হস্তিনাপুর আদর্শ বিদ্যালয়ে সেদিন বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা ছিল। বিকেলবেলা অন্দরমহলে খুব হৈচৈ শুনে ধৃতরাষ্ট্র বললেন, “ওহে সঞ্জয়, কী হচ্ছে ওদিকে? একটু লাইভ আপডেট দাও শুনি!”
দিব্যদৃষ্টি পাওয়ার আগেও তো সঞ্জয়ের দিব্যি দৃষ্টি ছিল, তাই ধৃতরাষ্ট্র তাকে দিয়েই সিসিটিভি-র কাজ চালাতেন। সে ঝুঁকি নিয়ে উঁকি মেরে দেখে বলল, “মাতা কুন্তী এখন হাতা খুন্তি নিয়ে পোলাউ রাঁধছেন… তাঁর ছেলেরা সবাই পুরস্কার জিতেছে সেই আনন্দে!”
“পুরস্কার! কে কীসে জিতল!”
“জিতেছে ছোটা ভীম পুটিং দা শট-এ, আর অর্জুন, শুটিং দা পট-এ। এছাড়া যুধিষ্ঠির পেয়েছে বেস্ট স্টুডেন্ট এর পদক, নকুল পেয়েছে বেস্ট এক্টরের কাপ, আর সহদেব…”
“আচ্ছা হয়েছে হয়েছে, বুঝেছি। আর আমার একশো ছেলেদের কেউ কিছু জেতেনি?”
“ইয়ে…মানে, ওই আর কী…”
“বুঝেছি। তা মাতা কুন্তীর আনন্দ কি শুধু পাণ্ডবদের পুরস্কারের জন্য, নাকি কৌরবদের মুখে ঝামা ঘষে পুরো স্কার-এর জন্য? দুর্যোধন কী করছে?”
“আজ্ঞে, জেলের ইয়েতে কেলে হাঁড়ির মতো মামা শকুনির পিছনে ঘুরে বেড়াচ্ছে।”
“ওহ! সঞ্জয়, কতবার বলেছি, আমার সামনে আনপার্লামেন্টারি কোনও প্রবচন ব্যবহার করবে না! জানো, আমি দু’চক্ষে দেখতে পারি না! বলো পশ্চাৎ পট-এর মতো! কিন্তু শকুনি ওদের শিক্ষার কী ব্যবস্থা করেছে?”
“বলতে গেলে আবার আনপার্লামেন্টারি কিছু বলতে হবে মহারাজ!”
“আচ্ছা থাক তাহলে। ওই ভালচারটার এমনিতেই কোনও কালচার নেই। নেহাত গান্ধারীর ভাই, তাই তাড়াতেও পারি না… আচ্ছা ওটাকে ডাকো তো একবার, আর তুমি এখন যাও সঞ্জয়, পোলাউ খেয়ে এনজয় কর।”
খানিক বাদে ঢেঁকুর তুলতে তুলতে শকুনির প্রবেশ।
“আমায় স্মরণ করেছেন মহারাজ?”
“বিস্মরণের উপায় রেখেছেন কোনও! এই সিংহাসনের ভবিষ্যৎ নিয়ে আমি যতই চিন্তিত, আপনি মনে হচ্ছে ততই নিশ্চিন্ত! বলছি, যুবরাজ এখন কী শিক্ষা লাভ করছে?”
“চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে মহারাজ।”
“চেষ্টা করে তো এখনও ফল কিছু হল না!”
“মহারাজ, আপনি আমার কথা তো বিশ্বাস করেন না, ওই ধিনিকেষ্ট একটা বই লিখছে, আমি লুকিয়ে দেখেছি, তাতেই আছে, কর্ম করে যান, ফলের আশা করবেন না। আর তাছাড়া, এই চেস দিয়েই একদিন ওই পাণ্ডবদের বেশ করে কেস খাওয়াব, তাই যুবরাজকে বলেছি চেস-টা চালিয়ে যেতে!”
নাম বলতে না বলতেই “জানু, মেরি জান..” গাইতে গাইতে দুর্যোধনের প্রবেশ। শকুনি শুনেই আঁতকে উঠে বললেন, “এই গানটা নয়! খবরদার এই গানটা গাইবে না ভাগনে! তাহলেই সব রহস্য ফাঁস হয়ে যাবে!”
দুর্যোধন কাঁধ ঝাকিয়ে “ওক্কে” বলে মহারাজকে বলল, “বাবা, আমার ইয়ারের একটা ব্যবস্থা করে দাও তো! পান্ডবগুলো ওকে সুতসুতো, ছুঁচসুতো এইসব বলে খ্যাপায়!”
শকুনি বিব্রত হলেন, “এ কী যুবরাজ, এ কী ভাষা মহারাজের সামনে! ইয়ার দোস্ত এইসব শিখলে কোথায়!”
“কেন! আমি ইংরিজিতে বলেছি তো! ইয়ার মানে কর্ণ!”
ধৃতরাষ্ট্র হা-হা করে হেসে বললেন, “অসাম শা_ মানে, ইয়ে, সম্বন্ধী!! দেখেছেন আমার দুজু-র কত বুদ্ধি! বাবা দুজু, কোনও চিন্তা নেই, আমি দৃষ্টিহীন, তাই কর্ণের মূল্য জানি। এ শুধু একটা অঙ্গ-ই নয়, শ্রেষ্ঠ অঙ্গ, অঙ্গরাজ! যাও, আমি ওকে অঙ্গরাজ্যের রাজা ঘোষণা করলাম!”
দুর্যোধন “ইয়ো ড্যাড!” বলে দৌড়ে চলে গেল খবরটা সকলকে দিতে। ধৃতরাষ্ট্র তখন শকুনিকে বললেন, “এত বুদ্ধিমান হয়েও আমার সন্তানেরা কেন কোনও পুরস্কার জেতে না, বলতে পারেন?”
শকুনি অল্প হেসে বললেন, “জানতাম, আপনি আমাকে এই প্রশ্ন-ই করবেন। কিন্তু মহারাজ, ওরা পুরস্কার জিতবে কী করে, যদি ওদের বিদ্যালয়ে প্রতিযোগিতা-ই না হয়!”
“তার মানে! আমার পুত্রেরা কি অন্য বিদ্যালয়ে পড়ে নাকি!”
“অবশ্যই মহারাজ! কারণ আপনিই বলেছিলেন যেন ওদের পাণ্ডববর্জিত কোথাও পড়তে পাঠানো হয়! তাই এমনই এক বিদ্যালয়ে ওদের পাঠানো হচ্ছে, যে…”
“নাহ, আপনাকে দিয়ে কিছু হবে না। আপনি এখন যান, নইলে আমি মেজাজ হারিয়ে আপনাকে কিছু বলে ফেলব, মিডিয়া আবার সেটাকে হাইলাইট করে আমার বিরোধীদের হাতে তুলে দেবে। এর বিহিত আমিই করছি!”
রাতে শকুনি আর দুর্যোধন অনেকক্ষণ শলাপরামর্শ করলেন।
“এইভাবে তো চলছে না মামা, কিছু করুন!”
“করতে তো হবে-ই! আচ্ছা, একটা স্বতঃ-বিশ্লেষণ করা যাক। পাণ্ডবদের স্ট্রেংথ কী?”
“ওই ব্যাটা.. সরি, ছোটা ভীম। ওটার জন্যেই বাকিগুলোর এত বাড় বেড়েছে।”
“হুম। আর ভীমের উইকনেস?”
“খাবার। ঠিক করে বলতে গেলে, লাড্ডু।”
“অপারচুনিটি?”
“লাড্ডু খেতে বললেই আসবে, যে কোনও সময়। তাতে একটু ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে দিলেই…।”
“এই তো, ধরতে পেরেছ! কিন্তু কোনও থ্রেট?”
“আর কেউ যেন টের না পায়… আর ব্যাটা যেন সহজে জেগে না ওঠে। বাকি দায়িত্ব আমার। ওকে একেবারে পিতামহ ভীষ্মের বাড়ি পাঠিয়ে দেব।”
“তার মানে? গঙ্গাবক্ষে? হা-হা-হা! বাঃ ভাগনে, আমার নাম রাখবে তুমি!!”
পরদিন সকালে ছোটা ভীমকে ডেকে পাঠালেন শকুনি।
“কী হে ছোটা ভীম, তোমার নামডাক শুনছি তো খুব! তা খাবে নাকি স্পেশাল লাড্ডু?”
লাড্ডুর নাম শুনে তো ছোটা ভীমের হুঁশ থাকে না! আনন্দে টপাটপ কয়েকটা খেয়ে নেওয়ার পর তার সত্যি-ই হুঁশ রইল না। যেই না ঢুলে পড়া, অমনি দুর্যোধন আর তার ভাইয়েরা “বড্ডো ভারী, কাঁধে তোল” “বড্ডো ভারী, কাঁধে তোল!” বলতে বলতে ছোটা ভীমকে পাশের নদীতে গিয়ে ঝপাস করে ফেলে দিয়ে এল!
এদিকে ছোটা ভীম বেশ স্বপ্ন দেখছিল যেন তার সামনে কেউ বিশাল বিশাল রাজভোগ রেখেছে… হাত দিতে গিয়ে পিছলে সে রাজভোগের রসের ভিতর পড়ে ডুবে যাচ্ছে… তারপর সত্যি-ই ভিজে ভিজে স্পর্শে চোখ খুলে সে দেখল জলের তলায় পড়ে আছে! প্রথম যে চিন্তাটা তার মাথায় এল, সেটা হল শকুনিমামা সব কিছুতেই এত জল মেশায় কেন! লাড্ডুতেও জল!! তারপর খেয়াল হল, তাকে এখান থেকে বেরোতে হবে। কী করা যায় ভাবতে ভাবতে সামনে দেখল কয়েকটা সাপ এসে হাজির। তাদের একটা নেতা মতো ছিল, সে বলল, “কীরে মানুষের বাচ্চা, এখনও বেঁচে আছিস! এবার আমরা কামড়ালে একেবারে এখুনি ফু-স-স-স হয়ে যাবি!”
ভীমের পুরো ঘুম ভাঙেনি তখন, সে বলল, “ফু-স-স-স-স মানে?”
হিসহিসিয়ে হেসে সাপের নেতা বলল, “আবার কী, হাওয়া!”
শুনে ভীম এমন হাসল, নদীতে ঘূর্ণি উঠে গেল।
“জানিস আমি কে? স্বয়ং পবনপুত্র ভীম! হাওয়া আমার বাবার নাম রে! দেখছিস না, এতক্ষণ জলের তলায় থেকেও দিব্যি বেঁচে আছি! বরং আগে বল তোরা কারা?”
সাপের নেতা একটু ঘাবড়ে গেলেও, গলা কাঁপিয়ে বলল, “আমরা বিষী নাগ!”
“ধুসসস! তোদের এক ভাই কেসি নাগ আমার দাদার খুব প্রিয়। আমি অবশ্য কেসি দাসকেই বেশি পছন্দ করি! যাই হোক, তোরা হোয়াটসাপ না টুইটার, এ নিয়ে আমার কোনও চিন্তা নেই। আগে বল আমি এখান থেকে বেরোব কী করে, নয়তো বড়দা হনুমানকে ডাকব!”
হনুমানের নাম শুনে সাপগুলো বেশ ভয় পেল। একজন বলল, “স্যার, আর ঘাঁটিয়ে লাভ নেই, আমি একটা সিনেমা দেখেছিলাম, স্নেক ইন দ্য মাঙ্কিস শ্যাডো, তাতে সাপগুলোকে…”
“বুঝেছি বুঝেছি! আচ্ছা বরং নাগরাজের কাছেই নিয়ে যাই!”
তাই যাওয়া হল। ভীমকে দেখেশুনে তো নাগরাজ হেব্বি ইম্প্রেসড!
“দেখুন মিঃ সিভি, মানে, ছোটা ভীম আর কী, আপনাকে দেখে আর কথাবার্তা শুনে আমার খুব পছন্দ হয়েছে। আমার একটা মেয়ে আছে, তার নামের শুরুতেই উলুধ্বনি আছে তবু তার বিয়ে হচ্ছে না। তুমি কি তাকে বিয়ে করতে চাও?”
“মহারাজ, বিয়ে মানে আমার কাছে পেটভরে মন্ডা মিঠাই খাওয়া। কিন্তু শুনেছি বিয়ে যে করে, তাকে সারাদিন না খেয়ে থাকতে হয়। সে আমি পারব না। বরং আমার এক ভাই আছে, আপনি তাকে অফারটা দিন। সে রাজি হলে আমারও অনেকদিন পর একটু ভালোমন্দ খাওয়া জোটে!”
নাগরাজ চিন্তায় পড়লেন, বললেন, “আচ্ছা, কিছুদিন ভেবে দেখি!”
এদিকে বিয়েবাড়ির ভোজের কথা মনে আসতেই ভীমের আবার খিদে পেয়ে গেল! গরম গরম লুচি! নারকেল দেওয়া ছোলার ডাল! ধোঁকার ডালনা।.. আহাআ.. ভাবতে ভাবতে এমন দীর্ঘশ্বাস বেরোল, সে বেশ কিছুটা ওপরে উঠে এল। সাপগুলো তাকে ধরতে এলেই সে উলটে সাপগুলোকে ধরে বেয়ে বেয়ে আরও উঠতে লাগল! নেতা চেঁচিয়ে বলল, “এটা কিন্তু চিটিং হচ্ছে! সাপলুডোতে সাপ ধরে নামতে হয়, তুই উঠছিস কেন?”
“ওরে, আমি কৃষ্ণসখা অর্জুনের দাদা, আমাকে তুই চিটিং শেখাবি!! ওঠার কোনও সিঁড়ি রেখেছিস তোরা? তাই তোদের ধরেই উঠব। উলটো সাপলুডো এটা।” বলতে বলতে ভেসে উঠল জলের ওপরে, আর একটু এগিয়েই পৌঁছে গেল নদীর তীরে!
পরদিন ব্রেকফাস্ট টেবিলে যুধিষ্ঠির রোলকল করতে গিয়ে দেখল ভীম অনুপস্থিত।
নকুল বলল, “গতরাত থেকেই ভীমের বিছানা খালি ছিল।”
“সত্যি বলছিস তো নকলে?”
“দাদা, আমি সত্যবাদী যুধিষ্ঠির না হতে পারি, কিন্তু সবসময় মিথ্যেও বলি না!”
ঝগড়া থামাতে মাতা কুন্তী বললেন, “আরে তোরা চিন্তা করিস না! ভীম কখনও খাওয়ার কথা ভুলে যেতেই পারে না! ও ঠিক আসবে, দেখিস!”
অর্জুন বলল, “মা, এইভাবে নয়, সেই পাঞ্চ ডায়লগটার মতো করে বলো প্লীজ!”
একটু গলাটা খাঁকরে নিয়ে কুন্তী বললেন, “মেরা বেটা আয়েগা… মেরা ছোটা ভীম আয়েগা.. জমিন কি ছাতি ফাড়কে আয়েগা.. আসমান কে সীনা চিরকে আয়েগা।”
বলতে বলতে ভিজে একসা হয়ে ছোটা ভীমের প্রবেশ। সহদেব দেখেই বলল, “এ কী দাদা, আজ তো তোমার স্নানের দিন ছিল না!”
“সে তো ছিলই না! কিন্তু কী করি, লাড্ডু খেয়ে এমন ঘুমোলাম, ঘুম ভাঙ্গল জলের তলায়!”
“জলের তলায়!! তারপর তারপর?”
“তারপর দেখি এত এত সাপ! দেখেই মনে পড়ে গেল সাপলুডো খেলার কথা।”
“সাপলুডো!!”
“হ্যাঁ, তবে উলটো, মানে এক একটা সাপ ধরে উঠতে আরম্ভ করলাম।”
“কী সাংঘাতিক!”
“সে তো বটেই! এদিকে আমার সাংঘাতিক খিদেও পেয়েছে! কি মা কী রেঁধেছ দাও!”
“সে তো হল, কিন্তু এই কথাটা তো আমাদের পিতামহ ভীষ্মকে জানাতে হবে!” যুধিষ্ঠির বলল। মাতা কুন্তী একটু চিন্তা করে বললেন, “না, দরকার নেই, শুনলেই উনি দুর্যোধনকে ডেকে পাঠাবেন, আর কুরুক্ষেত্র বেঁধে যাবে।”
“সে তো একদিন না একদিন বাঁধবে-ই মা!!”
“সে তখন দেখা যাবে, আয় এখন সবাই খেতে বোস, স্কুলের দেরি হয়ে যাচ্ছে, সে খেয়াল আছে?”
ছোটা ভীম ভিজে পোশাকেই মহা আনন্দে খেতে বসে পড়ল। আর যুধিষ্ঠির ভাবতে লাগল, সাপলুডোয় সাপ দিয়ে যদি ওঠা হয়, সিঁড়ি দিয়ে নামতে হয়.. সেইরকম পাশা খেলায় কোনও নিয়ম বদলে যদি একবারও শকুনিমামাকে হারানো যেত!