেটি যখন বলতে থাকে, “ভাবছেন এখানেই শেষ? এই তিনটি পেন নিলে, কোম্পানি আপনাকে কালো কালির আরও দুটো পেনও দিচ্ছে শুধুমাত্র সেই দশ, হ্যাঁ হ্যাঁ, মাত্র দশ টাকার বিনিময়ে।” মিলনবাবুর বুকটা তখন কেমন ধড়ফড় করছে, তবু সংবরণ করেছিলেন নিজেকে, কিন্তু আর পারলেন না, যখন ছেলেটি আরও বলতে লাগলো, “হ্যাঁ, হ্যাঁ শুধুমাত্র এই শিয়ালদা নৈহাটি লাইনে, একমাত্র এই হকার বন্ধুর কাছেই শুধু আপনি পাবেন এই অফার, এবং সেটাও কেবল আজকের দিনের জন্যে। আর হ্যাঁ, এই পাঁচটি পেনই নয়, যিনি দশ টাকা দিয়ে এই অফারটি সংগ্রহ করবেন, কোম্পানি তাঁকে আজ প্রচারের খাতিরে আরও দুটি সবুজ কালির পেন দেবেন বিনামূল্যে। তাহলে এই সাতটি পেন যিনি সংগ্রহ করতে বা হাতে নিয়ে পরখ করে দেখতে চান, তিনি একটু আওয়াজ দেবেন। দেখাশোনা একেবারেই ফ্রি, কেনাকাটা প্রত্যেকের নিজস্ব ব্যাপার।” এইবার মিলনবাবুর সংযমের সব বাঁধ ভেঙে পড়ল। বারবার পরখ করে কাগজে লিখে দেখে একসেট পেন নিলেন, আর নাচতে নাচতে বাড়ি ফিরলেন। সত্যি খুব লাভ হয়েছে আজ। তুলি অনেকদিন ধরেই পেনের কথা বলছিল, সে নাকি বন্ধুদের কাছ থেকে পেন চেয়েচিন্তে লিখছে, লজ্জায় নাকি তার মাথা কাটা যায় এতে। কে জানে বাপু, বন্ধু বন্ধুকে ধার দেবে না তো কী? তাও সামান্য তো একটা পেন, সে কি এমন হাতি ঘোড়া? আজকালকার ছেলেমেয়েদের মান সম্মান বোধগুলোও যেন কেমন ধারা। কই তাঁর তো এমন লজ্জা বাতিক নেই? এই তো সেদিন বাসে উঠেই দেখেন অফিস কলিগ, ওনার অনেক জুনিয়র সুশান্ত বসে, ওনাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে। উনি কখনও চেনা কাউকে দেখলে বাসে ট্রামে চেনা দেন না, পাছে টিকিট কাটতে হয় তাই। কিন্তু, ও একেবারে দরজার সামনাসামনি পড়ে গেল। বসে থেকে ইতস্ততঃ করছিলেন। দুটো ভাড়া কাটার চিন্তায় মুখ শুকিয়ে গেছিল। পারতপক্ষে এই জন্য ফাঁকা বাসেই উনি ওঠেন না। কী অবাক লাগছে বন্ধুরা? আরে তোমরা ভিড় বাস দেখলে বিরক্ত হও। কী বোকা তোমরা? ফাঁকা বাসের সমস্যাগুলো কিছুই জানো না যেন? বাস ফাঁকা থাকলে টিকিট কাটতেই হয়, আর যত ভিড় বাস মিলনবাবুর তত পোয়া বারো, টিকিট কাটার ঝামেলা নেই। ফাঁকা বাসে এইরকম চেনা বেরোলেই হল, আর ভিড়ে চেনা মুখও চোখে পড়ে না।
ও তোমরা ভাবছ মিলনবাবু এবার খুব ফাঁদে পড়েছেন, সুশান্তর টিকিট কাটতেই হল? আরে ছোঃ! ওনার নাম মিলন। কন্ডাকটার ওদের সিটের দিকে এগোতেই উনি মোবাইলে কথা বলতে শুরু করলেন মেয়ের সঙ্গে। সুশান্ত সেদিন একটু অবাক হয়েই দু’জনের টিকিট কেটে নিয়েছিল, কারণ পাশে বসেও মিলনবাবুর ফোনে রিং হবার শব্দ পাননি তাই। যাই হোক কথায় কথায় আসল কথা থেকে সরে গেছি। তুলি একটা পেন চেয়ে একেবারে সাত সাতটা পেন পেয়ে বেশ ব্যোমকেই গেছিল, বাবার টাকে একটা চুমুও দিয়ে দিয়েছিল।
কিন্তু, দু’দিন পরেই সেই পেনগুলো তুলি বাবার গায়ে ছুড়ে দিয়ে বলেছিল, “তুমি যখন একসঙ্গে সাতটা পেন এনে দিয়েছিলে তখনই আমার বোঝা উচিত ছিল! যে লোক রিফিলের কালি জমে গেলে চাটুতে গরম করে কাজ চালায় সে একসঙ্গে কিনা সাতটা পেন কিনেছে! একটু লিখলেই কালি আটকে যাচ্ছে, জোরে লিখলে খাতার পাতা ছিঁড়ে যাচ্ছে! এই পেন তুমি তোমার কাছেই রাখ। আমার ধার করেই চলে যাবে, আমার বন্ধুর বাবারা তোমার মতো নয়।” তুলি চলেই যাচ্ছিল, কী মনে করে আবার ফিরে এসে বাবার টাক থেকে আগের দিনের চুমুটা ঘষে ঘষে মুছে দিয়ে গেল। ভাব তো, এই হল আজকালকার ছেলেমেয়ে!! আরেকবার দশ টাকায় দশ প্যাকেট ধূপকাঠি বাসে কিনে এমনি ধারা ঠকে গেছিলেন। হকার ছেলেটি যে ধূপগুলো হাতে জ্বালিয়ে ঘুরছিল সেগুলোর সুমিষ্ট গন্ধ। জলের দরে অমন সুন্দর ধূপ পেয়ে একেবারে কুড়ি টাকার কিনে নিয়েছিলেন। বাড়ি এসে যখন হাসতে হাসতে গিন্নির হাতে দিয়েছিলেন, তাঁর তো ভিরমি খাবার জোগাড়। তবে দু’দিন পরেই রেগেমেগে এসে ধূপের বাক্সগুলো মুখে ছুঁড়ে দিয়ে বললেন, “এগুলো তুমিই রাখ, মশা তাড়াতে কাজে আসবে। আর যদি এর গন্ধে আর ধোঁয়ায় তুমি বিদেয় হও তো আমার হাড় জুড়ায়।” মিলনবাবু এরপরে যদি মনে মনে বলেন, “যার জন্য করি চুরি, সেই বলে চোর”, সেটা কি খুব দোষের বল? যাক গে, একদিন নিশ্চয় নিজের লোকেরা তাঁকে চিনতে পারবে, তবে পাড়ার লোক কিন্তু এর মধ্যেই এই গুণী মানুষটাকে বুঝতে শুরু করেছে। তার প্রথম আঁচটা তিনি পেলেন রমেশের কথায়। রমেশের এগিয়ে আসাতে যখন উনি ত্রস্ত, রমেশ
বলেন, “আমাকে একটা সাহায্য করবেন, তাহলে বড়ো উপকৃত হই।”
ঠিক ধরেছেন মিলনবাবু, নিশ্চিত কোনও প্রোডাক্ট গছাতে চায়।
“দেখুন ভাই, আমার কিছু লাগবে না।”
“না না, আমি কিছু বিক্রি করতে চাইছি না। কিছুদিন ধরে আমার খুব দ্রুত চুল উঠে যাচ্ছে, এর ওর শুনে নানারকমের তেল শ্যাম্পু লাগালাম, কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। এদিকে সেলসম্যানের কাজে চেহারাটাই একটা বড়ো সম্পদ। আমার ডাক্তার দেখানোর সামর্থ্য নেই। আমি পাড়ার অসীমের কাছে জানলাম, আপনাকে নাকি স্বপ্নে ধন্বন্তরি একটা খাতা দিয়ে গেছে, যাতে মানুষের সমস্ত রোগের নিরাময় রয়েছে। ওর কানে ব্যথা নাকি আপনি ভালো করে দিয়েছেন? আমার এই রোগের কি কিছু নেই কাকা, একটু দেখুন না?”
বোঝো কাণ্ড! মানুষের মুখে মুখে তিল থেকে কী ভাবে তাল হয় দেখ!! মিলনবাবুর দিনের পর দিনের অক্লান্ত গবেষণা, কিনা স্বপ্নে প্রাপ্ত ধন্বন্তরির খাতা হয়ে গেল? তবে, যাই হোক, মিলনবাবুর বেশ গর্ব হল নিজের উপর। আর এমন হলেই ওনার কথার বেগ আসতে শুরু করে, “বুঝলে সুশান্ত, ডাক্তার দেখানো একধরণের বাজে খরচা। ওরা কয়েকখানা ওষুধকেই বিভিন্ন অসুখে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে লেখে, আর কাঁড়ি কাঁড়ি ফিজ্ নেয়। একটু চোখ-কান খোলা রাখলে, আমরা নিজেরাই সব অসুখের নিরাময় করে ফেলতে পারি, ডাক্তারের দরকারই পড়বে না। আমি দেখছি, তোমার রোগের কী চিকিৎসা আছে।” শুধু সুশান্তই নয়, এরকমভাবে পাড়ার বহু মানুষেরই এখন অসুখবিসুখে ভরসা মিলনবাবু। কৃপণ হলেও, পাড়ার লোকের অসুখের চিকিৎসা কিন্তু মিলনবাবু বিনে পয়সাতেই করে দেন। আসলে এ এক অন্যরকম প্রাপ্তি। পাড়ার লোক তাঁদের পরিবারকে আর ছোটো চোখে দেখে না, আর সবচেয়ে বড়ো কথা, অসুখ ভালো হয়ে গেলে আলুটা, মুলোটা, জিনিসপত্র এসব ওনাকে উপহার দিয়ে যান। ডাক্তারের ফিজের পিছনে টাকা নষ্টের থেকে, আই প্যাড, আই ফোন কেনা, বড়ো রেস্তোরাঁয় খাওয়া, সপ্তাহান্তে কারণবারি সেবনে পয়সা ওড়ানো অনেকগুণ ভালো।
।। ৩।।
কিন্তু, মনুষ্য শরীর, বড়োই জটিল। আপাত নিরীহ রোগের যে কতরকমের জটিলতা সে আর কহতব্য নয়। ঘরে ঘরে আমরা প্রত্যেকেই একেকজন নেটিজেন, গুগুল শিক্ষিত ডাক্তার হওয়া সত্ত্বেও, মাঝে মাঝে ডাক্তার নামের এলিয়েনদের দরকার পড়ে সেটা মিলনবাবু হাড়ে হাড়ে টের পেলেন। শালার বৌভাত খেয়ে বাড়ি ফিরে শুয়েছেন। মেয়ে, স্ত্রী ঘুমিয়ে কাদা, শুরু হল অসহ্য পেট ব্যথা। সে পেটের ডানপাশে নিচের দিকে এমন অসহ্য যন্ত্রণা, যে কহতব্য নয়। কিছুক্ষণ এপাশ ওপাশ করে, শেষ অবধি তার ধন্বন্তরির ফাইল বেরোল। পেটব্যথার একটা প্রেসক্রিপশানে কয়েকটা অ্যান্টাসিডের নাম লেখা রয়েছে। বাড়িতেই তার মধ্যে দুটি আনা আছে। চটপট খেয়ে নিলেন। তারপর ঘণ্টাখানেক পার হয়ে গেল। ব্যথা উত্তরোত্তর বেড়েই চলেছে, কমার নামগন্ধ নেই। ঠাণ্ডা জলে ভিজিয়ে গামছা পেটের উপরে দিয়েও কোনও আরাম পেলেন না। এদিকে তাঁর নড়াচড়া, ওঠা-বসায় স্ত্রী রমলার ঘুম ছুটে গেছে। সব দেখেশুনে পাড়ার বড়ো নার্সিংহোমে ওনাকে নিয়ে যেতে চাইলেন রমলাদেবী। যন্ত্রণার চাপে একবার সেখানে যাওয়ার কথা মনেও হল, কিন্তু তারপরেই মিলনবাবু স্ত্রীকে বললেন, “ওরা সব ডাকাত, এ চিকিৎসার জন্য আমার রিসার্চ ফাইলই যথেষ্ট।” বললেন তো বটে, কিন্তু পেটব্যথা কমার নামগন্ধ নেই।
ভোর হতে না হতেই, লজ্জার মাথা খেয়ে ফোন করলেন অফিস কলিগ অমরকে। কদিন আগেই অমর পেট ব্যথায় নিদারুণ কষ্ট পেয়েছেন। কিন্তু ডাক্তারের ওষুধে একদিনের মধ্যে ফিট হয়ে অফিস জয়েন করেছিলেন। অগত্যা তাকেই ফোন করলেন ভোর সাড়ে পাঁচটায়…
“হ্যালো?” ঘুম চোখে অমর ফোন ধরেন।
“ভাই, কিছু মনে কোরো না, বড়ো বিপদে পড়ে তোমায় ফোন করছি। আসলে ভোররাত থেকে বড্ড পেট ব্যথা শুরু হয়েছে (মাঝরাত থেকে ব্যথার কথা বেমালুপ চেপে গেলেন)। এত ভোরে ডাক্তার কোথায় পাই (যেন ডাক্তার পেলেই ছুটে গিয়ে দেখিয়ে নিতেন!), তাই তোমায় বিরক্ত করছি। ক’দিন আগেই তোমার পেট ব্যথা হয়েছিল না, তখনকার ডাক্তারের ওষুধটা আমায় একটু বলবে?”
“হ্যাঁ, সে না হয় বলছি। কিন্তু, পেট ব্যথা তো কত কারণেই হতে পারে, তোমার আর আমার কারণ তো এক নাও হতে পারে? সেক্ষেত্রে তো তোমার ব্যথা কমবে না?”
“ভাই, এখনকার মতো তো চেষ্টা করি, তারপর যদি না কমে, তাহলে ডাক্তারখানা খুলতেই গিয়ে দেখিয়ে নেব।”
“আচ্ছা, সে না হয় হল। কিন্তু, এত ভোরে তো কোনও ওষুধের দোকান খোলা নেই? ওষুধটা তুমি কিনবে কী করে মিলনদা?”
“তাও তো বটে, কী করি বলো তো এখন?”
“আচ্ছা দাঁড়াও দাদা, আমার কাছে ওষুধ অনেকটাই রয়ে গেছে শিশিতে, দরকার পড়েনি। আমি প্রেসক্রিপশান আর শিশি নিয়ে যাচ্ছি।”
ভোরবেলা বহু কষ্টে অমরবাবু এসে ওষুধ আর প্রেসক্রিপশান রেখে গেলেন। প্রেসক্রিপশানে ওষুধটা দু’চামচ খাওয়ার কথা লেখা। কিন্তু, মিলনবাবুর মনে হল, ওনার যেরকম প্রচণ্ড পেট ব্যথা হচ্ছে, তাতে দু’চামচে কমার নয়। উনি সাধারণ ব্যথার প্রায় তিনগুন হিসাবে ছয় চামচ ওষুধ খেয়ে নিলেন। মিনিট পনেরো পরে একটু একটু যেন আরামও হল। নিশ্চিন্ত হয়ে গিয়ে এবার একটু শুয়ে পড়লেন।
কিন্তু, আধঘণ্টা কী পঁয়তাল্লিশ মিনিটের মধ্যে শুরু হল পেটে মোচড় দিয়ে পেট ব্যথা, আর তার কিছু সময়ের মধ্যেই ‘বড়ো বাইরে।’ ল্যাট্রিন থেকে ঘুরে আসার পনেরো মিনিটের মধ্যে আবার মোচড়, আবার ল্যাট্রিন যাত্রা, আবার বেডরুমে ফিরে আসতে না আসতেই আবার ফিরে যাওয়া। বাড়ির ট্যাঙ্কের জল ফুরিয়ে গেল ফ্লাশ করতে করতে, কিন্তু তিনি যেন ম্যাজিশিয়ান পি সি সরকার হয়ে উঠেছেন, তাঁর পেট নামক কমন্ডুলুর ‘ওয়াটার অফ ইন্ডিয়ার’ ‘ম্যাজিক ওয়াটার’ আর ফুরায় না। এদিকে শরীরের জল গেল শুকিয়ে, তায় সাতান্ন বার ল্যাট্রিন যাওয়া আসা করে জীবনের আশা মিলনবাবু প্রায় ছেড়েই দিলেন।
এবার অবশেষে রমলাদেবী মাঠে নামলেন, কারণ ততক্ষণে মিলনবাবু ‘রিটায়ার্ড হার্ট’ হয়ে প্যাভিলিয়নে খাবি খাচ্ছেন, আর কানের কাছে শুনতে পাচ্ছেন বহুদূর থেকে ভেসে আসা “বল হরি হরি বোল” ধ্বনি। রমলাদেবী যখন ডাক্তার ডাকতে বেরোচ্ছেন, তখনও মিলনবাবু ওনার শাড়ির আঁচল টেনে ধরেছিলেন, কিন্তু বাধা দেবেন, শরীরে সে শক্তিও তাঁর নেই তখন।
ডাক্তারবাবু এসে পেট টিপে টিপে, জিভ দেখে, প্রেশার, পালস দেখে পরীক্ষা করে বললেন, “করেছেন কী আপনারা! মানুষটাকে তো একেবারে মেরে ফেলেছেন! কী করে এমন হল?”
রমলাদেবী এগিয়ে দিলেন ওষুধের শিশিটা আর প্রেসক্রিপশান। সেটা দেখে ডাক্তারবাবুর টানা হেঁচকি ওঠা শুরু হল, যেটা থামল প্রায় আট গ্লাস জল খেয়ে। চোখ কপালে তুলে বললেন, “এটা তো একটা পারগেটিভ। অমরবাবুর টানা সাতদিন পটি হয়নি, তাই পেট ব্যথা হচ্ছিল। তাই এই ওষুধের দুই ডোজে পেট পরিষ্কার হয়ে গেছিল আর পেট ব্যথাও কমে গেছিল। কিন্তু মিলনবাবুকে পরীক্ষা করে আমি অনেকটাই নিশ্চিত যে ওনার পেট ব্যথার কারণ ডান কিডনিতে পাথর। সে ব্যথা পায়খানা হবার ওষুধে কমবে কী করে? উলটে অতিরিক্ত মাত্রায় ওই ওষুধ খেয়ে পায়খানা করতে করতে ওনার সিভিয়ার ডিহাইড্রেশান হয়ে গেছে। এখুনি নার্সিংহোমে ভর্তি করে স্যালাইন না চালালে ওনাকে বাঁচানো ভগবানেরও অসাধ্য। আমি লিখে দিচ্ছি, দ্রুত ওনাকে পাড়ার নার্সিংহোমে নিয়ে যান, আর ভবিষ্যতে জীবন নিয়ে এমন ছেলেখেলা দয়া করে আর করবেন না। জানবেন দশ টাকা বাঁচাতে গিয়ে দশ হাজার বেরিয়ে যাবে, এবং তাতেও জীবন ফিরবে কিনা তার গ্যারান্টি নেই।”
পরিশিষ্ট
অবশেষে পাড়ার লোকের সাহায্যে রমলাদেবী আর তুলি মিলে বাবাকে পাড়ার নার্সিংহোমে ভর্তি করল। মাত্র ‘সাত’ টাকার একটা ‘ভোভেরান’ ট্যাবলেট আর বেশি করে জল খেলেই অধিকাংশ ক্ষেত্রে যেখানে মিলনবাবুর ব্যথা কমে যেতে পারত, সেখানে ‘সাত হাজার’ টাকা খরচ করে তিনদিন পর মিলনবাবু মৃত্যুর মুখ থেকে এই যাত্রায় ফিরে এলেন। তবে যখন রমলাদেবী আর তুলি ডাক্তারদের আর ভগবানকে বারংবার ধন্যবাদ দিচ্ছেন মনে মনে, মিলনবাবু তখন চুপচাপ নিজের ঘরে বসে খরচের হিসাব করছেন আর মাথা চাপড়াচ্ছেন। হ্যাঁ, শেষ মুহূর্তেও যখন মেয়ে-বৌ নার্সিংহোমে নিয়ে যাচ্ছিল, ধন্বন্তরির ফাইলটা উনি একবার চেয়েছিলেন। কিন্তু ওরা কেউ শুনল না। হায়রে হায়রে হায়, এখন সেই ফাইল খুঁজে দেখছেন, অফিস কলিগ বিমলের হসপিটালের ডিসচার্জ সার্টিফিকেটটা, বারংবার পায়খানা হয়ে শরীরের জল শুকিয়ে গেলে তার চিকিৎসার পদ্ধতি স্পষ্ট লেখা আছে। ইশ তখন রমলা যদি একটিবার ফাইলটা এনে দিতেন, তাহলে ভর্তি হয়ে এতগুলো টাকা গচ্চা দিতে হত না, বাড়িতেই………। আসলে ‘থাকিলে ডোবা-খানা, হবে কচুরিপানা; বাঘে হরিণে খানা একসাথে খাবে না; স্বভাব তো কখনও যাবে না’ – তাই মিলনবাবুরাও বুঝি পালটাবেন না!!!